কুয়ো

কুয়ো

আজ ঘুম থেকে উঠে আবার দেবায়নকে দেখতে পেলাম না৷ কাল ঘটনাটা ঘটতে খুব একটা আশ্চর্য হইনি৷ এ জায়গাটা ওর পরিচিত৷ ছেলেবেলার একটা বড়ো সময় কেটেছে ওর এখানে৷ ভেবেছিলাম সকালে ঘুম থেকে উঠে নস্টালজিয়ার ঠেলাতেই বেরিয়ে পড়েছে স্মৃতিরোমন্থন করতে৷

কিন্তু আজ সন্দেহটা আগে থেকেই ছিল মনে, আজও কি তবে… বিছানা ছেড়ে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম৷ ঘরের ভিতরটা এখন জানলা দিয়ে আসা রোদে ভরে আছে৷ সেই রোদের ভিতরে মিহি ধুলো ভিড় করে উড়ছে৷ লক্ষ করেছি, গ্রামের দিকে এলে রোদের ভিতরে ধুলোর পরিমাণটা বেড়ে ওঠে৷

পরশু রাতে আমরা দু-জন এই সরঙে এসে উঠেছি৷ সরং পুরুলিয়ার একটা প্রত্যন্ত গ্রাম৷ এমনিতে শহরে শীত আর অফিসে ক-টা দিনের ছুটি পড়লেই আমরা দু-জনে এদিক ওদিক ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি, এ বছরের মাঝামাঝি দেবায়ন বায়না ধরে যে এই বছর শীতে সরঙে না এলেই নয়৷ আমি গাঁইগুই করছিলাম৷ ওর এখানে ছোটবেলার বছর পাঁচেক কেটেছে৷ ও যায় যাক, কিন্তু আমি এসে কী করব? দেখার মতো কিছুই নেই৷ অকারণেই একটা এঁদো গাঁয়ে দিন তিনেক কাটিয়ে যাওয়া৷

দেবায়নের কিন্তু ওই এক গোঁ৷ কোথাও যদি যাওয়া হয় তাহলে ওই সরং৷ শেষমেশ রাজি হয়েছি৷

চোখ-মুখ ধুয়ে দরজা খুলে বেরোতেই উজ্জ্বল রঙের খেলায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ আমাদের গেস্ট-হাউসটার সামনে যত দূর দেখা যায়, একটা বিস্তীর্ণ জলাভূমি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না৷ ছোট ছোট জংলি গাছ আর হলদে লতাপাতায় ভরে আছে জায়গাটা৷ গেস্ট-হাউস থেকে একটু এগিয়ে গেলেই মাটি নরম হতে শুরু করে, বোঝা যায়, কয়েক পা দূর থেকেই জলের রেখা শুরু হতে চলেছে৷

এখন সেই অদৃশ্য জলরাশির উপরে সাদা আর খয়েরি রঙের পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করে আছে৷ মজার কথা হল, এদের মধ্যে কোনও পাখিই ডাকতে পারে না, ফলে এতগুলো জীবিত প্রাণীর উপস্থিতি সত্ত্বেও ভারী নিস্তব্ধ হয়ে আছে জায়গাটা৷

খানিকটা হেঁটে গেস্ট-হাউসের পিছনে আসতেই মাঠটা দেখতে পেলাম, তার সঙ্গে একটু চোখ ঘোরাতেই কুয়োটা৷ সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে গেল আমার, কুয়োটার ঠিক পাশেই সাদা রঙের কী যেন পড়ে রয়েছে৷ ভালো করে দেখতে না পেলেও মনে সন্দেহের রেশ রইল না৷ এই নিয়ে পরপর দু-দিন, ভারী আশ্চর্য ব্যাপার তো৷

কুয়োটা যেখানে মাটিতে এসে মিশেছে ঠিক সেইখানে মাথা গুঁজে পড়ে আছে দেবায়ন৷ আমি মৃদু ঠেলা দিলাম তাকে, ‘কী রে…’

সে একটু নড়ে উঠল, মুখ দিয়ে শব্দও করল, কিন্তু চোখ খুলল না৷

—‘কী হয়েছে বল তো তোর?’

আরও বার তিনেক ডাকাডাকির পর চোখ খুলে গেল৷ দু-এক সেকেন্ড চারপাশটা দেখে নিয়েই ধড়ফড় করে উঠে বসল সে৷

—‘আ… আমি এখানে…’

কাল এই নিয়ে বেশি প্রশ্ন করিনি আমি, ওর উত্তর দেওয়ারও খুব একটা ইচ্ছা ছিল না, আজ কিন্তু চেপে ধরলাম, ‘রাতে কী হয় বলতো তোর? এখানে চলে আসিস কেন?’

ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল দেবায়ন, উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতের কথা মনে আছে কিছু?’

—‘ঠিক মনে পড়ছে না… মনে হয় রাতে…’ জড়ানো গলায় বলল সে৷ পুরো কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল৷

—‘রাতে এখানে এসেছিলি কেন?’

—‘কী জানি, মনে হল, কেউ ডাকছে…’ থমথমে গলায় বলল দেবায়ন৷ অন্যসময় হলে ধরেই নিতাম, আমাকে ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যে বলছে, কিন্তু এখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যিই ভয় লাগল আমার৷

—‘কে ডাকছিল?’

—‘জানি না, এই কুয়োটার ভিতর থেকে…’

মুখ তুলে কুয়োটা দেখাল সে৷ আমি এই প্রথম ভালো করে তাকালাম সেটার দিকে৷ কুয়োটা যে পরিত্যক্ত, সেটা বাইরে থেকে একবার দেখেই বোঝা যায়৷ চারপাশ জুড়ে আগাছা জন্মেছে, মাটি ছাড়িয়ে উপরে উঠে কুয়োর গোটাটাই ঢেকে ফেলেছে তারা৷ তার ফাঁক দিয়েও বেশ বোঝা যায় কুয়োটা পাথরের৷ মাথার উপরে খোলা অংশটা সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা৷ স্ল্যাবের কয়েকটা জায়গা এবড়োখেবড়ো হওয়ায় ছোট ছোট ফাঁক হয়ে আছে৷ ফাঁকের উপর চোখ রাখলাম আমি, অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না৷

—‘ছোটবেলাতেও এমন হত জানিস… মনে হত, একটা মানুষ যেন বন্দি হয়ে আছে ওর ভিতরে৷ কোনও কোনও দিন রাতে অজান্তেই হেঁটে চলে আসতাম এখানে৷ সকালে মাঠে এসে কেউ দেখতে পেয়ে বাড়ি দিয়ে আসত আমাকে… বাড়ির লোক যে কেন শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, এবার বুঝতে পারছি৷’

একটা হাত ধরে টেনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিই আমি, পিঠে একটা চাপড় মেরে বলি, ‘কুয়োর ডাকের গল্প পরে হবে না হয়, এখন পেটের ডাকে সাড়া দেওয়া দরকার, সেই কার্তিক বলে ছেলেটার তো দেখা নেই…’

—‘আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল দেবায়ন, মুখ থেকে থমথমে ভাবটা গেল না ওর, ‘কেন চলে এলাম বল তো রাতে? কে ডাকছিল?’

—‘আমার মনে হয়, ঘুমের ঘোরে কিছু স্বপ্ন-টপ্ন দেখিস তুই৷’

—‘উঁহুঁ… পরপর দু-দিন একই স্বপ্ন দেখব? তা ছাড়া স্লিপ ওয়াকিং-এর হ্যাবিট নেই আমার৷’

আর কিছু বললাম না৷ প্রসঙ্গটা আপাতত এড়িয়ে যাওয়াই ভালো৷

গেস্ট-হাউসে পৌঁছোতে দেখলাম, কার্তিক টেবিলের উপরে সকালের চা দিয়ে গ্যাছে৷ দেবায়ন জামাকাপড় ছেড়ে পরিপাটি হয়ে চা নিয়ে বসল৷ মুখ থেকে চিন্তার ছায়া কিন্তু সরেনি এখনও৷

আমি টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে বললাম, ‘কাছাকাছি শুনলাম, একটা পাহাড় আছে, আজ দুপুরের দিকে যাবি নাকি?’

—‘আমার শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না রে, মাথাটা ভার হয়ে আছে৷’

—‘সে কী! কাল রাতে তো দিব্যি ছিলি৷’

অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছিল দেবায়ন, থুতনিতে হাত রেখে কথাটা বদলে নিয়ে বলল, ‘তোকে একটা কথা বলা হয়নি৷’

—‘কী কথা?’ আমি এবার গোটা টোস্টটাই মুখে পুরলাম৷

—‘ওই কুয়োটার ভিতরে কেউ থাকে৷’

‘অ্যাঁ?’ আর-একটু হলে আমার মুখ থেকে খাবার ছিটকে বেরোত, কোনওরকমে সামলে নিয়ে বললাম, ‘তোর কি মাথাটা সত্যি গ্যাছে?’

—‘একবর্ণ মিথ্যে বলছি না, একটা বাচ্চা, আমার মতোই বয়স ছিল তার৷ আমি ওর গলার আওয়াজ শুনেছি৷’

টেবিলে চাপড় মারি আমি, ‘কোনও রাস্তার পাগলকেও এসব প্রলাপ বকতে শুনিনি আমি৷ কুয়োটা এত বছর ধরে পরিত্যক্ত, ওর ভিতরে সাপখোপও আছে কি না সন্দেহ, আর তুই বলছিস কিনা বাচ্চা…’

দেবায়ন মাথা নাড়ে, ‘তুই বুঝতে পারছিস না৷ কুয়োটার সঙ্গে যে অলৌকিক কিছু একটা জড়িয়ে আছে, সেটা আমি ছেলেবেলাতেই বুঝতে পেরেছিলাম৷ তুই চাইলে আমি প্রমাণ করে দেব৷’

—‘ইয়ারকি মারছিস আমার সঙ্গে? কী প্রমাণ করে দিবি? যে ওই কুয়োটার গভীরে একটা বাচ্চা থাকে?’

টেবিল থেকে উঠে পড়ে দেবায়ন৷ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়৷ জলার একদিকে এখন পাখির সংখ্যা কমে এসেছে, নীলচে পরিষ্কার আকাশের বুকে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে ইচ্ছেমতো৷ সেদিকে তাকিয়ে সে একটানা বলে যেতে থাকে, ‘অল্প বয়স আমার, ধর ওই আট কি নয়, বিকেল হলেই এই মাঠে এসে ফুটবল খেলতাম আমরা৷ আমি ছিলাম সব থেকে ছোট, তাই উৎসাহ ছিল সব থেকে বেশি৷ একবার পায়ে বল পড়লে আর দিগ্বিদিক খেয়াল থাকত না৷ সে সময় কুয়োর উপরের ঢাকনাটা লাগানো হয়নি৷ দৌড়োতে দৌড়োতে কখন কুয়োর একেবারে ধারে এসে পড়েছি, নিজেও বুঝিনি৷ টাল সামলাতে পারিনি, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল৷ পিছন থেকে বন্ধুদের আর্তনাদ শুনতে পেলাম, বুঝলাম, কুয়োর ভিতরে পড়ে যাচ্ছি৷ মাটিতে এসে পড়তেই মাথাটা ঠুকে গেছিল৷ কিন্তু জ্ঞান হারাইনি৷ দৃষ্টিটা একটু আবছা হয়ে গেছিল এই যা…’

কথাগুলো বলে একটু দম নিল দেবায়ন, জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর উপরে উঠলি কী করে?’

—‘বন্ধুবান্ধবরাই বড়দের ডেকে এনেছিল, ওরা একটা লম্বা দড়ি ঝুলিয়ে দেয় ভিতরে, আমি ওটা ধরেই উঠে আসি৷’

—‘কিন্তু এর সঙ্গে কুয়োর নীচে বাচ্চার…’

হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দেয় দেবায়ন, গল্প এখনও শেষ হয়নি, সে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বাকি গল্পটুকু বলতে থাকে, ‘যতক্ষণ ভিতরে ছিলাম, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, মনে হচ্ছিল কুয়োর একেবারে তলায় অনেকগুলো দরজা আছে৷ উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেওয়ালে আঁকা একটা ছবি দেখতে পেয়েছিলাম…

—‘দেওয়ালে আঁকা ছবি? কুয়োর ভিতরে! বলিস কী!’

—‘হ্যাঁ… বাচ্চারা যেমন আঁকে? কৌতূহল হতে আমি ওটার উপর হাত রাখতেই কী হয়ে গেল… কারা যেন ঘোরাঘুরি করছিল আমার চারপাশে, ফিসফিস করে কিছু বলছিল, আমারই বয়সি একটা বাচ্চার গলা৷ ছেলে না মেয়ে জানি না, গম্ভীর, অথচ কী মিষ্টি!’

লক্ষ করলাম, দেবায়নের চোখ দুটো শূন্যে হারিয়ে গ্যাছে৷ কিছুক্ষণ সেইভাবে থেকে সে আবার বলতে থাকে, ‘তারপর থেকে সারাক্ষণই মনে হয় যেন কুয়োর ভিতর থেকে কেউ ডাকছে আমাকে, কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, নীচে নামলেই দেখতে পাব তাকে… কিন্তু সাহস হত না কিছুতেই… মাঝে মাঝে সন্ধে হয়ে গেলে, মা-বাবাকে লুকিয়ে ছুটে চলে আসতাম এই কুয়োটার সামনে… একটানা তাকিয়ে থাকতাম ওই অন্ধকারের ভিতরে, যদি একবার দেখা যায় তাকে… যদি একবার ওই অন্ধকারের বুক থেকে উপরে উঠে আসে সে…’

চাপা উত্তেজনার স্রোত বইছে দেবায়নের গলার ভিতরে৷ বাতাসে কান পাতলাম আমি, দূর থেকে ভেসে-আসা কোনও ডাক শোনা যাচ্ছে কি? ঠিক বুঝতে পারলাম না৷

—‘দিনের পর দিন বেড়ে উঠছিল কৌতূহলটা, নিজের মধ্যে এমন আকুতি তার আগে কোনওদিন অনুভব করিনি আমি৷ কুয়োর পাশে পড়ে-থাকা পাথর তুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলতাম ভিতরে… সেই পাথরের প্রতিধ্বনি শুনতে পেতাম ভিতর থেকে… কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসতাম… এরকমই একদিন সন্ধে নেমে গ্যাছে, স্কুলে পরীক্ষার খাতা বেরিয়েছে সেদিন, রেজাল্ট ভালো হয়নি, মাঠে খেলতে গিয়ে অনেকখানি কেটে গ্যাছে পায়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই এসে দাঁড়িয়েছি কুয়োটার সামনে৷ মনটা ভারী খারাপ হয়েছিল৷ একদৃষ্টে কুয়োটার অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে আছি, চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল নীচের অন্ধকারে, এমন সময় মনে হল, কে সরে গেল নীচ থেকে৷’

—‘বলিস কী৷’ আমি মুখ তুলে বললাম৷

—‘এতটুকু মিথ্যে বলছি না আমি, খচখচ করে একটা আওয়াজ হচ্ছিল৷ মনে হল, কুয়োর দেওয়াল বেয়ে সে উপরে উঠে আসতে চাইছে আমার কাছে৷ তারপর থেকেই ভয় ধরে গিয়েছিল ভিতরে৷ আর যাইনি কোনওদিন৷’ আমার দিকে এগিয়ে এসে কাঁধে একটা হাত রাখল ও, ‘তুই আমার একটা কথাও বিশ্বাস করছিস না, তাই না?’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘তুই এই কুয়োটার জন্যেই এতদিন পর সরঙে এসেছিস?’

উপরে নীচে মাথা নাড়ে দেবায়ন৷ আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘বেশ, গল্প একটা আছে, তার সত্যি-মিথ্যেও যাচাই করা যাবে৷’

—‘কীভাবে?’

—‘কার্তিককে বললে একটা বড় দড়ি জোগাড় করে দিতে পারবে না?’

—‘পারবে হয়তো, কিন্তু কী হবে দড়ি দিয়ে?’

আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ‘একবার ভিতরে নেমে দেখাই যাক না কী আছে…’

এতক্ষণের উদ্বেগটা কেটে যায় দেবায়নের মুখ থেকে, তার বদলে কয়েকটা ভয়ের রেখা খেলে যায়, ‘মানে বলছিস, আমরা ওর ভিতরে নেমে দেখব? যদি কিছু গোলমাল হয়?’

—‘গোলমাল কীসের? যদি তেমন কিছু না থাকে তাহলে আবার উঠে আসব, অবশ্য সাপখোপ বা পোকামাকড়ের রিস্কটুকু নিতেই হবে৷’

দেবায়ন নিমরাজি হয় বটে কিন্তু মুখ দেখে বোঝা যায়, একরাশ অজানা দুশ্চিন্তা ঘিরে রেখেছে তাকে৷ থেমে থেমে হিসেব করে কথাবার্তা বলছে৷ দুপুর থেকে শরীরটাও খারাপ হতে থাকে ওর৷ জ্বর নেই বটে কিন্তু হাত-পা প্রচণ্ড দুর্বল৷ খাওয়া-দাওয়াও করেনি৷ কার্তিককে বলা ছিল, বিকেলের আগেই একটা মিটার দশেক লম্বা দড়ি রেখে গ্যাছে ঘরের এককোণে৷ একটু অবাক হয়েছে ছেলেটা৷

মুশকিল হল দেবায়নকে নিয়ে৷ বিছানা থেকে নামার ক্ষমতা নেই, এদিকে জেদ আছে ষোলোআনা৷ যেভাবে হোক আজই কুয়োর ভিতরে নামতে হবে তাকে৷ ব্যাপারটা বিপজ্জনক, এই অবস্থায় যদি দড়ি ধরে কোনওরকমে নামতেও পারে, উঠে আসার সময় হাতে জোর না পেলে এক কাণ্ড হবে৷ অনেক বোঝানোর পর শেষে ঠিক হল যে সে ঘরেই থাকবে৷ আমিই নেমে দেখে আসব কুয়োর ভিতরটা৷ সঙ্গে মোবাইল থাকবে, তাতে করে কিছু ছবি তুলে আনব ওর জন্য৷

(দুই)

গ্রামের দিকে লোকজন সন্ধে হলেই ঘরে ঢুকে পড়ে৷ তারপর থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়৷ গেস্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে যখন মাঠের উপর পৌঁছোলাম তখন মিহি শীতের কুয়াশা নেমেছে৷ পায়ের নীচের ঘাসগুলো শিশিরে ভিজে গ্যাছে৷ হাতে বড়সড় দড়িটা ঝুলিয়ে হাঁটতে লাগলাম৷ দূরে মাঠ আর ঘরবাড়ি পেরিয়ে দিগন্তরেখার কাছে দৈত্যের মতো জেগে-থাকা কিছু গাছ চোখে পড়ছে৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন বিশেষ একটা ইঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে তারা৷ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কুয়োটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি৷ দড়িটা মাটিতে বিছিয়ে রেখে দুটো হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে ফেললাম সিমেন্টের স্ল্যাবটা৷ ভারী শব্দ করে মাটির উপর এসে পড়ল সেটা৷ দড়িটা শক্ত করে বেঁধে ফেললাম স্ল্যাবটার সঙ্গে৷

পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বড় করে নিশ্বাস নিলাম৷ বুকের ভিতরটা কেন জানি না শুকিয়ে যাচ্ছে৷ মন বলছে, ভিতরে কিছু নেই, তা-ও একটা চাপা অস্বস্তি বারবার এসে গ্রাস করছে আমাকে৷

আকাশ ঝকঝকে৷ একচিলতে মায়াবী রূপালি চাঁদ উঠেছে আজ৷ মাঝ-আকাশে থমকে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে৷

কুয়োর প্রান্তের উপরে বসে দড়িটা শক্ত করে চেপে ধরলাম আমি৷ তারপর দুটো পা ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যে৷ কত গভীর হবে কুয়োটা? দেবায়নের আন্দাজে মিটার পনেরোর বেশি নয়৷ একটু একটু করে নীচে নামতে লাগলাম৷

কুয়োর ভিতরের দেওয়ালে পা রাখার মতো খাঁজ আছে মাঝে মাঝে৷ সেগুলোতে পা আর দড়িতে হাত রেখে কিছুটা নীচে নেমে আসতে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, পায়ের নীচে আর দড়ি নেই৷ অর্থাৎ প্রায় দশ মিটার নেমে এসেছি৷ ছোট একটা লাফ দিয়ে চোখ বুজে নিলাম৷

পায়ে সজোরে একটা ধাক্কা লাগতে বুঝলাম নীচে এসে পড়েছি৷ মাটির উপরের আওয়াজ কমে এসেছে এখানে৷ পোকামাকড়ের শব্দ প্রায় শোনা যাচ্ছে না৷ কোমরে জড়ানো ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে জ্বাললাম, কুয়োর ভিতরের দিকের দেওয়ালটা মাকড়সার ঝুলে ঢাকা, এগিয়ে গিয়ে দু-হাতে ঝুলগুলো সরাতেই দেওয়ালের একটা অংশে চোখ আটকে গেল৷

হ্যাঁ, সত্যিই লালচে রঙের শুকনো কালির রেখায় একটা মানুষের ছবি আঁকা আছে সেখানে৷ ঠিক যেন একটা বছর দশেকের বাচ্চা কাঁপা কাঁপা হাতে ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে দেওয়ালে৷ টর্চটা বাঁহাতে ধরে ডান হাত দিয়ে সেটার মাথার কাছটা স্পর্শ করতেই মাথাটা দুলে উঠল আমার৷ যেন মিষ্টি গন্ধের পারফিউমের বোতল হঠাৎ খুলেছে কেউ৷ উপরে তাকাতে মনে হল, গোটা আকাশটা যেন কুয়োর খোলা মুখের উপরেই নেমে এসেছে৷ বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা তরঙ্গ খেলে গেল আমার শরীরে৷ কুয়োর গোল দেওয়ালটা যেন চতুর্দিকে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে৷ মাটির তলায় লুকোনো একটা বিরাট হলঘরের ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছি৷

বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল৷ নিজের চোখে যা দেখছি, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না৷ কোথা থেকে আবছা হলদে আলো ভেসে এসে ভরিয়ে তুলেছে আমার চারদিক৷ খেয়াল করলাম, আমার চারপাশের দেওয়াল জুড়ে সারি সারি ছবি খোদাই করা৷ যেন কুয়োর ভিতর থেকে এসে দাঁড়িয়েছি কোনও এক আদিম গুহায়৷ কলকল করে বয়ে-যাওয়া জলের শব্দ৷ কান পাতলে শোনা যায়, তার মধ্যে মিশে আছে মানুষের গলার আওয়াজ৷ পৃথিবীর অতল গহ্বরে নিমজ্জিত কোনও খাদের ভিতর থেকে একযোগে আর্তনাদ করে চলেছে বহু মানুষ৷

হতভম্বের মতো এগিয়ে দিয়ে দেখতে লাগলাম সেই গুহাচিত্রের সার, এ কোথায় এসে পড়েছি আমি? সত্যি কি একসময় মানুষ থাকত এখানে? যারা থাকত, তারাই বা গেল কোথায়?

হঠাৎ মনে হল, দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো নিছক আঁকিবুকি নয়, নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্ন আছে তার, তার থেকেও বড় কথা, একটা বিশেষ মানুষের ছবি যেন বারবার ফিরে এসেছে৷ দেওয়াল জুড়ে ছবির মাধ্যমে একটা গল্প ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন শিল্পী, পরপর প্যানেলগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে গল্পটা বোঝার চেষ্টা করলাম আমি… অনেকগুলো মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, তাদের ঠিক মাঝবরাবর একটা বড়সড় গর্ত, সেই বিরাট গর্তটার দিকে তাকিয়ে আছে তারা… তার পরের ছবিটায়…

পিছন থেকে মেয়েলি গলার শব্দ ভেসে আসতে আমি চমকে পিছন ফিরলাম, হাত থেকে ছিটকে পড়ল টর্চটা৷ টর্চটা তুলতে নীচু হতেই একটা নরম হাতের স্পর্শ আমার কাঁধ ছুঁয়ে গেল৷

—‘কে? কে এখানে?’ চিৎকার করে উঠলাম৷

মিহি ব্যঙ্গের হাসি শোনা গেল, ‘নিজেই এসেছ আমার কাছে, আবার জিজ্ঞেস করছ আমি কে?’

—‘এখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে না… কে তুমি?’

—‘আমি তো বলিনি আমি মানুষ…’ রিনরিনে বাঁশির মতো গলা৷

—‘তবে কী তুমি?’

কয়েক সেকেন্ড পরে উত্তর আসে, ‘গলা শুনে মনে মনে কিছু একটা ভেবে নাও, যা ভাববে, আমি তা-ই…’

গলাটা ঠিক কোথা থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে গন্ধটা….

এই কি তবে কুয়োর ভিতরে থাকে? আজ এতদিনে তার বয়সও বেড়ে গিয়েছে? হায় ভগবান৷ এ-ও কি সম্ভব?

—‘কবে থেকে এখানে আছ তুমি?’ আমি কাঁপা-কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম৷

—‘কয়েক লক্ষ বছর… কয়েক কোটিও হতে পারে, সময়ের হিসেব আমি আর বুঝতে পারি না…’

মেয়েটার গলা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা হল জুড়ে, আমি পিছিয়ে এসে দেওয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়ালাম, ‘কী করো তুমি এখানে?’

—‘অপেক্ষা…’

—‘কার?’

এবার আর উত্তর এল না, তার বদলে মৃদু একটা চাপ পড়ল আমার হাতে, ‘এসো আমার সঙ্গে৷’

—‘কোথায়?’

—‘এসো-না…’

আমি আপত্তি করতে পারলাম না৷ সে আমাকে টেনে নিয়ে চলল অজ্ঞাতের দিকে, তাকে দেখতে পাচ্ছি না, তার নিশ্বাসের শব্দ নেই৷ শুধু আঙুলে অনুভব করছি পেলব হাতের এক অমোঘ টান৷ সে টান উপেক্ষা করা যায় না… কিছু দূর আসার পর দাঁড়িয়ে পড়ল সে, আবার সেইরকম মিহি গলা শোনা গেল, ‘দ্যাখো, কী আছে তোমার সামনে…’

হাত থেকে কখন যেন আলগা হয়ে এসেছে টর্চটা৷ আমার ঠিক সামনে একটা নীলচে আলো ফুটে উঠছে এবার, নিরেট পাথরের দেওয়াল চোখে পড়ছে৷ তার উপরে আবার সেই আগের মতো ছবি আঁকা আছে, একটা-মাত্র ছবি, দু-জন মানুষকে পাশাপাশি আঁকতে চেয়েছে কেউ৷ তার মধ্যে একজন পুরুষ, অন্যজনের মাথা থেকে নেমে এসেছে ঝালরের মতো চুল, আকাবাঁকা রেখায় ফুটে উঠেছে তার সরু চোখের কোণ, সে নারী, একটা হাত দিয়ে পুরুষটির আঙুল স্পর্শ করে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে কোথাও, যেদিকে তারা হাঁটছে, ঠিক সেইদিকে একটু দূরে অস্পষ্ট রেখায় আঁকা হয়েছে একটা ফুল, যেন ওই ফুলটার দিকে পুরুষটিকে ডেকে নিয়েছে চলেছে নারীটি, ঠিক একটু আগে আমি চলেছিলাম যেভাবে…

—‘আমি? আমার জন্য তুমি…’

এত লক্ষ বছর ধরে কি তবে আমার জন্যেই অপেক্ষা করে চলেছে সে?

অন্ধকার এখনও ঢেকে রেখেছে তার মুখ, বাঁশির মতো গলায় গুনগুন করে শব্দ করছে সে৷ সেটা সুর না মন্ত্র, আমি বুঝতে পারলাম না৷

—‘আমার জন্য এত বছর অপেক্ষা করছ তুমি! কিন্তু কেন?’

—‘জানি না কেন’ খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করেছে মেয়েটি৷ অন্ধকার-জড়ানো দুটো হাত দিয়ে টানছে আমাকে৷ কোথায় নিয়ে যাবে? তার অদৃশ্য শরীরের টান আমাকে আর স্থির থাকতে দিল না৷ হাতের টর্চটা সামনে তুলে ধরে আলো জ্বাললাম৷ সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল উচ্ছল হাসির আওয়াজ…

কোথাও কেউ নেই…

কুয়োর ভিতরের সেই মাকড়সার ঝুলে ঢাকা গোল দেওয়ালের একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি৷ মুখ তুলে উপরে তাকালাম৷ প্রথমে দেখা সেই লালচে রেখার ছবিটা এখনও দেখতে পাচ্ছি দেওয়ালে, সেটা ছাড়া বাকি সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গিয়েছে৷

তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ? নাঃ, তা হতে পারে না, মাথার ভিতরে এখনও সেই সম্মোহনী কণ্ঠ বেজে চলেছে৷ হাতের আঙুলে এখনও লেগে আছে তার ছোঁয়া৷ এ স্বপ্ন নয়, কিছুতেই স্বপ্ন নয়৷ দেওয়ালে আঁকা ছবিটার উপরে আবার হাত রাখলাম৷ একটু পিছিয়ে এসে জোর গলায় ডাক দিলাম, ‘কোথায় চলে গেলে তুমি?’ ফাঁকা কুয়োর ভিতরে ডাকটা প্রতিধ্বনিত হল৷ টর্চটা আবার চারদিকে ফিরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলাম৷ মাকড়সার জালের ফাঁকে ফাঁকে কিছু গুল্মলতা আর বুনো ফুল ফুটেছে৷ আর কিছু নেই৷ সে হারিয়ে গিয়েছে৷

ঝুলন্ত দড়িটা ধরে পাথরের খাঁজে পা রেখে রেখে উপরে উঠে এলাম আমি, এর মাঝে কতক্ষণ কেটেছে, জানি না৷ বাইরে বেরিয়ে ফাঁকা মাঠের ঘাসে পা রাখতেই মনে হল অন্য একটা জগতে এসে দাঁড়িয়েছি, এ জগৎটা আমার নয়৷ উপরে তাকালাম৷ আকাশের সরু চাঁদটা এখন ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷

দড়িটা গুটিয়ে নিয়ে গেস্ট-হাউসের দিকে হাঁটতে লাগলাম৷ এক অদ্ভুত মোহাচ্ছন্নভাব এসে বার-বার পথ ভুলিয়ে দিচ্ছে আমাকে৷ দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি গেস্ট-হাউসটা অথচ বার-বার অন্যদিকে চলে যাচ্ছি৷

মনে হচ্ছে, এখনও অদৃশ্য কেউ হেঁটে চলেছে আমার পাশে৷ তার পায়ের শব্দ নেই, নিঃশ্বাসের শব্দও নেই… তবু সে আছে…

(তিন)

—‘কিচ্ছু দেখিসনি!’ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকায় দেবায়ন, ‘মানে দেওয়ালে কিছুই ছিল না?’

—‘কে বলেছে, ছিল না? মাকড়সার ঝুল ছিল, চামচিকে ছিল, বাদুড় ঝুলে ছিল… কতবার তোর কথা জিজ্ঞেস করল…’

—‘তার মানে আমি ভুল দেখেছিলাম?’ বিড়বিড় করে বলল দেবায়ন৷ আমি একটু বাঁকা স্বরে বললাম, ‘তোর বিশ্বাস না হয়, নিজেই গিয়ে দেখে আসিস না হয় আজ, যদিও তোর শরীরের যা অবস্থা…’

—‘নাঃ… অবিশ্বাসের কী আছে?’ কথাটা বলে কনুইতে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে৷ তারপর রুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়, সে বেরিয়ে যেতেই আমি সামনে রাখা ল্যাপটপটা অন করে নিই৷ মোবাইলটা তুলে নিয়ে বিশেষ একটা নম্বর ডায়াল করতে থাকি, ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয় ‘এত সকালে৷ কী ব্যাপার?’

—‘আমি তোকে মেইলে কতকগুলো ছবি পাঠিয়েছি, ওগুলোর মানে বলতে হবে আমাকে৷’

—‘ছবির মানে৷ দাঁড়া, দেখছি৷’

ঘড়ঘড় করে একটা আওয়াজ শোনা যায় ওপাশ থেকে, কয়েকটা যান্ত্রিক শব্দ, প্রায় দু-মিনিট পর গলা ভেসে আসে ‘তুই তো পুরুলিয়া গিয়েছিলিস, ওখানে গুহা-টুহা আছে নাকি?’

—‘জাস্ট টেল মি দ্য মিনিং…’

—‘তুই এত চটছিস কেন? গিভ মি আ মোমেন্ট৷’

নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকি আমি, বুকের ভিতরে চাপাস্বরে ড্রাম বাজাতে শুরু করেছে কেউ৷ সেটা চাইলেও উপেক্ষা করতে পারছি না৷

—‘এগুলো অনেকটা কেভ পেন্টিং-এর মতো৷ কিন্তু একটা বেসিক ডিফারেন্স আছে৷’

—‘কীরকম ডিফারেন্স?’

—‘আমি আজ অবধি যা কেভ পেন্টিং দেখেছি, সেগুলো আদিম মানুষের সূক্ষ্ম হাতের কাজ৷ এই ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে কোনওরকমে আঁকা৷ আদিম মানুষের জীবনে অত তাড়া ছিল না, স্ট্রেঞ্জ!’

—‘মানে কী এগুলোর?’

—‘মানে এরকম ইন্সট্যান্টলি বলা সম্ভব নয়, ছবিগুলো অনেকটা কার্টুন ফর্ম্যাটের৷ সঙ্গে কিছু সিম্বলও আছে৷ তবে সব মিলিয়ে যদ্দুর মনে হয়, একটা মেয়ের কথা বলা হচ্ছে৷’

—‘কীরকম মেয়ে?’

—‘আই ডোন্ট নো, এনগ্রেভিংসগুলো তেমন স্পষ্ট নয়, তা ছাড়া আলোও কম, আর একটু ক্লোজলি দেখতে হবে, তুই এগুলো পেলি কোথায় বল তো?’

ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিলাম আমি, ওপাশ থেকে আবার গলা শোনা যায়, ‘দেয়ার ইজ সামথিং এলস…’

—‘কী?’

—‘যদি খুব ভুল না দেখে থাকি তবে এখানে একটা র‌্যাটল স্নেক আঁকা আছে, তিন নম্বর ছবিটার কোণের দিকে…’

—‘র‌্যা… টল স্নেক৷’ ছবিটা খুঁজে নিয়ে আমিও অবাক হয়ে যাই৷ একটা সাপের ল্যাজের ডগায় ঝুমঝুমি জাতীয় কিছু একটা বাঁধা আছে৷

—‘কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে র‌্যাটল স্নেকের সম্পর্ক কী?’

—‘আমার মনে হয় সাপটা এখানে সিম্বলিক৷ র‌্যাটলের ল্যাজের ডগায় যে ঝুমঝুমিটা বাঁধা থাকে, ওটা অন্য প্রাণীদের জন্য একটা ওয়ার্নিং হিসেবে কাজ করে, ওই ঝুমঝুমির শব্দ আসছে মানে কাছেপিঠে একটা র‌্যাটল স্নেক আছে, আমার মনে হয় র‌্যাটল স্নেক এঁকে কেউ ওয়ার্নিং বোঝাতে চেয়েছে… কিন্তু তুই…’

আর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলাম আমি৷ দেবায়ন চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকছে৷ আমার কাপটা সামনে রেখে সে বলল, ‘শরীরটা কালকের তুলনায় একটু চাঙ্গা লাগছে৷ কাল পাহাড়ে যাবি বলছিলি না? আজ দুপুরের দিকে বেরোব না হয়…’

—‘তুই যাস, আমার একটু কাজ আছে…’

—‘কাজ! এখানে আবার কী কাজ তোর?’

আমি জোর করে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলাম, ‘দেখি, স্থানীয় লোকজনের থেকে একটু মহুয়া-টহুয়া জোগাড় করা যায় কি না… তোর তো আবার ওসব চলে না…’

দেবায়ন মাথা নাড়ে, ‘একা একা পাহাড়ে উঠে মজা নেই, জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে গেলে এক কেলো হবে৷ একটা গাইড জোটাতে হবে৷’ কথাগুলো বলে আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকাল সে, তারপর কিছু একটা লক্ষ করে বলল, ‘তোরও আবার জ্বর-ট্বর হল নাকি?’

—‘কেন বল তো?’

—‘মুখ-চোখ বসে গেছে৷’ আমার কপালে হাত রাখল সে, ‘নাঃ, জ্বর তো নেই৷ তাহলে?’

আমি মুখ বাঁকালাম, ‘কাল থেকে ধকল কম গেছে নাকি? তার উপরে তোর জন্য আবার এই বয়সে কুয়োর মধ্যে নামতে হল৷ হাত-পা সব ব্যথা হয়ে রয়েছে… ভালো কথা…’ আমি বাইরে একবার উঁকি দিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতের দড়িটা আছে তো?’

—‘কার্তিককে বলেছি সকালে, সন্ধ্যায় নিয়ে যাবে…’

—‘না না৷’ আমি হাত তুলে বললাম, ‘আমরা যতদিন আছি, এখানেই না হয় থাক ওটা…’

আমার কথায় দেবায়ন একটু অবাক হল বটে কিন্তু আপত্তি করল না৷ মিনিট কুড়ি পরে সে জুতো পরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷ আমি টানটান হরে বিছানার উপরে শুয়ে পড়লাম৷ সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, কিন্তু খিদে পাচ্ছে না আমার৷ কাল সারারাত ঘুম হয়নি অথচ এতটুকু ক্লান্তি অনুভব করতে পারছি না৷ আশ্চর্য!

যতক্ষণ চোখ খুলে আছি, ততক্ষণ মনে হচ্ছে, ভিতর থেকে কেউ ডেকে চলেছে৷ কাল রাতে কুয়োর ভিতরে যার সঙ্গে পরিচয় হল আমার, সে কে? কয়েক লক্ষ বছর ধরে কেন সে অপেক্ষা করে চলেছে আমার জন্য, দেওয়ালে আঁকা ওই ছবিগুলোরই বা অর্থ কী?

ল্যাপটপ খুলে আবার ছবিগুলো দেখতে লাগলাম৷ সেগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল চাইলেও ছবিগুলোর উপর থেকে চোখ সরাতে পারব না আমি, একটানা তাকিয়ে আছি, চোখের পাতা পড়ছে না, বেশ বুঝতে পারছি, এতক্ষণ উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে চোখের শিরা-উপশিরা লাল হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম করেছে৷ জল পড়ছে অথচ শত চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারছি না৷

হঠাৎ, একদলা অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার সামনে৷ মনে হল, দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নেমে গিয়েছে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে৷ কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিনটাই বা নিবে গেল কী করে?

মন দিয়ে কান পেতে শুনতে পেলাম, ঘরের দরজায় আঙুলের টোকা পড়ছে৷ আমাকে দরজা খুলতে বলছে কেউ৷ দেবায়ন কি ফিরে এল?

বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম আমি৷ বাইরেটাও ভিতরের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে৷ গেস্ট-হাউসের কিছু দূরে জলাভূমির উপরে রোজ যে জোনাকি দেখা আজ তারা সবাই যেন মরে গেছে৷ নিশ্ছিদ্র নিকষ অন্ধকার৷ তা-ও, মনে হল, আমার সামনে জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে একদৃষ্টে৷

—‘কে?’ অন্ধকারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি৷

—‘অচেনা কেউ নই… আমি…’

আবার সেই গলা৷ কাল রাতে কুয়োর ভিতরে এই গলাটাই শুনেছিলাম৷ পিছিয়ে এলাম, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না, ‘তুমি৷ তুমি এখানে এলে কী করে?’

—‘আসতে তো বারণ করোনি…’

তার গলায় মেশানো মৃদু ছলনা গিয়ে লাগছে আমার বুকের ভিতরে, সে জানে, ঠিক কোন কথাটা বললে আমার বুকের ভিতরে সংকোচ আর ভয়ের পাঁচিলটা ভেঙে পড়বে৷

—‘কিন্তু… কী চাও তুমি?’

—‘তোমার কাছে আসতে, ঠিক এইভাবে…’

আবার আমার হাতে আঙুলের ছোঁয়া লাগল৷ প্রজাপতির ডানার মতো মসৃণ স্পর্শ৷ আমার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার মোহজাল, ক্রমশ নিজের দিকে আমাকে টানছে সে, ‘আসবে না আমার সঙ্গে?’

—‘কোথায়?’

—‘যেখানে আমি থাকি?’

—‘সেখানে তো অন্ধকার… তোমাকে দেখতে পাই না আমি…’

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে, পরমুহূর্তে গলা আরও নরম হয়ে আসে তার, ‘আসলে তোমার চোখ সয়নি এখনও৷ একবার সয়ে যাক, তারপর দেখতে পাবে আমাকে…’

পাবে বুঝতে পারছি এ অলৌকিক, এ অসম্ভব, তা-ও একটা অমোঘ আকর্ষণ আমাকে নিজের মধ্যে থাকতে দিচ্ছে না৷ আমি জানি না সে কী চায়, কোথায় নিয়ে যেতে চায় আমাকে, শুধু জানি, আমি তাকে চাই, সে যেখানে নিয়ে যাবে, আমি সেখানেই যেতে রাজি৷

—‘নিয়ে চলো, নিয়ে চলো আমাকে…’ হাতের উপর আর নিয়ন্ত্রণ নেই আমার৷ সে আবার হেসে উঠছে আগের মতো৷ আবার গোটা ঘর ভরে গেছে সেই মিষ্টি গন্ধে৷ আমি দু-হাতে শক্ত করে ধরে আছি তার দুটো কোমল হাত৷ মনে হল, আরও পাঁচটা আঙুল এসে পড়েছে আমার কপালে, পিঠে আঙুলের ছোঁয়া পাচ্ছি, বুকের উপর একটা হাত… পায়ে, গলায়… এ কী করে সম্ভব!

একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার গলা দিয়ে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলাম বিছানায়…

ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে বাইরে থেকে৷ গোটা ঘর এখন ফাঁকা৷ জানলা দিয়ে বাইরের বারান্দার হলদে আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে৷ সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধটাও মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়৷

দ্রুতপায়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ জলার উপরে জোনাকি দেখা যাচ্ছে এখন৷ হাওয়ার সঙ্গে মিশে মৃদু গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে৷ কোথাও কোনও মানুষের চিহ্ন নেই৷ বারান্দার এককোণে বড় দড়িটা চোখে পড়ল৷ এগিয়ে সেটা হাতে তুলে নিলাম আমি৷

তারপর খালি গায়েই হেঁটে এলাম মাঠে৷

একটা ডাক শুনতে পাচ্ছি, ওই কুয়োটার ভিতর থেকে কেউ একটানা ডেকে চলেছে আমাকে৷ চাইলেও সেটাকে উপেক্ষা করতে পারব না আমি৷ আমার সমস্ত শরীর-মন জুড়ে শুধু তার অধিকার, আমি নিজে আর নিজের মধ্যে নেই…

স্ল্যাবটা নীচে নামিয়ে আবার পাথরের দেওয়াল বেয়ে নেমে এলাম৷ ঘুমন্ত পৃথিবীর সমস্ত শব্দ আবার নিবে এল, বেড়ে উঠল শুধু সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধটা৷ আজ আকাশের চাঁদ ঢাকা পড়ে গিয়েছে৷ আকাশটাও যেন ভয়ে মেঘের চাদর জড়িয়ে নিয়েছে মুখে৷

—‘তুমি এসেছ?’ গলাটা শুনে ফিরে তাকালাম৷ মনে হল, একটু দূরে একটা পাথরের উপরে বসে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এবার আবছা দেখতে পাচ্ছি তাকে৷ লম্বা একটা শরীর, সাদা কুয়াশার চাদর দিয়ে যেন ঢাকা৷ হাঁটু অবধি নেমে সেই চাদর ছেঁড়া মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়েছে৷

—‘এসেছি, বলো কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?’

মনে হল, সে কাতর দৃষ্টি মেলে চেয়েছে আমার দিকে, ‘ও মা৷ আমি কখন বললাম তোমাকে নিয়ে যাব কোথাও?’

—‘স্বপ্ন দেখলাম…’ থেমে থেমে উচ্চারণ করলাম আমি৷ সে আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, ঠিক স্বপ্নে যেমন হেসেছিল, ‘আমাকে স্বপ্নে দেখেছ বুঝি?’

আমি উত্তর না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ একটা আলো হাতে ছুটে গিয়ে তার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু জানি, তাকে আমি ততটাই দেখতে পাব, যতটা সে নিজে দেখাতে চায়৷

—‘আমি কোথাও নিয়ে যেতে চাই না তোমাকে, তোমাকে ফিরিয়েই দেব আমি, শুধু…’

আসার সময় আমার প্যান্টের পকেটে থেকে গিয়েছিল ফোনটা৷ এখন মনে হল, বেজে উঠছে সেটা৷ কান দিলাম না৷

—‘শুধু একটা জিনিস দিতে চাই তোমাকে… এত বছর ধরে আগলে রেখেছি শুধু তোমার জন্যে…’

ফোনটা কেটে গিয়ে আবার বাজছে৷ আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম, সেই কুয়াশার চাদর ছিড়ে একটা হাত এগিয়ে এসেছে আমার সামনে৷ হাতের আঙুলে ধরা একটা ফুল৷ অনেকটা রজনিগন্ধার মতো দেখতে ফুলটা৷ সেটা আমার দিকে এগিয়ে ধরেছে সে, ‘নেবে না?’

ফোনটা বেজে চলেছে… বেজে চলেছে… বেজে চলেছে…

রাগে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল আমার, পকেট থেকে বের করে রিসিভ করলাম ফোনটা, ওপাশ থেকে দুপুরের গলাটা শোনা গেল,

—‘কোথায় আছিস তুই?’

—‘একটা কাজে আছি, কল মি লেটার৷’

—‘না, শোন৷’

—‘কী হল? নেবে না?’

আমি ফোনটা রেখে দিতে গিয়েও রাখলাম না৷ সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম মাটিতে, কলটা কাটেনি, ওপাশ থেকে এখনও গলা ভেসে আসছে, ….‘আজ গোটা দুপুর ধরে ছবিগুলোর মানে খুঁজে বের করেছি আমি, ছবিতে কোনও মেয়ের কথা বলা হয়নি…’

আমি তার হাতের কাছে এগিয়ে গিয়ে নিয়ে নিলাম ফুলটা, একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল আমার সমস্ত হাতে, যেন বিষাক্ত কাঁটা এসে ঢুকেছে হাতের তালুতে৷

…‘বলা হয়েছে একটা ফুলের কথা৷ পৃথিবী থেকে লক্ষ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ফুল৷ যার একটা স্পেশাল এবিলিটি আছে৷ ইউ লিসনিং? ক্ষমতাটা ভয়ানক…’

এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার মুখ, কী অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটো তার, বুকের ভিতর অবধি গিয়ে আছড়ে পড়ছে সেই চাহনি, ফুলের নরম পাপড়ির মতো কোমল দুটো ঠোঁট…

…‘ফুলের মিষ্টি গন্ধ হয় পতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য, পতঙ্গের পায়ে লেগে-যাওয়া রেণু দিয়ে বংশবিস্তার করে ফুল, কিন্তু এখানে যে ফুলের কথা বলা হয়েছে, সে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে একটি মেয়েকে৷ মিষ্টি গন্ধের মতোই মেয়েটিকে কাজে লাগিয়ে শিকারকে কাছে টেনে আনে… তারপর তার শরীরের ভিতরেই বুনে দেয় তার পরবর্তী প্রজন্মের বীজ… মনের দখল নেয় একটু একটু করে৷ শিকারের মৃত্যু হলে তার শরীর মাটিতে মিশে গেলে সেখান থেকে আবার জন্ম নেয় নতুন ফুল… এভাবেই বংশবিস্তার করে এরা…’ এতক্ষণে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গিয়েছে সে৷ ঠিক যেন মোমের একটা মূর্তি, মনে হল, আমার হাত দিয়ে মিহি রক্তের ধারা নামছে৷ দুটো হাত এনে রাখলাম তার গালে৷ আঃ, এমন স্পর্শ যদি মৃত্যুর হয় তাহলে….

…‘যতক্ষণ এর গন্ধ তোর নাকে আসবে, তুই অন্য একটা জগতে চলে যাবি৷ মনে হবে একটা গুহার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছিস তুই৷ যে ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়েছিস, সেগুলো এর আগের শিকাররাই গুহার দেওয়ালে এঁকে এই ফুল সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছিল আমাদের৷ আমাদের পূর্বপুরুষরা… ঠিক কী কারণে এই ফুল পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তা আর জানা যায় না৷ তুই ছবিগুলো তুলতে পেরেছিস মানে ইউ আর ইন ডেঞ্জার… আর ইউ দেয়ার? হ্যালো… সায়ন্তন…’

আমার দু-হাতের মাঝখান থেকে মিলিয়ে আসছে সে৷ ঠিক ভোরের কুয়াশার মতো৷ মন বলছে, আর কোনওদিন দেখা হবে না এই মেয়েটির সঙ্গে, চিরকালের মতো আমার সামনে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সে…

(চার)

—‘আপনিই দেবায়ন ঘোষ?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

—‘আজ সকাল থেকে আপনার বন্ধু সায়ন্তন বসুকে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ কেউ বলছে তাকে ভোরবেলা সবুজ টি-শার্ট পরে গঙ্গার দিকে হেঁটে যেতে দেখা গিয়েছে৷ আপনার কি মনে হয়, উনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন?’

—‘যে সায়ন্তনকে আমি চিনতাম, সে অনেককাল আগেই মারা গেছে, তার খোলসের ভিতরে যে বেঁচে ছিল, সে আত্মহত্যা করে থাকলে আমি অন্তত আশ্চর্য হব না৷’

—‘মানে?’

—‘ছ-মাস আগে আমরা দু’জনে মিলে সরঙে ঘুরতে যাই, দিন তিনেকের ছুটিতে ট্যুর আর কী, ওখান থেকে ফিরেই কেমন বদলে যায় সায়ন্তন, ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করত না, ঘুমোত না, বন্ধুবান্ধব এমনকী বাড়ির লোকের সঙ্গেও তেমন কথাবার্তা বলত না৷ মানুষটা বোধহয় তখন থেকেই মরে গিয়েছে৷ ইদানীং তেমন খোঁজখবর রাখিনি আমি৷’

—‘এই ট্যুরে কিছু হয়েছিল? মানে মানসিক আঘাতজাতীয়?’

—‘আমার তো জানা নেই, তবে কুয়োর ভিতর নামতে গিয়ে হাতে কেটে গিয়েছিল বেশ খানিকটা, সেটা ঠিকও হয়ে যায় পরে…’

—‘কুয়োর ভিতর নেমেছিলেন কেন?’

—‘আমরা অ্যাডভেঞ্চারার টাইপের ছিলাম, খেয়াল বলতে পারেন…’

—‘ওঁর টেবিল থেকে এই ছবিগুলো পেয়েছি আমরা, কেভ পেন্টিং-এর ফোটোগ্রাফ মনে হয়, শেষ ক-দিন নাকি এগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকতেন সারাদিন… দেখুন তো চেনেন কি না…’

—‘উঁহুঁ.. নো আইডিয়া…’

(পাঁচ)

গঙ্গার ঘাট এখন ফাঁকা৷ দুপুরের রোদ ঝলমল করছে ঘোলাটে জলের উপরে৷ হাতের রুমাল দিয়ে মুখটা মুছল দিয়া৷ তারপর পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বের করে ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করল৷ গঙ্গার জলটা পিছনে রেখে একটা সেলফি৷ পছন্দ হল না৷ ঘাটের ঠিক নীচেই নদী থেকে ভেসে-আসা মাটি স্তূপ রাখা৷ ব্যাকগ্রাউন্ডটা নষ্ট করছে সেটা৷

ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য অ্যাঙ্গল থেকে ছবিটা তুলতে যাচ্ছিল দিয়া৷ এমন সময় চোখে পড়ল জমা করে রাখা মাটির ভিতরে কিছু একটা গেঁথে আছে৷ কৌতূহল হতে নীচে নেমে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারে, একটা ছেঁড়া সবুজ টি-শার্ট৷

সে মুখ ঘুরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, এমন সময় অন্য একটা জিনিসে চোখ আটকে যায়৷ ঘাটের একদিকের মাটির উপর একঝাঁক ফুল ফুটে আছে৷ সাদা ফুল, অনেকটা রজনিগন্ধার মতো দেখতে৷ মৃদু হাওয়ার ধাক্কায় মাথা দোলাচ্ছে তারা৷

মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে সেখান থেকে৷

ফুলগুলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে আর-একটা সেলফি তুলতে যাচ্ছিল দিয়া, হাত কেঁপে যেতে ছবি ঝাপসা হয়ে গেল৷ ডিলিট করে আবার তুলতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে একটা ভারী পুরুষালি গলা শুনতে পেল সে, ‘মে আই হেল্প?’

ঘুরে দাঁড়িয়ে দিয়া দেখল, ভারী সুন্দর দেখতে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ঘাটের একেবারে উপরে৷ ঠোঁটের কোণে এত মিষ্টি একটা হাসি লেগে আছে যে নিজে না হেসে থাকতে পারল না৷

ছেলেটা বলল, ‘আপনি বরঞ্চ একটা ফুল তুলে হাতে নিয়ে দাঁড়ান, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি৷’

‘গঙ্গার পাড়ে এলেই ছবি তুলতে ইচ্ছা করে…’ লাজুক হাসে দিয়া৷

‘আই নো…’ ফোনটা নিয়ে ছেলেটা ছবি তোলার জন্য পিছিয়ে যায়৷ সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নীচে নেমে ফুল তুলতে যায় দিয়া৷ ফুলের ভিতর কাঁটার মতো কিছু ফুটে যায় হাতে…

মিষ্টি ফুলের গন্ধটা বেড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *