উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

কুকুরের ডাক্তারি

কুকুরের ডাক্তারি

মেজোমামা অষ্টাবক্র মুনির মতো কাতরাতে কাতরাতে বড়মামার ঘরে এসে ঢুকলেন। ডান হাতটা কোমরে। পরনে কালো শর্টস, স্যান্ডো গেঞ্জি। গলার কাছে একটা সোনার পদক ঝুলছে। চোখে চশমা নেই তাই মুখটা একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে।

বড়মামা সকাল থেকেই আজ ভীষণ ব্যস্ত। বড়মামার কুকুর লাকি নাকি রোগা হয়ে যাচ্ছে। গায়ে বুরুশ দিলেই গাদা গাদা লোম উঠে আসছে। সাতদিন আগেও বড়মামাকে দেখলে যেভাবে যত ঘনঘন পটাক পটাক ন্যাজ নাড়ত ইদানীং তত জোরে আর নাড়ছে না। নাড়ছে, তবে দেওয়ালঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ধীরে ধীরে, একবার এদিকে একবার ওদিকে। ডাকেরও আর তেমন ঝাঁঝ নেই। মিইয়ে মিইয়ে ডাকে। সবসময় হাত-পা ছড়িয়ে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে থাকে।

সেই কুকুরের জন্যে সুষম খাদ্য তৈরিতে বড়মামা ব্যস্ত। সামনে একটা বড় বই খোলা। বারে বারে পাতা উলটে যাচ্ছে বলে আমার ওপর হুকুম হয়েছে, ‘ধরে থাক। বই আর ছাত্র দু-পক্ষই সমান চঞ্চল। শুধু ছাত্রদের দোষ দিলেই তো হবে না, বইয়ের স্বভাবটাও তো দেখতে হবে। তখন থেকে খোলা রাখার চেষ্টা করছি। চশমার খাপ, পেপার ওয়েটমোয়েট কোনও কিছু দিয়েই জব্দ করা যাচ্ছে না। স্বভাব যাবে কোথায়? পাতায় পাতায় এত জ্ঞান ঠাসা, স্বভাবে নির্বোধ। ঝপাত করে বন্ধ হয়ে গেলেই হল।’

একটু আগেই বইয়ের সঙ্গে ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়ে গেছে। বইটার মাঝামাঝি একটা জায়গা খুলে বড়মামা একপাশে চাপা দিয়েছিলেন চশমার খাপ আর একপাশে একখণ্ড চৌকো কাঠ। আমি বসেছিলুম জানালায় পা তুলে। হাতে টিনটিন। মেজোমামা কালই এনে দিয়েছেন। কোমর দুরমুশ করে দেওয়ার পুরস্কার। হঠাৎ হুম্মার দুড়মুড় শব্দ। কাঠের টুকরো, চশমার ভারী খাপ দুটোই মেঝেতে। পাশাপাশি চিৎপাত। পরক্ষণেই বইটাও মেঝেতে। বড়মামার দাঁত কিড়মিড় করছে, ‘রাসকেল, থার্ডগ্রেড ইডিয়ট। আমি দেখছি, দেখে যাচ্ছি।’

বড়মামা বইটাকে মেঝেতে ফেলে জায়গা মতো খুললেন। তারপর সেই খোলা বইটার ওপর গ্যাঁট হয়ে বসেই বললেন, ‘যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। লাইক ডগ, লাইক ক্লাব।’

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মন্তব্য করলেন, ‘রাসকেল শব্দটা গালাগাল নয়। তুমি আবার মেজোকে গিয়ে যেন বোলো না বড়মামা সবসময় গালাগাল দেন।’

‘বইটার ওপর ওভাবে বসলেন?’

‘ওর মেরুদণ্ড ভেঙে না দিলে কাজ করা যাবে না। মানুষের মতো জ্বালাতনে স্বভাব হয়েছে। উনি খোলা থাকতে চান না, বন্ধই থাকবেন। এই যা অবস্থা হল এখন সারাজীবন খোলাই থাকবে, বন্ধ আর হবে না।’

মোটা রেকসিন বাঁধাই ‘ডগ ম্যানুয়েল’। পাতায় পাতায় পৃথিবীর যাবতীয় কুকুরের ছবি। বড়মামার ভারে সামান্য দমে গেলেও মেরুদণ্ডের জোর এখনও বেশ প্রবল। বইটার ওপর আরও অত্যাচারের প্ল্যান হচ্ছিল। মমতা পড়ে যাওয়ায় ছুটে এসে ধরে আছি।

টেবিলের কাচের ওপর নানারকম ট্যাবলেট ফেলে শিশির পেছন দিয়ে বড়মামা গুঁড়ো করছেন। কাজে এতই ব্যস্ত, মেজোমামা এসেছেন লক্ষ্যই করেননি।

মেজোমামা কাতরাতে কাতরাতে বললেন, ‘কোমরটা আর সোজা করতে পারছি না।’

‘সারা জীবন বেঁকে বসলে সোজা হবে কী করে? বেঁকেই থাকবে।’ মুখ না তুলেই উত্তর দিলেন বড়মামা।

‘আহা, সোজা করতে গিয়েই বেঁকে গেল।’

‘অ্যাঁ, সে আবার কী? কুকুরের ন্যাজ নাকি? সোজা করা যায় না?’ বড়মামা এইবার চোখ তুলে তাকালেন। তাকাতেই হল।

‘কোমর সোজা করা যায় না মানে? এই দ্যাখ আমার কোমর। সোজা করছি, বাঁকা করছি।’ বড়মামা মেঝেতে বসে বসেই মেজোমামাকে কোমর বাঁকানো আর সোজা করার খেলা দেখাতে লাগলেন।

মেজোমামার ডান হাতটা কোমরে। শরীরটা সামনে বেঁকে ধনুক। চেষ্টা করেও সোজা হতে পারছেন না। মুখ দেখে মনে হয় যন্ত্রণাও হচ্ছে। সেই অবস্থায় বললেন, ‘তোমার কোমর আর আমার কোমরে অনেক তফাত।’

বড়মামা সামনের দিকে ঝুঁকতে যাচ্ছিলেন। সোজা হয়ে বললেন, ‘তার মানে? কীসের তফাত? তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। তুমি কি নিজেকে অতিমানব ভাবো নাকি? ও তোমার হল গিয়ে শৌখিন কোমর আর আমার হল গিয়ে মেহনতি কোমর।’

মেজোমামা প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘সব কথাকেই তুমি বড় বাঁকা করে নাও, বড়দা। তোমার কপালে ভিটামিন বি কমপ্লেকসের গুঁড়ো।’

বড়মামা কপালে হাত দিলেন। মেজোমামা থামেনি, ‘আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তুমি ক্যাঁট-ক্যাঁট করে কথা শোনাতে লাগলে। আমি বলতে চাই, তোমার শরীরটা চিরকালই তো ভালো। ব্যায়াম-ট্যায়াম করো। আসন করো। আমার তো সেসব নেই। কোমরটাকে না খেলিয়ে খেলিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি।’

মেজোমামার কথায় বড়মামা যেন খুশিই হলেন। প্রশ্ন করলেন, ‘খেলাওনি কেন? পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান তোমার মাথায়, এই জ্ঞানটাই নেই, দরজার কবজাকে যেমন খেলাতে হয় তেমনি শরীরের কবজাকেও সচল রাখতে হয়।’

‘আহা! এতদিন পরে সেই জ্ঞানটাই তো হয়েছিল। কদিন থেকে কনকন করছে, কনকন করছে। সকালে উঠে ভাবলুম, মাথার ওপর হাত তুলে কানের পাশে চেপে ধরে হাঁটু না ভেঙে সামনে ঝুঁকি, ঝুঁকে পায়ের পাতা ছুঁই। হাঁটুটা একটু বাঁকলেও মোটামুটি হল, তারপর যেই সোজা হতে গেলুম খটাক করে একটা শব্দ হল, আর আমি এইরকম হয়ে গেলুম।’ মেজোমামার মুখ কাঁদো-কাঁদো।

অন্যের দুঃখে বড়মামা সবসময়েই কাতর। উঠে দাঁড়ালেন। মেজোমামাকে বললেন, ‘আয়, ঘরের মাঝখানে সরে আয়। ওষুধে কাজ হবে না। ফিজিওথেরাপি করতে হবে।’

মেজোমামা একপাশে চেত্তা খেতে খেতে ঘরের মাঝখানে সরে গেলেন। মেজোমামার বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। হাসি চাপবার কুঁক-কুঁক শব্দ হল কয়েকবার। ভীষণ অসভ্যতা। কী করব, চাপতে পারছি না।

বড়মামা মেজোমামার কোমরে আস্তে আস্তে দুবার চাপড় মারলেন, ‘অ্যাঁ, একেবারে দরকচা মেরে গেছে। রেগুলার একে তেল খাওয়াতে হবে। জং ধরে গেছে।’ দু-হাত পিছিয়ে এসে দেওয়ালে টাঙাবার সময় যেভাবে বাঁকা সোজা দেখে, বড়মামা সেইভাবে মেজোমামাকে দেখতে লাগলেন। ‘মনে রাখ, ফর্টি ডিগ্রি নর্থ, টেন ডিগ্রি ওয়েস্ট, জিরো ডিগ্রি ইস্ট।’

বড়মামার কথা শুনে মেজোমামা বললেন, ‘তুমি যেন জাহাজ চালাচ্ছ?’

‘এইবার বুঝবি কেন বাউলরা বলে দেহতরী। প্রথমে তোকে ঠেলে উত্তরদিকে চল্লিশ ডিগ্রি তুলব, তারপর দু-কাঁধ ধরে পশ্চিমে দশ ডিগ্রি মুচড়ে দেব, পুবে কিছু করতে হবে না। ব্যস, আবার তুই সোজা প্রফেসার হয়ে যাবি।’

বড়মামা কুস্তিগিরের মতো হাতের তালুতে তালু ঘষলেন। মেজোমামা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘এটা তো তোমার আসুরিক চিকিৎসা হয়ে গেল দাদা। ভীষণ লাগবে। এমনকী চিরকালের মতো আমার কোমরটা কবজা ভাঙা দরজার মতো ঢকঢকে হয়ে যাবে।’

‘অ্যানাটমির তুমি কী বোঝো হে! মেরুদণ্ডের শেষটা কীরকম তুই জানিস? কটা হাড় আছে তুই জানিস? ওই জায়গাটার হিঞ্জ সিস্টেম তুই জানিস?’

কথা বলতে বলতে বড়মামা মেজোমামার দিকে এগোচ্ছেন। মেজোমামা একটু একটু করে পেছোচ্ছেন। বড়মামা বলছেন, ‘তুই ভাবছিস সামনের দিক থেকে তোকে মারব? মোটেই না। পেছন দিক থেকে একটা হাত চালিয়ে দেব তোর গলার ওপর দিয়ে আড়াআড়ি। কবজাটাকে লাগিয়ে দেব গলা আর দাড়ির মাঝখানের খাঁজে, তারপর পেছন দিকে মারব টান।’

মেজোমামার মুখ দেখে মনে হল পালাতে চাইছেন। ক্রমশ দরজার দিকে পেছোচ্ছেন। বড়মামা ধরতে পেরেছেন, ‘তুই সরে সরে দরজার দিকে যাচ্ছিস কেন? পালাবার মতলব?’

মেজোমামা বললেন, ‘তোমার হাবভাব আমার মোটেই ভালো ঠেকছে না, দাদা। যে ভাবে ব্ল্যাকপ্যান্থারের মতো গুটি গুটি এগিয়ে আসছ! আমার ভয় লাগছে। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। নিজে নিজেই ঠিক করে নোব।’

‘তার মানে? অবিশ্বাস? আমাকে হাতুড়ে ভাবছিস? শরীরতত্ত্বের কিছুই জানি না!’

‘আহা, তা ভাবব কেন? এই গ্রামে তোমার মতো অ্যালোপ্যাথ আর কি আছে? আসলে অ্যালোপ্যাথিতে আমার আর তেমন বিশ্বাস, না না, বিশ্বাস নয়, উৎসাহ নেই। আমি হোমিওপ্যাথি করাতে চাই।’

‘ধ্যার, আমি কি তোকে অ্যালোপ্যাথি করছি নাকি? ফিজিওথেরাপিতে সবে যে ট্রেনিং নিয়ে এলুম গত তিনমাস ধরে, তারই প্রথম প্রয়োগ হবে তোর ওপর। এরকম একটা কেস এত সহজে ঘরে বসেই পেয়ে যাব ভাবিনি।’

‘দাদা, তোমার পায়ে পড়ছি। বিশ্বাস করো, আমি প্রায় সোজা হয়ে গেছি। তাকিয়ে দ্যাখো? আগের চেয়ে সোজা সোজা লাগছে না?’ মেজোমামা জোর করে একটু সোজা মতো হতে গিয়ে আউ করে চিৎকার করে উঠলেন।

বড়মামা শব্দ করে হেসে বললেন, ‘আমার হাত না পড়লে তুই মেরামত হবি না রে মেজো!’

বড়মামা দরজা আটকে ফেলেছেন, ‘চল, চল, ঘরের মাঝখানে একটু স্থির হয়ে দাঁড়া। তুই তো জানিস একসময় আমি কুস্তি করতুম। তুই যত চলে চলে বেড়াবি আমি আর তোকে রুগি ভাবতে না পেরে প্রতিপক্ষ ভেবে হঠাৎ একটা আড়াই-প্যাঁচ মেরে দোব, তখন মাস তিনেক আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবি না।’

বড়মামার খাটের তলায় এক টুকরো কার্পেটের ওপর লাকি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল। শরীর ভালো না। সারাদিন শুয়েই থাকে। পেছন দিকে অল্প অংশ ন্যাজ সমেত খাটের বাইরে বেরিয়ে আছে। বড়মামাকে সত্যিই এবার কিং কংয়ের মতো মনে হচ্ছে। যেমন করেই হোক মেজোমামাকে ধরে পেছন দিকে মটকে দেবেন। মেজোমামা বেকায়দা। খাটের দিকে পিছু হটছেন।

আমি জানতুম এইরকম ঘটনাই ঘটবে। লাকির বেরিয়ে থাকা ন্যাজে মেজোমামার পদপাত। অনেকদিন পরে লাকি লাফিয়ে উঠল। সেই পুরনো ঝাঁঝ, সেই পুরনো চিৎকার। ঘাউ ঘাউ করে লাফিয়ে উঠেছে। খাটে মাথা ঠুকে কেঁউ কেঁউ। মেজোমামার ভীষণ কুকুর ভীতি। আচমকা লাকির চিৎকারে অনায়াসেই সোজা হয়ে গেছেন। কোমরের খটকা নিজেরই চমকানিতে খুট করে খুলে গেছে।

বড়মামা টেবিল থেকে লাকির সুষম খাদ্য তৈরির সমস্ত মালমশলা সরাতে সরাতে বললেন, ‘বুঝলি, ডাক্তারের কুকুরও ডাক্তার হয়। আমাকে হাত দিতেই হল না। আমার অ্যাসিসটেন্টই এক চিৎকারে তোর মেজোমামাকে মেরামত করে দিলে!’

আমি বললুম, ‘মেজোমামার পা যেন রামচন্দ্রের পা। লাকির ন্যাজে পড়তেই অহল্যা উদ্ধারের মতো চাঙ্গা হয়ে উঠল। সেই থেকে কীরকম চেল্লাচ্ছে দেখেছেন। সেই পুরনো মেজাজ।’

কথাটা বড়মামার তেমন পছন্দ হল বলে মনে হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *