অধ্যায় ৪৮
“শামস সেদিন এসেছিলো এখানে।” তিন জুনিয়রের দিকে একে একে তাকালো তূর্ণা, “সকাল এগারোটার দিকে হবে। হঠাৎ করেই দেখা করতে চাইলো ও, বলল খুব জরুরি। আমি স্বাভাবিকভাবেই দেখা করতে রাজি হইনি। ব্রেক-আপের পর এক বছর পেরিয়ে গেছিলো ঠিক, তবে এক্স-দের ব্যাপারে অনুভূতিটা তোমরা জানো। হুট করে দেখা করতে চাইলেই করা যায় না আসলে। তাছাড়া আমাদের ব্রেকআপটা খুব পরিণত ছিল না। একে অন্যকে…” একটু কাশলো সে, অযথাই, “মানে, মুখে যা আসে তাই বলেছিলাম আমরা, শেষ যে বার কথা বলি। এর জন্য শামস কখনও আমাকে সরি বলেনি, আমিও না। ঐভাবে যখন দুটো মানুষের মধ্যে যোগাযোগ শেষ হয় তখন দেখা করার কথা বললেই দেখা করার প্রশ্ন আসে না।”
“কিন্তু দেখা আপনি করেছিলেন।”
“হুঁ।” আবারও নিজের হাতের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে নিয়ে গেলো তূর্ণা, “তা করেছিলাম। যখন ও বলেছিলো ব্যাপারটার ওপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আমাদের রিলেশন নিয়ে সে একটা শব্দও করবে না, কথা দিয়েছিলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাইছিলো সে।”
তিনজন মানুষ সাগ্রহে তাকিয়ে থাকলো তার মুখের দিকে।
“শামস আমাকে ঐদিন ফোনে বলেছিলো এটা পাবলিক প্লেসে বলা যাবে না। কেউ জানতে পারলে সমস্যা হবে। আমি তখন ভয় পেয়েছি কিছুটা। এক্স-বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তুমি কখনোই নির্জনে দেখা করতে চাইবে না। বিশেষ করে যখন তুমি একজন ব্যাংকে জব করা প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে প্রেম করছো আর তোমার এক্স এখনও রয়ে গেছে সিঙ্গেল!”
মাথা দোলালো মুহিব। শামসভাই প্রতিশোধ নিতে এই ‘জরুরি’ এবং ‘গোপন’ মিটিং ডাকলো কি না তা নিশ্চিত করে জানার উপায় তূর্ণার ছিল না।
“তারপরও আমি দেখা করলাম। ওকে বললাম, বাসায় চলে আসতে। ঐ সময় বাসায় কেউ থাকে না। বাবা ব্যবসার কাজে বাড়ি ফেরেনই রাতে, আর মা তো কলেজে পড়ানোটা ছাড়তে পারলো না। দিনটা একাই থাকি আমি, কাজেই গোপনীয়তা সে পাচ্ছে। তাছাড়া বাইরে তার ঠিক করা নির্জন কোনো জায়গার চেয়ে আমি নিজের বাসার নির্জনতায় বেশি নিরাপদ বোধ করতাম। আমার প্রস্তাবে শামসের আপত্তি ছিল না।”
*
দরজা খুলে দিতেই উদ্ভ্রান্তের মতো ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো শামস। দ্রুত দরজা ভিড়িয়ে ওয়াচিং গ্লাসে চোখ রেখে সিঁড়িঘরটা কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করলো সে। তূর্ণা তাকে এতো আতঙ্কিত কখনও দেখেনি। ঘামছে দর দর করে, চুলগুলো ভেজা সেই ঘামে। শামসের আতংক ধীরে ধীরে সংক্রমিত হচ্ছিলো ওর মধ্যেও।
“কি হয়েছে? কিসের সঙ্গে জড়িয়েছো তুমি নিজেকে? “
তূর্ণার প্রশ্নটাকে পাত্তাই দিলো না শামস। এখনোও ওয়াচিং গ্লাসে চোখ রেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
“কাম অন, শামস!” নিজের গলায় আতঙ্কের ছোঁয়া টের পেলো তূর্ণা। কেউ কি শামসকে ফলো করছে? তারা কি ছেলেটাকে অনুসরণ করে ওদের বাসা পর্যন্ত চলে আসবে? এক পা এগিয়ে গিয়ে শামসের কাঁধে হাত রাখলো সে, “কাম অন!”
ঝট করে ওর দিকে ফিরলো ছেলেটা, একসময় যাকে ভালোবেসেছিলো। চোখে তাড়া খাওয়া পশুর দৃষ্টি।
“আ’ম সো সরি। আমাকে নিশ্চিত হতে হতো…” কোন ব্যাপারে তার নিশ্চয়তার প্রয়োজন তা অবশ্য খোলাসা করে বলল না সে। দুই পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো। তারপর তাড়াহুড়ো করে বসে পড়লো একটা সোফায়।”পানি, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারো নাকি দেখো তো।”
রান্নাঘরে গিয়ে একটা গ্লাস বের করে তাতে পানি ঢালার সময় তূর্ণা লক্ষ্য করেছিলো তার হাত কাঁপছে। ছেলেটা এমন করছে কেন? তবে কি রিলেশনটা ভেঙে যাওয়ার পর সে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছে? এমনটা হওয়ার কথা নয়। শামসের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে ধারণা আছে তূর্ণার। সেটা পুঁজিবাদের সঙ্গে যায় না, আবার সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গেও হাত মেলাবে না সে, দেশে বর্তমান যে কয়টি বামধাঁচের দল আছে তাদের সঙ্গেও ঠিক মেলে না তার। তাহলে কাকে এতো ভয় পাচ্ছে সে? শামসের আচরণ থেকে এটুকু স্পষ্ট বিনা কারণে এমন আচরণ সে করছে না। ছেলেটা যেন প্রাণনাশের আশঙ্কা করছে।
পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললো শামস। শেষদিকে গলায় আটকে ফেললো তাড়াহুড়োয়। পাগলের মতো কিছুক্ষণ কাশলো সে। প্রাক্তন প্রেমিকের একটা হাত চেপে ধরলো তূর্ণা, “প্লিজ, শান্ত হও। আমাকেও ভয় দিচ্ছো তুমি। বলবে তো কি হয়েছে?”
আচমকাই শান্ত হয়ে এলো শামস। ধীরে ধীরে মেয়েটির দিকে তাকালো সে। উচ্চারণ করলো সচেতন এক বাচনভঙ্গিতে, “ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, তূর্ণা। কিন্তু কি করতে পারতাম আমি আর, বলো?”
“কারা?”
এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তূর্ণার হাত নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো শামস, “আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমার মতামত আমার জানা দরকার।”
“আমাকে আগে বলবে তো কিসের সঙ্গে জড়িয়েছো?”
“বলছি।” হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের ওপর থেকে পানি আর ঘামের জমে থাকা ফোঁটাগুলো মুছলো সে, “মনে করো, এমন কারও দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ তোমার হাতে চলে আসলো, যার অনেক ক্ষমতা। দুই-চারজনকে খুন করে গুম করে ফেলা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। এমন কেউ, যার সঙ্গে তুমি যথেষ্ট কারণ থাকার পরও লাগতে যাবে না। কিন্তু এখন তোমার হাতে আছে প্রমাণ, আর এটা নিয়ে যদি তুমি এগিয়ে যাও তবে সম্ভাবনা থাকে আর কোনো দুর্নীতি সেই মানুষটা করতে পারবে না। তোমার কি উচিত হবে না এটা ফাঁস করে দেওয়া?”
“এক সেকেন্ড।” হাত সরিয়ে নিতে চাইলো তূর্ণা, তবে শামস বেশ শক্ত করে ওকে ধরে রেখেছে, যেন এর ওপরই তার বেঁচে থাকা নির্ভর করছে।”আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কার কথা বোঝাচ্ছো তুমি? কেমন দুর্নীতি, কেমন প্রমাণ?”
“বিস্তারিত তোমাকে বলা যাবে না। শুধু জেনে রাখো, এর সঙ্গে অনেকের নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে।”
“আদালতে তোলার চেষ্টা করতে পারো তুমি এসব। নাকি আগেই নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছো?” নিজের চিন্তাশক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে তূর্ণা, “প্রশাসনের কোনো বড় অফিসারের সঙ্গে—”
“লাভ নেই। আমি জানি না কাকে বিশ্বাস করবো। সত্যিই জানি না।”
“ব্যাপারটার সাথে কি পলিটিশিয়ানদের কেউ জড়িত?”
মাথা দোলালো শামস।
“তারা কি জেনে গেছে তোমার কাছে এটা আছে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি ভাবছো ওরা তোমাকে—” কথাটা শেষ করতে পারলো না তূর্ণা। বুকের ভেতর অজানা এক আতঙ্ক শেষ করতে দিলো না।
“হ্যাঁ, ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। গতকাল থেকে আমার পেছনে লেগেছে ওরা। ফলো করেছে সারাদিন।” বলতে বলতে ঘামে ভিজে গেলো শামসের মুখ, “আই উইশ আই হ্যাড আ পিস্টল অর সামথিং।”
নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শামসের মাথাটা চেপে ধরে কাঁধে এনে রাখলো তূর্ণা, “এসব ভাববে না একদম। শান্ত হও। শান্ত হও তুমি। আমি তোমাকে যা বলি মন দিয়ে শোনো। তুমি বলছো কোনো এক ক্ষমতাশালী লোকের কুকীর্তির প্রমাণ তোমার হাতে আছে। সেটা ফেরত পাওয়ার জন্য ওরা তোমাকে খুঁজছে। এমনকি ওটা পাওয়ার জন্য ওরা তোমাকে সরিয়েও দিতে পারে। এটাই এখন সমস্যা। তাই না? অ্যাই?”
তূর্ণার কাঁধে মাথা রেখে শিশুর মতো শান্ত হয়ে যায় শামস। মাথা দোলালো একবার শুধু। প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য তূর্ণার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। এই নিষ্পাপ ছেলেটাকে ছেড়ে চলে আসা উচিত হয়নি। একেবারেই উচিত হয়নি!
“তাহলে আমার কথাটা শুনবে তুমি?” আলতো করে ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো তূর্ণা, “জিনিসটা ওদের ফেরত দিয়ে দাও। জীবনের বেশি মূল্য কিছুর নেই। এই ঝুঁকি নিও না।”
মাথা নাড়লো শামস।
“কি হলো? কথা বলো।”
“ওই বানচোতকে না ডুবিয়ে আমি মরছি না।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে, “তাছাড়া আমি ওদের সঙ্গে দেখা করে জিনিসটা ফিরিয়ে দিলেও ওরা আমাকে ছাড়বে না। বিশ্বাসই করবে না ওরা আমাকে।”
“কেন?”
“প্রমাণটা আছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। একটা ভিডিও ক্লিপ। ওরা কখনোই বিশ্বাস করবে না আমি এর আর কোনো কপি করে রাখিনি।”
ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তূর্ণা, “তাহলে?”
“আমি ওদের গোড়ায় আঘাত করার চেষ্টা করবো, তূর্ণা। এটা আমার ডিসিশন। আমি এটা পাবলিকে ছেড়ে দেবো বলে ভাবছি-”
“তুমি ওপরের দিকের কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারো”
“চেষ্টা করেছি। মি. ফাহাদ হিল্লোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। উনি বলেছেন এটা তিনি দেখবেন। পরশু উনার সঙ্গে আরেকটা মিটিং আছে। সেখানে উনার কাছে আমি প্রমাণাদি হ্যান্ডওভার করবো। তারপর শুরু হবে আসল খেলা।”
প্রাক্তন প্রেমিকের দিকে আড়চোখে তাকালো তূর্ণা, “মি. হিল্লোলের ব্যাপারে আমি অনেক ভালো কথাই শুনেছি। তুমি কি তাকেও অবিশ্বাস করছো?”
“ঠিক তেমনটা না। তবে রাজনৈতিক কোনো চ্যানেলই আমি বিশ্বাস করি না। একটা ইভেন্ট পাবলিক হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা চেষ্টা করে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার। প্রতিষ্ঠানের সম্মানই তখন তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। আমি জানি না এর উর্ধ্বে ফাদার হিল্লোল যেতে পারবেন কি না। শেষ কথা হলো, উনার সাহায্য নিয়ে হোক আর সাহায্যটুকু না পেয়েই হোক, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
“ভিডিও ক্লিপে কি ছিল?”
মাথা নাড়লো শামস, “তুমি যতো কম জানবে ততোই ভালো।” ওর কাঁধ থেকে মুখ তুলে খুব কাছ থেকে তাকে দেখলো সে, “তুমি দেখি দিন দিন আরও সুন্দর হচ্ছো।”
“শামস!”
“প্লিজ, আমাকে শুধু বলো–আমি কাজটা ঠিক করছি কি না? আমার কি পিছিয়ে আসা উচিত ছিল? ঐ লোকের নামে এই জিনিস নিয়ে মামলাও আছে, তবে আদালত তার চুলটাও ছিঁড়তে পারেনি। বরং তার ডেথ থ্রেটে বাদী পক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া জানোয়ারটাকে আটকানো সম্ভব না। সত্যি কথাটা হলো, এই মুহূর্তে শুধু মাত্র আমারই সেই ক্ষমতা আর ইচ্ছে আছে। এরপর কি আর পিছিয়ে পড়া সম্ভব ছিল আমার?”
“কয়জন জানোয়ারকে আটকাবে তুমি, হুঁ?” তূর্ণা অনুভব করেছিলো এক অদ্ভুত ক্রোধ।”কয়জনকে? যেমন প্রোফাইলের কথা তুমি বললে তেমন কি একজন দুইজন আছে দেশে? অনেক আছে। অন্নে-এ-ক! কয়জনকে ঠেকাতে পারবে, হ্যাঁ? সেজন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে কে বলেছে তোমাকে?”
“একজনকে তো অন্তত ঠেকাতে পারবো। তুমি কি বুঝতে পারছো না বেবি, এটা একটা অনেক বড় ব্যাপার। অন্তত একজনকে থামানো গেলেও অনেকগুলো মানুষ তাদের নিরাপত্তা ফিরে পাবে, ন্যায় বিচার পাবে।”
“শাট আপ! মূল্যটা কেমন দিতে হচ্ছে তোমাকে? আর কয়টা দিন পর ভার্সিটি থেকে বের হয়ে যাবে। আর কয়দিন আছে? এক বছর? ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর তোমার জীবন কেবল শুরু হবে। এই বয়সে এমন একটা ঝুঁকি নেওয়া খুব আনফেয়ার, শামস। খুব!”
তূর্ণার নরোম গালে হাত বুলিয়ে দিলো শামস, মেয়েটার দেহের পরিচিত গন্ধ নাকে পেতে ভালো লাগছে তার।”মানুষ এতো কিছু ভেবে চিন্তে কাজ করে না, বেবি। তাহলে যন্ত্রের সাথে আমাদের পার্থক্য থাকে কোথায়? আমরা বাই স্পিসিস কৌতূহলী। এধরণের একটা ব্যাপার আমার গোচরে আসার পর সেটাকে ভুলে গিয়ে কিছুই হয়নি এমন একটা ঢঙে জীবনযাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তুমিও কি পারতে? একটু ভেবে বলো, যদি তোমার কোনো বান্ধবিকে কেউ ব্রুটালি রেপ করে, সেই রেপকেস সে নিজের মোবাইলে ভিডিও করে রাখে, তারপর তুমি জানতে পারলে বান্ধবিটি আদালতে মামলা করে সুবিধে করতে পারেনি। বাসার সামনে পর পর দুইদিন ককটেল ফাটার পর তোমার বান্ধবির বাবা মামলাটি তুলে নিলেন। তুমি জানলে এই অন্যায়ের কোনো বিচার হবে না। কোনো বিচারই হবে না। তারপর তোমার হাতে কোনো কারণে ঐ ক্লিপটা চলে এলো। তুমি কি পারতে ‘এটা কিছুই নয়। ক্যারিয়ার গুছাই’ ভেবে তা ভুলে যেতে?”
বাস্তবসম্মত একটা উদাহরণ পাওয়ার পর পরই তূর্ণা প্রথমবারের মতো বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলো। তাৎক্ষণিক কোনো জবাব মুখে এলো না তার। এমন যদি হয়ে থাকে ঘটনা, শামসকে এর সঙ্গে না জড়াতে বলার সে কে?
“তুমি কি মেয়েটিকে চিনতে?”
মাথা নাড়লো শামস, “পার্সোনালি চিনতাম না। তবে ঐ মেয়েটির জায়গায় তুমিও কিন্তু থাকতে পারতে। তবে আমার কথাকে গ্র্যান্টেড ধরে নেওয়ার দরকার নেই। রেপ কেসই সব নয় ঐ ভিডিওর। ওখানে আরও ব্যাপার আছে। আমি তোমাকে শুধু বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে চাইছি। তুমি কি এখনও আমাকে সরে আসতে বলবে?”
শামসের চুলে এখনও নিজের হাত ডুবে আছে, সচেতন হতে লক্ষ্য করলো তূর্ণা। লজ্জিত একটা ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নিলো সে।
“তোমাকে বাঁধা দেওয়ার জন্য দুঃখিত। যেটা সঠিক, যেটা ন্যায় তাই করো। আমি আর তোমাকে নিষেধ করবো না।”
এখনও তূর্ণার গাল থেকে হাত সরায়নি শামস। মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে। যেন অনেকদিন পর প্রিয় খেলনাটি হাতে এসেছে কোনো শিশুর
“খুব একটা পাল্টাওনি।”
তার চোখে চোখে তাকালো তূর্ণা, “তোমার এই ন্যায়-অন্যায়ের সেন্সটা আগের মতোই আছে। এটা একটা কারণ ছিল তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। বোকা ছিলাম…”
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খুব আলতোভাবে আঙুল দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করলো শামস। ধীরে ধীরে ঝুঁকে এসে ছোট্ট করে চুমু খেলো প্রাক্তন প্রেমিকার ঠোঁটে, “তোমাকে আমি একদিনের জন্যও ভুলতে পারিনি।”
গাল থেকে শামসের হাতটা টেনে নামিয়ে দিলো তূর্ণা।”শামস, এসবের কথা কিন্তু ছিল না!”
তূর্ণার ঘন কালো চুলে বাম হাতটা ঢুকিয়ে দিলো শামস। মাথাটা টেনে নিজের আরও কাছে নিয়ে এলো। এবারের চুম্বনপর্ব হলো আরও গভির, আরও দীর্ঘ সময় ধরে। অজান্তেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিলো তূর্ণা, ঠোঁটগুলো আলাদা হতে ওরা লক্ষ্য করলো দু’জনই হাঁপিয়ে উঠেছে। চকচক করছে শামসের চোখ, এক হাত তূর্ণার উরুর নিচে ঢুকিয়ে মেয়েটার হাল্কা দেহটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে এলো সে, অজান্তেই ওর পিঠ জড়িয়ে ধরলো তূর্ণা–ঠিক আগের দিনগুলোর মতো। তৃতীয় দফায় ওরা হিংস্র হয়ে উঠলো অনেকটাই। তূর্ণা বুঝতে পারছে নিচের ঠোঁটের ভেতরদিকটা হাল্কা কেটে গেছে। মৃদু রক্তপাতও হচ্ছে সেখানে। রক্তের নোনা স্বাদ সব সময়ই ওকে বন্য করে তোলে, সোফার সঙ্গে শামসকে চেপে ধরে তার ওপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো সে।
ওরা যখন ব্যস্ত হয়ে একে অন্যের কাপড় খুলছিলো, শামসের পকেট থেকে ঝড়ঝড় করে রাজ্যের জিনিস পড়তে শুরু করে। চাবির রিং, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, এয়ারফোন, লাইটার, এক্সটেন্ডেড ফিল্টার, ব্রেসলেট ফিক করে হেসে ফেলেছিলো তূর্ণা, “একটুও পাল্টাওনি।”
“প্রাক্তন প্রেমিকার নগ্ন দেহটা দুই বাহুতে তুলে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শামস ফিসফিস করে বলেছিলো, “মিসড ইউ।”
তূর্ণা জানতো না, তার অনুভূতি কতোটা সঠিক, একজনের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে এধরণের আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া তার জন্য উচিত হচ্ছে কি না। তবে ঐ মুহূর্তে তার মনে হয়েছিলো উত্তরটা না দিলেই অন্যায় হতো, “আমিও।”
*
“তাহলে নিজের সুবিধেমতো নির্জন জায়গা বেছে নেওয়ার পরও যা হওয়ার তাই হলো।” কৌতুকের সুরে বলল মুহিব, “আপনি ঘুরে ফিরে শামসভাইয়ের প্রেমে আবারও পড়ে গেলেন।”
মাথা নাড়লো তূর্ণা, “আমি ওকে সব সময়ই ভালোবেসেছি। সব সময়। ঐ ঝগড়ার পর ওর ওপর এতো রাগ ছিল আমার, এত্তো রাগ! দূরত্বটা এসেছিলো। কখনও ভাবিনি ওর কাছে আবার ফিরে যাবো, আমার ইগো যাকে বলে হিমালয়ের মতো!” তূর্ণা তিনজন জুনিয়রকে অবশ্যই বিস্তারিত বলেনি সেদিন উজ্জ্বল দিনের আলোয় ঠিক কি কি করেছিলো ওরা দুই মানব-মানবী তবে বুঝে নেওয়ার মতো হাল্কা ইঙ্গিত সে দিয়েছে। মুহিবের কথা ঠিক, তোফায়েলদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারলে এরা দুইজনই পারবে। তাদের কাছে তথ্য গোপন করা ঠিক হবে না।
“এরপর আপনি নিজেকে আরেকটু চিনতে পারলেন। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন কবির ভাইয়ের সঙ্গে রিলেশনটা টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। ঠিক তো?”
মুহিবের প্রশ্নের মধ্যে ছিল উত্তর মেলানোর ভঙ্গি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেললো তূর্ণা।”হ্যাঁ, তোমার অনুমান এই ক্ষেত্রে নির্ভুল। তাছাড়া, আমার মধ্যে অপরাধবোধও কাজ করেছে। কবিরের তো আর কোনো দোষ নেই।”
কাঁধ ঝাঁকালো শামীম। একজন ছেলে হিসেবে তূর্ণার অবস্থানটা তার তেমন পছন্দ হয়নি। তবে ক্যাম্পাস্টুয়েন্টিফোরসেভেনের হয়ে সাংবাদিকতার টুকিটাকি শিখে ফেলার সুবাদেই হয়তো সোর্সের সামনে নিজের মনোভাব প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে পারলো সে।
“শামসের ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর আমি রেপ কেসগুলো নিয়ে একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি। তখনই প্রথমবারের মতো জানতে পেরেছিলাম তোফায়েলের রেকর্ড, তার মিথগুলো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সে ছিল শামসের বন্ধুদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আমার ধারণা হয়ে যায় কাজটা সে-ই করেছে। জাকির সঙ্গে যখন দেখা করে তাকে আমি চার্জ করলাম, সে ভুল বুঝলো।”
মাথা দোলালো শামীম, “সে ধরে নিলো আপনি জেনে গেছেন তার মাধ্যমেই শামসকে ডেকে এনে একটা ফাঁদে ফেলেছিলো তোফায়েল গ্রুপ।”
“এক্সাক্টলি।” তার দিকে একটা আঙুল তুলে বলল তূর্ণা, “জাকি তখন গড়গড় করে আসল কাহিনী বলে দিলো! আমি তো ওসব আগে থেকে জানি না! রাগে অন্ধ হয়ে গেছিলাম সব শুনে, জানো? এতো ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুকে সে ফাঁসিয়ে দিতে পারলো এভাবে? সম্ভব কি করে!”
জাকি’র পক্ষই সমর্থন করলো মুহিব, “কিন্তু জাকি ভাই স্বেচ্ছায় বা সজ্ঞানে…”
“হোয়াটেভার!” তূর্ণা শুনতেই রাজি না কিছু।”ওর জন্যই মরতে হলো না শামসকে? বলো? জাকির দিকে আমি ওদের গেস্টরুমের পেপারওয়েটটা ছুঁড়ে মারি ঐদিন। তারপর এতো কান্না পাচ্ছিলো, উঠে চলে এসেছিলাম। পেছন পেছন জাকি দৌড়ে এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, তবে কান দেইনি।”
এটা ওদের সামনেই হয়েছিলো, মুহিব-শামীমের এখনও ঐ দৃশ্যটা মনে আছে। তারা চুপচাপ শুনে গেলো শুধু।
“এটুকুই তোমাদের অজানা। মিসিং পিসেস। নতুন আর কিছু জানানোর নেই আমার।” উঠে দাঁড়ালো তূর্ণা, “ঘুমাও তোমরা। বিশেষ করে মুহিবের একটা লম্বা ঘুম দরকার। ইলোরা, আমার সাথে চলো, নাকি এখানেই ঘুমাতে চাও?”
দুষ্ট একটা হাসি ফুটলো ইলোরার মুখে। তবে কিছু বলল না সে।
দরজার কাছে গিয়ে ওদের দিকে ঘুরে তাকালো তূর্ণা, “তোমাদের ধন্যবাদ। বুকের ভেতর জমে ছিল কথাগুলো, কাউকে বলতেও যে শান্তি! মাঝে মাঝে মনে হয় শামস ঐদিন বাসায় না এলেই ভালো হতো। ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না আমাকে।
“কিছু একটা মিলছে না, আপু।” মাথার কাছে হাল্কা চুলকে বলল মুহিব।”আপনার মতামত নিতে শামসভাই এ বাসায় এসেছেন বলে মনে হয় না। উনি এই বিষয়টা নিয়ে এমনকি জাকি ভাইয়ের সাথেও আলোচনা করেননি, আপনাকে এসে বলে দিলেন কেন গড়গড় করে? যুক্তিতে মিলছে না এই গল্প। যাই হোক, এটা নিয়ে আমাকে পরে ভাবতে হবে। তবে উনার কোনো উদ্দেশ্য না থেকেই যায় না।
“শামস আমাকে ভালোবাসতো। এটা আমার প্রতিটা কোষ জানে!” প্রায় ধমকে উঠলো তূর্ণা, “উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কাছে আসবে কেন সে? তখন বিভ্রান্ত ছিল ও, আর…আর অনেক একা। আমার থেকে অপিনিয়ন চাইতে না আসুক, একটু মেন্টাল সাপোর্ট নিতে আসতেই পারে! এটা নিয়েও তোমরা গোয়েন্দাগিরি করবে না। প্লিজ!”
তূর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে। ভালোবাসার মানুষটিকে সে এমন একটা সময়ে পেয়েছে যখন নিজেই জানতো না নিজের অনুভূতি। এরপর সে নিজের মনকে বুঝতে পেরেছে, সত্যটা জানতে পেরেছে। জেনেছে শামসের জন্য তার ভালোবাসা কতোখানি। এবং এর ঠিক পরপরই কেউ তার প্রেমিককে চিরতরে সরিয়ে নিয়েছে তার জীবন থেকে। এমন এক ধাক্কার পর কেউ যদি প্রেমিকটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সহ্য করা কঠিন। পরিস্থিতি শামীম ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে। মুহিবকে সবার অলক্ষ্যে একবার কনুই দিয়ে খোঁচাও দিলো সে। কিন্তু এর মধ্যেই আরও একটি প্রশ্ন করে ফেলেছে তরুণ গল্পকার।
“আপনাকে কিছু রাখতে দিয়েছিলেন শামসভাই?”
মাথা নাড়লো তূর্ণা, “না, তবে…”
চৌকাঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সে। মুখ সাদা হয়ে গেছে ভূতের মতো। কিছু একটা মনে পড়ে গেছে যেন।
“আপু, প্লিজ, লুকাবেন না। আমাদের জানা দরকার।”
ওভাবেই চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো তূর্ণা। পাশ থেকে ইলোরা আস্তে করে ডাকলো, “আপু?”
“পাওয়ার ব্যাংক আর ফিল্টারটা ফেলে গেছিলো আমার বাসায়।”
“আপনি ওসব ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি?”
“ফোন দিয়েছিলাম।” আগের মতোই নিষ্প্রাণ গলায় বলল মেয়েটা, ‘পরে আর নিতে চায়নি, বলেছিলো এদিকে বার বার আসাটা তার জন্য রিস্কি হবে। আমাদের পাবলিক প্লেসে দেখা গেলে সেটাও আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আমি চাপাচাপি করিনি, তারপর তো…”
“প্লিজ, একবার দেখতে চাই ওগুলো।” প্রায় সোজা হয়ে বসেছে মুহিব এখন, প্রবল উত্তেজনায়।
“পাওয়ার ব্যাংক আর সিগারেটের ফিল্টারে মেমরি কার্ড রাখার জন্য কোনো ব্যবস্থা তো নেই! ওটা সে ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি, অবশ্যই সে ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি। ও আমাকে দেখতে এসেছিলো। আমাকে ভালোবাসতো ও।”
তূর্ণার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো ইলোরা, “আপু, অস্থির হবেন না প্লিজ। আপাতত বাদ দেই আমরা এসব। এই মুহিব, ঘুমা। এসব নিয়ে কালকে সকালে কথা বলা যাবে। আপু, চলেন। এখন এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে আমাদের। আপনারও ঘুম দরকার, অনেক লম্বা একটা দিন গেছে।”
মাথা নাড়লো তূর্ণা। অদ্ভুত এক কাঠিন্য ফুটে উঠেছে তার মুখে। চৌকাঠ অবশেষে ছাড়লো সে। ইলোরার দিকে তাকালো সরাসরি, “এর শেষ না দেখে আজকে রাতে ঘুমাতে পারবো না আমি।”
পাঁচ মিনিট পর ওদের ব্যস্ত হতে দেখা যায় একটা পাওয়ার ব্যাংক আর সিগারেটের এক্সটেন্ডেড ফিল্টার নিয়ে। প্রথমেই ছোট্ট একটা চাকু আর স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে পাওয়ার ব্যাংকের কাভার খুলে ফেললো মুহিব। ভেতরের প্রতিটা পার্টস আলাদা করে ফেললো একে একে। প্রাণ হারানো চলে এমন ভিডিও ক্লিপ সম্বলিত একটি মেমরি কার্ড কোথাও পাওয়া গেলো না।
ফিল্টারটা খুলে কার্ট্রিজ চেম্বারের দিকে তাকিয়ে থাকলো শামীম। যেন কিছুই হয়নি এভাবে বলল, “মালটাকে পেয়েছি।”