॥ আট ॥
ট্রেনের জানলায় বসে, স্ট্রিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে যত জায়গাজমি দেখা যায়—তার হিসেব নিকেশ কড়ায়-ক্রান্তিতে সরকার বাহাদুরের খাতায় লেখা থাকে। কোন্ জায়গা কার ছিল, কার হাতে গেল—সব লেখা থাকে। কথা হচ্ছিল সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে বসে।
কুবেরের জায়গা কেনা থামেনি। বরং বেড়েছে। ইদানীং বুলুও বিরক্ত। অফিসে প্রায়ই কামাই। সে বলতে বসলে সাতকাহন।
মাঝবয়সী কানুনগো আরও অনেক কথা বললেন। বহরিডাঙ্গা, মেদনমল শোলগোহালিয়া নাটাগাছি—এসব মৌজার সেটেলমেন্ট ক্যাম্প এই ঢাকুরিয়ায়। অফিসঘরে বসে কথা হচ্ছিল। সামনেই গেরস্থ বাড়ি—পাশ দিয়ে খোয়া ওঠা রাস্তা, দু’ধারে বয়স্ক সব নারকেল গাছ। শহরের মধ্যে আর এমন দেখা যায় দমদম নয়ত উল্টোডাঙায় কিংবা হাওড়ার গা দিয়ে যেসব বসতি উঠেছে গত বিশ ত্রিশ বছরে সেসব পাড়ায়। এই রাস্তা আর বাঁকুড়ার কেদুয়াডিহির ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে যে শালবন দেখা যায়—সব সরকারী খাতার হিসেবে তোলা আছে। ভাবতেই কুবেরের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
হরির পুকুর, রামের ডাঙা, পালানের ভদ্রাসন সব মেপে মেপে নকশা করে রাখতে হয়েছে।
কানুনগো বললেন, ‘মোগল আমলের আগে থেকেই আমাদের দেশে এই মাপজোক শুরু হয়ে গিয়েছে। ভূমিরাজস্ব একটা দারুণ সায়েন্টিফিক ব্যাপার।’
কুবের একটা জমির ইতিহাস জানতে এসেছিল। জমির পরিমাণ খুব বেশি নয়। কাঠা পনর হবে। পাঁচজন শরিক। স্বামী মারা যেতে নতুন হিন্দু আইনে বিধবার কপালে একভাগ পড়েছে। বাকি চার ভাগের তিন ভাগ তিন মেয়ে আর বাকিটুক ছেলে হরেকেষ্টর ভাগে বর্তেছে। চার ভাগ কেনা খতম। বাকি শুধু হরেকেষ্টর অংশ। সেই অংশ নিয়েই ঝামেলা আছে কিছু। বছর দুই আগে হরেকেস্ট তার নতুন বৌকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরে জেলে গিয়েছে! জেল থেকে বেরোলেই আর ও-জায়গা কেনা যাবে না। তখন খেয়াল খুশি মত হরেকেষ্ট কুবেরকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। অথচ হরেকেষ্টর ভাগটুকু না হলে নয়।
কানুনগোর কথাগুলো শুনে একদম ঘোরের মাথায় কুবের বেরিয়ে পড়ল। এখন নয়ান বাড়ি নেই। ব্রজদাও তার বাবার আত্মজীবনী বাঁধাইখানায় আনতে গেছে হয়ত। বহুদিনের পরিশ্রমের পর বইখানা বাজারে বেরোচ্ছে। এই ফাঁকে একবার কদমপুর ঘুরে আসবে।
দুপুরের ট্রেন ফাঁকা। প্রায় দুলকি চালে লাইনের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে। কুবের এখন জানে সরু পিয়াসলে পেরুলেই একটা খাল পড়ে—তার ওপর দিয়ে ট্রেন আস্তে যায়। সেখান থেকে খানিক এগিয়ে একতলা একটা বাড়ি ডানদিকে, গোয়ালের ছাদে বীজ রাখার একটা ঢাউস লাউ ছাতকুড়ো পড়ে কালচে হয়ে উঠেছে।
লেভেল ক্রসিংয়ে গেট খোলেনি। কলকাতা যাওয়ার ট্রেন আসছে উল্টোদিক থেকে। কুবের লাইন পেরোবার মুখে একখানা স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে দেখল। ড্রাইভারের পাশের সিটের দরজা খোলা। সেখানে গগলস্ চোখে তাগড়াই মত একজন ঘন ঘন কজির ঘড়ি দেখছিল। কুবেরকে দেখে বললো, ‘এখানে ডাব কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?’
‘এখন তো বাজার বন্ধ। ভোরের ট্রেনে ডাব, মাছ সব কলকাতায় চলে যায়—’
‘আমাদের সঙ্গে একজন বিদেশী আছেন। হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে পড়েছে। ঠাণ্ডা দেশের লোক। গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন।’
দু’জন ব্যাপারী বোধহয় বিকেলের ট্রেনের জন্যে বেশ আগেই এসে পড়েছে। রিকশা-ভ্যান বোঝাই দিয়ে স্টেশনের দিকে আসছিল। কুবের তাদের থামিয়ে চারটে ডাব কিনে দিল দরাদরি করে। পাশের চায়ের দোকান থেকে একটা বড় কাচের গ্লাসও যোগাড় করে দিল।
গাড়ির গায়ে লেখা ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’। পাশে ইংরাজি হরফে লেখা ও এন জি সি। পেট্রোল খোঁজার দল। কলকাতার ট্রেন চলে গেলো। স্টেশন ওয়াগনের ভেতর গরমে কাহিল সাহেব নানাভাবে ধন্যবাদ জানালো কুবেরকে।
‘কোত্থেকে আসছেন আপনারা?’
‘সোঁদালিয়া ক্যাম্প।’
গাড়ি ধোঁয়া তুলে বেরিয়ে গেল। মাইল সাত আটের মধ্যে তেল খুঁজে দেখা হচ্ছে। এদের গাড়ি আরও দু’চারবার কুবেরের চোখে পড়েছে। বড় পাকুড়তলায় বিক্রির জন্যে বাঁশ কিনে কিনে জমা করেছে কে। বিশাল গাছটার গায়ে হেলানো বাঁশের গোছা একটা দৃশ্য হয়ে আছে। পাশেই ধানকলে বটবট আওয়াজ। বিকেল হওয়ার আগেই খালপাড়ে এসে হাজির হল কুবের। এখানেই আভা বৌদি মাছ কিনতে আসে ভোর ভোর—নয়তো সন্ধ্যের ঘোরে।
মাঠ দেখে কোন্ জমিটা কতদূর বোঝার উপায় নেই। উত্তরে খেজুর গাছ ছিল আগেকার সীমানা। ভুবনদের জায়গা কেনার পর কুবের সাধুখাঁ বহরিডাঙা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আরও অনেকবার গেছে। ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হতে আর দেরি নেই। কদমপুরের বাজারে নতুন নতুন দোকান হচ্ছে। স্টেশন রোডে ঘরভাড়া এখন চড়া।
বিকেলে একখানা ছায়ার শতরঞ্চি সারা মাঠে একেবারে মাপসই হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ছায়ার শেষে শেষে পড়ন্ত রোদ্দুর ঝলক তুলে দাঁড়ানো। সেদিকে তাকিয়ে কুবের আর পলক ফেলতে পারে না। ছায়াবন্দী এই বিশাল চৌকোমত জায়গাটুক কিনতে পারলে ভেতর দিয়ে কয়েকটা রাস্তা বের করে দিলেই হবে। তারপর রাস্তার দুধারে প্লট কেটে নগর বসানো।
ছায়ার শেষ অবধি একবার ঘুরে আসার জন্যে কুবের মাঠে নেমে পড়ল। শীতের শেষ দিককার মাঠ। হলুদ ঘাসের মধ্যে পাম্প সু পায়ের চাপে ডুবে যাচ্ছে। এই মাঠ, মাঠের শেষ দিককার গাব গাছের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা ভঙ্গী, সরলরেখার ধারায় একটি খাল—এসবের মাঝখানে কুবের যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে তাজা শরীরে হাঁটতে শুরু করেছে। এখানে তার হাঁটাচলা আটকাবার কেউ সেই। কেউ বলবে না, আর এগিও না-বাস এই পর্যন্ত। পাম্প সু-র ওপর শুকনো ধুলোর গুঁড়ো ঘিরে রঙের পাউডার হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এক ঝলক রক্ত উঠে এলো বুকে। কুবের ঝোঁক সামলে থমকে দাঁড়ালো। ঘাসের মধ্যে অবলীলায় একটা সাপ এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে—একটু মাথা তুলল, তারপর যেমন যাচ্ছিল চলে গেল।
কুবের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, সাপটা খেজুরগাছের গোড়ায় একটা গর্তে একট একটু করে ঢুকে গেল। শেষে লেজটুকুও ভেতরে নিয়ে গেল।
ধাক্কা খেয়ে চমক ভাঙল কুবেরের।
‘সেই থেকে আপনাকে ডাকছি। কোন সাড়া নেই। কি ব্যাপার?’
লোকটাকে কোনদিন দেখেনি কুবের। তোবড়ানো মুখে খুব বুঝসমঝ করে কথা বলার ভাব। তখনও কুবের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, সাপটা একেবেঁকে কুঁচকে গিয়ে ভাঁজে ভাঁজে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা এই হাতের মুঠোর মত। ঘাড় ফিরিয়ে কুবেরকে দেখছিল—গলায় বোধহয় খড়মের ছাপ। গায়ে চর্বি হয়েছে বেশ—সাপটা অনেকদিনের পুরনো।
‘সাপ মানুষকে দেখে? ‘
‘তা দেখে বৈকি। এই দিনমানে আবার সাপ দেখলেন কোথায়। এখন তো ওনাদের বেরোবার সময় নয়।’ একটু থেমে বললো, ‘নয়ানের আমি জ্ঞাতি কাকা। আপনাকে আমার কথা বলেনি নয়ান? আপনি তো সালকের কুবের সাধুখাঁ। তাই না?’
মনে করতে পারল না কুবের। আন্দাজে মাথা নাড়ল।
‘শুনলাম সর্দারদের জায়গাটুকু কিনবেন। বড় বেগ দিচ্ছে ওরা। তাই যেচেই এগিয়ে এলাম।’
এবার ভাল করে লোকটাকে দেখলো কুবের। শীত চলে গেলেও ঠাণ্ডা যায়নি। খয়েরি রঙের র্যাপার একখানা গায়ে। বগলে টিনের একটা নল। ভেতরে কি আছে জানে কুবের। মৌজা ম্যাপ। দাগওয়ারি জায়গার চেহারা, রাস্তা, খানা, খাল-খন্দের নিশানা সবই আঁকা আছে। সারা পৃথিবীটা কালি করে খাতায় হিসেবপত্তর তোলা সারা।
‘আপনি ভদ্রেশ্বরের নাম শোনেননি? আমি সেই ভদ্রেশ্বর।’
খুব শুনেছে কুবের। এখানকার জমি-জায়গার জট ছাড়ানোর জন্যে ভদ্রেশ্বরের কাছে প্রায় সবাই যায়। নয়ানদের কর্তাবাবারা ছিলেন তিন ভাই। সেই তিন বুড়োর সংসার ডালপালায় এখন কদমপুরের আধখানা জুড়ে আছে। তাদেরই কারও ছেলে ভদ্রেশ্বর।
‘এখন তো সাপ বেরোয় না। সে সেই মাঝরাতে। তখন আহারে বেরোতে হয় ওনাদের।’
তারপর ভদ্রেশ্বর বললো, ‘সাপ যা-কিছু ওই বাঁশবাগানের ওখানে আছে। এদিককার সব সাপ ইটের লরির আওয়াজে পালিয়ে গেছে।’
তা বটে। কুবেরের কেনা জায়গার এখানে ওখানে বাড়ি উঠতে শুরু করেছে। ‘এ তল্লাটে আগে মানুষ আসত না। বাংলা তিরিশ সন থেকে জলে ডুবে ছিল। সবাই বলতো ভাসার লাট। আর কি মাছ! সে খেয়েছি বটে—’
এসব কথা অনেকবার শোনা কুবেরের। রায়মশাই বলেছিলেন, এখানে আগে সমুদ্র ছিল। পুকুর কাটতে গিয়ে কুবেরের ভায়রা ভাই বলাই মহাপাত্র পেল্লাই এক গাছের গুঁড়ি পেয়েছে। তিনটে লোকেও বেড় পায় না তার। দশ ফুট নীচে মাটি কি কালো। হাত দিলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আগুনে জ্বলে। আগে হয়ত জঙ্গল ছিল। কিংবা নদীর খাঁড়ি। গেঁয়োর জঙ্গল মাথা তুলে দাঁড়াতেই কোনদিন বোধহয় পাড় ধসানো বানে সব ভেঙে চুরে মাটি চাপা পড়েছিল।
বিকেলবেলা এসব ভাবলে মন বড় খারাপ হয়। ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে খালপাড় ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠল।
সর্দারদের জায়গার ইতিহাস সব কণ্ঠস্থ ভদ্রেশ্বরের। সর্দারদের বড় বুড়ো কোটিরাম নস্করের চাকর ছিল। কোটিরাম বুড়োকালে কাশীবাসী হওয়ার আগে ষোলটা টাকা ধার করেছিল চাকরের কাছে। তার বদলে জায়গাটুকু লিখিয়ে নিয়েছিল সর্দারদের বড় বুড়ো। কে জানত সে জায়গার দর আজ এমন হবে। তা হোক—তাতে কুবেরের আপত্তি নেই। জায়গার দর বলে কিছু আবার আছে নাকি। এ হল এক খেয়াল। কিংবা ঝোঁক! ওই জায়গাটা আমার চাই-ই-নাহলে সাইজে আসছে না। এইসব ভেবেই তো লোকে জায়গা কেনে। নাহলে কুবেরের কাছ থেকে লোকে এত জায়গা কিনছে কেন?
জানা গেল, সর্দারদের বড় ভাই মেয়ের বিয়ে দেবে। টাকা দরকার। তার অংশটা কিনে অবিভক্ত সম্পত্তির ভাগীদার হয়ে এখন চুপচাপ বসে থাকতে হবে। তাহলে বাকি শরীকরা অন্য জায়গায় কোবালার কথা পাড়তে পারবে না। তখন মানে মানে করে সবটুকু কুবেরকেই দিতে হবে।
কত জায়গা যে কুবেরের দরকার। শুরু হয়েছিল সামান্য জায়গা নিয়ে। এখন কুবের কয়েক বিঘার মালিক। এই অবস্থায় আসতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক ঝুঁকি মাথায় নিতে হয়েছে।
রাতে বিছানায় বুলু বলে, তুমি যে বেশি দামে জমি দিচ্ছ শেষে কোন কথা হবে না তো?
কুবেরও যে এসব একদম ভাবেনি—তা নয়। নিজেকে বুঝিয়েছে, এর নাম ব্যবসা। জমি তো লোকে কম দামে কিনে বেশি দামে ছাড়ে। সবাই তাই করে। এতে আর দোষ কি।
এমন সব যুক্তি নিজের মনের মধ্যে অনেকবার ভেঁজেও কেমন দুর্বল লাগে কুবেরের মাঝে মাঝে। ব্যাপারটার নাম ব্যবসা দিয়ে, সে তাই চাঙ্গা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। তাছাড়া, জায়গাটার উন্নতির জন্যে সে-ও তো কম করছে না।
এক এক সময় মনে হয়—উনিশ শো দশ কিংবা তারও আগে বঙ্গভঙ্গের সময় জন্মালে কত সুবিধে ছিল। অল্প টাকায় দনাদ্দন মৌজার পর মৌজা কিনে ফেলতো কুবের। তারপর সাজিয়ে গুছিয়ে বাজার বুঝে ছাড়তো। আজ অবশ্য সে বুড়ো হয়ে যেতো কিন্তু কত নিশ্চিন্ত হতে পারতো। তখন পৃথিবীতে এতো লোকও ছিল না।
আবার মনে হয়, এই পৃথিবীতে এক-একদল লোক এসে ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, বাগান, ফুলগাছ সব বানায়। কত লোক পলেস্তারার সময় পঙ্খের কাজ করায়, ছাদের আলসেতে সিমেন্টের পরী বসায়, পুকুরঘাটে বেঞ্চ দেয়—অথচ শেষে সব একদিন রাবিশ হয়ে ঠিকেদারের লরিতে ওঠে, জঙ্গলে ঢাকা পড়ে—নতুন লোক জায়গা বদলে আর এক জায়গায় গিয়ে বসতি বানায়। ‘এই খাল দেখছেন—এখানে আগে কতো দূর দেশের নৌকো আসতো।’
‘অনেক দূরের?’
‘আবাদের ধানের নৌকা এই খাল দিয়ে চেতলার হাটে গিয়ে আঢ্যিদের ঘাটে নোঙর ফেলতো। বেশি কি বলব—শ্রীহট্টের কমলালেবুর চালান এই পথ দিয়ে নৌকোয় কলকাতা যেতো। নদী মজে গিয়েই সব গেল।’
কুবেরের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এ আমি কোথায় আছি এখন। সালকের বাড়িতে মা চোখে চশমা দিয়ে লাল বারান্দায় মাদুর পেতে বই পড়ে এসময়। বাবার শুড়তোলা গেঞ্জি পরা হয়ে গেছে। এবার গরম শার্ট চাপিয়ে চৌরাস্তা অব্দি হেঁটে আসবে। বুলুর তিনমাস। খোকন হয়েছিল বছর চারেক আগে। ফার্নেসে বিকেলের সিফট শুরু হয়ে গেছে। অ্যাপ্রেন্টিসরা কেউ লম্বা লোহার রড দিয়ে গলন্ত ইস্পাত ঘেঁটে দেখছে। এ আমি কোথায় আছি। ধানকাটা মাঠের হলুদ রঙ পড়ন্ত রোদের আলো বেয়ে অনেকখানি উঠে এসেছে। তার মাঝখানে এক একটা তালগাছ সিধে দাঁড়ানো। দূরে দূরে এক এক পরতে এক একটা আবাদ। প্রথমে কেষ্টবাবুর আবাদ, তারপর নবীনবাবুর-শেষে তার মৈত্রী আবাদ, ডাক্তরবাবুর আবাদ।
‘নদীও গেল। আমরাও ম’লাম-’
ভদ্রেশ্বর এমনভাবে বলছে, চোখের জায়গায় আয়না বসানো থাকলে তিরিশ বছর আগের ঘোলানো ভরা নদীর সুদূর ছায়া তাতে পড়তো।
রেলের পুল দেখছেন ওই যে-এখন তো ওর নীচে নদীর বুকে চাষ হচ্ছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে রেলে গেছি ওখান দিয়ে—গাড়ির বেগ কমে যেতো, লোকে পয়সা ফেলতো। তেমন বর্ষায় সাহেবরা পাথর ফেলতো -ঢেউয়ের কোমর ভেঙে দিতে।’
‘নদী মরে যাওয়ার পর সেসব পাথর পাওয়া গেছে?’
‘অঢেল। মোটা মোটা কাছি বেঁধে মোষ জুড়ে তবে সেসব পাথর সরিয়েছে চাষীরা। আরও কত পড়ে আছে ধারে ধারে।’
খালের ওপারেই ননী বোসের পুরনো ইটখোলার ধ্যাড়ধেড়ে কঙ্কালটা পড়ে আছে। মাটি মাখানোর দু’দুটো পগ্মিল জং পড়ে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে কোনরকমে জেগে আছে। ইট করার পর বাতিল বিরাট বিরাট গর্ত এখন জলে ভর্তি। ননীর সেই মহা ফোক্কড় ছেলেটা বিকাশ এখন তাতে মাছ চাষ করে। লগনসার জন্যে বড় বড় মাছ তুলে বাড়ির গায়ের কানায় ছেড়ে দিচ্ছে। বিয়ের মরসুমে ঝাড়বে। মাটি এতোও দেয়!
না-দিলে কুবের আজ কারখানায় নাগা হওয়ার তোয়াক্কা না রেখে কদমপুরে আকাশের নীচে ফাঁকা মাঠে এসে ঘুরে বেড়াতো না। কোল কোম্পানির হীরেন নেবে আট কাঠা জায়গা। দু’ হাজার টাকা আগাম দিয়েছে। দলিরপত্র তৈরি হলে রেজিস্ট্রির দিন বাকিটা দেবে। গত ক’দিনে আরও যেন কে কে টাকা দিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর ডাইরি খুলে নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে তারিখ দিতে হবে। নয়তো কত টাকার হিসেব যে গুলিয়ে যাবে শেষে। নানান দিকে খরচও হচ্ছে টাকা। সরকারী অনুমতি যোগাড় হয়েছে। এখন খালপাড় ঘসে মেজে অ্যাভিন্যুর চেহারা পাবে। কি নাম দেওয়া যায় রাস্তার? কুবের সাধুখাঁ অ্যাভিন্যু? না! কুবের রোড। বেঁচে থাকতে সে বড় বিচ্ছিরি হবে।