কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
মহীতোষের ডায়রির কয়েকটা পৃষ্ঠা। সেই ডায়রি থেকে থানার দারোগা ইউসুফ তাঁর এক বন্ধুকে যেমনটি বলেছিলেন তার জবানিতে:
ভয়ে গা’টা একেবারে কাঁটা দিয়ে উঠল মহীর।
তার সহজ বুদ্ধি-বিবেচনা ও বিচার দিয়ে বুঝতে পারছে, এমনটি হতে পারে না, হওয়া সম্ভবও নয়। তথাপি দু-চক্ষু দিয়ে একটু আগে যা সে দেখেছে, সেটাকে অস্বীকারই বা করে কি করে? এবং একেবারে ভূতুড়ে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়েই বা দেয় কি করে?
কিন্তু আশ্চর্য! ভাবতে গেলে এখনো গা’টা যেন শিরশির করে উঠছে; গায়ের লোমগুলো সোজা হয়ে উঠছে। টেবিলের উপরে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পের শিখাটা আরো একটু উস্কিয়ে দিল মহী। আলোর শিখাটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই উজ্জ্বল আলোয় তীক্ষ্ণ প্রখর অনুসন্ধানী চোখে আরেকবার মহী ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরের প্রতিটি বস্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে—নাঃ, নেই কিছু। অথচ এই একটু আগেও দেখেছে সে স্পষ্ট।
যদিও ঘরের আলোটা ঈষৎ কমানো ছিল, তবু সেই কম আলোতেই সে স্পষ্ট দেখেছে। চোখের ভুল বলে উড়িয়ে দিতে পারে না। আলোটা চোখে লাগছিল বলে সামান্য একটু কমিয়ে ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বইটা পড়ছিল মহী।
সুন্দর কমনীয় চুড়িপরা দু’খানি হাত কে যেন তারই ঠিক পাশে টেবিলের উপরে রাখল।
চুড়ির মিষ্টি মৃদু আওয়াজেই তার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল। একদৃষ্ট্রে কতকটা গভীর বিস্ময়ের সঙ্গেই তার সামনে টেবিলের ’পরে ন্যস্ত চুড়িপরা হাত দুটির দিকে তাকিয়ে ছিল মহী। কী সুঠাম হাত দুটি, টেবিলের ’পরে ন্যস্ত হয়ে আছে। যেন কোন দক্ষ শিল্পীর সাদা ক্যানভাসের উপরে অঙ্কিত দুটি বঙ্কিম রেখা। কিন্তু চোখ তুলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গেই মহী যেন বিস্ময়ে ও ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কেউ নেই তার সামনে। পার্শ্বে, পশ্চাতে বা ঊর্ধ্বে।
একা সে ঘরের মধ্যে ‘আলোর সামনে বসে আছে। আশ্চর্য! তবে এই একটু আগে সে কার দুটি হাত দেখেছিল তারই সামনে টেবিলের উপর ন্যস্ত?
এতক্ষণে তার মনে পড়ে, বাড়িটা চমৎকার খোলামেলা দেখে অথচ কম ভাড়ায় সে যখন ভাড়া নেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, দু’খানা বাড়ির পরের বাড়িটাতে যিনি থাকেন, রাধানাথবাবু তখন বারবার করে মহীকে বলেছিলেন, ‘ও বাড়ি ভাড়া নেবেন না মহীবাবু, অনেকদিন থেকেই বাড়িটা অমনি খালি পড়ে আছে—’
‘কেন বলুন তো?’ বাড়িটা তো দেখলাম চমৎকার!’
‘হ্যাঁ, বাড়িটা দেখতে-শুনতে চমৎকার সন্দেহ নেই, তবে—’রাধানাথবাবু কেমন যেন ইতস্তত করতে থাকেন।
‘তবে কি মশাই?’
‘মানে বাড়িটা সম্পর্কে নানা রকমের কথা শোনা যায়। এর আগেও দু-একজন এসেছেন, তবে টিকতে পারেননি এক রাত্রের বেশি।’
‘তাই বুঝি অমন জায়গায় চমৎকার বাড়িটা আজও খালিই পড়ে আছে?’ হাসতে হাসতে মহী বলে, ‘কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি বলতে পারেন? ভূতের উপদ্রব আছে বুঝি বাড়িটায়?’
‘জানি না মশাই। তবে বছর দুই অমনি ‘ভেকেন্ট’ই পড়ে আছে এবং পূর্বে যে দু-চারজন ভাড়াটে এসে উঠেছিল, তারা এক রাত্রির বেশি থাকতে পারেনি—’
হাসতে হাসতে মহী জবাব দিয়েছিল, ‘দেখুন রাধানাথবাবু, গত এক মাস ধরে বাড়ি খুঁজে খুঁজে আমি সারাটা শহর প্রায় চষে ফেলেছি, কিন্তু আমারও পক্ষে মানানসই হয়—একটু হাওয়া-বাতাস পেয়ে হাত-পা মেলে থাকতে পারি, এমন একটি বাড়ি আজ পর্যন্ত দেখলাম না, যা ভাড়া পাওয়া যাবে। অথচ আমার ও আমার বুড়ি মার পক্ষে ওপরে-নিচে চারখানা ঘরওয়ালা ওই বাড়িটা একেবারে ঠিক যেমনটি খুঁজছিলাম, তেমনি। ভূতের ভয়ই থাক আর যাই থাক, এ সুযোগকে হারাতে আর যেই পারুক, আমি পারব না।’
‘কিন্তু—’
‘না রাধানাথবাবু, ভূতের ভয় তেমন আমার নেই।’ মহী হাসতে হাসতে বলে, ‘তাছাড়া সাতাশ বছর বয়স হল, আজ পর্যন্ত বহু কথিত ওই জীবটির দর্শন আমার ভাগ্যে ঘটেনি, বাড়ি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সৌভাগ্যটা যদি একান্ত ভাবে উপস্থিত হয়, বহুদিনের আকাঙ্ক্ষাটাও সেই সঙ্গে মিটে যাবে।’
এমনি কি বাড়ির মালিক কান্তিবাবুও মহীর বাড়ি-ভাড়া নেওয়া সম্পর্কে এতটুকু আগ্রহ প্রকাশ করেননি এবং ভাড়ার কথা বলতে বলেছেন, ‘দেখুন আগে আপনাকে বাড়িটা সুট করে কিনা। তারপর ভাড়ার কথা না হয় ঠিক করা যাবে।’
প্রত্যুত্তরে মহী বলেছে, ‘না কান্তিবাবু, সেটি ঠিক হবে না। শেষকালে হয়তো একটা অসম্ভব ভাড়া হেঁকে বসবেন—যা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।’
‘না, না, ভয় নেই আপনার। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। যদি আপনার থাকা হয়ই, যা ন্যায্য ভাড়া মনে করেন, তাই না হয় দেবেন—’
‘মনে থাকে যেন—’
‘থাকবে।’
সমস্ত বিচার-বিবেচনা-বুদ্ধি-শক্তি যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মহীর।
একটু আগে যা সে স্পষ্ট দেখেছে, কোন মতেই সেটাকে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিতে পারছেই বা কই?
আবার মহী বইটা খুলে বসল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আবার তার মন বইয়ের বিষয়বস্তুর মধ্যে নিমগ্ন হল। আধঘণ্টাও বোধ হয় হয়নি মহী আবার দেখল, চুড়িপড়া পেলব হাত দুটি এবারে তার ডান দিকে টেবিলের ’পরে ন্যস্ত হল।
এবার কিন্তু মহী চোখ তুলে দেবার চেষ্টা করল না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ন্যস্ত হাত দুটির দিকে। কি সুন্দর চাঁপার কলির মত হাতের আঙুলগুলো। বাম হাতের অনামিকায় একটি রক্তপ্রবালের অঙ্গুরীয়। কি সুন্দর নখাগ্র। যেন নখাগুলোতে কে চন্দনের প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে।
অনিমেষে তাকিয়েই থাকে মহী।
‘কি দেখছেন অমন করে? ভয় করছে না আপনার?’ সুমিষ্ট মেয়েলি কণ্ঠে প্রশ্ন এল।
তথাপি মহী চোখ তুলে দেখবার চেষ্টা করে না। কি জবাব দেবে ভাবছে। চোখ তুলে চেয়ে দেখবে নাকি?
‘কি দেখছেন, বললেন না তো?’
মহী চোখ তুলে তাকাতে লাগল। নাঃ, কেউ নেই। তবে কি সত্যি সত্যিই ব্যাপারটা ভৌতিক? অবিশ্বাস্য?
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত দেড়টা বাজে।
মহীর কেমন যেন একটা রোখ চেপে গেছে মাথার মধ্যে। আবার সে পড়বার ভান করে, কিন্তু পড়ায় মন আর বসে না। দু-চক্ষুর দৃষ্টি তার অধীর অপেক্ষায় টেবিলের দিকে নিবদ্ধ।
তৃতীয়বার। পূর্ববৎ হাত দুটি ন্যস্ত হল টেবিলের উপরে এবং এবারে বাম দিকে প্রথমবারের মত।
‘আশ্চর্য, আপনি এখনো ঘরের মধ্যে রয়েছেন! ভয় পাননি?’ সেই মেয়েলি কণ্ঠ।
‘ভয়! ভয় কেন পাবো?’ মহী এবারে জবাব না দিয়ে পারে না।
‘ভয় পাবেন না মানে? আচমকা এমনি দুটো হাত দেখলে সবাই তো ভয় পায়। তাছাড়া—’
‘তাছাড়া কি?’
‘আমার হাত দুটিই যে আপনার ওই কণ্ঠদেশকে মৃত্যুক্ষুধায় টিপে ধরবে না, কেমন করে জানলেন?’
এবার আর মহী না হেসে থাকতে পারে না। হেসে ওঠে।
‘হাসছেন যে? বিশ্বাস হল না বুঝি আমার কথা? জানেন, এই হাতে আমি গলা টিপে আমার স্বামীকে হত্যা করেছি? চেয়ে দেখুন, দেখুন আমার আঙুলের বাঁকানো ধারালো নখরে এখনো রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে—’
চমকে উঠল মহী। তবে কি নখাগ্রে ও রক্তের দাগ? চন্দন নয়—রক্ত চন্দন নয়?
আবার মুখ তুলে তাকাল মহী এবং পূর্ববৎ এবারেও দেখলে সে ঘর শূন্য।
এবং হঠাৎ ঠিক সেই মুহূর্তে দপদপ করে বারকয়েক কেঁপে উঠে টেবিল-ল্যাপটা নিভে গেল। ঘরটায় ভরে উঠল নিশ্চিদ্র আঁধার। একটা চাপা বিষাক্ত নিশ্বাস যেন অন্ধকার ঘরটার মধ্যে জমাট বেঁধে উঠছে।
কেন বার বার আমাকে দেখবার চেষ্টা করছেন? আমাকে দেখা যায় না। দেখতে পাবেন না আমাকে, কেবল আমার হাত দু’টি ছাড়া। স্বামী-হত্যাকারিণীর মুখ দেখাও যে পাপ, জানেন না এ কথাটা? শোনেননি?’
অন্ধকার যেন কথা বলে উঠল।
‘কিন্তু আপনি যেই হোন—ভূত, প্রেতযোনী। জানবেন, ভয় দেখিয়ে আমাকে এ-বাড়ি থেকে সরাতে পারবেন না।’ মহী এবারে বলে ওঠে।
‘তাড়াবো কেন, থাকুন না! তা আপনাকে একা দেখছি? বিয়ে থা করেননি বুঝি?’
‘আপনারা যে লোকে বাস করেন শুনি, সব কিছুই তো আপনারা দেখতে পান, জানতে পারেন! এ কথাটা জানেন না?’
‘কে বললে আপনাকে, আমরা সব কিছু জানতে পারি? আমাদের গতিবিধি শক্তির একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। তার বেশি একচুলও এদিক ওদিক আমরা এগোতে পারি না।’
‘তাহলেও বায়ুর জগতে শুনি লোকে বলে আপনারা বায়বীয় দেহ ধরে বাস করেন, সেদিক থেকে গতি আপনাদের যত্র-তত্র হওয়ারই তো কথা।’
‘সেটাই তো হয়েছে মুশকিল। সব কিছুই আমাদের বায়বীয় হলে কি হয়, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হিংসা-ক্রোধ সবগুলো অনুভূতিই ঠিক আপনাদের মতই আমাদের বর্তমান।’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা।
হঠাৎ আবার মহী প্রশ্ন করে: ‘এই যে একটু আগে বলছিলেন, আপনি আপনার স্বামীকে হত্যা করেছেন, কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘সকলকেই যে একঘেয়ে পতিব্রতা হতে হবে, তারই বা কি মানে আছে? তাই পতিঘাতিনী হয়েছি আমি।’
‘অদ্ভুত যুক্তি আপনার।’
‘অদ্ভুত কিনা জানি না, তবে একজন পুরুষকে হত্যা করে আমার আশ মেটেনি—’
‘বলেন কি?’
‘হ্যাঁ, আপনাকেও হত্যা করবার আমার ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘সর্বনাশ! আপনার ইচ্ছাটি তো ভাল নয়!’
‘তাই বলে ভয় পাবেন না যেন। এতক্ষণ ধরে আপনার মত কেউ এর আগে আমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায়নি—’
‘না পাওয়াটাই স্বাভাবিক, নয় কি?’
‘কিন্তু আর নয়, ভোর হয়ে এল। এবারে আমি আজকের রাতের মত আপনার কাছ থেকে বিদায় নেব। কিন্তু সকালে উঠেই পালাবেন না তো?’
‘পালাব কেন? পালাবার কোন কারণই ঘটেনি।’ মৃদু হেসে মহী বলে।
পরের দিন সকালে সারাটা রাত্রি জাগরণের পর একটু বেশি বেলা পর্যন্তই মহী ঘুমিয়েছিল। বাড়িওয়ালা কান্তিবাবুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল তার।
কান্তিবাবুও একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন। পরম নিশ্চিন্তে মহীকে ঘরের মধ্যে এত বেলা অবধি ঘুমোতে দেখে।
ব্যাপার কি! এত সকালে?
‘সকাল কোথায় মহীবাবু? বেলা দশটা বাজে যে! এখনো উঠছেন না দেখে—’
‘ভয় নেই কান্তিবাবু। আপনার ভূতের সঙ্গে কাল রাত্রে বেশ আমার, যাকে বলে ভাবই জমে গেছে। বেশ বাড়িটি আপনার। শুধু খোলামেলাই নয়, চমৎকার একটা রোমান্সও এ বাড়িটার সঙ্গে আপনার জড়িত আছে।’
প্রচুর যেন হাসির কথা বলেছে মহী, এইভাবে সে হাসতে লাগল।
কিন্তু পরের দিন রাত্রি সওয়া একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন কারো দর্শন পাওয়া গেল না, কতকটাযেন হতাশার সঙ্গেই মহী শয্যায় গিয়ে আশ্রয় নিল এবং গত রাত্রের সেই অদ্ভুত অভিসারিণীর কথাই ভাবতে ভাবতে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল; হঠাৎ একটা খাসরোধকারী অসোয়াস্তি ও বেদনায় ঘুমটা ভেঙে গেল। কঠিন হাতের দশ আঙুল দিয়ে কে যেন শায়িত তার গলা টিপে ধরেছে। উঃ, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!
তাড়াতাড়ি দু’হাত দিয়ে আততায়ীর হাত দুটো ছাড়াবার চেষ্টা করতেই মহী চমকে উঠল। চুড়ি-পরা দুটি হাত লৌহ-বেষ্টনীতে তার গলা চেপে ধরেছে। নিয়মিত বারবেল-মুগুর ভাঁজার হাত মহীর। কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সেই অদৃশ্য আততায়ীর লৌহবেষ্টনী হতে নিজেকে যেন মুক্ত করতে পারে না সে।
একি। ক্রমে শ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে যে! একটু হাওয়া। একটা গোঁ গোঁ শব্দ মহীর কণ্ঠ হতে বের হবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ এমন সময় সেই অদৃশ্য হস্তের লৌহ-বেষ্টনী গলার ওপর থেকে শিথিল হয়ে গেল এবং শোনা গেল একটা সুমিষ্ট হাসি। খিল খিল করে আনন্দে কে যেন হাসছে।
টনটন করছে ব্যথায় এখনও মহীর গলাটা।
‘কেমন লাগল?’ গত রাত্রের সেই নারী-কণ্ঠ।
মহীর গলা দিয়ে কোন স্বর তখনো বের হয় না।
পুনরায় নারী কন্ঠে প্রশ্ন হল, ‘রোমান্সটা উপভোগ করলেন কেমন? নারীর পেলব বাহুতে চিরদিন আপনারা পুরুষেরা কামনার পরশই পেয়ে এসেছেন। মৃত্যুর পরশটা পেলব হাতে কেমন লাগল?’
মহী তথাপি কোন জবাব দেয় না। চুপ করেই থাকে।
‘কি ভাবছেন?’
‘ভাবছি, বিংশ শতাব্দীর নারী আপনি, না সেই আদিম প্রস্তর যুগের বন্যা নারী আপনি—’
বিংশ শতাব্দীর তন্বী নারীও তো সেই আদিম যুগেরই প্রবাহিকা। সেই রক্ত-মাংস, সেই সব—কেবল মাঝখানে হাজার হাজার বছরের একটা ব্যবধান মাত্র।’
‘আপনি রাক্ষসী!’
‘তবু নারী। এই নারীর জন্যই কি যুগে যুগে হ্যাংলা পুরুষ আপনারা আমাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াননি? এবং এখনও বেড়াচ্ছেন না? যাকগে সে কথা, গলায় আপনার হাত বুলিয়ে দেব?’
‘রক্ষে করুন, যে নমুনা একটু আগে দেখিয়েছেন, আর হাত বুলিয়ে কাজ নেই।’
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।
‘ঠিক এমনি—এমনি ব্যথা লেগেছিল আমার, জানেন? আমাকেও যে গলা টিপে হত্যা করেছিল।’
‘কে? কে হত্যা করেছিল আপনাকে?’
‘কে আবার! আপনার মত এক পুরুষ! কিন্তু আমিও তাকে হত্যা করেছি। প্রতিশোধ নিয়েছি। অনেক আশা করে সে এ-বাড়ি করেছিল। ভেবেছিল, আমাকে হত্যা করে আমারই অর্থে তৈরি এই বাড়িতে তার মনোমত বিবাহিত প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে সুখে বসবাস করবে। নর্তকী-অভিনেত্রীর ভালোবাসা নাকি ভালোবাসাই নয়। কিন্তু নর্তকী-অভিনেত্রী করেছিল অর্থের লোভে কে আমাকে? বিবাহিত স্ত্রীকে অর্থের লালসায় রঙ্গমঞ্চে ঠেলে দিয়েছিল কে?’
‘আপনার কাহিনীটা শোনবার বড় ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘আমার কাহিনী! কোন নতুনত্ব নেই তাতে। বাংলাদেশে অনেক হতভাগিনীরই জীবনে অমন ঘটনা ঘটেছে। কি শুনবেন সে পুরাতন কথা।’
‘কিন্তু তা যেন হল, আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি, তবে আমার পেছনে আপনি লেগেছেন কেন?’
‘সব পুরুষই সমান। গোত্র এক।’
‘তাহলে আপনি চান যে, এ-বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাই?’
‘তা কেন যাবেন! থাকুন না!’
‘কিন্তু যেভাবে একটু আগে আজ আমাকে আপনি অভ্যর্থনা করেছিলেন, তার পরে আর থাকতে যে সাহস হচ্ছে না।’
‘এই না আপনার ভূতের ভয় নেই বলছিলেন?’
‘ভূতের ভয় যে নেই, সে তো আপনি বুঝতেই পারছেন। কিন্তু আপনার মত পেত্নীকে এড়িয়ে চলাই মঙ্গল নয় কি?’
‘আমি পেত্নী! জানেন, একদিন আমাকে একটিবার রঙ্গমঞ্চে চোখের দেখা দেখবার জন্যে প্রেক্ষাগৃহ ভরে যেত?’
‘তখন তো আপনি পেত্নী ছিলেন না!’
‘ভারি দুঃসাহস তো আপনার! এখুনি যদি আবার আপনার গলা টিপে ধরি?’
‘সত্যি সত্যিই ধরবেন নাকি?’
‘অসম্ভব নয় কিছু।’
‘শুনুন তাহলে, আমি এইমাত্র মনে মনে একপ্রকার স্থির করেছি কি জানেন?’
‘কি?’
‘এ বাড়ি আমি ছাড়ব না—’
‘আমার হাতে মরতে চান নাকি?’
‘ক্ষতি কি। সে একটা বিচিত্র নাটকীয় মৃত্যুই হবে। একদিন না একদিন মরতে তো হবেই।’ তারপর প্রসঙ্গটা পাল্টে মহী প্রশ্ন করে, ‘ঘরটা বড় অন্ধকার; আলোটা জ্বালাব?’
আলো জ্বাললেই আমাকে চলে যেতে হবে—’
‘তাই তো আমি চাই।’
‘কেন, আমাকে কি আপনি সহ্য করতে পারছেন না?’
‘না।’
‘বেশ, তবে আমি চললাম—’
মহী বাড়িটা ছেড়ে গেল না বটে কিন্তু তার যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা গেল।
রাত্রি হলেই তার মধ্যে কেমন যেন একটা আত্মহত্যা করবার দুর্নিবার প্রচেষ্টা জাগে। আচমকা ঘুমের মধ্যে নিজের গলা দু-হাতে টিপে ধরে নিজেকে হত্যা করবার চেষ্টা করে।
মা এসেছেন।
তিনি বারবার ছেলেকে বলছেন, এ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র কোথাও যেতে, কিন্তু মহী কোনমতেই রাজী হয় না। দিনের বেলাতে সে অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, কোন কিছু বোঝবার উপায় নেই। রাত্রি হলেই বাড়ে তার অস্থিরতা। অধীর আগ্রহে ঘরের দরজা বন্ধ করে কার জন্য যেন প্রতীক্ষা করে। কাউকে সহ্য করতে পারে না।
‘এমনি করে কতদিন তুমি এখানে থাকবে?’
মহী জবাব দেয়, ‘যতদিন না তুমি আমাকে হত্যা করছ—’
‘কিন্তু তোমার এ কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’
‘তবে আমাকে হত্যা করো। আমিও আর সয্য করতে পারছি না—’
‘বেশ, তবে তাই হোক। তোমাকে হত্যাই আমি করব।’
‘হ্যাঁ, তাই করো; আমাকে মুক্তি দাও।’
কিন্তু পারে না সে মহীকে হত্যা করতে।
প্রতি রাত্রের প্রতিজ্ঞা পরের রাত্রে শিথিল হয়ে যায়।
একজন করে প্রতিজ্ঞা। একজন করে চেষ্টা।
কাহিনীর শেষে দেখা গেল, একদিন প্রত্যুষে মহীর হিমশীতল মৃতদেহটা তার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। তার গলায় দশ আঙুলের সুস্পষ্ট দাগ।
গলা টিপে শ্বাসরোধ করে কেউ তাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু কে?
তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল এবং টেবিলের ড্রয়ারে তার ডায়রিটা পাওয়া গিয়েছিল।
বাড়িটা আর ভাড়া হয়নি।