কুয়াশাজয়ের দীক্ষা

কুয়াশাজয়ের দীক্ষা

রবীন্দ্রনাথের দুটি বাড়ি। একটি বাড়ি উপনিষদ। অন্য বাড়িটি বিজ্ঞান। এ-বাড়ির হাওয়া অন্য বাড়িতে যায়। ও-বাড়ির আলো এ-বাড়িতে আসে। দুই বাড়ির মধ্যে কোনও ঝগড়া নেই, নেই কোনও ভুল বোঝাবুঝি। যদি কখনও দেখা দেয় দুই বাড়ির মধ্যে কোনও সংশয়, রবীন্দ্রনাথের অখণ্ড বিশ্ববোধ খুঁজে পায় তার সমাধান। রবীন্দ্রনাথের এই অখণ্ড বিশ্বচেতনা— যার মধ্যে মিশে আছে উপনিষদের দীক্ষা, বিজ্ঞানের শিক্ষা, তৈরি হয়েছে অনেক বছর ধরে। একই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং উপনিষদের উন্মোচন ঘটেছিল তাঁর জীবনে বালকবয়সে। উপনিষদের ধ্যানলব্ধ সত্য আর বিজ্ঞানের প্রমাণসমর্থিত সত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের যখন বারো বছর বয়েস তখন তাঁর মনের ওপর একসঙ্গে পড়ল উপনিষদের উদ্ভাস, বিজ্ঞানের বিভা। তাঁর মনের মধ্যে ঘটল নবচৈতন্যের জাগরণ। ঠিক কী ঘটেছিল তা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকেই।

‘বয়েস তখন হয়তো বারো হবে… পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন।’

এই পুরনো ছবি একটি নতুন প্রশ্ন জাগাচ্ছে। প্রশ্ন হল, বালক রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এই প্রাথমিক বিজ্ঞান শিক্ষা? আকাশভরা সূর্য তারার দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়েছিল বারো বছরের রবীন্দ্রনাথের?

বালক রবির মনে হয়েছিল ওই সুদূর গ্রহের মধ্যে হয়তো বাস করে নানা জাতের প্রাণী! সেই ধারণা থেকেই বারো বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন একটি প্রবন্ধ— ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। লেখাটা ছাপাও হয়ে গেল ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়। এ লেখার ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ গ্রহ-নক্ষত্র মহাকাশ সম্পর্কিত এই লেখাই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্যরচনা! এই লেখা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানাচ্ছেন তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে—

‘তিনি (পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম।’

রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত রচনার বিষয় বৈজ্ঞানিক খবর।

এই ঘটনার পর কেটে গেল তেষট্টি বছর। ১৯৩৭ সাল। রবীন্দ্রনাথের বয়েস ছিয়াত্তর। তিনি লিখলেন ‘বিশ্বপরিচয়’— তাঁর লেখা একমাত্র বিজ্ঞানের বই। বিশ্বপরিচয় প্রমাণ করল সেই বারো বছর বয়েস থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, তিনি আজীবন ভালবেসেছিলেন বিজ্ঞানকে। চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার, বিশেষ করে বাংলা ভাষায়। ‘বিশ্বপরিচয়’ লিখে রবীন্দ্রনাথ পথ দেখালেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার।

রবীন্দ্রনাথের এই আজীবন বিজ্ঞানমনস্কতার কারণ কী? কারণ হল, রবীন্দ্রনাথ এমন একটি পরিবারে জন্মেছিলেন যে-পরিবারে বিজ্ঞানচর্চার একটি সুদীর্ঘ ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। এই কারণেই ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানের নানা বই পড়তে হয়েছিল।

বিজ্ঞানের সঙ্গে নানাভাবে আজীবন জড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে তাঁর তৈরি বিদ্যালয় ‘পাঠভবন’ ও বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্বভারতী’-তে তিনি রচনা করেছিলেন বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ। বিজ্ঞানের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সারাজীবন ব্যাপী গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর। জগদীশচন্দ্রের বিলেত যাওয়ার পিছনে যাঁর প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহায্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল তিনি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানীর মাধ্যমে ভারতের বিজ্ঞানচর্চা উত্তীর্ণ হোক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আলোয়। তাঁর সঙ্গে ভুবনবিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সম্পর্ক ছিল গভীর স্নেহের। তিনি তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটি সত্যেন্দ্রনাথকেই উৎসর্গ করেন।

রবীন্দ্রসাহিত্য পড়লেও বোঝা যায় বিজ্ঞানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়তা। তাঁর কাব্যে-গানে-সাহিত্যে বিজ্ঞানের আলো এসে পড়েছে বারবার। প্রতিভাত হয়েছে বৈজ্ঞানিক সত্য। ফুটে উঠেছে বিচিত্র বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গ।

তিনি যখন একটি গানের মধ্যে লেখেন, ‘বিশ্বভরা প্রাণ’, তখন তাঁর উদাত্ত সুরে উচ্চারিত হয় যেন এক বৈজ্ঞানিক সত্য। আবার উপনিষদের এই বার্তাও যে জগৎ জুড়ে চলছে অবিরাম প্রাণলীলা। আমাদের মনে পড়ে যায় বারো বছর বয়েসে লেখা রবীন্দ্রনাথের সেই প্রবন্ধটি— ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’।

একটু আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানপ্রেম ও বিজ্ঞানমনস্কতা পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রে। তাঁর পরিবারে লেখাপড়ার যে-ধারাটি ছিল, তার মধ্যে ভাষাচর্চার পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল গণিত ও বিজ্ঞান। ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক বিজ্ঞানচর্চার যে-ধারা তার উৎসে অবশ্যই দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।

বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি দ্বারকানাথের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কলকাতা মেডিকাল কলেজের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের পিছনে অনস্বীকার্য তাঁর অবদান। দ্বারকানাথের প্রেরণা, উৎসাহ, অর্থসাহায্য ছাড়া কলকাতা মেডিকাল কলেজের প্রতিষ্ঠা ও কলকাতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসার সম্ভবই হত না। তাঁর অর্থবলেই মেডিকাল কলেজের পরীক্ষায় একাধিক পুরস্কারের প্রবর্তন হয়। এর ফলে ছাত্রদের উৎসাহ বাড়ে। একটি ঘটনা বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করছি। এই ঘটনা থেকেই দ্বারকানাথের সংস্কারবর্জিত মুক্ত চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ পাই আমরা।

সেই সময়ে গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে যেসব ছাত্র ডাক্তারি পড়তে আসত তাদের অনেকেই শবদেহ কাটাছেঁড়া করতে চাইত না। তাদের প্রবল আপত্তির পিছনে কাজ করত এই ভাবনা— উচ্চবংশের হিন্দু মড়া কাটবে! তাতে তো জাত যাবে, পাপ হবে, সেই পাপে নরকবাস নিশ্চিত। সামাজিকভাবে একঘরে হওয়ারও ভয় ছিল বই কী। সুতরাং, ওই মড়াকাটার ভয়ে, ডাক্তারিশিক্ষা থেকেই গোঁড়া হিন্দুপরিবারগুলি মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল।

দ্বারকানাথ বুদ্ধি খেলিয়ে টোপ ফেললেন। তিনি বাত্সরিক দু’হাজার টাকার অনুদান বৃত্তি ঘোষণা করলেন। তখন এ তো অনেক টাকা! ফলে হিন্দু ছাত্রদের সংস্কারমুক্তি ঘটল। শবদেহ কাটাছেঁড়ায় তাদের আর কোনও আপত্তি রইল না।

এ ছাড়া চিকিত্সাবিজ্ঞানে কলকাতায় আরও উৎসাহ ও প্রসারিত গবেষণার জন্যে দ্বারকানাথ মেডিকাল কলেজের দুই মেধাবী ছাত্রকে নিজের খরচে ইংল্যান্ডে পাঠালেন। এই দুই ছাত্রের লন্ডনে যাওয়া-আসা এবং সেখানে থেকে ডাক্তারি পড়া ও গবেষণার সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন তিনি।

ঠাকুরবাড়িতে বিজ্ঞানচর্চার যে কাজটি শুরু হয়েছিল তার বীজ নিঃসন্দেহে রোপণ করেছিলেন দ্বারকানাথ। এ-কথা ঠিক তিনি মূলত শিল্পপতি ছিলেন। এ-কথাও ঠিক অর্থ-উপার্জন ও বিলাস ছিল তাঁর জীবনের একটি মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সেইসঙ্গে এ-কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই তিনি সেই বিপুল ও বিরল ধনীদের একজন যাঁদের মধ্যে ঘটে লক্ষ্মী-সরস্বতীর মিলন। দ্বারকানাথের বৈদগ্ধ্য এবং তাঁর আভিজাত্য— এই দুটি বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। তিনি যে ছিলেন ধনে-মান্যয়-শিক্ষায় অনন্য এবং উনিশ শতকের নবজাগ্রত বাঙালির এক প্রাণপুরুষ এইটুকু স্বীকার করতে আমরা যেন কার্পণ্য না করি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও মুক্তচিন্তার উৎসাহটি পেয়েছিলেন পিতা দ্বারকানাথের কাছ থেকেই। এই উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বঙ্গ ইতিহাসের অঙ্গ। জ্যোতির্বিজ্ঞানে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সদা আগ্রহী। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য তাঁর জানবার কৌতূহলকে সর্বদা প্রাণিত করেছে। প্রাচীন ভারতের ঋষিরা বিশ্বসম্পর্কে তাঁদের অনুভূত সত্যকে হৃদয়ে গ্রহণ করে সেই কথা জানিয়ে গেছেন বেদে ও উপনিষদে। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন বেদে ও উপনিষদে সুপণ্ডিত। কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন মুক্ত মননে বিশ্বাসী, তিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন সমসময়ের বিজ্ঞানের দিকেও। তাই তাঁর মধ্যে ঘটেছে ঔপনিষদিক দীক্ষার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার মহামিলন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তাঁর সন্তানদের মধ্যেও রোপণ করেছিলেন বিজ্ঞানচেতনার বীজ। শুধু পুত্রদের মধ্যেই নয়, কন্যাদের মধ্যেও। মেয়েদের বিজ্ঞানশিক্ষা দেওয়া সে যুগে যে কত বড় একটা বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল, আজ তার কোনও আন্দাজ পাওয়া সহজ নয়। দেবেন্দ্রনাথ অঙ্কে ছিলেন স্বভাবতই পারদর্শী— তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ছিল বড় অঙ্কের যোগবিয়োগ মনে মনে করতে পারার। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বিশেষ দক্ষতা গণিতে, তা তিনি পেয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকেই। পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথের মনে মনে হিসেব করার বিশেষ ক্ষমতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে:

‘গত মাসের ও গত বৎসরের সঙ্গে তুলনা করিয়া সমস্ত আয়ব্যয়ের বিবরণ তাঁহার সম্মুখে ধরিতে হইত। প্রথমত মোটা অঙ্কগুলি তিনি শুনিয়া লইতেন ও মনে মনে তাহার যোগবিয়োগ করিয়া লইতেন। মনের মধ্যে যদি কোনও অসংগতি অনুভব করিতেন তবে ছোট ছোট অঙ্কগুলো শুনাইয়া যাইতে হইত। কোনো কোনো দিন এমন ঘটিয়াছে, হিসাবে যেখানে কোনো দুর্বলতা থাকিত সেখানে তাঁহার বিরক্তি বাঁচাইবার জন্য চাপিয়া গিয়াছি, কিন্তু কখনো তাহা চাপা থাকে নাই। হিসাবের মোট চেহারা তিনি চিত্তপটে আঁকিয়া লইতেন। যেখানে ছিদ্র পড়িত সেখানেই তিনি ধরিতে পারিতেন।’

অত বড় জমিদারির বহু ডালপালায় বিন্যস্ত হিসাবের মোট চেহারা চিত্তপটে এঁকে নেওয়া সহজ কাজ নয়— দেবেন্দ্রনাথ স্রেফ কানে শুনে এই কাজ করতে পারতেন! এই হিসাবদর্শিতা থেকে দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুটি জিনিস বোঝা যায়। এক, তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দুই, তাঁর অঙ্কের মাথা ছিল পরিষ্কার।

ঠাকুরবাড়িতে বিজ্ঞানচর্চা আর এক রূপকথার গল্পের মতো। এই রূপকথার রাজকন্যার নাম স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি রবীন্দ্রনাথের ন’দিদি, দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরী দেবীর নবম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের থেকে পাঁচ বছরের বড় স্বর্ণকুমারীর জন্ম ১৮৫৬-র ২৮ আগস্ট। সেই সময়ে ঘরে ঘরে বাঙালি মেয়েরা ছিলেন নিরক্ষর। নিজেদের নামটাও তাঁরা লিখতে পারতেন না। সেই সময়ে স্বর্ণকুমারীর বিজ্ঞানচর্চার গল্প তাই রূপকথা। অবিশ্বাস্য। তবু সত্যি!

পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বর্ণকুমারীর লেখাপড়া শেখা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রধান প্রেরণা। স্বর্ণকুমারী দেবী অবশ্য মূলত হতে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক। তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু ছোটগল্প লেখার মাধ্যমে। তারপর কুড়ি বছর বয়েসে লিখলেন ‘দীপনির্বাণ’ নামের উপন্যাস। স্বর্ণকুমারীর বিয়ে হয় এগারো বছর বয়েসে। আশ্চর্য, তার পরেও তিনি সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা চালিয়ে যান। আঠেরো বছর বয়েস হতে না হতে তিনি চারটি সন্তানের মা হলেন। বড়টির বয়েস তখন ছয়। চতুর্থটি সবে জন্মেছে। এই অবস্থায় স্বর্ণকুমারী সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিজ্ঞানে মন দিলেন। ১৮৮২ সালে ছাব্বিশ বছর বয়েসে লিখলেন তিনি এক আশ্চর্য বিজ্ঞানের বই— নাম ‘পৃথিবী’। এই চমৎকার বইয়ে তিনি বিশেষ করে আলোচনা করেছেন তিনটি বিষয় নিয়ে— পৃথিবীর জন্ম, সূর্য ও সৌরপরিবার।

ঠাকুরবাড়িতে বিজ্ঞানচর্চার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৪.৫.১৮৪৯-৪.৩.১৯২৫) কথাও ভোলার নয়। সাহিত্য ও সুরচর্চার পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চা করে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গ জাগরণের এক পথিকৃৎ। বিজ্ঞানমনস্ক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দেখা পাই আমরা ‘ভারতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বেশ কয়েকটি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধে। তাঁর ‘সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক বিজ্ঞান শিখিবার সহজ উপায়’ বইটির ঐতিহাসিক মূল্য আজও নষ্ট হয়নি। আধুনিক মস্তিষ্কতত্ত্ব নিয়েও তিনি একাধিক প্রবন্ধ লেখেন।

এবার আসি রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১১.৩.১৮৪০-১৮.১.১৯২৬) প্রসঙ্গে। গণিতে তাঁর অসামান্য মেধা আজও আমাদের বিস্মিত করে। তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতিতে বেশ কয়েকটি অসংগতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ‘জ্যামিতির নতুন সংস্করণ’ তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ।

এতক্ষণে নিশ্চয় এইটুকু বোঝা গেল, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানচর্চা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। তার শিকড় চলে গেছে তাঁর পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, অন্ধকারের দরজা খুলে আলোকে আহ্বান করতে প্রয়োজন বিজ্ঞান। যত তাঁর বয়েস বেড়েছে ততই আরও ঘন হয়েছে তাঁর চেতনায় এই উপলব্ধি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে প্রশ্ন করেছেন, ‘কুয়াশাজয়ের দীক্ষা কাহার কাছে পাই?’

প্রাচীন ভারতের বিশ্ববোধ ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলো তাঁকে দিয়েছিল কুয়াশাজয়ের মন্ত্র।

এই কারণেই এই বই বারবার ফিরে গেছে তাঁর কাছে। এ-যুগে আমাদের জন্যে তাঁর মতো করে গানে-কবিতায় কে বলতে পেরেছেন উপনিষদের হৃদয়কথা? তাঁর ব্যাখ্যায় প্রাচীন ভারতের প্রজ্ঞা যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে আধুনিক যুগের নতুন আলোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *