কুমার দারার বেদান্ত চর্চ্চা
সম্রাট শাহজাহান ও মহিষী মমতাজ মহলের জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার দারাশুকোর ২০এ মার্চ ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে আজমীরে জন্ম হয়। তিনি পিতার প্রিয় ধন এবং রাজসভার আদরের বস্তু ছিলেন, কারণ স্বভাবতঃ তাঁহারই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হইবার কথা। শাজাহানের চারি পুত্রই এক স্ত্রীর সন্তান, তাঁহারা বয়সে ক্রমে ক্রমে কনিষ্ঠ ছিলেন, এরূপ স্থলে এক বাড়ীতে সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠই মান্য ও প্রতিপত্তিতে প্রধান হয়; ইহাই প্রকৃতির নিয়ম।
দারার হৃদয় উদার, তাঁহার মন পরমার্থতত্ত্বের জন্য উধাও হইল, যেন তিনি প্রপিতামহ আকবরের ছাঁচে গড়া। যখন তিনি এলাহাবাদ প্রদেশের সুবাদার ছিলেন, তখন তাঁহার এলাকাভুক্ত কাশী নগরী হইতে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত আনাইয়া তাহাদের সাহায্যে পঞ্চাশখানি উপনিষদ্ ফার্সীতে অনুবাদ করাইয়া লন, এবং নিজের ভূমিকাসহ তাহা হস্তলিপিতে প্রকাশিত করেন। গ্রন্থের নাম দিলেন সিরই আস্ত্রার অর্থাৎ গুহ্যরহস্যের মধ্যে গুহ্যতম। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই লেখা সমাপ্ত হইল। তাহার পর এক শতাব্দী চলিয়া গেল, দারার জীবনসূর্য্য রক্তসন্ধ্যায় অস্তমিত হইল, তাহার পিতা বংশ পুত্তলিকামাত্র হইয়া রহিল। এমন সময় একজন অসমসাহসী ফরাসী যুবক পারসীদিগের ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ইউরোপে প্রচার করিবার মহাব্রত গ্রহণ করিয়া সর্ব্বপ্রকার বিপদ্ ও কষ্ট তুচ্ছ করিয়া ফরাসী সৈন্যদলের সামান্য সৈনিকরূপে ভর্তি হইয়া ভারতে আসিলেন (১৭৫৫)। এই মহাপুরুষের নাম আঁকেতিল দ্যুপের (জন্ম ১৭৪৩ খ্রি:)। ফার্সী ভাষা শিখিবার পরে সুরট বন্দরে আসিয়া ঐ ভাষার সাহায্যে পারসী জাতির পুরোহিত ‘দস্তুর’-দের নিকট পড়িয়া ‘ভেন্দিদাদ’ প্রভৃতি ধৰ্ম্মগ্রন্থ ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করিলেন, এবং তাহা জেন্দ আবেস্তা অর্থাৎ জুরুথাষ্ট্রের গ্রন্থাবলী’ এই নামে ৩ বালুমে ১৭৭১ সালে প্রকাশিত করিলেন।
তাহার পর দারাশুকোর ফার্সী গ্রন্থের লাতিন অনুবাদ করিয়া Oupnekhat নামে ১৮০২-০৪ খ্রিস্টাব্দে দুই কোয়ার্টো বালুম মুদ্রিত করিলেন।
৫০খানি উপনিষদের সারাংশের ফার্সী অনুবাদের এই লাতিন অনুবাদ জম্মান পণ্ডিত শোপেনহবার পড়িয়া মুগ্ধ হন এবং লেখেন-
“In the whole world there is no study so beneficial and so elevating as that of the Upanishads. It has been the solace of my life-it will be the solace of my death” (Schopenhauer )
অর্থাৎ ‘উপনিষদের মত পরম উপকারী ও উন্নত জ্ঞানভাণ্ডার আর সমস্ত জগতে নাই। ইহা আমার জীবনে শাস্তি দিয়াছে, মৃত্যুসময়েও শান্তি দান করিবে।’
দারাও উপনিষদে সর্ব্বশেষে উপনীত হন এবং চরম শান্তি পান। তত্ত্বজ্ঞানের পিপাসায় তিনি নানা ধর্ম্মের গ্রন্থ পাঠ করেন এবং নানা সম্প্রদায়ের সাধুর চরণে শরণ লন। কাশ্মীরবাসী মুল্লা শাহ মুহম্মদ নামক সুফী কবি, লাহোরের বিখ্যাত পীর মিয়ানমিরের শিষ্য মুহম্মদ শাহ লিসানুল্লা, ইহুদী ফকির সরমদ্-ইঁহারা সকলেই দারার ধর্মগুরু ছিলেন। কিন্তু সুফীধর্ম্ম, খ্রিস্টীয় আদিগ্রন্থ, কিছুই কুমারের চিত্তের পিপাসা মিটাইতে পারিল না। দারা নিজ গ্রন্থ সির-ই-আস্রার্, এক ভূমিকায় লিখিয়াছেন–”আমি মুসা-রচিত প্রথম পাঁচ গ্ৰন্থ (ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথমাংশ) খ্রিস্ট-রচিত (নিউ টেস্টামেন্ট), গাথা (ছা) এবং অন্যান্য অনেক ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিয়াছি। কিন্তু বেদে, বিশেষত: বেদের সার বেদান্ততে অদ্বৈতবাদ (তৌহিদ্) যেমন পরিষ্কার করিয়া বিবৃত করা হইয়াছে, এমন আর কোথাও পাই নাই।”
দারা হানিফি সম্প্রদায়ের মুসলমান, সুতরাং বেদান্তের অন্বেষণে তিনি সুফীমত গ্রহণ করিলেন। কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসীদের সহবাসে যখন জানিলেন যে সুফীমত এবং বেদান্তের মধ্যে পার্থক্যটা শুধু কথাগত, তখন তিনি আর একখানি গ্রন্থ লিখিয়া ঐ দুই ধর্ম্মের সামঞ্জস্য স্থাপন করিলেন। এই ফার্সী পুস্তকের নাম মজমুয়া উল-বহারয়েন্ অর্থাৎ দুই সমূদ্রের সঙ্গম। ইহাতে হিন্দু বেদান্তে যে সব শব্দ ব্যবহার হয়, তাহার প্রতিশব্দ সুফী সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ফার্সী শব্দাবলী হইতে দিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।
বাবা লালদাস নামক একজন হিন্দু যোগীর সেই সময়ে বড় নাম ছিল। কুমার দারা তাঁহার চরণে উপনীত হইয়া ধর্মপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন-আত্মার স্বরূপ কি? পরলোক কি? কিসে সদ্গতি হয়? চিত্তশুদ্ধির উপায় কি? ইত্যাদি। যোগী এইসব প্রশ্নের যে উত্তর দিলেন তাহা কুমারের অনুচর, শাহজাহানের সভার মুনশী দক্ষ ফার্সী লেখক চন্দ্রভাণ নামক ব্রাহ্মণ, ফরাসীতে লিপিবদ্ধ করিলেন। গ্রন্থের নাম হইল প্রশ্নোত্তর অর্থাৎ “দারাশুকো ও বাবা লালের সওয়াল-জবাব” এই তিন গ্রন্থেরই নকল খুদাবখ্শ পুস্তকালয়ে আছে।
কিন্তু দারা ইস্লামধর্ম্ম হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন নাই। তিনি ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সফিনৎ-উল-আউলিয়া নামক এক ফার্সী গ্রন্থ লিখিয়া তাহাতে মুহম্মদ হইতে আরম্ভ করিয়া তাঁহার নিজ সময় পর্য্যন্ত সকল ইস্লামীর সাধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী দেন, এবং তাঁহারা সকলেই যে একই ঈশ্বর প্রেমিক পরিবারের অন্তর্গত তাহা প্রমাণ করেন। তিন বৎসর পরে সফিনৎ-উল-আউলিয়াতে সাধু মিয়ান্ মীরের জীবনকাহিনী বর্ণনা করেন। দারা এই সাধুর সম্প্রদায়ে শিষ্যরূপে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তাহার চারি বৎসর পরে আরব ও পারস্য দেশীয় সুফীধর্ম্মের এক সরল ব্যাখ্যান রিসালা-এ হ্যুমা নামে রচনা করেন। এই শেষোক্ত গ্রন্থখানির এবং সফিনতের ভূমিকার ইংরেজীতে মর্ম্মানুবাদ শ্রীশচন্দ্র বসু রায় বাহাদুর এলাহাবাদে ১৯১২ সালে প্রকাশিত করেন।
দারার ভগিনী জাহানারাও ফার্সী ভাষায় মুনীস্-উর্–আর্ওয়া নামে শেখ মুইনউদ্দীন চিশতীর একখানি ছোট জীবনী লেখেন, এবং এই চিশতী সম্প্রদায়ে দীক্ষিতা হন। নিজগ্রন্থে তিনি দারাকে নিজের ধর্মগুরু বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
এইসকল গ্রন্থপাঠে স্পষ্টই বুঝা যায় যে প্রকৃতপক্ষে দারা বৈদান্তিক ছিলেন, কখনও হিন্দু বা পৌত্তলিক হন নাই। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে যখন পিতৃসিংহাসন লইয়া যুদ্ধ বাধিল, তখন আওরংজীব গোঁড়া মুসলমান জনতা ও সৈন্যদলকে নিজপক্ষে আনিবার জন্য ঘোষণা করিয়া দিলেন যে দারা বিধর্মী অর্থাৎ কাফির হইয়াছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া প্রমাণ হয়! আওরংজীবের আজ্ঞায় রচিত এবং তাঁহার দ্বারা সংশোধিত সরকারী ফার্সী ইতিহাস আলগীরনামাতে বলা হইয়াছে যে দারা ইস্লাম হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছিলেন, কারণ (১) তিনি ব্রাহ্মণ যোগী ও সন্ন্যাসীর সহিত মিশিতেন, তাহাদের ধর্ম্ম-উপদেষ্টা ও তত্ত্বজ্ঞ বলিয়া গণ্য করিতেন এবং বেদ (অর্থাৎ বেদান্ত)কে দৈব গ্রন্থ মনে করিয়া তাহার চর্চ্চা ও অনুবাদে দিন যাপন করিতেন।
(২) তিনি নাগরী অক্ষরে খোদিত ‘প্রভু’ শব্দযুক্ত অঙ্গুরীয় ও রত্ন পরিধান করিতেন।
(৩) নমাজ ও রমজানের উপবাস করিতেন না, এই বলিয়া যে ওগুলি শুধু অপরিপক্ক সাধকের জন্য, কিন্তু তিনি পরমতত্ত্বজ্ঞ সাধক, তাঁহার পক্ষে এইসব বাহ্য ক্রিয়া অনাবশ্যক।
ইহাতে পৌত্তলিকতা, বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস, অথবা কোরানের সভ্যতায় অনাস্থা কোথায়? তবে তিনি কাফির হইলেন কেমন করিয়া? ‘প্ৰভু’ কোন দেবতা-বিশেষের নাম নহে, উহা পরমেশ্বরের উপাধিমাত্র। সংস্কৃত কোষে উহার ব্যাখ্যা ‘নিগ্রহানুগ্রহসমর্থ’, অর্থাৎ কোরানে ঈশ্বরের “রব-উল-আলমীন্ “ বলিয়া যে-উপাধি আছে, ঠিক তাহার অনুবাদ।
এই দারার জীবনী লিখিবার অনেক সমসাময়িক উপাদান বিদ্যমান আছে। এমন কি তিনি প্রিয় পত্নী নাদিরাবানুকে যে ছবির বই উপহার দেন তাহা ব্রিটিশ মিউজিয়মে আশ্রয় পাইয়াছে, এবং তাহা হইতে কয়েকখানি অতি মনোহর চিত্র V.A. Smith’s History of Fine Art in India and Ceylona মুদ্রিত হইয়াছে। তাঁহার জীবনের বিষাদময় অবসান দুখানি অ-সরকারী ফার্সী ইতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে– (ক) মাসুমের সূজা চরিত্র এবং (খ) পদ্যে আউরঙ্গ নামা। আর জয়পুর দরবারে পঞ্চাশেরও অধিক দারার লেখা পত্র পাইয়াছি।
[প্রবাসী, ভাগ ২৬, খণ্ড ১, সংখ্যা ১, বৈশাখ, ১৩৩৩।]