কুলবাগানের পরী

কুলবাগানের পরী

গোনা গুনতি দুটো কুলগাছ। জায়গার নাম অথচ কুলবাগান।

চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে সাহানাবাবু বলল, ”নামে কী আসে যায়, মাস্টার। আমার নাম সূর্য সাহানা। লোকে বলে সুজ্যু সাহানা। আমি আকাশের না সূর্য, না চাঁদ। কুলবাগানের সুজ্যি মুদি।”

আমি বললাম, ”না না তা নয়। ভাবছিলাম, একসময়ে হয়ত এখানে অনেক কুল ঝোপ ছিল।”

”ভাবলেই কী হয় মাস্টার! নাম হল, মন্দোদরী। মন্দোদরীর উদর যদি মন্দ হবে, তবে বলুন হে, ইন্দ্রজিতের মতন বেটা জন্মাবে ক্যানে?” বলে সাহানা যেন আমাকে নিয়ে তামাশা করার মতন করে হেসে উঠল! তারপর বলল, ”এখানে তো তবু দুটো কুলগাছ চোখে পাচ্ছেন।”

সাহানার কথাবার্তা ওই রকম। তার অনেক কথাই আমি ধরতে পারি না। ভাষায় নিজেদের দিকের মিলমিশ, টানটোন। আমাকে শহুরে পেয়ে কথাগুলোকে যতটা পারে সহজ করে বলে। শহুরে ভাষা।

”নিন, চা খান।”

সাহানার দোকানের চায়ের গ্লাস কালিপড়া লন্ঠনের কাচের মতন দেখতে। চায়ের কষে কালো, না রঙটাই ওই রকম বোঝা যায় না। গ্লাসগুলোকে বোতল বললেও বলা যায়, এমনই বিঘতখানেক লম্বা।

সন্ধেবেলায় সাহানার কাছে এসে বসলে সে চায়ের গ্লাস, বিড়ির বাণ্ডিল এগিয়ে দেয় আমাকে। খাতির দেখায়, গল্পগুজব করে।

এখন অবশ্য সাহানার দোকান বন্ধ। বেচাকেনার পালা ফুরিয়েছে। সামনের দিকের ঝাঁপ ফেলা। আলকাতরা মাখানো টিনের ঝাঁপ। এ-পাশে দোকানঘরের বাঁ দিকে তেরপল গোছের কাপড়ের মোটা পরদা পড়ে আছে। তার পাশে এক ফালি জায়গায় বেঞ্চির মতন সরু এক তক্তপোশে আমরা বসে। পাঁচ সাত পা পেছনে দরজা। ওপারে সাহানার অন্দরমহল।

ধীরে সুস্থে চায়ে চুমুক দিলাম। ক’দিন আগে আগুনের মতন গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে জিব পুড়ে গিয়েছিল।

বাইরের দিকে তাকালাম। অন্ধকার। কাঁচা রাস্তার ওপারে এক জোড়া কুলঝোপ। পাতাটাতা চোখে পড়ে না তেমন, অন্ধকার জড়িয়ে কালো হয়ে আছে। কাছাকাছি এক ডুমুরগাছ। কিছু বুনো ঝোপ-ঝাড়। হিমেভেজা মাটি গাছপালার ফিকে গন্ধ উঠতে শুরু করেছে। কার্তিক শেষ। বাইরে হিম, কুয়াশা। শীত-ছোঁয়ানো বাতাস।

হঠাৎ আমার কালকের কথা মনে পড়ল। বললাম, ”কাল রাত্তিরে এদিকে চেঁচামেচি শুনলাম। হয়েছিল কী?”

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহানা যেন একটু খেয়াল করল। বলল, ”পরী-মরির ঝগড়া। ওদের গলা চড়লে ও-গাঁয়েও শোনা যায়। আপনি তো কাছেই থাকেন।”

পরী-মরি কথাটা কানে শুনতে আমার ভুল হল। আমি শুনলাম পড়ি মড়ি ঝগড়া। না বুঝে বললাম, ”পড়িমড়ি ঝগড়া মানে জোর ঝগড়া?”

সাহানাবাবু হেসে উঠল। তার হাসির ধরনটা খোলামেলা, মজা পাওয়া ঢঙের, কিন্তু নাটুকে। বলল, ”না হে মাস্টার। পরী আর মরি। পরী জানেন না? পাখা-লাগানো মেয়েছেলে। নীল পরী, লাল পরী। ফেয়ারি। আমি ইংরিজি পড়েছি মাস্টার। অষ্টম শ্রেণী। ক্লাস এইট। তারপর ফচকে ছোঁড়া হয়ে ভেগে পড়লাম। শশী হাজরার দলের সাথে ঘুরতাম। চা পান তেল জুতো বয়েছি বাবুদের, আবার শালা দু-চার লাইনের পার্টও গেয়েছি আসরে দাঁড়িয়ে।” হাসতে হাসতে সাহানার গলা ধরে যাচ্ছিল। হাসি থামিয়ে কাশল বার কয়েক। গ্লাস উঠিয়ে চুমুক দিল চায়ে।

নিজেই আবার বলল, ”পরী! বুঝেছেন মাস্টার?”

”বুঝেছি!” আমি হাসলাম।

”কী বুঝেছেন?”

”পরী বলে একটা মেয়ে…”

”দেখেছেন পরীকে?”

”ক’জন মেয়েকে তো দেখি। কে পরী কেমন করে বলব?”

যেন আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে চাইল সাহানা। হাসি হাসি মুখে চেয়ে থাকল কয়েক পলক। বলল, ”দেখেচেন। নাম জানেন না। একটা মেয়েকে দেখেননি? লম্বা, রোগা। হাড় হাড় চেহারা। গায়ের রঙ…..রঙ ওই আপনার সাদা সিমের মতন। চোখা নাক। পাতা কেটে চুল বাঁধে। পরীকে পেছন থেকে দেখলে মাস্টার মেয়েছেলে মনে হবে না।” সাহানা বিড়ির বাণ্ডিল আলগা করে একটা বিড়ি বেছে নিল।

বর্ণনা শুনে মনে হল মেয়েটিকে আমি দেখেছি। গায়ের পাশে না হলেও কাছাকাছি থাকে। টিনের চালা দেওয়া বাড়ি, সামনে এক ভাঙা টিউবওয়েল, কলকে ফুলের ঝোপ, পচা বাঁশের বেড়া—সেই বাড়ির কাছেই না দেখেছি!

”ওই টিনের চালার বাড়ি?” আমি বললাম চা খেতে খেতে।

”ধরেছেন ঠিক। পেছনে বঁইচি-বন।”

”দেখলে খুবই রোগা মনে হয়। রঙ ফরসা।”

”ওকে ফরসা বলে না, মাস্টার। ওই যে সাদা রঙ গায়ের—সাদা সিমের মতন—ওটা হল গর্ভের দোষ। শুনি জন্মকাল থেকেই ওই। আমি তো ওর জন্ম দেখিনি। কোন বাপের মেয়ে, কোন মায়ের গর্ভ থেকে এসেছে তাও জানি না। পরীর বয়েস কত—আন্দাজ করতে পারেন?”

”না, আঠারো বিশ হবে।”

সাহানা আবার হেসে উঠল। এমন করে হাসল যেন আমার জ্ঞানের বহর দেখছিল। হাসতে হাসতে বিড়ি ধরাল। বলল, ”শুকনো মেয়েছেলের বয়েস আর বাঁজা বউয়ের মুচ্ছো বোঝা যায় না হে মাস্টার। পরীর বয়স কমপক্ষে পঁচিশ।”

আমি কিছু বললাম না। হতে পারে পরীর বয়েস পঁচিশ। আমার এ-ব্যাপারে কোনো চোখ নেই। চা খেতে খেতে বিড়ি ধরালাম। ”পরী তো হল, মরি কে?”

”ওর বোন।”

”বোন!”

”যমজ বোন। পরী আগে মরি পরে। শুনেছি আধ এক ঘণ্টার আগে পরে। পরী আগে, মরি পরে।”

 সাহানার বিড়ি আসে রানিগঞ্জ বাজার থেকে। একটু বেশি কড়া। গলায় লাগছিল। বললাম, ”মরি নাম কেন? পরীর সঙ্গে মিল রাখতে?”

মাথা নেড়ে সাহানা বলল, ”না মাস্টার। ঠিক কথা তো জানি না; তবে শুনেছি পরী জন্মানোর পর মরি নাকি মরতে মরতে জন্মেছিল। জন্মানোর পরও এই-যায় সেই-যায়। ভুগিয়েছিল ওদের মাকে বেশ কয়েক মাস, সেই থেকেই ‘মরি’।”

”ও!”

”দেখেছেন মরিকে? পরীর উলটো। পুরো নয়, আট দশ আনা। মরি ফরসা নয়, ময়লা। ও রোগা কাঠি, এ হল ছিপছিপে। এখন খানিক গায়ে ধরেছে। মুখের ছাঁদ পরীর মতন নয়, তবে থুতনির দিকে মিল আছে। ঘাড় পিঠও একরকম। তবে মরির আগায় পাছায় মাংস আছে।” বলে সাহানা চোখ ছোট করে হাসতে লাগল।

মরিকেও তাহলে আমি দেখেছি। একই বাড়ির কাছে।

একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছিল। যমজরা একই রকমের দেখতে হয় শুনেছি। দেখেছিও দু এক জনকে। এরা—পরী আর মরি দেখতে খানিকটা দু রকম হল কেন?

”যমজ দু রকম হয়?” আমি বললাম।

সাহানা চায়ের গ্লাস শেষ করে এনেছিল। বলল, ”হয়। না হলে দেখছি কেন? যমজ আমি দেখেছি মাস্টার। এক ছেলে এক মেয়ে হয়ে এল—চোখে দেখেছি। আর-এক যমজ দেখেছি—আমাদের পঞ্চু চট্টরাজের দলে ছিল, তারা দুটোই ছেলে, কিন্তু দুটোই দেখতে একে অন্যের চেয়ে আলাদা। আমাদের দলে তাদের নাম ছিল বাঁয়া তবলা। একটা ছিল লম্বু, আর একটা বাঁটু। তবু বাঁয়া তবলা নামটাই বেশি চলত।”

চা শেষ করে আমি বললাম, ”ওদের সঙ্গে থাকে কে?” কথাটা এই জন্যে বললাম যে, পরী মরির বাড়ির দিকে আমি কোনো পুরুষমানুষ বা বয়স্কা মেয়ে দেখিনি।

গলায় কেমন কৌতুকের শব্দ করে সাহানা বলল, ”সঙ্গে কেউ থাকে না, ওরা দুটিতে থাকে। কেন হে মাস্টার?”

সাহানার মজার তলায় একটা মামুলি রসিকতা ছিল। আমি কিছু বললাম না। হাসলাম একটু।

সাহানা পুরো গ্লাস চা খেয়ে ঢেঁকুর তুলল। বিড়ি ফুরিয়েছিল আগেই। চুপ করেই থাকল সামান্য। হাত কয়েক তফাতে একটা লম্ভ জ্বলছে। তার কাচ প্রায় খয়েরি, শিস লেগে একপাশ কালচে।

সাহানার অন্দরমহল থেকে সাড়াশব্দ বিশেষ পাওয়া যাচ্ছে না। ওই মহল আমার সামান্য চেনা। দিন দুই পাত পেড়ে খেয়েছি। সাহানা নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে।

অন্দরমহলে থাকে সাহানার স্ত্রী। আর দোকানে কাজ করা দুটি লোক। একটির সামান্য বয়েস হয়েছে, অন্যটি ছেলেছোকরা। ছেলেটি নাকি সাহানাবাবুর স্ত্রীর বাপের বাড়ির দেশের লোক। দোকানের কাজ, ঘরের কাজ দুইই করে সে। নাম গোপাল। আর সামান্য বয়স্ক লোকটির নাম তুলসীচরণ। তুলসীর কাজ দোকানে। লোকটি জিরজিরে ধরনের। গলায় কণ্ঠি। কানদুটো ছোট ছোট।

সাহানাবাবুর স্ত্রীকে আমি দেখেছি। গায়েগতরে যথেষ্ট। পটুয়াদের আঁকা ছবির মতন গোলগাল। মুখখানি গোল। হাত-পা ফোলা-ফোলা। সাহানাগিন্নিকে ভালমানুষ ভালমানুষ দেখায়। চোখ দুটি বড়। নাকে নাকছাবি। হাতে শাঁখা। গলায় রুপোর হার। নামটিও বেশ, তারামণি।

সাহানাবাবুর অন্দরমহল বলতে এই। তারপর সাফসুফ। বাচ্চা-কাচ্চা নেই।

শীত শীত বাতাস আসছিল। কুলঝোপের তলায় যেন জোনাকি উড়ল কয়েকটা। আজ কুয়াশা বেশি।

সাহানা আবার একটা বিড়ি ধরাল। বলল ”তোমার এখানে কতদিন হল মাস্টার?” বলেই যেন জিব কাটল। ”অপরাধ হয়ে গেল মাস্টার। তুমি বলে ফেললাম।”

আমি হেসে বললাম, ”অপরাধের কী! বয়েসে আপনি বড়।”

সাহানা এই প্রথম আমাকে ‘তুমি বলল না, মাঝে মাঝে বলে ফেলে। বলেই হেসে ওঠে। আমি সাহানাকে বলেছি, আপনি আমায় ‘তুমি’ বলবেন। বলতে চায় হয়ত, সঙ্কোচে পারে না। মনে হয় আর কিছুদিন পরে পারবে।

”কত দিন হল?” সাহানা আবার বলল।

”হপ্তা তিন।”

”তিন হপ্তায় পরীকে, পরী-মরিকে চেনা হল না?” সাহানার চোখে কৌতুক।

”না,” আমি মাথা নাড়ালাম। ”আমার আর কতটা দৌড়। হয় নিজের ডেরায় না হয় আপনার কাছে।”

ঘাড় হেলিয়ে সাহানা বলল, ”তা ঠিক।”

এখানে আমার সপ্তাহ তিন হল। এর আগে ছিলাম গঙ্গাপুর পোস্ট অফিসে। সেটা ছিল মাঝারি ডাকঘর। মাথার ওপর বড় পোস্টমাস্টারবাবু ছিলেন। আমি ছিলাম মানিঅর্ডার আর রেজিস্ট্রি চিঠিতে। বদলি হয়ে এখানে এসেছি হঠাৎ। এখানকার ডাকঘর ছোট, সাব পোস্ট অফিস। পুরোপুরি তাও হয়ত নয়। নতুন হয়েছে। যিনি ছিলেন এখানে তিনি অসুখে মরমর হওয়ায় ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।

আমার ডেরা আর ডাকঘর একই সঙ্গে। টিনের চালা দেওয়া এক বাড়ি। তার বাইরের খানিকটা অংশ অফিস। ভেতরের দিকটা আমার থাকার জায়গা। ছোট ডাকঘর, কাজকর্ম সামান্য। ফণী পিয়ন এখানকার লোক। থাকে এই গ্রামেই। ফণী আমার গার্জেনের মতন। লোকটা বেশি কথা বলে, কিন্তু ভাল লোক।

ফণীর দৌলতে অনাদি বলে একটা ছোঁড়াকে পাওয়া গেছে। সে আমার ঘরদোর দেখা থেকে রান্নাবান্নার ব্যবস্থাটা সামলায়। পয়সাকড়ি মারে কিন্তু চালিয়ে দেয় সংসার। অনাদি সকালে আসে, সন্ধের আগে চলে য়ায়। বেটা সর্বক্ষণ আমার রেডিয়োটা বাজায়। ব্যাটারির শ্রাদ্ধ করে।

সাহানা বলল, ”পরী মরির গল্প একদিন শোনাব মাস্টার। তার আগে একবার চোখে দেখে নিন।”

আমি হেসে বললাম, ”চোখে না দেখলে গল্প শোনা যাবে না?”

”তা যাবে। কিন্তু পোক্ত হবে না।” বলে সাহানা মুখ ঘুরিয়ে কান পেতে যেন অন্দরমহলের সাড়াশব্দ আঁচ করার চেষ্টা করল। ক’মুহূর্ত পরে মুখ ফিরিয়ে বলল, ”আমার পরিবারটি ক’দিন বড় লরম হয়ে আছে গো?” বলে চোখ টিপে সাহানা হেসে উঠল। ঠাট্টা তামাশার সময় সাহানার ভাষা আর বলার ঢঙ পালটে য়ায়।

আমি হেসে বললাম, ”সে তো ভাল কথা! দিদি নরম থাকলেই আপনার ভাল।”

”আহা! কথাটা বুঝলেন না মাস্টার। এ-লরম সে-লরম লয়।” বলে সাহানা মুখচোখের ভাবে বুঝিয়ে দিল তার পরিবারের এখন বিরাগের পর্ব চলছে। বলল, ”মুখে উনি চুপ হয়ে আছেন, ভেতরে গরম গো?”

”কেন?”

”অমন হয়! মেয়েছেলের স্বভাব। উপরে বালির বাঁধ, নিচে ছুঁড়ি তিন হাত…।”

আমি জোরে হেসে উঠলাম। ”দিদি এখন ছুঁড়ি নয়!”

”এখন নয়, তখন ছিল।” বলে সাহানা একটু চুপ করে গেল, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল অল্পক্ষণ। মুখ সামান্য মোলায়েম হয়ে গেল, মেটে আলোয় মনে হল, সাহানার গাল যেন আরও তামাটে হয়ে গেছে। ভাঙা গলায় বলল, ”মাস্টার, ও যখন ছুঁড়ি ছিল তখন আমি আসরে গাইতাম। নটবর। পালাও লিখতাম। সুজ্যি মুদি হইনি। পালা শুনে মন মজেছিল তারামণির। নল দময়ন্তী পালা! আহা, নলরাজার কী বচন গো!” সাহানার কথা শেষ হল না, অন্দরমহলের দরজা খুলে গোপাল এল।

সাহানা যেন বুঝতেই পেরেছিল, বলল, ”কোথায় পড়েছে? রসুইঘরে? না ভেতরে?”

”ঘরে।”

”চল, যাই।” বলে সাহানা উঠে দাঁড়াল, ”বসুন মাস্টার, তারামণি নয়ন মুদেছেন, খুলে আসি।”

সাহানা চলে গেল।

আমি বসে থাকলাম। তারামণি, মানে সাহানাবাবুর স্ত্রীর মূর্ছা হয়েছে। শুনেছি, মাঝে মাঝেই হয়। দু-চার দিন অন্তরও হয়—আবার বিশ পঁচিশ দিন তফাতেও হয়। ব্যাপারটা একরকম স্বাভাবিক ও অভ্যাসের মধ্যে এসে গেছে। এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ বোধ করে না কেউ আর।

অন্যমনস্কভাবে বিড়ি ধরিয়ে বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। কুয়াশা আজ যেন বড় বেশি। হিম কী গাছপাতা বাতাস ভিজিয়ে দিল এরই মধ্যে? হতে পারে। আজ সকালে আমার বাড়ির বাইরের সরু কাঁচা উঠোন বৃষ্টি হয়ে যাবার মতন ভিজে ছিল। শীত পড়ে গেল এখানে। কাল থেকে এ-ভাবে আর বেরুনো যাবে না সন্ধেবেলায়, চাদর নিয়ে বেরুতে হবে। আজ চাদর নিইনি, ভেতরে একটা মোটা সুতির গেঞ্জি পরে বেরিয়েছি।

মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম। দরজার পাট ভেজানো। সাহানা মূর্ছা ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ত।

সাহানাবাবু মানুষটিকে আমার বড় পছন্দ হয়েছে। মুদি বলতে যা বোঝায় সাহানা তেমন নয়। তেল ডাল নুন নিয়ে বসে থাকলেও নুনে জরেনি। মেজাজ আছে। একেবারে জোয়ান না হলেও সাহানাবাবুর বয়েস বেশিও নয়। বছর চল্লিশ। হাড়-শক্ত চেহারা। গায়ের রঙ তামাটে। মুখের ছাঁদ চৌকোনো, থুতনি সরু। চোখ দুটি লালচে ধরনের। মুখের একটা পাশের খানিকটা জায়গা কালচে।

মানুষটির জীবনকথা আমার কিছু শোনা হয়ে গেছে। কোন এক মুষলে গাঁয়ের ছেলে। জমি-জিরেত ছিল বাপের। খাওয়া পরার অভাব ঘটেনি কোনোদিন। ছেলেবেলায় দেড় ক্রোশ দূরের মণ্ডলবাবার বড় স্কুলে পড়েছে। মা মারা যাবার পর বাপ আর একটা বিয়ে করে। সেই নতুন মা নাকি ডাকিনী যোগিনীকেও হার মানায় এমন গলা আর স্বভাব। সাহানা তখন থেকেই ফচকে ফাজিল হয়ে ঘুরে বেড়াত যত্রতত্র। তাড়ি বিড়ির অভ্যেস করে ফেলল চোদ্দ পনেরোতেই। শেষে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাত্রার দলে ঢুকে পড়ল।

এ কলকাতার যাত্রা নয়। এখনকার যাত্রাও নয়। মফস্বলের গেঁয়ো যাত্রা। ছোট ছোট মফস্বল শহর আর গ্রামে এমন যাত্রা অনেক ছিল ওদিকে। এক শশী হাজরার দলে বছর দুই কাটিয়ে সূর্য সাহানা লায়েক হয়ে গেল। তারপর এখানে ওখানে। ‘মাস্টার আমি তিন লম্বর সাজ বনে গেলুম। দুলু বিশ্বাস আমাকে চড় চাপড় লাথি মেরে মেরে অ্যাক্টর করে তুলল। শালা গুরু আমার করত কী জানেন, গুরু নিজে এক চামচে গাওয়া ঘি খেত, গোলমরিচ আর আদাকুচি দিয়ে, খেয়ে আমাকে বলত—চাট শুয়োরের বাচ্চা—গলা সাফ হবে।’ সাহানার এই সব গল্প শুনতে শুনতে আমি হেসে মরেছি।

বিশ ঘাটের জল খাচ্ছে যখন সাহানা—তখন সহদেব ঘোষ বলে এক অধিকারী, উখড়োর লোক, সাহানাকে দিয়ে এক পালা লেখাল। সহদেব মুখে পালা বলত, সাহানা লিখত, আবার সাহানা নিজেও তার বিদ্যে জাহির করত। সহদেব ছিল বি এ কবিরত্ন আরও কী!—তবে সজ্জন, সুশীল। নিরামিষ খেত, বিড়ি মদ ছুঁত না, ভাড়া করা মেয়েছেলেদের বলত, মা বোন।

সহদেব ঘোষের দৌলতে সাহানা দু-তিনটে পালা লিখে ফেলল। দুটো পালা লেগে গেল। তার মধ্যে সর্পযজ্ঞ পালা এমন জমে গেল যে গাঁয়ে গাঁয়ে শুধু ‘সর্পযজ্ঞ’ পালাই গাইতে হয়েছে।

সাহানার শেষ পালা নল-দয়মন্তী উপাখ্যান নিয়ে লেখা। তখন আর সহদেব কবিরত্ন বেঁচে নেই। মফস্বলের গ্রাম্য যাত্রা আর তেমন কাটছে না। কলকাতার দল গ্রামে সেঁদিয়ে যাচ্ছে। সাহানা যাত্রা ছেড়ে দিল। তারামণিকে ভাগিয়ে ঘুরল এখান ওখান। তীর্থ দেখাল। খাটলো, খুটলো। শেষে এই জায়গায় এসে ছোট্ট এক দোকান খুলে বসল। সেই দোকানই আজ সুজ্যি মুদির দোকান।

সাহানা বলে, ”এখনও মাঝে-মধ্যে মনে হয়, একটা পালা লিখি মাস্টার। কিন্তু কী হবে গো লিখে? সুজ্যি মুদির মুদিখানাই ভাল। পালা লিখে কোন কাজে আসবে!”

পরের বিদ্যে বোঝার মতন বিদ্বান আমি নই। পোস্ট অফিসের সামান্য কেরানি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি, সাহানার মণ্ডলবাবার স্কুলের বিদ্যে যাই হোক সে অনেক কিছু জানে। রামায়ণ মহাভারত থেকে হুট হাট উপাখ্যান বলে, তুলনা দেয়, আমার বিদ্যে পরখ করার জন্যে বেয়াড়া প্রশ্ন শুধোয়, কবিতা করে কিছু আওড়ায় কখনো কখনো, আমাকে নিয়ে মজা করে। মানুষটা যে সত্যি সত্যি সুজ্যি মুদি তার বেশি কিছু নয় তা আমার মনে হয় না। বরং উলটটাই মনে হয়। ও যেন দায়ে পড়ে আজ সুজ্যি মুদি।

সাহানা ফিরে এল। যেমনভাবে গিয়েছিল সেইভাবেই। মুখে উদ্বেগ দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই। ফিরে এসে একটা বিড়ি টেনে নিয়ে ধরাল।

আমি বললাম, ”দিদির ফিট কেটেছে?”

”হ্যাঁ, কেটে গেছে।”

”আমার এক পিসির ফিট হত। দাঁত লেগে যেত, কষ গড়াত মুখের পাশ দিয়ে। হাত পা বেঁকে যেত। ফিট কাটার পর দুর্বল হয়ে পড়ত।”

সাহানা হেসে বলল, ”এর এসব কিছু হয় না। চোখ মুদে ধড় ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। হাত মুঠো। পাঁচ সাত মিনিট ওইভাবে পড়ে থাকে। তারপর মুর্ছো কাটলে যে কে সেই। গতরের গুণ গো মাস্টার।” বলে জোরে হেসে উঠল।

আমি বললাম, ‘এর কোনো ওষুধ নেই, না?”

”ডাক্তার কোবরেজরা বলে নেই। তবে আমি একটা ওষুধ জানি। বেশিক্ষণ পড়ে থাকলে নাকে গুঁজে দি। বড় ভাল ওষুধ মাস্টার। আমাদের নারায়ণ গড়াই, দুর্গা অপেরায় বেয়ালা বাজাত, তার কাছে শিখেছিলাম। গোলমরিচের গুঁড়ো কর্পূরের গুঁড়ো মিশিয়ে নস্যির মতন করে রেখে দিয়েছি। নাকে শুঁকিয়ে এক রত্তি গুঁজে দি। উনি চক্ষু মেলে উঠে পড়েন।” সাহানা হাসছিল।

একটু বসে থেকে আমি বললাম, ”উঠি তাহলে!”

”আসুন। ঠাণ্ডা পড়ছে। কাল থেকে চাদর নেবেন।”

উঠে পড়লাম। বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললাম, ”দিদিকে বলবেন, আমি বাড়িতে হোমিওপ্যাথি শিখি। আমি ওঁকে ওষুধ দেব।”

সাহানা যেন মজা পেল। নাটুকে হাসি হেসে বলল, ”মন চাইলে দেবেন। তবে কি মাস্টার, সব রোগের ওষুধ হয় না।”

দুই

কার্তিক ফুরিয়েছিল কবেই, অগ্রহায়ণও ফুরিয়ে গেল। শীত পড়ে গিয়েছে। বিকেল মরার আগেই শনশনে হাওয়া বয়, সাঁঝ-সন্ধে থেকে কাঁপিয়ে শীত ধরে। এই দিকটা এই রকমই। আধ জঙ্গলা গাছপালায় ভরা, শক্ত মাটি, রুক্ষু রুক্ষু রঙ। এখানে যেন নিম কাঁঠালের শেষ নেই, আম জাম কম, আর পলাশ বন। কাঁটা গোলাপের ঝোপঝাড়, সর্বত্র বনতুলসীর জঙ্গল। অল্প-স্বল্প বঁইচি বন। ওরই এখানে ওখানে ধানের ক্ষেত, এক আধটা ডোবা পুকুর। তফাতে দু একটা ছোট কয়লা কুঠি। নদী রয়েছে দু ক্রোশ দূরে।

শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিম যেন সারা রাত মিহি বৃষ্টির মতন নিঃশব্দে ঝরে যায়, সকালে মাঠঘাট গাছপালা শুকনো থাকে না। মেঠো ইঁদুরগুলো পর্যন্ত হিমভেজা মাঠ দিয়ে ভাল করে ছুটতে পারে না যেন। আমার তাই মনে হয় অজস্র পাখি এসে গিয়েছে শীতের মরসুমে।

নতুন শীতে ঠাণ্ডা লেগে আমার জ্বর হয়েছিল। সন্ধেবেলায় বেরুতে পারিনি। সাহানার কাছে যাওয়া হয়নি কয়েকদিন। গত পরশু সাহানা এসেছিল। ছিল অনেকক্ষণ। বলল, ”তোমার দিদি বলেছে জ্বরজ্বালা বেশি হলে আমাদের ওখানে গিয়ে থাকতে। মাথায় জলপটি দেবে, সাবু বার্লির পথ্য দেবে এগিয়ে। যাবে নাকি মাস্টার?”

সাহানা এখন আমাকে আর আপনি বলে না, তুমিই বলে। মাঝে মাঝে আবার রসিকতা করে শালাবাবু বলে ডাকে।

জ্বর আমার সামান্য বেশিই হয়েছিল; এখন কম। গা-ছোঁয়া। সর্দি-কাশিতে গলা ভেঙ্গে আছে এখনও। দু-চার দিনের মধ্যে সেরে যাবে।

আজ শীতটা আরও বেশি লাগছিল। কাল পাতলা মেঘ ছিল আকাশে, মেঘলা নয়, ঘোলাটে হয়েছিল সারা দিন। আজ মেঘ কেটে গেছে। শীত বেড়েছে।

সন্ধেবেলায় নিজের ঘরে শুয়ে পাতা-ছেঁড়া একটা বই পড়ছিলাম। লণ্ঠনটা মাথার কাছাকাছি। এমন সময় বাইরে শেকল নড়ে উঠল দরজার।

উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি সাহানা। হাতে পুঁটলির মতন কী যেন।

ভেতরে এসে সাহানা বলল, ”তোমার দিদি প্রসাদ পাঠিয়েছে, মাস্টার। আজ বৃহস্পতিবার।”

তারামণি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো করে। কলা, বাতাসা, বেসনের নাড়ু, মাঝে মাঝে শশার কুচি। প্রসাদটা ও-বাড়িতেই খাওয়া হয়। আজ এ বাড়িতে পাঠিয়েছে দিদি।

ঘরে এসে পুঁটলিটা এক পাশে রাখল সাহানা। বলল, ”প্রসাদ নামমাত্র। ওর মধ্যে তোমার জন্য দু-চারখানা লুচি আছে। মাটির ভাঁড়ে কলাপাতা রেখে লুচি তরকারি দিয়েছে, রাত্রে খেয়ে নিও।”

বসল সাহানা। একটি মাত্র কাজ চালানো চেয়ার। পায়াগুলো বাছুরের ঠ্যাঙের মতন।

বসেই বিড়ি ধরাল সাহানা। ”কেমন আছ শালাবাবু?”

”ভাল। কাশিটাও কমে গেছে।”

”তুমি তো ডাকঘরও কামাই দিলে না গো?”

”না। কতটুকু আর কাজ?”

সাহানা মাথা নাড়ল। যেন তারিফ করল।

একটু থেমে সাহানা বলল, ”মাস্টার, তোমার ডাকঘরে পরী এসেছিল?”

পরী! মনে পড়ল, কাল বেলার দিকে ওই মেয়েটি এসেছিল। এক জোড়া পোস্টকার্ড কিনল।

বললাম, ”হ্যাঁ, এসেছিল। পোস্টকার্ড কিনতে।”

”দেখলে পরীকে?”

”সে আমি আগেই দেখেছি। আপনি বলার পর তাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। বলেছি আপনাকে।”

সাহানা যেন অন্যমনস্কভাবে কথাটা শুনল, বলল, ”বলেছিলে বটে! ….পরী মাঝে এখানে ছিল না। আট দশ দিন।”

”কোথায় গিয়েছিল?”

”বায়না খাটতে।”

”বায়না খাটতে?”

সাহানা শব্দ করে বিড়ির ধোঁয়া ওড়াল। উড়িয়ে ফেলে দিল টুকরোটা দরজার দিকে। বলল, ”পরীরানী আমাদের লালু ঘাঁটির দলে পালা গায় মাস্টার। যাত্রা করে। গাঁ-গ্রামের যাত্রা। বাইরে থেকে লোক এসেও ডেকে নিয়ে যায়। এ গাঁয়ের, ও গাঁয়ের দলের লোক আসে। কোথাও এক দু রাত, কোথাও তিন রাত। কাছাকাছি গান হলে রাতে সেরে সকালে সাইকেলের পেছনে বসে ফিরে আসে। দূরে হলে দেরি হয় ফিরতে।”

পরীকে আমি গতকাল পোস্ট অফিসে দেখেছি। আগে দেখেছি ওদের বাড়ির কাছে, কিংবা পথে। সাহানা বলে দেবার পর বুঝেছি কে পরী, আর কে মরি। পরীকে দেখতে সত্যিই হাড়সার। এত রোগা যে মনে হয়, হাড়গুলোই যেন আছে ওর, যেন মাংস বলে কিছু নেই। গায়ের রঙ সত্যিই অস্বাভাবিক। এমনটি দেখা যায় কিনা জানি না। সাহানা যে বলে সাদা সিমের মতন রঙ গায়ের, তা ঠিকই। এমন অদ্ভুত সাদা আমি অন্তত দেখিনি। তবে আমার মনে হয়েছে, সাদা সিমের মতন গায়ের রঙ না বলে বলা উচিত থোড়ের গা ছাড়ালে যেমন সাদা রঙ দেখা যায় সেই রকম।

পরীর মুখের ছাঁদটি মন্দ নয়। নাক লম্বা, থুতনি সরু, গালে আঁচিল। গলা লম্বা। পাতা কেটে চুল বাঁধে।

গায়ের রঙ যদি অমন অস্বাভাবিক না হত, হয়ত পরীকে আলাদা করে নজরে পড়ত না। বরং মরির মেয়েলি গা-গতর খানিকটা নজরে পড়ার মতন।

আমি বললাম, ”বাইরে গেলে থাকে কোথায়?”

সাহানা হেসে বলল, ”তোমার কী কথা হে মাস্টার! থাকে কোথায়—? আরে গরুকে মাঠে ছাড়লে খায় কী? ঘাস! থাকার ব্যবস্থা ওদের হয়ে যায় হে। দলের সঙ্গে দু একটা মেয়ে তো থাকেই, রাত কাটানোর জন্য ঠাঁই পেয়ে যায়।”

”এবার কোথায় গিয়েছিলে?”

”গোষ্টপুর, তেলেটি, নিশাদল…ওদিকে তোমার গঙ্গাচটি কোলিয়ারির ভেতরের গাঁয়ে আমবনা, হরিণদীঘি…এই সব। ও তুমি বুঝবে না। …..পর পর দু-তিন রাত পালা গেয়ে একদিন বাদ, আবার পালা। ফিরে এসে আর কি যাওয়া যায়! তারপর তিন দলের গান। একেবারে সেরে ফিরল।”

আমার খানিকটা অবাক লাগছিল। সাহানা দেখি, পরীর সবরকম খবরই রাখে।

বললাম, ”আপনি তো আমায় পরীর গল্প বললেন না?” বলে আমি হেসে বললাম, ”বলেছিলেন, ওকে আগে দেখি, তারপর বলবেন।”

সাহানা একটু যেন মাথা দোলালে। দেখল আমাকে। আজ সাহানা গায়ে একটা চাদর চাপিয়েছে। মোটা চাদর। খদ্দরের। খয়েরি রঙ কালো দেখাচ্ছিল। ওর চোখের পাতা একটু ফোলা। অবেলায় ঘুমোলে যেমন হয়।

প্রথম প্রথম আমার সন্দেহ হত, সাহানা কি নেশা করে? চোখদুটি বড় লাল দেখায় সাহানার।

”এককালে করেছি মাস্টার? তাড়ি, ধেনো, পচাই, মহুয়া, দু-এক টান গাঁজা—সবই করেছি। এখন ভোলানাথ। ভাঙ ছাড়া কিছু খাই না। তারামণি সিদ্ধির গুলি করে দেয়। বাটা সিদ্ধি গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে গুলির মতন গোল গোল করে, ঘিয়ে ভেজে দেয়। সন্ধেবেলায় দু’গুলি খাই। তাতেই খিদে হয়, ঘুম হয়, পরিবারের আদর হয়।” বলতে বলতে সাহানা হাসে।

বললাম, ”আপনার কী ঠাণ্ডা লেগেছে?”

সাহানা অবাক গলায় বলল, ”না। কেন?”

”চোখ ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে।

”না মাস্টার। বেস্পতিবারে বিকেল বিকেল দোকান বন্ধ করি। তোমার দিদি লক্ষ্মী নিয়ে মাতে। আর আমি একটু গড়াই। এক-আধদিন চোখ লেগে যায়। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

”ভাঙের গুলি খেয়েছেন?” আমি হেসে বললাম।

”ও কি আর বাদ যায়?”

”তাহলে পরীর গল্পটা শুনি?”

সাহানা আমার দিকে ক’ পলক তাকিয়ে থেকে বলল, ”গল্প না হয় শুনলে। তারপর?”

আমি কিছু বুঝলাম না।

সাহানা, ”মাস্টার, তুমি ওকে রাখবে?”

রাখব! মানে? আমি কেমন থতমত খেয়ে গেলাম। পরীকে আমি রাখব? বলে কী সাহানা?

সাহানা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অল্পক্ষণ। যেন নজর করে বুঝে নিল আমাকে। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকল সামান্য। শেষে বলল, ”তোমায় তবে সত্যি কথাটা বলি মাস্টার। দিদি তোমার লক্ষ্মীপুজোর পাঁচালি আওড়াচ্ছে ঠাকুরঘরে। আমি নিজের ঘরে শুয়ে। অবেলায় আঁধার ধরেছে, গো! শুয়ে থাকতে থাকতে চটকা লেগে গেল।…কখন দেখি পরী এসেছে। তোমায় বলব কী মাস্টার, পরীর চেহারা দেখে আমার বুক বেজে উঠল। যেন তার কোন শালা সোয়ামিকে চিতেয় উঠিয়ে এসেছে। নোঙরা ছেঁড়াখোড়া শাড়ি, মাটিতে লুটোচ্ছে, গায়ে আড়াল নেই, কষ্টে আতার মতন শুকনো বুক, হাড় জেগে আছে। মাথার চুলগুলো রুক্ষু, ছড়ানো। …আমি মাস্টার, হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ভাবছি ছুঁড়ির হল কী?”

সাহানা চুপ। যেন চটকায় দেখা শরীর চেহারাটা তার চোখে ভাসছে এখনও। কেমন একটু অস্থির, উদভ্রান্ত হয়ে সাহানা আবার বলল, ”আমি মাস্টার—শুধতে যাচ্ছিলাম—তোর হল কী?….শুধতে হল না গো! ছুঁড়ি আমার পায়ের গোড়ায় ধপ করে বসে পড়ে, পা সাঁটিয়ে ধরল। বলল, ‘বাপ গো আমায় বাঁচা। আমি মরছি।’ বলে ছুঁড়ির কান্না কী গো, কুকুরের মতন পায়ে মাথা ঘষতে লাগল। পা ছাড়াতে গিয়ে দেখি, হারামজাদী কাশতে কাশতে রক্ত তুলে ফেলেছে। পায়ে আমার রক্ত।”

আমি চুপ। সাহানার মুখ দেখে মনে হল, এখনও যেন পরী তার পা জড়িয়ে রয়েছে।

আমি বললাম, ”ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলেন!”

সাহানা দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ”ঠিক ঘুম নয়, ঘোর। তন্দ্রা।”

”ওই একই হল।”

”কাল পরী তোমার কাছে এসেছিল মাস্টার। বলল। সাঁঝের গোড়ায় আমার কাছে গিয়েছিল তেল হলুদ পিঁয়াজ কিনতে। চিঠি লিখেছিল, বলল—ঠিকানাটা দেখে দাও ঠাকুর।”

”কার ঠিকানা? আপনার পরী লেখাপড়া জানে?”

”আকবক আঁচড়াতে পারে। গোটা গোটা অক্ষর পড়তে জানে। ঠিকানা লেখার সময় ভয় পায়। পাছে তোমাদের ডাকঘর পড়তে না পারে।”

”কাকে লিখেছিলেন চিঠি?”

”নাম জেনে তুমি বুঝবে না গো! কথা কি জানো, খাটাতে লোক পাওয়া যায়! টাকা দেবার লোক পাওয়া যায় না। ছুঁড়ি এর ওর ডাকে পালা গাইতে যায়। এই ঠাণ্ডায়, ছেঁড়া আসরে পালা গেয়ে রাত পিছু বিশ পঁচিশ টাকা। বেশি হলে তিরিশ। এই টাকা সব সময় পুরো পায় না। দশ পনেরো পায়। বাকিটা পড়ে থাকে। দেব দিচ্ছি করে ভোগায়। দায়ে পড়লে দেয়…।”

”ও!” আমি বুঝতে পারলাম। পরীর টাকা পড়ে আছে কোথাও তার দরুন চিঠি লিখেছে।

সাহানা পকেট থেকে বিড়ি বার করে আমায় দিতে গেল। আমি নিলাম না। এখনও কাশি রয়েছে।

বিড়ি ধরিয়ে সাহানা বলল, ”মাস্টার, আমার চোখ লাল, তবে কি না এই চোখের তলায় আমার দৃষ্টি আছে। আমি আগিয়ে দেখতে পারি। পরীকে কাল দেখে আমার মনে হল, ও মরবে।”

আমার কাশি এসেছিল। ঠাণ্ডাটা যেন বেড়েই চলেছে। আজ রাত্রে শীত বেশ বাড়বে। উত্তরের কনকনে হাওয়া আলগা জানলায় এসে ঠকঠক শব্দ করছিল।

”মরবে কেন?” আমি বললাম।

সাহানা বিড়ি টানা থামিয়ে বলল, ”মরণ যে মানুষকে ধরে মাস্টার।”

ধাঁধাটা আমার মাথায় এল না। বললাম, ”সে তো বড় কথা। পরীকে ধরবে কেন? ওর কি মরণ ধরার বয়েস হয়েছে?”

সাহানা বলল, ”তুমি কিছু জান না শালাবাবু। তোমার দিদি বলে—তুমি হলে ভাল ভদ্দর ছেলে। আমি বলি, তুমি হলে ঘেঁটু। মুখ খারাপ আর না করলাম।” বলে পর পর দুটো টান মেরে সাহানা বলল ”শোনো মাস্টার, মরণ দু’রকম। এক মরণে মানুষ চিতেয় ওঠে। আর এক মরণ কী জানো? তারে বলে কলি। সে শালা তোমার ছেঁদা খুঁজছে। কোথাও একটু ফাঁক পেল তো ঢুকে পড়ল। নলরাজকে যেমন করে ধরেছিল জান তো?”

”শুনেছি।” বললাম বটে শুনেছি, কিন্তু ভাল করে জানা ছিল না।

”তা হলে পরীকেও ধরেছে।….তুমি ওকে রাখো হে।

”রাখব মানে?”

”তোমার ঘরে রাখো,” সাহানা বলল, ”তোমার ঘরের সব কাজ করবে হে!….তুমি জাত পাত মানো?”

”না।”

”তবে আর কথা কিসের! উ তোমায় সাত সকালে আসবে মাস্টার। ঘরদোর ঝাটপাট করবে, রান্না সারবে, ধোয়া কাচা করবে, ঘর আগলাবে। সাঁঝবেলায় চলে যাবে।”

সাহানার কথাটা আমি বুঝতে পারলাম। বললাম, ”ঘরের কাজের জন্যে রাখতে বলেছেন?”

”আশ্চয্যি কথা তোমার। তোমায় কি সিংহাসন পেতে রাখতে বলছি!”

আমি হেসে ফেললাম। ”সিংহাসন কই যে রাখব! কিন্তু আমার এখানে অনাদি আছে!”

”উ শালাকে তাড়াও। ওটি চোর, বজ্জাত। শালা গরুহাটে গিয়ে জুয়া খেলে। সেদিন লেশা করে পাছায় গুঁতো খেয়েছে। হারামজাদা!”

অন্যদিকে আমারও আর পছন্দ হচ্ছে না। ফাঁকিবাজ, চোর। নেশাটেশা যে করে তাও বুঝতে পারি। আমার রেডিওটার দফারফা করে রেখেছে। চালচলনও পালটে গেছে এক দেড় মাসে। বেটা কোত্থেকে ঘাড় চাঁচিয়ে চুল কেটেছে, বাহার করে চুল নিয়ে, গলায় একটা মোটা কালো সুতো পরেছে, সুতোয় তাবিজের মতন কী একটা বাঁধা। মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়। ডাকঘরের টাকা পয়সা যদিও বড় ডাকঘরে জমা দিয়ে আসে ফণী, তবু কখন কী করে বসে অনাদি কে জানে!

আমি বললাম, ”ফণী আমাকে দিয়েছে ওকে…”

”ফণীর পরোয়া তুমি করো না। ওর বাপও তোমার কিছু করতে পারবে না। ও আমার বশ হে!” বলে ইশারায় সাহানা যা বোঝাল তাতে মনে হল, সুজ্যি মুদির দোকানে ফণীর বাকি বকেয়া পড়ে থাকে বরাবরই।

আমি বুঝতে পারছিলাম না, পরীর জন্য সাহানার এত দরদ উঠেছে কেন?

শীত ধরেছিল আবার। চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, ”বাসায় আমি একা থাকি। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একলা মেয়েছেলে থাকবে, লোকে কিছু বলবে না?”

সাহানা যেন আমার বোধবুদ্ধির বহর বুঝে নিল। বলল, ”ওদের কেউ কিছু বলে না। বলাবলি কাদের করে মাস্টার? জাতপাতের লোকদের। ভদ্দরদের। উদের কী বলবে হে! পরী যায় যাত্রায় খাটতে, মরি যায় কোলিয়ারির ছোট হাসপাতালে আয়াগিরি করতে। গু মুত ঘেঁটে কানি কেচে টাকা পয়সা নিয়ে ফিরে আসে। গতর না খাটালে পেট চলবে কেমন করে!”

”ও! মরি আয়ার কাজ করে?”

”করে বটে। জানো হে মাস্টার, মরির কোনো বাঁধা ধরা মাস নেই। ছানা বিয়োবার মাস থাকে না। তবু মরির কামাই যায়। আর পরীর এই তিন চার মাস। তাও মাসে পাঁচ সাত দিন। কামাই মরির বেশি।”

আমি চুপ করে থাকলাম। অন্যদিকে আমার পছন্দ নয়, কিন্তু পরীকে রাখা কি ঠিক হবে। ওই তো চেহারা। ভেতরে কোনো অসুখ-বিসুখও থাকতে পারে। চেহারা দেখলে তেমন মনে হয়। সাধারণ খাটাখাটুনিও ঠিকমতন করতে পারবে কী না কে জানে!

সাহানা বলল, ”পরীকে তুমি রাখো, মাস্টার। আমি বলছি।”

দোনামোনা করে বললাম, ”ও কী পারবে?”

”বলো কী তুমি! একটা লোকের বাড়ি আগলাতে পারবে না! ওর হাড় দেখে ওকে বুঝো না শালাবাবু! হাড়ে খেলা আছে গো!” বলে সাহানা একটু হাসল। বলল, ”আসরে যখন গাইতে নামে হে, দমখানি বোঝা যায়!”

আমি হেসে বললাম, ‘আপনি দেখেছেন গাইতে?”

মাথা হেলিয়ে সাহানা বলল, দেখেছে।

”তা হলে ঠিক?” সাহানা বলল।

”একটু ভেবে দেখব না?”

”ভাবার কিছু নাই। তুমি আমার কথায় রাখছ হে…সকালে এক আধখানা বাসি রুটি খাবে, দুপুরে চাট্টি ভাত ডাল। ও একটু চা খেতে ভালবাসে। তোমার হলে খাবে একটু।”

”মাইনে?”

”সে পরে কথা হবে। আগে ছুঁড়ি বাঁচুক, তারপর অন্য কথা।”

সাহানা যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

তিন

পরী মেয়েটার কাজকর্ম ভাল। অনাদি বোধহয় লুটেপুটে খেত। পরীকে দেখি সামলে-সুমলে চলে। যখন তখন হাত পাতে না। গুছিয়ে ফেলেছে বেশ। সত্যিই সাত সকালে ছেঁড়াফাটা করকরে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে আসে। সদরে শেকল নাড়ে। ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দিই। আবার শুয়ে পড়ি লেপের তলায়।

শীতও পড়েছে। পৌষের হাওয়ায় গাছপালা পর্যন্ত রুক্ষ কাঠ হয়ে গেল যেন। যতক্ষণ রোদ ততক্ষণ আরাম। দুপুরের পর থেকেই গায়ে কাঁটা দেয়। আর বিকেল ফুরোলে তো হাত পা ঠাণ্ডা, গায়ের চামড়া কেটে দেয় শীতের হাওয়া। সন্ধের পর মালসায় কাঠ কয়লার আগুন নিয়ে বসতে হয়।

এমন কনকনে হাড় কাঁপানো দিনেও পরী ঘরদোরের কাজকর্ম, মোছামুছি, ধুতি, জামা কাচা, রান্নাবান্না সবই করে যাচ্ছে। সন্ধের আগে চা খাইয়ে চলে যায়, রাতের খাবার রেখে যায় গুছিয়ে। যাবার আগে বলে যায়, একটা কেরোসিন স্টোভ কিনতে। স্টোভ থাকলে কষ্ট হত না। স্টোভ জ্বালিয়ে গরম করে নিতে পারতাম।

সাহানার দোকানে স্টোভ নেই। বলেছে, রানীগঞ্জ থেকে আনিয়ে দেবে।

পরী মেয়েটাকে আমার খারাপ লাগছিল না। নিজের মতন কাজ করে , নয়ত বসে থাকে রোদে। দু’ একদিন দেখেছি সেলাই করছে নিজের শাড়ি জামা। একদিন কি দুদিন শুনি নিজের মনেই গান গাইছে, গলা নামিয়ে, খেয়াল করেনি বোধহয়। গানের একটু কানে গিয়েছিল। ‘ধীরে ধীরে ধীরে, তটিনী হৃদয় নীরে…’। নিশ্চয় কোনো যাত্রার গান।

পরী আমাকে মাস্টারবাবু বলে ডাকত। কথায় আপনি আজ্ঞের বহরটা ছিল অদ্ভুত। কখনো আপনি থাকত, কখনো থাকত না।

কথাবার্তা আমিও বিশেষ বলতাম না। বলার কীই বা ছিল। পরীর বোন মরি এসেছিল একদিন। দেখে গেল বোধহয়।

শীতের দাপটে সন্ধেবেলায় সাহানার কাছে যাওয়া হত না রোজ। তবে যেতাম।

সাহানা ঠাট্টা করে বলত, ”কেমন ছুঁড়ি দিয়েছি হে মাস্টার! মনে ধরেছে তো?

হেসে বলতাম, ”মনে কেন ধরবে। কাজে ধরেছে।”

”উ এর মাঝে একদিন রাধানগরের দিকে গান গাইতে গিয়েছিল, জান?”

”না। কবে?”

”তোমার নজরে কিছুই পড়ে না হে।”

সত্যিই আমার নজরে পড়েনি। তবে হ্যাঁ গত পরশু না তরশু দিন বিকেল হতেই চলে গিয়েছিল কাজকর্ম সেরে, পরের দিন সকালে সামান্য দেরি হয়েছিল আসতে। আমি অতটা লক্ষ করিনি।

সাহানা বলল ”শোনো মাস্টার, তুমি ছুঁড়িকে বলে দেবে, গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে, এ চলবে না। উ যদি রাতে খাটতে চায় খাটুক, দিনে রাতে খাটা চলবে না।”

আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, ”মানে, ওকে তাড়িয়ে দেব বলছেন?”

”নিশ্চয়ই দেবে।” সাহানা যেন রুক্ষ হয়ে বলল, শালীকে মরণে ধরেছে; বাপ বলে পায়ে ধরবে, নিষেধও মানবে না।”

সাহানা একটা কথা আমার কাছে স্পষ্ট করে বলছে না। পরীকে মরণে ধরেছে এই কথাটা কত বারই না বলল, কিন্তু কিসের মরণ তা বলল না। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়।

আমি বললাম, ”পরীকে আপনি দিয়েছেন। আপনি ওকে বারণ করবেন। ও যদি আমার কাজ সেরে বাড়ি গিয়ে কোথাও যায়—আমি জানব কেমন করে? আর বলবই বা কী?”

সাহানা বলল, ”আমি বলেছি হে! বলেছি, তুই আমার চোখে ধুলো দিতে পারবি না। আর যাবি তো তোর কপালে মন্দ হবে।” বলে সাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, ”উঃ বোধহয় মরবে মাস্টার! অনর্থক কান্নাকাটি করল হারামজাদী।”

সাহানা বলেছিল বলেই আমার যেন নজর একটু বেশি করে পড়ল পরীর ওপর। ওকে লক্ষ করতাম। বিকেলের দিকে যেদিন তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে যেত—ওকে নজর করতাম। সকালে দেরি করে এলে ভাল করে লক্ষ করতাম ওকে। আমার চোখে স্পষ্ট করে কিছু ধরা পড়ত না।

একটা জিনিস আমার নজরে পড়ত। প্রায় দিন দুপুরে দেখতাম, স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে বাসন ধুয়ে, মাটির দালানে ছেঁড়া মাদুর পেতে ও শুয়ে থাকত। কোনো কোনো দিন পা ছড়িয়ে বা চুল ছড়িয়ে বসে থাকত। মনে হত আলস্য ভাঙছে শীতের রোদে। কিন্তু এমন অলস উদাস চেহারা আর ভঙ্গি, এমনই চুপচাপ যে আমার মনে হত, পরী যেন কোনো ঘোরের মধ্যে বসে থাকে দুপুরের রোদে। শীতও তো কমে এল।

সাহানাও অবাক মানুষ। পরী যে এখনও লুকিয়ে চুরিয়ে এক আধ দিন যাত্রায় খাটতে যায়, কাছাকাছি জায়গায়, এ-খবর তার কানে আসে। আর প্রতিবারই আমায় খবরটা জানিয়ে পরীকে গালমন্দ করে। প্রতিবারই বলে, হারামজাদীকে লাথি মেরে তাড়াও মাস্টার। উ শালী মরবে।

আমি বলি, আপনি তাড়ান। মুখে বলেন, তাড়ান না কেন?

সাহানা ঠিকমতন জবাব দিতে পারে না। বলে, গালিগালাজ করি হে, কিন্তু ছুঁড়ি কেঁদে ভাসায় গো। এমন করে কাঁদে মাস্টার, যেন শালী সাবিত্রীর পাট করছে। আর আমি শালা যমরাজ।

আমি হেসে ফেলে বলি, সত্যবান কে?

তোমার বাড়ির চাকরিটা হে! উটি যেন ওর প্রাণ।

শীতের পালা ফুরিয়ে এল। বসন্তর হাওয়া মিশেছে শীতের বাতাসে। গাছপালা আর রুক্ষু লাগে না চোখে।

এমন সময় পরী দিন দুই এল না। মরি এসে বলে গেল, পরীর গা গতরে ব্যথা আর জ্বর। আমি চার পুরিয়া হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিলাম।

দু-তিনটে দিন নিজেই কোনো রকমে চালিয়ে নিলাম। সাহানার বাড়ি থেকে দিদি বাটি করে এটা ওটা পাঠাল গোপালকে দিয়ে। সাহানা বলল, দুটো দিন একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও হে। নয়ত এ-বাড়িতে দু মুঠো খেয়ে যেও।

চার দিনের মাথায় সাহানা এল রাত্রের দিকে। ডাকল, ”মাস্টার?”

সদর খুলে দিতেই সাহানা বলল, ”করছিলে কী?”

”খেতে বসব ভাবছিলাম।”

”পরে খেও। চলো এখন।”

”কোথায়?”

”পরীর বাড়ি।”

”পরীর বাড়ি?”

”চলো হে!…ছুঁড়ি বুঝি মরল!”

মরল! আমি চমকে উঠলাম। মরার মতন কী হয়েছে পরীর?

”হয়েছে কী?”

”চলো, দেখবে।”

গায়ে জামা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তালা দিলাম সদরে।

পথে আমার মনে হল, হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা সঙ্গে নিলেই হত।

আজ বাইরে জ্যোৎস্না রয়েছে। কাল কি পরশু পূর্ণিমা হবে। চাঁদের আলো পরিষ্কার। শীত মরেছে। ফাল্গুনের গোড়া। মিহি কুয়াশা হয়ত আছে মাঠেঘাটে জড়ানো।

এ দিককার ঘর বাড়ি কম। দু-একটি আলো জ্বলছে কোথাও টিমটিম করে। বাতাসে বনতুলসীর গন্ধ। জামতলার গা দিয়ে কাঁচা রাস্তা। সাহানা কোনো কথা বলছিল না।

বঁইচি বাগানের পাশে পরীদের বাড়ি। টিনের চাল, বেড়াভাঙা চৌহদ্দি, ঘরের সামনে কলকে ফুলের গাছ, আশেপাশে ঝোপ।

খোয়া পেটানো কাঁচা রাস্তার মতন এক ফালি বারান্দা। দরজা ভেজানো ছিল। সাহানা দরজা ঠেলল। খুলে গেল।

ঘরের মধ্যে ভূসিওঠা ছোট লণ্ঠন। আলো যেন না থাকার মতন। জানলা খোলা। চাঁদের আলো এসেছে সামান্য।

ঘরের একপাশে এক সরু তক্তপোশ। নোঙরা বিছানা। ঘরের চারদিকেই ছেঁড়া ময়লা কত কী জমে আছে। কিসের এক গন্ধ উঠেছিল। বিশ্রী গন্ধ।

পরী বিছানায় পড়ে আছে। আড়াআড়ি। তার মাথার তলায় বালিশ নেই। হাত-পা এলানো। চোখ বন্ধ।

সাহানা বলল, ”দেখো তো মরে গেল কিনা!”

সাহানা লণ্ঠনটা তুলে এনে বিছানার সামনে দাঁড়াল।

পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, সে মরেনি। তবে নেশা করেছে। তার চোখের পাতা ভারি, গাল ভারি, ঠোট ফাঁক হয়ে আছে। গায়ে জামা নেই। পরনের শাড়ি যেন মাটিতেই বেশিটা পড়ে আছে। পেট দেখা যাচ্ছিল। পায়ের গোছ যেন কাঠির মতন। পা দুটো ফাঁক করা।

পরী আজ কোথায় যাচ্ছিল কে জানে। তার মাথার কাছে পাউডারের কৌটো, কাজললতা, প্লাস্টিকের ফুল, ক্লিপ, চুল বাঁধার গুছি, কাঁটা পড়ে আছে। হাতের পাশে একজোড়া পালক, টিয়াপাখির বোধহয়। ওর গলায় রয়েছে সাদা পুতির মালা।

ওর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা মুশকিল।

আমি সরে এলাম। বললাম, ”মরেনি।”

”ছুঁড়ির হুঁশ নেই।”

”নেশা করেছে।”

”তা বুঝি। কিন্তু শালীর বিছানার পাশে ফলিডল পড়ে আছে হে!”

”আমার তো নেশা বলেই মনে হয়। গন্ধ ছুটছে।”

”ছুঁড়ি বাঁচবে তো হে!”

”মরবে কেন?”

সাহানা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ”উ তো মরেছে। তোমার চোখ নাই মাস্টার।”

”মরি কোথায়?”

”আয়ার কাজে গেছে। রাতে আসবে কিনা—কে জানে?”

”চলুন।”

বাইরে এসে সাহানা দরজা ভেজিয়ে দিল।

ফেরার পথে সাহানা বলল, ”দেখো মাস্টার, নলরাজ সোনার হাঁস ধরতে গিয়েছিল নিজের বস্ত্র দিয়ে। হাঁস উড়ে গেল। বস্ত্রও গেল। এ হল কলির খেলা। মরণের খেলা।…ওই শালী ছুঁড়িকে আমি হাজার বার বলেছি, তুই বেজাত বেজম্মা, তোর যে মাসি তোদের এনেছিল এখানে সে ছিল নাচনি। মাগী ঝুমুর দলে নাচত। মাগী মরে গেল। বেশ হল। তুই ছুঁড়ি কাজেকর্মে থাক। মরির সাথে যা। তা উ শালীর লোভ হল পালা গেয়ে বেড়াবে। গু মুত কানি কাচবে না। …যা পালা গাইতে, আসরে লাচতে। একবার ছুঁড়ি মরতে মরতে বাঁচলি। শিক্ষা হল না। আবার শালী মরলি!…লে এবার শালা কোন রাজপুত্তুর তোকে সামলাতে আসবে! পেটে লিয়ে ঘোর ছুঁড়ি।”

কিছুটা পথ আমি কোনো কথা বললাম না। সাহানা যেন পথ ঠাওর না করেই চলছিল।

শেষে আমি বললাম, ”ওর মেলামেশা কার সঙ্গে ছিল, আপনি জানেন?”

সাহানা কোনো জবাব দিল না প্রথমে। পরে বলল, ”না। ছুঁড়ি বলেছিল, নিশাদল গাঁয়ের বলরাম হাজরার সঙ্গে। বলরামের সাথে উ লখীন্দর বেহুলার পালা গাইত। বলরাম মরেছে হে! আলপথে পা কেটে বিষ লেগেছিল। ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মারা গেল।”

চমকে উঠে বললাম, ”কবে?”

”বেশি দিন নয়।” বলে সাহানা যেন নিজেকে সামলাতে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে বিড়ি ধরাবার চেষ্টা করল।

বিড়ি ধরিয়ে বলল, ”ও ছুঁড়ি বাঁচবে না মাস্টার। মরণ ধরলে কে বাঁচে! শালীর ধরেছিল। এবার বুঝ! সোনার হাঁস ধরতে সাধ করেছিল ছুঁড়ি। হাঁস গেল, তোর বস্ত্র গেল। এবার তুই দেখ, এ-জগৎ কত সুখ ধরে।”

সাহানা দেখি আকাশের দিকে মুখ করে কী দেখছে! জ্যোৎস্না, চাঁদ, কোনো পরী, না ভগবান কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *