অধ্যায় ৫
মুহিবের ঘুম ভাঙলো পরদিন রাত আটটায়। শীতে গা কাঁটা দিচ্ছে ওর। কাঁথাটা টেনে নিজেকে একটু গরম দেওয়ার চেষ্টা করলো বৃথাই। কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁপলো ঠকাঠক। মাথাটা ভারি হয়ে আছে। কাসা পেটানোর মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে কোথাও। কাঁসা পেটাৰে কেন মানুষ, এটা কি উৎসবের রাত কোনো?
রেডিয়ামের ঘড়িটা জ্বলজ্বল করছে টেবিলের ওপর থেকে। একমাত্র আলোর উৎস ডেস্কটপের সিপিইউ লাইট। হাই তুলতে তুলতে মুহিবের খেয়াল হলো ক্ষিধে পেয়েছে প্রচণ্ড। গতকাল দুপুরের পর আর খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে যায়নি। মেসের ডাইনিংয়ে মিল চালু আছে, তবে খাবার মুখে তোলার স্পৃহা হয়নি গতকাল রাতে। ঘুমাতেও দেরি করেছে। এক মাথা দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমানো যায় না। কমনরুমে গিয়ে বসে ছিল, তার মেসে উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ। অন্তত একশ’ জন সাক্ষী বলতে পারবে আজ রাতে তাকে পুরোটা সময় কমনরুমে বসে টিভি দেখতে দেখা গেছে। এর ওর সাথে গল্প ও করেছে। নিখুঁত অ্যালিবাই। প্রতিটা সেকেন্ডে মনে হচ্ছিলো কেউ এখনই মেসের কমনরুমে আছড়ে পড়বে। হাঁফাতে হাঁফাতে ঘোষণা করবে, “লাশ! ভিসি স্যারের বাসার পাশে একটা লাশ পাওয়া গেছে ম্যান!”
এমনটা ঘটেনি। কয়েকটা সিগারেট কিনে এনে রুমে ঢুকেছিলো মুহিব। ড্রেস পাল্টেছে। পোশাকগুলো ভাঁজ করে একটা কাগজের ব্যাগে ভরে রেখেছে। পরদিন দুপুরে গোসলের ছুতোয় ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে।
হিসেব করে দেখলো প্রায় ষোলো ঘণ্টা ধরে ঘুমিয়েছে ও।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলো মুহিব। শরীর খারাপ করছে এটা নিশ্চিত, তবে খাবার না খেলে চলছে না। রাত দশটার মধ্যে মিল বন্ধ হয়ে যাবে। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। অন্ধকারেই সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে বের করে আগুন ধরালো মুহিব। মোবাইলে ডাবল ট্যাপ করে স্ক্রিন অন করলো। খবরটা দেখতে হবে। ফেসবুকে গেলেও পাওয়া যাবে হয়তো খবর।
বেমক্কা এক ঘুষির মতো ওকে আঘাত হানলো স্ক্রিনের প্রথম শব্দটা।
ইতি।
ছত্রিশটা মিসড কল!
বারোটা মেসেজ।
“ওয়েভার ছুটে গেলো নাকি, মেয়ে?” বিড়বিড় করে বলল মুহিব। মেসেজগুলো পড়ার আগ্রহও বোধ করলো না সে। সরাসরি ফেসবুকে এসে
ঢুকলো। প্রথমেই একটা হ্যাশট্যাগ চোখে পড়লো :
#Justice_for_Shams
“ওকে।” বিড়বিড় করে বলল মুহিব, “তাহলে ছেলেটার নাম শামস্।”
অনলাইনে নিউজ পোর্টালগুলো ঘাঁটলো তারপর। থার্ড ইয়ারের ছাত্র, ওদের ডিপার্টমেন্টেরই। ছাত্র রাজনীতির সাথে হাল্কা জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়েছে, যদিও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা এক বিবৃতিতে বলেছেন ছেলেটা কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এমন ন্যাক্কার জনক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তার দল সব সময়ই সোচ্চার। শামস হত্যার বিচার তিনি চান।
“সাধারণ ছাত্র প্রাণের নিরাপত্তা পাচ্ছে না এটা তো খুব লজ্জার। প্রশাসনকে এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে।”
মুখ বাঁকালো মুহিব। ছাত্রনেতাদের মিডিয়ার বক্তব্য সে বিশ্বাস করেনি কখনোই। এমনও হতে পারে, বিষয়টার সঙ্গে তিনিও জড়িত। খুন করেছেন যিনি, বিচার চাবেন তিনিই।
আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসলো ও। এখনও মনে হচ্ছে হিমঘরের ভেতর বসে আছে। জ্বর এসেছে হয়তো। একশ’ তিনের কম হলে এভাবে জানান দিতো না। ঠকাঠক দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে। চিকিৎসক গোত্রের কেউ থাকলে হয়তো বলতেন, “শকে” চলে গেছিলো মুহিব। মানসিক ধাক্কাটা নিতে পারেনি। সেখান থেকেই আকস্মিক শরীর খারাপ। নিজের ধারণাটিকে মুখ ভেংচে দিলো মুহিব।
আলো জ্বলে উঠলো ফোনে, ইনকামিং কল। ইতি।
রিসিভ করলো এবার, “হ্যাঁ, বলো।”
“কি হয়েছে তোমার?” তুলনামূলক নরোম কণ্ঠে জানতে চাইলো মেয়েটা।
হয়তো অনুতাপে পড়েছে। মেয়েরা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে মন দেওয়ার সময় একটা মধ্যবর্তী সময়কাল পার করে। ওই সময়টায় তারা প্রাক্তনের প্রতি অনুশোচনা অনুভব করে বটে। এখন সেই দশাই চলছে তার।
“কিছু না। জার্নি করে এসেছি, টায়ার্ড।”
“ঘুমাচ্ছিলে?”
“হুঁ। কালকে ফিরলাম, সারারাত জেগেই ছিলাম। মুভি দেখছিলাম। ঘুমাতে দেরি হয়েছে আর উঠতে পারিনি।” নিজের ওপরই বিরক্ত হলো মুহিব। এতো বেশি বকছে কেন? ঢাকা থেকে ফিরে এসেছে তিন দিন হয়ে গেলো, মিথ্যে বলার দরকার কি ছিল? চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ইতি কেবল জানতে চেয়েছে সে ঘুমাচ্ছিলো কি না। খুনের সময় ক্রাইম সীনে উপস্থিত ছিল কি না তা জানতে চায়নি।
“খবর কি তোমাদের ক্যাম্পাসের?” প্রশ্ন করেই যাচ্ছে ইতি। একবারও তার ঢাকার আচরণের জবাবদিহিতা করলো না। মেয়েরা জবাবদিহিতা করে না।
বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো মুহিবের। তারপর চোখ রাঙালো নিজেকে। স্বাভাবিক থাকো। স্বাভাবিক। কিছু হয়নি। কিছু ঘটেনি। তুমি ওখানে ছিলে না।
“কি আবার খবর, আমাদের মিড ব্রেক চলে। তেরো তারিখ থেকে ক্লাস খুলবে।”
“আহা, ওসব না। তোমাদের একটা ছেলে মারা গেছে দেখলাম।”
দেখাটাই স্বাভাবিক। ক্যাম্পাস মার্ডার। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন, নেহায়েত ক্ষুদ্র ঘটনা তো আর নয়। সংবাদমাধ্যমগুলো তোলপাড় হয়ে গেছে। ছত্রিশটা মিসড কলের মধ্যে বেশ কয়েকটা বাসা থেকেও আসার কথা। শামীমরা মনে হয় রাস্তায় আছে। খবরটা সেভাবে পায়নি এখনও। একসাথে অনেকে থাকলে ফেসবুক-ইন্টারনেট ঘাঁটা হয় না। গোটা দেশবাসী জানে এমন একটা খবর পেতে ওদের দেরি হবে।
“কি বলো? কীভাবে? অ্যাকসিডেন্ট—” বিস্ময়টা কণ্ঠে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো মুহিব।
“অ্যাকসিডেন্ট না। খুন করে ফেলেছে কেউ। তোমাদের ভিসির বাড়ির পাশেই নাকি পাওয়া গেছে লাশটা।”
“ইন্নালিল্লাহ। কি বলো তুমি!” আবারও বলল মুহিব। যেন বুঝতে পারছে না কিছু। নতুন আসা খবরটা নিতে পারছে না এখনও।
“ঘুম থেকে ওঠো। গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে। খুন হওয়া ছেলেটা কে জানো? খাদ্যমন্ত্রির চাচাতো ভাইয়ের নাতি।”
এটা একটা নতুন খবর। খাদ্যমন্ত্রির চাচাতো ভাইয়ের নাতি। অর্থাৎ খাদ্যমন্ত্রির বাবার ভাইয়ের ছেলের ছেলের ছেলে। খুব কাছের সম্পর্ক যা হোক! তবে এসব খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়। অন্তত সাধারণ নাগরিক তো ছিল না ভিক্টিম, ঘটনা এখানে প্যাঁচ খাবে। খুব ভালো করেই প্যাঁচ খেয়ে যাবে। ক্যাম্পাস কয়দিনের জন্য বন্ধ করে দেয় তাই এখন দেখার বিষয়।
“আচ্ছা! খুবই সিরিয়াস ঘটনা দেখা যায়। ফোনটা একটু রাখি, হ্যাঁ? দেখি কি চলছে ক্যাম্পাসে।”
“কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে যেও না আবার। সাবধানে থেকো!”
