1 of 2

কুকুরদল – ৪২

অধ্যায় ৪২

নিজের ক্যাম্পাসে ফিরে এসে মুহিব প্রথম যে কাজটা করলো তা হলো শেরে বাংলা হলে ঢুঁ মারা। আজ জাকির ঘরে মঞ্জুর একটা পিস্তল নিয়ে বসে ছিল না। পাতিনেতা একাই ছিল, আগেরদিনের মতোই চুলে রিবন নেই। লম্বা চুলগুলো নানাদিকে ছড়িয়ে আছে। ক্যাম্পাসের অনেক মেয়ের স্বপ্নপুরুষটি রুমের ভেতর লম্বা চুলগুলো খোলাই রাখে। আলগোছে শামসের টেবিলের দিকে তাকালো মুহিব, একেবারে ঝকঝক করছে। শুন্য টেবিল, শুন্য খাট। পাটাতন পর্যন্ত দেখা যায়। এখানে একসময় নিশ্চয় অনেক কিছু থাকতো। মঞ্জুর কিংবা জাকির টেবিলের মতোই অগোছালো ছিল শামসেরটা। নির্ঝরের অংশটা ফাঁকা ফাঁকা। নিজের বাড়ির কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হলে কেউ পুরোপুরি হলে শিফট করে না। মাঝে মধ্যে দুই একদিন থাকা যেন যায় তেমনই জিনিসপত্র এনেছে সে। তার খাট আর টেবিলটাই সবচেয়ে বেশি গোছানো।

“বসো, বসো। কাজটা করে নেই। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।” নিজের ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলল জাকি।

বসার লক্ষণ দেখালো না মুহিব, ইতিউতি তাকাচ্ছে চারপাশে। বলল, “শামসভাইয়ের টেবিলে বসলে সমস্যা আছে, ভাই?”

একটা হাত নেড়ে দুর্বোধ্য ভঙ্গি করলো জাকি। যার অর্থ খুব সম্ভবত: যেখানে মন চায় বসে পড়ো না হে! এতো বকর বকরের দরকার কি? কাজেই বসে পড়লো মুহিব। বাইরে এখনও শেষ বিকেলের আলো। তিন তলার এই ঘরে আর যারই অভাব থাকুক, আলোর কোনো অভাব নেই। নিজের স্মার্টফোনটা বের করে ফেসবুক ব্রাউজের অভিনয় করতে শুরু করলো মুহিব, আসলে টেবিলের প্রতিটা ইঞ্চি ধীরে ধীরে খালি চোখে এক্সপ্লোর করছে। ওপরের তল পুরোটা দেখে ফেললো, কোনো সন্দেহজনক খাঁজ নেই। একটা হাত টেবিলে অলসভাবে ফেলে রাখার ভান করে ধীরে ধীরে তলাটাও কেবল অর্ধেক পর্যন্ত পরীক্ষা করেছে, উচ্চস্বরে হাসির শব্দে ঘর ভরে উঠলো।

ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে জাকি, মাথা নাড়ছে দুই পাশে।

“নাই। আমরা তিনজন মিলে এই ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি খুঁজেছি। ঐ মেমরি কার্ড তো পাইনি-ই, অন্য কোনো ডাটা স্টোরিং ডিভাইসও পাইনি।” মঞ্জুরের টেবিল থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট এনে নিজের খাটে বসলো সে,

“এদিকে চইলা আসো। অযথা খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট করে লাভ নাই।”

অগত্যা মধুসূদন বলে যে প্রবাদটা আছে তার সামনে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলো মুহিব। জাকির চেয়ার টেনে নিয়ে তার মুখোমুখি বসলো।

“শামসভাই কার্ড ছাড়াই ওদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো এমনটা আপনারাও সন্দেহ করেছিলেন?”

একটা ভ্রু উঁচু করলো জাকি, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কিভাবে চিন্তা করে তা আমি ভালো জানবো, না তুমি?”

কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “গতদিন এটা আমাদের বলেননি।”

“কার্ডটা পেলে বলতাম হয়তো। যেটা পাওয়া যায়নি তার কথা তুলে লাভ কী?”

এক সেকেন্ড সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদের দিকে তাকিয়ে থাকলো মুহিব। জাকি গ্রুপ কি শামসের মেমরি কার্ড পেয়ে গেছে? সম্ভবত না। ওটা তারা পেয়ে গেলে তোফায়েল এতোক্ষণে ইতিহাস হয়ে যেতো। অথচ ছোকরা বহাল তবিয়তেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া, রুমমেটরা সহজে নাগাল পাবে এমন কোথাও মেমরি কার্ড লুকাতে যাবে কেন সে? তাহলে নিজের ল্যাপটপেও রাখতে পারতো এর একটা কপি।

“তা অবশ্য ঠিক।” অবশেষে জাকির মন্তব্য মেনে নেওয়ার ভান করলো মুহিব, “আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমারও ছিল, ভাই। দু’-একটা প্রশ্ন আগের দিন করা হয়নি।”

“শিওর।”

“যেদিন তূর্ণা আপুকে এই হল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখলাম, আপনারা কি নিয়ে আলাপ করছিলেন?”

“আসলে,” দীর্ঘশ্বাস ফেললো জাকি, “আমি তার সাথে কোনো কিছু নিয়েই আলাপ করতে চাইনি। জানো তো ওই সময় আমি বলতে গেলে রুম থেকেই বের হইনি। অথচ ঘটনাটার পর থেকে তূর্ণা আমাকে ফোন করে করে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। সে আমার সঙ্গে কথা বলবেই। ফোনে বলেছিলাম এই বিষয়ে আমিও কিছু জানি না কিন্তু সে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে গেলো।”

বাঁ হাতে সিগারেট নিয়ে লাইটার খুঁজে যাচ্ছে জাকি, তার ফাঁকেই কথা বলছিলো এতোক্ষণ। এবার বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো সে, “আগুন-টাগুন আছে নাকি?”

পকেট থেকে দুই টাকা দামের একটা ম্যাচ বের করে জাকিকে সিগারেট ধরিয়ে দিলো মুহিব।

“তো, যা বলছিলাম,” গল গল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল জাকি, “মেয়ে একেবারে হলে চলে আসলো। গেস্ট রুমে বসে আমার রুমে খবর পাঠিয়েছে, চিন্তা করতে পারো? নামতেই হলো।”

“তারপর?”

“নেমে ধরা খেয়ে গেলাম। আমার মাথায় তখন পুরো পেঁচানো ব্যান্ডেজ। তূর্ণা আর যাই হোক, বোকা না। এটার পেছনের কাহিনী জানতে চাইলো। তূর্ণাকে তো চেনো না, সে যদি চেপে ধরে তো শেষ। না বললে এমন সিন ক্রিয়েট করে বসবে যে মানুষ সন্দেহ করবেই।” সিগারেটে টান দেওয়ার জন্য ছোট্ট বিরতি দিলো জাকি।

“সবটা বলে দিলেন?”

“সবটা না। তোফায়েলের সাথে আমরা কি করেছি তা বলিনি। মেমরি কার্ড বিভ্রাটের কথা সে জানে না। শুধু জানে আমাদের সাথে পুরাতন বিরোধের জোরে এই কাজটা তোফায়েল করেছে। ওকে নির্ঝরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কাহিনীটা বললাম। আমি যে গাধার মতো ওদের ফাঁদে পড়েছিলাম তা জানালাম। আমার ফোন ব্যবহার করে ওরা শামসকে ওখানে ডেকে নিয়ে গেছিলো তাও বললাম। ঐ সময় গেস্ট রুম একেবারে ফাঁকা ছিল অবশ্যই।”

“ব্যাপারটা তূর্ণা আপু কিভাবে নিলো?”

“যতোটা খারাপভাবে নেওয়া যায়। আমাকে শামসের মৃত্যুর জন্য দায়ি করলো সে। একটা ছাতা নিয়ে এসেছিলো, খুব রোদ পড়েছিলো সেদিন। ঐ ছাতা সে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলো প্রথমে, তারপর একটা পেপারওয়েট। চিৎকার করে কি সব যেন বলছিলো, তারপর কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। ওকে যে ধরবো সেই সুযোগও দিলো না। হল থেকে বের হয়ে সোজা সামনে হাঁটা। কি করবো বুঝতে না পেরে আমিও বের হয়েছিলাম। সেই সময় তোমরা আমাকে দেখেছিলে।”

সিগারেটের অবশিষ্টাংশ মুহিবকে দিয়ে দিলো জাকি। একটু অবাক হলেও সিগারেটটা নিলো মুহিব, এখনও অর্ধেক বাকি আছে। আজকে জাকিকে বাড়াবাড়ি রকমের বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। শিয়াল কখন মুরগির ভাগ দেয়? মুহিব জানে না। ঘাড়ের পেছনের শিরশিরে অনুভূতিটা বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার জন্য তাগিদ দিলো ওকে।

“তোমার প্ল্যান কি? তোফায়েলের ব্যাপারটা নিয়ে কি করবা?” চলিত ভাষা ছাড়তে শুরু করেছে জাকি, অর্থাৎ সে সিরিয়াস হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।

“আপাতত কিছুই না। মেমরি কার্ডটা পেলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবো।”

“আমরা বিশ্বাস করি ঐ মেমরি কার্ড এখন তোফায়েলের কাছে। শামসের ঘটনার পর এসব নিয়ে সে আর ঘাঁটায়নি। অর্থাৎ কোনো একটা কারণে সে সন্তুষ্ট। মেমরি কার্ড হাতে না এলে তার সন্তুষ্ট হওয়ার কথা না। সে এখন জানে তার বিরুদ্ধে কারও কোনো প্রমাণ নাই।” মুহিবকে চোখ ছোটো করে তাকাতে দেখে নিজের বক্তব্যটা শুধরে নিলো জাকি, “আদালতে টিকবে এমন কোনো প্রমাণের কথা বলছি।”

“আমার সাক্ষ্য আদালতের রায়ে কোনো পরিবর্তন আনবে না?”

শুষ্ক হাসি হাসলো জাকি, “তোমাকে আমি দোষ দেই না। আদালতের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। বিষয়টা এমন না যে তুমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলবা ঐ রাতে তোফায়েল-রেদোয়ানকে ভিক্টিমের গলা কাটতে দেখেছো আর গোটা আদালত বিস্ময়ধ্বনী করবে। ‘হা–আআআআ!’ টাইপ। বিবাদী পক্ষের উকিল একটু নড়ে চড়ে বসবে কেবল, তারপর ঐ ব্যাটা যদি ঘুষ খাওয়া লোক না হয়, তোমার সাক্ষ্যকে সে আধঘণ্টার মধ্যেই ধরাশায়ী করে ফেলবে। আমি উকিল না, কিন্তু তোমাকে বলি কোন প্রশ্নগুলো তোমার সাক্ষ্য স্রেফ উড়িয়ে দেবে।”

মাথা দোলালো মুহিব।

“প্রশ্ন নম্বর এক. মেশিন শপের পেছনে তখন কেমন আলো ছিল? ওখানে কোনো ল্যাম্প নেই, আলোর উৎস শুন্য।”

“ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল।” স্বীকার করলো মুহিব। একেবারে ভূত দেখার উপযোগি অন্ধকারই ছিল সেরাতে। অমাবশ্যা।

“প্রশ্ন দুই। ঐ আলোয় কি কারও চেহারা স্পষ্ট দেখা গেছিলো?”

“না। তবে আমি গলার স্বরে চিনেছিলাম। রেদোয়ানকে নাম ধরেও ডেকেছিলো ওখানে, সে তার ট্রেডমার্ক গালিও দিয়েছে।”

হাহা করে হাসলো জাকি, “শেষ তোমার সাক্ষ্যের বৈধতা। তুমি আউট দুই প্রশ্নেই কাত। এটা ছিঁচকে চুরি নিয়ে কথা হচ্ছে না, ব্রাদার, যে তোমার গলার স্বর চেনার ‘ক্ষমতা’র ওপর ভিত্তি করে একটা রায় হয়ে যাবে। এটা মার্ডার কেস। এতো অল্প বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে কোনো আদালতই কাউকে দোষী বলে রায় দেবে না। যদি রেকর্ড করে রাখতে পারতে কিংবা ছবি তুলতে পারতে, ওরা একটা ঝামেলায় পড়তে পারতো। তাছাড়া রেদোয়ান–তোফায়েলের কোনো ভয় নেই।”

“ক্রাইম সিনে আমিও ছিলাম এটা তো তাদের মানতেই হবে?”

“মাথা নাড়লো জাকি, “অবশ্যই। তোমার কথা আদালতে উপস্থিত সবাই বিশ্বাস করবে, মায় বিচারক পর্যন্ত। তুমি ওখানে ছিলে এবং খুনটা হতে দেখেছো। কিন্তু খুনি যে তোফায়েল আর রেদোয়ানই তার স্বপক্ষে তোমার সাক্ষ্য জোরালো না। তুমি বলেছো ওখানে আলো ছিল না। তুমি বলেছো শুধুমাত্র পরিচিত কণ্ঠের কারণে তুমি খুনিদের চিনতে পেরেছো। এইটুকুর ওপর ভিত্তি করে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় না কোথাও।”

অতি সত্য কথা। মুহিব আদালত-মামলা ইত্যাদি নিয়ে এতো বিশদভাবে ভাবেনি। সে প্রথমে রহস্যটা উদঘাটন করতে চেয়েছে। রহস্য এখনও উদ্ধার হয়নি যেহেতু ওসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অর্থ দুই ধাপ সামনের জিনিস নিয়ে চিন্তা করা। মুহিব এই ভুলটা কখনও করে না। সে কাজ করে তার বর্তমান নিয়ে। বর্তমানে আদালতে উপস্থিত হতে হচ্ছে না তাকে, তাই এসব নিয়ে ভাবতেও চায়নি এতোদিন।

“তুমি এখন আদালত নিয়ে ভাবতে চাচ্ছো না, আমি জানি।” সবজান্তার ভেক ধরে জাকি বলল, “কিন্তু রাজনীতির মাঠে আমার যে কয় দিনের অভিজ্ঞতা তা থেকে একটা জিনিস ভালোমতো শিখেছি।”

নতুন একটা সিগারেট ধরালো জাকির। যথারীতি মুহিবের ম্যাচ, জাকির সিগারেট। যৌথ উদ্যোগে অগ্নিসংযোজন। একারণেই কি তাকে আজ সিগারেটের ভাগ বেশি দেওয়া হচ্ছে? হতেও পারে।

“শিক্ষাটা হলো, তুমি যাই করো না কেন তার শেষ ফলাফলটা সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। প্রথম স্টেপ থেকে তুমি চিন্তা করবে শেষ স্টেপ। এভাবে ভাবার কারণে কি উপকারটা হচ্ছে আমাকে বলতে পারবে?”

যেন ক্লাস নিতে ঢুকেছে প্রফেসর শাহাবুজ্জামান। পিত্তি জ্বলে গেলো মুহিবের। তবে শান্তভঙ্গিতেই উত্তর দিলো সে, “এতে করে আপনি যদি বুঝতে পারেন শেষ ধাপে ফলাফল শুভ না, তবে প্রথম ধাপেই থেমে যেতে পারবেন। সময় আর রিসোর্স বাঁচবে।”

“ঠিক তাই। এভাবে চিন্তা করা আমার জন্য সহজাত একটা ব্যাপার হয়ে এসেছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আদালতে তোফায়েলদের আটকে ফেলাটা যে অসম্ভব সেই দিকটা আমি নিশ্চিত হয়েছি? এই মাদারচোতকে আদালতে তুলতে পারলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। কিন্তু কাজটা অসম্ভব।”

জরুরি এবং গোপন মিটিংয়ে তাকে একাকি ডাকার কারণ কি? মুহিবের ধারণা, জাকি তার সঙ্গে মিষ্টিমধুর আলাপ করছে যেন তারা আদালতে না যায়। আদালত পর্যন্ত বিষয়টা গড়ালে জাকির কুকীর্তিও পরিস্কার ফুটে উঠবে। এই ঝুঁকি কোনো উঠতি রাজনীতিবিদ নেবে না। মুহিব এবার সেদিক থেকেই আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।

“কিন্তু আপনি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। আমরা যদি মেমরি কার্ডটা বের করতে পারি, তবে নতুন কোনো দিক থেকে আদালতে তাকে আটকে ফেলা যাবে হয়তো। শামসের মার্ডারটা তখন ভিন্ন প্রসঙ্গ হয়ে যাবে।”

“যেমন?”

“ঐখানে তোফায়েল কিংবা রেদোয়ানের কোনো এক ক্রাইমের প্রমাণ অবশ্যই আছে। এমন কিছু সেখানে ছিল যা মুখে মুখে প্রচার হলে থলের বেড়াল বের হয়ে যেতে পারে। নতুবা খুনোখুনির দিকে যাওয়ার দরকার পড়তো না। আর সেই প্রমাণ যদি আমাদের হাতে চলে আসে, তোফায়েলকে আদালতে আটকে ফেলাটা কঠিন হবে না। শামসভাইয়ের মার্ডার, আপনার ভূমিকা, কিছুই সেখানে তুলতে হচ্ছে না।”

“আমার প্রসঙ্গ আদালতে উঠলে কোনো সমস্যা নেই।” মুহিবের আশঙ্কাকে অবাস্তর প্রমাণের জন্যই যেন বলল জাকি, “কিন্তু মেমরি কার্ডের ওপর তুমি যে বাজিটা ধরতে চাইছো, আমার মনে হয় এটা একটা বোকামি। আমাদের ধারণা, ঐ জিনিস এরই মধ্যে তোফায়েলের কাছে আছে। আগেও বলেছি তোমাকে।”

মাথা দোলালো মুহিব, “তবে আমাদের ধারণা, ওটা শামসভাই কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলেন।”

আবারও সিগারেটের অর্ধেকটা জুনিয়রের হাতে তুলে দিলো জাকি, “ফাইন। তর্কের খাতিরে ধরলাম তুমি ঐ মেমরি কার্ড পেলা। সেখানে ক্রাইম রেকর্ডও পাওয়া গেলো। খুব চমৎকার। আদালতে উত্থাপিত হলো এবং আদালত তোফায়েল আর রেদোয়ানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলো। তারপর?”

বোকার মতো সিগারেটে টান দিলো মুহিব।

“তুমি কি সত্যিই আশা করো,” তার দিকে ঝুঁকে এলো জাকি, “আমাদের ছাত্র সংগঠনের কেউ খুন-ধর্ষণ করার পর তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে? প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা আছে কি করতে?”

এদিকটাও ভেবে দেখেনি মুহিব।

“গত বছরের কাহিনী মনে নাই? মাধুরীকে ধর্ষণ করে হত্যা করলো আমাদেরই সংগঠনের এক লোক। তার যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছিলো। সে এখন কাওরান বাজারে সবজি বিক্রি করে।”

“সিরিয়াসলি?”

“অবশ্যই। পয়েন্টে আসো, কোথায় তার যাবজ্জীবন? এক বছরের মধ্যে সে বের হয়ে এলো কি করে? কারণ সে আমাদের সংগঠনের হয়ে রাজনীতি করতো। কর্মিদের মনোবল ধরে রাখতে হলেও আমাদের সিনিয়ররা এমন কিছু কাজ করেন। আমাদের সাথে রাজনীতি করে যদি ফাঁসিতেই ঝোলা লাগে, নতুন কর্মি আসবে কোত্থেকে? আর এটা নিশ্চিত থাকো, তোফায়েলের সঙ্গে অনেক সিনিয়রের যোগাযোগ আছে। রেদোয়ানের বাবা নিজেই তো উপমন্ত্রি। পুরা ফ্যামিলিই পলিটিকাল। বুঝতে পারছো রেজাল্ট কি হতে যাচ্ছে? আদালত রায় ঘোষণা করলেও কোনো পরোয়া নেই। তাদের তুমি এক বছরের মধ্যে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখবে।”

“আপনার কথা সম্ভবত ঠিক।”

“অবশ্যই ঠিক। এরকম কতো কেস দেখলাম। তোমরা তো একটা দেখেই টাসকি খায়া গেলা!”

চুপচাপ ধূমপান করলো মুহিব। জাকি তার ল্যাপটপে আবারও কি যেন খুটখাট শুরু করেছে। হয়তো যা বলল তা নিয়ে ভাবার জন্য মুহিবকে যথেষ্ট সময় দিতে চাইছে। টেবিলের নিচে রাখা অ্যাশট্রের ভেতর সিগারেটের মোথা ফেলে দেওয়ার সময় মুহিব নিশ্চিত হলো, এ নিয়ে বেশী ভাবনাচিন্তার কিছু নেই। মুহিবরা জানে তারা কি করছে। জাকি গ্রুপ কি জানে তারা কি করছে? সন্দেহ আছে। বন্ধু হত্যার পর হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। কাপুরুষের দল। ক্যাম্পাসে এদের ‘ধ্বজ’ বলা হয় কেন তা এখন সুস্পষ্ট।

“অ্যাশট্রের পাশে লাল কাপড়ের ব্যাগটা বের করো তো।” টাইপ করতে করতেই বলল জাকি। লাল কাপড়ের ব্যাগটা দেখতে পেলো মুহিব। ভেতরে কোনো বই রেখে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন। টেনে বের করার সময় বুঝতে পারলো, যথেষ্ট ভারি।

“ভেতরে কি আছে বের করো।”

ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লাল ভেলভেট মোড়ানো এক বাক্স। যথেষ্ট ভারি। তুলে একবার ঝাঁকিয়ে ভেতরে কি আছে বোঝার চেষ্টা করলো মুহিব।

“খোলো ওটা।”

খুললো মুহিব। সৌম্যদর্শন এক পিস্তল শুয়ে আছে সেখানে। তিনটা বাড়তি ম্যাগাজিন। অস্বীকার করবে না, পিস্তলটার চেহারাটাই বদখত অথচ ওটা একবার স্পর্শ করার জন্য হাত নিশপিশ করে উঠলো ওর।

“এটা হলো তোমার সব প্রশ্নের জবাব, মুহিব। তোফায়েল–রেদোয়ানের আদালত, ন্যায়বিচার সব আছে তোমার হাতের ঐ বাক্সের ভেতর।”

“আপনি নিশ্চয় ওদের দু’জনকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারতে চাইছেন না!”

মাথা নাড়লো জাকি, “ঠিক সেটাই চাইছি আমি। ওখানে যারা ছিল, চার–পাঁচজনের সবাইকে এটা করা যাবে না। তবে পালের গোদা দুটোর জন্য ক্ষমা নেই! শামসকে মেরে ফেলার আগে ওদের এটা নিয়ে আরও ভালোভাবে ভাবা উচিত ছিল।”

“ফাইন।” বাক্সটা বন্ধ করে জাকির ল্যাপটপের পাশে রেখে দিলো মুহিব। তাকে এই হত্যা-পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দেওয়ার পরও ভীত বা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে না। যেন জাকি জনি ডেপের নতুন কোনো মুভি ল্যাপটপ থেকে চিরতরে ডিলেট করার কথা বলেছে আর মুহিব সে ব্যাপারে মতামত জানিয়েছে। ছেলেটার শক্ত নার্ভ জাকিকে সন্তুষ্ট করলো।

মুহিব বলল, “কাজটা কবে করছেন?”

হাসলো জাকি, “এই কাজটা আমি করতে পারবো না। তোফায়েল গুলি খেলে সবার আগে আমাদের খোঁজা হবে। আমাকে, নির্ঝরকে আর মঞ্জুরকে তো অবশ্যই, আমাদের গ্রুপের যে জুনিয়রগুলো আছে, তাদেরও। সেন্টার থেকে আর কিছু বুঝুক আর না বুঝুক, অ্যাফিলিয়েশনটা বোঝে। কার সাথে কার খাতির। আমার সাথে কার কার খাতির তার তালিকা তাদের হাতে প্রস্তুত আছে। আমাদের কেউ এই কাজটা করলেই ফেঁসে যাবে। বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ আমি কেন নিতে পারছি না, তা হয়তো তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের অবস্থা বস্তার ভেতর বন্দি সিংহের মতো। যে সিংহকে নিয়মিত বাইরে থেকে পিন মারা হচ্ছে, তবে তাদের কিছু করার নাই। রাজনীতির মাঠটা এরকমই।”

“তাহলে?”

“তোফায়েল-রেদোয়ান যখন গুলি খাবে, আমাদের সবাইকে শক্ত অ্যালিবাই রেডি রাখতে হবে। আমার মনে হয় আসছে সম্মেলনে এটা করা সম্ভব। ওখানে আমরা সবাই থাকবো। সিনিয়র নেতারা থাকবেন। ক্যামেরা থাকবে। অ্যালিবাইয়ের জন্য এরচেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।”

“সত্য, আপনাদের থাকবে পাথরের মতো শক্ত অ্যালিবাই। কিন্তু সেক্ষেত্রে তোফায়েলকে গুলি করছে কে?”

ভেলভেটের বাক্সটা বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে মুহিবের কাছে পাঠিয়ে দিলো জাকি, “তুমি। পিস্তলটা তোমার কথা ভেবেই কেনা হয়েছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *