কুকুর

কুকুর

শান্তিনিকেতনের আদি কুকুরগুলোকে দেখে নাগরিকতার প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়। আদি বলছি এই জন্য যে ওখানকার স্থানীয় কুকুরদের জাতই আলাদা। প্রাচীন গুহার দেয়ালে যেসব ছবি আঁকা দেখা যায়, তাতেও এই জাতের কুকুর দেখা যায়। পাতলা গড়ন, সরু সরু হাড়, চিক্কণ নাক-মুখ, ছোট ছোট সুন্দর থাবা। পাটকিলে চোখের ভেতরে তাকালে মনে হয় তলায় কোথায় আলো জ্বলছে। দু’চোখের কোণে নাকের দু’পাশে একটি করে সাদা দাগ। বেশিরভাগের গায়ের রং লালচে, কিম্বা সাদায় লালচেতে মেশানো, কদাচিৎ কালো। দুঃখের বিষয় ক্রমে এরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে।

শুধু চেহারাতেই ওদের বৈশিষ্ট্য নয়, ওদের সামাজিক ব্যবস্থা দেখলে অবাক হতে হয়। আজকাল শান্তিনিকেতনে যেসব বড় সাইজের পুরুষ্টু উটকো কুকুর দিন-রাত খ্যাঁক খ্যাঁক করে বেড়ায়, আমি তাদের কথা বলছি না। তারা সব হালের আমদানি, সুবিধাবাদী। তাদের সঙ্গে আদি কুকুরদের কোনও সাদৃশ্যই নেই। না চেহারায়, না ব্যবহারে। আদি কুকুরদের আজকাল বেশি দেখি না।

মনে হয় আদি কুকুররা সমস্ত আশ্রমটাকে কয়েকটা এলাকায় ভাগ করে ফেলেছিল। যে যার নিজের এলাকাতেই টহল দিত। পরের জমিদারিতে নাক গলাত না। যদি কখনও কারও মতিভ্রম হত এবং সে অন্যের এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করত, তা হলে সেপাড়ার ন্যায্য কুকুররা দল বেঁধে সোৎসাহে ও সরবে তাদের তাড়া দিত। আশ্রমের দূর দূর সীমানা থেকেও সেই কুকুরখেদানি শব্দ শোনা যেত।

একই এলাকার কুকুরদের মধ্যে কখনও ঝগড়া হতে দেখিনি। তার কারণ পাড়ার কুকুররা নিজেদের মধ্যে বাড়িগুলোকে ভাগ করে নিয়েছিল। কোন বাড়িতে কোন বেলা কে খাবে এসব নির্দিষ্ট হয়ে ছিল। কোন বাড়ির লোকরা কখন খায়-দায়, তাও ওদের ভাল করেই জানা ছিল। মক্কেল চটালে নিজেদেরই ক্ষতি তাও জানত। কার কতখানি দৌড় তাও ওদের অজানা ছিল না। আমাদের বাড়িতে কখন সকালের জলখাবার, দুপুরের খাওয়া, রাতের খাওয়া হয়, তাতে ওদের কখনও ভুল হত না।

আগেকার সুষ্ঠু ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়লেও, আজ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের কুকুরদের আত্মসম্মান দেখে আশ্চর্য হই। হ্যাংলার মতো ঘোরে না ওরা। যাদের পালা তারা আমাদের হাতার ভেতরে আসে। বাকিদের তারের বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।

আমরা খেতে বসলে দল থেকে দুটি কুকুর তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলে, জানলার বাইরে চুপ করে বসে থাকে। শুধু দু’জোড়া কান আর দু’জোড়া চকচকে চোখ দেখা যায়। ক্যাঁওম্যাও নেই, হাঁচড়-পাঁচড় নেই। মনটা আগের থেকেই নরম হয়ে যায়। আগন্তুকদের নিয়ম মাঝে মাঝে একটু বদলায়। দুটো বয়স্ক কুকুরের বদলে একটা মা আর দুটো খিদে-পাওয়া ছানা আসে।

কেউ দাও-দাও করে না। বাসনপত্র তুলে নিয়ে গেলে ওরাও উঠে রান্নাঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায়। জানে এবার ভাগ পাবে। খাওয়া হলেই, নিঃশব্দে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে, তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলে দলের সঙ্গে মিলে, ওরা পাশের বাড়ির বাইরে দাঁড়ায়। সেখানে আর দু’জনের পালা।

কেউ ওদের ওপর বিরক্ত হয় না, কারও ওপর ওরাও জবরদস্তি করে না। মানুষের সমাজে এমন ভাল ব্যবস্থা দেখিনি। অবিশ্যি ওদের সব নিয়ম সবসময় বোঝা যায় না। মনে হয় কার বাড়িতে রাত কাটাবে তাও নির্দিষ্ট থাকে। আশ্রমবাসীরাও মিনি-মাগনা পাহারাওয়ালা পেয়ে খুশিই হন।

তবে একেক সময় অন্য পাড়ার উচ্ছৃঙ্খল কুকুররা বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করবার তালে থাকে। ন্যায্য কুকুররা তা হতে দেবে কেন? এইসব ক্ষেত্রে রাত-বিরেতে পিলে-চম্‌কানি গন্ডগোল হয়। সবাই রেগে চতুর্ভুজ! আসল ব্যাপারটা বুঝতে আমার কম করে ৫ বছর লেগেছিল।

অনেক সময় দেখি কুকুররা যাদের বাড়িতে খায়, রাতে তাদের বাড়ি পাহারা দেয়। অন্য বাড়িতে টহল দেয়। সেবাড়িতে হয়তো একজন উটকো ব্যাচেলর থাকেন, আশ্রমের রান্নাঘরে খান, বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। কাজেই কুকুররা সেখান থেকে বিশেষ কিছু আশা করে না। তবু রাতে দু’-একজন ওই বাড়িই পাহারা দেয়। ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। আশ্রমের চৌকিদারকে পর্যন্ত তাড়া করে।

আমরা ভাবি সব বেওয়ারিশ কুকুর একরকম। মোটেই তা নয়। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়দের একটা বড় সাইজের কুকুর ছিল, সে একটু ঝগড়াটে স্বভাবের হলেও, সভা-সমিতি করতে খুব ভালবাসত। একবার এক জায়গায় মাঘোৎসবের উপাসনা হচ্ছে, এমন সময় ওই কুকুর সবাইকে ঠেলেঠুলে একেবারে বুড়ো আচার্যমশায়ের মুখোমুখি ফরাশের ওপর গিয়ে বসল।

তারপর পাক্কা আড়াই ঘণ্টা গান, উপদেশ, প্রার্থনা শুনে সবাই যখন উঠল, ও-ও নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস আচার্যমশাই সারাক্ষণ চোখ বুজে ছিলেন, নইলে চোখ খুলে ছয় ইঞ্চি দূরে ওই কুকুর-মুখ দেখলেই হয়েছিল আর কী!

নাম-করা শিশুসাহিত্যিক অজেয় রায়দের বাড়িতে একটা কুকুর থাকত। হঠাৎ তার চটি খাবার শখ চাপল। চটির বাড়ি নয়, চটির ওপর দিকটা। এখানে সবাই বাইরে চটি খুলে ঘরে ঢোকে। ওদের বাড়িতে কেউ এলে, ঘণ্টাখানেক পরে বেরিয়ে এসে দেখত চটির তলা আছে, ওপরটা নেই! কুকুর ল্যাজ নাড়ছে।

ক্রমে বাড়ির সকলে কুকুরের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠল। বাদে বলাই মুচি। তাকে দিয়ে ওই সব হাফ-খাওয়া চটি সারানো হত। তার কিছু বাড়তি রোজগার হত। সে কুকুরের মাথায় হাত বুলোত, ছিলকেটা বিস্কুটটা খেতে দিত। একদিন কিন্তু তিন জোড়া চটি সারিয়ে পকেটে পয়সা ফেলে, হাসিমুখে বাইরে এসে কুকুরটাকে গাল দিতে লাগল! বলাই যতক্ষণ বাড়ির লোকের চটি সারাচ্ছিল, কুকুর ততক্ষণে বলাইয়ের চটির ওপরটা চেটেপুটে সাবাড় করে রেখেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *