কুপমন্ডুক
১৬ই ডিসেম্বর
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নমাস যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিল বাংলাদেশ, এক নদী রক্ত পেরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বেশ রোমাঞ্চকর বটে। ৪৪ বছর আগের কথা। মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা।
ভারত ভাগ করা হয়েছিল কারণ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা নাকি সংখ্যালঘু মুসলমানদের ঠিক সহ্য করতে পারে না, এই সমস্যার সমাধান হলো, পাকিস্তান নামের একটি দেশ বানিয়ে ফেলা, যেখানে মুসলমানরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারে। ভারত ভাগ হয়ে অবশ্য লাভ কিছু হয়নি। মুসলমানরাই মুসলমানদের অত্যাচার করতে শুরু করলো। বাঙালি মুসলমানের ওপর অবাঙালি মুসলমান ঝাঁপিয়ে পড়লো। শেষ অবধি আবারও দুটুকরো হলো ভূখণ্ড।
কথা ছিল বাংলাদেশ নামের নতুন দেশটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হবে, ধর্মনিরপেক্ষ হবে, গণতান্ত্রিক হবে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান সবাই সুখে শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু সে আর হচ্ছে কই! দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পরই শুরু হয়ে গেছে অশান্তি। দেশটা এখন আক্ষরিক অর্থে ভাগ না হলেও আদর্শের কারণে ভাগ হয়ে গেছে, এক দিকে আছে মুসলমান মৌলবাদী-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, আরেক দিকে আছে ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থী মানুষ। দুই দলে লড়াই হচ্ছে। একে বাংলাদেশ আর বাংলাস্তানের লড়াইও বলা চলে। বাংলাস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র। তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মতো অস্ত্র হাতে ঘন ঘন ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর, তাদের নির্বাচারে হত্যা করে, যে হত্যার কোনও বিচার হয় না।
অধিকাংশ ভারতীয় দাবি করে একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে ভারত জিতেছে। বেচারা বাঙালি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তবে ও দিয়ে যুদ্ধে জেতা হতো না। সাততাড়াতাড়ি বাংলাদেশ নামের একটি দেশ জন্ম নিয়েছে বটে, জন্ম নিয়েই স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দ উচচারণ করতে শিখেছে বটে, তবে এগুলোর অর্থ এখনও দেশটি জানে না। যেদিন জানবে, যেদিন বিশ্বাস করবে, চর্চা করবে এগুলোর, সেদিন স্মৃতিসৌধে পতাকা ওড়ালে তাকে বিদঘুঁটে দেখাবে না। আমি বিজয় দিবস পালন করি না, কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখতে পাই না। পাকিস্তানেও মুক্তচিন্তকদের ওপর নির্যাতন চলে, বাংলাদেশেও তাই। কেউ মানুক আর নামানুক, আমি মনে করি, বিজয় দিবস পালন করার যোগ্যতা বাংলাদেশ সেদিনই সত্যিকার অর্জন করবে যেদিন দেশের মুক্তচিন্তকদের খুন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে এবং নির্বাসিত সব মুক্তচিন্তককে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারবে। তার আগ অবধি বিজয় দিবসের উৎযাপন নিতান্তই ন্যাকামো ছাড়া কিছু নয়।
ন্যাকামোই চলছে অনেকগুলো বছর। লোক দেখানো বিজয় দিবস। লোক দেখানো একুশে ফেব্রুয়ারি। এসব আর কতদিন চলবে! আত্মা বলে যদি কিছু সত্যিকার থাকতো, তাহলে ওই শহিদদের আত্মা কষ্ট পেতো, ওই মৃত মৃক্তিযোদ্ধাদের আত্মা কষ্ট পেতো।
আত্মায় আমার বিশ্বাস নেই, ধর্মে আমার বিশ্বাস নেই। আমার মানুষে বিশ্বাস, ভালো কাজে, ভালো চিন্তায় বিশ্বাস। আমার প্রাণে বিশ্বাস, নিষ্ঠায় বিশ্বাস। সাম্যে, সমতায় আর সমানাধিকারে বিশ্বাস। আমার কি তবে অধিকার নেই বাংলাদেশে বাস করার? আজ একুশ বছর আমি নির্বাসিত জীবন যাপন করছি। না, স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে। দেশ ত্যাগ করতে আমাকে বাধ্য করেছে দেশের সরকার। দেশের দরজাও এখন আমার জন্য বন্ধ। আমি কি কাউকে খুন করেছিলাম? কারও কিছু লুঠ করেছিলাম। আমি ছিলাম ডাক্তার এবং লেখক। ডাক্তার এবং লেখক হিসেবে মানুষের সেবা করেছি। দেশ এবং দশের মঙ্গলের জন্য পরিশ্রম করেছি, মানুষ যেন মানুষ হয়, তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়, সে কারণে নিরলস লিখেছি। আমার এই ত্যাগের পুরস্কার আমাকে এখন ভোগ করত হচ্ছে। হ্যাঁ একুশ বছর আমি নির্বাসিত। একুশ বছরে দেশের সংজ্ঞা আমার কাছে পাল্টে গেছে। দেশ বলতে এখন আমি মানুষ বুঝি। যে মানুষ ভালোবাসে, যে মানুষ সবার মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে, ধর্ম এবং কুসংস্কার থেকে যে মানুষ মুক্ত, সে মানুষই আমার স্বদেশ।
পৃথিবীর মানচিত্র এঁকেছেন মূলত রাজনীতিকরা। আমরা যদি মানচিত্র আঁকার অধিকার পেতাম, তাহলে মানচিত্রটা অন্যরকম হতো। ধর্মের কারণে মানচিত্রের অদল বদল হতো না। ধর্মের কারণে দেশ ভাগ হওয়ার মতো গ্লানি আর কিছুতে নেই। যুদ্ধ করা, দেশ ভাগ করা, এসব এখন আর উৎ্যাপনেরও হয়তো বিষয় নয়। পৃথিবীটা ক্রমশ কি ছোট হয়ে আসছে না? মানুষ আন্তর্জাতিক ভাষায় কথা বলতে শিখছে, আন্তর্জাতিক পোশাক পরতে শিখছে, খাবার খেতে শিখছে। ভাষা ও সংস্কৃতির কারণেও নিজেদের আলাদা করার কোনও কারণ আর নেই। রাজনীতিকরা যে ভাগটা করেছে নিজেদের স্বার্থে, সেই ভাগটা আমাদের এখন মুছে দেওয়ার পালা, কাঁটাতার সরিয়ে দেওয়ার পালা, দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার পালা। দেশগুলোকে না ভেঙে বরং এক করে দেওয়ার সময় এখন।
হিংসে, দ্বেষ, খুনোখুনির ইচ্ছেটা মানুষের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। একে আমরা যতটা পারি শান্ত রাখি। একে পুরোপুরি শান্ত রাখতে পারলেই আমরা এক করতে পারবো পৃথিবী। এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ আর আমেরিকার ভৌগোলিক দুরত্ব যা আছে তা থাকবেই, কিন্তু মানুষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে যাবে। ধনী আর দরিদ্রের ফারাকটাও কমে কমে শূন্যের দিকে যাবে। ভাষা আর সংস্কৃতি ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, অপশিক্ষা, শিক্ষাকে সবাই মিলেই দুর করতে হবে। এগুলো যেন আবার কারও সংস্কৃতির অংশ না হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর এক কোণে সন্ত্রাস জন্ম নিলে আরেক কোণে তা পাচার হবেই। ভালো জিনিস যেমন বিশ্বময় ছড়িয়ে যায়, খারাপ জিনিসও ছড়িয়ে যায়। তথ্য আর প্রযুক্তির যুগ এ যুগ। এই তথ্য আর প্রযুক্তিই পৃথিবীকে এক করার জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে একাত্তরে। যুদ্ধটি শিয়া-সুন্নির যুদ্ধ নয়, সুন্নি-আহমদিয়া বা কাদিয়ানির যুদ্ধ নয়, ও ছিল সুন্নিতে সুন্নিতে যুদ্ধ। এমনটি খুব বেশি দেখা যায় না। যে ভাষা আর সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য একাত্তরে বীর বাঙালির অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান হয়েও সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলো, সেই ভাষারই লেখক আমি, সেই সেলার সংস্কৃতির পক্ষেই আমি কলম ধরেছিলাম। আজ আমার জীবন বিপন্ন। শাসকরা কতটা নির্বোধ হলে, কতটা স্বৈরাচারী হলে, কতটা দেশদ্রোহী হলে, কতটা মানবাধিকারবিরোধী হলে, কতটা গণতন্ত্রবিদ্বেষী হলে, কতটা একনায়কতান্ত্রিক হলে নারীর অধিকারের পক্ষে এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে যে মানুষটি অনড় দাঁড়িয়েছিল, তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়, আর আলিঙ্গন করে মৌলবাদী সন্ত্রাসী অপশক্তিকে। একুশ বছরেও সরকার নিজেকে শোধরায়নি। তাই এখনও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের এক এক করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশকে দেশ বলতে আজকাল আমার বাধে। দেশ মানে আমি নিরাপত্তা বুঝি। যে মাটিতে মানুষের নিরাপত্তা নেই, যে মাটিতে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, সেই মাটিকে আমি আমার দেশ বলতে চাই না। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া সহজ, দেশ হওয়া সহজ নয়। ঠিক যেমন মানুষের মতো দেখতে হওয়া সহজ, মানুষ হওয়া সহজ নয়।