কুন্তী সংবাদ
তখন আমি বিহারের সাঁওতাল পরগনার কোনও এক জায়গায় বেড়াবার উপলক্ষে অবস্থান করছিলাম। স্বাস্থ্যান্বেষণের কোনও ব্যাপার ছিল না। যকৃত প্লীহা ফুসফুস ইত্যাদি বেশ ভাল ভাবেই তাদের কাজ করছিল। ক্ষুধামান্দ্য অম্ল অজীর্ণ উপসর্গ সকল আমাকে কোনওরকমেই স্পর্শ করেনি। আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল, সাঁওতাল পরগনায় প্রকৃতি উপভোগ। রক্তমৃত্তিকা, খোয়াই, ছোটখাটো পাহাড়, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, শালের বন, তালের জটলা এ সব দেখা; এই প্রকৃতির মধ্যে ঘোরা ফেরা। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, সেখানকার জলবায়ুর একটি বিশেষ গুণ, ক্ষুধাটা বেড়ে গিয়েছিল, এবং বেশি খেয়েও হজম হত। আমি সাধ্যমতো আহারে বিশ্বাসী এবং অভ্যস্ত। তথাপি প্রকৃতির হাত থেকে রেহাই পাইনি। ক্ষুধার প্রাবল্যটা প্রকৃতই বেড়ে গিয়েছিল।
বিহারের সাঁওতাল পরগনায় আমি যেখানে ছিলাম, সেটা একটা ছোটখাটো শহর। সে শহরও, নিতান্তই রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরেই। প্রকৃতপক্ষে, শহর শব্দটাই বোধহয় ব্যবহার করা চলে না। কিছু দোকানপাট, ছোট একটি বাজার, যে বাজারে আনাজপাতির বিশেষ অভাব। প্রধানত মুরগি, ডিম, পায়রা এ সবই বেশি। চাল-ডাল-আটা ইত্যাদি মুদি দোকানেই পাওয়া যেত। মাছও কিছু কিছু আসত। বাঙালি চেঞ্জারদের পক্ষে তাতেই কুলিয়ে যেত। আমার সবথেকে ভাল লাগত ওখানকার স্থানীয় দই। যদিও বাঙালিদের সেই বিহারি দইয়ের স্বাদ মোটেই ভাল লাগত না। কারণ সে দই মিষ্টি না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই গোরুর দুধের না হয়ে, মহিষের দুধের হত। হাঁড়ি উপুড় করে ধরলেও, সেই দই পাথরের মতো হাঁড়িতে আটকে থাকত। হাত দিয়ে খেলে রীতিমতো মাখন চটচট করত। তবে স্টেশনের সামনের সেই ছোট বাজারটুকু বাদ দিলেও সেখান থেকে মাইল তিনেক দূরে সপ্তাহে দুদিন হাট হত। কাছাকাছি দশ বারো মাইলের মধ্যে অধিবাসীরা সকলে সেখানেই হাটে যেত, আমরাও যেতাম।
যাই হোক, হাটবাজার খাদ্য-স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, প্রসঙ্গক্রমে কথাগুলো এসে গেল। আমি সেখানে অলস ভাবে বেরিয়ে বেড়াতাম। আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। যে বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়ি দেখাশোনা করত যে লোকটি, সে একজন মাঝবয়সি সাঁওতাল হলেও, বিহারি বলেই তাকে ভুল হত। সে সেই অঞ্চলের বিহারিদের দেহাতি ভাষাতেই কথা বলত, এবং তার চালচলনের মধ্যে কোথাও সাঁওতাল আদিবাসীর সন্ধান পাওয়া যেত না। সেই আমাকে রান্না করে দিত। এবং পরিচর্যা বলতে যা বোঝায় তা করত।
স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরে, একটি বিশাল কাঁকর-পাথর বিছানো প্রান্তরের দুপাশে দুটো গ্রাম আছে। বিহারি অধিবাসীদের গ্রাম। গ্রাম খুব বড় না। দুটো গ্রামই ছোট, অধিবাসীরা সকলেই প্রায় কৃষিজীবী পশুপালক। দু-চার ঘর গোয়ালাও আছে। আর আশেপাশে সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘর-গৃহস্থালি রয়েছে।
অনেক দিনই সেই গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেহাতি ছেলেমেয়েদের গোরু-মহিষ চরাতে দেখেছি। দেখে ভাল লাগত, যখন চোখে পড়ত, ছেলেমেয়েরা বিশাল কালো মহিষের পিঠে চেপে ছোট হাঁটু ডোবানো নদী পার হয়ে যেত। অনেক সময় দেখতাম, পশুরা মাঠে চরছে, রাখাল ছেলেমেয়েরা খাবার খাচ্ছে বা গাছতলায় মুখের ওপর গামছা চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। কেবল ছোটরাই নয়, কখনও কখনও বড়দেরও দেখতে পেয়েছি। বড়দের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
সেখান থেকে ফিরে আসার কয়েক দিন আগে, পড়ন্ত বেলায়, সেই গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের ভিতরে কখনও বড় একটা প্রবেশ করতাম না। একদিন গানের শব্দ পেয়ে গিয়েছিলাম। যে দিনের কথা বলছি, সেই দিন, প্রান্তরের ডান দিকের গ্রামে একটা জটলা দেখতে পেয়েছিলাম, এবং মেয়ে-পুরুষদের চড়া গলায় কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম। তার জন্য আমার কোনও কৌতূহল ছিল না। আমি একটি মেয়ের আর্তনাদ শুনে, কৌতূহলিত এবং আকৃষ্ট হয়ে, গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম।
জটলার কাছে গিয়ে দেখলাম, মেয়ে-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-যুবা, অনেকেই সেখানে রয়েছে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা বসে। বয়স্কা মেয়েদের কেউ হয়তো তার কোলের শিশুটিকে বুকজোড়া খুলেই খেতে দিয়েছে, যেন ক্ষুধার্ত একটি বাছুর সবুজ কচি ঘাসের বুকে মুখ ডুবিয়ে আছে, এবং সেই সঙ্গেই মা চিৎকার করে কথা বলে চলেছে। তাতে শিশুটির খাবার যেমন কোনও ব্যাঘাত ঘটছে না, তেমনি মায়ের কথা ও চিৎকারেও কোনও বাধা ঘটছে না। পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ হুঁকো হাতে। মাঝে মাঝে টানছে, উত্তেজিত ভাবে চিৎকার করে কথা বলছে। কেউ বা শুকনো তামাক পাতার সঙ্গে চুন মিশিয়ে বাঁ হাতের তালুতে রেখে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ঘসছে। কেউ ঘাস-পাতার দড়ি পাকাচ্ছে বা দা দিয়ে তামাক পাতা কাটছে। কিন্তু কথা ও চিৎকার সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। সকলেই যে কাজ করছে, তা নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে, যারা কাজ করছে তারাও রীতিমতো উত্তেজিত এবং এই আসরে অংশ নিচ্ছে।
জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে, গ্রামের বারোয়ারি তলার মতো, যেখানে গ্রামের লোকেরা মিলিত হয়, পঞ্চায়েত বসে, নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, বিচার করে, এবং রায় দেয়। এদের বোধহয় সেই রকম কোনও পঞ্চায়েতের আসরই বসেছে, কারণ এদের কথার মধ্যে সরপঞ্চ কথাটা কয়েকবারই আমি শুনতে পেলাম।
আমরা বাঙালিরা সাধারণ ভাবে হিন্দি বলতে যা জানি, এদের কথাবার্তা ঠিক সেরকম না। একে ঠিক কী ধরনের বুলি বলে, আমি জানি না। বিহারের মৈথিলি বুলি একরকম, যা আমরা বাঙালিরা সাধারণত বুঝে উঠতে পারি না। কারণ সে-মৈথিলি বুলি, শিক্ষিত বাঙালির জানা বিদ্যাপতির কবিতার ভাষা না। আমি এখন যাদের কথা বলছি, এদের ভাষা আবার অন্যরকম, যা আমি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না। তবে কতগুলো ইতর গালিগালাজের ভাষা বোধহয় এরকমই হয়। যেমন ছিনার অর্থাৎ বাংলায় যাকে ছিনাল বলা হয়, এখানে সে বিশেষণটি কয়েকবারই শুনতে পেয়েছি। কয়েকটি ক্রিয়াপদ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ইতর উচ্চারণ, যে সব কথা লিখে প্রকাশ করা যায় না, তাও শুনতে পাচ্ছি।
যাকে উদ্দেশ করে এ সব গালিগালাজ এবং ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত ইতরভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে, সে একটা মেয়ে। তার বয়স এগারো বারোর বেশি না, জানি না, তার চেয়েও কম কিনা। মেয়েটির কালো চোখ, একটু বোঁচা বোঁচা নাক, কিন্তু কটা কটা মুখোনি বেশ মিষ্টি, বটের পাতার মতো গড়ন। ঠোঁট দুটি রাঙা। মাথার চুলে বেশ কিছু দিন তেল পড়েনি, জট পাকানোর মতো দেখাচ্ছে। শরীরের গঠন ছিপছিপে, পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠার অবকাশ যেন এখনও হয়নি, অথচ পূর্ণতার একটি স্পর্শ যেন তার শরীরে লেগেছে।
মেয়েটির দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা। সামনে ছড়ানো ধুলো মাখা পা দুটিও বাঁধা। ময়লা একটা কাপড় আর জামা তার গায়ে। সে কাঁদছে মাথা নিচু করে। তার মুখে বা হাঁটু অবধি তোলা কাপড়ের নীচে দেখলেই বোঝা যায়, তাকে প্রহার করা হয়েছে।
গোটা ছবিটা নিষ্ঠুর আর করুণ। করুণতর আরও এই কারণে, মেয়েটির বয়সি অন্যান্য মেয়েরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নির্দয় ঘৃণা প্রজ্বলিত চোখে। কেউ বা বিদ্রুপে শাণিত হাসি নিয়ে। নিজেদের মধ্যে তারা কী সব বলাবলিও করছে, কিন্তু তা একান্ত নিজেদের সমবয়সিদের মধ্যে। অন্যেরা সেকথা শুনতে পাচ্ছে না।
কী এমন ব্যাপার ঘটতে পারে, বা মেয়েটি এমন কী অপরাধ করতে পারে, যার জন্য গোটা গ্রামের মানুষ একত্র হয়ে এরকম শাস্তি দিচ্ছে! ও কি চুরি করেছে? ও কি কারও পালিত পশুকে বিষ খাইয়েছে, অথবা দুধের বাটে তুক করেছে? এ ধরনের দু-একটি ঘটনার কথা শুনেছি, এ সব অঞ্চলে নাকি ঘটে এবং সকলেই বিশ্বাসও করে। কেন না, ডাইনিতন্ত্রটা এখানে খুবই চলে, ডাইনি বিরোধী ঘৃণাও প্রচণ্ড। কিন্তু এরকম একটি মেয়ে কি ডাইনিতন্ত্র জানে? ডাইনিরা তো একটু বয়স্ক হয় বলেই জানি।
অবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলাম। কিন্তু সকলে আমার দিকে মুখ তুলে এমন ভাবে দেখছে, আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন মনে হল না। এটা গ্রামের মানুষদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। আমি একজন ভিনদেশি অপরিচিত, ভিন্ন সমাজের মানুষ। স্বভাবতই তারা বিরক্ত হতে পারে। তাই আমি মনে মনে বিশেষ কৌতূহল নিয়ে, সেখান থেকে সরে এসে, চলে যাবার উদ্যোগ করলাম। এই সময়ে শুনতে পেলাম, বাবুজি!
আমি ফিরে তাকালাম। দেখলাম, মাথায় চাদর জড়ানো একটি প্রায় বৃদ্ধালোক আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কালো মুখে, সাদা খোঁচাখোঁচা দাড়ি। লোকটিকে দেখেই চিনতে পারলাম। এ আমাকে রোজ দই দেয়। তাকে আমি দহিবালা বলে ডাকি।
জিজ্ঞেস করলাম, কেয়া দহিবালা?
দহিলার উচ্চারিত দেহাতি ভাষা আমার পক্ষে বলা বা লেখা সম্ভব নয়, তাই তার কথা আমি বাংলাতেই লিখছি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, বাবুজি, আপনি চলে যাচ্ছেন?
বললাম, হ্যাঁ। কেন না, আমার মনে হচ্ছে এটা তোমাদের গ্রামের কোনও একটা ব্যাপার, আমার এখানে থাকা উচিত না।
দহিবালা বলল, কথাটা বাবু ঠিকই বলেছেন। আজ সকাল থেকেই আমাদের এখানে গ্রামের পঞ্চায়েত বসেছে, একটা বিচার চলেছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সকাল থেকেই?
হ্যাঁ, বাবুজি, সকাল থেকেই।
কিন্তু তুমি তো আজ সকালে আমাকে দই বিক্রি করতে গেছলে।
তা গেছলাম। কাজকর্ম তো সব বন্ধ করে দেওয়া যায় না। যার যা কাজ তাকে তা করতেই হবে, কারণ পঞ্চায়েত করলে তো আর পেট ভরবে না! কিন্তু সমাজ-ঘরের ইজ্জত রক্ষা করতে হলে পঞ্চায়েতও বসাতে হবে। তাই পঞ্চায়েতের ফাঁকে ফাঁকে কাজকর্মও করে নিতে হয়।
এ সব তথ্য আমার জানা ছিল না। তা ছাড়া, এমনকী ব্যাপার ঘটতে পারে যে তার জন্য সকাল থেকে পঞ্চায়েত বসেছে, এবং এ পড়ন্ত বেলাতেও তা শেষ হল না? মামলার আসামি যাকে দেখতে পাচ্ছি, সে তো নিতান্তই একটি বালিকা। এমনকী অপরাধ সে করতে পারে, একটা গোটা দিনেও যার বিচার করা গেল না?
আমি দহিলাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার নিশ্চয়ই খুব গুরুতর?
দহিবালার ভাষা বাংলায় অনুবাদ করলে, এইরকম হয়, অতি ভয়ংকর ব্যাপার, কারণ ব্যাপারটার মূল এখনও বোঝাই যাচ্ছে না।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যদি একটা ব্যাপারের মূলই না বোঝা যায়, তা হলে তো মারাত্মক ব্যাপারই হবে। আমার কাছে ঘটনাটা তো রীতিমতো রহস্যময় বলেই ঠেকল।
দহিবালা আবার বলল, এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না, ব্যাপারটা যা ঘটেছে, তা মানুষের কাজ কিনা; অথবা কোনও প্রেতাত্মার, যারা বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। যদি প্রেতাত্মার কাজ হয়, তবে বুঝতে হবে গ্রামের ওপর অপদেবতার নজর পড়েছে, দেবতার অভিশাপ লেগেছে। তা হলে গ্রামে মড়ক লাগবে। ফসল ফলবে না। একটা তছনছ কাণ্ড হয়ে যাবে। পঞ্চায়েতের মুখিয়ার মনে সেই রকম একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর অর্ধ শতকে, কথাগুলো শুনে খুবই অবাক লাগে। এখনও যে মানুষ এ সব বিশ্বাস করে, ভাবা যায় না। কিন্তু এই যে আমার সামনে দহিবালা, হাঁটুর ওপরে ময়লা ধুতি, গায়ে সামান্য একটা কাপড়ের জামা, মাথায় জড়ানো চাদর, এবং যে সব নরনারী আমার সামনে বসে আছে, এবং উঁচু-নিচু দিগন্তবিস্তৃত রক্তাভ ভূমি, শ্যামল এবং রুক্ষতায় মিশ্রিত প্রকৃতি, এ সবের মাঝখানে তাদের বিশ্বাসের একটা মূল বা শিকড় আছে বলে মনে হয়। আমার মন দিয়ে যতই অবিশ্বাস করি, এই সব মানুষদের আমি অবিশ্বাসী মিথ্যাচারী ভাবতে পারি না।
কিন্তু আমার অবাক লাগছে। মানুষ বা অপদেবতা এমনকী কাজ করেছে, যে জন্য এরকম ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাতে পারে, এবং বালিকাটির সঙ্গেই বা সে সবের সম্পর্ক কী। এটা তো স্পষ্টই যে, যা-ই ঘটে থাকুক, ওই বালিকাটি হচ্ছে সমস্ত অপরাধের মূলে।
দহিবালা আবার বলল, অবিশ্যি কোনও দেবতার দয়াও হতে পারে। বাবুজি, আমরা আমাদের মানুষের চোখ দিয়ে সবসময়ে দেবতার লীলা বুঝতে পারি না। এখন মোট সমস্যাটা হচ্ছে, কাজটা কে করেছে? দেবতা, অপদেবতা, না মানুষ? এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই বিচার হয়ে যাবে।
রীতিমতো ওদের বিষয়। এমনকী কাজ, যা দেবতা, অপদেবতা বা মানুষ, সকলের দ্বারাই ঘটতে পারে?
দহিবালা হঠাৎ বলল, আপনি বসুন না বাবুজি। আমার কোনও আপত্তি নেই। গ্রামবাসী বা পঞ্চায়েতের লোকেরা আপত্তি করবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
আমার জবাবের আগেই দহিবালা মুখ ফিরিয়ে, গলা চড়িয়ে কী যেন বলে উঠল। সকলেই আমার দিকে ফিরে তাকাল।
দহিবালার বাবুজি শব্দটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি দেখলাম, খাটিয়ার ওপরে তিনজন বসে ছিল। তিনজনেই বুড়ো। তারাই বোধহয় পঞ্চায়েতের তিন প্রধান। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে, নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল। তারপরে দহিলাকে যা বলল, তার মর্মার্থও বুঝতে পারলাম, আমাকে তারা এ আসরে বসতে দিতে সম্মত আছে।
দহিলা আমাকে ডেকে বলল, আসুন বাবুজি।
এবার আমি একটু লজ্জিত হলাম। আমাকে সেই তিন প্রধানের খাটিয়ার এক পাশেই বসতে দেওয়া হল। আমি তাদের কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলাম। তারাও মাথা নত করে, কপালে হাত ঠেকিয়ে আপ্যায়ন করল, এবং একজন বলল, বাবুজি, আমরা ভারী বিপদে পড়েছি। তার জন্য পঞ্চায়েত বসেছে।
আমি চুপচাপ ঘাড় নাড়লাম।
প্রধানদের একজন সকলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, আমাদের এভাবে বসে থাকা চলে না। আমরা এখনও খাঁটি জবাবটা পাইনি।
একটি মাঝবয়সি স্ত্রীলোক হঠাৎ ছিপটি হাতে হাত-পা বাঁধা মেয়েটির কাছে ছুটে গেল এবং ছিপটি দিয়ে সজোরে মেয়েটির শরীরে যত্র তত্র প্রহার করতে লাগল। চিৎকার করে যা বলতে লাগল তা হচ্ছে, তুই এখনও মুখ ফুটে সত্যি কথা বলবি কিনা (গালাগালগুলো লেখা যায় না)। এতগুলো লোকের সামনে তুই এখনও মিথ্যা কথা বলছিস! হয় তুই মুখ খোল, তা না হলে তোকে খুন করে ফেলব।
বলেই ছিপটি দিয়ে আবার সপাং সপাং করে মারতে লাগল। বালিকাটি আর্তনাদ করে উঠল।
এই আর্তনাদ শুনেই আমি এগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই নিষ্ঠুর নারকীয় কাণ্ড আমি আর দেখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন ছিপটির আঘাত আমারই গায়ে লাগছে। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কারোর মুখেই কষ্টের লেশমাত্র নেই। সকলেই চোখমুখ শক্ত করে, ঘৃণার দৃষ্টিতে বালিকাটির দিকে চেয়ে আছে।
একজন চিৎকার করে বলল, এ অপদেবতার কাজ না হয়ে যায় না। তা না হলে হুঁড়ি এতক্ষণে মুখ খুলত।
বালিকাটি কান্নার আর্তনাদের মধ্যে বলে উঠল, আমি তো বলছি, আমি তো সবই বলছি।
আমার পাশ থেকে, তিন প্রধানের একজন চিৎকার করে বলল, হেই মুনিয়ার মা, তুমি থামো।
যে স্ত্রীলোকটি বালিকাটিকে মারতে মারতে নিজেই হাঁপিয়ে পড়েছিল, সে এবার প্রহার থামাল।
প্রধান বলল, বল মুনিয়া, তুই সত্যি কথা বল। আমরা তোর কাছ থেকে সত্যি কথা শুনতে চাইছি।
বোঝা গেল, বালিকার নাম মুনিয়া। এবং প্রহার করছিল ওর মা।
আর একজন প্রধান চেঁচিয়ে বলল, কিন্তু তুই কিছুই জানিস না–এ কথা আমরা শুনতে চাই না।
মুনিয়া তখন প্রহারে অবসন্ন। ওর মাথাটা নুয়ে পড়ে প্রায় হাঁটুর কাছে ঠেকেছে। আঘাতের জায়গাগুলিতে হাত বোলাতে পারছে না বলে, গায়ের পেশি ও চামড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমার মনে হল, সত্যি ওরা মেয়েটাকে খুন করেও ফেলতে পারে। যা-ই ঘটুক, আমার পক্ষে এই পীড়ন বসে দেখা সম্ভব না। অথচ কিছু বলাও অসম্ভব। সে অধিকার আমার নেই, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমার কাছে খাটিয়ার নীচেই দহিবালা বসেছিল। আমি তার দিকে তাকালাম। কিন্তু সে মুনিয়ার দিকে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে ছিল। সকলেই মুনিয়ার দিকে দেখছিল।
মুনিয়া আস্তে আস্তে মুখ তুলল। ওর মুখে হাঁ হয়ে আছে, ওপর পাটির ঝকঝকে দাঁত আর জিভ দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো বোজা, গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আস্তে আস্তে ও ভেজা আরক্ত চোখ মেলে তাকাল, দৃষ্টিতে শূন্যতা। কয়েকবার কিছু বলবার চেষ্টা করেও বলতে পারল না, তারপরে উচ্চারিত হল, পানি…
প্রধানদের একজন বলল, ওকে পানি দাও।
একটি বুড়ি ঝকঝকে ঘটি নিয়ে কাছে গিয়ে মুনিয়ার হাঁ-মুখে জল ঢেলে দিল। মুনিয়া ঢক ঢক করে জল পান করল, গালের কষ বেয়ে কিছু গড়িয়ে পড়ল। মাথা নেড়ে জানাল, আর চায় না। তারপর আর একটু সময় খুঁকে ও বলল, ভইষাঁড়ের মাঠে।
সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠল। আমিও।
মুনিয়া আবার বলল, সেদিন ভঁইষাঁড়ের মাঠে, গাছের তলায় আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম। আমার ভঁইষগোরুরা তখন সেই মাঠে চরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু আমি ঘুমোচ্ছিলাম…।
মুনিয়ার কথা শেষ হবার আগেই, একটা প্রবল হট্টগোল লেগে গেল। সবাই হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে লাগল। সকলের চিৎকার চেঁচামেচি থেকে আমি যা বুঝতে পারলাম, তা হল ভঁইষাঁড়ের মাঠে গাছতলায় মুনিয়ার ঘুমোবার কথা তারা সকাল থেকেই শুনেছে, আর শুনতে চায় না, এবং ঘুমোবার কথা তারা বিশ্বাস করে না।
মুনিয়া চুপ করে দূরের দিকে তাকিয়ে রইল। তিন প্রধানের একজন চেঁচিয়ে বলল, মুনিয়া, তুই ভাল করে মনে করবার চেষ্টা কর। তোকে আমরা প্রথমেই বলেছি, তোর কোনও ভয় নেই। লজ্জা করবারও কোনও কারণ নেই। যা সত্যি, তুই তাই বল।
একটি স্ত্রীলোক, যে তার শিশুকে, নিজের বুকটা মাঠের মতো করে খুলে দিয়ে খাওয়াচ্ছিল, সে বলে উঠল, ওর আবার লজ্জা করবার কী আছে। ওর মতো বেশরম (অশ্লীল গালাগাল) মেয়ে শরমকে চিবিয়ে খেয়েছে। ওর পেট ছিঁড়ে ফেলা উচিত।…।
তারপরে স্ত্রীলোকটি যা বলল, তা হল, মুনিয়ার বিশেষ অঙ্গে লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া উচিত, এবং আরও যে সব ক্রিয়াকর্মের কথা বলল, তা যেমন অশ্লীল, তেমনই নিষ্ঠুর।
দেখলাম, সকলেই সে কথা সমর্থন করল। মুনিয়ার বয়সি মেয়েরা ঘৃণার মধ্যেও হেসে, মুখে হাত চাপা দিল। মনে হল, তারা লজ্জা পেয়েছে।
এই সময়ে, আমার পাশ থেকে দহিলা প্রধানদের উদ্দেশে নিচু গলায় বলে উঠল, প্রধানরা, তোমরা কিন্তু মুনিয়াকে কোনও সময়েই ভাল করে কথা বলতে দিচ্ছ না। ও কথা শুরু করতে না করতেই, সবাই চেঁচামেচি করছে।
এক প্রধান বলল, কিন্তু মুনিয়া যে এক কথাই বারে বারে বলছে।
দহিবালা বলল, তা বলছে, কিন্তু ধৈর্য ধরে পুরো ঘটনাটা শোনাই হচ্ছে না। ও ভঁইষাঁড়ের মাঠে গাছতলায় ঘুমোচ্ছিল, সেই সময়ে ওর ভঁইষগোরুরা মাঠে চরছিল, তখন একজন ওর কাছে আসে, তাকে ও চেনে না…ব্যস। অমনি সবাই এমন চেঁচামেচি হল্লা করছে আর মুনিয়ার বাবা মা মুনিয়াকে পেটাতে শুরু করছে। পুরো ঘটনাটা শোনা হচ্ছে না। তোমরা সবাইকে চুপ করতে বলো। সাচ্চা ঝুটা যা-ই হোক, মুনিয়ার সব কথা শোনা দরকার।
দহিবালার কথাগুলো আমার খুব ভাল লাগল। যা-ই ঘটে থাকুক, (অবিশ্যি ঘটনার মাথামুণ্ডু আমি এখনও কিছুই বুঝিনি) তা পূর্বাপর সকলের শোনা উচিত। তা ছাড়া, আমার আরও মনে হল, দহিবালা প্রধান নয় বটে, কিন্তু তার বুদ্ধিশুদ্ধি বেশ ভাল; এবং তাকে, সকলের মধ্যে হৃদয়বান বলে মনে হল।
দহিবালার প্রস্তাব, প্রধানদের বোধহয় মনে লাগল। তারা নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আলোচনা করতে লাগল।
আমি দহিবালার দিকে তাকালাম। দহিবালা মোটা নিচু স্বরে বলল, মেয়েটার কপাল খারাপ বাবুজি, তা না হলে কেন এমন হবে। বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এখন তাকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হল, মুনিয়ার অপরাধটা কী? সে কী করেছে? কিন্তু তার আগেই, একজন প্রধান গোঁফে হাত বুলিয়ে, চিৎকার করে বলল, আমি সবাইকে চুপ করে থাকতে বলছি। মুনিয়া পুরো ঘটনাটা কী ঘটেছিল, আগে সব বলুক, তারপরে আমরা সত্যি-মিথ্যা যাচাই করে দেখব। খটকা লাগলে, আমরা মুনিয়াকে জিজ্ঞেস করব, তোমরা কেউ কথা বলবে না। আসল কথা কী বেরিয়ে আসে, আগে আমাদের শোনা দরকার।
তারপরে সে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, শোন মুনিয়া, তুই ভয় না করে শরম না করে, সমস্ত ব্যাপারটা বল। একটা কথাও তুই বাদ দিবি না।
মুনিয়া তেমনি দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল। ও ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল, শোনা গেল না। তারপরে আবার গলা তুলে বলল, আমার হাত-পা তোমরা খুলে দাও।
সকলেই অবাক হল মুনিয়ার কথা শুনে। একজন চেঁচিয়ে বলল, দড়ি খুলে দিলেই ও পালিয়ে যাবে।
দহিবালা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তা হলে মুনিয়াকে আমরা বর্শা বিঁধিয়ে মেরে ফেলব। ও আমাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু ও যখন বলছে তখন ওর হাত-পা খুলে দাও।
দহিবালার প্রতি আমি নিজেই কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলাম। তার কথায় যুক্তি ও সহৃদয়তা, দুই-ই আছে। তখন প্রধানদের একজন উঠে গিয়ে মুনিয়ার বাঁধন খুলে দিল। মুনিয়া সেখান থেকে নড়ল না। উঠে বসল না। তার সুন্দর কচি মুখখানা চোখের জলে আর ধুলোয় আর ছিপটির দাগে অদ্ভুত দেখাচ্ছে, তবু এখন তার মুখে যেন একটু স্বস্তি আর আরামের ছাপ ফুটল। সে দুহাত দিয়ে মাথার পিছনে চুল এলো খোঁপায় জড়িয়ে নিল। ময়লা কাপড়টাকে গায়ে ভাল করে গুছিয়ে জড়াল।
তারপরে সামনের দিকে দূরে তাকিয়ে বলল, আমি তাকে চিনি না…আমি তখন ভঁইষাঁড়ের মাঠে, গাছতলায় নিদ যাচ্ছিলাম। আমার ভঁইষগোরুরা মাঠে চরছিল। ঝটসে আমার নি টুটে গেল, আমি দেখলাম, আমার পাশে সে বসে আছে।
একজন প্রধান জিজ্ঞেস করল, সে কে?
মুনিয়া বলল, তাকে আমি চিনি না। তাকে আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। না ভঁইষটাঁড়ে, শামপুরে, না শহরে বাজারে হাটে, না সাত দেবীতলা মেলায়, যেখানে তামাম দুনিয়ার লোক আসে। তাকে আমি কখনও দেখিনি।
আর একজন প্রধান জিজ্ঞেস করল, তার উমর কত?
মুনিয়া বলল, আমি জানি না, আমি মানুষের উমর বুঝি না।
তখন আর একজন প্রধান জিজ্ঞেস করল, সে দেখতে কেমন। সে কি জোয়ান না বুড়ো ছিল?
মুনিয়া এবার একটু ভাবল, কিন্তু সেই দূরে দৃষ্টি রেখে। তারপরে বলল, সে বুড়ো ছিল না। সে খুব বড় জোয়ান ছিল না, তার মাথায় বড় বড় চুল ছিল। তার রং কালো ছিল। সে দেখতে সুন্দর ছিল। তার গায়ে কোনও জামা ছিল না, তার গায়ে চুল ছিল না।…।
মুনিয়া চুপ করল। তার মুখের অভিব্যক্তিতে একটু পরিবর্তন দেখা দিল। বড় বড় চোখে, মুখে যেন একটা স্বপ্নের ঘোর।
একজন প্রধান বলল, কোনও কথা বাদ দিস না মুনিয়া। সব সত্যি কথা বল। সত্যি কথার থেকে বড় ধর্ম কিছু নেই, তাতে কোনও লজ্জা নেই।
আমার মনে হল, মুনিয়া প্রধানের কথা আদপে যেন শুনছেই না। ও আবার বলতে লাগল, আমি যখন চোখ মেলে তার দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আমার ভয় লাগল না। আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম। তারপরে আমি দেখলাম আমার গা খোলা, আমার গায়ে তার হাত রয়েছে। সে কখন এসেছে, আমি কিছুই জানি না। সে আমাকে বলল, ভয় পেও না, আমি তোমাকে ভালবাসি। বলে সে আমার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমার খুব ভাল লাগছিল, মনে হচ্ছিল, সে যেন আমাকে মন্ত্র দিয়ে কেমন করে ফেলছিল। সে আমার পাশে শুয়ে আমার গায়ে হাত দিচ্ছিল। সে শিশুর মতো আমার বুকে মুখ দিচ্ছিল, আমার সারা গায়ে হাত দিয়ে যেন খেলা করছিল।
মুনিয়া আবার থামল। আমার মনে হল, আমি যেন এক অবিশ্বাস্য রূপকথা শুনছি। যদিও সেই রূপকথার মধ্যে, স্পষ্টতই বাস্তবের গূঢ় লক্ষণগুলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।
একজন প্রধান জিজ্ঞেস করল, তখনও তুই তাকে চিনতে পারলি না?
মুনিয়া ঘাড় নেড়ে জানাল না।
প্রধান আবার জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হল না, সে একটা ধূর্ত বদমাইশ? তোর কি তখন মনে হয়নি, সে আর তুই দুজনেই পাপ করছিস?
মুনিয়া স্পষ্টভাবেই বলল, না। সে কী করছিল, আমি কিছুই জানি না। আমার ভাল লাগছিল। তাকেও খুব ভাল লাগছিল। আমি কোনও দিকে তাকাইনি। শুধু তার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম…।
তারপরে মুনিয়া যে ভাবে, যে ভাষায় পরবর্তী ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা দিল, তা মহাভারতের ভাষার থেকেও সরল এবং এত সরল ও গ্রাম্য যে, আমাদের লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকদের শ্রবণ পুড়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, লেখাও অসম্ভব। মোট কথা, সে একটি পরিপূর্ণ রমণের বর্ণনা দিল, এবং তার দেহ ও মনের অনুভূতিসমূহের কথা স্পষ্ট করে বলল, যা আমার কাছে এখনও একটি স্বপ্নে দেখা ও শোনার মতো মনে হয়। মুনিয়া আমাকে কেবল বিস্মিত করেনি, তার সত্যবাদিতায় আমার মনে হয়েছিল, আমি বহু যুগ আগের ভারতের বুকে সেই যুগের মানুষদের মধ্যে বসে আছি। সেই ভাষা এবং বর্ণনার দ্বারা কেউ মিথ্যা কথা বলতে পারে না। এতক্ষণের সমস্ত রহস্য তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। দেবতা, অপদেবতা বা মানুষের কথা কেন উঠেছিল; তখন বুঝতে পারছিলাম।
মুনিয়া তার বর্ণনায় এ কথাও বলল, তার একটু রক্তপাত হয়েছিল, কষ্ট পেয়েছিল, কিন্তু ভাল লেগেছিল বেশি। সে যে গর্ভবতী হল, এ কথা সে জানত না। তারপরে মুনিয়ার যেন তন্দ্রার ঘোর লেগেছিল, এবং যখন তার তন্দ্রা ভেঙে যায়, তখন সে আর ছিল না। মুনিয়ার গা ভোলা ছিল না, কাপড়চোপড় গুছিয়ে পরানো ছিল। মুনিয়া তখন মাঠের চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিল, কোথাও তার চিহ্ন ছিল না। সবই যেন একটা ভোজবাজির মতো ঘটে গিয়েছিল। মুনিয়ার তখন কান্না পেয়েছিল, সে গাছতলায় বসে বসে খানিকক্ষণ কেঁদেছিল। ইতিমধ্যে তার ভইষ এবং গোরুরা কোথায় চলে গিয়েছিল, দেখতে পাচ্ছিল না। খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারে গিয়ে তাদের পেয়েছিল, তারা জল খেতে গিয়েছিল। জল দেখে, পড়ন্ত বেলায় মুনিয়ার স্নান করতে ইচ্ছা হয়েছিল। সে স্নান করে, ভেজা কাপড়ে গৃহপালিত পশুদের নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
আরও জানতে পারলাম এ ঘটনা ঘটেছে প্রায় ছমাস আগে। অর্থাৎ ভাদ্র মাসে। ভঁইষাঁড়ের মাঠ আমার দেখা ছিল। ভাদ্রের দুপুরের রৌদ্রদগ্ধ নির্জন বিশাল মাঠের ছবি আমার চোখে ভেসে উঠেছিল। আর কেন জানি না, একটি প্রাচীন কবিতার কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, ই ভর বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।যদিও মুনিয়ার বর্ণনায় বর্ষার কোনও কথাই ছিল না, বলতে গেলে কোনও প্রাকৃতিক বর্ণনাই ছিল না, তথাপি আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার অবাক লাগছিল, আমার সামনে মুনিয়া নামে যে দেহাতি বালিকাটি বসে ছিল, সে যে প্রায় ছমাসের গর্ভবতী, সে যে পুরুষ সঙ্গক্ষম, এ যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অথচ অবিশ্বাস করারও কিছু নেই, কারণ মুনিয়ার কথা থেকেই জানা গেল, গতকাল রাত্রে তার মা তার গর্ভবতী হবার কথা জানতে পারে, এবং সে তার মাকে সব কথাই অকপটে বলেছে। কিন্তু সে কিছুই অনুমান করতে পারেনি, কেবল তার পেট একটু বড় হয়ে ওঠা ছাড়া এবং সে এ কথাও জানাল, তার কখনও ঋতুদর্শন ঘটেনি।
আরও একটা বিষয় আমার কাছে লক্ষণীয় মনে হল, গ্রামের যে সব ক্রুদ্ধ অধিবাসীরা বসে ছিল, যারা অতি ইতর ভাষায় মুনিয়াকে গালাগালি করছিল, মুনিয়ার সমস্ত ঘটনা বর্ণনার সময় কেউ-ই কোনওরকম বিদ্রূপ করা বা ইতর ভাষা বলেনি। সকলেই খুব মনোযাগ দিয়ে শুনছিল।
মুনিয়ার কথা শেষ হলে সকলেই খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কারোর কারোর চোখেমুখে অবিশ্বাস এবং সংশয়ের অভিব্যক্তি। একজন প্রধান জিজ্ঞেস করল, মুনিয়া সেই মানুষকে তুই আর কখনও দেখতে পাসনি?
মুনিয়া বলল, না। তাকে আমি জীবনে একবারই দেখেছি।
তখন খাটিয়ার কাছেই একজন বৃদ্ধা উঠে দাঁড়াল। সাদা শন নুড়ি চুল বুড়ির মাথায়। তার চোখ ঘষা কাচের মতো, সে অন্ধ। সে বলল, আমি এটা বলতে পারি, মুনিয়া যা বলেছে তা মিথ্যা হতে পারে না।
সবাই অন্ধ বৃদ্ধার দিকে তাকাল। বৃদ্ধার চোখের ঘষা কাচের ক্ষেত্র কাঁপছে। মনে হয় মোটা পরদার ভিতরে তার চোখের মণি নড়াচড়া করছে। সে আবার বলল, সরপঞ্চকে আমি এও বলতে পারি, মুনিয়ার পেটে যে বাচ্চা দিয়ে গেছে সে কখনও অপদেবতা হতে পারে না। সে যদি অপদেবতা হত, মুনিয়া পাগল হয়ে যেত, নয়তো অপঘাতে মারা যেত। কারণ অপদেবতারা যার ওপর ভর করে তার সর্বনাশ করে দিয়ে যায়।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সকলেই যেন দৈববাণী শোনার মতো অন্ধ বৃদ্ধার কথা শুনছে, এবং বিশ্বাসও করছে।
বৃদ্ধা আবার বলল, মুনিয়ার পেটে কোনও মানুষের বাচ্চাও নেই। মানুষ হলে, মুনিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হত না। ও চেঁচামেচি করত, আঁচড়ে কামড়ে দিত। আমাদের পশুপাখিদের এখনও মড়ক লাগেনি। গ্রামেও মড়ক লাগেনি। মাঠে এখনও ফসলের কোনও ক্ষতি হয়নি, ফসল ভালই হয়েছে। আমার মনে হয়, এ কোনও দেবতারই কাজ। মুনিয়াকে তাঁর ভাল লেগেছিল। তবু আমি একটা কথা বলব, মুনিয়ার বাচ্চা হওয়ার আগে যদি গ্রামের কোনও ক্ষতি হয়, তবে বুঝতে হবে, এর মধ্যে কোনও পাপ আছে।
অন্ধ বৃদ্ধা চুপ করল। আমি সীমাহীন বিস্ময়ে দেখলাম, কারোর মুখে আর কোনও সংশয় বা অবিশ্বাস নেই। এমনকী পঞ্চায়েত প্রধানদেরও। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলাম কিনা, নিজেও ভাল জানি না, তথাপি যেন একটা স্বস্তি বোধ করলাম। বৃদ্ধার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
তখন একজন পঞ্চায়েত প্রধান চিৎকার করে, সকলের উদ্দেশে বলল, তোমরা সোতিয়া বুড়ির কথা সবাই মেনে নিচ্ছ? প্রায় সকলেই একযোগে বলে উঠল, তারা মেনে নিচ্ছে। প্রধান বলল, পঞ্চায়েতও তাই মেনে নিচ্ছে। কিন্তু এখন কথা হল, শামপুরের লছমনের ব্যাটার সঙ্গে মুনিয়ার বিয়ে হয়েছে, বহুত আগে। সে যদি মুনিয়াকে আর না নিতে চায়, তা হলে কী হবে?
কেউ কোনও কথা বলল না। সোতিয়া নামে অন্ধ বৃদ্ধা বলল, যদি মুনিয়াকে শ্বশুরবাড়ি থেকে না নিতে আসে, তবে গ্রামের দেবী মঙ্গলার পূজা করবে মুনিয়া। মঙ্গলা দেবীর সেবা করবে, সেখানেই থাকবে সারা জীবন।
একজন পঞ্চায়েত প্রধান বলল, আমরাও তাই চাই।
আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম। তখন অনেকেই উঠতে আরম্ভ করেছে, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। সকলের কাজকর্মও আছে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দেখলাম, মুনিয়ার মা এসে মুনিয়ার হাত ধরে মাটি থেকে তুলল। মুনিয়ার মুখ নিচু। চোখ জলে ভাসছে। কয়েক পলক আমি ওর দিক থেকে চোখ সরাতে পারলাম না। আমার মনে তখনও নানান প্রশ্ন ও বিস্ময়।
বিশ-পঁচিশ বছর কেটে গিয়েছে। এখনও আমার মনে সেই বিস্ময় এবং প্রশ্ন সকল এক রকমই আছে। এবং মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যি কি এরকম ঘটনার আমি সাক্ষী ছিলাম? নিজেকে নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারিনা, কারণ আমাদের বাস্তব বোধ এবং বিশ্বাসের ছকে না মিললে, অনেক কিছুই আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।