কুমারের বাঘা গোয়েন্দা
প্রথম – ট্রেনের উপরে হানা
সন্ধ্যা হয়—হয়।
সূর্য অস্ত গিয়েছে, কিন্তু তার সমুজ্জ্বল ও আরক্ত আশীর্বাদের কিছু—কিছু আভাস এখনও দেখা যাচ্ছে আকাশের এখানে—ওখানে, মেঘের ফাঁকে—ফাঁকে।
যাকে বলে তেপান্তরের মাঠ। ধু—ধু—ধু—ধু ময়দানের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে বন্য বাতাস হু—হু—হু—হু! এবং সেই বন্য বাতাসের গতিকে অনুসরণ করবার জন্যেই যেন বাঁধা লাইনের উপর দিয়ে তীব্র বেগে ধেয়ে চলেছে একখানা রেলগাড়ি।
ছুটতে ছুটতে ট্রেনখানা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল—সম্ভবত ট্রেনের বিপদসূচক ঘণ্টার দড়িতে টান মেরে রেলগাড়িকে কেউ থামাতে বাধ্য করলে।
তারপরেই একটা হই—হই—রই—রই কাণ্ড!
ঠিক যেন কোনও অদৃশ্য জাদুকরের আশ্চর্য মন্ত্রশক্তিবলে আচম্বিতে প্রায় শতাধিক মনুষ্য—মূর্তি আবির্ভূত হল সেই বিজন তেপান্তর মাঠের উপরে। তারা যে এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল, তা অনুমান করাও অসম্ভব। তাদের প্রত্যেকেই সশস্ত্র। অনেকেরই হাতে রয়েছে বন্দুক বা রিভলভার এবং যাদের আগ্নেয়াস্ত্র নেই তাদেরও হাতে আছে ভয়াবহ বর্শা, তরবারি, কুঠার বা মোটামোটা লোহা—বাঁধানো বাঘ—মারা লাঠি।
তারা সবাই বেগে ছুটে গেল ট্রেনের দিকে। তারপরই সেই বিজন মাঠের নিদ্রাতুর নিস্তব্ধতা হঠাৎ যেন আর্তনাদ ও ছটফট করে উঠল ঘন—ঘন বন্দুকের শব্দে, বহু মনুষ্য—কণ্ঠের হুঙ্কারে এবং আর্ত চিৎকারের পর চিৎকারে!
সেই ট্রেনেরই একটি কামরায় বসেছিল বিমল এবং কুমার। কলকাতা ছেড়ে তারা কোনও জমিদার—বন্ধুর নিমন্ত্রণ রাখতে চলেছে। কিন্তু এই আকস্মিক গোলমাল শুনে তারা দুটো জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলে। মিনিট—খানেক এদিক—ওদিক দৃষ্টিচালনা করে কুমার শুধোলে, ‘এ আবার কী কাণ্ড বিমল?’
বিমল বললে, ‘কাণ্ডটা অনুমান করা একটুও কঠিন নয়। একদল ডাকাত লুটপাট করবার জন্যে ট্রেনখানাকে আক্রমণ করেছে! তাদেরই দলের কোনও লোক গাড়ির ভিতরে ছিল, নির্দিষ্ট স্থানে এসে হঠাৎ ‘অ্যালার্ম চেন’ টেনে গাড়িখানাকে থামিয়ে দিয়েছে।’
দলে—দলে লোক বিকট চিৎকার ও অস্ত্রশস্ত্র আস্ফালন করতে করতে বেগে ছুটে আসছে তাদের কামরার দিকেই!
কুমার বললে, ‘এখন আমাদের কী করা উচিত?’
বিমল তাড়াতাড়ি কামরার অন্যদিকের একটা জানালার কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললে, ‘এদিকটা দেখছি একেবারেই নির্জন। এসো কুমার, জানালা দিয়ে গলে মারো লাফ বাইরের দিকে!’
বিমলও তাই করলে, কুমারও তাই করলে। তারপর তারা দুজনে দ্রুতপদে উঁচু রেলপথ ছেড়ে ঢালু জমির উপর দিয়ে নেমে নীচের মাঠের উপরে গিয়ে পড়ল।
কুমার বললে, ‘ট্রেন তো ছাড়লুম। এখন যাই কোনদিকে?’
বিমল বললে, ‘দিগবিদিক—জ্ঞানহারা হয়ে ছুটে চলো এই মাঠের উপর দিয়ে। এই বিপজ্জনক রেলপথ ছেড়ে যত দূরে গিয়ে পড়তে পারি ততই ভালো!’
সামনেই ছিল একটা মস্ত—বড়ো ঝুপসি অশথগাছ। তারই উপরের কোনও ডাল থেকে হঠাৎ কে পেত্নির মতন রোমাঞ্চকর ও খনখনে কণ্ঠস্বরে খল—খল অট্টহাস্য করে বলে উঠল, ‘আরে বিমল, আরে কুমার, পালিয়ে যাবে কোথায়? এত সহজে অবলাকান্তকে ফাঁকি দেওয়া চলে না!’
বিমল এবং কুমার সচমকে ও সবিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে গাছের উপরদিকে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে দেখল! পরমুহূর্তেই সেই বৃহৎ বৃক্ষটা করলে যেন দলে—দলে মনুষ্য বৃষ্টি!
পিছনদিকে উঁচু রেলপথ ও ট্রেন ও দস্যুদল এবং সামনের দিকেও এই আকস্মিকভাবে আবির্ভূত শত্রুর দল! বিমল আর কুমারের পালাবার কোনও পথই আর খোলা রইল না।
একটা কৃষ্ণবর্ণ, সুদীর্ঘ ও বলিষ্ঠ মূর্তি চকচকে রিভলভার হাতে করে বিমলের সামনে এগিয়ে এসে আবার খিলখিল করে হেসে উঠে ব্যঙ্গপূর্ণ কণ্ঠে বললে, ‘মহামহিমার্ণব বিমলবাবু, অধীনকে চিনতে পারছেন কি?’
বিমল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে শান্ত কণ্ঠেই বললে, ‘চিনতে পারছি বইকী! তুমি হচ্ছ অবলাকান্ত, পৃথিবীর একটা নিতান্ত নিকৃষ্ট কীট।’
অবলাকান্ত তার সেই অস্বাভাবিক নারীকণ্ঠে আবার একবার অট্টহাস্য করে উঠল। তারপর হাতের রিভলভারটা নাচাতে—নাচাতে বললে, ‘কে যে নিকৃষ্ট আর কে যে উৎকৃষ্ট এখনও তার প্রমাণ কি পাওনি বাপু? সেই ‘জেরিনার কণ্ঠহারে’র* মামলার সময় থেকেই বারবার তোমরা আমাকে আক্রমণ করবার চেষ্টা করেছ। কিন্তু কোনও বারেই তোমাদের আক্রমণ সফল হয়নি। উলটে প্রত্যেক বারেই আমি তোমাদের নাজেহাল করে নাকের জলে আর চোখের জলে এক করে ছেড়েছি। কেমন, এ—কথা মানতে রাজি আছ কি?’
বিমল মাথা নেড়ে বললে, ‘মোটেই নয়। তুমি তোমার ওই ক্ষুদ্র প্রাণ নিয়ে বারবার আমাদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করেছ—এইমাত্র! যতবারই তুমি ফাঁদ পেতেছ, ততবারই আমরা সেই ফাঁদ ভেঙে বাইরে আসতে পেরেছি। জেরিনার কণ্ঠহারের কথা বলছ? তোমার হাত থেকে আমরা কি সেটা ছিনিয়ে নিতে পারিনি?’
অবলাকান্তের সেই বৃহৎ দেহ বিপুল ক্রোধে ফুলে যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। নিজের একটিমাত্র চক্ষুর ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড অগ্নিবর্ষণ করে সচিৎকারে সে বললে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যাঁ! সেইজন্যেই তো তোদের সকলকার ওপরে আমার এমন জাতক্রোধ! আমার নিজের কথা বলছিস? আমাকে তোরা ধরবি কী রে, আমার যখন খুশি তোদের খোকার মতন ভুলিয়ে ফাঁকি দিতে পারি! কিন্তু জেরিনার কণ্ঠহার—জেরিনার কণ্ঠহার! হ্যাঁ, তোদের জন্যেই আমি হারিয়েছি জেরিনার কণ্ঠহার! সে দারুণ দুঃখ এ—জীবনে আমি আর ভুলব না!’
বিমল মৃদু—মৃদু হাসি হেসে বললে, ‘বেশ, সেই দুঃখ নিয়েই ইহলোকে তুমি তোমার পাপজীবন যাপন করো, তাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু আজকের এই ঘনঘটার অর্থটা কী?’
—’অর্থ? হুঁ, অর্থের ভিতরেই আছে অনর্থ! তোদের ওপরে আমি বরাবরই নজর রেখেছি। তোরা যে আজ এই ট্রেনে আসবি সে—খবরও আমি পেয়েছি যথাকালেই! আমি কেবল এই ট্রেনখানাকে আক্রমণ করতে আসিনি, আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তোদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা!’
কুমার হাসতে—হাসতে বললে, ‘আমরা হচ্ছি তুচ্ছ ব্যক্তি। মনে আছে, বিমল তোমাকে প্রথমে আক্রমণ করেনি, প্রথম আক্রমণ করেছিলে তুমিই তাকে? তবে আমাদের ওপরে এতটা সুনজর দেওয়ার কারণটা কী?’
অবলাকান্ত ভুরু নাচিয়ে বললে, ‘কারণ? কারণ নিশ্চয়ই আছে! তোরা আর জয়ন্তরা যতদিন বেঁচে থাকবি, ততদিন আমি এই পৃথিবীতে নিরাপদ নই! তোদের আমি তিল—পরিমাণ তুচ্ছ লালপিঁপড়ের মতনই মনে করি। কিন্তু জানিস তো, ক্ষুদ্র লালপিঁপড়েও কামড়ালে মানুষ তাকে বধ না করে পারে না? সেইজন্যেই আগে আমি তোদের ক—জনকে এই পৃথিবী থেকে একেবারে সরিয়ে দিতে চাই।’
বিমল বললে, ‘তুমি তো বারবার নতুন—নতুন উপায়ে আমাদের পৃথিবী থেকে সরাবার চেষ্টা করেছ। কিন্তু পেরেছ কি?’
অবলাকান্ত আবার খলখলে অট্টহাসি হেসে বললে, ‘ঠিক বলেছিস! ধরলুম আর মারলুম, এভাবে মানুষ মেরে আমার হাতের সুখ হয় না। যদি শত্রুর মতন শত্রু পাই, নতুন—নতুন উপায়ে তাকে বধ করতে পারলেই সীমা থাকে না আমার আনন্দের!’
কুমার বললে, ‘এবারেও একটা নতুন উপায়েই আমাদের হত্যা করবে নাকি?’
—’নিশ্চয়!’
—’উপায়টা কী দাদা?’
—’আগে থাকতে বলবার দরকার কী? একটু পরেই স্বচক্ষে আর স্বকর্ণে সমস্তই দেখতে আর শুনতে পাবি!’ অবলাকান্ত হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে তার অনুচরদের ডেকে বললে, ‘এই! তোরা সঙের মতন দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বন্দুকের পাহারার ভিতরে রেখে এই দুটো ছুঁচোকে আমাদের আড্ডার দিকে নিয়ে চল!’
দ্বিতীয় – সাঁকোর উপরে অভিনয়
বহু—বহুদূর থেকে শোনা গেল একটা বংশীধ্বনি।
তারপর আরও কাছ থেকে শোনা গেল আর একটা বাঁশির তীক্ষ্ন আওয়াজ!’
তারপর খুব নিকটেই জেগে উঠল তীক্ষ্নতর আর একটা বংশীধ্বনি!
অবলাকান্ত ব্যস্তভাবে বললে, ‘এসব বাঁশি বাজাচ্ছে আমাদের চররাই! খুব সম্ভব পরের স্টেশনের কর্তাদের টনক নড়েছে, আর ব্যাপার কী জানবার জন্যে এদিকে ছুটে আসছে রেলওয়ে পুলিশের দল! ব্যাস, আর নয়, এইবারে সময় থাকতে—থাকতে জাল গুটিয়ে ফেল!’ বলেই পকেট থেকে নিজে একটা বাঁশি বার করে খুব জোরে উপর—উপরি তিনবার ফুঁ দিলে!
পরমুহূর্তেই ট্রেনের এদিক—ওদিক থেকে দলে দলে সব যমদূতের মতন মূর্তি দ্রুতবেগে অবলাকান্তের কাছে এসে তার চারিদিক ঘিরে দাঁড়াল! তাদের হাতে কেবল অস্ত্রশস্ত্র নেই, সেই সঙ্গে অধিকাংশেরই কাঁধ বা পিঠের উপরে রয়েছে পোঁটলা—পুঁটলি, ব্যাগ, সুটকেস বা ‘ট্রাঙ্ক’ প্রভৃতি। নরহত্যা ও ট্রেন লুণ্ঠন করেই তারা যে হতভাগ্য যাত্রীদের এইসব মালপত্তর হস্তগত করেছে, সে—বিষয়ে নেই কোনওই সন্দেহ।
সকলকার দিকে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি—সঞ্চালন করে নিয়ে অবলাকান্ত অত্যন্ত প্রফুল্ল কণ্ঠে বললে, ‘বাহাদুর, তোরা সবাই বাহাদুর। দেখছি আজ আমাদের এক ঢিলে দুই—পাখি মারা উৎসব ষোড়শোপচারে সুসম্পন্ন হল! আর দেরি নয়! এই দুটো ব্যাটা নচ্ছারকে একেবারে সামনের দিকে রেখে গোরু—তাড়ানোর মতন তাড়িয়ে নিয়ে চল! এদের ঠিক পিছনেই দুজন লোক বন্দুক নিয়েই তৈরি হয়ে থাকুক। কেউ পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করে তাকে মেরে ফেলা হবে। সবাই মনে রাখিস, এরা হচ্ছে পাঁড়ঘুঘু, অসম্ভব রকম সব চালাকি জানে।’
ঠিক অবলাকান্তের হুকুম মতোই ব্যবস্থা হল। মাঠের উপর দিয়ে সর্বাগ্রে অগ্রসর হতে বাধ্য হল বিমল এবং কুমার। দুজন লোক বন্দুক তুলে চলল তাদের পিছনে—পিছনে। এবং তাদের পরে আসতে লাগল প্রায় শতাধিক ডাকাদের দল, বিপুল আনন্দে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে।
অবলাকান্ত ক্রুদ্ধকণ্ঠে ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘এইসব সব গাধার দল! সবাই একেবারে চুপ করে থাক! কেউ যদি টু—শব্দটি করবি, আমি তখনই গলা টিপে তাকে মেরে ফেলব! ব্যাটারা ষাঁড়ের মতন চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে আর পৃথিবী জাগাতে জাগাতে পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে! ওদিকে যে পুলিশের টনক নড়েছে সে—খেয়াল কারুর নেই!’
বিমল বললে, ‘অবলাকান্ত, তুমি আগে ছিলে গুন্ডা আর চোর! তারপর হয়েছিলে সুন্দরবনের নদী—নালার খুনে বোম্বেটে! তারপর আজ তোমাকে দেখছি লুণ্ঠনকারী দস্যুরূপে! এরপর তোমাকে আর কোন মূর্তিতে দেখতে পাব, সেটা আমি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছি না!’
নারীকণ্ঠ অবলাকান্ত হো—হো স্বরে হেসে উঠে বললে, ‘ওরে বিমল, ভোল না ফেরালে ভিখ মেলে কি? তোদের উৎপাতে কলকাতা শহর ছাড়তে হল! গেলুম সুন্দরবনে জলের বাসিন্দা হতে। সেখানে গিয়েও তোরা নাক গলাতে ছাড়লি না! কাজেই আমি এখন আবার নতুন কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছি! আমি হচ্ছি পারার মতন পিচ্ছিল, ধরি—ধরি করেও তোরা আমাকে কোনওদিনও ধরতে পারবি না!’
তখন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে সন্ধ্যা। প্রান্তরের দিকে দিকে নেমে এসেছে নিবিড় অন্ধকারের কালো যবনিকা। বাসায় ফিরে—যাওয়া পাখিদের কলবর পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে শোনা যাচ্ছে কেবল ঝিল্লিদের কর্কশ কণ্ঠের অবিশ্রান্ত ধ্বনি!
বোধহয় সেদিন আকাশে উঠেছিল অষ্টমীর চাঁদ। তার স্বল্প কিরণে অন্ধকারের নিবিড়তা খানিকটা পাতলা হয়ে গেল এবং সেই ম্লান আলোকেই দেখা গেল সামনেই রয়েছে একটি সাঁকো এবং তার তলায় শোনা যাচ্ছে কোনও নদীর কলকণ্ঠ স্বর।
বিমল আর কুমার সর্বাগ্রে সাঁকোর উপর গিয়ে দাঁড়াল।
হঠাৎ বিমল অনুচ্চকণ্ঠে তামিল ভাষায় কুমারকে সম্বোধন করে বললে, ‘কুমার, আমি যেই ‘পুলিশ’ বলে চিৎকার করে উঠব, তুমি তখনই এই সাঁকোর উপর থেকে নদীর উপরে মারবে এক লাফ! তারপর জলের উপরে আর না মাথা জাগিয়ে ডুব—সাঁতার দিয়ে চলে আসবে ঠিক এই সাঁকোর তলায়। আমিও তোমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকব। তারপর যা করতে হবে যথাসময়েই বলে দেব।’
পিছন থেকে অবলাকান্ত খাপ্পা হয়ে বলে উঠল, ‘তোরা ইন্ডিল—মিন্ডিল করে কী কথা কইছিস রে?’
বিমল বললে, ‘আমরা কইছি নিজেদের কথা।’
—’নিজেদের কথা? কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন?’
—’সেটা তোমার বিদ্যা—বুদ্ধির দোষ, আমরা কী করব বলো?’
—’খবরদার! তোরা আর কোনও কথাই কইতে পারবি না!’
—’যো হুকুম, জনাব!’
তারা তখন সাঁকোর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় এসে পড়েছে।
বিমল আচম্বিতে পিছনপানে তাকিয়ে প্রচণ্ড উল্লাস—ভরা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘পুলিশ! পুলিশ! কুমার, আর আমাদের ভয় নেই! পিছনদিকে তাকিয়ে দ্যাখো দলে দলে পুলিশের লোক এইদিকে ছুটে আসছে! জয় ভগবান!’
অপরাধীদের কাছে ‘পুলিশ’ নামের চেয়ে ভয়াবহ আর কিছুই নেই। বিমলের সেই উল্লসিত উক্তি শুনেই দস্যুদলের সবাই সচমকে আত্মহারার মতন পিছনদিকে ফিরে দাঁড়াল!
—এবং সেই সুযোগে বিমল ও কুমার সাঁকো থেকে লাফ মেরে নদীর জলের ভিতরে গিয়ে পড়ল!
ডুব—সাঁতার দিয়ে তারা দুজনে ঠিক সাঁকোর তলায় গিয়ে আবার জলের উপরে ভেসে উঠল। এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনলে উপর—উপরি বন্দুকের গর্জন!
বিমল বললে, ‘ছুড়ুক ওরা বন্দুক! স্বভাবতই ওরা ভাববে আমরা নদীর এদিক বা ওদিক দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছি! কিন্তু কুমার, আমরা তা করব না! আমরা এই সাঁকোর তলা দিয়েই বারংবার ডুব—সাঁতার কেটে যে—দিক থেকে এসেছি, আবার সেই দিকেই চলে যাব! তারপর পায়ের কাছে যখন মাটি পাব, সেইখানেই আমরা গোপনে অপেক্ষা করব কিছুক্ষণ। সাঁকোর তলাটা ওরা দেখতে পাচ্ছে না। আর ওরা কল্পনাও করতে পারবে না যে, যেদিক থেকে আমরা এসেছি, আমরা আবার সেইদিকেই ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করছি।’
এক—একবার ভেসে উঠে নিঃশ্বাস নিয়েই আবার ডুব—সাঁতার দিতে দিতে তারা হাজির হল সাঁকোর প্রান্তদেশে।
সাঁকোর তলায় নদীর জলের উপর বিরাজ করছে কালো ছায়া। সেইখানে তারা জলের উপরে কেবল নাক পর্যন্ত জাগিয়ে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে চুপ করে বসে রইল। সেই অবস্থায় থেকে তারা শুনতে পেলে বহু দ্রুতপদের শব্দ, চিৎকার এবং মাঝে মাঝে বন্দুকের আওয়াজ।
তারপরেই শোনা গেল অবলাকান্তের খনখনে কণ্ঠস্বর! সে বলে উঠল, ‘ওরে, দরকার নেই আর এখানে গোলমাল করে! ওই হতভাগা ব্যাটাদের নিয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে বেশি মাথা ঘামাতে গেলে এখনই সত্য—সত্যই পুলিশ—ফৌজ এসে পড়বে! তার চেয়ে হাতে যা পেয়েছিস তাই নিয়েই এখন তাড়াতাড়ি লম্বা দেবার চেষ্টা কর!’
তৃতীয় – ঈশ্বর—প্রেরিত বৃষ্টি
তখন সবে প্রাতরাশ শেষ হয়েছে। সুন্দরবাবু মস্ত বড়ো একটা ‘বার্মা—সিগার’ ধরালেন। জয়ন্ত আলমারির ভিতর থেকে অপরাধতত্ত্ব সম্বন্ধে একটা বই নিয়ে আবার নিজের সোফায় এসে বসল। মানিক টেনে নিলে খবরের কাগজখানা।
হঠাৎ সিঁড়ির উপর শোনা গেল একাধিক ব্যক্তির দ্রুত পদশব্দ। জয়ন্ত হাতের বইখানা সামনের টেবিলের উপর রেখে মানিকের দিকে তাকালে জিজ্ঞাসু চোখে। মানিক তাকিয়ে রইল ঘরে ঢোকবার দরজার দিকে।
ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল বিমল এবং কুমার। তাদের দুজনেরই চেহারা ছন্নছাড়ার মতো।
সুন্দরবাবু তাঁর মস্ত চুরোটে একটা জোর টান দিতে—দিতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বিমল এবং কুমারের দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘হুম!’
জয়ন্তও তাড়াতাড়ি আসন ত্যাগ করে অত্যন্ত বিস্মিত স্বরে বলে উঠল, ‘বিমলবাবু, কুমারবাবু! আপনাদের এ কী চেহারা? কী হয়েছে? আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’
বিমল অত্যন্ত শ্রান্তভাবে একখানা চেয়ারের উপরে ধপাস করে বসে পড়ে বললে, ‘আমরা আসছি যমালয় থেকে।’
—’মানে?’
—’মানে হচ্ছে এই যে, আমরা আবার গিয়ে পড়েছিলুম সেই অবলাকান্তের পাল্লায়।’
সুন্দরবাবু ধড়মড় করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর হাতের চুরোটটা দূরে নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন, ‘বলেন কী, আপনারা আবার অবলাকান্তের দেখা পেয়েছেন নাকি?’
—’পেয়েছি বইকী! যথেষ্ট রূপেই পেয়েছি।’
—’হুম!’
—’আর একদিন অবলাকান্তের পাল্লা থেকে মুক্তি পেয়ে আপনি যেমন এইখানে এসেই হাজির হয়েছিলেন, আমরাও আজ এসেছি তেমনি ভগ্নদূতরূপেই।’*
সুন্দরবাবু মুখব্যাদান করে প্রায় দুই—তিন সেকেন্ড অবাক হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘অবলাকান্ত আবার সুন্দরবনের নদীতে নদীতে নৌবিহার আরম্ভ করেছে নাকি?’
—’না, এবারে সে সুন্দরবনের বাইরে স্থলপথে আবির্ভূত হয়ে রেলগাড়ি লুণ্ঠন করেছে। সেই গাড়িতেই ছিলুম আমরা, আমাদেরও সে গ্রেপ্তার করেছিল। রেলগাড়ি লুণ্ঠন বা আমাদের গ্রেপ্তার করা, কোনটা ছিল যে তার মুখ্য উদ্দেশ্য, সেকথা আমরা ঠিক করে বলতে পারি না।’
মানিক দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললে,’ বলেন কী মশাই? অবলাকান্ত আপনাদেরও গ্রেপ্তার করেছিল? কিন্তু আপনারা মুক্তি পেলেন কেমন করে?’
বিমল হাসতে হাসতে বললে, ‘চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে।’
—’কী—রকম?’
—’তাহলে আগে সব কথা শুনুন।’
তারপরে বিমল যে কাহিনি বললে, পাঠকদের কাছে তার অধিকাংশই বলেছি প্রথম পরিচ্ছেদে। কাজেই সেসব কথার আর পুনরুক্তি না করে এখানে কেবল তারপরের ঘটনা বিমলের ভাষাতেই তুলে দেওয়া হল :
‘সাঁকোর আচ্ছাদন মাথার উপরে রেখে আমি আর কুমার বারংবার ডুব—সাঁতার কাটতে কাটতে, যে—দিক থেকে এসেছিলুম সাঁকোর ঠিক সেই প্রান্তে গিয়ে পায়ের তলায় খুঁজে পেলুম পৃথিবীর মাটি।
‘যে—কারণেই হোক, অবলাকান্ত তার দলবল নিয়ে আমাদের আর পুনরাবিষ্কার করবার চেষ্ট করলে না। খুব সম্ভব বেশি খোঁজাখুঁজি করবার সময় তার হাতে ছিল না, কেননা সেখানে রেলওয়ে—পুলিশের এসে পড়বার সম্ভাবনা ছিল যে—কোনও মুহূর্তেই। সাঁকোর উপরে ব্যস্ত পদশব্দ শুনে বুঝতে পারলুম, ডাকাতের দল দ্রুতবেগে ছুটে চলে গেল নদীর অন্য পারের দিকে।
‘ঠিক সেই সময়েই নামল ঝমঝম করে প্রবল বৃষ্টির ধারা। সেই বৃষ্টিকে আমার মনে হল স্বর্গের অভাবিত আশীর্বাদের মতন। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, অবলাকান্ত তার দলবল নিয়ে আজ পালিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু তার গুপ্ত আস্তানা আবিষ্কার করতে আমাদের আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না।’
জয়ন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমিও বুঝতে পেরেছি বিমলবাবু। সত্যসত্যই এ বৃষ্টি হচ্ছে ঈশ্বর—প্রেরিত।’
সুন্দরবাবু অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘এই রে! দুই পাগলে আবার হেঁয়ালি শুরু করলে! বৃষ্টি তো চিরকালই ঈশ্বর—প্রেরিত হয়। কিন্তু বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অবলাকান্তের আড্ডার সম্পর্কটা কী বাবা? হুম, তোমাদের কথার কিচ্ছু মানে হয় না।’
বিমল ও জয়ন্ত কোনও উত্তর না দিয়ে হাসতে লাগল।
কুমার বললে, ‘সুন্দরবাবু, বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অবলাকান্তের আস্তানার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। শুনেছেন তো, সে তার দলের শতাধিক লোক নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে বটে, কিন্তু তারা পাখি নয়, তারা হচ্ছে মানুষ।’
—’হুম, তারা যে পাখি নয় সেকথা আমিও জানি। আপনি আবার একটা নতুন হেঁয়ালির সৃষ্টি করলেন। এখানে হঠাৎ পাখির কথা উঠল কেন?’
—’অবলাকান্তরা হচ্ছে মানুষ। পাখির মতন তারা শূন্যপথ দিয়ে উড়ে পালাতে পারে না। স্থলপথ দিয়ে তাদের পালাতে হবেই, আর তাদের যেতে হবে এই পৃথিবীর মাটি মাড়িয়েই! এইবারে কিঞ্চিৎ আলোকিত হলেন কি?’
—’মোটেই নয়, মোটেই নয়! দুই চক্ষে আমি দেখছি গভীর অন্ধকার!’
মানিক সকৌতুকে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি যে অন্ধকারের বন্ধু সেটা আমরা চিরদিনই জানি! কিন্তু দয়া করে আজ একটিবার কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে সমস্ত ব্যাপারটা তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করুন না কেন?’
—’কী আবার বোঝবার চেষ্টা করব? আমি তোমাদের হেঁয়ালির কোনও ধারই ধারি না। ধাঁধার জবাব দেবার বয়েস আমার নেই।’
জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি ঠিক বালকের মতন কথা বলছেন। আপনার মতন পুরাতন পুলিশ—কর্মচারীর বোঝা উচিত যে, বৃষ্টিপাতের ফলে মাঠ হয় কর্দমাক্ত। আর সেই ভিজে মাটির উপরে যারা পদচালনা করে যাবে, পৃথিবী তাদের সকলেরই পদচিহ্ন রক্ষা করবে সযত্নে। আমরা যদি অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হতে পারি, তাহলে সেইসব পদচিহ্নের অনুসরণ করে অনায়াসেই খুঁজে বার করতে পারব ডাকাতদের গোপন আস্তানা। এখনও আমাদের কথা হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে কি?’
সুন্দরবাবু দুই চক্ষু ভাঁটার মতন করে তুলে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি ভাই জয়ন্ত, বুঝতে পেরেছি! এইবারে আমি স্বীকার করছি, এতক্ষণ আমি একটা আস্ত গাধার মতন কথা বলছিলুম! ঠিক বলেছ, ওই বৃষ্টিই অবলাকান্তের হাতে পরিয়ে দেবে চকচকে লোহার হাতকড়ি।’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘কিন্তু আমাদের হাতে আর মোটেই সময় নেই। মাঠের উপর দিয়ে কত মানুষ কত জন্তু চলে বেড়ায়। আমরা যেসব পদচিহ্ন অনুসরণ করতে চাই, সেগুলো অদৃশ্য হতে বেশি দেরি লাগবে না। সুতরাং—’
বিমলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘সুতরাং অবিলম্বেই আমাদের ঘটনাস্থলে যাত্রা করা উচিত।
‘বিমলবাবু, ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছোতে আমাদের কত দেরি লাগবে?’
—’ঘণ্টা আড়াই। কিন্তু যে ট্রেন আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে, এখনও দেড় ঘণ্টার আগে সে কলকাতার স্টেশন ত্যাগ করবে না। ইতিমধ্যে আপনারাও প্রস্তুত হয়ে নিন, আমি আর কুমারও এই জামা—কাপড় ত্যাগ করে খানিকটা ভদ্রলোক সাজি আর কিঞ্চিৎ আহার্য গ্রহণ করে খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠি, কী বলেন?’
জয়ন্ত বললে, ‘তথাস্তু। সুন্দরবাবু, আপনিও আমাদের সঙ্গে যাবেন নাকি?’
—’হুম। যাব না আবার? ওই অবলাকান্ত ব্যাটা সুন্দরবনের নদীতে—নদীতে আমাকে নাকানি—চোবানি খাইয়েছে। তার আগে আর পরেও সে আমাদের কম জ্বালিয়ে মারেনি। তাকে হাতের কাছে পেলে আমি তার আস্ত মুন্ডুটা চিবিয়ে খেতে আপত্তি করব না। আমি এখনই বড়োসায়েবের কাছে ছুটলুম, অবলাকান্তরা দলে খুব ভারী শুনছি, সঙ্গে মিলিটারি পুলিশ থাকা দরকার।’
কুমার বললে, ‘আর আপনাদের ওই মিলিটারি পুলিশের চেয়েও বেশি কাজ করতে পারবে আমাদের প্রিয়তম বাঘা। পদচিহ্নর গন্ধ শুঁকতে সে হচ্ছে মস্তবড়ো ওস্তাদ! কী বলো বিমল, তাকেও সঙ্গে নেওয়া উচিত নয় কি?’
বিমল গাত্রোত্থান করে বললে, ‘নিশ্চয়, সেকথা আবার বলতে!’
চতুর্থ – ঝরা ঘেসো ফুল
বিমল ও জয়ন্ত প্রভৃতি সদলবলে যখন আবার সেই নদী এবং সেতুর কাছে এসে দাঁড়াল, বেলা তখন চারটে বেজে গেছে।
সেতু পার হয়ে তারা নদীর অন্য তীরে গিয়ে উপস্থিত হল। সর্বাগ্রে মহা আনন্দে লাফাতে লাফাতে ছুটে যাচ্ছে বাঘা, বোধহয় সে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে, আজ আবার কোনও একটা নতুন অভিযানের সূত্রপাত হবে।
বাঘার পরেই ছিল বিমল এবং জয়ন্ত। সেতুর অন্য প্রান্তে গিয়ে জয়ন্ত চেঁচিয়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু, পুলিশ—ফৌজ এখন সাঁকোর উপরই অপেক্ষা করুক। এখানকার মাটির উপরে আমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে যত কম লোকের পদচিহ্ন পড়ে ততই ভালো।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কিন্তু আজ সারাদিন ধরে এই সাঁকোর উপর দিয়ে স্থানীয় কত লোক যে আনাগোনা করেছে, তুমি কি সেটা হিসাব করে বলতে পারো?’
জয়ন্ত একবার মাঠের মাটির উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, ‘বিমলবাবু, যারা ট্রেন আক্রমণ করেছিল তাদের পায়ে জুতো ছিল কি না বলতে পারেন?’
বিমল বললে, ‘আমি যত লোককে দেখেছি তাদের কারুরই পা খালি ছিল না।’
জয়ন্ত বললে, ‘এ জায়গাটা দেখছি বেশ নির্জন। এখানে কাদার উপরে যতগুলো পায়ের দাগ রয়েছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে খালি পায়ের দাগ। কয়েকটা জুতো—পরা পায়ের দাগও রয়েছে বটে, কিন্তু ওগুলো ডাকাতদের পায়ের দাগ নয় বলেই মনে হচ্ছে।’
বিমল বললে, ‘আমারও সেই বিশ্বাস।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এ—রকম বিশ্বাসের কারণ কী কিছুই বুঝতে পারছি না। আসামিদের জুতোর দাগের ওপর কি ‘ডাকাত’ কথাটা ছাপ মারা থাকবে?’
জয়ন্ত বললে, ‘না সুন্দরবাবু, তা থাকবে না। কিন্তু আমি এখানে ডাকাতদের পায়ের দাগ দেখবার আশাই করি না।’
—’কেন? তারা সাঁকোর ওপর থেকে মাটিতে পা না ফেলে পাখির ঝাঁকের মতন কি হুস করে উড়ে পালিয়েছে?’
—’তাও নয়। কিন্তু আমি বিমলবাবুর মুখে শুনেছি, ডাকাতরা সাঁকো পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। তখনও এখানকার মাটি ভালো করে ভিজতে পারেনি, তাই এখানে ডাকাতদের পায়ের দাগ আবিষ্কার করা সম্ভবপর নয়। ডাকাতদের দলে লোক ছিল নাকি শতাধিক। অতগুলো লোক এই মাঠের উপর দিয়ে যখন একসঙ্গে অগ্রসর হয়েছে, তখন আর কিছুদূর এগুলে আমরাও তাদের পদচিহ্ন নিশ্চয়ই খুঁজে বার করতে পারব। এখানে যেসব পথিক পায়ের দাগ রেখে গিয়েছে, বৃষ্টি আসবার অনেক পরেই তাদের আবির্ভাব হয়েছিল।’
মাঠের উপর দিয়ে সকলে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে আবার থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখান থেকে আরম্ভ হয়েছে পুরু ঘাস—ভরা জমি। এতক্ষণ কাদার উপরে যেসব পথিকের পায়ের দাগ দেখা যাচ্ছিল, সেগুলো পায়ে—চলা মেটে পথ ধরে সেইখান থেকে বেঁকে ডানদিক ধরে বরাবর চলে গিয়েছে। কিন্তু সে পথের উপরে তখনও কোনও বৃহৎ জনতার পদচালনার চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল না।
সুন্দরবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘কী আশ্চর্য, ডাকাতগুলো তবে কি সত্যিসত্যিই মাটিতে পদার্পণ না করেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে! কী হে জয়ন্ত, কাল বৃষ্টি পড়েছিল বলে তোমরা তো খুব খুশি হয়ে উঠেছিলে, কিন্তু এখন কোথায় গেল ডাকাতদের পায়ের দাগ?’
জয়ন্ত বললে, ‘আপনারা এখানেই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করুন, মাঠের ঘাসের উপর দিয়ে আমি একবার এদিক—ওদিক ঘুরে আসি।’ বলেই সে মুখ নামিয়ে নতদৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকিয়ে মাঠের উপর দিয়ে নানাদিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। মাঝে মাঝে সে আবার মাটির উপরে বসে পড়ে এবং কখনও—বা দস্তুরমতন হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! দ্যাখো একবার জয়ন্তের কাণ্ড! মাঠের উপরে হামাগুড়ি দিয়ে ও কী করছে বলো দেখি মানিক?’
মানিক বললে, ‘বোধহয় ঘাস খাবার চেষ্টা করছে।’
হঠাৎ দূর থেকে জয়ন্ত সানন্দে চেঁচিয়ে উঠে বললে, ‘পেয়েছি, পেয়েছি! আপনারা সবাই এইখানে আসুন।’
সকলে যখন তার কাছে গিয়ে হাজির হল, জয়ন্ত প্রফুল্লভাবে বললে, ‘গোড়াতেই আমি আন্দাজ করেছিলুম যে, কাঁচা মেটে পথ দিয়ে নিরীহ মানুষরা আনাগোনা করে, ডাকাতরা নিশ্চয়ই সে পথের পথিক হবে না। কারণ, কাছাকাছি কোনও লোকালয়ে নিশ্চয়ই তাদের আস্তানা নেই। অপথ, বিপথ কিংবা কুপথ দিয়ে তারা নিশ্চয়ই যাবে এমন কোনও বিজন নিরালা জায়গায়, যেখানে পৃথিবীর সাধারণ লোকের দৃষ্টি থেকে সহজেই নিজেদের আড়ালে রাখা যায়। এই পথহীন মাঠের উপরে আমি তাদের পদচিহ্ন আবিষ্কার করেছি। এই দেখুন!’ সে মাঠের উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে।
সুন্দরবাবু এধারে—ওধারে দৃষ্টি চালনা করে বললে, ‘ধ্যাত, যতসব বাজে কথা! কোথা এখানে পায়ের দাগ?’
জয়ন্ত বিমলের দিকে ফিরে বললে, ‘আপনি কিছু বুঝতে পারছেন কি?’
বিমল হেসে বললে, ‘পারছি বইকী! এখানকার ঘাসের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে অনেক লোক এগিয়ে গিয়েছে!’
জয়ন্ত বললে, ‘হ্যাঁ। দেখুন সুন্দরবাবু, মাঠের এই অংশের জমির উপরের ঘাসগুলো কত বেশি নেতিয়ে পড়েছে। কেবল তাই নয়, ভারী—ভারী পায়ের চাপে অনেক ঘাসই কাল মাটির উপরে একেবারে শুয়ে পড়েছিল, আজও তারা আর খাড়া হয়ে উঠতে পারেনি। কত ঘেসো ফুল একেবারে পিষে মরে গিয়েছে সেটাও দেখতে পাচ্ছেন কি? অথচ একটু এপাশে আর ওপাশে ঘুরে এসে দেখুন, সেখানকার ঘাসগুলো কেমন সজীব ও সতেজভাবে খাড়া হয়ে হাওয়ায় দুলছে, তাদের একটা ফুলও খসে পড়েনি!’
সুন্দরবাবু লজ্জিত—কণ্ঠে বললেন, ‘তাই তো, সত্যিই তো। এসব তো আমারও লক্ষ করা উচিত ছিল!’
মাঠের জমির ঘাস যেখানে নিস্তেজ বা ফুল ঝরিয়ে মাটির উপরে শুয়ে পড়েছে সেইখান দিয়ে সকলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। জয়ন্তের কথায় সুন্দরবাবু সশস্ত্র পুলিশ—বাহিনীকেও পিছনে পিছনে আসবার জন্যে ইশারা করলেন।
পঞ্চম – ভিজে আর শুকনো পায়ের দাগ
মাঠের প্রান্তে ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত নিবিড় এক অরণ্য। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল দিকচক্রবাল—রেখাকে আচ্ছন্ন করে সেই অরণ্যের উপরে পাহারা দিচ্ছে বিপুলদেহ বনস্পতির দল। এক—একটি বৃক্ষ আবার তাল—নারিকেল—কুঞ্জেরও মাথা ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে পত্রবহুল অসংখ্য বাহুর দ্বারা যেন বন্দি করবার জন্যে শূন্যতাকেই।
সকলে যখন সেই মাঠের প্রান্তদেশে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখা গেল সেখানে এমন একটি মেটে পথের রেখা রয়েছে, যার উপরে তৃণদের শ্যামল আবরণ আর নেই।
অরণ্যের বক্ষ ভেদ করে সোজা চলে গিয়েছে সেই পথের রেখা।
কুমার বললে, ‘বাঃ, পায়ের দাগগুলো এইবারে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! একজন নয়, দুজন নয়, পথের দু’দিক জুড়ে অগুন্তি লোকের পায়ের দাগ!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাঁচা গেল বাবা, বাঁচা গেল! শুয়ে—পড়া মরা ঘাস আর ঝরা ঘেসো—ফুল দেখে আসামিদের পিছু নেওয়া কী চাট্টিখানেক কথা? এতক্ষণ আমার সন্দেহ হচ্ছিল, ভাবছিলুম জয়ন্ত আমাদের ধাপ্পা মারছে। কিন্তু আর সন্দেহ করবার কোনও উপায়ই নেই, এই পায়ের দাগগুলো নিশ্চয়ই আমাদের যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে। চলো, অগ্রসর হও!’
মানিক মুখ টিপে হেসে বললে, ‘ঘাসের উপরে সূক্ষ্ম প্রমাণ দেখে সুন্দরবাবু যে খুশি হচ্ছিলেন না, সেটা আমি অনেকক্ষণ ধরে টের পাচ্ছিলুম। তা খুশি হবেন কেমন করে? মোটা দেহ আর মোটা বুদ্ধি দিয়ে ভগবান এমন অনেক জীবকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, মোটা প্রমাণ না পেলে যারা মোটামুটি কিছুই বুঝতে পারে না!’
সুন্দরবাবু তেলে—বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘তুমি জানো মানিক, আমরা চলেছি এখন দস্যু—বাহিনীর সঙ্গে জীবন পণ করে যুদ্ধ করতে? এই কি হালকা আর পলকা ঠাট্টা করবার সময়? তোমার স্থান—কাল—পাত্র জ্ঞান নেই?’
মানিক আবার সকৌতুকে ভুরু নাচিয়ে সুন্দরবাবুকে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে মুখ খোলবার আগেই বিমল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘চলুন, চলুন! এখানে দাঁড়িয়ে এখন কথা—কাটাকাটি করবার সময় নেই। শিগগির এগিয়ে চলুন!’
আবার সবাই হল অগ্রসর। পথের দুই—ধারে ঘন—সন্নিবিষ্ট বৃক্ষের দল এমনভাবে দুই দিক থেকে শাখা—বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, উপরদিকে তাকালে দেখা যায় না আর সমুজ্জ্বল নীলাকাশকে—দেখা যায় কেবল ছায়া—ভরা মর্মরিত সবুজ পত্রদের চন্দ্রাতপ।
লাঙ্গুলকে পতাকার মতন ঊর্ধ্বে তুলে সর্বাগ্রে সগর্বে এগিয়ে যাচ্ছিল বাঘা এবং তারপরেই জয়ন্ত। সে বললে, ‘সবাই চটপট পা চালিয়ে দিন! এখনও দিনের আলো আছে, এখনও বনের ভিতরে নজর চলছে। অন্ধকারে অন্ধ হবার আগেই অবলাকান্তের আস্তানায় গিয়ে হাজির হতে হবে।’
প্রায় মিনিট পনেরো ধরে সবাই এগিয়ে চলল দ্রুতপদে।
হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জয়ন্ত বললে, ‘দেখুন বিমলবাবু, দেখুন! পায়ের দাগগুলো এইখানে মোড় ফিরে আরও সরু একটা পথ জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে!’ তারপর হেঁট হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বিপুল বিস্ময়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু একী ব্যাপার, এ কী?’
বিমলও মাটির দিকে হেঁট হয়ে ভালো করে দেখে বললে, ‘ব্যাপার কী জয়ন্তবাবু? যে পায়ের দাগগুলো বাঁদিকের ওই সরু পথের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে, সেগুলোকে মাড়িয়ে আরও অসংখ্য পায়ের দাগ আবার বেরিয়ে এসেছে বাইরের দিকে!’
কুমার বললে, ‘পদচিহ্নগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে বাঁদিকে—অর্থাৎ আমরা যে পথের উপরে দাঁড়িয়ে আছি এই পথ ধরেই সোজা চলে গিয়েছে! এরই বা মানে কী?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ধ্যাত, মানে আবার কী? ডাকাত—ব্যাটারা কাল কোনও কারণে একবার ওই বাঁদিকের পথ ধরে জঙ্গলের ভিতরে গিয়েছিল, তারপর আবার বেরিয়ে এসে আমরা যে বড়ো পথের উপরে দাঁড়িয়ে আছি সেইটে ধরেই আবার এগিয়ে গিয়েছে নিজেদের আড্ডার দিকে।’
জয়ন্ত নীরবে সেইখানে হাঁটু গেড়ে মাটির উপরে বসে পড়ল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে একবার এদিক আর একবার ওদিকে গিয়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি যা ভাবছেন, সেটা ঠিক নয়!’
—’কেন, বেঠিকটা কোনখানে?’
—’ভালো করে চেয়ে দেখুন। আমরা এতক্ষণে যে পায়ের দাগগুলো দেখে এগিয়ে আসছিলুম, আর যেগুলো মোড় ফিরে ওই বাঁদিকের সরু পথের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে, তাদের অনেকগুলোই ভিজে মাটির ভিতরে চেপে বসে গিয়েছে। এখানে রোদ আসে না বলে ওইসব পদচিহ্নের উপর থেকে এখনও বৃষ্টির জল শুকিয়ে যায়নি। দেখুন, এক—একটা পদচিহ্ন কত গভীরভাবে মাটির ভিতরে বসে গিয়েছে—এর মানে হচ্ছে, এগুলো হৃষ্টপুষ্ট সুবৃহৎ দেহের পায়ের দাগ। এগুলোর মধ্যে এখনও কিছু—কিছু বৃষ্টির জল জমে আছে। কিন্তু যে পায়ের দাগগুলো বাঁদিকের ওই সরু পথটার ভিতর থেকে আবার বাইরে বেরিয়ে এসে এই বড়ো পথটা ধরে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে জলের কোনও চিহ্নই নেই। এত্থেকে আমাদের কী বুঝতে হবে বলুন দেখি?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! বুঝতে হবে ঘোড়ার ডিম! শুকনো আর ভিজে পায়ের দাগ—খালি হেঁয়ালি, খালি হেঁয়ালি!’
বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, হেঁয়ালি বোঝাই হচ্ছে গোয়েন্দার ব্যবসা। যদি অপরাধ না নেন তো, ব্যাপারটা কী হয়েছে আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারি।’
সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধ—কণ্ঠে বললেন, ‘হাতি গেল, ঘোড়া গেল, ভেড়া বলে কত জল! আমি হচ্ছি পুরোনো পুলিশের লোক, আর আপনি পুলিশও নন, জয়ন্তের মতন শখের গোয়েন্দাও নন, আপনি আবার আমাকে কী বোঝাতে চান?’
বিমল হাসতে—হাসতে শান্ত স্বরেই বললে, ‘না সুন্দরবাবু, আপনার কাছে আমি কিছুই নই! আপনার মতন মাতঙ্গের কাছে আমি হচ্ছি সামান্য একটা পতঙ্গ মাত্র! তবে কী জানেন, মুনিরও মতিভ্রম হয়।’
সুন্দরভাবে আরও রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমার মতিভ্রমটা হল কোথায়, সেইটেই আমি জানতে চাই?’
—’চেয়ে দেখুন সুন্দরবাবু। এতক্ষণ আমরা যে পায়ের দাগগুলো অনুসরণ করছিলুম, তাদের অনেকগুলোর ভিতরে যে বৃষ্টির জল জমে আছে, জয়ন্তবাবু তো সেটা এখনই আমাদের দেখিয়ে দিলেন। এর অর্থ কী তাও আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কাল বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ডাকাতের দল এই পথ ধরে এগিয়ে এসেছিল, তারপর তারা ঢুকেছিল বাঁদিকের পথ ধরে ওই জঙ্গলের ভিতরে। কিন্তু তখনও বৃষ্টি পড়ছিল, তাই ওই পদচিহ্নগুলোর উপরে এখনও অল্প—বিস্তর বৃষ্টির জল জমে আছে। কিন্তু যে পদচিহ্নগুলো ওই বাঁদিকের ছোটো পথ ধরে বাইরে বেরিয়ে এসে আবার এই বড়ো পথ ধরেই আমাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে, সেগুলো হচ্ছে একেবারে শুকনো। এখানকার মাটি ভিজে, তাই এই ভিজে মাটির উপরে পদচিহ্ন পড়েছে বটে, কিন্তু আমাদের এই সামনের দিকের পদচিহ্নগুলোর কোনওটার ভিতরেই যখন বৃষ্টির জল জমে নেই, তখন বুঝতে হবে যে, এই পদচিহ্নগুলোর উৎপত্তি হয়েছে, বৃষ্টি থেমে যাবার পরেই।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বেশ তো, তাতে হয়েছে কী?’
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘বাঁদিকের ওই সরু পথের ভিতর দিয়ে এই যে অসংখ্য শুকনো পদচিহ্ন আবার বাইরে এসে বড়ো পথটা ধরেই সোজা এগিয়ে গিয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটাই কত গভীরভাবে মাটির ভিতরে বসে গিয়েছে সেটাও দেখতে পাচ্ছেন কি?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, গেলই বা মাটির ভিতরে গভীরভাবে বসে, তা নিয়ে আমাদের এতটা মাথা—ব্যথা হবার কারণ কী?’
জয়ন্ত বিরক্ত—কণ্ঠে বললে, ‘কারণ কী জানেন? এই নতুন শুকনো পায়ের দাগগুলো হচ্ছে এমন একদল লোকের, যারা ওই জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণপণ বেগে ছুটে আবার এই বড়ো পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছে। মানুষ যখন খুব বেগে ছোটে তখন প্রত্যেক পদেই তাকে লাফ মারতে হয়। আর সেইজন্যেই তখন তার পদচিহ্ন গভীরভাবে বসে যায় ভিজে মাটির ভিতরে।’
—’হুম। তোমাদের এই আবিষ্কারে নতুনত্ব আছে। তারপর?’
এইবারে জয়ন্তের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল রীতিমতো ক্রুদ্ধ। সে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি বোঝালেও যদি না বোঝেন, তাহলে আমাদের হার মানতে হয়! আপনাকে বোঝাবার জন্যে আমরা এখানে আসিনি, আমরা এসেছি এক দুর্ধর্ষ দস্যুদলকে গ্রেপ্তার করতে। এখানকার মাটি ভিজে না হলে আমরাও কিছুই বুঝতে পারতুম না, কারণ তাহলে সামনের দিকের এই নতুন পদচিহ্নগুলো আমাদের কারুরই চোখে পড়ত না। কিন্তু মাটি ভিজে বলেই আন্দাজ করতে পারছি যে, একদল লোক অত্যন্ত তাড়াতাড়ি এখান থেকে ছুটে চলে গিয়েছে! তাদের এতটা তাড়াতাড়ির কারণ কী? নিশ্চয়ই তারা কোনও—কিছু বিভীষিকা দেখেছে! কী সেই বিভীষিকা?’
সুন্দরবাবু কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে বাঁহাতে টুপি খুলে ডানহাতে মাথা চুলকোতে লাগলেন নীরবে।
কুমার বললে, ‘বিভীষিকা হচ্ছি আমরা! নতুন ওই পায়ের দাগগুলো যখন সজল নয়, তখন খুব সম্ভব ওগুলোর সৃষ্টি হয়েছে আজকে—হয়তো একটু আগেই!’
মানিক বললে, ‘ব্যাপারটা বেশ বোঝা যাচ্ছে! আমরা যে সদলবলে এই বনের ভিতরে এসে ঢুকেছি, ডাকাতরা সেটা আগেই টের পেয়েছে! তারা তাই ওই বাঁদিকের সরু পথ দিয়েই বেরিয়ে এই বড়ো পথটা ধরে ছুটে চম্পট দিয়েছে!’
সুন্দরবাবু ভেঙেও মচকাবার পাত্র নন। বললেন, ‘চম্পট দিয়ে যাবে কোথায়? তাদের পায়ের দাগগুলো তো এখনও ওই মাটির উপরেই আঁকা আছে? তারা কালকেই পালাক আর আজকেই পালাক, দাগগুলো তো তারা আর মুছে দিয়ে যেতে পারেনি! সুতরাং তোমাদের এসব গবেষণার কোনও অর্থই হয় না। চলো, আমরা এই শুকনো পায়ের দাগগুলো ধরেই সামনের দিকে এগিয়ে যাই!’
মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি হচ্ছেন অসম্ভব মানুষ! যুক্তির দ্বারা আপনাকে দমাতে পারে এমন পাষণ্ড বোধহয় ত্রিভুবনে জন্মগ্রহণ করেনি! দাদা, একবার পায়ের ধুলো দিন!’
সুন্দরবাবু হেসে ফেলে বললেন, ‘মানিক হে, তুমিই আমাকে চিনতে পেরেছ! যাক, আজ আর তোমার কথায় রাগ করব না!’
মানিক বললে, ‘ধন্যবাদ!’
জয়ন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললে, ‘বাজে কথায় সময় কাটাবার সময় নেই। আমরা যতক্ষণ এইখানে দাঁড়িয়ে কথা—কাটাকাটি করব, ততক্ষণে ডাকাতরা আরও—আরও দূরে গিয়ে পড়বে! পায়ের দাগ অত্যন্ত স্পষ্ট—এই দাগ দেখেই আমাদের এখন ছুটে এগিয়ে যেতে হবে!’
সর্বাগ্রে বাঘাই যেন বুঝতে পারলে জয়ন্তের কথা। ঘন—ঘন লেজ নাচিয়ে সামনের দিকে মারলে সে টটএক লম্বা দৌড়।
ষষ্ঠ – খ্রিস্ট—পূর্ব যুগের যুদ্ধ—কৌশল
দুধারে প্রায় যেন নিরেট জঙ্গলের প্রাচীর, তারই মাঝখান দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে তাজা পায়ের—দাগ—আঁকা সেই পথটা।
বিমল ও জয়ন্ত প্রভৃতি প্রায় মিনিট—দশ ধরে অগ্রসর হয়েও দেখলে, সেখানকার কাঁচা মাটি তখনও পদচিহ্নগুলোর ছাঁচ তুলেছে তেমনি গভীর রূপেই। বোঝা গেল ডাকাতরা এতদূর এগিয়েও তাদের দ্রুতগতি বন্ধ করেনি।
সুন্দরবাবু ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘বাপ—রে, আমার এই দেহ নিয়ে এত দৌড়োদৌড়ি কি পোষায় বাবা?’
মানিক ছুটতে ছুটতেই চোখ মটকে বললে, ‘কেন পোষাবে না মশাই? আপনি তো হাতির ছোট্ট সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নন। হাতিরা যে তাদের অমন ভারী আর বিরাট দেহ নিয়ে বিলক্ষণ ছোটাছুটি করতে পারে!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘মানিক, এইবারে তুমি ঠকলে! যখন—তখন তুমি আমাকে হাতি বলে গালাগাল দাও। আজ তোমার নিজের কথাতেই প্রমাণ হয়ে গেল যে, আমি মোটেই হাতি নই। কারণ হাতি হলে আমিও খুব ছোটাছুটি করতে পারতুম।’
জয়ন্ত হঠাৎ চেঁচিয়ে বললে, ‘সবাই দাঁড়িয়ে পড়ুন! পায়ের দাগগুলো আর সামনের দিকে এগোয়নি, এখান থেকেই বেঁকে ডানপাশের ওই জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে। এখন আমাদের কী করা উচিত বিমলবাবু? চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, একটু পরেই আমাদের চোখও অন্ধ হয়ে যাবে।’
বিমলের জবাব দেওয়ার আগেই আচম্বিতে অরণ্য কাঁপিয়ে কোথা থেকে গর্জন করে উঠল কয়েকটা বন্দুক! সকলকার মাথার উপর দিয়ে কতকগুলো বুলেটও যে সশব্দে বাতাস কেটে ছুটে চলে গেল, তা বুঝতেও কারুর দেরি হল না!
জয়ন্ত আবার চিৎকার করে বললে, ‘ওই ডানপাশের বনের ভিতর থেকে গুলি ছুটে আসছে! আমাদের বধ করবার জন্যে ডাকাতরা এইখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে! সবাই ডানপাশের বনের দিকে মুখ করে মাটির উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন। তারপর হতভাগাদের বুঝিয়ে দিন যে, আমাদেরও বন্দুকের অভাব নেই!’
বিমল তাড়াতাড়ি বললে, ‘কুমার, জয়ন্তবাবু, মানিকবাবু, আসুন আমরা চারজন মাটির উপরে হামাগুড়ি দিয়ে এই পথটা ধরেই সোজা এগিয়ে যাই!’
মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘কেন বিমলবাবু? ওদিকে তো ডাকাতদের পায়ের দাগ নেই, ও—দিকে গিয়ে আমরা কী করব?’
বিমল বললে, ‘এখন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। কেবল জেনে রাখুন, আমার মাথায় একটা ফন্দি এসেছে।’
বিমল, জয়ন্ত, কুমার ও মানিক একসঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে সেই পদচিহ্নহীন পথ ধরে যতটা সম্ভব দ্রুতবেগে অগ্রসর হল।
সুন্দরবাবু তাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘হুম। বিপদ দেখে কাপুরুষের মতন পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তোমরাই আবার ‘অ্যাডভেঞ্চার’ চাও? গোয়েন্দাগিরি করতে চাও? আরে ছোঃ!’
বিমল, জয়ন্ত ও কুমার হাসতে লাগল, কিন্তু দুষ্টু মানিক সেইভাবে যেতে যেতেই পিছনদিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘জয়, বীরপুরুষ সুন্দরবাবুর জয়! আপনার মতন বীরপুরুষের কাছে আমাদের মতন কাপুরুষদের থাকা উচিত নয় বলেই তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়ছি!’
সুন্দরবাবু বোধ করি কী—একটা খুব কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তখনই ওদিক থেকে তেড়ে এল আর এক—ঝাঁক উত্তপ্ত বুলেট! একটা বুলেট তাঁর মাথা বাঁচিয়েও টুপির উপর দিকটা ছ্যাঁদা করে বেরিয়ে গেল। দুই চক্ষে অগণ্য সর্ষেফুল দেখে এবং ‘বাপ’ বলে চিৎকার করে তিনি তখনই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। তারপর বিপুল ক্রোধে চিৎকার করে বললেন, ‘এই সেপাই! চালাও গুলি, চালাও গুলি! শুয়োরের বাচ্চাদের বুঝিয়ে দাও, আমাদের কাছে ওদের চেয়ে ঢের বেশি বন্দুক আছে!’
সেপাইরা তাঁর আগেই বুদ্ধিমানের মতন ভূমির উপরে লম্বমান হয়েছিল। তারাও অদৃশ্য শত্রুদের উদ্দেশে বারংবার বন্দুক ছুড়তে শুরু করলে।
দুই পক্ষে বন্দুকের চিৎকারে সেই বনভূমির শান্তিপূর্ণ আবহ যখন ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, বিমল, কুমার, জয়ন্ত ও মানিক তখন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা।
হঠাৎ বিমল লাফ মেরে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘ব্যস, আর আমাদের চতুষ্পদ জন্তুর মতন পথ চলতে হবে না! শত্রুদের গুলিগুলো ছুটোছুটি করছে এখান থেকে অনেক দূরে। এইবারে আমরাও দুই পদে নির্ভর করে দাঁড়িয়ে দু—একটা কথা কইতে পারি।’
জয়ন্ত উঠে বিমলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললে, ‘এতক্ষণে আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি।’
বিমলও সহাস্যে বললে, ‘কী বুঝতে পেরেছেন বলুন না!’
—’এইবারে আপনি এই ডানদিকের বনের ভিতরে গিয়ে ঢুকতে চান, তাই নয় কি?’
—’ঠিক! তারপর?’
—’ডানদিকের এই বনের ভিতরে ঢুকে আমরা যদি সোজাসুজি খানিকটা এগিয়ে যাই, তাহলে হয় শত্রুদের পিছনে নয় পাশে গিয়ে পড়তে পারব।’
—’তারপর?’
—’আমরা যে এইভাবে লুকিয়ে তাদের পিছনে বা পাশের দিকে এসে হাজির হয়েছি, শত্রুরা নিশ্চয়ই সে—সন্দেহ করতে পারবে না। ইতিহাসে পড়েছি, এই রকমই একটা উপায়ে গ্রিসের আলেকজান্ডার দি গ্রেট নাকি ভারতের মহারাজা পুরুকে কাবু করে ফেলেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে আপনি সেই খ্রিস্ট—পূর্ব যুগের যুদ্ধ—কৌশলকে কাজে লাগাতে চান।’
—’কিন্তু এটা যুদ্ধ নয় জয়ন্তবাবু, এটা হচ্ছে তুচ্ছ দাঙ্গারই শামিল।’
—’খ্রিস্ট—পূর্ব যুগের যুদ্ধের বর্ণনা পড়লে কী মনে হয় জানেন বিমলবাবু?’
—কী মনে হয়, বলুন।’
—’এই আণবিক বোমার যুগে পৃথিবীতে যেসব দাঙ্গা—হাঙ্গামা হয়, খ্রিস্ট—পূর্ব যুগের যুদ্ধ ছিল তারও চেয়ে তুচ্ছ!’
—’কিন্তু এ—যুগের বড়ো—বড়ো যুদ্ধেও প্রকাশ পায় কেবল তথাকথিত যোদ্ধাদের কাপুরুষতা। শত্রুদের দেখতে পায় না, তবু গর্তের ভিতরে লুকিয়ে এ—যুগের যোদ্ধারা ছোড়ে খালি বন্দুকের পর বন্দুক—লড়াই করে যেন তারা বাতাসের সঙ্গে। কিংবা বিমানপোত নিয়ে শূন্যে ওড়ে বিপদের সীমানা ছাড়িয়ে, তারপর অশ্রুতপূর্ব নিষ্ঠুরতা আর কাপুরুষতার প্রমাণ দেবার জন্যে অসামরিক, নির্দোষ, আবালবৃদ্ধবনিতার উপরে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে বাস করে এমন এক বৃহৎ নগর—কে—নগরকেই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত করে দেয়! কিম্বা তারা ডুবোজাহাজ নিয়ে সমুদ্রের তলায় ডুব মেরে সামরিক হোক আর অসামরিক হোক যে—কোনও জাহাজকেই গুপ্ত উপায়ে অতলে তলিয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ নরহত্যা করে! কিন্তু সেকালের যুদ্ধে প্রকাশ পেত মানুষের বীরত্ব আর রণকৌশল। তখনকার যোদ্ধাদের লড়াই করতে হত শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যার শক্তি আর নিপুণতা বেশি, জয়ী হত সেই—ই। এই মধ্যযুগের মহাবীর তৈমুরলংয়ের জীবনচরিত পড়েছেন?’
—’না, কিন্তু বিমলবাবু, এখন—’
বিমল বাধা দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তৈমুরলং গিয়েছেন, এক মস্ত বড়ো রাজার দুর্ভেদ্য কেল্লা দখল করতে। দুই পক্ষেই সৈন্যসামন্তের সংখ্যা নেই।—বিশেষত তৈমুরের সঙ্গে ছিল এমন—এক বিপুল বাহিনী, সে—যুগের রুশিয়াকে পর্যন্ত যে বাহিনীর মহাবীরেরা অনায়াসেই পায়ের তলায় নত করতে পেরেছিল—উনিশ শতকের নেপোলিয়ন বা বিশ শতকের হিটলার পর্যন্ত যা করতে পারেনি। তবু তৈমুর তাঁর অপরাজেয় বাহিনীর উপর নির্ভর করলেন না, ঘোড়ার পিঠে চড়ে নির্ভয়ে এগিয়ে চললেন বিপক্ষের দুর্গ—তোরণের দিকে। তাঁর সেনাপতিরা সভয়ে তাঁকে বাধা দিয়ে অনুরোধ—উপরোধ করতে লাগলেন, ‘সুলতান, আমরা যখন এখানে রয়েছি, তখন আমাদের পিছনে রেখে আপনি কেন এগিয়ে যাচ্ছেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে? আপনার যদি কিছু হয়, তাহলে আমরা থাকব কোথায়?’ তৈমুর তরবারি কোষমুক্ত করে শূন্যে বিদ্যুৎ নাচিয়ে বললেন, ‘তোমরা সরে দাঁড়াও আমার সুমুখ থেকে! যে আমাকে বাধা দেবে তাকেই আমি হত্যা করব।’ তৈমুরের চক্ষে কঠিন প্রতিজ্ঞার ইঙ্গিত দেখে সেনাপতিরা ভীতভাবে তাঁর নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তৈমুরের ঘোড়া মাটির উপরে খুরের আঘাতে ধূলি উড়িয়ে সিধে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল বিপক্ষদের দুর্গ—তোরণের সামনে। দুর্গ—প্রাকারের উপরে নানান—রকম নিষ্ঠুর অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল হাজার হাজার শত্রুসৈন্য। একাল হলে তারা নিশ্চয়ই সেই মুহূর্তে তৈমুরকে বধ করত। কিন্তু তারা তা করলে না, নির্বাক বিস্ময়ে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিস্পন্দ মূর্তির মতো। দুর্গ—তোরণের সামনে গিয়ে তৈমুর ঊর্ধ্বমুখে চিৎকার করে বললেন, ‘যুদ্ধ এখনই হতে পারে, আর যুদ্ধ হলে দুই পক্ষের অনেক মানুষের প্রাণও যাবে। শেষ পর্যন্ত আমি যে এই কেল্লা ফতে করব সে—বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই! কিন্তু অত—বেশি গোলমালে দরকার কী? এই দুর্গ—তোরণ দিয়ে বেরিয়ে আসতে বলো তোমাদের নায়ককে—আমি এখানে একলা এসেছি, সেও এখানে থাকবে একলাই। লড়াই করুক সে কেবল আমার সঙ্গে। যে হারবে, তার পক্ষকে সেই পরাজয়কেই সকলের পরাজয় বলে স্বীকার করে নিতে হবে!’…জয়ন্তবাবু, আমি একেই বলি বীরত্ব—একালের যুদ্ধ যে—বীরত্বকে স্বীকার করে না।’
জয়ন্ত বললে, ‘বিমলবাবু, আপনি চমৎকার প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু আজ এইখানেই এ—প্রসঙ্গ ধামা—চাপা দেওয়াই নিরাপদ! ওদিকে ঘন ঘন বন্দুকের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন না?’
উত্তেজিত হয়ে বিমল সত্য—সত্যই স্থান—কাল—পাত্র সব ভুলে গিয়েছিল। জয়ন্ত আজকের কথা মনে করিয়ে দিতেই সে অত্যন্ত লজ্জিত স্বরে বললে, ‘মাপ করবেন জয়ন্তবাবু, মাপ করবেন! ছেলেমানুষের মতন আমি গাইছিলুম ধান ভানতে শিবের গীত! ছিঃ ছিঃ, আমাকে ধিক!’
জয়ন্ত বললে, ‘এখন নিজেকে ধিক্কৃত করবারও সময় নয়। আপনারই নির্দেশে আমরা এদিকে এসেছি। এখন কী করতে হবে বলুন?’
বিমল তৎক্ষণাৎ অতি—জাগ্রত হয়ে ডানদিকের জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে এগুতে এগুতে বললে, ‘আসুন আমার সঙ্গে! আগে খানিকটা এগিয়ে দেখি, তারপরই বুঝতে পারব আমার অনুমান সত্য কি না।’
সেখানে জঙ্গলের ভিতরে পথ বলে কোনও—কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। ঝোপ—ঝাপ সরিয়ে, কাঁটাগাছে দীর্ণ—বিদীর্ণ হয়ে, কখনও দাঁড়িয়ে কখনও—বা হামাগুড়ি দিয়ে তারা অগ্রসর হতে লাগল কোনওরকমে। ওদিকে তখনও দুই পক্ষের বন্দুক দুই—পক্ষের শত্রুদের দিচ্ছিল অবিশ্রান্ত ভাবে প্রচণ্ড ধমকের পর ধমক!
অবশেষে তারা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াল, যার পরেই আছে সাত—আট—হাত গভীর এবং সাত—আট—হাত চওড়া একটা সুদীর্ঘ খানা। গতকল্যকার বৃষ্টি খানার তলায় জমিয়ে রেখেছে হাত—দেড়েক গভীর জল।
বাঘা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। খানার ভিতরে লাফিয়ে পড়ল সে সর্বাগ্রে। তারপরেই বিমল খানার ভিতরে গিয়ে অবতীর্ণ হল। একদিকে তাকিয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মিনিটতিনেক। তারপর মুখ ফিরিয়ে বাকি সবাইকেও খানার ভিতরে নামবার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করলে।
জয়ন্ত, কুমার ও মানিকও খানার ভিতরে গিয়ে নামল। তারপর বিমলের ইঙ্গিতে একদিকে তাকিয়ে যা দেখলে, তা হচ্ছে এই :
খানাটা লম্বালম্বি অনেকদূর অগ্রসর হয়ে হারিয়ে গিয়েছে কোথায়, আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে। খানার দুই তীরেই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বড়ো—বড়ো গাছের পর গাছ। তাদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে সেইসব গাছের উপরে ঘন—ঘন বন্দুকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই দপদপ করে জ্বলে জ্বলে উঠছিল অগ্নিশিখার পর অগ্নিশিখা!
খানার ভিতরে বড়ো—বড়ো সব আগাছা এখানে—ওখানে তৈরি করেছিল রীতিমতো ঝোপঝাপ। বিমলের দেখাদেখি বাকি তিনজনও সেই—রকম এক—একটা ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করলে।
বিমল অনুচ্চ স্বরে বললে, ‘ডাকাতরা গাছের উপরে চড়ে পুলিশবাহিনীর উপরে গুলিবৃষ্টি করছে! ওরা আমাদের বন্দুকের সীমানার মধ্যেই আছে। আমরা চারজনেই ‘অটোমেটিক’ বন্দুক নিয়ে এসেছি—এগুলো ওদের অস্ত্রের চেয়ে ঢের—বেশি শক্তিশালী আর অল্প সময়ের মধ্যেই অশ্রান্তভাবে ঢের—বেশি গুলি বৃষ্টি করতে পারে। সকলে তৈরি হয়ে থাকো। গাছের উপরের শত্রুদের আমরা দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু ওখানে যখনই বন্দুকের আগুন জ্বলবে তখনই আন্দাজে শত্রুদের উদ্দেশে গুলির পর গুলি চালাও! কেউ একবারও থেমো না, শত্রুরা মনে করুক তাদের পিছনদিক থেকেও অনেক পুলিশের লোক আক্রমণ করতে এসেছে।’
মিনিট—খানেক পরই ‘অটোমেটিক’ বন্দুকগুলো শত্রুদের সঙ্গে কথা কইতে লাগল ভয়াবহ ও অশ্রান্ত আগ্নেয় ভাষায়!
উপরি—উপরি জেগে উঠল কয়েকটা বিকট আর্তনাদ! ‘অটোমেটিক’ বন্দুকের বুলেট তাহলে অদৃশ্য শত্রুদেরও সন্ধান পেয়েছে!
বিমল উৎসাহ—ভরে বলে উঠল, ‘চালাও, আরও তাড়াতাড়ি গুলি চালাও! ওরা ভেবে নিক দলে আমরা দস্তুরমতো ভারী!’
বিমল, জয়ন্ত, কুমার ও মানিক মহা উৎসাহে বন্দুক ছুড়তে আরম্ভ করলে। তাদের আধুনিক বন্দুকগুলো ধূম্র উদ্গীরণ করছিল না, সুতরাং এই নতুন আক্রমণকারীরা যে কোথায় অবস্থান করছে ডাকাতরা সেটাও আন্দাজ করতে পারলে না।
মিনিট তিন—চার পরেই গাছের উপরকার সমস্ত বন্দুক একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। খুব সম্ভব, দু—দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ডাকাতরা গাছের উপর থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে যে—যেদিকে পারলে পলায়ন করলে।
বিমলরাও আর বন্দুক ছুড়লে না। সেইখানে চুপ করে বসে রইল প্রায় দশ মিনিট। তখনও দূর থেকে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল পুলিশের বন্দুকগুলোর শব্দ। তারপর পুলিশদের বন্দুকও হয়ে গেল বোবা।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখনও সেখানে রীতিমতো ঘনীভূত হয়নি বটে, কিন্তু আট—দশ হাত দূরে চোখ আর চলছিল না। আট—দশ হাত ভিতরেও যা দেখা যাচ্ছে সবই ঝাপসা ঝাপসা। মাথার উপরে আকাশের বুকে মাঝে মাঝে তখনও একটু—আধটু আলোর আভাস দেখা যাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে আলো দূর করতে পারছিল না পৃথিবীর আসন্ন অন্ধতাকে।
জয়ন্ত বললে, ‘শত্রুরা পালিয়েছে। বিমলবাবু, এখন আমাদের কী করা উচিত?’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আসুন, এই নোংরা ঘোলা জল ছেড়ে আপাতত আমরা খানার উপরে গিয়ে ওঠবারই চেষ্টা করি।’
যেদিক থেকে সকলে এসেছিল তারা আবার খানার সেই তীরে গিয়েই উঠল।
জয়ন্ত বললে, ‘আর এখানে থেকে লাভ কী? আজ আর ডাকাতদের ধরা অসম্ভব। এখন বোধহয় যেখান থেকে এসেছি সেইখানে গিয়েই দেখা উচিত, সুন্দরবাবু কতখানি বীরত্ব প্রকাশ করছেন।’
বিমল বললে, ‘ঠিক বলেছেন। আজ আমাদের কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল! চলুন,আমরা যেখানকার মানুষ সেইখানেই ফিরে যাই।’
সকলে যে অপথ বা বিপথ দিয়ে এসেছে, ঘন জঙ্গল ভেদ করে কখনও দাঁড়িয়ে এবং কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে আবার সেই দিকেই চলতে লাগল।
তারা মিনিট—তিনেক এইভাবে অগ্রসর হবার পর আচম্বিতে ঘটল এক অভাবিত ঘটনা! অন্ধকার ভেদ করে আবির্ভূত হল দলে দলে অস্পষ্ট সব যমদূতের মতন মূর্তি এবং তারা কেউ কিছু বোঝবার আগেই সেই মূর্তিগুলো তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপুল বিক্রমে! চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তাদের নিষ্ঠুর বাহুবন্ধনে বন্দি হল বিমল ও জয়ন্ত, কুমার ও মানিক! বিমলরা কেউ একখানা হাত পর্যন্ত তোলবার সুযোগ পেলে না!
তারপরেই খনখনে নারী—কণ্ঠে জেগে উঠল সেই সুপরিচিত তীক্ষ্ন অট্টহাসি। খিলখিল—খিলখিল করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে হঠাৎ একটা তীব্র কণ্ঠস্বর বললে, ‘আজ আমার অনেকদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল হল! আজ গ্রেপ্তার করেছি একসঙ্গে চারজনকে! আজ আমার সমস্ত বুক নেচে উঠছে উৎকট আনন্দে! কী হে বিমল—গাধা, কী হে জয়ন্ত—ছুঁচো, আমি কে তা বুঝতে পারছ?’
বিমল শান্ত কণ্ঠে বললে, ‘বিশ্রী অবলাকান্ত, তোমার গলা শুনলে কালা ছাড়া সবাই তোমাকে চিনতে পারবে।’
অবলাকান্ত আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, ‘হ্যাঁ রে গাধা, ঠিক তাই! আমার বাইরে এক রূপ, ভিতরে আর এক রূপ। ভগবান জানতেন দুনিয়ায় এসে আমি কী করব, তাই আমার ভিতরের রূপ ঢাকবার জন্যে আমি পেয়েছি নারীর কণ্ঠস্বর আর মেয়েলি একটা নাম—অবলাকান্ত! কিন্তু আসলে আমার কি নাম হওয়া উচিত তা জানিস? প্রবলাকান্ত!’
জয়ন্ত বললে, ‘তোমার বক্তৃতা তুমি তোমার চ্যালা—চামুণ্ডাদের শুনিয়ো। এখন আমাদের নিয়ে কী করতে চাও, তাই বলো।’
—’কী করতে চাই? তোদের নিয়ে কী করতে চাই? দুনিয়ার খাতা থেকে তোদের নাম একেবারে মুছে দিতে চাই।’
—’সেটা তো অনেকদিন ধরেই করতে চাইছ! কিন্তু পেরেছ কি?’
—’পারব, এবারে ঠিক পারব! এখনই আমার বাসনা চরিতার্থ করতে পারি, কিন্তু আমার আবার কেমন একটা বদ—রোগ আছে জানিস তো? আমি নরবলি দিতে চাই নতুন পদ্ধতিতে।’
—’পদ্ধতিটা কী, শুনতে পাই না?’
—’শুনবি কী, একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পাবি! পদ্ধতিটা যে কী আমি নিজেই তা এখনও জানি না, পরে ভেবে—চিন্তে বুদ্ধি খাটিয়ে স্থির করব। কিন্তু এটা ভালো করেই মনে করে রাখিস, এখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে তোদের আমি পরলোকে পাঠিয়ে দেবই দেব!’
—’বেশ, আমরা তাহলে এখন থেকেই প্রস্তুত হচ্ছি।’
আবার অট্টহাস্য করে অবলাকান্ত বললে, ‘হ্যাঁ, এখন থেকে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে শুরু করে দে, কারণ পরলোকে যাত্রা করবার সময় সেইটেই হবে তোদের একমাত্র পাথেয়!’
ঠিক সেই সময়ে যখন অন্যান্য সকলে একমনে এদের কথাবার্তা শুনছিল, কুমার আচম্বিতে এক হ্যাঁচকা মেরে দুজনের হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকের অন্ধকারের ভিতরে বেগে ছুটে যাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু শত্রুদের সকলেই অন্যমনস্ক হয়ে ছিল না, একজন বেগে ছুটে গিয়ে কুমারের মাথার উপরে করলে প্রচণ্ড এক লাঠির আঘাত। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে কুমার তৎক্ষণাৎ ঘুরে মাটির উপর পড়ে গিয়ে একেবারে নিশ্চেষ্ট হয়ে রইল।
কুমারকে হয়তো এরা হত্যা করলে, এই ভেবেই বিমল একেবারে আত্মহারা হয়ে গেল। সেও এক বিষম টান মেরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আঘাতকারীর উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বলিষ্ঠ দুই বাহু সেই বিপুলবপু দস্যুর দেহটাকে অনায়াসে শিশুর মতন মাথার উপরে তুলে নিয়ে মাটির উপরে আছড়ে ফেলে দেবার উপক্রম করলে।
কিন্তু ডাকাতরা দল বেঁধে ছুটে গিয়ে আবার তাকে চারিপাশ থেকে চেপে ধরলে প্রাণপণে। যে ডাকাতটাকে সে ধরেছিল, তিন—চারজন লোক এসে আবার তাকে তার কবল থেকে উদ্ধার করলে।
অবলাকান্ত ক্রুদ্ধ—কণ্ঠে বললে, ‘মরতে বসেও তোরা চালাকি করবি? ওরে, তোরা হতভাগাদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বেঁধে এখুনি এখান থেকে নিয়ে চল! সেইসঙ্গে ওদের চোখগুলোও বাঁধতে ভুলিসনে! বনে পুলিশ হানা দিয়েছে, আর এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়।’
একজন শুধোলে, ‘কর্তা ওদিকে তো পুলিশ আমাদের পথ আগলে আছে, আমরা এখন কোথায় যাব?’
অবলাকান্ত বললে, ‘কেন, আমরা এখন বানের জলে ভাসছি নাকি? বনের উত্তরদিকে এখান থেকে মাইল—দশ পরে আমবাগানে আমাদের পোড়োবাড়ির আড্ডা আছে, সেকথা কি ভুলে গেলি? চল সেখানে।’
আর একজন জিজ্ঞাসা করলে, ‘যে—ব্যাটা ওখানে মাটির উপর পড়ে রয়েছে, ওকেও আমাদের কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে নাকি?’
অন্ধকারের ভিতরে হেঁট হয়ে কুমারের ঝাপসা দেহের উপরে ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অবলাকান্ত বললে, ‘না রে শঙ্কর, এর ভার আর তোদের কারুকে বইতে হবে না। এর মাথা ফেটে দু—ফাঁক হয়ে গিয়েছে, এ পটল তুলেছে বলেই মনে হচ্ছে! চল, আমরা এখান থেকে অদৃশ্য হই।’
সপ্তম – ভূত না মানুষ?
কুমার কিন্তু মারা পড়েনি, বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল মাত্র। গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে অল্পে অল্পে যখন তার জ্ঞান ফিরে আসছে, আচ্ছন্নভাবের ভিতরে থেকেও এইটে সে অনুভব করতে পারলে, তার মাথার উপরে কী যেন একটা সজল ও সজীব পদার্থের চঞ্চল অস্তিত্ব! সে অন্ধকারেই ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সেটা যে কী তা বোঝবার চেষ্টা করলে। বুঝতে দেরি লাগল না। তাকে আগলে মাথার কাছে বসে আছে তার প্রিয় কুকুর বাঘা, সেইই স্নেহভরে জিহ্বা দিয়ে তার রক্তাক্ত মস্তককে লেহন করছে বারংবার!
এতক্ষণে কুমারের সব কথা মনে পড়ল। এ—পাশে ও—পাশে ফিরে তাকিয়ে সে শত্রু বা মিত্র কারুরই সাড়া পেলে না। গভীর অন্ধকারের মধ্যে নির্জন অরণ্যের মর্মর শব্দ এবং অদৃশ্য ঝিল্লিদের ঐকতান ছাড়া সেখানে আর কোনও শব্দই নেই।
অবিরাম রক্তপাতে তার দেহ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, বাঘার গলা জড়িয়ে ধরে সে কোনওক্রমে আস্তে আস্তে উঠে বসল।
ঠিক সেই সময়েই বনের একদিকে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখ গেল কতকগুলো চঞ্চল আলো এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষদের কণ্ঠস্বর!
শত্রুরা আবার ফিরে আসছে ভেবে কুমার হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটা ঝোপের ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করছে, এমন সময় সে শুনতে পেলে উচ্চকণ্ঠের একটা চিৎকার—’বিমলবাবু! কুমারবাবু! জয়ন্ত! মানিক!’ সুন্দরবাবুর কণ্ঠস্বর!
কুমারও সানন্দে চিৎকার করে ডাকলে, ‘সুন্দরবাবু, সুন্দরবাবু! এইদিকে আসুন, এইদিকে! আমি কুমার!’
সুন্দরবাবু বিপুল উৎসাহে সচিৎকারে বলে উঠলেন, ‘হুম! বাব্বা, বনে বনে ঘুরে আমি হয়রান হচ্ছি, আর আপনারা এখানে মজা করে দিব্যি অরামে লুকিয়ে আছেন? বেড়ে মানুষ তো আপনারা! এইবারে দয়া করে আত্মপ্রকাশ করুন, এইদিকে এগিয়ে আসুন!’
কুমার বললে, ‘আপনার কথা রাখতে পারলুম না, ক্ষমা করবেন। আমি আহত! আমার চলবার শক্তি নেই।’
—’কী বললেন? আপনি আহত? আমারও ঠিক ওই দশাই জানবেন। আমার বাঁ—হাতের ভিতর দিয়ে বন্দুকের ‘বুলেট’ ছোটাছুটি করছে! কিন্তু আর তিন—মূর্তির সাড়া পাচ্ছি না কেন? তাঁরা কি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে লজ্জায় বোবা হয়ে আছেন?’
—’জয়ন্তবাবু, মানিকবাবু আর বিমলকে ডাকাতরা ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমি একলা আহত হয়ে এইখানে পড়ে আছি। সব কথা পরে শুনবেন, আগে এইদিকে আসুন।’
সুন্দরবাবু একেবারে চুপ মেরে গেলেন। তারপরই কুমার দেখলে জঙ্গলের ওপাশ থেকে আলোগুলো তার দিকেই ছুটে আসছে।
মিনিট—তিনেক পরেই ঘটনাক্ষেত্রে হল সুন্দরবাবুর আবির্ভাব। হাতে টর্চের আলো এদিকে এবং ওদিকে নিক্ষেপ করে সুন্দরবাবু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, ‘কুমারবাবু, আপনি কোথায়?’
কুমার বললে, ‘আপনার বাঁদিকে পিছনে তাকিয়ে দেখুন!’
সুন্দরবাবু তখন টর্চের আলোটা মাটির উপরে নিক্ষেপ করে শিউরে উঠে বললেন, ‘কী ভয়ানক, এখানে এত রক্ত কেন?’
কুমার বললে, ‘ও—রক্ত আমার!’
ততক্ষণে পুলিশের অন্যান্য লোকেরা অনেকগুলো আলো নিয়ে সেখানে এসে তাড়িয়ে দিলে চারিদিকের ঘনীভূত অন্ধকারকে।
সুন্দরবাবু ঝোপের পাশে কুমারকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বসে পড়লেন, তারপর তার ক্ষতস্থান লক্ষ করে উদ্বিগ্ন—কণ্ঠে বললেন, ‘সর্বনাশ, এ—যে মারাত্মক আঘাত!’
কুমার ম্লান হাসি হেসে বললে, ‘কিন্তু আমি মরিনি সুন্দরবাবু! আর শীঘ্র মরব বলেও আমার সন্দেহ হচ্ছে না।’
সুন্দরবাবু প্রবলভাবে মস্তক আন্দোলন করে বললেন, ‘না, না, না! আপনাকে যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেখছি। তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে নিশ্চয়ই আপনি মারা পড়বেন। ইস, এখনও যে মাথা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। দাঁড়ান, খান—কয় রুমাল দিয়ে আগে আপনার মাথাটা যতটা ভালো করে পারি বেঁধে দি।’
সুন্দরবাবু নিজের পকেট থেকে রুমাল বার করে এবং এর—ওর—তার কাছ থেকে আরও কয়েকখানা রুমাল চেয়ে নিয়ে কুমারের ক্ষতস্থানে ‘ব্যান্ডেজ’ বাঁধতে নিযুক্ত হলেন। এবং সেই সঙ্গেই বললেন, ‘তাহলে বিমলবাবু, জয়ন্ত আর মানিক ডাকাতদের হাতে বন্দি হয়েছে? কেন যে আপনারা ভয়ে পালিয়ে এলেন, আমাদের সঙ্গে থাকলে এমন দুর্ঘটনা তো ঘটত না!’
কুমার মৃদু—হাসি হেসে বললে, ‘আমরা পালিয়ে আসিনি সুন্দরবাবু, আমরা একটা কৌশল অবলম্বন করেছিলুম মাত্র। আমরা লুকিয়ে ডাকাতদের পিছনে এসে তাদের আক্রমণ করেছিলুম, আর সেই আক্রমণের ফলেই ডাকাতরা ঘটনাস্থল থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পালাবার সময় তারা আমাদের দেখতে পেয়েছিল।’
সুন্দরবাবু দুই ভুরু কপালের উপর দিকে তুলে বললেন, ‘তাই নাকি, তাই নাকি? তাহলে আমি তো ভুল বুঝেছিলুম! কিন্তু বলতে পারেন কুমারবাবু, ডাকাতরা কোনদিকে লম্বা দিয়েছে?’
—’আমি কিছুই বলতে পারব না, কারণ তখন আমার জ্ঞান ছিল না।’
সুন্দরবাবু তিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ডাকাতরা কোনদিকে গিয়েছে এখন তা আর জেনেই বা লাভ কী? আমি আহত, আপনারও এই সাংঘাতিক অবস্থা। আমাদের পক্ষে এখন ডাকাতদের অনুসরণ করা একেবারেই অসম্ভব। এখন আগে আমাদের লোকালয়ে ফিরে না গেলে কিছুতেই চলবে না। তাড়াতাড়ি ডাক্তার না দেখালে রক্ত বিষিয়ে আমরা দুজনেই মারা পড়তে পারি। খালি আমরা দুজন নই, আমাদের পক্ষে আরও সাতজন লোক আহত আর তিনজন নিহত হয়েছে। ডাকাতদের কী হয়েছে জানি না।’
কুমার বললে, ‘আপনাদের গুলিতে ডাকাতদের কী হয়েছে আমিও বলতে পারি না, কিন্তু আমাদের গুলি খেয়ে ক—জন ডাকাতকে গাছের উপর থেকে পড়ে যেতে দেখেছি।’
—’হুম! এত দুঃখের মধ্যে এও হচ্ছে একটা সুসংবাদ!…কিন্তু থাকগে এখন ওসব কথা। এই সেপাইরা, কুমারবাবুকে তোমরা সাবধানে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে চলো। আর এখানে থেকে কোনওই লাভ নেই।’
ঠিক সেই সময়ে অরণ্যের নিবিড় অন্ধকারের ভিতর থেকে জেগে উঠল একটা অদ্ভুত, তীব্র ও ভয়াবহ অট্টহাসি! হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা! সেই ভীষণ অট্টহাস্য গভীর অরণ্য এবং নৈশ আকাশকে যেন স্তম্ভিত করে দিলে! সে প্রচণ্ড হাসির যেন আর বিরাম নেই!
কুমার নিজের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল এবং সুন্দরবাবু সচকিত কণ্ঠে সভয়ে বলে উঠলেন, ‘ও কে? ও কে হাসে? ও কেন হাসে? ও কাদের দেখে হাসছে?’ ও কি মানুষের হাসি?’
তখন কুমারেরও সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। সেও ও—রকম অস্বাভাবিক হাসি জীবনে কখনও শোনেনি। সে অভিভূত কণ্ঠে বললে, ‘সুন্দরবাবু, কে—যে হাসছে আমি এখন তা জানতে চাই না। আমাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিয়ে চলুন।’
বাঘা এতক্ষণ কুমারের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে ঝোপের একপাশে চুপ করে বসে ছিল। সেও এখন তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠল—তার সর্বাঙ্গে বিস্ময়ের লক্ষণ। হঠাৎ সে এক লাফ মেরে কুমারের দেহকে টপকে বিষম ক্রোধে গর্জন করে কোনদিকে ছুটে যেতে উদ্যত হল, কিন্তু কুমার তাড়াতাড়ি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাঘাকে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘তুই আমার কাছ থেকে যাসনে বাঘা, যাসনে, এ—বন হচ্ছে অদৃশ্য বিপদে পরিপূর্ণ!’
সুন্দরবাবু বিকৃত স্বরে বললেন, ‘এ—বনে প্রেতযোনি আছে, প্রেতযোনি আছে! ও—রকম হাসি মানুষে হাসতে পারে না। ডাকাতদের সঙ্গে আমরা লড়াই করতে পারি, কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়বার শক্তি মানুষের নেই। এই সেপাইরা, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বলছি না, কুমারবাবুকে তুলে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে?’
হঠাৎ থেমে গেল সেই অট্টহাসির তরঙ্গ। তারপরেই জেগে উঠল একটা প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর! কে যেন কোথা থেকে ভীষণ চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ! চলে যা এখান থেকে, আজ তোদের এখান থেকে চলে যেতে হবেই। তোরা চলে যা, কিন্তু আমি এখানে জেগে থাকব দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর। প্রতিহিংসা—প্রতিহিংসা—প্রতিহিংসা! আমি আজ আর তোদের পৃথিবীর কেউ নই, আজ আমি রক্তলোলুপ, আজ আমি হত্যা করতে চাই, করতে চাই রক্তপাত।…হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা! জানি, জানি, আজ তোরা চলে গেলেও আবার তোরা এখানে ফিরে আসবি, আবার তোরা এই বনে বনে ঘুরবি শিকার খোঁজবার জন্যে! আজ আর তোদের দেখা দেব না, কিন্তু আবার তোরা, যেদিন এখানে ফিরে আসবি, সেদিন আমি তোদের সাহায্য করব! হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা!’
সেই বীভৎস এবং আকাশ—বাতাস—কাঁপানো অট্টহাসি অরণ্যের অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দূর হতে আরও দূরে গিয়ে হঠাৎ আবার থেমে গেল!
সুন্দরবাবু শিউরোতে শিউরোতে আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘একী ব্যাপার কুমারবাবু, কে এমন করে হাসলে, কে ওসব কথা বলে গেল?’
কুমার তখন ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে রক্তপাতের ফলে আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল! সেই অবস্থাতেই অস্ফুট স্বরে বললে, ‘আমি আর কিছু বুঝতে পারছি না সুন্দরবাবু, চোখেও আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন।’ বলেই সে সমস্ত চেতনা হারিয়ে ধপাস করে আবার মাটির উপরে শুয়ে পড়ল!
অষ্টম – একখানা হাত—আয়না
অবলাকান্ত বললে, ‘শম্ভু, এইবার ব্যাটাদের চোখ খুলে দে। এরা কোন দিক দিয়ে কোথায় এসেছে কিছুই দেখতে পায়নি। ব্যাটাদের ওই ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে, তোরা ওদের হাত—পা বেঁধে ঘরের মেঝেতে ফেলে রাখ। আজ ভয়ানক খাটুনি হয়েছে, ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে, আমি ঘুমুতে চললুম। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে শম্ভু যেন জেগে সারারাত এখানে পাহারা দেয়।’
শম্ভু লণ্ঠন হাতে করে একটা মাঝারি—আকারের ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকল। তারপর কয়েকজন লোক বিমল, জয়ন্ত ও মানিককে নিয়ে সেই ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে। বিমলদের হাত তো আগেই পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল, ডাকাতরা এখন তাদের মাটির উপরে শুইয়ে সকলকার পা—গুলোও শক্ত দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে বাইরে বেরিয়ে গেল।
শম্ভু তার হাতের লণ্ঠনটা উপরদিকে তুলে বন্দিদের দিকে আলোকপাত করে বললে, ‘বাপধনরা, পৃথিবীতে আজই হচ্ছে তোমাদের শেষ রাত। কারণ কাল থেকে তোমরা যে ঘুম ঘুমোবে, সে—ঘুম আর কখনও ভাঙবে না। হা—হা—হা—হা, কর্তা নিজে চললেন ঘুমোতে আর আমাকে বললেন সারারাত জেগে থাকতে। আমার যেন খাটুনি হয়নি! ঘুমে আমারও চোখ ঢুলে আসছে, জেগে থাকব কিসের জন্যে, কার ভয়ে? এ ঘরের দরজা তো বাইরে থেকে তালা বন্ধ থাকবে, তবে আর ভয়টা কিসের? এ—ব্যাটাদের হাত—পা বাঁধা, আর বাইরের দরজায় তালা বন্ধ! আমার জেগে থেকে লাভ?’ বলতে বলতে আলো নিয়ে বাইরে গিয়ে সে দরজা বন্ধ করে দিলে সশব্দে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতরে তিনজন বন্দি আড়ষ্ট হয়ে মাটির উপরে শুয়ে রইল নীরবে।… মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই ঘরের বাইরে দরজার ও—পাশ থেকে শোনা গেল খুব সম্ভব পাহারাওয়ালা শম্ভুরই উচ্চ নাসিকাগর্জন!
জয়ন্ত নিম্নকণ্ঠে ডাকলে, ‘বিমলবাবু!’
—’বলুন।’
—’আমাদের পাহারাওয়ালার নাক তো ডাকছে! এইবার বোধহয় মরবার আগে আমরা অল্পস্বল্প গল্প করতে পারি, কী বলেন?’
—’কিন্তু, ভায়া, এখন গল্প করে কোনও লাভ আছে কি?’
—’তাছাড়া আর কী করব বলুন? সামনে যখন জাগছে চিরনিদ্রা, তখন পৃথিবীর এই শেষ—রাতটা ঘুমিয়ে নষ্ট করা কি উচিত?’
—’আমি চিরনিদ্রার ভক্ত নই জয়ন্তবাবু। আমি বেঁচে এই পৃথিবীতে জেগে থাকতেই চাই।’
—’কিন্তু বাঁচবেন কেমন করে? অজানা শত্রুপুরী, আমাদের হাত—পা বাঁধা, বাইরে দরজার সামনেও প্রহরী, বাঁচবার কোনও উপায় আছে কি?’
—’নিরুপায় আমি কখনও হই না জয়ন্তবাবু! হয়তো আমরা বাঁচলেও বাঁচতে পারি।’
—’আপনি এ কী অসম্ভব কথা বলছেন!’
—’ঘরের ভিতরে যখন আলো ছিল তখন আমি কি দেখেছি জানেন জয়ন্তবাবু?’
—’কী দেখেছেন?’
—’আমি যেখানে শুয়ে আছি, ঠিক এইখানেই আমার উপরে দেয়ালের গায়ে আছে কতকগুলো তাক। আর মাঝের একটা তাকের উপরে আছে একখানা দাঁড়—করানো হাত—আয়না।’
—’কিন্তু ও হাত—আয়না নিয়ে আমাদের কী উপকার হবে?’
—’কিছু উপকার হলেও হতে পারে বইকী!’
—’মানে?’
—’আমার হাত আর পা বাঁধা আছে বটে, কিন্তু এই বাঁধা পা—দুটো আমি উপরদিকে তুলে লাথি মেরে ওই হাত—আয়নাটাকে মাটির উপরে ফেলে দিতে পারি।’
জয়ন্ত উৎসাহিত কণ্ঠে বললে, ‘বুঝেছি, বুঝেছি!’
মানিকও চমৎকৃত স্বরে বললে, ‘জয়ন্ত, বিমলবাবু আজ তোমাকে হারিয়ে দিলেন।’
জয়ন্ত বললে, ‘বিমলবাবু চিরদিনই আমাকে হারাতে পারনে, কারণ ওঁর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে ঢের বেশি। একদিন পৃথিবীর বাইরে গিয়েও উনি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।’
ততক্ষণে বিমল তার বাঁধা পা—দুটো উপরদিকে তুলে আন্দাজ করে আয়নার উপরে এমনভাবে পদাঘাত করলে যে, সেখানা মাটির উপরে পড়ে সশব্দে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু সে—শব্দে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন শম্ভুর নাসিকার সঙ্গীত একবারও বন্ধ হল না।
বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কাছে আসুন। আপনি এখনই এই ভাঙা আয়নার একখানা কাচ দাঁত দিয়ে ধরে মাটি থেকে তুলে নিন। ভাঙা কাচের ধার হচ্ছে ক্ষুরের মতন। কাচখানা দাঁতে চেপে ধরে আপনার হাতের দড়ি কাটতে একটুও বিলম্ব হবে না। তারপর যা করতে হবে সেটা আপনাকে বলাই বাহুল্য!’
তিন মিনিট পরে জয়ন্তের দুই হস্ত হল মুক্ত! সে অন্ধকারে হাতড়ে আয়নার আর—একখানা ভাঙা কাচ তুলে নিয়ে আগে নিজের পায়ের দড়ি ফেললে কেটে। তারপর সেই কাচখানা নিয়ে শীঘ্রহস্তে বিমলের হাতের দড়িও কেটে ফেললে। তারপর বিমলের পায়ের দড়ি এবং মানিকের হাত ও পায়ের দড়ি কাটতেও আর বেশি দেরি লাগল না। সবাই যদিও ঘরের ভিতরে বন্দি, তবু তারা এখন রজ্জুর বন্ধন থেকে মুক্ত!
বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, মানিকবাবু, আপনারা ঘরের দরজার ওপাশে দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়ান। আমি দাঁড়াচ্ছি দরজার এপাশে। এইবারে দেখা যাক, কেমন করে শ্রীমান শম্ভুচন্দ্রের নাসিকার সঙ্গীত বন্ধ করা যায়।’ সে হেঁট হয়ে মেঝের উপরে হাত বুলিয়ে ভাঙা—আয়নার ফ্রেমখানা কুড়িয়ে নিলে। তারপর সেখানা বারংবার দেয়ালের উপরে ঠুকতে লাগল সজোরে ও সশব্দে!
দরজার ওপাশে শুয়ে শম্ভু ঘুমোচ্ছিল। বিমলকে বেশিক্ষণ শব্দ সৃষ্টি করতে হল না। প্রথমে থামল শম্ভুর সবাক নাসিকা, তারপর জাগল তার ক্রুদ্ধ কণ্ঠ। সে বললে, ‘কী রে, কী রে, ঘরের ভেতরে তোরা কী করছিস রে?’
বিমলের হাতের আয়নার ফ্রেম আরও জোরে করলে দেয়ালকে আক্রমণ।
—’বটে, বটে, ভালো কথায় কান পাতা হচ্ছে না? দেখবি মজাটা?’
শব্দ থামবার নাম করলে না।
—’নাঃ, জ্বালালে দেখছি। ব্যাটারা ভেবেছে আমাকে ঘুমোতে দেবে না! আচ্ছা, পিঠের ওপরে দমাদ্দম লাথি পড়লেই সব ঠান্ডা হয় কি না দেখি!’
একটু পরেই বাহির থেকে দরজার কুলুপ খোলার আওয়াজ হল এবং তারপর খুলে গেল দরজার পাল্লা দুখানা। লণ্ঠন হাতে করে ঘরের ভিতরে শম্ভুর প্রবেশ।
কিন্তু সে চোখে কিছু দেখবার আগেই জয়ন্তের শিক্ষিত মুষ্টি তার চিবুকের উপরে দিলে প্রচণ্ড এক ‘নক—আউট ব্লো’! একটিমাত্র টুঁ শব্দ উচ্চারণ না করেই শম্ভু মেঝের উপর লম্বা হয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে।
শম্ভুর হাত পা মুখ ভালো করে বাঁধতে বাঁধতে বিমল বললে, ‘অবলাকান্ত সুচতুর বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে সে অতি চালাকি করতে গিয়ে সব পণ্ড করে দেয়। সে বারবার আমাদের বন্দি করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে যদি আমাদের বধ করত তাহলে বহুদিন আগেই তার মনের বাসনা পূর্ণ হত। কিন্তু তার নিষ্ঠুর মন হচ্ছে বিড়ালের মতো। শিকারকে একেবারে মেরে না ফেলে তাকে নিয়ে সে আগে খেলা করতে চায়! তার এই বুদ্ধির দোষেই আমরা বারবার তাকে ফাঁকি দিতে পারছি।’
মানিক বললে, ‘আকাশে আধখানা চাঁদ আছে বটে, কিন্তু বনের ভিতরে অন্ধকারের রাজত্ব। তার উপরে ওরা চোখ বেঁধে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে যদি বাইরে বেরুতে পারি, তাহলে পথ চিনব কেমন করে?’
জয়ন্ত বললে, ‘পথ চেনবার দরকার নেই। আমাদের দক্ষিণদিকে যেতে হবে।’
—’কী করে জানলে?’
—’চোখ বন্ধ থাকলেও আমাদের কানও তো বন্ধ ছিল না। ভুলে যাচ্ছ কেন,এখানে আসবার সময়ে অবলাকান্ত সবাইকে উত্তরদিকে যেতে বলেছিল।’
বিমল ব্যস্তভাবে বললে, ‘আর দেরি করা নয়। আমাদের আগে কুমারের সন্ধান নিতে হবে। তার জন্যে আমার মন ছটফট করছে।’
মানিক বিষণ্ণ কণ্ঠে বললে, ‘কুমারবাবুর যে অবস্থা দেখে এসেছি, জানি না গিয়ে কী দেখব!’
বিমল জোর গলায় বললে, ‘ভালোই দেখব, ভালোই দেখব! এত সহজে মরবার জন্যে আমি আর কুমার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিনি! আমার মন বলছে, কুমার জখম হয়েছে বটে, কিন্তু বেঁচে আছে!’
নবম -তিন ভূতের আবির্ভাব
‘ব্যান্ডেজ’—বাঁধা হাতখানি বুকের কাছে ঝুলিয়ে সুন্দরবাবু নিজের আপিসে একখানা চেয়ারের উপরে বসেছিলেন অত্যন্ত বিমর্ষের মতো। হঠাৎ ঘরের ভিতরে একসঙ্গে প্রবেশ করলে, জয়ন্ত, মানিক, বিমল এবং কুমার—তারও মাথায় ‘ব্যান্ডেজ’ বাঁধা।
সুন্দরবাবু বিপুল বিস্ময়ে ধড়মড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কেবলমাত্র বলতে পারলেন— ‘হুম!’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনার মুখের পানে তাকালে মনে হয়, আপনি যেন ভূত দেখেছেন!’
—’ঠিক তাই জয়ন্ত, ঠিক তাই। একটা—আধটা নয়, তিন—তিনটে ভূত!’
—’আপনি কি আমাদের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন?’
—’একেবারেই।’
—’কেন?’
—’অবলাকান্ত মানুষ নয়, দানব। তার কবল থেকে তোমরা যে মুক্তি পাবে, এতটা আশা আমি করতে পারিনি।’
—’কিন্তু দেখছেন তো, মুক্তি আমরা পেয়েছি?’
—’কেমন করে পেলে?’
জয়ন্ত সংক্ষেপ তাদের কাহিনি বর্ণনা করলে।
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম। এ—যাত্রায় দেখছি আমাদের উপরে টেক্কা মারলেন বিমলবাবুই।’
বিমল বললে, ‘মোটেই নয়, মোটেই নয়! জয়ন্তবাবুর সঙ্গে সঙ্গে আছি বলেই আমার ভোঁতা বুদ্ধি একটু সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। একেই বলে সঙ্গগুণ!’
জয়ন্ত বললে, ‘বিলক্ষণ! বিনয় দেখিয়ে বিমলবাবু লোককে লজ্জা দিতে ভালোবাসেন।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘অতঃপর আমাদের কী কর্তব্য?’
জয়ন্ত বললে, ‘আবার আমরা সদলবলে অবলাকান্তের উদ্দেশে যাত্রা করব।’
—’কবে?’
—’আজকেই।’
—’অসম্ভব!’
—’কেন?’
—’অন্তত এই হাত নিয়ে আমার, আর ওই মাথা নিয়ে কুমারবাবুর পক্ষে আজ যাত্রা করা অসম্ভব। দেখছ না, আমরা দস্তুরমতো আহত?’
কুমার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না সুন্দরবাবু, যাত্রা করবার জন্যে আমি দস্তুরমতো প্রস্তুত।’
—’আরে, বলেন কী মশাই?’
—’হ্যাঁ। আহত হলেও আমি অক্ষম নই।’
—’আপনারা সকলেই পাগলা—গারদের লোক। আর এতটা তাড়াতাড়ির দরকার কী জয়ন্ত? অবলাকান্ত নিশ্চয়ই এতক্ষণে সেই আমবাগানের পোড়োবাড়ি ছেড়ে সরে পড়েছে।’
—’আমরাও তা জানি।’
—’তবে তাকে পাবে কোথায়? তোমরা তার ঠিকানা জানো?’
—’হয়তো জানি।’
—’হয়তো মানে?’
—’মনে করে দেখুন সুন্দরবাবু, ট্রেন আক্রমণের পরে লুটের মাল নিয়ে অবলাকান্ত প্রথমেই কোনদিকে গিয়েছিল?’
—’বনের যে পথে পদচিহ্ন দেখে আমরা ডাকাতদের পিছু নিয়েছিলুম, তারা সেই পথের বাঁদিকের জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছিল আরও—সরু একটা পথ ধরে।’
—’তারপর তারা আমাদের দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি আবার বেরিয়ে এসেছিল পালিয়ে যাবার জন্যে।’
—’হ্যাঁ।’
—’এখন সমস্ত ব্যাপারটা একবার তলিয়ে বুঝে দেখুন। লুটের মাল নিয়ে পালিয়ে সর্বপ্রথমেই ডাকাতদের কোথায় যাওয়া উচিত? নিশ্চয়ই নিজেদের প্রধান আস্তানায়।’
সুন্দরবাবু ঘাড় নেড়ে সমর্থন করে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার এ—কথা মানি বটে।’
—’তাহলেই বোঝা যাচ্ছে, ডাকাতদের সবচেয়ে বড়ো আস্তানা আছে ওই বনের ভিতরেই।’
—’তাও মানলুম। কিন্তু ওখানকার অরণ্য তো ছোট্ট নয়—বিশ—পঁচিশ মাইল ছুটোছুটি করলেও আমরা হয়তো তার শেষ খুঁজে পাব না। আর ডাকাতদের আস্তানাও নিশ্চয়ই কোনও গুপ্তস্থানেই আছে, যা আবিষ্কার করা মোটেই সহজ নয়।’
—’অবলাকান্ত কী—রকম জায়গায় লুকিয়ে আছে সেটাও হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি। যাঁরা অপরাধ—তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ তাঁরা জানেন যে, এক—একজন অপরাধীর এক—এক রকম বিশেষ অভ্যাস থাকে। গোয়েন্দা—কাহিনির নয়, পৃথিবীর সত্যিকার গোয়েন্দারা কোনও মামলা হাতে পেলে আগে দেখবার চেষ্টা করেন, তার ভিতরে অপরাধীর কোনও বিশেষ অভ্যাস প্রকাশ পেয়েছে কি না। যে—মামলায় সেই বিশেষ অভ্যাসের প্রমাণ থাকে তার কিনারা করতেও বিশেষ বিলম্ব হয় না। এই অবলাকান্তের একটা বিশেষ অভ্যাস বরাবরই আমরা লক্ষ করেছি। ‘জেরিনার কণ্ঠহার’ মামলা স্মরণ করুন। সে মামলায় অবলাকান্তকে আমরা পেয়েছিলুম কলকাতার টালিগঞ্জ—অঞ্চলের একটা বুনো জায়গায় একখানা প্রকাণ্ড ভাঙা অট্টালিকার মধ্যে। তারপর ‘সুন্দরবনের রক্তপাগল’ মামলাটাতেও অবলাকান্তকে আমরা খুঁজে বার করেছিলুম কোথায়? সুন্দরবন অঞ্চলে প্রাচীন মৃত্তিকাস্তূপের নীচে প্রোথিত সেকেলে একটা মঠের ভিতরে গিয়ে সে আড্ডা গেড়েছিল। বর্তমান মামলাতেও দেখছি এখানকার বনজঙ্গলেও তার বিভিন্ন আড্ডা আছে, আর সম্প্রতি তার যে আড্ডা থেকে আমরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি তাও আছে একখানা পোড়ো ভাঙা বাড়ির ভিতরে। অবলাকান্ত ভারী চালাক। সে আড্ডা তৈরি করেছে অনেকগুলো, আর এক আড্ডায় সে বেশিদিন থাকে না। তাই তাকে ধরাও সহজ হয় না। আমার বিশেষ সন্দেহ হচ্ছে যে, ওই বনের ভিতরে তার আর একটা আস্তানা আছে, আর সেইটেই হচ্ছে তার প্রধান আস্তানা। ওর ওই প্রধান আস্তানাও হয়তো পাওয়া যাবে একখানা মান্ধাতার আমলের ভাঙা—চোরা বাড়ি বা অট্টালিকার ভিতরে। বাংলাদেশের বহুস্থানেই দেখা যায় এমন গভীর অরণ্য, কিন্তু সেইসব অরণ্যের ভিতরে অন্বেষণ করলে আজও পাওয়া যায় অনেক পুরাতন প্রাসাদ বা বাড়ি, পরিত্যক্ত নগর আর গ্রামের চিহ্ন। অবলাকান্তের বিশেষ অভ্যাস হচ্ছে, সে খুঁজে খুঁজে এই রকম সব জায়গাই বাস করবার জন্যে নির্বাচন করে।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘সবই তো বুঝলুম, কিন্তু আর দু—দিন পরে গেলেই কি ভালো হত না?’
—’না। যদিও সেদিনের বৃষ্টিতে ভেজা মাটি আজ আর নরম নেই, কিন্তু তবু চেষ্টা করলে শুকনো কাদার উপরে এখনও হয়তো তাদের পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারব তারা কোনদিকে গিয়েছে! পায়ের দাগ পাওয়া গেলে অবলাকান্তের আড্ডা খুঁজে বার করতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না! এমন সুযোগ হারাতে আমি প্রস্তুত নই।’
বিমল বললে, ‘আমারও ওই মত। শুভস্য শীঘ্রম!’
কুমার ও মানিক হাসতে হাসতে বললে, ‘আমরাও জয়ন্তবাবুর এই প্রস্তাব সমর্থন করি!’
সুন্দরবাবু মুখের উপরে বিপুল গাম্ভীর্যের বোঝা নামিয়ে বললেন, ‘সব বুঝতে পারছি—হুম! অগত্যা ভাঙা হাত নিয়ে আমাকেও যেতে হবে দেখছি—নইলে মানিক চিরদিনই আমাকে কাপুরুষ বলে যখন—তখন ঠাট্টা করতে ছাড়বে না! মানিক হচ্ছে পাজির পা—ঝাড়া। বরাবরই সে ছিনেজোঁকের মতন আমাকে কামড়ে থাকতে ভালোবাসে! আমি যে কেন ওর এমন চোখের বালি হলুম, ভগবানই তা জানেন! হুম!’
দশম – ভয়াবহ বন্ধু
আবার সেই ঘটনাস্থল।
ট্রেন থেকে সদলবলে নেমে পড়ে জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, সেবারে আমরা বৃহৎ একটা দল নিয়ে দস্যুদের পিছনে অনুসরণ করেছিলুম বলে সফল হতে পারিনি। এবারে আর সে—ভ্রম করতে চাই না।’
—’মানে?’
—’আপনি আহত। আপাতত আপনি সেপাইদের নিয়ে স্টেশনেই অপেক্ষা করুন। ইচ্ছা করলে কুমারবাবুও এখানে অপেক্ষা করতে পারেন, কারণ তিনিও আহত হয়েছেন।’
কুমার বললে, ‘খুব কথাই বললেন যে দেখছি! আমার উপরে এতটা সদয় না হলেও পারতেন। আপনারা আমাকে অক্ষম ভাবছেন, না? তাহলে আমি একটা প্রস্তাব করতে চাই, সমর্থন করবেন?’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললেন, ‘আজ্ঞা করুন!’
—’আপনারা সকলেই খানিকক্ষণের জন্যে এখানে বিশ্রাম করুন। বাঘাকে নিয়ে আমিই ওই বনের দিকে যাত্রা করি। পদচিহ্ন আবিষ্কার করবার শক্তি আমারও আছে—বাঘার তো আছেই! হয়তো এ—বিষয়ে বাঘা আমাদের সকলের চেয়েই শক্তিশালী! আমি একলা গেলে নিশ্চয়ই ডাকাতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব না।’
কুমারের একখানা হাত চেপে ধরে জয়ন্ত বললে, ‘কুমারবাবু, মাপ করবেন। আপনি অক্ষম বলে কোনও ইঙ্গিতই করছি না। বিমলবাবু আর আপনি হচ্ছেন অসাধারণ লোক—আপনারা সব করতে পারেন তা আমি জানি। বেশ, সুন্দরবাবুই তাহলে সেপাইদের নিয়ে এখানে অপেক্ষা করুন, আর আমরা চারজনে মিলে বনের দিকে যাত্রা করি।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বা—রে, আমার কাছে তোমাদের কেউই থাকবে না? তাহলে আমার সময় কাটবে কেমন করে? ওই সেপাইদের সঙ্গে তো আমি গল্প করতে পারি না? অন্তত মানিককেও আমার কাছে রেখে যাও।’
মানিক বললে, ‘পাগল! আমিও জয়ন্তদের সঙ্গে যেতে চাই!’
সুন্দরবাবু মিনতি—ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘না মানিক, তুমি লক্ষ্মীছেলে! তুমি যখন—তখন আমাকে নিয়ে বড়ো বাজে ঠাট্টা করো বটে, কিন্তু তবু তোমাকে আমি ভারী ভালোবাসি। প্রায় বুড়ো হতে চলেছি, আমাকে এখানে একলা ফেলে যেয়ো না।’
জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, আমারও ইচ্ছা তুমি সুন্দরবাবুর কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকো।’
মানিক নাচারের মতন বললে, ‘বেশ, তাহলে আপাতত আমি হুম—বাবুরই পার্শ্বচর হলুম।’
সুন্দরবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘মানিক, মানিক! আবার তুমি আমাকে হুম—বাবু বলে ডাকছ? ও—নাম আমি পছন্দ করি না! তুমি যদি আবার আমাকে হুম—বাবু বলে ডাকো তাহলে এখনই আমি নিজেই তোমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেব! বয়ে গেল, না— হয় আমি একলাই থাকব, না—হয় আমি সেপাইদের সঙ্গেই গল্প করব, ওরাও মানিকের চেয়ে ভদ্দরলোক! হুম—বাবু! হুম—বাবু আবার একটা নাম নাকি? কোনও ছোটোলোকও ও—নাম ধরে কারুকে ডাকতে পারে না! হুম।’
মানিক দক্ষিণবাহু দিয়ে সুন্দরবাবুকে সাদরে বেষ্টন করে মিষ্ট—কণ্ঠে বললে, ‘না সুন্দরবাবু, অন্তত আজ আমি আপনাকে হুম—বাবু বলে ডাকব না! আজ আপনার সঙ্গে খালি ভালো—ভালো গল্প করব, আর যদি ভালো—ভালো খাবার পাওয়া যায় তাহলে দুজনে মিলে বেশ পেট ভরে খাব!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হেঃ, এটা আবার একটা স্টেশন নাকি, এখানে ‘প্যাসেঞ্জার’ ছাড়া আর কোনও ট্রেনই থামে না। এখানে বসে তুমি খেতে চাও ভালো ভালো খাবার? মরুভূমিতে তুমি খুঁজতে চাও রজনীগন্ধার চারা? সত্যি মানিক, তুমি অত্যন্ত বোকা কিন্তু।’
মানিক সকৌতুকে খিল—খিল করে হেসে উঠে বললে, ‘উঁহু, উঁহু! কে বলে আমি অত্যন্ত বোকা? অত্যন্ত বলছেন কী মশাই, আমি অল্প বোকাও নই। ভালো—ভালো খাবারের জন্যে আমি স্টেশনের মুখ চেয়েই বসে আছি নাকি?’
—’হুম! তোমার এ—কথার অর্থ কী?’
—’অর্থ হচ্ছে এই, আমার হাতে এই যে ‘টিফিন কেরিয়ার’টি দেখছেন, এর মধ্যে কী কী খাবার আছে জানেন?’
—’তাই নাকি, তাই নাকি, তাই নাকি?’
—’আজ্ঞে হ্যাঁ! এই ‘টিফিন কেরিয়ারে’র ভিতরে আছে ‘ফাউল রোস্ট’, ‘মটন কাটলেট’, ‘পোলাও’, ‘চিংড়ি—মাছের মালাইকারি’, ‘রুই—মাছের কালিয়া’, আর ‘ভেটকি—মাছের ফ্রাই’।’
—’তাই নাকি, তাই নাকি? হুম, হুম, হুম, হুম! মানিক, তোমার মতন মধুর ছেলে জীবনে আমি আর কখনও দেখিনি। কিন্তু লক্ষ্মী—ভাইটি আমার, তুমি দয়া করে আমাকে আর হুম—বাবু বলে ডেকো না, ও—নামে ডাকলেই আমার মেজাজ কেমন বিগড়ে যায়। এই সেপাই! স্টেশনমাস্টারকে গিয়ে বল—গে যা, আমার জন্যে এখনই যেন ‘ওয়েটিং রুম’ খুলে দেয়। ভয়ঙ্কর ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে, আমরা এখন ওখানে গিয়ে খাওয়া—দাওয়া করব, কী বলো মানিক?’
মানিক অতিশয় গম্ভীর মুখে বললে, ‘নিশ্চয়ই।’
বিমল, কুমার ও জয়ন্ত হাসতে—হাসতে সেতুর দিকে চলে গেল এবং বিমলের ডাক শুনে তাদের সঙ্গে—সঙ্গে লাঙ্গুল আন্দোলন করতে—করতে ছুটে গেল বাঘাও।
আবার বনের সেই পথ। সেখানে বড়ো—পথের বাঁ—দিক দিয়ে একটি ছোটো পথ গভীর জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করেছে।
জয়ন্ত নীচের দিকে অঙ্গুলি—নির্দেশ করে বললে, ‘দেখুন বিমলবাবু, শুকনো কাদার উপরেও এখনও রয়েছে কত পদচিহ্ন। দু—দিন পরে এলে এ—চিহ্ন হয়তো আমরা দেখতে পেতুম না। চলুন, আমরাও এগিয়ে যাই।’ বাঘার মাথার উপরে হাত দিয়ে কুমার তাকে দেখিয়ে দিলে সেই পদচিহ্নগুলো। সুশিক্ষিত সারমেয়—অবতার বাংলার স্বদেশী জীব বাঘা! কুমারের ইঙ্গিত বুঝতে তার একটুও দেরি লাগল না। সে তৎক্ষণাৎ মাটির উপরে মুখ নামিয়ে মিনিট—খানেক ধরে আঘ্রাণ নিলে, তারপর অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে কুমারের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করতে লাগল, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ’।
কুমার আদর করে তার মাথা চাপড়াতে—চাপড়াতে বললে, ‘তাহলে বাঘা, তুই আমার কথা বুঝতে পেরেছিস তো? তবে চল ওই পায়ের দাগগুলো ধরে আমাদের আগে—আগে।’
বাঘা সানন্দে লাফ মেরে একবার কুমারের গাল চেটে দেবার চেষ্টা করলে। তারপর নিজের লাঙ্গুলকে জয়নিশানের মতন ঊর্ধ্বে তুলে মৃত্তিকার উপরে নিজের নাসিকাকে প্রায় সংলগ্ন করে অগ্রসর হতে লাগল দ্রুতপদে।
বিমল খুশি—ভরা গলায় বললে, ‘ব্যস, আমাদের আর কোনওই বেগ পেতে হবে না। বাঘা যখন গন্ধ পেয়েছে, তখন মাটির উপরে যেখানে দৃশ্যমান পায়ের দাগ থাকবেও না, সেখানেও সেই অদৃশ্য গন্ধকেই অনুসরণ করে আমাদের যথাস্থানেই নিয়ে গিয়ে হাজির করবে। বাঘাকে আমি চিনি। আগেও সে এইভাবে আমাদের অনেকবার পথ দেখিয়েছে। কুমার তাকে কী সুন্দর শিক্ষাই দিয়েছে—বাহাদুর কুমার, বাহাদুর! আর আমাদের কোনওই ভাবনা নেই।’
বিমল যে সন্দেহ প্রকাশ করলে, খানিক পরেই দেখা গেল তা মোটেই ভুল নয়। মিনিট—পনেরো অগ্রসর হবার পরেই বনের একটা অংশ শেষ হয়ে গেল। তারপর রয়েছে একটা কাঁকর—ভরা মাঝারি আকারের মাঠ, তার উপরে পায়ের ছাপের বা পথের কোনও চিহ্নই নেই। আসামিরা কোনদিকে গিয়েছে কোনও তীক্ষ্নদৃষ্টি বিশেষজ্ঞের পক্ষেও আর তা আন্দাজ করা অসম্ভব।
কিন্তু বাঘা একবারও দাঁড়াল না, একবারও ইতস্তত করলে না। মৃত্তিকার উপরে নাসিকা সংলগ্ন করে সমানে এগিয়ে যেতে লাগল।
কুমার বললে, ‘দেখছেন জয়ন্তবাবু, এখানে বাঘা না থাকলে আমাদের কী মুশকিলেই পড়তে হত?’
—’মুশকিল বলে মুশকিল! এখানে কিছুতেই আমরা গন্তব্য পথ খুঁজে পেতুম না। আশ্চর্য কুকুর! শিক্ষাগুণে দেশি কুকুর যে এতটা বুদ্ধিমান হয়, স্বচক্ষে না দেখলে আমি তা বিশ্বাস করতেই পারতুম না।’
মাঠ শেষ। আবার ঘন বনজঙ্গল। ঝোপঝাপের আশপাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা আর একটা সংকীর্ণ পথের রেখা—এতটা অস্পষ্ট যে, সহজে সেখানে পথ আছে বলে মনে সন্দেহই হয় না। সেই পথটাই অবলম্বন করলে বাঘা।
অরণ্য হয়ে উঠছে ক্রমেই বেশি নিবিড়। স্থানে স্থানে মাথার উপরেও এমন পুরু লতাপাতার আচ্ছাদন যে, সূর্যালোক হারিয়ে সেসব ঠাঁই হয়েছে অন্ধকারে রহস্যময়। সেখানে কোনওরকমে চোখ চলে, কিন্তু স্পষ্ট কিছুই দেখা যায় না।
চলতে চলতে জয়ন্ত হঠাৎ বিমলের গা টিপলে। আর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিমল সচমকে দেখলে, সুমুখের একটা ঝোপের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে দুটো তীব্র ও বন্য চক্ষু!
জয়ন্ত একলাফ মেরে সেই ঝোপের উপরে গিয়ে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে বিমল ও কুমারও। কিন্তু ঝোপ ফাঁক করে কিছুই আবিষ্কার করা গেল না। কেবল দেখা গেল যে, এ—ঝোপ থেকে ও—ঝোপের ভিতর দিয়ে একটা চাঞ্চল্যের তরঙ্গ ছুটে চলে যাচ্ছে ক্রমেই দূরের দিকে!
জয়ন্ত বন্দুক তুললে।
বিমল বাধা দিয়ে বললে, ‘থাক। ঝোপের ফাঁকে যে অদ্ভুত চোখ দেখলুম তার মধ্যে মানুষী ভাব নেই। জঙ্গল ভেদ করে মানুষও বোধহয় অত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে না। হয়তো ওটা কোনও বড়ো—জাতের বন্য জন্তু।’
—’ওটা জন্তু কী মানুষ, বন্দুক ছুড়লেই সে সন্দেহ ভঞ্জন হতে পারে।’
—’সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্ত আশা—ভরসার মূলে কুঠারাঘাত হতে পারে। এই বনে যদি শত্রুদের আস্তানা থাকে, বন্দুকের শব্দ কি সেখানে গিয়ে পৌঁছোবে না?’
জয়ন্ত জিভ কেটে বললে, ‘ঠিক বলেছেন! ঝোঁকের মাথায় ভুলে গিয়েছিলুম! আর—একটু হলেই সমস্ত পণ্ড করেছিলুম আর কী!’
পথ চলতে চলতে কাটল আরও কিছুক্ষণ। অরণ্য হয়ে উঠেছে অধিকতর দুর্ভেদ্য। সরু পথটা চলেছে যেন অজগরের মতন কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে। কোনওদিকেই হাত—কয়েক দূরে আর কিছুই দেখবার জো নেই। মাথার উপরে জ্যান্ত পাতার মর্মরধ্বনি, পায়ের তলায় মরা পাতার আর্তনাদ, চারিদিকে দিবাকালেও যেন চিরসন্ধ্যার আবছায়া, কোথাও কোনও প্রাণীর সাড়া নেই—পাখিরাও যেন কোনও অজানার ভয়ে সেখানে গান গাইতে ভরসা পায় না।
কী যেন একটা বুকচাপা অমঙ্গলের থমথমে ভাব জেগে উঠছে দিকে দিকে—যেদিকে তাকানো যায় সেইদিকেই। অনন্ত নীলিমার অভিনন্দন এবং সূর্যালোকের সোনালি আশীর্বাদ থেকে চিরবঞ্চিত এ যেন এক অভিশপ্ত অরণ্যজগৎ, হিংসা আর হত্যার দুঃস্বপ্ন এখানে যেন যেখানে—সেখানে ওত পেতে অপেক্ষা করে থাকে, প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে—সঙ্গেই হয় ঘন ঘন হৃৎকম্প! তবু এটা দিনের বেলা, অন্ধ নিশীথে চক্ষু যখন হয় একেবারেই দৃষ্টিহীন, তখন এই অরণ্যানী যে কতখানি বিভীষণা হয়ে ওঠে, সেকথা কল্পনা করলেও স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রাণ—মন।
জায়গায় জায়গায় রয়েছে এক—একটা মহাকায় বনস্পতি, তারা প্রত্যেকেই যেন বহু ঊর্ধ্বে উঠে শূন্যের অনেকখানি পূর্ণ করে ঘন শাখাপল্লব দিয়ে সৃষ্টি করতে চায় নতুন নতুন অরণ্য! কোনও—কোনও বনস্পতি আবার এমন গাঢ় অন্ধকার মাখা যে, তার সীমারেখা পর্যন্ত আন্দাজ করবার উপায় নেই।
এমনি একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে উপরদিকে মুখ তুলে জয়ন্ত লক্ষ করলে, অরণ্যের ক্ষুদ্রতর সংস্করণের মতো সেই সুবৃহৎ বটগাছের এখানে—ওখানে জমাট অন্ধকার ফুটো করে ফুটে ফুটে উঠছে যেন সব আশ্চর্য আগুনের ফিনকি! সেগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে আর নিবছে, জ্বলছে আর নিবছে! কিন্তু জোনাকিরা মনে জাগায় না ত্রাস, এগুলো দেখলে বুক কেমন ছমছম করে ওঠে, এ—সব অগ্নিকণার মধ্যে আছে যেন কোনও হিংস্র পৈশাচিকতা—এরা যেন বনবাসী ক্ষুধার্ত রক্তলোভীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়!
জয়ন্ত বিস্মিতভাবে কী বলবে ভাবছে, এমন সময়ে বিমল ও কুমার হেসে উঠল সকৌতুকে! এমন ভয়াবহ স্থানে সেই তরল কৌতুক—হাস্যকেও মনে হল অত্যন্ত অস্বাভাবিক!
—’আপনারা হঠাৎ হাসলেন কেন?’
—’অন্ধকারে গাছের ভিতরে যেগুলো জ্বলে জ্বলে উঠছে ওগুলো বাদুড় কী প্যাঁচার চোখ। খুব সম্ভব বাদুড়ের।’
তারা আবার এগিয়ে চলল—সেই দীপ্তদৃষ্টিময় বটগাছটাকে পিছনে ফেলে।
খানিকদূর এগিয়ে জয়ন্ত সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘এ বনে আমরা ছাড়া আর কোনও মানুষ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাঘা ভুল পথে যাচ্ছে না তো?’ কুমার মাথা নেড়ে বললে, ‘বাঘা এমন ভুল কখনও তো করেনি!’
বিমল বললে, ‘বনে এখন শত্রুদের অস্তিত্ব আছে কি না বলতে পারি না, কিন্তু এখান দিয়ে যে মানুষ আনাগোনা করে তার প্রমাণ তো এই পথটাই। এখানে মানুষ নিয়মিত কাজে পদার্পণ না করলে এই পথের কোনও চিহ্নই থাকত না, ঘন জঙ্গল নিশ্চয়ই তাকে নিঃশেষে গ্রাস করে ফেলত।’
জয়ন্ত বললে, ‘তাও তো বুঝছি। কিন্তু পথ আমাদের আরও কত দূরে কোথায় টেনে নিয়ে যেতে চায়?’
—’খুব সম্ভব পথ শেষ হবে অবলাকান্তের আস্তানার কাছে গিয়ে।’
কুমার বললে, ‘আস্তানার খোঁজ যদি পাই, আমরা কী করব?’
জয়ন্ত বললে, ‘আবার আমাদের স্টেশনে সুন্দরবাবুর কাছে ফিরে যেতে হবে!’
—’তাতে অনেকটা সময় নষ্ট হবে না কি?’
—’নষ্ট হলেও উপায় নেই। শুনেছি এখানে নাকি শতাধিক ডাকাত আছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা তিনজনে কিছুই করতে পারব না।’
—’স্টেশন থেকে আমরা আবার যখন সদলবলে ফিরে আসব, তখন সন্ধ্যা উতরে যাবে।’
—’আসুক রাত্রি, আজ তার অন্ধকার হবে আমাদের বন্ধুর মতো। শত্রুদের চোখের আড়ালে থেকে আবার আমরা বনের ভিতরে ঢুকতে পারব। অন্ধকারেও আমাদের খুব বেশি অসুবিধা হয়তো হবে না, কারণ চোখ অন্ধ হলেও আমাদের পথ দেখাবে বাঘার নাসিকা।’
চারিদিকে তীক্ষ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, বারবার আমার কী সন্দেহ হচ্ছে জানেন? কে যেন আনাচে—কানাচে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে, আমাদের ভাবভঙ্গি সমানে লক্ষ করছে, আমাদের প্রত্যেক কথা কান পেতে শুনছে।’
—’ওটা বোধহয় আপনার মনের ভ্রম। আমি তো এখানে কারুর সাড়া পাচ্ছি না। বরং মনে হচ্ছে এ বন যেন মনুষ্য—বর্জিত।’
আচম্বিতে যেন জয়ন্তের কথার প্রতিবাদ করবার জন্যেই অরণ্যের একটা অত্যন্ত— অন্ধকার অংশ থেকে ঠিক অপার্থিব স্বরেই খিল খিল করে কে হাসতে লাগল হি হি হি হি হি হি। সেই অদ্ভুত হাস্যধ্বনি রীতিমতো রোমাঞ্চকর!
জয়ন্ত ও বিমল চমকে উঠে পরস্পরের মুখ—চাওয়া—চাওয়ি করলে।
কুমার বললে, ‘যেদিন আহত হয়েছিলুম সেদিনও আমি শুনেছিলুম এই বিশ্রী হাসিই।’
জয়ন্ত সবিস্ময়ে বললে, ‘কিন্তু এ কে? এমন করে হাসে কেন?’
বিমল বললে, ‘এ যে শত্রুদের চর নয় এ—বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। শত্রুচর হলে লোকটা এমনভাবে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিত না।’
হাসির পর হাসির ধাক্কায় তখনও বন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
জয়ন্ত বললে, ‘খানিক আগে ঝোপের ফাঁকে আমরা বোধহয় এরই চোখ দেখতে পেয়েছিলুম।’
বিমল বললে, ‘তাহলে বলতে হবে এর চোখ দুটো হচ্ছে বন্যজন্তুর চোখের মতো। এ আমাদের সঙ্গে—সঙ্গে আসেই—বা কেন, আর দিনে—রাতে বনে বনে থাকেই—বা কেন?’
হাসি থামিয়ে হঠাৎ কে উদভ্রান্ত তীক্ষ্নস্বরে বলে উঠল, ‘দিন—রাত বনে বনে থাকি কেন? দিন—রাত বনে বনে থাকি কেন? ওরে তোরা বুঝতে পারবিনি রে, বুঝতে পারবিনি, সে কথা বুঝতে পারবিনি!’
বিমল চেঁচিয়ে বললে, ‘কে তুমি?’
—’হা হা হা হা! কে আমি? আমি তোদের বন্ধু!’
—’তুমি আমাদের বন্ধু!’
—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তোদের বন্ধু! কারণ তোরাও যা চাস, আমিও তাই চাই!’
—’আমরা কী চাই তুমি জানো?’
—’জানি জানি, ভালো করেই জানি! এগিয়ে যা, আরও খানিক এগিয়ে যা, তোরা আজ ঠিক পথই ধরেছিস! এই পথের শেষে আছে জঙ্গলে—ঢাকা ভাঙাবাড়ি। সেইখানেই তোদের মনের বাসনা পূর্ণ হবে।’
জয়ন্ত বললে, ‘তুমি তো অনেক কথাই জানো দেখছি! বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছ, একবার বাইরে বেরিয়ে এসো না।’
—’না, না, না। আমাকে দেখলে তোরা ভয় পাবি।’
—’বেশ, দেখা যাক তোমাকে দেখে আমরা ভয় পাই কি না।’ বলেই বিমল দুই হাতে ঝোপ ঠেলে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করলে।
খানিক দূরের একটা ঝুপসি গাছের তলায় শুকনো পাতার শব্দ জাগল। দেখা গেল যেন একটা বিদ্যুৎগতিতে বিলীয়মান ছায়াকে। তারপর আর কিছুই দেখা বা শোনা গেল না।
ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বিমল হতাশ কণ্ঠে বললে, ‘নাঃ, লোকটার পাত্তা পাওয়া গেল না! সেও দেখছি এই বনের আর একটা মূর্তিমান রহস্য!’
কুমার বললে, ‘কিন্তু সে আমাদের উদ্দেশ্য জানলে কেমন করে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!’
বিমল বললে, ‘কেবল তাই নয়, বললেল, তার আর আমাদের মনের বাসনা নাকি এক। এ কথারই বা অর্থ কী?’
—’লোকটা ছদ্মবেশী পুলিশের চর নয় তো?’
—’পুলিশের চর কখনও অমন পাগলের মতন অট্টহাসি হাসে? সে আমাদের দেখা দিতেও প্রস্তুত নয়। বলে কিনা তাকে দেখলে আমরা ভয় পাব। তার মূর্তি কি এমনই ভয়াবহ?’ কথা কইতে কইতে সকলে অগ্রসর হচ্ছে। তারপর তারা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। সেখানে ছিল খানিকটা ঘাসজমি—তার আয়তন ত্রিশ—পঁয়ত্রিশ বিঘার বেশি নয়। জমির একপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে একটি নদী, রৌদ্রকিরণে যার জলধারাকে মনে হচ্ছে হীরকধারার মতো। হয়তো এখান থেকে অনেক দূরে এই নদীরই উপরে আছে সেই সেতু, যার সাহায্যে তারা এসেছে এপারে।
ফাঁকা ঘাসজমির উপরটা শুঁকতে শুঁকতে বাঘা চলল ওধারের বনের দিকে। সকলে যখন বনের খুব কাছে এসে পড়েছে তখন হঠাৎ জাগল এক আকাশ—বাতাস—কাঁপানো বিকট চিৎকার : ‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার! সামনেই দুশমন—আর তাকে পালাতে দিয়ো না, দিয়ো না, দিয়ো না!’
বিমলদের কাছে থেকে হাত—বিশ তফাতে, বনের ভিতর থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে এল একটা সুদীর্ঘ ও বিপুল মূর্তি।
সেই অদ্ভুত চিৎকার শুনে মূর্তিটা চমকে উঠে একবার পিছন ফিরে তাকালে। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে চেয়েই সে স্তম্ভিতের মতন দাঁড়িয়ে পড়ল।
সে হচ্ছে অবলাকান্ত স্বয়ং।
একাদশ – জয়, বাঘার জয়
অবলাকান্তের স্তম্ভিত ভাবটা স্থায়ী হল সেকেন্ড দুই মাত্র।
তারপরেই সে আবার পিছন ফিরে মস্ত এক লাফ মেরে ঢুকল গিয়ে বনের ভিতরে!
জয়ন্ত, বিমল ও কুমারও চোখের সুমুখে আচম্বিতে অবলাকান্তকে দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। যার জন্যে এত হাঙ্গামা, সে যে নিজেই এমন অভাবিত রূপে তাদের কাছে একলা এসে দাঁড়াবে, এতটা আশা করতে পারেনি তারা।
এখন অবলাকান্ত আবার সরে পড়ে দেখে তাদের চটক গেল ভেঙে। তারাও প্রাণপণে ছুটল তার পিছনে পিছনে।
কুমার চিৎকার করে বললে, ‘বাঘা, বাঘা! তুই আমাদেরও চেয়ে জোরে ছুটতে পারিস! ধর, ধর, অবলাকান্তের একখানা পা কামড়ে ধর!’
বাঘা এক দৌড়ে স্যাঁত করে বনের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জয়ন্ত, বিমল ও কুমার বনে ঢুকে অবলাকান্ত বা বাঘা কারুকেই দেখতে পেলে না।
অল্পক্ষণ এদিকে—ওদিকে ছুটোছুটি করবার পর বিমল বললে, ‘এখন কোনদিকে যাই? অবলাকান্ত আবার বুঝি আমাদের কলা দেখালে!’
জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু বাঘা এখনও নিশ্চয়ই তার পিছু ছাড়েনি!’
কুমার বললে, ‘সেইটেই হচ্ছে ভাবনার কথা। বাঘা যে অবলাকান্তের পিছু ছাড়বে না, আমি তা জানি। কিন্তু বাঘা যদি তার আড্ডার কাছ পর্যন্ত যায়, তাহলে আর কি তাকে ফিরে পাব?’
বিমল বললে, ‘আমরা সকলেই সশস্ত্র। যতদূর মনে হল অবলাকান্ত নিরস্ত্র আর একাকী। এসো, আমরা তিনজনে বনের তিনদিকে যাই—কোনও—না—কোনওদিকে নিশ্চয়ই অবলাকান্ত আর বাঘার সন্ধান পাওয়া যাবে। আপনি কী বলেন জয়ন্তবাবু?
জয়ন্ত বললে, ‘আমি কি ভাবছি জানেন? কুকুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ কখনও এতক্ষণ দৌড়োতে পারে না। এতক্ষণে বাঘার অবলাকান্তকে ধরে ফেলবার কথা। তবু দুই প্রাণীর কারুরই সাড়া পাচ্ছি না কেন?’
বিমল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললে, ‘ঠিক বলেছেন, এতক্ষণে একথা তো ভেবে দেখিনি! আমরা সকলেই জানি, অবলাকান্ত হচ্ছে অসুরের মতন বলবান। তাহলে সে কি এর মধ্যেই বাঘাকে বধ করে ফেলেছে?’
কুমার করুণ স্বরে চেঁচিয়ে ডাকলে, ‘বাঘা, বাঘা, বাঘা! ওরে বাঘা রে!’
বেশ—খানিকটা তফাত থেকে বাঘার সাড়া ভেসে এল, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’
কুমার সানন্দে নৃত্য করে বলে উঠল, ‘আমার বাঘা বেঁচে আছে—আমার বাঘা বেঁচে আছে! বাঘা! বাঘা!’
—’ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’
বিমল বললে, ‘বাঘা সাড়া দিচ্ছে বনের দক্ষিণদিক থেকে।’
কুমার ব্যস্তভাবে সেইদিকে ছুটতে ছুটতে বললে, ‘চলো চলো, দেখে আসি ব্যাপারটা কী?’
কুমার দৌড়োতে দৌড়োতে ক্রমাগত ‘বাঘা বাঘা’ বলে ডাক দিতে লাগল এবং বাঘাও ক্রমাগত ‘ঘেউ ঘেউ’ করে দিতে লাগল তার জবাব! বাঘার গলার আওয়াজ শুনেই তারা তিনজনেই অগ্রসর হতে লাগল। ক্রমেই বাঘার কণ্ঠস্বর এগিয়ে এল তাদের কাছ থেকে আরও কাছে।
তার অল্প পরেই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাঘা চিৎকার করতে করতে উপর—পানে মুখ তুলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণদিকে। এবং গাছের উপরে হচ্ছে ঘন—ঘন—ডাল—পাতা নড়ে ওঠার শব্দ! সে—শব্দ একটা গাছের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে নেই, শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে একটা গাছ থেকে আর একটা গাছের দিকে!
বিমল হেসে ফেলে বললে, ‘কুমার, কাণ্ডটা কী বুঝছ তো? তোমার বাঘার দাঁতের আদর থেকে নিস্তার পাবার জন্যে অবলাকান্ত গিয়ে চড়েছে ওই গাছের উপরে! এখানকার গাছগুলো ঠিক যেন দাঁড়িয়ে আছে পরস্পরকে জড়াজড়ি করে, তাই সুমাত্রাদ্বীপের ওরাং—উটানের মতন অবলাকান্তও পালিয়ে যাচ্ছে ডাল ধরে এক গাছ থেকে পাশের গাছের উপরে লাফ মারতে মারতে! অবলাকান্তকে আমি বাহাদুর উপাধি দিতে বাধ্য, কারণ আমিও বোধহয় বানরের ধর্ম এমন ক্ষিপ্রগতিতে পালন করতে পারতুম না! আশ্চর্য মানুষ এই অবলাকান্ত!’
বাঘার সঙ্গে এগুতে এগুতে জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু এইবারে অবলাকান্ত—বাবাজি যাবেন কোথায়? গাছের সার শেষ হয়ে এসেছে, তারপরই দেখছি ফাঁকা জায়গা, আর তারপরেই সেই নদীটা! এইবারে শ্রীমানকে আমাদের বন্দুকের গুলি খেয়ে মাটির উপরে আছড়ে পড়তে হবে! শোনো অবলাকান্ত, এই বেলা ভালোয় ভালোয় আত্মসমর্পণ করো!’
অবলাকান্ত তখন শেষ—গাছের একটা উঁচু ডালের উপরে দাঁড়িয়ে। সে হিংস্র জন্তুর মতন গর্জন করে বললে, ‘আত্মসমর্পণ? অবলাকান্ত জীবনে কখনও আত্মসমর্পণ করতে শেখেনি! ওইখানে দাঁড়িয়ে থাক তোরা ছুঁচো—ইঁদুরের দল! আমি এখনই গাছ থেকে নেমে তোদের প্রতি—আক্রমণ করব! মরি তো লড়তে লড়তেই মরব!’ বলেই সে আশ্চর্য তৎপরতার সঙ্গে শেষ—গাছের উপর থেকে নীচের দিকে নেমে আসতে লাগল! তার অভাবিত নির্ভীকতা দেখে জয়ন্ত, বিমল ও কুমার হতভম্বের মতো অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!
অনেকটা নীচে নেমেই অবলাকান্ত এদিকে আসতে আসতে হঠাৎ ফিরে মাথার উপরকার একটা ডাল ধরে এবং পায়ের তলাকার একটা ডালের উপর দিয়ে সেইরকম অদ্ভুত ক্ষিপ্রগতিতে অন্য দিকে চলে গিয়ে লাফ মেরে মাটির উপরে গিয়ে পড়ল। তারপর ঝড়ের মতন ছুটে চলল নদীর দিকে! বাঘা কিন্তু শত্রুর দিকে তার দৃষ্টি রেখেছিল সম্পূর্ণ জাগ্রত। সেই তিরের মতন ছুটল অবলাকান্তের পিছনে পিছনে! তারপর অবলাকান্ত প্রায় যখন নদীর কাছে গিয়ে পড়েছে, বাঘা তখন তার উপরে লাফিয়ে পড়ে শত্রুর একখানা পা প্রাণপণে কামড়ে ধরলে!
বিপুলবপু অবলাকান্ত বাঘাকে কিন্তু গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না। সে পা—সুদ্ধ বাঘাকে নিয়ে টানতে টানতে এগিয়ে গিয়ে নদীর জলে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করলে!
বিমল চিৎকার করে বললে, ‘গুলি করো! অবলাকান্তের পা লক্ষ্য করে গুলি করো! ‘জেরিনার কণ্ঠহার’ মামলায় অবলাকান্ত গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আমাদের ফাঁকি দিয়েছিল! ‘সুন্দরবনের রক্তপাগল’ মামলাতেও মোটরবোট থেকে ও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আর একবার সরে পড়েছিল! এবারও সে নদীকেই অবলম্বন করতে চায়! গুলি করো, গুলি করো, গুলি করো!’
বিমল, কুমার ও জয়ন্ত তখনই বন্দুক তুলে ধরলে। কিন্তু তারপর চোখের নিমেষেই ঘটল এক কল্পনাতীত ঘটনা!
যেন নদী—তীরের মাটি ফুঁড়েই আবির্ভূত হল এক অমানুষিক মূর্তি! উচ্চতায় সে প্রায় সাড়ে ছয়—ফুট, কিন্তু দেহ তার ঠিক মাংসহীন কঙ্কালের মতন শীর্ণ! তার মাথা থেকে লটপট ও ছটফট করতে করতে বিষাক্ত সাপের মতন ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে দীর্ঘ দীর্ঘ তৈলহীন রুক্ষ জটা! এবং দুই—চক্ষে তার জ্বলে জ্বলে উঠছে অসীম নিষ্ঠুরতার অগ্নিশিখা! প্রায়—উলঙ্গ তার দেহ, কোমরে তার ঝুলছে কেবল এক—টুকরো অতি মলিন ন্যাকড়া! সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে বিমল, কুমার ও জয়ন্ত এমন স্তম্ভিত হয়ে গেল যে, হাতের বন্দুক হাতেই রেখে তারা বসে রইল নিশ্চল মূর্তির মতন!
সেই প্রেত—মূর্তিকে দেখেই অবলাকান্ত সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না। কারণ ছিনেজোঁক বাঘা তখনও তাকে ত্যাগ করেনি, সে নিজের দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে শত্রুর পা ধরে আকর্ষণ করতে লাগল।
প্রেত—মূর্তিটা একটা দুঃস্বপ্নের ঝটকার মতন অবলাকান্তের উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে বিদ্যুৎ খেলিয়ে তার হাতের ছোরা উপরে উঠল এবং চকিতে অবলাকান্তের বুকের উপরে গিয়ে নামল! এদিকে—ওদিকে বুকের রক্ত ছিটিয়ে বিষম একটা আর্তনাদ করে অবলাকান্ত পড়ল মাটির উপর লুটিয়ে।
তার পাশে গিয়ে সেই প্রেতের মতন মূর্তি সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড কণ্ঠে বললে, ‘আমাকে চিনতে পারছিস অবলাকান্ত? চার বছর আগে তুই তোর ডাকাতের দল নিয়ে আমার বাড়ির উপরে হানা দিয়েছিলি! তুই আমার স্ত্রী, দুই ছেলে আর মেয়েকে খুন করে আমার বংশে বাতি দিতে আর কারুকে রাখিসনি! সেদিন কোনওগতিকে প্রাণ নিয়ে আমি পালিয়ে যেতে পেরেছিলুম! কিন্তু আমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাইনি, আমি পালিয়ে গিয়েছিলুম প্রতিশোধ নেবার জন্যে বেঁচে থাকব বলে! বন্যজন্তুর মতন তুই বনে বনে থাকিস, আমিও তোর পিছনে—পিছনে ছায়ার মতন ঘুরে হইছি অমানুষ বন্যজন্তুরই মতন! চিনতে পারিস? তুই আজ আমাকে চিনতে পারিস কি? হা—হা—হা—হা—হা—হা! প্রতিশোধ নিয়েছি, আজ আমি প্রতিশোধ নিয়েছি!’
বাঘা তখনও অবলাকান্তের পা ছাড়েনি এবং সে সাংঘাতিকরূপে আহত হয়েও তখনও মরেনি। সেই অবস্থাতেই সে হঠাৎ উঠে বসল এবং প্রাণপণে নিজের দুই বলিষ্ঠ বাহু জড়িয়ে প্রেত—মূর্তিকে ধরে নিজের কাছে টেনে মাটির উপরে আছড়ে ফেললে। এবং তারপর সজোরে চেপে ধরলে তার কণ্ঠদেশ! কিন্তু কণ্ঠ যখন তার রুদ্ধ হচ্ছে যাচ্ছে তখনও সেই মূর্তিটা অবলাকান্তের দেহের উপরে চকচকে ছোরার আঘাত করতে লাগল বারংবার। তারপর দুই মূর্তি নদীতীরে পড়ে রইল একেবারে নিশ্চেষ্ট নির্জীবের মতন।
সর্বাগ্রে কুমার গিয়ে বললে, ‘বাঘা, তুই ওর পা ছেড়ে দে। তুই কাকে কামড়ে আছিস? তোর শত্রু মরে গেছে!’
বাঘা তার শত্রুকে ত্যাগ করে প্রভুর দিকে রক্তাক্ত মুখ তুলে সানন্দে ও সবেগে লাঙ্গুল আন্দোলন করতে লাগল।
বিমল কাতর কণ্ঠে বললে, ‘অবলাকান্তের মতন শরীরী পাপ পৃথিবী থেকে বিদেয় হল বলে আমি কিছুমাত্র দুঃখিত হইনি। কিন্তু এই হতভাগ্য উন্মত্তের জন্যে আমার সমস্ত প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অবলাকান্ত মরে গিয়েও দুই হাত ওর গলা চেপে রয়েছে। বেচারিকে ওর হাত ছাড়িয়ে একবার পরীক্ষা করে দেখুন তো জয়ন্তবাবু, ও এখনও বেঁচে আছে কি না?’
জয়ন্ত সেই শীর্ণ—বিশীর্ণ প্রায় নগ্ন কঙ্কালমূর্তিকে অবলাকান্তের বন্ধন থেকে মুক্ত করে নিয়ে দুঃখিতভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘এ আর বেঁচে নেই বিমলবাবু! প্রতিশোধ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দানবের কবলে এর মৃত্যু হয়েছে! এই আমার খেদ রইল যে, শেষ পর্যন্ত অবলাকান্তকে ফাঁসিকাঠে দোলাতে পারলুম না!’
বিমল বললে, ‘মানুষের সব আশা পূর্ণ হয় না জয়ন্তবাবু! কিন্তু অবলাকান্ত আজ যে এই দুনিয়ায় নেই, পৃথিবীর পক্ষে এটা কি একটা সান্ত্বনার কথা নয়?’
কুমার সগর্বে বললে, ‘বাঘা, আমার বাঘা! অবলাকান্তকে কে ধরতে পারত আমার বাঘা না থাকলে?’
বিমল হেঁট হয়ে বাঘাকে কোলে করে তুলে নিয়ে বললে, ‘ঠিক কথাই তো! বলুন জয়ন্তবাবু—জয়, বাঘার জয়।’
জয়ন্ত সাদরে বাঘার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে—দিতে বললে, ‘এ—মামলায় বাঘাকেই তো বাহাদুর বলে মানতে হবে। বাঘা না থাকলে আজ আমরা অবলাকান্তের আস্তানার কাছে আসতেই পারতুম না। বাঘা না থাকলে অবলাকান্ত বৃক্ষের উপরে আরোহণ করে আমাদের চোখের সামনে ধরা দিতে বাধ্য হত না। আর বাঘা অবলাকান্তকে কামড়ে না থাকলে, বোধহয় সে ওই প্রেত—মূর্তিকে ফাঁকি দিয়ে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগেকার মতো আজকেও আমাদের ফাঁকি দিয়ে সাঁতরে পালিয়ে যেত! অতএব—জয়, বাঘার জয়! এ—মামলায় সবচেয়ে বড়ো গোয়েন্দার কাজ করেছে এই সারমেয়—অবতার বাঘাই! সুতরাং আবার বলি—জয়, বাঘার জয়!’
প্রকাশিত—১৯৪১
* আমার লেখা ‘জেরিনার কণ্ঠহার’ উপন্যাস দেখুন।
* ‘সুন্দরবনের রক্তপাগল’ দ্রষ্টব্য।
___