কুয়াংকারের মৃত্যু – মিহির দাশগুপ্ত
শহীদগড়ে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। কবে এখানে এসেছেন, কি জন্য এসেছেন কিছুই জানতাম না। স্কুল ছুটির পর যখন বাড়ি ফিরছি নদীর ধার ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে, সেই সময় তিনি পলাশ গাছটার গোড়ায় বসেছিলেন। এখানে নদী বাঁক নিয়ে কিছুটা উত্তরে গিয়ে আবার দক্ষিণে ঘুরেছে। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে হাসলেন একটু। চুলে তাঁর পাক ধরেছে। দৃষ্টিতে শীতলতা স্পষ্ট।
নমস্কার!
বছর পঁয়তাল্লিশ হবে তাঁর বয়স। একনজর ভাল করে দেখে প্রতিনমস্কার জানালাম। ভাবলাম, কোন ছাত্রের অভিভাবক হবেন তিনি। একটু পরেই কথাবার্তায় বুঝলাম, তা নয়।
চিনলেন না তো?
না।
আমি সত্যব্রত চ্যাটার্জি। এ পাড়াতে এসেছি ক’দিন হল। বড্ড ভাল লেগেছে এখানকার সমস্ত কিছু। ভাল লেগে গেল বলে বাড়ি ভাড়া করে ফেললাম। ক’দিন থেকে আপনাকে দেখছি···শুনেছি, আপনার কয়েকটি ছাত্রের কাছে আপনার কথা। তাই আলাপ করতে ইচ্ছে হল—
বললাম, বেশ তো, আসুন না আমার বাড়ি।
সত্যব্রত চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপের সূত্রপাত এখান থেকেই। ওঁর বাড়িতে আমার আড্ডাটাও বেশ জমে উঠেছিল। সত্যবাবু নানা দেশ ঘুরেছেন। পাখি সংগ্রহ করা ওঁর একটা হবি। বারান্দায় ঝোলানো খাঁচাতে রকমারি পাখি। তার মধ্যে কয়েকটি আশ্চর্য সুন্দর কথা বলে এবং কয়েকটি দিনে-রাতে রং পাল্টায়। এগুলি নাকি তিনি এবার বক্সায় সংগ্রহ করেছেন। বসন্তকালে কচিৎ হিমালয় থেকে ডুয়ার্সের অরণ্যে নেমে আসে। এই পাখিদের পরিচর্যায় ভদ্রলোকের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। তারের জাল দেওয়া একটা বাক্সে কিছু পাহাড়ী পোকাও সংগ্রহ করেছেন ওই পাখিগুলোর খাবারের জন্য। ভদ্রলোক বেশ পড়াশোনা করেন, তাও টের পেয়েছি তাঁর টেবিলে মোটা মোটা বই দেখে। বেশির ভাগই অর্থনীতির। আরো পরে জেনেছিলাম, সত্যব্রতবাবু কলকাতার কোন কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপনা করতেন। একটু খেয়ালী প্রকৃতির বলে মনে হল আমার।
এর কয়েকদিন পর। সারা দিন আকাশ মেঘলা আর সেই সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। স্বাভাবিকভাবেই ঘুমটাকে উপভোগ করব ভেবে রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে বই পড়লাম। বাইরে বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাড়া অন্য কিছুই কানে আসছিল না। এরপর কখন কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই নি।
রীতিশবাবু—রীতিশবাবু—
খট খট খট···
কান থেকে কম্বল সরিয়ে সজাগ হয়ে যাই। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে সত্যব্রতবাবুর গলা কানে এসে বাজল।
আপনি, এত রাতে?—দরজা খুলে বিস্ময়ে প্রশ্ন করি।
সত্যব্রতবাবু যেন আতঙ্কিত হয়েছেন। তাঁর সমস্ত শরীর দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ আগের চেয়ে বেড়েছে।
সত্যব্রতবাবু বললেন, খুন হয়েছে! খুন হয়েছে আমার পাশের বাড়ির একটি বউ!—একটু থামলেন তিনি।
আমি সেই ফাঁকে প্রশ্ন করি, পুলিশ খবর পেয়েছে?
জানি না। বোধ হয় পায় নি।
আপনি কি করে টের পেলেন?
কিছুক্ষণ থেমে একটু ভেবে বললেন, চিৎকার শুনেছি। ঘুম হচ্ছিল না, বই পড়ছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও চিৎকার কানে বাজতেই ছুটে গিয়ে দেখি—
আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। পুলিশে খবর দেওয়া প্রয়োজন। বর্ষাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সোজা থানায় গিয়ে খবর দিয়ে সত্যব্রতবাবুকে নিয়ে শহীদগড়ে গেলাম।
রাস্তায় স্থানে স্থানে কাদা জমে উঠেছে। চারদিক ঘন অন্ধকার।
সত্যব্রতবাবুর পাশের বাড়ি—তাঁর বাড়ি থেকে গজ কয়েক দূরে। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। ভেতরে আলো জ্বলছে। কাচ-বসানো জানলা অক্ষত। জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরের সমস্ত কিছুই দেখা যায়। মেঝের ওপর ভদ্রমহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। আসবাবপত্র খুব সামান্যই। একপাশে খাট। তার ওপর খোলা একটা সিনেমা-পত্রিকা। সম্ভবত উনি মৃত্যুর পূর্বে পত্রিকাটা পড়ছিলেন। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে কি করে ভদ্রমহিলা খুন হলেন। রক্তের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। সাদা ধবধবে বিছানার চাদরে লালের কোন ছোপ নেই। যতদূর দেখা যায় মেঝেও পরিষ্কার। আসলে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন কিনা, সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অথচ সত্যব্রতবাবু কি করে আঁচ করলেন বুঝতে পারলাম না।
একটু বাঁ-দিকে এগিয়ে বাড়ির উঠোনে যাবার পথ। সেখানে পা দিতেই দেখা গেল, সামনের ঘরগুলোর উল্টোদিকে উঠোনের শেষ মাথায় ছোট একটা জ্বালানী কাঠ রাখবার ঘর। আর একপাশে কুয়ো। সম্ভবত কুয়োতলায় আলো দেবার জন্য কাঠ-রাখবার ঘরের বাতায় একটা লণ্ঠন ঝোলানো। সত্যব্রতবাবুকে নিয়ে ওদিকে এগোতেই হঠাৎ কে যেন একটা লাঠি দিয়ে ঝোলানো লণ্ঠনটা ভেঙে দিল। যা একটু আলো এতক্ষণ ছিল, তাতে উঠোনটা আবছা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু এখন সমস্ত অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
সত্যব্রতবাবু ভয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমার মনে হল, কেউ যেন আমাদের খুব সামনে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। অন্ধকারে খালিহাতে ওর পেছনে ছোটা মুর্খতারই সামিল হবে ভেবে ধীরে ধীরে বাড়ির সামনের দিকে এসে দাঁড়ালাম।
সত্যব্রতবাবু ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছেন।
বৃষ্টির বেগ একটু কমলেও বাতাস বইছে শিরশির করে।
সত্যব্রতবাবু বললেন, লোকটার খুব সাহস দেখছি—
কি করে আঁচ করলেন?—আমি বলি।
খুন করেও এতক্ষণ এখানে থাকা এবং আমাদের চোখের ওপর দিয়ে প্রায় গা ঘেঁষে ছুটে পালিয়ে যাওয়া, এগুলো সাহসের লক্ষণ নয়?
পুলিশ একটু যেন তাড়াতাড়ি এসে পৌঁছল। যা সচরাচর চোখে পড়ে না। দু-একজন পাড়া-প্রতিবেশীকে ডেকে তুলল পুলিশ। জানা গেল, মহিলাটির স্বামী ছোটখাটো কাপড়ের ব্যবসা করে হাটে হাটে ঘুরে। আজকে গিয়েছে চামুর্চির হাটে। রাত দশটার মধ্যে সাধারণত প্রতিদিন বাড়ি ফেরে। কিন্তু আজ এখনো সে ফেরে নি।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ভেঙে ফেলা হল। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। মৃতদেহ উল্টেপাল্টে দেখল পুলিশ। কোথাও আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল না। বৌটির বয়স খুব বেশি নয়; মনে হল, ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। শোনা গেল, বছর দুয়েক হল ওদের বিয়ে হয়েছে। সন্তান এখনো হয় নি, তবে দেখে মনে হল, বৌটি সন্তান-সম্ভবা।
পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য মৃতদেহ নিয়ে গেল। পুলিশ প্রথমেই সত্যব্রতবাবুর জবানবন্দি নিল।
আপনিই তো প্রথম চিৎকার শুনেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কতদিন এ পাড়ায় আছেন?
দিন কুড়ি হবে।
আগে কোথায় ছিলেন?
বেশির ভাগ কলকাতায়। তবে কয়েক মাস যাবৎ মেঘালয়ে ছিলাম। এখানে আসবার আগে কয়েকদিন বকসায় ছিলাম।
কিছু মনে করবেন না···আপনার পেশা?
পেশা—, একটু ভেবে নিয়ে সত্যব্রতবাবু বললেন, আগে অধ্যাপনা করতাম—ভাল লাগে নি, ছেড়ে দিয়ে এখন দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই—পাখি সংগ্রহ করি।
পাড়াগাঁয়ে রাত দশটা-এগারোটা বেশ গভীর রাত, এর ওপর যদি বর্ষা হয়—তা এত রাত অবধি জেগে জেগে আপনি কি করছিলেন?
সত্যব্রতবাবু বললেন, এটা পাড়া-গাঁ হলে কি হবে—পুরোন অভ্যাস পাল্টাতে পারিনি। অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেও পড়াশোনা ছাড়তে পারি নি।
এরপর পুলিশ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে পাড়ার কয়েকজনের কাছে খোঁজ-খবর নিল। বাকি রাতটার জন্য একজন সিপাই পাহারায় রইল। মহিলাটির স্বামী হাট থেকে ফিরলেই থানায় যাবার জন্য নির্দেশ দিয়ে গেলেন সাব-ইন্সপেক্টর।
শিক্ষকতায় প্রবেশের আগে দিব্যেন্দুর সঙ্গে অনেকগুলি খুনের তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ফলে পুরোন অভ্যাসটা মাঝে মাঝে আমায় উত্তেজিত করছিল। খুনটা সম্পর্কে অনেক ভেবেছি—মহিলাটি খুন হবার পেছনে কারণ কি—ওকে মেরে কার কি উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে? খবর নিয়ে জানা গেছে, ওদের স্বামী-স্ত্রী কারোর নামেই লাইফ-ইনসিওরেন্স নেই। হঠাৎ মনে হল এমনও তো হতে পারে, প্রণয়ঘটিত কোন ঘটনা এর পেছনে আছে। যেমন বৌটি গোপনে স্বামীর অজান্তে অপর একটি পুরুষকে ভালবাসতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে। অথবা বিবাহের পূর্বের কোন প্রণয়সূত্র ধরে অপর কোন পক্ষ এ-কাজটি করতে পারে।
সাব-ইন্সপেক্টর মতিলালবাবু আজকে সকালেই এসেছিলেন। তিনি বললেন যে পোস্টমর্টেমে জানা গেছে, তীব্র বিষপ্রয়োগে বৌটিকে হত্যা করা হয়েছে। বিষপ্রয়োগ করার এক সেকেণ্ডের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটেছে। অত্যন্ত সুঁচলো—খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না—এমন একটি বস্তু দিয়ে গালের ওপরে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
বিকেলে সত্যব্রতবাবু এলেন। তাঁর চোখ মুখ সাদা। খুব ভয় পেলে যেমন হয় তেমনি।
বললাম, ব্যাপার কি সত্যব্রতবাবু? খুব ভয় পেয়েছেন নাকি?
একটা অচেনা লোককে আজ হঠাৎ আমার জানলায় দেখলাম। মুহূর্তেই কোথায় যেন মিশে গেল।
বিস্মিত হলাম। বললাম, তাই নাকি?
মনে হচ্ছে, সত্যব্রতবাবু শঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, সেই লোকটি!
কোন্ লোকটি?
খুনের দিন লণ্ঠনটা যে ভেঙে দিয়েছিল।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সত্যব্রতবাবুর মুখের দিকে। সত্যিই তো ওই লোকটার সঙ্গে বৌটির খুনের একটা সম্পর্ক আন্দাজ করা যায়। কিন্তু এতে সত্যব্রতবাবুর ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখি না। বললাম, আপনার ভীত হবার কারণ কি? পুলিশকে খবরটা দিয়ে দিন। আর যদি আপনার বাড়িতে একা থাকতে ভয় হয়, তবে আমার এখানে অনায়াসে চলে আসতে পারেন। কোন অসুবিধে হবে না। দিব্যি গল্প-গুজব করে কাটানো যাবে।
সত্যব্রতবাবু বললেন, আমার পাখিগুলো নিয়েই যত চিন্তা রীতিশবাবু। রাতে উঠে ওদের খাওয়াতে হয়। যদি একান্ত অসুবিধা না মনে করেন, তাহলে আমার ওখানে রাত্তিরটা থাকুন না। আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য লজ্জাও পাচ্ছি, কিন্তু···
এ অবস্থায় তাঁর অনুরোধ রক্ষা না করা উচিত হবে না ভেবে, সত্যব্রতবাবুর বাড়িতে চলে এলাম। একই ঘরে দুটো খাটে আমরা শুলাম। গভীর রাতে একবার পাখিগুলোকে খাওয়ালেন।
ভোরের দিকে আমায় ঠেলে তুলে দিলেন সত্যব্রতবাবু। খুন হয়েছে আবার। এখান থেকে দু’ফার্লং দূর হবে। এবারও একটি স্ত্রীলোক, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যা তা হল, এই মহিলাটিও সন্তান-সম্ভবা! কেমন হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ কেমন খুনী! কি পৈশাচিক মনোবৃত্তি! মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি করে নিষ্পাপ শিশুও হারিয়ে গেল—পৃথিবীর আলো আর সে দেখতে পেল না।
সত্যব্রতবাবু শঙ্কাজড়িত কণ্ঠে বললেন, সেই লোকটিকে আজকেও দেখলাম।
কোথায়?
আমার বাগানের পেছন দিকটাতে।
হতভম্ব হয়ে গেলাম। ওই লোকটার সাথে খুন দুটোয় যোগাযোগ কি হতে পারে চিন্তা করতে লাগলাম।
সত্যব্রতবাবুই বা লোকটিকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন? একজন খুনীকে দেখলে যেমন সাধারণ মানুষের ভয় হয়, তেমনটি কি? কিন্তু ওই লোকটিই যে খুনী, একথাও হলফ করে বলা যায় না। এই সময় দিব্যেন্দুর কথা আমার মনে হল। ব্যাপারগুলো ওকে জানানো যেতে পারে। যদি এর মধ্যে ইন্টারেস্টিং কিছু পেয়ে যায়, নির্ঘাৎ চলে আসবে।
সত্যব্রতবাবুকে আমার বন্ধু সত্যান্বেষী দিব্যেন্দু রায়ের কথা বললাম। উনি অত্যন্ত উৎসাহ প্রকাশ করলেন। বললেন, যেন প্লেনেই আসতে লিখে দিই।
দিব্যেন্দুকে কলকাতার ঠিকানায় চিঠি দিয়ে উত্তর না পাওয়ায় টেলিগ্রাম করলাম। উত্তর এল এবার দিব্যেন্দুর কাছ থেকে নয়—ওর বোন শর্মিষ্ঠার কাছ থেকে। লিখেছে, দাদা বহুদিন এখানে নেই। কোথায় গেছে জানায়নি। তবে শুনেছি, কোন এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর পাল্লায় পড়ে হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছে। আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে সম্ভবত দাদা তদন্ত চালাতে আগ্রহী।
শর্মিষ্ঠার পত্রে একটু উষ্মাও প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। দিব্যেন্দু হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যাবে, আর যেই বিশ্বাস করুক, একথা আমি করি না। যাই হোক, সত্যব্রতবাবুকে এ মতবাদ জানাতে তিনি ঈষৎ দুঃখিত হলেন বলে মনে হল। পুলিশের ওপর তিনি ভরসা রাখতে পারছিলেন না। কারণ পর পর একইভাবে দুটো খুন সংঘটিত হয়ে গেল, এবং সন্দেহজনক ব্যক্তিটিকে পুলিশ ছুঁতে পর্যন্ত পারছে না।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে সত্যব্রতবাবু উপস্থিত হলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি একটা খাম বার করে আমার হাতে দিলেন। ওঁর একমাত্র মেয়ের পত্র। ভূপালে থাকে, জামাই সেখানে ভাল কাজ করে। মেয়ে পান্না বাবার এখানে আসবে। দু-একদিনের মধ্যেই রওনা দিচ্ছে।
চার বছর হল মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সত্যব্রতবাবু। স্ত্রী মারা গিয়েছেন তারও আগে। চার বছরের মধ্যে মেয়ের বাচ্চা হয় নি একটিও। যথাসময়ে জামাই এল পান্নাকে নিয়ে। পান্নাকে রেখে সে দু’দিন পরই কর্মস্থলে চলে গেল। পান্না বাবার কাছে কিছুদিন থাকবে এ রকম কথাবার্তা হয়েছে।
পান্না আসবার পর সত্যব্রতবাবু আমার বাড়িতে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আমিও স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতাম।
একদিন মাঝ-রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দরজার ওপর কে যেন ঠক ঠক আওয়াজ করছে। অতীত অভিজ্ঞতা থাকার ফলে সন্দেহ হল নিশ্চয়ই সত্যব্রতবাবু। এবং তিনি কোন একটি রমণীর খুন হবার সংবাদ বহন করে এনেছেন।
ঠক···ঠক···ঠক···
দরজা খুলতেই খুবই বিস্মিত হলাম।
দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করল পান্না। মনে হল, একটু আগে সে ঘুম থেকে উঠেছে। অবিন্যস্ত বেশবাস। মুহূর্তে চমকে উঠতে হল আমাকে। পান্না যে সন্তান-সম্ভবা এই প্রথম টের পেলাম, তাকে এই বেশে দেখে। সে নিজে থেকেই দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।
অস্বস্তি বোধ করলাম। এই গভীর রাতে পান্নার মত একটি মেয়ে আমার ঘরে অর্গলবদ্ধ অবস্থায় আছে, এ কথা বাইরে জানাজানি হলে লজ্জা উভয়েরই।
বললাম, বস।
পান্না ভীত কণ্ঠে বলল, এখানে আপনার সঙ্গেই পরিচয় আছে মাত্র। তাই ছুটে এসেছি।
কি হয়েছে?
একটু আগে একটা শব্দ পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়। একটা লোক আমার ঘরে কি করে ঢুকেছিল, বলল, চিৎকার করবেন না! বলেই একটা চিঠি দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
একটা সাধারণ কাগজে লেখা চিঠি পান্না এগিয়ে দিল। ভাবলাম, এ আবার কোন্ নতুন ঘটনা ঘটতে চলেছে? তবে কি পান্নার ওপরেও খুনীর নজর পড়েছে? বটেই তো—পুরোন থিওরি অনুযায়ী সন্তান-সম্ভবা পান্নার খুন হবার একটা উপযুক্ত কারণ আছে বটে! চিঠিটা হাতে নিয়ে না খুলে তাকিয়ে রইলাম পান্নার ভয়কাতর মুখের দিকে। পান্না বলল, চিঠিটা পড়ুন।
কাগজের ভাঁজটা খুলতেই চমকে উঠলাম। লেখাটা অত্যন্ত পরিচিত হাতের মনে হল। কিন্তু কি জানি কেন, এই মুহূর্তে স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে হয়রান হয়েও ব্যক্তিটিকে মনে করতে পারলাম না। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতায় মনে মনে নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হলাম। চিঠিতে লেখা।
আজ এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যান—নইলে আপনার মৃত্য কেউ ঠেকাতে পারবে না। আগের দুটো খুন সম্পর্কে যদি সামান্য ধারণাও হয়ে থাকে, তবে জানা উচিত সন্তান-সম্ভবা হিসাবে আপনার মৃত্য এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক হবে না।
ঠিক এ কয়টি পংক্তি। কাকে লেখা হয়েছে, কে লিখেছে, কোত্থেকে লেখা হয়েছে, কিছুই লেখা নেই। এমন কি চিঠিটায় তারিখ পর্যন্ত দেওয়া নেই। এ চিঠি পাওয়ার পর পান্না বিহ্বল হয়ে পড়বে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু আমার কাছে ও এসেছে কেন? আমি ওকে কি বাঁচাতে পারি—নাকি ডুবন্ত মানুষের একটুকরো কুটোকে ধরে বাঁচবার বাসনার মত, এক্ষেত্রে তার মনে সেই ধরণের একটা মনোভাব ক্রিয়া করছে?
সত্যব্রতবাবু কি বললেন?—আমি প্রশ্ন করলাম।
তাঁর দেখা পাইনি।—পান্না প্রায় কেঁদে ফেলল।
দেখা পাওনি!
না।
কোথায় তিনি এত রাতে?
জানি না।
প্রতি রাতেই কি তিনি বাইরে চলে যান?
পান্না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হঠাৎ এক এক রাতে কোথায় যেন যান।
খুবই অবাক হলাম সত্যব্রতবাবুর এ ধরণের আচরণে। তিনি বাইরে কোথায় যান, কোথায় যেতে পারেন চিন্তা করলাম মনে মনে। আমার আশু কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হই। এখন সত্যব্রতবাবুকে খুঁজতে যাওয়ার চেয়ে পান্নার নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা উচিত।
পান্না এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। কি যেন বলতে চাইল। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, এখানে যখন এসে পড়েছ, তোমার প্রাণনাশের ভয় নেই পান্না। আমি সারারাত জেগে তোমায় পাহারা দেব।
পান্না ফুঁপিয়ে উঠল: জানেন রতিশবাবু—থেমে যায় সে, কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায়।
আমি সন্তান-সম্ভবা নই।
মানে? বিস্মিত হই আমি।
পান্না কান্না-জড়ানো গলায় বলে, চার বছর আমার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু···এখন আমাকে বাইরে থেকে দেখে অনেকেই ভুল করে···আসলে পেটে একটা টিউমার হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, মাসখানেক পরে অপারেশান হতে পারে।
আমি বেদনা বোধ করি পান্নার জন্য। বললাম, তোমার বাবা একথা জানেন?
না। মাথা নাড়ে পান্না।
কেন জানাওনি?
মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সংসারের কোন কিছুর সঙ্গেই তিনি জড়িত থাকতে চাইতেন না। অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেন, কেবল বই পড়তেন অর্থনীতির। আর আমার বিয়ে দিয়ে দেবার পর ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যবারের চেয়ে এবার তাঁকে খুব ভালই মনে হয়েছে—তাই তাঁকে আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে বিব্রত করতে চাইনি।
বুঝতে পারলাম খুনীর হিসেবে ভুল হয়েছে। পান্নার বাবা যে খবর জানেন না, সে খবর বাইরের লোকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যে লোকটি আজ পান্নার ঘরে প্রবেশ করেছিল, সে ওকে খুন করতে চায় না—কারণ তাহলে তাকে সাবধান করে চিঠি দেবে কেন ? আবার ওই লোকটা হঠাৎ সত্যব্রতবাবুর বাড়ি থেকে পান্নাকে সরিয়ে দিয়ে কোন উদ্দেশ্য সাধন করবে? সত্যব্রতবাবুই বা আজ দিন বুঝে উধাও হলেন কোথায়? যদিও তিনি মাঝে মাঝে রাতে বাড়ির বাইরে চলে যান বলে পান্না বললে!
এই সময় বাইরে দু’জোড়া জুতোর শব্দ কানে এল। পান্না অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আগন্তুকদ্বয় দরজায় এলোপাথাড়ি নক করতে লাগল। আমার কোট রাখবার আলমারিটার ভেতর পান্নাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে একটু ফাঁক রেখে পাল্লা দুটো চেপে দিলাম।
দরজার কাছে এগিয়ে প্রশ্ন করলাম, বাইরে কে?
ভারী গলায় উত্তর এল: সাব ইন্সপেক্টর মতিলালবাবু।
একটু যেন অভয় পেলাম। তবু সাবধানে আরেকবার নিরীক্ষণ করে নিলাম আলমারিটা। পুলিশ হোক আর খুনী হোক, অথবা অন্য যে ব্যক্তিই হোক না কেন, এত রাত্রে একলা আমার ঘরে পান্নার আবির্ভাব ভাল চোখে হয়তো কেউই দেখবে না।
দরজা খুলে দিতেই মতিলালবাবু ও একজন সিপাই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে এদিক-ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
মতিলালবাবু বেশ কড়া গলায় বললেন, একটু আগে আপনার ঘরে কে ঢুকেছিল?
আমতা আমতা করে বলি, কেউ না তো—
কেউ না? কি আশ্চর্য!
মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?—যেন অপমান বোধজনিত একটু উষ্ণ হলাম।
খবরটা যে অত্যন্ত পাকা।—বলে মুচকে হাসলেন মতিলালবাবু।
তবে কি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন তিনি? এই রসসিঞ্চিত হাসিটি আমি উপভোগ করতে পারলাম না। বরং হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি ঘামতে শুরু করেছি।
এত রাতে আলো জ্বেলে জেগে কি করছিলেন? মতিলালবাবু একটু কঠোর হলেন যেন।
আমাকে হঠাৎ এত জেরা করবার কারণ খুঁজে পেলাম না। আমি নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে পারছিলাম না। পুলিশ আসবার পূর্ব মুহূর্তে আমি ভীত হয়েছিলাম সামাজিক কারণে। মতিলালবাবু কি ভেবে নিয়ে সিপাইকে নির্দেশ দিলেন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতে। সিপাইটি বেরিয়ে যেতে মতিলালবাবু আলমারিটার কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, বাইরে আসুন পান্না দেবী, কোন ভয় নেই।
এতক্ষণ আমার নজরই পড়ে নি যে পান্নার শাড়ির একটা কোণা আলমারির দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। পান্না বেরিয়ে এল আলমারির গহ্বর থেকে। আর আমার যেন বলতে ইচ্ছে হল, আমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দাও প্রভু!
পান্নাই আমার লজ্জা মাথা পেতে নিতে চাইল। দেখুন, বাধ্য হয়ে রীতিশবাবুর এখানে আশ্রয় নিয়েছি। উনি মিথ্যে কথা বলেছেন আমার মুখ চেয়ে।
মতিলালবাবু বললেন, আমারই একটু ভুল হয়েছে। দ্বিতীয় আর একজনকে সঙ্গে না নিয়ে এলে রীতিশবাবুর এতগুলো মিথ্যে বলবার প্রয়োজন হত না। পান্না দেবী, আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম যে খুনী এবার আপনার পেছনে লেগেছে, তাই আমি আরো কয়েকজন পুলিশ নিয়ে বিকেল থেকে আপনাদের বাড়ির আশেপাশে লুকিয়েছিলাম। আপনি যখন এখানে পালিয়ে আসেন, তখনো আমাদের লোক আপনার পেছনে ছিল। আজকে আর আপনার মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। তবে লোকটাকে আজ রাতেই গ্রেপ্তার করতে হবে। ওকে আর এক মুহূর্তও সমাজে ছেড়ে রাখা নিরাপদ নয়। যে মৃত্যু-নেশা ওকে পেয়ে বসেছে, তার পরিসমাপ্তি আজকেই ঘটাতে হবে।
ওই লোকটাকে তাহলে ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন সত্যব্রতবাবু। আজকেও তারই উপস্থিতি ঘটেছিল পান্নার শোবার ঘরে। পান্নাকে খুন করবে বলেই কয়েকদিন থেকে সত্যব্রতবাবুর বাড়ির আশেপাশে তাকে দেখা গিয়েছিল। লণ্ঠনের হঠাৎ একটা ঝলকানিতে প্রথম খুনের দিন আমি ওকে আবছা দেখেছিলাম। আর কোনদিন নজরে পড়েনি, যদিও সত্যব্রতবাবু প্রায়ই তাকে দেখেছেন।
মতিলালবাবু আবার বললেন, চলুন আপনারাও।
আমরা গিয়ে···
চলুন, অন্তত কিছুটা সাহায্য করতে পারবেন।
পান্না বললে, আমার বাবা কোথায় গিয়েছেন জানি না। আপনারা কি জানেন?
মতিলালবাবু দ্রুত ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হতে বললেন, যাবেন আর কত দূর—কাছেই আছেন হয়তো কোথাও।
অন্ধকারে নিঃশব্দে দ্রুত আমরা পান্নাদের বাড়ির বাগানের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সমস্ত বাড়িটাতে অন্ধকার—আকাশে স্বচ্ছ চাঁদ। মতিলালবাবুর নির্দেশ মত পাশাপাশি দুটো হাসনাহানার ঝোপে পান্না আর আমি লুকিয়ে রইলাম। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। সত্যব্রতবাবুর পোষা পাখিগুলো কিচির-মিচির শুরু করেছে। মতিলালবাবু আমাদের বসিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়েছেন। প্রায় দশ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। হঠাৎ ভীষণভাবে চমকে উঠলাম, সম্ভবত পান্নাও। যার আশায় আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে আছি, সেই লোকটি অত্যন্ত মন্থরগতিতে ঝোপের উল্টো দিক থেকে এগিয়ে আসছে।
নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি, কতক্ষণে লোকটাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। যেই মুহূর্তে নাগালের মধ্যে পেলাম, অমনি ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর। পান্নাও যেন তৈরি ছিল—সেও রীতিমত সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে।
এই ছাড়···ছাড় রীতিশ···আমি দিব্যেন্দু···ছাড়, গলাটা ছেড়ে দে···
একি! এমন একটা অসম্ভব ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। এই ঘটনায় পান্নাও কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে। তাহলে প্রথম থেকে যাকে খুনী বলে সন্দেহ করেছি—যাকে প্রথম খুনের রাতে হঠাৎ লণ্ঠনের আলোয় দেখেছি, যাকে পান্না তার ঘরে দেখেছে সে যে দিব্যেন্দু, আচমকা এই আবিষ্কারে আমি ক্রমে উৎফুল্ল হয়ে উঠি।
আমাদের হুটোপুটি ধস্তাধস্তির শব্দে সত্যব্রতবাবু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন উত্তেজিতভাবে। আমাদের দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন।
রীতিশবাবু আপনি! আরে, পান্নাও যে—ব্যাপার কি? এই লোকটাকে ধরে ফেলেছেন দেখছি—এক্ষুণি পুলিশে খবর দেওয়া দরকার—
আমরা এসে গেছি সত্যব্রতবাবু।
নাটকীয়ভাবে সাব-ইন্সপেক্টর মতিলালবাবু এবং আরো তিনজন সিপাই তিনদিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল সত্যব্রতবাবুকে।
দিব্যেন্দু বলল, দেরি না করে হাতকড়াটা পরিয়ে দিন মতিলালবাবু—
মতিলালবাবু হাতকড়া পরিয়ে দিলেন সত্যব্রতবাবুর হাতে। সত্যব্রতবাবু কেমন স্থির হয়ে গেলেন মুহূর্তে। তিনি যেন প্রতীক্ষা করেই ছিলেন—হাত দুটো জোড়া করে এগিয়ে দিয়েছিলেন মতিলালবাবুর দিকে।
পান্না চিৎকার করে উঠল ‘বাবা’ বলে, এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পরপর এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেখে হতবাক হয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। একি অসম্ভব কাণ্ড ঘটে গেল!
ক্রমে ভোরের আলো ফুটছে, পূর্ব দিগন্তে লালের আভা। দূরে কোথায় যেন মুরগির ডাক শোনা গেল।
দিব্যেন্দু বলল, পান্নাকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দে রীতিশ—একটু পরেই জ্ঞান ফিরবে।
পান্নাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে ওর খাটে শুইয়ে দিলাম। বাইরে এসে দেখি, তিনজন সিপাই সত্যব্রতবাবুকে নিয়ে থানার দিকে রওনা দিয়েছে। দিব্যেন্দু আমাদের নিয়ে যেখানে উপস্থিত হল, সতাব্রতবাবুর বাড়িতে এলেও, সেখানে কোনদিন আসিনি। অথচ এমন একটি দর্শনীয় বস্তু তিনি কেন যে আমাকে দেখাননি প্রথমে বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম একটু পরেই।
দুই বর্গফুট স্থান কাচ দিয়ে ঘেরা, ওপরে সূক্ষ্ম তারের জাল দেওয়া। ভেতরে চমৎকার একটি সোনালী রংঙের আভাযুক্ত ফুল। বড় বড় পাপড়ি। অনেক নাম-করা ফুলের সৌন্দর্যকেও হার মানায় এর সৌন্দর্য। মাটি থেকে ওঠা একটা ডাঁটার ওপর ফুলটা ফুটে রয়েছে। গাছটার কোথাও কোন পাতা নেই।
দিব্যেন্দু পকেট থেকে একটা শিশি বার করে কয়েক ফোঁটা তারের জালের ওপর দিয়ে ফুলটার মধ্যে ফেলল। গন্ধে বুঝলাম, ওটা নাইট্রিক অ্যাসিড। এমন সুন্দর ফুলটার ওপর এ ধরণের আচরণে খুব দুঃখ হল। কিন্তু জানি, দিব্যেন্দুর সৌন্দর্যবোধ আমার চেয়ে কম নয়। বাধ্য হয়ে যে তাকে এ কাজ করতে হচ্ছে, তা বুঝতে পারলাম। একটু পরেই দেখা গেল ফুলের পাপড়িগুলো থরথর করে কাঁপছে এবং তার কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর একেবারে স্তব্ধ।
এবার কাচের দরজা খুলে ফেলল দিব্যেন্দু। ফুলটার ভেতর থেকে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কোয়ার্টার ইঞ্চি একটা নীল রঙের পোকা বার করল।
দিব্যেন্দু বলল, যতগুলো খুন হয়েছে সব এই পোকাটাই করেছে। তবে চালনা করেছেন সত্যব্রতবাবু।
মতিলালবাবু বললেন, তাই তো দুটো খুনের ক্ষেত্রেই দেখলাম দরজা-জানলা সব বন্ধ, কোথাও পায়ের বা হাতের ছাপ নেই—এখন বুঝতে পারছি এই ছোট্ট পোকাটা ঘুলঘুলি বা যে কোন সামান্য ছোট ফুটোর ভেতর দিয়েই প্রবেশ করতে পারত। আপনি সময় মত উপস্থিত না থাকলে সত্যিই এই রহস্যের উদ্ঘাটন সম্ভব হত কিনা সন্দেহ।
আমার দিকে চেয়ে দিব্যেন্দু বললে, তোর অনেক প্রশ্ন রীতিশ, সবগুলোর উত্তর এখন দেওয়া সম্ভব নয়, বাইরে তাকিয়ে দেখ রোদ উঠে গেছে, এখন প্রয়োজন চা···পান্নার জ্ঞান ফিরল কিনা দেখ। আর আজকেই ওর হাজব্যাণ্ডকে টেলিগ্রাম করে দে, পান্নাকে নিয়ে যাবার জন্য।
একটু গোড়া থেকেই বলি রীতিশ। তুই শর্মিষ্ঠার চিঠি পেয়েছিস। সত্যি আমি এক সাধুর সঙ্গে কলকাতা ত্যাগ করেছিলাম মাসখানেক আগে। তিনি আমাকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর একদিন সকালে উঠে তাঁকে আর দেখলাম না। অনেক খোঁজ করেও দেখা মিলল না।
কলকাতা ফের ফিরব সাব্যস্ত করলাম, হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল। বহুদিন দেখা হয়নি—এই ফাঁকে একবার দেখা করে যাই ভেবে চলে এলাম। বেশ রাত করে ট্রেনটা নিউ ময়নাগুড়ি এল। রিক্সা বা ট্যাক্সি কিছুই পেলাম না স্টেশনে—সম্ভবত বর্ষার জন্য। জানিসই তো আমার মনটা চিরকালই সন্দেহবাতিক। ওই দুরন্ত বর্ষার মধ্যেও দেখি একজন বর্ষাতি-গায়ে যে বাড়িটায় প্রথম খুন হল, তার আশেপাশে সন্দেহজনক অবস্থায় ঘুরছে। একটু লুকিয়ে থেকে দেখলাম, লোকটা বর্ষাতির ভেতর থেকে কি একটা বার করে ছেড়ে দিতেই সেটা উড়ে গিয়ে ঘুলঘুলিটার ওপর বসল। লোকটা এরপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। পরে বুঝলাম, যেটা ছেড়ে দিতেই উড়ল, সেটা একটা পাখি। মিনিট তিনেক পর পাখিটা আবার ফিরে এল। এরপর লোকটা সেখান থেকে চলে গেল। বন্ধ করা জানলার কাচের ভেতর দিয়ে যা চোখে পড়ল, তাতে আঁতকে উঠলাম। ঘরের ভেতরের স্ত্রী-লোকটি মৃত্যর কোলে ঢলে পড়েছে।
লোকটার পিছু নিয়ে দেখলাম যে, তোর বাড়িতে গিয়ে চমৎকার অভিনয় করল। তোর বাড়িটাও আমার চেনা হয়ে গেল। বুঝলাম, তোর সঙ্গে লোকটির যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। তুই ওর অভিনয় ধরতে পারছিলি না।
আমি ওখান থেকে সরাসরি চলে এলাম খুনের জায়গায়। ব্যাপারটা ভাল করে বোঝবার জন্য। তুই পাছে আমায় চিনে ফেলিস, তাই তো জ্বলন্ত লণ্ঠনটা ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তুই চিনে আমার পরিচয় ওঁকে দিয়ে দিলে তদন্তে অসুবিধে হত।
তারপর বিভিন্ন সময়ে সত্যব্রতবাবুর বাড়িতে খোঁজ-খবর নিয়েছি। ওঁর ডায়ারি চুরি করেছি। উনি ছিলেন অধ্যাপক। কিন্তু অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেও ইকনমিক্সের ওপর অত বই তাঁকে পড়তে দেখে অবাক হয়ে যাই। ভাল করে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখলাম, জনসংখ্যার ওপর অংশগুলোতে ওঁর নজর বেশি। সত্যব্রতবাবুকে খুব বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল পপুলেশনের ওপর ম্যালথাসের থিয়োরিটি। তাঁর ধারণা জন্মেছিল এ হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে, একদিন পৃথিবী তার ভার বইতে পারবে না—তখন সমস্ত মনুষ্যজাতিই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি মনুষ্যজাতির কল্যাণের জন্যই জনসংখ্যা কিভাবে কমানো যায় ভাবতেন। আসলে এ সময় থেকেই তিনি মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
তিনি ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। বক্সাদুয়ারে বেড়াতে গিয়ে আলাপ হল এক লামার সাথে। সেখানেই সংগ্রহ করলেন পোকাটিকে। ওই পোকাটির নাম সম্ভবত ‘কুয়াংকার’। এই পোকার বাস যেখানে, তা আবার এমন দুষ্প্রাপ্য যে সচরাচর মেলে না। যে ফুলটিকে দেখেছি সত্যব্রতবাবুর বাড়িতে, সেটাই হচ্ছে সেই দুষ্প্রাপ্য ফুল। ওর নাম ‘গারগাম’। গারগামের রস খেয়েই কুয়াংকার বেঁচে থাকে।
সবচেয়ে মজার কথা, পোকাটা ভাল উড়তে পারে না। সেটা অবশ্য মঙ্গল বলতে হবে—নাহলে জীবজগতের বহু প্রাণী প্রাণ হারাত। যখন কাউকে খুন করবার প্রয়োজন হত, একটা পাহাড়ী পাখির ঠোঁটে পোকাটাকে বহন করে ঘরের কোন ছোট ফুটোর সামনে ছেড়ে দিলেই পোকাটা ঘরের জীবটির ওপর তার তীব্র বিষাক্ত হুল বিঁধ িয়ে দিয়ে ফের ফিরে আসত, যেখানে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে। তারপর পাখিটা আবার ঠোঁটে নিয়ে ফিরে আসত নির্ধারিত জায়গায়।
অনেকগুলো পাখির মধ্যে এই বিশেষ পাখিটাকে মিশিয়ে রাখতেন সত্যব্রতবাবু। যার জন্য আমি পোকাটাকে কিছুতেই বাগাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে কুয়াংকারকে মেরে ফেলতে হল।
এর মধ্যে আর একটা খুন করেছেন সত্যব্রতবাবু। এও ছিল সন্তানসম্ভবা। তিনি ভেবেছিলেন, সন্তান-সম্ভবা নারীদের মেরে ফেলতে পারলে অনেকখানি কাজ হবে। মানসিক রোগাক্রান্ত হবার পর হয়তো তিনি এই খুনের মধ্যে আরো লজিক খুঁজে পেয়েছিলেন। আমি এ সময় ওঁর ডায়ারি চুরি করেই বক্সাদুয়ার যাই, নাহলে হয়তো দ্বিতীয় খুনটা রোধ করতে পারতাম।
তৃতীয় খুনের জন্য সত্যব্রতবাবু প্রস্তুত হচ্ছিলেন। প্রথমে বুঝতে পারিনি এবারকার অভাগিনী কে! কিন্তু হঠাৎ পান্নাকে দেখলাম। মনে হল সন্তান-সম্ভবা। সত্যব্রতবাবু দু’দিন পূর্বের তারিখে ডায়ারিতে লিখেছেন, ‘হোক নিজের সন্তান—মনের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে পৃথিবীর অমঙ্গল হবে—আমার সাধনা সফল করতেই হবে।’—ইত্যাদি। বুঝলাম, এবার পান্নার পালা। বেচারি জানতেও পারছে না, তার জন্মদাতা পিতাই আজ মৃত্যুবাণ প্রয়োগ করতে চলেছেন ওর বিরুদ্ধে।
কিছুতেই পান্নাকে সজাগ করবার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মুখে কথা হওয়ার সম্ভাবনা কম অনুমান করে চিঠি লিখে ওর হাতে পৌছে দিলাম রাতেই। এ সময় সত্যব্রতবাবু বাড়ির ভেতর দিকে পাখির খাঁচায় বিশেষ পাখিটাকে বার করতে ব্যস্ত ছিলেন।
সাব-ইন্সপেক্টর মতিলালবাবু, তাঁর দলবলসহ সন্ধ্যে থেকে পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন। পান্না চিঠি পেয়ে যে ওর বাবাকে না পেয়ে তোমার কাছে ছুটে আসবে জানতাম। ও যে সন্তান-সম্ভবা নয়, সেই দুঃখের কথা আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছি।
তুই অনেক দিন আমার সহকারী থেকেও পান্নাকে চিঠিটা লেখার লেখককে ধরতে পারলি না। ধরতে পারলে নিশ্চয়ই তুই পান্না-সহযোগে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তিস না। অবশ্য দোষ তোকে দেওয়া যায় না—কারণ এ রকম গোঁফ-দাড়ি আমার আগে ছিল না। সাধুজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পর থেকে দাড়ি কামাই নি।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। পান্নার অপারেশন হয়েছে কলকাতায়। ডাক্তাররা ওকে বাঁচাতে পারে নি। কোর্ট থেকে সত্যব্রতবাবুকে রাঁচি পাঠাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমার মা ও বোন লিলি ও মিলি কলকাতায় এসেছে জানতে পেরে আমি ক’দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় গেলাম। সত্যব্রতবাবুর কথা মনে হওয়াতে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আগামী কাল তাঁকে ট্রেনে রাঁচি পাঠানো হচ্ছে। পরের দিন তাঁর সঙ্গে স্টেশনে দেখা করলাম। তিনি হাত তুলে নমস্কার করেলন। ট্রেন ছাড়ার পূর্বে বললেন, পান্নার সঙ্গে দেখা হল না, ও যেন আমায় ক্ষমা করে।
আরো হয়তো কিছু বললেন, ট্রেনের শব্দে তা মিলিয়ে গেল। আমিও বলতে পারলাম না যে, পান্নার সঙ্গে আপনার আর দেখা হবে না।