কুঠুরি ও বারান্দা
গালিব এখন চিঠি লিখছেন।
তখনো রাত ফুরোয়নি। রাত্রি অবসানের মৃদু আলো ছড়াতে শুরু করেছে মাত্র।
তিনি লিখছেন, শোনো, পৃথিবী দুটি। একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবী। সাধারণত নিয়ম একটাই। অর্থাৎ যারা মাটিজলের পৃথিবীতে অপরাধী, তারা আত্মার পৃথিবীতে শাস্তি পাবে। যারা আত্মার বিশ্বে অপরাধী, তারা মাটিজলের বিশ্বে শাস্তি পাবে।
তিনি আরো কিছু লিখতে চাইছিলেন। কিন্তু দিনের প্রথম আলো দেখার জন্য কুঠুরি ছেড়ে বাইরে এলেন। মুগ্ধ হয়ে গেল মন। অপার বিস্ময়ে দু’চোখ মেলে ঈশ্বরের পৃথিবী দেখে মুখে মুখে আওড়ালেন—
‘একটি কথা, একটু মৃদু হাসি, সামান্য ইঙ্গিত
আমার আশা প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে,
যদি জানাও তুমি আমার প্রতি মনোযোগী—
আমি আলোয় শিহরিত উল্লাসময় নগরীতে পরিণত হতে পারি।’
এভাবেই নিজেকে তিনি নিজের কবিতায় ফুটিয়ে রাখেন। ভাবেন, আলো এবং নগরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক তৈরি করে বিহ্বল হন। দিনের প্রথম আলো এবং দিল্লির পথঘাট-বাড়িঘর তাঁর চেতনাকে হরণ করে। তিনি দিনের আলো ছুঁয়ে নগরীতে হেঁটে যান। তাঁর মাথায় ভর করে কবিতা। তিনি একের পর এক লিখতে থাকেন। টেবিলের ওপর নুয়ে আসে তাঁর মাথা। আজও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আলোর বিকাশ দেখলেন। একজন-দু’জন মানুষকে রাস্তায় বের হতে দেখলেন। মাথায় চলছে অলৌকিক আলোর রশ্মির বুনন। তিনি বিমুগ্ধ চিত্তে দু’হাত ওপরে তুলে কিছু করতে চাইলেন। কিন্তু কী করবেন, ভাবতে পারলেন না। ফিরে আসেন টেবিলে। যে পিদিমটি জ্বলছিল, ফুঁ দিয়ে তা নিভিয়ে দিলেন। ঘরে আলো প্রবেশ করেছে। টেবিলের ওপর রাখা রাতের খাওয়ার প্লেটটি নামিয়ে রাখলেন মেঝেতে। মাংসের হাড়, পেঁয়াজের টুকরো ইত্যাদিতে প্লেটটা নোংরা হয়ে আছে। শুধু সুরার গ্লাসটি তিনি কখনো নোংরা হতে দেন না। কারণ, পানপাত্র ছাড়া তাঁর দিন ভালো যায় না।
এলোমেলো হয়ে থাকা বিছানাটি ঝেড়েঝুড়ে ঠিক করলেন। নিজেকে বললেন, এখন আমাকে ঘুমুতে হবে; অন্তত ঘণ্টা দুয়েক। বন্ধুরা আসার আগে। বন্ধুরা এলে লুডোর ছকের ওপর জুয়া খেলা হবে। দারুণ উত্তেজনা।
তিনি শুয়ে পড়লেন।
ঘুমে জড়িয়ে পড়ার আগে নিজের একটি ঘটনার কথা মনে পড়লে হো হো করে হাসলেন। ভাবলেন, এই হাসি ঘুমের জন্য উপাদেয় সুরা।
ঘুমানোর আগে নিজেকে বললেন, তোমার আরেকটু হিসাব করে চলা উচিত গালিব। এত বেহিসাবি চললে তো ঋণের বোঝায় মুখ থুবড়ে পড়বে এবং মরবে। আর বেশি কিছু তিনি ভাবতে পারলেন না। ভীষণ ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
গালিবের ঘুম যখন ভাঙল, তখন সূর্য মধ্যখানে। প্রচণ্ড গরম। কুঠুরির মধ্যে কোনো বাতাস আছে বলে মনে হয় না। গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছেন। বালিশ ভিজে গেছে। সঙ্গে চুলভর্তি পুরো মাথাটা। মহাবিরক্তিতে হাত পাখাটা খুঁজলেন। পেলেন না। হয়তো উমরাও বেগম সরিয়ে রেখেছেন।
তাঁর স্ত্রী সংসারের শৃঙ্খলার জন্য সবকিছু গুছিয়ে রাখেন। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তক্তপোষের নিচে পা নামিয়ে দিয়ে বুঝলেন, পায়ের কাছে চটি নেই। কোথায় রেখেছেন মনে করতে পারলেন না। দেখলেন, ঘরের কোণে এলোমেলো পড়ে আছে তাঁর মদ খাওয়ার পেয়ালাগুলো। উমরাও বেগম আগে পেয়ালাগুলো ধুয়ে রাখতেন। এখন রাখেন না। কারণ, তিনি তাঁর স্বামীকে মদপান থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিরত করতে পারেননি। ।
এই প্রসঙ্গ উঠলেই গালিব বলেন, সুরা তো আকাশের ঝলমলে সূর্য। তোমার-আমার সংসারে আলো দেয়।
আলো? সংসারে আলো?
গালিব ভ্রু কুঁচকে বলেন, হ্যাঁ, তাই তো। মিথ্যে তো বলিনি।
উমরাও বেগম রাগত স্বরে বলেন, যে সংসারে সাতটি সন্তান জন্ম নিয়ে এক বছর বয়সের আগেই মরে যায়, সেই সংসারে আলো থাকে নাকি? যত্তসব উদ্ভট ভাবনা। রাতদিন মদ খেয়ে মানুষের মাথা ঠিক থাকে নাকি?
থাকে, থাকে। সে তুমি বুঝবে না যে, কীভাবে থাকে।
কবিতা লেখা আরেক বিশৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খল কাজের জন্য মদভরা মাথাই যথেষ্ট।
উমরাও বেগম দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রাগ ঝাড়েন। গালিব কবিতার ভাষায় বলেন-
‘আমি মানুষের স্বভাব পেয়েছি; মানুষ
থেকেই আমার জন্ম, আমি গর্বিত যে
আমি পাপ করতে পেরেছি, আমার
দ্রাক্ষার বন্দনা কখনোই পরিত্যাগ করব না,
ঝড়ের ঘূর্ণিতে আমি সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়ব।’
শেষ হলে চোখ বড় করে দু’হাত নেড়ে বলেন, বুঝলে, দ্রাক্ষার বন্দনা কখনোই পরিত্যাগ করব না। বুঝলে, আমি গর্বিত যে, আমি পাপ করতে পেরেছি। কবিতা লেখাও আমার পাপ। আমি পাপের পাঁকে ডুবে আছি।
তারপর স্ত্রীকে বলেন, তাহলে তুমি আমার মদ খাওয়ার পেয়ালাগুলো ধোবে না?
না, কখনোই নয়।
তবে তা-ই হোক।
হবেই তো।
আমি একটা সমুদ্র এনে কুঠুরিতে রাখব। সুরা খেয়ে, পেয়ালাগুলো সেখানে ডুবিয়ে রাখব।
তা-ই করেন। একটা সন্তান যার কপালে টেকে না, তাঁর আবার কবিতা, তাঁর আবার দ্রাক্ষার বন্দনা।
চোখ পানিতে ভরে যায়। কাঁদতে কাঁদতে চলে যান উমরাও বেগম। মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর, কিন্তু অল্পক্ষণের জন্য। তিনি এত কিছু করতে ভালোবাসেন না। অনুশোচনা তাঁর অভিধানে নেই। অনুশোচনাকে তিনি ঘৃণা করেন
একবার একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল জামা মসজিদের সামনে। তিনি মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়েছেন। গালিবকে পছন্দ করেন, কিন্তু তাঁর শরাবে আসক্তি সহ্য করতে পারেন না। দেখা হতেই বললেন, কেমন আছেন মির্জা সাহেব?
গালিব বুঝে যান যে তিনি কি বলবেন। তারপর মাথা নেড়ে বলেন, ভালো আছি। জামা মসজিদের সিঁড়িতে ভালো কাবাব বিক্রি হয়। কাবারের জন্য এসেছি।
তিনি শক্ত কণ্ঠে বলেন, সুরার জন্য আপনার কাবাব লাগে শুনেছি। শরাব পান খুব খারাপ কাজ মির্জা সাহেব। এর ফল ভয়াবহ।
গালিব শাস্ত কণ্ঠেই বলেন, শরাবে কি এমন খারাপ জিনিস আছে?
ধর্মপ্রাণ মানুষটি তাঁকে বোঝানোর জন্য উৎসাহ নিয়ে বলেন, শরাবীর প্রার্থনা কবুল হয় না। আর প্রার্থনা কবুল না হলেতো বেহেশতের দরজা বন্ধ থাকে।
গালিব শক্ত কণ্ঠে বলেন, শরাবের সঙ্গে যাঁর প্রতিদিনের লেনদেন তিনি আর কিসের জন্য প্রার্থনা করবেন? তাঁর তো প্রার্থনার দরকার নেই।
ধর্মপ্রাণ মানুষটি তাঁর উত্তর শুনে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। আর একটি কথাও না বলে হনহন করে চলে যান। সেদিনও তাঁর কোনো অনুশোচনা হয়নি। যে তাকে অযাচিত উপদেশ দেবে তিনিতো তাকে ঠিক উত্তরটিই দেবেন। নিজের অনুভবের প্রকাশতো তিনি করবেনই।
সেই সকালে তিনি চটি খুঁজে পা ঢোকালেন। এক ঝলক বাতাস তাঁকে ছুঁয়ে যায়। তিনি স্বস্তি বোধ করেন। তখন উমরাও বেগম ঘরে ঢোকেন।
যাক, আপনার ঘুম ভেঙেছে তাহলে?
ভাঙবে না কেন? ঘুম তো আমার ভাঙবেই। তুমি কী আশা করেছিলে—
খবরদার, বাজে কথা বলবেন না। ঘুম পেলে আপনি মরার মতো ঘুমান আপনার প্রচণ্ড নাক ডাকে। সেই শব্দ আপনি টের পান না। আর যখন আপনার ঘুম ভাঙে, আপনি মনে করেন, ঘুমটা বুঝি এলো আর গেল।
হ্যাঁ, তাই তো, এ রকমই ভাবি।
আজ আড্ডা হবে না?
হবে, বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া আমার কাছে দিনের অর্থ মরে যায়। উমরাও, তোমার মতো নারী হয় না।
আমি আমার প্রশংসা শুনতে এখানে আসিনি।
তবে কেন এসেছো?
গরিবুল্লাহ মহাজনের কাছ থেকে যে আপনি ঋণ করেছেন, সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বলে গেছে মহাজনের লোক।
বলবেই, তাকে বলতেই হবে। যে টাকা পায়, সে তো বাড়ি এসে তাগাদা করবেই।
এতই যদি বোঝেন, তাহলে টাকা দিচ্ছেন না কেন?
থাকলে তো দিতামই। আর যা আছে, তা সব দিয়ে দিলে আমার দ্রাক্ষারস কোত্থেকে আসবে বিবি!
এসব আমি বুঝি না। বাড়িতে লোক এসে টাকা চাইলে আমার অপমান লাগে। আমি অপমান সইবার জন্য আপনার সংসারে আসিনি। এই শহরে আমার আব্বা একজন অভিজাত মানুষ। তাঁর মান-সম্মান আছে।
ব্যস, ব্যস, থাম। তুমি তো কবিতা শোনার জন্য আমার সংসারে এসেছো।
না। খবরদার, এসব কথা বলবেন না। আমি আপনার তামাশা বুঝি
চেঁচিয়ে ওঠেন উমরাও বেগম। রেগে আগুন হন। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে চুপসে যান তিনি— মীর্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব। তিনি অভিজাত পরিবারের সন্তান। সে জন্য তাঁর গর্ববোধ আছে। সেখানে ধাক্কা লাগলে তিনি বিপন্ন বোধ করেন। তার চরিত্রের এই দিকটি তাঁর বিবি ভালোভাবে জানেন। সুতরাং আঘাত করার জন্য এটি একটি উত্তম জায়গা। সেই প্রসঙ্গ তুলেই বললেন, ছোটবেলায় আব্বা আর চাচাকে হারিয়ে দাদা আর চাচীর কাছে বড় হয়েছেন। তারা আপনাকে তেমন কিছু শেখাতে পারেননি।
ভুল কথা। তারা আমাকে আমার মর্যাদার জায়গাটি ঠিকই চিনিয়ে দিয়েছিলেন। শোনো আমার কথা। কবিতায় বলছি—আমার পূর্বপুরুষেরা শত পুরুষব্যাপী যোদ্ধা ছিলেন, আভিজাত্যের পদমর্যাদার জন্য আমাকে কবিতা লিখতে হবে না।
ফুঃ, কবিতা। উমরাও বেগম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করেন।
কবিতা দিয়ে আভিজাত্যের মর্যাদা হয় নাকি? বাজে কথা। দিল্লির রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা অনেকেই কবিতা লিখতে পারে। তাদের পেটে রুটি আর আণ্ডা নাও থাকতে পারে। তাতে কী আসে-যায়?
কবিতা লেখার জন্য বাদশাহর দরবারে জায়গা হয় বিবি। আর শৈশবে আমি খেলাধুলা এবং ঘুড়ি উড়িয়ে সময় কাটিয়ে দিতাম। অভিজাত লোকজনের সঙ্গে আমার দাদা আর চাচার খুব যোগাযোগ ছিল। তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। আমার কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি।
ফুঃ, আবার সেই অভিজাতদের গল্প, যা বলতে আপনি ভালোবাসেন। কিন্তু সে কথা বলছেন না কেন যে, তারা আপনাকে কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি। আপনার ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবেননি। আপনি সৈনিক হিসেবে শিক্ষিত হননি, কোনো জীবিকার জন্য শিক্ষা পাননি, এমনকি কোনো সরকারি চাকরির যোগ্যতা আপনার নাই।
আহ, বিবি থাম।
উমরাও বেগম থামেন না। চেঁচিয়েই বলেন, শুধু নওয়াবদের কাছ থেকে ভাতা নিতে শিখেছেন। ঝিরকার নবাব আপনাকে বছরে যে দেড় হাজার টাকা ভাতা দেয়, সেটা আবার আপনার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় আপনাকে।
যে কথাগুলো আমার জানা আছে সেই কথাগুলো তুমি আবার আমাকে বলছ কেন?
বলছি এ জন্য যে, যদি আপনি নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করেন।
তা কখনোই হবে না। অনুশোচনা আমার চরিত্রে নেই।
তা আমি জানি। যেটা আমি জানি, সেটাই আপনি আবার আমাকে বললেন।
হো হো করে হাসেন তিনি। ভাবেন, এও মন্দ নয়। মদ, জুয়া, আড্ডা, কবিতা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় বিবির সঙ্গে ঝগড়া। এই তো বেঁচে থাকা। উমরাও বেগম ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর খিদে পেয়েছে। এখন কাকে বলবেন যে, তার রুটি-মাংস দরকার। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ান। একটু পরই মাংসের ঘ্রাণ তাঁর নাকে লাগে। তিনি বারান্দার কোণে রাখা পানি দিয়ে মুখ ভিজিয়ে নেন। দেখেন, উমরাও বেগম দস্তরখানার ওপর রুটি-মাংসের প্লেট রাখছেন।
আমি জানতাম, তুমি আমার জন্য খাবার আনতে গেছ। তুমি কখনোই আমাকে অভুক্ত রাখতে পার না।
উমরাও বেগম মৃদু হেসে বলেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
ইদানীং তুমি ধর্মকর্মে মন দিয়েছ। দিবেই যার সাতটি সন্তান মরে যায় তার আর অন্য উপায় থাকে না। তাঁকেতো এক জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়।
আপনাকে এ পথে আনতে পারলাম না। উমরাওর বিষণ্ণ কণ্ঠ উপেক্ষা করে তিনি মৃদু হেসে বলেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
উমরাও মশকরা বোঝেন না। তিনি কথা না বাড়িয়ে ঘর ছাড়েন। গালিব বোতল থেকে গ্লাসে সুরা ঢালেন। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরলে তাঁর কাছে কুঠুরির ভেতরের আলো অপূর্ব মনে হয়। এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে আনন্দে ভরে তুলতে হয়। তাঁর জন্য মদ আর কবিতাই শেষ কথা। তিনি গুনগুন করে কবিতা আওড়াতে আওড়াতে বেশ মনোযোগ সহকারে রুটি-কাবাব খেতে থাকেন। একটু পর ছোট সোরাই ভর্তি পানি নিয়ে আসেন উমরাও বেগম। তিনি চোখ তুলে পরিতৃপ্তির আনন্দে উমরাওর দিকে তাকান
তুমি কি খেয়েছ বিবি?
কেমন করে খাব? যার খসম দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়, তার নসিব তো বদনসিব।
ব্যস, ব্যস। আর বলতে হবে না। তুমি খেতে যাও। আল্লাহর দোহাই, আমি বলছি, তুমি খেতে যাও। আজ মাংসের কাবাব তোফা। জিহ্বায় স্বাদ লেগে থাকছে। একটি কবিতা শোনো বিবি—
‘স্বর্গ এই মহাবিশ্বে ধ্বংস ডেকে আনুক,
কিন্তু প্রেমের শপথ আরো, আরো শক্তিশালী হোক।
পাপ, পাপ।’
উমরাও উঠে পড়েন। ঘরের চৌকাঠ ডিঙাতেই তার চটির ফিতা ছিঁড়ে যায়। তিনি সেটা হাতে নিয়ে চলে যান।
এবার রুটি-কাবাব নয়, মদের পেয়ালায় তাঁর মনোযোগ ডুবে যায়। তিনি ভাবেন, প্রিয়তমা, তোমাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভাবলাম, গোলাপের পাপড়ি দাঁতের ফাঁকে রেখে তুমি আসছ। কাছে এলে দেখলাম, গোলাপের পাপড়ি নয়, সে তোমার রঙিন ঠোঁট। তিনি এক চুমুকে পেয়ালার সুরা শেষ করে বলেন, জীবন কি সুন্দর। উল্লাসময় নগরীতে আমি বেঁচে আছি সৌন্দর্যে অবগাহন করে। ধন্য, ধন্য বেঁচে থাকা।
হাসেন তিনি, যেন হাসিতে মুক্তা ঝরে। হাসিতে তাঁর সুদর্শন চেহারা আরো উদ্ভাসিত হয়। তাঁর দৈহিক কান্তির বিচ্ছুরণ এই নগরীর কোথাও কোথাও নারী-হৃদয়ে ঢেউ ওঠায়। তিনি তা বোঝেন, বুঝে-শুনে এগোন। এগোলেই দেখতে পান, বিশাল নীল সমুদ্রের হাতছানিতে আশ্চর্য রংধনু। পানের পেয়ালা আবার ভরে ওঠে। তিনি বলে যান কবিতা-
‘মদিরাতেই জীবন, পেয়ালাটি আঁকড়ে ধরলে
হাতের রেখাগুলো হৃদয়তন্ত্রীর মতো স্পন্দিত হতে থাকে।
খামখেয়ালিপনায় মাতাল করে সাকি
তৃণশয্যায় আমার বাসনাকে বহন করে।’
কল্পিত বিশ্বে মদের ইন্দ্রজাল প্রভাবে নিজের মধ্যে নিজেকে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করা বৃথা
আবার আত্মনিমগ্ন হওয়া, আবার ফুল ফোটানো। আবার দিগন্তে পাড়ি জমানো। তাঁর মাথার ভেতর জলের ঘূর্ণি। সেই জলে দোল খায় আশ্চর্য রঙের পদ্ম। তাকে ধরা যায় না, মুঠির ফাঁক গলিয়ে আবার জলে আছড়ে পড়ে। মাখামাখি হয়ে যায় জল আর ফুলের সৌরভ।
তিনি ভরদুপুরে রাস্তায় নামেন। গনগনে রোদ চারদিকে। একটা ঘোড়ার শকট নেবেন কি-না ভাবছেন। কিন্তু আশপাশে শকটের চিহ্নমাত্র নেই।
রোদে ঘেমে যাচ্ছেন তিনি। ডান হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন। এই মুহূর্তে নগরীর বারবনিতাদের কেউ কেউ তাঁকে দেখলে হাসাহাসি করবে। বলবে, দেখো দেখো, একজন কবিকে কেমন কুৎসিত দেখাচ্ছে। হাঃ, আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনতেই আমি ভালোবাসি। আমার চেয়ে রূপবান পুরুষ আর কে আছে এই নগরীতে!
তিনি নিজের টকটকে গায়ের রং নিয়ে সচেতন হয়ে রাস্তার পাশের গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ান। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগে! ঠাণ্ডা পরশে তাঁর মন প্রফুল্ল হয়ে যায়। তিনি সেই বয়সী জ্ঞানী মানুষটির কথা ভাবেন। তাঁর যৌবনে যিনি তাঁকে বলেছিলেন, ধর্মের নিয়মকানুন আমাকে আনন্দ দেয় না। আমি পাপ-পুণ্যে পূর্ণ। জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে বাধা অনুভব করি না।
হ্যাঁ, আমিও। তিনি আনন্দে গাছের নিচু ডাল ধরে নাড়া দেন। পাপ-পুণ্য আমার কাছেও সমান। আমিও বাধা অনুভব করি না। আমি খাদ্য ও পানীয় নিয়ে খুশির জীবন চাই। শুধু মনে রাখতে চাই যে, আমার পা আটকে যেতে পারে এমন কিছুতে আমি বসবো না। আমি মিছরির ওপরের মাছি হবো।
তিনি দেখতে পান, রাস্তার বিপরীত দিক থেকে শেখ মেহেদী আসছে। তিনিও এদিক থেকে এগিয়ে যান। দুই বন্ধ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন।
আমি তোমার কাছে যাচ্ছিলাম মীর্জা। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
তেমন কোথাও না। ভাবলাম, বারবনিতা দূরকিজানের অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসি।
হ্যাঁ, তোমার জন্য ওদের ঘরের দরজা উন্মুক্ত। ওরা তোমার রূপের প্রশংসা করে। ওরা তোমার কবিতাও ভালোবাসে। তুমি ওদের প্রিয় পাত্র মির্জা।
হা হা করে হাসেন তিনি। হাসতে হাসতে নিজের কবিতা আবৃত্তি করে উত্তর দেন-
‘প্রেম যে ধ্বংসের আয়োজন করেছে তার জন্য আমি লজ্জিত,
একটি গৃহের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছাড়া
আমার বাড়িতে আর কিছু নেই।’
আহ, মির্জা আমরা তোমাকে বুঝি। তোমার কবিতা তোমার মনের কথা বলে দেয়।
গালিব তখন আবার নিজের পঙক্তি আওড়ান-
‘আমরা জীবনের অন্ধকার কক্ষে
পায়ে বেড়ি দেওয়া অবস্থায় আছি,
স্বাধীনতার অর্থ
গ্রানাইট পাথরের ধমনিতে স্ফুলিঙ্গ প্রবেশ করানো।’
ঠিক বলেছ।
তিনি মেহেদীর দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, স্বাধীনতা পাওয়া খুব কঠিন। আপসই কখনো কখনো বড় হয়ে ওঠে। আমার স্ত্রী আমাকে বোঝে না।
বুঝবে কী করে, তোমাকে বোঝা কি সহজ। তুমি তো সাধারণ স্বামী নও মির্জা। চলো, তোমার বাড়ি যাই।
চলো। কিন্তু আমি একটু সমস্যায় আছি।
সমস্যা? কী সমস্যা।
পাওনাদাররা আমার বাড়িতে হানা দিচ্ছে। আমাকে টাকার খোঁজ করতে হচ্ছে। সে জন্য আমি বাড়ি থেকে বের হয়েছি। কোথায় খুঁজব ভাবছি।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। শেখ মেহেদী বুঝতে পারে না, মির্জা আসাদকে কী উপদেশ দেওয়া যায়। বাড়ির কাছাকাছি এলে গালিব মাথা নেড়ে বলেন, এক জায়গায় একটা চেষ্টা করতে পারি।
কোথায়?
ঘরে চলো, বলছি।
নিজের ছোট কুঠুরিতে তিনি জীবনসমস্যার পথ খোলার চিন্তা করতে স্বস্তি পান। নিজ বাড়ি ছাড়া কোন জায়গায় তিনি সমস্যার সমাধান খুঁজবেন? দুরকিজানের গৃহ তো তার আনন্দের জায়গা। উমরাও বেগমের ভাষায়, পাপের জায়গা। আর তাঁর চিন্তায় পাপ-পূণ্যই জীবন।
কী চিন্তা করছো আসাদ?
চিন্তাই মানুষের জীবন। যে চিন্তা করে না, সে জীবনের অর্থ বোঝে না।
এ মুহূর্তে তোমার নতুন চিন্তা কি?
তিনি কবিতার ভাষায় বলেন,
‘ঈশ্বর এক—এটাই আমাদের বিশ্বাস।
সমস্ত শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান আমরা বর্জন করতে পারি,
সমস্ত ধর্মই যখন অদৃশ্য হয়ে যায়
তখনই বিশ্বাস পবিত্র হয়ে ওঠে!’
শেখ মেহেদী হাততালি দিয়ে বলে, বাহবা, বাহবা। দারুণ বলেছ, দোস্ত।
তুমি আমার সঙ্গে একমত?
হ্যাঁ, একমত। শেখ মেহেদী শেষের পঙ্ক্তিটি আওড়ে বলে, সমস্ত ধর্মই যখন অদৃশ্য হয়ে যায়, তখনই বিশ্বাস পবিত্র হয়ে ওঠে। তখন মানুষই সত্য থাকে, নাকি?
হ্যাঁ, তা-ই। মানুষের সত্য থাকাটা জীবনের সবচেয়ে বড় কথা।
শেখ মেহেদী গালিবকে আলিঙ্গন করে। তখন মধ্য দুপুর। তখনো রাস্তাঘাট শূন্য। দু-চারজন মানুষ এদিক-ওদিক যাচ্ছে। দুই বন্ধু হাত ধরে রাস্তা পার হয়। ওদের দীর্ঘ ছায়া রাস্তার ওপরে বিছিয়ে থাকে।
গালিব শেখ মেহেদীর হাত টেনে ধরে বলে, দেখো, আমরা ছায়াহীন মানুষ নই।
আমরা তা হতেই পারি না।
দুজনে হো হো করে হাসে। উড়ে যায় রাস্তার শূন্যতা। যেন রাস্তাটা বাদ্যযন্ত্রের মতো বাজছে। টুংটাং ধ্বনিতে প্রলম্বিত হচ্ছে দীর্ঘ স্বর। মনে হয়, বুকের ভেতর আন্দোলিত হচ্ছে।
দুজনে কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে উমরাওর কণ্ঠ, কে ওখানে?
আমি, আমি দিল্লির কবি।
দরজা খুলে যায়। উমরাও মেহেদীকে দেখে লজ্জায় সরে যান। দরজার আড়াল থেকে বলেন, সারা বিকেল কি লুডো খেলা হবে দুজনের?
দু’জন নয় বিবি। আমার অন্য বন্ধুরাও আসবে। আর তুমি তো জানো, আমরা লুডো খেলি না। নসিব পরীক্ষার খেলা খেলি। আজ আমি ঠিকই জিতব। আমার নসিব সহায় হবে।
তবে তা-ই করেন।
কাপড়ের খসখস শব্দ করে চলে যান উমরা বেগম। গালিব টেবিলের ওপর রাখা সুরাইয়ের ঢাকনা সরিয়ে গ্লাসে পানি ঢালেন। ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করেন। আর এক গ্লাস ঢেলে মেহেদীকে দেন। তারপর নিজের আলখাল্লা খুলে ঝুলিয়ে রাখেন। এতক্ষণে তাঁর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
শেখ মেহেদী মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, শুনলাম তুমি চিফ সেক্রেটারি টমাস থমসনের সঙ্গে দেখা করনি?
গালিব ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, দেখা করিনি তা নয়। তাঁর সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কেন হয়নি এই খবরটি শেখ মেহেদীর জানা নেই। ও জানে যে দিল্লি কলেজে একজন ফারসি শিক্ষকের খুব দরকার ছিল। আর ফারসি পড়ানোর জন্য তিনজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন গলিব নিজে। অন্য দু’জন কবি মোমিন খান ও মৌলবী ইমাম বখশ। মেহেদী খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, কেন দেখা করা সম্ভব হয়নি। টমাস থমসন তোমার পূর্ব পরিচিত। তিনি তোমাকে ভালো জানেন। তাছাড়া দিল্লি কলেজে অধ্যাপনা করলে ফারসি পণ্ডিত হিসেবে তোমার খ্যাতি হতো। তাছাড়া নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা হতো। অর্থ কষ্ট দূর হতো।
মেহেদী আরও কিছু বলতে গেলে তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি অনেক লম্বা বক্তৃতা করছো বন্ধু। আসলে কি জানো, সেদিন আমাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আমাকে খুব দ্রুত ভাবতে হয়েছিল যে কোনটি আগে- আত্মসম্মান না অর্থকষ্ট। আমি ভেবে দেখলাম আত্মসম্মান আগে। ভুলে যেওনা বন্ধু যে আমি কবি। কবিতা লিখে খ্যাতি হয়েছে।
সেদিন কি হয়েছিল?
একদিন থমসন তার অফিসে আমাকে ডাকলো। তুমিতো জানো দোস্ত যে সরকারি অফিসে আমি কুর্সী-নসীন। রেওয়াজ অনুযায়ী তারা এসে আমাকে গেট থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। আমি যথারীতি পালকিতে করে থমসনের অফিসে গেলাম। গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ এলো না। এর আগে যখন গিয়েছিলাম তখন থমসন এসে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। এবার থমসন এলো না। আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছি। এদিকে থমসন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে না দেখে অনেকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বলল, মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ সাহেব আপনি ভেতরে আসছেন না কেন? আজকে আপনার ইন্টারভিউর দিন
আমি বললাম, স্যার, আমাকে কেউ অভ্যর্থনা করে না নিয়ে গেলে আমি কেমন করে ঘরে যাবো?
তিনি বললেন, আমি জানি আপনি সরকারি দরবারে কুর্সী-নসীন। কিন্তু আজকেতো আপনি মেহমান হয়ে দরবারে আসেননি। চাকরিপ্রার্থী হয়ে এসেছেন। আজকে দরবারের নিয়ম আপনার জন্য পালিত হবে না।
আমি অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বললাম, একজন কুর্সী-নসীন হয়ে যে সম্মান আমি পাই তা আমি সব অবস্থাতেই প্রাপ্য বলে মনে করি।
থমসন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমি পারবো না। আমাকে মাফ করবেন।
ঠিক আছে, তাহলে আমি ফিরে যাচ্ছি। আত্মসম্মানই বজায় থাকুক।
আমি পালকিতে উঠে ফিরে আসি।
মেহেদী খানিকটুকু নরম সুরেই বলে, যার মাথার ওপর এমন ঋণের বোঝা, তাঁর কি অভিজাত পদমর্যাদার গরিমা সাজে!
খামোশ, মেহেদী।
গালিব চোখ গরম করেন।
গালিব বুঝতে পারেন, শেখ মেহেদী হয়তো আরো কিছু ঝাড়বে। তিনি নিজেও নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেন না। ভাবেন, মেহেদীর বাড়াবাড়ি আছে। ও এমনই। বন্ধু হলে হবে কী, ছেড়ে কথা বলে না। তারপরও তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। মেহেদী বারবারই তাকে একটি কথা বলে শাসায়, অভিজাতের পমদর্যাদা নিয়েও তোমার দিন এনে দিনে খেতে হয় দোস্ত। ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।
মেহেদী বেরিয়ে যায়।
তাঁর মেজাজ খারাপ হতে থাকে। তিনি চেঁচিয়ে বলেন-
‘আমার হৃদয়ে জীবনের অনির্বাণ বাসনার দাগ,
নির্বাপিত মোমবাতির মতোই কোথাও
স্থান পাবার যোগ্য নই।’
দুটো পক্তি বার বার আওড়াতে আওড়াতে তিনি ভেঙে পড়েন। তাঁর ভীষণ কষ্ট হয়। চেঁচিয়ে বলেন, পানি। কে আছ, আমাকে পানি দাও।
সেদিন তিনি বাড়িতে ফিরে আড্ডা দেওয়ার কুঠুরিতে ঢুকে পড়েছিলেন। উমরাও বেগমের মুখোমুখি হতে চাননি। জানেন, উমরাও বেগমও মেহেদীর মতো তাঁকে কথা শোনাবে। সে কথা বিষের মতো ছড়াতে থাকবে তাঁর শরীরে। সেই বিষ স্পর্শ করবে তাঁর কবিতার জগৎ। ওহ, কী নিঃসঙ্গতা! চারপাশে কত মানুষ, বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত, অপরিচিত— কত জন, তবু তাঁর নিঃসঙ্গতা কাটে না। ভীষণ একা হয়ে যান কখনো, চারপাশের মানুষের কোনো কিছুই তাকে ছুঁয়ে দেখে না। তিনি জোরে জোরে বলে যান নিজেরই কবিতার পক্তি—
‘ঘর ধুয়ে দিতে আমার চোখের জল এমনি অবেলায় যে
দরজা এবং দেয়াল থেকে নিঃসঙ্গতা চুইয়ে পড়ছে।’
এই ঘরে আলো-হাওয়া কম। তবু মনে হয়, প্রকৃতি সদয়। আজ বেশ হাওয়া খেলছে এই ঘরে। তাঁর স্বস্তি ফিরতে থাকে।
সেদিন সে সময়ে ঘরে ঢুকেছিলেন উমরাও বেগম। বলেছিলেন, বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে নিশ্চয়ই?
গালিব তার দিকে না তাকিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ।
টমসনের মতো বিদেশিরা দিল্লির কবিকে সম্মান দেখাতে শেখেনি। বজ্জাত।
তিনি সোজা হয়ে বসে বলেন, আলবৎ ঠিক। মূর্খরা কবির মর্যাদা কী বুঝবে। ঠিক বলেছ বিবি, ঠিক বলেছ।
উমরাও মৃদু হেসে ঘর ছাড়তে গেলে গালিব বলেছিলেন, দাঁড়াও বিবি। তুমি কি আমার পেয়ালায় সুরা ঢেলে দেবে?
উমরাও কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, না। কাল্লুকে ডাকেন।
গালিব এমন রূঢ় আচরণে নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন। তিনি মন খারাপ করেন না। এমন তো হরদমই হচ্ছে। এভাবেই তো দিন কাটছে। তিনি নিজেও তো কখনো এমন রূঢ়ই হন। জীবনতো এভাবেই চলছে। যতদিন বাঁচবেন ঘরে এবং বাইরে এভাবেই চালাবেন। কোথাও কোনো আপস করবেন না। যেমন করবেন না সংসারের সঙ্গে, তেমন দরবারের সঙ্গে, তেমন ধর্মের সঙ্গে। কেউ তাঁকে বশে নিতে পারবে না। দেখা যাক কি হয়।
কয়েকদিন পরে এক বিকেলে এক ঠোঙা রুটি আর কাবাব নিয়ে শেখ মেহেদী আসে। গালিব তখন গজল লিখছিলেন। দুরকিজান একটি গজলের কথা বলেছিল। লিখব লিখব করে লেখা হয়নি। মেহেদীকে কুঠুরিতে ঢুকতে দেখে প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে তাকান, পরে হেসে বলেন, কাবাব আর রুটি? বেশ তো জুয়ার আড্ডা ভালোই জমবে।
তুমিও তো রুটি-কাবাব খাওয়াতে কসুর করো না। তখনও জুয়ার আড্ডা জমে।
গালিব হেসে বলেন, ঋণ শোধ। বহুত আচ্ছা।
কী লিখছো?
গজল, দুরকিজান চেয়েছে।
তিনি একজন সমজদার মহিলা। চমৎকার গজল গাইতে পারেন।
এ জন্য তাকে আমি পছন্দ করি। তার বাড়িতে আড্ডাটা জমে ভালো। সময় যে কোথায় দিয়ে পার হয়ে যায় তা টেরই পাই না।
হুঁ। শেখ মেহেদী গালিচার ওপর হাত-পা ছাড়িয়ে বসে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, গালিবের লেখার সময়টুকু পর্যন্ত। টমসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি তাকে খুব হতাশ করেছে। সেটা এখন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মাঝে মাঝেই বুকের ভেতরে ক্রোধ জাগে। ক্রোধ টমসনকে ঘিরে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি গালিবকে নিয়ে। লোকটি কবি, কিন্তু কবির আচরণ মানে না। তাঁর মর্যাদাবোধ তাঁকে ভুল পথে নিয়ে যায়, তা নিয়ে তিনি সচেতন নন। পরক্ষণে শেখ মেহেদী নিজেকে বলে, আমি আমার মতো করে গালিবকে দেখছি কেন? কেন এমন করে তাঁকে নিয়ে ভাবছি, গালিব গালিবের মতোই। সে নিজে যা সে তাই-ই।
শেখ মেহেদী লুডোর ওপর চালের গুটি নিয়ে ঠোকাঠুকি করে। এক সময় গালিবের লেখা শেষ হয়। তিনিই খাতাটি যত্ন করে গালিচার নিচে রাখেন। সহজে কেউ বুঝতে পারবে না যে ওখানে গজল লেখা একটি খাতা আছে। তিনি শেখ মেহেদীর কাছে এসে বসতে বসতে বলেন, আজকের দিন বেশ গেলো।
মোটেই বেশ যায়নি।
হ্যাঁ, বেশ গেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন।
মেহেদীও জোর দিয়ে বলে, তুমি তা মনে করতে পারো। আমি করি না।
সে তোমার খুশি।
আমার খুশি নয়। একজন কবির জন্য আমার ভাবনা।
গালিব হা হা করে হাসেন। হাসতেই থাকেন।
অনেক হেসেছো। এবার থামো।
আমি ভীষণ অর্থ সংকটে আছি বলে তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ দোস্ত।
হ্যাঁ, দেবোই। আমি তো দেখেছি, তুমি অনেক ফরমায়েশী লেখা লেখো। প্রশস্তির কবিতা লিখতে তোমার আত্মমর্যাদায় বাধে না।
আমি এটাকে আত্মসম্মান হানিকর মনে করি না। কারণ আমার অর্থের দরকার।
মেহেদী উত্তেজিত হয়ে বলে, দিল্লি কলেজে শিক্ষকতা করার ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছিল তোমাকে। তুমি তা অকারণে ভণ্ডুল করে দিয়েছিলে। কি হতো তোমার শিক্ষকতার কাজটির জন্য চেনাজন থমসনের সামনে হাজির হলে? মনে কর সে দিনটির কথা?
গালিব বলেন, আমি তাদের বলেছিলাম কাজটি আমার মর্যাদার জন্য হানিকর।
হ্যাঁ, তুমি তা-ই বলেছিলে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না যে তুমি তা বুঝে বলেছিলে কি-না।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, হ্যাঁ আমি বুঝেই বলেছিলাম। ব্যস, এ নিয়ে আমি আর একটি কথাও বলতে চাই না।
মেহেদী চুপ করে থাকে। গালিব কাবাব-রুটির ঠোঙাটি ছিঁড়ে দুজনের মাঝখানে রেখে বলেন, খাও দোস্ত। আমার বিবি আমাকে আজ কিছু খেতে দেয়নি। হয়তো ঘরে কিছু নেই। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সে কাজটি আমাকেই করতে হয়।
হ্যাঁ, সেটা তোমারই কাজ। কাজটি ঘরের স্ত্রীর নয়। তুমি কি তাঁকে কিছু রুটি আর কাবাব দিয়ে আসবে?
তুমি তো জানো তাঁকে। সে এসব খাবে না। এর চেয়ে শুধু পানি খেয়ে থাকতে পছন্দ করে। খাও বন্ধু। আমার খিদে পেয়েছে।
আবার নীরবতা। তখন এক বোতল সুরা নিয়ে এলেন মুফতী সদরুদ্দিন আজুরদা।
গালিব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আমার বন্ধুরা এমনই। আমাকে যেমন শাসন করে, তেমন ভালোবাসে। একজন এনেছে রুটি-কাবাব, অন্যজন শরাব, দুটোই আমার বেঁচে থাকার জন্য খুবই জরুরি।
সদরুদ্দিন হাসতে হাসতে বলে, শুধু জরুরি নয় বন্ধু। এসবের মধ্যে বেঁচে আছে কবির প্রাণ। আমরা কবিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
বোস বন্ধু, বোস।
গালিব সদরুদ্দিনের হাত ধরে টেনে বসান। সদরুদ্দিন একজন বিচারক। গালিবের কবিতার ভক্ত। এ আড্ডায় আসতে পছন্দ করেন। গালিব তাঁর আনা সুরার বোতল খুলতে খুলতে বলেন, তুমি তো পান করো না। সজ্জন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের সামনে সুরার পেয়ালা হাতে নিলে আমার শরীরে কাঁপুনি ওঠে।
শেখ মেহেদী বলে, জগতে তোমার কাউকে ভয় নেই দোস্ত। তুমি খুব স্বাধীন মানুষ। আপস করতে শেখইনি।
কী যে বলো না! জগতে ভয় করার মতো কত মানুষই তো আছে। যা হোক, আমি জানি মুফতী সদরুদ্দিন এখন আমার কাছে একটা কবিতা শুনতে চাইবে। ঠিক না?
বিলকুল ঠিক।
সদরুদ্দিন আল্লাখাল্লা গুছিয়ে যুত করে বসেন। মেহেদী কাবাব-রুটি খাওয়া প্লেট দুটো ঘরের কোণে গুছিয়ে রাখে। গালিবের কণ্ঠ আস্তে আস্তে উচ্চকিত হতে থাকে-
‘তোমার যদি বিশ্বাস থাকে ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা
মঞ্জুর করবেন, তাহলে কিছুই চেয়ো না,
যদি চাও, শুধুমাত্র একটি হৃদয় প্রার্থনা করো-
যার কোনো ভয় নেই, লক্ষ্য নেই, এবং কামনাও নেই।
সমুদ্রের প্রবল আলোড়ন তটের গাম্ভীর্যকে
অতিক্রম করে।
তুমি সেখানে সাকির মতো মদ ঢেলে দাও,
সংযম কিছুই ধরে রাখতে পারে না।’
দু’বন্ধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে, বাহবা, বাহবা।
আজুরদা বেশ কিছুক্ষণ তালি বাজিয়ে বলে, আমার একটি কবিতায় হবে না। আরও দু-একটি শোনাতে হবে। নতুন লেখা না থাকলে ক্ষতি নেই। আগের লেখাই শোনান, না হয়।
গালিব পুরনো খাতা টেনে বের করেন। পাতা ওল্টাতে থাকেন। একটি পৃষ্ঠায় থেমে বলেন পেয়েছি। এটাই পড়বো। তিনি শুরু করেন :
‘শরীর যখন জ্বলে গেছে আর হৃদয় পুড়েছে সঙ্গে,
তবুও তো তুমি ভস্ম ঘাঁটছ, কী খুঁজছ ওইখানে?
শিরায় শিরায় রক্ত আমার বয়েই চলেছে,
তবু দুই চোখ দিয়ে না-ই যদি পড়ে, কীভাবে রক্ত বলি?
ওই যে রূপসী, যার কথা ভেবে অমরা আমার প্রিয়
কস্তুরী ঘ্রাণ সুরায় কী কাজ সে যদি না থাকে কাছে!
মধুকলসটি দেখলে দু-চার চুমুক দেবই, তবে
বোতল পেয়ালা পানপাত্রের দরকার কিছু আছে?
বলার শক্তি একটুও কিছু বাকি আর নেই আমার
থাকতই যদি, কোন আশা নিয়ে বলি আকাঙ্ক্ষা কী?’
গালিব একের পর এক তাঁর গজল পড়তে থাকেন। দু’জন মুগ্ধ শ্রোতা অনবরত মারহাবা ধ্বনি উচ্চারণ করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন। সময় কেটে যায়। দিল্লির আকাশে জমে ওঠে সময়ের ঘুড়ি নাটাই থেকে খুলে আসে কবিতার সুতো। সে সুতোয় জড়িয়ে থাকে কবির কণ্ঠস্বর। কবির সামনে সময় নেই- তা ঘুড়ির মতো উড়ে যায় অনন্ত আকাশে। আর এই কবিতার জন্য তাঁর প্রতি অনুরক্ত শহরের গুণী মানুষেরা।
.
গালিব একে একে বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েন, যেন তিনি ঘোরের ভেতরে প্রবেশ করেছেন এবং এটাই তাঁর প্রার্থনার ভাষা। সদরুদ্দিন আজুরদা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মুগ্ধ তন্ময়তায় বলেন, এ জন্য তোমার জন্য আমার এত ভালোবাসা দোস্ত। মনে হয় আমার সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে ঘিরে রাখি। খোদাতালা তোমাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুন।
দুরকিজানের অভ্যর্থনা কক্ষে আড্ডা জমে উঠেছে। নগরীর দামী তাওয়ায়েফ সে। যে কারোর এখানে প্রবেশাধিকার নাই। যারা সম্ভ্রান্ত তারাই আসেন। গালিবের অভাব, আর্থিক সংকট সত্ত্বেও দূরকিজানের দরজা তাঁর জন্য উন্মুক্ত। কখনো দূরকিজান লোক পাঠিয়ে তাঁকে যেতে বলেন গজল শোনার জন্য। নিজেও চমৎকার গায়। তার কণ্ঠ মাতিয়ে তোলে অতিথিদের। রাত ভোর হয়ে যায় এক একটি আসর দিয়ে।
কতদিন দেখা গেছে অতিথিরা চলে গেছে। থেকে গেছেন শুধু কবি। দুরকিজানের ইচ্ছায়। সে এক আশ্চর্য সময়ের ভেতর দিয়ে যাত্রা। বিছানায় ফুল ছড়ানো থাকে। চারদিকে আগরবাতি জ্বলে। ফুল ও আগরবাতির সৌরভ লেগে থাকে দূরকিজানের শরীরে। কবি তখন অস্ফুট কণ্ঠে বলতে থাকেন—
‘আমার পাপের মধ্যে পবিত্র জীবন যাপনের দাবি
শতবার মৃত্যুলাভ করেছে।
দুরকিজান তাঁকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে, কার সঙ্গে কথা বলছেন কবি?
সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে।
সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে! আপনার তো সৃষ্টিকর্তা নাই। তাহলে তার সঙ্গে আবার কথা কেন?
সে আমি কাউকে বোঝাতে পারি না ডোমনি। তাহলে শোন কবিতা—
‘ঈশ্বরের করুণা সর্বাত্মকভাবে আলিঙ্গন করে।
যদিও আমি ধর্মহীন এবং
আমাকে পাপের সীমা নেই তবুও আমি
ক্ষমা পাই।’
এতো খোদাতালার কাছে আত্মসমর্পণের কথা। কবি, আপনি অনেক বড় নেকবান বান্দা। আপনি যেভাবে খোদাকে স্মরণ করেন, আর কেউ এভাবে পারে বলে আমার মনে হয় না কবি।
তোমার মতো এমন করে আমার কবিতা কেউ ভালোবাসে না দিল্লি দামী গায়িকা। তোমাকে সেলাম।
বাসে, বাসে। অনেক লোক আপনার কবিতা ভালো বাসে। আপনি দিল্লির অভিজাত মহলে একজন নামকরা লোক। আপনার মতো আর কে আছে!
গালিব প্রবল প্রশান্তিতে ডুবে গিয়ে বলেন, আমার জীবন ধন্য ডোমনি। তোমার এই বিলাসী ঘর, বিছানায় আমি স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যাই। আর তোমার প্রশস্তি বাক্য শুনলে আমার কবিতা লেখা সার্থক হয়ে ওঠে।
আমি আপনার একটা কবিতা বলি?
বলো, বলো হে আমার প্রিয়তমা।
দুরকিজান মৃদুকণ্ঠে বলতে থাকেন—
‘জীবনের প্রতিটি উপাঙ্গেই প্রেম ঈর্ষাপূর্ণ,
মজনুর ছবি আঁকো,
তার প্রবল ছদ্মবেশহীন উত্তেজনা যেন
নগ্ন হয়ে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে।’
গালিব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, বাহ্ বাহ্। আমার গোলাপ। আমার দিনের আলো তুমি। তুমিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখো পাপে ও পুণ্যে।
দুরকিজান গালিবের বুকে মাথা রাখেন। কেটে যায় ভোরের প্রহর। এভাবে কত রাত পার হয়।
এমন রাত কাটিয়ে নগরের আকাশে ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়ান তিনি। বুঝতে পারেন না নিজের এমন ঘুড়ি হয়ে যাওয়ার অর্থ। শুধু বুঝতে চান স্বর্গমর্ত্যের সীমানা কেমন! ওহ, জীবনের এমন সুন্দর সময় আর হয় না। একটি কবিতার জন্মের মতো। তিনি পাখির মতো উড়তে উড়তে নিজের বাড়িতে ফেরেন— যেখানে অভাব আছে, মহাজনের তাড়া আছে, কোতোয়ালের ভয়ে লুকিয়ে থাকার অন্ধকার আছে এবং ঘুমোবার বিছানা আছে। তাঁকে দরজা খুলে দেয় কেউ— তাঁকে ঘরে ঢুকতে সাহায্য করে কেউ। তাঁর সামনে রুটি আর কাবাবের প্লেট এগিয়ে দেয় কেউ। তিনি গালিচার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে শূন্য ছাদে মাকড়সার হেঁটে যাওয়া দেখেন। ভাবেন, জীবন এমনই জটিল স্নিগ্ধ এবং কুৎসিত। জীবন এমনই বড়— ঘর এবং আকাশ। জীবন এমনই গভীর মদ এবং সমুদ্র। তাঁর মনে হলো তাঁর ঘুম পাচ্ছে। তাঁর চোখ বুজে আসছে। ঘরে আলো নেই। হাওয়া নেই। শীত বা গ্রীষ্ম অনুভূত হচ্ছে না। তিনি তলিয়ে যেতে থাকেন— তিনি বুঝতে পারেন তাঁর অঙ্গজুড়ে প্রবল ভালোলাগা। ভালোলাগার তীব্র স্রোত তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। স্বপ্ন দেখেন। তাঁর মনে হয় তিনি নিজের ভবিষ্যতের সময় নিয়ে কোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন। না, তা বোধহয় ঠিক নয়। তিনি কাউকে চিঠি লিখছেন। শুধু ভেতর থেকে উঠে আসছে কিছু কথা, যে কথা তাঁর ভবিষ্যতের দিনগুলোর জন্য তুলে রাখা হয়েছে। সে কথাগুলো তিনি স্বপ্নের মধ্যে আওড়াতে থাকেন, আমার মনে হয় স্রষ্টার অনুরাগীদের মধ্যে হাজারে একজনও আমার মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য, সম্পর্কের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের জন্য ত্যাগ ও উদারতা লাভ করতে পারেনি। আমার শারীরিক শক্তি ফুরিয়েছে। একটি লাঠিও ধরতে পারি না। একটি কম্বল, টিনের কৌটা বা দড়ি নিয়ে হেঁটে সিরাজ, মিসর বা নফজে যাবার সাধ্য নেই। সারা দুনিয়ার শাসক হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি যদি সবার জন্য নিজেকে যোগ্য করতে না পারি তবে যে নগরে আমি বাস করি, দেখতে চাই সে নগরের একটি লোকও খাদ্য ও পোশাক ছাড়া নেই।
তিনি অনুভব করেন তাঁর স্বপ্নের পৃষ্ঠাগুলো সাদা হয়ে গেছে। ওখানে আর আঁচড় কাটা যাচ্ছে না। তিনি তাঁর কুঠুরি থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। রাত। নগরী অন্ধকারে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। যেন নগরী ভীষণ একা। কোথাও কেউ নেই যে তাঁর নিঃসঙ্গতা ভরিয়ে দেবে। তিনি মনে মনে বলেন, আমি এমনই নগরী চাই, যে আমার সবটকু গ্রহণ করবে। বলবে, নিঃসঙ্গতার চেয়ে বড় শক্তি আর কী! বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে শব্দরাজি
রচিত হতে থাকে কবিতা-
‘আমি চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতার মধ্যে বাঁচতে চাই
কারো সঙ্গে বাক্যালাপ নয়,
কাউকেও চিন্তার অংশীদার করতেই চাই না
ছাদ এবং দেয়ালশূন্য বসতি, অথবা
প্রতিবেশীরা ভাগ্য এবং তস্করের জন্য
পাহারা বসাবে, আমি অশক্ত এবং অসুস্থ হলে
কারো যত্ন চাই না, এবং আমার প্রয়াণ ঘটলে
কারো শোক প্রকাশের প্রয়োজন নেই।’
ঘুম ভাঙলে দেখতে পান উমরাও বেগম দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি প্রথমে তাঁর পায়ের অংশ দেখেন, পরে ঊর্ধ্বাঙ্গ। তাঁর চেহারায় বিরক্তির ছাপ। ভ্রূ কুঁচকে আছে। হাতে তসবি। তাঁকে চোখ খুলতে দেখে উমরাও বলেন, কী ব্যাপার গালিচার ওপর ঘুমিয়ে আছেন?
মৃত্যু তো এভাবেই শুতে বলে।
বারবণিতার ঘর থেকে ফিরলে মৃত্যু কাছে আসার তো কথা নয়। সেটা তো আপনার স্বর্গ।
যার ধর্ম নেই, তার আবার স্বর্গ কী বিবি!
তিনি হাসতে হাসতে উঠে বসেন। উমরাওকে যেতে দেখে বলেন, আমার পেয়ালাগুলো ধুয়ে দেবে বিবি?
না। ওসব আমি ছুঁই না। যা আপনি জানেন তা নিয়ে আবার অনুরোধ করেন কেন? কাল্লুতো আছে আপনার কাজ করার জন্য।
তাই তো! ঠিক বলেছো। তুমি কি কিছু বলতে এসেছিলে?
না, শুধু দেখতে এসেছিলাম।
মরে গেছি কি-না দেখতে এসেছিলে?
অতোটা বোকা আমি নই। সাতটি সন্তানের মৃত্যু দেখেছি। মৃত্যু আমার খুব চেনা।
উমরাও বেগম চলে যান। গালিব চুপ করে বসে থাকেন। মনে হয় কে যেন ডাকছে।
গালিব, গালিব দরজা খোল।
কোন দরজা খুলবো? সব দরজা তো খোলা।
তখনও উচ্চারিত হতে থাকে— গালিব, গালিব দরজা খোল।
চারদিক থেকে শব্দ আসে। চারদিক চৌচির হতে থাকে। তিনি কুঠুরির জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে পান না। দেখেন আকাশ ঘরে। কতদিন তোমাকে নিজের মতো করে দেখবো বলে রাস্তায় হেঁটেছি। তুমি তো আমাকে ধরা দাওনি আকাশ– আজ তুমি আমার ঘরে কেন? তুমি কি ভেবেছো আমাকে শিশিরে ভরে দেবে? আমার শরীরে মুক্তার মতো লেগে থাকবে শিশির? বলবে, দুঃখ ভুলে যাও? না, বন্ধু এমন কথা আমাকে বলো না। আমি ফুলের প্রেমে বন্দি পাখি। আমি তো ওড়ার ক্ষমতা হারাইনি। আমি হারাতে পারি না। কারণ আমি জানি মদিরাতেই আমার জীবন। পানপাত্র আঁকড়ে ধরলে আমার কররেখা হৃদয়তন্ত্রীর মতো স্পন্দিত হতে থাকে। তুমি আমার কতটুকু নিতে চাও আকাশ? সবটুকু! না, তুমি আমার কিছুই নিতে পারবে না। আমি আমার সবটুকু নিবেদন করেছি সৌন্দর্যের কাছে। আকাশ, তুমি যদি আমার প্রেমিকা হও তাহলে অত দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, গোলাপ কুঁড়ির মতো তোমার ওষ্ঠাধর এগিয়ে নিয়ে এসো। আমি প্রবল চুম্বনে ভরিয়ে দেই।
গালিব, গালিব দরজা খোল।
আমার তো সব দরজাই খোলা। আমার সৌন্দর্য তুমি ঘরে এসো। আমি তোমার অপেক্ষাতেই আছি। তুমি আমার হৃদয় খুঁড়ো না, সেখানে আগুন চাপা দেয়া আছে। যন্ত্রণা পেতে পেতে আমার হৃদয়ে আগুন জমেছে।
আমি বসন্ত গালিব!
ওহ্, আমার প্রেমিকা! তুমি আমাকে মদের নির্যাস থেকে মদিরতা পেতে দাও। তুমি আমার তৃণভূমির শ্যামলিমা প্রিয়তমা বসন্ত। তুমি আমাকে কোমল ঠাণ্ডা বাতাসের কথা বলতে দাও।
তুমি আমাকে তুলে নাও হৃদয়ে—তুলে নাও শরীরে। যত খুশি ভালোবাসো-ভালোবাসায় ভেসে যাও, আমি তোমারই আছি কবি। আমি তোমার বসন্ত দিন। নগরীর পাতাঝরা দিনের সময় এখন। আহ, প্রিয়তমা বসন্ত, তুমি আছো বলে আমার বেঁচে থাকা। তোমার জন্য আমার নতুন পত্রপল্লব দেখা। পাখির গান শোনা। প্রিয়তমা বসন্ত, তোমার দক্ষিণা বাতাসে আমার বুকভরে শ্বাস নিতে দাও। আমার জন্য কোনো শাসনের বেড়ি তুমি হাতে উঠিও না, প্রিয়তমা।
গালিব, গালিব দরজা খোল।
আমার তো সব দরজা খোলা। তুমি কি দেখতে পাও না?
আমি তো দেখছি তোমার সব দরজা বন্ধ গালিব। আমি তোমার প্রিয়তমা রাস্তা। দিনের বেলায় তুমি আর ছুটে বের হতে পার না। নগরীর রাস্তাগুলো তো তোমার অপেক্ষায় আছে।
চুপ করে থাকেন তিনি। শুনতে পান অনবরত বয়ে যাওয়া শব্দতরঙ্গ। তরঙ্গ ছুটে এসে কল্লোলিত হয় তাঁর কুঠরির মধ্যে। তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন তিনি কত অসহায়। এই নগরীতে তিনি এখন বড় বেশি বিপন্ন বোধ করছেন।
মদের দেনার জন্য মহাজনরা তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করেছে। দেনা তো তিনি করবেনই। কারণ মদ ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। মদ তাঁর জীবনধারণ। মদ তাঁর কবিতা। আর মদ কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা নেই বলে তাঁকে ঋণ করতে হয়। মহাজনরা তো নালিশ করবেই। কারণ তিনি ওঁদের টাকা শোধ করতে পারেন না। এই সরল হিসাবটি তিনি খুব সরলভাবেই বোঝেন। বলেন, আমি তো মদপানের প্রশংসা করি না। মদপানের মহত্ত্ব প্রচার করি না। আমি জানি আমি পাপী। কারণ আমি উদভ্রান্তের মতো মদ পান করি। বেহিসাবী মানুষ। এমন আচরণ ঠিক নয় বলেই মনে করি। তারপরও আমি মদ ছাড়া বাঁচতে চাই না।
তকীয়ুল্লাহ তীব্র ভাষায় বলেন, এভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না তুমি। পাপী হওয়ার মতো ধিক্কারের মানুষ হয়ে লাভ কী? এটা সম্মানের নয়। তুমি মদ্যপান পরিহার করো।
তিনি সরল হাসিতে বন্ধুর ভর্ৎসনা উড়িয়ে দেন। সরলভাবে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলেন, মদপানকে তো আমি দোষের মনে করছি না। বন্ধু, আমার অপরাধ কোথায়?
তকীয়ুল্লাহ বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে বলেন, তুমি কি জানো না মাতালের প্রার্থনা শোনা হয় না?
হা হা করে হাসেন তিনি। হাসতে হাসতে বলেন— বন্ধু, পেয়ালাভরা মদ মজুদ থাকলে প্রার্থনা করার প্রয়োজন হবে কেন?
বন্ধু চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এ লোককে মদ ছেড়ে দেয়ার কথা বলা বৃথা।
তিনি বলেন, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও বন্ধু।
মদ যার পাপ এবং জীবন, তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না।
গালিব বলেন, আমার বন্ধুরা আমার কাছে লাজওয়াব থাকবে কেন? তারাই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাদের ছাড়া তো আমার বেহিসাবী অপচয় পূর্ণ হয় না।
.
গালিব এখন আদালতে। সদরুদ্দিন আজুরদা বিচারক। মদের দেনার জন্য মহাজনদের নালিশের বিরুদ্ধে তিনি বিচারকের প্রশ্নের জবাব দিলেন কবিতায়-
‘আমি ঋণ করে মদ্যপান করি, কিন্তু এটাও জানি
আমার বেহিসাবী খরচের জন্য যে দারিদ্র্য
তাতে আমার ধ্বংস ডেকে আনবে।’
মাননীয় বিচারক আপনি আমার বিচার করুন।
মহাজন উদ্বিগ্ন। কারণ তিনি বিচারকের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখছেন। তিনি কি এই অভিজাত কবিকে প্রশ্রয় দেবেন? নাকি বিচারের রায় তাঁর পক্ষে আসবে? মহাজন ভালো করেই জানেন যে বিচারক কবির বন্ধু। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় গালিবের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বন্ধু বলেই তো আদালতে এমন কবিতার ভাষা। বন্ধু না হলে তিনি কি কবিতা বলতে পারতেন? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তাঁর সময় শেষ হওয়ার আগেই বিচারক অভিযোগকারীর পক্ষে রায় দিলেন।
সদরুদ্দীন আজুরদা আসামিকে বললেন, আপনি দু’দিনের মধ্যে ঋণদাতার ঋণ পরিশোধ করবেন। বিচারের রায় কার্যকর না হলে পরবর্তী বিচারের দিন ধার্য করা হবে।
গালিব শূন্য দৃষ্টিতে বিচারক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অন্যদিকে মহাজন খুশি হয়ে গদগদ স্বরে বলে, হুজুর নায্য বিচার পেয়েছি। হুজুর ন্যায়বান মানুষ। হুজুর শুকরিয়া।
আদালত শেষে আজুরদা গালিবকে বলেন, আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসবেন।
মহাজন সালাম দিয়ে বিচারকক্ষ ছেড়ে যায়। গালিবও বাড়ি ফিরে আসেন।
সন্ধ্যায় তিনিও হাজির হন সদরুদ্দিন আজুরদার বাড়িতে।
আজুরদা মৃদু হেসে বলে, এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। বিচারকের আসনে যখন বসি তখন আমাকে ন্যায় বিচারই করতে হয়।
গালিব চেয়ারে বসতে বসতে বলেন, আমি তোমার সঙ্গে একমত। বিচারকের আসনে বসে বন্ধুর মুখের দিকে তাকাতে হয় না। সেই মুখ তখন আসামীর।
আজুরদা হা হা করে হেসে ওঠেন। বলেন, তুমি একজন সমঝদার লোক। তোমার রসিকতা দিল্লির গুণী মানুষের আসরে আলোচনার বিষয়। সবাই বেশ মজা পায়। সেদিন নাকি তোমার বন্ধু তোমার কাছে জানতে চেয়েছিল, রথ শব্দটি পুরুষ না স্ত্রীলিঙ্গ? তুমি মজার উত্তর দিয়েছ।
হ্যাঁ, আমাদের বন্ধু হাকির যখন প্রশ্নটি করল আমি সহজ উত্তর দিয়ে দিলাম। বললাম, দোস্ত শব্দটা কি তা ভেবে দেখুন। মনে করবেন রথের আরোহী কে। তিনি যদি নারী হন তাহলে সেই রথ হবে স্ত্রীলিঙ্গ। আর আরোহী যদি পুরুষ হন তবে সেই রথ হবে পুংলিঙ্গ।
আজুরদা হেসে বলেন, শব্দের ব্যাকরণ যিনি জানতে চেয়েছিলেন তিনি কোনো উত্তর পাননি। কিন্তু রসিকতা হিসেবে দারুণ। আমরা তোমার স্মার্ট উত্তর শুনে মুগ্ধ।
গালিব ঘাড় নেড়ে বলেন, আমি তোমাদের বন্ধুত্ব উপভোগ করি। এই শহরে আমার বন্ধুরা আছে বলেই আমার দিনগুলো মিইয়ে থাকে না। আমি প্ৰাণ পাই।
আজুরদা হাত বাড়িয়ে গালিবের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আজ কি কবিতা পড়া হবে, নাকি তাওয়াফদের কোথাও আসর আছে।
মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে বললেন, আসর আছে।
আজুরদা একটি ছোট প্যাকেট তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, এই টাকা দিয়ে
কালই ঋণ শোধ করবে। মহাজন যেন দ্বিতীয়বার আদালতে আসার সুযোগ না পায়।
এ ওয়াদা আমি তোমাকে করতে পারবো না বন্ধু। কারণ আমার খরচের কোনো হিসাব নাই। যেদিন হিসাব করবো সেদিন কবি গালিবের মৃত্যু হবে।
ঠিক আছে, এসব কথা আর হবে না। আমরা তোমার পাশে থাকব। শুকরিয়া। তারপর টাকার প্যাকেটটা দু’হাতের মধ্যে রেখে আবৃত্তি করেন :
‘রূপনগরের আদালতে দরজা খুলেছে,
ফৌজদারির বাজার আবার চাঙ্গা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে হাঁকিয়ে আছে এমন অন্ধকার—
পুঞ্জ চুলের সেরেস্তা যে ফলায় অধিকার।
হৃদয়কণা এখন যে এক সওয়াল করে ফের,
কান্না থাকে ফরিয়াদের সঙ্গে মিশে ঢের।
সাক্ষী তলব হয় যে আবার প্রেমপিরিতির মাঝে
হুকুমদারি নইলে চোখের বর্ষা নামে না যে।
মনের সঙ্গে চোখের পাতায় মামলা ছিল জমা-
পেশ হলো যে আজকে আবার সেসব মোকদ্দমা।
গালিব, জেনো, নই অকারণ আত্মভোলা, যার
এমন কিছু আছে— খানিক আড়াল দরকার।’
আজুরদা মুগ্ধ হয়ে অভিভূত কণ্ঠে বলেন, মারহাবা। মাশাল্লাহ।
আনন্দে তাঁর চোখ চিকচিক করে ওঠে। তিনি গালিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বেঁচে থাক বন্ধু। তোমার কবিতা আমার হৃদয়ে অমৃত সমান।
গালিব বিদায় জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। ভেবেছিলেন দুরকিজানের বাড়ির আসরে যাবেন। এমনই কথা ছিল। কিন্তু খানিকটুকু যেতেই পালকির বেহারাদের বাড়িতে যেতে বললেন। ভাবলেন, মহাজনের ঋণ শোধ করার টাকা যদি দুরকিজানের গানের আসরে খরচ হয়ে যায় তাহলে আজুরদার কাছে আর মুখ দেখাতে পারবেন না। বন্ধুর ভালোবাসার অপমানও করা হবে।
গালিব ঘনঘন মাথা নাড়েন। কখনো অস্থিরতা তাঁকে নিরাশাবাদী করে তোলে। কখনো তিনি বিষণ্ন হয়ে যান। নিজের আচরণের বিরুদ্ধে নিজেই নিষ্ঠুর রায় দেন। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চানও না। তিনি জানেন, নিজের ইচ্ছাকে কষ্ট দিয়ে কবিতা হয় না। আত্মাকে লাগামহীন হওয়ার সুখ দিতে হয়। সেটাই কবির দায়।
আজকে তিনি আর নিজের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হলেন না। বাড়িতেই ফিরলেন। পরদিন মহাজনের ঋণ শোধ করে দিলেন।
দিন তো এক রকম যায় না। কিছুদিন নিশ্চিত কাটানোর পরে আবার শুরু হলো ঋণ করা। যে ভাতা পান তার দ্বিগুণের বেশি খরচ করেন। অর্থ নেই বলে ঋণ জমে বোঝা হয়ে যায়। পরিশোধ করা কঠিন। আবার মহাজনরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। কয়েক মাসের মধ্যে মহাজনরা তাঁর বিরুদ্ধে আদালত থেকে ডিক্রি পেয়েছে। এখন ঋণের জন্য তাগাদা নেই। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দিনের বেলায় সম্মানিত ঋণগ্রস্তদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করার নিয়ম নেই। কিন্তু রাস্তায় পেলে গ্রেফতার করা হবে এবং আদালতের অফিসারদের জানাতে হবে।
গালিব ঘরে থাকতে শুরু করলেন। রাতের বেলা বের হয়ে নিজের পছন্দমতো জায়গায় যেতেন। তিনি কুঠরিতে চিৎ হয়ে শুয়ে বলতে থাকেন, প্রিয়তমা রাস্তা, আমি এখন ঘরে অন্তরীণ। তোমার শরীরে আমার স্পর্শের জন্য আমিও দিনের আলোর অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু দরজা আমার খোলা হয় না। প্রিয়তমা রাস্তা, আমি জানি আমার অপেক্ষার দিন ফুরোবে। কোতোয়াল এসে ধরে নিয়ে যাবে আমাকে। আমি মুক্তির অপেক্ষায় জীবনের প্রহর গুনবো শুধু। তুমি আমার পাশে থেকো প্রিয়তমা। তিনি নিজেরই লেখা নিজেকে শোনাতে থাকেন—
‘ভোরের আগে মোমবাতির কম্পিত শিখায়
আমার স্পন্দিত অনুশোচনা, আমারই অসফলপ্রসূ জীবন।
হতাশাই যথেষ্ট মদ,
সাকি আমাকে কী দেয়, গ্রাহ্য করি না,
মাতাল আকাঙ্ক্ষা নদী পেরিয়ে যায়,
তৃষ্ণা প্রশমিত হয় না।’
কবিতা শেষ করে তিনি নিশ্চুপ বসে থাকেন ঘরে। আর একটি কবিতা লেখার কথা ভাবেন। কাগজপত্র গোছান। দোয়াত-কলম সামনে রাখেন। বুঝতে পারেন লেখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু মাথায় কিছু আসছে না। তিনি বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকেন। কোমরের কাপড়ের বেল্টটি নাড়াচাড়া করেন। চিন্তা গোছানোর সময় জামার বেল্টটি তাঁর একটি আশ্রয় হয়। তিনি বেল্টের সঙ্গে খুনসুটি করে পুরোপুরি কবিতার কল্পনায় ঢুকতে পারেন।
সে সময়ে উৎফুল্লচিত্তে ঘরে ঢোকেন তকীয়ুল্লাহ। গালিবের নিমগ্ন ভাব দেখে বুঝে যান যে তিনি এখন অন্য জগতে। কিন্তু গালিবের মনোযোগ ছিল না, বলে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান।
তকীয়ুল্লাহ ভুরু উঁচিতে বলেন, কি করছো দোস্ত?
ভাবনার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। তাছাড়া আমার তো কিছু করার
নেই। আমার বিরুদ্ধে আদালতের ডিক্রি জারি হয়েছে।
আমি জানি। আমিও ভাবছি যে কতকাল এভাবে চলবে।
তিনি তকীয়ুল্লাহর দিকে তাকান না। চুপ করে বসেই থাকেন।
তোমার কী হয়েছে দোস্ত? তোমাকে খুব বিষণ্ন দেখছি।
গতকাল সন্ধ্যায় মুসকেদীন কোতোয়াল আমাকে শাসিয়ে গেছে।
কেন?
বলেছে, আমি যে বাজি ধরে লুডো খেলি, এটা জুয়া খেলা। তিনি যে কোনোদিন এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবেন।
তকীয়ুল্লাহ মাথা নেড়ে বলেন, ওই কোতোয়াল কি নিজের পাহারা সম্পর্কে খুব কঠোর? নাকি তোমার প্রতি ও বিরূপ?
দুটোই। নিজের কর্তব্য বিষয়ে কঠোর বলে আমার এই জুয়া খেলা ও পছন্দ করে না। তাই আমার প্রতি বিরূপ।
তাহলে তো ভয়ের কথা।
হ্যাঁ, আমারও তা-ই মনে হয়। যে কোনোদিন ওই কোতোয়াল এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
তকীয়ুল্লাহ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোমাকে নিয়েও পারা যায় না বন্ধু। কথা বলাতেও মাত্রা রাখো না।
গালিব চুপ করেই থাকেন।
কি হয়েছে এমন ঝিম মেরে আছ কেন? এসো চৌরস খেলি।
আবার খেলা? এসব নিয়েইতো ঝামেলায় আছি
ছাড়ো দোস্ত। বসো। মন ভালো হয়ে যাবে।
সেই ভালো।
দুজনে খেলায় মেতে যায়। এভাবে কয়েকদিন গেলও ভালো। কোনো হাঙ্গামা হলো না। একদিন জমজমাট আসর বসেছে। অনেকে এসেছে। বেশ হইচই-গালগল্প হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে কোতোয়াল ফয়জুল হাসান তাঁর সিপাহীদের নিয়ে জুয়াড়ীদের আসর ঘিরে ফেলে। হুকুম দেয়, হাতকড়ি লাগাও।
গালিব ফয়জুল হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। বলেন, আপনি ভুল করছেন কোতোয়াল সাহেব। আমার বন্ধুরা সবাই শহরের সম্মানিত ব্যক্তি। আমরা নির্দোষ আমোদ-ফুর্তি করছি।
কোতোয়াল কঠোর স্বরে বলে, থানায় চলেন। সেখানেও আমোদ-ফুর্তি করতে পারবেন।
একজন বলেন, আপনি ওনাকে চিনতে পারেননি? উনি মির্জা গালিব। শহরের নামজাদা শায়র। উনি মুশায়রার আসর মাতিয়ে রাখেন।
বাকোয়াস রাখেন। আগে থানায় চলেন। অনেক দিন ধরেই দেখছি এখানে জুয়ার আড্ডা বসে। ধরার চেষ্টায় ছিলাম।
সবার সঙ্গে গালিবও থানায় গেলেন। অন্যরা টাকাপয়সা দিয়ে নিজেদের ছাড়িয়ে নিলেন। গালিব ছাড়া পেলেন না। তাঁকে জেলে ঢোকানো হলো।
মামলা জেলা প্রশাসকের কাছে গেলো। যথারীতি বিচার হলো। তাঁর অপরাধ যে তিনি নিজ বাড়িতে জুয়ার আড্ডা বসান। সুতরাং তিনি দোষী সাব্যস্ত হলেন। ছ’মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও দুশো টাকা জরিমানা করা হলো। জরিমানা না দিতে পারলে ছ’মাস বেশি কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। যদি তিনি পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত জরিমানা দেন তবে তাঁকে ছ’মাস বিনাশ্রমে কারাদণ্ড দেয়া হবে।
গালিবের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় দিল্লির গুণীজনেরা ক্ষুব্ধ হলেন। সামান্য অপরাধের জন্য এমন একজন অভিজাত প্রতিভাবান মানুষকে শাস্তি দিতে হবে এটা উচিত নয় বলে অনেকে মত দিলেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হলো গালিবের মুক্তির জন্য। প্রশাসনের সাফ জবাব, যে বিষয় আদালতের এখতিয়ার সেখানে প্রশাসনের কিছু করার নেই।
ঘটনায় সবচেয়ে মর্মাহত হলেন নওয়াব মুহম্মদ মুস্তফ খাঁ, তিনি শইফতা তখলুসে কবিতা লেখেন। তিনি তাঁর মুক্তির দাবিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাস্তি এড়াতে পারলেন না। মামলার খরচ দিলেন। জরিমানার টাকা দিলেন। নিজে জেলে যান কবির সঙ্গে দেখা করতে।
গালিবের শত্রুরা তাঁকে পরিহাস করলে বলেন, তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে সম্মান করি। তাঁকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের সময়ের বড় কবি। তিনি মদ পান করেন, জুয়া খেলেন, ধার্মিক নন, সংযমী নন— এতো সবাই জানে। আমিও জানি। এসবের জন্য আমার কিছু এসে যায় না। এসব কাজের জন্য আমি তাঁকে অশ্রদ্ধা করবো কেন?
শইফতার এমন তীক্ষ্ণ মন্তব্যে অন্যরা চুপ করে যায়। গালিবের চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও গালিব তাঁর ভীষণ অনুরাগী। জেলখানায় গেলে তাঁর সময় আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে।
মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় এই ভেবে যে আমিনউদ্দিন তাঁর খোঁজ নেননি। অথচ সেই তরুণ বয়স থেকেইতো তাঁর সঙ্গে ভীষণ বন্ধুত্ব ছিল। গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় তিনি নাখোশ হয়েছেন। যাহোক, কি আর করা। ভাবেন, ফজল হক দিল্লিতে নেই। থাকলে ঠিকই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতো। তারপরও তিনি খুশি যে বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আসেন। গল্পস্বল্প হয়, হাসিঠাট্টায় সময় ভালোই কেটে যায়।
তিনি বন্ধুদের বলেন, আমার কাছে যে অর্থ চাওয়া হয়েছিল সে অর্থই যদি থাকবে, তবে তো ঋণ না করে নিজের টাকায় মদ কিনে খেতে পারতাম। এটা করতে পারলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দে থাকতাম।
তাঁর বিনাশ্রম কারাদণ্ড চলেছিল তিন মাস। শুয়ে বসে ঘুমিয়ে তিনি দিব্যি দিন কাটিয়েছেন।
শেখ মেহেদী হাসতে হাসতে বলে, এ তোমার শাস্তি নয় বন্ধু। তবে কী?
মহাজনরা তোমাকে ধরে যদি মারধর করে, সে জন্য তোমাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে।
হাসতে হাসতে বলেন, নগরবাসী দেখুক দিল্লির একজন নামকরা লোককে কীভাবে আটকে রাখা হয়েছে। আমার কী, এতে অভিজাত মহলের মর্যাদাই পুড়ছে। আবার বলেন, আমি বলতে গেলে আরামেই আছি। আমার বন্ধুরা আমাকে দেখতে আসে। তাদের বাধা দেয়া হয় না। আমার বিবি আমাকে খাবার পাঠায়।
আর দামী দামী খাবার পাঠায় তোমার প্রেমিকা।
ঠিক। তিনি মাথা নাড়েন। তার মতো উদার হৃদয়ের প্রেমিকা হয় না। সে আমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
বাহবা, বাহবা। তুমি ভাগ্যবান পুরুষ। তোমার স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না থাকলেও তিনি তোমার জন্য প্রতিদিন খাবার পাঠাচ্ছেন।
ওহ, মেহেদী থামো। তুমি কি আমাকে হিংসা করছো?
হ্যাঁ, একটু করছি। তুমি তো জানো না যে তোমার মুক্তির জন্য সম্রাট নিজে রেসিডেন্টের কাছে লিখেছেন।
তিনি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কোনো খবর আছে?
না। আদালতে মামলাটি স্থগিত আছে বলে কিছু করা যাবে না।
ওহ! তিনি আশাহত হন।
আরো একটি খারাপ খবর আছে দোস্ত!
খারাপ খবর? বলো কী?
আমাদের বন্ধু মির্জা হাতিম আলি বেগের রক্ষিতা চুন্নাজান বেগম মৃত্যুবরণ করেছেন।
তিনি আঁতকে উঠে বলেন, চুন্নাজান! আহা, খুবই ভালো মহিলা ছিলেন। চমৎকার রুচিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। যেমন চমৎকার গান গাইতেন, তেমন বাকপটু ছিলেন। আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা ঘন্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। তাঁকে নিয়ে লেখা হাতিম আলির কবিতাগুলো তিনি আমাকে পড়তে দিতেন। হায় চুন্নাজান!
গালিব চোখ মোছেন।
তুমি দেখছি ভীষণ ভেঙে পড়েছো?
হ্যাঁ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। নগরীর তাওয়াফরা সেরা নারী। তাদের ছাড়া আমরা ফুর্তি করার জায়গা কোথায় পেতাম! তাদের অভ্যর্থনা কক্ষগুলো আমরা আড্ডা, কবিতা পাঠ, সঙ্গীতচর্চার জন্য ব্যবহার করি।
ব্যস থাম। তোমার এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না।
নবাব হাতিম আলি খানের রক্ষিতা ছিলেন মুঘলজান। আমি তাঁর কাছে হাতিম আলির প্রশংসা শুনেছি। তাঁর সাংস্কৃতিক রুচি ছিল অসাধারণ।
আমি যাচ্ছি দোস্ত। তুমি তোমার স্মৃতিচারণ নিয়ে মশগুল থাকো। এখানে তোমার কাজ নেই। কারাগারই স্মৃতিচারণের জন্য উত্তম জায়গা।
তোমার হলো কি মেহেদী?
আমার কিছু হয়নি। একটু পরে সাদউল্লাহ আসবে তোমাকে সঙ্গ দিতে। ওর সঙ্গে আমার বাজারে দেখা হয়েছে।
তকীমীরও আসবে। কাল ও আমাকে বলে গেছে, এক বোতল সুরা ও আমাকে উপহার দেবে।
মনের সুখে পান করো। আসলে তোমাকে তো শাস্তি দেয়া হয়নি। আনন্দ উপভোগের সময় দেয়া হয়েছে। খুশনুর, মুঘলজান, বাহারজানকে আসতে দিলে তোমার আসর জমজমাট হয়ে যেতো।
গালিব হাসতে হাসতে বলে, আমার জন্য সেই প্রার্থনাই করো বন্ধু।
শেখ মেহেদী পেছন ফিরে তাকায় না। বারবণিতাদের আসরে যাওয়ার সুযোগ ওর হয়নি। ও তো গালিবকে ঈর্ষা করবেই। ঈর্ষায় ওর বুক পোড়ে। ও তখন গালিবের কবিতাই বলতে বলতে পথ হাঁটে-
‘একটি গান গায়কের কণ্ঠে আশ্রয় নেয়,
পরমানন্দের জন্য মদের কোনো প্রয়োজন নেই,
চূড়ান্ত পাপী হও এবং তোমার মাথা
পুণ্যের প্রাচুর্যে অবনত হোক।
আহ্ গালিব, তুমিই পারো পাপকে পুণ্যে পরিণত করতে। আহ্ গালিব, তুমিই সেই পাপী যে পারো পুণ্যের প্রাচুর্যে ডুবে থাকতে। তোমার মতো এতো ক্ষমতা আর কার বা আছে? তুমি কুঠুরিতে ঢুকে থাকতে ভালোবাসো। সমাজ দেখো না। অনাচার দেখো না। তোমার কোনো সামাজিক দায় নেই গালিব। এমনই চোখ বোজা মানুষ তুমি।
গালিব তখন কয়েদিদের আড্ডায় তুমুল জমিয়েছে। হাসতে হাসতে পাশে বসে থাকা অন্য কয়েদিকে বলে – বুঝলে হে, মানুষ যখন একলা থাকে তখন সে চিন্তার সমুদ্র হয়। আমাকে বলো তো, তুমি কেন এখানে এসেছো?
চুরি করেছিলাম। চুরি করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।
এই যে তুমি উপায় ছিল না বললে, এটাই তোমার চিন্তা।
কয়েদি ভুরু কুঁচকে বলে, পেট ভরে রুটি খেতে না পারলে চিন্তা দিয়ে কী করবো? এই চিন্তা আর বেশ্যাবাড়িতে যাওয়া এক কথা।
কী বললে? গালিব চমকে তাকান।
কয়েদি একই ভঙ্গিতে বলে, আমি তো এমনই চিন্তা করি।
তিনি চুপ করে যান। কথা বাড়ান না। তাঁর খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তখন তিনি মনে মনে হাতিম আলির জন্য একটি লোকগাথা রচনা করতে থাকেন— বন্ধু শোক করো না। মৃত্যু আমাদের শোকার্ত করে। করবেই তো। প্রেম যে অনিঃশেষ। তুমি মনে করো লায়লী-মজনুর কথা। মজনু বেঁচে থাকতেই লায়লী মারা যান, তোমার প্রেমিকাও তোমার জীবিত অবস্থায় মারা যায়। একদিক থেকে তুমি মজনুকে ছাড়িয়ে গেছ। লায়লী তার নিজের বাড়িতে মারা গিয়েছিলেন আর তোমার প্রেমিকা তোমার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তুমি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান বন্ধু। তবে কি জানো মুঘলরা কিন্তু ভয়াবহ। যাদের ভালোবাসার জন্য আমরা মরতে চাই তাদেরই আমরা মেরে ফেলি। আমি জনা থেকেই মুঘল, আমার জীবিত অবস্থায় একটি ডোমনির মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী সে হৃদয়ের ওপর প্রবল আঘাত হেনেছে। আমাকে শোকে বিহ্বল করেছে। খোদাতালা তোমার এবং আমার প্রতি ক্ষমাশীল হোন। এ মৃত্যুর জন্য আমাদের হৃদয়ে রক্তপাত হয়েছে। ওই বন্ধু, আমরা যারা ভালোবাসতাম মৃত্যু তাদের পৃথক করে দিয়েছে। কখনোই ভুলতে পারি না সে মৃত্যুকে। মৃত্যুই আমাদের প্রেম। প্রেমই ঈশ্বর।
রচিত হয় কবিতা— আমি সেই অবস্থা থেকে মুক্তি কামনা করি, যখন আমি প্রেমিকার চিন্তায় ডুবে থাকি দিন এবং রাত— সব সময়।
ভাবনার শেষে তিনি আকস্মিকভাবে হেসে ওঠেন।
কয়েদি অবাক হয়ে বলে, হাসছেন যে?
প্রেম। প্রেমের জন্য হাসছি। তোমার প্রেমিকা আছে বন্ধু?
প্রেমিকা? না তো। আমার ঘরে বিবি আছে। আমাকে খুর ভালোবাসে।
বিবি, বিবি–
তিনি পরেরটুকু শেষ করেন না। তিনি তো বিবির ভালোবাসায় সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি লোকটির মতো বিবির ভালোবাসায় জীবন কাটাননি; বরং বিবাহিত জীবন তাঁর কাছে শৃঙ্খলের মতো মনে হয়েছে। বন্দি জীবনের আক্ষেপ তাঁকে মরমে মেরেছে। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে শৈশবে ফেলে আসা যমুনা নদীর কথা ভাবেন। তাঁর জন্মস্থান আগ্রার কথা ভাবেন। আবার ফিরে আসেন জেলের চার দেয়ালের ভেতরে। কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো— একদিন ভুলেই তো যাবেন এসব মানুষের মুখ। পরক্ষণে অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলে ভাবেন, আমার চোখ থেকে হৃদয় পর্যন্ত প্রদীপ্ত। প্রেমিক ও প্রেমিকার মিলন আলোর উৎসব। এভাবেই আমার শেষ। আমার বেঁচে থাকা।
তিন মাসের মধ্যে তিনি কারামুক্ত হন। বন্ধুরা তাঁকে নিতে এসেছে। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে আনন্দ নেই। এভাবে জীবনের আলোছায়ায় তাঁর বিস্তার।
শেখ মেহেদি বলে কি হয়েছে দোস্ত? তুমি উৎফুল্ল নও কেন? জীবনের শেষটুকু দেখার জন্য বর্তমান যথেষ্ট নয়।
তুমি কি আবার বাজি ধরে লুডু খেলবে?
খেলব।
কোতোয়াল বলবে, ওটা জুয়া খেলা।
আমিও জানি ওটা জুয়া খেলা।
কোতোয়াল আবার এসে তোমার কুঠুরিতে হানা দেবে।
গালিব হেসে বলেন, আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবে এই তো। যাবে। ধরতে দাও বন্ধু।
তিনি এখন ঘোড়ার শকটে। খোলা শকটে বাতাসে তাঁর চুল উড়ছে। তাঁর সুন্দর চেহারা রৌদ্র তাপে স্নিগ্ধ। তার মগজের কোষে খেলে বেড়ায় রৌদ্র- হাওয়া। তিনি বুনে চলেন ভাবনা, গভীর থেকে গভীরতর হয় আকাশের নীল- আমার জন্য তুমি ভয় পাচ্ছ, কেঁপেও উঠছ, উদাসীন থাকার অভ্যাস তোমার কোথায় গেল? তুমি যদি না চেয়ে থাক যে হৃদয়ে দুঃখের ঝড় বয়ে যাক, তাহলে তুমি আমার দুঃখের অংশী হতে চাইলে কেন? তুমি কেন ভেবেছিলে যে আমার দুঃখের সঙ্গী হবে যখন আমার প্রতি অনুকম্পা তোমার নিজের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াবে? তুমি বিশ্বস্ততার শপথ করো, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই শপথে বিশ্বাসী থাক। জীবনই যেখানে নশ্বর, সেখানে এ শপথ সত্য হবে কি করে। আমাকে লজ্জা দেওয়ার ভয়ে তুমি নিজেকে মাটির পর্দার আড়ালে রেখেছ। প্রেমে গোপন মর্যাদা এর চেয়ে বেশি কীভাবে রক্ষা হতে পারে। তোমার গোলাপ ছড়ানো গৌরব এবং সৌষ্ঠবের অবসান ঘটেছে। এখন তুমি ফুল দিয়ে ধুলো আঁকো — ধুলোকে ভরিয়ে দাও ফুলের পাপড়ি দিয়ে। এখন আমার কাছে জীবনের জলবায়ু কারাগারের মতো, তুমি এই জলবায়ু সইতে পারলে না। যে হাত সৌন্দর্যের চাবুক ঘোরাত, তা এখন অক্ষম। প্রেমের রহস্যময় দীপ্তি ধুলোয় লুটিয়েছে, আহা পৃথিবী থেকে বন্ধুত্ব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। চোখ যেখানে নক্ষত্র গুনতে অভ্যস্ত সেখানে বর্ষার অন্ধকার রাত কীভাবে কাটবে? কোনো ভালোবাসার কথা শোনে না, চোখ সৌন্দর্যের দৃশ্য দেখে না, কীভাবে একা একটি হৃদয় এ বঞ্চনা সহ্য করতে পারে। নিয়তি কি চেয়েছিল দিল্লিতে আমি এই অপমান সহ্য করব? আহা, আহা!
তকিয়ুল্লাহ মৃদুকণ্ঠে বলে, কী হয়েছে? তোমার চোখ ভিজে যাচ্ছে?
নিয়তি কি চেয়েছিল দিল্লিতে আমি এই অপমান সহ্য করব?
বন্ধু তোমার কবিতা দিয়ে বলি, বাতাসে মদ আছে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াই পান করা।
এভাবে কি অপমান ধোয়া যায়?
যায় না। তকিয়ুল্লাহ হাত ঝাঁকুনি দেয়। তুমিই তো বলো, যদি আমি শপথ করি যে মদ স্পর্শ করব না, সাকি কেন পানপাত্র পূর্ণ করার মধুর কর্তব্যের কথা ভুলে যাবে?
হাসেন তিনি। বলেন, ঠিকই তো বলি। সাকির কর্তব্য তো সাকিকে মনে রাখতে হবে। আমার শপথে সাকির কি এসে যায় বন্ধু!
দিল্লির রাস্তায় ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ হয়। রাস্তার দু’পাশ দিয়ে চলাচল করে মানুষ। বাতাসে ধুলো উড়ে। মেঘের আড়ালে সূর্য ঢেকে পড়লে ম্লান হয়ে আসে রোদের ছায়া। কোথাও কোনো পাখি নেই কেন? তার তো সবচেয়ে প্রিয় পাখি কাক। কাকই বা কোথায় গেল? কাকেদের প্রিয় শহর দিল্লি, এটা আমার বিশ্বাস।
শেখ মেহেদি তাঁর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, ধ্যান ভাঙ বন্ধু। আমরা এসে গেছি।
.
তিনি এখন তাঁর প্রিয় কুঠুরিতে।
অনুভব করেন বন্ধ কুঠুরি গুমোট। বন্ধুরা ঘরের জানালা খুলে দিচ্ছে। এই তিন মাস এই ঘরে হাওয়া খেলেনি। এখানে জুয়া খেলা হয়নি। মদের আসর বসেনি। বন্ধুদের আড্ডায় তর্ক ওঠেনি। গজল গাওয়া হয়নি। কবিতা পাঠ হয়নি।
ওহ, মাংসের ঘ্রাণ আসছে। উমরাও বেগম তাঁর প্রিয় খাবার মাংস আর রুটির আয়োজন করেছে। ভালোই জমবে দুপুরের খাবার। শুধু দরকার এক বোতল সুরা। সেটা তো উমরাও বেগমের কাছে আসা করা ধৃষ্টতা। তাঁর বিবি হয়ে উমরাও বেগম শুধুই পাপের ভাগি হয়েছে। সে এই পাপে আর জড়াতে চায় না। আহা, বেচারী! দুঃখভরা জীবন টানতে টানতে টানতে…। ।
গালিব আর ভাবতে পারলেন না। কারণ উমরাও বেগমের সঙ্গে মিলে জীবন কাটেনি, কেটেছে অমিল আর কলহের জীবন। হ্যাঁ, এমনই নিয়তি। এই শহরের মতো ধুলো আর কংক্রিটে ভরা। রুক্ষ আর প্রখর।
তখন দরজার বাইরে টাঙা থামার শব্দ হয়। টাঙাওয়ালার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। বাড়ির কারো সঙ্গে কথা বলছে বোঝা যায়। নিশ্চয়ই লোকটি শহরের কোনো পরিচিত টাঙাওয়ালা, তিনি ভাবলেন। দরজায় টুক টুক শব্দ হয়। দরজা খোলে তকিয়ুল্লাহ। টাঙাওয়ালা বাঁকা হয়ে কুঠুরিতে ঢুকে বলে, আপনার জন্য এই সুরার বোতল উপহার পাঠিয়েছেন মুফতি হুজুর!
বোতলটি নিতে নিতে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, আজুরদা, ওহ আজুরদা। ও আমার এত ভালো বন্ধু যে আমার জীবন ধন্য। তুমি ওকে আমার শুকরিয়া জানাবে ভাই।
বেরিয়ে যায় টাঙাওয়ালা।
তিনি বন্ধুদের হাত ধরে বলেন, বোস। এক পেয়ালা হয়ে যাক।
আজ না, আরেকদিন। তোমার সঙ্গে তো বেগম সাহেবার দেখা হয়নি। আমরা আজ আসি দোস্ত।
দু’জনে বেরিয়ে গেলে তিনি খানিকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে হয় তিনটি মাস এই ঘর থেকে হারিয়ে গেছে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগছে এই ঘরে। উমরাও বেগম ঘরে ঢোকেন। হাতে মাংস-রুটির প্লেট।
তুমি কেমন আছ বিবি?
উমরাও বেগম মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, ভালো থাকব না কেন?
সে তো ঠিকই। ভালো থাকবে না কেন। ভালো না থাকার তো কোনো কারণ ঘটেনি।
তাহলে জিজ্ঞেস করলেন যে?
অভ্যেস। অভ্যেসের বশে। জানো বিবি, অস্তিত্ব নিজেকে অদ্ভুতভাবে বিক্রি করে, প্রতিবারই বাজারে হৃদয়ের দাম কমে যায় এবং তিক্ত হাসির উদ্রেক হয়।
এসব শের আমি বুঝি না।
কিন্তু এটা তো বোঝ যে আমি তোমার তিক্ত হাসি উদ্রেক করার মতো একটা প্রশ্ন করেছি?
উমরাও বেগম নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকেন। তিনি রুটি-মাংসের রেকাবিটা নিতে নিতে বলেন, দাও, আমার খিদে পেয়েছে। আমার পেয়ালা দুটি কোথায়?
সরিয়ে রেখেছিলাম। কাল্লু এনে দেবে।
.
পুরো এক দুপুর মদ-রুটি মাংস খেয়ে তিনি নিজের ঘরে ঘুমাতে যান। ভাবেন পৃথিবী আশ্চর্য সুন্দর। দিল্লি শহরের বাইরে শুধু রুক্ষ প্রান্তরই নেই, একটি সমুদ্রও আছে। সেটা সবাই দেখতে পায় না। দেখতে পায় শুধু কবি।
তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যান।
রমজান মাস। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সংযমের মাস হিসেবে খুব তমিজের সঙ্গে পালন করে। শহরের মহল্লায় মহল্লায় ইফতারের আয়োজন। মসজিদে তারাবির জমায়েত। তিনি ভাবেন, মাসটা এলে নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগে। শহরের এসব ব্যাপারে তিনি নিজেকে জড়ান না, কিন্তু শহরের বদলে যাওয়া চেহারা তাকে আনন্দই দেয়। তিনি কুঠুরিতে বসে বাজি ধরে লুডু খেলে সময় কাটান। বন্ধুদের কেউ কেউ আসে। সবাই না।
শুক্রবার দিন এমন খেলার আসরে এসে ঢোকেন মুফতি সদরুদ্দীন। এ মাসেও গালিব এসবের মধ্যে ডুবে থাকবেন, এতটা তিনি ভাবেননি।
ভেতর ঢুকে তিনি থমকে দাঁড়ান।
ভ্রূ কুঁচকে বলেন, আমি হাদিসে পড়েছি রমজান মাসে শয়তানকে বন্ধ করে রাখা হয়।
গালিব হেসে বলেন, বসো বন্ধু, বসো।
সদরুদ্দীন জায়গা থেকে না নড়েই বলেন, হাদিসে ঠিক কথা লেখা হয়েছে কি-না এ নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
আমার বন্ধু, হাদিস একদম খাঁটি। এ নিয়ে প্রশ্ন করা ঠিক হবে না, তুমি বুঝে নাও যে শয়তানকে এ ঘরেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দেখতেই তো পাচ্ছ যে শয়তান তার কর্ম করছে।
বন্ধুরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি হাসতে হাসতে লুডুর ছকের ওপর ঝুঁকে থাকেন একটু সময়। তারপর মুফতির হাত ধরে টেনে বলেন, বসো বন্ধু। একটি কথা বলি। বলো না যে শয়তানের আবার কথা কি শুনব।
না, না বলো।
তিন মাস জেলে থাকার কারণে আমার ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে নওয়াব…। না, থাক নামটা আর বলছি না। বাড়ি এসে দেখি ঘরে টাকা-পয়সা নেই। আটা- ময়দার টান পড়েছে। ঘি কেনার টাকা নেই। গতকালই পোশাকের আলমারিটা বিক্রি করে দিলাম। কিছু টাকা হাতে এলো। বিবির হাতে দিলাম। বুঝলে বন্ধু লোকে রুটি খেয়ে বেঁচে থাকে, আমি পোশাক খেয়ে বাঁচি।
আবার হাসি।
মুফতি মৃদু হেসে বলেন, এতকিছুর পরও তোমার পরিহাসপ্রিয়তার কমতি নেই।
বাঁচা তো এমনই বন্ধু। জীবনকে তিক্ত করে বাঁচতে চাই না আমি। তারপর মুখে মুখে শের রচনা করে বলেন,
‘প্রণয়পাত্রীকে দেখার স্বাদু আনন্দ আমার নেই।
এমনকি তার স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে গেছে।
আমি এমন একটি বাড়ি, যা এমন আগুনে
পুড়ে গেছে যে সবই ভস্মীভূত।’
এতো তোমার হতাশার কথা।
হতাশাও জীবন।
মুফতি গালিবের হাত ধরে বললেন, আজ যাই। আগামী দিন দেখা হবে। কিংবা অন্য কোনো দিন।
গালিব গভীরভাবে হাত চেপে ধরে কবিতার ভাষায় বলেন,
‘সব সম্পর্ক ছিন্ন করো না বন্ধু;
আর যদি কিছু না থাকে তো শত্রুতাই থাক।
শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বই থাকবে বন্ধু।
চলে যান মুফতি সদরুদ্দীন।
গালিব আবার খেলায় মত্ত হয়ে যান।
তবে রমজান মাসে মদ্যপান ও জুয়া খেলা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয় তাঁকে।
আবার ঘনায় রাত। আসে দিন। আবার সূর্য ওঠে। রোদ বাড়ে। রুক্ষ প্রান্তরে চৌচির হতে থাকে মাটি। তিনি বুঝতে পারেন ঋণ আর অনটনে চৌচির হয়ে যাচ্ছে জীবন-মাটি। তিনি রামপুরের নবাবের কাছে তাঁকে বরাদ্দ মাসিক ভাতা বাড়ানোর জন্য আবেদন করছেন। কুঠুরির স্বল্প আলোয় লিখছেন আবেদনপত্র। আগেও লিখেছেন। কতবারই তো লিখলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। রামপুরের নবাব যা দিতেন তার বেশি একটি টাকাও বরাদ্দ হলো না।
লিখতে লিখতে কলম থেমে যায়। নিশ্চুপ বসে থাকেন। বেলা কত বেড়েছে, কিন্তু উমরাও বেগম তখন পর্যন্ত কিছু খেতে দেননি তাঁকে। খিদের যন্ত্রণায় কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ঘরে একফোঁটা মদও নেই।
এক টুকরো রুটির সঙ্গে কবিতার অনুভব বড়ই বেদনার- তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে পড়ল কবি জওকের মুখে শোনা শেরটির কথা— অত্যন্ত প্রিয় সে শের, কোনো এক মুশায়রার শুনেছিলেন— ‘এখন তো অস্থির হয়ে বলি মরে যাব। মরেও যদি শান্তি না পাই তবে কোথায় যাব।’ কি আশ্চর্য, কঠিন কথা, এমন করে উর্দু কবিতায় আর কে বলতে পেরেছে। তিনি উঠে পায়চারী করেন। ভাবেন, সাহিত্য যখন চটকদার শব্দে ভেসে যাচ্ছিল, কবিতায় অলঙ্কারের বাড়াবাড়ি, মেকি আবেগের উচ্ছ্বাস তখন এমন একটি শের উপহার দিয়েছিল কবি জওক। কেউ কেউ এমন আগুনের ফুলকি। তারা তো ইতিহাসের পাতায় টিকে যাবেন। তিনি পায়চারী করতে করতে চেঁচিয়ে বলেন, ‘হে ঈশ্বর কাল আমাকে মুছে ফেলছে কেন? পৃথিবীর পৃষ্ঠার ওপর আমি বাড়তি হরফ তো নই।’ হা-হা-হা-হা হাসিতে ভরে যায় ঘরের সবটুকু বাতাস, মিশে যায় হাসির ধ্বনি।
উমরাও বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, কি হয়েছে আপনার?
তিনি ফিরে দাঁড়ান যেন ডোমনি এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর পরপার থেকে।
উমরাও আবার বলেন, কি হয়েছে? হাসছেন কেন?
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, আমার শ্বশুরকে মনে করছি।
হঠাৎ আমার আব্বাকে স্মরণ কেন?
তিনি বেঁচে থাকলে আজ আমাকে শুধু এক টুকরো রুটি খেয়ে-
ব্যাস, খামোশ। আব্বাজানই আপনাকে দিল্লিতে এনেছেন।
হ্যাঁ, এ জন্যই আজ আমি কবি গালিব, এটা তুমি ভেবো না। গালিব হয়ে জন্ম নিয়ে আমি সময়ের বড় কবিই হতাম। এই সময়ে আমার চেয়ে বড় কবি দিল্লিতে আর কেউ নেই।
অহঙ্কার ভালো নয়। খোদাও সইবে না।
চলে যান উমরাও বেগম।
অহঙ্কার? অহঙ্কার তো আমার মাথার মুকুট। ‘বাসনার নিত্যনব রঙের দর্শক আমি; আমার বাসনা কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা, অবান্তর সে কথা।’ তখন তিনি আল্লাহকে স্মরণ করে বলেন, তুমি তো সব দিতে পারো। তাহলে আমি চাইব না কেন? আমি সব চাইব। আমার সব চাই। আমার প্রার্থনাকে তুমি সেই সাহস আর শক্তি দাও।
ঘরে হাওয়া বয়ে যায় না। দরজা বন্ধ। বাইরে ভীষণ সময়। এই পোড়- খাওয়া নগরীতে একদিন প্রেমের বারুদ জ্বলে উঠেছিল। ডোমনি তাঁর প্রেমে পড়েছিল। সেই নারী হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, তুমি এত সুন্দর কেন? দেখে তৃষ্ণা মেটে না।
আমি তখন যুবক। নারীর স্তুতি বাক্যে দিশেহারা। পর্দাপ্রথার জন্য নারীদের দেখা যেত না রাস্তায়। প্রেম করার সুযোগ ছিল না। বারবনিতারা ভরে রেখেছিল শহরের নাচঘরগুলো। আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল ডোমনি— অপূর্ব সুন্দর। মায়াকাড়া সবটুকু আবেদন নিয়ে সে আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছিল। হায় খোদা, তারপরও আমি তাঁকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই। ও অন্যসব প্রেমিককে ছেড়ে আমার কাছে এসেছিল। বলেছিল, তুমি ছাড়া আমার দুনিয়ায় আর কেউ থাকবে না। ডোমনি ওর প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। আমি রাখিনি। রাখতে পারিনি। আমার নেশা জমে উঠেছিল। পকেট সচ্ছল ছিল। তাই রূপে-গুণে-গানে-নৃত্যে সেরা বনিতাকে পাওয়া আমার লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। আমি তাদের কাউকে পাওয়ার জন্য তাদের মাহফিলে যাতায়াত শুরু করি। আমার বিশ্বাসঘাতকতায় অকালে মারা যায় ডোমনি। আমি এভাবে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করি। সত্য স্বীকার করতে আমি দ্বিধান্বিত নই। খোদা আমাকে বাসনা পূরণের সাহস দিয়েছেন। আমি তো আমার মতো দুনিয়া দেখবই।
পরিচিত টাঙাওয়ালার কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তারপর দরজায় টুকটুক শব্দ। দরজা খুললে বিগলিত হাসি হেসে বলে, সেলাম হুজুর।
এক বোতল সুরা এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনার তাওয়ায়েফ।
বুঝেছি কে পাঠিয়েছে। তাকে আমার শুকরিয়া জানিও।
তিনি দ্রুত দরজা বন্ধ করেন। শহরের হট্টগোল প্রতিদিন বাড়ছে। দরজা খুলে রাখতেও ভয় পান তিনি। বোতলে চুমু দিয়ে বলেন, বারবনিতার রূপের গরব এই শহরকে তাদের কাছে নিয়ে যায়। তারা কখনো প্রেমিকের গৃহে প্রবেশ করে না। তাদের নাচঘরে সান্ধ্য মজলিসের আড্ডা জমে। শহরের অভিজাতরা সেখানে ভিড় জমায়। যারা ঘনিষ্ঠ প্রেমিক তারা অন্য সময়েও সেসব গৃহে থাকতে পারেন। তিনিও পেরেছেন। তার জন্য কারো কারো টান ছিল। তার অপরূপ কান্তি তাকে এমন সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি মদের পেয়ালার জন্য ভেতরের ঘরে ঢোকেন।
উমরাও বাঁকা চোখে মদের বোতলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কে পাঠাল?
আমার বন্ধুরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
আমি জানতে চাইছি শহরের কোন নাচনেওয়ালি, গানেওয়ালি-
আহ্ বিবি, দাম্পত্য প্রেম উপভোগ করা আমার ভাগ্যে ছিল না-
সংসারকে যে কারাগার ভাবে তার আবার দাম্পত্য প্রেম ভোগ!
আমি আমার মদের পেয়ালা নিতে এসেছি।
ওই যে ওই কোনায়। আমার বাসনপত্রে যেন হাত না লাগে।
আমি জানি তুমি আমাকে খুবই অশুচি ভাবো।
আমি মদ্যপানকে ঘোরতর গুনাহর কাজ মনে করি।
তিনি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে দাঁড়ান। বলেন, “যে পাপ আমি করেছি তার জন্য যদি শাস্তি ধার্য থাকে তবে, হে ঈশ্বর যে পাপ আমার সামর্থ্যের বাইরে ছিল বলে করতে পারিনি অথচ তার জন্য খেদ রয়ে গেছে মনে, তাও তোমার কাছে একটু সাধুবাদ পাক।’ তারপর শের পড়ার ঢঙে বলেন, ‘আয়ুর মেয়াদ আর দুঃখের বন্ধন আসলে তো একই। মৃত্যুর আগে মানুষ দুঃখ থেকে ত্রাণ পাবে কেমন করে?’ বিবি আমি দুঃখ থেকে ত্রাণ পেতে চাই না।
উমরাও কিছু বলার আগেই তিনি দ্রুত কুঠুরিতে ঢুকে যান। মদের ছিপি খুলতে খুলতে বলেন, ‘সুর আছে, ভেসে যাও সুরের স্রোতে; সুরা আছে বলে যাও সব কিছু। রূপসীর প্রেমে পাগল হয়ে যাও, সাধুতা থাক অন্যদের জন্য।’ পেয়ালাভরা মদপান করতে করতে কেটে যায় বেলা।
লেখা হয় শের ‘চলে যাচ্ছি জীবনের অপূর্ণ বাসনার ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে আমি এক নির্বাপিত প্রদীপ, মাহফিলে রাখার যোগ্য নই আমি।’
শূন্য কুঠুরিতে হাওয়ার নাচন নেই— হাওয়া হা-হা ফেরে। শূন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহরের ওপর দিয়ে দিগন্তে তাকিয়ে বলেন, পৃথিবীর পৃষ্ঠায় তিনি তো বাড়তি হরফ নন।