উপন্যাস
গল্প

কুয়াশায় ঢাকা মুখ

কুয়াশায় ঢাকা মুখ

পারিজাত বক্সী সবে দরজার বাইরে পা দিয়েছেন, এমন সময়ে ফোনের শব্দ।

এ সময়ে আবার কে ফোন করছে? অবশ্য পারিজাত বক্সীর কাছে ফোন করার কোনও সময়-অসময় নেই। থাকতে পারে না। মানুষের বিপদ তো আর দিনক্ষণ বুঝে আসে না। পারিজাত বক্সী ফিরে গেলেন!

ক্র্যাডল থেকে ফোনটা তুলে কানের কাছাকাছি নিয়ে যেতেই বাজখাঁই কণ্ঠ শুনতে পেলেন, পারিজাতবাবু আছেন?

চেনা কণ্ঠস্বর। এ কণ্ঠ কানের ভিতর দিয়ে মরমে যেতে দেরি হয় না।

আছি এবং কথা বলছি—পারিজাত বক্সীর মোলায়েম স্বর।

কোথায় থাকেন মশাই! আধ ঘণ্টা ধরে ফোন বেজে যাচ্ছে।

যাঁর কণ্ঠ তিনি ভবানীপুর থানার অফিসার-ইন-চার্জ মহিম রুদ্র। এমন সার্থক-পদবি লোক সচরাচর দেখা যায় না।

প্রশ্নটা এড়িয়ে পারিজাত বক্সী বললেন, কী ব্যাপার বলুন?

ব্যাপার গুরুতর। আসতে পারবেন একবার?

একটু দেরি হবে।

কত দেরি?

একবার ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে যাব। অসিতবাবু তলব করেছেন। কতক্ষণ লাগবে জানি না।

যতক্ষণই লাগুক, আমি অপেক্ষায় থাকব। চলে আসবেন।

পারিজাত বক্সী জানেন, ফোনে মহিম রুদ্র এর বেশি একটি কথাও বলবেন না। কেসের সম্বন্ধে তিনি সামনাসামনি ছাড়া কিছু বলেন না। ফোন নামিয়ে রেখে পারিজাত বক্সী বেরিয়ে পড়লেন।

ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে পারিজাত বক্সী ছাড়া পেলেন বারোটা নাগাদ। সেখান থেকে সোজা ভবানীপুর থানা।

ঢুকতেই কল্যাণ সোমের সঙ্গে দেখা হল। চালের চোরাকারবারিদের নিয়ে ব্যস্ত।

কল্যাণ সোম মহিম রুদ্রর সহকারী। কিন্তু স্বভাবে একেবারে বিপরীত।

পারিজাত বক্সীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আপনার জন্য অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন।

একেবারে ভিতরের ঘরে গিয়ে দেখলেন, মহিম রুদ্র অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। হাত দুটো পিছনে।

আমি এসে গেছি মিঃ রুদ্র। বলার অপেক্ষা না করে পারিজাত বক্সী নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন।

উদ্ধার করেছেন। বলেই মহিম রুদ্র নিজেকে সামলে নিলেন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, একেবারে বেলা কাবার করে এলেন! পারিজাত বক্সী কোনও উত্তর দিলেন না।

মহিম রুদ্র নিজের চেয়ারে বসলেন। সামনে টেবিলের ওপর দুটো হাত রেখে বললেন, আর তিনটে বছর কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচি মশাই। আমার আর এক্সটেনশনের দরকার নেই।

কী হল?

কী হল না তা-ই বলুন। রায়বাহাদুর অতুল সিংহর মেয়ে মারা গেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু কিন্তু বিষ এল কোথা থেকে, কে দিল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটির বয়স কত?

বছর বারো।

তাহলে ব্যর্থ প্রেমের প্রসঙ্গটা অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়। অবশ্য আজকালকার মেয়েরা বারোতেই ঝানু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এ মেয়েটা খুব ক্ষীণজীবী। সেরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না।

মাত্র পরশু ব্যাপারটা ঘটেছে, এর মধ্যে সহকারী কমিশনারের তিনবার ফোন এসেছে কেসটার সম্বন্ধে। অতুল সিংহর সঙ্গে কমিশনারের আবার খুব দহরম মহরম। আচ্ছা ঝামেলা।

কেসটা গোড়া থেকে আমাকে বলুন তো।

পারিজাত বক্সী চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।

শুনুন তাহলে, মহিম রুদ্র র‌্যাক থেকে একটা ফাইল টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, অতুল সিংহর বাড়ি টার্ফ রোডে। একসময়ে অভ্রপতি ছিলেন। লোকে বলে মাইকা কিং। নিজেই সব দেখাশোনা করতেন। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ছেলেটি বিলাতে স্কেটিং করতে গিয়ে বরফ ফেটে মারা গেল। সেই শোকে, এক মাসের মধ্যে অতুল সিংহর স্ত্রী মারা গেলেন। অতুল সিং বাতে পঙ্গু হলেন। কারবার এক গুজরাতিকে বিক্রি করে বাড়িতেই বসে রইলেন, সম্বল ওই মেয়েটি। মেয়েটিকে দেখবার জন্য নবদ্বীপ থেকে দূর সম্পর্কের এক বোনকে নিয়ে এলেন। বিধবা বোন।

একটা কথা, মেয়েটি লেখাপড়া করত না?

না, স্কুলে যেত না, বাড়িতে এক দিদিমণি পড়িয়ে যেত।

তারপর?

তারপর রোজ সকালে অতুল সিংহ দু-পায়ে বাঘের চর্বি মাখতেন বাতের জন্য। সেই সময়ে মেয়ে রোজ কাছে বসে থাকে, সেদিন মেয়েকে দেখতে পেলেন না। বোনকে ডাকলেন, নীহার, মলিকে দেখতে পাচ্ছি না।

ঘুমোচ্ছে।

এখনও ঘুমোচ্ছে!— অতুল সিংহ দেয়ালঘড়ির দিকে দেখলেন। ন-টা বেজে গেছে।

ন-টা বেজে গেছে, এখনও ঘুমোচ্ছে? শরীর খারাপ হল নাকি?

চেয়ারের পাশ থেকে মোটা লাঠিটা তুলে নিয়ে অতুল সিংহ বোনের সঙ্গে মেয়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে বললেন, মলি, মলি, অনেক বেলা হয়ে গেছে মা। উঠে পড়।

কোনও সাড়া নেই।

নীহার মলির পাশের ঘরে শুত। দু-ঘরের মধ্যে যাওয়া-আসার দরজা আছে। অতুল সিংহ সেই দরজা দিয়ে মেয়ের ঘরে এসে দাঁড়ালেন।

মলি বিছানায় শুয়ে। তার শোয়ার ভঙ্গিটা অতুল সিংহর ভালো মনে হল না। তিনি মেয়ের কাছে এসে একটু ঝুঁকেই চিৎকার করে উঠলেন।

ডাক্তার এল। পাড়ার ডাক্তার। জানিয়ে দিল, মলি আর বেঁচে নেই। তারপর থানায় খবর এল। আমরা গেলাম। আমাদের করণীয় সব করলাম।

এখানে পারিজাত বক্সী বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলেন, অতুল সিংহর বাড়িতে কে কে থাকে?

অতুল সিংহ, মেয়ে মলি, বোন নীহার। বাইরের লোকের মধ্যে একজন রান্নার লোক, একটি ঝি, একজন ড্রাইভার। ড্রাইভার নেপালি। নাম জং বাহাদুর। সে আউটহাউসে থাকে।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা একবার দেখতে পারি?

এই তো, ফাইলেই আছে। মহিম রুদ্র গোটা ফাইলটা পারিজাত বক্সীর দিকে এগিয়ে দিলেন।

পারিজাত বক্সী মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

শুধু পোস্টমর্টেম রিপোর্টই নয়, সকলের জবানবন্দি।

এই সময়ে মহিম বেরিয়ে গেলেন। ওপরেই তাঁর কোয়ার্টার। সেখানে উঠে গেলেন। একটু পরে যখন নেমে এলেন তখন পারিজাত বক্সীর ফাইল পড়া শেষ। তিনি দু-হাত কপালে চেপে চুপচাপ বসে আছেন।

মহিম রুদ্রর পিছনে হাতে ট্রে নিয়ে একজন চাকর ঢুকল। ট্রে-র ওপর প্লেটে লুচি-তরকারি, ধূমায়মান চায়ের কাপ।

পায়ের আওয়াজে পারিজাত বক্সী মুখ তুলে দেখলেন।

দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন? আরে, অসময়ে এ কী করেছেন?

মহিম রুদ্র হাসলেন। আমাদের আবার সময়-অসময়। নিন, মুখে তুলে দিন।

খেতে খেতে পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, ওই মেয়ে তো অতুল সিংহর সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী ছিল তা-ই না?

মহিম রুদ্র ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ তা-ই।

সব হত্যাকাণ্ডের পিছনে একটা মোটিভ থাকে। এক্ষেত্রে মলির মৃত্যুতে লাভবান কে হবে?

মানে?

মানে মলি না থাকলে অতুল সিংহর সম্পত্তি কার পাবার সম্ভাবনা?

মহিম রুদ্র প্রশান্ত হাসলেন।

সেদিকটা যে আমি ভাবিনি তা মনে করবেন না। খোঁজ নিয়ে জানলাম অতুল সিংহর ভাইপো সম্পত্তি পেতে পারে। কিন্তু সে থাকে পাটনায়। ব্যাবসা করে। আজ দু-বছর এদিকে আসেনি।

ঠিক আছে, খাওয়া শেষ করে পারিজাত বক্সী উঠে দাঁড়ালেন, আজ বিকেলে একবার অতুল সিংহর সঙ্গে দেখা করতে চাই; সুবিধা হবে?

মহিম রুদ্র বললেন, আলবত হবে। ক-টা নাগাদ?

ধরুন পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা।

ঠিক আছে, আপনি সাড়ে চারটে নাগাদ এখানে চলে আসুন। একসঙ্গে যাওয়া যাবে। আমি বলে দিয়েছি, আমার হুকুম ছাড়া ও বাড়ির কেউ শহর ছেড়ে যেতে পারবে না।

পারিজাত বক্সী চলে এলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর নিজের লাইব্রেরিতে বসে ‘টক্সিন’ সম্বন্ধে মোটা মোটা গোটা চারেক বইয়ের পাতা ওলটালেন। গোটা তিনেক ফোন করলেন। যখন ভবানীপুর থানায় পৌঁছালেন তখন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটে।

মহিম রুদ্র তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছিলেন। পারিজাত বক্সীর মোটরে এসে উঠলেন।

মোটর যখন সিংহ লজ-এর সামনে এসে থামল, তখন প্রায় পাঁচটা, সাদা রঙের আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি। সামনে বাগান। বড়ো লোহার গেট। মোটর গেট পার হয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

কলিং বেল টিপতেই একটা লোক এসে দাঁড়াল।

মহিম রুদ্রকে দেখেই তার মুখ শুকিয়ে গেল। বোঝা গেল এর আগে জেরায় জেরবার হয়েছে।

বাবু আছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

খবর দাও, আমরা একটু দেখা করতে চাই।

চাকর ভিতরে গিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে এল। আসুন।

চাকরের পিছন পিছন দুজন বসবার ঘরে এলেন।

মেঝের ওপর দামি কার্পেট, বৃহৎ আকারের সোফা সেট, সুদৃশ্য পেলমেট শুধু গৃহস্বামীর অবস্থা নয়, তাঁর রুচিরও নিদর্শন।

একটু পরেই অতুল সিংহ ঘরে ঢুকলেন। মাথায় কাঁচায়-পাকায় মেশানো চুল, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, হাতে লাঠি। বিষণ্ণ মুখের চেহারা। ভদ্রলোক যেন বিধ্বস্ত।

মহিম রুদ্র পারিজাত বক্সীর পরিচয় দিতেই অতুল সিংহ এগিয়ে এসে পারিজাত বক্সীর দুটো হাত আঁকড়ে ধরলেন, আপনার কথা খুব শুনেছি। আপনি আমার মেয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা একটা কিনারা করে দিন। ফুলের মতন মেয়ে। তার এ সর্বনাশ কে করবে? মেয়েকে আর ফিরে পাব না জানি। তবু আততায়ীকে আমি চিনতে চাই।

অতুল সিংহ যে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, সেটা তাঁর কথাবার্তাতেই বোঝা গেল।

পারিজাত বক্সী চাপা অথচ দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাকে সন্দেহ হয়?

আমার? কাকে সন্দেহ হবে? নিজের কপাল ছাড়া আমি কাউকে দায়ী করি না।

আপনার ভাইপোর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

ভাইপো? মানে সুনীল, যে পাটনায় থাকে? তার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগই নেই। এমনকী চিঠিপত্রেও নয়।

তিনি তো ব্যাবসা করেন?

হ্যাঁ, শুনেছি ঠিকেদারি ব্যাবসা।

আপনাকে একটা নির্মল প্রশ্ন করছি, কিছু মনে করবেন না। এখন যা অবস্থা, আপনার অবর্তমানে আপনার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক তো সুনীলবাবুই হবেন?

তখনই অতুল সিংহ কোনও উত্তর দিলেন না। লাঠির ওপর মুখ রেখে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আইন অনুসারে অবশ্য তা-ই হবার কথা, কিন্তু তা-ই হবে না। আমি স্থির করেছি আমার সবকিছু আমি এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করে দেব।

ভাইপোকে বঞ্চিত করবেন?

পারিজাত বক্সীর এ প্রশ্নের উত্তরে অতুল সিংহ নিজের দুটো হাত জোড় করলেন, মাপ করবেন। এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না।

পারিজাত বক্সী আর মহিম রুদ্র দৃষ্টি বিনিময় করলেন, তারপর পারিজাত বক্সী বললেন, একবার নীহারদেবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

অতুল সিংহ বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, ভুবন, ভুবন।

ভুবন বোধহয় কাছাকাছিই ছিল। শুকনো মুখে এসে দাঁড়াল।

বাবু।

পিসিমাকে একবার আসতে বল।

মিনিট পনেরো পরেই নীহার এসে দাঁড়াল। বয়সের তুলনায় অনেক শক্তসমর্থ চেহারা। ফিনফিনে ধুতি, সরু কালো পাড়। ধবধবে সাদা ব্লাউজ। শোকার্ত কিন্তু একেবারে মুষড়ে-পড়া নয়। ঘরের মধ্যে ঢুকে একবার মহিম রুদ্রর দিকে আর একবার পারিজাত বক্সীর দিকে দেখল।

কোণের একটা চেয়ার দেখিয়ে পারিজাত বক্সী বললেন, বসুন।

নীহার বসল। কোলের ওপর দুটি হাত রেখে। পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন, আপনি তো মলির পাশের ঘরেই থাকতেন।

পাশের ঘর কেন বলছেন, বলুন একই ঘর। মাঝখানে শুধু একটা কাঠের পার্টিশন।

ভালো। মলি কীভাবে মারা গেল, তা আপনি কিছু টের পাননি?

একেবারেই না।

সেদিন মলির কাছে কে কে এসেছিল মনে আছে?

হ্যাঁ, মনে আছে বই কী। দাদা আর আমি তো গেছিই। ভুবন আর জং বাহাদুরও একবার গেছে।

বাইরের কেউ?

না, বাইরের কেউ আসেনি।

ভুবন কেন গিয়েছিল?

ওভালটিন দিতে। মলি ঘুমোচ্ছে দেখে ওভালটিন ফিরিয়ে নিতে গিয়েছিল।

আর জং বাহাদুর?

জং বাহাদুর মোটরে অপেক্ষা করছিল। ভোরবেলা মলি বেড়াতে যায়। তবে দেরি দেখে খোঁজ করতে এসেছিল।

আচ্ছা নীহারদেবী, শুনেছিলাম মলির ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, এরা ভিতরে গেল কী করে?

আমার ঘরের মধ্যে দিয়ে। আমি খুব ভোরে উঠে ঠাকুরঘরে যাই। আমার দরজা খোলাই থাকে।

আপনি তো শুনেছেন, মলির বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে।

দাদার কাছে শুনলাম।

এদের ওপর আপনার সন্দেহ হয়?

মোটেই না। এরা প্রায় বাড়ির লোকের মতন। ভুবন বহু বছর রান্নার কাজ করছে, ড্রাইভার জং বাহাদুরও খুব বিশ্বাসী।

মহিম রুদ্রর দিকে ফিরে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, একজন ঝি আছে না এ বাড়িতে?

নীহার উত্তর দিল, শোভার মা। ঠিকে ঝি। সে দু-বেলা বাসন মেজে, ঘর ঝাঁট দিয়ে চলে যায়। তাকে এখন পাওয়া যাবে না।

পারিজাত বক্সী উঠে দাঁড়ালেন, আজ তাহলে চলি। দরকার হলে পরে একদিন আসব।

মহিম রুদ্র জিজ্ঞাসা করল, ভুবন আর জং বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলবেন না?

আজ থাক, অন্য একটা কাজ আছে।

পারিজাত বক্সী বেরিয়ে এলেন। পিছন পিছন মহিম রুদ্র।

দরজা পার হতে গিয়েই পারিজাত বক্সী সামলে নিলেন। আর-একটু হলেই হোঁচট খেতেন।

ছোটো আকারের কুকুর চৌকাঠের পাশে শুয়ে। কুচকুচে কালো কুণ্ডলী-পাকানো লোম। ঠিক যেন কালো তুলোর বস্তা। এত বড়ো বড়ো লোম যে চোখগুলোও ঢাকা পড়ে গেছে। বেশ কুকুরটি তো! পারিজাত বক্সী কুকুরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।

অতুল সিংহ বললেন, রুবি মলির খুব ফেভারিট ছিল। ওর কাছেই থাকত। ও-ই এর দেখাশোনা করত। মলি চলে যাবার পর থেকে বেচারি কীরকম নিঝুম হয়ে গেছে।

পারিজাত বক্সী রুবির লোমে হাত বোলাতে বোলাতে একবার ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন, তারপর বললেন, মনে হচ্ছে খুব শকড হয়েছে। চলুন যাই।

পারিজাত বক্সী বাড়ি গেলেন না। ভবানীপুর থানায় এসে নামলেন। মহিম রুদ্রকে বললেন, মিস্টার রুদ্র, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।

কী? কাল অতুল সিংহ আর নীহারদেবীকে কোনও ছুতোয় থানায় ডেকে ঘণ্টা দুয়েক কথাবার্তায় আটকে রাখতে হবে।

কারণ?

কারণ আমি একবার ওদের ঘরগুলো সার্চ করতে চাই।

সে তো সোজাভাবেই হতে পারে।

তা হয়তো পারে কিন্তু এটা আমি ওদের জানতে দিতে চাই না। পারবেন তো?

না-পারার কী আছে? কিন্তু বাড়িতে তো আরও লোক থাকবে।

ভুবন আর জং বাহাদুর তো?

হ্যাঁ।

অতুল সিংহ আর নীহারদেবী মোটরে আসবেন। জং বাহাদুর সঙ্গেই থাকবে। ভুবনকে আমি ম্যানেজ করে নেব।

তা-ই ঠিক হল।

পরের দিন মহিম রুদ্র অতুল সিংহকে ফোন করলেন, নীহারদেবীকে নিয়ে দুপুরের দিকে একবার আসতে হবে।

আবার কী হল?

এলে জানতে পারবেন। জং বাহাদুরকেও আনবেন।

মোটরে যখন যাব তখন জং বাহাদুর তো সঙ্গেই থাকবে। ঠিক আছে, বারোটা নাগাদ যাব।

খবরটা মহিম রুদ্র পারিজাত বক্সীকেও ফোনে জানিয়ে দিলেন।

ঠিক সাড়ে বারোটা।

পুলিশের পোশাক-পরা, পাকানো গোঁফ, চোখে কালো চশমা এক ভদ্রলোক অতুল সিংহর বাড়িতে ঢুকলেন।

কে?

ভুবনের প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বললেন, আমি থানা থেকে আসছি। অতুলবাবু তাঁর শোবার ঘরের টেবিলে একটা কাগজ ফেলে গেছেন, সেটা নিতে এসেছি।

আসুন।

ভুবন লোকটিকে নিয়ে অতুলবাবুর শোবার ঘরে ঢুকল।

কোন কাগজ?

ভুবন আর কথা বলতে পারল না। লোকটা তার নাকে একটা রুমাল চেপে ধরল।

 শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। দু-চোখে অন্ধকার দেখে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

লোকটা দ্রুতপায়ে নীহারের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলা থেকে দুটো স্যুটকেস টেনে বের করলেন। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে একটার পর একটা লাগিয়ে দুটো স্যুটকেসই খুলে ফেললেন। খুঁজে খুঁজে কাগজপত্রগুলো পড়তে লাগলেন, তারপর একসময়ে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লেন। বিকালের দিকে অতুল সিংহ আর নীহার থানা থেকে ছাড়া পেলেন। কেন যে ডেকেছিল, বুঝতেই পারলেন না। মামুলি কতকগুলো প্রশ্ন।

বাড়ি ফিরতেই ভুবন হাউমাউ করে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবু। ডাকাতি হয়ে গেছে।

সে কী রে?

ভুবন সব বলল। কী হারিয়েছে খোঁজাখুঁজি শুরু হল। অতুল সিংহর একটা ঘড়ি পাওয়া গেল না। আর সব ঠিক আছে। আশ্চর্য কাণ্ড, তুচ্ছ দামের একটা ঘড়ির জন্য এত কাণ্ড!

নীহার নিজের আলমারি-স্যুটকেস সব খুঁজে দেখল। না, কিছু হারায়নি, সব ঠিক আছে।

দিন চারেক পর—

নীহারই বলল, দাদা, মলি যাবার পর থেকে রুবিটা কেমন মনমরা হয়ে আছে। ভালো করে খায় না। কেবল খাবার ওপর মুখ রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে।

অতুল সিংহ উত্তর দিলেন, রুবি মলিকে খুবই ভালোবাসত। কুকুরটা বাঁচলে হয়।

তুমি একবার ডেকে আদর করো।

ডাকব? অতুল সিংহ বাইরের দিকে চোখ ফিরিয়ে ডাকলেন, রুবি রুবি, এদিকে আয়।

রুবি চৌকাঠের কাছেই শুয়ে ছিল! প্রভুর ডাকে প্রথমে মুখ তুলে দেখল, তারপরে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল।

আয়, আয়। অতুল সিংহ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

রুবি আরও এগিয়ে এল। মুখ তুলে আবার দেখল, তারপর লাফিয়ে অতুল সিংহর কোলে উঠে পড়ল।

তার লোমের মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে অতুল সিংহ চমকে উঠলেন, এ কী রে, কী হয়েছে?

লোমগুলো সরাতে গিয়েই অতুল সিংহ থেমে গেলেন। বাইরের জানলায় পারিজাত বক্সীকে দেখা গেল।

অতুলবাবু, সাবধান! অতুল সিংহ চমকে উঠতেই রুবি তাঁর কোল থেকে লাফিয়ে নীচে নেমে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে নীহারের আর্তনাদ।

অতুল সিংহ ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন, মহিম রুদ্র দাঁড়িয়ে। দুজন পুলিশ নীহারের দু-পাশে।

কী হল? অতুল সিংহ চেঁচিয়ে উঠলেন।

এদিকে আসুন, আমি বলছি।

অতুল সিংহ ফিরে দেখলেন, পারিজাত বক্সীর কোলে রুবি।

মহিম রুদ্র নীহারকে নিয়ে জিপে উঠলেন।

অতুল সিংহ পারিজাত বক্সীকে নিয়ে বসবার ঘরে এলেন।

প্রথমে একটা জিনিস আপনাকে দেখাই।

পারিজাত বক্সী রুবির লোমগুলো ফাঁক করে দেখালেন। খুব সরু একটা ফিতে দিয়ে বাঁধা একটা কাঠের বাক্স।

এই বাক্সের মধ্যে হাইড্রোসায়ানিক গ্যাস ভরা। যে-ই রুবিকে কোলে নেবে, সে-ই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বাক্সের ডালাটা খুলবে আর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে। এইভাবেই আপনার মেয়ে মলির মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু কে এ কাজ করলে?

যে করেছে, মহিমবাবু তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে গেছেন।

আমি ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না।

শুনুন, আমি তাহলে বুঝিয়ে বলছি। নীহারদেবী আপনার দূর সম্পর্কের বোন। তাঁর অতীত জীবন খুব কলঙ্কমুক্ত নয়। তাঁর সঙ্গে আপনার ভাইপো সুনীলবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সেলাইয়ের ক্লাসে যাবার নাম করে নীহারদেবী যে বাইরে যেতেন, তা শুধু সুনীলবাবুর সঙ্গে দেখা করার জন্য।

ডাকাত সেজে একবার এ বাড়িতে হানা দিয়েছিলাম। নীহারদেবীর বাক্স তল্লাশি করে দুটো চিঠি উদ্ধার করেছি। অবশ্য পাছে নীহারদেবী সন্দেহ করেন বলে সে চিঠি দুটো আমি নিয়ে যাইনি। শুধু ফোটোস্ট্যাট কপি করে নিয়েছি। এই হাইড্রোসায়ানিক গ্যাসের জোগানটা সুনীলবাবুই দিয়েছিলেন, প্রয়োগপদ্ধতিও তাঁর।

অতুল সিংহ প্রশ্ন করলেন, কিন্তু এর আগে পুলিশ তো সবকিছু সার্চ করে গেছে, তখন তারা এ চিঠি দুটোর সন্ধান পায়নি?

তখন নীহারদেবী চিঠি দুটো সরিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর পুলিশের হাঙ্গামা মিটে যেতে চিঠি দুটো আবার বাক্সে রেখে দিয়েছিলেন। এ চিঠি দুটোই তাঁর পরম অস্ত্র। এ দুটো চিঠির ভয়ে সুনীলবাবু প্রতিশ্রুত টাকা নীহারদেবীকে দেবেন।

তারপর যখন সুনীলবাবুর কাছে খবর গেল, আপনি সম্পত্তি কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করে দেবেন, তখন আপনাকে সরাবার প্রয়োজন হল। দানপত্র করার আগে আপনার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার আইনমাফিক সম্পত্তি সুনীলবাবুর পাবার পথে কোনও বাধা থাকবে না। সেইজন্য রুবিকে আপনার কোলে তুলে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

স্কাউন্ড্রেল! তার কী ব্যবস্থা করেছেন আপনারা?

আজ সকালে বিহারের পুলিশ সুনীলবাবুকে গ্রেপ্তার করেছে। এতক্ষণে বাংলার দিকে রওনা হয়ে গেছে।

অতুল সিংহ পারিজাত বক্সীর দুটো হাত আঁকড়ে ধরলেন, আপনি এক গভীর ষড়যন্ত্র থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন। আপনার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারব না।

পারিজাত বক্সী মুচকি হাসলেন।

চলি অতুলবাবু, একবার থানায় যেতে হবে। মহিম রুদ্র অপেক্ষা করছেন।

-সমাপ্ত-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *