কুমড়োগাড়ি – দত্তাত্রেয় দত্ত

কুমড়োগাড়ি – দত্তাত্রেয় দত্ত

খুকু-সিন্দি

খুকুর মা

ফেরিওয়ালা-বহুরূপী

কুড়ুনি/ছাইবুড়ি

ছেলে১-রটাই

ছেলে২-পটাই

ছেলে৩-ওরে

ইন্দি

বিন্দি

ইন্দি-বিন্দির মা

ঢ্যাঁটারাম

রাজপুত্র

দুই সভাসদ

মেয়ের দল

প্রথম দৃশ্য

[ ঘর। ঘরের সামনে রাস্তা। খুকু স্কুলব্যাগ নিয়ে গাইতে গাইতে ঘরে আসে। ব্যাগ রেখে জানলার কাছে দাঁড়ায় ]

খুকু। গান

ইন্দি, বিন্দি, সিন্দি উঁকি মারে

গাছের আড়াল থেকে শনিবারে,

একদিন নাকি সুরে কে গাইছিল গান-

তাই শুনে ইন্দি-বিন্দির উড়ে গেল প্রাণ।

[ এক ফেরিওয়ালা আসে। তার হাতে লাঠির আগায় ঝোলানো অনেক খেলনা, অনেক মুখোশ ইত্যাদি ]

ফেরি। চাই খেলনা-মুখোশ- কী খুকু! কী করছ? খেলনা নেবে?

খুকু। নাঃ। এখন তো ইস্কুল যাব। আজ আমাদের প্রাইজ দেবে। আমাদের ক্লাসে আমি ফার্স্ট হয়েছি তো! তারপর আমরা ফাংশন করব।

ফেরি। কী করবে?

খুকু। ফাংশন-মানে নাটক করব-নাটক। সিন্ডারেলা নাটক।

ফেরি। ও। তাহলে মুখোশ কিনে নিয়ে যাও না। নাটকে তো মুখোশ লাগে।

[ এক কাগজ কুড়ুনি বুড়ির প্রবেশ ]

খুকু। নাঃ। আমাদের নাটকে মুখোশ নেই।

বুড়ি। এই, তোমার কাজকর্ম নেই? খুকুমণির ইস্কুলের দেরি করিয়ে দিচ্ছ!

খুকু। না, না, আমার যেতে এখনও দেরি আছে। এই তো খেলাম। এখন একটু জিরিয়ে তারপর ইস্কুলের ড্রেস পরে ইস্কুলে যাব।

বুড়ি। তুমি এবারে এগোলেই তো পারো!

[ তিনটে ছেলে আসে। একটা কাঠের পাটায় চাকা লাগিয়ে একজন তাতে চড়েছে আর অন্য দুজন সেটা টানছে ]

ছেলে১। চাই ঢ্যাঁসকুমড়ো! চাই ঢ্যাঁসকুমড়ো!

খুকু। এই শোন। শোন না!

ছেলে২। কী?

খুকু। ঢ্যাঁসকুমড়ো কী জিনিস রে?

ছেলে৩। তুমি খেলবে, ঢ্যাঁসকুমড়ো? খুব মজা। এসে চড়ো না!

খুকু। চড়ব? (গুটিগুটি এগোয়)

খুকুর মা। (নেপথ্যে) খুকু!

খুকু। ওই রে! মা এসে যাবে। এখন হবে না। কাল আয়। তখন খেলা যাবে।

বুড়ি। যাও যাও, এখন সব যাও। খুকুমণির অনেক কাজ আছে।

[ সকলে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। দূরে তাদের ডাক মিলিয়ে যায়

খুকুর মা। (নেপথ্যে) খুকু, তুমি কী করছ? বাইরে অত কথা বলছে কারা?

খুকু। ওরা ফেরিওয়ালা মা। আমি তো গান গাইছি।

গান

ইন্দির খিদে পেল

গাছ থেকে নেমে এল

খিচুড়ি খাবে বলে

কাঁদিল রে।

মা তাকে দু-ঘা দিল,

খাওয়া তার ঘুচে গেল-

তাই না খেয়ে ইন্দি-বিন্দি

শুতে গেল রে।

তাই না খেয়ে ইন্দি-বিন্দি শুতে গেল রে! হি-হি! (হঠাৎ খেয়াল হয়) আচ্ছা, তাহলে সিন্দির কী হল? দাঁড়াও, দেখি; ইন্দি, বিন্দি আর সিন্দি-নিশ্চয় তিন বোন-শনিবার গাছের আড়াল থেকে উঁকি মারছিল, আর কে যেন নাকি সুরে গান গাইছিল। তাইতেই ইন্দি-বিন্দির প্রাণ ভয়ে উড়ে গেল। কী ভীতু রে বাবা! কিন্তু সিন্দি একদম ভয় পায়নি। সিন্দি খুব সাহসী! তারপর ইন্দির খিদে পেল, গাছ থেকে নেমে মার কাছে খিচুড়ি খেতে চাইল আর খুব ঠ্যাঙানি খেল। ঠ্যাঙানি-ট্যাঙানি খেয়ে, ইন্দি আর বিন্দি শুতে গেল। কিন্তু সিন্দির কী হল? সে তো গাছ থেকেও নামেনি, খিচুড়িও চায়নি, শুতেও যায়নি! সিন্দির খাওয়াদাওয়া কিছু হল না আর সব্বাই তার কথা বিলকুল ভুলে গেল? (খুকুর এইবার ঘুম পাচ্ছে!) সিন্দি বেচারি বোধ হয় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে-কিংবা নিশ্চয় ইন্দি-বিন্দিদের সৎবোন হবে। কেউ তাকে ভালোবাসে না। ওকে বোধ হয় সবাই খুব খাটায় আর খেতে-পরতে দেয় না। ইন্দি-বিন্দির সঙ্গে ছাগলের সেজো ছানার মতো নেচেকুঁদে মানুষ হচ্ছে বেচারি! আমি যদি সিন্দি হতাম তো সব্বাইকে দেখিয়ে দিতাম মজা। আমাকে জব্দ করবে! ইঃ।

[ আলো ক্রমে ক্রমে অন্ধকার হয়ে এসেছে। তার মধ্যে কড়া নীল আলোর রেখা খুকুকে ধরে রেখেছে। নেপথ্যে ধীরে ধীরে সুর বাজছে। হঠাৎ আলো বাড়ে। খুকু দেখে ইন্দি-বিন্দি এসে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ]

ইন্দি। এ্যাই! আমার ব্যাগ নিয়ে কী করছিস? দিয়ে দে!

খুকু। তোমার ব্যাগ মানে? এটা আমার ইস্কুলব্যাগ!

ইন্দি। ইঃ! কী চোর! দিয়ে দে বলছি। নইলে এক্ষুনি মাকে ডাকব। (ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়)

বিন্দি। দেখেছিস! (টিফিন বাক্সটা নিয়ে নেয়)

খুকু। একী! আমার টিফিনবক্স-

ইন্দি। কটা বাজে খেয়াল আছে? আমরা ইস্কুল যাব না? জুতো পরিষ্কার করে দে!

খুকু। কক্ষনো আমি জুতো পরিষ্কার করব না।

বিন্দি। মা! দেখে যাও! কেমন অসভ্যতা করছে! (খুকুকে) তোমার পিঠে ঘা কতক না পড়লে তোমার শিক্ষা হবে না।

খুকু। বারে! তোমাদের জুতো আমি কেন পরিষ্কার করব?

ইন্দি। তুমি যে সিন্দি-তাই।

খুকু। অ্যাঁ?

বিন্দি। হ্যাঁ।

[ ইন্দি-বিন্দির মা আসে ]

মা। সিন্দি! এক্ষুনি গিয়ে জুতো সাফ করো!

খুকু। বারে! আমি কেন জুতো পরিষ্কার করব?

মা। বিন্দি, গিয়ে লাঠিটা আনো তো! (বিন্দি লাঠি আনতে যায়। খুকু গিয়ে জুতো নিয়ে বসে। বিন্দি লাঠি নিয়ে আসে) ইন্দি, গিয়ে লাঠিটা রেখে এসো। (ইন্দি লাঠিটা নেয়)

বিন্দি। জানো মা, কাল না, সিন্দি গাছে চড়ে একটা পাখির সঙ্গে সরু গলায় কথা বলছিল!

মা। অ্যাঁ! এতবড়ো আস্পদ্ধা! পাখির সঙ্গে কথা বলছিল?

বিন্দি। আবার সরু গলায়!

মা। সিন্দি! তুমি বাসন মাজবার আগে উনুনের সব ছাই ধুয়ে কয়লার টুকরোগুলো বার করে রোদে শুকোতে দেবে।

[ চলে যায়

বিন্দি। আর জানো, মা, পরশুদিন সিন্দি কী করেছে…

[ মার সঙ্গে চলে যায়

ইন্দি। কেমন মজা! আর কথা বলবি, পাখির সঙ্গে?

[ খুকুকে একটা লাঠির বাড়ি দিয়ে বেরিয়ে যায়

খুকু। (জুতো সাফ করতে করতে) এঃ! ভারী মজা! আমাকে সিন্দি বানিয়ে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করছে! দাঁড়া! এই জুতো দিয়েই তোদের টেক্কা না দিয়েছি তো আমার নাম-আমার নাম-ওমা! আমার নাম কী? -আমার-আমার নাম সিন্দিই নয়!! (জুতো সাফ হয়ে গেছে। ব্যাগ খোলে) দেখি, কী কী বই। ভূগোল, জ্যামিতি, ইতিহাস। বেশ। (বইয়ের তাক থেকে তিনটে বই নিয়ে পালটে দেয়) এই রইল স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান আর-আহা!-কৈলাসে কেলেঙ্কারি! বুঝবে মজা ইস্কুলে গিয়ে। একেবারে কেলাসে কেলেঙ্কারি না হয় তো কী বলেছি। দেখি, কী কী খাবার আছে। (টিফিনবাক্স খোলে) ও মা! লুচি, মোহনভোগ, চিত্রকূট, আমসত্ব! ইসস! খেয়ে নেব সব? আচ্ছা দাঁড়াও, মজা বার করছি। (জুতোর জায়গা থেকে একটা আরশোলা ধরে এনে টিফিনবাক্সতে পুরে দেয়) হুঁ হুঁ ব্বাবা! খুললেই চিত্তির। আরশোলা দেখে লাফায় না, এমন মানুষ নেই। যাই। এবারে গিয়ে কয়লাগুলো ধুয়ে ফেলি। নইলে আমায় দেখতে পেলেই এক্ষুনি হয়ত বলবে- জুঁতো পঁরিয়ে দেঁ!

[ খুকু চলে যায়। ইন্দি-বিন্দি ও সৎমা আসে। ইন্দি-বিন্দিকে স্কুলব্যাগ, টিফিনবাক্স ইত্যাদি দিয়ে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। তারা জুতো পরে ]

মা। এইবার ইস্কুলে যাও। বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে! ইন্দি-বিন্দির মতো সুন্দর মেয়ে আর একটাও নেই। তাই না? দিদিমণি তোমাদের এত ভালোবাসে, তবু পরীক্ষায় কেন সবচেয়ে কম নম্বর দেয় বুঝি না।

ইন্দি। ক্লাসের সবচাইতে বড়ো মেয়েদের কথা সব্বাই শোনে কিনা, তাই দিদিমণি আমাদের এক-এক ক্লাসে বেশিদিন করে রেখে দেয়।

বিন্দি। আমাদের বেশি ভালোবাসে বলেই তো ছাড়তে চায় না। সবাই তাই হিংসে করে।

মা। হিংসে করে? বাঃ, বাঃ। যাও, এবার তাড়াতাড়ি এগিয়ে পড়ো, নইলে দেরি হয়ে যাবে। দুগগা, দুগগা।

[ ইন্দি-বিন্দি চলে যায়। খুকু আসে ]

খুকু। আমি ইস্কুল যাব না?

মা। তুই আবার ইস্কুল যাবি কী? আবদার!

খুকু। তাহলে বাইরে খেলতে যাই?

মা। খেলতে যাবে? আস্পদ্ধা দিনকে দিন বাড়ছেই! বলি কয়লাগুলো ধুয়ে রোদে দেওয়া হয়েছে?

খুকু। হ্যাঁ।

মা। যাও। ইন্দি-বিন্দি খেয়ে গেছে, ওদের থালা মেজে রাখো।

খুকু। কী দিয়ে মাজব? ছাই তো সব ধুয়ে গেছে।

মা। অ্যাঁ? কেন?

খুকু। তুমিই তো বললে ছাই ধুয়ে কয়লা রোদে দিতে।

মা। এখন কী হবে?

খুকু। কিছু ভেবো না। আমি এক্ষুনি বাইরে থেকে ছাই জোগাড় করে আনছি।

[ দৌড়ে চলে যায়

মা। দেখলে! ঠিক একটা না একটা ছুতো করে বাইরে গেলই!

[ প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ পথ। ছাইবুড়ি বসে আছে। সিন্দির প্রবেশ ]

সিন্দি। তুমি কে, এখানে বসে আছ?

ছাইবুড়ি। আমি ছাইকুড়ুনি বুড়ি-ছাইবুড়ি। ছাই কুড়িয়ে বেড়াই।

সিন্দি। সে কী? ছাই কুড়িয়ে কী করো?

ছাইবুড়ি। ছাই কত কাজে লাগে!

সিন্দি। আমি তো বাসন মাজার জন্য ছাই খুঁজছি।

ছাইবুড়ি। তাহলেই দেখো। ছাই দিয়ে ঘষো, সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপর ধরো, কিছু চাপা দিতে ছাই লাগে-যেমন ছাইচাপা আগুন। তারপর বাড়াভাতে ছাই দেওয়া যায়। তারপর ধরো না কেন, ছাই ওড়াতেও খুব মজা। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই।

সিন্দি। আমায় একটু ছাই দেবে?

ছাইবুড়ি। এক্ষুনি চাই?

সিন্দি। না, না, এক্ষুনি নয়। আগে একটু খেলে নিই, তারপর ছাই নেব। (দু-চার পা এক্কাদোক্কা খেলার চেষ্টা করে) দ্যুৎ! খেলব কার সঙ্গে? একা একা খেলা যায় নাকি? এখানে তো কেউ নেই।

ছাইবুড়ি। কে বললে নেই? ওই তো আসছে।

[ বহুরূপী ও রটাই-পটাইয়ের প্রবেশ। বহুরূপীর সঙ্গে একটা বড়ো থলি ]

সিন্দি। তোমরা কারা?

বহু। আমি বহুরূপী। এ হল রটাই, -এ পটাই। তুমি কে?

সিন্দি। উমম- আমি সিন্দি।

তিন জন। (বোদ্ধার মতো) ও।

সিন্দি। তোমরা কী করো?

বহু। তাও জানো না? আমি সাজি। তাই আমি বহুরূপী।

রটাই। আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করি আর সাজের একখান ব্যাখ্যান করি। তাই আমি রটাই।

পটাই। আর আমি সেইসব লোকদের পটিয়ে পয়সা তুলি। তাই আমি পটাই।

সিন্দি। ও। তা, তুমি কী সাজো?

বহু। সব কিছুই সাজি। রাজা, রানি, বাঘ, ভালুক, কার্তিক, গণেশ- সত্যি বলতে কী, নিজে ছাড়া আর সব কিছুই সাজি।

সিন্দি। কেন? মাঝে মাঝে নিজের সাজ সাজলেই পারো।

বহু। আহা, সেটাও তো একটা সাজাই হল। লোকে ভাববে যে আমি -আমি’ সেজেছি। বিশ্বাস করবে কেন যে এটা আসলে আমিই? এই দেখো না, এখন আমি কী সেজেছি?

সিন্দি। কিছুই না।

বহু। কিন্তু, লোকে বলবে, আমি বহুরূপী সেজে ঘুরছি।

রটাই। (সিন্দিকে) আচ্ছা, সিন্দির জীবন তোমার খুব ভালো লাগে?

সিন্দি। মোটেই না।

রটাই। পারলে তুমি অন্য কিছু হতে?

সিন্দি। নিশ্চয় হতাম।

রটাই। তাহলে তুমি সিন্দি সেজে আছ-আসলে সিন্দি নও। পারলে তুমি অন্য কিছু সাজতে-

পটাই। এখন তাহলে আমরা সেই খেলাটা খেলব। কই, থলিটা দেখি?

[ বহুরূপীর থলি থেকে রানির মুকুট, ঘাগরা, ইত্যাদি পোশাক বেরোয়-সেগুলো ছাইবুড়ির সাহায্যে সিন্দিকে পরানো হয় ]

বহু। এটা হচ্ছে রানি-রানি খেলা। তুমি হবে রানি আর আমরা হব তোমার প্রজা। ওইটে ধরো তোমার সিংহাসন। (একটা ঢিপি দেখায়) ওইখানে গিয়ে বোসো। (সিন্দি যায়) উঁহুঃ! হল না। ওরকম করে যাবে নাকি? রানির মতো হেঁটে যাও।

সিন্দি। সে আবার কেমন করে হাঁটা?

বহু। বেশ একটা রানি রানি ভাব আনো মনে। যেন তুমি সত্যিই রানি। কিংবা অন্তত রাজকন্যা।

সিন্দি। হ্যাঁ। ঘুঁটেকুড়ুনি হবে রাজরানি! অমন ভাবাই যায় না।

বহু। নয় কেন? আমি তো নিজেকে বেজায় বড়োলোক ভাবি। কারণ আমি বহুরূপী। বহু Rupee! রুপি মানে টাকা!

সিন্দি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন।

বহু। তাই-ই তো! স্বপ্নটাই তো আসল। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আছি বলেই না লাখ টাকার স্বপ্ন দেখি! যার লাখ টাকা আছে, তার তো আছেই। সে আর স্বপ্ন দেখবে কেন?

রটাই। দেখবেই বা কী করে?

পটাই। রাতে তো ঘুমই হয় না।

রটাই। এই বুঝি কমে গেল!

পটাই। এই বুঝি চুরি হল!

রটাই। কী করে আরও বাড়ানো যায়!

পটাই। অন্য কারুর টাকা বেশি হল কি না!

সিন্দি। উঃ! হয়েছে, হয়েছে। থামো। (সবাইকে দেখে নিয়ে) আমি তাহলে রানি হচ্ছি।

আমি তবে রানিই হলাম-এই রাজ্যের রানি।

রাজ্য শাসন করতে গিয়ে হালে পাই না পানি।

মন্ত্রী কোথায়? কোটাল কোথায়? সওদাগরের পুত্র?

সেনাপতি একখানা চাই। বাধে যদি যুদ্ধ?

গন্ডাকয়েক প্রজাও তো চাই-অল্প করেই ধরছি,

প্রজা নইলে কেমন রাজ্য? কাদের শাসন করছি?

শাসন করার মানে, প্রজার ভালো করার চেষ্টা।

তারাই যদি না থাকে, সব ভেস্তে যাবে শেষটা!

এই যে তুমি-লম্বা মতন-মন্ত্রী হও তো এসে-

কোটাল হবে রটাই-দাঁড়াও ডানদিকেতে ঘেঁষে।

পটাই হল সেনাপতি। বাকি রইল কী কী?

আচ্ছা, সেসব হবে। এবার প্রজারা কই দেখি?

[ একটা অদ্ভুত হাতগাড়ি ঠেলে একটি ছেলের প্রবেশ ]

রটাই। ওই একটা যাচ্ছে প্রজা। আনব ওকে ধরে?

আচ্ছা করে শাসন করে ধমকে দেবেন জোরে!

সিন্দি। আচ্ছা, আনো।

পটাই। এই যে! ওরে! যাচ্ছে নাকি কানে?

সিন্দিরানি ডাকছে তোকে-আয় দেখি এইখানে।

নাম কীরে তোর?

ছেলেটা। ছোট্ট বয়স থেকেই আমার মা-বাবা কেউ নাই;

নামকরণের আগেই তাঁরা মারা গেছেন। তাই

সবাই আমায় -ওরে- বলেই ডাকে।

পটাই। আচ্ছা তুখোড় ছেলে বটে! এ্যাই, কী করে তুই খাস?

ওরে। আজ্ঞে আমি ফেরিওয়ালা। ব্যবসাতে হয় টাকা।

পটাই। মিথ্যে কথা বলিস না! তোর হাতগাড়ি তো ফাঁকা!

ওরে। এখন শুধু কথাই বেচি। আর কটা দিন পরে

কুমড়ো কেনা-বেচার ব্যবসা করব ফলাও করে।

সিন্দি। কুমড়ো বেচা? কুমড়ো কেন, এত জিনিস ফেলে?

ওরে। কুমড়ো আমার স্বপ্ন! দেখো গন্ডা গন্ডা ছেলে

পড়া, লেখা, চাকরি কি চাষ ফেলে কেবল ভাবে।

ডান্ডা দিয়ে বল পিটিয়ে ক্রিকেটপ্লেয়ার হবে;

স্বপ্নেতে হয় মারাদোনা। কেবল সব জিনিসে

খুঁত ধোরো না। বলের চেয়ে কুমড়ো খারাপ কীসে?

সিন্দি। এ-যুক্তিটা মন্দ নয় তো! আচ্ছা, তুমি তবে

এখন থেকে রানির সভার প্রধান বণিক হবে।

পটাই। (রটাইকে) এমন করলে রাজ্য চলে? যাও বা একটা প্রজা

জুটলে, সেটাও ফসকে গেল। কতবার যায় খোঁজা?

সিন্দি। হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রজা! প্রজারা কই? শিঘ্রি তাদের ডাকো।

কাদের ভালো করব আমি? তারপরে তা দেখো,

বাঁধ বানানো, পুকুর কাটা, এই সমস্ত কাজে

প্রজাই খাটে-কারণ সেসব প্রজার কাজেই আসে।

রটাই। (বিরক্ত হয়ে) এই দুপুরে কোথায় প্রজা খুঁজব হেথা-হোথা?

সিন্দি। (চোখ পাকিয়ে) কোটাল! তোমার স্পর্ধা! রানির মুখের ওপর কথা!

বহু। (গলা ঝেড়ে) গায়ে পড়ে কথা বলা মন্ত্রীর স্বভাব নয় মোটে,

তাহলেও, মহারানি, এই প্রশাসনিক সংকটে

দু-চারটে জ্ঞানগর্ভ কূটনীতি-

সিন্দি। সংক্ষেপে বলো।

বহু। বটেই তো। কথাটা হচ্ছে গিয়ে, প্রজাদের ভালো

করা ভালো; কিন্তু তাতে অনেক প্রজার প্রয়োজন।

কিন্তু, শাস্তি দিলে, দিনে বড়োজোর দুজন-চারজন

প্রজা লাগে। নেড়ে নেড়ে এক-আধটা আইনের ধারা

দু-চারটে ফাঁসি দিলে সংক্ষেপে রাজকার্য সারা!

সিন্দি। (ভেবে) বেশ, তবে তাই হোক। ইন্দি ও বিন্দির মাকে

শিগগির নিয়ে এসো। এইবারে দেখে নেব তাকে।

রটাই-পটাই। অ্যাঁ!!!

সিন্দি। গান

ইন্দি-বিন্দির মাকে ধরে আনো

দড়ি দিয়ে নাকে একেবারে

হেঁইও জোয়ান বলে মারো কষে টান

কাঁইমাই করলে দু-দিক থেকে মুলে দিয়ো কান!

রটাই। ইন্দি-বিন্দির মাকে ধরা নয়কো সহজ কাজ!

পটাই। তা ছাড়া সে দূরেও থাকে। থাক না ওটা আজ।

বহু। রানির আদেশ! শোনো বরং-ওই যে একটা বুড়ি

ঘাপটি মেরে বসে আছে, গায়ে চাদর মুড়ি-

ও একটা প্রজা তো-তা ওকেই আপাতত

ইন্দির মা বানানো যাক কাজ চালাবার মতো।

পটাই। ওকেই তবে আনছি ধরে।

সিন্দি। সাবধানেতে এনো।

বুড়ি মানুষ, লাগতে পারে। আস্তে করে টেনো।

[ রটাই-পটাই ছাইবুড়িকে ধরে আনে ]

তুমি তো ইন্দির মা?

ছাইবুড়ি। বিন্দির মা বলাও চলে।

সিন্দি। দুজনেরই মা তাহলে। তোমাকে এ রাজসভাতলে

কেন আনা হয়েছে জানো কি?

ছাইবুড়ি। জানি রানি।

সিন্দি বেচারিকে আমি অনেক করেছি হয়রানি।

খেতে-পরতে দিই নাকো। পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে

রোগা করে দিচ্ছি তাকে দিবারাত্র খাটিয়ে খাটিয়ে।

শাস্তি পাবারই কথা মোর; আমি মিথ্যে বলব না-

সিন্দি। সিন্দির কথা থাক। সে বিচার আমি করব না।

ইন্দি তোমার কাছে খিচুড়ি খেতে কি চেয়েছিল? (বুড়ি সায় দেয়)

তাকে দু-ঘা দিলে কেন? সে কিছু অন্যায় করেছিল?

খিচুড়ি খাওয়া তো ভালো। স্বাস্থ্যকর। খরচও বেশি না।

ছাইবুড়ি। সেসব কথা তো খুবই সত্যি মহারানি, তবে কিনা…

সিন্দি। না নিস্তার নেই। শোনো, বিন্দি তো খিচুড়ি চায়নি?

আমরা সকলে জানি, তা সত্বেও রাতে সে খায়নি।

তাকে কেন ঠেঙিয়েছ? তুমি কি বলতে চাও বাবা,

মার কাছে খেতে চাওয়া মানে শুধু মার খেতে চাওয়া?

ছাইবুড়ি। আসলে জানেন, রানি, মাথা ধরেছিল ভয়ানক।

ডাক্তারের লেখা দেব, দেখবেন-

সিন্দি। কী খারাপ লোক!

রাত্তিরে উপোস করে জ্বলে গেল মেয়েদের পেট-

আমাকে দেখায় কিনা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট! (ইতস্তত করে)

রটাই। ফাঁসি দিয়ে দিই রানি?

পটাই। কিংবা কোতল করা চলে।

সিন্দি। না না, তাতে মরে যাবে। শোধরানোর সময় পাবে না।

রটাই। তাহলে চাবুক মারি?

পটাই। লাঠি নিয়ে ঘা-কতক দে না।

সিন্দি। না না, ওকী! ব্যথা পাবে। ওকে দিয়ে দাও নির্বাসনে।

এ-দেশ পেরিয়ে গিয়ে-ওই বড়ো ঝোপটার কোণে

সাবধানে রেখে এসো।

[ রটাই-পটাই ছাইবুড়িকে নিয়ে যায়। সিন্দি তার বাহারি পোশাক খুলে বহুরূপীকে দিতে থাকে ]

রাজকার্য শেষ। ইস বেজায় দেরি হয়ে গেল। বাড়ি যাই বাবা, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে।

বহু। সেকী মহারানি, দুপুরে বিশ্রাম করবেন না?

সিন্দি। আর মহারানি! দাঁড়াও এখন সিন্দি হতে হবে। বাসন মাজা বাকি আছে। কাল পারলে আবার আসব। তোমরা থাকবে তো?

বহু। হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি থাকলেই আমরা আছি!

সিন্দি। কাল তাহলে আবার খেলব-

[ বলতে বলতে সিন্দি চলে যায়। ছাইবুড়ি উঠে বহুরূপীর দিকে এগিয়ে আসে। রটাই-পটাই আর ওরে হাতগাড়ি আর থলি নিয়ে বেরিয়ে যায়। পরের কথাগুলো বলতে বলতে ছাইবুড়ি পরচুল আর চাদর খুলে ফেলে। বহুরূপী মুখোশ আর গায়ের জোব্বা খুলে ফেলে। তাদের দুজনেরই বয়স অল্প; গায়ে সাদা-রুপোলি অপূর্ব পোশাক। আলো পালটে যেতে থাকে ]

বহু। মেয়েটা বেশ। কী বল?

ছাইবুড়ি। চমৎকার। ও কী করছে?

বহু। সবাই যা করে। সিন্দি হয়ে আছে। ও কী চায়, জানো?

ছাইবুড়ি। আন্দাজ করো তো!

বহু। শোধ তুলতে চায় না দেখতেই পেলাম। রাজকন্যা হতে চায়?

ছাইবুড়ি। না।

বহু। বড়োলোক হতে চায়?

ছাইবুড়ি। তাও নয়।

বহু। তাহলে কী চায়?

ছাইবুড়ি। ময়লা সাফ করার জন্য দু-মুঠো ছাই।

বহু। অ্যাঁ?

ছাইবুড়ি। হ্যাঁ। দু-মুঠো ছাই।

[ আলো নিভে যায় ]

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[ বাড়ি। ইন্দি-বিন্দির মা বসে ঘুমোচ্ছে। -মা- -মা- বলে ডাকতে ডাকতে ইন্দি-বিন্দির প্রবেশ ]

বিন্দি। ওমা, আজ কী হয়েছে জানো?

মা। কী হল? পড়ে গেছ?

বিন্দি। না। আমার টিফিনকৌটোর মধ্যে না-(কেঁদে ফেলে) একটা আরশোলা ঢুকে বসেছিল।

মা। সেকী? অ্যাঁ! তারপর কী হল?

ইন্দি। ওর সব খাবার না-হি হি-ছিটকে পড়ে গেছে। কিচ্ছু খায়নি।

মা। সেকী! ইন্দির টিফিন ভাগ করে খেলে না কেন?

ইন্দি। এঃ! আমার টিফিন আমি দেব কেন? আমি তাহলে খেতাম কী?

বিন্দি। কেন? মার খেতিস মার! একবার তো খেলি। আবার একটু খেতিস!

মা। মার খেয়েছে? কেন? ইন্দি মার খেয়েছ কেন? কে মেরেছে? তাকে আমি-

বিন্দি। ও তো ক্লাসে গল্পের বই নিয়ে গিয়েছিল। (ভেংচিয়ে) কৈলাসে কেলেঙ্কারি! দিদিমণি দিয়েছে দুই চড়!

মা। ক্লাসের বই নিয়ে যায়নি?

বিন্দি। একটাও নিয়ে যায়নি। সব আগের দিনের বই নিয়ে গিয়েছিল।

মা। তা তোমার বই দুজনে ভাগ করে নিয়ে পড়লে না কেন?

বিন্দি। আমার বই ওকে দেব কেন? ও আমায় টিফিন দিয়েছে?

মা। যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। এখন দুজনে দুজনকে আদর করে দাও। তোমরা তো লক্ষ্মী মেয়ে। ঝগড়া করে কখনো? তোমরা কি সিন্দির মতো খারাপ নাকি? সব্বাই তোমাদের কত ভালোবাসে! কই? আদর করো!

[ ইন্দি-বিন্দি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ]

এই তো। ব্যাস। এবার সিন্দিকে বলছি তোমাদের খাবার দিতে। সে আবার কোথায় চরতে গেল কে জানে! সিন্দি! সিন্দি!!

[ মা চলে যায়। অমনি ইন্দি-বিন্দি পরস্পরকে ঝটকা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। অন্যদিক দিয়ে সিন্দি প্রবেশ করে ]

ইন্দি। ঝুঁটি ধরে সমস্ত চুল একেবারে উপড়ে নেব না!

বিন্দি। খিমচে তোর মুখে রক্ত বার না করেছি তো কী বলেছি! দেখবি মজা?

সিন্দি। হয়ে যাক! হয়ে যাক একহাত। কে জেতে, কে হারে। চার আনা বাজি। যে হারবে সে চার আনা পয়সা পাবে।

ইন্দি-বিন্দি। তবে রে! তোকেই আজকে-

সিন্দি। দাঁড়া, দাঁড়া, হাতটা ধুয়ে আসি। এক্ষুনি আস্তাকুঁড়ে জঞ্জাল ফেলে এলাম তো! (ইন্দি-বিন্দিকে আদর করতে এগোয়) তোদের কী সুন্দর দেখাচ্ছে রে! দেখি, দেখি-

ইন্দি-বিন্দি। উঁঃ! নোংরা কোথাকার! ছুঁস না, ছুঁস না বলছি!

[ দুজনেই দৌড়ে পালায়

সিন্দি। বাব্বা! আর একটু হলেই হয়েছিল আর কী! মেরে তক্তা করে দিত। যাই, খাবার দিই।

[ চলে যায়। ধীরে ধীরে আলো পালটায়। কড়া নাড়ার আওয়াজ। সিন্দি গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ছাইবুড়ি আসে ]

সিন্দি। একী, ছাইবুড়ি, তুমি এখানে!

ছাইবুড়ি। খুঁজতে খুঁজতে চলেই এলাম।

সিন্দি। কেন? ভেতরে এসো।

ছাইবুড়ি। তুমি যে দু-মুঠো ছাই না নিয়েই চলে এলে, তাই। তোমার বাসন মাজা হল?

সিন্দি। ওমা, সে তো আমি ওদিকের ছাইগাদা থেকে ছাই নিয়ে এসে মেজেছি।

ছাইবুড়ি। কিন্তু আমি তো তোমার জন্য ছাই এনেছি। এই নাও। (ছোট্ট পুঁটলি সিন্দিকে দেয়)

সিন্দি। তাই তো, এখন আমি ছাই নিয়ে কী করব?

ছাইবুড়ি। নেবে না?

সিন্দি। না, নেব না কেন? তুমি কত কষ্ট করে এনেছ-কিন্তু করব কী?

[ বহুরূপীর প্রবেশ ]

বহু। সিন্দিরানি আছ নাকি?

সিন্দি। কে? বহুরূপী? এই দেখো-ছাইবুড়িও এসেছে।

বহু। হুঁ। তাই তো। কী নিয়ে কথা হচ্ছে?

ছাইবুড়ি। সিন্দি এখন দু-মুঠো ছাই নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

সিন্দি। হ্যাঁ-ছাই দিয়ে আর কী হয়?

বহু। কী ছাই কথা! দুপুরে কী করলে, তাই বলো।

সিন্দি। আর কী করব? আমি একটা কুমড়ো গাছ পুঁতে ফেললুম। বাগানের ওই কোনায়।

বহু। ব্যাস! তবে আর কী! তোমার দু-মুঠো ছাই নিয়ে ওই কুমড়োগাছের গোড়ায় দিয়ে দাও। ভালো সার হবে। দেখবে, কত বড়ো কুমড়ো ফলবে।

সিন্দি। রটাই-পটাই আসেনি?

বহু। ডাকলেই আসবে।

সিন্দি। এই রটাই-পটাই, ভেতরে আয়।

[ রটাই-পটাই আসে। ওরে মাথা বাড়ায় ]

ওরে। আমি আসব না?

সিন্দি। আয়, আয় ওরে। বাঃ আমরা সবাই হাজির আছি। এখন তাহলে কী খেলব?

বহু। খেলার আগে তুমি বরং রটাই-পটাইকে সঙ্গে নিয়ে তোমার কুমড়ো গাছে সার দিয়ে এসো।

ওরে। কুমড়ো গাছে? আমিও যাব।

ছাইবুড়ি। না, না, সেটি হবে না। কুমড়ো গাছ কোথায় আছে তোমায় জানতে দিলেই চিত্তির। গাছে আর একটিও কুমড়ো থাকবে না। তুমি এইখানে থাকো আমাদের সঙ্গে।

সিন্দি। আমরা তবে এক্ষুনি ঘুরে আসছি। রটাই-পটাই, চল।

[ তিনজন চলে যায়। একটা সংকীর্ণ আলোর বৃত্তে বহুরূপী ওরে-কে রাজপুত্রের পোশাক পরায়। সাইক্লোরামায় সিল্যুয়েটে দেখা যায় একটা লতানে গাছে একটা কুমড়ো ফলে আছে। সিন্দিরা সোৎসাহে এসে গাছের গোড়ায় ছাই দিয়ে আবার চলে যায়। তারা পিছন ফিরতেই কুমড়োটা একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে ]

বহু। ব্যাস তৈরি। এখন সিন্দি এলেই হয়।

[ সিন্দিদের প্রবেশ ]

সিন্দি। দিয়ে এলুম। ওমা! ও কে? আরে! এযে ওরে!

ছাইবুড়ি। আস্তে, আস্তে। অত চেঁচিয়ো না জোরে।

বহু। ইনি এক রাজপুত্র। আসছেন অন্য রাজ্য থেকে

নানা দেশ ঘুরে ঘুরে। সব দেশ দেখে

নিজের মনের মতো রানি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

সিন্দি। তবে ইন্দিকে ডেকে আনি? হয়তো মনের মতো হবে।

বহু। উঁহুহু দরকার নেই। আমি তো রাজার সভাসদ-

না দেখেই বলে দিচ্ছি-ইন্দি-বিন্দিরা ভারী বদ।

রাজপুত্র পছন্দ করবে না।

ওরে। আমি শুনেছি এখানে

সিন্দি নামে একজন থাকে। তার কথা কেউ জানে?

সিন্দি। না, কেউ জানে না। তুমি ওকথা শুনলে কার কাছে?(ওরে ঘাবড়ে গিয়ে বহুরূপীর দিকে তাকায়)

পটাই। আমিই বলেছি। আমি চর কিনা,-আনাচেকানাচে

এ দেশের কোথায় কী আছে, সব নখের ডগায়।

বহু। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও-ই। ওর মতো আরও আছে নানান জায়গায়।

তারাই খবর দেয়। অমনি ইনি রাজ্যপাট ফেলে নিজে চোখে দেখতে আসেন।

সিন্দি। (ছাইবুড়িকে) বটে? এ কেমন ছেলে?

পড়াশোনা নেই নাকি? কাজকর্ম চেষ্টা করলে পারে।

তা না করে মিছিমিছি এধারে-ওধারে-

ছাইবুড়ি। আরে আরে,

রাজার ছেলের সামনে অমন করা চলে?

এমনি করে ঘাঘরা ধরে মাথা

নোয়াও। একে কার্টসি করা বলে।

সিন্দি। করব কেন? কী বকো ছাই ছাতা-

ছাইবুড়ি। রাজার সামনে চলবে এমনি চালে।

তখন রানির মুখের ওপর কথা

বলল বলে কোটালকে ধমকালে-

কাজেই এখন তোমাকে সেই প্রথা

মানতে হবে।

সিন্দি। বেশ, তবে তাই হোক।

রাজার কুমার, আমরা গরিব লোক।

আমরা, রাজা, খেটেখুটেই খাই।

বোকার মতন তাকিয়ে দেখবে তাই।

ওরে। না না, তুমি খাটবে কেন? আমার রানি হলে

পায়ের ওপর পা চাপিয়ে কাটবে হেসে খেলে।

গাড়ি, বাড়ি, শাড়ি এবং কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না-

সিন্দি। পায়ে বেজায় ঝিঁঝি ধরবে। সব তো সবার সয় না।

[ ওরে নিতান্ত বিপর্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। রটাই চটে যায় ]

রটাই। এমনি করে বাগড়া দিলে চলবে নাকি? ধুত্তোর!

সিন্দি, তোমার কাণ্ডটা কী? দেখছ রাজার পুত্তুর

সাধছে তোমায়-

সিন্দি। সাধছে বলেই নাচতে হবে নাকি?

রটাই। হ্যাঁ, তাই হবে!

বহু। আহা, আহা, অমন রাগারাগি

করলে চলে? রাজপুত্তুর, বোঝাই যাচ্ছে তবে,

মিষ্টি কথায় সিন্দিরানির মন ভোলাতে হবে।

তুমি বরং শাড়ি-গাড়ির গল্প রেখে তুলে

এমন কিছু বলো, যাতে ওর মন যায় ভুলে।

ওরে। গান

সিন্দি তোমায় দেখতে খাসা

বলতে গিয়ে পাইনে ভাষা

জোছনা দিয়ে আঁকা-

যদিও তোমার মুখের কথা একটু যেন বাঁকা।

সিন্দি। গান

দেখতে তোমায় পরিপাটি

আলুর দমে খ্যাংরাকাঠি

চাউনি তোমার ফাঁকা-

মাথায় তোমার পাগড়ি যেন মুটের মাথায় ঝাঁকা।

[ হঠাৎ ঢ্যাঁটরার শব্দ। খেলা ভেঙে যায়। সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় ভিড় করে। ওরে পোশাক খুলে বহুরূপীর থলি সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় আসে। তারপরেই ইন্দি-বিন্দির মা এসে জানলার কাছে দাঁড়ায়। ঢোল বাজিয়ে ঢ্যাঁটারামের প্রবেশ ]

ঢ্যাঁটা। শোনো হে শোনো, সব দেশের প্রজাগণ! আদেশ দিয়েছেন রাজাধিরাজ

আগামী সপ্তাহে প্রথম তিন দিন সবাই ছুটি পাবে। সকল কাজ

বন্ধ রাখা হবে। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বিরাট উৎসব চলবে; তাই

এদেশে সুন্দরী যেখানে যত আছে, সেখানে সকলের হাজিরা চাই।

[ সবাই হাঁ করে শুনছে। ঢ্যাঁটারাম মুগ্ধ শ্রোতা পেয়ে নিজের টীকা-টিপ্পনী জুড়তে থাকে ]

এ আর কিছু নয়-জনতা ডেকে এনে তাদের মাঝ থেকে হবে বাছাই রাজার কুমারের যোগ্য রাজবধূ-

সিন্দি। যেকোনো মেয়ে হলে চলবে ভাই?

ঢ্যাঁটা। তাও কি হতে পারে? আসল কথা শোনো-বেজায় খ্যাপা এই রাজকুমার।

নাহক এ যাবৎ দেড়শো মেয়ে তাকে দেখানো হয়ে গেছে। তবুও তার

কিছুতে ভালো আর লাগে না কাউকেই। এমনই খুঁত খুঁতে, বলব কী,

অনেক ভেবে ভেবে, কেমন চাই তার দিয়েছে দেড়্গজি ফিরিস্তি।

যেমন, রূপেগুণে, বিদ্যেবুদ্ধিতে, আচারে ব্যবহারে, নাচগানে,

কথা ও বার্তায়, খেলা কি ছবি আঁকা, রান্না-সেলায়েতে-

সিন্দি। তার মানে

চাইছে সে সোনার পাথরবাটি। আর টাকার পোঁটলা কি বনেদি ঘর

এসব চাইছে না? নিজে সে পারেটা কী?

ছাইবুড়ি। আহাহা ওরকম করলে পর

বিষম গোল হবে। কথাটা বুঝে দেখো রাজার ছেলে সে তো হাজার হোক-

হয়তো শৌখিন-বিয়ের ব্যাপারেতে থাকতে পারে তার অমন ঝোঁক।

একথা তবু আমি বলতে পারি, তার হঠাৎ যাকে হবে পছন্দ,

ওসব ভুলে গিয়ে তাকেই বেছে নেবে। সেটাই বা এমন কী মন্দ?

মা। (ঘর থেকে) সিন্দি!

সিন্দি। (ছাইবুড়িকে) তুমি বলছ ওইসব আবদার ভুলে সে এমনি একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? করবেই না।

বহু। করতেই পারে।

সিন্দি। হুঁঃ! আমার ইচ্ছে করছে গিয়ে একবার দেখে আসি লোকটা কেমন মেয়ে পছন্দ করে।

মা। সিন্দি! ডাকছি কানে যাচ্ছে না? তুমি ওখানে রাস্তার লোকেদের সঙ্গে কী করছ? এক্ষুনি ভেতরে এসো!

সিন্দি। এই যাচ্ছি। (বাড়ির ভেতরে যায়)

মা। তোমার অভ্যেস দিনকে দিন খারাপ হচ্ছেই। অ্যাঁ? কতবার বলেছি, রাস্তার লোকেদের সঙ্গে মিশবে না? কাজকর্ম চুলোয় গেল-

সিন্দি। আমি ঢ্যাঁটরা শুনতে বাইরে গিয়েছিলাম। রাজার ছেলের বউ পছন্দ করা হবে তো, তাই ঢ্যাঁটরা দিয়েছে।

মা। তাতে তোমার কী?

সিন্দি। আমিও যাব ভাবছি।

মা। কী? তুমি যাবে? পিঠটা বড্ড শুলোচ্ছে না? ইন্দি-বিন্দি থাকতে উনি যাবেন! যাওয়া বার করছি আমি। ঘরটা ঝাঁট দে। (পথের লোকদের) তোমরা এখানে বাড়ির সামনে ভিড় করছ কেন? তোমাদের কাজ নেই? যাও, চলে যাও!

[ প্রস্থান

সিন্দি। ঈঃ! ইন্দি-বিন্দি যাবে আর আমি যাব না! আমি যাবই। দেখি কী করে ঠেকায়। (ঝাঁট দিতে থাকে)

ঢ্যাঁটা। শোনো হে শোনো সব দেশের প্রজাগণ…

[ ঘোষণা করতে করতে বেরিয়ে যায়। তার কথা আর বাজনার নকল করতে করতে রটাই, পটাই আর ওরে পিছন পিছন যায় ]

বহু। শুনলে তো? সিন্দি যাবেই বলছে।

ছাইবুড়ি। যাবেই যখন, তখন তার ব্যবস্থা তো করে দিতে হয়। দেবে নাকি?

বহু। দেব বইকী! এখন চলো।

[ চলে যায়। সিন্দি ঝাঁট দিতে থাকে। আলো নিভে যায় ]

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[ ঘর। ইন্দি, বিন্দি, মা। সিন্দি কুটনো কুটছে ]

ইন্দি। এই কুঁড়ে, আমার জন্য সর-ময়দা বেটে রেখেছিস?

বিন্দি। আমার জামাটা সেলাই হয়েছে? ফাঁকিবাজ কোথাকার।

সিন্দি। হয়েছে হয়েছে।

মা। -হয়েছে হয়েছে’ আবার কী? ঠিক করে কথা বলতে পার না?

ইন্দি। সিন্দিটা এমন হিংসুটে হয়েছে না, কী বলব! সর-ময়দা এমন দানা-দানা করে বেটে রাখে যে গায়ে দিলে মনে হয় চামড়া একেবারে ছিঁড়ে যাচ্ছে।

মা। হবেই তো। গায়ে সর ঘষলে কষ্ট হবে না? তোমাদের গায়ের চামড়া কত নরম!

সিন্দি। নেই বললেই চলে।

মা। অ্যাঁ! কী বললি তুই?

সিন্দি। বলছি, সর নেই বললেই চলে। বিন্দি খেয়ে নিল না?

ইন্দি। অ্যাঁ! দেখলে মা! আমি এখন কী মাজব? অ্যাই, তুই সর খেলি কেন?

বিন্দি। তোরই ভালোর জন্য। তোর গায়ের চামড়া ছিঁড়ে যায় না?

ইন্দি। তাই বলে তুই সর খেয়ে নিবি?

বিন্দি। তোর যা গণ্ডারের চামড়া-তার্পিন তেল মাখ, যদি নরম হয়।

মা। ছি ছি, তোমরা আবার ঝগড়া করছ! তোমরা না ভালো মেয়ে!

[ বেরিয়ে যায়

সিন্দি। হ্যাঁ। এত ঝগড়া করার কী আছে?

ইন্দি। কখন খেল সরটা?

সিন্দি। ওই তুই যখন ওর নতুন ফ্রকটায় কলমের কালি মুছছিলি, তখন।

বিন্দি। আমার নতুন ফ্রকটায়! ওমা! দেখেছ! এখন আমি কী পরব?

ইন্দি। তুই আবার ফ্রক পরে কী করবি? ঘরমোছা ন্যাতাটা গায়ে জড়িয়ে নে না। তাহলেই হবে। উঃ! উনি যাবেন রাজপুত্তুরের সামনে। তোকে পছন্দ করবে ভেবেছিস নাকি?

বিন্দি। নয়তো কি তোকে পছন্দ করবে? তোর রূপের বহর দেখলে-

ইন্দি। কী? (রুখে দাঁড়ায়)

বিন্দি। দেখবি মজা?

সিন্দি। হয়ে যাক, হয়ে যাক! যে হারবে সে চার আনা পয়সা পাবে!

[ মায়ের প্রবেশ ]

মা। একী, ছি ছি! তোমরা আবার ঝগড়া করছ? তোমাদের দু-বোনে কত ভাব!

সিন্দি। হ্যাঁ। কী সুন্দর ভাব!

ইন্দি। তোর তাতে কী?

বিন্দি। তুই এর মধ্যে কথা বলছিস কেন?

সিন্দি। না, রাজপুত্র তো একটাই, তাই বলছিলাম, যত ভাব হয় ততই ভালো।

মা। অত কথায় তোমার দরকার কী? তোমায় কাজ করতে বলা হয়েছে, কাজ করো।

ইন্দি। তুই বিন্দিকে সর খেতে দিলি কেন? আগেই বেটে রাখতে পারলি না?

বিন্দি। ইন্দিকেই বা কালি মুছতে দিলি কেন? আলমারিতে তুলে রাখতে পারিস না? যা, এখন যে করে পারিস কালির দাগ ঢেকে নতুন করে সেলাই করে দে।

ইন্দি। আমার জন্য ময়দা দিয়ে তেল-হলুদ বেটে রাখবি। মিহি করে বাটিস।

মা। তাই বলে রান্নাটা যেন করে রাখতে ভুলো না। এই এক সিন্দিকে চরাতে চরাতে আমার প্রাণটা তো বেরিয়ে গেল। ওফ! গিয়ে একটু বিশ্রাম করিগে।

[ ইন্দি-বিন্দি ও মার প্রস্থান

সিন্দি। বিশ্রাম তো করতেই হবে। বেলা দশটা অবধি ঘুমিয়ে মা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই ঘুমিয়ে উঠে একটু বিশ্রাম করতে হয়। বিশ্রাম নিতে নিতেও আবার ঝিম এসে যায়। সেটা কাটাবার জন্য একটু জিরোবার দরকার হয়েই পড়ে। এখন, জিরোবার পরিশ্রমেও তো আবার ক্লান্তি আসে… (বলতে বলতে কুটনোর থালা নিয়ে চলে যায় এবং ফ্রক হাতে ফিরে আসে।) ফ্রকটা হয়েছিল বেশ। বোঝো কাণ্ড। আমার তৈরি ফ্রক-সেটায় কালি ঢালবেন ইন্দি, পরবেন বিন্দি,-আর আমি যেন কেউ না!

[ সিন্দি সেলাই করতে করতে আপন মনে গান গায়। আলো খুব কমে আসে ]

গান

আমার যদি এমন জামা হত

তবে আমি জলপরীদের মতো

জোছনারাতে দিঘির পাড়ে গান গাইতে যেতাম।

অচেনা কেউ রাখালিয়া বেশে

আমার সাথে কইত কথা এসে

তার দু-চোখেই আমি আমার রাজার দেখা পেতাম।

হয়তো বনে বেঁধে পাতার ঘর

আমায় নিয়ে পাতত সে সংসার

দিনে তাকে পড়ত মনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

সন্ধেবেলায় কাজ ফুরোলে পরে

ক্লান্ত হয়ে আসত যখন ঘরে

দেখত ছোটো সিন্দিই তার ঘর সাজিয়ে রাখে।

[ আলো নিভে যায় ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ ওই ঘর। ফাঁকা। আলো অল্প বাড়ে। বহুরূপী ও ছাইবুড়ির প্রবেশ ]

বহু। সিন্দি! ঘরে আছ নাকি? ও সিন্দি!

[ সিন্দি আসে ]

সিন্দি। বহুরূপী এসেছ? কী খবর বলো। খেলবে?

ছাইবুড়ি। তুমি রাজবাড়ি যাবে বলছিলে যে-যাবে না?

সিন্দি। নাঃ। আমি গেলে বাড়ি পাহারা দেবে কে?

ছাইবুড়ি। কেন, তুমি যাও না। আমরা না হয় বাড়ি পাহারা দেব।

সিন্দি। দেবে? আচ্ছা, তাহলে গেলে হয়। কিন্তু যাব কী পরে?

ছাইবুড়ি। কেন? বহুরূপী আছে তো! ওর কাছে হাজারো পোশাক থাকে। একটা পরে নাও।

বহু। এমন পোশাক দেব, এই দেখো না-(ঝোলা থেকে পোশাক বার করে) দেখেছ, কেমন সুন্দর! একেবারে রাজকন্যের পোশাক। যাও গিয়ে পরে এসো।

[ সিন্দি পোশাক নিয়ে ভেতরে যায়

ছাইবুড়ি। তাহলে হল?

বহু। জামা অবধি হল। এখন জুতো চাই। তারপর ওর নিজের দায়িত্ব। রাজার ছেলের সামনে গিয়ে কী করে সেটাই আসল কথা। ক্যাঁটক্যাঁট করে কথা শুনিয়ে না দিলেই বাঁচি।

ছাইবুড়ি। রাজকুমারকে তো কেউ কোনোদিন কথা শোনায়নি; কাজেই সেইটেই তার নতুন লাগতে পারে। আর সিন্দিকে তার ভালো লাগলে সিন্দির কথাও তার ভালো লাগবে।

বহু। সেইটেই একমাত্র ভরসা। আসলে, যে-মেয়ে কিছুই চায় না, তার জন্য কিছু করা ভারী মুশকিল। সে নিজে থেকে তোমায় একটুও সাহায্য করবে না।

[ রাজকন্যের পোশাকে সিন্দির প্রবেশ ]

সিন্দি। ছাইবুড়ি, একটু দেখো তো, পিঠের বোতাম-টোতামগুলো…

[ ছাইবুড়ি সাহায্য করে। বহুরূপী ক্লোক লাগিয়ে দেয় ]

ছাইবুড়ি। ব্যস। বেশ হয়েছে। এইবারে এগিয়ে পড়ো।

সিন্দি। ওমা, খালি পায়ে যাব নাকি? আমার তো জুতোই নেই।

বহু। দাঁড়াও। জুতো দিচ্ছি। (একজোড়া জুতো বার করে)

সিন্দি। ওমা! কী সুন্দর জুতো! এমন জুতো কক্ষনো দেখিনি! আমার পায়ে হবে?

বহু। হবে না মানে? এ হল টেক্কামার্কা জুতো। এই জুতো পরে সব্বাইকে টেক্কা দেওয়া যাবে।

সিন্দি। অ্যাঁ? কী বললে?

বহু। বলছি, এই জুতো দিয়েই সব্বাইকে টেক্কা দিতে হবে না?

সিন্দি। ওমা! তুমি কী করে জানলে?

বহু। সে এখন বলব না। ঠিক সময়ে তোমার ঠিক মনে পড়ে যাবে।

সিন্দি। মনে পড়ে যাবে? কী জানি! (জুতো পরে নিয়ে হাঁটে) কিন্তু এতটা পথ হেঁটে যাব-নতুন জুতোয় ফোসকা পড়বে না? রাজবাড়িতে গিয়ে যদি খোঁড়াই, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।

ছাইবুড়ি। তাও তো বটে।

সিন্দি। তা ছাড়া, এমন দামি পোশাক যে পরে, তার তো নিজের গাড়ি থাকে। যাঃ, পোশাকটাই গন্ডগোল বাধাল। আমার আর যাওয়া হল না। (হতাশ হয়ে বসে পড়ে। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে) যাকগে, চলো, খেলি।

বুড়ি। না না, সেকী, দাঁড়াও। গাড়ি, না? (বহুরূপীকে) গাড়ি কী করে জোগাড় করি?

বহু। তাইতো! দাঁড়াও, রটাই-পটাই ঠিক একটা বুদ্ধি বার করবে। রটাই! পটাই!

[ রটাই-পটাই আসে ]

রটাই, সিন্দি তো চলল রাজবাড়িতে। এখন, যাবে কীসে? হেঁটে তো আর যেতে পারে না-গাড়ি জোগাড় করতে পারো?

পটাই। গাড়ি? গাড়ি কোথায় পাব? গাড়ি-টাড়ি নেই।

রটাই। আচ্ছা, ওরের একটা গাড়ি আছে তো! পটাই যদি ওকে পটিয়ে গাড়িটা আনতে পারে তো একটা উপায় হয়। পটাই যা না-গিয়ে দেখ না।

পটাই। তুই সঙ্গে আয় না।

[ দুজনে চলে যায়

সিন্দি। আমি হাতগাড়িতে চড়ে যাব নাকি?

বহু। হুঁ। তাইতো। ব্যাপারটা কেমন হবে কে জানে।

[ রটাই-পটাই এবং ওরে আসে ]

ওরে। রানি, এ কেমন কথা? আমি আপনার দেশের প্রধান বণিক-আর আমার হাতগাড়ি কোটাল কেড়ে নিতে চাইছে?

বহু। বাঃ! তুমি প্রধান বণিক, আর রানির দরকারে গাড়ি দেবে না? তবে কি সিন্দি যাবে না?

সিন্দি। আমার বয়ে গেছে ওই হাতগাড়িতে চড়ে যেতে। ওটায় করে গেলে লোকে হাসবে না? আমি যাবই না।

. . . আমি এটায় চড়ে যাব

ওরে। না না না, ভাবছেন কেন মহারানি! সেই কথাই তো বলছি।

সিন্দি। -রানি-রানি’ কোরো না তো! সিন্দি বলে কথা বলো।

ওরে। তোমার ওই কুমড়োগাছটা আমায় দিয়ে দাও, তাহলেই আমার গাড়িতে চড়তে পাবে।

সিন্দি। কুমড়ো গাছ? ওহো! তুমি তো কুমড়োর ব্যবসা করবে বলেছ। বেশ, কুমড়ো তুমি নাও।

ওরে। না না, কুমড়ো চাই না। ঢ্যাঁসকুমড়ো তোমারই থাক। আমি কেবল গাছটা নেব। পরের কুমড়ো সব আমার।

সিন্দি। তাহলে গাড়ি দাও।

ওরে। বেশ তোমার কুমড়ো আর গাড়ি নিয়ে আসছি।

[ চলে যায়

বহু। এখন, গাড়িটা টানবে কীসে?

সিন্দি। যা না গাড়ি। ওতে দুটো ইঁদুর জুতে দিলে মানাবে ভালো। রটাইয়ের যেমন বুদ্ধি!

ছাইবুড়ি। না না, তোমায় টানতে গেলে অন্তত দুশো ইঁদুর দরকার। অত ইঁদুর পাব কোথায়?

বহু। ঘোড়াই বা পাবে কোথায়?

পটাই। ঘোড়ারা তো আর থলিতে থাকে না; গাছেও ফলে না।

রটাই। থলি? হ্যাঁ, থলিতে থাকে তো! দেখি, ঘোড়া হয়ে যাবে বোধ হয়। (তাড়াহুড়ো করে থলি থেকে নাচুনে ঘোড়ার পোশাক বার করে)

পটাই। এই তো! ঘোড়া!! আমরা দুজন ঘোড়া হব।

[ সিন্দি আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। ঘোড়ার পোশাকের মধ্যে ঢুকে রটাই-পটাই ঘোড়া হয়। ওরে এই সময় হাতগাড়ি নিয়ে ঢোকে তাতে বিশাল আধখানা কুমড়ো বসানো। বাকি আধখানা ছাতার মতো ওপরে ঝুলছে। সবটা লতাপাতা দিয়ে সাজানো ]

সিন্দি। ওমা!-এটা কী গাড়ি? কী সুন্দর দেখতে!

ওরে। এর নাম কুমড়োগাড়ি!!

সিন্দি। এমন গাড়ি কারোর নেই! আমি এটায় চড়ে যাব! আমার কুমড়োগাড়ি!!

[ গাড়িতে ঘোড়া জুতে দেওয়া হয়। সিন্দি তাতে চড়ে বসে। ওরে ইতিমধ্যে একটা কালো কোট পরে নেয় ]

ওরে। আমি কোচোয়ান। গাড়ি সামলাব। দরকার হলে ঠেলেঠুলেও দেব। চলো রাজার বাড়ি। হুররে!

সিন্দি। হুররে।

ঘোড়া। চিঁ-হি-হি!!

ছাইবুড়ি। কিন্তু সিন্দি, সবচেয়ে দরকারি কথাটা বলা হয়নি। সেটা মনে রাখতে হবে।

সিন্দি। কী কথা ছাইবুড়ি?

ছাইবুড়ি। ইন্দি-বিন্দিদের আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হবে। নইলে বুঝছ তো, ইন্দি-বিন্দির মা বাড়ি ফিরে যদি আমাদের দেখে!

সিন্দি। সে আমার মনে থাকবে। আমি ঠিক ফিরে আসব। ভেবো না।

ওরে। তাহলে চলো রাজার বাড়ি। হুরর টক টক!

ঘোড়া। চিঁ-হিঁ-হিঁ!

[ গাড়ি এগোয়। বহুরূপী ও ছাইবুড়ি হাত নাড়তে থাকে ]

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[ রাজবাড়ির প্রাঙ্গণ। আসনে রাজপুত্র ও দুই সভাসদ। সামনে মেয়েরা নাচছে ]

সমবেত নৃত্যগীত

রাজার কুমার ধন্য ডেকেছ সেই জন্য

এসেছি আজ রাতে।

অনেক সেজেগুজে কিচ্ছুটি না বুঝে

তোমার রাজসভাতে।

এইখানেতে মোরা করছি ঘোরাফেরা

নেহাত বোকার মতো,

দেখছ না তো কিছু মুখটি করে নিচু

ভাবছ কথা কত।

লাগবে কীসে ভালো তাও যদি বা বলো

করব মোরা তাই

মন খুশি না হলে সে কথা দাও বলে

চলেই মোরা যাই।

[ রাজপুত্র অভিভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ায় ]

রাজপুত্র। মাননীয় প্রজাবৃন্দ-(জিভ কাটে) মানে, যত স্নেহের প্রজারা,

ব্যাপারটা খুলে বলি আসল কথাটা হল গিয়ে,

আজকের এই যে উৎসব, এটা অনেকটা ইয়ে।

মানে, -ঠিক- ইয়ে নয়, তাহলেও যাকে বলে গিয়ে

উৎসবের আসল ব্যাপারটা হল-

সভাসদ১। আপনার বিয়ে।

রাজপুত্র। তাও বলা যেতে পারে। -কিন্তু ঠিক তা কি বলা যায়?

বিয়ে যদি না-ও করি, তাহলেও উৎসবটা হয়।

উৎসব তো বিয়ে নয়-বিয়ে করা উৎসব হলেও-

মানে ঠিক কী যে বলি-

সভাসদ২। লাভ নেই বিশেষ বলেও।

সভাসদ১। এদের কাউকে তবে আপনার পছন্দ হল না?

তবে যেতে বলে দিই?

রাজপুত্র। না না সেকী, ওকথা বোলো না।

আসলে, এরা তো কিছু করছে না-শুধু শুধু এই নাচগান,

পোশাক-আশাক দেখে কোনোকিছু হয় কি প্রমাণ?

সভাসদ২। ও, তাই বলুন! এ্যাই, তোমরা সব এক-একজন করে

রাজকুমারের সামনে এসে বেশ মিঠে মিঠে সুরে

দু-চারটে কথা বলো, যাতে এঁর মন খুশি হয়।

প্রত্যেকে বলবে-তবে দু-লাইন; তার বেশি নয়।

[ অমনি সবাই এক-এক করে আসে এবং দু-লাইন করে কথা বলে চলে যেতে থাকে। রাজপুত্র উত্তরোত্তর বিরক্ত হয় ]

১। রাজপুত্তুর তোমার মুখের কী সুন্দর শোভা!

দেখে দেখে হলাম আমি এক্কেবারে বোবা।

রাজপুত্র। হুঁ!

২। রাজপুত্তুর, তোমার দুটি ডাগর ডাগর আঁখি,

খাঁচার মধ্যে নাচছে যেন জোড়া চড়াই পাখি।

রাজপুত্র। ধ্যেৎ!

ইন্দি। রাজপুত্তুর আমায় যদি না কিনে দাও শাড়ি

তোমায় আমি দুষ্টু বলব। এক্কেবারে আড়ি।

রাজপুত্র। বাঁচা যায়।

বিন্দি। রাজপুত্তুর, আমায় তুমি না করলে বিয়ে

মনের দুঃখে মরব আমি গলায় দড়ি দিয়ে।

রাজপুত্র। (সোৎসাহে) দড়ি রেখেছি বাড়িয়ে?

[ কুমড়োগাড়ির প্রবেশ। সকলে স্তম্ভিত। সিন্দি নেমে কার্টসি করে। গাড়ি বেরিয়ে যায়। রাজপুত্র এগিয়ে আসে। ]

কী আশ্চর্য! তুমি কে? তুমি এদেশের প্রজা?

সিন্দি। খবর পেলাম, নাকি এখানে উৎসব হবে আজ

রাজার আদেশে, তাই তাড়াতাড়ি ফেলে সব কাজ

হুজুরে হাজির আছি আমি। তুমি রাজার কুমার?

রাজপুত্র। আমিই রাজার ছেলে এদেশের। তুমি কোথাকার?

সিন্দি। এদেশেরই মেয়ে; তবে একেবারে নই এদেশেরই।

রাজপুত্র। তবে তুমি নিশ্চয় ভিনদেশি রাজার কুমারী!

এমন পোশাক রূপ, এই গাড়ি, কোথাও দেখিনি।

এত মিষ্টি কথা বলো-নিশ্চয় তুমি বিদেশিনী!

সিন্দি। তাও নই। আমার মতন আছে এদেশের অনেক ঘরেই।

রাজপুত্র। কখনো না। ওই গাড়ি এই দেশে কারো ঘরে নেই।

সিন্দি। (হেসে) আছে, আছে, দেশটা কি তাকিয়ে দেখেছ কোনোদিনই?

রাজপুত্র। তা দেখিনি, তবে আমি-

সিন্দি। (হঠাৎ চটে গিয়ে) তবে তুমি কিছুই দেখোনি।

প্রজারা কেমন থাকে খোঁজ রাখ? তাদের দুর্দশা,

তাদের ওপরে হয় কী জুলুম, জানো? আছ খাসা!

রাজকার্য করা নেই, শুধু শুধু রাজা-রাজা খেলা-

সভাসদ১। তুমি কে হে? উৎসবে মিছিমিছি বাধাচ্ছ ঝামেলা?

রাজার ছেলেকে তুমি রাজকার্য শিক্ষা দেবেটা কী?

সিন্দি। শেখানোটা ঢের আগে তোমারই উচিত ছিল নাকি?

রাজপুত্র। (সভাসদকে) তুমি কেন এর মধ্যে কথা বল? (সিন্দিকে) তোমার নাম কী বললে না?

সিন্দি। নাম একটা আছে, তবে সে তোমার মনে ধরবে না।

[ ইন্দি-বিন্দি ও তাদের মা এগিয়ে আসে ]

ইন্দি। রাজপুত্র, আমরা তবে বাতিলের দলে?

রাজপুত্র। না না, তোমরা খেয়ে যাবে? ওই বড়ো হল-এ-

মা। সে হবে। তা যাকে দেখে তুমি গলে গেলে,

অন্তত কী নাম তার, সেটা জানতে পেলে-

সভাসদ২। নাম শুনে কী করবেন? এ মেয়েটা বেজায় উদ্ধত।

এখুনি খারিজ করে দিন।

রাজপুত্র। শোনো, এ দেশসুদ্ধ তো

মেয়ে এল। সারা মাঠ খ্যাঁদা-বোঁচা-ন্যাকাদের দলে

ভরে গেছে-একজনাও এরকম স্পষ্ট কথা বলে?

যতসব মনগড়া বাজে কথা সমস্ত সময়

শুনে কান পচে গেল। নির্ভয়ে যে সোজা কথা কয়

সেই তো রানির মতো রানি হবে! তার ওপর এমন বাহারি

জামা যে পরতে পারে, গাড়ি যে চড়তে পারে, তারই

রানি হওয়া সাজে। (সিন্দিকে) তুমি নামটা তো বলনি আমাকে-

সিন্দি। আমাকে বাড়ির লোকে সিন্দ-না না, সিন্ডারেলা ডাকে।

রাজপুত্র। সিন্ডারেলা! কী সুন্দর নাম!

[ গান শুরু হয়। সিন্দি ও রাজপুত্র নাচতে থাকে। বাকি সবাই ধীরে ধীরে চলে যায় ]

গান

সিন্ডারেলা সিন্ডারেলা চাঁদের মতন মেয়ে

কোথায় ছিল মেঘের দেশে চোখের আড়াল হয়ে,

সিন্ডারেলা সিন্ডারেলা চাঁদের মতন মেয়ে।

কেউ রাখেনি খোঁজ, কী করত সে রোজ

কোন আঁধারে লুকিয়ে ছিল অবহেলা হয়ে

সিন্ডারেলা সিন্ডারেলা চাঁদের মতন মেয়ে।

আজ উৎসবের দিনে নিলাম তাকে চিনে

ওই দেখো তার রূপের ছটায় জগৎ গেছে ছেয়ে

সিন্ডারেলা সিন্ডারেলা চাঁদের মতন মেয়ে।।

সিন্দি। একী? সবাই কোথায় গেল?

রাজপুত্র। সিন্ডারেলা, সবাই কেন এসেছিল তুমি তো জানো।

সিন্দি। সবাই চলে গেছে নাকি?

রাজপুত্র। হ্যাঁ। ওরা সবাই চলে গেছে। তুমি আমায়-

সিন্দি। ইন্দি-বিন্দি?

রাজপুত্র। হ্যাঁ, সবাই। ওরা আর থেকে কী করবে? শোনো না, তুমি আমায়-

সিন্দি। সর্বনাশ! আমি তবে যাই!

রাজপুত্র। শোনো শোনো তুমি আমায় ইয়ে করবে?

সিন্দি। আমার গাড়ি কই? গাড়ি? ওরে! ওরে!

[ দৌড়ে পালায়

রাজপুত্র। এই দেখো! শোনো শোনো, তুমি আমায় বিয়ে করবে? সিন্ডারেলা-

[ পিছন পিছন যায়। একটু পরে ফিরে আসে। হাতে একপাটি জুতো ]

যাঃ! ধরতেই পারলাম না। পাবার মধ্যে শুধু এই। যাক, বলল তো

এদেশেরই মেয়ে-এই এক পাটি জুতো থেকেই তাকে খুঁজে বার করব।

সভাসদ! আঃ! সভাসদরা কই?

[ ডাকতে ডাকতে চলে যায়। পরদা পড়ে ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ বাড়ি। ইন্দি, বিন্দি, সিন্দি ]

ইন্দি। দেখলি তো কী হল! রাজপুত্র আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখল না।

বিন্দি। কোথাকার কে একটা মেয়ে-তাকেই পছন্দ করল। পছন্দের কী ছিরি!

সিন্দি। তাই নাকি? তোদের পছন্দ করেনি? তাহলে সে নিশ্চয় তোদের চাইতেও সুন্দর দেখতে!

ইন্দি। সুন্দর না হাতি। বিশ্রী দেখতে। ঠিক তোর মতন।

সিন্দি। ওমা, তাই নাকি? তবে আমি গেলেই পারতুম।

বিন্দি। হ্যাঁ। তুই গেলে তোকে চাকর দিয়ে খেদিয়ে দিত। ঢুকতে দিত নাকি?

ইন্দি। ছেঁড়াকোটা জামা পরে উনি যাবেন রাজপুত্রের সামনে!

সিন্দি। কেন? সে বুঝি খুব সুন্দর জামা পরে ছিল?

বিন্দি। নয়তো কী? তেমন জামা তুই চোখেও দেখিসনি। আর ঘোড়ায় টানা গাড়ি যা চড়েছিল না, দেখলে তুই ভিরমি যেতিস। আমাদের নেহাত ভালো জিনিস দেখা অভ্যেস আছে, তাই।

ইন্দি। আমাদের জামাগুলো খারাপ বলেই তো আমাদের পছন্দ করেনি। নইলে আমাদের চেয়ে সুন্দর আর কেউ আছে নাকি? বিন্দি, দেখলি? সিন্দি ইচ্ছে করে আমাদের জামাগুলো বিশ্রী করে বানিয়েছিল, যাতে আমাদের কেউ পছন্দ না করে!

বিন্দি। কী হিংসুটে কী বলব! ইচ্ছে করে ওইরকম জামা তৈরি করেনি।

সিন্দি। তা, যেমন জামা আমি চোখেও দেখিনি তেমন জামা আমি বানাব কী করে?

ইন্দি। না পারবি তো আগ বাড়িয়ে জামা বানাতে গেলি কেন?

সিন্দি। আগ বাড়িয়ে বানাতে আমার বয়ে গেছে। তোরাই তো বললি বানাতে।

বিন্দি। তুই -না- বললেই পারতিস।

সিন্দি। -না- বললে মা আমায় আস্ত রাখত নাকি?

ইন্দি। কেন আস্ত রাখবে শুনি?

[ মার প্রবেশ ]

মা। কী হল? সিন্দি, তুমি ফের ঝগড়া করছ?

ইন্দি। দেখো না মা! বলছে, তুমি নাকি মারের চোটে ওর হাড়মাস আলাদা করে দাও!

মা। সিন্দি! রাজার ছেলে ইন্দি-বিন্দিকে পছন্দ করল না, তোমার লজ্জা করে না? তোমার তো ঘরের কোণে গিয়ে বসে থাকা উচিত। আবার ঝগড়া!

সিন্দি। আমি ঘরের কোণে বসে থাকলে রান্না করবে কে?

মা। কেন? রান্নাঘরের কোণে বসে রান্না করবে। যাও।

[ সিন্দি চলে যায়

ইন্দি। মা, আমাদের তাহলে কী হবে?

মা। তোমরা কিছু ভেবো না। আমি সব খবর নিয়েছি। ওই যে মেয়েটা-ওই গুন্ডারেলা না কী যেন নাম-তাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই আবার নিশ্চয় সব্বাইকে ডাকা হবে। এবারে সিন্দিকে দিয়ে এমন জামা তৈরি করিয়ে নেব না-ঠিক ওই গুন্ডারেলার মতন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজার ছেলে, সে বিয়ে না করে আর কতদিন থাকবে? তোমাদেরই ঠিক পছন্দ করবে।

[ হঠাৎ ঢ্যাঁটরার আওয়াজ। পথে ঢ্যাঁটারাম এবং ঘরে সিন্দির প্রবেশ ]

ঢ্যাঁটা। শোনো হে মন দিয়ে দেশের প্রজাগণ! রাজার কুমারের আদেশ এই।

রাজার সভাসদ দেশের মেয়েদের পায়ের মাপ নেবে। সক্কলেই

তৈরি থাকো। আর কালকে উৎসবে সবচে ভালো ছিল যে মেয়েটি

খবর চাই তার। যাবার সময়ে সে পাদুকা ফেলে গেছে এক পাটি

রাজার কুমারের কাছে তা রাখা আছে। অন্য পাটি যে-ই করবে পেশ

রাজার পুত্রের সঙ্গে সে-মেয়ের বিবাহ দেওয়া হবে। ঘোষণা শেষ।।

[ ঢ্যাঁটারাম পুনরাবৃত্তি করতে করতে চলে যায়

ইন্দি। ও মা! দেখেছ? পায়ের মাপ নেওয়া হবে। আমি দেব।

বিন্দি। তোর পা হবে নাকি? আমারটা হবে। আমি দেব।

ইন্দি। হ্যাঁ! ক্যাঙারুর মতো পা। জুতো ছিঁড়েই না যায়।

বিন্দি। তোর ও হাতির মতন পা, জুতো চেপটে ব্যাং হয়ে যাবে।

মা। আচ্ছা থাক থাক। ওরা আসুক তো আগে। দুজনেরই হবে নিশ্চয়।

সিন্দি। তাহলে কে রাজপুত্রের বউ হবে?

ইন্দি। আমি!

বিন্দি। আমি!

দুজনে। না, আমি!

[ সভাসদযুগলের প্রবেশ। সঙ্গে একটা জমকালো বাক্স ]

সভাসদ১। এই বাড়ি থেকে কে কে কাল উৎসবে গিয়েছিল?

ইন্দি, বিন্দি। আমি! আমি!

সভাসদ২। হুঁ! আর কেউ?

মা। ইয়ে আমিও গিয়েছিলাম।

সভাসদ১। তোমরা ঘোষণা শুনেছ? (সবাই সায় দেয়)

সভাসদ২। আচ্ছা, দেখি পায়ের মাপ। এই জুতোয় পা গলাও দেখি।

[ বাক্স থেকে সিন্দির জুতোর একপাটি বার করে ]

ইন্দি-বিন্দি। আমার হবে, আমার হবে! আমার জুতো। ওই তো আমার হারানো পাটিটা!

সভাসদ১। এই একটাই পাটি দুজনে মিলে পরতে?

ইন্দি। অ্যাঁ?

বিন্দি। হ্যাঁ।

সভাসদ২। প্রত্যেক বাড়িতে দেখছি, এই একই জুতোর ডানপাটি হারিয়েছে। কী বলো?

সভাসদ১। আর বাঁ-পাটিগুলো কারোর কাছে নেই।

সভাসদ২। কেন বলো তো? এ-জুতোর কি শুধুই ডানপাটি তৈরি হয়?

সভাসদ১। আর সেটাও এমন করে তৈরি যে কারুর পায়ে মাপসই হয় না?

ইন্দি। হবে না কেন? আমার হবে।

বিন্দি। এই তো, আমারই হবে। দেখুন না!

সভাসদ২। আচ্ছা, এক এক করে। দেখি তোমার পা-

[ ইন্দির পা জুতোয় ঢোকাতে চেষ্টা করে। ইন্দি চ্যাঁচায় ]

ইন্দি। উঃ! ওরে বাবা! না না, লাগছে না-এক্কেবারে ঠিক হয়েছে। বাপরে, কী আরাম লাগছে! উ হুহুহু!!

[ সভাসদ এবার বিন্দির পায়ে চেষ্টা করে ]

বিন্দি। উঃ, আঃ! লাগছে, লাগছে-আরাম লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। ওমা, এক্কেবারে মাপে মাপে হয়েছে। বাবা গো-এটা আমরাই জুতো!!

সভাসদ২। হুঁ। বোঝা গেছে। দেখি, তোমার-

[ মা জুতোটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে ফেরত দিয়ে দেয় ]

মা। নাঃ, আমার বোধ হয়-

ইন্দি। কী করে হবে? ওটা তো আমার পায়ের মাপ।

বিন্দি। না না, আমার পায়ে এক্কেবারে হয়েছে। দেখলেন তো!

সভাসদ১। বটে? তা এর অন্য পাটিটা কই?

ইন্দি। অন্য পাটি?

বিন্দি। সেটা? সেটা ওই সিন্দি হারিয়ে দিয়েছে।

সভাসদ২। সিন্দি? সিন্দি আবার কে?

ইন্দি। ওই যে দাঁড়িয়ে-ভারী শয়তান মেয়ে। এই, তুই আমাদের একপাটি জুতো হারিয়েছিস কেন রে?

সভাসদ১। আঃ, থামো। (সিন্দিকে) তুমি কাল রাজবাড়িতে গিয়েছিলে?

[ সিন্দি চুপ ]

সভাসদ২। তোমার নাম কী?

সিন্দি। সিন্দি।

সভাসদ১। নামটাও চেনা চেনা লাগছে। সিন্দিরানি না কী যেন নাম বলেছিল না?

সভাসদ২। সিন্দিরানি?

সভাসদ১। নাকি সিন্দিরেলা?

সভাসদ২। নানা, -সিন্ডারেলা- বোধ হয়। ওইরকমই কী একটা।

সভাসদ১। এই, তুমি এদিকে এসো তো। এটা পরো।

[ সিন্দি পরে নেয় ]

সভাসদ২। এবার হাঁটো।

সিন্দি। একপায়ে জুতো পরে হাঁটব কী? আমি কি ল্যাংড়া? (জুতো খুলে নেয়)

সভাসদ১। হুঁ। কথাবার্তাতেও সেইরকমই মনে হচ্ছে। তাই না?

সভাসদ২। হুঁ। কাটা কাটা মতন। (সিন্দিকে) তা দু-পায়ে জুতো পরলেই তো পারো। বারণ করছে কে?

সিন্দি। তাই পরব তো। বারণ শুনছে কে?

[ জুতোর বাক্স থেকে অন্য পাটিটা নিয়ে দু-পাটি পরে হেঁটে বেড়ায় ]

সভাসদ১। এই তো! এই তো সেই মেয়ে!

সভাসদ২। চলো আমাদের সঙ্গে। রাজপুত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে।

সিন্দি। কেন, কেন?

সভাসদ১। তোমার পায়ের মাপ যে জুতোর সঙ্গে মিলে গেছে। রাজপুত্রের আদেশ-বিয়ে করতেই হবে।

সিন্দি। তার মানে? পায়ের মাপ দেখে আবার বিয়ে হয় নাকি? যত্তসব পা-গোল!

সভাসদ১। এই মেয়ে! রাজার অপমান করবে না বলে দিচ্ছি। বেশি লম্ভঝম্প করলে সেপাই ডেকে ধরে নিয়ে যাব। ভালোয় ভালোয় এসো বলছি! সেপাই!

সভাসদ২। সেপাই! সেপাই!!

সিন্দি। ইঃ! ধরে নিয়ে যাবেন! ধরো দেখি! আমি কক্ষনো বিয়ে করব না। আমি ইস্কুল যাব, পড়াশোনা করে প্রাইজ নেব! আজ আমাদের সিন্ডারেলা নাটক -ওমা, তাই তো, আজ যে আমাদের সিন্ডারেলা নাটক!

[ সিন্দি দৌড়ে পালায়। সকলে তাকে ধর-ধর করে তাড়া করে। মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে নানা গলায় হট্টগোল চলে। একটা নীল আলোয় দেখা যায় খুকু আগের জায়গায় বসে ঘুমিয়ে রয়েছে। টিফিনকৌটো হাতে খুকুর মা আসে। আলো বাড়ে ]

খু-মা। খুকু, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? ইস্কুলে যাবে না? তোমার টিফিন ব্যাগে ভরে নাও।

খুকু। উঁ? মা? ওঃ, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কীসব স্বপ্ন!

খু-মা। নাও, টিফিনবাক্স গুছিয়ে নাও।

খুকু। ওমা, আজ তো ইস্কুলে প্রাইজের ফাংশন। আমরা সিন্ডারেলা করব না? আজ তো স্কুল থেকেই টিফিন দেবে।

মা। ও, তাই তো! তাহলে টিফিনটা কী হবে? ফিরে এসে খাবে?

খুকু। দেখি, কী টিফিন-ওব্বাবা, লুচি, মোহনভোগ, চিত্রকূট, আমসত্ব- আচ্ছা মা, তুমি একটা কাজ করবে?

মা। কী?

খুকু। আগে বলো, করবে। আমি ফার্স্ট হয়েছি বলে করবে।

মা। আচ্ছা, কাজটা কী, শুনিই না।

খুকু। বিকেলবেলায় না, দেখবে, একজন মুখোশওয়ালা আসবে খেলনা বেচতে। ওকে আমার টিফিন থেকে একটু দিয়ো। আর-

মা। আর?

খুকু। আর ওই যে কাগজকুড়ুনি বুড়ি আসে থলি হাতে, ওকে একটুখানি দিয়ো।

মা। এই? আচ্ছা দেব।

খুকু। আর শোনো মা, দুপুরে দেখবে, তিনটে ছেলে আসে-একটা কাঠের গায়ে চাকা লাগিয়ে টেনে টেনে খেলে বেড়ায়। ওদের একটু দিয়ো।

মা। ওরে বাবা! তাহলে তো আমায় আবার রাঁধতে হবে সোনা!

খুকু। ওদের দেবে না? ওরা খুব ভালো গো!

মা। আচ্ছা আচ্ছা দেব।

[ মা খুকুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে ছাইবুড়ি, বহুরূপী, রটাই-পটাইরা যায়। খুকু তাদের দেখতে পায় না ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *