কুতুব শীর্ষে
দুইজনে লুকাইয়া ষড়যন্ত্র করিয়াছিলাম যে সন্ধ্যার সময় কুতুব মিনারের ডগায় উঠিয়া নিরালায় দেখা-সাক্ষাৎ করিব। প্রণয়ী-যুগলের নিভৃত মিলনের পক্ষে এমন উচ্চস্থান আর কোথায় আছে? এখান হইতে নীচের দিকে তাকাইলে মানুষগুলাকে পিপীলিকার মতো ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর দেখায়।
তা ছাড়া, অন্য একটা কারণও ছিল। কুমারী বিন্ধ্যেশ্বরীর অর্থাৎ আমার বিন্দুর পিতা মহামহোপাধ্যায় জটাধর শাস্ত্রী মহাশয় আমাকে পছন্দ করিতেন না। বিন্দুর সহিত বিন্দুর পূজ্যপাদ পিতার এই মতভেদের কারণ—আমি নাকি পরিপূর্ণভাবে সাহেব বনিয়া গিয়াছি; মনুষ্যত্ব এবং আরও কয়েকটা ষত্বণত্ব আমার একেবারেই লোপ পাইয়াছে। তাই আমাকে বিন্দুর সান্নিধ্যে দেখিলেই মহামহোপাধ্যায় মহাশয়ের শুঁয়াপোকার মতো ভ্রুযুগল কপালের উপর কিলবিল করিয়া উঠিত। এবং তিনি গলার মধ্যে অস্ফুটস্বরে যে-সকল শব্দ উচ্চারণ করিতেন তাহা দেবভাষা হইলেও সম্পূর্ণ প্রসাদ-গুণবর্জিত বলিয়াই আমার সন্দেহ হইত। শাস্ত্রী মহাশয় গোঁড়া হিন্দু, সুতরাং জবরদস্ত লোক—সম্প্রতি একটা প্রকাণ্ড কলেজের প্রধান সংস্কৃত-অধ্যাপকের পদ হইতে অবসর লইয়া একান্তমনে কেবল কন্যাকে আগলাইতেছেন।
বিন্দুর বয়স আঠারো বৎসর; গোঁড়া হিন্দু শাস্ত্রী মহাশয় ইহা কিরূপে সহ্য করিতেছেন, প্রশ্ন উঠিতে পারে। ইহার সহজ উত্তর আছে—ফলিত জ্যোতিষ মতে উনিশ বছর বয়সে বিন্দুর একটি প্রচণ্ড ফাঁড়া আছে, সেই ফাঁড়া উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত জটাধর শাস্ত্রী কন্যার বিবাহ দিবেন না। তিনি কেবল তাহাকে হবিষ্য আহার করাইয়া বেদান্ত পড়াইতেছেন।
গতিক বুঝিয়া আমরা লুকাইয়া দেখাশুনা আরম্ভ করিয়াছিলাম—কিন্তু তাহা এতই ক্ষণস্থায়ী যে তৃপ্তি হইত না। শেষে বিন্দুই এই মতলবটি বাহির করিয়াছিল। হবিষ্যান্ন ও বেদান্তের দ্বারা বুদ্ধি সম্ভবত মার্জিত হয়; কুতুব মিনারের শীর্ষে দেখা করিবার চাতুরী তাহার মস্তিষ্কেই উৎপন্ন হয়। ইহার পরম সুবিধা এই যে, জটাধর শাস্ত্রী কন্যাকে লইয়া সান্ধ্যভ্রমণ উপলক্ষে কুতুব মিনারের মূল পর্যন্ত পৌঁছিবেন; কিন্তু তিনি বিপুলকায় ও বৃদ্ধ—কুতুব মিনারের ডগায় ওঠা তাঁহার কর্ম নয়; কন্যাটি তন্বী ও নবযৌবনা—সে পিতাকে নীচে ফেলিয়া ক্রীড়াচ্ছলে হাসিতে হাসিতে চক্রায়িত সোপানশ্রেণী বাহিয়া উপরে উঠিয়া যাইবে। আর আমি পূর্ব হইতেই উপরে অপেক্ষা করিয়া থাকিব—
কৌশলটা বুঝিতে পারিয়াছেন?
কিন্তু এ কৌশলটাই এই কাহিনীর চরম প্রতিপাদ্য নয়—মুখবন্ধ মাত্র। কুতুব-শীর্ষে যাহা ঘটিয়াছিল (রোমাঞ্চকর কিছু নয়; পাঠক-পাঠিকা অযথা উৎসাহিত হইয়া উঠিবেন না) তাহাই সংক্ষেপে বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য। অবশ্য ঘটনার অকুস্থল যে দিল্লী নগরীর উপকণ্ঠস্থিত স্বনামখ্যাত স্তম্ভ তাহা বোধ করি এতক্ষণে অনেকেই বুঝিতে পারিয়াছেন।
যথাকালে দুই পকেটে নানাবিধ বিজাতীয় মিষ্টান্ন ভরিয়া লইয়া কুতুব-শীর্ষে আরোহণ করিলাম। একটু আগে ভাগে আসাই সমীচীন; ভাবী শ্বশুরমহাশয়ের সহিত মুখোমুখি দেখা হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়।
উপরে উঠিয়া কিন্তু দেখিলাম, আমারও আগে আর একজন এখানে আসিয়া হাজির হইয়াছে! অপরিচিত একজন ছোকরা সাহেব। আমাকে দেখিয়া সে ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া মুখ ফিরাইয়া রহিল।
ছোকরা আমারই সমবয়স্ক হইবে। সাধারণত ইংরেজদের চেহারা যেমন হয়—নাক মুখ ভাল নয়, অথচ বেশ বলিষ্ঠ সুপুরুষ। অন্য সময় হইলে অবিলম্বে তাহার সহিত আলাপ জমাইয়া ফেলিতাম; কিন্তু এ সময়ে তাহাকে দেখিয়া মনটা খিঁচড়াইয়া গেল। তুমি বাপু কিজন্য এখানে আসিয়া উঠিলে? ভারতবাসীর সুখে বিঘ্ন করা ছাড়া আর কি তোমাদের অন্য কাজ নাই?
আকাশের মাঝখানে গোলাকৃতি চত্বর, কোমর পর্যন্ত পাঁচিল দিয়া ঘেরা—যেন প্রণয়পাখির নিভৃত একটি নীড়। এখানে ঐ বস্তুতান্ত্রিক ইংরেজ পাষণ্ড কী করিতেছে? বিন্দুর জন্য যে চকোলেট আনিয়াছিলাম, বিমর্ষভাবে তাহাই কয়েকটা খাইয়া ফেলিলাম। লোকটা চলিয়াও তো যায় না! একটু বুদ্ধি থাকিলে আমার অবস্থা বুঝিয়া নিজেই ভদ্রভাবে নামিয়া যাইত। কিন্তু কেবল ষাঁড়ের ডালনা খাইলে বুদ্ধি আসিবে কোথা হইতে?
লক্ষ্য করিলাম, সে ঘাড় ফিরাইয়া মাঝে মাঝে দেখিতেছে আমি চলিয়া গিয়াছি কি না। বোধ হয় কালা আদমি কাছে থাকার জন্য সাহেবের কষ্ট হইতেছে। উঃ! এই পাপেই তো আর্যাবর্ত ইহাদের হাত হইতে যাইতে বসিয়াছে।
কিন্তু আমি যে রাগ করিয়া নামিয়া যাইব তাহারও উপায় নাই—বিন্দু আসিবে। নীচে—স্তম্ভের কটি বেষ্টন করিয়া আরও কয়েকটি রেলিং-ঘেরা ব্যাল্কনি আছে বটে, কিন্তু সেখানে বিন্দুর সহিত একত্র দৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বড় বেশী। শাস্ত্রী মহাশয় চক্ষুতে নিয়মিত সর্ষপ তৈল প্রয়োগ করিয়া দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা অনাবশ্যক বজায় রাখিয়াছেন।
সিঁড়ির উপর দ্রুত লঘু পায়ের শব্দ। পরক্ষণেই বিন্দুর কৌতুক-হাসি-ভরা মুখ। তারপরই বিন্দুর হাসি মিলাইয়া গেল। সে থমকিয়া সাহেবের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, ‘এ আবার কে?’
বলিলাম, ‘একটা নৃশংস ইংরেজ। ইচ্ছে হচ্ছে এখান থেকে সটান রেলিং ডিঙিয়ে ওকে তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিই।’
বিষণ্ণভাবে বিন্দু আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। দুইজনে শুন্যের পানে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া আছি। পকেট হইতে সমস্ত টফী, চকোলেট ও ক্যারামেল্ বাহির করিয়া বিন্দুকে দিলাম। তাহার মুখে হাসি ফুটিল বটে, কিন্তু ম্রিয়মাণ হাসি। ক্ষুব্ধ মুখে সে টফী চিবাইতে লাগিল।
আমি বলিলাম, ‘আজকের দিনটাই বৃথা গেল।’
বিন্দু বলিল, ‘বাবাকে এদিকে আনতে যে কত কষ্ট পেতে হয়েছে—’
বুঝিতে পারিলাম, পিতৃদেবকে কুতুব মিনারের সন্নিকটে আসিতে রাজী করা বিন্দুর পক্ষে সহজ হয় নাই। এত আয়োজন, এত কৌশল—সব ব্যর্থ! আমি কটমট করিয়া সাহেবের দিকে তাকাইলাম।
এই সময় সাহেব একবার ঘাড় বাঁকাইয়া আমাদের দিকে চাহিয়াই আবার মুখ ফিরাইয়া লইল। বিন্দু এতক্ষণ তাহার মুখ দেখে নাই, এখন ফিস্ফিস্ করিয়া বলিল, ‘লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি। মনে পড়েছে—এই ছোঁড়াই ফ্যানির পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ফ্যানি কে?’
‘আমাদের বাগনের পাঁচিলের ওপারে একজন ফৌজী সাহেব থাকে দেখনি? ফ্যানি তারই মেয়ে। এর সঙ্গে তার—’
‘তা এখানে কেন? ফ্যানির কাছে গেলেই তো পারে।’
ফ্যানির কাছে কেন যাইতেছে না এই সমস্যা লইয়া কিছুক্ষণ তিক্ত মনে গবেষণা করিলাম। —ফ্যানি সম্ভবত উহাকে তাড়াইয়া দিয়াছে। ঠিকই করিয়াছে—
বিন্দু নীচের দিকে একবার উঁকি মারিয়া হতাশ স্বরে বলিল, ‘বাবা ওপর দিকে চেয়ে আছেন; এবার নেমে যেতে হবে, নয়তো সন্দেহ করবেন—’
বিন্দুর হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, ‘বিন্দু—’
‘আঃ—ও কি করছ! এখনি দেখতে পাবে লোকটা।’
মরীয়া হইয়া বলিলাম, ‘দেখুক গে। কোথাকার একটা বে-আক্কেলে সাহেব রয়েছে বলে আমরা প্রাণ খুলে কথা কইতে পাব না! রইল তো বয়েই গেল। আমাদের কথা তো আর বুঝতে পারবে না।’
‘না না—আজ না—সব মাটি হয়ে গেল! আমি যাই।’ বিন্দু ছলছলে চোখে তাহার আশাহত হৃদয়টিকে আমার দৃষ্টির সম্মুখে মেলিয়া ধরিল।
‘মুখপোড়া ড্যাক্রা!’—সাহেবটার দিকে বারি-বিদ্যুৎ-ভরা একটা কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বিন্দু নামিয়া গেল। আমি বজ্রগর্ভ অন্তর লইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম।
ক্রমে দেখিতে পাইলাম, বহুদূর নিম্নে বিন্দু ও তাহার পিতাকে লইয়া মোটর চলিয়া গেল। তখন আমিও শেষবার সাহেবকে রোষকটাক্ষে ভস্মীভূত করিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া নামিবার উপক্রম করিলাম। সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত গিয়াছি—
‘মশায়, শুনুন—’
পশ্চাতে শুলবিদ্ধবৎ ফিরিলাম।
সাহেব হাতজোড় করিয়া সলজ্জ স্মিতমুখে দাঁড়াইয়া আছে; পরিষ্কার বাংলায় বলিল, ‘আমায় মাপ করতে হবে।’
কিছুক্ষণ হতভম্ব থাকিয়া বলিলাম, ‘কি ভয়ানক! অর্থাৎ—আপনি বাংলা বলছেন যে! মানে—তবে কি আপনি ইংরেজ নয়?’ বিন্দুর সহিত সায়েব সম্বন্ধে কি কি কথা হইয়াছিল স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলাম।
সাহেব বলিল, ‘ইংরেজ বটে, কিন্তু বাংলা জানি। পাঁচ বছর বয়স থেকে শান্তিনিকেতনে পড়েছি।…কিন্তু সে যাক। আপনারা নিশ্চয় ভেবেছেন আমি একটা অসভ্য বর্বর, কিন্তু মাইরি বলছি—আমার চলে যাবার উপায় ছিল না।’ বলিয়া সাহেব সলজ্জে মাথা নিচু করিল।
বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘ব্যাপার কি?’
‘আমিও—’ সাহেব হঠাৎ হাসিয়া ফেলিল, —‘আপনার উনি—অর্থাৎ যে মহিলাটি এসেছিলেন তিনি ঠিক ধরেছেন—ফ্যানির সঙ্গে আমার—’
‘এইখানে দেখা করবার কথা ছিল?’
‘হ্যাঁ।—আমি তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম।’
ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করি ফ্যানি বেদান্ত এবং হবিষ্যান্নের ভক্ত কি না। কিন্তু বলিলাম, ‘আপনাদের এত দূরে আসার কি দরকার? বাড়িতেই তো—’
ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িয়া সাহেব বলিল, ‘আপনি ফ্যানির বাবাকে জানেন না—একটি আস্ত কাঠ-গোঁয়ার। একেবারে পাকা সাহেব। তাঁর বিশ্বাস আমি একেবারে নেটিভ্ হিন্দু হয়ে গেছি, ফ্যানিকে আমার সঙ্গে মিশতে দিতে চান না। তাই আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে—’
মহানন্দে সাহেবের দিকে হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলাম, ‘বন্ধু, এসো শেক্হ্যান্ড করি। আর যদি দেশী মতে কোলাকুলি করতে চাও, তাতেও আপত্তি নেই।’
কোলাকুলি শেষ হইলে সাহেব বলিল, ‘কেন যে ফ্যানি এলো না—হয়তো বুড়োটা…।’
এমন সময় সিঁড়িতে দ্রুত লঘু জুতার খুটখুট শব্দ! পরক্ষণেই একটি তরুণী ইংরেজ মেয়ে ছুটিয়া আসিয়া প্রায় সাহেবের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, ‘ও জিমি, অ্যাম আই ভেরি লেট্? বাট্ ড্যাডি—ওঃ!’
আমাকে দেখিয়া মেয়েটির মুখের হাসি নিবিয়া গেল; জিমির বুকের নিকট হইতে ইঞ্চিখানেক সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘হোয়াট্স্ হি ডুয়িং হিয়ার?’
জিমি অপ্রস্তুতভাবে আমার পানে চাহিয়া হাসিল। আমি বলিলাম, ‘জিমি, চল্লুম ভাই, আর থাকছি না—তোমাদের মিলন মধুময় হোক্।’
কুতুব-শীর্ষ হইতে ধীরে ধীরে নামিয়া গেলাম।
ভাদ্র ১৩৪৫