1 of 2

কুকুরদল – ৩৬

অধ্যায় ৩৬

ভাইস চ্যান্সেলরের রুমের সামনে এখনও তীব্র জটলা। ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। বাইরে, প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় বসে থাকা মানুষের সংখ্যা একরাতে বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে ভেতরের খবর বাতাসের আগে আগে এসে বাইরে পৌছেছে সেজন্যই এতো ভিড়-বাট্টা। গুজব শোনা যাচ্ছে ভিসি স্যার বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেলেছেন, অর্থাৎ খুব দ্রুতই ছাত্রছাত্রিদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। সিগনেচার করা কাগজের কপি নিয়েই আজ তারা হলে ফিরতে পারবে।

খানিক দূরে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে তোফায়েল। গতকালের হ্যাঙওভার এখনও কাটানো যায়নি। একটা সিগারেট ধরিয়ে দূর থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে সে। প্রশাসনিক ভবনের সামনে এখন প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রি। এতো ছেলেমেয়েকে সংগঠনের মিছিলে পাওয়া যাবে না তা স্বাভাবিক। এর দশ ভাগের একভাগও জুটলে কাজ হতো।

অবস্থা আজকে উল্টোরকম হতে পারতো। হলে সিটের অ্যালোট নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর নীতি-আদর্শ টেনে না আনলে এধরণের আন্দোলনের ফলাফল শিক্ষকদের অনুকূলেই যেতো। এই তিন হাজার ছাত্রছাত্রির স্লোগান থামিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিটা তোফায়েলের ভালোমতোই জানা আছে। কিছু টাকা পয়সা আর বিরানির প্যাকেট আদায় করা লাগতো ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে। তারপর শটগান আর পিস্তল নিয়ে জুনিয়র ক্যাডারগুলোকে একটা মাইক্রোতে করে পাঠিয়ে দিলেই তারা জিনিসটা দেখতো। সেই সাথে হকি স্টিক। হকি স্টিক অবশ্যই লাগতো।

এখনও কাজটা করতে কোনো আপত্তি নেই তোফায়েলের। বাইকে বসে ভাইস চ্যান্সেলরের একটা ফোনকলের অপেক্ষায় আছে সে। উপাধ্যক্ষকে ক্ষমা প্রার্থনা করে একবার বলতে হবে, হলের কাগজপত্রের ঝামেলা তিনি মিটিয়ে দেবেন। এখন এই ‘অসহযোগ’ আন্দোলন যেন সে প্রশমিত করে। বাংলা ভাষার নানাবিধ ব্যবহারে এই উপাধ্যক্ষের সুনাম আছে।

এমন একটা ফোন পেলে আধাঘণ্টার মধ্যেই মাইক্রো নিয়ে আসতে পারবে সে। লক্ষীপাড়ায় মাইক্রো রেডি আছে। একটা ফোন করলেই চলে আসবে। শটগান শফিও বাজারে রেডি। পাত্তিসহ ওকে তুলে নিয়ে সোজা ক্যাম্পাসে চলে আসতে মাইক্রোর লাগবে বিশ মিনিট। অ্যাকশনে লাগবে আধঘণ্টা। ঝামেলা কিভাবে সরাতে হয় তা এদের ভালো জানা আছে।

তোফায়েলের মনে হচ্ছে কাঙ্খিত ফোনকলটা আজ আসবে না। এই ভাইস চ্যান্সেলর সততা আর নীতির বুলিগুলোকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেন। পঁয়ত্রিশ ক্রেডিটের আইডিয়াটাও অসৎ আর অনৈতিক, তবে নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষভাবে নীতিভ্রষ্ট যে শিক্ষকগণ ছিলেন তারা ভাইস চ্যান্সেলরকে উল্টোটা বুঝিয়েছেন। যখন পঁয়ত্রিশ ক্রেডিট সিস্টেম সেশন জট তথা ভবিষ্যৎ হল অ্যালোকেশনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারবে বলে দেখানো হয়েছে, তিনি এটা মেনে নিয়েছেন। হয়তো এক ঢিলে দুই পাখি মারতেই সাইন করেছিলেন এর পক্ষে। হলের সিট দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেলে একশ ভাগ অ্যালোকেশন দিতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনীতির মাঠে হল নিয়ে আর খেলা করা যাবে না। যখন পলিটিকাল ছেলেও হল পায়, নন-পলিটিকাল ছেলেও পায় তখন তা নিয়ে বারগেইন করা যায় না। চাহিদাশুন্য হলে ক্রেতার সংখ্যাও হবে শুন্য। পঁয়ত্রিশ ক্রেডিটের পক্ষে থাকার পেছনে তোফায়েলের রাজনৈতিক অবস্থানটা সরল অঙ্কের মতোই সরল।

ভিড়ের মধ্যে ঝলমলে একমাথা চুল দেখা যাচ্ছে। সকালের সূর্য আলো ছড়াচ্ছে ইলোরার চুলে। মেয়েটি অবশ্য সেই সূর্য উপভোগ করছে না, একটা ছেলের কাঁধে মাথা রেখে পরম নির্ভরতায় ঘুমাচ্ছে। ছেলেটার দিকে নজর গেলো এবার তোফায়েলের। একে সে চেনে, এর বন্ধুই এখন ঢাকায় বারডেমে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। ছেলেটার নাম সম্ভবত মুহিব। একদিন সিগারেট টানতে গিয়ে ধরা পড়েছিলো, আর দুই একদিন ইলোরার আশেপাশে তাকে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। কখনও ভালোমতো এর সাথে আলাপ হয়নি।

তোফায়েল লক্ষ্য করলো তার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে। মুহিব ধীরে ধীরে ইলোরার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই ছেলেটা কি জানে না তোফায়েল ইলোরার সঙ্গে আছে? ক্যাম্পাসের অনেকেই তোফায়েলের নাম শুনলে প্যান্টের ভেতর পেশাব করে ফেলে। এই ছেলে ইলোরার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে কি প্রমাণ করতে চায়?

হ্যাঙওভারের মাথাব্যথাটা এতোক্ষণ মৃদু দপ দপ করছিলো, আচমকাই তা যেন বহুগুণে বেড়ে গেলো। তোফায়েল নিজেকে চেনে, এই যন্ত্রণা শারীরিক নয়। হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে গেলে তার এমন বোধ হয়। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলো সে, বানচোত ভিসি মনে হচ্ছে ফোন করবে না। জায়গাটা ছেড়ে যাওয়া দরকার। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে তিন হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে একটা সিন ক্রিয়েট করে ফেলতে পারে।

বাইক ঘোরানোর সময় তোফায়েল লক্ষ্য করলো যত্নের সাথে ইলোরার এক গালে হাত ধরে রেখেছে মুহিব। হারামজাদার সুন্দর মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না! দাঁতে দাঁত চেপে বাইক টান দিলো তোফায়েল।

লিটুর চাচাতো ভাই বাদল এখন বারডেমের সামনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন। তার সামনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুটো অল্পবয়েসী ছেলে। এরা লিটুর সঙ্গে একসাথে কলেজে পড়েছিলো। নড়াইলের অজপাড়া গাঁয়ের কলেজ। লিটুদের ব্যাচটা ভালো ছিল। এখন তার কলেজের যে দুই বন্ধু বারডেমের সামনে অপেক্ষা করছে, তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অপরজন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এদের জন্যই বুকে অনেকটা সাহস পাচ্ছে বাদল। সে নিজেও ঢাবিতে মাস্টার্স করছে। ভাগ্যিস ঢাকাতে থাকা হয়েছিলো। লিটুর বাবা এখানে নিয়মিত থাকতে পারেননি।

বাদল অবশ্য প্রকৃত কারণটা জানে। ব্যস্ততার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে খরচের ধাক্কা। তার এই চাচাটির পরিবার বেশ বড়। বর্তমান সময়ে এমনটা বড় দেখা যায় না। বাদলের এমন বড় পরিবারের আইডিয়া পছন্দের না, তবে আত্মীয় তো

“মিঠুন, আরেকবার দ্যাখ না।” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল বাদল।

মোবাইলে আরেকবার ব্যালেন্স চেক করলো শীর্ণকায় ছেলেটা, মুখ উজ্জ্বল হলো তার, “টাকা চলে এসেছে। ব্যাংকে আমার সাথে একজন আসলে ভালো হয়।”

বাদল এগিয়ে গেলো তার সঙ্গে। টাকা সারা দেশে তোলা হচ্ছে। যেখানে যেই মানুষটা ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার কাছেই সাধারণত দুই–তিনদিনের টাকা তোলা থাকে। দরকার বুঝে তারা মিঠুনের অ্যাকাউন্টে টাকাটা পাঠায়। সেখান থেকে হাসপাতালের বিল ইত্যাদি পরিশোধ করে দেয় সে। মিঠুন যথেষ্টরও বেশি করছে। লিটু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে ঠিকমতো একটা রাতও ঘুমিয়েছে কি না সন্দেহ। এর মধ্যে একবার নড়াইলে গিয়ে লিটুর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করেও এসেছে। তাদের আপডেট জানিয়ে এসেছে।

আশায় বুক বাঁধলো বাদল। এখানে একজন মিঠুন তো কেবল নয়, লিটুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারখানেক মতো ছেলেমেয়ে তার জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ একটাকা দিলেও তা সংগ্রহ করছে পরম মমতাভরে। কেউ যখন তাদের সঙ্গে ভিখিরির মতো দুর্ব্যবহার করছে তাও হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে। এরা সবাই নিজেদের রক্তবিন্দুর শেষটা দিয়ে চেষ্টা করছে কাজটা বের করে আনার। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি একটা নিয়ে যেন আন্দোলনও চলছে, এসবের মাঝেও এই ছেলেগুলো রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে লিটুর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। আজকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পেইনে দুই লাখ টাকা তোলা হচ্ছে তো কাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিন ভালোবাসি বাংলাদেশ নামক প্রোগ্রামে গুরু এফতেখার কেবল ওদের নিয়েই একটা শো করলেন। লিটুর মা সেখানে ছিল, চাচী কান্নার দমকে যদিও কথাই বলতে পারেননি। ঐ শো-তে সারা দেশ থেকে অসংখ্য ফোন এসেছিলো। সবাই ছেলেটার জন্য প্রার্থনা করেছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, চিকিৎসায় অর্থসাহায্য করেছে। ছেলেটাকে এতো ভালোবাসা এরা দিচ্ছে সব কি বিফলে যাবে? সৃষ্টিকর্তা তো ওপরে আছেন।

চোখের পানি আড়াল করে ব্যাংকে ঢুকে পড়লো বাদল। মিঠুন এর মধ্যে কাউন্টারে পৌঁছে গেছে।

*

ছাত্রদের মধ্যে একজন প্রশাসনিক ভবন কাঁপিয়ে ভাষণ দিচ্ছে। প্রথমে এই ভাষণ দেওয়ার অধিকার কেবল মাত্র আন্দোলন সংগঠকদের ছিল। আসাদ কিংবা জাহিদের গলা শোনা যাচ্ছিলো তখন। এখন মাইক হয়ে গেছে সার্বজনীন একটা বিষয়। যার তার হাতে দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে একটু বামঘেঁষা ছেলে অনিকের হাতে মাইক দেখা যায়। তার জেল দেওয়া চুলে সুর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। গলার রগ ফুলিয়ে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে সে–

“স্বাধীন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চেতনা আজ এখানে কেঁদে ফিরছে। আপনারা সবই দেখেন ভাইসকল, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ … তাদের আমি অসম্মান করবো না কিন্তু তারা তবলা-লীগী ছাত্রদের বাড়তি সুবিধা দেন তা তো আপনারা সবাই জানেন। নতুন কিছু বলার নাই কিন্তু ভাই আপনাদের। ল্যাবে, থিসিসে, অ্যাটেন্ডেন্সে ঐ লেবাসের ছেলে হইলেই সাত খুন কিন্তু মাফ ভাই। দেরি করে আসলেও সমস্যা নাই। ভাইভাতে মুখ থেকে শব্দ বের না হলেও সমস্যা নাই। নাম্বার একেবারে বিশে আঠারো! অথচ হিন্দু আর লো সিজিপিএ থাকলে তো জীবন শেষ। এই কোন দেশ ভাই? একাত্তরের চেতনা—”

অনিকের গলার রগ ধীরে ধীরে ফুলছে। এই ছেলে ইতিহাস না টেনে কথা বলে না। এখন একাত্তরে আছে, একটু পর সাতচল্লিশে নেমে যাবে। শ্রোতামণ্ডলীর যদি সৌভাগ্য থাকে বক্সারের যুদ্ধে গিয়ে থামতে পারে।

এই ভাষণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে ছাত্রছাত্রিদের জাগিয়ে রাখতে। অনেকেই এখানে ওখানে ঘুমিয়ে পড়ছে। সাতদিন ব্যপি আন্দোলনে একবারের বেশি ঘুম কেউ পায়নি। ভাষণের মাইক সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে আরেকটি গূঢ় রহস্য আছে। যার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে সে চাইলে গিয়ে মাইকে কথা বলতে পারে। আন্দোলন প্রায় সফল, এখন ভাইস চ্যান্সেলর আর মিডিয়া যেন বের হয়ে এসে না দেখে সবাই ঘুমিয়ে একাকার।

মিডিয়ার কেউ কেউ এখনও এখানে উপস্থিত। দিনের পর দিন আন্দোলন দেখতে দেখতে তারাও সম্ভবত ক্লান্ত। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ছেড়ে তারা এখন সাধারণ ছাত্রদের সামনে মাইক্রোফোন ধরছে।

এমন একজন চোখের পাতা না কাঁপিয়ে বলে গেলো, “না। রাস্তা তো ছাড়বো না। ভিসিকে বের হতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আগে আমাদের লিখিত দেওয়া হবে, সাইন ছাড়া এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়া হবে না।

“যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোনো আন্দোলন করতে এখানে আসেনি, যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করতে এসেছে। দাবি এখন দফা থেকে সরাসরি মাটির ওপর।

অপর একজন ছাত্রি চামচিকের মতো গলায় শক্তভাবে নিজের মতামত দিয়ে যাচ্ছে, “খাতায় আমরা ঠিক লিখবো, তো নাম্বার দেবে। ভুল লিখলে শুন্য দেবে। এমনটাই তো নিয়ম। তাই কি না? তাহলে তারা কি করে রোল নম্বর ধরে একজনের সঠিক উত্তরকে কেটে শুন্য দেয়? শিক্ষকরা এমন দুর্নীতি করলে আমরা তাদের কাছ থেকে কি শিখবো?”

সাংবাদিকরা বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থিদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো চেষ্টা অবশ্যই করছে না। তারা যত্নের সঙ্গে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করে যাচ্ছে। টিআরপি বেড়ে গেছে রাতারাতি। যতো হাঙ্গামা, ততোই আনন্দ তাদের

প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশপথের সামনে এখনও শুকনো রক্ত দিয়ে লিখিত আছে “পঁয়ত্রিশ”। ছাত্র-ছাত্রির রক্তে লেখা এই রাস্তার অংশটুকু কয়েকজন পাহারা দিয়ে রাখছে যেন কোনো রিকশা বা মোটরসাইকেল এর ওপর দিয়ে চলে না যায়। অনেক ছাত্রছাত্রি সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে রাস্তায় লিখেছে। রক্ত দিয়ে দুইজনের মুখে ফেনা উঠে গেছিলো। তাদের ছায়াময় এক অংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এতো ভাষণেও ইলোরার ঘুম ভাঙছে না। মেয়েটার বালিশ হতে প্রথম প্রথম মুহিবের ভালোই লাগছিলো, সুন্দরি এক মেয়ের বালিশ হতে খারাপ লাগার কথা না কোনো অবিবাহিত একলা যুবকের। কিন্তু ঘন্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর কাঁধটা টনটন করছে। এই মেয়ে তো দেখা যায় দিনে দিনে ভুটকি হচ্ছে। তোফায়েল তাকে কি খাওয়ায় কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতেই ইলোরা কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে অ্যাড-বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তাতে শুয়ে পড়লো। চারপাশে প্রচুর মানুষ, এর মধ্যে হাত পা ছড়ানোর সুযোগ নেই। মুহিব সুযোগটা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পারলো না। ওর উরুকে মেয়েটি নতুন বালিশ হিসেবে বেছে নিয়েছে।

তোফায়েলের ব্যাপারে ইলোরাকে অন্ধকারে রাখতে মুহিবের খুব ভালো লাগে এমন না। তবে কাজটা করতে হতো। অনেক সময় দেখা যায় বিজ্ঞ কোনো চরিত্র হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোয় খুব গম্ভির মুখে এমন সব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়, “তোমাকে নিরাপদে রাখার জন্যই আমি এটা গোপন রেখেছিলাম!” টু প্রটেক্ট ইউ এর গুরুত্ব মুহিব আজকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ঘটনা এখন অনেকটাই প্যাঁচ খেয়ে আছে, সেই সঙ্গে দৃশ্যপটে যুক্ত হয়েছে একজন প্রতিশোধপরায়ণ বোন।

মঞ্চের কাছে ছাত্রদের বড় একটা অংশ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। অনিক একাত্তরের পর বায়ান্নোতে ঢুকে পড়েছে। সবার রক্ত উত্তরোত্তর গরম হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ তুলে অনিক যে উদাহরণগুলো দিচ্ছে তার · সাথে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ভাগ্যকে ছাত্রদের অনেকেই সম্পর্কিত করতে পারছে। তারা শিক্ষক সম্প্রদায়ের হাতে যেসব অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে সব স্মৃতিভেদ করে উঁকি দিচ্ছে। ফলাফল হিসেবে রণহুঙ্কার বেরিয়ে পড়া স্বাভাবিক। আর কিছুক্ষণ মাইক ধরে রাখলে ওই লেফটিস্ট ছেলেটা এদের হয়তো আক্রমণাত্মক কোনো এক কাজ করিয়ে ফেলাতে পারবে। দাবি আদায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া অসংখ্য মুষ্ঠিবদ্ধ হাত কোনো উপকারে আসতে পারে না।

উদ্ভূত পরিস্থিতির সবগুলো সম্ভাবনা যাচাই করলো মুহিব। জাকিদের ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা শামসকে এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে জাকি নিজেই। এখানে তোফায়েল–রেদোয়ান হয়তো একটা মনস্তাত্বিক খেলা খেলেছে। খেলাটায় তারা জয়ী হয়েছে সন্দেহ নেই। নির্ঝরকে তোফায়েল তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তার সব দুশ্চিন্তা ছিল নির্ঝরের জন্য, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন একজন বন্ধু শামসের বিপদটা কেউ খেয়াল করেনি। তাছাড়া যখন মেমরি কার্ডের কথা উঠেছে, জাকি বোকার মতো নিশ্চিত করেছে সে এব্যাপারে কিছুই জানে না। মেমরি কার্ডে কি ছিল তা মুহিবের জানা নেই। তবে তোফায়েলের চায়নি সেটা আর কেউ দেখুক। কার্ডের কন্টেন্ট যে জাকি দেখেনি তা বোঝার জন্য তোফায়েলের মতো কূটকৌশলে দক্ষ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মুহিবের মতো সাধারণ শিক্ষার্থিও বুঝে ফেলতে পারতো।

মেমরি কার্ডের ভেতরে কি আছে? কোটি টাকার প্রশ্ন। তোফায়েল বাহিনি একজন মানুষকে মেরে ফেলেছে এই কার্ডের জন্য। কন্টেন্টের মূল্য ছিল একজন মানুষের জীবন। কেন?

মুহিব ধারণা করতে পারে, ওতে তাদের নিজেদের পর্নোগ্রাফি থাকবে। শিয়া গতকাল চমৎকার তদন্ত করেছে। একজন পতিতাকে ভাড়া করে তোফায়েল রেদোয়ানের রুটিন আর অভ্যাস জানার চেষ্টাটা দারুণভাবে কাজে এসেছে। জানা গেছে তোফায়েল আর রেদোয়ান বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে তাদের যৌনজীবনও ভাগাভাগি করে নেয়। এবং একটি মেয়েকে নিয়ে এই কাজ করার সময় তাদের মোবাইলের ক্যামেরাও অন করা থাকে। এধরণের অসংখ্য ক্লিপ তাদের সংগ্রহে থাকার কথা। সম্ভবত কোনো অনলাইন ক্লাউড স্টোরেজে তাদের সংরক্ষণ করা হয়। শত শত ভিডিও তো মোবাইল ফোনে রাখা যায় না।

স্রেফ নিজের যৌনতার ভিডিওর জন্য কেউ কাউকে খুন করে ফেলে না। যৌনতার ভিডিও প্রকাশ পেয়ে যাওয়া ২০১৮তে একটা সাধারণ ঘটনা। ভিডিওচিত্র ধারণ করলে তা ফাঁস হবেই। এতে করে আজকের বাংলাদেশে কেউ ছোটো হয়ে যায় না। তাও একটা কথা থেকে যায়, সামাজিক চোখ রাঙানির ভয়ের চেয়ে বেশি ভয় থাকতে পারে সংগঠনের চোখ রাঙানির। তোফায়েল-রেদোয়ানের যৌনতার দৃশ্য অনলাইনে আপলোড হয়ে গেলে তাকে নিশ্চয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি বানানো হবে না?

তবে এধরণের আপলোড দুর্ঘটনা ঠেকানোর অনেক পথ আছে। সেজন্য মানুষ হত্যার দরকার পড়ে না। একজন মানুষকে হত্যা করে ফেলাটা সহজ, তবে তার পর যে পরিণতি অপেক্ষা করে তার মুখোমুখি হওয়াটা সহজ নয়। জটিলতা থাকবেই, সব রাজনীতিবিদই চেষ্টা করেন খুন-গুম এড়িয়ে চলতে। শিশু রাজনীতিবিদ হিসেবে তোফায়েল কেন সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করলো না?

না, ব্যক্তিগত যৌনতা ছাড়াও আরও ব্যাপার আছে। এমন কোনো তথ্য যা গোপন রাখতে আর কারও গলা কাটতে হয়। মুহিব জানে এরপর তাকে কি করতে হবে। শামসের কাছে থাকা মেমরি কার্ডটা খুঁজে বের করতে হবে। তাকে জানতে হবে ঠিক কোন তথ্যটা গোপন রাখার জন্য প্রাণ দিতে হলো শিয়ার একমাত্র বড়ভাইকে।

দোতলায় ভিসির কামরার দিক থেকে নতুন একটা হট্টগোল শোনা গেলো। ভিসি স্যার নতুন একটা শার্ট দাবি করেছেন, সেই শার্টের যোগাড় যন্ত্র করতে হবে। অর্থাৎ এই ভদ্রলোক ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। ছাত্রদের দাবি তিনি মানবেন না, দরকার হলে বমিমাখা শার্ট পাল্টাবেন বরং!

ইলোরার চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে দিলো মুহিব। এখানে আজ আরও অনেকক্ষণ থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *