কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
“যে রামকৃষ্ণের ছেলে, সে আপনার ভাল চায় না।” স্বামীজী বলছেন : “প্রাণাত্যয়েঽপি পরকল্যাণচিকীর্ষবঃ”—প্রাণ বিসর্জন দিয়েও পরের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী। এই হলো রামকৃষ্ণধর্মের মূলকথা। নিজের মোক্ষ চাইছ, না কর্তব্য থেকে পালাতে চাইছ? ভাল করে ভেবে দেখ। কর্ম ছাড়া ধর্ম থাকে কি করে! দেহ যখন ধরেছ, শ্বাসপ্রশ্বাস আছে। নাকটা টিপে ধরলে ‘গেল গেল’ অবস্থা! ইন্দ্রিয়ের ফোকর দিয়ে সংসার, জগৎজীবন দেখছ। হাসছ, কাঁদছ, খেপছ, খেপাচ্ছ! ‘আমি, আমার’ বলে সব আঁকড়ে আঁকড়ে ধরছ! কোন্ আক্কেলে তুমি পনের মিনিট জপের মালা ঘুরিয়ে ‘পরমহংস’ হয়ে গেলে ভাব! অতই সহজ! আষ্টেপৃষ্ঠে তিলকসেবা করে, গলায় কেজি দশেক হরেকরকম মালা পরে, হরিণের ছালে বসে থাকলেই হিরণ্যগর্ভ সহাস্যে এসে যাবেন, কি দু-চ্যাপ্টার ‘গীতা’ পড়লেই তাঁর আলোয় আলোকময় হয়ে যাব—এমন কোন আশা নেই। স্বামীজী বলেছেন, ধর্ম মানে শাস্ত্রপাঠ, তত্ত্বকথা কিংবা মতবাদ নয়। ধর্ম মানে ‘হওয়ার’ চেষ্টা করা এবং ‘হয়ে যাওয়া’। It is being and becoming.
এ যে তাঁর গুরু পরমহংসদেবেরই শিক্ষা। তিনি বলতেন, পাঁজিতে বিশ আড়া জল লেখা আছে। কিন্তু পাঁজি নেংড়ালে এক ফোঁটাও বেরোয় না, তেমনি পুঁথিতে অনেক ধর্মকথা লেখা আছে, শুধু পড়লে ধর্ম হয় না—সাধন চাই।
কেশবচন্দ্র সেন পরমহংসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, অনেক পণ্ডিত লোক বিস্তর শাস্ত্রাদি পাঠ করেন, কিন্তু তাঁদের জ্ঞানলাভ হয় না কেন? ঠাকুর বললেন, যেমন চিল, শকুন অনেক উঁচুতে ওড়ে, কিন্তু তাদের দৃষ্টি থাকে গোভাগাড়ে। তেমনি অনেক শাস্ত্রপাঠ করলে কি হবে?
দুটো কীটকে যে আগে পোড়াতে হবে—কাম আর কাঞ্চনে আসক্তি। রাম আর কাম, দিন আর রাত একসঙ্গে থাকে কি করে। ঐ দুটি ‘প্যারাসাইট’-এর জায়গায় আনতে হবে বিবেক আর বৈরাগ্য। মা বললে-ভাল ভাল জিনিস খাচ্ছে-দাচ্ছে, ছেলেটার গায়ে গত্তি লাগছে না কেন? কেবল পেটটাই বড় হয়ে যাচ্ছে! বৈদ্য এসে বললে, লাগবে কি করে, এর যে পেটজোড়া পিলে! পিলেতেই সব খেয়ে নিলে! পিলের স্বাস্থ্যই ভাল হচ্ছে। ঠাকুর বলছেন, গ্রন্থ নয়, গ্রন্থি—গাঁট। বিবেক-বৈরাগ্যের সঙ্গে বই না পড়লে পুস্তক পাঠে দাম্ভিকতা আর অহঙ্কারের গাঁট বেড়ে যায় মাত্ৰ।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের মিলনে তৈরি হলো ভয়ঙ্কর এক ধর্ম— ‘মরণ ধর্ম”। ‘আমি’টা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। অনেকটা—নিজেকে চিতায় চড়ানো। গোখরোর ছোবল। ‘কাঁচা আমি’ বৈরাগ্যের আগুনে পুড়ে ‘পাকা আমি’ হবে। কাঁচা সোনাকে পাকা করা। উপাধি পোড়ার পড়পড় শব্দ নিজের কানেই শোনা যাবে।
গঙ্গার ধারের নিরালা এক উদ্যান, জানবাজারের রানীর দেবালয়, জমিদার মথুরমোহনের সাত টাকা মাসোহারা। জপ, ধ্যান, পূজা, শাস্ত্রকথা, সঙ্গীতের গতানুগতিক পথে ধর্মজীবন কাটানো নয়। কী অসম্ভব রোখ! কে রাসমণি, কে মথুর! কলকাতার মাথাওলা জ্ঞানী, গুণী, ধর্মপ্রচারক, লেখক, আমলা, মুৎসুদ্দি, ব্যবসায়ী, ধনী ব্যক্তিরাই বা কে! দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ বেপরোয়া। একবার করে বাজান আর বাতিল করে দেন। তোমার পুঁথিপড়া জ্ঞানের অহঙ্কার নিয়ে এস, তোমাকে আমি চুপসে দেব। ‘জ্ঞান’ কাকে বলে? ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নামই অজ্ঞান। ডিগ্রী, ডিপ্লোমা, সেমিনার, বক্তৃতা, মামলা, মকদ্দমা, চালবাজি, ফেরেব্বাজি, ভেকধারণ, শাস্ত্র আলোচনা সব ফুঃ! ক্ষণকালের ফুৎকার। অজ্ঞানের অন্ধকারে ভূতের নৃত্য! জ্ঞান হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। ধর্মের পথ ঈশ্বরের দিকেই গেছে। সে-পথ বাইরে নেই—ভিতরে। নিজের দিকে এগনোর নামই সাধনা। তারই নাম তীর্থযাত্রা। স্বামীজীকে দিয়ে বলালেন, ভগবানের দিকে যাওয়ার পথ সাংসারিক পথের ঠিক বিপরীত। মানুষের মধ্যে যে দেবত্ব প্রথম থেকেই আছে, তার বিকাশই ধৰ্ম।
যাগ, যজ্ঞ, ধ্যান, জপ, আরতি, চর্চা—যা আছে সব চলুক, সব সাধনই একবার করে হোক। আসল সাধনা হবে মানুষ নিয়ে। কামারপুকুর নয়, শ্রীরামকৃষ্ণের আক্রমণস্থল খাস কলকাতা। ইংরেজের কলকাতা, বুদ্ধিজীবীর কলকাতা, এলিটদের কলকাতা, বাবুদের কলকাতা, নক্ষত্রখচিত কলকাতা! কেশবচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, শিবনাথ। কী দুঃসাহস এই বিত্তহীন রিক্ত ব্রাহ্মণটির! ‘চাল-কলা বাঁধা’ বিদ্যা আমি শিখব না। পেটের জন্য দাসত্ব আমি করব না। “অজগর না করে নোকরি, পঞ্জি না করে কাম।” রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না। আমি এসেছি যাঁর ইচ্ছায় তিনিই আমাকে দেখবেন। প্রথমে আমি ভক্ত। আমি সাকার-বিশ্বাসী। আমার সন্তানভাব। পরে আমি নিরাকারবাদী জ্ঞানী। সব ভাবের সাধন আমি করে দেখাব। দেখাব শাস্ত্র সত্য, ভগবান সত্য। “যত মত তত পথ।” “একং সদ্বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি।”
শ্রীরামকৃষ্ণের আক্রমণে কলকাতার সংসারীদের জগতে হাহাকার। গেল, গেল, সব গেল! হ্যামলিনের বাঁশি শুনে কলেজের ইংরেজী-জানা টাটকা তরুণরা সব দক্ষিণেশ্বরের দিকে ছুটছে। ব্রাহ্মসমাজ চুরমার! কেশবচন্দ্ৰ সেন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস বলতে অজ্ঞান, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পায়ের কাছে বসে থাকেন হাতজোড় করে। অ্যাটর্নি-পুত্র নরেন্দ্রনাথের যাবতীয় অধীত বিদ্যা, জ্ঞান, অহঙ্কার, অন্বেষণ, সংশয় কাঁচের পুতুলের মতো চুরচুর করে চুরমার করে দিয়েছেন। কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক ক্লাস নিতে নিতে ডিরোজিও-র কলকাতার ছাত্রদের বলছেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় যে ‘একস্ট্যাসি’র কথা আছে, তা যদি দেখতে চাও দক্ষিণেশ্বরের সাধকের কাছে যাও।
স্টেজ থেকে টেনে আনলেন গিরিশ ঘোষকে। পণ্ডিতমহল থেকে উৎপাটিত করে আনলেন বৈষ্ণবচরণ, পদ্মলোচনকে। মহামহোপাধ্যায়দের শাস্ত্রবিচার হোঁচট খেল। সকলেরই বিস্মিত প্রশ্ন—তুমি কে? ব্রহ্মজ্ঞানী তোতাপুরী গুরু হতে গিয়ে বিস্ময়ে বলে উঠলেন : “এ কেয়া দৈবী মায়া!” ভৈরবী ব্রাহ্মণী এসেছিলেন তন্ত্রশিক্ষা দিতে। শিষ্যের সিদ্ধির প্রভাবে জীবনসায়াহ্নে তাঁকে পাওয়া গেল বৃন্দাবনে—প্রেম সাধছেন।
তিনি যে এই ঘৃণার পৃথিবী, নিষ্ঠুর পৃথিবীকে প্রেম দিতে এসেছিলেন! চৈতন্য দিতে এসেছিলেন! ‘হেথা’য় থাক, কিন্তু ‘হোথা’র সঙ্গে তোমার যোগটি যেন থাকে। হেথা সব শূন্য, ঐ ‘এক’-কে এনে শূন্যের আগে বসাও, জীবনের মূল্য খুঁজে পাবে। বহুর মধ্যে সেই ‘এক’কে প্রত্যক্ষ কর। ত্রৈলঙ্গস্বামী তখন মৌনী। একটি আঙুল আকাশের দিকে তুলে ধ্যানস্থভাবে ঠাকুরকে দেখালেন, সবই এক-এর খেলা। ঠাকুর যখন সমাধিতে লীন হতেন, তখন তাঁর যে-ভঙ্গিটি হতো সেটি একটি অপূর্ব, অদ্বিতীয় ‘সিম্বল’। মুখমণ্ডলে চৈতন্যের আলো। ডান হাতের আঙুলে সেই সর্বোর্ধ্ব এক-এর ইঙ্গিত। বুকের কাছে হাতের আঙুলে প্রস্ফুটিত পদ্মমুদ্রা। সূর্যকিরণেই পদ্ম পাপড়ি মেলে। হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে ঘুচে।
জন্ম, জায়া, জরা, জন্মান্তরের ছকে বাঁধা চক্রান্ত থেকে নরেন্দ্রনাথকে টেনে বের করে আনলেন। দেখিয়ে দিলেন তার আগে—কি বিষাক্ত এই মানবসংসার! তাঁকে মৃত্যু দেখালেন, অভাব দেখালেন, জ্ঞাতিদের শত্রুতা দেখালেন, মামলা দেখালেন, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের স্বরূপ চেনালেন। এক ঝটিকায় ‘জ’-এর জগৎ থেকে নরেন্দ্রনাথকে মুক্ত করে সমস্ত সংশয় ধুয়ে মুছে চৈতন্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে মোক্ষের চাবিটি কেড়ে নিলেন। ভগবান মৃদু হেসে বললেন, সবই হয়ে রইল নরেন। ঘর চিনলে। জগৎ-প্রপঞ্চ, স্বস্বরূপ, চৈতন্যস্বরূপকে তুমি চিনলে। যদু মল্লিকের বাগানবাড়িতে তোমাকে স্পর্শ করে চৈতন্যলোকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলুম এই জীবজগৎ ব্রহ্মেরই মায়া। এদিক থেকে দেখলে এটা সত্য, ওদিক থেকে দেখলে নেই, নেই কিছু নেই।
এস, এইবার দুজনে মিলে তৈরি করি নতুন বেদ—নতুন গীতা। এবারের পার্থসারথি শ্রীরামকৃষ্ণ, এবারের অর্জুন নরেন্দ্রনাথ। সেবার তুমি গাণ্ডীব ধরেছিলে, এবার ধর আমার দেওয়া প্রেম। বিশ্বরূপ তোমাকে দেখিয়ে দিয়েছি। এবারের কুরুক্ষেত্র অন্যরকম। মেরে নয়—মরে গিয়ে প্রেমের চাদরে আচ্ছাদিত কর ওদের, যারা কৌরবের স্বার্থপরতা, নৃশংসতা, উদাসীনতার শিকার। এই কৌরবপক্ষে আছে ধর্মগুরু, পুরোহিত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, নির্ধন; আছে জমিদার, ব্যবসাদার, শিক্ষক, রাষ্ট্রপতি, শিল্পপতি। আছে সেইসব পামরপুরুষ যারা শত-সহস্র দ্রৌপদীর মর্যাদাহানি করছে। এস, মন্দির থেকে ভগবান নয়, এই প্রাচীন ভারত থেকে নতুন ভারত বের করি। সেই নতুন ভারত বেরুক “লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।” নেই, নেই নয়, আছে, আছে। মানুষ চাই—মানুষ, পশু নয়। এখানে যা আছে ত্রৈলোক্যেও তা নেই!