কুকুর-কুকুর
কুকুর হইতে সাবধান (Beware of dogs)। অনেক বাড়ির দরজায় শুধু এটুকু নোটিশ লাগিয়ে গৃহকর্তার মনে শান্তি হয় না, তাঁরা বিজ্ঞপ্তির পাশে একটি হিংস্র সারমেয়ের দাঁত ও জিব বের করা ছবিও এঁকে রাখেন। অনেক সময়েই দেখা যায়, ছবির হিংস্র কুকুরটির সঙ্গে গৃহস্থ কুকুরটির কোনও মিলই নেই, সে নিতান্ত ভিতু, নিরীহ এবং সর্বোপরি নেড়ি। সে যা হোক, কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা যে কোনও রকম কুকুর দেখলেই ভয়ে হিম হয়ে যান আবার অনেকে কোনও কুকুরকেই তেমন পরোয়া করেন না।
তবে ওই ‘কুকুর হইতে সাবধান’ কথাটায় আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। কথাটা কেমন যেন খটমটে এবং অবাংলা। বরং ‘কুকুর আছে, সাবধান’ কিংবা ‘সাবধান, কুকুর আছে !’ কিছুটা ভাল।
এবার কুকুরের গল্পে আসি। যাঁরা কুকুর নিয়ে রঙ্গরসিকতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বা বিরক্ত বোধ করছেন কিংবা সেইসব কুকুর-অন্ত প্রাণ সারমেয় প্রেমিকেরা যাঁরা কুকুর নিয়ে ঠাট্টা করায় আহত রয়েছেন, তাঁদের জন্য এবার প্রথমেই দুটি দু’রকম উপহার আছে।
প্রথম কাহিনীটা রীতিমতো রহস্যময় এবং দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক।
রহস্যময় কাহিনীটি আমি অন্যের কাছে শুনেছি। কিন্তু বক্তব্যের সুবিধার জন্য নিজের জবানিতে লিখছি।
কয়েক সপ্তাহ আগে একদিন সকালে শহরতলিতে আমার এক বৃদ্ধ আত্মীয়ের বাড়িতে গেছি। ভদ্রলোক একটু বিচিত্র চরিত্রের লোক, বহুরকম অভিজ্ঞতা তাঁর। তাঁর সঙ্গে নানারকম বিষয়ে কথা হচ্ছে। এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে একটি সাধারণ দিশি কুকুর আমরা যে বসার ঘরে বসে আছি সেখানে এসে ঢুকল এবং আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল, ‘আজ সকালের আনন্দবাজারটা কোথায় গেল।’ পাশেই টেবিলের উপরে খবরের কাগজটা ছিল, ভদ্রলোক এগিয়ে দিতেই কুকুরটা সেটা নিয়ে আবার পাশের ঘরে চলে গেল।’
আমার তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, কুকুর কথা বলছে, কাগজ পড়ছে; জীবনে কোনওদিন কল্পনা করতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হয়ে ভদ্রলোককে বললাম, ‘আপনার কুকুর খবরের কাগজ পড়তে নিয়ে গেল ?’ বৃদ্ধ ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমার ধারণা হয়েছে ও ওই কাগজটা পড়বে ?’ আমি তখনও হতভম্ব হয়ে আছি, বললাম, ‘তবে ? ভদ্রলোক বললেন, ‘খবরের কাগজ পড়ার বিদ্যাবুদ্ধি ওর নেই। শুধু প্রত্যেকদিন সকালে অনেকক্ষণ ধরে ওই অরণ্যদেব আর গোয়েন্দা রিপটা মন দিয়ে দেখে।’
এ গল্পটি অবশ্যই অবিশ্বাস্য। তবে এর পরের রাজনৈতিক কাহিনীটি হয়তো তত অবিশ্বাস্য নাও হতে পারে।
ঘটনাটি ঘটেছিল পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এক ভারতীয় গ্রামে। পাকিস্তান অঞ্চল থেকে একটা কুকুর একদিন সেই গ্রামে প্রবেশ করেছে। কুকুরটি রীতিমতো গায়ে-গতরে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। দেখলেই বোঝা যায় আরাম এবং সাচ্ছল্যের মধ্যে সে বড় হয়েছে।
এদিকে ভারতীয় গ্রামের কুকুরগুলির অস্থিচর্মসার, মড়াখেকো চেহারা। তারা কোনওদিন ভাল করে পেট পুরে খেতে পায় না। তারা এই কুকুরটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল, তার সঙ্গে গল্পগুজব করতে গেল। কথায় কথায় যখন জানল যে ওই পাকিস্তানি কুকুরটি প্রতিদিন সকালে দু’ লিটার দুধ খায়, দুপুরে রাতে এক কেজি করে সুস্বাদু মাংস খায়; ভারতীয় কুকুরেরা অবাক হয়ে গেল, তাদের সকলের তখন একটাই জিজ্ঞাসা, তা হলে তুমি অত আরাম, বিলাসবৈভব ছেড়ে আমাদের এ কষ্টের এলাকায় এলে কেন ? এখানে তো কিছুই খেতে-টেতে পাবে না। পাকিস্তানি কুকুরটি বিরসবদনে বলল, ‘আমি কি আর সাধে এসেছি, ওরা যে ওপারে একদম ভৌ ভৌ করতে দেয় না। আমি যে আবার একটু ভৌ ভৌ না করে থাকতে পারি না।’
দেশে দেশে, কালে কালে কুকুর নিয়ে সহস্র গল্প। সেই কবে বেদব্যাস মহাপ্রস্থানের পথে তাকে যুধিষ্ঠিরের শেষ সঙ্গী করেছিলেন, তারও আগে কিংবা পরে সে প্রবেশ করেছিল পিরামিডের অভ্যন্তরে। হিতোপদেশ আর ঈশপের কথামালার যুগ থেকে, তারও আগে থেকে সে মানুষের চিরসঙ্গী।
কুকুরপ্রীতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন লর্ড বায়রন। তাঁর প্রিয় কুকুরের মৃত্যুতে তার সমাধিফলকের জন্য রচিত বিখ্যাত কবিতাটি অনেকেই হয়তো পড়েছেন। যেখানে বলা আছে, ‘আমি জীবনে আর কোনও বন্ধুকে জানি না, শুধু একজনই ছিল, সে এখানে শায়িত।’ সেই দীর্ঘ কবিতার শেষে আরও একটি এপিটাফ আছে, সেখানে বলা আছে, ‘বেটসোয়াইন, একটি কুকুর, মানুষের সব গুণই তার ছিল, মানুষের কোনও দোষই তার ছিল না।’
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আজ যদি কেউ বায়রনের সমাধি খুঁজতে যান তাঁকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হবে। ইংল্যান্ডের হাকাল গ্রামে লর্ড বায়রনের পারিবারিক কবরখানায় অনেক প্রস্তরলিপির মধ্যে একটি গৌণ ফলকে তাঁর নাম ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা। অথচ অদূরে নিউস্টেড অ্যাবেতে রয়েছে তাঁর প্রিয় কুকুর বেটসোয়াইনের সুরম্য সমাধিমন্দির, কারও দৃষ্টিই সেটা এড়াবে না।
আমিও একজন কুকুরভক্ত সামান্য লেখক। তবে নিজে লেখার চেয়ে টুকে লেখাতেই আমার বেশি ফুর্তি। এমনকী আমার নিজের কুকুরের ক্ষেত্রেও তাই করেছিলাম, আলেকজান্ডার পোপের বিখ্যাত শ্লোক থেকে চুরি করে একদা আমি আমার কুকুরের গলার বকলসে ব্যাজ লাগিয়ে লিখে দিয়েছিলাম,
‘আমি হুজুর, পণ্ডিতিয়ার
তারাবাবুর কুকুর।
আপনি হুজুর কোথাকার
কোন বাবুর কুকুর ?’
এই ছোটলোকি পদ্য পড়ে কত বড়লোকের যে মাথা হেঁট হয়েছে তার শেষ নেই। আর এ ছাড়া আমি কিইবা করতে পারি। আমি আজ পর্যন্ত যত কুকুর পুষেছি বায়রন সাহেবের মতো তাদের সমাধিমন্দির করতে গেলে পুরো কলকাতা ময়দান লেগে যেত।
আধুনিক হাসির রচনার সঙ্গে কুকুর মিলেমিশে রয়েছে প্রথম থেকেই। অদ্যাবধি রচিত শ্রেষ্ঠ হাসির উপন্যাসটির নামই হল, ‘একটি নৌকায় তিনজন মানুষ, কুকুরটির কথা না বলাই ভাল’, উপন্যাসকার জেরোম কে জেরোম। এ বই যিনি পড়েননি, তিনি হাসির রচনার কিছুই পড়েননি।
তবে কুকুর সম্বন্ধে মোক্ষম কথা বলে গেছেন থার্বার। জেমস থার্বার, নিউ ইয়র্কার কাগজের বিখ্যাত সরস লেখক এবং গ্রন্থকার, এই শতকে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন কুকুর নিয়ে। কুকুর নিয়ে অসামান্য সব কার্টুনও এঁকেছেন। থার্বার বলেছিলেন, ‘কুকুররা মানুষকে নিয়ে যত মজা পায়, মানুষরা কুকুর নিয়ে ঠিক তত মজা পায় না কারণ এই দু’রকম জন্তুর মধ্যে মানুষই বেশি হাস্যকর।’
কোটেশন কণ্টকিত এই কুকুরকাহিনী শেষ করার আগে দু’-একটা সত্যিকারের মজার কথা বলি।
প্রথম গল্পটি অভিনেতা রবি ঘোষ মশায় বোধহয় বলেছিলেন কিংবা স্বর্গীয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সে যাঁর গল্পই হোক, তাঁর একটা কুকুর ছিল। সেই কুকুরের জন্যে বাড়িতে চোর বা কোনও বাইরের লোক এলেই তিনি বুঝতে পারতেন। না, কুকুরটা গর্জন, ঘেউ ঘেউ, তেড়ে যাওয়া, কামড়ে দেওয়া এসব কিছুই করত না। সে ছিল একটা অত্যন্ত ভীরু কুকুর। বাড়িতে কোনও অচেনা ব্যক্তির আবির্ভাবের গন্ধ পেলেই সে পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে প্রভুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। একবার একটা চোর ঢুকেছে বাড়িতে, গভীর রাত, প্রভু নিদ্রামগ্ন, কুকুরটা মশারি ছিঁড়ে বিছানার মধ্যে ঢুকে প্রভুর কোলে গিয়ে লুকোতে প্রভু টের পেলেন বাসায় চোর এসেছে।
আর একবার হাতিবাগান বাজারের সামনে এক রবিবার সকালে আমার এক বন্ধুর মেয়ের জন্যে একটা কুকুরছানা কিনতে গিয়েছিলাম, একটা বাচ্চা পছন্দ হওয়ার পর কুকুরওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা বেশ বিশ্বস্ত, প্রভুভক্ত হবে তো ?’ গম্ভীর মুখে তিনি বললেন, ‘বিশ্বস্ত? জানেন এই কুকুরটা এখন পর্যন্ত চারবার বেচেছি, চারবারই খদ্দেরের বাড়ি থেকে পালিয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে।’