অধ্যায় ৪১
বিকট শব্দে টেবিলের ওপর পিস্তলটা আছড়ে ফেললো তোফায়েল। এক থাবায় টেবিলের ওপর থেকে ফেলে দিলো দুটো মদের বোতল। প্রকাণ্ড এক লাথি বসিয়ে দিলো চেয়ার। হাল্কা-পাতলা সরকারি চেয়ার সেই লাথির প্রচণ্ডতা সহ্য করতে পারলো না। কিছুদূর গিয়ে গড়িয়ে পড়লো, গড়াতে গড়াতেই চলে গেলো ঘরের অন্য প্রান্তে।
“মাগির পরিচয়টা জানতে পারলে দুই মিনিটে নিকেশ করে দিতাম। হারামজাদি!” পিস্তলটা আবার তুলে নিয়ে উন্মাদের মতো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল সে।
রেদোয়ান দু-হাত পকেটে পুরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ক্ষেপে যাওয়ায় তার খ্যাতি তোফায়েলের চেয়ে বেশি। অথচ এখন তাকেই তুলনামূলক শান্ত মনে হচ্ছে। বিপদে পড়লে রেদোয়ানের মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
শান্ত গলাতেই জানতে চাইলো সে, “মেয়েটা তোকে আবারও ফোন করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আর তোর কাছে ঐ কার্ডটা চেয়েছে?”
মাথা নাড়লো তোফায়েল, “তারা বলতে চাইছে কার্ডটা তারা অবশেষে হাতে পেয়েছে।”
“যথারীতি তারা ঐ রাতে আমাদের বলা কোনো একটা লাইন শুরুতে বলেছে?”
“হ্যাঁ। তুই ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া নিয়ে একটা কিছু বলেছিলি, সেইটা। এই মেয়ে সে রাতে ওখানে ছিল না, আমি শতভাগ নিশ্চিত। তাকে কেউ ব্যবহার করছে।”
“এই মাত্র বললি সেখানে আমরা কি বলছি তা এই মেয়ে গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। আবার কি করে বলিস সে ওখানে ছিল না?”
“ওখানে কেউ ছিল। চারপাশ অন্ধকার থাকে, আমরা খেয়াল করিনি 1 কোনো মাদারচোত জঙ্গলে গিয়ে শুয়ে থাকবে ঐ হতচ্ছাড়া জায়গায় তা আমরা কি করে জানবো? কিন্তু যে হারামজাদা ওখানে ছিল সে কোনো মেয়ে না। আমাদের ক্যাম্পাসের কোনো ছেলে সে। এখন এই মেয়েকে ব্যবহার করে আমাদের থেকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছে হয়তো।”
“এই মেয়ে কি তার বান্ধবি?”
“হতে পারে। কি আসে যায়? আমার মনে হয় এই মেয়ে আমাদের ভার্সিটিরই না। তাকে গলা শুনে চেনার কোনো উপায় আমার নাই বলেই একে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
বুকপকেট থেকে একটা বেনসনের প্যাকেট বের করে ধরালো রেদোয়ান, “ফাইন। এখন আমরা তাহলে কি তাদের ফাঁকা থ্রেট খেতে থাকবো? নাকি পাল্টা ফাঁদ পাতবো?”
অন্ধকারে এক বিন্দু আলোর দেখা পেলে যেমন উৎসাহ নিয়ে মানুষ তাকায়, তেমনই দৃষ্টি বন্ধুর মুখে ফেললো তোফায়েল, “তুই ফাঁদ পাতবি কি করে?”
ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে রেদোয়ান শুধু বলল, “বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দে তুই।”
*
হঠাৎই কালো হয়ে এসেছে ঢাকার আকাশ। অলসভঙ্গিতে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা, যেন শহরটিকে ডুবিয়ে দিতে তাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এটা ঘটবেই, যেন তারাও জানে। সামান্য সময়ের ব্যবধান মাত্র, তারপর ডুববে শহর কোমর পানিতে সাঁতরাবে নগরবাসী। ছয় কিলোমিটার ধরে লেগে থাকবে টানা জ্যাম। সুভাসের এসইউভির ভেতর বসে দৃশ্যকল্পটার সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য শিয়া পরিস্কার দেখতে পেলো। ভাইয়ার সঙ্গে কি ঘটেছিলো তা সে অচিরেই জানতে পারবে, সময়ের ব্যাবধান মাত্ৰ।
কোকড়া চুলের পরচুলাটা ঠিকমতো শিয়ার মাথায় বসিয়ে দিলো সুভাষ আইল্যাশ ঠিকমতো বসালো। তারপর যত্নের সাথে দুই চোয়ালে লাগালো সিনথেটিক প্যাড। চোয়ালের হাড় সামান্য উঁচু মনে হচ্ছে এখন, রূপ বাড়লো বই কমলো না। চোখের নিচে নকল ট্যাটুটা পরিপাটি করে বসানোর পরই অন্য এক মেয়েতে পরিণত হলো শিয়া।
“সব কিছু বাই দ্য বুক করবে। দেখবে কি সহজ একটা কাজ এটা।” উষ্ণ হাসি সুভাষের মুখে, “নার্ভাস?”
“খানিকটা।” সুভাষ ছাড়া আর কেউ হলে মরে গেলেও স্বীকার করতো না
“স্বাভাবিক। এর আগে কখনও কারও প্রাণ নাওনি তুমি। সবকিছুরই প্রথম আছে।” ওর ঘাড়ের পেছনে হাত জড়িয়ে নরোম কিন্তু গভির চুম্বন উপহার দিলো সিনিয়র অনুশীলনী। প্রেমিকের বুকে বাম হাত ঠেকিয়ে তার সুগঠিত পেশি অনুভব করলো শিয়া। আড়ষ্টতা দূর হয়ে গেলো নিমেষেই।
গাড়ির দরজা খুলে যখন নেমে এসেছে, ওর হাত আর কাঁপছে না। মাথার ওপর কুচকুচে কালো আকাশ, ভর দুপুরেও মনে হচ্ছে সন্ধ্যার আলো। কারও প্রাণ হরণের জন্য একেবারে মানানসই আবহাওয়া। শিয়ার মনে হলো বাংলাদেশ তাকে ভালোবাসা জানাচ্ছে। এসো হে কন্যা, আমাকে আবর্জনামুক্ত করো। ভালোবাসায় সিক্ত করলাম তোমায়।
জ্যাকেটটা দু-হাতে চেপে ধরে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে। পনেরো ফিট উঁচু দেওয়াল। তার ফাঁকে বসিয়ে দেওয়া প্ৰধান ফটক। কারুকার্য দেখে মনে হবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রির বাসভবন থেকে খুলে আনা। ভেতরে প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স। মজার ব্যাপার হলো, এই বিলাসবহুল বসতবাড়ি কোনো প্রধানমন্ত্রির বাসভবন নয়। এটা স্বাধীন বাংলাদেশের একজন মন্ত্রির বাড়ি। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি চমৎকার এক সরকারি ফ্ল্যাট পান। প্রতিটি সংসদ সদস্যের জন্যই রয়েছে ফ্ল্যাটের বরাদ্দ।
ঐ ফ্ল্যাট তিনি ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে কড়কড়ে ষাট হাজার টাকা আদায় করেন। ভদ্রলোকের দয়ার শরীর, ঐ বিরাট ফ্ল্যাটের ভাড়া আশি হাজারের কম হওয়া উচিত নয়। তিনি কতোটাই না কমিয়ে রেখেছেন। সরকার কা মাল, দরিয়া মে ঢাল। তিনি দরিয়াতে মাল ঢালেননি, নগদ কিছু ভাড়ার বিনিময়ে জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছেন জনগণের সম্পদ। প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স থাকতে ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটে বাস করবে কোন গর্দভ?
পুঁজিবাদের ভয়াবহ থাবার প্রকৃষ্ট উদাহরণ!
জনগণের সম্পদ অপচয় করার জন্য এরকম আড়াইশ’ সংসদ সদস্যের নাম অনুশীলন সমিতির হাতে এসেছে। একজন একজন করে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি ভোগ করবে। এর একটা অংশ হতে পেরে শিয়া গর্ববোধ করছে। ঝলমলে মুখে প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়ালো সে।
ধারণার চেয়েও সহজ হলো কাজটা। দারোয়ান তাকে একটা প্ৰশ্ন পর্যন্ত করলো না। নোংরা আর তেলতেলে একটা হাসি মুখে নিয়ে দরজাটা খুলে দিলো সে। আজকে এসময় একজন এসকর্টের সঙ্গে মন্ত্রিমহোদয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এমনটা মন্ত্রিসাহেবের অন্যায় বলে দারোয়ান শামসু মিয়া মোটেও ভাবে না। ঘরের বউয়ের বয়স পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে গেলে অল্প বয়েসী মেয়েদের সঙ্গ যে কোনো পুরুষই প্রত্যাশা করতে পারে। ভদ্রলোকের যেহেতু টাকা আছে, আশা পূর্ণ করতে সমস্যা কোথায়?
আজকের মেয়েটাকে দেখে শামসু মিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো একেবারে টসটসে। এসকর্ট সার্ভিসগুলো ড্রেসআপে সচেতন, তাদের প্রোডাক্ট দেখা মাত্রই গা ঝিমঝিম করে উঠবে যে কোনো পুরুষের। মন্ত্রির জন্য আজেবাজে মেয়ে পাঠাবে এমন সাহস কোনো এসকর্ট সার্ভিসেরই নেই। বিশেষ করে যখন এই মন্ত্রির মদদেই অর্ধশতাধিক এসকর্ট সার্ভিস নির্বিঘ্নে শহরজুড়ে ব্যবসা চালাচ্ছে!
দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শিয়া। এই লোক তাকে মনে রাখবে। খুব ভালো ভাবেই মনে রাখবে। তবে পুলিশের কাছে যখন স্বীকারোক্তি দেবে তখন সে মনে করতে পারবে মেয়েটির মুখের উল্কির কথা, মনে করতে পারবে অদ্ভুত কটা চোখের কথা, মনে করতে পারবে সুন্দর উন্নত চোয়ালের কথা, আকর্ষণীয় কোকড়া চুলের কথা। কিন্তু এগুলো কোনোটাই শিয়ার শরীরের অংশ নয়।
“সোজা চইলা যান। গেট খুলা আছে।” দারোয়ান অভয়ের সুরে বলল।
এতোই সহজ তাহলে সব! কোনো চেকআপ নেই। অস্ত্র খোঁজার ব্যাপার নেই। মেটাল ডিটেক্টর নেই! থাকলেও সমস্যা হতো না, শিয়ার কাঁধের ব্যাগে চমৎকার সব কুঠুরি আছে। মেটাল ডিক্টেটর এটাকে আটকাবে ধাতব ডিজাইন করা হ্যান্ডেলের কারণে। তারপর গার্ড এটা খুলে দেখবে। টিপে দেখবে। সাপ্রেসরটাও খুঁজে পাবে না তারা, পাবে না পিস্তলের অন্যান্য যন্ত্রাংশ। ডেরিঞ্জারের পার্টস এতো ক্ষুদ্র করেই বানানো হয়! এদেশের অনেক সিকিউরিটি এতো ছোটো পিস্তলের জন্য চেকই করে না।
আলিশান বাড়িটায় ঢুকে পড়লো শিয়া। এদের ড্রইংরুমে অনায়াসে ক্রিকেট খেলা যাবে। সেখানেই পাওয়া গেলো খানসামাকে। যত্নের সাথে তাকে ‘সাহেবের’ বেডরুমে নিয়ে এলো সে। বিনয়ের সাথে জানালো, সাহেব এখন সংলগ্ন বাথরুমে। সাফ সুতরো হয়েই বেরুবেন তিনি। ততোক্ষণ বেডরুমে অপেক্ষা করতে পারবেন কি ‘ম্যাডাম’? কিছু কি লাগবে? ঠাণ্ডা, গরম?
তাকে খালি হাতেই ফেরত পাঠালো শিয়া। অ্যাটাচড বাথরুয়মের ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। বিশাল বিছানাটার আস্ত হাতি ঘুমাতে পারবে। একপাশে দেওয়ালের বদলে পুরোটাই জানালা। সৌভাগ্যের বিষয়, পুরো পাশটাই পর্দা টানা এই মুহূর্তে। বিছানার বরাবর সামনে স্টেডিয়ামের বিগ স্ক্রিনের সমান একটা টিভি। সিএনএন চলছে সেখানে, শব্দ নেই।
যে কোনো মিশনে হাসিমুখে শিকারের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার শারীরিক ও মানসিক ট্রেনিং আছে শিয়ার। অনুশীলন সমিতির ইন্সট্রাক্টর ফাইনাল সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে ‘ডেমো মিশন’-এ তাদের পাঠিয়েছেন। বাইরে জগতে সেসব ডেমো মিশন। আজকের মতোই, ড্রাইভ করে টার্গেটের বাড়িতে যাওয়া। টার্গেটের সঙ্গে বিভিন্ন পরিবেশে দেখা হওয়া। বিভিন্ন রকম ব্যবহার সেসব ডামি-টার্গেট করতো। মোট দশটি ডেমো-মিশনের সাতটিতেই ডামি–টার্গেটরা তাকে বিছানায় তুলেছে। চতুর্থবারের পরই অচেনা মানুষের সঙ্গে বিছানায় যাওয়া নিয়ে আর অস্বস্তিবোধ হয়নি ওর। এটা তেমন কোনো বড় ব্যাপার না এখন। এই ডামি-টার্গেটরা সবাই কমিউনিস্টি পার্টির লোক। তাদের দেওয়া চরিত্রে তারা রোল প্লে করেছে। প্রতিবারই সফলভাবে টার্গেটকে ‘হত্যা’ করেছে শিয়া। ক্যামেরায় আটকায়নি, সিকিউরিটি আটকাতে পারেনি। অতি অবশ্যই, ডেমো-মিশনে তার সঙ্গে আসল পিস্তলের বদলে থাকতো ডার্ট গান। ছুরিগুলোও আসল নয়, সেন্সর বসানো স্প্রিংয়ের ছুরি। ডেডলি হিট ডিটেক্ট করার জন্য ডামি-টার্গেটই যথেষ্ট। এরাও প্রকৃতপক্ষে অন্য শাখার ইন্সট্রাক্টর। তারাই মার্কিং করে থাকে, ফেল করলে বাদ।
অথচ বাস্তব জীবনের প্রথম মিশনটা মোটেও কঠিন হলো না শিয়ার জন্য। কোনো রকম তাড়াহুড়ো না করে বিছানায় বসে একটা একটা করে গোপন কুঠুরির ভেতর থেকে প্রতিটা পার্টস বের করে আনলো সে। তারপর সাপ্রেসরটা বসালো অস্ত্রের সামনে। ভ্যানিটি ব্যাগটা যত্ন করে বাম কাঁধে ঝুলিয়ে ডান হাতে পিস্তলটা তুলে নিলো তারপর, গুলিবর্ষণের জন্য সম্পুর্ণ প্রস্তুত অস্ত্রটা। খুব শান্ত পায়ে হেঁটে এসে অ্যাটাচড বাথের দরজা বরাবর বিছানায় বসে রইলো, যতোক্ষণ না ভেতরে পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হয়।
এর দশ মিনিটের মাথায় খুট করে দরজাটা খুলে যায়। পঞ্চাশোর্ধ্ব ফর্সামতো একজন মানুষ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে বাথরুম থেকে বেডরুমে ঢুকতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই একবার মাত্র গুলি করলো ও।
মন্ত্রি মহোদয় শিয়ার অস্ত্রটা দেখার সুযোগ পর্যন্ত পেলেন বলে মনে হলো না। যে গতিতে ভেতরে ঢুকছিলেন, তার দ্বিগুণ গতিতে বাথরুমের ভেতর ফিরে গেলেন তিনি। বুলেটটা ডান চোখের সামান্য ওপর দিয়ে ঢুকেছে, মস্তিষ্ক ভেদ করেছে নিঃসন্দেহে। মারা গেছেন তৎক্ষণাত।
নিজের শরীরের দিকে নজর দিলো শিয়া। এতোদূরে রক্তের স্প্রে আসেনি। বিশেষ কায়দায় ভ্যানিটিব্যাগের নিচের কুঠুরিতে পিস্তলটা ঢোকালো সে। এভাবে রাখা হলে ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকানোর প্রয়োজন পড়বে না; বাইরে থেকেই অস্ত্রটার বাট আর ট্রিগার ধরতে পারবে যখন ইচ্ছে। কাঁধের সঙ্গে ঝুলে থাকা ব্যাগের সঙ্গে রেডিমেড শুটিং উইপন-বুয়েটের এক ছাত্রের ডিজাইন, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এদেশে এমন কতো প্রতিভা আছে কে জানে! পুঁজিবাদের আমলে তাদের প্রতিভার কদর পাওয়ার সুযোগ সামান্য।
ড্রইং রুমের ফ্লাওয়ার ভাসগুলোর কাছে পাওয়া গেলো পরিচারক ছোকরাকে। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে একটা ব্রাশ দিয়ে ভাস পরিস্কার করছে সে। তার দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে থামলো শিয়া, আরেকবার ফায়ার করলো। সাপ্রেসরের কল্যাণে থুতু ফেলার মতো মৃদু একটা শব্দ হলো কেবল। তিনটা ভাসসহ ভেঙেচুড়ে পড়ে গেলো পরিচারকের দেহ। ঘাড়ের রগের সামান্য ওপর দিয়ে মাথায় ঢুকেছে বুলেট, শিরোশ্ছেদের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই ‘কজ অব ডেথের’। মৃত্যুপথযাত্রী লোকটা যা সামান্য শব্দ করছে তা আলিশান বাড়ি ভেদ করে বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা শুন্য। মেইন গেট থেকে বের হওয়ার আগে নবের লকটা লাগিয়ে দিলো ও, তারপর বাইরে থেকে টেনে লাগিয়ে দিলো দরজা। এটার ডুপ্লিকেট চাবি মিসেস মন্ত্রির কাছে আছে, তিনি পার্লার থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। অর্থাৎ ততোক্ষণে লাশগুলো কেউ আবিষ্কার করে বসবে এমন সম্ভাবনা নেই। সময়টা সেফ হাউজে ফিরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ভ্যানিটি ব্যাগের নিচ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছে শিয়া। প্রয়োজনে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ড্র করতে পারবে অবশ্য। তড়িৎগতি নিশ্চিত করার আগে কাউকে অনুশীলন সমিতির ডেমো-মিশনে পাঠানো হয় না। বাস্তব মিশন দূরে থাকুক!
দারোয়ান তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। এতো দ্রুত বের হয় না সাধারণত এসকর্ট মেয়েগুলো। তার দৃষ্টি হাস্যোজ্জ্বল মুখেই ফিরিয়ে দিলো শিয়া। ঢলে পড়া সুরে বলল, “মিসাস চলে আসছেন। আজকে আর হলো না।”
কি ‘হলো’ না তা ভেবেই দারোয়ানের মুখে কুৎসিত একটা হাসি ফুটে উঠলো। শিয়ার ইচ্ছে করছে এই ব্যাটাকেও একটা গুলি করে দেয়। তবে এটা করা যাবে না। নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কোনো ‘আউট ইন দ্য ওপেন টার্গেট’কে ‘এনগেজ’ করা চলবে না। এই দারোয়ান ব্যাটা ‘আউট ইন দ্য ওপেন টার্গেট’।
রাজকীয় প্রধান ফটক টপকে বেরিয়ে পাশের রোদে পার্ক করে রাখা ভুয়া নাম্বারপ্লেট বসানো সুভাষের আসল এসইউভির কাছে পৌছে লক্ষ্য করলো ঢাউস জ্যাকেটটা পরে ড্রাইভিং সিটের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। ঐ জ্যাকেটের নিচে আজ যা যা সে নিয়ে এসেছে তা দিয়ে গোটা গুলশান দখল করে ফেলা চলে। শিয়ার ব্যাকআপের এক হাত এরই মধ্যে দরজার হাতলে চলে গেছে। তার উদ্দেশ্যে আলতো করে একবার মাথা দোলালো ও, অর্থ : কাজ শেষ।
যান্ত্রিক দক্ষতায় দু’জন দু’পাশ থেকে গাড়িতে উঠে বসলো। মসৃণ গতিতে গাড়িটা ছেড়ে দিলো সুভাষ, যেন কোনো তাড়াহুড়া নেই। কিছুই ঘটেনি এখানে। বিশ মিনিট পর একটা সিগন্যালে আটকে গেলো ওদের গাড়ি। ততোক্ষণে শিয়া তার নিজস্ব চেহারা ফিরে পেয়েছে। মেকআপের সব উপকরণ একটা প্লাস্টিক ব্যাগে প্রস্তুত, সেফ হাউজের চুলোয় পুড়ে মরার জন্য। বাতিটা সবুজ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে দু’জনে, প্রথমবারের মতো কথা বলল সুভাষ।
“ইউ ডিড গুড। দারুণ একজন অ্যাসাসিন হতে যাচ্ছো তুমি। আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ। বাংলাদেশ তোমাকে নিয়ে গর্ব করবে একদিন, আমি নিশ্চিত।”
জবাবে গিয়ার লিভারের ওপর দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে এলো শিয়া। আলতো করে চুমু খেলো প্রেমিকের ঠোঁটে, “আই লাভ ইউ, সুভাষ।”