এই কথাগুলো মেয়েটির একদম ভেতর থেকেই এলো মনে হলো ওর। দেখানো কারবার নয়। অনেকদিনের পরিচয় ওদের, পনেরো বছর ধরে চেনে একে অন্যকে। এতোটুকু আশা করা যেতেই পারে।
“থাকবো। পরে ফোন দেবো, ঠিক আছে?”
ইতিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো মুহিব।
আরেকবার আড়মোড়া ভেঙে ড্রয়ার খুলে ভেতরটা হাতড়ালো। নাপা এক্সট্রা নামক প্যারাসিটামল এবং ক্যাফেইনের মিশ্রণ এখানে থাকার কথা। পাতাটা পাওয়া গেলো, কিন্তু ভেতর ঠনঠন। একটা ট্যাবলেটও নেই, ফুরিয়ে গেছে।
গতকাল রাত বারোটার দিকে একবার খবর নিতে বেরিয়েছিলো মুহিব, সিগারেট কেনার ছুতোয়। তখনও কিছু জানা যায়নি। সম্ভবত সারা রাত ওখানেই পড়ে ছিল লাশটা। সবার অগোচরে।
ওষুধ না পেয়ে তখনকার কেনা সিগারেটই হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো ও। ঠোঁটের কোণে আলগোছে ঝুলিয়ে লাইটারটা বের করে আনলো। আগুন ধরাতে ধরাতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তালা ঝোলালো ছোট্ট খুপরিটায়। ভিসুভিয়াসের মতো ধোঁয়া ছাড়ছে, কপালের ওপর এসে পড়া সদ্য ঘুম থেকে ওঠার কারণে এলোমেলো হয়ে থাকা চুল নিয়ে নামতে শুরু করলো সিঁড়ি বেয়ে। জ্বরের ঘোরে অথবা অনেক দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে ওঠার কারণে পৃথিবী সামান্য টলটলায়মান।
চারতলা থেকে নামতে নামতে সিগারেট অর্ধেক হয়ে এলো। ধর্ম-অন্তপ্রাণ বেলায়েত ভাইকে দেখা গেলো দো’তলায়। এই মানুষটার সঙ্গে সিঁড়িঘর বা বাথরুম ছাড়া আর কোথাও দেখা হওয়ার স্মৃতি তার মস্তিষ্কে নেই। মুহিবের হাতে সিগারেট দেখলেই নোংরা কোনো সরীসৃপ দেখার মতো মুখভঙ্গি করেন তিনি। তবে আজকে তেমন কোনো অভিব্যক্তি তেড়ে এলো না। তাঁরই সিরিজের আরেকজন ছাত্রের সাথে গভির আলাপে বেলায়েত ভাই মগ্ন। কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে তা বুঝতে মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তার ওপর একবার “লাশটা” শোনা গেলো ওদিক থেকে।
টালমাতাল অবস্থাতেই মেসের সামনে বের হয়ে এলো মুহিব। চারপাশে তাকিয়ে নিজের ব্যাচের কাউকে খুঁজলো। নেই। দুটো সিরিজের মিড ব্রেক চলছে, এদের পাওয়া যাবে না এখন। লিটু বা শামীমকে দশটা মিনিট পাশে পাওয়ার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারতো ও। সবচেয়ে দরকার যখন তাদের, তখনই তারা নেই।
ওয়ান-ওয়ানের রাজ্জাক ভাইকে পাওয়া গেলো মেসের সামনের দোকানটায়। ইমিডিয়েট সিনিয়র, এক হাতে পেপসির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার ব্যাচের ছাত্রদের মিড ব্রেক আগের মাসে শেষ হয়ে গেছে, এখন পুরোদস্তুর ক্লাস-ল্যাব চলছে ওয়ান-ওয়ানের। তবে এই মুহূর্তে তাদের কাউকে আশেপাশে দেখা গেলো না।
“তোর অবস্থা এমন ক্যান?” মুহিবকে দেখেই প্রশ্ন করলেন তিনি।
“জ্বর ধরছে, ভাই।” সিগারেটের অবশিষ্টাংশটা তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল মুহিব, “ঘটনা আমাকে কন তো।”
সিগারেটটা নিলেন রাজ্জাক ভাই, “শামসভাইয়ের কেসটা?”
“হুঁ। মাত্র ঘুম থেকে উঠছি।”
মাথা দোলালেন রাজ্জাক ভাই। বোতলটা তুলে দিলেন জুনিয়রের হাতে। একবার ভেতরের তরলটুকু দেখলো মুহিব, অর্ধেকটা মতো আছে।
“শামসভাই তো রাজনীতিতে তেমন অ্যাক্টিভ বলে শুনি নাই। ব্রাইট স্টুডেন্ট উনি, ক্যম্পাসে মোটামুটি ফ্যামিলিয়ার ফেইস। উনার ফ্রেন্ডরা অবশ্য অ্যাক্টিভ, কিন্তু তাতে কইরা তো আর একজনকে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ট্যাগ দেওয়া যায় না।”
মাথা দোলালো মুহিবও, পোর্টালগুলোর কথা বলছেন রাজ্জাক ভাই।”ক্যাম্পাস কি বন্ধ করে দিয়েছে?”
বোকার মতো প্রশ্ন করলে শিক্ষক ছাত্রের দিকে যেভাবে তাকান সেভাবেই তাকালেন রাজ্জাক ভাই, “অবশ্যই। এর পর আর ক্যাম্পাস খোলা থাকে? হল ভ্যাকেন্ট করার নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। প্রশাসন চোদ খেয়ে গেছে ঘটনায়, কিছু বুঝতেছে না কেউ।”
মুহিবদের জন্য এসব নোটিশের কোনো প্রভাব নেই অবশ্য। অপ্রতুল সীট থাকার কারণে প্রথম দুই বছর ক্যাম্পাসের বাইরে মেসগুলোয় থাকতে হয় তাদের। বাচ্চুদারা টাকা পান প্রচুর। এইদিকে মেস ব্যবসার চেয়ে ভালো ব্যবসা আর নেই। তবে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকলে হল ভ্যাকেন্ট হওয়া যা না হওয়াও তা।
“তদন্ত-টদন্ত কিছু হচ্ছে নাকি?”
“তা তো কিছু হবেই। ভিসি স্যার নাকি বেশ চাপের মধ্যে আছেন। সকালে লাশটা পাওয়ার পর ছেলেমেয়েরা যারা ক্যাম্পাসে ছিল, সবাই ভিসির বাসার সামনে দাঁড়িয়েছিলো। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ধরতে হবে, এই আলটিমেটাম দিয়ে এসেছে। শামসভাই পপুলার ফেস, কইলাম না?”
আমরা যারা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকি তাদের কাছে নয়, মনে মনে ভাবলো মুহিব। শামসভাইয়ের নাম সে আজকের আগে শুনেছে কি না মনে করতে পারে না। তবে সে নিজেও খানিক নিভৃতচারী, তাও বিবেচনা করা প্রয়োজন।
“ঐ মিছিলের মধ্যে শামসভাইয়ের খুনিও থাকতে পারে।”
কাঁধ ঝাঁকালেন রাজ্জাক ভাই, “থাকতেই পারে। রাতের বেলায় খুনটা করে এলো, দিনের বেলায় সাধু সেজে ভিসির বাড়ি ঘেরাও করে দাবি জানালো খুনিকে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের জন্য।
“কি যে লাগলো ক্যাম্পাসে, ভাই।” স্বগোক্তির ভঙ্গিতেই বলল মুহিব, এরকম কিছু কি হইছিলো আগে ক্যাম্পাসে?”
“রাজু ভাই, একটা বেনসন দেন তো।” একটু আগে পাওয়া সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললেন রাজ্জাক ভাই, তারপর মনোযোগ ফিরিয়ে আনলেন মুহিবের দিকে, “হইছিলো একবার। ২০০২ সালে। ঐবার মারাত্মক মারপিট লাগছিলো। রড দিয়ে পিটাইয়া অপজিশনের বারোটা বাজায়া দিছিলো পোলাপান। পরে হসপিটালে একজন মারা যায়। কিন্তু এরকম কিছু ঘটে নাই আগে।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে রাজু ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিলো মুহিবও। রাজ্জাক ভাই ততোক্ষণে নিজেরটায় আগুন ধরিয়ে ফেলেছেন। লাইটারটা জ্বলন্ত অবস্থাতেই মুহিবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, “ক্যাম্পাসের অবস্থা ভালো না। মনে হয় না দুই-তিন মাসের আগে খুলবে। বিরাট ক্যাচাল লাগায়া দিলো বাল।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ ধূমপান করলো ওরা। রাতের আকাশে ওদের বিষণ্ণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। ক্রমাগত ধূমপানের ব্যাপারে এভাবে অভ্যস্ত ছিল না মুহিব। বাড়িতে থেকে এতো সিগারেট খাওয়া হয় না। কিন্তু এখানে সবাই বাড়ি থেকে এতো দূরে থাকে, ধূমপান বেড়ে যায় ধূমপায়ীদের। প্রকৌশলবিদ্যা পড়ার প্রবল চাপ, এই চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো উপায় নেই। প্রেশার ভালভ খোলার মতো পথ নেই, পরিবারের সঙ্গে দশ মিনিট কাটানোর সুযোগ যেটা সৃষ্টি করে দিতে পারতো। বন্ধুদের প্রত্যেকেই একই পথের পথিক। একে অন্যকে দেখে রাখা, একে অন্যের সঙ্গে খুব ভয়ঙ্কর চাপগুলোতেও সস্তা রসিকতা করে হাল্কা করার চেষ্টা করা। এর মধ্যে প্রেম, আড্ডা আর ধূমপান প্রবলহারে বেড়ে চলে সব।
এখানে পড়তে আসার আগে অত্যাধিক ধূমপান যারা করে তাদের একরকম অপছন্দই করতো মুহিব। পরে অবশ্য কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে, বেড়াল কতো সুখে গাছে চড়ে। অন্যকে বিচার করার বদঅভ্যাস ছেড়ে দিয়েছিলো অনেকদিন হলো। তবে এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নেই।
শামস হত্যার সঙ্গে জড়িত অন্তত দু’জনকে সনাক্ত করতে পারবে সে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মুহিবের। খুনিরা এখনও জানে না বিষয়টা।
মানিব্যাগ বের করলো মুহিব, সিগারেটের বিলটা দিয়ে এখান থেকে সরে যেতে হবে। খোলা জায়গা দাঁড়িয়ে থাকতেই অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সবাই দেখে ফেলছে তো ওকে! ফিরে এসেছে গতকালের আতঙ্ক। গায়ের সবগুলো লোম দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড শীত। এতো ঠাণ্ডা কেন গরমের এই রাতে?
খপ করে ওর কাঁধ চেপে ধরলো কেউ। এতোটাই চমকে উঠলো মুহিব, আরেকটু হলেই হাত থেকে পড়ে গেছিলো মানিব্যাগ। উদভ্রান্তের মতো ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখী আবিষ্কার করলো রাজ্জাক ভাইকে।
“টাকা দিস না। আমি দিয়ে দেবো।” বড় ভাই সুলভ কণ্ঠে বললেন তিনি
মাথা দোলালো আরেকবার, নিজেকে অরক্ষিত মনে হচ্ছে মুহিবের। কোনোরকমে ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত সরে এলো সবুজ পুকুরের কাছে। এখানে অনেকগুলো বালি জমিয়ে রাখা হয়েছে। তার আড়াল নিয়েই বসে পড়লো ধপ করে।
আজও সবুজ পুকুরের পানি অন্ধকারে কালো। শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে পানি ছুঁয়ে। ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সিগারেটটা টেনে চললো মুহিব। রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে খুন হয়ে যাওয়া মানুষটাকে নিয়ে কি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই না কথা বলতে হয়েছে! অথচ লাশটার পাশে দাঁড়িয়ে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেই ও কুড়িয়েছিলো সিগারেটের ফিল্টার।
কী ভয়ানক!
স্ট্রিট ল্যাম্পের প্রতিফলন কিছুটা এখান পর্যন্ত আসে। কালিগোলা অন্ধকার সরিয়ে আবছা আলো ছড়িয়ে দেয় পুকুরের পাড় পর্যন্ত। সেই আলোয় নিজের হাতজোড়া দেখলো মুহিব, কাঁপছে তারা।
“শান্ত হও, ম্যান। শান্ত থাকতে হবে আমাদের।” নিজেকেই বলল মুহিব, “শান্ত থাকতে হবে।”
মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে খানিক ভাবলো ও।
এক. শামস ছিল ক্যাম্পাসের পরিচিত এবং প্রিয় মুখ। যার জন্য ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই ভিসির বাসা ঘেরাও করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া চলে। নিঃসন্দেহে ক্যাম্পাসে বারুদ ফেটে পড়েছে। কোনো সন্দেহ নেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে ক্যাম্পাস।
দুই. শামস ছিল সক্রিয় কর্মিদের বন্ধু। তাদের কারণে পোর্টালগুলো তাকেও ‘পলিটিকাল ট্যাগ দিতে পেরেছে। এই বন্ধুরা কারা? যাদের গতকাল দেখা গেলো কাজটা করতে, তারাই কি?
তিন. শামসের সেই বন্ধুরা যদি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না হয়ে থাকে তবে তারা কেন খুন হলো না? একজন সাধারণ ছাত্রকেই কেন খুন হতে হলো?
চার. নিহত শামস খাদ্যমন্ত্রির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তবে খাদ্যমন্ত্রির ব্যাপারে মুহিব যতোটা জানে, তিনি বিরোধীদলের পক্ষের লোক। ওই এলাকাটাই বিরোধীদলের। সেখান থেকে প্রতিবারই মন্ত্রি হিসেবে কেউ না কেউ নির্বাচিত হন এবং বাজেটের অভাবে কাজকর্ম তেমন কিছু করতে পারেন না। তিনি দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের খুনিদের ধরতে কতোটা চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা তেমন নেই।
পাঁচ. গতকাল রাতে একাকি শত্রুপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো শামস।
এই পয়েন্টটা নিয়ে একটু ভাবলো মুহিব। দেখা করতেই কি এসেছিলো? খুব সম্ভব। নতুবা ওরকম এক সময়ে তাকে ভিসি স্যারের বাড়ির সামনের মাঠে দেখতে পাওয়ার কথা না। ওদিকে মেকানিক্যালের দুটো ল্যাব ছাড়া আর কিছু নেই-মেশিন শপ আর ফাউন্ড্রি শপ। হলগুলো ক্যাম্পাসের অন্য প্রান্তে। ঠিক এ কারণেই ওদিকটায় গিয়েছিলো মুহিব, নির্জনতা খুঁজতে। ইতির অমন ব্যবহারের পর ফেসবুকে মেয়েটিকে তারই শিক্ষকের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে হয়েছিলো তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষকদের প্রতি ঘৃণার পরিমাণও বেড়েছে সেই সঙ্গে। সে চায়নি কারও সঙ্গে কথা বলতে, চেয়েছিলো একাকিত্ব। হল থেকে যতো দূরে সম্ভব গিয়েছিলো মুহিব।
অর্থাৎ, শামসেরও সেখানে অকারণে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। নিঃসন্দেহে একটা মিটিং ঠিক করা হয়েছিলো। মিটিংটা কে ঠিক করেছিলো? মুহিব জানে না।
ষষ্ঠ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা হলো, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার প্রসঙ্গ খুনিরা কেন তুলেছিলো?
সিগারেটের ফিল্টারে চলে এসেছে আগুন। এক টোকায় ওটাকে সবুজ পুকুরের মাঝে ফেলে দিলো মুহিব। পরমুহূর্তে জমে গেলো সে।
ঠিক এভাবেই সবগুলো ফিল্টার সবুজ পুকুরে ফেলেছিলো চব্বিশ ঘণ্টা আগে। পরিচিত কাঁটা দেওয়া অনুভূতিটা ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো মুহিব। মোবাইল বের করে ফেলেছে।
বাসায় একটা ফোন দেওয়া দরকার।