1 of 2

কুকুরদল – ৪৭

অধ্যায় ৪৭

গলিটা নির্জন। দু’পাশে সারি সারি বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে, তবে গাদাগাদি করে নয়। ঢাকা শহরের এই প্রান্তে এলেই মন ভালো হয়ে যায়। গুলশান-বনানীর পরই অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে এদিকটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানকার বাড়িগুলো ডিজাইনে অতুলনীয়, ডুপ্লেক্সের সংখ্যা এতো বেশি যে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা তালগাছের মতো কুৎসিতভাবে। সাত অঙ্কের মাসিক আয় না থাকলে এখানে বসবাস করা কঠিন। তবে ঢাকায় এমন আয় করতে পারা মানুষের সংখ্যা যে কতো বেশি তার একটা প্রমাণ এই এলাকা।

মৃদুলা। রামরাইলের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো ‘মেগা সিটি’। অন্তত প্লট বিক্রেতারা এমন ভাবেই উপস্থাপন করছেন জায়গাটিকে। কালো এসইউভিটা মসৃণ গতিতে মৃদুলার রাস্তা ধরে ছুটে এসে একই ঢঙে ঢুকে পড়লো নির্জন গলিটায়। সাদা রঙের ডুপ্লেক্সের সামনের গেটে সামান্য গতি কমলো, দরজা মেলে ধরা দারোয়ানকে পাশ কাটিয়ে গ্যারেজ বরাবর ছুটে গেলো গাড়িটা।

ড্রাইভার বেরিয়ে এলো প্রথমে, পেছনের দরজা খুলে ধরলো সসম্মানে। লাখ টাকা দামের জুতোজোড়া বেরিয়ে এসে চকচকে মেঝেতে থামলো, তারপর ঝাঁ চকচকে পোষাকে বেরিয়ে এলেন ফাহাদ হিল্লোল। টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় যেমনটা দেখা যায়, তেমনই পোষাক আর অভিব্যক্তি তার। বছরের পর বছর ব্যক্তিত্ব ধরে চলাফেরা করার ফসল সার্বক্ষণিক এই স্মার্টনেস।

“ইসমাইল,” ড্রাইভার-কাম-বডিগার্ডকে ডাকলেন তিনি, “আগামিকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বের হতে হবে। তৈরি থেকো।”

“উইল ডু, স্যার। উইল ডু।” মাথা নিচু করেই বলল ইসমাইল। কেবল চাকরি করে বলে নয়, মনিবের প্রতি তার ভক্তি অতুলনীয়। ভদ্রলোকের মতাদর্শকে শ্রদ্ধা করে সে, পরিপূর্ণ সমর্থন করে তাকে। সামান্য এক রাস্তার গুণ্ডা থেকে তাকে তুলে এনে নিজের সহচর বানানোর সম্মান হিল্লোল স্যার তাকে দিয়েছেন, এটার পর জীবনে আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না।

ইসমাইল মারা গেলো পরিপূর্ণ তৃপ্তির এই ভাবনাটুকু মাথায় নিয়েই। ঘটনাটা ঘটার আগে থুতু ফেলার মতো বার দুয়েক শব্দ হয়েছিলো কেবল। ভারি ক্যালিবারের বুলেট মাটি ছাড়া করে তাকে প্রায় উড়িয়ে পেছনে নিয়ে গেলো তারা। সেলেব্রিটি রাজনীতিবিদের সাদা স্যুটটার দফারফা করে মনিবকে সঙ্গে নিয়েই মাটিতে আছড়ে পড়লো সে।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিয়ে গেলেন ফাহাদ হিল্লোলের মতো প্রখর ধীসম্পন্ন স্মার্ট একজন মানুষও। সর্বশক্তিতে ঠেলে মৃত বডিগার্ডের শরীরটা থেকে নিজেকে বের করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি, প্রক্রিয়াটির মধ্যেই সরিয়ে ফেলেছেন ইসমাইলের হিপ হোলস্টারের লাইসেন্স করা পিস্তলটি

মেইনটেনেন্স শেডের ছায়া থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো এক অপরূপ নারীমূর্তি। পেছনের দেওয়াল থেকে আসা আলোয় তার অবচ্ছায়া ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলেন না হিল্লোল। আততায়ী এসেছে টাইট ফিটিং ট্রাউজার আর টিশার্ট গায়ে চাপিয়ে। যে কোনো পুরুষের আরাধ্য একটি শরীর, সরু কোমর আর ভরাট নিতম্বটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কমনীয়তার প্রদর্শনের কারণে এই আঁটো পোশাক নয়, তা হিল্লোল জানেন। বরং বাড়তি যে কোনো বাহুল্যতা পোষাক থেকে কমিয়ে নিজের ক্ষীপ্রতাকে সর্বোচ্চ করে তোলার লক্ষ্যেই সে এটা করেছে। ইসমাইলের আগ্নেয়াস্ত্রটি কমনীয় মূর্তিটির দিকে তোলার রিফ্লেক্সটাকে অনেক কষ্টে দমাতে হলো তাকে।

মেয়েটির হাতের লম্বাটে অস্ত্রটা সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাত ঘুরিয়ে তার দিকে নিয়ে যাওয়ার আগেই অন্তত ডজনখানেকবার তাকে মেরে ফেলতে পারবে সে। গ্যারেজের মেঝেতে অস্ত্রটি শব্দ করে ফেলে দিলেন তিনি ওকে, লেডি। আমার মনে হয় আমাদের আলোচনা করার মতো অনেক কিছুই আছে যা আপনাকে আগ্রহি করে তুলতে পারে।”

মুচকি হাসলো শিয়া। ঝানু রাজনীতিবিদের স্নায়ু প্রচণ্ড শক্ত। এমন একটা পরিস্থিতিতেও নিজের জন্য ভালো হবে কোনটা তা ঠিক বুঝতে পেরেছেন। অস্ত্র ছেড়েছেন সেই হিসেব-নিকেশটুকু করেই। এখন চেষ্টা করছেন দর কষাকষির। আলোতে এসে দাঁড়ালো সে।

“আমার মনে হয় আলোচনার যতোটুকু ছিল, আজকে বিকেলেই তা সেরে ফেলতে পেরেছি আমরা।”

মুখ থেকে সব রক্ত সরে গেলো ‘ফাদার’ হিল্লোলের। প্রথমবারের মতো ভয় পেয়েছেন তিনি, সত্যিকারের ভয়। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে গেলো শিয়ার হৃদয়।

“আপনি!” বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন তিনি।

“আর কাউকে আশা করেছিলেন নাকি?” এগিয়ে এসে এক লাথি মেরে পিস্তলটাকে গ্যারেজের আরেক কোণে পাঠিয়ে দিলো শিয়া। তারপর আবারও

পিছিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ালো সে, “আলিশান বাড়ি। এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে যে খরচ হয় তাতে কয়জন নাগরিকের বছর চলে যাবে সে খবর নিশ্চয় রাখেন না? না, আপনার নিন্দা করছি না। পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণিতে আপনি একদম প্রথম কাতারে। হাততালি হবে।”

টায়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসলেন হিল্লোল, “কমিউনিস্ট পার্টি।”

মাথা দোলালো শিয়া, “আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় নেননি। তবে এটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এখানে আমি এসেছি আপনাকে নিকেশ করতে। কথার মারপ্যাঁচে আমাকে ঠেকিয়ে দেবেন তা হচ্ছে না। ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য আপনার প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভূমিকা আছে তা আমি জানি।”

সরাসরি তার দিকে তাকালেন হিল্লোল। গভির, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।

“তাহলে কাজটা শেষ না করে এতো কথা বলার অর্থ কি? অনুশীলন সমিতিতে আজকাল টার্গেট এলিমিনেশনের আগে খোশগল্প করার ট্রেনিং দেওয়া হয় নাকি?”

“আমি চাই আপনি আমাকে নিজে থেকে পুরো গল্পটা বলবেন। ভাইয়ার মৃত্যুর পেছনের গল্পটা আমার জানা লাগবে। এবং আপনি আপনার দিক থেকে যতোটুকু ঘটেছে তার পুরোটা জানাবেন।”

“এতে আমার লাভ? পরিণতি তো সেই একই, না?”

“যতোক্ষণ কথা বলছেন ততোক্ষণ আয়ু বাড়ছে আপনার।” শান্ত কণ্ঠে জানালো শিয়া, “কে জানে, এর মধ্যে আর কেউ এসে আপনাকে উদ্ধার করে বসতেও তো পারে? আপনার জন্য বেটার অপশন কথা বলে যাওয়াটাই, মি. হিল্লোল।”

“মরতে ভয় পাই না আমি। বাড়তি আয়ুর লোভ দেখিয়ে কাজ হবে না। আর কিছু আছে অফার করার মতো?” কৌতুকের ছোঁয়া এখন হিল্লোলের কণ্ঠে। প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কাটা তিনি সামলে ফেলেছেন। দেখা যাচ্ছে, কমবয়েসি আততায়ীর এখনও কিছু চাওয়া পাওয়ার আছে। এটা একটা ভালো খবর। খুবই ভালো খবর। রাজনীতির মাঠে বিশ বছর ধরে তিনি যেই শিক্ষাটিকে সবার আগে রেখেছেন, ‘কখনও শত্রু যা চাইছে তা সরাসরি দিয়ে দিতে নেই। সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ থাকলে সর্বোচ্চ সময় বের করে নিতে হবে।” তিনি এখন অক্ষরে অক্ষরে সেই নীতি মেনে চলার চেষ্টা করছেন। আততায়ী মেয়েটির কাছ থেকে যতোদূর সম্ভব বের করে নিতে চাইছেন সময়।

ডুপ্লেক্সের নিচতলায় হাউজগার্ড আসলাম এতোক্ষণে নিশ্চয় সন্দেহ করতে শুরু করেছে। গ্যারেজে গাড়ি ঢোকার পাঁচ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও মনিব

ফিরে না আসার অর্থ ভালো কিছু নয়। যে কোনো মুহূর্তে তাকে এই গ্যারেজের দরজায় তিনি দেখার আশা করছেন।

শিয়ার দিকে আরও একবার অপলক দৃষ্টি রাখলেন তিনি, “ডু ইট!”

*

আসলামের দিনটা শুরু হয়েছিলো গতানুগতিকভাবেই। সকালে স্যার চলে যাওয়ার পর জিমে সময় কাটিয়েছে দুই ঘণ্টা। বাইরে যেতে হয়নি, ডুপ্লেক্সের দক্ষিণপ্রান্তে আছে যে কোনো আধুনিক জিমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো সুব্যবস্থা। যতোক্ষণ স্যার বাড়িতে ফিরছেন না, আশেপাশে যেতে কোনও বাঁধা নেই। কাজেই সাড়ে এগারোটার দিকে মৃদুলার আরেক কোণে চলে গেছিলো সে। ৩৯/বি’র সুন্দরি কলেজ পড়ুয়া মেয়েটার সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে। বাবা-মা দারুণ ব্যস্ত, যখন তখন বেডরুমে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা পেয়েছে আসলাম। সাধারণত সে নিজের চেয়ে কম বয়সীদের প্রতি দৈহিকভাবে আকৃষ্ট হয় না। তবে আইরিনের শরীর মোটেও এদেশি আঠারো বছরের মেয়েদের মতো নয়, বরং তেইশ-চব্বিশ বছরের পরিণত দেহের সঙ্গে প্রেম করতে আসলামের ভালোই লাগে। উত্তাল দুটো ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে এসে মনিবের বাড়িতেই রমরমা এক লাঞ্চ সেরে ফেলেছিলো সে। বাঁধা বাবুর্চিটি রাঁধে অসাধারণ।

সন্ধ্যা নামার পর আরও দুটো ঘণ্টা জিমে ব্যয় করেছিলো আসলাম। তার পেশাতে ফিটনেসটাই সব। যে কোনো সময় তার সার্ভিসের প্রয়োজন হতে পারে স্যারের। সেই সময় মুহূর্তের ভুলও নিভিয়ে দিতে পারে তার এবং সংশ্লিষ্ট সবার জীবন প্রদীপ। ফিটনেস ঠিক রাখার প্রশ্নে কোনো আপোষ করে না সে। কাজের প্রতি এই ডেডিকেশনই তাকে দিয়েছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের হাউজ গার্ড হওয়ার সম্মান। ফাহাদ হিল্লোলের মতবাদ এবং আদর্শে পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে। জানে, একদিন এই দেশটায় পরিবর্তন আসবে। আর সেই পরিবর্তন আসবে এই মানুষটির হাত ধরে। স্রেফ মোটা অঙ্কের বেতনের জন্য এই চাকরিটির এতো সম্মান সে দেয় না। আসলাম জানে, সে শুধুমাত্র একজন মানুষের বাড়ি এবং তার জীবন রক্ষার দায়িত্ব নেয়নি। আসলাম রক্ষা করছে দেশটির ভবিষ্যতকে I

রাত আটটার পর নিজের ঘরে ফিরে এসে রগরগে এক পর্নো মুভি ছেড়ে বসেছিলো সে। স্ক্রিনের মেয়েটি দেখতে অনেকটা আইরিনের মতো। এই পর্নো মুভিটি সে গত দুইদিন ধরে বার বার দেখছে, ভাগ্যগুণে কাছাকাছি মিলে যাওয়া চেহারার পর্ণস্টারকে খুঁজে পেয়েছে সে। যদিও এই মেয়েটির চুল বাদামি। তারপরও কাজ চলছে। আইরিনের সদৃশ্য স্তনবৃন্ত আর ভরাট নিতম্বের স্পর্শের কথা ভাবতে ভাবতেই স্বমেহন করেছিলো সে। তারপর গোসল করে রাতের খাবার খেয়ে একটা পত্রিকা পড়তে বসেছিলো। মনের চাহিদা তো কেবল যৌনতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। আসলামের দেওয়ালের শেলফ ভর্তি দেশি বিদেশি লেখকের অসংখ্য বই। অ্যাকাডেমির দুই বছর বাদ দিলে কখনোই সে নিয়মিত বই পড়া থামায়নি।

পত্রিকায় ঘণ্টার কাঁটা কেন ষাট দিয়ে ভাগ করা হয় এবং কেন চব্বিশ ঘণ্টা হিসেবে একদিনের পরিমাপ করা হয় তা নিয়ে ইন্টারেস্টিং এক প্রবন্ধ পড়ছিলো আসলাম। প্রশ্নটা চমৎকার, সবক্ষেত্রে মানুষ হিসেব করে ডেসিমাল বা দশক পদ্ধতিতে। সময় পরিমাপে কেন বারো ঘণ্টায় দিন এবং বারো ঘণ্টায় রাত? আরও বড় কথা, তিনশ ষাট ডিগ্রিতেই ভাগ করতে হলো কেন একটি বৃত্তকে? একে তো একশ’তে ভাগ করা যেতো, একটু বড় হতো প্রতিটি কোণের মাপ, তাতে কি? হিসেবে কতো সুবিধে হতো তা অস্বীকার্য নয়।

বেশ আগ্রহোদ্দীপক এই আর্টিকেল পড়ে শেষ করার আগেই গেটের কাছে স্যারের গাড়ির শব্দ পেয়েছিলো সে। ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে গ্র্যান্ড উইন্ডো থেকে সরাসরি দেখতে পেলো প্রবেশ পথ। এই ঘরটার ডিজাইন করাই হয়েছে গার্ড হাউজের কথা বিবেচনা করে।

পত্রিকাটা ভাঁজ করে জানালার একটু পাশে সরে দাঁড়িয়েছিলো আসলাম। এখানে শেলফের সঙ্গে কাঁচের পাল্লা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে একটা অ্যাসল্ট রাইফেল। যদি ঐ গাড়ি কোনো হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং পূর্ণগতিতে বাড়ির দিকে ছুটে আসতে থাকে, আসলাম দেড় সেকেন্ডের মধ্যেই রাইফেলটা বের করে প্রতি-আক্রমণ করতে সক্ষম। ড্রাইভার এবং সামনের সিটের আরোহী লন পেরুনোর আগেই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। এম-ফোরটি অ্যাসল্ট রাইফেলের স্টপিং পাওয়ার সম্ভাবনা রাখে ড্রাইভারেকে কাঁপিয়ে দেওয়ার। ফলাফল, গাড়ির গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বাড়ির সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা নাও লাগতে পারে।

আসলাম প্রতিটা দিন এমন একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে। রুটিনে পড়ে যাওয়ার কারণে একচিলতে ঢিল যেন না পড়ে মাংসপেশিতে। তবে আজকের দিনটি সেইদিন ছিল না। নিরাপদেই বাড়ি সংলগ্ন গ্যারেজে ঢুকে পড়লো ফাহাদ হিল্লোলের এসইউভি। মিনিট পাঁচেক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো আসলাম, ভেতর থেকে কেউ বের হলো না। না হিল্লোল স্যার, না ইসমাইল।

ভ্রু কুঁচকে একবার হাতঘড়িটা দেখলো সে। রাইফেলের স্বচ্ছ কেসিংয়ের নিচেই সযত্নে রাখা পিস্তলটা তুলে নিলো সে। হোলস্টারে ভরে এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।

বিষয়টা দেখতে হচ্ছে।

*

সটান দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যেন মানবিক সব দুর্বলতা কাটিয়ে ফেলার সক্ষমতা রাখে। একটি পেশিও একবারের জন্য নড়ে ওঠেনি, তাক করে রাখা সাপ্রেসর লাগানো পিস্তলটার ওজন একেবারে মামুলি নয়, হিল্লোল আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে এতোটুকু জ্ঞান অন্তত রাখেন। অথচ ওটা এখন পর্যন্ত একবারও কেঁপে ওঠেনি, নিষ্কম্পভাবে এমন একটা পিস্তল শিকারের দিকে তাক করে রাখার পেছনে দিনের পর দিন গ্রহণ করা প্রশিক্ষণ রয়েছে। ‘অনুশীলন সমিতি’র সাফল্যের একটা জীবন্ত উদাহরণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি। এখানে এসেছে টার্গেটকে নিকেষ করতে এবং তা করার জন্য যা করা লাগবে তাই করবে সে। কিলিং মেশিনদের এক অনাবিল সৌন্দর্য হিসেবে দেখে এসেছেন হিল্লোল, নিজের সংগঠনে এমন কেউ কেউ আছে। এই মুহূর্তে অপরূপা কিলিং মেশিনের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করে এর মধ্যে আর যাই থাকুক, সৌন্দর্যটুকু খুঁজে পেলেন না তিনি।

“উই আর রানিং আউট অব টাইম।” শান্ত কণ্ঠে বলল শিয়া, যেন গবেষণাগারের কোনো পাঠ নিচ্ছে।

“আগেই বলেছি, মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত।” টায়ার থেকে পিঠ সামান্য সরালেন হিল্লোল। বাম হাতের কব্জিতে মৃদু একটা ব্যথা টের পাচ্ছেন। হয়তো মচকে গেছে। আকস্মিক পতনটা খুব সুখকর ছিল না।

“তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।” হিল্লোল লক্ষ্য করলেন মেয়েটির হাসিটা বেশ সুন্দর। অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরাদের পটিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট, “তবে আপনার মতো বুদ্ধিমান একজন মানুষ কি করে ভাবলেন মৃত্যুই আপনার একমাত্র পরিণতি?”

ঘামতে শুরু করলেন হিল্লোল। খুব বেশি সময় পাওয়া যায়নি। আততায়ী কি বলতে চাইছে তিনি জানেন। এর জন্য তিনি প্রস্তুত নন।

“বুলেটের আঘাতে থেঁতলে ফেলার জন্য নিজের ডান হাঁটু আপনার পছন্দ? না বামটা?” ভ্রু কুঁচকালো শিয়া, “নাকি, অপছন্দ বলা উচিত হবে? কোন হাঁটু আপনার অপছন্দ, তা বলে ফেলুন ঝটপট!”

একটা আঙুল তুললে তিনি, “বরং আমি বলতে পারি তোমার ভাই কিভাবে এই নোংরা ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত, আমার সব কথা শোনার পর তুমি নিজেই ধরতে পারবে এখানে আমার দায় কতোখানি। বিশ্বাস করো, শামসের মৃত্যু আমি কখনোই চাইনি। নেভার – “

থুতু ফেলার মতো একটা শব্দ হলো। প্রায় একই সময় ধাতব একটা বিকট শব্দ। চমকে উঠলেন রাজনীতিবিদ। ডান কানটা ঝিম ঝিম করছে। কানের খুব কাছে গাড়ির বডিতে একবার গুলি করেছে শিয়া। কালো চোখের তারা যেন জ্বলছে প্রবল ক্রোধে। ঝানু রাজনীতিবিদ এই মাত্র শামস হত্যার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছেন!

“আপনার মুখে আমার ভাইয়ের জন্য দরদ যেন আরেকবার শুনতে না হয় আমাকে।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে, “কাম টু দ্য পয়েন্ট। ভাইয়া আপনার সঙ্গে দেখা করার পর তাকে আপনি তোফায়েল–রেদোয়ানের কাছে এক্সপোজ করে দেন। এটুকু যোগ-বিয়োগ করার মতো আমার ঘিলু আছে। আমি জানতে চাই, কেন?”

“আমি কখনোই–”

“হিল্লোলের বাম কানটাও ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো এবার। পরের বুলেটটা গাড়ির বনেটে লেগে পিছলে চলে গেলো মেইনটেন্যান্স শেডের দিকে।

“জাস্ট আন্সার! দুনিয়ার কারোই জানতে পারার কথা না তাদের ভিডিও ক্লিপ আমার ভাইয়ের কাছে থাকবে। ওরা বড়জোর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাকিকে সন্দেহ করতে পারতো। সেখান থেকে তারা কিভাবে একেবারে নিশ্চিত হলো এটা আমার ভাইয়ের কাছে আছে? তোফায়েল–রেদোয়ানের কাছে আপনি আমার ভাইয়ের নাম ফাঁস করলেন কেন?”

“ওরা আমার কাছ থেকে জানেনি।” একটা হাত তুললেন হিল্লোল, যেন পরের বুলেটটিকে তিনি তালুবন্দি করতে চান, “নির্ঝরকে কিডন্যাপ করেছিলো তোফায়েল। আমি এসব পরে জানতে পারি। নির্ঝরকে কিডন্যাপ করার পর জাকিকে ডেকে নিয়ে যায় সে। নিজের মোবাইল ফেরত চেয়েছিলো

“কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল মেমরি কার্ডটা কোথায় আছে তা জানা। এটা অনেক ভাবেই করা যায়। অনেক ভাবে। একটা ছেলেকে অপহরণ করে অপর একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতাকে মারধর করে এটা করার দরকার পড়ে না। এতোকিছুর দরকার পড়তো কি আসলেই? রেদোয়ান-তোফায়েল খুব সহজেই একটা রফায় আসতে পারতো জাকির সঙ্গে। তাই না?”

“তারা হয়তো ভেবেছে সেই সুযোগ জাকি তাদের দেবে না।”

“মিথ্যে কথা। তারা সেই চেষ্টা করেনি কেন তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। কারণ, এর আগেই আমার ভাই আপনার অফিসে এসে পৌছেছে। আপনি জেনে গেছেন ঠিক কার কাছে আছে মেমরি কার্ডটি। জেনেছেন যার হাতে এটা পৌছেছে আপনার বা বিরোধী দলের কাছে তার কোনো রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নেই। বুঝতে পেরেছেন ভাইয়া এই ভিডিও ফ্ল্যাশ করবেই। কাজেই, পুরো ব্যাপারটা আপনি তোফায়েল-রেদোয়ানকে জানিয়ে দেন।”

“না! তারা এটা জাকিকে টর্চার করে বের করে। আমি আগেও বলেছি এসব আমি অনেক পরে জানি। ঐ মার্ডারের পর…”

“এখানে নির্ঝরের কিডন্যাপ কিংবা জাকির টর্চার স্রেফ লোক দেখানো ব্যাপার। হয়তো ভাইয়াকে একা করে দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে, হয়তো শুধুই জাকিকে ফাঁসানোর জন্য। তবে জিনিসটা যে আমার ভাইয়ের হাতে তা ওরা আগে থেকেই জানতো। জানতো আর কোথাও এর কপি নেই। আর এই তথ্য কেবলমাত্র আপনার কাছেই পাওয়া সম্ভব। যে মানুষটিকে আমার ভাই বিশ্বাস করেছিলো!”

“বুঝতে পারছো না, এখানে মিথ্যে বলে আমার লাভ-”

“তাহলে জবাব দিন প্লিজ, জাকি গ্রুপ তোফায়েলের মোবাইল কেড়ে নেওয়ার পর এক-দেড় মাস কেন ওরা নির্ঝরকে কিডন্যাপ করলো না? কেন জাকিকে টর্চার করতে এগিয়ে এলো না? কেন ওরা এই কাজগুলো করলো আপনার সঙ্গে আমার ভাইয়ের সাক্ষাতের দ্বিতীয়দিনের মাথায়? আছে কোনো ব্যাখ্যা এর?”

শব্দের অভাবে খাবি খেলেন হিল্লোল।

“নেই। কাজেই ছেঁদো কথা ছাড়ুন। আপনি কেন ওদের জানিয়ে দিয়েছেন তা স্পষ্ট করে আমাকে ব্যাখ্যা দেবেন নয়তো আর যুক্তিতর্ক কপচাবো না আমি। ডান হাঁটুতে গুলি খাওয়ার পর আপনার বুদ্ধি এমনিতেই খুলবে মনে হয়।”

“আমি বলতে পারি ঐ ভিডিওতে কি আছে।” ঘেমে গোসল হয়ে গেছেন ‘ভবিষ্যত-প্রধানমন্ত্রি’। চকচকে মুখ তুলে মরিয়ার মতো তাকিয়ে আছেন শিয়ার দিকে।

“সেটা আমরা শুনবো। তবে আমার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর। আমার ভাইকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য কতো নিয়েছেন তা জানার পর। জানতে হবে না আমাকে, ওর জীবনের দাম কয় টাকা ছিল?”

চকচকে ঘর্মাক্ত মুখটায় হঠাৎ-ই এলো পরিবর্তন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন হিল্লোল, “টাকা? না না, টাকার প্রশ্ন না এটা। টাকার অভাব আমার আছে কি? এই বাড়ি এই গাড়ি দেখে কি মনে হয়?”

“তবে বলতে চাইছেন দলের সম্মান রক্ষার জন্য–”

শিয়া তার বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে হিল্লোলের চোখ। ওর সামান্য পেছনে একবার তাকিয়েই আবার ফিরে এলো দৃষ্টি, তবে এই এক মুহূর্তেই অনেক কিছু স্রেফ অনুমান করে নিলো শিয়া। ঘাড়ের পেছনে শিরশির করে উঠলো, বুকের ভেতর রক্ত ছলকে ওঠার মতো অনুভূতি।

পেছনে আর কেউ আছে!

প্রথমে ডানদিকে ঝাঁপ দিলো শিয়া। ওদিকেই মেইনটেন্যান্স শেড। ঘরের ভেতর ঘর। ‘ফাদার’ হিল্লোলের গাড়িটি গ্যারেজে ঢোকার সময় যেখানে লুকিয়ে ছিল সে। দড়াবাজদের মতো বাতাসে একটা ইংরেজি ‘এক্স’ অক্ষর কেটে প্রথমে ডান হাত, তারপর বাম হাত এবং অবশেষে বাম পায়ের পর নেমে আসা ডান পা শেডের ভেতর ঢুকে যায়। অসম্ভব নমনীয় দেহটি দিয়ে পূর্ণ এক বৃত্ত এঁকে ফেলার আগেই অনেকটা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো অবস্থানে চলে আসে সে। বাতাসে তখন বোলতার গুঞ্জন।

তখনই প্রথমবারের মতো পেছনের দৃশ্যটি দেখার অবকাশ পেলো শিয়া এবং ভারসাম্য পুরোপুরি ফিরে পাওয়ার আগেই দু’বার গুলি করার সুযোগ পেলো সে, সেই সঙ্গে গতি জড়তার কারণে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়লো শেডের মাটিতে।

আসলাম যে ধাক্কাটা খেলো তা দ্বিমুখী। প্রথমত, বিস্ময়ের এক প্রাচীন অনুভূতি তাকে সঙ্গ দিলো মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য। চুপিসারে গ্যারেজে ঢুকেছে সে, হাতে ছিল খোলা পিস্তল। মেঝেতে মৃত বডিগার্ডকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে সে, কিন্তু আততায়ী মেয়েটি ছিল তার এবং স্যারের ঠিক মাঝখানে। লাইন অব ফায়ার পরিস্কার, তবে হোস্টেজ সিচুয়েশনে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। মেয়েটাকে বিদ্ধ করার পর একটা বুলেট যদি স্যারের শরীরে ঢুকে পড়ে, অঘটন ঘটে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতি এড়াতেই নিজের অবস্থান কয়েক ফিট ডানে নিয়ে যাচ্ছিলো সে, এই সময় কেঁচিয়ে ফেললেন স্যার। মেয়েটির দিকে সে তখন কেবল অস্ত্র তুলছিলো, অজান্তেই তার দিকে স্বস্তির সঙ্গে তাকিয়ে বসলেন ঝানু রাজনীতিবিদ! নিঃসন্দেহে বাড়তি কোনো কমব্যাট ট্রেনিং তার নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজের ইন্দ্রীয়গুলোর ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে ও ধরণের ট্রেনিং অবশ্যই প্রয়োজন। সেজন্য মনিবকে দোষ দিতে পারলো না সে। মেয়েটা প্রফেশনাল, ওটুকুতেই পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে স্রেফ সার্কাসের অ্যাক্রোব্যাটদের মতো চরকি-নাচ নেচে শেডের দিকে চলে যাচ্ছিলো সে। সময় ছিল না, সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়েছে আসলাম। বদ্ধ গ্যারেজে গুলির শব্দ হয়েছে বিকট। ম্যাগাজিনের আট আর চেম্বারের এক নয় নয়টি বুলেট বেরুতে সময় লাগে এক সেকেন্ডের দশ ভাগের নয় ভাগ। অথচ একটিও লাগলো না তাকে, এটা বিস্ময়কর।

তবে শেডে ঢোকার আগে এক মুহূর্তের জন্য যেন খাটো ঐ দরজায় থমকে ছিল শত্রু, বার দুয়েক গুলি ছুঁড়েছে, তাদের একটাই কাঁধের কাছে মাঝারি এক ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সে ধাক্কায় ডানদিকে হাল্কা ঘুরে গেলো আসলাম।

হোস্টেজ সিচুয়েশনে কি করতে হয় তা পুরোপুরি না জানলেও, বিশৃঙ্খলার সুযোগ কি করে নিতে হয় সে ব্যাপারে ফাহাদ হিল্লোল যে ভালো জ্ঞান রাখেন তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। এই গোলাগুলি-দড়াবাজির মধ্যেই হাঁচরে পাঁচরে গ্যারেজের মেঝে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকলেন তিনি 1 প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য গ্যারেজের দরজা মনে হলেও পরবর্তিতে বোঝা যায় ইসমাইলের পরে থাকা পিস্তলটা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন এখন। শত্রু এখনও সক্রিয় আছে এই দিকটা বুঝে নিতে তিনি ভুল করেননি।

আহত কাঁধের আড়ষ্টতা কাটাতে ডান হাতটা বার দুয়েক ঝাড়লো আসলাম। সেই সঙ্গে বাম হাতের এক মৃদু স্পর্শে ম্যাগাজিনটা খুলে ফেললো, কোমরে অন্য হাতটা চলে গেছে তার–নতুন আরেকটি ম্যাগাজিন বের করে ফেলেছে। তবে উত্তেজনায় সে লক্ষ্য করেনি, ফাঁকা গ্যারেজে ম্যাগাজিন বেরিয়ে আসার স্লাইডিং নয়েজ কতোটা জোরে শোনা যেতে পারে! সড়াৎ শব্দে ওটা বেরিয়ে এলো ফ্রেম থেকে।

শত্রুর অস্ত্র ফাঁকা, টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেইনটেন্যান্স ডোর থেকে উড়ন্ত এক নারীদেহ বেরিয়ে এলো। এটা এলিমেন্ট অব সারপ্রাইজের প্রথম অংশ। সাপ্রেসরটা শিয়া খুলে ফেলেছে, কাজেই দ্বিতীয় অংশটি এলো গগনবিদারী গুলির শব্দে। আসলামের মুখ উড়ন্ত শত্রুকে দেখা মাত্রই বিস্ময়ে সামান্য হা হয়ে গেছিলো। সেই হা-য়ের অর্ধেকটা উড়ে গেলো ভারি ক্যালিবারের বুলেটের আঘাতে।

ইসমাইলের পিস্তলটা তখনও শিয়ার দিকে তোলার চেষ্টা করছেন হিল্লোল, ল্যান্ড করলো মেয়েটা। মাটিতে আছড়ে পড়েই কুমড়োর মতো গড়িয়ে গেলো অনুশীলনী সমিতির নবিস সদস্যা। সোজা হয়ে থামলো যখন এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে।

হিল্লোলের কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে ছোট্ট এক গর্ত করে ঢুকলো বুলেটটা। মাথার পেছনটা বিস্ফোরিত করে বেরিয়ে গেলো মগজের প্রায় সবটুকু নিয়ে! প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ তার নিজের গ্যারেজে আছড়ে পড়লেন, দেশের ইতিহাসে আরও একটি ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’ নামধারী ফাইলে জমা হওয়ার জন্য। আরও একটি ভুল ফাইল।

শেষ গুলিটির শব্দ গ্যারেজে এখনও প্রতিধ্বনী তুলছে। তারপর একেবারে আচমকাই থমকে গেলো। হঠাৎ আসা এই নিস্তব্ধতায় শিয়ার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। একমুহূর্তের জন্য গ্যারেজের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের কীর্তি দেখতে চারপাশে চোখ বোলালো সে। তিনটে লাশ, প্রচুর রক্ত আর সামান্য মগজ। মোটেও পরিচ্ছন্ন নয়। তার কাজ এতো অগোছালো হয়ে এসেছে জানলে সুভাষ নিশ্চয় মন খারাপ করতো। অনুশীলন সমিতি ব্যক্তিগত অনুভূতি জড়িয়ে থাকা টার্গেট নিকেশ করতে পাঠায় না কেন, সদ্য অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করলো সে।

হিল্লোলের সঙ্গে খেজুরে আলাপ না করলে এই নোংরা গ্যারেজ দেখতে হতো না। জড়াজড়ি করে পড়ে থাকতেন সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য, তারই বডিগার্ডের সঙ্গে-নিজের কোটি টাকা দামের এসইউভির ফ্রন্ট টায়ারের পাশে। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাটি কিছু টের পাওয়ার আগেই রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে যেতো আততায়ী। দূর থেকে ভেসে আসা পুলিশের যে সাইরেন এখন শোনা যাচ্ছে তা শুনতে হতো না এখানে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সাইরেন শোনা যাচ্ছে, কারণ টার্গেটের সঙ্গে ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ চুকাতে গিয়ে নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছে সে।

মেইনটেন্যান্স শেডের ভেতর থেকে সাপ্রেসরটা তুলে আনলো শিয়া। বুলেটের খোসাগুলো একে একে তুলে নিলো কোমরের ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগে। তারপর যেন কিছুই হয়নি এভাবে হেঁটে যেতে থাকলো বারো ফিট উঁচু পাঁচিলের দিকে। কালো একটা দড়ি ঝুলছে ওখানে। টপকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খুলে নিলো ওটা। দুই গলি পরে পার্ক করে রাখা কালো মোটরসাইকেলটায় চেপে বসে যখন একটার পর একটা গলি ধরে মৃদুলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, পুলিশের সাইরেন অনেকটাই পেছনে পড়ে গেলো। তাদের গন্তব্য জনপ্রিয় রাজনীতিক ফাহাদ পাটোয়ারী হিল্লোলের বসতবাড়ি।

শিয়ার গতিপথ তার ঠিক বিপরীতদিকে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস কেটে ছুটে যাচ্ছে মোটরসাইকেল, মাথার ভেতর চলছে সম্ভাব্য চেকপয়েন্টগুলোর অবস্থানের এক খসড়া হিসেব। অনুশীলন সমিতি যদি তাকে সামান্য কিছুও শিখিয়ে থাকে, ওসব চেকপয়েন্টের কোনোটাতেই আটকাবে না সে।

শান্ত এক ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বাইকের গতি বাড়ালো শিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *