কুন্তী গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র

কুন্তী গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র

কুন্তিভোজ রাজার কন্যা কুন্তী। তরুণী, সুন্দরী, যিনি সহজাত কবচ-কুণ্ডল নিয়েই যেন তেজের প্রতীক। একবার রাজার অতিথি হয়ে এলেন দুর্বাসা ঋষি। রাজার নির্দেশে কুমারী কন্যা কুন্তী তাঁর সর্বান্ত পরিচর্যা করলেন। তাঁর যত্ন ও সেবায় তুষ্ট হয়ে ঋষি যাবার সময়ে তাঁকে বর দিলেন: একটি মন্ত্র, সেইটি উচ্চারণ করে কুন্তী যে দেবতাকে ডাকবেন, তিনিই এসে উপস্থিত হবেন। তরুণী কুন্তী কৌতূহলী হয়ে মন্ত্র দিয়ে সূর্যকে ডাকতে সূর্য এসে হাজির, বর দিলেন : আমি শুধু আঙুল দিয়ে স্পর্শ করব তুমি সৎ, অনবদ্য শক্তিমান পুত্র লাভ করবে। তোমার কৌমার্য অক্ষত থাকবে। কুন্তীর এই পুত্রই হল কর্ণ। এ দিকে রাজকন্যা কুমারী কুন্তী পড়লেন মহা বিপাকে। যথাকালে সখীদের সাহায্যে গর্ভ গোপনে লালন করে অবশেষে যথাকালে জন্ম দিলেন সর্ব সুলক্ষণযুক্ত এক কুমারের। এর বৈশিষ্ট্য ছিল সহজাত কবচ ও কুণ্ডল। সখীদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি পেটিকায় শিশুটিকে সাজিয়ে শুইয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। অনেক দূরে এক গ্রামে অধিরথ নামের এক সারথি (যার স্ত্রীর নাম রাধা) ওই শিশুটিকে তুলে নিয়ে লালনপালনই শুধু করলেন না, কৈশোরকাল থেকে তাকেই ক্ষত্রিয়ের পাঠক্রম নিপুণ ভাবে আয়ত্ত করালেন। স্বাস্থ্যবান বুদ্ধিমান কর্ণ নানা বিদ্যা আয়ত্ত করলেন। ফলে, মহাপরাক্রমশালী এক বীর হয়ে উঠলেন। কুন্তীর সঙ্গে তাঁর আর একবারমাত্র দেখা হয়েছিল, জীবনের প্রায় শেষে এসে। কর্ণকে তখন কুন্তী অনুনয় করেন, তুমি যেহেতু কুত্তীর প্রথম সন্তান, তাই প্রথম পাণ্ডব হিসাবে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে, অর্জুনের অগ্রজের স্থান নিয়ে যুদ্ধ করতে। কিন্তু শৈশব থেকেই অনাদৃত কর্ণ এতদিন পরে মাকে সম্মান দিলেন কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হতে পারলেন না। কারণ, তিনি ‘অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’। কুন্তীর গর্ভজাত সন্তান তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্থান দিতে পারলেন না। কিশোরী কুন্তী যে কৌতূহলী হয়ে ঋষির বরে সূর্যের স্পর্শেই পুত্র লাভ করেছিলেন, তার সবটাই নাকচ হয়ে গেল। দীর্ঘকাল মনে মনে যাকে জ্যেষ্ঠপুত্রের আসনে রেখেছিলেন, সে দুর্জয় অভিমানে সেই চূড়ান্ত অপমানের শোধ নিল এই ভাবে।

যৌবনে কুন্তীর বিবাহ হল পাণ্ডুর সঙ্গে এবং সেই মন্ত্রবলে দেবতাদের আহ্বান করে ধর্মের কাছে যুধিষ্ঠিরকে, বায়ুর কাছে ভীমকে এবং ইন্দ্রের কাছ থেকে অর্জুনকে পেলেন। মাদ্রী ওই মন্ত্র শিখে অশ্বিনীদ্বয়ের কাছ থেকে নকুল ও সহদেবকে পেলেন। কিছুকাল পরে পাণ্ডুর মৃত্যু হয়, মাদ্রী সহমৃতা হলে বিধবা কুন্তী একাই পঞ্চপাণ্ডবের মা হয়ে রইলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

মাঝে শকুনির প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হারলেন। পাশা খেলা যুধিষ্ঠিরের নেশা ছিল, কিন্তু দক্ষতা ছিল না। এ কথা শকুনি জানতেন এবং পাণ্ডবদের সর্বনাশের এই পথটি বেছে নেন। পাণ্ডবদের ধনেপ্রাণে বিনষ্ট করতে তাই যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা স্তাবকতার দ্বারা একেবারে নিজের বশীভূত করলেন। উন্মত্তের মতো একে একে বাজি রাখতে গিয়ে যখন দ্রৌপদীকে বাজি রাখলেন ও হারলেন, তখন সেই বিপন্ন পুত্রবধূটিকে টেনে এনে বাঁচালেন কুন্তী। দ্বিতীয়বার পাশা খেলায় হেরে পাণ্ডবরা বারো বছর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে গেলেন। এর পর বনবাসের দিনে, প্রৌঢ়া শাশুড়ির ভূমিকায়, দ্রৌপদীর সহায় এবং মানসিক আশ্রয় ছিলেন কুন্তী।

এর আগে একবার শকুনির প্ররোচনায় দুর্যোধনেরা কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডবকে পুড়িয়ে মারবার ব্যবস্থা করে, লাক্ষা দিয়ে একটি আপাত স্বাভাবিক গৃহ নির্মাণ করে পাণ্ডবদের সপরিবারে সেখানে বাস করতে বলে। কুন্তী ব্যাপারটা সন্দেহ করেন। নিজেই পাঁচ চণ্ডাল পুত্র ও তাদের মাকে নিমন্ত্রণ করে খাদ্যের সঙ্গে প্রচুর সুরা পান করিয়ে পুত্রদের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলে। চণ্ডালরা যখন সুরায় আচ্ছন্ন তখন নিজের পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে সুড়ঙ্গ পথে নীরবে বেরিয়ে যান। পরদিন ওখানে পাঁচটা পুরুষ ও এক নারীর দগ্ধ দেহ দেখে শকুনি আশ্বস্ত হল। ভাবল কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব মারা গেছে। এ দিকে কুন্তী-সহ পাণ্ডবেরা ঘুরতে ঘুরতে নানা ঘটনাচক্রে দ্রুপদের রাজ্যে এসে শোনেন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের কথা। তাঁরা সেখানে যোগদান করেন। অর্জুন দ্রৌপদীকে লাভ করেন। সব কিছু জানাজানি হয়ে গেলে সস্ত্রীক পাণ্ডবেরা স্বগৃহে ফিরে আসেন। এর পরই পাশা খেলার ঘটনা। যখন দ্রৌপদী শুনলেন যে, যুধিষ্ঠির পাশায় তাঁকে বাজি রেখে হেরেছেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছে না দ্রৌপদীকেই। উত্তর এল, আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন। বুদ্ধিমতী দ্রৌপদী বললেন, স্বয়ং হেরেছে যে, সে তো তার স্ত্রীর আধিপত্য হারিয়েছে, অতএব দ্বিতীয় পাশা খেলা এবং এ বারও পরাজয়। ফলে সিদ্ধান্ত হল, দ্বাদশ বছর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস— এই শাস্তি ধার্য হলে পাণ্ডবরা বনবাসে গেলেন, কুন্তী রাজগৃহে রইলেন। বারো বছর বনবাসের পরে পাণ্ডবরা বিরাট রাজার রাজগৃহে ভিন্ন ভিন্ন ছদ্মবেশে রইলেন। তেরো বছর পর রাজধানীতে ফিরে শুরু হল কুরুপাণ্ডব যুদ্ধের প্রস্তুতি। তখন পাঁচ ছেলে নিয়ে কুন্তী রাজপ্রাসাদে।

যুদ্ধের পর, কৌরব যোদ্ধাদের মৃত্যুর পরে রাজধানী থেকে কুন্তী গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র বনবাসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেহেতু সিংহাসনের অধিকার অনির্ণীত রইল, অতএব যুদ্ধই তখন একমাত্র সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হয়েছিল। ঠিক যুদ্ধের আগে, কুন্তী এক অন্ধকার সন্ধ্যায় কর্ণের সঙ্গে দেখা করে, কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত তাকে বললেন। বললেন, রাজকন্যার পুত্রকে কত দুঃখে তিনি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। রাজপুরীতে তাঁর কোনও বৈধ স্থান ছিল না। অবিবাহিত কন্যা কোন পরিচয়ে তাঁকে লালন করবেন? কেই বা ওই বৃত্তান্ত বিশ্বাস করবে? কাজেই, সহজাত কবচ-কুণ্ডল-সুদ্ধ তিনি ছোট এক ভেলায় তাঁকে রাজপুত্রের সাজেই ভাসিয়ে দিলেন। সূতপল্লির বাসিন্দা নিঃসন্তান অধিরথ ও রাধা তাকে দেবতার দান রূপে পেয়ে অতি হৃষ্টচিত্তে তাকে লালন করলেন। কিন্তু কুন্তীর জীবনে সেই দিন যে দাহ তাঁর মর্মস্থলে জ্বলে উঠল, সে তো আর কোনও দিন মিটল না। ধর্ম, ইন্দ্র, বায়ু তিন দেবতাকে আহ্বান করে আরও তিনটি দেবপুত্রকে লাভ করলেন বটে কিন্তু কিশোরী কন্যার সেই প্রথম সন্তানকে ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার জ্বালা তাঁর কোনওদিনই মেটেনি। তাই যুদ্ধের ঠিক পূর্বে তিনি কর্ণকে অনুরোধ করলেন, যেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের যথার্থ স্থানে আসীন হয়ে প্রথম পাণ্ডবের স্থানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করে। কিন্তু অভিমানী জননীর অভিমানী পুত্র তাঁর অনুরোধে সম্মত হতে পারলেন না। হৃদয়ের প্রথম জ্বালা দ্বিগুণ হয়ে উঠল। অবমানিতা মাতা, পুত্রের কাছ থেকে ফিরে গেলেন, সেই দ্বিগুণ জ্বালাকে সঙ্গত বলে মেনে নিয়েই গেলেন। জন্মানোর পরেই যে শিশু পরিত্যাজ্য হয়েছিল, তার অভিমান— সারা জীবন অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত যার পরিচয়, সে আজ গৌরবের লোভে জ্যেষ্ঠপাণ্ডব পরিচয় গ্রহণ করবে কেন? সারা জীবন কুন্তী যাকে কোনও সম্মান দেননি, আজ সেই সম্মানের লোভে? না না এ সেই সূর্যতনয় কর্ণের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ কুন্তীরও পুত্রজন্মের পরে আর কোনও গত্যন্তর ছিল না। প্রবল নিরুদ্ধ ক্রন্দন চেপে কুন্তী ফিরে গেলেন তাঁর অন্তরে দেদীপ্যমান অগ্নিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে সঙ্গোপনে লালন করে। তার পর যুদ্ধ।

বেশ কিছু বৎসর আগে গান্ধার রাজদুহিতা এ প্রাসাদে আসেন জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের রাজবধূ হয়ে। এসে আবিষ্কার করেন স্বামী অন্ধ। পতিব্রতা নারী স্থির করলেন, এই যে নানারূপে মণ্ডিত পৃথিবী তাঁর স্বামী কোনওদিনই দেখতে পাননি, পাবেনও না, তাই আদর্শ স্ত্রী হিসেবে গান্ধারী, এই দৃশ্যমান পৃথিবীর রূপ চোখে দেখলে স্বামী যেখানে বঞ্চিত সেখানে তাঁর অবারিত ভোগ অন্যায়। তাই বস্ত্রখণ্ড দিয়ে দু’-চোখের দৃষ্টিকে নির্বাসন দিলেন: অন্ধের অন্ধ-স্ত্রী।

ধীরে ধীরে গান্ধারী আবিষ্কার করলেন, তাঁর স্বামীর অন্ধত্ব আরও অনেক গভীর, অনেক বড় পরিমাপের— এ অন্ধত্ব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। এর মধ্যে ভ্রান্তবোধ নেই, আছে আত্মপ্রতারণা। কৌরবদের চরিত্র, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কার্যপদ্ধতি সব জেনেও কেবলমাত্র নিজের পুত্র বলে তাদের সব অপরাধ সমর্থন করা অন্যায়। এবং এ অপরাধগুলি সংখ্যায় যেমন বেশি, কালপরিসরে তেমনই বহু বিস্তৃত। গান্ধারী নীতিবোধের প্রেরণায় বারবার ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, পুত্রপক্ষ ত্যাগ করে পাণ্ডবদের ন্যায্য প্রাপ্য সিংহাসন তাদের ফিরিয়ে দিতে। তারা ন্যায়নিষ্ঠ। কৌরবরা দীর্ঘকাল ধরে পরপর মিথ্যাচরণ ও অন্যায় আচরণ করছেন; সিংহাসনে তাদের অধিকার থাকতে পারে না। ধৃতরাষ্ট্রের চর্মচক্ষুই শুধু অন্ধ ছিল না, তাঁর নীতিবোধ বলেও কিছু ছিল না। ছিল না কোনও আধ্যাত্মিক বোধের দৃষ্টি। অন্ধত্বের দোহাই দিয়ে প্রকৃত পাপের দায় থেকে তাঁর মুক্তি নেই। নিজে এই বোধকে নিত্য দৃঢ় আধ্যাত্মিকতার সাহায্যে গান্ধারী দৃঢ় করতে চাইতেন ও ব্যর্থ হতেন। চর্মচক্ষুর সঙ্গে সঙ্গে মর্মচক্ষুও অকর্মণ্য। পাশা খেলায় পরপর যা কিছু যুধিষ্ঠির বাজি রাখছিলেন, তার মধ্যেও বহু অন্যায় ছিল।

ধৃতরাষ্ট্র স্বামী, অন্ধ তাই গান্ধারী স্বেচ্ছান্ধ, নিজের চক্ষু দু’টিকে বেঁধে রাখলেন। কিন্তু তাঁর নৈতিক দৃষ্টি ছিল স্পষ্ট, উজ্জ্বল। তাই সমস্ত বিবাহিত জীবনটা তাঁকে অন্তর্দগ্ধ হতে হয়েছিল।

ধৃতরাষ্ট্র অন্তরে বাহিরে অন্ধ। রাজ্যলোভী শরীরের অন্ধত্বের খুঁত থাকায় সিংহাসনে তাঁর অধিকার নেই। তাই ছলে বলে কৌশলে পুত্রদের জন্য সেই অধিকার যে-কোনও ভাবে কেড়ে নিতে তাঁর দ্বিধা নেই। পাশা খেলায় দক্ষতা নেই, লোভ আছে। মাঝে মাঝেই খবর পাচ্ছেন, দুর্যোধন শকুনি এদের কুচক্রান্তে পাণ্ডবদের ক্ষতি ঘটিয়ে তাঁর নিজের পুত্ররা নিজেদের সুবিধা করে নিচ্ছে। সিংহাসনে পাণ্ডবদের অধিকার খর্ব করবার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। পিতা হিসাবে যেখানে এ সবে বাধা দিয়ে নিজের পুত্রদের লোভ ও উচ্চাশাকে খর্ব করা উচিত ছিল, সেখানে নৈতিক অন্ধতা তাঁর ন্যায়-অন্যায়ের বোধকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই গান্ধারীর সৎপরামর্শে কখনও কর্ণপাত করেননি, বরং ধীরে ধীরে গভীরতর পাপের দিকে সজ্ঞানে নেমে গেছেন।

রাজত্বের স্পৃহা একদিন চলে গেল, এবং সে শক্তি তাঁর কোনওদিনই ছিল না। প্রচুর অন্যায়, জুয়ার নেশা জেনে শুনে অন্যায় করা, সারা জীবনই এ সব করে এসেছেন। জীবনের শেষ পর্বে এসে রাজসিংহাসনের নেশাও ছুটে গেল, সিংহাসনে পাণ্ডবদের একাধিপত্য মেনে নিতে হল। নিজের শতপুত্র প্রায় নিঃশেষ। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, গান্ধারী ও কুন্তীকে নিয়ে বনবাসে যাবেন। সঙ্গে বিদুরও চললেন এবং সঞ্জয়। কয়েকদিন পরে দেখা গেল, নিত্য-উপবাসী বিদুরের ছায়াদেহ যুধিষ্ঠিরের শরীরে বিলীন হয়ে গেল— দু’জনেই ধর্মের পুত্র ছিলেন। তারও কিছুকাল পরে, বনবাসের কিছুকাল পরে, একদিন বনে দাবানলের চিহ্ন দেখা যেতে এঁরা সঞ্জয়কে পালাতে বললেন। এ বার গান্ধারী ও কুন্তী-সহ ধৃতরাষ্ট্র দাবানলে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। মহাভারতে রাষ্ট্রনীতির সব মুখ্য চরিত্র অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। কিছুকাল পরে পাণ্ডবেরা এঁদের খুঁজতে খুঁজতে এসে দগ্ধ কঙ্কালগুলির সন্ধান পান এবং যথাবিধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করলেন।

মহাভারতে অগ্নি নানা রূপে ও প্রসঙ্গে দেখা দেন। প্রথম থেকেই কৌরব ও পাণ্ডব রাজপুত্রদের মধ্যে শত্রুতা ছিল। এতটাই যে, পরস্পরের শত্রুতা করা তাদের শৈশব ও কৈশোরে যেন এক বিনোদনে পরিণত হয়েছিল। একপক্ষের ক্ষতি হলে অপরপক্ষ উল্লসিত হত। এ সময়ে তাদের শিক্ষার কাল, এ শিক্ষার মধ্যে ক্ষত্রিয় হিসেবে অস্ত্রশিক্ষার প্রাধান্য ছিল। পরস্পরের ক্ষতি করা একটা বিলাসিতা বলে গণিত হত। অর্থাৎ বিদ্বেষের একটা আগুন দু’-পক্ষের মধ্যে যেন সর্বদাই প্রজ্জ্বলিত ছিল।

এ আগুনে ইন্ধন জোগাত শকুনি, কর্ণ এরা। যৌবনেও এরা পরস্পরের ক্ষতি করার জন্যে সর্বদা উৎসাহী ছিল। কুন্তী যখন বুঝতে পারলেন যে, অপরপক্ষ তাঁকে সন্তান-সহ পুড়িয়ে মারতে উদ্যোগ করছিলেন, তখন তাঁর জীবনে একটা বড় পাপের ভার জুড়ে রইল। এ আর এক আগুন। সম্পূর্ণ নিরপরাধ চণ্ডাল পরিবারের ছ’-টি প্রাণী জতুগৃহে দগ্ধ হল। কুন্তীর জীবনে সত্যকার পাপের কালিমা লাগল, যদিও আত্মরক্ষা ও সন্তানদের রক্ষার জন্য ওই নৃশংস কাজটা করে অগ্নিদাহের কালিমা লাগল, তবু এ তো সত্যকার পাপেরই কালিমা। জীবন এ ধরনের কালিমার মূল্য শোধ করে নেয়। যত বিলম্বিত হোক, এ পরিশোধ প্রায়ই ঘটে। তবে মা হয়ে কুন্তী সন্তানদের ও তাঁর নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করবেনই তো। সে কাজে সিদ্ধি লাভ করে তিনি তখনকার মতো নিজেকে পাপী ভাবেননি, কারণ, পাণ্ডবদের জীবনের দায় তাঁরই, বিশেষত মাদ্রীর মৃত্যুর পর। অবশ্য এ কথাও সত্য, এটা না করলে পঞ্চপুত্র-সহ তিনি জতুগৃহে দগ্ধ হয়ে মরতেন। তবু এটা পাপের আয়োজন। এ আগুন জমে রইল।

ধৃতরাষ্ট্রের নৈতিক আধ্যাত্মিক নানা পাপ ছিল। একমাত্র গান্ধারীর, পাপী রাজার বধুর, নৈতিক দৃষ্টি দিব্যদৃষ্টির মতো স্পষ্ট। তিনি জানেন, সমস্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা তাঁর স্বামী, শকুনি ও কর্ণ এবং পুত্রদের বেশ কিছু বর্ষের সঞ্চিত পাপের ফলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল এক মহতী বিনষ্টির দিকে। যদিও তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে নিষ্পাপ

অরণ্যবাস প্রায়শ্চিত্ত নয়। ওই দাবানল পাপের অনলের প্রতীক। হঠাৎ জন্মে-ওঠা সঞ্চিত আগুনের বহু সহস্র স্ফুলিঙ্গের কারণে জ্বলে এটা। সঞ্জয়কে ধৃতরাষ্ট্র দাবানলের পূর্ব সূচনা দেখে বললেন, পালাও এখনই পালাও। নিষ্পাপ সঞ্জয় পালিয়ে বাঁচল। কুন্তীর অপরাধ-সচেতন মন স্বকৃত অপরাধের এই প্রলয়ংকর প্রকাশ থেকে পালাতে চায়নি। পাপী স্বার্থপর, পাশার নেশায় পরপর অন্যায় করে যাওয়া ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে জানলেন, এ দাবানল মুখ্যত তাঁর কুল ধ্বংস করতে উদ্যত। পবিত্রতা গান্ধারীর চোখের আবরণ পুড়ে গেল। তিনি দেখলেন, তাঁর নির্দোষ জীবন ও চূড়ান্ত পাতিব্রত্যও তাঁকে স্বামীর পাপের অংশদায়িত্ব থেকে বাঁচাতে পারবে না। মহাভারতের মুখ্য চরিত্রগুলি, বিশেষত পাণ্ডবেরা, মহাপ্রস্থানের পথে বা হিমালয় আরোহণ করে স্বর্গে গেলেন কিন্তু এই তিনজন মহাপ্রস্থান, স্বর্গারোহণ কোনওটাই করেননি। এঁরা মর্তেই দাবানলে প্রাণত্যাগ করেন। তিনজন তিন ভাবে অন্তর্জালায় জ্বলছিলেন। শরীরের সঙ্গেই সেই জ্বালার অবসান ঘটাল দাবানল— সে যুগে অগ্নির যে ভীষণতম প্রকাশ তার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রাণত্যাগ করেন। সারা জীবনই এঁরা নানা আকৃতি-প্রকৃতির ছোট বড় স্ফুলিঙ্গের বোঝা অন্তরে বহন করেন। আজ সেই সমস্ত স্ফুলিঙ্গ যেন একত্র হয়ে দাবানলের রূপে এঁদের মৃত্যু ঘটাল। মহাভারতের প্রথম থেকেই এই সব স্ফুলিঙ্গ বিরাজ করত নানারূপে— ধৃতরাষ্ট্র, যার নামের অর্থ রাষ্ট্রকে যিনি ধারণ করেছেন। তিনি যেন রাষ্ট্রের বাইরে একান্ত ভাবে লোভ, ঈর্ষার জ্বালাকে নানারূপে অন্তরে ধারণ করেছিলেন। নিজে রাজা হতে পারেননি অতএব সিংহাসনের জন্য এবং সেই কারণে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে তিনি সারা জীবন গভীর ঈর্ষা অন্তরে লালন করে এসেছেন। কুন্তীর নানা জ্বালা কৌরবদের প্রতি ঈর্ষা বিদ্বেষের রূপে সারা জীবন তাঁর অন্তরে জ্বলে। তা ছাড়া কুমারী সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে লালন করতে না পারার জ্বালা, শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাবে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কর্ণের অসম্মতি সেই জ্বালাকে দুঃসহ করে তুলেছিল। গান্ধারী (পৃথিবীকে যিনি ধারণ করেন), তিনি পৃথিবীর কোনও দায়িত্ব পালন করতেই পারেননি। লোভী, পাপী স্বামীর কাছে নৈতিক যুক্তি— যা দিয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাঁর সিংহাসনের লোভ সারা জীবন প্রতিহত হয়েছিল, যে অগ্নিপিণ্ড তিনি অন্তরে ধারণ করেছিলেন, দাবানলে তাই বৃহদাকার হয়ে তাঁর জীবনান্ত ঘটাল।

অগ্নি সমস্তটাই সর্বদাই যেন রোষ, হিংসা, দ্বেষ, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাই এই অন্তিম দাবানলটি যেন একটা বিভীষিকাময় প্রতীক। সেই দাবানলে মৃত্যু যেন মহাভারতে একটি মর্মকথার প্রতীক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *