অধ্যায় ৭
“তুই–”
“খুনটা কারা করেছে?
“মাই গড!”
তিন জন প্রায় একই সাথে বলে উঠেছে। তাদের মুখে ফুটে ওঠা উৎকণ্ঠাটুকু অকৃত্রিম। মুহূর্তের মধ্যেই এত্তোগুলো ঘণ্টা পর প্রথমবারের মতো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলো মুহিব। প্রত্যক্ষদর্শি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনুভব করা অসহায়ত্ব আর আতঙ্ক যেন নিমেষেই উধাও হয়ে গেছে।
“খুনটা কারা করেছে আমি জানি না।” ডাহা মিথ্যেটা বলার সময় মাথাও নাড়লো মুহিব। পরিচিত কণ্ঠটির কথা তুললো না আর, “তবে ব্যাপারটা আমি খতিয়ে দেখতে চাই।”
“তাদের তুই না চিনলে কি করে—”
“অতো কাছে বসে ছিলি, তোকে কিছু বলল না?”
আবারও একই সাথে প্রশ্ন করেছে লিটু আর ইলোরা।
“না, আমাকে দেখতে পায়নি ওরা।” লাশের রক্তমাখা সিগারেটের ফিল্টার উদ্ধারের আলোচনা আর করলো না মুহিব।”আর কিভাবে তাদের চিনবো তা নিয়ে এখনও ভাবিনি। তবে ওদের টুকরো কথাবার্তা কানে এসেছে। আশা করি একটা কিছু করে ফেলতে পারবো।”
আরও একবার চুপচাপ হয়ে গেলো ঘরের ভেতরটা। শামীমকেই খানিকটা নির্বিকার দেখাচ্ছে। চানাচুরের প্যাকেট খুলে মুখে কিছুটা ফেললো সে। মুহিবের হাত থেকে সিগারেট কেড়েও নিলো।
“তাহলে আমরা একটা সিচুয়েশনে পড়ে গেলাম।” অবশেষে ‘মূল্যবান’ মতামতটা ছেড়ে দিলো শামীম, “মুহিব একটা মার্ডার কেসের সাক্ষী। আর দশটা মার্ডার কেসের সাথে একে মিশিয়ে ফেললে হবে না। এটা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হবে। তোলপাড়ে আমরা থাকি বা না থাকি, খাদ্যমন্ত্রি থাকবেন। রাজনৈতিকভাবে টানা হ্যাঁচড়া চলতে পারে। ক্যাম্পাস খুলুক আর না খুলুক, এইসব সমস্যা এড়ানো যাবে না।”
দীর্ঘ এক নীরবতা। শামীম তার নাটুকেপনা ধরে রাখতে সব সময়ই ব্যস্ত। এই ফাঁকে চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের সিগারেটে আগুন ধরালো ইলোরা। ঘরের ভেতর ধোঁয়ারা জমে উঠছে জমাট তরলের মতো।
“সত্যিকারের ঝামেলাটা হবে মুহিবের। এসবের মধ্যে যদি কোনোভাবে মুহিবের নাম একবার চলে আসে, পুরো সমস্যাটার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যাবে ও।”
“কিন্তু ও তো কেবল এক সাক্ষী। এর বেশি কিছু না।” কথাটা লিটু এমনভাবে বলল যেন এখানে মুহিব উপস্থিত নয়।
“বুঝতে পারছিস না কেন? কাজটার পেছনে রাজনৈতিক মদদ আছে বলে মুহিব মনে করছে। আর সেক্ষেত্রে আসল খুনিরা থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। তারা খুঁজবে খিড়কির দরজা। আর মুহিব হবে সেই খিড়কির দরজা।”
“কারণ ও সেই সময় ক্রাইম সিনে উপস্থিত ছিল।” ইলোরাও বোঝালো লিটুকে, “ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারবে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট খুনিরা। কারণ, আদালত চায় অপরাধী। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটা খুনি না ফেঁসে যাওয়া নিরপরাধ তা বোঝার ক্ষমতা থাকবে না বিচারকের, প্রমাণ সব ওর বিরুদ্ধে থাকবে। রাজনৈতিকভাবে মুহিবকে ফাঁসালে সেভাবেই ফাঁসাবে। আর ও খুনের দায়ে জেল খাটা শুরু করলে কেসটা ক্লোজড হয়ে যাবে। আসল খুনিদের নামে হত্যা মামলা আসার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।”
সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে মাথা দোলালো লিটু। এসব মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিও হয়। মানুষ সামান্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এতো হানাহানি করে কেন? লিটুর মাথায় এতোকিছু ঢোকে না। চাষার ছেলে হিসেবে সে গর্বিত। রাজনীতির মাঠে নেমে ক্ষমতার অপব্যবহার তো তার বাবা করেনি কখনও, নেমেছেন বড়জোর ফসলের মাঠে। হত্যা মামলা নিয়ে চিন্তার দরকারও তাই আগে কখনও পড়েনি। এখন ঘটনা অবশ্য ভিন্ন, মুহিবের সমস্যাটা বুঝতে হলেও এসব তাকে জানতে হচ্ছে। লিটুর মাথা ধরে আসে। ইলোরার বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেটটা সে খুশি মনেই নিলো।
“আমাকে ওখানে কোনোভাবে ফিট করতে পারবে বলে মনে হয় না।” অবশেষে চানাচুরের প্যাকেটটা নিজের কাছে নিয়ে মুহিব বলল।
“এটা তুই নিশ্চিত করে বলতে পারিস না। আদালতে যদি তোকে তোলা হয়, উকিলের প্রশ্ন কি হবে তা হয়তো বুঝতে পারছিস না।” শামীম যথারীতি তার ধীরস্থির গলায় বলে চলেছে, “ঘটনার রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তরে কি বলবি? মেসে নিজের রুমে ছিলাম? তখন প্রশ্ন আসবে, এই বক্তব্য সমর্থনের জন্য কেউ কি আছে? থাকিস তো সিঙ্গেল রুমে। কাজেই তোর বক্তব্য সমর্থনের উপায় কারও থাকবে না।”
“তুই বলতে চাইছিস, মুহিবের একটা অ্যালিবাই দরকার?”
ইলোরার কথায় সায় দিলো শামীম, “সেটাই বলতে চাচ্ছি। এক কাজ করা যায়, আমাদের সঙ্গে মুহিবও গিয়েছিলো সেটা দেখিয়ে দেওয়া চলে। ভুতবাবাকে একটু ম্যানেজ করতে হবে। আর লিটুকে করতে হবে সুইপ।”
“আমি সুইপ করবো মানে, ক্রিকেটের সুইপ–”
“আরে না। তুই হয়ে যাবি মুহিব, যদি আমাদের অ্যালিবাই দেখানোর প্রয়োজন পড়ে।”
“তেমন কিছুর দরকার…” মুহিব শুরু করতে চাইছিলো, ওকে পাত্তাই দিলো না কেউ।
“অর্থাৎ ভুত ধরতে গিয়েছিলাম আমি, তুই, মুহিব আর ভুতবাবা? লিটু বন্ধে ফিরেছিলো বাড়ি। দরকারে এমনটা বলবি?”
মাথা ঝাঁকালো শামীম। লিটু এখনও এসব মিথ্যে সাজানোর বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তাকে বোঝানোর জন্য বাকিদের ব্যস্ত হতে দেখা গেলো।
“আমার কথাটা কি শুনবি তোদের কেউ?” বেশ কর্কশ কণ্ঠেই বলল মুহিব এবার, “অ্যালিবাইয়ের দরকার নেই। মেসের কমনরুমে বসে সেটা আমি নিশ্চিত করেছি। তোরা যা করতে চাইছিস তাতে করে মিথ্যে সাক্ষী দিতে হবে, তাই তো? এতে করে তোরা তিনজন তো বটেই, সঙ্গে ভুতবাবা পর্যন্ত ফেঁসে যেতে পারে।”
নতুন করে শুরু করলো এবার শামীমরা। সে রাতে মেসে ফিরে মুহিবের অ্যাক্টিভিটিগুলো বিস্তারিত শুনলো। এই অ্যালিবাইয়ের মধ্যে ফাঁক ফোকড় আছে কি না তা নিয়ে আলোচনা হলো। কে কে দিনটায় মুহিবকে কমনরুমে মনে রাখতে পারে তাদের একটা মৌখিক তালিকা প্রস্তুত করা হলো, তাদের নাম ওরা সবাই মুখস্ত করলো রীতিমতো। কাজের সময় কারা সেদিন কমনরুমে ছিল মনে করতে না পারলে কেস কেঁচে যাবে, যদি কোনো কেস আদৌ তোলা হয় আদালতে! অনেক রাত পর্যন্ত ওরা অ্যলিবাইয়ের ফাঁক ফোকড় বন্ধ করলো। আলোচনা চললো কোকের বোতল, চানাচুরের প্যাকেট আর সিগারেটের প্যাকেটগুলো শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। এক বোতল জনি ওয়াকারের জন্য এক পর্যায়ে খানিকটা আফসোসও করলো ওরা। তবে আগে থেকে প্রস্তুতি না থাকলে সে জিনিস নাগালে আনা শক্ত।
শামীমের ডাবল বেড ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে নিচে তিনজনের ফ্লোরিং করার বন্দোবস্তটা অবশ্য ইলোরার পছন্দ হলো না। এতো বড় খাটে আরেকজন যখন অনায়াসে শুতে পারে, নিচে তিনজনের কষ্ট করার দরকার কি? নিচে তিনজন মানুষ শোয়ার মতো জায়গাও নেই। একসঙ্গে অবিবাহিত ছেলে আর মেয়ের শোয়া নিয়ে বাড়তি সংস্কার ওদের তিনজনের আছে কি না তাও জানতে চাইলো যখন, মুহিবকে ওপরে শুতেই হলো। মিটিমিটি হাসলো শামীম আর লিটু।
আরও ঘণ্টাখানেক পর, মাঝখানের দূরত্বটা অনেকটা কমিয়ে আনলো ইলোরা। ফিসফিস করে জানতে চাইলো, “তোর এসব ভালো লাগছে না, তাই তো? জড়াতে চাইছিস না আমাদের?”
সিলিং দেখছিলো মুহিব, ওভাবেই জবাব দিলো, “না। কারণটা তুই-ও জানিস।”
“তোর দিক থেকে যেমন আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা, আমাদের দিক থেকেও ঠিক তাই। আর এতো ভাবার সময় আসেনি। হয়তো তোর নাম আসবে না কখনও। এটা নিয়ে আমাদের আর কখনোই কথা বলতে হবে না। বাড়তি সতর্কতা রাখা খারাপ কিছু না, সেজন্য এতো আলোচনা।”
মুহিব কিছু বলল না। ওর মনে হচ্ছে এটা আরও খারাপ দিকে যাবে। অনেকটাই খারাপ দিকে যাবে।
“নাকি ওই মেয়ের জন্য ঘুমাতে পারছিস না?” চাপা হাসলো ইলোরা। ওর দিকে ফিরে শুলো মুহিব, “তুই কি করে বুঝলি ইতির সাথে কিছু হয়েছে? ফোনেও বলেছিলি-”
“এসব তুই বুঝবি না।” গলায় রহস্য ফুটিয়ে বলল ইলোরা।
“না বুঝলাম। ঘুমা। কালকে জার্নি আছে তোর।”
“বাসায় ফিরে বেকার বসে থাকতে হবে।” ঘুমানোর আগে ইলোরার শেষ কথা ছিল এটাই। শেষের দিকে জড়িয়ে গেলো বাক্যটা।
বাকি তিনজনের মতো ঘুমাতে পারলো না মুহিব। জেগে রইলো অনেকক্ষণ। স্থাণুর মতো শুয়ে শুয়ে সিলিংয়ের অন্ধকার দেখা। ঘুমের ঘোরে ইলোরা ওকে যখন জড়িয়ে ধরলো তখনও ওভাবে শুয়ে থাকলো মুহিব। মুখে এসে পড়া মেয়েটার চুলগুলো ঠিকমতো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে দিলো একবার।
মফস্বলে চারজনের বন্ধুত্বটি কখন পরিবারে রূপ নিয়েছে, ওরা কেউ তা বোঝেনি। ইলোরার নাক থেকে এক ইঞ্চি দূরে নিজের নাক, হঠাৎ করেই উপলব্ধিটা এলো মুহিবের।
ওরা চার বন্ধু নয়, ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্মানো চার ভাই-বোন যেন। এই পরিবার ওর কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। কোনোভাবেই না।
অজান্তেই ঘুম জড়িয়ে এলো মুহিবের চোখে।