কুঠিয়াল সাহেব! (শেষ অংশ)
(অর্থাৎ সেকেলে নীলকর সাহেবের ভীষণ-অত্যাচার কাহিনী!)
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দারোগাবাবু মনে মনে একটু ক্রোধান্বিত হইয়া নীলকুঠি হইতে বহির্গত হইলেন ও যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
দারোগাবাবু সেই স্থানে আসিয়া দুই দিবস পৰ্য্যন্ত অনুসন্ধান করিতেছেন, এই কথা ক্রমে নিকটবর্তী সমস্ত গ্রামের চৌকিদারগণ অবগত হইতে পারিল, ও ক্রমে ক্রমে তাহারাও আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। ঐ সকল চৌকিদারগণের মধ্যে এক ব্যক্তি ঐ মৃতদেহটি উত্তমরূপে দেখিয়া কহিল, “মৃতদেহের অবস্থা এখন যেরূপ হইয়াছে, তাহাতে উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা চিনিতে পারা নিতান্ত সহজে নহে, কিন্তু ইহার অবয়বের সহিত “___” গ্রামের রামচন্দ্র বিশ্বাসের অনেকটা সাদৃশ্য আছে।”
চৌকিদারের এই কথা শুনিয়া দারোগাবাবু কহিলেন, “রামচন্দ্র বিশ্বাস কে, ও তিনি কী কার্য্য করিয়া থাকেন?”
চৌকিদার। তিনি নীলকুঠিতে গোমস্তাগিরি কার্য্য করিয়া থাকেন।
দারোগা। কৰ্ম্ম করেন তো নীলকুঠিতে; কিন্তু, থাকেন কোথায়? নীলকুঠির হাতার মধ্যেই কী তাঁহার বাসা আছে?
চৌকিদার। না, তিনি নীলকুঠির কার্য্য করেন বটে, কিন্তু নীলের সহিত তাঁহার কোনরূপ সংস্রব নাই। তিনি ‘মালের’ গোমস্তা; নিজের বাড়ীতে বসিয়াই সকল কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিয়া থাকেন।
দারোগা। যে গ্রামে রামচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ী, তুমি কী সেই গ্রামের চৌকিদার?
চৌকিদার। হাঁ মহাশয়, আমি সেই গ্রামের চৌকিদার; কিন্তু, আমার বাড়ী সেই গ্রামে নহে; নিকটবর্ত্তী একটি গ্রামে আমার বাসস্থান।
দারোগা। যে গ্রামের তুমি চৌকিদার, সেই গ্রামে তুমি কোন সময় গমন করিয়া থাক?
চৌকিদার। সেই গ্রামে গমন করিবার আমার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। চৌকি দিবার নিমিত্ত প্রত্যহ রাত্রিতে সেই গ্রামে গমন করিয়া থাকি; তদ্ব্যতীত, দিনমানেও প্রায় গিয়া থাকি। এককথায়, যখন আবশ্যক হয়, তখনই আমি সেই গ্রামে গমন করিয়া থাকি।
দারোগা। তুমি যে গ্রামের চৌকিদার, সেই গ্রামের আর কোন চৌকিদার এখন এই স্থানে উপস্থিত আছে?
চৌকিদার। না, আর কাহাকেও তো এখন এখানে দেখিতে পাইতেছি না।
দারোগা। রামচন্দ্র বিশ্বাস এখন তাঁহার গ্রামে উপস্থিত আছেন কি না, তাহা তুমি বলিতে পার?
চৌকিদার। না, আমি তাঁহাকে চারি পাঁচ দিবস দেখি নাই।
দারোগা। তুমি এখন ইহা গিয়া জানিয়া আসিতে পারিবে কী, যে তিনি কোথায় আছেন?
চৌকিদার। কেন পারিব না, মহাশয়! আমি এখনই গমন করিতেছি।
চৌকিদারের কথা শুনিয়া দারোগাবাবুর মনে দুইটি কারণে কেমন একরূপ সন্দেহ হইল। প্রথমতঃ রামচন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে ঐ মৃতদেহের অনেকটা সাদৃশ্য আছে। দ্বিতীয়তঃ, যে নীলকর সাহেব তাঁহাকে কুঠির মধ্যে প্রবেশ করিতে দেন নাই, তাঁহারই অধীনে তিনি গোমস্তাগিরি কার্য্য করিয়া থাকেন।
দারোগাবাবুর মনে এইরূপ একটু সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হওয়ায়, তিনি রামচন্দ্র বিশ্বাসের সংবাদ আনিবার নিমিত্ত কেবলমাত্র সেই চৌকিদারকে প্রেরণ না করিয়া হেড-কনষ্টেবলকেও তাঁহার সহিত পাঠাইয়া দিলেন। যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থান হইতে রামচন্দ্র বিশ্বাসের বাসস্থান ৩।৪ ক্রোশের অধিক হইবে না। দারোগাবাবুর আদেশ পাইবামাত্র হেড-কনষ্টেবল তাঁহার অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক দ্রুতগতি রামচন্দ্র বিশ্বাসের গ্রামাভিমুখে গমন করিলেন। দারোগাবাবু এদিকে যাহারা রামচন্দ্র বিশ্বাসকে চিনিত, তাহাদিগকে ডাকাইয়া ঐ মৃতদেহ দেখাইতে লাগিলেন। ঐ সকল ব্যক্তির মধ্যে কেহ কহিল, ইহা রামচন্দ্র বিশ্বাসের মৃতদেহ, কেহ কহিল রামচন্দ্র বিশ্বাসের আকৃতি এই মৃতদেহের সহিত অনেকটা মিলে বটে, কিন্তু বোধ হইতেছে, ইহা তাঁহার মৃতদেহ নহে।
এইরূপ ক্রমে চারি ঘণ্টা অতীত হইয়া গেল। চারি ঘণ্টা পরে সকলেই দেখিতে পাইলেন, যে দিকে হেড- কনষ্টেবল গমন করিয়াছিলেন, সেই দিক হইতে দুই ব্যক্তি অশ্বারোহণে আগমন করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে তাঁহারা আসিয়া দারোগাবাবুর নিকট উপস্থিত হইলেন। উহাদিগের মধ্যে একজন সেই হেড-কনষ্টেবল, অপর ব্যক্তি রামচন্দ্র বিশ্বাসের সহোদর, তাঁহার নাম রামরূপ বিশ্বাস।
রামরূপ বিশ্বাস অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া দ্রুতপদে সেই মৃতদেহের নিকট গমন করিলেন ও উহা দেখিবামাত্রই উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিলেন। রামরূপ বিশ্বাসকে রোদন করিতে দেখিয়া সকলেই বুঝিতে পারিলেন, ঐ মৃতদেহ তাঁহার ভ্রাতার। দারোগাবাবু তখন রামরূপকে কহিলেন, “এখন আর রোদন করিবার সময় নাই; ইহার পরে রোদন করিবার বিস্তর সময় প্রাপ্ত হইবেন, এখন যে ব্যক্তি কর্তৃক আপনার ভ্রাতার এই অবস্থা ঘটিয়াছে, সেই ব্যক্তি যাহাতে ধৃত হয় ও উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হয়, তাহার চেষ্টা করাই আপনার কর্ত্তব্য। বৃথা রোদন করিয়া সময় নষ্ট করিবার সময় এখন নাই।”
রামরূপ। আমাকে কী করিতে হইবে মহাশয়?
দারোগা। আপনি বেশ চিনিতে পারিয়াছেন, ইহা আপনার ভ্রাতা রামচন্দ্রের মৃতদেহ?
রামরূপ। উত্তমরূপে চিনিতে পারিয়াছি; ইহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
দারোগা। এই চাদর, পিরাণ, গামছা ও জুতা কাহার?
রামরূপ। ইহাও আমার ভ্রাতার।
দারোগা। এই জিন লাগাম প্রভৃতি?
রামরূপ। ইহাও আমাদিগের। দাদা যখন কোনস্থানে অশ্বারোহণে গমন করিতেন, তখন তিনি এই জিন লাগামই ব্যবহার করিতেন।
দারোগা। আজ কয়দিবস হইতে তিনি তাঁহার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছেন?
রামরূপ। অদ্য চারি দিবস হইল।
দারোগা। তিনি কোথায় গমন করিয়াছেন?
রামরূপ। তাঁহার মনিব সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে কুঠিতে আসিয়াছিলেন।
দারোগা। কী কারণে তিনি সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা আপনি কিছু বলিতে পারেন?
রামরূপ। তাহা আমি অবগত নহি; তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, কুঠির দুইজন বরকন্দাজের সহিত তিনি গমন করিয়াছিলেন।
দারোগা। আপনি যতদূর অবগত আছেন, তাহার আনুপূর্ব্বক বিবরণ আমার নিকট বলুন দেখি।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
দারোগাবাবুর কথার উত্তরে রামরূপ কহিলেন, “আমার ভ্রাতা রামচন্দ্র বিশ্বাস অনেক দিবস হইতে নীলকরসাহেবের অধীনে গোমস্তাগিরি কর্ম্ম করিতেন। আমাদিগের সামান্য একটু জমিদারী আছে। উহা বরাবরই আমাদিগের খাস দখলে ছিল। কিন্তু নীলকরসাহেব ঐ জমিদারীটুকু আমাদিগের নিকট হইতে কোনরূপে গ্রহণ করিবার মানসে অনেকরূপ চেষ্টা করেন, ও পরিশেষে আমাদিগের উপর অনেকরূপ অত্যাচার আরম্ভ করেন। তাঁহাদিগের অত্যাচার আমরা কোনরূপে সহ্য করিতে না পারিয়া, পরিশেষে সাহেবের প্রস্তাবেই সম্মত হই, ও যে গ্রামখানি আমাদিগের জমিদারী ছিল, তাহা দশ বৎসরের জন্য ইজারা করিয়া দি। ঐ গ্রামের আদায় উসুল করিবার নিমিত্ত নীলকরসাহেব দাদাকে গোমস্তাগিরি কার্য্য প্রদান করেন। তিনি যে আমাদিগের উপর বিশেষরূপ সদয় ছিলেন বলিয়া এই কার্য্যে দাদাকে নিযুক্ত করেন, তাহা নহে। ঐ গ্রামে অপর লোক আগমন করিলে, তিনি সহজে প্রজাগণের নিকট হইতে আদায় উসুল করিতে পারিবেন না, ও প্রজাগণকে সহজে নীলের দাদন লইতে স্বীকৃত হওয়াইতে পারিবেন না বলিয়াই, তিনি দাদার হস্তে ঐ কার্যভার অর্পণ করেন। দাদাও তাঁহার সাধ্যমত মনিবের কার্য্য যতদূর সম্ভব, তাহা সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিলেন, সাহেবও তাঁহার উপর বিশেষরূপ সন্তুষ্ট ছিলেন।
সম্প্রতি কয়েকখানি গ্রামের প্রজাগণ কিছুতেই নীলবুনানি করিবে না, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া দলবদ্ধ হইয়াছে ও নীল কুঠির সাহেবের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছে। দাদা যে গ্রামের তহশীলদারী করিতেন, ঐ গ্রামের প্রজাগণও নীলবিদ্রোহী প্রজাগণের সহিত মিলিত হইয়া, নীলবুনানি পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাহেবকে বিশেষরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছে। সাহেব এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, একদিবস স্বয়ং আসিয়া দাদার নিকট উপস্থিত হন, ও তাঁহাকে কহেন, “তুমি প্রজাগণের সহিত মিলিত হইয়াছ। সেই নিমিত্তই প্রজাগণ সাহসী হইয়া আমার নীলবুনানি কার্য্য বন্ধ করিয়াছে। তোমার অভিমত না পাইলে তোমার প্রজাগণ কখনই তোমার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া, আমার নীলের কার্য্যের ক্ষতি করিতে সাহসী হইত না। তুমি প্রজাগণকে এখনও বুঝাইয়া দাও, ও যাহাতে তাহারা নীলবুনানি করে, তাহার বন্দোবস্ত কর; নতুনা ইহার নিমিত্ত তোমাকে অতিশয় কষ্ট পাইতে হইবে।”
সাহেবের কথার উত্তরে দাদা কহলেন, “ধর্ম্মাবতার! আমি আপনার চাকরি করি; যাহাতে আপনার অনিষ্ট হয়, এরূপ কার্য্যে কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। প্রজাগণ প্রকৃতই আমার অবাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। তাহারা কিছুতেই আমার কথায় কর্ণপাত করিতেছে না। যাহাতে তাহারা পূর্ব্বের ন্যায় নীলবুনানি করে, তাহার নিমিত্ত আমি তাহাদিগকে বিস্তর বুঝাইয়া দেখিয়াছি ও অনেকরূপ ভয়ও প্রদর্শন করিয়াছি; কিন্তু, তাহারা কিছুতেই আমার কথায় সম্মত হয় না। এরূপ অবস্থায় আমি প্রজাগণকে যে পুনরায় সহজে বশীভূত করিতে পারিব, তাহা বোধ হয় না। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, আমি প্রজাগণের কোনরূপ পরামর্শের মধ্যে নাই।”
দাদার কথা শুনিয়া সাহেব অতিশয় ক্রোধভাব প্রকাশ করিলেন ও কহিলেন, “আমি সব শুনিয়াছি ও সকল কথা জানিতে পারিয়াছি। এই গ্রামের সমস্ত প্রজা দলবদ্ধ হইয়া নীলবুনানি বন্ধ করার মূলই তুমি। আমি তোমাকে এখনও বলিতেছি যে, সহজে প্রজাগণ যাহাতে অবাধ্য না হয়, তাহার চেষ্টা তুমি কর, € দুই দিবস পরে আমার নিকট কুঠিতে গিয়া সমস্ত কথা আমাকে বলিয়া আইস।” এই বলিয়া সাহেব সেইস্থান হইত প্রস্থান করিলেন; দাদার আর কোন কথা তিনি শ্রবণ করিলেন না।
এদিকে দুই দিবস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু দাদা সাহেবের কুঠিতে আর গমন করিলেন না। তিনি কুঠিতে গমন করিলেন না দেখিয়া, আমি দাদাকে কহিয়াছিলাম, “দাদা, সাহেব আপনাকে কুঠিতে গমন করিতে বলিয়াছিলেন; কিন্তু কৈ আপনি তো গমন করিলেন না?” উত্তরে দাদা আমাকে বলিয়াছিলেন, “সাহেব যখন আমার উপর কুপিত হইয়াছেন, তখন তাঁহার নিকট কুঠিতে কি গমন করিতে আছে! উহারা সাহেবলোক; যদি রাগভরে হঠাৎ আমাকে অবমাননা করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে আমি কী করিতে পারিব; সুতরাং, সেই স্থানে যাওয়া আমার কর্ত্তব্য নহে। না হয় চাকরী হইতে সাহেব আমাকে জবাব দিবেন।”
দাদার এই রূপ কথা শুনিয়া আমি আর কোন কথা কহিলাম না। দাদাও কুঠিতে গমন করিলেন না। চারি পাঁচ দিবস এইরূপ অতীত হইয়া যাইবার পর, এক দিবস একজন বরকনদাজ একখানি পত্র সহ আমাদিগের বাড়ীতে,, আসিয়া উপস্থিত হইল। পত্রখানি নায়েবের স্বাক্ষরিত। উহাতে লেখা ছিল, “আমি শ্রীযুক্ত মনিব সাহেবের আদেশ অনুসারে আপনাকে লিখিতেছি যে, আপনাকে এখানে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তিনি স্বয়ং আপনাকে বলিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু, আপনি তাঁহার আদেশ লঙ্ঘন করিয়া এ পর্যন্ত কুঠিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন না। এই কারণে মনিব বাহাদুর আপনার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন; কিন্তু আমি অনেক রূপ বলিয়া তাঁহাকে নিরস্ত করিয়াছি। তথাপি আপনি একবার এখানে আগমন করিয়া তাঁহার সতিহ সাক্ষাৎ করিবেন। আমার নিকট আসিলে আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া মনিব বাহাদুরের নিকট লইয়া যাইব।”
পত্রখানি পাঠ করিয়া কী কর্তব্য, তাহার কিছুই দাদা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। আমি কিন্তু কহিলাম, “যখন নায়েব মহাশয় আপনাকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের নিকট লইয়া যাইতে চাহিতেছেন, তখন একবার গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করা কর্তব্য। কারণ, যে মনিবের নিকট চাকরী করিতে হইবে, তিনিই যখন ডাকিতেছেন, তখন তাঁহার নিকট গমন করা উচিত; ও তাঁহার আদেশ কোনরূপে লঙ্ঘন করা কর্ত্তব্য নহে।”
আমার কথা শুনিয়া দাদা কহিলেন “তোরা ছেলে মানুষ, বুঝি কী! সাহেব লোক কুপিত হইলে যে পৰ্য্যন্ত সেই ক্রোধ প্রশমিত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত কিছুতেই তাঁহাদিগের সম্মুখে গমন করিতে নাই।’
আমাকে এইরূপ বলিয়া দাদা নীলকুঠির নায়েবকে একখানি পত্র লিখিলেন। ঐ পত্রের সার মর্ম্ম এইরূপ : “আপনার পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম; কিন্তু আমার শরীর নিতান্ত অসুস্থ বলিয়া আপনার আদেশ প্রতিপালন করিতে পারিলাম না। ক্ষমা করিবেন ও মনিব বাহাদুরকে ক্ষমা করিতে কহিবেন। দিন দিন আমার শরীরের অবস্থা যেরূপ হইতেছে, তাহাতে আমার বর্তমান চাকরি যে করিয়া উঠিতে পারিব, সে আশা আমার নাই; সুতরাং আমি আমার চাকরি পরিত্যাগ করিলাম। মনিব বাহাদুরকে বলিয়া আপনি অন্য একজন গোমস্তা নিযুক্ত করিয়া এখানে পাঠাইয়া দিবেন। আমি তাঁহার নিকট আমার ‘নিকাশ’ দিয়া আপনাদিগের নিকট হইতে অবকাশ গ্রহণ করিব। শরীর সুস্থ হইলে মনিব বাহাদুর যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক পুনরায় আমাকে চাকরি প্রদান করেন, তাহা হইলে পুনরায় আপনাদিগের তাঁবেদারিতে হাজির হইব। আমার ইচ্ছা ছিল, আপনার নিকট স্বয়ং গমন করিয়া এই সকল বলিয়া বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক প্রত্যাগমন করিব; কিন্তু, শরীরের অবস্থা ভাল না থাকায়, আমার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না। অনুগ্রহ পূর্ব্বক ক্ষমা করিবেন ও যতশীঘ্র পারেন, আমার নিকট লোক পাঠাইয়া দিয়া বাধিত করিবেন।”
দাদা পত্রখানি সেই বরকনদাজের হস্তে প্রদান করিলেন ও তাহাকে বক্সিস্ বলিয়া একটি টাকাও দিলেন। বরকনদাজ পত্র লইয়া হাষ্ট মনে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
ইহার পর, দুই দিবস আর কোন লোকজন বা চিঠিপত্র কুঠি হইতে আসিল না। তৃতীয় দিবস অতিশয় প্রত্যূষে দুই জন বরকনদাজ আসিয়া আমাদিগের বাড়ীতে উপস্থিত হইল। উহাদিগের সহিত সাহেবের স্বাক্ষরিত একখানি হুকুমনামা ছিল। উহাতে লেখা ছিল, “খুবারি সিং বরকনদাজের উপর এই আদেশ দেওয়া যাইতেছে যে, সে অপর যে কয়েকজন বরকন্দাজের সাহায্য লওয়া বিবেচনা করিবে, তাহাদিগের সাহায্য লইয়া গোমস্তা রামচন্দ্র বিশ্বাসকে আমার সম্মুখে লইয়া আসিবেন। হুকুম জরুরী বিবেচনায় যেন তামিল করা হয়।”
হুকুমনামা দেখিয়া দাদা কহিলেন, “এবার দেখিতেছি কুঠিতে গমন না করিলে আর চলিবে না। সহজে যদি আমি গমন না করি, তাহা হইলে বরকনদাজগণ অবমানিত করিয়া যে আমাকে ধরিয়া লইয়া যাইবে তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় গমন করাই কৰ্ত্তব্য।”
এই বলিয়া দাদা দুইজন বরকনদাজকে ২টি করিয়া ৪টি টাকা প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, “এই লও তোমাদিগের খোরাকী; ও এই স্থানে আহারাদি করিয়া অপেক্ষা কর। অদ্য আহারান্তে বৈকালে বা কল্য প্রত্যূষে তোমাদিগের সহিত কুঠিতে গমন করিব।”
বরকনদাজগণ রামচন্দ্র বিশ্বাস গোমস্তাকে উত্তমরূপে জানিত ও মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকট আসিয়া খোরাকী বা বক্সিস্ বলিয়া কিছু কিছু লইয়া যাইত; সুতরাং, তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তাহারা সেইস্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিল। সেই দিবস বৈকালেও দাদা গমন করিলেন না। পরদিবস অতিশয় প্রত্যূষে তিনি আপন ঘোড়াটি সজ্জিত করিয়া তাহার উপর আরোহণপূর্ব্বক সেই বরকনদাজদিগের সঙ্গে গমন করিলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, “অদ্যই নাগাইতে সন্ধ্যা প্রত্যাগমন করিব। তবে যদি কোন কারণে ফিরিয়া আসিতে না পারি, তাহা হইলে একদিবস বিলম্ব হইলেও হইতে পারে।”
এই বলিয়া দাদা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন, কিন্তু সে দিবস আর প্রত্যাগমন করিলেন না। পর দিবসও ফিরিয়া আসিলেন। না। তৃতীয় দিবস সন্ধ্যার সময় আমাদিগের একটি ভৃত্য আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বড় বাবু কখন ফিরিয়া আসিলেন?” উত্তরে আমি কহিলাম, “তিনি তো এখন পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই!” আমার কথা শুনিয়া ভৃত্য কহিল, “কেন আসিবেন না? তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন। তাঁহার ঘোড়া বাগানের ভিতর চরিতেছে; আমি এখনই দেখিয়া আসিলাম।”
পরিচারকের কথা শুনিয়া আমি তাহার সহিত বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তাহার কথা প্রকৃত। “যে অশ্বে আরোহণ করিয়া, দাদা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলেন, সেই অশ্বটি প্রত্যাগমন করিয়াছে; কিন্তু দাদা প্রত্যাগমন করেন নাই। অশ্বটি দেখিয়া আমার মনে একটু আশঙ্কা হইল। একবার ভাবিলাম, হয় তো দাদাকে কোনস্থান উহার পৃষ্ঠ হইতে ফেলিয়া দিয়া সে চলিয়া আসিয়াছে, তিনি হয় তো আহত হইয়া কোনস্থানে পতিত আছেন; নতুবা, প্রত্যাগমন করিলেন না কেন? আবার ভাবিলাম, পৃষ্ঠোপরি হইতে যদি সে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া আসিবে, তাহা হইলে জীন তো উহার পৃষ্ঠের উপরই থাকিবে; কিন্তু যখন উহার পৃষ্ঠোপরি জীন নাই, তখন সে কখনই দাদাকে ফেলিয়া দেয় নাই। হয় তো কোনস্থানে চরিয়া খাইবার নিমিত্ত দাদাকে উহাকে ছাড়িয়া বা বাঁধিয়া দিয়াছিলেন, দড়া ছিড়িয়া হয় তো সেইস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছে।” মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে লাগিলাম সত্য, কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। “এদিকে দাদার প্রত্যাগমনের যতই বিলম্ব হইতে লাগিল, মনে মনে ততই আশঙ্কা আসিয়া উপনীত হইতে লাগিল। অদ্য দাদার অনুসন্ধানে গমন করিবার অভিপ্রায়ে তাঁহারই সেই ঘোড়ায় আরোহণ করিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উপক্রম করিতেছি, এরূপ সময়ে জমাদার গিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহার নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, তাঁহারই সহিত আমি এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতেছি।”
রামরূপের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু স্পষ্টই বলিয়া উঠিলেন, “এই কাৰ্য্য দেখিতেছি সাহেবের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। সাহেব ব্যতীত অপর কাহার দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন হয় নাই, ইহা আমি শপথ করিয়া এখন বলিতে পারি।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
রামরূপের সমস্ত কথা শেষ হইয়া গেলে, দারোগাবাবু মনে করিলেন, “এরূপ অবস্থার কুঠির ভিতর গিয়া অনুসন্ধান করা কর্তব্য কী না?” পরক্ষণেই তাঁহার মনে হইল, সাহেব কর্তৃক যখন একবার অবমানিত হইয়া সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন, তখন সেই সাহেবের বিরুদ্ধে বিশেষরূপ প্রমাণ সংগ্রহ না করিয়া, তাঁহার কুঠির হাতার মধ্যে আর কখনই প্রবেশ করিবেন না।
দারোগাবাবু যখন মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছেন, সেই সময় রামরূপ দারোগাবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! ঐ খুবারি সিং জমাদার আসিতেছে। উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিলেই আপনি বেশ বুঝিতে পারিবেন, যে আমার কথা সত্য কী না!” এই বলিয়া একজন পশ্চিমদেশীয় লোককে রামরূপ দেখাইয়া দিল।
দারোগাবাবু দেখিলেন, মালকোঁচা মারিয়া কাপড় পরা, অঙ্গে একটি মৃজাই আঁটা, ও মস্তকে একটি প্রকাণ্ড সাদা পাগড়ী বাঁধা একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, প্রায় পাঁচ হস্ত পরিমিত একটি বংশদণ্ড স্কন্ধে ফেলিয়া সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছে। রামরূপ খুবারি সিং জমাদর বলিয়া ইহারই পরিচয় দারোগাবাবুকে প্রদান করিয়াছিল।
দারোগাবাবুর আদেশ অনুযায়ী দুইজন চৌকীদার তাহার নিকট গমন করিয়া কহিল, “ঐ দারোগাবাবু বসিয়া আছেন, ও তিনি আপনাকে ডাকিতেছেন।”
চৌকীদারের কথা শুনিয়া খুবারি সিং দারোগাবাবুর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। রামরূপ দারোগাবাবুকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা সংক্ষেপে তিনি খুবারিকে কহিলেন। খুবারি ঐ সকল কথা শুনিয়া কহিল, “বিশ্বাস মহাশয় যাহা বলিয়াছেন, তাহা ঠিক। গোমস্তাবাবু আমাদিগের সহিত কুঠিতে আসিয়াছিলেন। আমরা তাঁহাকে লইয়া সাহেবের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, তিনি আমাদিগকে বিদায় করিয়া দেন, ও গোমস্তাবাবুকে কহেন, ‘তুমি দাওয়ানখানায় গিয়া অপেক্ষা কর। সময়মত আমি তোমাকে ডাকিব।’ সাহেব বাহাদুরের এই কথা শুনিয়া গোমস্তাবাবু দাওয়ানখানার দিকে গমন করিলেন। আমরাও আমাদিগের বাসায় চলিয়া আসিলাম। ইহার পর যে কী হইয়াছে, তাহা আর আমরা অবগত নহি।
দারোগা। গোমস্তাবাবু কী তাঁহার ঘোড়ায় চড়িয়াই সাহেবের নিকট গমন করিয়াছিলেন?
খুবারি সিং। ও বাবা। ঘোড়ায় চড়িয়া সাহেবের সম্মুখে যায় কাহার সাধ্য? হাতার ভিতর একটি গাছে ঘোড়াকে বাঁধিয়া তিনি আমাদিগের সহিত হাঁটিয়া গমন করিয়াছিলেন।
দারোগা। ঘোড়ার জীন কোথায় রাখিয়া দিয়াছিলেন?
খুবারি। ঘোড়া হইজে জীন লাগাম প্রভৃতি কিছুই খোলেন নাই। লাগাম দিয়া ঘোড়াটিকে গাছের সহিত বাঁধিয়াছিলেন। জীন তাহার পিঠের উপরই ছিল। খুবারি সিংএর কথা শুনিয়া দারোগাবাবু বেশ বুঝিতে পারিলেন, এখন নীলকুঠির হাতার মধ্যে গিয়া অনুসন্ধান করিতে না পারিলে, প্রকৃত কথা বাহির হইবে না। এখন তাঁহার অনুমান হইল, হয় ত নীলকর সাহেব ক্রোধ সংবরণ করিতে না পারিয়া, রামচন্দ্র বিশ্বাসকে প্রহার করেন, ও সেই প্রহার সহ্য করিতে না পারায় রামচন্দ্রের মৃত্যু হয়। পরিশেষে তাঁহার মৃতদেহ এইরূপ উপায়ে গোপন করিয়া রাখা হয়। আরও তিনি অনুমান করিলেন যে, এই কার্য্য যদি সাহেবের নিজহস্তে সম্পাদিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে তিনি যেস্থানে বাস করিয়া থাকেন, বা যেস্থানে বসিয়া বিষয়কাৰ্য্যাদি নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, ইহা সেইস্থানেই হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু সেইস্থান কুঠির আভ্যন্তরীণ অপর কোন স্থান নহে। তাঁহার ঘর অর্থাৎ যে স্থানকে “খাস কামরা” বলিয়া থাকে, সেই ঘর বা তাহার সংলগ্ন অপর কোন ঘর। ঐ স্থানে যদি এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে অপর কোন সাক্ষী পাইবার উপায় নাই। এক মেম সাহেব সেইস্থানে থাকেন; তিনি যদি দেখিয়াও থাকেন, তাহা হইলে তিনি কি আপন স্বামীর বিপক্ষে সাক্ষী প্রদান করিবেন? অপর লোকের মধ্যে তাঁহার বেহারাগণ ও সর্দ্দার বেহারা। সর্দ্দার বেহারা সর্ব্বদাই সাহেবের নিকট থাকে। সে সকল বিষয় জানিলেও জানিতে পারে; কিন্তু, অপর বেহারাগণের মধ্যে সকলে এক সময় উপস্থিত থাকে না, সময়মত আসিয়া আপনাপন কার্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। তাহাদিগের মধ্যে সেই সময় কোন কোন ব্যক্তি সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাই বা স্থির করিতে পারা যাইবে কি প্রকারে? সর্দ্দার বেহারা যদি সকল কথা স্বীকার করে ও সকল কথা বলিয়া দেয়, তাহা হইলেই সমস্ত অবগত হইতে পারা যাইবে; নতুবা, এই মোকদ্দমার কিনারা করা নিতান্ত সহজ হইবে না। আর এক কথা, যদি এই অনুমানই প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সাহেব নিজে কিছু আসিয়া ‘দোয়ার’ মধ্যে এইরূপ অবস্থায় ঐ লাস প্রোথিত করিয়া যান নাই; আর নিজেও যদি আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঐ লাস কিছু নিজে বহন করিয়া লইয়া আসেন নাই; বিশেষ একজনে কখনই ঐ লাস বহন করিতে পারে না। এরূপ অবস্থায় অপরাপর লোকজনের দ্বারা যে এই লাস আনীত ও প্রোথিত হইয়াছিল, তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। অনুসন্ধান করিয়া যদি ঐ স্কল লোককে বাহির করিতে সমর্থ হই, ও তাহারা যদি প্রকৃত কথা কহে, তাহা হইলেও এই মোকদ্দমার কিনারা হইবার কিছু না কিছু আশা হয়।
সাহেবের সদার-বেহারা ও অপরাপর বেহারাগণ সকলেই সাঁওতাল দেশীয় লোক। বঙ্গদেশে তাহারা “বুনা” নামে অভিহিত হইয়া থাকে। নীলকুঠির অধিকাংশ কার্য্যই বুনাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে। উহারা সাহেবদিগের বিশেষরূপ অনুগত। উহারা স্ত্রী পুরুষে মিলিয়া নীলকরসাহেবদিগের কার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে ও তাঁহাদিগের সমস্ত লালসা পূর্ণ করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয় না। উহাদিগের বাস করিবার নিমিত্ত নীলকরগণ কুঠির ব্যয়ে ঘর সকল প্রস্তুত করিয়া দিয়া থাকেন। ঐ সকল ঘর প্রায় একস্থানেই প্রস্তুত এবং উহাতে সকলে মিলিয়া বাস করিয়া থাকে। এই রূপে যে স্থানে উহারা বাস করিয়া থাকে, সেই স্থানটি ক্রমে একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে পরিগণিত হয়। তখন উহা “ধাওড়া” বা “বুনা ধাওড়া” নামে অভিহিত হয়। ঐ সকল “ধাওড়া” প্রায়ই নীলকুঠির অতিশয় সন্নিকটে বা কুঠির সীমার মধ্যেই স্থাপিত হইয়া থাকে। বুনা বা বুনারমণীগণকে অপর কোন স্থানে প্রায় কৰ্ম্ম করিতে হয় না। নীলকুঠির সমস্ত কার্য্যই তাহাদিগের দ্বারা নির্বাহিত হয় ও নীলকুঠি হইতেই তাহারা প্রতিপালিত হইয়া থাকে। যে কুঠির কথা এই স্থানে বিবৃত হইতেছে, উহাতেও বুনাগণের “ধাওড়া” ছিল। এই “ধাওড়া” স্থাপিত ছিল,– পূৰ্ব্বকথিত দোয়ার একপার্শ্বে, ও নীলকুঠির অতিসন্নিকটে। সাহেবের সর্দ্দার-বেহারা, বেহারা ও অপরাপর বুনা পরিচালকগণও ঐ “ধাওড়ায় বাস করিত।
দারোগাবাবু এই সকল বিষয় জানিতে পারিয়া, তাঁহার সমস্ত লোকজন ও খুবারি সিং- এর সহিত সেই “ধাওড়ার” ভিতর প্রবেশ করিলেন। বলা বাহুল্য, “ধাওড়ার” ভিতর গমন করিবার পূর্ব্বেই মৃতদেহ পরীক্ষার্থ জেলায় পাঠাইয়া দিলেন।
“ধাওড়ার” ভিতর প্রবেশ করিয়া, যাহাতে উহা হইতে কোন লোক বাহিরে গমন করিতে না পারে, সর্ব্বাগ্রে তাহার বন্দোবস্ত করিলেন; অর্থাৎ, “ধাওড়ার” চতুষ্পার্শ্বস্থ ময়দানের মধ্যে কতকগুলি চৌকিদার রাখিয়া দিলেন।
এই সময় দারোগাবাবুর মনে হইল যে, তিনি বাঙ্গালী হইয়া সাহেবের বিপক্ষে খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; সুতরাং, এ সংবাদ এখন তাঁহার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্মচারীকে প্রদান করা কর্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, টেলিগ্রাফযোগে এই সংবাদ ইংরাজ-কর্মচারিগণের নিকট প্রেরণ করিবার মানসে, তিনি পূর্ব্বোক্ত হেড-কনষ্টেবলকে রেলওয়ে ষ্টেশনে পাঠাইয়া দিলেন। ঐ স্থান হইতে রেলওয়ে ষ্টেশন অর্দ্ধ ক্রোশের অধিক হইবে না।
যে সব-ডিবিজনের অন্তর্গত স্থানে ঐ মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তথায় সেই সময় একজন ইংরাজ বিচারক ছিলেন। হেড-কনষ্টেবল তাঁহার নিকট ও জেলার পুলিসের বড় সাহেবের নিকট টেলিগ্রাফযোগে নিম্নলিখিত সংবাদটি পাঠাইয়া দিলেন।
“নীলকুঠির সংলগ্ন দোয়ার জলের ভিতর একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। অনুমান হইতেছে, নীলকুঠির সাহেবের দ্বারা বা তাঁহারই আদেশ অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে ও পরিশেষে ঐ মৃতদেহ জলের ভিতর প্রোথিত করিয়া রাখা হইয়াছে। স্থানীয় পুলিস অনুসন্ধান করিতেছে। বোধ হইতেছে, আর একটু প্রমাণ সংগৃহীত হইলেও, নীলকর সাহেবকে এই মোকদ্দমায় ধৃত করিতে হইবে ও তাঁহাকে কয়েদ অবস্থাতে রাখিতে হইবে। গোচরার্থ এই সংবাদ প্রেরিত হইল।”
নবম পরিচ্ছেদ
“ধাওড়ার” চতুৰ্দ্দিকে চৌকিদারগণকে সংস্থাপিত করিয়া, দারোগাবাবু কয়েকজন অনুচরের সহিত তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন ও সেই স্থানে সেই সময় যে সকল পুরুষ উপস্থিত ছিল, তাহাদিগকে একত্র সমবেত করিয়া নানারূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।
যে সময় দারোগাবাবু সেই “ধাওড়ার” মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সেই সময় তথায় প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিল। বুনাগণ আপনাপন কার্য্য সমাপন করিয়া আহারাদি করিবার মানসে, সেই সময় আপনাপন ঘরে প্রত্যাগমন করিয়াছিল। নীলকর সাহেবের সর্দ্দার বেহারাও সেই সময় ঐ “ধাওড়ায়” আসিয়া উপস্থিত হয়। আরও কয়েকজন বেহারা সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিল।
দারোগাবাবু “ধাওড়ার” ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া, বুনাগণের মধ্যে যখন অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হন, সেই সময় নীলকুঠির একজন কর্ম্মচারী সেই স্থান দিয়া গমন করিতেছিলেন। দারোগাবাবু যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহা তিনি সেইস্থানে কিছুক্ষণ দণ্ডায়মান হইয়া দর্শন করেন, ও পরিশেষে সাহেবের নিকট গিয়া তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা বলিয়া দেন। আরও বলিয়া দেন যে, পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ তাঁহার বরকনদাজের জমাদার খুবারি সিংকে সেইস্থানে বসাইয়া রাখিয়াছেন; তাহাকে কোন প্রকারে কুঠিতে আগমন করিতে দিতেছেন না।
এই সংবাদ অবগত হইয়া, সাহেব পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণের উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হন ও তৎক্ষণাৎ তাঁহার দাওয়ানকে দারোগাবাবুর নিকট প্রেরণ করেন, ও তাঁহার দ্বারা দারোগাবাবুকে বলিয়া পাঠান যে, পুলিস তাঁহার বিপক্ষে যেরূপ ভাবে কার্য্য করিতেছেন, তাহাতে তিনি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। এরূপ ভাবে কার্য্য করিলে, কিছুতেই পুলিসের মঙ্গল হইবে না। “ধাওড়ার” সমস্ত লোকজনকে আবদ্ধ রাখিয়া, তিনি নীলকুঠির কার্য্যের যেরূপ ক্ষতি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, পরিশেষে সেই ক্ষতি তাহাকে সহ্য করিতে হইবে। তদ্ব্যতীত, সাহেবের বরকনদাজের প্রধান জমাদার ও সর্দ্দার বেহারা প্রভৃতিকে তিনি যেরূপ অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা কোনরূপেই আইন সঙ্গত নহে। দারোগাবাবু যদি এখনই তাহাদিগকে ছাড়িয়া না দিয়া বেআইনি কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলে তাঁহার সহিত সাহেবও সেইরূপ বেআইনি কার্য্য করিয়া এখনই তাহাদিগকে কুঠিতে আনয়ন করিবে ও পরিশেষে বেআইনি কার্য্য করা অপরাধ দারোগাবাবুই অপদস্থ হইবেন। ইহা যেন তিনি নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখেন।
সাহেব তাঁহার দাওয়ানকে যেরূপ বলিয়া দিয়াছিলেন, দাওয়ানও সেইস্থানে আসিয়া দারোগাবাবুকে তাহা বলিতে কিছুমাত্র ভুলিলেন না। অধিকন্তু আরও দুই চারি কথা বাড়াইয়া বলিলেন।
নীলকরগণের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া কাৰ্য্য করা যে কিরূপ দুরূহ ব্যাপার, তাহা দারোগাবাবু পূৰ্ব্ব হইতে অবগত থাকিলেও, তাঁহার ইচ্ছা ছিল, যাহাতে তিনি এই মোকদ্দমার কিনারা করিতে সমর্থ হন, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিবেন। এবং সেই ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়াই তিনি এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।
দাওয়ানের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু তাঁহাকে কহিলেন, “আপনি সাহেবকে যাইয়া বলুন, আমি তাহার বিপক্ষে কোন রূপ অনুসন্ধান করিতেছি না। বিশেষ তাঁহার বিপক্ষে অনুসন্ধান করার ক্ষমতা যদি আমার থাকিত, তাহা হইলে তাঁহার কুঠির হাতা হইতে কখনই তিনি আমাকে বহির্গত করিয়া দিতে পারিতেন না। রামচন্দ্র বিশ্বাসকে কে মারিয়া জলের ভিতর প্রোথিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছে, কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পাদিত হইয়াছে, তাহাই জানিবার নিমিত্ত আমি এইস্থানের প্রজাগণকে দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি মাত্র। ইহাতে সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ আমি কেন করিব? প্রকৃত কথা বলিতে গেলে, আমি সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া, তাঁহার সহায়তায় প্রবৃত্ত হইয়াছি; কারণ, রামচন্দ্র বিশ্বাস সাহেবের একজন কর্ম্মচারী। সে সাহেবের কুঠিতে আগমন করিয়াছিল, ও বোধ হয়, কুঠি হইতে প্রত্যাগমন করিবার কালীন তাহার এই দশা ঘটিয়াছে। আজ কাল নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহের প্রজাগণ একরূপ নীলবিদ্রোহী হইয়া দাঁড়াইয়াছে, নীলকুঠির কর্ম্মচারিগণকে দেখিতে পাইলে তাহাদিগের হৃদয়ে ভয়ানক ক্রোধের সঞ্চার হইয়া থাকে; সুতরাং, এই কার্য্য যে প্রজাগণের দ্বারা না হইবে, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? এরূপ অবস্থায় আমি যদি সাহেবের প্রজাগণকে জিজ্ঞাসাবাদ না করি, বা তিনি নিজেও যদি আমাকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য প্রদান না করেন, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার কোনরূপেই কিনারা হইতে পারে না। আর যদি এই মোকদ্দমার রহস্য বহির্গত না হয়, তাহা হইলে সাহেবের অনিষ্ট ভিন্ন কখনই ইষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই; কারণ প্রকৃত কথা বাহির না হইলে সকলেই মনে করিবেন, রামচন্দ্র বিশ্বাস প্রজাগণকে সাহায্য করিতেন বলিয়া সাহেব তাঁহাকে কুঠিতে লইয়া গিয়া হত্যা করিয়াছেন। যদি প্রজাগণের মনে এইরূপ সন্দেহের একবার উদয় হয়, তাহা হইলে সেই সন্দেহ তাহাদিগের অন্তর হইতে কোনরূপেই দূরীভূত হইবে না। সুতরাং, প্রজামাত্রেই সাহেবকে আর বিশ্বাস করিবে না। আর যদি তিনি প্রজাগণের নিকট অবিশ্বাসী হইয়া পড়েন, তাহা হইলে তাঁহার নীলকুঠির কার্য্য কখনই সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারিবে না। এই সকল অবস্থা আপনি সাহেবকে বুঝাইয়া বলিবেন, ও যাহাতে এই অনুসন্ধানে তিনি আমাকে সম্যকরূপে সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা করিবেন।”
দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া দাওয়ানজি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কুঠি হইতে সংবাদ আসিল যে ‘ধাওড়ার’ সমস্ত লোকদিগকে সাহেব ডাকিতেছেন। এই সংবাদ পাইয়া সমস্ত লোকই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। দারোগাবাবু কাহার গতি রোধ করিলেন না। কেবলমাত্র ৪ জন লোককে তিনি গমন করিতে দিলেন না। ঐ চারিজন লোকের মধ্যে একজন সাহেবের সদারবেহারা, আর একজন তাঁহার ঘরের বেহারা। অপর দুইজন সেই ‘ধাওড়ার’ অধিবাসী, ও তাহারা সাহেবের কার্য্যেই সর্ব্বদা নিযুক্ত থাকে।
‘ধাওড়ার’ সমস্ত লোকজন যেমন সেইস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক নীলকুঠির উদ্দেশ্যে গমন করিল, দারোগাবাবুও ঐ. চারিজন লোক সমভিব্যাহারে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের গ্রামের সীমানার মধ্যে আগমন করিলেন। দারোগাবাবু যে সময় ‘ধাওড়ার’ মধ্যে অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময় বুনাগণকে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে সাহেবের বেহারার নিকট হইতে কোন কথা জানিতে পারেন ও সেই কথার উপর নির্ভর করিয়া তিনি অপর তিনজনকে সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে লইয়া যান ও সেইস্থানে বসিয়া উহাদিগকে উত্তমরূপে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করেন।
দারোগা। তোমার নাম কি বলিলে?
বেহারা। আমার নাম ছিদাম বুনা।
দারোগা। তুমি কতদিবস হইতে সাহেবের কৰ্ম্ম করিতেছ?
ছিদাম। আমি যতদিবস এখানে আসিয়াছি; বোধ হয় ১৯।২০ বৎসর হইবে।
দারোগা। তোমাদিগের জাতির মধ্যে কেহ মিথ্যাকথা কহে না, কেমন?
ছিদাম। আমরা মিথ্যাকথা কহিব কেন? আমরা মনিবের চাকর; তিনি যাহা যাহা আদেশ করিবেন, তখনই তাহা আমরা প্রতিপালন করিব; কিন্তু, জীবন থাকিতে কখনই মিথ্যাকথা কহিব না।
দারোগা। আমি জানি যে প্রাণ থাকিতে তোমরা কখনই মিথ্যাকথা কহিবে না; এই নিমিত্তই তোমাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই?
ছিদাম। কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন করুন।
দারোগা। তুমি রামচন্দ্র বিশ্বাসকে চিন?
ছিদাম। আমি অনেককে চিনি, কিন্তু রামচন্দ্র বিশ্বাস কাহার নাম জানি না।
দারোগা। তোমার সাহেবের গোমস্তা। আজ কয়েকদিবস হইল সে ঘোড়ায় চড়িয়া নীলকুঠিতে আসিয়াছিল, ও সে সেই স্থানে মরিয়া যায়।
ছিদাম। হাঁ! একজন মরিয়া গিয়াছিল বটে; কিন্তু সে কে, কি করে, কোথায় থাকে, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি।
দারোগা। সে কোথায় মরিয়াছিল?
ছিদাম। সাহেবের কামরার সম্মুখে।
দারোগা। কে তাহাকে মারিয়াছিল?
ছিদাম। তাহা আমি জানি না।
দারোগা। কিরূপে সে মরিয়াছিল?
ছিদাম। তাহাও আমি জানি না।
দারোগা। তবে তুমি কি জান?
ছিদাম। আমি এই জানি যে, আমার কাজের ছুটী হইলে সন্ধ্যায় পরই আমি আমার ঘরে আসি, ও আহারাদি করিয়া রাত্রি ৯টা কি ১০টার সময় আমি শয়ন করি। তাহার পর সর্দ্দার আসিয়া আমাকে ডাকে। সর্দ্দারের কথা শুনিয়া আমি আমার ঘরের বাহিরে আসি। বাহিরে আসিয়া দেখিতে পাই সর্দ্দার ও তাহার সহিত অপর দুইজন, জানকী ও পবন, সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। আমি বাহিরে আসিবামাত্রই সদার কহে, “সাহেব তোমাকে ডাকিতেছেন।” মনিব ডাকিতেছেন, এই কথা শুনিয়া আমি সর্দ্দারকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করি না, তখনই তাহার পশ্চাৎ গমন করি। সর্দ্দার আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একেবারে সাহেবের খাস কামরার নিকট গিয়া উপস্থিত হয়। সেইস্থানে সাহেবকে দেখিতে পাই না; কিন্তু সেইস্থান দাওয়ানজি মহাশয়কে দেখিতে পাই। সর্দ্দার আমাদিগকে একটু দূরে রাখিয়া দাওয়ানজির নিকট গমন করে, ও তাঁহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া তখনই আমাদিগের নিকট প্রত্যাগমন করে ও কহে, “এই লোকটি হঠাৎ মরিয়া গিয়াছে। ইহাকে এই স্থান হইতে এখনই স্থানান্তরিত করিতে হইবে।” সর্দারের কথা শুনিয়া মৃতদেহ ছুঁইতে প্রথমে আমরা অস্বীকার করিয়াছিলাম, ও কহিয়াছিলাম, “এ ব্যক্তি কেও কোন জাতি তাহা যখন আমরা অবগত নহি, তখন ইহাকে আমরা কিরূপে স্থানান্তরিত করিব?” আমাদিগের কথার উত্তরে সর্দ্দার কহিল, “মনিবের কাৰ্য্য আমাদিগকে সম্পন্ন করিতে হইবে, ছুঁইব না বলিলে চলিবে কি প্রকারে? তাহার উপর সাহেব মদ খাইবার নিমিত্ত আমাদিগের প্রত্যেককে পাঁচ টাকা করিয়া বক্সিস্ দিতে চাহিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় এই কাৰ্য্য আমাদিগকে করিতেই হইবে। আমিও তোমাদিগের সহিত গমন করিতেছি।” এই বলিয়া সদার সেই মৃতদেহের সন্নিকটে গিয়া উপস্থিত হইল। আমি সদারকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই মৃতদেহ কোথায় লইয়া যাইতে হইবে?” সর্দ্দার কহিল, “অধিকদূরে লইয়া যাইব না, এই দোয়ার মধ্যেই উহাকে পুঁতিয়া রাখিয়া এখনই আমার চলিয়া আসিব।” এই কথা শুনিয়া আমরা আর কোন কথা কহিলাম না। এক খানি চারিপায়ার উপর ঐ মৃতদেহটি স্থাপিত করিয়া আমরা তিন জনেই উহা লইয়া দোয়ার অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। সর্দ্দার ও দাওয়ানজি আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। দোয়ার সন্নিকটে একস্থানে উপস্থিত হইলে দাওয়ানজি ঐ মৃতদেহ সেইস্থানে নামাইতে কহিলেন। আমরা উহা সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম। সর্দ্দার দুইখানি “পিনের” কাষ্ঠের ও একটি মুগুর সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল। পরিশেষে সর্দ্দার ও আমরা মিলিত হইয়া দোয়ার জলের মধ্যে অবতরণ করিলাম, ও সেইস্থানে “পিন” দুইটি উত্তমরূপে পুঁতিয়া ফেলিলাম। পরিশেষে ঐ মৃতদেহটি সেইস্থানে লইয়া গিয়া জলের মধ্যে ঐ পিনের সহিত উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম। দাওয়ানজি মহাশয় সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া আমাদিগকে সমস্ত দেখাইয়া দিতে লাগিলেন। উহা জলের মধ্যে উত্তমরূপে বন্ধন করিবার পর, কয়েকখানি ডাল উহার উপর রাখিয়া দিয়া আমরা উপরে উঠিলাম। দাওয়ানজি মহাশয় আমাদিগের প্রত্যেককে পাঁচটি করিয়া পনেরটি টাকা প্রদান করিয়া বিদায় দিলেন, ও যাইবার সময় বলিয়া দিলেন, “এ কথা তোমরা কাহারও নিকট কোনরূপে প্রকাশ করিও না।” আমরা তিনজনেই সেইস্থান হইতে চলিয়া গেলাম; কিন্তু দাওয়ানজি মহাশয় ও সর্দ্দার সেইস্থানে থাকিলেন। তাহার পর যে আর কি হইয়াছে, তাহা আমরা অবগত নহি।
দারোগা। ঐ মৃতব্যক্তির কাপড় জুতা তোমরা কি করিলে?
ছিদাম। তাহা আমরা জানি না। কাপড় জুতা প্রভৃতি কিছুই আমরা দেখি নাই।
দারোগা। তাহার ঘোড়ার জীন লাগাম প্রভৃতি?
ছিদাম। তাহাও আমরা জানি না; কিন্তু, ঐ গাছের গোড়ায় জীন লাগাম প্রভৃতি কি কি পড়িয়াছিল, তাহা পরে দেখিয়াছি; কিন্তু, উহা যে কাহারা রাখিয়াছিল, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি।
দারোগা। তোমরা ঐ স্থান হইতে কোথায় গমন করিয়াছিলে, ‘ধাওড়ায়’ না সাহেবের কুঠিতে?
ছিদাম। সাহেবের কুঠিতে আমরা যাই নাই। ধাওড়াতেই আমরা গমন করিয়াছিলাম।
দারোগা। সর্দ্দার কোথায় গমন করিয়াছিল?
ছিদাম। তাহা আমি জানি না। তাহাকে ও দাওয়ানজিকে আমরা দোয়ার ধারেই রাখিয়া আসিয়াছিলাম। তাহার পর যে তাহারা কোথায় গমন করিয়াছিল, তাহা আমরা অবগত নহি।
দারোগা। এ কথা তোমরা আর কাহার নিকট প্রকাশ করিয়াছিলে?
ছিদাম। না।
দারোগা। কেন?
ছিদাম। এই কথা প্রকাশ করিতে একে দাওয়ানজি মহাশয় আমাদিগকে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার উপর আমাদিগকে এ পর্য্যন্ত কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসাও করেন নাই।
দশম পরিচ্ছেদ
ছিদামের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া দারোগাবাবু জানকী ও পবনকে ডাকিলেন, ও তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, ছিদাম যেরূপ বলিয়াছিল, তাহারাও সেইরূপ কহিল। ইহার পরই তিনি সদারকে ডাকিলেন ও তাহাকেও জিজ্ঞাসা করিলেন; কিন্তু, সদার সহজে কোন কথা স্বীকার করিতে চাহিল না। সে কহিল, “ছিদাম প্রভৃতি অপরাপর বুনাগণ যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা; আমরা কোন মৃতদেহ জলের ভিতর প্রোথিত করিয়া রাখি নাই, অথবা দাওয়ানজি মহাশয় বা সাহেব আমাদিগকে কোন মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিতে কখন কহেন নাই।”
সাহেবের সর্দ্দার বেহারা সর্ব্বপ্রথমে কোন কথা স্বীকার করিল না সত্য, কিন্তু পরিশেষে সেও কোন কথা গোপন করিল না। পরে সে বলিয়াছিল, “রামচন্দ্র বিশ্বাস গোমস্তাকে আমি চিনি। সাহেবের আদেশ অনুযায়ী তাহাকে নীলকুঠিতে আনয়ন করা হয়। যে বরকনদাজ তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল, সেই বরকনদাজ রামচন্দ্রকে সাহেবের সম্মুখে আনিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে উপস্থিত করে। সেই সময় সাহেব উহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসাবাদ না করিয়া দাওয়ানজিখানায় গিয়া উহাকে বসিতে কহেন। রামচন্দ্র দাওয়ানজির নিকট দাওয়ানজিখানায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিবার পর, সন্ধ্যার সময় দাওয়ানজি মহাশয় পুনরায় সাহেবকে কহেন, “রামচন্দ্র বিশ্বাস সমস্ত দিবস হাজির আছে, তাহার উপর কোনরূপ আদেশ এখনও হয় নাই।’ এই কথা শুনিয়া সাহেব তাহাকে তাঁহার খাস কামরায় আনিতে কহেন। সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হয়। দাওয়ানজি মহাশয় রামচন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। সাহেব তাহাকে দেখিয়া একেবারে ক্রোধে অধৈর্য্য হইয়া পড়েন, ও কহেন, “তুমি আমার চাকর হইয়া, প্রজাদিগের সহিত মিলিত হইয়াছ ও আমারই বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছ; সুতরাং, ইহার দণ্ড তোমাকে লইতে হইবে।’ এই বলিয়া তিনি জুতা সহিত সজোরে রামচন্দ্রকে এক পদাঘাত করেন। ঐ পদাঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া, কাঁপিতে কাঁপিতে রামচন্দ্র সেই স্থানে পতিত হন। সাহেব তাহার উপর আরও দুই চারি বার পদাঘাত করিয়া, সেইস্থান হইতে প্রস্থান করেন। যাইবার সময় তিনি দাওয়ানজিকে বলিয়া যান যে, ‘অদ্য উহাকে গুদামে বদ্ধ করিয়া রাখ, কল্য প্রাতে ইহার অপরাধের বিচার হইবে।’
সাহেবের কথা শুনিয়া দাওয়ানজি রামচন্দ্রকে উঠাইতে চেষ্টা করেন, কিন্তু উঠাইতে সমর্থ হন না। রামচন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া দাওয়ানজি প্রথমতঃ অনুমান করেন যে, সাহেবের প্রহারে সে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে বলিয়া সহজে গাত্রোত্থান করিতে পারিতেছে না; কিন্তু, পরিশেষে জানিতে পারেন, রামচন্দ্র বিশ্বাস ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। এই অবস্থা জানিতে পারিয়া দাওয়ানজি মহাশয় তখনই গিয়া সাহেবকে এই সংবাদ প্রদান করিলেন। সংবাদ পাইবামাত্রই সাহেব ও মেমসাহেব সেইস্থানে আসিয়া উহাকে দেখিলেন ও বাঁচাইবার নিমিত্ত কতরূপ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু, যখন কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না, তখন আমাকে ও দাওয়ানজিকে কহিলেন, ‘যেরূপে হউক অদ্য রাত্রির মধ্যেই এই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিয়া ফেল। আমার বোধ হয়, দোয়ার মধ্যে উহার মৃতদেহ উত্তমরূপে পুতিয়া রাখিতে পারিলেই ভাল হয়; কারণ, দুই চারি দিবসের মধ্যেই ঐ মৃতদেহ পচিয়া গেলেই সমস্ত গোল মিটিয়া যাইবে।’ আরও কহিলেন, ‘উহার বস্ত্র প্রভৃতি যদি কিছু থাকে, তাহার কোনরূপ চিহ্ন যেন কুঠির ভিতর দেখিতে পাওয়া না যায়। এই কার্য্য চতুরতার সহিত সম্পন্ন করিতে পারিলে তোমরা আমার নিকট হইতে উত্তমরূপে পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবে।” এই বলিয়া সাহেব ও মেমসাহেব কামরার মধ্যে গমন করিলেন। আমি দাওয়ানজির সহিত পরামর্শ করিয়া, ছিদাম, জানকী ও পবনকে ডাকিয়া তাহাদিগের সাহায্যে ঐ মৃতদেহ দোয়ার মধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখিলাম। গোমস্তার যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহাও একত্রে সংগ্রহ পূর্ব্বক তাহার সহিত দুইখানি ইট উত্তমরূপে বাঁধিয়া ঐ দোয়ার জলে নিক্ষেপ করিলাম। তাহার ঘোড়া ছাড়িয়া দিলাম ও জিন লাগাম প্রভৃতি ঐ বৃক্ষের নিম্নে রাখিয়া আসিলাম। এইরূপে সমস্ত কার্য শেষ করিয়া আমি ও দাওয়ানজি মহাশয় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহাকে সমস্ত কথা কহিলাম। সাহেব আমাদিগের কথা শুনিয়া আমাদিগের উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন।”
সদার বেহারার কথা শুনিয়া দারোগাবাবুর আর কিছুই অবগত হইতে বাকী রহিল না। তিনি ছিদাম, জানকী পবন ও সর্দ্দার বেহারার জবানবন্দী সবিশেষ লিখিয়া লইলেন। এখন তাঁহার সম্মুখে তাঁহার অনুসন্ধানের দুরূহ কাৰ্য্য আসিয়া উপস্থিত হইল। মৃতদেহ গোপন করিয়া হত্যাকারীর সহায়তা করা অপরাধে এখন দাওয়ানজিকে ধৃত করা আবশ্যক। এ কাৰ্য্য নিতান্ত সহজ না হইলেও একেবারে অসাধ্য নহে; কারণ, তিনি এখন পর্যন্ত লুক্কাইত বা পলায়িত হন নাই। কাৰ্য্যোপলক্ষে সময় সময় এখনও নীলকুঠি হইতে বহির্গত হইয়া বাহিরে আসিতে সঙ্কুচিত নহেন; সুতরাং, হাতার ভিতর প্রবিষ্ট না হইয়াও তাঁহাকে ধরা যাইতে পারে। কিন্তু এই মোকদ্দমার প্রধান নায়ক সাহেব। সেই সাহেবকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ নহে। তিনি একে ইংরাজ, তাহাতে সেকেলে নীলকর সাহেব। অর্থবল, লোকবল প্রভৃতি কোন বলেরই তাঁহার অভাব নাই। তাঁহার হস্তে রামচন্দ্র বিশ্বাসের যে অবস্থা ঘটিয়াছে তাঁহাকে হত্যাপরাধে ধৃত করিবার নিমিত্ত তাঁহার কুঠির মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে, দারোগাবাবুরও যে সেইরূপ অবস্থা ঘটিবেনা, তাহাই বা কে বলিতে পারে? আর যদি তাহাই না হয়, অসীম সাহসের উপর নির্ভর করিয়া কালা দারোগা যদি সেই গোরা আসামীকে ধরিতেই সমর্থ হন, তাহা হইলেও পরিণামে দারোগাবাবুর অদৃষ্টে যে কি হইবে, তাহার অনুমান করাও নিতান্ত সহজ নহে। তাঁহার উপরিতন প্রধান কর্মচারী ও ঐ মহকুমার বিচারক ইংরাজ। তাঁহারা যে ইংরাজ আসামীর পক্ষ অবলম্বন না করিয়া একজন দেশীয় সামান্য পুলিস-কর্ম্মচারীর পক্ষ সমর্থন করিবেন, এরূপ অনুমান আজকাল করা যাইতে পারে বটে, কিন্তু সেই সময়ে সেইরূপ অনুমান করা একেবারে অসম্ভব ছিল। একশত জন ইংরাজ-কর্মচারীর মধ্যে ন্যায়পক্ষ অবলম্বন করিয়া, তাঁহাদিগের স্বজাতীয় বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইতেন, সেইরূপ কৰ্ম্মচারী সেই সময় একজনও ছিলেন কি না সন্দেহ। এদিকে দারোগাবাবুকে ঠিক আইন অনুসারে না চলিলেও তাঁহার নিস্তার ছিল না; সুতরাং, সেই সময় তিনি যে কি করিবেন, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই সহজে স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। কোনটি ন্যায় ও কোনটি অন্যায় তাহাও তাহার অন্তরে সেই সময় স্থান পাইল না, অথচ ইতিপূর্ব্বে তিনি সাহেবের নিকট অবমানিত হইয়া নীলকুঠির হাতা হইতে তাড়িত হইয়াছিল, এখন সেই ক্রোধ প্রবল তেজ ধারণ করিল বলিয়া তিনি সেই সময় ভাল মন্দ কিছুই বুঝিতে সমর্থ হইলেন না। যাহা তাহার অদৃষ্টে আছে, তাহাই হইবে; মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সাহেবকে ধৃত করিতেই মনস্থ করিলেন। কিন্তু নীলকুঠির হাতার মধ্য হইতে সাহেবকে ধৃত করিয়া আনা নিতান্ত সহজ নহে। সাহেবের যেরূপ লোকবল ও অর্থবল আছে, একজন সামান্য পুলিস-কৰ্ম্মচারীর সেইরূপ লোকবল বা অর্থবল কোথায়? তাঁহাদিগের থাকিবার মধ্যে কেবলমাত্র আইন বল, কিন্তু অনেক সময় সেই আইনের বল আদালতের মধ্যে ভিন্ন প্রায় কার্য্যকরী হয় না। আদালতের বাহিরে সেই আইনের বল অনেক সময় বে-আইনে পরিণত হইয়া পড়ে।
দারোগাবাবু তাহা উত্তমরূপে অবগত থাকিয়াও কিন্তু সাহেবকে ধৃত করিতে প্রস্তুত হইলেন। তাঁহার যতদূর ক্ষমতা সেই অনুযায়ী চৌকীদার কনেষ্টবলগণকে সংগ্রহ করিয়া নীলকুঠির দিকে গমন করিতে মনস্থ করিলেন। তাঁহার সংগৃহীত চৌকীদার প্রভৃতি যখন জানিতে পারিল, তাহাদিগকে সেই নীলকুঠির সাহেব ও দাওয়ানকে ধৃত করিতে হইবে, তখন তাহারা নীলকুঠির দিকে গমন করিতে ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। তাহাদিগের ইচ্ছা ক্রমে ক্রমে তাহারা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে, কিন্তু সরকারী চাকরীর খাতিরে তাহারা একেবারে তাহা করিয়া উঠিতে পারিল না। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্রমে তাহাদিগকে নীলকুঠির দিকে অগ্রসর হইতে হইল।
একাদশ পরিচ্ছেদ
দারোগাবাবু স্বদলবলে যখন নীলকুঠির দিকে অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিলেন, সে সময় পশ্চাৎদিক হইতে অশ্বের পদশব্দ তাঁহার বর্ণগোচর হইল। পশ্চাৎ ফিরিয়া দেকিলেন, তিনি জন অশ্বারোহী ইংরাজ দ্রুতপদে সেইদিকে আগমন করিতেছেন। ইংরাজত্রয়কে দেখিয়া দারোগাবাবু সেইস্থানে একটু দাঁড়াইলেন। দেখিতে দেখিতে অশ্বারোহীত্রয় সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উহাদিগের দুইজনকে দেখিবামাত্রই দারোগাবাবু চিনিতে পারিলেন। একজন তাঁহার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্ম্মচারী। অপর জন সেই মহকুমার ভারপ্রাপ্ত
কৰ্ম্মচারী। তৃতীয় ব্যক্তিকে সেই সময় যদিচ তিনি চিনিতে পারিলেন না, কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলেন যে তিনি জেলার ডাক্তার সাহেব।
ইংরাজ-অশ্বারোহীগণ দারোগাবাবুর নিকটবর্তী হইয়াই আপনাপন অশ্বের বেগ সংবরণ করিলেন। ইংরাজ- পুলিস-কৰ্ম্মচারী এখন দারোগাবাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “এরূপ দলবল লইয়া তুমি এখন কোথায় গমন করিতেছ?”
দারোগা। আসামী গ্রেপ্তার করিতে।
কৰ্ম্ম-সাহেব। ইহা কি খুনি মোকদ্দমায় পরিগণিত হইল?
দারোগা। তাইতো এখন দেখিতেছি। কৰ্ম্ম-সাহেব। আসামী কে?
দারোগা। নীলকর সাহেব।
কৰ্ম্ম-সাহেব। সাহেবের উপর এই মোকদ্দমা প্রমাণ হইয়াছে?
দারোগা। আমার বিবেচনায় প্রমাণ যথেষ্ট আছে।
কৰ্ম্ম-সাহেব। তুমি সাহেবকে ধরিতে গমন করিতেছ, আমরা না আসিলে এ কাৰ্য্য তুমি সম্পন্ন করিতে পারিতে?
দারোগা। না পারিলে আর যাইতেছি কেন?
কর্ম্ম-সাহেব। তোমার সেরূপ বল কই?
দারোগা। আমার বল যথেষ্ট আছে; আইনবলের বল অপেক্ষা আর অধিক বল কি হইতে পারে?
কৰ্ম্ম-সাহেব। তুমি আমাদিগের সহিত আইস। আবশ্যক হইলে আমরা সাহেবকে ধৃত করিব। অপর আর কোন লোকজনের আমাদিগের সহিত গমন করিবার প্রয়োজন নাই।
এই বলিয়া ইংরাজত্রয় সেই নীলকুঠির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দারোগাবাবুও তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন। চৌকিদার প্রভৃতি অপরাপর লোকজন, সাহেবকে ধরিবার নিমিত্ত গমন করিতে হইবে না জানিতে পারিয়া, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে তাহারা সেইস্থান হইতে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিতে আরম্ভ করিল।
সাহেবত্রয় অশ্বারোহণে ছিলেন; সুতরাং, পদব্রজে গমনকারী দারোগাবাবুর অনেক পূর্ব্বেই তাঁহারা নীলকুঠির মধ্যে গিয়া উপনীত হইলেন। দারোগাবাবু সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগকে দেখিতে পাইলেন না। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলেন, তাঁহারা নীলকর সাহেবের কামরার মধ্যে গমন করিয়াছেন; সুতরাং, তিনি সেই কামরার বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে একজন বেহারা আসিয়া দারোগাবাবুকে সেই কামরার মধ্যে ডাকিয়া লইয়া গেল। তিনি সেইস্থানে গিয়া দেখিলেন, পূৰ্ব্ব কথিত সাহেবক্রয় সেইস্থানে বসিয়া আছে, আর নীলকর সাহেব ও তাঁহার মেমসাহেব সেইস্থানে উপস্থিত আছেন। দারোগাবাবু সেই স্থানে গিয়া দণ্ডায়মান হইলে, কৰ্ম্মচারী সাহেব তাঁহাকে কহিলেন, “এই সাহেব যে হত্যা করিয়াছেন, তুমি তাহার কি প্রমাণ পাইয়াছ?” সাহেবের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু সেই নীলকর সাহেবের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাইয়াছিলেন, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ একে একে বর্ণন করিলেন।
দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া সাহেবগণ কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া পরিশেষে কহিলেন, “প্রমাণের মধ্যে দেখিতেছি, সাহেবের চাকরগণ তাহাদিগের মনিবের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, কিন্তু পরিশেষে তাহারা এই সকল কথা বলিবে তো?
দারোগা। তাহা আমি এখন বলি কি প্রকারে? কিন্তু সমস্ত সাক্ষীই এখন উপস্থিত আছে, অনুমতি হয়তো আমি এখনই তাহাদিগকে আনিয়া আপনাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন, যে তাহারা মিথ্যা কথা কহিতেছে, কি সত্য কথা বলিতেছে।
কৰ্ম্ম-সাহেব। আমি এখন সাক্ষ্যগণের এজাহার শুনিতে চাই না। তোমার কথা শুনিয়া বোধ হইতেছে, সাহেব সম্পূর্ণ রূপে দোষী; সুতরাং, তোমার কথা অনুযায়ী আমি তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতেছি। কিন্তু মোকদ্দমার সময় সাক্ষীর দ্বারা তুমি যদি ইহার প্রমাণ না করিতে পার, তাহা হইলে সাহেবকে গ্রেপ্তার করার নিমিত্ত তোমাকে জবাবদিহি করিতে হইবে।
দারোগা। আপনার বিবেচনায় যেরূপ হয়, তাহাই করিবেন; কিন্তু, সাক্ষীগণ এখানে উপস্থিত আছে, তাহাদিগের মুখে শুনিয়া সাহেবকে গ্রেপ্তার করিলে ভাল হইত না কি?
কৰ্ম্ম-সাহেব। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার সময় তুমি কতকগুলি নিতান্ত বেআইনি কার্য্য করিয়াছ।
দারোগা। আমি কোন রূপ বেআইনি কার্য্য করি নাই।
কৰ্ম্ম-সাহেব। তুমি অনুসন্ধান করিবার মানসে সাহেবের বিনা অনুমতিতে তাঁহার কুঠির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলে কেন?
দারোগা। অনুমতি লইবার সুযোগ আমাকে প্রদান করা হয় নাই। আমি যদি সাহেবের নিকট না আসিব, তাহা হইলে তাঁহার অনুমতি লইব কি প্রকারে? আমি যে সময় তাঁহার হাতার ভিতর আসিতেছিলাম, সেই সময় সাহেব বাহিরে যাইতেছিলেন, তিনি আমাকে দেখিয়াই হাতার ভিতর হইতে আমাকে দূরীভূত করিয়া দেন; সুতরাং, আমি তাঁহার নিকট হইতে কিরূপে অনুমতি গ্রহণ করিতে সমর্থ হই?
কৰ্ম্ম-সাহেব। তুমি আরও একটি নিতান্ত অন্যায় ও বেআইনি কার্য্য করিয়াছ।
দারোগা। কি?
কৰ্ম্ম-সাহেব। সাহেবের সর্দ্দার বেহারা, সর্দ্দার বরকন্দাজ ও অপরাপর কতকগুলি পরিচারককে নিতান্ত অবৈধরূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছ।
দারোগা। আমি কাহাকেও আবদ্ধ করিয়া রাখি নাই। তবে যে সকল সাক্ষিগণের জবানবন্দী লওয়া আমি আবশ্যক বিবেচনা করিয়াছি, সেই সকল লোকদিগকে আমি আপনার নিকট ডাকাইয়া লইয়াছি ও তাহাদিগকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে ও তাহাদিগের জবানবন্দী লিখিতে আমার যে সময়ের প্রয়োজন হইয়াছে, সেই সময় পৰ্য্যন্ত আমি তাহাদিগকে আমার নিকট রাখিয়াছি সত্য, কিন্তু তাহাদিগের উপর কোন রূপ অসদ্ব্যবহার বা তাহাদিগকে অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখি নাই। আমি যেরূপ ভাবে সাক্ষীগণের জবানবন্দী গ্রহণ করিয়াছি, সেইরূপ ভাবে তাহা না করিলে এরূপ মোকদ্দমার কিছুতেই কিনারা ইহবার সম্ভাবনা নাই। ইহাতে যদি আমার অপরাধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে অবশ্যই আমি অপরাধী।
কৰ্ম্ম-সাহেব। সাহেবদিগের চাকর প্রভৃতিকে সময় মত তাহাদিগের কার্য্যে আসিতে না দিলে তাঁহাদিগের যে কতদূর কষ্ট হয়, তাহা জানিয়া তোমার কার্য্য করা উচিত ছিল। যে যাহা হউক, সে সম্বন্ধে এখন আমি তোমাকে আর কোন কথা বলিতে চাহি না। তুমি এখনই তোমার লোকজন সমভিব্যাহারে তোমার থানায় গমন কর। তোমাকে এই মোকদ্দমার আর অনুসন্ধান করিতে হইবে না। যে কর্ম্মচারী এইরূপ মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার উপযুক্ত, তাহাকে আমি এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিব। তুমি এখনই তোমার থানায় প্রত্যাগমন কর; কিন্তু, যে পর্যন্ত তোমার উপর অপর কোন আদেশ না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত তুমি থানার কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিও না। তুমি এখন “সাসপেণ্ড” অবস্থায় থাকিবে।
এই বলিয়া সাহেব, দারোগাবাবুর নিকট হইতে সমস্ত কাগজপত্র গ্রহণ করিলেন। দারোগাবাবু আর কোন কথা না বলিয়া, নত মস্তকে সেইস্থান হইতে আস্তে আস্তে বহির্গত হইয়া গেলেন।
এই ঘটনার প্রায় একঘণ্টা পরে, সাহেবত্রয় সেই নীলকুঠি হইতে বহির্গত হইলেন। এবার তাঁহাদিগের সহিত সেই নীলকর সাহেবও গমন করিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া সকলেই মনে করলেন, এবার আর নীলকর সাহেবের উদ্ধার নাই, স্বয়ং বিচারক ও পুলিসের বড় সাহেব আসিয়া যখন তাঁহাকে ধৃত করিয়া লইয়া গেলেন, তখন তাহার স্থান এবার নিশ্চয়ই জেলের মধ্যে অবধারিত হইবে।
প্রজাগণের মধ্যে অনেকেই মনে মনে এইরূপ ভাবিয়াই যে নিরস্ত থাকিলেন, তাহা নহে। সাহেবকে কোথায় লইয়া যাওয়া হইতেছে তাহা জানিবার নিমিত্ত কেহ কেহ সাহেবদিগের অনুসরণ করিয়াছিলেন ও পরিশেষে প্রত্যাবর্তন করিয়া সকলের নিকট বলিয়াছিলেন, “নীলকর সাহেবকে মহকুমা পৰ্য্যন্ত লইয়া গিয়াছে ও সেইস্থানে তাঁহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে।” কিন্তু পরে জানিতে পারা গিয়াছিল যে, নীলকর সাহেব প্রকৃতই ধৃত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখা হয় নাই, জামিন বা মুচলেকায় ছাড়িয়া দেওয়া হয়।
দারোগাবাবু থানায় গমন করিবার পর, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার সেই মহকুমার বড় দারোগা অর্থাৎ ইনস্পেক্টারের হস্তে অর্পণ করা হয়। তিনিও বাঙালি, কিন্তু তিনি উহার পুনরায় অনুসন্ধান করিয়া যে কিরূপ রিপোর্ট প্রদান করেন, তাহা কেহই অবগত হইতে পারিয়াছিলেন না; সুতরাং, সে সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করা আমার সাধ্যাতীত।
যে দিবস নীলকর সাহেব আর সাহেবদিগের সহিত গমন করিয়াছিলেন, সেই দিবস নীলকুঠিতে অপর কেহ তাঁহাকে প্রত্যাবর্তন করিতে দেখে নাই; সুতরাং নীলকুঠির অপরাপর কর্মচারীগণের মনে যে কিরূপ ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না। যে সময় সাহেবগণ নীলকুঠিতে আসিয়াছিলেন, সেই সময় দাওয়ানজি কুঠিতে উপস্থিত ছিলেন না, কাৰ্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। সেইস্থানেই তিনি সংবাদ পাইলেন, যে তাঁহার মনিব সাহেবকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া সেই দিবস তিনি আর কুঠিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন না। অপরাপর কর্ম্মচারীগণের মধ্যে অনেকেই কোন না কোন কার্য্যের ভান করিয়া ক্রমে সেইস্থান হইতে অন্তৰ্দ্ধান হইতে লাগিলেন। স্থুল কথায়, নীলকুঠির কর্ম্মচারী মাত্রই অতিশয় ভীত হইয়া পড়িলেন। তাঁহাদিগের অবস্থা দেখিয়া প্রজাগণের আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। এই মোকদ্দমায় যাহাতে সাহেব দণ্ডিত হন, তাহার নিমিত্ত সকলেই দেবদেবীর আরাধনায় নিযুক্ত হইলেন। হিন্দুগণ হরিধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। স্থানে স্থানে দেবদেবীর পূজার আয়োজন হইতে লাগিল। মুসলমানগণ স্থানে স্থানে তাহাদিগের দরগায় সমবেত হইয়া আরাধনায় প্রবৃত্ত হইল। স্থানে স্থানে ‘মৌলুদ সরিফের” আয়োজন হইতে লাগিল। কিন্তু হিন্দু বা মুসলমানদিগের আরাধনায় বিশেষ কোন ফল ফলিল না। পরদিবস অতি প্রত্যূষে সকলেই দেখিতে পাইলেন, সাহেব অশ্বারোহণে নীলকুঠি হইতে বহির্গত হইয়া নীল দেখিতে গমন করিতেছেন।
মহকুমা হইতে সাহেব সেই রাত্রিতেই প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রত্যাগমনের সঙ্গে সঙ্গে যে সকল কৰ্ম্মচারী ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহাদিগের ভয় তিরোহিত হইতে লাগিল। যাহারা নীলকুঠি পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারাও ক্রমে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন।
এই অবস্থা দৃষ্টে প্রজাগণের মধ্যে একটু ভয়ের সঞ্চার হইল বটে, কিন্তু সোৎসুক হৃদয়ে সকলেই সাহেবের বিচারফল প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ প্রত্যহই মহকুমায় গমন করিয়া সাহেবের বিপক্ষে কি হইতেছে না হইতেছে, তাহার সংবাদ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন।
সেই সময় মহকুমার মধ্যে এই কথা প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল, যে, রামচন্দ্র বিশ্বাসকে হত্যা করা অপরাধে নীলকর সাহেবের উপর মোকদ্দমা রুজু হইয়াছে, সাহেবও ধৃত হইয়া জামিনে আছেন। কিন্তু, যে পর্যন্ত ডাক্তার সাহেবের নিকট হইতে মৃতদেহ পরীক্ষার ফল না আইসে, সেই পর্য্যন্ত মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইতেছে না।
এই সময় প্রজাগণের মধ্যে অনেকে এরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, কেহ কেহ জেলা পর্যন্তও গমন করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের নিজ হইতে খরচ করিয়া সেই স্থানে গমন করিবার উদ্দেশ্য এই ছিল যে যদি কোন গতিকে তাঁহারা অগ্রে সেই মৃতদেহ পরীক্ষার ফল, ডাক্তার সাহেব বা তাঁহার কোন কর্মচারীর নিকট হইতে অবগত হইতে পারেন; কিন্তু, তাঁহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় নাই। মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সাহেব যে কি মত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা তাঁহারা কোন রূপেই অবগত হইতে না পারিয়া, ক্ষুণ্ন মনে আপন আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন।
এইরূপে ক্রমে কয়েক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। নীলকর সাহেব আপন কুঠিতে অবস্থিতি করিয়া, নিজের কাৰ্য্য সকল দেখিতে লাগিলেন। যে সকল সাক্ষীগণ দারোগার নিকট সকল কথা বলিয়া দিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ সমস্ত কথা একেবারে অস্বীকার করিল। কাহাকেও বা অনুসন্ধানে আর কেহ দেখিতে পাইলেন না। এদিকে দারোগাবাবু নিষ্কর্ম্ম অবস্থায় থানায় বসিয়া নিজের অদৃষ্ট ফল ভাবিতে ভাবিতে সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন।
এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, তথাপি এই মোকদ্দমার বিশেষ ফল কেহই অবগত হইতে পারিলেন না। কিন্তু লোকপরম্পরায় শুনা যাইতে লাগিল, যে এখন পৰ্য্যন্ত খুনি মোকদ্দমা সাহেবের বিপক্ষে আদালতে দায়ের
আছে।
ইহার পর আরও দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, এক দিবস সেই দারোগাবাবু আমাদিগের গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি কোন কার্য্যোপলক্ষে সেই সময় সেই গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন না। তিনি স্থানান্তরে গমন করিবার কালীন তাঁহার পরিচিত দুই এক ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসেই গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। সেই সময় তিনি যাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে বলিয়া যান যে, সাহেবের বিপক্ষে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া তিনি যে শিক্ষা-প্রাপ্ত হইয়াছেন, যত দিবস পুলিস বিভাগে তিনি কৰ্ম্ম করিবেন, তত দিবস তিনি তাহা ভুলিবেন না; ও এখন হইতে চাকরি বজায় রাখিবার নিমিত্ত যেরূপভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়, ঠিক সেই রূপ ভাবেই চলিবেন। প্রকৃত বিচার বা অবিচারের দিকে তিনি আর লক্ষ্য করিবেন না। তাঁহার নিকট হইতে আরও অবগত হইতে পারা গিয়াছিল যে, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে তিনি এক মাস কাল কাৰ্য্যচ্যূত হইয়াছিলেন। ঐ এক মাসের বেতন তিনি কিছুমাত্র প্রাপ্ত হন নাই; তদ্ব্যতীত, বঙ্গ দেশের এক প্রান্তে যে স্থানের জল হাওয়া ভাল নয়, বা যে স্থানে কোন ইংরাজের সংস্রব নাই, সেইস্থানে তাঁহাকে বদলি হইতে হয়।
যে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া দারোগাবাবু দণ্ডিত হইলেন, সেই মোকদ্দমার ফলও ক্রমে সংবাদপত্রে বাহির হইয়া গেল। তখন সকলেই জানিতে পারিলেন যে, ঐ মোকদ্দমা পরিণামে কি দাঁড়াইল। সেই সময় যে সকল সংবাদপত্রে এই বিষয় বাহির হইয়াছিল, তাহার একখানি ইংরাজি সংবাদ পত্রের ভাবার্থ এইস্থানে প্রদত্ত হইল :—
“–নামক সাহেবের বিপক্ষে তাঁহার একজন কর্ম্মচারী রামচন্দ্র বিশ্বাসকে হত্যা করা অপরাধে যে নালিস হইয়াছিল, এখন জানা গেল, সেই অভিযোগ নিতান্ত অন্যায়রূপে রিপোর্ট করিয়াছিল। সাহেবের বিপক্ষে অন্যায়রূপে আনা হইয়াছে। পুলিসের অনুসন্ধানে যে সকল বিষয় স্থির করিয়া লওয়া হইয়াছিল, এখন দেখা যাইতেছে, পুলিস সেই সমস্ত বিষয় নিতান্ত অন্যায়রূপে রিপোর্ট করিলে বা তাঁহার উপর নিতান্ত অলীক মোকদ্দমা রুজু করিলে, পরিণামে অনুসন্ধানকারী-কর্মচারী যে রূপ ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, বর্তমান ক্ষেত্রে অনুসন্ধানকারী দারোগাবাবুও সেইরূপ ফল প্রাপ্ত হইয়াছেন। পুলিস-বিভাগের ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারী কর্তৃক তিনি উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইয়া স্থানান্তরে প্রেরিত হইয়াছেন। এই সকল দেখিয়া শুনিয়াও পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ যে সতর্ক হইতে চাহেন না, ইহাও বড় লজ্জার কথা। এক ব্যক্তি তাহার নিজের কোন কারণবশতঃ জলে আত্মহত্যা করিল, আর পুলিস-কর্মচারী তাহার অনুসন্ধান করিয়া একজন বিশিষ্ট ভদ্র ইংরাজের নামে এক খুনী মোকদ্দমা দায়ের করিয়া দিল। পুলিসের দ্বারা ইহা অপেক্ষা ভয়ানক কার্য্য আর কি না হইতে পারে? আজকাল দেশীয় পুলিস যেরূপ অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িতেছে, তাহাতে আর কিছুদিবস পরে যে কোন ইংরাজ অধিবাসীর মান সম্ভ্রম বজায় থাকিবে, তাহা বোধ হয় না। গভর্ণমেন্টের কর্ত্তব্য, এই সময় হইতেই পুলিসের প্রধান কর্ম্মচারীর পদ দেশীয়দিগের হস্ত হইতে একেবারে উঠাইয়া লওয়া। রামচন্দ্র বিশ্বাস দেশীয় লোক, সে জলমগ্ন হইয়া আত্মহত্যা করিল। দেশীয় পুলিস তাহার অনুসন্ধান করিয়া, একজন ইংরাজের উপর সমস্ত দোষ চাপাইয়া দিয়া, তিনি রামচন্দ্রকে হত্যা করিয়াছেন, এইরূপ ভাবে এক মোকদ্দমা তাঁহার বিপক্ষে রুজু করিলেন। ইহা অপেক্ষা লজ্জাস্কর ও ঘৃণাঙ্কর বিষয় আর কি হইতে পারে? এই মোকদ্দমার বিচারক ইংরাজ না হইয়া যদি একজন দেশীয় হইতেন, রামচন্দ্রের মৃতদেহ একজন ইংরাজ ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষিত না হইয়া যদি একজন দেশীয় ডাক্তারের দ্বারা উহার পরীক্ষা করা হইত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বলা যাইতে পারে যে, বিনা দোষে একজন ইংরাজ চরম দণ্ডে দণ্ডিত হইতেন। রামচন্দ্র বিশ্বাসের মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সাহেব স্পষ্টই বলিয়া দেন, “জলমগ্নই ইহার মৃত্যুর কারণ। ইহার শরীরে কোন রূপ আঘাতের চিহ্ন নাই বা অপর কোন রূপে যে ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। আমার বিবেচনা সে আত্মহত্যা করিবে বলিয়া জলের মধ্যে প্রোথিত কাষ্ঠের সহিত আপনার হস্ত পদ বন্ধন করিয়া ডুবিয়া মরিয়াছে; কারণ, বোধ হয় তাহার মনে ভয় ছিল, ডুবিয়া মরিতে গেলে পাছে ভাসিয়া উঠে ও মরিতে না পরে, এই নিমিত্তেই সে অগ্রে তাহার হস্ত পদ বাঁধিয়া রাখে।”
এইরূপ সংবাদ পত্র পাঠ করিয়া সকলেই জানিলেন যে, আসামীর বিচারের পরিণাম কি হইল। ইংরাজের বিচারে ইংরাজ আসামীর কিছু হইল না সত্য, কিন্তু ঈশ্বরের নিকট তিনি পরিত্রাণ পাইলেন না। এই ঘটনার দুই চারি বৎসরের মধ্যেই সেই নীলকুঠি বিক্রয় হইয়া গেল। যে যাহা পাইল, সেই তাহা খরিদ করিল। এই সকল অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ লেখকও পরিশেষে তাহার একটু বিষয় খরিদ করিয়া লইয়াছিলেন। নীলকর সাহেবের সমস্ত বিষয় বিক্রয় হইয়া গেলে, পরিশেষে তাঁহার অন্ন কষ্ট উপস্থিত হয়, ও পরিশেষে রেলওয়ে কোম্পানির অনুগ্রহে তিনি একটি চাকরি পাইয়া আপনার জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে থাকেন। কিন্তু সেই অবস্থাও তাঁহাকে অধিক দিবস ভোগ করিতে হয় নাই। পরিশেষে তিনি অস্বাভাবিক মৃত্যুর হস্তে পতিত হইয়া এই যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতিলাভ করেন।
[অগ্রহায়ণ, ১৩০৭]