কুবলয়াশ্ব

কুবলয়াশ্ব

 পূর্বকালে শত্রুজিৎ নামে অতি বিখ্যাত এক রাজা ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম ঋতধ্বজ। ঋতধ্বজের গুণের কথা আর কি বলিব। যেমন রূপ, তেমনি বুদ্ধি, তেমনি বিনয়, তেমনি বল, তেমনি বিক্রম। এমন পুত্রলাভ করিয়া রাজা শত্রুজিৎ খুবই খুশি হইয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

 ইহার মধ্যে একদিন গালব নামে এক মুনি একটি সুন্দর ঘোড়া লইয়া রাজা শত্রুজিতের নিকট আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমি বিপদে পড়িয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। একটা দুষ্ট দৈত্য আমাকে বড়ই ক্লেশ দিতেছে। সে কখনো সিংহ, কখনো বাঘ, কখনো হাতি, কখনো আর কোনো জন্তুর বেশে আসিয়া দিবারাত্র আমাকে অস্থির রাখে, উহার জ্বালায় আমার তপস্যাই অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। আমি ইচ্ছা করিলে শাপ দিয়া উহাকে বধ করিতে পারি, কিন্তু তাহাতে তপস্যার হানি হয়, কাজেই আর কি করিব, শুধু নীরবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। এমন সময় একদিন এই ঘোড়াটি আকাশ হইতে আমার নিকট পড়িল, আর দৈববাণী হইল, ‘গালব! এই ঘোড়াটির নাম কুবলয়। ইহার কিছুতেই ক্লান্তি নাই, সংসারে ইহার অগম্য স্থান নাই, ইহাকে রোধ করিবার শক্তি কাহারও নাই। রাজা শত্রুজিতের পুত্র ঋতধ্বজ ইহাতে চড়িয়া তোমার শত্রু সেই দুষ্ট দানবকে বধ করিয়া কুবলয়াশ্ব নামে বিখ্যাত হইবে।’

 “মহারাজ তাই আমি এই ঘোড়াটি লইয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। আপনার পুত্র যদি ইহাতে চড়িয়া দানবটাকে তাড়াইয়া দেন, তবেই এ ব্রাহ্মণের তপস্যা হয়।”

 রাজার আজ্ঞায় তখনই ঋতধ্বজ সেই আশ্চর্য ঘোড়ায় চড়িয়া মুনির সঙ্গে তাহার আশ্রমে আসিলেন। তারপর মুনিরা সকলে তাঁহাদের সন্ধ্যাবন্দনা আরম্ভ করিতে না করিতেই সেই দুষ্ট দানব শূকর সাজিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। মুনির শিষ্যেরা তাহাকে দেখিয়া প্রাণপণে চ্যাঁচাইতে লাগিল। রাজপুত্র তখনই সেই ঘোড়ায় চড়িয়া তাহাকে তাড়া করিলেন। তাঁহার হাতের অর্ধচন্দ্র বাণের বিষম খোঁচা খাইয়া আর কি দুষ্ট দানব সেখানে দাঁড়ায়? সে প্রাণের মায়ায় কোন পথে পলায়ন করিবে কিছুই বুঝিতে পারিল না। পাহাড়ে, বনে, শূন্যে, সাগরে, যেখানে যায়, রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া, ধনুর্বাণ হাতে সেইখানেই গিয়া উপস্থিত হন। এইভাবে চারি হাজার ক্রোশ চলিয়া শেষে সে একটা গর্তের ভিতরে লাফাইয়া পড়িল। রাজপুত্রও তাহার সঙ্গে সঙ্গেই গর্তে গিয়া ঢুকিলেন বটে, কিন্তু সেখানকার সেই ঘোর অন্ধকারের ভিতরে আর তাহাকে দেখিতে পাইলেন না।

 রাজপুত্র সেই গর্তের পথে দানবকে খুঁজিতে খুঁজিতে একেবারে পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে আর অন্ধকার নাই, সেখানে ইন্দ্রপুরীর ন্যায় অতি অপরূপ সোনার পুরী। রাজপুত্র তাহারা ভিতরে কতই খুঁজিলেন কিন্তু দানবকে পাইলেন না। মানুষও সেখানে কেহই ছিল না। ছিল কেবল দুটি মেয়ে। তাহার একটি যে কি সুন্দর, সে আর বুঝাইবার উপায়ই নাই।

 এই কন্যার নাম মদালসা, ইঁহার বৃত্তান্ত অতি আশ্চর্য। ইঁহার পিতার নাম বিশ্বাবসু, তিনি গন্ধর্বের রাজা। একদিন মদালসা তাঁহার পিতার বাগানে খেলা করিতেছিলেন, এমন সময় হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হইয়া গেল। সে অন্ধকার আর কিছুই নহে, উহা পাতালকেতু নামক দুষ্ট দানবের মায়া। দুরাত্মা সেই অন্ধকারের ভিতর সেই অসহায় বালিকাকে লইয়া পলায়ন করিল, কেহ সে কথা জানিতে পারিল না। তাহার আর্তনাদও কেহ শুনিতে পাইল না।

 তদবধি সেই দুষ্ট তাঁহাকে পাতালে আনিয়া নিজ বাড়িতে আটকাইয়া রাখিয়াছে, বলিয়াছে যে, ভালো দিন পাইলেই তাঁহাকে বিবাহ করিবে।

 ইহার মধ্যে একদিন মদালসা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করিতে যান, তখন সুরভি তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া বলেন, “বাছা, তোমার কোনো ভয় নাই, এই দুষ্ট দানব তোমাকে বিবাহ করিতে পাইবে না! ইহার মৃত্যু যাঁহার হাতে হইবে, তিনিই অবিলম্বে তোমাকে বিবাহ করিবেন।”

 রাজপুত্র মদালসার সঙ্গের মেয়েটির নিকট এ সকল সংবাদ শুনিতে পাইলেন। মেয়েটির নাম কুণ্ডলা! তিনি একজন তপস্বিনী এবং মদালসার সখী। কুণ্ডলা আরো বলিলেন যে, সেদিন পাতালকেতু শূকর সাজিয়া মুনিদের আশ্রম নষ্ট করিতে গিয়াছিল, সেখান হইতে এইমাত্র এক রাজপুত্রের হাতে সাংঘাতিক বাণের খোঁচা খাইয়া আসিয়াছে।

 তখন আর ঋতধ্বজের বুঝিতে বাকি রহিল না যে তিনিই সেই রাজপুত্র, আর পাতালকেতুই তাহার সেই দানব।

 সে কথা শুনিয়া মেয়ে দুটির যে আনন্দ হইল!

 রাজপুত্রকে দেখিয়াই মদালসার যারপরনাই ভালো লাগিয়াছিল আর সেজন্য তাঁহার মনে দুঃখও হইয়াছিল যতদূর হইতে হয়। কেননা, ইঁহাকে তো আর পাওয়ার কোনো আশাই নাই, যেহেতু সুরভি বলিয়াছেন, ‘যে দানব মারিবে, সেই মদালসাকে বিবাহ করিবে তাঁহার কথা বৃথা হইবার নহে।

 যাহা হউক, এখন সে ভয় কাটিয়া গেল, সুতরাং দুঃখের জায়গায় আনন্দ হইল চতুর্গুণ! তবে আর বিলম্ব কেন? তখনই পুরোহিত তম্বুরু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিতে দেখিতে পবিত্র আগুন জ্বলিল, ঘৃতের আহুতি পড়িল, মন্ত্রের ধ্বনি উঠিল, শুভকার্য শেষ হইল।

 তারপর কুণ্ডলা আবার তপস্যা করিতে গেলেন। রাজপুত্র মদালসা সহ সেই আশ্চর্য ঘোড়ায় চড়িয়া দেশে ফিরিবার আয়োজন করিলেন। অমনি পাতাল কাঁপাইয়া ভীষণ চিৎকার উঠিল, ‘নিয়া গেল রে, নিয়া গেল! শীঘ্র আয়, শীঘ্র আয় তোরা।’

 তাহার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার দানব কোথা হইতে খাঁড়া ঢাল গদা শূল হাতে আসিয়া মার, মার!’ শব্দে ঋতধ্বজকে আক্রমণ করিল।

 ঋতধ্বজ তখন করিলেন কি, তাঁহার তৃণ হইতে ত্বাষ্ট্র নামক অস্ত্রখানি লইয়া, মারিলেন তাহা সেই দানবের ভেঙ্‌চির ভিড়ের উপর ছুঁড়িয়া। অমনি দানবের দল চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে পলকের মধ্যে পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, রাজপুত্রও মনের সুখে মদালসাকে লইয়া দেশে চলিয়া আসিলেন। তখন সেখানে না জানি কেমন বাজি, বাদ্য আর ভোজের ঘটা হইল! না জানি সকলে কতদিন ধরিয়া কত কি খাইল!

 ইহার পর হইতে ঋতধ্বজের নাম হইল কুবলয়াশ্ব। এখন তিনি রাজার আজ্ঞায় প্রতিদিনই সেই ঘোড়ায় চড়িয়া মুনিদের আশ্রম হইতে দানব তাড়াইয়া বেড়ান। ইহাদের মধ্যে হইয়াছে কি, সেই পাতালকেতুর ভাই ছিল তালকেতু, সে বেটা দিব্য একটি শুদ্ধ শান্ত মুনি সাজিয়া, যমুনার ধারে আশ্রম করিয়া চোখ বুজিয়া বসািয় থাকে, যেন সে ভারি একটা তপস্বী!

 কুবলয়াশ্ব ঘোড়ায় চড়িয়া সেই পথে যাইতেছেন, এমন সময় সে চোখ মিট্‌ মিট্‌ করিতে করিতে আসিয়া তাঁহাকে বলিল, “রাজপুত্র! আমার একটা যজ্ঞ করিতে ইচ্ছা হইয়াছে, কিন্তু দক্ষিণা দিবার পয়সা নাই। আপনি যদি দয়া করিয়া আপনার গলার ঐ হারখানি আমাকে দেন, তবে আমার সাধ পূর্ণ হয়।”

 রাজপুত্র তৎক্ষণাৎ গলার হার তাহাকে দিলেন। তখন সে আবার বলিল, “আপনার জয় হোক! এখন তবে আর একটি কাজ যদি করেন, আমি জলের ভিতরে থাকিয়া বরুণের স্তব করিতে যাইব, ততক্ষণ আমার আশ্রমটির উপর একটু চোখ রাখিবেন।”

 রাজপুত্র তাহাতেই সম্মত হইলেন। তালকেতুও চলিয়া গেল। কিন্তু সে তো তপস্যা করিতে গেল না, সে সোজাসুজি কুবলয়াশ্বের বাড়িতে গিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “হায়, হায়! ওগো! সর্বনাশ হইয়াছে! রাজপুত্রকে দানবে মারিয়াছে। মৃত্যুর সময়ে তিনি এই হার আমার হাতে দিয়া বাড়িতে সংবাদ দিতে বলিয়াছেন!”

 কুবলয়াশ্বের হার দেখিয়া আর কাহারও এ কথায় অবিশ্বাস করিবার উপায় রহিল না। তখন দেশময় হাহাকার পড়িয়া গেল; সে দারুণ সংবাদ সহিতে না পারিয়া মদালসা প্রাণত্যাগ করিলেন।

 ততক্ষণে সেই দুষ্ট তালকেতু আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে কুবলয়াশ্বকে বলিল, “আহা! আপনি আমার বড়ই উপকার করিলেন। আপনি এখানে থাকায় আমি প্রাণ ভরিয়া যজ্ঞ করিয়াছি! এখন তবে আপনি ঘরে ফিরিয়া যাউন।”

 এ কথায় রাজপুত্র তথা হইতে চলিয়া আসিলে, দুষ্ট ঘরে বসিয়া হো হো শব্দে হাসিতে লাগিল।

 কুবলয়াশ্ব সেই মুনিবেশধারী দুষ্ট দানবের আশ্রম হইতে ফিরিয়া আসিলে সকলে কিরূপ আশ্চর্য আর আহ্লাদিত হইল, তাহা বুঝিতেই পার। কিন্তু মদালসার মৃত্যুর কথা শুনিয়া কুবলয়াশ্বের প্রাণে বড়ই কষ্ট হইল। তিনি সেই দুঃখ ভুলিবার জন্য বন্ধুদিগের সহিত মিশিয়া নানারূপ আমোদ-প্রমোদে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

 এই সময়ে নাগরাজ অশ্বতরের দুইটি পুত্র ব্রাহ্মণের বেশে তাঁহার সঙ্গে আমোদ-প্রমোদ করিতে আসিতেন! ইঁহাদের কথাবার্তা তাহার বড় ভালো লাগিত। এইরূপে তাঁহাদের সহিত কুবলাশ্বের এমনি বন্ধুত্ব হইয়া গেল যে পরস্পরকে ছাড়িয়া থাকিতে আর তাঁহাদের কিছুতেই ভালো লাগিত না। নাগপুত্রেরা সমস্ত দিন কুবলয়াশ্বের নিকটে কাটাইয়া রাত্রে গৃহে যাইতে বড়ই কষ্ট বোধ করিতেন, আর কোনোপ্রকারে রাত্রিটি কাটাইয়া প্রভাত হইবামাত্রই পুনরায় কুবলয়াশ্বের নিকট চলিয়া আসিতেন।

 একদিন নাগরাজ অশ্বতর তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, এখন তো আর তোমাদিগকে দিনের বেলায় পাতালে দেখিতে পাইনা, রাত্রিটি কোনোমতে এখানে কাটাইয়া, প্রভাত হইতেই তোমার পৃথিবীতে চলিয়া যাও। ঐ স্থানটার প্রতি তোমাদের এত অনুরাগ কেমন করিয়া হইল?”

 নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, আমরা মহারাজ শত্রুজিতের পুত্র ঋতধ্বজকে বড়ই ভালোবাসি; তাঁহাকে না দেখিয়া থাকিতে আমাদের নিতান্ত কষ্ট হয়। তাই প্রভাতে উঠিয়া প্রত্যহ তাঁহার নিকট চলিয়া যাই। বাবা, এমন সুন্দর, এমন সরল, এমন ধার্মিক, এমন মিষ্টভাষী লোক আর এ জগতে নাই!”

 এ কথায় নাগরাজ বলিলেন, “বাছা, এমন মহৎ লোকের সহিত তোমাদের বন্ধুত্ব হইয়াছে, আর তাঁহার নিকটে তোমরা এত সুখ পাইতেছ, তোমরা তাঁহার সুখের জন্য কি কিছু করিয়াছ?”

 নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, তাঁহার তো কোনো বস্তুরই অভাব নাই এমন মহৎ লোকের যোগ্য কি আছে, যাহা দ্বারা তাঁহাকে সুখী করিতে পারি? তাঁহার কোনো কষ্ট দূর করিতে পারিলে আমরা নিশ্চয় করিতাম। তাঁহার স্ত্রী মদালসার মৃত্যুই তাহার একমাত্র কষ্টের কারণ। সেই মদালসাকে আমরা কোথা হইতে আনিয়া দিব?”

 কিন্তু, এ কাজটি যতই কঠিন হউক না কেন, ইহা যে একেবারেই অসাধ্য, নাগরাজ তাহা মনে করিলেন না। তিনি অবিলম্বে হিমালয় পর্বতের প্লক্ষাবতরণ নামক তীর্থে গিয়া কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে তপস্যা এমনই চমৎকার হইয়াছিল, আর তখন যে নাগরাজ সরস্বতীর স্তব করিয়াছিলেন, তাহা সরস্বতীর এত ভালো লাগিয়াছিল যে, তিনি আর সেখানে না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না!

 সরস্বতী আসিয়া বলিলেন, “হে অশ্বতর! আমি তোমাকে বর দান করিব;বল তোমার কি লইতে ইচ্ছা হয়।”

 অশ্বতর অমনি করজোড়ে বলিলেন, “মা, যদি কৃপা হইয়া থাকে, তবে আমাকে আর আমার ভাই কম্বলকে সংগীতে অসাধারণ পণ্ডিত করিয়া দিন!”

 একথায় সরস্বতী ‘তথাস্তু’ বলিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলে অশ্বতর আর কম্বল দুভাই তৎক্ষণাৎ সংগীত শক্তি লাভ করত অপরূপ তান লয় সহকারে বীণা বাজাইয়া মহাদেবের স্তবগান আরম্ভ করিলেন। অনেকদিন এইরূপ সংগীত আর স্তবের পর, মহাদেবকেও তুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে বর দিতে আসিতে হইল। তখন দুই ভাই তাঁহার পদতলে পড়িয়া এই বর প্রার্থনা করিলেন, “কুবলয়াশ্বের স্ত্রী মদালসা যেমন বয়সে, যেমন বেশে, যেমন শরীরে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন, অবিকল সেই মূর্তিতে, পূর্বজন্মের সকল কথা স্মরণে রাখিয়া, পুনরায় অশ্বতরের গৃহে জন্মলাভ করুন।”

 মহাদেব কহিলেন, “তাহাই হউক। অশ্বতর শ্রাদ্ধ করিতে বসিলে তাঁহার মধ্যম ফণা হইতে মদালসা অবিকল তাঁহার পূর্বের শরীর লইয়া বাহির হইবেন।”  কি আনন্দের কথা হইল! ইহার পর দুই ভাই পাতালে চলিয়া আসিতে আর তিলমাত্রও বিলম্ব করিলেন না। সেখানে আসিয়া অশ্বতর একটি নির্জন স্থানে চুপিচুপি শ্রাদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে, মহাদেবের কথামতো মদালসা, তাঁহার মধ্যম ফণা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। অবিকল সেই মদালসা কিছুমাত্র প্রভেদ নাই, যেন দুদিনের জন্য কুবলয়াশ্বের নিকট হইতে পাতালে বেড়াইতে আসিয়াছেন। এ ব্যাপারে কেবল অশ্বতরই উপস্থিত ছিলেন, আর কেহ ইহা দেখিলও না, এ বিষয়ে কোনো কথা জানিতেও পারিল না।

 তখন নাগরাজ কয়েকটি বুদ্ধিমতী, মিষ্টভাষিণী সখী সঙ্গে দিয়া মদালসাকে একটি সুন্দর ঘরে লুকাইয়া রাখিলেন।

 তারপর সন্ধ্যাকালে নাগপুত্রেরা দুভাই কুবলয়াশ্বের নিকট হইতে ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহারাও অবশ্য এ ব্যাপারের কিছুই জানেন না। নাগরাজ অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিনও তাঁহাদের সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া কহিলেন, “বৎসগণ, সেই রাজপুত্রকে একদিন আমার নিকট আনিলে না?”

 এ কথায় কুবলয়াশ্ব সম্মত হইলে তিনজনে মিলিয়া তখনই পাতালে যাত্রা করিলেন। কুবলয়াশ্ব কিন্তু জানেন না যে তাহাকে পাতালে যাইতে হইবে বা তাঁহার বন্ধুগণ নাগপুত্র। তিনি জানেন, উঁহারা ব্রাহ্মণকুমার। গোমতী নদীতে আসিয়া নাগপুত্রেরা তাহার জলে নামিতে গেলেন; কুবলয়াশ্ব ভাবিলেন, গোমতীর পরপারে ব্রাহ্মণকুমারদের বাড়ি। এমন সময় নাগপুত্রেরা হঠাৎ তাঁহাকে লইয়া পাতালে প্রবেশ করিলেন। ইহাতে কুবলয়াশ্ব ভয় পাইলেন না, কেননা, সে স্থান তাঁহার দেখিতে বাকি নাই। যাহা হউক, সেবারে তিনি দানবের বাড়িই দেখিয়াছিলেন, এবারে সাপের দেশটিও তাঁহার নিকট যারপরনাই আশ্চর্য এবং সুন্দর বোধ হইল। তাঁহার বন্ধুদ্বয়ও ততক্ষণে ব্রাহ্মণের বেশ ছাড়িয়া নিজের রূপ ধারণ করিয়াছেন। সে রূপ যে ঠিক কি প্রকার, তাহা আমি বলিতে পারি না। সে-সকল সাপের ফণার কথা লেখা আছে স্বস্তিক চিহ্ন[১] এবং মণিরও উল্লেখ দেখা যায়। অথচ মানুষের মতো তাহাদের হাত পা, বেশভুষা, কানে কুণ্ডল, গলায় হার!

 যাহা হউক, নাগপুত্রেরা কুবলয়াশ্বকে অবিলম্বেই তাঁহাদের পিতার নিকট নিয়া উপস্থিত করিলেন, সেখানে সেরূপ অবস্থায় যেমন কথাবার্তা, প্রণাম, আশীর্বাদাদির প্রথা আছে, সকলই হইয়া গেল। এত পথ চলিয়া আসাতে সকলই ক্লান্ত, সুতরাং অতঃপর স্নানাহারপূর্বক সুস্থ হওয়া প্রথম কাজ!

 আহারান্তে বিশ্রামের পর, নাগরাজ আর কুবলয়াশ্বের অনেক কথাবার্তা হইল।

 শেষে নাগরাজ বলিলেন, “বাছা, তুমি আমার পুত্রগণের বন্ধু, সুতরাং আমার পুত্রেরই তুল্য। আমারও তোমার প্রতি অতিশয় স্নেহ হইয়াছে। আমার বড় ইচ্ছা হয় যে, আমার পুত্রেরা যেমন আমার নিকট যাহা ইচ্ছা চাহিয়া লয়, তুমিও সেইরূপ কিছু চাহিয়া লও।”

 কুবলয়াশ্ব বলিলেন, “আপনার আশীর্বাদে আমার কোনো বস্তুরই অভাব নাই, সুতরাং আমি কি চাহিব? আমি যে আপনাকে দেখিলাম, আপনার পায়ের ধূলা পাইলাম, ইহার উপর আর আমার কিছুই চাহিবার নাই।”

 অশ্বতর কহিলেন, “বাবা, তোমার মনে কি কোনো কষ্ট আছে? তাহার কথাই না হয় আমাকে বল, আমি সাধ্য মতো তাহা নিবারণের চেষ্টা করিব।”

 এ কথায় নাগপুত্রেরা বলিলেন, “মদালসার মৃত্যুতে ইঁহার বড়ই কষ্ট হইয়াছে, কিন্তু তাহা তো আর দূর হইবার নহে!”

 অশ্বতর বলিলেন, “অবশ্য মরা মানুষকে আর কি করিয়া বাঁচানো যাইবে? তবে মন্ত্রবলে তাহারও মায়ামূর্তি আনিয়া দেখাইতে পারি।”

 ইহা শুনিয়া কুবলয়াশ্ব নিতান্ত ব্যস্তভাবে বলিলেন, “যদি তাহা সম্ভব হয়, তবে দয়া করিয়া একবার তাহাই দেখান।”

 অশ্বতর বলিলেন, “এই কথা? আচ্ছা, তবে দেখাইতেছি। কিন্তু মনে রাখিও, ইহা মায়া!”

 তারপর অশ্বতর খুব গম্ভীরভাবে বসিয়া বিড়বিড় করিতে লাগিলেন, যেন কতই মন্ত্রতন্ত্র আওড়াইতেছেন। ততক্ষণে তাহার ইঙ্গিত অনুসারে মদালসাকে সেখানে আনিয়া উপস্থিত করা হইল। সকলে ভাবিল, মন্ত্রের কি জোর! কুবলয়াশ্বও জানেন, উহা মন্ত্রেরই কাজ, মায়ার মূর্তি। তথাপি তাঁহার এত আনন্দ হইল যে তাহা আর বলিয়া শেষ করা যায় না।

 তারপর যখন অশ্বতর বলিলেন যে, উহা মায়া নহে বাস্তবিকই মদালসা, তখন না জানি ব্যাপারখানা কিরূপ হইয়াছিল!

 কুবলয়াশ্ব পাতালেই মদালসাকে পাইয়াছিলেন, এখন সেই পাতালেই তাহাকে আবার পাইয়া মহানন্দে তাহাকে লইয়া গৃহে ফিরিলেন। সেখানে অবশ্য ইহা লইয়া খুবই আনন্দ আর উৎসবাদি হইল।

[১. সাপের ফণায় যে চক্র থাকে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *