কুমেরু থেকে তিমিঙ্গিল – মনোরঞ্জন দে
সমুদ্র—মেখলা দ্বীপ। সীমাহীন সিন্ধুর বুকে ক্ষুদ্র একটি বিন্দুর মতো জেগে আছে অজ্ঞাত এই দ্বীপটি। একদিকে যেমন দামাল বাতাস ক্লান্তিহীন বেগে উড়িয়ে নিতে চাইছে গাছগাছালির সবুজ ওড়নাখানি, অন্যদিকে তেমনি তরঙ্গিত আনন্দে নির্লজ্জের মতো সমুদ্র এসে ঢলে ঢলে পড়ছে দ্বীপের গায়ে। আকাশে মেঘ নেই, আছে পাখির ঝাঁক। বাতাসে তাদেরই অবিশ্রান্ত কিচিরমিচির আওয়াজ।
ভারত মহাসাগরে দ্বীপ আরও অনেক আছে। কিন্তু এমনটি বুঝি নেই। এমন জনমানবশূন্য বিজন দ্বীপ আর একটি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। অফুরন্ত সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও দ্বীপটি এতকাল কেন যে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে ছিল সেটাই এক পরম বিস্ময়।
প্রথম যেদিন দ্বীপটিকে দেখি সেদিন আমার মনেও বিস্ময় দানা বেঁধে উঠেছিল। নরখাদক আদিবাসী কিংবা হিংস্র পশু, কোনোটাই নেই এখানে। বিষাক্ত কীটপতঙ্গও নেই যে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। অথচ সভ্য মানুষের আওতা থেকে দিব্যি গা বাঁচিয়ে ছিল মনোরম এই দ্বীপটি।
এখন অবশ্য দ্বীপটি আর ততটা নির্জন নয়। আমরা উনিশজন ভারতীয় আশ্রয় নিয়েছি এখানে। সঙ্গে আমাদের চারটি শিকারি কুকুর। সুদৃশ্য একটি ইমারত আমাদের আস্তানা। ইমারতের মাথায় ছোট একটি গম্বুজ। সেখানে বাতাসের গতি—নির্দেশক যন্ত্র বসানো। সমুদ্রের তীরে জাহাজ—ঘাট আর দ্বীপের মাঝে বিমান অবতরণের জন্য রানওয়ে। একদিকে একসারি সুপ্রশস্ত গুদামঘর, অন্যদিকে প্রমোদকক্ষ। একদিকে গৃহপালিত পশুপাখি রাখবার জন্য কতকগুলি ছোট ছোট ছাউনি, অন্যদিকে অতিকায় একটি রাডার যন্ত্র ধীর ছন্দে, অবিরাম বেগে আকাশের কোনা কোনা থেকে সংবাদ এবং সঙ্কেত আহরণে ব্যস্ত।
রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুন্দর এক প্রভাতে বর্তমান কাহিনির সূত্রপাত। সেদিনও রেডিও মারফত সংবাদ আদান—প্রদান চলছিল। হঠাৎ রেডিওতে ছোট্ট একটি সংবাদ ভেসে এসে দ্বীপের উনিশজন মানুষের মধ্যে যেন ছোট্ট একটি বিস্ফোরণ ঘটাল। প্রথমে ফিসফিস, পরে গুনগুন এবং শেষে সোরগোল উঠল তাদের মধ্যে।
দ্বীপটির অবস্থান ৮০০ পূর্ব দ্রাঘিমায় এবং ৩৯.৩০০ দক্ষিণ অক্ষাংশে। কলম্বো এখান থেকে ৩১২০ মাইল উত্তরে। আফ্রিকার কেপটাউন সমুদ্রপথে ২৯০০ মাইল এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ২৯১৫ মাইল। দ্বীপটি কুমেরু প্রদেশের অধিকতর নিকটবর্তী। দূরত্ব মাত্র ১৫০০ মাইল।
কুমেরু থেকে একটি অস্ট্রেলীয় বিমান পার্থ—এ ফিরে যাচ্ছিল। একদল মেরুবিজ্ঞানী তাতে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল পাঁচটি পেঙ্গুইন পাখি এবং দুর্লভ কতকগুলি গাছপালার নমুনা। সবই অবশ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। এই ছিল মোটামুটি খবর।
কিন্তু এজন্য তো আমাদের মাঝে চাঞ্চল্যের কোনো কারণ থাকতে পারে না। চাঞ্চল্যের কারণ অন্যত্র। হিয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ ছাড়বার কিছুক্ষণ পরে বিমানটিকে জানানো হল যে ভারত মহাসাগরের একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিমানটি যেন পার্থ—এর দিকে না গিয়ে আমাদের দ্বীপে নেমে পড়ে। ব্যাপারটা ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে। সপ্তাহে আমরা মাত্র একবার বিমানের দেখা পাই। সেটাও মাত্র ঘণ্টা কয়েকের জন্য। ফুয়েল দিয়ে ট্যাঙ্ক বোঝাই করে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভার নামিয়ে দিয়ে বা তুলে নিয়ে বিমানটি আবার অন্তর্হিত হয়। জাহাজের দেখা মেলে ন—মাসে—ছ—মাসে একবার। কিন্তু অস্ট্রেলীয় বিমানটি এখানে থাকবে ষোলো ঘণ্টা। বিমানের সাতজন যাত্রী এবং তিনজন নাবিক এখানে ষোলোটি ঘণ্টা আমাদের মাঝে হৈ—হট্টগোল করে কাটাবে। প্রতিটি মুহূর্ত তারা ঘরে ফেরার আনন্দে মশগুল হয়ে থাকবে। আর আমাদের মনে করিয়ে দেবে আমাদের আত্মীয়—পরিজনের কথা, হাজার তিনেক মাইল দূরে আমাদের ঘরবাড়ির কথা।
অ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার হিসেবে আমাকে সব কিছু সামলে নিতে হবে। আমার অধস্তন কর্মচারীরা যতই ঘরে ফেরবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে, আমার অস্বস্তিও ততই বাড়বে।
সমস্যা আরো আছে।
আমার স্টাফদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় সুতপা চৌধুরীর। চলনে—বলনে আদব—কায়দায় পোশাকে—আশাকে মার্জিতস্বভাব এই মেয়েটি মাসখানেক আগে সবে এখানে এসেছে। চোখে তার এখনও আনন্দোজ্জ্বল দ্যুতি। অপর সকলের মতো এখনও দ্বীপের নির্জনতাকে একঘেয়ে বলে ভাবতে শেখেনি। পাওয়ার—অফিসার জীমূতবাহন সেন রোমান্টিক মনোভাব নিয়ে তার সাথে মেলামেশা করলেও সে বড় একটা আমল দেয়নি তাকে। তার এই নিরুত্তেজ ব্যবহার জীমূতবাহনের কাছে বিশেষ ভালো লাগে না। প্রেমের ব্যাপারে পাছে কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, এই ভয়ে সে সর্বদাই শঙ্কিত। স্বভাবতই নতুন কোনো মানুষের আগমন তার কাছে বিরক্তির কারণ হয়।
স্টাফদের মধ্যে আরো তিনটি মেয়ে আছে। নাম তাদের চিত্রিতা, শশীকলা এবং মীনা। প্রেমের ব্যাপারে তারা কেউই একনিষ্ঠ নয়। তাদের দিলদরিয়া মেজাজে আগন্তুকেরা যেমন সন্তুষ্ট হয়, প্রেমিকেরা হয় তেমনি বিরসবদন। তাই প্রতিটি বিমান এখান থেকে চলে যাবার পর নিজ নিজ প্রেমিকের সাথে তাদের সংঘাত অনিবার্য।
আর আছে মুসলমান পাচক করিম বক্স মোল্লা। নিজে যেমনি খেতে পারে, অপরকেও সে খাওয়াতে পারে তেমনি। নতুন কোনো বিমান আসতে দেখলে সে খুশিই হয়। খাইয়ে বাহবা পাবে এর চেয়ে বড় তৃপ্তি তার কাছে বুঝি আর কিছু নেই। কিন্তু কোনো কারণে যদি তার রান্না আগন্তুকদের রুচিপ্রদ না হয় তবেই মুখখানা আমসি হয়ে যায়।
চারজন মেকানিকও আছে। আগন্তুকদের সাথে তারা পোকারের আসর জমাতে চায়। জিততে পারলে আনন্দের আর সীমা থাকে না তাদের। কখনো দেখা যায় পোকারের আসর জমানোর চাইতে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতেই আগন্তুকেরা বেশি ব্যস্ত। সেক্ষেত্রে তারা কপাল চাপড়িয়ে ‘হা হতোহস্মি!’ করে, নয়তো আড়ালে—আবডালে মেয়েদের প্রচণ্ড ধমক দেয়।
মেকানিকদের কাজে সাহায্য করবার জন্য আছে সুগ্রীব পট্টনায়ক। আগন্তুকেরা যখন চলে যায় তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ভাবে : হায়! সে—ও যদি তাদের সাথে যেতে পারত তবে আগের মতো সিনেমা দেখে দিন কাটাতে পারত নির্বিবাদে।
জীববিজ্ঞানী রোহিতাশ্ব ভাবা আছেন। নিজের গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। বিমানের আগমন বা অন্তর্ধান তাঁর চির—উদাসীন মনে কোনো রেখাপাতই করে না। এমন যে বৈজ্ঞানিক তিনিও চঞ্চল হয়ে উঠেছেন অস্ট্রেলীয় বিমানটির আগমন—বার্তা শুনে। কারণও অবশ্য আছে। বছরখানেক আগে হেলিকপ্টারে চেপে কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ অঞ্চল তিনি বেড়িয়ে এসেছেন। আকাশ থেকে কিছু ছবিও তুলে নিয়েছেন। সীমাহীন বরফের রাজ্যে কয়েক শ’ বর্গ মাইল উন্মুক্ত জমি দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। দেখেছেন, আশমানি রঙের উষ্ণ জলধারা বয়ে যাচ্ছে সেখানে। তারই প্রভাবে বিচিত্র সব উদ্ভিদ সেখানে ছড়িয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে কুমেরুতে বরফের পাহাড় জমে উঠেছিল। প্রাণসৃষ্টির সেই আদিপর্বেই সেই তল্লাট অবশিষ্ট পৃথিবীর সাথে সংস্রব হারিয়েছে। তাই ওখানকার উদ্ভিদ বা প্রাণীর পরিচয় সভ্য জগতের মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। হেলিকপ্টার থেকে নেমে সরেজমিনে তদন্ত করতে পারেননি বলে তাঁর আপসোস রয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি সেই সুযোগ পাবেন। অস্ট্রেলীয় বিমানটিতে আছে উষ্ণ হ্রদ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত উদ্ভিদের কিছু নমুনা। তাই উদগ্র কৌতূহলে তিনি বিমানটির আগমন প্রত্যাশা করছেন। এবার তিনি আশ মিটিয়ে সেসব গাছপালা নিয়ে পরীক্ষা চালাবেন।
একদিক দিয়ে ব্যাপারটা অবশ্য ভালোই। বৈচিত্র্যহীন রুটিনমাফিক কাজকর্মে একটু নতুনত্ব আসবে। অসীম নীল আকাশ আর অনন্ত এই জলরাশি দেখে দেখে অরুচি ধরে গেছে। তার ওপর রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক পাখি। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, চিৎকার করে, আর পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে বেড়ায়। আমাদের অবসন্ন স্নায়ুতেও তাদের প্রভাব সংক্রামিত হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই রোমান্সের নেশায় একে অপরের সাথে অহেতুক কলহে লিপ্ত থাকে।
এবার একটু ছন্দপতন ঘটবে। ইতিমধ্যেই তার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
রেডিওতে প্রথম যখন খবর পাওয়া গেল, তার দু’ঘণ্টা আগে বিমানটি যাত্রা শুরু করেছে। সর্বসাকুল্যে ১৫০০ মাইল পাড়ি দিতে হবে তাকে। একটানা পাঁচ ঘণ্টা উড়ে এসে এখানে নামবে। সেই থেকে প্রায় আড়াইটি ঘণ্টা আমরা অপেক্ষা করে আছি। আর মাত্র চৌত্রিশ মিনিট পরে বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করবে।
নিজের নিজের আয়নার সামনে মেয়েরা প্রসাধনে লিপ্ত ছিল। জীমূতবাহন ডেকে নিয়ে গেল সুতপাকে। লোকটার এই দোষ আর সারল না দেখছি। যখনই কোনো বিমান আসবার সম্ভাবনা দেখা যাবে, তখনই সে একবার করে সুতপাকে সাবধান করে দেবে যেন নতুন লোকদের সাথে সে না মেশে। কিন্তু মেয়েরা হচ্ছে ঝাঁকের কই—ঝাঁক বেঁধে চলাই তাদের অভ্যেস। সঙ্গীসাথীরা যে কাজ করবে, ইচ্ছে না থাকলেও তাদের কমবেশি সেই কাজ করতে হয়। অথচ জীমূতবাহন কোনো অজুহাতই শুনতে রাজি নয়।
ভারত মহাসাগরে আর যে—সমস্ত দ্বীপ আছে সেগুলি হয় ব্রিটিশদের, নয়তো ফ্রান্সের কিংবা অস্ট্রেলিয়ার। এটার মতো বেওয়ারিশ কেউ নয়। আজ পর্যন্ত আমি কিন্তু এর কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। প্রথম যেদিন আমরা দ্বীপে পদার্পণ করি, সেদিন সমুদ্রের তীরে একটা ভাঙাচোরা নৌকা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম ইতস্তত ছড়ানো কিছু কংকাল। তিমি শিকার করতে এসে একটা দল হয়তো সমুদ্রে প্রবল ঝড়ের কবলে পড়েছিল। ঝড় থেকে তারা রেহাই পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু….
আর মাত্র উনিশ মিনিট পরেই বিমানটি ভূমি স্পর্শ করবে।
শর্ট ওয়েভ রেডিও সেটের পাশে অপারেটর বসে আছে। কানে তার হেডফোন। বুকের কাছে ঝোলানো মাইক্রোফোনে মাঝে মাঝে সে কথা বলছে। একজন তার কাজ লক্ষ করে যাচ্ছে। তিনজন তাকিয়ে আছে রাডার স্ক্রিনের দিকে। বিমানটিকে চর্মচক্ষে দেখতে পাবার অনেক আগেই রাডার স্ক্রিনে তার অবস্থান ধরা পড়বে।
অপারেটর স্পিকারের বোতাম টিপে দিতেই বিমানের ভেতর থেকে কেমন একটা সোরগোলের শব্দ ভেসে এল।
একজনের গলা শোনা গেল, ‘হচ্ছেটা কি? এত হট্টগোল কীসের?’
আর একজন জবাব দিল, ‘কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই—দাঁড়াও দেখে আসি।’
গণ্ডগোল হঠাৎ বেড়ে গেল। পাইলটদের একজন বোধ করি ককপিটের দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে বিস্মিত আর্তনাদ, ‘কী সর্বনাশ! ওটা আবার কি?’
‘পিস্তল….একটা পিস্তল….শিগগির!’
‘দরজা খোল….কারগো ডোর খুলে দাও!’
‘চেপে ধর….জোরে….আরো জোরে!’
‘মারো ঠেলা….হেঁইও, আরো জোরে….হেঁইও!’
হৈ—চৈ আর্তনাদ চিৎকার ছাপিয়ে হঠাৎ দুড়ুম করে পিস্তল গর্জে উঠল। আবার। তারপর আরো একবার।
ঝিনঝিন করে একটা শব্দ। ক্র্যাক করে একটা আওয়াজ। ব্যস, লাউডস্পিকার স্তব্ধ হয়ে গেল।
একটা গুলি সম্ভবত সচল ট্রান্সমিটারকে অচল করে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া—চাওয়ি করতে লাগলাম।
সম্বিৎ ফিরে আসতেই অপারেটর দরাজ গলায় চেঁচাতে লাগল, ‘কলিং আইসক্যাপ! কলিং আইসক্যাপ! উত্তর দাও, আইসক্যাপ! কি হয়েছে বল।’
কিন্তু বৃথাই সমস্ত চেষ্টা।
রাডার স্ক্রিনে তখন ক্ষুদ্র একটা বিন্দু ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিমানটি যে তখনও দ্বীপের দিকেই এগিয়ে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রেডিও অপারেটরকে ঘিরে দশ—বারো জোড়া চোখ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল রাডার স্ক্রিনের ওপর। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
আমিই প্রথম স্তব্ধতা ভঙ্গ করলাম, ‘বিমানটা বাঁক নিল দেখছি! পাইলটকে জানিয়ে দেওয়া দরকার।’
অপারেটর বলল, ‘কিন্তু ওদের ট্রান্সমিটার যে অকেজো হয়ে গেছে। কোনো সংবাদই পাঠাতে পারছে না!’
‘রিসিভার তো ঠিক থাকতে পারে। ওরা পাঠাতে পারছে না—আমাদের কথা তো পৌঁছোতে পারে। পাইলটকে জানিয়ে দাও যে তার বিমান ভুল পথে যাচ্ছে।’
বুকে ঝোলানো মাইক্রোফোনে অপারেটর চেঁচাতে লাগল, ‘কলিং আইসক্যাপ! কলিং আইসক্যাপ। তিমিঙ্গিল দ্বীপ থেকে তোমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছ। তোমাদের প্রকৃত পথ পনেরো ডিগ্রি। অথচ তোমরা তিনশো চল্লিশ ডিগ্রির দিকে যাচ্ছ। তোমরা পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি ভুল পথে যাচ্ছ। পথ ঠিক করে নাও।’
বারকতক নির্দেশ দেওয়ার পর দেখা গেল বিমানটি ঘুরে পথ ঠিক করে নিচ্ছে। তিমিঙ্গিল দ্বীপের সাথে বিমানটির দূরত্ব তখনও চল্লিশ মাইলের ওপর।
তিমিঙ্গিল দ্বীপ! হ্যাঁ, তিমিঙ্গিলই বটে। নাহলে তিমি শিকারিদের এমন হাল হবে কেন? গোটা সমুদ্র চষে বেড়িয়ে দ্বীপে নেমে তারা মৃত্যুবরণ করবে কেন? নামটা অবশ্য আমি ঠাট্টাচ্ছলেই দিয়েছিলাম।
বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওপরে ধূসর রঙের আকাশ। সমুদ্রের তীরে ছোটখাটো পাহাড়গুলির রং ধূসর। তীরে এসে সমুদ্রের যে ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছে, তাদের রংও ধূসর। এদের সাথে মিলেমিশে ইমারতগুলিও দাঁড়িয়ে আছে ধূসর রঙের চাদর গায়ে দিয়ে। বর্ণসুষমার এই সামঞ্জস্যের মাঝে লাল রঙের বায়ুনির্দেশক যন্ত্রটি রানওয়ের শেষপ্রান্তে একটি গম্বুজের মাথার ওপর প্রচণ্ড ব্যতিক্রমের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
এদিককার সবাই যখন বিমানের আগমন প্রতীক্ষায় নিদারুণ উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছে, তখন পাওয়ার অফিসার জীমূতবাহন সেন হাজির হল প্রচণ্ড ব্যতিক্রমের মতো। সাথে তার সুতপা চৌধুরী।
আমাকে দেখে সুতপা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ‘বিমানে যারা আসছে, তারা অতিথি—অভ্যাগত তো বটে! একটা সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করলে কেমন হয়?’
কথাটা যে জীমূতবাহনের কানে মধুবর্ষণ করবে না তা জানি। জীমূতবাহনের অসহায় মুখভঙ্গি প্রমাণ করে দিল সে কথাটা তার প্রাণে বড় বেজেছে। সুতপার অধর দংশন দেখেও বুঝলাম মনে মনে সে দুষ্টু হাসি হাসছে।
অন্য সময় হলে এই পরিস্থিতি আমি চুটিয়ে উপভোগ করতাম। হয়তো বা কিছু ইন্ধনও যোগাতাম। কিন্তু তখন আমার সে মনের অবস্থা নয়।
সুতপাকে পাইলটের অদ্ভুত আচরণের কথা বললাম। সম্ভাব্য বিপদের কথা জানালাম। দুজনেই চঞ্চল হয়ে উঠল। জীমূতবাহন চাইল স্ট্রেচার এবং ফার্স্ট—এড বক্স হাতের কাছে তৈরি রাখতে। সুতপা চাইল সাময়িক ভাবে রেডিও অপারেটরের কাজ হাতে নিতে। পুরুষের গলা যে কাজ না করতে পেরেছে, মেয়েলি গলা হয়তো তাই করতে সমর্থ হবে। শত হলেও সুরেলা মেয়েলি গলার এক বিশিষ্ট আকর্ষণী শক্তি আছে।
আমার সম্মতি নিয়ে সুতপা রেডিও—ঘরের দিকে চলে গেল। আমি গেলাম এমার্জেন্সি স্টোরের দিকে। কি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এখনো জোর করে বলা যায় না। বিমানের আরোহীরা প্রবল বিভীষিকা দেখে মানসিক অবসাদে ভুগতে পারে। হয়তো বা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। কিংবা এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে যে আমাদের পক্ষে সেটা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অবস্থা যাই ঘটুক না কেন তার মোকাবিলা তো করতে হবে!
রেডিও—ঘরে ঢুকে দেখি অপারেটর তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘ব্যাপার কি বল তো? বারে বারে বাঁ—দিকে মোড় নিচ্ছ কেন? ওদিকটায় আফ্রিকা ছাড়া ধারে—কাছে আর কোনো ভূভাগ নেই। ওদিকে গেলে আড়াই হাজার মাইলের আগে তোমরা নামতেই পারবে না।’
সুতপা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আমাকে দেখে বলল, ‘পাইলট কথাই শুনতে চায় না। খানিক আগে বৃত্তাকার পথে চক্কর দিচ্ছিল। এখন আফ্রিকার দিকে চলেছে—সোজা পশ্চিমে। আমি আর একবার চেষ্টা করে দেখব?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে সুতপা বলতে লাগল, ‘কলিং আইসক্যাপ! কলিং আইসক্যাপ! তিমিঙ্গিল দ্বীপ থেকে আমি সুতপা চৌধুরী কথা বলছি। রাডার স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি, আপনারা পশ্চিমে যাচ্ছেন। সেটা মোটেই আমাদের দ্বীপের দিকে নয়। অনুগ্রহ করে যদি আমাদের নির্দেশ মেনে চলেন, তবে সঠিক পথে আসতে পারবেন। আপনাদের ট্রান্সমিটার নিশ্চয়ই কাজ করছে না। আমরা আপনাদের কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছি না। আমাদের আওয়াজ আপনাদের কাছে পৌঁছোচ্ছে কিনা জানতে পারলে ভালো হয়। অনুগ্রহ করে বৃত্তাকার পথে বিমানটিকে চালাতে থাকুন। সঠিক অবস্থানে এলেই বাতলে দেব—আপনারা ভুল শুধরে নেবেন।’
কোনো ফল হল না। সুতপাও হার মানবার পাত্রী নয়—নিরলসভাবে চেষ্টা করে যেতে লাগল। শেষে দেখা গেল বিমানটি বাঁক নিচ্ছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠল সুতপা। চোখ দুটি তার রাডারের দিকে স্থির নিবদ্ধ হয়ে রইল।
মনে হতে লাগল যেন কতকাল ধরে রাডার স্ক্রিনের ওপর একটা আলোর বিন্দু ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ সুতপা বলে উঠল, ‘চমৎকার! এই তো সঠিক অবস্থানে এসে গেছেন! এবার সোজা চালাতে থাকুন। খানিক পরেই তিমিঙ্গিল দ্বীপ দেখতে পাবেন।’
আমার দিকে একটা উৎফুল্ল চকিত চাহনি হেনে আবার বলতে লাগল, ‘আমার নির্দেশ নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে পৌঁছেছে। অন্তত একবার নিশ্চয়ই আমার কথা শুনেছেন। ঠিক কিনা বলুন? আমরা আপনাদের স্বাগত জানাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। নেমে দেখতে পাবেন, কী সুন্দর এই দ্বীপ! নামটাও কত সুন্দর— তিমিঙ্গিল! অর্থাৎ সমুদ্র—দানব।’
দরজা ঠেলে আবার বাইরে বেরিয়ে গেলাম। দক্ষিণ আকাশে বিমানের আবির্ভাব এখনও ঘটেনি বটে, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, এবার বুঝি দেখতে পাব। ছোট এক—একটা কালো বিন্দু দেখে বারকয়েক বিমান বলে ভ্রমও হয়েছিল। কিন্তু খানিক অপেক্ষা করেই দেখা গেল, বিমান নয়—পাখি। হ্যাঁ, পাখি। অজস্র পাখি এখানকার আকাশে। পাখির কি আর কোনো কমতি আছে!
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে আমার কাজের দায়িত্ব অনেক। প্রয়োজনের সময় সবকিছু যাতে হাতের কাছে পাওয়া যায় এখনই তার আয়োজন দরকার। রানওয়ে বিমান অবতরণের উপযুক্ত কিনা দেখতে হবে। অগ্নিনিরোধ সাজসরঞ্জাম নিয়ে কয়েকজনকে তৈরি রাখতে হবে। ফার্স্ট—এড বক্স, স্ট্রেচার প্রভৃতি নিয়ে প্রস্তুত থাকবে আর একটি দল। সুগ্রীব পট্টনায়ক ছেলেটা বেশ চটপটে। মেকানিকদের সাহায্য করতে যেমন, জরুরি কোনো কাজের সময়ও তেমনি, সমান তৎপর সে। ওকে আমাদের প্রয়োজন হবে।
আবার যখন রেডিও—ঘরে ফিরে এলাম, তখনও সুতপা শান্তভাবে ট্রান্সমিটারে কথা বলে যাচ্ছিল। বিমান অবতরণের নির্ধারিত সময় বিশ মিনিট আগেই পার হয়ে গেছে।
সুতপা বলে যাচ্ছিল, ‘বলুন তো, বারবার কেন আপনারা দ্বীপটিকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন? এখানে নেমে আসতে যেন আপনাদের দারুণ অনিচ্ছা। কিন্তু কেন? প্রতিটি লোক আমরা এখানে তৈরি হয়ে আছি। প্লেনে যদি আগুন লাগে? কোনো ভয় নেই, আমরা সেদিক দিয়েও প্রস্তুত আছি। আপনারা বরং একটা কাজ করুন না! আপনাদের অসুবিধেটা জানিয়ে দিন আমাদের। প্লেন থেকে একটা চিঠি ফেলে দিন। তাহলেই বুঝতে পারা যাবে আপনাদের ভয়টা কীসের।’
বিমানের ভেতরে গুলির শব্দ কেন হল তাই নিয়ে কয়েকজন বাদানুবাদ করছিল। কৌতূহলোদ্দীপক কতকগুলি মন্তব্য করে নিজের নিজের বিদ্যে জাহির করছিল তারা। আমি তাদের নিবৃত্ত করলাম। বললাম, ‘অযথা তর্কে উৎসাহ নষ্ট না করে একটু অপেক্ষা করো। বিমানটা নামলেই সব জানা যাবে।’
তারা চুপ করে গেল।
সুতপা বলে যেতে লাগল, ‘এই তো বেশ হচ্ছে! এবার নিশ্চয়ই আপনারা দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়ে যাবেন! একটা কিছু ফেলে দিন যাতে আপনাদের বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছোয়—হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই চলতে থাকুন। দিক বদলাবেন না, অন্য দিকে মুখ ফেরাবেন না। সোজা চলে আসুন। যে কোনো মুহূর্তে এখন দ্বীপটিকে দেখতে পাবেন।’
আমি লাফিয়ে বাইরে চলে এলাম। আমার পেছনে বাকি সবাই—সুতপা বাদে। রাডারের কাছে তার উপস্থিতি এখন নিতান্ত প্রয়োজন।
কামানের গোলার মতো প্রচণ্ড বেগে পশ্চিম থেকে উড়ে আসতে দেখলাম বিমানটিকে। প্রথমে ছোট্ট একটি বিন্দু। তারপর ফুটকি। তারপর ডানা—ছড়ানো ছোট্ট একটা পতঙ্গের মতো। ডানা দুটির নীচে কি যেন লেগে ছিল। চাকা নিশ্চয়ই নয়?
আরো কাছে এলে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বললাম, ‘যাক, অন্য কিছু নয়—খোলা কারগো ডোর।’
কে যেন মস্করা করে বলল, ‘তবে কি উড়ন্ত চাকী হবে?’
কে একথা বলল খেয়াল করিনি। তবে বিমানটিকে ঘিরে আমার মনের মধ্যে ক্রমেই যে ভয় জমা হচ্ছিল তাতে কোনো সন্দেহই নেই। খোলা কারগো ডোর দুটিকে প্রথমে ঠিক ঠাওর করতে না পেরে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক দুশ্চিন্তাই তখন মনের মধ্যে ভিড় করছিল। তবে কি কুমেরুর রাশিয়ান ঘাঁটি থেকে কোনো বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র ছাড়া হয়েছে! ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা উৎকণ্ঠায় কাটিয়ে ঝোঁকের মাথায় যদি এমন একটা অসম্ভব চিন্তা করেই বসি, সেটা কি অন্যায় কিছু!
যতই এগিয়ে আসতে লাগল, বিমানের শব্দও ততই বেড়ে চলল। শেষে সমুদ্রের গর্জনকেও ছাপিয়ে দালানের কাচের জানলায় ঝনঝন আওয়াজ তুলে রানওয়ের ঠিক পাঁচশো ফিট ওপর দিয়ে সাঁ করে পশ্চিম থেকে পুবে চলে গেল বিমানটি। আমরা তাকিয়েই রইলাম। বার্তা নিয়ে কোনো প্যারাসুট নেমে এল না। উন্মুক্ত কারগো ডোর দিয়ে একটি মুখকেও উঁকি মারতে দেখলাম না। দেখতে দেখতে বিমানটি আবার ছোট্ট বিন্দুতে পরিণত হয়ে আকাশের বুকে হারিয়ে গেল।
ফিরে গিয়ে আমি নিজেই এবার মাইক্রোফোন তুলে নিলাম।
‘কলিং আইসক্যাপ! তিমিঙ্গিল—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার বলছি। আমরা এত করে অনুরোধ করলাম, এত আশা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কিন্তু বিমান থেকে কোনো বার্তাই নেমে এল না। বুঝতে পারছি না কেন আপনারা এমন করছেন। বিমানের বাইরে তো সন্দেহজনক কিছুই দেখলাম না। গায়ে তো কিছুই লেগে নেই। কিছু তো আপনাদের অনুসরণও করছে না। বলতে কি আকাশে আপনাদের প্লেন ছাড়া আর কিছুই নেই। আমাদের রাডার তো সেকথাই বলে।’
রাডার স্ক্রিনের মাঝখানে দ্বীপের নকশা কাটা। আলোর বিন্দুটি সেখান থেকে ক্রমেই দূরে যাচ্ছিল। পাইলটের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। নাহলে ওভাবে অকূল সমুদ্রে আবার পাড়ি দেয়!
সুতপা আবার মাইক্রোফোন তুলে নিল, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে আকাশে আর কোনো প্লেনই নেই….’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। রাডার স্ক্রিনের কিনারা ঘেঁষে আলোর যে বিন্দুটি ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেটি হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। অর্থাৎ বিমানটি চলে গেল রাডারের আওতার বাইরে।
সত্য বটে সংখ্যায় আমরা অতি নগণ্য। এ—ও সত্য বিমানের পাইলট আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবুঝকে তবু বোঝানো যায়, কিন্তু যে ইচ্ছে করে না বোঝার ভান করে, তাকে বোঝানো শিবেরও অসাধ্য। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পাইলটদের দোষে যাত্রীদের একটা অপঘাত মৃত্যু ঘটবে আজ। বাস্তবিকই যদি তাই ঘটে তবে আমাদের যেন কেউ সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী না করতে পারে। কেউ যেন বলতে না পারে, আমাদের নির্বুদ্ধিতা এবং দায়িত্বজ্ঞানের অভাবই এই দুর্ঘটনার কারণ। তাহলে লজ্জার আর সীমা—পরিসীমা থাকবে না। সবার অলক্ষে, সবার অগোচরে আমাকে দেখে যেতে হবে, বিপদের মুহূর্তে যা—যা প্রয়োজন সবই যাতে সময়কালে পাওয়া যায়।
অপারেটর সুতপার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আমাকে লক্ষ করে বলল, ‘সবই তো ঠিক ঠিক চলছিল। হতচ্ছাড়া পিস্তলের আওয়াজটাই যত নষ্টের গোড়া—ঝামেলার সূত্রপাত তারপর থেকেই। আচ্ছা, কুমেরুর অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটিতে একটা সংবাদ পাঠালে হয় না?’
আমি বললাম, ‘এখন নয়। তোমরা দুজন পলকের জন্যও রাডার ছেড়ে যাবে না। প্লেনটা এখনও আয়ত্তের মধ্যেই আছে। হয়তো বা রাডারের আওতার মধ্যে এসেও পড়তে পারে। তাই যদি হয়, আর একবার তোমরা সুযোগ পাবে ওটাকে দ্বীপের দিকে টেনে আনবার।’
পশ্চিমে দিকচক্রবাল থেকে ভীমবেগে এগিয়ে আসছে উদ্বেল ঢেউ। চলার পথে কেউ অবরোধের সৃষ্টি করতে পারে, এ যেন তাদের ধারণার অতীত। তাই অবাধ ঔদ্ধত্যে এসে আঘাত করছে তীরঘেঁষা উঁচু পাথরের গায়ে, আর শত—সহস্র ধারায় উৎক্ষিপ্ত হয়ে ব্যর্থ আক্রোশে ফেটে পড়ছে। একদিকে উত্তাল তরঙ্গের উন্মত্ত গর্জন, অপর দিকে বাতাসের একটানা সোঁ সোঁ আওয়াজ—দুটোই যেন পাল্লা দিয়ে চলেছে।
আর এদিকে অপরিমেয় নির্জনতার মাঝে মুষ্টিমেয় কতকগুলি লোক ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জটলা করছে। আলোচনার বিষয়বস্তু অবশ্য একটাই—বিমানের রহস্যময় আচরণ।
পাচক করিম বক্স মোল্লা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, ‘স্যার, আপকো ইয়াদ হোগা কিতনা লাশ মিলে থে এঁহা। ইস ঘটনাকে সাথ উসকা কোই সম্বন্ধ হ্যায়?’
আমি হেসে বললাম, ‘আরে দূর! তাই কি কখনও হয়?’
করিম নাছোড়বান্দার মতো নিজের অভিমত প্রকাশ করে চলল, ‘কিঁউ নেহি! তামাম সমুন্দর মে উন লোগো কো কুছ নেহি হুয়া। লেকিন তকদির উনকো ইধর লে আয়া, আউর ওলোগ এন্তেকাল ফরমায়া। আপ তো জানতে হি হ্যায় আদমি খতম করনেবালা কোই জানোয়ার এঁহা নেহি মিলেগা। ফির ভি ওলোগ মর গ্যয়া। অ্যায়সা হুয়া কিঁউ বোলিয়ে?’
‘শোন করিম, এসব আজগুবি চিন্তা মগজে ঠাঁই দিও না। প্লেনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, তার সূত্রপাত হয়েছিল শতশত মাইল দূরে কুমেরুর বরফের ওপর। এই দ্বীপে যদি কোনো হিংস্র জানোয়ার থেকেও থাকে, সে এখানেই আছে। অকূল সমুদ্র পেরিয়ে নিশ্চয়ই সেখানে যায়নি। তাছাড়া বছরের পর বছর আমরা এখানে কাটিয়ে দিলাম। তেমন কিছু থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের নজর এড়াত না, কি বল?’
নিজের যুক্তি ধোপে টিকল না দেখে করিম বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হল।
এতক্ষণ দুটো ব্র্যান্ডির বোতল বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বলা যায় না কখন প্রয়োজন হয়। হতচেতন পাইলটের অবসন্ন মগজকে চাঙ্গা করে তোলবার জন্য হয়তো বা কাজেও লাগতে পারে। সেই বোতল দুটিকে রেখে দিয়ে রিপোর্ট লিখতে বসলাম। আসন্ন বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রিপোর্ট লিখতে বসলাম, সেটিই হবে অনাগত দিনের তল্লাশি—তদন্তের মুখবন্ধ।
কয়েক কলম লিখেছি কি লিখিনি, সুতপার উল্লসিত আর্তনাদে উঠে দাঁড়ালাম। রাডার স্ক্রিনে দেখা গিয়েছে বহু প্রত্যাশিত সেই আলোর বিন্দু। মাতালের মতো উত্তর—দক্ষিণে টাল খেতে খেতে আসছে সেটা। আসছে পশ্চিমের সেই দিকচক্রবাল থেকেই।
সুতপার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়। তখনও সে সমান উৎসাহে আগন্তুক পাইলটকে লক্ষ করে কথা বলে যাচ্ছিল। একটুও বিরক্তি নেই, একটুও ব্যস্ততা নেই। গলার স্বরও কি চমৎকার! যেন মধু ঝরে পড়ছিল!
‘হ্যাঁ, এভাবেই চলতে থাকুন। ভয় পাবার কিছুই নেই। প্লেনের আশেপাশে ওপরে—নীচে আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কোনো কিছু আপনাদের অনুসরণও করছে না। আপনারা নিরাপদেই নেমে আসতে পারবেন। নেহাত যদি কিছু অঘটনই ঘটে যায়, তার জন্য ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমরা সবাই তৈরি হয়ে আছি। বাতাসের বেগ তিরিশ নট, গতিপথ ২৪০ ডিগ্রি, একটু ঝড়ো আবহাওয়া।’
এদিকে আমাদের আয়োজনের কোনো কমতি নেই। অগ্নিনিরোধ সাজসরঞ্জাম নিয়ে গাড়িতে বসে আছে সুগ্রীব পট্টনায়ক। জীববিজ্ঞানী রোহিতাশ্ব ভাবা আর জীমূতবাহন তৈরি হয়ে আছে স্ট্রেচার, ব্যান্ডেজ এবং এমন আরো টুকিটাকি চিকিৎসার জিনিসপত্র নিয়ে। সাথে তাদের আরো জনাছয়েক লোক।
আকাশের পশ্চিমপ্রান্তে দেখা গেল ছোট্ট একটা বিন্দু ছোঁ মারার ভঙ্গিতে খানিকটা নেমে এল। বিন্দুটি বড় হতে হতে অতিকায় একটি বিমানের রূপ নিল। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, বাতাসের গতিপথ ধরেই বিমানটি নেমে আসবে। কিন্তু সেটা যে কতটা গর্হিত কাজ সেকথা কোনো পাইলটকে বোঝাতে হয় না।
অথচ এই পাইলটকে সেকথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। খেয়াল যখন হল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। হুঁশিয়ার করবার সময় আর নেই। রানওয়ের ওপর সে তখন নেমে আসছে অপ্রতিহত বেগে। কারগো ডোর ঝুলে রয়েছে নীচের দিকে, চাকাগুলি তখনো গোটানো। ভয়ে—ত্রাসে আমার নাড়ি ছেড়ে বাবার উপক্রম হল। প্রবল হতাশায় হাত—পা ছুড়তে লাগলাম। আর বিমানটি তখন বেপরোয়াভাবে নেমে আসতে লাগল মাটি লক্ষ করে। তারপর….
তারপর আমি ভয়ে চোখ বুজলাম। শুধু শুনতে পেলাম ভাঙাচোরা দোমড়ানো— মোচড়ানো আর ঘসড়ানির তীব্র, তীক্ষ্ন ধাতব আওয়াজ। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম পাথুরে রানওয়ের ওপর দিয়ে বিমানটি বুকে ভর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। চাকাগুলি তার বিলকুল সেঁধিয়ে আছে বিমানের দেহের ভেতর। আর তাকে ঘিরে সৃষ্টি হচ্ছে ধূলাবালির প্রচণ্ড আবর্ত।
একসময় থেমে গেল বিমানটি। বাতাসের বেগে তখনো ধূলিঝড় উড়ে যাচ্ছিল পুবদিকে।
তারপর দেখা গেল একদল লোক ছুটে চলেছে বিমানটির দিকে। সাথে তাদের নানারকম সরঞ্জাম। ছুটতে ছুটতে অনেকে অবাক হতে লাগল কোনোরকম আগুনের চিহ্ন না দেখে। আর আমি ভাবতে লাগলাম, পাইলট নিশ্চয়ই ফুয়েল ট্যাঙ্ক উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে সমুদ্র—গর্ভে।
তারপর দ্রুত ধাবমান লোকগুলিকে চমকে দিয়ে বিমানের ভেতর থেকে ভেসে এল একটি গুলির শব্দ।
ককপিটে ঢুকে দেখলাম, পাইলটের মাথা বেয়ে তাজা রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। হাত দুটি অসহায়ভাবে সিটের দু’পাশে ঝুলছে। পায়ের কাছে পড়ে আছে রিভলবারটা। অর্থাৎ পাইলট আত্মঘাতী হয়েছে।
সারাটা বিমান তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কোনো লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল বিমানের গায়ে আটটি বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। তার একটি রেডিও ট্রান্সমিটারটাকে অকেজো করে দিয়েছে।
কুমেরু থেকে বিমানটি যখন যাত্রা শুরু করে, তখন মোট দশজন লোক ছিল তার ভেতর। হিয়ার্ড দ্বীপ ছাড়িয়ে আসবার পর হঠাৎ কি যে হল, হৈ—চৈ আর্তনাদ সোরগোল আর গুলির শব্দ ভেসে এল। অনেক সাধ্য—সাধনা করে বিমানটিকে নামানো তো হল। কিন্তু লাভ কিছুই হল না। কোনোমতে নেমে এসে নিজের গুলিতে নিজেরই মাথার খুলি বিদ্ধ করল হতভাগা পাইলটকে।
(২)
দিন গড়িয়ে সন্ধে হতে চলল। এমন একটা ভয়াবহ পরিণতির জন্য আমরা তৈরি ছিলাম না। শহর হলে ব্যাপারটা হয়তো আমাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়াই ঘটাত না। সেখানে লোকে লোকে গিজগিজ করছে। দুর্ঘটনায় কেউ মরল কি বাঁচল সেদিকে তাকাবারও ফুরসত নেই কারো। কিন্তু পাণ্ডববর্জিত এই দ্বীপের কথাই আলাদা। মাত্র উনিশজন মানুষ এখানকার অধিবাসী। সাথে তাদের চারটি শিকারি কুকুর। এই সীমিত জনসংখ্যার মাঝে একটি মৃতদেহের উপস্থিতি করুণই শুধু নয়, নিদারুণ বাস্তবও বটে।
পাওয়ার—অফিসার জীমূতবাহন সেন অবশ্য আগেই পাইলটের মৃতদেহটাকে নামিয়ে এনেছিল এবং সাথে সাথে পাচার করে দিয়েছিল গুদামঘরের এক কোনায়। মৃতদেহটি আমাদের চোখের আড়ালে ছিল বটে, কিন্তু মনের পর্দায় ভাসছিল সবসময়। পাইলট ছাড়া আর আটজন লোকের কি হল? তারা কী কর্পূরের মতো উবে গেল! নাকি ঝুপঝুপ লাফিয়ে পড়ল সমুদ্রের জলে!
রেডিও মারফত খবর পাঠানো হল আন্দামানে, হিয়ার্ড দীপপুঞ্জে এবং কুমেরুর অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটিতে। খবরের সত্যতা সম্বন্ধে সবাই কিন্তু সন্দিহান হয়ে উঠল। এমন একটা অসম্ভব অলৌকিক ব্যাপার তারা দ্বিতীয়বার যাচাই না করে বিশ্বাস করতে রাজি হল না। ফলে প্রত্যেক জায়গাতেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনার বিবরণ দিতে হল দু’বার করে। তাতেও কি নিস্তার আছে! কুমেরুর অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটি জানাল, সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবার জন্য তারা শিগগিরই একটি বিমান পাঠাচ্ছে।
আমরা এদিকে কারগো সিট মিলিয়ে বিমান থেকে মাল খালাস করছি। আবহাওয়া ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাতাসের গর্জন বেড়ে চলেছে। সমুদ্রও সমান তালে ফুলে—ফুঁসে তাতল সৈকতে এসে আছড়ে পড়ছে। আকাশ পাখিতে পাখিতে পাখিময়।
জীববিজ্ঞানী রোহিতাশ্ব ভাবা নামতা পড়ার মতো মালের তালিকা পড়ে যেতে লাগলেন : একাডেমি অব সায়েন্সের জন্য তিনটি বাক্স….খাঁচাবন্দি পাঁচটি পেঙ্গুইন পাখি….উষ্ণ হ্রদ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তিন পেটি উদ্ভিদের নমুনা….ইত্যাদি।
কুমেরুর এই উদ্ভিদের প্রতি রোহিতাশ্ব ভাবার চিরকেলে আকর্ষণ। তিনি বলতেন, কুমেরুতে এ জাতীয় উদ্ভিদের সংখ্যা নাকি নিতান্তই অল্প। পঞ্চাশ লক্ষ বৎসরেরও বেশি তারা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে নীরব নির্জন পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে।
এমন অদ্ভুত জিনিস দেখবার জন্য আমার কিন্তু মোটেই মাথাব্যথা নেই। তবু দেখলাম। অমসৃণ চট দিয়ে জড়ানো মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি। প্রতিটি প্রায় ছ—ফুটের মতো লম্বা। সাপের মতো লম্বা লম্বা বিচিত্র শিকড়। শিকড়ের গায়ে কর্কশ রোমের অজস্র শুঁয়া। আগায় বহুদূর প্রসারিত সব শাখা—প্রশাখা। এক—একটি পেটিতে বেশ কয়েকটি গাছের গুঁড়ি খুব শক্ত করে বাঁধা।
মোট তিনটি পেটি থাকার কথা। খুঁজতে গিয়ে কিন্তু একটি পেটি খোলা অবস্থায় পাওয়া গেল। যেভাবেই হোক বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। গাছের গুঁড়িগুলি ইতস্তত ছড়ানো।
রোহিতাশ্ব ভাবা হা হা করে উঠলেন। এমন অমূল্য সম্পদের এই হাল দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না।
পাওয়া গেল না শুধু একটি পেঙ্গুইন পাখি। বিমানের জিনিসপত্র সব নয়ছয় হয়ে ছিল বটে। সেগুলিকে নামিয়ে থরে থরে সাজানোও হল। ব্যক্তিগত মালপত্র, এমন কি টুকরো—টাকরা জিনিসও যথাযথ পাওয়া গেল। পাওয়া গেল না পেঙ্গুইন পাখিটি। শূন্য খাঁচাটি অবশ্য যথাস্থানেই ছিল, তবে অক্ষত অবস্থায় মোটেই নয়।
রানওয়ে থেকে বিধ্বস্ত বিমানটিকে সরাতে না পারলে নতুন কোনো বিমান এখানে নামতেও পারবে না। চিফ মেকানিক দেওপ্রকাশ রাই এসব ব্যাপারে খুব যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তার ওপর আমার অগাধ আস্থা। তার অধীনে যারা কাজ করে যোগ্যতার নিরিখে তারাও কেউ কম যায় না। দেওপ্রকাশ রাই—এর ওপর এই দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।
আমার নিজের কাজও কম নয়। দিল্লিতে আনুষঙ্গিক রিপোর্ট পাঠাতে হবে। অপর সকলের কাজের তদারক করাও বিশেষ দরকার।
সময় সময় ভাবি, তিমিঙ্গিল দ্বীপের মতো নির্জন জায়গায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হয়ে কেন এলাম? এখানে কাজের দায়িত্ব যেমন অনেক, বাহবাও সেই অনুপাতে দারুণ কম। সব দিক সামলাতে হলে অফিসারসুলভ বুদ্ধিবৃত্তি থাকা চাই। বিবদমান দুই দলের মধ্যে সালিসি করবার যোগ্যতা থাকা চাই, লোকমনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে খানিক জ্ঞানও থাকা চাই, আর চাই অপরিসীম ধৈর্য এবং অধ্যবসায়। আমার নিজের মধ্যে কোন গুণ কতটা আছে সেটা বিধাতাই জানেন।
রোহিতাশ্ব ভাবা হঠাৎ বলে বসলেন, ‘কিন্তু একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি—বিমানের ভেতরে কোথাও একছিটে রক্ত নেই!’
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, তাঁর কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সত্যিই তো, এদিকটা একদম ভেবে দেখিনি!
ভাবা বলতে লাগলেন, ‘আর একটা কথা। উদ্ভিদগুলো নিয়ে আমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। এত সাধের জিনিস—হেলায় নষ্ট করা তো আর যায় না!’
আমি বললাম, ‘ওগুলো নিয়ে আপনি কী করতে চান?’
‘আমি ওদের মাটিতে পুঁততে চাই। এভাবে বেঁধেছেঁদে রাখলে মরে যেতে পারে। উষ্ণ ঝরনা আমাদের দ্বীপেও আছে। সেখানকার আবহাওয়া হুবহু এক না হলেও কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ অঞ্চলের সাথে খানিকটা মিল রাখে। এই গাছগুলি শীতকালে নির্জীব হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। এখানকার আবহাওয়ায় এরা হয়তো সারা বৎসরই সজীব হয়ে থাকবে। তাই—’
‘ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বোঝেন করুন।’
‘তাহলে একাডেমি অব সায়েন্স থেকে একটা অনুমোদন নিয়ে নিন। পরে যেন আমাদের কোনো দোষারোপ করতে না পারে।’
‘বেশ, তাই হবে।’ সুতপাকে দেখতে পেয়ে বললাম, ‘এস সুতপা, বিমানের ভেতরে আর একটু নজর বুলিয়ে নিই।’
বিমানের ভেতরে পা দিতে যাব এমন সময় রেডিও অপারেটর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, ‘স্যার, প্লেনে করে একদল ঝানু গোয়েন্দা আসছে—কী বলব তাদের?’
‘বলে দাও, এখন এলে কোনো লাভ হবে না—রানওয়ে আটকা পড়ে আছে।’
সুতপার হাত ধরে যখন নেভিগেশন কম্পার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকলাম, তখন বাইরে খাঁচায় আবদ্ধ পেঙ্গুইন চারটি তারস্বরে নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করছিল। পঞ্চম পেঙ্গুইনটি তখনও নিপাত্তা।
পাইলটের সিটে রক্তের দাগ ছিল। রোহিতাশ্ব ভাবা নিশ্চয়ই সেটা লক্ষ করেননি। কাবার্ড থেকে মৃত পাইলটের কোটটা নিয়ে রক্তের দাগ ঢেকে দিলাম। উদ্দেশ্য সুতপার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া। বলতে পারি না, তার নজর এড়াল কিনা।
বিমানটি একদিকে কাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভেতরটা অন্ধকারই থাকত, যদি না মেঝেতে মাল—খালাসের চৌকো জায়গাটি হাট হয়ে আলো—বাতাস অবাধে প্রবেশের পথ করে দিত। সেখানে কপাটের পাল্লা দুটি ঝুলে ছিল নীচের দিকে।
বিমানের ভেতরটা অনেকগুলি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। দূরপাল্লার বিমান। তাই বাড়তি ফুয়েল ট্যাঙ্ক আছে। মেঝেটা ছিমছাম পরিষ্কার। হেথাহোথা ছড়িয়ে আছে কুমেরুর বিচিত্র গাছের বিচিত্র সব ছাল—বাকল। আর পেঙ্গুইনের ছোট ছোট কয়েকটা পালক।
এক দুই করে বুলেটের ছিদ্রগুলো খুঁজে দেখলাম। মোট আটটি চিহ্ন। একটি বুলেট ট্রান্সমিটারটাকে ভেঙে ফেলেছে। কটা পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে বোঝা গেল না। দুটো হতে পারে। অথবা একটাতেই পুনরায় গুলি ভরা হয়েছে।
পাইলটের চেম্বারের দরজা অক্ষত ছিল। যে বুলেটটা ট্রান্সমিটার অকেজো করে দিয়েছে সেটা ছুটে এসেছে ভেতর থেকে এবং যখন ককপিটের দরজা খোলা ছিল তখন।
সোরগোল শুনে পাইলট অথবা সহকারী পাইলট ভেতরে যায়। তখনই আবার সে ফিরে আসে পিস্তল নিয়ে যাবার জন্য। একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। তারই একটি এসে লাগে রেডিও ট্রান্সমিটারে।
কার্তুজের খালি শেলগুলি দেখে মনে হল, পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে একটাই।
তাই না হয় হল। অবস্থা যত সাংঘাতিকই হোক না কেন, পিস্তলে গুলি ভরবার সময় পাওয়া গেল। কিন্তু কেন? কেন তাকে গুলি ভরবার সময় দেওয়া হল? কেনই বা এত স্বল্পপরিসর জায়গায়ও পাইলট বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে লাগল? তার গুলি যদি লক্ষ্য বিদ্ধই করে থাকে, তবে রক্তের বিন্দুমাত্র চিহ্নই বা নেই কেন? পাইলটই বা দ্বীপে নামতে এত অনিচ্ছুক ছিল কেন তা ধরে নেওয়া গেল, প্লেনের অফুরন্ত ফুয়েলের সঞ্চয়কে পাইলট ভয়ের চোখে দেখত। ধাক্কা লাগলে বিমানখানা নিমেষে ভস্মীভূত হয়ে যাবে, এই ভয় তার ছিল। তাই বুদ্ধি করে সমস্ত ফুয়েল সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে নেমে এসেছিল রানওয়ের পাথুরে জমির ওপর। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারল না কেন? কেন সে নিজেরই পিস্তলের গুলিতে নিজের খুলি বিদ্ধ করল?
এতগুলি কেন—র জবাব খুঁজতে গিয়ে আমি যখন হিমশিম খাচ্ছি, সুতপা তখন কালো রঙের বেশ বড়সড় একটি পেঙ্গুইনের পালক নিয়ে হাজির। এ ধরনের পালক দুম করে কখনো খসে পড়ে না। পেঙ্গুইনের লেজ থেকে টেনে—হিঁচড়ে বের করে আনতে হয়।
পেঙ্গুইনের পালকটি পকেটে রাখলাম। আর রাখলাম কার্তুজের খালি শেলগুলি আরো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবার জন্য।
বিমান থেকে বেরিয়ে এসে দেওপ্রকাশ রাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রানওয়ের থেকে এটা সরাতে কতক্ষণ লাগবে?’
উত্তরে বলল, ‘সঠিক বলা মুশকিল। ছোট ছোট যে দুটি বুলডোজার আমাদের জিম্মায় আছে, তাই দিয়ে তো আর এমন একটা ভারী জিনিসকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায় না! টর্চ দিয়ে কাঠামোটাকে কেটে টুকরো টুকরো যে করব, তারও উপায় নেই। সেটা বেআইনি কাজ হবে।’
আমি নিরুত্তরে শুনে যেতে লাগলাম।
‘বিমানটা বুকে ভর দিয়ে নেমেছে। যাত্রীবাহী বিমান হলে নামার পর ওকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। ভেঙে খানখান হয়ে যেত। কিন্তু এটা হচ্ছে মালবাহী বিমান। কাঠামোটা যেমন মজবুত, উড়তেও পারে তেমনি একনাগাড়ে শত শত মাইল। প্রতিকূল অবস্থায় যাতে বুকে ভর দিয়ে নামতে পারে, তৈরি করবার সময় সেদিকে নজর রাখা হয়। দেখতেই পাচ্ছেন, বিমানটির বিশেষ কোনোই ক্ষতি হয়নি। ডানা দুটি অক্ষত আছে। একটা প্রপেলার অবশ্য ভেঙে বেরিয়ে গেছে। সময় পেলে সেটা বসিয়ে নিতে পারব। আমাদের গুদামে বেশ কিছু স্পেয়ার পার্টস আছে। জ্যাক লাগিয়ে প্লেনটা তুলে ধরে চাকার ওপর দাঁড় করাব। তারপর প্রপেলার বসিয়ে ঠেলে রানওয়ের বাইরে নিয়ে যাব। আমি তো মনে করি, এটা আবার আকাশে উড়তে পারবে।’
দেওপ্রকাশ রাই যখন নিজের পরিকল্পনার কথা বলে যাচ্ছিল, আমি তখন ভাবছিলাম, কি করে অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটি থেকে একটা অনুমতি আদায় করে নেওয়া যায়।
হঠাৎ সে বলে বসল, ‘কিন্তু স্যার, পাইলট এভাবে মারা গেল কেন?’
জবাব দিলাম, ‘সেকথা এখন থাক। অনেক প্রশ্নের উত্তরই এখন জানা যাবে না। তবে তুমি যদি কোনো সূত্র খুঁজে পাও বা এই বিমান রহস্যের কোনো সমাধান করতে পার, আমাকে জানাবে।’
জীবিত অবস্থায় পাইলট যে বেশ শক্তসমর্থ লোক ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আগে বেশ কয়েকবার তার সাথে আমার সাক্ষাতও হয়েছে। হাসিখুশি সাদামাটা স্বভাবের লোক। এমন লোকেরও কি মানসিক বিকৃতি ঘটল?
হবেও বা। তবে এটা ঠিক, যাত্রীরা কেউ তার সাথে বেইমানি করেনি। বরং রেডিও মারফত যেটুকু টুকরো টুকরো কথা ভেসে এসেছে তাতে বোঝা যায়, তারা পরস্পরের সাথে সহযোগিতাই করেছে। ‘মারো ঠেলা—হেঁইও’ কথাটার যথেষ্ট তাৎপর্য আছে। কিন্তু কি সেই তাৎপর্য?
কোনো লোকের মৃতদেহ দেখলেই আমার মনে আধ্যাত্মিক ভাবের উদয় হয়। পাইলটের মৃতদেহ দেখেও হয়েছিল। খানিক আগেও যে লোকটার অস্তিত্ব ছিল তার দেহটাই শুধু পড়ে রইল, অথচ সে তখন কোথায় কে জানে! এ—চিন্তা অবশ্য বেশিক্ষণ মনের মধ্যে ঠাঁই পায়নি। কাজের তাগিদে মন থেকে যতসব আজব চিন্তা দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সুতপাকে নিয়ে অফিসে ফেরবার সময় আবার সেই অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন অবিশ্বাস্য। বিমানের ভেতর থেকে জলজ্যান্ত ন’টা মানুষের উধাও হয়ে যাওয়া যেন সম্ভবই নয়। এক হতে পারে, কোনো অপার্থিব বিভীষিকা বিমানের দশজন মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে তাদেরই একজনের স্থান গ্রহণ করেছে। তাহলে বলতে হয় পাইলটের দেহেই সেই অপার্থিব বিভীষিকা এসে ভর করেছিল। কিন্তু এই যুক্তি মোটেই বুদ্ধিগ্রাহ্য নয় এবং অপরে শুনলে বলবে, নিশ্চয়ই কয়েক ছিলিম গাঁজা খেয়ে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে।
সুতপাকে বললাম, ‘একজন ডাক্তার থাকলে নিশ্চয়ই পোস্টমর্টেম করিয়ে দেখতাম।’
সুতপা কোনো কথা বলল না। সে—ও বোধ হয় নানারকম সমাধান হাতড়িয়ে দেখছিল।
গুদামঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ধাতব চাকার ঘরঘর আওয়াজ শুনতে পেলাম। বিমান থেকে মাল খালাস করে প্রথম দফায় হাতে টানা চারচাকার যে গাড়িটা এসে পৌঁছোল এ তারই আওয়াজ। দফায় দফায় আরও মাল আসবে।
আমাকে দেখে একটা কুকুর লেজ নেড়ে আনুগত্যের পরিচয় দিল। তারপর পায়ে পায়ে আমার অফিস পর্যন্ত এসে আবার ফিরে গেল নিজের জায়গায়।
সুতপা নিজের কাজে মন দিল। দুর্ঘটনার রিপোর্ট দ্রুত হাতে টাইপ করে আমার সামনে পেশ করল। দুর্ঘটনার পরে তিনটি ঘণ্টাও কাটেনি। এর মধ্যেই রিপোর্ট তৈরি হয়ে গেল। দুর্ঘটনা অনেকই ঘটে। বিমান দুর্ঘটনাও নেহাত কম হয় না। কিন্তু এমন বিচিত্র উপায়ে নিশ্চয়ই নয়। সমস্ত কাজকর্মই যে আমরা চটপট সেরে ফেলতে লাগলাম তার মূলেও সেই অভাবিত মানসিক প্রতিক্রিয়া।
আজকাল দেখা যায়, প্রত্যেকেই নিজের নিজের চিকিৎসক, তেমনি এক—একজন দিগগজ মনস্তত্ত্ববিদও বটে। দিল্লিতে যখন আমাদের রিপোর্ট পৌছোল, তখন রিপোর্টের বক্তব্যকে প্রাধান্য না দিয়ে তারা অমূলক সব জল্পনা—কল্পনায় মত্ত হল। তারা ভাবল দ্বীপের নির্জনতায় আমরা নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছি।
সেখান থেকে আদেশ দেওয়া হল, দ্বীপের উনিশজন লোকের প্রত্যেকেই যেন নিজের নিজের বক্তব্য রেডিও মারফত অবিলম্বে পাঠিয়ে দিই।
অর্থাৎ বিমান দুর্ঘটনার কথা তারা বিশ্বাসই করল না। উপরন্তু দলবদ্ধভাবে আমাদের যে মতিভ্রম ঘটেছে তার কারণ এবং প্রতিকার খুঁজে বের করবার জন্য তারা পৃথক পৃথক বিবৃতি চেয়ে বসল। দক্ষ মনস্তত্ত্ববিদ দিয়ে সেসব বিবৃতি পরীক্ষা করে দেখা হবে। তারপর হয়তো গ্রহণ করা হবে প্রতিকারের কোনো পথ।
দিল্লি থেকে জানানো হল, ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে একটি ভারতীয় বিমান তিমিঙ্গিল দ্বীপে হাজির হবে।
দ্বীপে নামা যে সেটার পক্ষে সম্ভব হবে না সেকথা আর জানাতে নিষেধ করলাম। দুর্ঘটনার কথা সত্যি কি মিথ্যে নিজের চোখেই তারা যাচাই করে যাক।
দ্বীপের নির্জনতায় মনের ওপর যে যথেষ্ট চাপ পড়ে, স্নায়ুমণ্ডল যে অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, অতিবড় মানসিক শক্তির অধিকারীও একথা অস্বীকার করতে পারবে না। তাই বলে দিল্লি যতটা মনে করেছে, ততটা দুর্বল নিশ্চয়ই আমরা হয়ে পড়িনি।
দিল্লির আদেশ অমান্য করবার উপায় নেই। পৃথক পৃথক রিপোর্ট পাঠাতেই হবে। প্রত্যেকের কাছে দিল্লির আদেশ বয়ে নিয়ে গেল সুতপা। কেউ কেউ ব্যাপারটাকে পরিহাসতরল কণ্ঠে স্বাগত জানাল। কেউ ভাবল, এমন একটা আদেশ দিয়ে দিল্লি তাদের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। আর যাদের মানসিক গঠন প্রকৃতই দুর্বল তারা ভয় পেল, সত্যি কি তারা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছে! এদের নিয়েই যত ভয়।
ক্ষণে ক্ষণে কেবল বিমান দুর্ঘটনার কথাই মনে আসে। যাত্রীদের মধ্যে ষড়যন্ত্র হয়নি, বিদ্রোহ হয়নি, পাগলামিও দেখা দেয়নি। রেডিওতে শোনা কথাবার্তা বিশ্লেষণ করলে তো তাই মনে হয়। বিমানের ভেতরে কোনো—না—কোনো বিভীষিকা হয়তো ছিল। পাইলট হয়তো চেয়েছিল বিভীষিকা সমেত সমুদ্রের জলে সমাধিস্থ হতে। তারপরই হয়তো মত পালটেছে। তারও হয়তো যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আছে।
জীমূতবাহন সুইংডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকল। যদি কাউকে নিয়ে আমি বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি তবে সেই বিশেষ লোকটি হচ্ছেন ইনিই। যদি কেউ ভবিষ্যতে এই দ্বীপ থেকে পালাবার জন্য ছুটির আবেদন করে তবে এই লোকটাই করবে প্রথমে। বলা নেই কওয়া নেই দুম করে এক—একটা মন্তব্য করে বসবে। সুতপার মন পাবার জন্য হামেশাই ছোঁকছোঁক করবে। কিন্তু নিজের যোগ্যতা যাচাই করে দেখবে না একটিবারও।
জীমূতবাহন বলে বসল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। দুর্ঘটনার কারণ আমি প্রায় জেনে ফেলেছি।’
বললাম, ‘তাই নাকি? তবে তো ধন্যবাদ জানাতে হয়!’ মনে মনে বললাম, ‘তোমার মাথায় তো হরবখতই এমন সব আইডিয়া গিজগিজ করছে।’
সে বলে চলল, ‘শুনবেন?’
‘নিশ্চয়ই—বলে যান।’
‘প্রথম যখন বিমানে চড়ে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেওয়া শুরু হয়েছিল, তখন পরপর কয়েকটা বিমান অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই জানেন সেকথা? পরে তদন্ত করে জানা গিয়েছিল, প্রচণ্ড সমুদ্রের ঢেউ কিংবা জলস্তম্ভ সেসব দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ। বহুদিন অবশ্য সে জাতীয় দুর্ঘটনা আর ঘটেনি, কিন্তু সেই কারণটা তো রয়ে গেছে। এই তো সেদিন একটা ট্রানস প্যাসিফিক এয়ারলাইনার—’
দুর্ঘটনার কথাটা কাগজেই পড়েছি। বিমানটি সমুদ্রেই ভেঙে পড়েছিল। আজ পর্যন্ত কিন্তু তার কারণ জানা যায়নি।
জীমূতবাহন বলে চলল, ‘সেই বিমানটিও নিশ্চয়ই সমুদ্রের প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবলে পড়েছিল।’
আমি উসখুস করতে লাগলাম। এই আজব যুক্তি একেবারেই অচল।
সে বলে চলল, ‘কিংবা এমন কোনো রহস্যজনক উপায়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল, বর্তমান দুর্ঘটনার মূলেও যেটা রয়েছে।’
গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেন?’
‘প্রমাণ দেখাতে পারি না ঠিকই, কিন্তু যুক্তি দিয়ে তো বোঝাতে পারি। প্রশান্ত মহাসাগরে যে—কটা বিমান অবশ্য হয়েছে—সবারই একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। আচমকা রেডিও বন্ধ হয়ে যায়, আর বৈমানিক নিজেদের বিপদের কথা জানাতে পারে না।’
‘কিন্তু এটা প্রশান্ত মহাসাগর নয়—ভারত মহাসাগর।’
‘ওই একই কথা হল, সাগর তো বটে। আর সাগরেই এ জাতীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি। কোনো একটা উড়ন্ত প্রাণী বিমানের গায়ে সেঁটে যায় আর টপাটপ ভেতরের লোকগুলোকে গিলে ফেলে কিংবা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’
ধৈর্যের বাঁধ আমার ভেঙে পড়বার উপক্রম হল। বললাম, ‘মিস্টার সেন, ভুলে যাচ্ছেন যে এটা রকেটের যুগ। আরব্য রজনীর গল্প এখন আবার বাস্তবে ঘটতে যাচ্ছে না নিশ্চয়ই!’
জীমূতবাহনের আঁতে ঘা লাগল, ‘না, রকেটের যুগে রক পাখির গল্প জমিয়ে আসর সরগরম করতে চাই না আমি। রকবাজির দিন বহুকাল আগেই অতীত হয়েছে। বিমান দুর্ঘটনাটা যেমন বাস্তব, তার ভেতর থেকে ন’জন লোকের অদৃশ্য হওয়াটাও যেমন বাস্তব, তেমনি বাস্তব বিমানে কোনো দানবাকার প্রাণীর আচমকা উপস্থিত হওয়া। সুন্দরবনে কোনো চাষি হঠাৎ গুম হয়ে গেলে কেউ যদি বলে যে বাঘে নিয়ে গেছে, তবে তাকে পাগলের খেতাব দেওয়া হয় না। কারণ বাঘ আর মানুষ একই সময় একই জায়গায় মুখোমুখি হলে এমন একটা ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। সমুদ্র থেকে যে বিমান অদৃশ্য হচ্ছে, সেটাও বাঘে মানুষ নেওয়ার সামিল। পার্থক্য শুধু এই যে, মরবার আগে হতভাগ্য যাত্রীরা উড়ন্ত দানবের সাথে প্রাণপণে লড়াই করতে ব্যস্ত থাকে বলে খবর পাঠাবার সুযোগটুকু পর্যন্ত পায় না।’
এর ওপর আর কথা নেই। তবু যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, ‘ধরে নিলাম, আপনার কথাই সত্যি। কিন্তু আপনার যুক্তির সমর্থনে কোনো প্রমাণ কিন্তু দেখাতে পারবেন না!’
তিক্ত স্বরে বলল, ‘আমার ধারণা যে সত্যি হবেই এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।’
‘বেশ, বেশ। সেই সম্ভাবনাটাই যদি বাস্তবে ঘটে গিয়ে থাকে, তবে বিপদ তো আমাদের এখনো ঘটতে পারে?’
‘তা পারে বৈকি। পাইলট সেই দানবের হাত থেকে কোনোক্রমে রেহাই পেয়ে এই দ্বীপে এসে নেমেছে। তার পিছু পিছু সেই দানবটাও এসে হাজির হতে পারে।’
তর্ক করা বৃথা জেনেও চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, ‘আপনার ধারণাটা রিপোর্টের আকারে যদি দিল্লি পাঠিয়ে দিই, তবে কি হবে জানেন? আপনাকে ওরা পাগলা গারদে আটকে রাখতে বলবে। অতটা করতে অবশ্য আমি রাজি নই। আপনাকে শুধু এইটুকু জানাতে চাই, আপনার সেই কিম্ভুতকিমাকার দানব, যে নাকি পাখি নয় অথচ উড়তে পারে, যে টপাটপ মানুষ গিলে খায়, যে বাইরে থেকে বিমান আক্রমণ করে, সে কিন্তু এই বিমানটাকে বাইরে থেকে আক্রমণ করেনি—ভেতরেই ছিল। আর তাকে ঠেলে ফেলে দেবার জন্য কারগো ডোরও খোলা হয়েছিল।’
আচ্ছা লোক এই জীমূতবাহন—ভাঙবে তবু মচকাবে না। বলল, ‘আর গুলিও চালানো হয়েছিল ছ—সাত বার। কিন্তু ফল যে কিছুই হয়নি সেটা দেখতেই পাচ্ছেন।’
‘অর্থাৎ আপনি বলতে চান, সে এতই বিরাট কিংবা এমনই বিচিত্রদর্শন যে দু—চারটে গুলিতে তার কিছুই হয় না। তবে কিসে তাকে কাবু করা যাবে?’
পরম উৎসাহে বলে ফেলল জীমূতবাহন, ‘আগুনে, আবার কিসে! আর এই কথাটা বলবার জন্যই তো আমার এখানে আসা। কিন্তু আপনি আমাকে কথা বলবারই সুযোগ দিচ্ছেন না মোটে। অনেক প্রাণী আছে যাদের কায়দামতো গুলি করতে না পারলে কোনো ক্ষতিই হয় না। অথচ এমন একটিও প্রাণী নেই যে আগুনে পোড়ে না। তাই বলছিলাম, গুদাম থেকে কয়েকটা ভেরী পিস্তল বের করে নেওয়া দরকার। দানবের চেহারা যত ভয়ানকই হোক না কেন, এই পিস্তলের আগুনে রশ্মির সামনে সে মোটেই তিষ্ঠতে পারবে না।’
কয়েকটা ভেরী পিস্তলের বিনিময়ে যদি এর হাত থেকে নিষ্কৃতি মেলে মন্দ কি। অগত্যা বললাম, ‘আপনি নিজেই তো সাপ্লাই অফিসার। আপনার যতগুলো খুশি ভেরী পিস্তল নিয়ে নিন। শুধু দেখবেন, অপব্যবহার যাতে না হয়।’
সাগ্রহে বলল, ‘আমি প্রত্যেককেই একটা করে এই পিস্তল দিয়ে দেব। শত্রুর সাথে প্রাণপণ লড়াই না করে একজনকেও আমি মরতে দেব না।’
জীমূতবাহন চলে গেল। লক্ষ করে দেখলাম, মুখের গুমোট ভাবটা তার বেশ কিছুটা হালকা হয়ে গেছে। একে তো সুতপার সাথে প্রেমের ব্যাপারটা তার মোটেই জমে উঠছে না। তার ওপর সুতপা আমার অফিসেই কাজ করে। ফল হয়েছে এই যে আমি তার ঈর্ষার পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছি। সবই বেশ বুঝতে পারি। তাই অনেক অন্যায় আবদারও আমাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। ভেরী পিস্তল নিয়ে সে যদি সন্তুষ্ট থাকতে চায় ক্ষতি কি। ব্যস্ত থাকবার একটা অজুহাত তো পাবে।
কিন্তু করিমের কি গতি হবে? গজগজ করতে করতে সে এসে জানাল, দশজন অতিরিক্ত লোকের খানাপিনার যোগাড় করে ফেলেছে সে। এখন আর সেসব কাজে লাগাতে পারছে না।
আমি বললাম, ‘যেমন খুশি তুমি এসব খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করতে পার। তোমার কাজে আমি হস্তক্ষেপ করব না।’
যাবার সময় করিম বলে চলে গেল, তার ধ্রুব বিশ্বাস কুমেরুর রাশিয়ান ঘাঁটি থেকেই কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে বিমানটিকে লক্ষ্য করে।
করিম বেরিয়ে গেলে সুতপাকে বললাম, ‘নানাজনে তো নানান অভিমত ব্যক্ত করল। তোমার ধারণাটা এবার জানতে পারি সুতপা?’
‘আগে আপনি বলুন।’
‘আমার কথা ছেড়ে দাও। বিশজনে বিশ রকম কথা বললে মাথা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক। এই বিশটি অভিমতের মধ্যেই যে সত্য নিহিত আছে এমন কথা ভাবাও অন্যায়। শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে, চোখ—কান খোলা রাখা। সব কিছুই দেখে যাও। যতক্ষণ না হাতেনাতে প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো মন্তব্য করো না।’
‘কিন্তু মন্তব্য না করেও থাকা যায় না। ভুল তো মানুষের হবেই—’
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার মস্তবড় একটা ভুল হতে চলেছে।’
সুতপা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল, ‘কীসের ভুল?’
‘পাঁচটা বেজে গেছে—অফিসে থাকা আর ঠিক নয়।’
সুতপা হেসে উঠল।
‘বিকেলে সমুদ্রের ধারে যাবে নাকি?’
‘যাব।’
‘তাহলে তৈরি হয়ে এস। জীমূতবাহন কি বলে গেছে, শুনেছ তো? একটা করে ভেরী পিস্তল সবাইকে সাথে রাখতে হবে। এমন কি তোমাকেও।’
‘আর আপনি?’
‘আমিও বাদ যাব না।’
মুখে যদিও একথা বললাম, মনে মনে কিন্তু বিলক্ষণ জানতাম, অপ্রয়োজনে ভেরী পিস্তল বয়ে বেড়াবার পাত্র আমি নই।
(৩)
সমুদ্রের ধারে একাকী বেড়াতে শুরু করলেই টপ্পা গাইবার শখ হয়। কেন হয় জানি না। গান তো আর গলায় আসে না, শুধু গুনগুনানি সার। সুতপার বিলম্ব দেখে সুরে—তালে—লয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি গান গেয়ে যাচ্ছিলাম। আর তখনই টগবগ করে ছুটে এল সুতপা।
এসেই শুধাল, ‘কোন তালে গাইছিলেন?’
আন—অফিসিয়াল কথাবার্তায় কখনোই আমি সংযম রক্ষা করতে পারি না। বললাম, ‘ঝাঁপতালে।’
ফিক করে হেসে ফেলে বলল, ‘সে আবার কি?’
‘নায়িকার অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে যে তালে গান গাইতে গাইতে নায়কের ইচ্ছে করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে ঠিক—’
ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘যান, আপনি ঠাট্টা শুরু করেছেন।’
‘উঁহু, আমি নয়—তুমি। এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল? এদিকে যে সন্ধে হয় হয়!’
‘কি করব বলুন—আপনার পাওয়ার—অফিসারকে নিয়ে আর পারা গেল না।’
‘সে আবার কি করল?’
‘কি করেনি তাই বলুন। আমাদের মেলামেশা করতে দেখলেই তার চোখ টাটায়।’
‘স্বাভাবিক।’
‘বলে, খুব যে দহরম—মহরম চলছে; একদিন এমন দাওয়াই দেব যে আর ফুরফুর করে উড়তে হবে না।’
‘ক্ষতি কি। লোকে ডানাকাটা পরি না বলে বরং ডানাভাঙা পরি বলবে তোমাকে। তাতে কি এসে গেল?’
‘আপনি ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমি মানি আর না মানি, সে আমার দাবিদার হয়ে বসে আছে। তার দাপট কত! আমাকে যা না বলবার তো বলেই, আপনাকেও ছেড়ে কথা কয় না। বলে, বুড়ো বয়সে আবার ধেড়ে রোগ কেন? বাঁদরের দাঁত—খিঁচুনি আর কত সহ্য হয় বলুন? অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।’
‘মিথ্যে তো কিছু বলেনি। তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় তোমার গায়ের রং, দেবভোগ্য হাসি, রানিসুলভ দেমাক। সব মিলিয়ে তুমি হচ্ছ একটি আচমকা সুন্দরী। আচমকা সুন্দরী মানে জানো? আচমকা দেখলেই যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। সেই তোমার পাশে আমাকে মানাবে কেন? তোমার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য কত জানো? সাত—সাতটি বছর।’
‘হলেই বা। আমিও তো আর নেহাত কচি খুকিটি নই। কেউ আমাকে দ্বাদশী কিংবা ত্রয়োদশী বলবে না। আমার বয়স একুশ পেরিয়ে গেছে। আপনার ওই লোহাপেটানো চেহারা দেখলে দুশমনের থরথরি কম্প শুরু হবে, আর আমরা তো মেয়ের জাত। আপনার হাত দুটি যেন হাতই নয়—যেন একজোড়া থান ইট!’
‘থাক, থাক, বড়দের সঙ্গে আর টক্কর দিয়ে কথা বলতে হবে না। একেই ডুরে শাড়ি পরে এসেছ। জানোই তো, ডুরে শাড়ির ওপর আমার দারুণ দুর্বলতা, তার ওপর যদি এমন তোয়াজ করে কথা বল, তবে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়বে।’
‘হলেই বা।’
‘তোবা! তোবা! তাই কি কখনো হয়? প্রেমের মতো অপথ্য আর কিছুই নেই। সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে এই প্রেম। দণ্ডে দণ্ডে যে অসদ্ভাবের সৃষ্টি সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রেমকে কেন্দ্র করেই। প্রেমের মতো সর্বনাশা জিনিস আর নেই। উনিশজন লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে আছি, সেই ভালো। পদাবনতি ঘটিয়ে একজনের কর্তা হতে চাই না। তা ছাড়া একটা গোপন কথা তুমি বোধ হয় জানো না, আমি ধনকুবের নই—ধনদাস। অর্থাৎ কৃপণ।
হাসির দমকে সুতপা দম ফেটে মরবার উপক্রম। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম, ‘কি হল?’
‘হবে আর কি! আমার এই অপাপবিদ্ধ শরীর আপনার চরণে নিবেদন করতে চাই, অথচ আপনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। আর ওদিকে অপলক নেত্রে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রেমের অবমাননা সে সহ্য করতে পারছে না।’
সত্যিই তো! জীমূতবাহন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। ঠিক যেন ঠুঁটো জগন্নাথ! না, এটা আমার পক্ষে ন্যায্য কাজ হচ্ছে না। সুতপার সমস্ত উচ্ছ্বাসের কারণ এতক্ষণে আমার বোধগম্য হল। জীমূতবাহনকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার সাথে ঢলাঢলি করা হচ্ছে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
সুতপা বলে ফেলল, ‘একি! উঠছেন কেন?’
‘এবার ফিরতে হবে—অনেক কাজ আছে।’
‘দোহাই আপনার, আর একটু বসুন।’
এতকাল আমার ধারণা ছিল, ডবকা ছুঁড়ির বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। কথাটা ঠিকই। কিন্তু তার সাথে আরো কিছু কথা জুড়ে দেওয়া দরকার—যদি মুখ ফোটে তবে বুঝতে হবে সেটা শুধু নিছক ছলনা।
সুতপা আবার তাড়া দিল, ‘কি হল, বসুন—’
‘না সুতপা, তুমি হচ্ছ আমার সহকর্মিণী। আর আমার শাস্ত্রে কি বলে জানো? ছাত্রী শিষ্যা বারবনিতা এবং সহকর্মিণী—চারজনই হচ্ছে অগম্যা নারী।’
‘কিন্তু আপনার পাওয়ার—অফিসার তো সেটা মানে না—’
‘সে না মানুক, আমি তো মানি।’
‘যাক, আপনার শাস্ত্রে আর কি বলে?’
‘আর বলে : অতিভক্তি ভালো নয় চোরের লক্ষণ,
অতিবুদ্ধি ভালো নয় বিপদ কারণ,
অতিলোভ ভালো নয় অতিসারে যায়,
অতিপ্রেম ভালো নয় দয়িতা পলায়।’
‘বাঃ, বেশ বানিয়েছেন তো!’
‘ঠাট্টা করবার কিছু নেই—এর প্রতিটি কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি।’
‘আপনি চটছেন কেন? আমি ঠাট্টা করিনি, ঠাট্টা করবার ধৃষ্টতাও আমার নেই। আমি—’
‘শোনো সুতপা, প্রেম করা অগৌরবের কিছু নয়। আবহমান কাল ধরে প্রেম চলে আসছে, এবং চলবেও। কিন্তু প্রেমের চেয়েও বড় মানুষের মনুষ্যত্ব এবং কর্তব্যবোধ। জীমূতবাহন হচ্ছে কাঁচা কাঠ—যতটা না পোড়ে তার চেয়ে বেশি ধোঁয়া বেরোয়। কিন্তু এমন কাঠও আছে যেটা পুড়ে খাক হয়ে যায়, অথচ সামান্য ধোঁয়া বেরোয় বলে কেউ বিন্দুমাত্র টের পায় না। আশা করি, আমার বক্তব্য ধোঁয়াটে নয়। তুমি লেখাপড়া জানা বুদ্ধিমতী মেয়ে; আইনমতে সাবালিকাও হয়েছ। নিজের ভবিষ্যৎ নিজে বেছে নেবার অধিকার তোমার আছে। তাই বলে রূপের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে যেও না। পুরুষকে পতঙ্গ ভেবে যেমন খুশি নাচাবার অপচেষ্টা করো না। তাতে নিজের সর্বনাশ তো ডেকে আনবেই, দ্বীপের অনাবিল শান্তিও বিষিয়ে তুলবে। তোমার আজকের আচরণ মোটেই ক্ষমার যোগ্য নয়। তুমি জীমূতবাহনের সাথে ঝগড়া করে এখানে এসেছ, আর এখানে আমার সাথে এমন নাটক খেলছ যাতে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা তিক্ত হতে হতে আশমান আর জমিনের ফারাক হয়ে দাঁড়ায়। ভাবতে পারো, এর পরিণাম কি হতে পারে? একটা মেয়ের লোভে আস্তিন গুটিয়ে মারামারি করবার মতো আহাম্মক আমি নই। কিন্তু জীমূতবাহন লোকটা তো আস্ত পাগল, ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে সে কি করে বসে তার ঠিক আছে! শোনো সুতপা, তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি—ফের যেন এমন দুমুখো নীতি অনুসরণ করতে না দেখি।’
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুতপা। পরে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি এতটা ভেবে দেখিনি।’
সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘জানি। এ—ও জানি, মেয়েদের আঁচল—ধরা পুরুষ তোমার পছন্দ নয়। তুমি পুরুষকে ডাকাবুকো স্বভাবের দেখতে চাও। জীমূতবাহনকে তুমি অত ছোট করে দেখো না। বিপদে তোমাকে সাহায্য করতে সে—ই এগিয়ে আসবে সবার আগে, এই বলে রাখলাম।’
‘তবেই হয়েছে আর কি! নিজেকে দারুণ তালেবর মনে করে সে। বাকি সবাই যেন তালকানা। ও লোক আমার জীবনসাথী হবে, একথা ভাবতেও আমার ভয় হয়।’
‘তাকে যদি ভালবাসতে না পারো স্পষ্ট জানিয়ে দেবে। ঢাক—ঢাক গুড়—গুড় করবার কোনো দরকার নেই।’
সুতপা কোনো জবাব দিল না। আমিও চুপ করে রইলাম। সূর্য ইতিমধ্যে পশ্চিমের দিকচক্রবালে ঢলে পড়েছে। সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জন ক্রমেই যেন বেড়ে চলেছে। আকাশ রঙে রঙে রঙিন। সেই রঙের ছোঁয়াচ সুতপার মুখেও এসে লেগেছে। তার দুধে—আলতায় মেশানো গায়ের রঙে কে যেন আবির ঢেলে দিয়েছে।
সেই দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখন বরং থাক। বিমান রহস্যের একটা কিনারা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলে কাজ নেই।’
সুতপা বলল, ‘রহস্যের কিনারা হয়ে গেলে আপনি বুঝি ছুটি নিয়ে চলে যাবেন এখান থেকে?’
‘কেন, তোমারও বুঝি ছুটির দরকার?’
‘আমি কি করব ছুটি নিয়ে? ছুটি দরকার আপনার পাওয়ার—অফিসারের। তবে একটা জিনিস আমি মনশ্চক্ষে এখনই দেখতে পাচ্ছি, রহস্য সমাধানের পর আপনার জয়জয়কার পড়ে গেছে। সবার মুখে মুখে আপনার নাম ফিরছে।’
‘আর তখন আমার মুখেই হয়তো কোনো কথা নেই। আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেছে, ধমনী অচল হয়ে গেছে। আমার মৃতদেহ ঘিরে নানারকম কথাবার্তা তো হবেই।’
‘এসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না। মরি যদি আমি মরব—আপনি মরতে যাবেন কোন দুঃখে?’
‘নাহয় আমরা দুজনেই একসাথে মরব—হল তো?’
দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
এমন সময় সুগ্রীব পট্টনায়ককে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসতে দেখে চোখ টিপে দিলাম। সুতপা হাসি থামিয়ে আগের মতোই গম্ভীর হয়ে গেল।
হাঁপাতে হাঁপাতে সুগ্রীব এসে বলল, ‘স্যার, মহা অনর্থ বেধে গেছে!’
আমি আঁতকে উঠলাম, ‘তার মানে?’
‘যা না ঘটবার তাই ঘটেছে!’
শশব্যস্তে বললাম, ‘কীসের অনর্থ! কি ঘটেছে?’
‘স্যার, বিলকুল উধাও হয়ে গেছে!’
পেছনে তাকিয়ে বারান্দায় জীমূতবাহনকে দেখতে পেলাম না। সুগ্রীব কথা বলবে কি, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল। মুখখানা তার এমনিতেই ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তার ওপর দিনান্তের সূর্যের অন্তিম রক্তরাগ এসে পড়ায় মড়ার মতো পাংশু হয়ে গেছে মুখখানা।
বললাম, ‘যা বলবার পরিষ্কার করে বল।’
‘স্যার, গুদামঘরের এককোনায় জিনিসপত্র সব সাজিয়ে রাখা শেষ হলে আমার কেমন খেয়াল হল, মৃত পাইলটের দিকে যেতে লাগলাম। একজন না একজনকে মৃতদেহ তো পাহারা দিতেই হবে। বসবার জন্য একটা চেয়ারও দরকার হবে সব সময়। একথা ভেবে ফিরলাম আবার চেয়ার নিয়ে যাবার জন্য। চেয়ার নিয়ে যখন হাজির হলাম, তখন ভেতরে চাপ চাপ অন্ধকার; কিছুই ঠিকমতো ঠাওর করা যায় না। আলো জ্বালবার জন্য যখন মুখ ফিরিয়েছি ভেতরে তখন কেমন যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল, কে যেন চলে—ফিরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আমার রোম খাড়া হয়ে গেল। অজান্তে একবার দূরে পাইলটের মৃতদেহের দিকে তাকালাম। কি দেখলাম জানেন? দেখলাম, মৃতদেহটি বিলকুল গায়েব হয়ে গেছে! আর থাকতে পারলাম না। সেখান থেকেই ছুটতে ছুটতে আপনার কাছে আসছি।’
আমি আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলাম, ‘তুমি ভুল দেখেছ—অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারোওনি। মৃতদেহ গায়েব হবার কি আছে?’
‘না স্যার, মোটেই ভুল দেখিনি আমি। কালীর নামে শপথ নিয়ে বলছি।’
‘বেশ, চল তাহলে। দেখা যাক ব্যাপারটা কি।’
তিনজনে যখন দরদালানের কাছে পৌঁছোলাম, তখন গোটা দ্বীপটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। অতিকায় একটি কালির দোয়াত কে যেন উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে দ্বীপের ওপরে। টিমটিমে তারার আলো ছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর একছিটে আলোও যেন নেই।
গুদামঘরের ফটকের সামনে আমি খানিক ইতস্তত করলাম। সুগ্রীব বলল, ‘অন্ধকারে একা ভেতরে যাবেন না স্যার। একটু দাঁড়ান, একটা টর্চ নিয়ে আসি।’
‘হ্যাঁ, তাই বরং নিয়ে এস। আর সুতপাকে অন্দরমহলে পৌঁছে দাও। ফেরবার সময় পারো জনাকয়েক লোক সঙ্গে এনো।’
‘তাই হবে।’
সুতপা বেঁকে বসল, ‘আমি আপনার সাথেই থাকব। আপনাকে বিশ্বাস নেই, আপনি হয়তো একাই ভেতরে ঢুকে যাবেন।’
‘বাজে বকিও না, যা বলি তাই করো। সুগ্রীব, নিয়ে যাও একে।’
সুতপা বলল, ‘তা আমি যাচ্ছি। কিন্তু আপনাকেও কথা দিতে হবে, আপনি একলা গুদামঘরের ভেতরে ঢুকবেন না।’
‘দেখা যাবে।’
ওরা চলে গেল। আর আমি ভাবতে লাগলাম, আজকের দিনে অন্তত সশস্ত্র হয়ে না—বেরোনোটাই অন্যায় হয়েছে। জীমূতবাহনের পরামর্শ যদি মেনে চলতাম, তবে এখন আমাকে অপরের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হত না। ভেরী পিস্তল সাথে থাকলে যমকেও ভয় পাবার দরকার হয় না।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম গুদামঘরের ফটকের দিকে। নামেই গুদাম, আসলে এটা এক বিচিত্র সংগ্রহশালা। কত কিছু যে এখানে গুদামজাত করা আছে তার ইয়ত্তা নেই। যেসব জিনিস আমাদের দরকার এবং যেসব জিনিস বিমানে করে চালান যাবে, সবই এখানে আছে। খানিকটা অংশ আবার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। পচনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য অনেক কিছুই সেখানে রাখতে হয়। দূর থেকে গুদামঘরগুলিকে দেখলে মনে হয় যেন অতিকায় তিনটি পিপে পড়ে রয়েছে। এগুলিকে গড়ে তুলতে আমাদের কত কাঠখড় যে পোড়াতে হয়েছে সে আমরাই জানি। শুধু কি তাই, প্রচুর খরচ করে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে মালমশলা এনে বহুদিন ধরে গড়ে তোলা হয়েছে এগুলিকে।
এ হেন গুদামঘরে কোনো রহস্য থাকতে পারে, একথা ভাবতেই যেন মন চায় না। নানা কথা চিন্তা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম এক নম্বর গুদামঘরের দিকে। অতিকায় একটি দরজা। পাল্লা দুটিও তার তেমনই বড়। একার পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব নয়। জিনিসপত্র আনা—নেওয়া করবার সময়ই শুধু দরজাটাকে খোলা হয়, অন্য সময়ে বন্ধই থাকে। পাল্লার গায়ে মানুষপ্রমাণ এক ফোকর। দরজা না খুলে যাতায়াত করবার জন্যই এই ব্যবস্থা।
সুগ্রীব হয়তো বেরিয়ে যাবার পর ফোকরটাকে আর বন্ধ করে যায়নি।
কারুর জন্য অপেক্ষা না করেই আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে কিছু দূরে ফিউজ বক্স। তারই পাশে আলো জ্বালবার সুইচ। একবার যদি সেখানে পৌঁছোতে পারি, তবে নিমেষে সমস্ত আঁধার ঘুচে যাবে।
বাইরে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। কিছু একটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে যেতেই কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরই মনে হল, কি যেন চলে—ফিরে বেড়াচ্ছে। মানুষের পায়ের আওয়াজ নয়, থাবাওয়ালা কিংবা ক্ষুরওয়ালা কোনো প্রাণীর পায়ের শব্দও নয়। ঘষটানির শব্দ। কিছু যেন টানতে টানতে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ঝুপ করে আরেকটা কি যেন মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল কিংবা পড়ে গেল! দালান থেকে তখন সমস্বরে কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাঁড়ান, আমরা এখুনি আসছি।’
দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বললাম, ‘বুদ্ধির বলিহারি যাই! সাত গাঁও জানান দিয়ে আসা হচ্ছে। কেন, চুপি চুপি আসতে কি হয়েছিল? ভেতরে যাই থাক না কেন, এখন সতর্ক হয়ে যাবে।’
অন্ধকারে আমি দেখতে না পেলেও আমার দুশমন নিশ্চয়ই আমার প্রতিটি চালচলন লক্ষ করে যাচ্ছে। আমাকে এখন কান খাড়া রেখে সুইচের দিকে এগোতে হবে। আর যা—ই হোক, প্রাণীটি নিশ্চয়ই অন্ধকারের জীব। অন্ধকারেই সে অভ্যস্ত—আলোতে নয়। একবার সুইচের নাগাল পেলেই গুদামঘরে আলোর বন্যা বইয়ে দেব। তখন আমিই হব বিজেতা, সে হবে পরাজিত।
সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরো খানিকটা এগোতেই কি যেন আমার মাথার চুলে বিলি কেটে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। আমার সমস্ত অন্তরেন্দ্রিয় যেন বলতে লাগল : পালাও….বাঁচতে হলে এই বেলা পালাও।
করলামও তাই। মুহূর্তে পিছু ফিরে ফটকের দিকে দৌড়লাম। একটু বাদে সুগ্রীব এসে পৌঁছোল। সাথে জনা দশ—বারো লোক ছিল।
বললাম, ‘ভেতরে কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। আমাকে একটা ভেরী পিস্তল দাও। তোমরা টর্চ হাতে আমার পেছনে এস।’
কার হাত থেকে যে ভেরী পিস্তলটা নিয়েছিলাম খেয়াল নেই। অন্ধকারে কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। দু—চারজনকে শুধু চিনেছিলাম গলার স্বর শুনে।
এ জাতীয় পিস্তলগুলি যেমন ভারী তেমনি অদ্ভুত আকারের। পেতলের তৈরি আটকোনা এক—একটা ব্যারেল। অনেকটা শটগানের মতো। আগুনের শিখা ছুটে যায় তার নলচে দিয়ে। অস্ত্রের মতো অস্ত্র বটে।
তাড়াহুড়ো করবার কিছু ছিল না। অন্ধকারের অতিথি অন্ধকারেই ঘাপটি মেরে ছিল। দরজা দিয়ে আমরা তাকে বেরুতে দেখিনি।
সদলবলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলাম।
সেই অদ্ভুত শব্দ যেন মন্ত্রবলে স্তব্ধ হয়ে গেল। আলোয় উদ্ভাসিত গুদামঘরে কোনো সাড়াশব্দ আর নেই। কে বলবে, খানিক আগেও ওখানে রহস্যময় শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
বিমান থেকে খালাস করা মালপত্র একপাশে পরিপাটি করে থরে থরে সাজানো ছিল। অন্যপাশে কতকগুলি ড্রাম ছিল স্তূপাকার হয়ে। হেন—তেন জিনিসের তো আর অভাবই নেই।
সমস্ত শৃঙ্খলার মাঝে কুমেরু থেকে আনা গাছের গুঁড়িগুলিই একমাত্র ব্যতিক্রম। ঝকঝকে তকতকে মেঝের ওপর তারা এলোমেলো ছড়িয়ে ছিল। কে যেন প্রতিটি গাছের ওপর তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েছে। কে যেন অন্ধের মতো গাছগুলি হাতড়িয়ে দেখেছে।
অথচ সমস্ত গুদামঘরটায় দৃষ্টি বুলিয়েও এমন কিছু দেখা গেল না, যাকে আমরা এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী করতে পারি। রহস্যের হদিস মিলতে পারে এমন কোনো সূত্রও খুঁজে পাওয়া গেল না।
ধপাস করে পড়তে পারে এমন কিছুই আমরা পেলাম না। টেনে—হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যায় তেমন কিছু তো নয়ই।
সবারই হতচকিত ভাবভঙ্গি। এমন কি জীমূতবাহনেরও। কারণ তারা কেউই কোনো কিছু বেরিয়ে যেতে দেখেনি, গুদাম তছনছ করেও এমন কিছু পায়নি যা সেখানে থাকবার কথা নয়।
বরং যেটার সেখানে থাকবার কথা সেইটাই কিন্তু নেই।
পাইলটের মৃতদেহ উধাও হয়ে গেছে!
(৪)
ঘোর তমিস্র রজনী। আলকাতরা—কালো আঁধারের চাদর গায়ে মুড়ি দিয়ে দ্বীপটা যেন সমুদ্রের বুকে শুয়ে আছে। সমুদ্রের রং কালো। আকাশও কালো। সমুদ্রের ঢেউ—এ নাম—না—জানা কত ক্ষুদ্র প্রাণী চিকচিক করছে। আকাশে করছে অগণিত ছোটবড় নক্ষত্র। প্রচণ্ড গর্জনে দ্বীপের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করছে সমুদ্র। বাতাসও করছে। কিন্তু পারছে না।
আর অন্যদিকে দালানের ভেতর থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর রোশনাই বাইরে এসে পড়েছে। রেডিও—ঘরের বারান্দায় একটা ছোট বিজলি বাতি জ্বলছে। আঁধার তাতে দূর তো হয়ইনি, বরং আরো যেন বেড়ে গেছে।
সবাই এসে জটলা পাকিয়েছে প্রমোদকক্ষে। জটলা মোটেই জমে উঠছে না। রেডিওগ্রাম বন্ধ হয়ে আছে। কেউ তাস খেলছে না, ক্যারামও নয়। অন্যদিন হলে কলগুঞ্জনে আসর গুলজার হয়ে উঠত; আজ সবারই কণ্ঠ স্তব্ধ। অটলা ভীতি স্থান পেয়েছে তাদের মনে। অথচ কেউই জানে না আতঙ্কটা অহেতুক কিনা।
রেডিও—ঘরে অপারেটর একাকী কাজ করছিল। তার একাকিত্ব ঘোচাবার জন্য দুজন লোক নিয়ে সেদিকে চললাম। বাড়িটা যদিও একটু তফাতে, তবে এত তফাতে নয় যে এখান থেকে ডাক দিলে সেখানে শোনা যাবে না। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পথ দেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তীব্র আলোয় অন্ধকার ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের মনের অন্ধকারও যদি এভাবে ফালা ফালা করে কেটে ফেলতে পারতাম, তবে আর কোনো দুর্দৈবের সম্মুখীন হতে হত না। কিন্তু আমরা নিরুপায়।
সঙ্গীদের বললাম, ‘সব দিক দিয়েই আমাদের সতর্ক হতে হবে। বিপদ কোন দিক দিয়ে আসে বলা তো যায় না। অপারেটরের সাথে তোমরা দুজন রেডিওর পাশে থাকবে। রাডার স্ক্রিন থেকে পলকের জন্যও দৃষ্টি সরাবে না। একঘেয়েমি যাতে না আসে তার জন্য পালা করে তোমরা এ কাজ করবে।’
সর্দার সিং ঘোঁত করে উঠল। গুদামঘরের ভার যাদের ওপর এ তাদের তত্ত্বাবধায়ক।
বলল, ‘আপ ফিকর মত কিজিয়ে—সব ঠিক হো যায়েগা।’
ইঞ্জিন—রুমে জেনারেটর ধুকপুক করছিল। একটা মাত্র জেনারেটারেই আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা মিটে যায়। অবশ্য বিপদে—আপদে প্রয়োজন হতে পারে ভেবে দুটো জেনারেটরই আমরা বসিয়ে রেখেছি।
রেডিও—ঘরে ঢুকে সর্দার সিং সম্ভাষণ জানাল অপারেটরকে, ‘ওয়ে শের কা পুত্র! ডরতে হো তুম?’
অপারেটর বলল, ‘আদাব সর্দারজি! আপনি এসে গেছেন, আর ডর কীসের?’
‘সাবাস ওয়ে ইয়ার! ফির ডর লাগে তো দারু পি লেও—তুমহারে লিয়ে এক বোত্তল সাথ লে আয়া।’
‘থাক সর্দারজি। কার কাঁধে দশটা মাথা গজিয়েছে যে, আপনার সামনে আমাকে ভয় দেখাতে আসবে?’
অপারেটরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে নিজের গোঁফ চুমরে উঁচু করে দিল সর্দার সিং।
হাসিঠাট্টা শেষ হলে অপারেটরকে বললাম, ‘তোমরা পালা করে সতর্ক নজর রাখবে রাডারের ওপর। কিছু দেখতে পেলেই আমাকে খবর দেবে। সকালে আর সন্ধ্যায় পাখিরা এত জ্বালাতন করে যে ছোটখাটো কিছু রাডারে ধরা পড়ে না। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে তখন কুয়াশার মতো একটা আবছায়া আভা রাডারে ফুটে ওঠে। ওটা আর কিছুই নয়—উড়ন্ত পাখির দঙ্গল। তোমরা সেকথা জানো। রাডারে কুয়াশার মতো চিহ্ন এত স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে, ওদিক দিয়ে কোনো জাহাজ এলেও আর আলাদা করে চেনবার উপায় থাকে না। রাতের বেলা কিন্তু সেই ঝামেলা নেই, পাখিরা সবাই তখন যে যার বাসায় আরাম করে শুয়ে থাকে। রাডার স্ক্রিন তখন বিলকুল সাফ। সমুদ্রে কিংবা আকাশে কিছু এসে হাজির হলেই রাডারে তার পরিষ্কার চিহ্ন ফুটে উঠবে।’
তিনজনেই আমার কথায় সমর্থন জানাল।
সর্দারজি বলল, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে—হামলোক ইমানসে কাম করেগা।’
‘হ্যাঁ স্যার, কিছু দেখতে পেলেই আপনাকে জানাব।’ অপারেটর বলল, ‘কিন্তু এই অন্ধকারে আপনি একা ফিরে যাবেন কি করে?’
‘আমি ঠিক ফিরে যাব—সে—জন্য ভাবতে হবে না।’
প্রমোদকক্ষে ফিরে গিয়ে দেখলাম, সুতপা বিষম উৎকণ্ঠায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রেডিও—ঘরে যে তিনজনকে রেখে এলাম, তারা বাদে সবাই জমায়েত হয়েছে এখানে। সকলেই যে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে সেকথা বলাই বাহুল্য।
সুতপা জানতে চাইল, ‘নতুন কোনো খবর এসেছে?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘না। অবশ্য রেডিওর পাশে ওদের বসিয়ে রেখে এসেছি। কোন দিক দিয়ে বিপদ ঘটে বলা তো যায় না। সব দিক দিয়েই আমরা তৈরি হয়ে থাকব। আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে আমাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ করে যেতে হবে। গুদামঘরে কি ছিল জানি না, তবে একথা স্পষ্ট যে আলো দেখেই সে পালিয়েছে। আমি ঠিক করেছি, দালানের চারধারটা আলোয় ভরে দেব। আলোতে থাকলে মনের জোর বাড়বে, সাহস বাড়বে, নির্ভয়ে কাজ করবার প্রবৃত্তি জন্মাবে।’
তারপর ইলেকট্রিশিয়ানের দিকে ফিরে বললাম, ‘আমার সাথে গুদামে চলুন। আপনার যা যা দরকার নিয়ে আসবেন।’
জীমূতবাহন বাধা দিয়ে বসল, ‘আপনি কি করছেন ভেবে দেখছেন?’
‘হ্যাঁ, অতিরিক্ত কিছু আলোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।’
‘তার ফল কি হতে পারে জানেন?’
‘জানি বৈকি—সবারই নিরাপত্তা বাড়বে।’
‘না, বিপদ বাড়বে। যার বিরুদ্ধে এত তোড়জোড় সে হচ্ছে অন্ধকারের জীব। আর অন্ধকারের জীব মাত্রেই আলো দেখে আকৃষ্ট হয়। আমার কথা যদি শোনেন তো আমি বলব, আলোর ফোয়ারা না ছুটিয়ে নিষ্প্রদীপের মহড়া শুরু করা হোক। কেউ যেন যেতে—আসতে একটা টর্চও ব্যবহার না করে।’
আমি আর থাকতে পারলাম না। বলে ফেললাম, ‘মিস্টার সেন, আপনার এই অমূল্য পরামর্শ আমার পক্ষে গ্রহণযোগ্য হল না বলে আমি দুঃখিত। এমন কোনো নৈশ প্রাণীর কথা আমার জানা নেই, যে নাকি ইলেকট্রিক বালব দেখলেই আক্রমণ করে বসে। আপনি দফায় দফায় আমাকে উপদেশ দেবেন, আর আমি আহ্লাদে ডগমগ হয়ে ঝড়াঝঝর ইনাম দেব, এতটা উজবুক আমি নই।’
রাগে জীমূতবাহনের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘যে ভুল আপনি করতে যাচ্ছেন, তার পরিণাম বড় শোচনীয়।’
‘ঠিক আছে, ফাঁদ পেতে আপনি যদি প্রাণীটাকে ধরে দিতে পারেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। শুধু তাই নয়, আপনি যা বলেন তাই শুনব।’
আড়ালে ডেকে সুতপা বলল, ‘দফায় দফায় যেমন উপদেশ দিচ্ছে তাতে উপাধিটা ‘সেন’ না হয়ে ‘দফাদার’ হওয়া উচিত ছিল।’
আমি টিপ্পনি কেটে বললাম, ‘তাহলে ক্ষতিটা তোমারই হত সবচেয়ে বেশি।’
সুতপা ব্যস্ত হয়ে উঠল, ‘কি রকম!’
‘তোমাকেও তাহলে দফাদার উপাধি নিতে হত।’
রেগে টং হয়ে গেল সুতপা, ‘আর কখনো এমন ঠাট্টা করলে আমি আপনার সাথে কথাই বন্ধ করে দেব, এই বলে রাখলাম।’
মুচকি হেসে ইলেকট্রিশিয়ানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আরো দুজন আমাদের সাথে যোগ দিল। প্রত্যেকেরই কোমরের বেল্টে একটি করে ভেরী পিস্তল বাঁধা। হাতে তাদের দূরপাল্লার ফ্ল্যাশলাইট।
গুদামঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একে একে আমরা ফ্ল্যাশলাইটের আলো নিভিয়ে খানিক অপেক্ষা করলাম। ভেতরে তখনও আলো জ্বলছিল। গুদাম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আমরা আলো নেভাতে ভুলে গিয়েছিলাম। বাইরে অতলস্পর্শী অন্ধকার। দূরে সমুদ্রের গর্জন। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। আর জেনারেটরের একঘেয়ে ধুকপুকানি। কান খাড়া রেখেও আর কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না। ভেতরে থেকেও নয়, বাইরে তো নয়ই।
একে একে ভেতরে ঢুকলাম। জিনিসপত্র যেমন দেখে গিয়েছিলাম তেমনই আছে! কুমেরুর গাছগুলি ছত্রাকারে ছড়ানো।
ইলেকট্রিশিয়ান বিদ্যুতের সরঞ্জাম এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল। আমি তাকে বললাম, ‘একটা জেনারেটরের ওপর বেশি চাপ পড়বে বলে মনে হয়। আমাদের অন্যটাও চালু করতে হবে।’
সুগ্রীব সাথেই এসেছিল। বলল, ‘গুদামের বাইরে আপনি লাইট নিভিয়ে অপেক্ষা করলেন কেন? কিছু কি শুনতে পেয়েছিলেন?’
জবাবে বললাম, ‘না, ঠিক সেজন্য নয়। অন্ধকারকে আমরা ভয় পাই। কারণ থাক আর না থাক, ভয় পাই। আমি দেখছিলাম, আতঙ্কিত হওয়ার যথার্থই কোনো হেতু আছে কিনা।’
ফেরবার সময় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেব কষে দেখাল, কোথায় ক’টা ফ্লাডলাইট বসাতে হবে, আর কোথায় ক’টা টিউবলাইট। অল্পসংখ্যক লাইট ব্যবহার করে কীভাবে বেশি জায়গা আলোকিত করা যাবে সেকথাও বলল।
সুগ্রীবের তখন অন্যরকম চিন্তা। বলল, ‘কার বিরুদ্ধে এতসব আয়োজন?’
সে চিন্তা আমারও। আমিও কি ছাই জানি, কার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি! কতরকম সম্ভাবনার কথাই তো মনে আসছে। কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক জানবার কোনো উপায়ই নেই।
উপায় বের করে দিল জীমূতবাহন। সময়কালে এক ছটাক বুদ্ধিও কেউ ধার নিতে পারবে না তার কাছ থেকে, আর অসময়ে তার মগজে যেন বুদ্ধির ঝিলিক খেলে যায়। অফিসে গিয়ে দেখলাম, শ্রীমান বসে আছেন আমার টেবিলের ধারে। সুতপা টাইপ করছে। বিমান থেকে যেসব মালপত্র নামানো হয়েছে তার তালিকা রেডিও মারফত পাঠানো হবে। জীমূতবাহন নিশ্চয়ই সুতপাকে জ্বালাতন করছিল। আমাকে দেখেই বলল, ‘রহস্য ক্রমেই জমাট বেঁধে উঠছে দেখতে পাচ্ছি। প্রাণীটা সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারলেন?’
বললাম, ‘আপনি নিশ্চয়ই নতুন কোনো ধারণা নিয়ে এসেছেন? বলুন, শুনে যাই।’
গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় কি জানেন—প্রাণীটা ট্যারান্টুলা হবে! ট্যারান্টুলা অতি বীভৎস জাতের মাকড়সা । তেমন তেমন ট্যারান্টুলা দেখতে পেলে অতিবড় সাহসীরও ভিরমি যাবার যোগাড় হয়। নিউইয়র্ক বন্দরে কতবার অঘটন ঘটে গেছে। জাহাজের খোল থেকে কলার কাঁদি নামিয়ে দেখা গেল একটা ট্যারান্টুলা রয়েছে তার সাথে। আর একবার এখটা বিষধর সাপ নিয়ে বন্দরে তো রীতিমতো সোরগোল পড়ে গেল। অথচ কলার কাঁদিগুলো যখন কাটা হল তখন কিছুই দেখা যায়নি। জাহাজে যখন মাল উঠল তখনও না। এমন ঘটনার বহু নজির আছে। এক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।’
যুক্তি শুনে আমার তো চোখ ছানাবড়া, ‘কুমেরুর ট্যারান্টুলা!’
‘কেন নয়? ঠান্ডায় তারা নিঝুম হয়েছিল, বিমানের ভেতরে গরম পেয়ে জেগে উঠেছে।’
‘মিস্টার সেন, ট্যারান্টুলা বধ করতে কেউ পিস্তলের প্রয়োজন অনুভব করে না। বিমান থেকে সেটাকে ঠেলে ফেলে দেবারও চেষ্টা করা হয় না। সেটাকে পিষে মেরে ফেলা হয়।’
যুক্তিটা মাঠে মারা যাওয়ায় চোখ ছলছল করে উঠল জীমূতবাহনের। তবু হাল ছাড়ল না। বলল, ‘তবে হয়তো বিষধর কোনো সাপই হবে।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘শুনুন মিস্টার, আপনার যুক্তির এতই ছড়াছড়ি যে এলোপাতাড়ি আপনি লাগাবার চেষ্টা করে চলেছেন। লাগে তুক, না লাগে তাক। সাপ না হয়ে একটা কাছিমও তো হতে পারে। কিংবা শামুক। কিংবা গিরগিটি। কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই সেই এক জবাব—সদলবলে কেউ তাকে বিমান থেকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করবে না।’
মরিয়া হয়ে বলল, ‘কিছুই নয় তো সেটা তবে কি?’
‘সেটা জানতে পারলে তো ল্যাটা চুকেই যেত। তাহলে কি আর ঝুটমুট এত ঝামেলা পোহাতে যাই?’
আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে জীমূতবাহন বেরিয়ে গেল। সুতপা মন্তব্য করল, ‘যুক্তি একটা খাড়া করবার জন্য ছটফট করে মরছে।’
আমি বললাম, ‘জীমূতবাহনকে যতটা বোকা ভাবা যায় ততটা সে হয়তো নয়। ছলে—বলে তোমার সান্নিধ্যলাভই তার উদ্দেশ্য। আমি কাছে এলেই এক—একটা আজব যুক্তি দাঁড় করিয়ে আমাকে ভুলিয়ে দেয়। তার উপস্থিত বুদ্ধি সত্যই প্রশংসার দাবি রাখে।’
সুতপা অবাক হল, ‘কি ব্যাপার! আজ যে আপনি ভিন্ন সুরে গান গাইছেন?’
‘সাথে কি আর গাইছি। এখন ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখি, তুমি ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে আছ। পাশেই বরবেশে জীমূতবাহন। কি সুন্দর তার মুখের ছাঁদ! আপনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নায়ক সেজে বসে আছে সে। তার ছলাকলা আমি ধরতে পারিনি। দাবার ছকে মোক্ষম এক চাল দিয়ে কিস্তিমাৎ করে দিয়েছে।’
‘আবার আপনি বকতে শুরু করেছেন। আজেবাজে কথা বললে এমন জব্দ করব একদিন যে তখন বুঝবেন। আমি কি পতিত জমি যে উনি আমাকে জবরদখল করে বসবেন? অনেক জন্তু আছে যারা জল না ঘুলিয়ে জল খেতে পারে না। জীমূতবাহন হচ্ছে তাই।’
কথায় সুতপার সাথে এঁটে ওঠা মুশকিল। তুরুক জবাবে সে ওস্তাদ। অগত্যা বললাম, ‘কিন্তু আসল জন্তু যে কে, সেটাই তো আমাদের খুঁজে দেখা দরকার।’
সুতপা কথার জের টেনে বলল, ‘তাই বরং চলুন।’
অফিস থেকে বেরিয়েই দেখি, সুগ্রীব জুত করে বসে বিড়ি টানছে। নাকি আড়ি পেতে কথা শুনছে!
আমাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, বাতি জ্বালানোর আয়োজন প্রায় শেষ করে এনেছি।’
বাইরে বেরিয়ে দেখি, চারদিক আলোয় আলোয় আলোময়।
সুগ্রীব বলল, ‘পেছন দিকটায় এখন খুঁটি পুঁতে তার টানানো হচ্ছে।’
তার কথায় কান না দিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, সুগ্রীব, তোমার কি মনে হয় কুমেরুর গাছগুলোর সাথে কোনো নিশাচর প্রাণী আমাদের এই দ্বীপে এসে হাজির হয়েছে?’
‘হয়েছে কি হয়নি, বলা মুশকিল। আপনি বরং কুমেরুর অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটি থেকে জেনে নেবার চেষ্টা করুন এমন কোনো জীব আছে কিনা যে নাকি উষ্ণ হ্রদ অঞ্চলের উদ্ভিদ খেয়ে প্রাণধারণ করে।’
‘ঠিক বলেছ, কাল ভোরেই আমি জানবার চেষ্টা করব।’
‘ভোর হতে তো এখনো ঢের বিলম্ব রয়েছে—রাতটা কি করে কাটাবেন?’
‘ঘুমিয়ে নিশ্চয়ই নয়। পালা করে পাহারা দিতে হবে আমাদের। যাও, তুমি সবাইকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে এস। রাতের প্রথম প্রহরে পাহারা দেব আমরা দুজন। আর মেয়েদের বলবে নিজের নিজের ঘরে ফিরে যেতে।’
সুগ্রীব চলে গেল। গুদামঘর থেকে ব্যারাক, আর ব্যারাক থেকে রেডিও—ঘর—সমস্ত পথটাই আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। চোখধাঁধানো আলোর রোশনাই দেখে ঘোর অন্ধকার যেন থমকে দাঁড়িয়েছে চারদিকে। সেই অন্ধকারে নিশাচর কোনো আতঙ্ক হয়তো ওত পেতে আছে সুযোগের অপেক্ষায়।
সুগ্রীব ফিরে এলে তাকে নিয়ে ঘুরেফিরে টহল দিতে লাগলাম সব—ক’টা দালান। হাতে আমাদের ভেরী পিস্তল। অঘটন কিছুই ঘটল না।
আমাদের পরে পাহারায় এল জীমূতবাহন এবং রোহিতাশ্ব ভাবা। আমরা ঘুমাতে গেলাম।
নির্ঝঞ্ঝাটে রাত কাটল। ভোরের আলোয় স্বস্তির শ্বাস নিয়ে দেখলাম, বহাল—তবিয়তে বেঁচে আছি আমরা। গায়ে সামান্য আঁচড়টুকুও লাগেনি কারো।
প্রাতরাশের জন্য সবাই জমায়েত হলে আমি আমার পরিকল্পনাটা খুলে বললাম। তিমিঙ্গিল দ্বীপটা আগ্নেয়গিরি বলয়ের ওপর অবস্থিত। এই দ্বীপের মতো ছোট জায়গায়ও তাই উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। সেখান থেকে আরো খানিক দূরে পাখিদের আস্তানা। সমুদ্রে দশ—বিশ মাইলের মধ্যে যত পাখি উড়ে বেড়ায়, রাতের বেলা তারা সেখানে এসে আশ্রয় নেয়। প্রাণীটি যদি প্রকৃতই মাংসাশী হয়ে থাকে, তবে পাখিদের আস্তানা ঠিক খুঁজে বের করবে। পাখিদের আস্তানায় গেলে হয়তো বা তার দৌরাত্ম্যের চিহ্ন পাওয়া যাবে। পাইলটের মৃতদেহেই যদি তার ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়ে থাকে তবে আপাতত তার জিঘাংসার কোনো পরিচয় পাওয়া যাবে না বটে, কিন্তু তীব্র অনুসন্ধানের ফলে তার হদিস হয়তো পাওয়া যাবে। মোদ্দা কথা, দ্বীপের সমস্ত জঞ্জাল ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে প্রাণীটাকে খুঁজে পাওয়া চাই—ই চাই। দুটো দল দু’দিক দিয়ে উষ্ণ প্রস্রবণ অঞ্চলে গিয়ে মিশে যাবে। সেখান থেকে একযোগে তল্লাশি চালানো হবে পাখিদের আস্তানায়। একটা দল আমি নিজে পরিচালনা করব, অন্যটা জীমূতবাহন।
যেমন কথা তেমনি কাজ। আমার দলটা আগে রওনা হল। সাথে আমাদের একটি শিকারি কুকুর। ছোট—বড় হরেক রকমের গাছ দেখলাম। রং—বেরঙের থোবা থোবা ফুল দেখলাম। মল—ফার্নের ছড়াছড়ি দেখলাম। ছত্রাকের তো কথাই নেই, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না রেখে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে বসে আছে। দ্বীপে আছে অনেক কিছুই। পাহাড় আছে, টিলা আছে, রুক্ষ শুষ্ক জমি আছে, জলাভূমি আছে, তরতর করে বয়ে—যাওয়া ঝরনা আছে, ক্ষুদে ক্ষুদে অজস্র পোকাও আছে। নেই শুধু চতুষ্পদ কোনো হিংস্র প্রাণী।
তেজি কুকুর সাথে নিয়েছিলাম। কিন্তু হলে কি হবে, সারাটা পথে একবারও সে ঘেউ করে একটা শব্দ পর্যন্ত করল না। গন্ধ শুঁকেও কিছু আবিষ্কার করতে পারল না। থেকে থেকে সে কেবল দলছাড়া হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। খানিক পরেই আবার ফিরে এসে দেখতে লাগল মানুষের দলটা তাকে অনুসরণ করছে কিনা।
আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে এসে থমকে দাঁড়ালাম। এখানে আসল রহস্যের হদিস মিললেও মিলতে পারে। অন্যত্র কঠিন পাথুরে জমিতে আগন্তুক প্রাণীর পায়ের ছাপ পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানকার জমি নরম। সারা তল্লাট জুড়ে ঘন বাষ্পের মেঘ। বাতাসের দমকে সেই মেঘ ছুটে যাচ্ছিল সমুদ্রের দিকে। বাষ্পের মেঘের অন্তরালে ফুটন্ত লাভা থেকে বুদবুদ ফেটে পড়ছিল। সালফারের গা—গুলোনো গন্ধ সহ্য করে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ানোও সম্ভবপর নয়।
তবু যতটা সম্ভব তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম। পায়ের কোনো ছাপই পাওয়া গেল না। একদিকে লাল এবং নীল রঙের বুদবুদের সমারোহ, আর অন্যদিকে পাথুরে জমির ওপর দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছিল ক্ষীণকায়া উষ্ণ স্রোতধারা। চারদিকের গভীর প্রশান্তির মাঝখানে একটা ফোয়ারা থেকে থেকে লাফিয়ে উঠছিল। এটারই নাম উষ্ণ প্রস্রবণ। এরই কিনারা ঘেঁষে থিকথিক করছিল নানা রঙের বিচিত্র সব কাদামাটির স্তর। সেখানে যেন রঙের হাট বসে গিয়েছিল।
প্রস্রবণের ধারে অপর দলটার সাথে সাক্ষাৎ হল। তাদের হালও আমাদেরই মতো। সন্দেহজনক কিছুই খুঁজে পায়নি তারা।
আবার আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম। এবার গন্তব্যস্থল পাখিদের আস্তানা। দূরত্ব কমবেশি আরো দু—মাইল।
এ তল্লাটে ছিটেফোঁটা মাটিও যেন নেই। শুধু পাথর আর পাথর। অজস্র ছোট—বড় পাথর। দূর থেকেই পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যেতে লাগল। আর পাওয়া গেল বিশ্রী একটা গন্ধ।
রোহিতাশ্ব ভাবা বাতাস শুঁকে বললেন, ‘নিশ্চয়ই নাইট্রেটের গন্ধ—পালক গলে গেলে এমন গন্ধই বেরোয়।’
আমি তখন খুঁটিয়ে দেখছি জমিতে কোনো পায়ের ছাপ আছে কিনা। নরখাদক প্রাণীর পক্ষে পাখি শিকারও অসম্ভব কিছু নয়। বাতাসে তো শুধু পাখিরই গন্ধ। যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধু পাখির বাসা। গাছের ডগায়, ডালের আগায়, পাথরের ফোকরে, এমন কি জমির ওপর প্রতি ইঞ্চি জায়গাতে—যেখানেই পা রাখবার ঠাঁই পেয়েছে সেখানেই—পাখিরা একটি করে বাসা গড়ে তুলেছে।
আমাদের হানাদার ভেবে পাখিরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। কেউ কেউ ডানার ঝাপটানি দিয়ে উড়তে লাগল চারদিকে, কেউ ডিমে তা দিতে দিতে ঘাড় বেঁকিয়ে সরু ঠোঁট উঁচিয়ে সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। যত সতর্কতা নিয়েই আমরা এগোই না কেন, ঘন—সংবদ্ধ পাখির বাসাগুলির অল্পবিস্তর ক্ষতি না করে উপায় ছিল না।
অগত্যা আমরা পিছু ফিরলাম। পাখিদের আস্তানায় হানাদারের কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না।
কিছু নীচে খানিকটা বন্ধ্যা পতিত জমির ওপর মস এবং লিচেনের সমারোহ দেখলাম। কী বিচিত্র তাদের রং! বহুবিস্তীর্ণ একখানা সাদা গালিচার গায়ে কে যেন লাল নীল সবুজ বাদামি প্রভৃতি রঙের ছোপ বুলিয়ে দিয়েছে।
রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘ওইগুলি হচ্ছে তুন্দ্রা অঞ্চলের উদ্ভিদ। ওদের বৈজ্ঞানিক নাম নাইট্রোফাইল। যেখানে কোনো গাছই জন্মাবে না সেখানেই ওদের রাজত্ব। গলা—গলা পালক থেকে ওরা আহার সংগ্রহ করে। অন্য পরিবেশে ওরা মরে যাবে, অথচ এই পূতিগন্ধময় বাতাসেই দিব্যি বেঁচে—বর্তে থাকবে। তাজ্জব ব্যাপার নয়?’
আমি তখন ভাবছিলাম অন্য কথা।
রোহিতাশ্ব ভাবা বলে যেতে লাগলেন কীভাবে তিনি কুমেরুর উদ্ভিদগুলি নিয়ে পরীক্ষা—নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। গাছগুলি নাকি এক একটি জীবন্ত ফসিল। এদের সেলিউলোস ফাইবার নাকি দারুণ লম্বা। যে ফ্ল্যাক্স ফাইবার থেকে লিনেন তৈরি হয়, এগুলি নাকি অনেকটা সেরকমই দেখতে। তন্তুগুলির আকার নাকি নিউরোন—এর মতো। বোটানির ইতিহাসে ব্যাপারটা নাকি অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য। মানুষের অভিজ্ঞতার ইতিহাসে এমন গাছের নজির নেই।
আনন্দের আতিশয্যে তিনি অবিরাম কথা বলে যেতে লাগলেন। কুমেরুর গাছগুলিকে তিনি উষ্ণ প্রস্রবণের ধারে পুঁতবেন বলে মনস্থ করেছেন, সেকথাও জানালেন। আমি কিন্তু মনমরা হয়ে পথ চলতে লাগলাম।
আমাকে ফিরে আসতে দেখে সুতপা ছুটে এসে একখানা কাগজ গুঁজে দিল আমার হাতে। বলল, ‘আন্দামান থেকে একখানা বিমান আজ দুপুরে এসে পৌঁছোবে। তারা জানতে চায়, আমাদের রানওয়ে পরিষ্কার আছে কিনা।’
সকালের তল্লাশিপর্ব ব্যর্থ হওয়ায় মেজাজ এমনিতেই খিঁচড়ে ছিল। বললাম, ‘আসুক না! এসে স্বচক্ষেই তারা দেখে যাক দুর্ঘটনার খবর সত্যি না মিথ্যে।’
কাগজটায় একবার দৃষ্টি বুলিয়ে বললাম, ‘তা কখন বিমানটা এসে পৌঁছোচ্ছে?’
‘সময় হয়ে গেছে : যে কোনো মুহূর্তে তারা এসে পৌঁছোতে পারে। অপারেটর তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।’
বললাম, ‘ফিরে তো তাদের যেতেই হবে। প্রচুর ফুয়েল না নিয়ে যদি রওনা হয়ে থাকে, তবে কপালে তাদের যথেষ্ট দুর্ভোগ আছে। যাক, রাডারে এতক্ষণ তাদের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে নিশ্চয়ই। আবার একটা দুর্ঘটনা না হলে বাঁচি! চল, দেখে আসি—’
তড়িঘড়ি রেডিও—ঘরে ছুটে গেলাম। রাডার স্ক্রিনে আলোর বিন্দু দেখে বুঝলাম, বিমানটা সোজা দ্বীপের দিকেই আসছে। অপারেটর মাইক্রোফোনে কথা বলছিল। আমাকে দেখে বলল, ‘….এবার আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের সঙ্গে কথা বলুন।’
লাউড—স্পিকারে আন্তরিকতাহীন নীরস একটি কণ্ঠ ধ্বনিত হল : নিশ্চয়ই…. নিশ্চয়ই….একশোবার….দিন তাঁকে!’
মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে বললাম, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু তার সাথে এ—কথাও জানাতে বাধ্য হচ্ছি, অল্পপরিসর রানওয়েতে আপনারা সম্ভবত নেমে আসতে পারবেন না। একটা বিমান আগেই বেলি—ল্যান্ডিং করেছে, জানেনই তো।’
‘বটে! বটে! আমরা ঠিক নেমে আসব দেখবেন।’
‘তা যদি পারেন তো আমরাই খুশি হবো সবচেয়ে বেশি। আশা করি বাতাসের গতি কত আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে?’
‘তা হয়েছে, প্রয়োজনীয় সব তথ্যই জানানো হয়েছে আমাদের।’
মাইক্রোফোনটা অপারেটরের হাতে দিয়ে বললাম, ‘কি ভেবেছে ওরা? আমাদের কথা বিশ্বাস না করে পার পাবে? আজব কাহিনি ভেবে আমাদের বক্তব্য উড়িয়ে দেবে? সত্যি যদি ওরা নেমে আসতে পারে, তবে বিমান বোঝাই করে আমাদের চিকিৎসার জন্য পাঠাবে। ওদের বদ্ধমূল ধারণা, আমরা সকলেই মানসিক রোগে ভুগছি। অথচ—’
সুতপা বলল, ‘ভাবতে দিন ওদের। তাতে আমাদের কিছু যাবে—আসবে না।’
বললাম, ‘তাই নাকি! কি করে?’
সুতপা জবাব দেবার আগেই বাইরে উল্লাসধ্বনি উঠল। যে যেখানে ছিল ছুটে এসে বাইরে দাঁড়াল। ছোট্ট একটা বিন্দু অতি দ্রুত এগিয়ে আসছে।
বিমানটা অতি দ্রুত দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একবার। তারপর বৃত্তাকার পথে চক্কর দিতে লাগল।
হঠাৎ কোথা থেকে জীমূতবাহনের আবির্ভাব। হাতে তার একটা বোতল। এটাই নাকি তার নবতম আবিষ্কার। বলল, ‘দেখুন কি বানিয়েছি—মলোটভ ককটেল!’
দেখলাম, বোতলটা স্যান্ডপেপার এবং দিয়াশলাই দিয়ে সুসজ্জিত।
জীমূতবাহন বুঝিয়ে বলল, ‘এই পলতেটা আঙুলের চারধারে জড়িয়ে রাখতে হয়। বোতলটাকে ছুড়ে মারলে দিয়াশলাইয়ের সাথে স্যান্ডপেপারের ঘষা লাগে এবং পলতেটাতে আগুন লেগে যায়। তারপর বোতলটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেলে মারাত্মক ব্যাপার ঘটে। এমন কোনো জীবিত প্রাণী নেই, যাকে এই হাতিয়ার দিয়ে ঘায়েল করা যাবে না।’
বললাম, ‘আপনার আবিষ্কারের গুরুত্ব আমি বুঝলেও যারা আসছে তারা বুঝবে না—তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। বিমানটি একবার নেমে আসুক না—’
কিন্তু নেমে আসা সম্ভব হল না বিমানটির পক্ষে। কেবল উড়ে বেড়ানোই সার হল। অপারেটর জানাল, ‘ওরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।’
আবার মাইক্রোফোন তুলে নিলাম।
ওরা বলল, ‘রানওয়েতে একটা বিধ্বস্ত বিমান দেখতে পাচ্ছি। সত্যি কি বুকে ভর দিয়ে নেমেছে নাকি! হয়েছিল কি?’
বললাম, ‘সেকথা আগেই জানানো হয়েছে—নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না।’
‘কিন্তু….কিন্তু এ যে হতে পারে না….এ যে অসম্ভব!’
আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
‘ঠিক আছে। নামা যখন যাবেই না, আমরা ফিরেই যাচ্ছি। গিয়েই একটা জাহাজ পাঠিয়ে দেব আমরা। তদন্ত করবার জন্য বিশেষজ্ঞও আসবে। যত তাড়াহুড়োই করা যাক না কেন, জাহাজ পৌঁছোতে দু—চারদিন তো লাগবেই।’
‘আমরা অপেক্ষা করব।’
‘শুধু অপেক্ষা করলে চলবে না। দেখবেন যাতে আতঙ্ক না ছড়ায়—কাজকর্ম ঠিক মতো চলে। তবে বিমানের কোনো জিনিসে হাত দেবেন না, তদন্ত করবার সময় প্রয়োজন হবে।’
‘কিন্তু আমরা সে সমস্ত মালই খালাস করে ফেলেছি।’
‘ভুল করেছেন। বিমানে হাত দেওয়াটা আপনাদের অন্যায় হয়েছে। যা হোক, যা হবার হয়েছে—আপনাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে?’
‘না, আমাদের গুদামে যথেষ্ট মাল আছে।’
‘বেশ, আমরা তাহলে চলি। জাহাজ শিগগিরই আসছে—বিদায়!’
আস্তে আস্তে বিমানটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আবার বিমর্ষ মনোভাব ফিরে এল সবার মধ্যে। এই জনবিরল ক্ষুদ্র দ্বীপে নতুন করে নির্জনতা অনুভব করবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবু মনে হতে লাগল, আমরা যেন আরো নির্জনতার মধ্যে গিয়ে পড়লাম। বিমানের লোকজনদের আমরা আমাদের মধ্যে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি বলেই এই হতাশ ভাব।
সবাই যখন বিষণ্ণ নজরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন ছোট্ট একটি ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল।
একটা কুকুর মাটি শুঁকে শুঁকে ছোট্ট একটা প্রাণী আবিষ্কার করল। কাঁটাওয়ালা তিনটে ছোট ছোট পাতা নিয়েই প্রাণীটার দেহ। আকারে প্রায় চার ইঞ্চির মতো লম্বা। কুকুরের হাত থেকে বাঁচবার জন্য প্রাণীটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল। কুকুরটাও ওর পেছনে নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে ছিল বলে লাফিয়ে সামনের একটা থাবায় কাঁটা বসিয়ে দিল। আকস্মিক আক্রমণে কুকুরটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বিস্মিতও হল কম নয়। সেই সুযোগে প্রাণীটা গিয়ে ঢুকল একটা ছোট গর্তে। পাতাগুলি মুড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না। এ আপদ আবার কোথা থেকে এসে জুটল!
মনমেজাজ ভালো নয় বলেই ওই অদ্ভুত প্রাণীটাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। কারণ তখনও জানতাম না যে ওকে ঘিরে এক অদ্ভুত ভবিতব্য অপেক্ষা করছে!
(৫)
একে একে সবাই ফিরে এল। স্বস্তি পাবার জন্য আমি গুনে দেখলাম তাদের। গিয়েছিল উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায়। রোহিতাশ্ব ভাবা সাথে ছিলেন। আর ছিল কতকগুলি কুমেরুর গাছের গুঁড়ি। প্রস্রবণের ধারে উষ্ণ মাটিতে তিনি গাছগুলিকে রোপণ করে এসেছেন। এবার সাগ্রহে অপেক্ষা করবেন। তাঁর আশা, গাছগুলি নিশ্চয়ই এই দ্বীপের আবহাওয়ায় বেঁচে থাকবে।
রোহিতাশ্ব ভাবা যখন গাছ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, জীমূতবাহন তখন সুতপার প্রেমে ধন্য হবার জন্য ছোঁকছোঁক করছে। সুতপাকে বেশির ভাগ সময়ই কাটাতে হয় আমার কাজে। জীমূতবাহনকেও তাই নিত্য নতুন আবিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এখন যেমন ‘মলোটভ ককটেল’ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। হাতিয়ারটা কাজ দেখাতে পারলে সুতপার হৃদয়ে সে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে—এই তার আশা।
চিফ মেকানিক দেওপ্রকাশ রাই কিন্তু নিজের কাজে তন্ময় হয়ে আছে। তার অধীনে কাজ করছে আরো জনাপাঁচেক লোক। দালানের একপ্রান্তে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে ঠুকঠাক শব্দ করছে তারা। জ্যাক দিয়ে বিধ্বস্ত বিমানটিকে তুলে ধরে চাকার ওপর দাঁড় করাবেই—এই তাদের সংকল্প।
আমি তখন সুতপাকে নিয়ে দালানের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে আর আঁধারের নিশ্ছিদ্র যবনিকা নেমে আসছে দ্বীপের ওপর। সেদিকে তাকিয়ে সুতপাকে বললাম, ‘আবার একটি রাত ঘনিয়ে আসছে। জানি না, আজকের রাতটা কেমন যাবে।’
সুতপা বলল, ‘আর কিছু ঘটবে বলে তো মনে হয় না। আপনারা দ্বীপটাকে তো চষে ফেললেন। পেলেন কিছু? হিংস্র প্রাণী কেন, একটা ছুছুন্দরীও নেই এখানে।’
‘তা নেই বটে। বিপদের প্রকৃত স্বরূপ জানা নেই বলেই তো ভয়টা এত বেশি। কোন দিক দিয়ে আমরা সাবধান হব, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।’
রোহিতাশ্ব ভাবার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘দেখুন, দেখুন, উনি এদিকেই আসছেন।’
বললাম, ‘ওঁর কথা ছেড়ে দাও। উনি গাছ নিয়েই মেতে আছেন। অন্য কোনো চিন্তা ওঁর মগজে প্রবেশ করবার সুযোগ পায় না।’
একটা বেস—বল নিয়ে সুগ্রীব নিজের মনেই খেলা করছিল। করিম ব্যস্ত ছিল রান্নার কাজে।
রোহিতাশ্ব ভাবা গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাঁর দিকে তাকালাম।
তিনি বললেন, ‘গাছগুলি যেখান থেকে এসেছে সেখানকার মাটির খানিকটা নমুনা পেলে ভালো হত। একটা পি—এইচ রিডিং নিয়ে নিতাম। মাটির উষ্ণতা এবং আর্দ্রতা সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকলেও ভালো হত। আর একটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না। এই গাছগুলিকে আহার্য হিসেবে গ্রহণ করে এমন কোনো প্রাণী আছে কি?’
আমার কৌতূহল উদগ্র হয়ে উঠল, ‘কেন? কেন?’
‘কারণ, একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি আমি। গাছের ডগাগুলি ভাঙা ভাঙা দেখতে পাচ্ছি। কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ এলাকায় হয়তো প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায়। গাছের ডালপালাও হয়তো ভেঙে পড়ে তার ফলে। কিন্তু বাতাসে যখন ডাল ভাঙে, তখন জোড়ের জায়গাগুলোতেই ভাঙে—বেছে বেছে ডগাগুলি ভাঙে না।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাঙার চিহ্নগুলি কি পুরোনো মনে হয়?’
‘কিছু তো পুরোনো আছেই। সেই চিহ্নগুলি এত পুরোনো যে, প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। তাজা চিহ্নও আছে। এত তাজা যেন গতকালই কেউ ডগাগুলি খেয়ে ফেলেছে। এ তো দেখছি মহা ফ্যাসাদ। জাল দিয়ে ঘিরে না ফেললে গাছগুলিকে তো খেয়ে সাবাড় করবে! রাত পোহালেই একটা কিছু করতে হবে।’
রোহিতাশ্ব ভাবা চলে গেলেন। এবার আমি চিন্তায় মগ্ন হয়ে মাথার চুলে হাত বুলোতে লাগলাম।
সুতপা বলল, ‘ডক্টর ভাবা কি বললেন শুনেছেন তো? সকালে কুমেরুর অস্ট্রেলিয়ান ঘাঁটিতে খবরটা জানতে চেয়ে ভালোই হয়েছে। দেখা যাক, তারা কি জবাব দেয়।’
বললাম, ‘তেমন কোনো প্রাণী যদি থেকেই থাকে, ওই গাছগুলি দিয়েই আমরা টোপ ফেলতে পারব।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা যেন ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাই না?’
মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি।
আকাশটা যেন থমথম করছে। তেমনি সমানে বয়ে চলেছে ঝড়ো হাওয়া আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। একে একে সবাই দালানের ভেতর আশ্রয় নিচ্ছে। দূরে রানওয়ের ওপর আধো আলো আধো অন্ধকারে বিধ্বস্ত বিমানটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে। গুদামঘরের বাইরে চার—চাকার একটা গাড়ির পাশে কয়েকটা গাছ জড়ো করা আছে। কুমেরুর গাছ এগুলি। যাদের আজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের দলে এদের স্থান সঙ্কুলান হয়নি। আগামী কাল আবার এদের পুঁততে নিয়ে যাওয়া হবে।
দপ করে সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। জীমূতবাহন তক্কে তক্কে ছিল। ফুরসত পেলেই একবার সুতপার সাথে কথা বলে যাবে। সুতপাকে একা না পেয়ে অগত্যা সর্দার সিং—এর সাথেই তর্ক জুড়ে দিল।
জীমূতবাহন বলল, ‘কি সর্দারজি, জমিজমা দেশে ফেলে রেখে এই নিরিবিলি জায়গায় আর কতদিন কাটাবেন?’
সর্দার সিংও চুপ করে কথা হজম করবার পাত্র নয়। বলল, ‘জনাব, আপনে গলত সমঝা হ্যায়। জরু অউর জায়দাদ মেরে সাথই তো হ্যায়!’
‘কি, আপনার সাথে আছে?’
‘জরুর! এ দেখিয়ে।’
‘আরে, এটা তো আপনার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের গ্রুপ ফটো!’
‘তোবা! তোবা! এ সেরেফ তসবির হ্যায়—অউর কুছ নেহি?’
‘আবার কি?’
‘জনাব, এ হ্যায় মেরে আমানত—মেরে আশনাই—মেরে দুনিয়া—মেরে সবকুছ। এ মেরে সাথ হ্যায় তো ম্যায় ইতনা আমির হুঁ কে ব্যস মত পুছিয়ে। ধান্দা কে লিয়ে ইধর—উধর তো জানা হি পড়েগা। বিবি কি সাথ জুদা হোনা জরুরত সে জাদা জরুরি হ্যায়। ইস্তফা তো নেহি দে সকতা—তনখা কাঁহা সে মিলেগা? ইসি লিয়ে তসবির সাথ লেকর হি ফিরতা হুঁ।’
‘বহুত আচ্ছা, সর্দারজি! আপনি তো বেশ দিলদার আদমি দেখতে পাচ্ছি!’
‘ইমানদার ভি। লেকিন আপ ক্যা হ্যায়—দাগাবাজ?’
ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
একটা কুকুর আলোকিত অংশের শেষ সীমায় হঠাৎ মাটি আঁচড়াতে লাগল। তারপর আঁচড়ানো বন্ধ রেখে বসে রইল চুপচাপ। কান দুটো তার খাড়া হয়ে উঠল। চোখ দুটো অন্ধকারের ভেতর কি দেখতে পেল কে জানে।
দেওপ্রকাশ রাই এসে জানাল, কালই সে বিধ্বস্ত বিমান সরানোর কাজে হাত দেবে।
আমি জানতে চাইলাম, ‘ক’দিন লাগবে বলে মনে হয়?’
জবাব দিল, ‘দিন দুই লাগবে। বিমানটার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। হয়তো বা আবার উড়তেও পারবে।’
কুকুরটা প্রথমে একবার ডেকে উঠল। তারপর ঘন ঘন। কারণে—অকারণে ডেকে ওঠাই কুকুরের জন্মগত অধিকার—অভ্যাসও বটে। তাকে আমল না দিয়েই আমরা দালানের ভেতরে পা বাড়ালাম। দেওপ্রকাশকে বলতে বলতে গেলাম, ‘কিন্তু ওপর থেকে কি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানো? আমরা যেন বিমানটাকে স্পর্শই না করি। তাদের কথা শুনলে তো আর চলবে না। তাই—’
কুকুরটা এবার আর্তনাদ করে উঠল। ভয়াবহ সে আর্তনাদ। আগে যে ডেকে উঠেছিল সেটা ঔৎসুক্যবশে। যেন প্রতিবাদ জানাচ্ছে। যেন প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কিছুর সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে চায়। এবারকার চিৎকার সম্পূর্ণ ভিন্নতর। প্রচণ্ড যন্ত্রণা না পেলে কুকুরের কণ্ঠে এমন প্রাণান্তকর চিৎকার ধ্বনিত হয় না।
চারজন লোক ছুটে কুকুরটার দিকে যেতে উদ্যত হতেই আমি বাধা দিলাম। চেঁচিয়ে বললাম, ‘খবরদার! আলো না নিয়ে কেউ বেরোবে না। বন্দুক নাও! প্রত্যেকে একটা করে বন্দুক নাও!’
মেয়েদের বললাম, ‘দালান থেকে কেউ বাইরে এক পাও এগোবে না।’
এক হাতে শটগান এবং অন্য হাতে ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে আমি দালানের বাইরে এলাম। সুতপা হাত ধরে অনুরোধ করল, ‘আপনি একা কিন্তু বিপদের ঝুঁকি নেবেন না!’
তার কথায় কর্ণপাত না করে আমার দলবলের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। প্রত্যেকেই মনেপ্রাণে তৈরি। জীমূতবাহনের হাতে একগাদা গ্যাসোলিনের বোতল—শখ করে যার নাম দেওয়া হয়েছে মলোটভ ককটেল। তার আবিষ্কৃত হাতিয়ার এই বেলা কাজে লাগবে মনে করে সে বেজায় খুশি।
সবার হাতে ফ্ল্যাশলাইট ছিল না। সুতপা জীমূতবাহনের হাত চেপে ধরল। বলল, ‘দোহাই আপনার! আপনি আরো কয়েকটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে আসুন।’
জীমূতবাহন যেন কৃতার্থ হয়ে গেল। তিলমাত্র বিলম্ব না করে অন্দরমহলে ছুটল।
তোড়জোড় সাঙ্গ হলে আমরা অকুস্থলে ছুটে গেলাম। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় সমস্ত অন্ধকার তছনছ করে দেওয়া হল। গাছগাছালি লতাপাতা খুঁটিয়ে দেখা হতে লাগল। কিন্তু বৃথাই। কুকুরটা যেন হাওয়ায় উবে গেছে।
জীমূতবাহন বলল, ‘গ্যাসোলিনের একটা বোতল ফাটাব নাকি?’
আমি সাগ্রহে সম্মতি জানালাম।
জীমূতবাহন একটা বোতল ছুড়ে দিল। বারুদে ঘষা লেগে পলতেটাতে আগুন ধরে গেল। মাটিতে পড়ে বোতলটা ভেঙে যেতেই আগুনের লেলিহান শিখা প্রায় দশ ফুট পর্যন্ত লাফিয়ে উঠল।
ঝোপঝাড়ের আনাচে—কানাচে সামনে—পেছনে আরো কয়েকটা বোতল ভাঙা হল। প্রচণ্ড আলোর ঝটকায় প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঝোপ, এমন কি প্রতিটি তৃণখণ্ডও পরিষ্কার দেখা যেতে লাগল। দেখা গেল না শুধু কুকুরটাকে।
ঝোপের মধ্যে কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল! ডালপালা নড়তে দেখেছি আমি।
ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে আরেক দফা তল্লাশি চালানো হল। সুগ্রীব বলল, ‘দেখুন! দেখুন! এখানকার মাটির অবস্থাটা একবার দেখুন!’
মাটিতে অজস্র দাগ দেখলাম। কুকুরের নখের দাগ। মরিয়া হয়ে সে আক্রমণকারীর কবল থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
রোহিতাশ্ব ভাবা অভিনিবেশ সহকারে দাগগুলি দেখতে লাগলেন। আর আমি ঝোপের ভেতরে ঢুকে দেখতে চাইলাম—রহস্যটা কি। যাবার আগে বললাম, ‘আমাকে ঘিরে ফ্ল্যাশলাইটের আলো জ্বেলে রাখবে। গুলি করবার প্রয়োজন হলে দেখেশুনে করবে।’
আরো কয়েকটা গ্যাসোলিনের বোতল ফাটানো হল।
আমি যখন ঝোপের ভেতর ঢুকছি, জীমূতবাহন তখন দৌড়চ্ছে দালানের দিকে। সম্ভবত গ্যাসোলিনের সব ক’টা বোতলই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
অজানা আতঙ্কের সম্মুখীন হবার জন্য আমি একাকী জঙ্গলে ঢুকছি—এর চেয়ে রোমহর্ষক ব্যাপার আর কি হতে পারে? বাহবা পাবার জন্য আমি এ কাজ করিনি। অতগুলি লোকের নিরাপত্তার কথাই আমার মনে জেগেছিল সবার আগে।
সে কথা ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ডালপালার মধ্য দিয়ে আমি পথ করে নিচ্ছি। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি একটা কিছু ঘটে যাবে। হতচ্ছাড়া ডালগুলিও যেন আমার স্পর্শ পাবার জন্য কাতর। ফ্ল্যাশলাইটে পথ দেখছি। শটগান বাগিয়ে ধরে আছি। তবু যেন অস্বস্তি দূর হয় না।
পেছনে খসখস আওয়াজ শুনে চোখের পলকে পিছু ফিরে দাঁড়ালাম। না, অন্য কিছু নয়—সুগ্রীব আসছে। সেও সশস্ত্র।
বলল, ‘একা আসাটা আপনার কিন্তু খুবই অন্যায় হয়েছে। বিপদ ঘটতে কতক্ষণ! দুজন একত্র থাকলে বিপদের মোকাবিলা করবার সুবিধে হয়।’
তার কথায় কর্ণপাত না করে বললাম, ‘মাটিতে তীক্ষ্ন নজর রাখতে হবে—কুকুরটাকে হয়তো নিয়ে যাবার সময় পায়নি।’
প্রতিটি ঝোপঝাড় গাছগাছালি তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। না পাওয়া গেল আততায়ীকে, না হতভাগ্য কুকুরটাকে। কিছু কীটপতঙ্গ দেখা গেল। বড় একটা মাকড়সার জাল দেখা গেল। দলিত—মথিত কিছু মস এবং ফার্নও দেখা গেল। আর দেখা গেল মাটির ওপর কতকগুলি গাছের শিকড়। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
ঝোপের বাইরে যারা ছিল তারা আমাদের দুজনকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে দেখে আরও হতাশ হল। বললাম, ‘যতদূর মনে হয় চোখ—ধাঁধানো আলো মোটেই সহ্য করতে পারে না প্রাণীটা। আমরা ঝোপে ঢোকার সাথে সাথে সেও হয়তো পালিয়ে গেছে।’
দেওপ্রকাশ রাই বলল, ‘কিন্তু এমন কোনো প্রাণী তো মোটেই ছিল না এখানে! এলো কোথা থেকে?’
প্রশ্নের পর প্রশ্নই শুধু মনের মাঝে উঁকি মারছে। তার সমাধান কে করবে?
একজন মেকানিক বলল, ‘পাখিটাখি তো হতে পারে?’
আমি বললাম, ‘এই যুক্তি আগেই একবার নাকচ হয়ে গেছে।’
রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘কুমেরুতে কয়েক জাতের নিশাচর পাখি অবশ্য আছে। পেঁচাই তাদের মধ্যে প্রধান। ইঁদুর আর খরগোশ খেয়েই তারা বেঁচে থাকে। তাদের এমন ক্ষমতা নেই যে একটা কুকুর তুলে নিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া কোনো নিশাচর পাখিই ঘন জঙ্গলের ভেতর উড়ে বেড়াবে না। অথচ জঙ্গলের ভেতর ডালপালা নড়তে দেখেছে সবাই।’
আমি সতর্ক করে দিলাম, ‘নৈশ আগন্তুকের স্বরূপ যা—ই হোক না কেন, আলোটাকে সে যমের মতো ভয় করে। আঁধারেই তার কারবার। একান্ত জরুরি দরকার না হলে কেউ যেন অন্ধকারে পা না বাড়ায়।’
সর্দার সিং প্রতিবাদ জানাল, ‘লেকিন স্যার, ম্যায় বুজদিল আদমি নেঁহি—’
আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘শোন সর্দারজি, মানুষের প্রথম এবং প্রধান ধর্ম আত্মরক্ষা করা। সেটা কাপুরুষতা নয়।’
জীমূতবাহন এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু দেখতে পেলেন?’
নিরুত্তরে মাথা নাড়লাম। হঠাৎ খেয়াল হল, সে এতক্ষণ আমাদের মাঝে ছিল না। কোথায় গায়েব হয়ে ছিল এতটা সময়? আরো একটা কথা খেয়াল হতেই শিউরে উঠলাম। মেয়েদের অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই আমরা বেরিয়ে এসেছি। সঙ্কল্প করলাম, ভবিষ্যতে এই মারাত্মক ভুলের আর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেব না।
দোরগোড়ায় সুতপা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই অভিযোগ পেশ করল, ‘আপনি একাকী জঙ্গলে ঢুকেছিলেন?’
‘তুমি জানলে কি করে?’
‘জানতে পেরেছি—সত্যি কিনা বলুন?’
‘সেকথা থাক। শোনো সুতপা, এতকাল সংশয় ছিল, এবার সেই সংশয়ের নিরসন ঘটল। ভয় পাবার মতো কিছু একটা এখানে আছেই। অথচ ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস, কর্তৃপক্ষ সেকথা বিশ্বাস করবেন না। কি করি বল তো?’
সুতপা কোনো মন্তব্য করতে সাহসী হল না।
দৃপ্ত পদক্ষেপে জীমূতবাহন এগিয়ে এল সুতপার কাছে। যেন দেশ জয় করে ফিরছে। তার গ্যাসোলিন বোতল যে যথার্থই কাজ দিয়েছে, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। বললাম, ‘আপনার আবিষ্কারকে আমি হেলার চোখেই দেখে এসেছি—কদর বুঝতে পারিনি। এ—জন্য সত্যি দুঃখিত।’
সুতপা আমার কানে কানে বলল, ‘আপনি তো আর জহুরি নন যে জহর চিনবেন!’
আমি চোখ টিপে দিলাম, ‘আস্তে কথা বল—শুনতে পাবে।’
জীমূতবাহন এবার যুক্তি দিয়ে নতুন একটা থিয়োরি যে খাড়া করবে সেটা আগেই টের পেয়েছিলাম। করলও তাই। বলল, ‘এতক্ষণে একটা কার্য—কারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল।’
আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম, ‘কি রকম?’
সুতপা ফিসফিস করে বলল, ‘ছিপি—আঁটা গ্যাসের বোতল খুলে দিলেন। এবার ঠেলা সামলান—ভুরভুর করে গ্যাস বেরোবে।’
জীমূতবাহন বলতে লাগল, ‘ডালপালা নড়তে দেখেছে সবাই। কিন্তু কে নাড়াচ্ছে দেখতে পেয়েছে কি? পায়নি। দেখতে না পাবার কি এমন কারণ থাকতে পারে? দূরত্ব তো বেশি ছিল না—মাত্র তিরিশ ফুটের মতো। আলোর অভাবও ছিল না। এক ডজন ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল। গ্যাসোলিনের আলো তো ছিলই। ঘটনাটা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে।’
সুতপা কানে কানে মন্তব্য করল, ‘কেউ দেখে শেখে, আর কেউ ঠেকে শেখে। আপনি এবার ঠেলায় পড়ে শিখুন।’
জীমূতবাহন বলে যেতে লাগল, ‘কি, কিছু বুঝতে পারছেন? পারছেন না। আমাদের এবার কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। গাছের গুঁড়ি অটল হয়ে আছে, অথচ ডালপালা নড়ছে। মাত্র তিরিশ ফুট দূরে রয়েছি আমরা অথচ দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। ঘটনাটা বাস্তব। প্রাণীটা তো আর অবাস্তব হতে পারে না। দোষ যদি দিতে হয় আমাদের চোখকেই দিতে হবে। কারণ সামনে থাকা সত্ত্বেও প্রাণীটাকে আমরা দেখতে পাইনি—পাবার উপায়ও ছিল না। প্রাণীটা অদৃশ্য যে!’
আমি চমকে উঠলাম, ‘অদৃশ্য প্রাণী!’
‘কেন নয়? সমুদ্রে তো হামেশাই স্বচ্ছ প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়।’
‘তা যায়। তাদের স্বচ্ছতা অহেতুক নয়—আত্মরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য। দৈহিক স্বচ্ছতা সত্ত্বেও আমরা তাদের দেখতে পাই। কাচ আর প্ল্যাস্টিক যত স্বচ্ছই হোক না কেন আলো প্রতিফলিত হয়ে তারা দৃশ্যমান হয়। এমন কি পাতলা সাবানের বুদবুদও অদৃশ্য নয়। কোনো প্রাণী অদৃশ্য হবে তখনই, যখন তার রিফ্রাকটিভ ইনডেক্স বাতাসের সাথে সমান হবে। সেটা অসম্ভব।’
সুতপা আনমনে বলতে লাগল, ‘যুক্তিগুলো রসগোল্লা নয় যে টকাটক গিলে ফেললেই হল।’
জীমূতবাহন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো সুতপার কথায়। আমি ধৈর্য ধরে বলে যেতে লাগলাম, ‘প্রতিটি ঘটনার পেছনেই একটা কারণ আছে। যতক্ষণ সেই কারণটা আমরা ধরতে না পারি, ততক্ষণই ব্যাপারটা আমাদের কাছে রহস্যময় ঠেকে। প্রাণীদের দেহে আমরা যে রঙের বৈচিত্র্য দেখি তারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু অদৃশ্য থাকার সার্থকতা কি—বিশেষ করে কুমেরুর মতো জায়গায়? আত্মরক্ষা? কোন প্রাণীর কবল থেকে আত্মরক্ষা করবে সে? পেঙ্গুইন? সিলমাছ? ভালুক? নাকি পাখি? ন’জন দশাসই চেহারার লোককে সে কুপোকাত করতে পারে, একটা মৃতদেহ তুলে নিয়ে যাওয়া যার কাছে কিছুই নয়, জলজ্যান্ত একটা শিকারি কুকুর নিয়ে যে নিমেষে উধাও হয়ে যেতে পারে, সে কার ভয়ে ভীত হয়ে অদৃশ্য হবে?’
জীমূতবাহন মরিয়া হয়ে বলল, ‘যুক্তি দিয়ে মীমাংসা করা যায় না বটে, কিন্তু ঘটনাটা তো সত্যি।’
সুতপা কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘দেখলেন যুক্তির ধারে—কাছে যেতে চায় না। তাহলে যে ধাপে ধাপে ধাপ্পাবাজি আর চলবে না!’
জীমূতবাহন বলল, ‘বেশ, অকুস্থলে চলুন। সব কিছু আবার খুঁটিয়ে দেখা যাক—’
সুতপা চাপা গলায় বলল, ‘ঠেলা সামলান এবার—উঠল বাই তো কটক যাই!’
জীমূতবাহন ফোঁস করে উঠল, ‘সুতপা, চুপ কর—আমার অফিসারের সাথে আমি কথা বলছি। তোমার জ্বালায় কথা বলবার জো নেই দেখছি!’
সুতপাও ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘ঝকমারি হয়েছে আমার—এই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।’
‘ঠেস দিয়ে কথা বলো না সুতপা। আকাট মূর্খ আমি নই—সবই বুঝতে পারি। সাধে কি আর বলে নারী—চরিত্র অতি দুর্বোধ্য—তার থই পাওয়া ভার।’
সুতপাও রেগে টং, ‘অকথা—কুকথা বলবেন না বলে দিচ্ছি। আমি আপনার থেকে কোনো অংশে হীন নই। আপনার আগড়ম—বাগড়ম শোনবার মতো ধৈর্য আমার নেই।’
‘তা থাকবে কেন, দেমাকে দেখছি মাটিতে পা পড়ে না। ভগবান না করুন, ভবিষ্যতে আমাকে যেন আর কোনো দজ্জাল মেয়ের পাল্লায় না পড়তে হয়!’
‘কি! আমি আপনার পাল্লায় পড়েছি? আপনিই তো তাকে তাকে থাকেন কখন একটু ফুসরত মেলে কথা বলবার। আপনি কথার তুবড়ি ছুটিয়ে দেন, আর ভদ্রতার খাতিরে আমাকে চুপ করে শুনতে হয়। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছি আমি। আপনাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি, বুঝলেন—থোড়াই কেয়ার করি!’
আর ঠেকানো দায়। এ যে দেখছি মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল!
দুজনকে ধাতস্থ করতে বেগ পেতে হল আমাকে। জীমূতবাহন গজগজ করতে করতে চলে গেল।
সুতপা বলল, ‘আমাকে দু—কথা শুনিয়ে দেবার উনি কে?’
আমি বললাম, ‘জানোই তো, লোকটা আস্ত পাগল; ওর কথা ধর্তব্যের মধ্যে নাও কেন?’
হঠাৎ রেডিও—ঘরের বাইরে অপারেটরের গলা শোনা গেল, ‘স্যার, শিগগির আসুন! রাডার স্ক্রিনে কীসের যেন ছায়া পড়েছে!’
জনা চার লোক নিয়ে ছুটলাম সেখানে।
দিনের বেলা রাডার স্ক্রিনে পাখিদের আস্তানার দিকটায় আবছা একটা কুয়াশার মতো চিহ্ন ফুটে ওঠে। উড়ে বেড়ানো পাখির দঙ্গল ছাড়া সেটা আর কিছুই নয়। বেশির ভাগ পাখিই তখন দূর সমুদ্রে পাড়ি দেয়। অল্পসংখ্যক যারা বাসার চারদিকে উড়ে বেড়ায়, তাদের ছায়াই রাডারে ফুটে ওঠে। রাতের বেলা রাডার স্ক্রিন বিলকুল সাফ থাকার কথা, অথচ তা নেই। ঘন কুয়াশার মতো চিহ্ন ফুটে উঠেছে তাতে। অর্থাৎ হাজারে হাজারে লাখে লাখে পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে এখন। উদভ্রান্ত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, অন্ধের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, বেপরোয়া হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু কেন? রাতের আঁধারে আততায়ী প্রাণীটা কি এর মধ্যেই পৌঁছে গেল সেখানে? তবে তো তার দুর্দমনীয় বেগ রীতিমতো শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে!
সর্দার সিং ঠোঁট চেপে বলল, ‘ইয়া আল্লা! কুত্তা সে পেট নেহি ভরা, আর নিমকহারাম জানোয়ার পনছি খানে কো চলা। সুবহ তক এয়সা হি চলেগা সায়েদ।’
সর্দারজিকে সাবধান করে দিলাম, ‘তাই বলে আমাদের পাহারায় কোনোরকম গাফিলতি হলে চলবে না।’
‘বিলকুল নেহি। ইন্তিজাম বরাবর জারি রাখনা চাহিয়ে।’
প্রাণীটার নৃশংসতার সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পেট ভরা থাকলে অতিবড় হিংস্র প্রাণীও অহেতুক হত্যায় প্ররোচিত হয় না—এটাই অলিখিত জঙ্গুলে আইন। এই হতচ্ছাড়া প্রাণীটার কাছে দেখছি আইন—কানুনের কোনো বালাই নেই।
সর্দার সিং ঠাট্টা করে বলল, ‘মেরে সামনে আয়েগা তো বাপ কা নাম ইয়াদ করেগা। লেকিন কৌন জানে বাপ হ্যায় ইয়া নেহি?’
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
দালানে ফেরবার সময় সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, সুগ্রীব আমার সাথে সাথেই চলেছে। মনে পড়ল, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই দুরন্ত ছেলেটাই আমার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঝোপের ভেতর।
তামাশা করে বললাম, ‘তুমি আমার দেহরক্ষী বুঝি?’
বালসুলভ সারল্যে উত্তর দিল, ‘কি যে বলেন!’
‘তবে আমার পায়ে পায়ে ফিরছ কেন?’
‘দিদিমণি যে বলল—’ কথাটা বলে ফেলেই জিভে কামড় দিল সুগ্রীব।
‘দিদিমণি! কোন দিদিমণি?’
‘সুতপা দিদিমণি, আবার কে?’ আবার জিভ কাটল সুগ্রীব, ‘ইস, বলেই ফেললাম! দিদিমণি যদি জানতে পারে তবে আমাকে আস্ত রাখবে না। আপনি যেন আবার বলে দেবেন না আমার কথা!’
‘তুমি বুঝি তোমার দিদিমণিকে খুব ভালোবাস?’
‘কি যে বলেন! দিদিমণিই বরং আপনাকে ভালোবাসে। এখানকার ঝামেলা মিটে গেলে আপনাদের তো বিয়ে হয়ে যাবে—তাই না?’
‘আমার চেয়েও বেশি জেনে ফেলেছ দেখছি। তোমার দিদিমণি এ—কথা বলেছে বুঝি?’
সুগ্রীব নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে রইল। মৌনং সম্মতি লক্ষণম।
মস্করা করে বললাম, ‘তোমার নাম সুগ্রীব না হয়ে হনুমান হওয়া উচিত ছিল। রামভক্ত হনুমান।’
‘না, সীতাভক্ত।’ সুগ্রীব জবাব দিল।
আমি হেসে বললাম, ‘ওই একই কথা হল।’
হঠাৎ লক্ষ করলাম, অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি সাঁত করে সরে গেল। আলো ফেলেও কিছু দেখা গেল না। চোখের ভ্রম মনে করে নিরস্ত হলাম।
সুতপার কথা চিন্তা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ সুগ্রীবের আর্ত—চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পাগলের মতো দরজায় করাঘাত করছিল সে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
‘স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে! সর্দারজি নিখোঁজ!’
‘অ্যাঁ, বল কি! কখন ঘটল এই দুর্ঘটনা?’
‘সঠিক বলতে পারি না। রেডিও—ঘরের কাছে তার শটগান আর ফ্ল্যাশলাইট পড়ে আছে।’
‘রাডারের কি অবস্থা?’
‘পাখিগুলি এখনও পাগলের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৌনে বারোটা বাজে। মাঝরাত। ঝাড়া পাঁচটি ঘণ্টা উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিগুলি।
জীমূতবাহন ছুটে এসে বলল, ‘গ্যাসোলিনের বোতল আনব নাকি?’
‘নিশ্চয়ই—নিয়ে আসুন।’
সারাটা বাড়ি ততক্ষণে জেগে গেছে।
সদলবলে বাইরে আসতেই জীমূতবাহন একটা বোতল ছুড়ে মারল। তাতে আগুন জ্বলল না দেখে আরো একটা ছুড়ে মারতেই লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দুটো বোতলের দাহ্য তরল পদার্থ একযোগে জ্বলতে থাকায় আগুনের প্রচণ্ডতা হয়েছিল ভয়ঙ্কর।
তার ওপর ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে বাড়ির আনাচে—কানাচে পাতি পাতি করে অনুসন্ধান চালানো হল। সর্দারজির কোনো হদিসই পাওয়া গেল না।
এদিকে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আগুনের শিখা প্রচণ্ড বেগে ছুটে গিয়ে রেডিও—ঘরের গায়ে আছড়ে পড়েছে। খেয়াল যখন হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। করবার আর কিছুই নেই আমাদের। এতগুলি লোকের অসহায় দৃষ্টির সামনে দাউ দাউ করে বাড়িটা জ্বলতে লাগল। আগুনের দাপটে জানলার সার্সি ফেটে যেতে লাগল ফটফট শব্দে। আর তখন হতভম্ব লোকগুলিকে হতবাক করে দিয়ে জেনারেটর স্তব্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথে বাইরে এবং ভেতরে যেখানে যত আলো ছিল নিভে গেল দপ করে। রেডিও—ঘরের প্রজ্বলিত হুতাশনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে হতে লাগল যেন নিজেদের অগ্নিসৎকার আমরা নিজেরাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি।
(৬)
অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড়চড় করে। জীমূতবাহনের ওপর আমার খানিকটা দরদ এসে গিয়েছিল। লোকটার বুদ্ধি যে একেবারে ফেলনা নয়, সে—কথাই ভাবতে শুরু করেছিলাম। তখনই আচমকা এমন কাণ্ড করে বসল যে দমকা হাওয়ার বেগে সমস্ত সহানুভূতি উবে গেল।
সারাটা রাত যে কতটা উদ্বেগে কেটেছে সেকথা কহতব্য নয়। ভয়ে গা ছমছম করেছে। শীতে ঠকঠক কেঁপেছি। আর দূরে নিভন্ত আগুনের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থেকে ভাগ্যকে অভিসম্পাত করেছি। মনের সেই শোচনীয় অবস্থায় জীমূতবাহনের এক একটি কথা তিরের ফলার মতো কানে এসে বিঁধছিল। বিদ্যেবুদ্ধি উজাড় করে সে যখন বোঝাতে চাইল যে প্রাণীটা সত্যই অদৃশ্য, তখন প্রচণ্ড এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘জাহান্নমে যান আপনি! আমার সামনে কোনো থিয়োরি কপচাবেন না।’
সকালের আলোয় রাতের ঘটনাটাকে পরম দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। গুদামঘর থেকে তেলের ড্রাম বের করে আনা, পলতে পাকানো, হাতে তৈরি প্রদীপ জ্বালানো, প্রমোদকক্ষে জমায়েত হয়ে রাত কাটানো, মেয়েদের জড়োসড়ো ভাব, পুরুষদের জবুথবু হয়ে থাকা—সব মনে পড়তে লাগল একে একে। সবার শেষে মনে পড়ল দ্বিতীয় কুকুরটাকে নির্মমভাবে গুলি করে মারার কথা। গুলি না করেও উপায় ছিল না। নৈশ আগন্তুকের সাথে লড়াই করতে গিয়ে সাংঘাতিক জখম হয়েছিল সে। যন্ত্রণার হাত থেকে তাকে মুক্তি দেবার পথ আমাদের সামনে খোলা ছিল না।
প্রভাতের নির্মল আলোয় সদ্যস্নাত কুমারীর মতো ঝলমল করছিল চারদিক। ভস্মীভূত বাড়িটা থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরুচ্ছিল তখনও। বাতাস ম ম করছিল ঝুল আর তেলের গন্ধে।
সর্দারজির জন্য মনটা আমার হু হু করছিল। তার ফ্ল্যাশলাইট এবং শটগান যেখানে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল সেখানে গেলাম। রাতের বেলা যা দেখেছি, দিনের বেলায়ও তাই দেখলাম। সন্দেহজনক কোনো চিহ্নই নেই।
চিফ মেকানিক দেওপ্রকাশ রাই মেস হল থেকে হাত মুছতে মুছতে আমার সামনে হাজির হল। সাথে তার দুজন সহকারী মেকানিক। চার মোটরের বিমানটাকে তুলে ধরবার চিন্তা দিবারাত্র তাদের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে তারা। সাতসকালে পড়িমড়ি করে ছুটে চলেছে কারখানায়। যন্ত্রপাতি নিয়ে আবার খুটপাট চলবে সেখানে।
সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছিল রেডিও অপারেটরকে। বাড়িটা পুড়ে যাওয়ায় সে বেকার হয়ে পড়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও যেন এতটা মুষড়ে পড়ত না সে।
করিতকর্মা হিসেবে সুগ্রীব ছেলেটার দারুণ সুনাম। এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো কাজ করতে হবে নাকি, স্যার?’
আমি তখনও জমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। বললাম, ‘এখানে দাঁড়াও।’
জমিটা প্রধানত ছোট ছোট পাথরে বোঝাই। হেথা—হোথা কিছু মস গজিয়ে উঠেছে। ঘাস আর শেওলা তো আছেই। কয়েকটা পাথর আলগা হয়ে ছিল। সর্দারজির খোঁজ করতে গিয়ে গতরাতে আমিই হয়তো অজান্তে এ কাজ করে বসেছি।
সুগ্রীব বলল, ‘কিছুই দেখতে পাবেন না স্যার। আমি কি আর দেখতে বাকি রেখেছি কিছু।’
চিন্তার কুটিল রেখা দেখা দিল আমার কপালে। বললাম, ‘আচ্ছা সুগ্রীব, কাল রাতে তুমি তো আমার পাশেই ছিলে। আমার নজর এড়িয়ে গেছে, এমন কিছু তুমি দেখেছিলে কি? ভেবে দেখ।’
‘না, মনে তো পড়ে না। এখানে থাকবার কথা নয় অথচ আছে, কিংবা এখানে থাকবার কথা অথচ নেই—এমন কিছুই আমি দেখতে পাইনি।’
‘কিন্তু সুগ্রীব, আমার মনে হয় কি জানো? আমি দেখেছি। কিছু একটা নিশ্চয়ই দেখেছি আমি। অথচ খেয়াল করিনি। বলতে পারো, বুঝে উঠতে পারিনি। স্মৃতিশক্তিকে উসকে দেবার চেষ্টা করি। কোনো জবাব পাই না সেখান থেকে। সব কিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়।’
সুগ্রীব বলল, ‘দিনের আলোয় কোনো ভয় তো আর নেই। চলুন, ভালো করে খুঁজে দেখা যাক।’
বন্দুকটা তুলে নিলাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চললাম দুজনে। গাছগাছালি লতাপাতার ঠাস বুনোটে দুর্ভেদ্য হয়ে আছে ঝোপটা। তাই বলে এত দুর্ভেদ্য নয় যে কিছুই দেখা যাবে না। অথচ গতরাতের সমস্ত প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে গেছে। ডালপালা নড়তে স্পষ্ট দেখা গেছে। অথচ কে নাড়াচ্ছে দেখা যায়নি।
মুমূর্ষু কুকুরটার মরণকালীন সংগ্রামের চিহ্ন মাটিতে তখনও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। গ্যাসোলিন বোতলের আগুনের দাগও ছড়িয়ে ছিল যত্রতত্র। নরম কচি ঘাসে সুগ্রীব এবং আমার জুতোর ছাপও অতি স্পষ্ট। নেই শুধু নৈশ আগন্তুকের কোনোরকম চিহ্ন।
তাহলে কি মাটির তলায় আশ্রয় নিয়েছে প্রাণীটা?
একথা মনে আসতেই বললাম, ‘সুগ্রীব, বন্দুকের কুঁদো দিয়ে আঘাত করে দেখ তো জমিটা কোথাও ফাঁপা কিনা।’
অনুসন্ধিৎসাই সার হল। জমিটা ফাঁপা হওয়া দূরে থাকুক, কোথাও একটু নরম পর্যন্ত নয়। আমাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টির সামনে রহস্য তরল তো হলই না, বরং আরো যেন গাঢ় হয়ে গেল। দালানে যখন ফিরলাম তখন অনেক চিন্তাই মনের গহনে তোলাপাড়া হচ্ছে।
জীমূতবাহনের নির্বুদ্ধিতায় রেডিও—ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভরসা একমাত্র রোহিতাশ্ব ভাবা। নিহত কুকুরটাকে পোস্টমর্টেম করে তিনি হয়তো কোনো সূত্র খুঁজে পাবেন। শব—ব্যবচ্ছেদ তাঁর অভ্যস্ত কাজের অঙ্গীভূত নয়। তবু তিনি অপটু হাতেই কুকুরটাকে কাটাছাঁটা করেছেন।
ফল কি পেয়েছেন জানি না। মুখের ওপর তাঁর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু জানা গেল?’
তিনি নিরুত্তর রইলেন।
আমি বললাম, ‘কুকুরটা কার পেছনে ছুটে গিয়েছিল? আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই, ওর থুতনি থেকে এক খাবলা মাংস উঠে এসেছে। নিজের থাবায় নিশ্চয়ই এ ধরনের জখম হয়নি?’
আসল প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘পাখিদের আস্তানায় যখন হামলা চলছে তখনই আবার সর্দারজি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ব্যাপারটাতে যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে।’
‘তা আছে বৈকি। দিল্লিতে আপনার একটা রিপোর্ট পাঠাতে পারলে ভালো হত। আপনার রিপোর্টে কাজ হত নিশ্চয়ই। আমাদের বিপদ সম্বন্ধে তাদের ওয়াকিবহাল করা দরকার। অথচ দেখুন, রেডিওর প্রয়োজন যখন সবচেয়ে বেশি তখনই ঘটল এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। বিমানের ভেতরে যা—ও একটা ট্রান্সমিটার ছিল সেটাও অকেজো হয়ে আছে। লোকটাকে নিয়ে কি করি বলুন তো?’
রোহিতাশ্ব ভাবা জীমূতবাহনের পক্ষ নিয়ে বললেন, ‘কাজ করলে ভুলচুক একটু হয়েই থাকে।’
‘কিন্তু এ ধরনের ভুল যে ক্ষমার অযোগ্য।’
রোহিতাশ্ব ভাবা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তিনি সম্ভবত চাননি যে, চরম বিপদের মুহূর্তে আমাদের মধ্যে কোনোরকম মনকষাকষি চলুক। আলোচনার মোড় ঘোরাবার জন্য বললেন, ‘পাখিদের আস্তানায় একবার যাওয়া দরকার। আপনি বরং একটা অনুসন্ধানী দল গঠন করুন।’
সুগ্রীব এসে হাজির হল জীমূতবাহনের বার্তা নিয়ে। জীমূতবাহন আমার বিরুদ্ধে নাকি অনেক কথাই বলেছে তার কাছে। আমি নাকি তাকে ঈর্ষার চোখে দেখি। আমি নাকি তার কোনো কথায়ই কর্ণপাত করি না। বিপদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সে সাবধান করে দিয়েছিল আগেই। আমি তার কথা কানে তুলিনি বলেই নাকি কুকুর এবং একজন মানুষকে প্রাণ হারাতে হল। বিপদের মোকাবিলা করবার জন্য সে হাতিয়ার তৈরি করেছে। যথেষ্ট ফলও হয়েছে তাতে। তার অসাবধানতার ফলে রেডিও—ট্রান্সমিটারটা ভস্মীভূত হয়েছে বটে, কোনো লোকের প্রাণ তো আর যায়নি।
সমস্ত কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। সুগ্রীবকে বললাম, ‘সব কথা তুমি মুখ বুজে শুনে এলে? একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করলে না?’
সুগ্রীব অপ্রস্তুত হল, ‘আমি কি করব বলুন? আপনাকে সব কিছু জানানোই আমার কর্তব্য—প্রতিবাদ করা নয়।’
‘ঠিক আছে। তুমি জীমূতবাহনকে গিয়ে বল, তার থিয়োরি প্রমাণ করবার যথেষ্ট সুযোগ সে পাবে। খানিক পরেই পাখিদের আস্তানার দিকে আমরা রওনা হচ্ছি। তাকেও যেতে হবে।’
সুগ্রীব চলে গেল।
জীমূতবাহনকে রহস্য—সন্ধানী দলের ভার দিয়ে দিলাম, রাতভর ভীতত্রস্ত পাখিদের উড়ে বেড়াবার যুক্তিসঙ্গত কারণ তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তদন্ত পরিচালনার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে তার। কোনোরকম বাধ্যবাধকতা থাকবে না। তবে ফিরে আসতে হবে সন্ধের আগেই। রাতের বেলা একটি লোকেরও বাইরে থাকা চলবে না।
জীমূতবাহন এসে কি রিপোর্ট দেবে জানি না। প্রাণীটার পরিচয়ও দুর্জ্ঞেয়। তবে একটা কথা ঠিক, শিকার তার মোটেই জমে ওঠেনি। হতাশ হয়ে সে হয়তো ফিরে এসেছে দালানের কাছে। সন্ধেবেলা অনায়াসেই একটা কুকুর শিকার করতে পেরে তার হয়তো লোভ বেড়ে গিয়েছিল। সর্দারজি হয়তো তার কবলেই পড়েছে।
ঝাঁ ঝাঁ করা রোদে পাঁচজনের একটা দল বেরিয়ে গেল। নিষ্ফলা পাথুরে জমির ওপর দিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রাকৃতিক দৃশ্য আজ আর চোখ জুড়াতে পারছে না আমার—কেমন কৃত্রিম মনে হচ্ছে। বিলীয়মান দলটার মধ্যে একজন অন্তত এমন লোক আছে যার আনুগত্যও কৃত্রিম। মনেপ্রাণে সে আমাকে ঘৃণা করে—বিতৃষ্ণার চোখে দেখে।
আমার কাজের সমালোচনা আমি কোনোদিনও সহ্য করতে পারি না। জীমূতবাহনের মতো মেয়ে—ঘেঁষা লোকের কাছ থেকে সমালোচনা তো আরও দুঃসহ। এ জন্যই হয়তো তদন্তের অছিলায় তাকে দূরে সরিয়ে দিলাম। আমার যা করণীয় কাজ আছে এই সুযোগে সেরে ফেলতে হবে।
গত রাতে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা কেরোসিন তেলের লণ্ঠন বানানো হয়েছিল। আজ সেগুলোকে সংস্কার করতে হবে। বিশালকায় কয়েকটা তৈলাকার পাত্র বানানো দরকার। আর দরকার রানওয়ে থেকে বিমানটা সরিয়ে নেওয়া। আন্দামান থেকে জাহাজ তো আসছেই। বিমানও হয়তো আবার পাঠানো হবে। নতুন বিমানকে আমরা যদি নামবার সুযোগ দিতে পারি, তবে সব অসুবিধেই অচিরে দূর হয়ে যাবে। রেডিও মারফত যোগাযোগের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন জেনারেটর আসবে। বিদ্যুতের আলো আবার জ্বলে উঠবে দালানের কোনায় কোনায়।
সুতপা আছে বলেই সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করবার উৎসাহ পাচ্ছি। সুতপাই যেন আমার শক্তির প্রধান উৎস, হতাশায় একমাত্র ভরসা। সুতপাহীন জগৎ আমি যেন কল্পনাই করতে পারি না। প্রথম সুযোগেই মেয়েদের এই দ্বীপ থেকে কোনো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিতে হবে। সুতপাও থাকবে তার মধ্যে।
দেওপ্রকাশ রাই—এর সাথে দেখা করবার জন্য কারখানায় গেলাম। ধাতব মুখোশ পরে ওয়েল্ডিং টর্চ দিয়ে কি যেন ঝালাই করছিল সে। আমাকে সামনে পেয়ে তার পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল। প্রথমে সে বিমানের লেজটা তুলে ধরবে। তারপর পর্যায়ক্রমে ডানা দুটো একটু একটু করে তুলবে যাতে ভেঙে যাবার মতো অবস্থায় না পৌঁছোয়। বিমানটাকে কোনোরকমে একবার চাকার ওপর দাঁড় করাতে পারলেই আর ভয় নেই। ঠেলেই তখন রানওয়ে থেকে সরানো যাবে।
অফিসে ফিরে গিয়ে দেখলাম, সুতপা নিজের মনে হাসছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার, ভয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’
জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, হয়েছে। তবে আমার নয়—আপনার পাওয়ার—অফিসারের।’
‘কেন, তার আবার কি হল?’
‘সে বলে কি জানেন? প্রাণীটার নাকি মানুষের মতো ব্রেন আছে। কেমন মাথা খাটিয়ে জেনারেটরটা নষ্ট করে দিল।’
‘অ্যাঁ! তুমিও একথা ভাবো নাকি?’
‘ধেৎ, আমি ভাবব কেন?’
‘শোনো সুতপা, আত্মরক্ষার জন্য ভগবান মানুষকে থাবা দেয়নি, নখরও দেয়নি—দিয়েছে তীক্ষ্ন বুদ্ধি। আর যাকে যত বেশি দৈহিক শক্তি দিয়েছে, তাকে বুদ্ধিও দিয়েছে তত কম। আমরা যে প্রাণীর কথা আলোচনা করছি, তাকে শিকার ধরবার জন্য বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। সহজাত প্রবৃত্তিই তাকে শিকার ধরতে প্রণোদিত করে। প্রাণীদের মধ্যে একদল যেমন শিকারি, অন্যদল তেমনি তাদের শিকার। প্রাণীজগতে তাই দেখা যায় একদল অপর—দলের স্বাভাবিক শত্রু। যেমন ইঁদুরের শত্রু বেড়াল, হরিণের শত্রু বাঘ। মানুষের কোনো স্বাভাবিক শত্রু নেই। কেননা, মানুষের সাথে বুদ্ধিতে পাল্লা দিতে পারে এমন প্রাণী আজও জন্মায়নি। মানুষই মানুষের স্বাভাবিক শত্রু। সুতরাং জীমূতবাহন যা বলেছে, সেকথা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।’
‘তাহলে তাকে গারদে পুরছেন না কেন?’
‘কারণ সেই শুভ মুহূর্ত এখনো আসেনি—আসতে অনেক দেরি আছে। এখন শুধু অন্ধকার দেখছি চোখের সামনে। প্রত্যেককে এখন সেই অজ্ঞাত শত্রুর সাথে লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’
সারাটা দুপুর প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে কেটে গেল। গুদাম থেকে বড় বড় ড্রাম বেরিয়ে এল। এঞ্জিনিয়ারের হাতে পড়ে সেগুলি রূপান্তরিত হল এক একটি আলোক—বর্তিকায়। জ্বেলে দেওয়ার পর আলোর যে শিখা বেরুবে তার উচ্চতা হবে কম—সে—কম বিশ ফুট। ছোট ছোট লণ্ঠনও তৈরি হল অনেকগুলি। তেল ভরবার বিশেষ ব্যবস্থাও রইল তাতে। ডজন ডজন গ্যাসোলিন বোতল তৈরি হল। শটগান আর ভেরী পিস্তল তো রইলই। কেউ কেউ ব্লো—টর্চও হাতের কাছে রাখল। কখন কোন প্রয়োজনে লাগে তার ঠিক কি! এককথায় প্রতিটি মানুষই ব্যস্ত হয়ে রইল কোনো না কোনো কাজে।
দুপুরের খানিক পরেই তদন্তকারী দলটা ফিরে এল পাখিদের আস্তানা থেকে। জীমূতবাহন আগে আগে হেঁটে এল, পেছনে বাকি সবাই। তার বিমর্ষ মুখভঙ্গি দেখেই বুঝলাম নিজের প্রভাবে অপরদের সে প্রভাবিত করতে পারেনি। তার থিয়োরি হয়তো অপরের কাছে পাত্তাই পায়নি।
তদন্তের ফলাফল সম্বন্ধে আমাকে সে কিছুই জানাল না। জানাল সুগ্রীব পট্টনায়ক।
বলল, ‘এলাকাটা পাখির বাসায় ছয়লাপ হয়ে আছে। কত ডিম যে নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যেদিকে তাকানো যায় শুধু পালক আর পালক। ছড়ানো—ছিটোনো সেই পালকের স্তূপের মধ্যে অজস্র পাখি মরে পড়ে আছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের কেউ খোঁড়াচ্ছে, কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ বা ভাঙা ডানা নিয়ে অযথা ওড়বার চেষ্টা করছে। রাতারাতি জায়গাটাতে যেন নরক গুলজার হয়ে বসে আছে।’
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পায়ের ছাপ বা অন্য কোনোরকম চিহ্ন পাওয়া যায়নি?’
‘না।’
হঠাৎ নজরে পড়ল রোহিতাশ্ব ভাবা মাটিতে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছেন।
ওসব জায়গা আজ সকালেই তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। তবে কি তিনি কোনো সূত্র খুঁজে পেলেন? কোনো প্রাণী কি ছুঁচোর মতো গর্তে সেঁধিয়ে আছে? সুড়ঙ্গপথে যাতায়াত করে আমাদের চোখে ফাঁকি দিচ্ছে কি?
কোদাল দিয়ে খানিকটা মাটি তুলে নিলেন রোহিতাশ্ব ভাবা। বড় একটা কাচের জারে অতি সাবধানে মাটিটা ভরে নিলেন। তারপর প্রতি বর্গ ইঞ্চি জমি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন অসীম ধৈর্য সহকারে। রেডিও—ঘর এবং গুদামঘরের ঠিক জায়গাটা। ওখান থেকেই সর্দারজি নিখোঁজ হয়েছে, ওখানেই আহত হয়েছে একটা কুকুর। তাজ্জব ব্যাপার এই, সর্দারজি নাকি পলকের জন্য অন্ধকারের বৃত্তে গিয়ে ঢুকেছিল, আর সেই সময়টুকুর মধ্যেই বিপর্যয় ঘটে গেছে। তার সঙ্গী লোকটি নাকি সামান্য একটু কাতরানি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায়নি।
অসমাপ্ত কথার খেই ধরে সুগ্রীবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতটা জায়গা অমন তছনছ হয়ে আছে দেখতে পেলে?’
‘তা সিকিভাগ হবে। পাখিদের আস্তানাটা তো আর নেহাৎ ছোট নয়।’
রোহিতাশ্ব ভাবা কিছু একটা ধরেছেন মনে হচ্ছে। আমরা যেভাবে জাল দিয়ে ফড়িং ধরি অনেকটা সেভাবে।
আর কিছু খুঁজে না পেয়ে ত্রস্ত চরণে আমার দিকে আসতে লাগলেন। উত্তেজনায় রীতিমতো থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। এসেই বললেন, ‘এটাকে ফাঁদে ধরলাম। কুকুরটা সম্ভবত এর দ্বারাই আহত হয়েছিল।’
আমি আঁতকে উঠলাম, ‘বলেন কি!’
কিন্তু প্রাণীটাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হল না। কাচের জার ঢাকনি দিয়ে এঁটে বন্ধ করা ছিল। তার ভেতরে মাটি আর আবর্জনার স্তূপে সমাহিত হয়েছিল প্রাণীটা। মাটি নড়ছিল অল্প অল্প।
‘এটাকেই বুঝি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আপনি? কী এটা?’
‘জানি না এখনও। কাল রাতে বাড়িটা যখন জ্বলছিল, তখনই একে দেখতে পাই, ধরবারও চেষ্টা করি। কিন্তু তখন গুটিসুটি মেরে একটা গর্তে এমনভাবে ঢুকে যায় যে অনেক চেষ্টা করেও আর ধরতে পারিনি।’
‘এটা বুঝি খুব বিষাক্ত?’
‘নিশ্চয়ই—সাংঘাতিক রকমের বিষাক্ত।’
‘কিন্তু দ্বীপে তো কোনোরকম বিষাক্ত পোকামাকড় ছিল না! জীব—বিজ্ঞানীদের রিপোর্টে তো তাই বলে।’
‘ছিল না বটে, তবে আমদানি হয়েছে। যতদূর মনে হয়, কুমেরুর গাছেই এরা ছিল। এ জাতের প্রাণী যে থাকতে পারে, সেকথা ভাবাই যায় না।’
‘একে একে অনেক অসম্ভব জিনিসই আমদানি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একে পেয়ে আমাদের আসল সমস্যার কোনো সমাধান হবে কি? হতে পারে একটা কুকুরকে কামড়ে দিয়েছে দৈবাৎ। কিন্তু অন্য কুকুরটার কি হল? সর্দারজি কি করে উধাও হল? পাইলটের মৃতদেহই বা গেল কোথায়? বিমান থেকে ন’জন লোকই বা দুম করে অদৃশ্য হয় কি করে? একে পেয়ে নিশ্চয়ই এতগুলি প্রশ্নের উত্তর মিলবে না!’
‘তা হয়তো মিলবে না। কিন্তু—’
‘পাখিদের আস্তানার কথাটাই ধরুন, কী ভয়াবহ ব্যাপার বলুন তো? কে করল এ—কাজ? এই ক্ষুদে প্রাণীটা নিশ্চয়ই নয়?’
‘তা নয়। হয়তো কোনো সমস্যার সমাধানই এ নয়। কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ নিজেই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’
প্রবাদ আছে, দুর্ভাগ্য আর গোরুর গাড়ি কখনও একা আসে না। একের পর এক নিত্য নতুন সমস্যা যেভাবে সৃষ্টি হয়ে চলেছে, তাতে সমস্যার অতল জলে তলিয়ে না যেতে হয়। রোহিতাশ্ব ভাবার আশঙ্কা যদি বাস্তবে পরিণত হয়, তবে দস্তুরমতো চিন্তার খোরাক বাড়বে। তিনি প্রাণীটাকে নিয়ে নিজের গবেষণাগারে নানারকম পরীক্ষা—নিরীক্ষা চালাবেন, আর সমস্ত ঝক্কি পোহাতে হবে আমাকে।
কারখানার দরজা ঝনঝন শব্দে খুলে গেল। চার চাকার হাতে—টানা একটা গাড়ি বেরিয়ে এল ধীরে ধীরে। বিমান উত্তোলনের সরঞ্জাম নিয়ে দেওপ্রকাশ রাই রানওয়ের দিকে চলল। সাথে তার চারজন সহকারী মেকানিক।
কাজকর্ম তদারক করবার জন্য আমিও গেলাম বিমানের পাশে। গিয়ে দেখি, তন্ময় হয়ে সুতপা কি যেন দেখছে।
বললাম, ‘তুমি যে এখানে—ব্যাপার কি?’
‘কেন, এখানে আসাটা আমার অন্যায় হয়েছে নাকি?’
‘অন্যায় হয়নি, একটু বিসদৃশ দেখায়—এই আর কি। মনে হয়, আদার ব্যাপারী যেন জাহাজের খবর নিচ্ছে—’
তামাশাটা সুতপা যেন হাল্কাভাবে গ্রহণ করতে পারল না। চোখ—মুখ লাল করে জবাব দিল, ‘রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘরেই বুঝি মেয়েদের বেশি মানায়? সেসব দিনকাল আর নেই, বুঝলেন?’
‘তবে কি জন্য আসা হয়েছিল শুনি?’
‘বলব?’
‘হ্যাঁ, বলেই ফেলো—’
‘অভিসারে।’
‘বটে! বটে! সেই মনের মানুষটি কে, সেটা জানতে পারি কি?’
‘আর যেই হোক, আপনি নিশ্চয়ই নন।’
একজন মেকানিককে কাছে আসতে দেখে ঝট করে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি—আমিই তোমাকে এ—কাজের ভার দিচ্ছি। রোহিতাশ্ব ভাবাকে তুমি সাহায্য করবে। তিনি নতুন বিপদের আশঙ্কা করছেন। প্রতিকারের কোনো পথ যদি বের করতে পারেন—’
সুতপা মেকানিককে দেখতে পায়নি। আমার অসংলগ্ন কথাবার্তায় থমমত খেয়ে বলল, ‘কি বলছেন!’
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আস্তে!’ তারপর সবাইকে শুনিয়ে বললাম, ‘আমার কথামতো কাজ করবে—চলে এসো।’
দালানে ফেরবার পথে সমস্ত পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বললাম। শুনে সে হেসে বাঁচে না। বলল, ‘অপরকে আপনার এত ভয়?’
আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘ভয় নয়—এড়িয়ে চলা। তিমিঙ্গিল দ্বীপটা এত ছোট যে কারো চোখ এড়িয়ে কিছু করবার উপায় নেই। আরো তিনটি মেয়ে এখানে আছে—চিত্রিতা, শশীকলা আর সীমা। তাদেরও প্রেমাস্পদ আছে। তাদের দেখেই বোঝা যায়, প্রেমে পড়লে মানুষকে কত বোকা বোকা দেখায়। আর পাঁচজনের মতো আমিও যদি বোকার মতো আচরণ করি, তাহলে কে আমাকে সমীহ করে চলবে? দ্বীপের ভেতর তখন একটা বিশৃঙ্খলার ভাব দেখা দেবে না? এই নিদারুণ বিপদের সময় বিশৃঙ্খলার অর্থ কি জানো? আত্মহত্যা। তাই সাবধান হয়ে চলতে হয়।’
‘কিন্তু ডক্টর ভাবাকে সত্যি সাহায্য করতে হবে নাকি?’
‘হ্যাঁ। যে বিষাক্ত প্রাণীটা তিনি খুঁজে পেয়েছেন, তার স্বরূপ জানতে হবে। সন্ধের পর কোনো কাজকর্মই আর করা উচিত হবে না। এমন কি দিন থাকতে থাকতে রাতের আহারও শেষ করতে হবে। সর্দার সিংকে আমরা হারিয়েছি। আর কোনো ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। সবাইকে একত্রে প্রমোদকক্ষে রাত কাটাতে হবে। টহল দিয়ে বেড়ানোর আর দরকার নেই। নৈশ আগন্তুকের ওপরও নজর রাখতে হবে না। বাইরে তেলের ড্রাম আলো দেবে। ঘরে দেবে লণ্ঠন।’
আমার প্রতিটি আদেশই অক্ষরে অক্ষরে পালিত হল। সন্ধে ততক্ষণে উতরে গেছে। আর একটি রহস্যময়ী রজনী সমস্ত বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে।
আতঙ্কের প্রকৃত রূপ কি এতদিনে বোঝা গেল। প্রতিটি মানুষ যেন ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। কারো মুখে একটি রা নেই। ট্রানজিস্টার বন্ধ হয়ে আছে, কারণ গান শোনবার উৎসাহ কারো নেই। খেলার সরঞ্জাম নামানোই হয়নি, কারণ খেলতে রাজি নয় কেউ। প্রেমের কলগুঞ্জন শোনা যাচ্ছে না। অবসর বিনোদনের জন্য গালগল্প তো নয়ই। ঘুমেরও যেন দফা রফা হয়ে গেছে।
ঘরের এই গুমোট আবহাওয়ার মধ্যে রোহিতাশ্ব ভাবা একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন। দরাজ গলায় ঘোষণা করলেন তিনি, ‘আজ আপনাদের এমন একটি জিনিস দেখাব, যা কেউ কখনো দেখতে পাবে বলে কল্পনাও করতে পারেনি।’
আমি সাগ্রহে তাঁর দিকে তাকালাম।
তিনি বলে চললেন, ‘আমার কাছে আপাতত একটিমাত্র নমুনাই আছে। আর কেউ যদি কোথাও এ জিনিস দেখতে পান আমাকে এনে দেবেন। এটার নাম কি জানি না। পরিচয়ও সঠিক জানা নেই। মেরে ফেলবার ভয়ে কেটেও দেখতে পারছি না। তবে জিনিসটা যে মারাত্মক রকমের বিষাক্ত তার প্রমাণ পেয়েছি।’
তিনি কাচের একটা জার আলোর শিখার সামনে রাখলেন। উদগ্র কৌতূহলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর। জিনিসটা এমন কিছু বীভৎস দেখতে নয়। আকারে প্রায় চার ইঞ্চির মতো লম্বা। কাঁটাময় কতকগুলি সবুজ পাতা গায়ে এঁটে আছে। দেখে মনে হয়, চারাগাছের একটুখানি শিকড় ঝিম মেরে যেন পড়ে আছে।
পাচক করিম বক্স মোল্লা বলল, ‘বহুৎ মামুলি চিজ। ইসকে সাথ জান—পহচান হোনেসে ক্যা ফায়দা?’
ডক্টর ভাবা বললেন, ‘এটা লাফাতে পারে।’
করিম মন্তব্য করল, ‘জাদু হ্যায়!’
হেসে বললেন তিনি, ‘জাদু নয়—জাদুগর। এর পাতাগুলি লজ্জবতী লতার চেয়েও অনুভূতিপ্রবণ। মাছিধরা কলস—গাছ আর মিসোসাস উদ্ভিদেরা এদেরই স্বজাতি—পরিজন। অথচ এর গঠনগত উৎকর্ষের কাছে তারা নেহাত শিশু। এ রীতিমতো হাঁটাচলা করতে পারে, শিকার ধরতে পারে। উদ্ভিদ জগতে এটা এক অসাধারণ ব্যতিক্রম।’
দেওপ্রকাশ জানতে চাইল, ‘প্রাণীটা মাংসভোজী নিশ্চয়ই—তবু কেন একে উদ্ভিদ বলছেন?’
‘কলস—গাছ ফাঁদ পেতে পতঙ্গ ধরে খায়। তবু কেউ তাকে পশু বলে না—উদ্ভিদ বলে। এর বেলারও তেমনি।’
সুতপা বলল, ‘আপনি জীববিজ্ঞানী। আপনার কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কিন্তু আর কেউ একথা বললে তার কথা হেসেই উড়িয়ে দিতাম।’
‘আমার কথায় বিশ্বাস করতে কাউকেই আমি বলতে পারি না। এক—খণ্ড মাংস নিয়ে এসো—চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাবে।’
বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হিমঘর এবং রেফ্রিজারেটরে যে সমস্ত খাদ্যবস্তু ছিল, তার কতকগুলি পচতে শুরু করেছে। অবশ্য তাজা মাংসের অভাব কোনোদিন হবে না আমাদের—পাখি শিকারের অফুরন্ত সুযোগ যতদিন আছে।
মাংস আনা হলে কাচের জারের ঢাকনি পেঁচিয়ে খোলা হল। ঢাকনিটা একটু সরিয়ে নিয়ে ছোট্ট একখণ্ড মাংস ফেলে দিতেই প্রাণীটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। জারের তলদেশে পৌঁছোবার আগেই মাংসখণ্ডটা লুফে নিয়ে কাঁটাওয়ালা পাতাগুলি দিয়ে উন্মত্তের মতো আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগল প্রাণীটা। ক্ষতবিক্ষত মাংসখণ্ড ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে লাগল।
আর সেই পৈশাচিক তাণ্ডবলীলা দেখে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একটি মেয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
(৭)
দেহের সাথে মনের অতি নিকট সম্পর্ক। পর পর কয়েকটা রাত উদ্বেগ—উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয়েছে বলে দেহ এবং মন কোনোটাই সুস্থ ছিল না। অজানা আতঙ্ক শুরু হবার পর এই প্রথম একটা রাত নির্বিঘ্নে কাটল।
ভোর হতেই দালানটা মুখর হয়ে উঠল কর্মচাঞ্চল্যে। হেঁসেল থেকে ভেসে এল টুং টাং আওয়াজ—প্রাতরাশের আয়োজন চলছে। কারখানার দরজা খুলে গেল ঝনাৎ করে। একটা কুকুর আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। শটগান হাতে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম তদারক করতে।
পেঙ্গুইন চারটির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। কুকুরটাকে নিয়ে প্রথমেই গেলাম তাদের দর্শন করতে। গুদামঘরের বাইরে কুমেরুর গাছগুলির কয়েকটা তখনও ঠায় দাঁড়িয়েছিল। উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় এদের আর পুঁততে নিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গুদামে ঢুকে দেখলাম প্রত্যেকটি খাঁচার দরজাই খোলা। পেঙ্গুইনগুলি নিপাত্তা। গাছের একটা পেটি কর্কশ মোটা চট দিয়ে তখনও শক্ত করে বাঁধা ছিল। সেই পেটিটাকে আর খোলাই হয়নি।
রানওয়েতে বিমানটা দাঁড়িয়েছিল একটা অস্বস্তিকর ভঙ্গি নিয়ে। লেজটা তার উঁচু হয়ে ছিল, নাকটা ভূমি ছুঁই—ছুঁই।
রেডিও—অপারেটর বেকার। বিমানের ভেতর যে রেডিও আছে, তার পাশে তাকে কাজ দিতে হবে। খবর পাঠাতে পারবে না বটে, খবর সংগ্রহ তো করতে পারবে। দিল্লি থেকে কোনো জরুরি নির্দেশ দিলে জানা যাবে। হিয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিপদ সংকেত পাঠালে আগেভাগেই সচেতন হওয়া যাবে।
হঠাৎ খেয়াল হল, সমস্যার মূলে পৌঁছোতে হলে যা করা দরকার ছিল, সেটাই অবহেলিত হয়ে রয়েছে। তাকাবার সময় নাকের সোজাই তাকিয়েছি, ডাইনে—বাঁয়ে নজর দিইনি। মানুষের সমাজে যেমন, প্রকৃতির রাজ্যেও তেমনি প্রতিটি ঘটনার একটা কার্যকারণ—সম্পর্ক আছে। নিয়মের বাইরে কিছু ঘটে না সেখানে। তবে সমাজ ভেদে আইন—কানুনের অবশ্য তারতম্য আছে। এক দেশে যেটা আইন, অন্য দেশেই হয়তো সেটা বেআইনি। আইন জানা না থাকলে বিদেশি আগন্তুক নতুন পরিবেশে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে পারে। পথের কানুন ভঙ্গ করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে ট্র্যাফিক জ্যাম করে দিতে পারে। পরিবহন ব্যবস্থায় গণ্ডগোলের সূত্রপাত হতে পারে সেই একটি বিদেশিকে কেন্দ্র করেই। ট্রাফিক পুলিশ যদি গাড়ির চালকদের ওপর চোখ রাঙাতে থাকে, তবে সমস্যার কোনো সুরাহা হবে না। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী খোদ বিদেশির ওপরই নজর রাখতে হবে তাদের।
দ্বীপের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে সেই অদ্ভুত গাছগুলি আসার পর থেকেই। সমস্ত ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে। গাছগুলির সাথে অন্যান্য দুর্ঘটনার কোনোরূপ সম্পর্ক নাও থাকতে পারে, তবু তাদের ওপর নজর রাখা দরকার। দ্বীপের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শান্তস্বভাব পাখিরাও। গাছগুলিও যদি সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবেই রহস্য অনেকটা তরল হয়ে যাবে—মীমাংসাও হয়তো সম্ভব হবে।
বিমানে থাকার সময়ই গাছের একটা পেটি খুলে গিয়েছিল। রোহিতাশ্ব ভাবা দ্বিতীয় পেটিটাও খুলে ফেলেছেন। উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় অনেকগুলি গাছ পুঁতেও আসা হয়েছে। তারা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে কিনা সেটাই এখন খোঁজ নেওয়া দরকার।
বিষাক্ত ক্ষুদে প্রাণীটা সম্বন্ধেও ভাবনার যথেষ্ট কারণ আছে। এ—জাতীয় কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই তিমিঙ্গিল দ্বীপে ছিল না। রোহিতাশ্ব ভাবার আশঙ্কা, এ—জাতীয় প্রাণী একটাই শুধু আসেনি, আরো অনেক এসেছে। এ—ক্ষেত্রেও দেখা যায় কুমেরুর গাছগুলির সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে।
সুতরাং সমস্যার মূল ধরে নাড়া না দিলে সমস্যার মূলোৎপাটন ঘটবে না।
সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে পথ চলতে লাগলাম। কুকুরটাও আমার সঙ্গ ত্যাগ করল না।
কুকুরটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে মাটি শুঁকতে লাগল, তারপর ডেকে উঠল খেলাচ্ছলে। শেষে মাটি আঁচড়িয়ে কিছু একটা খুঁড়ে বের করবার চেষ্টা করতে লাগল।
দ্বিতীয় কুকুরটার মৃত্যুদৃশ্য ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। তাই সাবধান হলাম, ‘বাঘা! বাঘা! এদিকে এসো!’
লেজ নাড়তে নাড়তে খানিকটা পথ এগোতেই তার গলাবন্ধ চেপে ধরলাম।
কুকুরটার উত্তেজনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অবাক হলাম। সেই মাংসাশী উদ্ভিদ। হুবহু সেই আকার। সেরকমই কাঁটাওয়ালা তিনটি সবুজ পাতা। সবুজ শেওলার আস্তরণের ওপর দিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিলমাত্র বিলম্ব না করে জুতো দিয়ে পিষে ফেললাম।
দলিত—মথিত প্রাণীটাকে পরখ করে দেখতে চাইল বাঘা। আমি বাধা দিলাম। শুকনো একটা বড় পাতা কুড়িয়ে নিয়ে আলতো ভাবে তুলে নিলাম তার ওপর। ভুলেও কিন্তু স্পর্শ করলাম না।
রোহিতাশ্ব ভাবা তাঁর গবেষণাগারেই ছিলেন। আপনভোলা সাদাসিধে এই মানুষটাকে দেখে মনে হল, সারাটা রাত যেন তিনি জেগেই কাটিয়েছেন। চোখ দুটি তাঁর জবাফুলের মতো লাল।
ছিন্নভিন্ন পিষ্ট দেহাংশটুকু টেবিলে রেখে বললাম, ‘আপনি চেয়েছিলেন, তাই নিয়ে এলাম।’
নেবার সময় তাঁর কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। নীচু গলায় বললেন, ‘ইতিমধ্যে আমি একগাদা সংগ্রহ করে ফেলেছি।’
অগত্যা বললাম, ‘আপনার পুঁতে রাখা গাছগুলি একবার দেখে আসা দরকার।’
‘হ্যাঁ, আমিও সে—কথাই চিন্তা করছিলাম। প্রাতরাশ সেরে একটা দল তৈরি করতে হবে।’
ব্রেকফাস্ট—এর টেবিলে প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিল। চিফ মেকানিক দেওপ্রকাশ রাই বলল, ‘বিমানের সামনের অংশটা বেশি ভারী। এটাকে তুলতে হলে সবার সাহায্যই দরকার হবে।’
আমি আশ্বাস দিলাম, ‘কোনো চিন্তা নেই—সবাই হাত লাগাবে।’
রোহিতাশ্ব ভাবাকে বললাম, ‘দেওপ্রকাশের কাজ সারা হলেই আপনি লোক পাবেন।’
সবাই টুকটাক কথা বলছিল। একমাত্র জীমূতবাহনই মুখে যেন কুলুপ এঁটে ছিল। তার দিকে তাকাতেই সেও আমাকে আড়চোখে দেখল। বললাম, ‘পাখিদের আস্তানায় কি দেখে এলেন, আপনি কিন্তু আমাকে জানাননি এখনও। সুগ্রীব অবশ্য তার মতামত জানিয়েছে। আপনার মুখ থেকে এবার শুনতে চাই।’
জীমূতবাহন কখনো চুপ করে থাকবার লোক নয়। সুযোগ পেলে সে যেন চোখেমুখে কথা কইতে থাকে। কিন্তু বাড়িটা পুড়ে যাবার পর থেকে তার মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ করছি। কেউ তাকে আমল দেয় না—এই বোধটা যেন তার হয়েছে। অন্যের সাথে দু—চারটে কথা বললেও আমার সামনে কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে।
তাকে নিঃশব্দে খেতে দেখে আবার তাগাদা দিলাম, ‘কই, আপনার অভিমত জানান!’
সে মুখ খুলল, ‘ঢের হয়েছে! আমাকে কি অপমান না করলেই নয়?’
‘অপমান! আপনাকে অপমান করল কে?’
‘আমার মতামতের কি কোনো মূল্যই নেই? আমার মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে দেখতে পেলেই আমি অপমানিত বোধ করি।’
‘আপনার মতামতের মধ্যে যদি কোনো সার বস্তু থাকে তবে নিশ্চয়ই সেটা উপেক্ষিত হবে না। আপনি নির্ভয়ে বলে যেতে পারেন।’
‘তাহলে শুনুন। যে ধ্বংসস্তূপ আমরা দেখে এসেছি, সেটা একটামাত্র দানবের কাণ্ড নয়। দশটা—বিশটা—কিংবা আরও বেশি হতে পারে। পাখিদের আস্তানায় যে দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে সেটা এক জায়গায় হঠাৎ আরম্ভ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি—চারদিক থেকে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তারপর সেখান থেকে অন্যপথ ধরে তারা নীচে নেমে এসেছে। ধ্বংসের চিহ্নগুলি খুঁটিয়ে দেখলে একথা বেশ বোঝা যায়।’
আমি নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
জীমূতবাহন রেগে গিয়ে বলল, ‘আগেই বলেছি, আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না।’
আমি তাকে আশ্বাস দিলাম, ‘আপনার কথা অবিশ্বাস করছি না। বর্তমান অভিমতের মধ্যে একটু নতুনত্বও আছে। সন্ধ্যায় একটা কুকুর নিখোঁজ হল। তারপর গণ্ডগোল শুরু হল পাখিদের আস্তানায়। সেখানে যখন ধ্বংসলীলা চলছে তখনই আবার সর্দার সিং নিখোঁজ হয়ে গেল। একটি দানবের পক্ষে বারবার যাওয়া—আসা করা অসম্ভব বলেই মনে হয়। কারণ পাখিদের আস্তানাটা কম করেও এখান থেকে চার মাইল দূরে। এতটা দূরত্ব পলকের মধ্যে যাওয়া—আসা করা চাট্টিখানি কথা নয়। একাধিক দানবের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু বিমানের ভেতর তো একটাই দানব ছিল। সেটা রাতারাতি সংখ্যায় এত বেড়ে গেল কি করে? রক্তবীজের বংশ এরা নিশ্চয়ই নয়!’
জীমূতবাহন গম্ভীর হল, ‘মস্করা করবার কোনো প্রয়োজন নেই। সময় হলে আপনা—আপনিই টের পাবেন।’
তারপর অর্ধসমাপ্ত ভোজনে মন দিল সে।
আমি সুতপার সাথে কথা বলতে লাগলাম। তবে অফিসার এবং তার সেক্রেটারির মধ্যে যে—ধরনের কথা হওয়া উচিত তার বাইরে কিছুই নয়।
অযথা বাক্যালাপের সময়ও আর ছিল না। দেওপ্রকাশ রাই—এর সাথে ছুটতে হল বিমানের পাশে। অতিকায় সেই জ্যাকটা প্রথমে বসানো হল বাম ডানার নীচে। লেভার নিয়ে ব্যস্ত রইল চারজন লোক। লম্বা বিমের ওপর বাকি সবাই সমস্ত শক্তি নিয়োগ করল। ধীরে ধীরে উঁচু হতে লাগল ডানাটা। ডানার নীচে শক্ত খুঁটি বসিয়ে জ্যাক খুলে নেওয়া হল। তারপর জ্যাক বসানো হল ডান দিকের ডানার নীচে। সেদিকটা খানিক উঁচু হতেই আবার ফিরে আসা হল বাঁ দিকের ডানায়। ধীরে ধীরে বিমানের সমগ্র কাঠামোটা উঠে আসতে লাগল মাটি থেকে।
রেডিও—অপারেটরকে বিমানের ভেতর পাঠানো হল। রিপোর্ট পাঠাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে। কোনো ফল হল বলে মনে হল না। শর্ট ওয়েভের বার্তাগুলি কিন্তু ঠিকমতোই এসে পৌঁছোতে লাগল। আমাদের রেডিও ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ওপরের মহলে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে বোঝা গেল। আমাদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তারা হিয়ার্ড দ্বীপকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবার চেষ্টা করে। হিয়ার্ড দ্বীপ জানিয়ে দিয়েছে, তিমিঙ্গিলের কাছে সমুদ্রের ওপর নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হতে চলেছে। আবহাওয়া ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আপাতত সেখানে কোনো বিমান পাঠানো ঠিক হবে না।
কাজ যেমন ঢিমেতেতালা চালে এগুচ্ছিল, তাতে মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে বিধ্বস্ত বিমানটাকে চাকার ওপর দাঁড় করানো যাবে বলে মনে হল না।
হঠাৎ দালান থেকে মেয়েলি কণ্ঠের এক চিৎকার ভেসে আসতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম সেদিকে।
চিৎকার করে উঠেছিল মীনা। গিয়ে দেখলাম, মীনা ভয়ে ঠকাঠক কাঁপছে, আর করিম রান্নাঘর থেকে সসপ্যান এনে তার মধ্যে বন্দি করেছে সেই বিচিত্র ধরনের একটা মাংসাশী উদ্ভিদকে।
চলমান উদ্ভিদটিকে নিয়ে রোহিতাশ্ব ভাবার গবেষণাগারে হাজির হলাম। তিনি জানালেন, খানিক আগে আরো একটা উদ্ভিদকে নাকি জুতো দিয়ে পিষে মেরে ফেলা হয়েছে। বিপদ ঘটেছে তারপরে। সেটাকে ফেলে দেবার জন্য স্পর্শ করতেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে চিত্রিতা। তার আঙুল দুটো সাথে সাথে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া সত্ত্বেও ফুলে কব্জির মতো মোটা হয়ে গেছে।
চিত্রিতাকে দেখতে গেলাম। ফেরবার সময় সুতপার ঘরের দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়ালাম। দরজা ভেজানো। ভেতরে পুরুষের চাপা কণ্ঠস্বর।
আমার চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠল। কে এই উদ্ধত যুবক?
পাচক করিম বক্স মোল্লা নয়। বিজ্ঞানী রোহিতাশ্ব ভাবাও নয়। নিশ্চয়ই পাওয়ার—অফিসার জীমূতবাহন সেন। কারণ সে বাদে সকলেই কোনো না কোনো কাজ নিয়েই ব্যস্ত।
আড়ি পেতে শোনবার অভ্যেস আমার কস্মিনকালেও ছিল না। সুতপার একটা কথা কানে যেতেই আমি বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হতে লাগল, কে যেন আমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে—নড়বার ক্ষমতা একেবারেই যেন নেই।
সুতপা বলছিল, ‘যাও না লক্ষ্মীটি! অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার এসে পড়লে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সমস্ত পরিকল্পনা ফেঁসে যাবে।’
আবদারের সুরে জবাব দিল জীমূতবাহন, ‘এটাই বুঝি উপকারের প্রতিদান? কলিযুগে উপকার করাটাই দেখছি পাপ। আমি না এলে তোমার কি হত বল তো! জড়সড় হয়ে চেয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে। এই প্রাণীগুলিকে তো চেনো না। তোমার নাগাল পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করত। বিফল হলে চেয়ারের নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত, যে পর্যন্ত না তুমি নেমে আসতে চেয়ার ছেড়ে। হেঁজিপেঁজি উদ্ভিদ নয়—মিমোসাসের বংশধর এরা, বুঝলে!’
‘বুঝেছি, আজ একটা অনর্থ না বাধিয়ে তুমি ছাড়বে না। তোমার কপালে আজ দুর্ভোগ আছে।’
জীমূতবাহন মুখিয়ে উঠল, ‘আমার কপালে দুর্ভোগ? আরে ছো! এ শর্মার সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এমন লোক এখনো পয়দাই হয়নি, বুঝলে। আমি ঝড়তি—পড়তি মাল নেই যে একটু টোকা লাগলেই টসকাতে হবে। আমার চুলের ডগাটি ছোঁবার সাধ্য নেই কারো। তবে হ্যাঁ, তোমার মধ্যে কোনো দৃঢ়তা নেই। এখনই দেখতে পাচ্ছি, তোমার মধ্যে দোমনা মনোভাব এসে গেছে।’
‘অন্যের দোহাই দিয়ে কি হবে—নিজের বুকে হাত রেখে কথা বল।’
‘তুমি হাসালে সুতপা।’
‘কেন, তুমি চিত্রিতার সাথে ঢলাঢলি করনি বুঝি?’
‘দু—চারটে কথা বললেই যদি ঢলাঢলি করা হয়ে থাকে তবে তুমি নিজে কি করেছ? অধরসুধা দান করনি তোমার পেয়ারের অফিসারকে?’
লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেল সুতপা, ‘এত কথা জানলে কি করে?’
‘আমার মাথার পেছনেও দুটো চোখ থাকে, বুঝলে! তবে অনর্থক চিন্তা করতে যেও না। আমি এক কথার মানুষ—যা বলেছি তার অন্যথা হবে না। তোমাদের প্রেমালাপে বাদ সাধতে আসব না। শুধু খেয়াল রাখবে অসতর্ক মুহূর্তে যেন অন্যের কাছে ধরা না পড়ে যাও। এত আটঘাট বেঁধে নেমে শেষে যেন সব ভণ্ডুল না হয়ে যায়।’
সুতপা আমতা আমতা করে বলল, ‘অফিসারটি যা কড়া ধাতের লোক—’
‘হতে পারে। হৃদয়ের উত্তাপে পাথর গলাবার কৌশলও তো তোমার অজানা নয়। কিন্তু নিজেই যদি গলে গিয়ে থাকো, তবে অপরকে কাবু করবে কি করে? তোমার আসল কাজই তাহলে অসমাপ্ত থেকে যাবে!’
দুজনের কথাবার্তা শুনে আমার হাত নিশপিশ করতে লাগল। আমার চোখের সামনে আমারই অধস্তন কর্মচারীরা আমার বিরুদ্ধে দরবার করছে!
এক লহমায় আমি সমস্ত ষড়যন্ত্রের ইতি করে দিতে পারি। কিন্তু না, দাগি আসামি যারা তাদের দাগ না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এমন শাস্তি আমি দেব, যাতে সারা জীবন মনে থাকে।
অজানা আতঙ্কের রহস্য উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত ওদের আমি কিছুই বলব না। ওদের আসল উদ্দেশ্যটা আমাকে জানতে হবে। আমাকে এখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। একটি মাত্র ভুল পদক্ষেপ এখন মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে।
আঘাত যেটা হানব সেটা চূড়ান্ত আঘাত হবে—শত্রুর সমস্ত অপকৌশল তাতে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
মতলব ভাঁজতে ভাঁজতে অফিসে ঢুকলাম। তারপর ছিন্নমূল কলাগাছের মতো ধপ করে বসে পড়লাম রিভলভিং চেয়ারে।
(৮)
নিরুত্তেজ আবহাওয়ার মধ্যে মধ্যাহ্ন ভোজন সাঙ্গ হল। চিফ মেকানিক তার দলবল নিয়ে ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে বসেছিল। সুতপা বসেছিল আমারই পাশে। জীমূতবাহনকে দেখলাম চিত্রিতার পাশে বসে থাকতে। চিত্রিতার আঙুল দুটি ব্যান্ডেজ—বাঁধা থাকায় চামচ দিয়ে তাকে খেতে সাহায্য করছিল।
অপারেটরের মুখে শুনতে পেয়েছি, আন্দামান থেকে নাকি একটা জাহাজ যাত্রা শুরু করেছে। সোজা এখানেই আসবে সেটা। ভালোই হবে। আমাদের ক্লান্ত অবসন্ন মগজ দিয়ে রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারা যাচ্ছে না। সমস্যার আশু প্রতিকার করতে হলে চাই সুস্থ সতেজ চিন্তা—ভাবনা।
রোহিতাশ্ব ভাবা সমস্যার একটা দিক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তাঁর ওপর আমার অগাধ আস্থা আছে। এই ভয়াবহ ক্ষুদে দানবদের হাত থেকে রেহাই পাবার পথ নিশ্চয়ই তিনি বাতলে দেবেন।
দিলেনও তাই।
ডাইনিং টেবিলে হাজির হয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন আমার পাশে। গবেষণা নিয়ে মেতে থাকলে সময়ের কোনো জ্ঞান থাকে না তাঁর। মনে করিয়ে না দিলে সারাদিন হয়তো অভুক্তই থেকে যাবেন। বিলম্ব দেখে আমিই তাঁকে লোক পাঠিয়ে ডেকে এনেছি।
প্রথম গ্রাস মুখে তুলেই বললেন, ‘ক্ষুদে উদ্ভিদগুলি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছি। গ্যাসোলিনকে ওরা যমের মতো ভয় করে। ওপাশে মাংস থাকলেও গ্যাসোলিনে ভেজা মাটি পেরিয়ে কিছুতেই যাবে না সেখানে।’
আমি স্বস্তির শ্বাস নিলাম। যাক, আবিষ্কারটা কাজে লাগবে।
তিনি বলে চললেন, ‘যেভাবে ওরা একের পর এক দালানে এসে হামলা চালাচ্ছে, তাতে আজ রাতটা সেখানে কাটানো ঠিক হবে না। তিন নম্বর গুদামঘরটা তো খালিই পড়ে আছে। আজ রাতটা আমাদের সেখানে থাকলেই ভালো হয়। মেঝের চারধারে চার ফুট চওড়া করে তেল বুলিয়ে দিতে হবে। সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে ওরাও যেতে পারবে না, আমরাও নিরাপদে রাত কাটাতে পারব।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই ক্ষুদে দানবগুলি সম্বন্ধে আরো অনেক কথাই আপনি জানেন—তাই নয় কি?’
‘জানি বটে, কিন্তু যতক্ষণ না নিঃসন্দেহ হতে পারছি, ততক্ষণ বলা ঠিক হবে না। আমি বিজ্ঞানী। আমাকে তো আর মনগড়া কথা বললে চলবে না। হাতেনাতে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।’
এ ব্যাপারে আমি তাঁর সাথে একমত।
তিনি বলে চললেন, ‘তবে একটা কথা এখন আবার জোর দিয়ে বলতে পারি, শিগগিরই ওরা কাতারে কাতারে এসে হামলা শুরু করবে। জানি না, ওদের বংশবৃদ্ধির হার কতটা দ্রুত। তবে ওদের আক্রমণ যে অচিরেই ভয়াবহ রূপ নেবে সেকথা ঠিক।’
‘এ—যাত্রা তাহলে গ্যাসোলিনই আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।’
‘আপাতত গ্যাসোলিন ব্যবহার করা ছাড়া পরিত্রাণের আর কোনো পথ নেই আমাদের। কৌতূহলবশে একটার গায়ে কয়েক ফোঁটা গ্যাসোলিন ঢেলে দিয়েছিলাম। প্রাণীটা সেই ধকল সহ্য করতে না পেরে মরেই গেল।’
‘কিন্তু গ্যাসোলিনের ব্যাপক ব্যবহার করাও তো যাবে না। একদিকে যেমন খরচের প্রশ্ন রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অন্যান্য অসুবিধেও আছে। বৃষ্টিতে তেল ধুয়ে গেলে কি করবেন? তা ছাড়া আগুনের ভয়ও তো আছে।’
‘হ্যাঁ, সেজন্যই আমি অন্য একটা প্রতিষেধক খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছি। দেখি, কতদূর কি করতে পারি।’
তিনি চলে গেলেন তাঁর বিজ্ঞানাগারে। সুতপা আমার অফিসে। বাকি সবাই রানওয়ের দিকে যাবার জন্য তোড়জোড় করতে লাগল।
তিন নম্বর গুদামঘরটা রাতে থাকার উপযোগী করে তুলতে হবে। সে কাজের ভার দিলাম জীমূতবাহনের ওপর। তাকে বলা হল, সে যেন এ—ব্যাপারে রোহিতাশ্ব ভাবার প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলে।
সুগ্রীব আর করিমকে নিয়ে আমি চললাম জাহাজঘাটের দিকে। জাহাজের লোকেরা দ্বীপের বিভীষিকা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। মাটিতে নেমে আসার পর তারা যাতে কোনোরূপ বিপদের সম্মুখীন না হয় তার জন্যই আমাদের এই সতর্কতা। সশস্ত্র হয়েই আমরা বেরুলাম। পায়ে পরলাম পুরু সোল বুট জুতো। হাতে রইল ফ্ল্যাশলাইট আর বন্দুক।
দালান থেকে জাহাজঘাট খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু পথ ভালো নয় বলে সময় লাগে বড্ড বেশি। মাঝপথে ছোটখাটো অজস্র জলাভূমি, চেনা—অচেনা গাছের জঙ্গল। দু—চার জায়গায় লম্বা লম্বা ঘাস। কোথাও রাশি রাশি বুনো কপি। তার ওপর খুদে দানবদের ভয়ে দেখেশুনে পথ চলতে হচ্ছিল বলে সময় বড় কম লাগছিল না।
উপলময় সুদৃশ্য সৈকত। দক্ষিণে তটভূমির দুই—তৃতীয়াংশ জুড়ে খাড়া পাহাড়। বাতাস এখানে ততটা প্রবল নয়—পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ভিন্নপথে ঘুরে যায়। কোথাও বা নৈঃশব্দ্য এত গভীর যে সমুদ্রের অস্তিত্ব টেরই পাওয়া যায় না—সমুদ্র যে পাহাড়ের অপর পিঠে ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফেটে পড়ছে সেকথা বোঝবার উপায় নেই।
জাহাজঘাটের কাছে তটভূমি বালুময়। একটা সিলমাছ হুশ করে হঠাৎ ভেসে উঠেই ডুব দিল।
পেঙ্গুইন চারটিকে সমুদ্রের ধারে দেখতে পেলাম। আমাদেরই কেউ হয়তো খাঁচার দরজাগুলি খুলে দিয়েছিল। বন্ধনমুক্তির আনন্দে মশগুল হয়ে জটলা করছিল তারা। হয়তো বা বন্দিদশার অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই ভুলে বসে আছে। আমাদের দেখেও তারা দেখল না। দুলকি চালে বেলাভূমির ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল থপথপ করে। পেঙ্গুইনদের পরিভাষায় নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করছিল সেটা ওরাই জানে।
আমি খোঁজ করছিলাম ছোট একটা টিলার, পাথরের একটা কৃত্রিম স্তর যেখানে সহজেই জাহাজের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। করিমও যেন কীসের খোঁজে ছিল। খোঁজ করছিল বললে ভুল বলা হবে—তাকে তাকে ছিল। সুযোগ পেয়েই বন্দুক নিয়ে ছুটল। দুড়ুম করে একটা আওয়াজ হতেই দেখি, একপাল সিলমাছ দুদ্দাড় করে জলে গিয়ে নামছে, আর তাদের একটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। কপাল বেয়ে তার নামছে রক্তের ধারা, আর করিমের বন্দুক থেকে উঠে যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
আমি বিব্রত বোধ করলাম। একটা প্রতিবাদও করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শিকার করতে পেরে ওর যা ফুর্তি হচ্ছিল সেটাকে অযথা ম্লান করে দিতে মন চাইল না। বললাম, ‘মেরেছ ভালোই করেছ—তাজা মাংস পাওয়া যাবে।’
খুশি হয়ে বলল, ‘চামড়াটাও তো কম সুন্দর নয়। দেখবেন, নতুন কিছু খাইয়ে আজ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে, চামড়াটা নয় পরে ছাড়ানো যাবে। এসো, আগে আসল কাজটা সেরে আসি।’
কাঠ আর পাথর দিয়ে ছোট একটা টিলার ওপরে যে স্তম্ভটি তৈরি করলাম, কারুকার্যের দিক দিয়ে সেটি নেহাত খারাপ দেখতে হল না। সীমাহীন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে মানুষেরা যখন বালুকাবেলায় পদার্পণ করবে, তখন প্রথমেই তাদের নজর গিয়ে পড়বে স্তম্ভটির গায়ে। তারা দেখবে, একখানি সাদা নিশান পতপত করে উড়ছে সেখানে। তার নীচে ঝুলছে ছিপি—আঁটা একটা বড় বোতল; বোতলের ভেতর রয়েছে একখণ্ড সাদা কাগজ। তাতে লেখা :
চার ইঞ্চির মতো লম্বা সবুজ কাঁটাওয়ালা পাতার চলমান কোনো উদ্ভিদ দেখলে কৌতূহলী হয়ে কেউ যেন সেটাকে স্পর্শ না করে। ওরা মারাত্মক রকমের বিষাক্ত। গ্যাসোলিনই ওদের একমাত্র প্রতিষেধক। বুটের গায়ে জ্বালানি তেল মেখে যেন সবাই দ্বীপে অবতরণ করে। পথের মাঝে কোথাও বসাটাও বিপজ্জনক।
সাবধান করে দেওয়াই আমার কাজ। কেউ যদি সে কথায় কর্ণপাত না করে তার ফল সে ভুগবে।
চামড়া ছাড়াতে গিয়ে করিম দেখতে পেল, তার ছুরিটা আশানুরূপ ধারালো নয়। অথচ সমুদ্রতটে বেশিক্ষণ থাকবারও উপায় নেই। উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় যেতে হবে। কুমেরুর গাছগুলির হাল স্বচক্ষে না দেখলেই নয়।
আমি তাগাদা দিলাম। শিকার ফেলে যেতে হবে দেখে করিমের মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। এত কষ্ট করে সিলটাকে শিকার করল, অথচ তাকে কাজে লাগাতে পারবে না—এর চেয়ে আপসোসের ব্যাপার তার কাছে আর কি আছে!
ক্রমাগত বিপদের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখলে সাহসী লোকও কাপুরুষের মতো আচরণ করতে শুরু করে। তা ছাড়া তিমিঙ্গিল দ্বীপের মতো স্বল্পপরিসর জায়গায় জেলখানার কয়েদির মতো আটক থেকে অনেকেরই মনমেজাজ বিশেষ ভালো নয়! একটু স্বাধীনতা তাই দেওয়াই উচিত। শিকার করে যতটা না আনন্দ পেয়েছে, লোক খাইয়ে করিম আনন্দ পাবে তার তুলনায় চতুর্গুণ বেশি।
অগত্যা বললাম, ‘বেশ, আপত্তি আমি করব না। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে সূর্যাস্তের আগেই তুমি দালানে গিয়ে পৌঁছোবে। একগাদা মাংস নিয়ে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। বিদ্যুৎ না থাকায় রেফ্রিজারেটর অচল হয়ে আছে—মাংস জমিয়ে রাখা যাবে না।’
সানন্দে সম্মতি জানাল করিম।
দালান থেকে উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় যেতে কোনোরকম বেগই পেতে হয় না। সেদিককার পথ বিলকুল সাফ। রানওয়ে থেকে জাহাজঘাট যাবার পথও খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু জাহাজঘাট থেকে উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় যেতে হলে নাকের জলে চোখের জলে এক হতে হয়। জলাভূমিতে সারাটা তল্লাট ছয়লাপ হয়ে আছে। একবার এগুতে গিয়ে তিনবার পিছোতে হয়। বার চারেক এগিয়ে পিছিয়ে সুগম্য পথ যখন খুঁজে পেলাম তখন হ্রদ এলাকায় যাবার আর সময় নেই। ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। অগত্যা সেদিনকার মতো পথচলায় ইস্তফা দিলাম।
অনেকটা পথ ঘোরাঘুরি করে সন্ধে ঘনিয়ে এল। ফ্ল্যাশলাইট নাড়াচাড়া করে দেখে দিলাম। দূরে রানওয়ে থেকে বিমানটা হটিয়ে নেওয়া হয়েছে। দালানের আনাচে—কানাচে বড় বড় ড্রাম থেকে দীর্ঘ অচঞ্চল শিখা বেরিয়ে আসতে দেখলাম। তাদের ঘিরে ছিল লালচে কালো আভা। আকাশটা যেন থমথম করছে। ঝড়ের পূর্বাভাস আর কি।
সুগ্রীবের সাথে কথা বলতে বলতে জোরে পা চালালাম। দূরে থাকতেই চিৎকার করে নিজেদের আগমনী সংবাদ জানিয়ে দিল সুগ্রীব। ওরাও চেঁচিয়ে জবাব দিল।
আমাকে নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে দেখে সুতপা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তার মেকি উল্লাসে আমি কিন্তু ততটা উৎফুল্ল হলাম না। বললাম, ‘করিমই সব গোলমাল করে দিল। আজও আমাদের প্রস্রবণের ধারে যাওয়া হয়ে উঠল না। কাল সেখানে না গেলেই নয়!’
সবার ওপর এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললাম, ‘এখানকার খবর কি?’
সুতপা জবাব দিল, ‘আর একটা কুকুর মারা গেছে।’
আমি আঁতকে উঠলাম, ‘কীভাবে!’
‘কীভাবে আবার—খুদে উদ্ভিদ—দানবের আক্রমণে। এখন যেন ওরা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। দেখছেন না, আমরা সবাই বুট পরে আছি!’
‘তিন নম্বর গুদামঘর সাফ করা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার ভাবা নিজের হাতে সব কিছু করেছেন। এদিকে বিমানটাকে দালানের কাছাকাছি এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঝড়ের সময় বিমানের আলো ফ্লাড—লাইটের কাজ করবে।’
‘চমৎকার!’
কাজটা সত্যই প্রশংসনীয়। দেওপ্রকাশ লোকটাকে এজন্যই আমি এত ভালোবাসি। বললাম, ‘করিম কোথায়? তাকে একবার ডাকো তো।’
সুতপা অবাক হল, ‘কেন, করিম তো আপনাদের সাথেই গিয়েছিল!’
আমার মাথায় যেন বিদ্যুতের শক খেলাম। মুখের মাংসপেশি টানটান হয়ে গেল। বললাম, ‘যে যে এখানে আছো তৈরি হয়ে নাও—করিমকে খুঁজতে যেতে হবে।’
অনেক সম্ভাবনার কথাই মনে হতে লাগল। করিম হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। জলাভূমির চারিদিকে হয়তো হয়রান হয়ে ঘুরে মরছে সে। কিংবা আমার নিষেধ অমান্য করে অত্যধিক মাংসের ভারে ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে নিজেকে, যার ফলে গদাই—লস্করী চালে চলতে হচ্ছে এখন। কিংবা ভোঁতা ছুরি দিয়ে মাংস কাটতে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে। একটু এগিয়ে গেলেই হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে।
জনা দশ—বারো লোক নিয়ে অভিযানে বের হলাম। জীমূতবাহনকে ধারে—কাছে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। তাকে ডেকে নেবার সময়ও ছিল না।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পরপর কয়েকবার বন্দুকের শব্দ শুনতে পেলাম। পরক্ষণেই করিমের গলার ভয়াবহ আর্তনাদে রাত্রির স্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। নিশ্চয়ই কোনো বিপদে জড়িয়ে পড়েছে করিম!
ছুটলাম আমরা। লতাপাতা মাড়িয়ে, ডালপালা ভেঙে, ঝোপঝাড় তছনছ করে ছুটে চললাম বারোজন লোক। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল চারদিকে।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় কি যেন একটা চকচক করে উঠল। দেখেই চিনলাম—করিমের হাতের ফ্ল্যাশলাইট। সামনের কাচটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। অদূরেই দেখা গেল বন্দুকটা দু—টুকরো হয়ে পড়ে আছে। এই বন্দুকেই আজ সে সিলমাছ শিকার করেছিল।
অপরিসীম আতঙ্কে চারদিক খুঁজে দেখতে লাগলাম। কে এই নিশাচর আগন্তুক, যে নাকি অমন মজবুত একটা বন্দুক অবহেলায় দু—টুকরো করে ফেলতে পারে!
চারদিকে গাছগাছালি ঝোপঝাড় নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই শোচনীয় দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী তারাই। খানিক আগেই যেখানে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল, এত তাড়াতাড়ি সে জায়গাটা এমন নিবাত নিষ্কম্প হয়ে যায় কি করে! প্রাণীটা পালিয়ে যেতে পারেনি। আছে, ধারে—কাছে নিশ্চয়ই ওত পেতে আছে।
চকিত বিস্ময়ে দেখতে পেলাম একদিককার ঝোপটা মৃদু মৃদু নড়ছে। আমি চেঁচিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম সেদিকে। বারোটা ফ্ল্যাশলাইটের বারো ঝাঁক জোরালো আলোয় সমস্ত ঝোপটা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল। মোটা মোটা গাছের গুঁড়ির পাশে কিছুই দেখা গেল না। অথচ ডালপালা নাড়িয়ে খসখস শব্দ করে কিছু একটা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল নিশ্চয়ই।
প্রবল উত্তেজনায় বুকটা আমার ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। নাগালের মধ্যে যখন পাওয়া গেছে, তখন আর নিষ্কৃতি নেই প্রাণীটার। আমার হাতে তার মৃত্যু অনিবার্য।
শুরু হল আক্রমণ। পরপর কয়েকটা গ্যাসোলিন বোতল ছুড়ে মারা হল। আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। সাথে সাথে ঝোপটা যেন স্থির হয়ে গেল। কোথাও সামান্যতম চাঞ্চল্যও নেই।
তবে কি পালিয়ে গেল প্রাণীটা! ব্যর্থ হল আমাদের আক্রমণ!
আচমকা সুতপা এসে হাজির হল আমার পাশে। এসেই বলল, ‘প্রাণীটা ধরা পড়েছে নাকি?’
প্রচণ্ড এক ধমকে তার অহেতুক কৌতূহল দূর করে দিলাম, ‘কে আসতে বলেছে তোমাকে এখানে? যাও, দালানে ফিরে যাও। সুগ্রীব, সুতপাকে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিয়ে এসো।’
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার বড় একটা ইচ্ছে ছিল না সুগ্রীবের। তবু যেতে হল।
আবার শুরু হল আক্রমণ। ঝাঁকে ঝাঁকে গ্যাসোলিন বোতল ছুটে গেল ঝোপ লক্ষ্য করে। এবার দেখা দিল দাবানল। গাছে গাছে আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল অতি দ্রুত। সেই অগ্ন্যুৎসবে আমরা হলাম হোতা। একে একে গ্যাসোলিনের সমিধ আহুতি দিতে লাগলাম।
ফল পাওয়া গেল। সেই বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে কিছু একটা বেরিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। ডালপালা দুমড়ে—মুচড়ে প্রচণ্ড আবর্ত সৃষ্টি করল সেই জ্বলন্ত ঝোপের ভেতর। মনে হল, সে যেন অন্ধ হয়ে গেছে, যেন বেরিয়ে যাবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছে না, যেন সারা দেহে তার প্রচণ্ড আক্ষেপ সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ আমাদের সামনে কিছুই বেরিয়ে এল না। কোনো প্রাণীকে পুড়তেও দেখলাম না আমরা।
রাত্রিশেষে নিভন্ত ছাই ঘেঁটে একখানা বোতাম কিংবা একটুকরো পোড়া হাড়ের সন্ধানও পাওয়া গেল না। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সেই স্তূপাকার ছাইয়ের গাদার দিকে।
যেদিকে তাকাই শুধু দেখি অঙ্গার আর ছাই। আর কিছুই নেই সেখানে!
(৯)
‘তুমি আমাকে কতটা ভালোবাস সুতপা?’
‘আস্তে কথা বলুন। চারদিক লোকে লোকে গিজগিজ করছে!’ সুতপা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল আমার কথায়।
বললাম, ‘তাতে কি হয়েছে? আমি এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার—আমার সামনে কে মাথা উঁচু করে কথা বলবে?’
সুতপা চুপ করে রইল।
‘বেশ, ও—কথা নয় থাক। রাতটা তোমাদের কীভাবে কাটল বল।’
‘ভয়ে ভয়ে কেটেছে। তিন নম্বর গুদামঘরেই ছিলাম আমরা। ডক্টর ভাবা ছিলেন গবেষণাগারে। তেলের গন্ডি পেরিয়ে খুদে প্রাণীরা আসতে পারেনি—সার বেঁধে গন্ডীর বাইরেই অপেক্ষা করেছে। পাওয়ার—অফিসার চিমটে দিয়ে তাদের ধরে ধরে জ্বলন্ত তেলে ফেলেছেন।’
‘তা সেই পাওয়ার—অফিসারটি সন্ধেবেলায় ছিলেন কোথায়? তাঁকে তো তখন খুঁজেও পাওয়া যায়নি।’
‘আমি তার কি জানি? তাঁর কাছেই বরং কৈফিয়ত তলব করুন।’
জীমূতবাহনকে ডাকতে হল না। ধূমকেতুর মতো আচমকা এসে হাজির হল। বললাম, ‘এই যে মিস্টার সেন! সারাটা রাত আপনি গুদামঘরেই ছিলেন নিশ্চয়?’
‘সন্ধেবেলা ঘণ্টা দু—তিন ছিলাম না। ডক্টর ভাবার ফাইফরমাশ খাটছিলাম।’
‘তা বেশ। সারাক্ষণ আপনি তাঁর সাথেই কাজ করছিলেন বুঝি?’
জীমূতবাহন আমতা আমতা করতে লাগল—কোনো সদুত্তর দিতে পারল না।
বললাম, ‘দেখুন মিস্টার সেন, আপনি অনেক কাজেরই কোনো কৈফিয়ত দিতে পারবেন না। তবু আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ গুদামঘরটা আপনি তেলের গন্ডি দিয়ে সুরক্ষিত করে রেখেছেন। এখন আর একটা কাজের ভার দিচ্ছি আপনাকে। রেফ্রিজারেটর থেকে কিছু মাংস নিয়ে আসুন। মাংস জমিয়ে রেখে লাভ নেই—এর মধ্যেই পচন ধরেছে। এখন বরং একটা সৎ কাজ করা যাক। মাংসখণ্ডগুলিকে টোপ হিসেবে দু—তিন জায়গায় রেখে দিন। খুদে মাংসাশী প্রাণীরা ওদের কাছে এগিয়ে গেলেই শটগান দিয়ে খতম করতে থাকুন। দিনের শেষে হিসেব করে দেখা যাবে ক’টা মারা পড়ল।’
আদেশটা জীমূতবাহনের কাছে বিশেষ মনঃপূত হল না। মুখ কাঁচুমাচু করে ভাঁড়ার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল সে।
সুতপার দিকে আবার দৃষ্টি ফেরালাম, ‘আচ্ছা সুতপা, এখানকার অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব তো আমার ওপরেই। আমি যদি একটা অমানুষিক কাণ্ডই করে বসি, সেটা কি অন্যায় কিছু হবে?’
বুঝতে না পেরে সুতপা হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
‘যেমন ধরো, অজানা সেই বিভীষিকার অস্তিত্ব এখনো আছে কি নেই আমরা সঠিক বলতে পারি না। কাল রাতে জঙ্গলের সাথে সেও ভস্মীভূত হয়েছে কি না জোর করে বলতে পারি না। আজ সন্ধেবেলায় আমাদের মধ্য থেকে আর একজন যদি উধাও হয়ে যায় এবং তারই খোঁজে শুধুমাত্র তোমাকে নিয়েই যদি জঙ্গলে ঢুকি, তুমি আমার সঙ্গী হতে রাজি হবে কি?’
সুতপার অনিন্দ্যসুন্দর মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল, ‘আমি একা সাথে গিয়ে কি করব?’
‘একা কেন, প্রেমের অনির্বাণ দীপশিখা সাথে নেবে—অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনবে আমাকে!’
অর্থপূর্ণ চাউনি মেলে ধরল সুতপা, ‘সারারাত জেগে কাটিয়েছেন—আপনার এখন বিশ্রাম দরকার। অসলংগ্ন প্রলাপ শুরু করেছেন।’
‘তাই বুঝি?’
সুগ্রীবকে ডেকে বললাম, ‘একবার ধাঁ করে ডক্টর ভাবাকে ডেকে নিয়ে এসো তো সুগ্রীব। কিন্তু সাবধান! ভুলেও যেন কোনো ঘরে ঢুকতে যেও না। একটা লাঠি নিয়ে যাও—কাজে লাগবে। বুট তো তোমার পরাই আছে। ল্যাবরেটরির বাইরে কোনো খুদে প্রাণী দেখতে পেলে তাঁকে জানাবে।’
সুগ্রীব চলে গেল। বাইরে পাখিরা পতপত শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। গুদামঘরের এক কোনায় রান্নার আয়োজন চলছে। শশীকলা এবং মীনা আজ রান্না করবে। একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে আমি তদারক করছি। পাশে বসে রয়েছে সুতপা।
বলতে লাগলাম, ‘বুঝলে সুতপা, প্রচণ্ড খাটুনিতে আমার মাথা এখন ঠিক নেই। ইচ্ছে করছে, অষ্টপ্রহর শুধু তোমার পাশেই বসে থাকি। তুমি হচ্ছো আমার প্রেমের উৎকলিকা। তুমি হচ্ছো একটি বহুমূল্য আশরাফ। তুমি হচ্ছো আমার কাছে আকবরি মোহরের মতো—একবার হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। এই অধমকে ধন্য করতেই তোমার আবির্ভাব। অনিয়মের রাজত্বে তুমিই একমাত্র নিয়ম। প্রেমের মরুভূমিতে তুমিই একমাত্র মরূদ্যান। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে শুধু তোমার জন্যই। সমস্ত অন্তরায় দূর করতে চাইছি শুধু তোমাকে পাবার আশায়।’
ইতিউতি তাকিয়ে সুতপা কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমাকে আকাশে তুলে দেবেন না—পড়ে গেলে ব্যথা পাব।’
একটা জবাব জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল। সুগ্রীবকে ফিরে আসতে দেখে আর বলা হয়ে উঠল না।
বললাম, ‘কি, ডক্টর ভাবা এলেন না যে?’
সুগ্রীব বলল, ‘তিনি খানিক বাদেই আসছেন। তাঁর দরজার বাইরে আধ ডজনের মতো হতচ্ছাড়া খুদে প্রাণীরা অপেক্ষা করে ছিল। দরজা খুলতেই তারা একে একে ভেতরে গিয়ে ঢুকল। ডক্টর ভাবা ফাঁদে ধরলেন তাদের। মাংসে বিষ মিশিয়ে তাদের খেতে দিলে কি প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাই এখন পরীক্ষা করে দেখছেন।’
‘আইডিয়াটা মন্দ নয়। বিষ মাখানো মাংস খেয়ে যদি পটল তোলে, তাহলে ঝামেলা অনেক চুকে যায়। আচ্ছা সুগ্রীব, আর একটা কাজ করবে?’
‘বলুন।’
‘একবারটি এক নম্বর গুদামঘরে যাবে?’
‘কেন?’
‘ওখানে কুমেরুর যে গাছগুলি রাখা আছে, তাদের হালটা একটু দেখে আসবে। ডক্টর ভাবা সেদিন বলছিলেন, কোনো নিশাচর প্রাণী নাকি সেখানে যাতায়াত করে। ডালের ডগাগুলি নাকি খাওয়া—খাওয়া মনে হয়। তোমার কি মনে হয় আমাকে জানাবে। কিন্তু সাবধান, কাছে যেও না যেন!’
‘আচ্ছা।’
সুগ্রীব চলে গেল। সুযোগ পেয়ে এবার সুতপার কথার জবাব দিলাম, ‘তুমি অমন্দ কিছু বলোনি সুতপা। গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া অতি উত্তম জিনিস। কিন্তু অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক উর্বশী, কোন অর্বাচীন তোমাকে আকাশে তুলে ছেড়ে দেবে? তেমন যদি কেউ করেই বসে, পরিত্রাতার কি কোনো অভাব ঘটবে?’
‘যার—তার অনুগ্রহ আমি গ্রহণই বা করব কেন?’
‘সেটা তোমার অভিরুচি।’
‘অতি বড় আপনার জন না হলে আমার হৃদয়ে অনধিকার প্রবেশই বা করতে দেব কেন?’
‘সেটা একশোবার। তবে এমন অনেক লোক আছে, যারা রকেটের মতো অপ্রতিহত বেগে বুক ফুটো করে হৃদয়ে ঢুকে যায়। বেরিয়েও যায় তেমনি অপ্রত্যাশিত ভাবে।’
সুগ্রীব ফিরে এসে বলল, ‘কথাটা কিন্তু সত্যি। ডালের ডগাগুলি খাওয়া—খাওয়াই মনে হয়। আরো একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, অজস্র বিষাক্ত খুদে উদ্ভিদ গাছের নীচে কিলবিল করছে; অথচ গাছের গায়ে একটাকেও দেখলাম না।’
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। বললাম, ‘যাও, রোহিতাশ্ব ভাবাকে কথাটা জানিয়ে এসো।’
সুগ্রীব চলে গেল। সুতপাকে বললাম, ‘বুঝলে সুতপা, মেয়েরাও হচ্ছে ওই বিষাক্ত উদ্ভিদের মতো। পুরুষ দেখলে ধেয়ে যায়। পুরুষদের তো আর অতটা অন্তর্দৃষ্টি নেই। উচ্ছ্বসিত হয়ে আলিঙ্গন করে বসে। পরিণাম মৃত্যু।’
‘আপনার যত উদ্ভট কথা! বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাহলে চলছে কি করে শুনি?’
‘চলছে প্রচণ্ড একটা ধাপ্পাবাজির মধ্য দিয়ে। স্বামী ধোঁকা দিচ্ছে স্ত্রীকে, আর স্ত্রী দিচ্ছে স্বামীকে। প্রেমিক দিচ্ছে প্রেমিকাকে, আর প্রেমিকা প্রেমিককে। এই ধোঁকাবাজির হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। এর হাত থেকে যিনি গা বাঁচিয়ে চলতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন ঋষিকল্প পুরুষ।’
‘এতই যখন বুঝেছেন, তখন আপনাকে নিশ্চয়ই কেউ ধোঁকা দিতে পারবে না।’
‘মুশকিল তো সেখানেই। যে স্টেশনে গাড়ি ধরবার কথা নয়, শেকল টানলে সেখানেও গাড়ি ধরে। গার্ড যখন জরিমানা আদায় করতে আসে, চালাক যাত্রী ততক্ষণে হাওয়া হয়ে যায়। পুরুষ জাতটা এত বোকা যে মেয়েরা বুকে বসে দাড়ি ওপড়ালেও ক্ষতিটা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। যখন পারে তখন উলটো বিপত্তি ঘটে যায়। দাড়িও যায়, প্রেয়সীও হাতছাড়া হয়।’
সুতপার মুখ ভার হল, ‘কেমন ধারা লোক আপনি! মেয়েদের মন বুঝে কথা বলতে পারেন না?’
বললাম, ‘আর যাই হই, ধামাধরা নিশ্চয়ই নই। কপালটা অবশ্য ধামাচাপা তবু একবার কপাল ঠুকে বলেই ফেলি আসল কথাটা; তোমাকে আমি ধর্মসাক্ষী করে সারা জীবনের জন্য সেক্রেটারি করতে চাই। আপত্তি আছে তোমার?’
‘আপত্তি থাকলেও সেটা ধোপে টিকবে বলে তো মনে হয় না। আপনার যা অখণ্ড প্রতাপ!’
খুশি হয়ে বললাম, ‘সমঝদার হয়ে উঠেছ দেখছি!’
সুতপা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, ‘রোহিতাশ্ব ভাবা আসছেন।’
চিন্তার ভারে যেন নুয়ে পড়েছেন রোহিতাশ্ব ভাবা। এসেই বিনা ভূমিকায় বলে বসলেন, ‘সুগ্রীব নাকি আজ কুমেরুর গাছগুলি দেখতে গুদামঘরে ঢুকেছিল? আমাকে গিয়ে জানাল, ডালের ডগাগুলি নাকি ভাঙা ভাঙা দেখাচ্ছে।’
বললাম, ‘আমাদের অজান্তে নিশ্চয়ই কোনো প্রাণী সেখানে যাতায়াত করছে।’
‘না।’
‘না কেন?’
‘খুদে বিষাক্ত উদ্ভিদগুলি নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছি আমি। দেখেছি, এমিনো ট্রায়াজোল ব্যবহার করে যতটা ফল পাওয়া যায়, আর কিছুতেই তেমন হয় না। ডি—ভি—টি দিয়ে যেমন কীটপতঙ্গ মারা হয়, এটা দিয়েও তেমনি এদের বিনাশ করা যাবে। মাংসের চারদিকে এমিনো ট্রায়াজোল পাউডার ছড়িয়ে রাখতে হয়। গ্যাসোলিনকে এরা ভয় পায়। গ্যাসোলিনে ভেজা মাটি পেরিয়ে কিছুতেই এরা এগোবে না। অথচ এই মারাত্মক পাউডারের মধ্য দিয়েই এরা এগিয়ে যাবে মাংস খাবার জন্য। এরা তো আর জানে না যে পাউডারের সংস্পর্শে আসবার দশ সেকেন্ডের মধ্যেই এদের মৃত্যু অনিবার্য।’
‘এমিনো ট্রায়াজোল সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই। কি পরিমাণ আছে আমাদের স্টকে?’
‘খুব বেশি নেই। সেই কবে আনা হয়েছিল। দালানগুলি তৈরি হয়ে যাবার পর সামনে ফুলের বাগান করবার ইচ্ছে ছিল আমাদের। বাগানে কীটপতঙ্গ এবং আগাছার বংশ নির্বংশ করবার জন্য পাউডারটা ছড়াতে হয়। বাগান তো আর করা হয়ে উঠল না—পাউডারটা রয়েই গেল।’
‘গুদামঘরের রহস্যটা কিন্তু আপনি খোলসা করে বললেন না। কোনো প্রাণী যদি সেখানে যাতায়াত না—ই করবে—’
কথা শেষ করতে না দিয়েই রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘আমি এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। যথাসময়ে সব কিছুই আমি অকপটে জানাব।’
ভগ্ন হৃদয়ে বললাম, ‘আমাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক তাহলে অকালে ঝরে যাবে?’
বিরক্ত হলেন ডক্টর ভাবা, ‘দেখুন, আসল রহস্যের ধারে—কাছেও আমি যেতে পারিনি। তবে বিষাক্ত খুদে উদ্ভিদের বিপদ থেকে আপনাদের রক্ষা করতে পারব, এই আশা রাখি। গুদামঘরে দালানে রান্নাঘরে সর্বত্র এমিনো ট্রায়াজোল পাউডার দিয়ে গণ্ডি রচনা করা হবে। গণ্ডির ভেতর আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। আসল রহস্যের সন্ধান হয়তো মিলবে উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায়। এখানকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সাঙ্গ করে আমরা রওনা হব সেখানে।’
আমি অধীর হয়ে উঠলাম, ‘ইতিমধ্যেই আমাদের দুজন লোক মারা গেছেন। তিনটি কুকুরও আমরা হারিয়েছি। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে আমাদের। আর লুকোচুরি খেলা বরদাস্ত করা যায় না। সহ্যের একটা সীমা তো আছে!’
রোহিতাশ্ব ভাবা বলতে লাগলেন, ‘নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু নাটক শেষ হবার আগে যবনিকা নিশ্চয়ই নেমে আসবে না?’
সুতপা আবদারের সুরে বলল, ‘আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।’
বললাম, ‘যেতে না চাইলেও তোমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হত। যেতে চেয়েছ ভালোই হয়েছে—তোমার সাধ অপূর্ণ থাকবে না।’
সুতপা কি বুঝল কে জানে—হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে, কিন্তু আওয়াজটা যেন তেমন জোরদার নয়। বাতাসও বয়ে যাচ্ছে চিরাচরিত পন্থায়, কিন্তু সেই দুর্দম চাঞ্চল্য যেন আর নেই। মানুষেরাও যে যার কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু কেমন যেন একটা ঝিমুনি ভাব এসেছে তাদের মধ্যে। রোহিতাশ্ব ভাবা বড় একটি চিনামাটির পাত্রে এমিনো ট্রায়াজোল নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁর পিছে পিছে এল সুগ্রীব। হাতে তার মাংসের গামলা। বিষাক্ত খুদে উদ্ভিদদের জন্য ভোজের আয়োজন চলতে লাগল। সুগ্রীব মাংস রাখতে লাগল মাটিতে, আর তার চারদিকে পাঁচ ফুট ব্যাসার্ধের এক—একটা বৃত্ত রচনা করতে লাগলেন রোহিতাশ্ব ভাবা। বৃত্তের ভেতর ছড়ানো হল ট্রায়াজোল পাউডার।
সুতপাকে বললাম, ‘দেখ, কেমন টোপ ফেলা হচ্ছে। মাংসাশী খুদে প্রাণীরা শিকার ধরতে এসে নিজেরাই শিকার হয়ে যাবে।’
সুতপা কোনো মন্তব্য করল না।
হঠাৎ আমার হাসি পেল। শটগান হাতে জীমূতবাহন তখনো বসে রয়েছে শিকারের অপেক্ষায়। সেও মাংসের টোপ ফেলেছে। সুগ্রীবকে নতুন করে টোপ ফেলতে দেখে তেলে—বেগুনে জ্বলে উঠল। সে হয়তো মনে ভেবেছে, অপদস্থ করবার জন্যই আমি তাকে এই অদ্ভুত কাজের ভার দিয়েছি। আমার আদেশ শুনে সে হয়তো অপ্রস্তুত হয়েছে।
সুতপা মুখ খুলল, ‘অকারণে হেসে উঠলেন কেন?’
‘তোমাকে আর জীমূতবাহনকে দেখে।’
‘তাতে হাসির কি আছে?’
‘আছে। তুমি হচ্ছ টোপ আর আমি গ্যাসোলিনের গণ্ডি। বেচারা জীমূতবাহন ভয়েই এগোতে পারছে না।’
‘বলিহারি যাই! আপনার চিন্তাধারার মধ্যে এখন যেন খেয়ালিপনা শুরু হয়েছে। চিন্তাগুলো যেন দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াচ্ছে। না হলে এমন চিন্তা আপনার মাথায় আসত না। জানেনই তো কবেই ওঁর সাথে আমার সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে।’
আমি অনুতপ্ত হলাম, ‘ইস, একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম কথাটা।’
গুদামঘরের ভেতরেই রান্না হবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাইরেই নিয়ে আসা হল যাবতীয় রান্নার সরঞ্জাম। রোহিতাশ্ব ভাবা মুক্তাঙ্গন রন্ধনশালার চারদিকে পাউডারের গন্ডি এঁকে দিলেন। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি গুদাম, গবেষণাগার, মায় কুকুরটিকেও পাউডারের গন্ডি দিয়ে সুরক্ষিত করে রাখা হল। তিনটি কুকুর মারা যাবার পর শেষেরটিকে আর ছাড়া রাখতে ভরসা পাওয়া গেল না। খুদে বিষাক্ত প্রাণীগুলি ইতিমধ্যেই মরতে শুরু করেছে। প্রতিটি টোপের কাছেই দু—চারটে করে মৃতদেহ পাওয়া গেল। এই মৃতদেহগুলি যে কতটা বিষাক্ত চিত্রিতা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তার আঙুল দুটো এখনও ফুলে ঢোল হয়ে আছে।
রেডিও—অপারেটর এসে বলল, ‘শর্টওয়েভে আরো কিছু খবর পেলাম। জাহাজটা ফিরে যাচ্ছে। আমাদের দ্বীপের পাশ দিয়ে নাকি আশি মাইল বেগে কুমেরুর শীতল বাতাস হয়ে যাবে।’
আমি হতাশ হয়ে বললাম, ‘কপালে আমাদের আরো অনেক দুর্ভোগ আছে দেখতে পাচ্ছি। আরো কিছুদিন জাহাজ আর বিমানের জন্য হা—পিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে।’
দেওপ্রকাশ এসে জানাল, ‘বিমানটাকে ঠেলে দালানের কাছাকাছি আনা হয়েছে। বেঁধেও রাখা হয়েছে শক্ত করে। ঘূর্ণিঝড়েরও সাধ্য নেই তাকে একচুল এদিক—ওদিক করবার।’
আমি বাহবা দিলাম, ‘চমৎকার! এবার কিছু ফুয়েল ভরে নাও। ইঞ্জিনটাকেও চালু করবার চেষ্টা করো। ঝড়ের সময় ড্রামগুলো তো আর জ্বালানো যাবে না। বিমানের ল্যান্ডিং—লাইটই তখন আলোর বন্যা বইয়ে দেবে।’
দেওপ্রকাশ চলে গেলে বললাম, ‘বুঝলে সুতপা, রোহিতাশ্ব ভাবা আর দেওপ্রকাশ রাই, দুজনেই আমার ডান—হাত আর বাঁ—হাত। রোহিতাশ্ব ভাবা রহস্যের অনেক কিছুই জেনে ফেলেছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু সতর্কতার খাতিরে সবার সামনে প্রকাশ করছেন না। দেওপ্রকাশও জানে এই বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হতে হলে কখন কি করা প্রয়োজন। না বলতেই সে সব কাজ করে যাচ্ছে।’
‘আর বুঝি নেই কেউ?’
‘সুগ্রীব আছে।’
‘আর?’
‘আর আছো তুমি। কিন্তু তোমার সমস্ত আচরণ আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারি না। প্রেমের ব্যাপারে এটাই তোমার হাতেখড়ি কিনা আমার জানা নেই। হুট করে একেবারেই তুমি রাজপথে এসে পৌঁছে, নাকি প্রেমের অনেক অলিগলি পার হতে হয়েছে, জানতে পারিনি।’
‘জেনে আপনি কি করবেন?’
‘দেখব, তোমার পাশে টোপর মাথায় আমাকে মানাবে কিনা। দেখব, ভবিষ্যতে অসদ্ভাবের কোনো কারণ আছে কিনা। দেখব, অসবর্ণ বিবাহ সমাজসম্মত হবে কিনা।’
‘আপনি বরং এক কাজ করুন—দৈবজ্ঞের শরণ নিন।’
‘উঁহু, আমি ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি নই যে দৈবজ্ঞের শরণাপন্ন হবো।’
‘তাহলে চলুন, আপাতত মীনার শরণাপন্নই হওয়া যাক। রান্নাবান্নার কাজ যেমন ঢিমে তেতালা চালে চলছে, তাতে প্রাতরাশ এবং মধ্যাহ্ন ভোজন দুটোই আমাদের একসাথে সারতে হবে দেখছি। একটু হাত লাগালে যদি তাড়াতাড়ি হয়—’
‘হ্যাঁ, তুমি যাও। আমি দেখি জীমূতবাহন কি করছে।’
জীমূতবাহন আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। আমি বললাম, ‘মিস্টার সেন, ভেবে দেখলাম, আপনার যুক্তিগুলো একেবারে ফেলনা নয়। রোহিতাশ্ব ভাবাও আপনার সাথে একমত। তিনিও একাধিক দানবের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। আপনি চেষ্টা করে দেখুন, রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেন কিনা।’
নিরুত্তেজ কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আমার কথা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব আমি এখানকার লোকজনদের বাঁচাতে চেষ্টা করব।’
‘তা করুন। তেজ থাকাটা খারাপ নয়—পৌরুষের লক্ষণ। আমাদের সাথে উষ্ণ প্রস্রবণ এলাকায় যাবেন নাকি?’
‘না, যে—কাজের ভার দিয়েছেন সেটাই করে যাব।’
‘জীমূতবাহনকে আর ঘাঁটালাম না। টুকিটাকি আরও কিছু কাজ সাঙ্গ করে দুপুরের আহারে বসলাম।
সুতপাকে আর তাগাদা দিতে হল না। স্যুট—বুট পরে হাতে বন্দুক নিয়ে যথাসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। সুগ্রীবের মতো তারও যাবার উৎসাহ কিছু কম নয়।
রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘অযথা দল ভারী করে লাভ নেই। চারজনই যথেষ্ট—আপনি, আমি, সুগ্রীব আর সুতপা।’
আমারও তাই মত।
সুপরিচিত ঝোপঝাড় পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম। সেই বুনো ঘাস, সেই জংলি কপির ক্ষেত। রোহিতাশ্ব ভাবা আগে আগে যাচ্ছিলেন, সাথে সুগ্রীব পট্টনায়ক। পেছনে সুতপার হাত ধরে আমি।
সুতপাকে বললাম, ‘ঝড় আসছে সুতপা—প্রচণ্ড ঝড়! ফেরবার পথে ঝড়ের কবলে পড়তেই হবে। সাবধানে পা ফেলে চলবে—পদস্খলন না হয়!’
সুতপা জবাব দিল, ‘পদস্খলন যদি হয়েই যায়, আপনিই তো আমাকে সামলে নিতে পারবেন!’
বললাম, ‘আমি নিজেই যদি অধঃপতিত হই, আমার ওপর নির্ভর করবে কি করে?’
হেসে জবাব দিল সুতপা, ‘এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? দুজনেই তাহলে অধঃপতিত হয়ে থাকব।’
‘তা কেন! অন্য কারো ওপর নির্ভর করে তো চলতে পারো। সুগ্রীব ছেলেটা মন্দ নয়। ওর ওপর নির্ভয়ে ভরসা করতে পারো। ছেলেটা তোমাকে যথেষ্ট ভালোও বাসে।’
সুতপা বেঁকে দাঁড়াল, ‘কি বললেন?’
‘আহা—হা, অত চটছ কেন? ও না হয় তোমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটই হল। তাতে কি আসে—যায়!’
অভিমানভরে সুতপা বলতে লাগল, ‘ফের একথা বললে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। ছেলেটাকে আমি স্নেহের চোখেই দেখে আসছি। ওর পেটে পেটে এত শয়তানি বুদ্ধি গজগজ করছে জানতে পারলে—’
‘জানতে পারলে কি করতে? ঘা কতক বসিয়ে দিতে? দূর করে তাড়িয়ে দিতে?’
‘যা—ই হোক করতাম।’
‘তোমার কথায় ছেলেটা হাসতে হাসতে প্রাণও দিতে পারে। উঠতি বয়সে সবারই অমন হয়, বুঝলে?’
সুতপার কান লাল হয়ে উঠল, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি—’
‘অকাতরে মিছে কথা বলে যাচ্ছি, আমাকে এই অপবাদ কিন্তু দিতে পারবে না। বিশ্বাস না হয় সামনে তাকিয়ে দেখো। আমাদের এত পিছিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়েছে সুগ্রীব। আমাদের খোঁজেই আসছে সে।’
বিরক্ত হয়ে জোরে পা চালিয়ে দিল সুতপা। সুগ্রীবকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সীতাভক্তি তোমার অটুট আছে তো সুগ্রীব? নাকি চিড় ধরেছে?’
সুগ্রীব উত্তর দিল, ‘ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
সে না বুঝলেও আমি ঠিক বুঝে নিলাম, সুতপা সম্বন্ধে তার ধারণা আগের মতো আর নেই। কিন্তু কেন?
জানি না কেন। জানবার সুযোগও আর হল না। রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘গাছগুলিকে আমি প্রস্রবণের কিনার ঘেঁষে পুঁতেছিলাম। প্রস্রবণের ভেতর দিকটায় কাদা অত্যন্ত গরম। কাদায় ধাতব পদার্থের ভাগও তেমনি বেশি। উদ্ভিদ তো দূরের কথা, ব্যাকটিরিয়া পর্যন্ত সেখানে বেঁচে থাকতে পারে না। কিনারের মাটি ততটা গরম নয়। গাছ সেখানে মাটি থেকে অনায়াসেই রস শোষণ করতে পারে। কুমেরুর গাছগুলিকে সে—জন্যই আমি সেখানে পুঁতেছি। গাছগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের মোটা মোটা শিকড়। উত্তপ্ত মাটি না হলে তাদের চলে না, আবার বেশি উত্তপ্ত হয়ে যাবার ভয়ে মাটির ভেতরেও তারা বেশিদূর প্রবেশ করতে পারে না।’
সুগ্রীব পট্টনায়ক বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করে বসল, ‘কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ এলাকায় নাকি প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায়?’
রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘যায় বৈকি।’
‘তাহলে তারা অগভীর শিকড়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কি করে?’
‘সে—জন্যই তো উচ্চতায় গাছগুলি পাঁচ—ছ’ ফুটের বেশি হয় না। শাখা—প্রশাখায় বিভক্ত অসংখ্য শিকড় মাটির ওপর ছড়িয়ে থেকে গাছটাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করে।’
আচমকা একটা স্মৃতি মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণিত হয়ে ফিরতে লাগল আমার। আমি দেখেছি—মাটির ওপর অসংখ্য শিকড়ের সমারোহ—নিশ্চয়ই আমি দেখেছি। এই দ্বীপেই দেখেছি। কিন্তু কোথায়? কখন? কীভাবে?
রোহিতাশ্ব ভাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাটি থেকে যারা রস শোষণ করে, তাদের তাহলে মাটির ওপরে কোনো শিকড় থাকে না?’
‘নিশ্চয়ই না।’
‘তিমিঙ্গিল দ্বীপে তাহলে কোনো গাছেরই মাটির ওপরে শিকড় নেই?’
‘না।’
‘কিন্তু আমি যে দেখেছি!’
রোহিতাশ্ব ভাবা চমকে উঠলেন, ‘দেখেছেন! কোথায়?’
‘সেটাই তো মনে করতে পারছি না। কিন্তু দেখেছি আমি ঠিকই।’
রোহিতাশ্ব ভাবা ঢোঁক গিলে বললেন, ‘তারা কি এই রকমের দেখতে?’
বলেই অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন উষ্ণ প্রস্রবণের লাল রঙের কাদার দিকে। তারপরই উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন থরথর করে।
সুগ্রীবের মুখখানাও ভয়ে পাংশু হয়ে গেল। ত্রস্ত হয়ে সে ছুটে গেল প্রস্রবণের ধারে। শুরু হল তার তোতলামি, ‘আ—আ—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি বললাম, ‘রহস্যের কোনো হদিস মিলল নাকি?’
রোহিতাশ্ব ভাবা পাথরের মূর্তির মতো নিস্পন্দ হয়ে রইলেন। সুগ্রীব বলল, ‘গাছগুলিকে আমরা এখানেই পুঁতেছিলাম। এই যে তার চিহ্ন। ওখানেও ছিল একটা। ওইখানে ছিল আরো একটা। একসারিতে পরপর বারোটা গাছ ছিল।’
আমরা ভয়ার্ত দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম উষ্ণ প্রস্রবণের ওপর দিয়ে। থেকে থেকে লাফিয়ে উঠছে প্রস্রবণের উষ্ণ জলরাশি। বাষ্পের কুণ্ডলীতে ছেয়ে আছে সারাটা তল্লাট। তপ্ত নরম কাদার স্তরে স্তরে কতই না, রঙের বাহার! কিনারা ঘেঁষে বারোটা গর্ত শূন্যগর্ভ মড়ার খুলির মতো হা হা করে হাসছে। বাতাসের দমকে তাতে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে আলগা ময়লা আবর্জনা। কিন্তু গাছ নেই—গাছের চিহ্নও নেই কোথাও। কে যেন সব ক’টা গাছকে টেনে—হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেছে!
(১০)
আকাশ—পাতাল ভাবতে ভাবতে আমরা যখন দালানে ফিরছিলাম, তার অনেক আগেই আকাশ ঘোর করে এসেছিল। ক্রমে অশান্ত বাতাস উথাল—পাথাল নৃত্য জুড়ে দিল। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকে চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল। তারপর শুরু হল বৃষ্টি। দু—এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি নয়, ইলশেগুঁড়িও নয়—রীতিমতো ধারাবর্ষণ।
সারাটা রাত চলল এই তাণ্ডব। সারাটা রাত যেন আবলুস কালো অতিকায় দুটো দানো তর্জন—গর্জন আর আস্ফালনে দ্বীপটাকে তছনছ করে দিতে লাগল। দিগন্তব্যাপী উদাস সমুদ্র দিগম্বর বেশে নৃত্য জুড়ে দিল। তামাম বিশ্বচরাচর থেকে তিমিঙ্গিল দ্বীপের অস্তিত্ব যেন লোপাট হয়ে যাবে। বজ্রপাতের শব্দ শুনে মনে হতে লাগল যেন তোপ দাগা হচ্ছে। মেঘের আওয়াজ যেন রণদামামা।
সারাটা রাত অঝোরে বর্ষণ হল। জল থৈ থৈ করতে লাগল দালানের বাইরে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঢল নামল। এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর ডামাডোলের মধ্যে দ্বীপের অস্তিত্ব যতই টলমল করতে লাগল, আমাদের জ্ঞানও তত টনটনে হয়ে উঠল। সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে যেতে লাগলাম আমরা।
সবকিছু তোলপাড় করে দিয়ে দুর্যোগ একসময় শেষ হল। ঢুলু—ঢুলু চোখে আমরা দেখলাম যে সকাল হয়েছে। বর্ষণক্লান্ত মেঘের অট্টহাসি থেমে গেছে। দাঙ্গাবাজ দানো দুটোকে কেউ যেন মাথায় ডাঙশ মেরে ঠান্ডা করেছে। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আমরা।
আরো ঘণ্টা চার—পাঁচ পরে আকাশের কোণে বিমানের আবির্ভাব ঘটল। বিমান তো নয়, যেন সাক্ষাৎ দেবদূত এগিয়ে আসছিল মুক্তির বার্তা নিয়ে। আমাদের আনন্দ তখন আর ধরে না। অনেকেই তখন তাথৈ তাথৈ নৃত্য জুড়ে দিল। পাওয়ার—অফিসার জীমূতবাহন এই প্রথম বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজ করল। কয়েকটা প্যানেল ছড়িয়ে দিয়ে আগন্তুক বিমানটাকে জানিয়ে দিল যে রানওয়ের সমস্ত বাধা অপসারিত হয়েছে।
বিমানটাও বারকয়েক পাক খেয়ে নেমে এল রানওয়ের কঠিন পাথুরে জমিতে।
নামতে যে পারবেই এমন কোনো দৃঢ়মূল ধারণা বিমানের আরোহীদের মনে ছিল না। সব রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার জন্য তারা অবশ্য প্রস্তুত ছিল। নতুন একটা রেডিও—ট্রান্সমিটার তারা সঙ্গেই এনেছিল। তাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হল বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। দ্বিতীয় কাজ তিমিঙ্গিল দ্বীপের অধিবাসীদের দিকে নজর দেওয়া। আগন্তুকদের আচার—আচরণে অবজ্ঞা এবং উপেক্ষার বিন্দুমাত্র ছাপও ছিল না। আমাদের প্রতিটি কথাই তারা অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে শুনে যেত। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, এমন শব্দ কখনোই তারা মুখ ফুটে উচ্চারণ করত না যাতে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের বিপদের কথা তারা অবিশ্বাস করছে। অথচ তাদের প্রতিটি ভাবভঙ্গিতে কেমন যেন একটা অনাসক্তি জড়িয়ে ছিল।
গুদামঘরে কুমেরুর গাছপালার একটা পেটি তখনো শক্ত করে বাঁধা ছিল। তার চারদিকে ছিল ট্রায়াজোল পাউডারের গণ্ডি। গুদামঘরের বাইরে আরো কতকগুলি কুমেরুর গাছ চারচাকার একটা গাড়ির সাথে এঁটে বাঁধা ছিল। সেখানেও ছিল ট্রায়াজোল পাউডারের গণ্ডি। আগন্তুকেরা গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টি নিয়ে গাছগুলিকে যে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে, এতটা আশা করা যায় না। ফলে সন্দেহজনক কিছুই তাদের নজরে পড়ল না।
আমরা খুদে উদ্ভিদগুলির কথা জানালাম তাদের। তারা দেখতেও চাইল। কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে খুঁজেপেতে একটাও সংগ্রহ করতে পারলাম না তখন। গণ্ডির ভেতরে যেখানে যত খুদে উদ্ভিদ মরে ছিল সবই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এমন কি ল্যাবরেটরিতে পর্যন্ত একটাও পাওয়া গেল না। মরে গেলেও উদ্ভিদগুলি সমান বিষাক্তই থেকে যায়। চিত্রিতা ভুল করে স্পর্শ করেছিল একটাকে। আঙুলের ব্যথা তার তখনো একেবারে কমেনি, ফোলাও সারেনি। সে—জন্যই আমাদের অত সতর্কতা।
আগন্তুকেরা প্রশ্নে প্রশ্নে অযথা উত্যক্ত করে তুলল না আমাদের, দ্বীপের উনিশজন লোক কি করে সতেরোজনে এসে দাঁড়াল, সেই কৈফিয়ত পর্যন্ত তলব করল না। কারণে—অকারণে তারা দেঁতো হাসি হাসত, আমাদের দুঃখের অংশীদার হবার ভান করত। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
রেডিও—ট্রান্সমিটার চমৎকার কাজ দিচ্ছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কীসের সংবাদ আদানপ্রদান হত আমাদের জানবার কোনো উপায়ই ছিল না। তারা আমাদের জানতে দিত না। ওপরের নির্দেশ আমাদের অবসন্ন মগজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাবে, এরকমের একটা ধারণাই হয়তো তাদের ছিল। তারা হয়তো ভাবত, মনের দিক দিয়ে আমরা সুস্থ নই—বুদ্ধির দিক দিয়ে আমরা দেউলে হয়ে গেছি।
সবার মানসিক ভারসাম্য যে বজায় ছিল, একথা বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। ক্রমাগত ভয়ের তাড়নায় অনেকেই একেবারে ভেঙে পড়েছিল। দ্বীপ থেকে পালাবার চেষ্টায় উদগ্রীব হয়ে ছিল তারা। জীমূতবাহনের আচরণ আমাকে নতুন করে আবার অবাক করে দিল। আর পাঁচজনের মতো তিমিঙ্গিল থেকে যাবার জন্য মোটেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল না। আগের মতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলাও বন্ধ করে দিল। এখন সে গাম্ভীর্য নিয়ে চলে—ফিরে বেড়ায়, ওজন করে কথা বলে।
আমাদের জানানো হল, প্রথম দফায় কিছু লোক বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে। বিমানটা যাত্রীবাহী নয়—মালবাহী। সমস্ত লোক আঁটবে না এতে। জাহাজ তো আসছেই। বাকি লোকেরা জাহাজেই যাবে।
প্রথম দফায় যারা চালান যাবে, তাদের নামের তালিকা দেখলাম। সবার ওপরে রয়েছে আমার নাম। তারপর একে একে রোহিতাশ্ব ভাবা, জীমূতবাহন, সুগ্রীব এবং সুতপা। অর্থাৎ যার মানসিক অবস্থা যত বেশি সুস্থ তাকে তত বেশি রোগগ্রস্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
আমরা পাঁচজনেই একযোগে প্রতিবাদ জানালাম। আমরা চলে গেলে আমাদের অন্যান্য স্টাফেরা ভয় পাবে, সেকথা জানালাম। দ্বীপের অন্ধিসন্ধি আমরা যতটা ভালো জানি, আর কেউ ততটা জানে না, সে কথাও বললাম। কিছুতেই কিছু হল না। অগতির গতি রোহিতাশ্ব ভাবা—অগত্যা তাঁর সাথেই পরামর্শ করতে বসলাম আমরা।
তিনি বললেন, ‘তথাস্তু! ওদের অনড় সিদ্ধান্তই বহাল থাক। অথৈ রহস্যের মধ্যে শুরু হোক নতুন অধ্যায়।’
তাঁর পরামর্শ আমরা মাথা পেতে নিলাম। আমরা যেতে রাজি হলাম একটা শর্তে—আমাদের সাথে কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ অঞ্চলের উদ্ভিদগুলিও নিয়ে যেতে দিতে হবে। কোনো রকম দ্বিধা না করে আমাদের আবদার মেনে নেওয়া হল। না যাবার সঙ্কল্প নিয়ে আমরা যে ধনুকভাঙা পণ করে বসেছিলাম, সেটা থেকে টলাতে পেরেছে ভেবে আগন্তুকেরা সন্তুষ্ট হল। আমরাও মনে মনে বললাম, ‘রোস, আমাদের জোর করে নিয়ে যাবার মজাটা খানিক বাদেই টের পাবে!’
দেওপ্রকাশ রাই ফুয়েল দিয়ে বিমানের ট্যাঙ্ক বোঝাই করে দিল। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার কলকব্জাগুলি পরীক্ষা করে দেখে নিল। আমরা পাঁচজনে গিয়ে ঢুকলাম মাল রাখবার জায়গায়। মালপত্রের সাথে একই খোলে আমাদেরও যেতে হবে। বসবার ভালো ব্যবস্থা নেই—ঘুমোবার তো নেই—ই। গাছগুলিকে আগেই বিমানে তোলা হয়েছিল। এমিনো ট্রায়াজোল পাউডার দিয়ে একটা বৃত্ত রচনা করে তার ভেতর আমরা বসেছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ফ্ল্যাশলাইট, শটগান এবং আরো অনেক টুকিটাকি জিনিস।
পাইলট সকৌতুকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত সব হাতিয়ার সঙ্গে নিচ্ছেন কেন?’
রোহিতাশ্ব ভাবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিপদ থেকে বাঁচবার জন্য।’
‘কীসের বিপদ?’
‘বলে লাভ নেই—বিশ্বাস করবেন না।’
অযথা কথা না বাড়িয়ে পাইলট ককপিটে গিয়ে ঢুকল। তার পেছনে কো—পাইলট এবং ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার। রোহিতাশ্ব ভাবার কথায় তারা কোনো গুরুত্ব দিল বলে মনে হল না।
মোটরগুলি একে একে গর্জন করে উঠল। প্রপেলার ঘুরতে লাগল। আস্তে আস্তে নড়ে উঠল বিমানটা। তারপর বাঁক নিল বাতাস যেদিকে বয়ে যাচ্ছে সেই দিকে। বিমানের চাকা গড়িয়ে চলল। তারপর বেগ বাড়তে লাগল—দ্রুত, অতি দ্রুত।
খানিক পরেই সামনের চাকাগুলি মাটি ছেড়ে উঠল। তারপর পেছনের চাকা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বিমানটা পড়ল খোলা সমুদ্রে। সেখান থেকে বাঁক নিল উত্তরে।
ঊর্ধ্বে অনন্ত নীল আকাশ। নীচে অপার সমুদ্র। মাঝখানে ক্ষুদ্র একটা বিন্দুর মতো আমাদের এই বিমান।
সুতপা বলল, ‘এই যাত্রাই আমাদের অগস্ত্যযাত্রা নয়তো?’
বললাম, ‘কে জানে?’
সুগ্রীব বলল, ‘দ্বীপের বিভীষিকা এতকাল উৎকট ব্যাধির মতো আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। তার হাত থেকে এখন মুক্তি পাওয়া গেল।’
রোহিতাশ্ব ভাবা হাসলেন।
কো—পাইলট ককপিট থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আপনাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’
জবাব দিলাম, ‘অসুবিধে আবার কি—তোফা আছি।’
কো—পাইলট বলল, ‘অসুবিধে হলেও প্রতিকারের কোনো পথ নেই। মালবাহী বিমান বলে যাত্রীদের বসবার কোনো ব্যবস্থা নেই এতে। কারগো স্পেসে আলোও এত অল্প যে পড়াশোনা করবার উপায় নেই। বসে বসে ঘুমোনো ছাড়া করবার আর কিছুই নেই আপনাদের।’
কো—পাইলট নিজের কাজে চলে গেল। রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘আর যা—ই করি না কেন, ঘুমোনোটাই এখন চলবে না।’
সুতপা জানতে চাইল, ‘কেন?’
রোহিতাশ্ব ভাবা জবাব দিলেন, ‘সেকথাই এখন বলবার সময় হয়েছে।’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি শুরু করলেন, ‘সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হলে আমাদের যেতে হবে কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ এলাকায়। আমাদের দ্বীপে যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, কুমেরুতেও তেমনি আছে উষ্ণ হ্রদ। শত শত যোজন বরফের মাঝে কয়েক শো’ বর্গমাইল এলাকা আগ্নেয়গিরি বলয়ের ওপর অবস্থিত। আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার সংস্পর্শে এসে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে উষ্ণ হ্রদ। লক্ষ লক্ষ বৎসর আগে জায়গাটার সৃষ্টি, লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে সেখানকার উদ্ভিদ পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সেখানে ছ—মাস দিন আর ছ—মাস রাত্রি। দিনের বেলা উদ্ভিদেরা মাটি এবং সূর্যের আলো থেকে আহার সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু রাতের বেলা কি করবে তারা?’
রোহিতাশ্ব ভাবা থামলেন একটু। আমাদের পাঁচজোড়া চোখের অচঞ্চল দৃষ্টি তাঁর মুখের ওপর নিবদ্ধ হয়ে রইল।
সেদিকে গ্রাহ্য না করে তিনি বলে চললেন, ‘প্রাণীদের সারাটা জীবনই এক—একটা অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। উদ্ভিদের বেলায়ও তেমনি। অনলস প্রচেষ্টা না থাকলে প্রতিকূল আবহাওয়ায় মৃত্যু অবধারিত। আহার সংগ্রহ করতে না পারলে সুদীর্ঘ রাত্রি যাপন করাও উদ্ভিদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু কীভাবে তারা আহার সংগ্রহ করবে? ছ—মাসের মতো লম্বা রাত্রি তারা ঘুমিয়েও তো কাটাতে পারে না। মাটি যে গরম! অগত্যা বেঁচে থাকবার অন্য একটা পথ আবিষ্কার করল তারা। অর্কিডেরা যেমন আবিষ্কার করেছে, লিচেনেরা যেমন খুঁজে পেয়েছে—তেমনই একটা পথ। বেঁচে থাকবার জন্য এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই পথেরই অনুসরণ করতে করতে একদল পরিণত হয়েছে পতঙ্গভুক উদ্ভিদে। বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ শিকার ধরবার বিভিন্ন পন্থাও উদ্ভাবন করেছে। মাদাগাস্কারের নরভুক বৃক্ষের কথা কে না জানে? জনশ্রুতি আছে, গাছটার নাকি অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো সুদীর্ঘ সব শাখাপ্রশাখা ছিল এবং সেগুলি দিয়ে নাকি শিকার ধরত। গাছটাকে নাকি মানুষ উৎসর্গ করা হত। সেই কাহিনিই এখন কিংবদন্তির স্তর পেরিয়ে বাস্তবের আঙিনায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে।’
মনে সন্দেহের দোলা লাগলেও কেউ সাহস করে বলতে পারল না, কাজের বেলা ঢু ঢু—যত সব আষাঢ়ে গল্প। জীববিজ্ঞানী রোহিতাশ্ব ভাবা স্বয়ং যখন বলে যাচ্ছেন, তখন কোনো কথাই অবিশ্বাস করবার উপায় নেই।
বিমানটা একঘেয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করে উড়ে যেতে লাগল। আমরা পরম উৎকণ্ঠায় জীববিজ্ঞানীর বক্তব্য শুনে যেতে লাগলাম।
‘বিবর্তনবাদের স্বাভাবিক নিয়মে কোনো একটা গাছ হয়তো উষ্ণ হ্রদের কাছে কায়েমি বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। দিনের বেলায় সে মাটি থেকে রস শোষণ করত। সূর্যের আলো তাকে খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করত। দৈহিক বৃদ্ধির দিক দিয়ে অন্যান্য গাছের সাথে তখন তার বিশেষ কোনো পার্থক্যই থাকত না। রাতের বেলা কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে আহার সংগ্রহ করতে হত। খাদ্যের ব্যাপারে তখন তার চলেফিরে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না।’
একযোগে আমাদের কণ্ঠে বিস্ময়ের আর্তনাদ ধ্বনিত হল, ‘বলেন কি!’
কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রোহিতাশ্ব ভাবা বলে যেতে লাগলেন, ‘বাকিটা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয় না। মাটি গরম বলে শিকড় বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। চলেফিরে বেড়াতে হয় বলে রোঁয়া—ওঠা কৈশিক নলের মতো শিকড়গুলি অধিকাংশই মাটির ওপর ছড়িয়ে থাকে। কোনো এক অন্ধকার রাতে একটা গাছের চলমান শিকড় হয়তো আর একটার গায়ে গিয়ে পড়েছিল। সাথে সাথে দ্বিতীয় গাছটা প্রথমটির আহার্যে পরিণত হয়ে গেল। শিকারি গাছটা বেঁচেই শুধু রইল না, বংশবৃদ্ধির কৌশলও আয়ত্ত করে ফেলল। ডালপালার ডগায় অঙ্কুরোদ্গম হল। পরিপুষ্ট হওয়া মাত্র অঙ্কুরগুলি খসে পড়তে লাগল গাছ থেকে। প্রতিটি পরিপুষ্ট অঙ্কুরই রাতে শিকার ধরে এবং দিনে মাটি থেকে রস শোষণ করে এক একটি গাছে পরিণত হতে লাগল। হাজার হাজার বছর ধরে, বিবর্তিত হতে হতে ওরা বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছোল।’
আমাদের সামনে রহস্যের খানিকটা অন্তত উন্মোচিত হল। গুদামঘরে গাছগুলিকে কেন খাওয়া—খাওয়া মনে হত এতক্ষণে বোঝা গেল। সুতপা বলল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি। কুমেরুর উষ্ণ হ্রদ এলাকা থেকে এই গাছগুলি সংগৃহীত হল। দিনের বেলায় তারা অন্যান্য গাছের মতোই নিরীহ। তাদের সংগ্রহ করা হয়েছিল সম্ভবত দিনের বেলায়। বিমানের কারগো স্পেসে ঢোকাবার আগে তারা অন্ধকারের সম্মুখীন হয়নি। মানুষেরও তাই বিপদের কারণ ঘটেনি। অন্ধকারে কিন্তু প্রতিটি গাছই এক—একটি দানব বিশেষ। শিশু—উদ্ভিদেরা অন্ধকারে তো বটেই, এমন কি দিনের আলোতেও চলাফেরা করে বেড়ায়। পছন্দসই জায়গায় গিয়ে তারা শিকড় দিয়ে মাটি থেকে রস শোষণ করে। মাংসের ওপর তাদের এতই লোভ যে দিনের বেলাতেও তারা শিকার ধরতে পশ্চাদপদ হয় না। এ—ব্যাপারে আমরা যথেষ্টই তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তাই অধিক কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু আর একটি কথা বলেই আমি আমার বক্তব্য শেষ করব।’
অবাস্তব মনে হলেও রোহিতাশ্ব ভাবার প্রতিটি কথাই যে অভ্রান্ত সত্য অনেক আগেই আমরা তার পরিচয় পেয়েছি। শেষটুকু জানবার জন্য তাই উতলা হয়ে উঠলাম।
আবেগহীন নিরুত্তাপ গলায় বলতে লাগলেন, ‘গ্রীষ্মকালে অজস্র খুদে উদ্ভিদ ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে গাছ থেকে। সারাটা গ্রীষ্মকাল খুদে উদ্ভিদগুলি খেয়ে—দেয়ে বড় হয়। গাছগুলি তখন মাটি থেকে রস শোষণ করে বেঁচে থাকে। শীতকালে সূর্য যখন অন্তর্হিত হয়, যখন শুরু হয় সুদীর্ঘ রজনীর পালা, তখন সামনে যা পায় তাই দিয়েই জলযোগ সারে ভয়াবহ এই বৃক্ষেরা। খাওয়ার ব্যাপারে এদের কোনো বাছবিচার নেই। নিজেদের দেহজাত চারাগাছগুলিও এদের রাক্ষুসে গ্রাস থেকে রেহাই পায় না।’
সুগ্রীব বলল, ‘এজন্য বুঝি পুঁতে রাখা গাছগুলির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি? তারা বুঝি একে অন্যের শিকার হয়েছিল?’
‘কেউ কেউ হয়েছিল বৈকি। বাকি যারা ছিল তারা গিয়েছিল পাখিদের আস্তানায়।’
এতক্ষণে বোঝা গেল ঝোপের মধ্যে কেন আমরা ডালপালা নড়তে দেখেছিলাম, কেনই বা জ্বলন্ত ঝোপ থেকে কোনো প্রাণী বেরিয়ে আসেনি।
রোহিতাশ্ব ভাবা আমাদের প্রত্যেককেই একখানা করে প্যারাসুট পিঠে বেঁধে নিতে বললেন। যুক্তি দেখালেন, সাবধানের মার নেই।
সুতপা অবাক হল, ‘এখনো আমাদের বিপদ ঘটতে পারে নাকি?’
রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘ঘটতে পারে নয়—ঘটবে। ইতিমধ্যে আমি তার আভাসও পেয়েছি। ওদের উগ্রচণ্ডা মূর্তি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবারে সেটা প্রত্যক্ষ করবে। গাঢ় অন্ধকার আর ঝড়ো আবহাওয়া, দুটো অবস্থাতেই ওরা জেগে ওঠে। এখানকার আলো—আঁধারি পরিবেশেও ওরা জেগে উঠবে। কারণ মোটরের শব্দকে ওরা ঝড়ের গর্জন বলে ভুলে করেছে।’
সুগ্রীব ভয় পেল, ‘তাহলে আমাদের কি হবে?’
একগাল হেসে আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমাদের হবে না কিছুই—শিক্ষা হবে ওদের। আমাদের কথা অগ্রাহ্য করার ফল ওরা হাতে—হাতে পাবে।’
আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। আর মালবাহী সেই বিমানটা একটানা আওয়াজ করতে করতে উড়ে চলল মেঘের ভেতর গিয়ে।
রোহিতাশ্ব ভাবার আশঙ্কা যে অমূলক নয় সেটা টের পেতে খুব বেশি বিলম্ব হল না। উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম, সুদীর্ঘ কারগো স্পেসের শেষপ্রান্তে ঘষটানির একটানা একটা খসখস আওয়াজ। অধিক বিলম্ব করা সমীচীন নয় ভেবে আমরা প্রস্তুত হলাম। একজোটে পাঁচটি ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠল।
এ কি দৃশ্য দেখলাম! চোখের দেখাও যেন ভুল বলে মনে হতে লাগল। এগুলি কি গাছ? নাকি গাছের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর কতকগুলি দানব! কোনো গাছের ডালপালা কি এমনভাবে কিলবিল করে শিকার সন্ধান করতে পারে? কোনো গাছের শিকড় কি এভাবে মাটির ওপর দিয়ে তিড়বিড় করে এগুতে পারে?
টলটলায়মান গাছগুলিকে মাতালের মতো এগিয়ে আসতে দেখে সুতপা আর্তনাদ করে উঠল। রোহিতাশ্ব ভাবা বললেন, ‘ডাকুন ওদের—নিজের চোখে ওরা দেখে যাক।’
পাইলটের চেম্বারের বন্ধ দরজার গায়ে সুতপা দুমদাম কিল মারতে লাগল। খেঁকিয়ে উঠল পাইলট, ‘হলটা কি? এত সোরগোল কীসের?’
সুতপা বলল, ‘গাছগুলি এগিয়ে আসছে—ওদের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে!’
অবিশ্বাসের সুরে পাইলট জবাব দিল, ‘দেখুন ম্যাডাম, গোলমাল করে কোনো লাভ হবে না। গাছগুলি দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। চোখ বুজে থাকুন, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সুতপা ছটফট করতে লাগল, ‘দোহাই আপনার, একবারটি দরজা খুলুন।’
ঝাঁঝালো গলায় পাইলট বলল, ‘কেন অসঙ্গত দাবি করছেন? দরজা না খোলবার কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে আমাদের ওপর।’
আমি আর থাকতে পারলাম না। পাইলটকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলাম। সুগ্রীব অনুনয়—বিনয় করতে লাগল। রোহিতাশ্ব ভাবা বুঝিয়ে বললেন সব। জীমূতবাহনও চুপ করে রইল না। ফল হল না কিছুই। এতগুলি ছিটগ্রস্ত লোককে নিজের চেম্বারে ঢুকতে দিয়ে পাইলট বিমানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দিল না!
আমাদের মধ্যে সোরগোল বেড়েই চলল। অগত্যা ফ্লাইট—এঞ্জিনিয়ার দয়াপরবশ হয়ে বলল, ‘উত্তেজনা দূর করবার জন্য আপনাদের কতকগুলি পিল খেতে দিতে পারি—তার বেশি কিছু নয়।’
দরজা খুলে কারগো স্পেসে ঢুকতেই গাছগুলির দিকে তার নজর পড়ল। তারপর কি ঘটল সেটা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। সহকর্মীর চিৎকার শুনে ছুটে এল কো—পাইলট। তার হালও তথৈবচ। শেষে এল পাইলট। সব দেখেশুনে চোখ তার কপালে উঠল। তখুনি আবার ছিটকে বেরিয়ে গেল পিস্তল আনতে।
সামান্য ঝাঁকুনি খেলেও স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় বিমানটি দিশেহারা হল না।
রোহিতাশ্ব ভাবা ফ্ল্যাশলাইট নিবিয়ে দিতে বলেছিলেন। ফলে চাপ চাপ অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল কারগো স্পেসটা। আশি ফুট লম্বা বিরাট সেই জায়গাটিতে ছড়িয়ে ছিল ভয়াবহ সেই গাছগুলি। পাইলটের পিস্তল থেকে একের পর এক গুলি ছুটে যাচ্ছিল। কাবু হওয়া দূরে থাকুক তাতে গাছগুলির এগিয়ে আসা একটুও থামেনি।
নিরুপায় হয়ে পাইলট নিজের চেম্বারে ফিরে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় রেডিও—ট্রান্সমিটারের সামনে বলতে লাগল, ‘কলিং তিমিঙ্গিল! কলিং তিমিঙ্গিল! বিপদে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। বুঝতে পারছি না কীভাবে এর হাত থেকে রেহাই পাব। সারাটা বিমানে এখন সন্ত্রাসের রাজত্ব। সারাটা বিমানে শুধু দুঃস্বপ্ন আর বিভীষিকা!’
রোহিতাশ্ব ভাবা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমাদের ওপর যেমন টেক্কা দিতে চেয়েছিল তেমনি উচিত শিক্ষা পেয়েছে। আসুন, এবার আমরা কাজে নামি।’
অ্যালুমিনিয়মের একটা সিলিন্ডার বারকতক ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বেলে দিলেন তিনি। চোখ—ধাঁধানো প্রচণ্ড আলোয় কারগো স্পেসটা ভরে গেল। চলমান গাছগুলি যে যেখানে ছিল নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই প্রচণ্ড আলোর ওপরও ভরসা রাখতে না পেরে সব ক’টা ফ্ল্যাশলাইট কায়দামতো বসিয়ে দিয়ে জ্বেলে দিলেন। বিমানের ভেতরকার আলো বাইরের দিনের আলোটাকেও ম্লান করে দিল।
লেভারে চাপ দিয়ে মালখালাসের দরজাটাকে খুলে দিলাম আমি। পাল্লা দুটো ক্যাঁচ শব্দ করে ঝুলে পড়তেই দুটো গাছ শূন্যপথে পাড়ি দিল। অচিরেই অতল সমুদ্রগর্ভে চিরতরে সমাহিত হয়ে গেল।
রোহিতাশ্ব ভাবা সিলিন্ডারটা সুতপার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিভে যাবার আগেই অন্য একটা জ্বালিয়ে দিয়ে এটাকে বাইরে ফেলে দেবে।’
জীমূতবাহন ততক্ষণে লম্বা মোটা কাছি দিয়ে আর একটা গাছকে জড়িয়ে ফেলেছে। তারপর চলল দড়িটানার খেলা। মারো টান—হেঁইও, আরো জোরে—হেঁইও, জলদি জলদি—হেঁইও!
অতি সন্তর্পণে অসীম ধৈর্যভরে শেষ গাছটিকেও যখন বাইরে ফেলে দেওয়া হল, তখন আমরা রীতিমতো গলদঘর্ম হয়ে উঠেছি। সুতপাকে দুটো সিলিন্ডার আরো জ্বালতে হয়েছে।
কারগো স্পেসে বসেই আমরা টের পেলাম, নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এলোমেলো বিমান চালাচ্ছে পাইলট।
সুতপা বলল, ‘ঝুটমুট আমাদের এত হয়রান হতে হল।’
রোহিতাশ্ব ভাবা জানালেন, ‘হয়রানির অবশ্য এখনো ইতি হয়নি। তবে তার স্বরূপ যখন জানা গেছে আর কোনো অসুবিধে হবে না। গাছগুলিকে খুঁজে বের করবার জন্য দ্বীপটাকে চষে ফেলতে হবে। সেসব কাজ অবশ্য করবে জাহাজে যারা আসছে তারা। আমাদের এখন প্রচুর বিশ্রাম দরকার।’
সুগ্রীব লাফিয়ে উঠল, ‘বিশ্রাম! আঃ, কী মধুর শব্দ! সুতপা দিদিমণিও তাহলে ছুটির দরখাস্ত করছেন? তাহলে শিগগিরই একটা খানাপিনার আশা করতে পারি, কি বলেন?’
ধমকের সুরে সুতপা বলল, ‘সুগ্রীব! বাজে বকো না বলে দিচ্ছি।’
জীমূতবাহন এবং সুগ্রীব হেসে উঠল।
আমি কিন্তু হাসির কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম না।
জীমূতবাহন আমাকে লক্ষ করে বলল, ‘কলকাতায় সুতপার বিয়ে হচ্ছে শিগগিরই। আপনি আসছেন তো?’
আমার মুখের মাংসপেশি টানটন হয়ে গেল।
সুগ্রীব মস্করা করে বলল, ‘আপনিও যেমন—উনি না গেলে বিয়ে হবে কি করে শুনি!’
সুতপা সুগ্রীবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিস না বলে দিচ্ছি। আয় তোর সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’
সুগ্রীব বাধা দিল, ‘দরকার নেই—নিজের পরিচয় আমি নিজেই দিতে জানি। আমি হচ্ছি সুতপার ভাই, আর সুতপা আমার আপন মায়ের পেটের বোন।’
চমকের পর চমক। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, ‘তাহলে তোমার পদবি—তোমার নাম—’
সুগ্রীব বলল, ‘সব কিছুই ভুয়া। তাই বলে আপনার ওপর সুতপার অনুরাগ কিন্তু ভুয়া নয়।’
সুতপা ধমক দিল, ‘তুই চুপ কর তো অমর।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ও হচ্ছে শখের গোয়েন্দা। এখানে অবশ্য এসেছিল ছুটি কাটাতে। এম.এস—সি পাশ করে রিসার্চ করছিল।’
সুগ্রীব হেসে ফেলল, ‘দিদি, আমার সব পরিচয়ই যখন দিয়ে দিলে, তখন তোমার পরিচয়ই বা বাদ থাকে কেন। জানেন স্যার—মানে হবু জামাইবাবু—দিদিটি আমার ডবল এম.—এ। এখন সাইকোলজি নিয়ে থিসিস লিখছে। পুরুষ মনস্তত্ত্বের ওপর সম্যক জ্ঞানলাভের জন্য মিস্টার সেনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে আপনাকে ফাঁসিয়েছে।’
আমি বললাম, ‘বটে! বটে! আমাকে তাহলে গিনিপিগের মতো ব্যবহার করা হয়েছে?’
সুগ্রীব তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘ধেৎ, কি যে বলেন! আপনাকে ফাঁসাতে গিয়ে ও নিজেই যে আগে ফেঁসে গেছে, সে খবর রাখেন?’
সুতপা ওর দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল।
আমি বললাম, ‘তোমার গোয়েন্দাগিরির কোনো পরিচয় কিন্তু এখনো দিতে পারনি।’
‘পারিনি, না আপনি দেখতে পাননি? যাই হোক, কলকাতায় তো যাবেনই। আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কাহিনি তখন শোনাব।’
‘এখানে নয় কেন?’
‘কারণ, এখানে ভালো জমবে না। শত হলেও এখানে আপনি আমার অফিসার। আর সেখানে হবেন আমার—ইয়ে—’
কথা শেষ করতে না দিয়ে সুতপা বলল, ‘দেখুন, দেখুন, প্লেনখানা মাতালের মতো টাল খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে!’
ছুটে পাইলটের চেম্বারে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। বিমানখানা তখন তিমিঙ্গিলের পাথুরে রানওয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য ধেয়ে যাচ্ছে। অথচ চাকাগুলি তার তখনও নামিয়ে দেওয়া হয়নি।
ভয়ের শিহরন খেলে গেল আমাদের দেহের অণুতে অণুতে। আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে নাকি! বোবা আতঙ্কে পাইলটের সমস্ত চেতনা লোপ পেয়েছে নাকি!
জীমূতবাহন ততক্ষণে ছুটে গিয়ে লেভারে চাপ দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে প্লেনের গুটানো চাকাগুলি।
বিমানটা নির্বিঘ্নে নেমে এল বটে, কিন্তু যেভাবে নেমে এল তাতে পাইলটের দক্ষতার পরিচয় মোটেই পাওয়া যায় না।
তারপরই পাইলট একটা কাণ্ড করে বসল। নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে মোহাবিষ্টের মতো কপালে ঠেকিয়ে টিপে দিল তার ঘোড়াটা। গুলি ছুটল না—খুট করে একটা নির্দোষ শব্দমাত্র হল।
সুগ্রীব বলল, ‘ভাগ্যিস কার্তুজগুলি ফেলে দিয়েছিলাম!’
আমি বললাম, ‘তাই যদি না দেবে তো কেমন ধরনের গোয়েন্দা তুমি?’
অঘটনের আশঙ্কা যারা করেছিল তারা অবাক হল। আশঙ্কা যারা করেনি তারাও অবাক হল। কারণ আমি তখন রানওয়েতে নেমে এসে এক হাতে জীমূতবাহনকে এবং অপর হাতে সুতপাকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম দালানের দিকে।
যেতে যেতে সুগ্রীবকে বললাম, ‘কলকাতায় গিয়ে আমার প্রথম কাজ কি হবে জানো?’
সাগ্রহে জানতে চাইল সুগ্রীব, ‘কি?’
দুষ্টু হাসি হেসে বললাম, ‘তোমার জন্য পাত্রী যোগাড় করা।’
সুগ্রীবের মুখ আরক্তিম হল, ‘ধেৎ, কি যে বলেন!’
তার কথায় আমি হেসে ফেললাম। রোহিতাশ্ব ভাবাও হাসলেন। আমার আগে—পিছে ডাইনে—বাঁয়ে যারা ছিল তারাও হাসিতে যোগ দিল। এক কথায় হাসির ধুম পড়ে গেল সেখানে।
—