অধ্যায় ৩৪
দুটো চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছে মুহিব আর শামীমকে। এখনও ওদের পেছনে, সামান্য বাম দিকে ভীমদর্শন পিস্তলটা নিয়ে বসে আছে জাকির ডান অথবা বাম হাত মঞ্জুর। ডান কিংবা বাম যেটাই হোক না কেন, তার দু-হাত যে নির্ঝর আর মঞ্জুর এটা ক্যাম্পাসের সবার জানা। নির্ঝর-মঞ্জুরের কড়িৎকর্ম কাজের কথা অজানা নেই কারও। ছাত্র হিসেবে তারাই প্রথমে এরকম একটা বড় কাজ নিজেরাই করে দেখিয়েছিলো। বোমা হামলা ট্র্যাক করা, তারপর ফাঁদ পেতে রাঘব বোয়ালসহ তাদের ধরে ফেলা এটা কেবল ছাত্রনেতার জন্য নয়, যে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রেই “আপ অ্যাভাব ইয়োর পে–গ্রেড” ধরণের কাজ। এদের হাতে বন্দি হতে পেরে কারও বুকই ‘সুখের উচ্ছ্বাসে’ ভরে ওঠার কথা নয়।
মুহিব বলল, “শিয়া আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
জাকির মুখের কঠোরভাব এতে করে নরোম হলো না, “তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন?”
“শামসভাইয়ের মার্ডারারদের খুঁজে বের করতে।” সত্য কথা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখলো না মুহিব।
“মার্ডারারদের?”
“আমরা জানি সেখানে চার বা পাঁচজন খুনি ছিল।” নিষ্কম্প কণ্ঠে জানাও শামীম।”এটা নিয়ে আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই তদন্ত করছি।”
“শামসের মার্ডার নিয়ে তোমরা কি জানো?”
শামীম এর উত্তরেও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। তার দিকে একবার তাকিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলো মুহিব। সরাসরি জাকির দিকে তাকালো সে, “শামসভাইয়ের মার্ডার নিয়ে আমরা কি জানি তা আপনাকে বলবো কেন? মাথার পেছনে বন্ধুকে দিয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে ভাবছেন যা জানতে চাইবেন গড় গড় করে বলে দেবো?”
জুনিয়র একটা ছেলের এমন তেজ দেখে জাকি উত্তেজিত হলো না। শান্তভাবে ফোনটা টেনে নিয়ে নির্দিষ্ট একটা নাম্বারে ডায়াল করলো।
“নির্ঝর, শামসের বোনের রুমে যা। হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই। পরবর্তি নির্দেশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত ওখান থেকে বের হবি না।” টেবিলের ওপর ফোনটা নামিয়ে রাখলো সে, “আমার সাথে খোলামেলা আলোচনা করলেই তোমাদের জন্য ভালো হবে। আমাকে শত্রুপক্ষের লোক ভাবার কোনো কারণ নাই। তোমরা যদি উইটনেস পেয়ে থাকো, তবে এটা নিশ্চিত করেই জানো আমার গ্রুপের কেউ ঐ মার্ডারের সাথে জড়িত ছিল না। একটু খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবে শামস আমাদেরই ক্লোজ ফ্রেন্ড। লিটু যেমন তোমাদের বন্ধু, তার জন্য জান দিচ্ছো তোমরা। আমরাও শামসের জন্য এমনটাই করতাম।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। শামসভাইয়ের বোনের ঘরে নিজের লোক পাঠাচ্ছেন। বাজি ধরে বলতে পারি নির্ঝর ভাইয়ের কাছেও আছে আরেকটা পিস্তল। শিয়ার মাথায় ওটা ঠেকিয়ে আমাদের পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করবেন। তাই কি না?”
দু-হাত উল্টে দেখলো জাকি। আচার আচরণে হতাশার ছাপ সুস্পষ্ট। যেন সামনে বসে থাকা দু’জন বেয়াড়া জুনিয়র তাকে যারপরনাই হতাশ করছে।
“তোমরা আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না। এটা আমি স্বাভাবিকভাবেই নেবো। আমার পেছনে কেউ গুপ্তচর লাগিয়ে অজান্তে ছবি তোলার পর আমি ও তাকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। তবে শিয়ার কোনো ক্ষতি নির্ঝর করবে না। অতি অবশ্যই আমি আমার মৃত বন্ধুর ছোটো বোনের মাথায় পিস্তল ধরতে বলবো না। ওকে তেমনটা বললেও কাজ হতো না। নির্ঝর গান ক্যারি করে না।”
কিন্তু শিয়া করে; মনে মনে বলল মুহিব। এসব জাকির জানার দরকার নেই।
“কিন্তু ইদানিং তোমরা যা শুরু করেছো, তারপর তোমাদের গতিবিধি নজরে না এনে আর উপায় থাকে কি? যেখানে সেখানে শামসের মার্ডার নিয়ে কথা বলতেছো মিয়ারা। এটা কেমন সেন্সিটিভ একটা ব্যাপার সে ব্যাপারে তোমাদের কোনো ধারণা আছে?”
ঠোঁট ওল্টালো মুহিব, “সেন্সিটিভ কাদের জন্য? আপনার জন্য যে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করাটা সমস্যার, তা তো বুঝতে পারছি। শামসভাইয়ের মার্ডারের সাথে আপনার সংযোগ আছে।”
দড়াম করে টেবিলের ওপর একটা কিল বসিয়ে দিলো জাকি। এলোমেলো চুলের ভেতর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখটা জ্বল জ্বল করছে অনুভূতির তীব্রতায়।
“শাট আপ!”
“মার্ডারের খানিক আগে আপনাকে তোফায়েল–রেদোয়ান যে পিটিয়ে
আধমরা করে ফেলেছিলো তা আমাদের জানা আছে। পুরো ব্যাপারটাই কি
কাকতাল মনে করবো? আপনাকে তোফায়েল পিটিয়ে একসা করে দিলো, ঐদিকে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড শামসকে সেই তোফায়েল-রেদোয়ানই খুন করে ফেললো একই সময়। আমাদের কি এতোটাই গাধা মনে হয়?”
একটা হাত তুললো জাকি, “তোমরা কি করে জানো কাজটা ওরাই করেছে?”
চুপ করে থাকলো মুহিব। প্রথমদিকের মতো সেই রাতের স্মৃতি তাকে অসহায়ত্ব আর অপরাধবোধে ভাসিয়ে তোলে না। ঐ স্মৃতির সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট পরিণত হয়েছে আজকের মুহিব।
“দেখো, তোমাদের আজকে এখানে ডেকে এনেছি তার পেছনের কারণটা কি মনে হয়? তোমাদের মাথায় গুলি করে লাশ দুটো গুম করে ফেলা?” জাকিকে এবার সত্যই ভীষণ বিরক্ত মনে হচ্ছে। একটু পেছনে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো সে, “মঞ্জুর, পাত্তিটা দে তো।”
পাত্তিধারী মঞ্জুর গুরু-স্ল্যাশ-বন্ধুর নির্দেশ নিমেষেই পালন করলো। পিস্তলটা নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিলো জাকি। শামীমের হাত থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে রইলো হাতলটা। টেবিলে ‘পাত্তি স্থাপন’ শেষে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলো জাকি।
“হয়েছে? এখানে কেউ কাউকে গুলি করছে না। কিন্তু আমাদের খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তোমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে একই কাজ আমিও করতে পারি। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাদের ব্যাপারে আমিই বেশি জানি। তোমরাই বরং আমার ব্যাপারে তেমন কিছু জানো না। অর্থাৎ জানাশোনার দরকার আমার চেয়ে তোমাদেরই বেশি।”
শামীম মুহিবের দিকে অসহায়ের মতো একবার তাকালো। সে জানে জাকি ভাই একেবারে ভুল কিছু বলেননি। তাছাড়া শিয়া নিজের বাসায় মুহিবের সঙ্গে প্রথম দেখার দিন বলেছিলো সে জাকি ভাইকে চেনে। শামসের বন্ধু হিসেবে জাকির নাম এক নাম্বারে রেখেছিলো সে। লোকটা অবশ্যই বিপজ্জনক, তবে তাকে ঠিক শত্রুপক্ষের লোক বলা যায় না।
মুহিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জাকির চোখের দিকে। দীর্ঘ দশটা সেকেন্ড পর অবশেষে স্বীকার করলো সে, “ওখানে আমি ছিলাম। শামসভাইকে যেখানে রেদোয়ান গলা কাটে তার মাত্র সাত ফিট দূরে শুয়ে ছিলাম আমি।”
মঞ্জুর পাত্তি-সমর্পণ করে নিজের খাটে চলে গেছিলো। মুহিবের মুখ থেকে বাক্য দুটো বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিংয়ের মতো ছুটে জাকির বিছানায় চলে এলো সে।
“হোয়াট?”
আলতো করে মাথা দোলালো মুহিব, “ঠিকই শুনছেন। শামসভাইয়ের মার্ডারে একজন উইটনেস ছিল। সেই উইটনেস আমি নিজেই।”
“শিট!” পিঠ সোজা হয়ে গেছে জাকির, “তোমরা আমার কাছে আগে কেন আসো নাই?”
“আপনি কি তাদের আদালতে নিয়ে যেতে পারতেন? আমরা তেমনটা মনে করিনি। সেজন্য কাউকে জানাইনি ব্যাপারটা।”
“আদালতের বাইরেও অনেক বিচার করার জায়গা আছে পৃথিবীতে।” দায়সারাভাবে উত্তর দিলো জাকি। লম্বা চুলগুলোকে চেপে কপালের ওপর টেনে নিয়ে গেলো সে। একটা ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিলো।”আরও আগে জানতে পারলে…”
“আদালতের বাইরের বিচার করার জায়গাগুলোয় বিষয়টা তুলে দিতে আমরা চাইনি। আমরা চাই আদালতের নিষ্পত্তি। তা না হলে আমি সবখানে বলে বেড়াবো আমি কিছু জানি না। আমি কিচ্ছু দেখিনি।”
একটা সিগারেট ধরানোর বিরতি নিলো জাকি। তার প্যাকেট থেকে আরেকটা বের করে নিলো মঞ্জুর। ওদের হজম ক্ষমতার চেয়ে বেশি তথ্য দেওয়া হয়েছে। খানিক সময় তারা চাইতে পারে। এটাতে দূষনীয় কিছু নেই।
মুহিব জানতে চাইলো, “এখন ব্যাপারটা আপনিও জানেন। রাখঢাকের দরকার নেই আর, তাই না? তোফায়েলকে এখন কোথায় পাওয়া যেতে পারে?”
“রাত হইছে না? পইড়া আছে কোনো বারে।” মঞ্জুর প্রথমবারের মতো মুখ খুললো, “মাউরারটায় খুব সম্ভব। মাগি-টাগি লাগাইতেছে।”
“মাউরার বারে কি মাগি অ্যাভেইলেবল?” ফস করে জানতে চাইলো শামীম।
“সেইটা না। কিন্তু ঐখানে মেয়েছেলেও তো ড্রিংক করতে আসে। মাদারচোতগুলা তাদের থেকেই তুইলা নেয় কাওরে।”
আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো শামীম। মঞ্জুরের বাজখাঁই গলা ঘর কাঁপিয়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে, “তুমি আবার কই যাও মিয়া?”
গলা খাঁকারি দিলো শামীম, “পিস্তল-ফিস্তল দেখলে সমস্যা হয় ভাই। হাল্কা মুতে আসি।”
এর ওপর আপত্তি চলে না। শামীমের ‘মুততে’ যাওয়া দেখলো মুহিব। কোনো সন্দেহ নেই তার ফোনকল পাওয়ার পর পরই মাউরা ইউসুফের বারে ছুটবে শিয়া। তাও ভালো। অন্তত মাগিপাড়ায় তো ঢুকতে যাচ্ছে না।
“যাই হোক। আমরা প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি।” মনে করিয়ে দিলো জাকি, “আমার সাথে কথা না বলে তোমরা এরপর থেকে তোফায়েলের সাথে দেখা করার চেষ্টা কইরো না। ঠিক আছে? হারামজাদা দেখি ভালোই ডেঞ্জারাস।”
“খুনটা করেছিলো রেদোয়ান। তোফায়েল তার পাশে ছিল। করতে বলছিলো কাজটা। তবে সে করেনি। করেছে রেদোয়ান।” ধীরে ধীরে সেরাতে যা দেখেছিলো সবটাই খুলে বলল মুহিব। জাকি আর মঞ্জুরের চাহনি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো। শামসের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা যে স্রেফ গালগল্প ছিল না তাতে বিশ্বাস ফিরে এলো মুহিবের। মেয়েদের ক্ষেত্রে বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশের মাধ্যম হতে পারে চোখের পানি, কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে এমন শোকই আশা করা যেতে পারে যেমনটা ওদের মুখে ফুটে উঠেছে। জাকির চোখের তারায় জ্বলছে প্রতিশোধের অনন্ত আগুন, সেই সঙ্গে আত্মগ্লানির ছাপও কি রয়ে গেছে? মুহিব নিশ্চিত হতে পারলো না।
শামীম ফিরে এসেছে। মুহিবের পাশে বসার সময় খুবই আলতো করে একবার মাথা দোলালো। অর্থাৎ, কাজ হয়ে গেছে।
“তাইলে তুমি কইতেছো কামটা করছে রেদোয়ান, তাই না?” আঞ্চলিক ভাষা বের হয়ে এলো জাকির মুখ থেকে।”ওকে। ওকে। ওরে ওর পাওনা আমি বুঝায়া দিমুনে।
“তার আগে, প্লিজ আপনার গল্পটা খোলাসা করেন। আমার দিকে যা ছিল আপনাকে বলেছি। এবার আপনার পালা।”
“কোন ঘটনা?”
শামীম নড়ে উঠলো এবার। মুহিবের “ওয়াইল্ড হাঞ্চ” ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত সে। একটুও গলা না কাঁপিয়ে বলে গেলো, যেন এগুলো সে ফ্যাক্ট হিসেবে জানে, “আপনি কোনো এক তথ্য ফাঁস করেন তোফায়েলের কাছে। আপনাকে আমরা দোষ দেই না। আপনাকে নির্যাতন করে তারা বের করে নেয় তথ্যটা। আর ঐটার ভিত্তিতেই শামসভাইকে ডেকে এনে খুন করে তারা।
অস্বস্তিকর এক নীরবতা নেমে এলো ঘরের ভেতর। যে সুরে শামীম কথা বলেছে তা সরাসরি অভিযুক্ত করাই বলা যায়। একজন সিনিয়র ভাই এবং একজন সক্রিয় ছাত্রনেতাকে উদ্দেশ্য করে এমন সুরে কথা বলা যায় না। সৌভাগ্যক্রমে জাকি কিংবা মঞ্জুর বেয়াদবী ইস্যু টানলো না। তাদের মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করলো মুহিব। অন্ধকারে যায় না দেখা ভালো। জাকিকে দেখে মনে হচ্ছে সে দোটানায় আছে।
তাকে উৎসাহ দিতেই বলল মুহিব, “আমার মনে হয়, এখানে আপনার হারানোর কিছু নাই। আমাদের সমস্যা তোফায়েলের সঙ্গে। আপনার নাম কোথাও আসবে না। তবে আপনার ভার্সনটা আমাদের জানা দরকার।”
“ঠিক আছে। আমি তোমাদের কিছু ভুল ধারণা ভাঙ্গিয়ে দেবো।” অবশেষে মুখ খুললো জাকি।”আমি ওদের হাতে খালি মাইর খাইয়া যাই এমনটা সত্য না। তোমাদের কি মনে আছে, ক্যাফেটেরিয়ায় একবার আমাকে তোফায়েল কোপাইছিলো? তারপর আমরা প্রতিশোধ নেইনি বলে ক্যাম্পাসে আমাদের অনেকেই মেরুদণ্ডহীন মনে করে?”
মাথা দোলালো মুহিব-শামীম। প্রথমে ওরা একবার মার খেয়েছিলো, এটা ক্যাম্পাসের অনেকের সামনেই ঘটে। এরপর ওরা দ্বিতীয়বার মার খায়, শামসভাইয়ের মার্ডারের আগে আগে। দ্বিতীয় ঘটনাটার কথা অবশ্য সবাই জানে না। ভুতবাবার মাধ্যমে ওরা জানতে পেরেছিলো সেবার। সাধারণ ছাত্ররা মনে করে জাকি গ্রুপ মেরুদণ্ডহীন। ওদের ভাষায় “ধ্বজ” বা ধ্বজভঙ্গ।
“যেটা কেউ জানে না-একদিন আমি, নির্ঝর আর মঞ্জুর প্রতিশোধটা ঠিক ঠিক নিয়েছিলাম।” জাকিকে দেখে মনে হলো নিজের ওপর হওয়া আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ায় সে যারপরনাই লজ্জিত। সিগারেটটা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। মুহিবের দিকে ক্যাম্পাসের বড়ভাইসুলভ ভঙ্গিতে সেটা বাড়িয়ে দিলেন। মুহিব বড় ভাই থেকে সিগারেট নিয়ে টানতে থাকলো। জাকি ভাই বলে যাচ্ছেন, “আমি অন্য কাউকে দিয়ে নিজের প্রতিশোধ নেওয়ার মতো মানুষ না। আসলে আমি প্রতিশোধেই বিশ্বাস করি না। ফার্স্ট ইয়ারের ঘটনার প্রতিশোধ না নিয়ে যখন থার্ড ইয়ার পর্যন্ত উঠে গেলাম, এটা আমাদের মধ্যে আর আসবে বলে আমি ভাবি নাই। কিন্তু ঐদিন ডিপার্টমেন্টের এন্ট্রান্স ডের অর্গানাইজে অ্যান্টিপার্টির সরোজ আমাকে দুইটা কথা শোনালো। বুঝোই তো, ইনসাল্টিং আলাপ। সরোজ হারামজাদা দুইদিন আগেও বিরোধীদলের হোল চুষে বেড়াতো। দলবদল করে তোফায়েলের তলায় আশ্রয় নিয়েছে। তার কথাগুলা আমার গায়ে খুব লাগছিলো।”
“আসলে, ঐটাও সমস্যা না। জাকির মাথা বরাবর খুব ঠাণ্ডা।” বন্ধুকে সাপোর্ট দিতে মঞ্জুর বলল, “ঐ রাতে আমরা ছয়টা বোতল নিয়া বসছিলাম। সেইখানেই ঝামেলাটা লাইগা গেলো। প্রত্যেকে দুই বোতল সাবড়াইছি, সাথে বারোটা স্টিক। পুরা বেহেড।”
“তো, বেহেড হয়ে আমরা বের হলাম। খানকির পোলার সাহস কতো, আমাদের অপমান করে! তোফায়েলরে মাইরাই ফালামু এরকমটা ঠিক কইরা বাইর হইছিলাম। নির্ঝরের গাড়িটা নিলাম। মাদারচোত যে মাউরা ইউসুফের বারে গিয়া মাগি-টাগি লাগায় সেইটা পার্টির সবাই জানে। শালার ফেরার পথে গাড়ি নিয়ে অ্যাম্বুশ করে বসে আছি। বোতল তখনও চলতেছে, কিন্তু আমরা অ্যাকশনে নামলে মাথা একেবারে সাফ হইয়া যায়।”
মুহিব-শামীম তাদের অ্যাকশনের কাহিনী চুপচাপ শুনতে থাকে। জাকি ভাইয়ের সিগারেটের প্যাকেট থেকেই আরেকটা সিগারেট বের করে নেয় ওরা। মঞ্জুর-জাকি দেখেও দেখলো না তা। তারা সে রাতের ধারাবিবরণী দিতে ব্যস্ত।
নির্ঝর আগেই অ্যামবুশ-স্থলের পাশে দোতলা বাড়ির ছাদে তার বাইনোকুলার নিয়ে উঠে পড়েছিলো। এধরণের কাজ ওরা অনেকদিন ধরেই করে আসছে, কাজ ভাগাভাগিতে সমস্যা হয়নি। তোফায়েলের আগমন সংবাদ প্রচার করবে ছাদের মাথায় বায়নোকুলার হাতে দাঁড়ানো নির্ঝর। নিচে ড্রাইভিং সিটে ছিল মঞ্জুর। সে ক্লাইম্যাক্স ঘটাবে। তারপর বাকিটা করবে পাইপ রেঞ্চ হাতে গাড়ির বাইরে রাস্তার পাশে ছায়ায় অপেক্ষা করা জাকি। প্রতিশোধটা সে নিজেই নেবে।
সময়মতো তোফায়েলের বাইক দেখা যায়। যথারীতি গতিসীমার তোয়াক্কা না করে বাইক ছোটাচ্ছিলো সে। মঞ্জুর গাড়িটা সময় মিলিয়ে ছাড়ে, বিপরীত দিক থেকে ছুটে গিয়ে মুখোমুখী সংঘর্ষের ব্যবস্থাটা করে দেয়। গাড়ির গতি খুব বেশি তোলেনি সে, আড়াআড়ি বের করে বাঁধিয়ে দেওয়া কেবল। তবে তোফায়েলের জন্য কাল হলো তার মোটরসাইকেলের ভীমগতি। সামনের বনেটে বাইকটা সজোরে বাড়ি খেয়ে এপাড়েই রয়ে গেলো, তবে আরোহীর অবস্থানের পরিবর্তন এতো সামান্য হলো না।
বনেটের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে গাড়ির অপরপ্রান্তের শক্ত রাস্তায় আছড়ে পড়েছিলো তোফায়েল। কি ঘটেছে বোঝার চেষ্টা করছে তখনও, আড়াল ছেড়ে বের হয়ে এসেছিলো জাকি। পাইপ রেঞ্চ দিয়ে মাত্র দুইবার বাড়ি মেরেছিলো তার মাথায়। ওখানেই শুইয়ে ফেলেছিলো চিরশত্রুকে। মরণ আঘাত হানতে রেঞ্চটা যখন মাথার ওপর তুলে ধরেছিলো সে, শত্রুর কপালের ক্ষতটা থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পিচঢালা পথে পড়ছিলো। লাইটপোস্টের আলোয় সেই দৃশ্য দেখে থমকে গেছিলো জাকি। নেশা টুটে গেছিলো তার। তৃতীয় আঘাতটা আর না করে রেঞ্চ নামিয়ে এনেছিলো। একেবারে মেরে ফেলার মতো ক্ষতি তোফায়েল করেনি।
ততোক্ষণে ওপর থেকে নেমে এসেছে নির্ঝর। গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেছে মঞ্জুর। তোফায়েলের পড়ে থাকা শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে জাকি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো কি ভুলটাই না সে করে ফেলেছে!
কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই মাতাল অবস্থায় নিজদলের একজন ছাত্রনেতাকে আক্রমণ করে বসেছে। এর পর কি করবে তাও তারা ঠিক করে আসেনি। রাস্তার মাঝে পড়ে আছে একটা মোটরসাইকেল আর একটা দেহ। মাথায় ক্ষতটা একেবারে আমলে না নেওয়ার মতো নয়। জাকির মাথায় প্রথম যে সমাধানটা এলো তা হলো : ঘটনাটাকে ছিনতাইয়ের মতো করে দেখাতে হবে।
দ্রুততার সাথে তোফায়েলকে মানিব্যাগ আর মোবাইলের ওজন থেকে মুক্তি দিয়ে নির্ঝরের গাড়িতে উঠে এসেছিলো সে। প্রথমেই ওরা খেয়াল করেছিলো মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নির্ঝরের গাড়ির সামনের অবস্থা বর্ণনার অযোগ্য। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে কেউ গদা দিয়ে এই গাড়ির বনেটে আঘাত করেছে। নির্ঝর এলাকার লোকাল, নিজের বাড়ির গ্যারেজেই গাড়িটা আপাতত পার্ক করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সেখান থেকে অটো ধরে হলে ফিরে আসে মঞ্জুর আর জাকি।
হলে ঢোকার পর নিজেদের চিন্তা-ভাবনা আরও সুস্থির হয়ে আসে। তখনই কেবল জাকি খেয়াল করে এখনও তার পকেটে তোফায়েলের মোবাইল ফোন আর মানিব্যাগ। মোবাইলটা রাস্তার সঙ্গে তার দেহের সংঘর্ষেই বন্ধ হয়ে গেছিলো। ডিসপ্লেটা ফেটে একাকার। মানিব্যাগে বেশি টাকা ছিল না। তোফায়েলের সুনাম আছে শেষ কপর্দকটা পর্যন্ত খরচ করে মদ গেলার
দুটো সিম কার্ড, একটা মেমরি কার্ড, একটা ব্যাটারি আর এক কেসিং। সব আলাদা করে করে খুলেছিলো ওরা। তারপর সিম কার্ডজোড়া আর ডিভাইসটা তুলে দিয়েছিলো মঞ্জুরের হাতে। জাকি বলেছিলো, এগুলো কাল সকালেই নদীর মাঝে ফেলে আসতে হবে। প্যাকেটে অবশ্যই পাথর বাঁধতে হবে। তবে মেমরি কার্ড আর ব্যাটারির ব্যাপারটা আলাদা। এগুলো আনট্রেসেবল। এদের কি করা যায় তা পরে ভেবে দেখা যাবে।
ঘরের চতুর্থ রুমমেট শামস তখন নিজের খাটে বসে একটা বই পড়ছিলো। ওখান থেকে সে বলে ওঠে, “মেমরি কার্ড এক্সট্রা থাকলে একটা দে না, ভাই। অনেকদিন ধরে মেমরি কার্ড ছাড়া ফোন চালাইতেছি।”
*
চুপচাপ হয়ে গেলো ঘরটা। নতুন একটা সিগারেট বের করলো জাকি। তারপর আবারও বলল, “ঠিক এইটাই সে বলেছিলো। আমার কানে এখনও বাজে কথাটা। ঐ একটা কথা থেকেই তো সবকিছুর শুরু। ‘মেমরি কার্ড এক্সট্রা থাকলে একটা দে না, ভাই।” এতো জান্তব এখনও বাক্যটা।”
“তাহলে আপনারা তোফায়েলের ফোনের মেমরি কার্ড আপনাদেরই নন–পলিটিকাল রুমমেট শামসভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ।”
তোফায়েল কিভাবে বুঝলো কাজটা আপনাদের?”
মঞ্জুর এই প্রশ্নের উত্তর দিলো, “হালায় তো আর পিউর বোকাচোদা না। হালার মাথায়ও ঘিলু-টিলু আছে। এই এলাকায় তারে সবাই চেনে। হুটহাট ছিনতাই করার মতো ঘটনা ঘটাবে এমন বুকের পাটা কারও থাকার কথা না। তাছাড়া আমরা তখন ছিলাম পুরা মাতাল। আমাদের মাথাতেও এইসব ফাঁক ফোকড় ধরা পড়ে নাই। পড়ছিলো পরদিন সকালে। তখন এইসব ভাইবা তো আর লাভ ছিল না।”
প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছে আলোচনা। প্রমাদ গুণলো মুহিব, “যেটা বলছিলেন, তোফায়েল কি করে বুঝলো আপনারাই সেখানে ছিলেন?”
“সে হাসপাতালে ছিল সাতদিন। সবাইরে কইয়া বেড়াইলো বাইক অ্যাকসিডেন্ট। মানে, প্রতিশোধ সে গোপনে নিতে চাইতেছিলো। লোক জানাইলে তো আর আমাদের ক্ষতি করতে পারতো না। কপালে স্টিচ পড়ছিলো শালার। তারপরও দাগটা থাইকা গেছিলো, পুরাপুরি যায় নাই। এখনও তাকাইলে দেখতে পাইবা।” মুহিব-শামীম দু’জনেরই মনে পড়লো প্রথম আড্ডার দিন যখন মোটরসাইকেল নিয়ে তোফায়েল আসে তার চোখের পাশে সেই কাটাদাগ তারাও দেখেছিলো। ভুত দেখতে যাওয়ার আলোচনায় তারা মগ্ন ছিল তখন। ইলোরাকে বাইকে তোলার জন্য দৃষ্টিকটু পর্যায়ের তোড়জোর করেছিলো সে।”হাসপাতাল থেইকা বাইর হইয়া সে গিয়া হাজির হইলো নির্ঝরের বাসায়। আমার মনে হয় মাদারচোত এইসব নিয়া ভালোই ভাইবা রাখছিলো। নির্ঝরের বাসা পর্যন্ত তো আর উঠতে হয় নাই। তার কাম হইয়া গেছে।”
“গ্যারাজেই দেখতে পেলো চকচকে নতুন বনেট লাগানো এক পুরাতন বডির গাড়িতে।”
“হ!” বিমর্ষ মুখে বলল মঞ্জুর, “আমরা ভুল করছি আসলে। অনেকগুলা ভুল কইরা ফালাইছি।”
“তারপর ঘটনা কোনদিকে গেলো?”
সিগারেটের অবশেষটা এবার শামীমের হাতে তুলে দিলো জাকি, “আমরা একটা কিছুর জন্য রেডি ছিলাম। অথচ শুয়োরের বাচ্চা কিছুই করলো না। এক দেড় মাস পার হইয়া গেছে, আমরা এইসব প্রায় ভুইলাই গেছি-ঢিল মাইরা দিলাম। আর সেই ফাঁকে হারামজাদা নির্ঝরকে উঠায় নিয়া গেলো। যেহেতু গাড়ি ওর, তারেই নিবে এটাই স্বাভাবিক। ওরে মারপিট করে নাই। পিছন থেকে ধরছে। ক্লোরোফর্ম দিয়া অজ্ঞান করে ধইরা নিয়া কোন এক বাড়ির ভেতর আটকায় রাখছিলো, চোখ বন্ধ করা। সে তোফায়েল বা আর কারও বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারতো না। সে কাউকে দেখেই নাই। শোনেও নাই কারও গলা। কাজটা মাদারচোত খুব ভালো মতোই করেছিলো।”
নড়ে উঠলো মুহিব। কাহিনী দেখা যায় ভালোই প্যাঁচ খেয়ে গেছিলো। যে দলটা তোফায়েলকে আক্রমণ করেছে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে তাদেরই একজনকে দুর্ধর্ষ ছাত্রনেতা তুলে নিয়ে গেলো! তোফায়েলকে তার নিষ্ঠুরতার জন্য যতোই ঘৃণা করুক, লোকটার কূটবুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না সে।
“তারপর আমার সাথে দেখা করতে ফোন দিয়া ডাকলো হারামজাদা।” হাত তুলে দুর্বোধ্য একটা ভঙ্গি করলো জাকি, “এইদিকে আমরা কয়দিন ধরে নির্ঝরকে পাই না। সব খুঁজে একাকার করে ফেলসি। শালার পুতের ফোন পাইয়াই বুঝলাম নির্ঝর তোফায়েলের কাছে আছে। নগদে গেছি গা তার কাছে। যাওয়ার পর পরই একজন আমার মাথায় পাত্তি ধরলো।”
“তোফায়েলের ঘরে?”
“হ্যাঁ। সরোজ মাদারচোদের কথা মনে আছে?”
“জি ভাই।”
“ওই শালা আমার মাথায় মেশিন ঠেকাইছে। আমি তো পুরা ফ্রিজ। তোফায়েল তখন বলল, বন্ধুরে ফিরায় নিয়ে যেতে হলে তার থেকে যা যা সরাইছি তা ফেরত দেওয়া লাগবে। তার জিনিস আমি নিয়েছি, আমার জিনিস সে নিছে। এটা নাকি পুরাপুরি এক বিনিময় প্রথা।”
আরেকটা সিগারেট ধরালো জাকি। চুপচাপ কিছুক্ষণ ধূমপান করলো ঘরের সবাই।
“তো, আমি তারে কইলাম, জিনিসপত্র যা ছিল সব পদ্মার তলে। জবাবে খানকির পোলা কইলো তাইলে নির্ঝররেও পদ্মার তলে পাঠায়া দেওয়া যাক। আমি এইটা নিয়ে তার সাথে বার্গেইন করি নাই। কারণ নির্ঝরের নাম কেন্দ্রের তালিকায় আছে। তারে নিয়া বাড়াবাড়ি করলে তোফায়েল সব সাপোর্ট হারায় ফেলবে। মুখে যাই বলুক, ওরে পদ্মার তলায় সে পাঠাইতে পারতো না।”
“কিন্তু পরে আপনি শামসের ব্যাপারে বললেন।” ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মুহিব।
“তা না। আমি তার কথার জবাব যখন দিতেছিলাম না তখন তোফায়েল কইলো মোবাইল আর সিম যে নাই সে সেইটা বুঝে। কিন্তু মেমরি কার্ডটা যেন আমি ফেরত দেই। তখনই আমি বুঝলাম কাহিনী খারাপ হইয়া গেছে। যেই মুহূর্তে মাদারচোত মেমরি কার্ডের কথা মুখে নিছিলো তখনই বিষয়টা বুইঝা ফালাইছি আমি।”
“বিষয়টা রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরাতন নাম জাকি বুঝে ফেললেও শামীম বুঝতে পারেনি। তাই জানতে চাইলো, “কি সেটা?”
“তোফায়েলের জন্য ঘাপলা হবে এমন কিছু শামস ঐ কার্ডে খুঁইজা পাইছে। আর সেইটা বোকাচোদা শামস আমাদের না জিগায়া কেন্দ্রীয় কমিটির কার সাথে যেন আলাপ করার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টা করতেছিলো ছাত্র সংগঠন থেকে তোফায়েলকে নিষিদ্ধ করানোর। তাইলে মাদারচোতের আর পাওয়ার থাকে না। সেইজন্যই কার্ড যে একটা বাইরে ঘুরতেছে সেটা তোফায়েল জাইনা ফেলছে। শামস বোকাচোদাটা যদি কার্ডটা ফরম্যাট কইরা নিজের ফোনে ঢুকায়া চালাইতে থাকতো, এসব কিছুই হইতো না। নির্ঝরকে
ওরা ধরতো না, শামস টার্গেটের মধ্যে গিয়া পড়তো না। শালা…
“আপনাকে সেইটা কি বলেছিলো তোফায়েল? মানে, কিভাবে সে জানলো এটা?”
“না, কিন্তু এইটা বোঝা তো কঠিন কোনো কাজ না। রাজনীতির মাঠে খবর এমনেই বাইপাস করে। যাই হোক আমি ওকে বললাম, কার্ড তো নাই। সে বলল কার্ড থাকবে কি করে, ওইটা তো রুমমেটকে ধরায় দিসি। আমার মাথায় তখনও পিস্তল, নাহলে শালারে আমি দেখায় দিতাম ওই কার্ড ওর কোন দিক দিয়া ঢুকানোর ক্ষমতা রাখি।”
“সে কি বলেছিলো যে শামসভাইয়ের কাছে জিনিসটা আছে তা জানে?”
“হ্যাঁ। শেষটায় সে জানতে চাইলো, ‘শামস কি আর কাওরে দিসে কার্ডটা?’ আমি বললাম শামসের সাথে এই ঘটনার কোনো সংযোগ নাই।” জাকিকে খুব অসহায় দেখাতে থাকে।
“তারপর?”
“তারপর সে আমার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বলল, এখন শামসকে সে একটা ফোন করবে। লাউডস্পিকারে। আমাকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘শামস দোস্ত, তোর কাছে কি মেমরি কার্ডটা এখনও আছে?’ এতোটুকুই। শামসের কাছে কার্ড না থাকলে সে তো আকাশ থেকে পড়বেই। আর কার্ড থাকলে সে হ্যাঁ বা না উত্তর দেবে। তখন স্পষ্টই বোঝা যাবে শামস জড়িত কি না।”
“শিট।”
“আমি ফোন করতে রাজি হই নাই। আমার তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক ফোনে। লক খুলতেই রাজি হই নাই আমি। তখন রেদোয়ান এক পাশ থেকে লোহার একটা কি দিয়া জানি মাথায় মারলো। ঐ খানেই জ্ঞান হারায় ফেলি—”
মঞ্জুর বাঁধা দিলো এখানে। মুহিব আর শামীমকে ইশারা করে বলল, “তোমরা দুইটা এই জায়গাটা ভালো মতো শুনো। এইটা নিয়া তোমাদের অভিযোগ ছিল, মনে আছে না? জাকির মাথায় কাটা দাগ কোত্থেইক্কা আইলো? ঐ হলো তোমাগো কাটাদাগের উৎস।”
মাথা দোলালো মুহিব, তাকে অনুসরণ করলো শামীমও। ছিন্নসূত্রগুলো জোড়া লাগতে শুরু করেছে।
“যাই হোক,” আবারও প্রসঙ্গে ফিরে এলো জাকি, “জ্ঞান আমার ফিরে পদ্মার চরে। তখন সকাল, চারপাশে কেউ নাই। আমি একলা পইড়া আছি। মাথার সবখানে রক্ত। বাম চোখ রক্তে ঢাইকা গেছিলো। খুলতে পারি না। পরে পকেট হাতড়াইলাম, পকেটে আমার ফোন। মানিব্যাগও অক্ষত আছে। ফোন বাইর কইরা দেখি বন্ধ করা। প্রথমে ভাবছিলাম চার্জ নাই। তারপর অন কইরা দেখি সত্তর পার্সেন্ট চার্জ। মানে মাদারচোতগুলা আমার ফোন বন্ধ কইরা পকেটে রাইখা দিছে যেন আমি জ্ঞান ফেরার পর ফোনে চার্জ পাই।”
“ক্যান?” বিরতি সহ্য করার মতো অবস্থাতেই নেই গল্প। দ্রুত বলার দাবিটা জানালো শামীম।
“কারণ, আমার মোবাইল ফোন থেকেই ওরা সেরাতে শামসকে মেসেজ দিয়েছিলো। বলেছিলো মেমরি কার্ডটা নিয়ে যেন মেশিন শপের পেছনে দেখা করে। একা। আমার ফোনে চার্জ নাই তাই টেক্সট করছি এসব হাবিজাবি। ফোন অন দেখে খটকা লাগে আমারও, মেসেজ অপশনে গিয়েই দেখলাম আমার মেসেজ। এই মেসেজ তো আমি পাঠাই নাই ওকে। দেখলাম রিপ্লাইও দিয়েছে শামস। ‘আসতেছি দোস্ত।” ঐটাই আমার সাথে শামসের শেষ যোগাযোগ। অন্তত আমার মোবাইলের সাথে শামসের।” খুব জোরে সিগারেটে টান দিলো জাকি। মোবাইল বের করে স্ক্রল করলো কিছুক্ষণ। তারপর বাড়িয়ে দিলো মুহিবের দিকে।”পরে মঞ্জুরকে ফোন দিয়া শুনলাম শামসের বডি পাওয়া গেছে। নির্ঝরকেও ছাইড়া দিছে ওরা।”
মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখলো ওরা দুইজন।
জাকির মেসেজ, (যেটা আসলে পাঠিয়েছে তোফায়েল), “মেমরি কার্ডটা নিয়া মেশিন শপের পিছে চইলা আয়। একটা ঝামেলা হইছে। আমার ফোনে চার্জ নাই। কল দিতে পারতেছি না। কাউকে জানাইস না।”
শামসের মেসেজ, “আসতেছি দোস্ত।”
আরও এক স্বল্পদৈর্ঘ্য নীরবতা নেমে এলো ঘরের মধ্যে।
মাথা দোলালো মুহিব, “বুঝতে পেরেছি, কেন আপনি এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাটি করতে পারেন নাই। বেশি ঘাঁটাঘাটি করা হলে দেখা যেতো মেশিন শপের কাছে বডি পাওয়া শামসভাইকে আপনিই ওখানে ডেকে নিয়ে গেছেন। বন্ধুর হাতে বন্ধুহত্যা। আপনি এটা কাউকে বলতেও পারতেন না।”
“না পারি নাই।”
“মাথায় কাটা দাগ নিয়ে ঘোরা ফেরা করার ঝুঁকিও নিতে পারলেন না। লোকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করতো। শামসভাই ছিলেন আপনারই রুমমেট। সবার নজর তখন আপনার দিকে।”
“ঐসময় জাকি ঘর থেকে দিনের বেলায় বাইরও হইতো না।” মঞ্জুর বলল, “আমাদের সাথেও কম আলাপ করার চেষ্টা করে নাই অন্যরা। পোলাপাইন আমাদের অবশ্য ধ্বজ ভাবে। অনেকে ভাইবাই নিছে শামসের ঘটনার পর আমরা ভয়ে খিঁচ খাইয়া গেছি। আসলে আমাদের সমস্যা হইলো হাত পা বাঁধা। জাকিকে ওরা ফাঁসায়া দিছে অলরেডি।”
মঞ্জুর ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করলো তাদের হাত-পা কিভাবে বাঁধা। একই সংগঠনের ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে বিনা প্রমাণে খুনের অভিযোগ তোলা যায় না। আর এক্ষেত্রে জাকির কাছে প্রমাণ তো নেই-ই, বরং পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তার ফোনের মেসেজ লগ চেক করলে জাকির বিরুদ্ধেই প্রমাণ পেয়ে যাবে। পুলিশ অতো গভিরে নিজে থেকে যায়নি, কারণ পেছনে তোফায়েল গ্রুপ কলকাঠি নেড়ে রেখেছে। আলোচনা শুরু হলে তারা এটা ঘাঁটবে, কাজেই এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করা যাবে না। প্রকাশ্যে তদন্ত করতে গেলে ফেঁসে যাবে জাকি নিজেই।
দ্বিতীয়তঃ তোফায়েল আর রেদোয়ান হাই প্রোফাইল। তাদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা যাবে না। অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে তখন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক কিছুই করা যায় না। খুনের পেছনে জাকির হাত থেকে থাকলে তা খুঁজে বের করে ফেলবে কেন্দ্রীয় কমিটি। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আবার দুর্ঘটনায় তোফায়েল-রেদোয়ানের মৃত্যু সাজানোর উপায়ও এখানে নেই। বেপরোয়া বাইক চালানো ছাড়া তোফায়েলের উইকপয়েন্ট ছিল না। সেই মার খাওয়ার ঘটনার পর থেকে সে হেলমেট ব্যবহার করে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু সাজানো কঠিন। এমনকি মদটাও কেনে মাউরা ইউসুফের থেকে। বিষপ্রয়োগের সম্ভাবনা বাদ। তাদের ধারেকাছে একাকি ঘেঁষার সম্ভাবনা শুন্য।
জাকি গ্রুপ যতোই চাক, পরিস্থিতির কারণে তারা তোফায়েল বা রেদোয়ানকে ফুলের টোকাটাও দিতে পারবে না। দিতে হলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে হবে। জেল থেকে ফাঁসি নিশ্চিত করে কেউ বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ নিতে যায় না। এই কাজ করতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়, নিজেকে নিরাপদ রেখে। সাপ মেরে লাঠি অক্ষত রাখাই যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষের লক্ষ্য হবে।
“তোমরা এখন কি করতে চাইতেছো?” মঞ্জুর জানতে চাইলো, তুলনামূলকভাবে নরোম হয়ে এসেছে তার গলা।
“আমরা তোফায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি। অ্যানোনিমাস কল ইত্যাদি। দেখি তার থেকে কোনো ভুল বের করা যায় কি না। চাপের মুখে মানুষ দুর্বল হয়ে যায়। সে এর মধ্যেই স্বীকার করেছে খুনটা তারা করেছে।”
“কি কও!” মঞ্জুর বিস্মিত হলো।
“ঠিক স্বীকার করেনি।” নিজেকে শুধরে নিলো মুহিব, “আমরা টাকা দাবি করার মতো একটা ভঙ্গি করেছিলাম। সে জানতে চেয়েছিলো কতো চাই আমরা। অর্থাৎ সে অস্বীকার না করে টাকা দিতে রাজি হয়েছে। কাজটা সে করেছে এটাই তো প্রমাণ। তবে আদালতে টিকবে না।”
জাকি চুপ থাকলো। কিছু একটা বিবেচনা করছে যেন।
“তোমরা যে এইসব করতেছো, তোফায়েল জানলে কিন্তু চোদনে আর দাঁড়াইতে পারবা না। কোনো পলিটিকাল সাপোর্ট নাই, পিছন থেইকা ব্যাক করার মতো পাওয়ার নাই। তোমাদের একদম খায়া ছাইড়া দেবে সে।”
মিষ্টি করে হাসলো মুহিব, “আপনাদের আশ্রয়প্রার্থি হবো না আমরা। সবচেয়ে সুন্দর দিকটা আপনি ধরতে পারছেন না। তোফায়েলের কোনো ধারণাই নাই তার পেছনে আমরা লেগেছি। আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখেন। ক্লিন। আপনাদের ভাষায় আমরা হলাম গিয়ে ‘নলাচোদা’ পোলাপান। শিং নাই, দাঁত নাই। কোনো লিডিংয়ে নাই, সংগঠনে নাই। আমাদের কে সন্দেহ করবে?”
মুখ খুললো জাকি, “তারপরও সাবধানে থাইকো। তোফায়েল স্মার্ট। এখন যাও গা। আমার হাতে কিছু কাজ আছে। এইসব নিয়া আরেকদিন বসবো আমরা।”
মুহিব আর শামীম যখন শেরে বাংলা হল ছেড়ে নেমে আসছে, প্রচণ্ড উত্তেজিত তারা। আজকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু জানতে পেরেছে, এতোটা আশা করে আসেনি। পেছনে টিকটিকি লেলিয়ে দেওয়ার কারণে জাকির ওপর প্রথমে বেজায় নাখোশ ছিল ওরা। তবে পরে তার খোলামেলা বক্তব্যের পর ওটুকু মাফ করে দেওয়া যায়। মুহিবের মন খচ খচ করছিলো। শামীমকে সে মনে করিয়ে দিলো জাকি ভাই এতো সহজে তাদের সব গড় গড় করে বলে দিচ্ছেন এটা ঠিক রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকা একজন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষের কাজ নয়। এর পেছনে আরও বড় কোনো এজেন্ডা নেই তো? শামসভাইয়ের মার্ডার নিয়ে বেশি ছোঁক ছোঁক করতে গিয়ে অজান্তেই বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থে তাদের ব্যবহারের চেষ্টা করা হবে না তো? শামীম অবশ্য তার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলো।
শেরে বাংলা হলের ভেতরে নতুন প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছিলো তখন জাকি। একসাথে আগুন ধরালো নিজেদের সিগারেটে।
“ছেলেগুলা মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বেশিদিন হয় নাই ক্যাম্পাসে ঢুকছে। এর মধ্যেই অনেক কিছু কইরা ফালাইছে কিন্তু।” মঞ্জুর বলল।
মাথা দোলালো জাকি, “ইম্প্রেসিভ। কিন্তু আমার কানে আটকাইছে ওদের ঐ কথাটা। ওদের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নাই। ক্লিন শ্লেট। নন-পলিটিকাল পোলাপান, ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখও না। এরকম আছে না অনেক? আছে তো। রাস্তাঘাটে প্রতিদিন কতোজনকে দেখি, কয়জনকে চিনি? এরা এরকম অচেনা মুখ, কেউ পাত্তা দেয় না তাদের। কেউ চেনেও না, চোদেও না। কথাটা কিন্তু ঠিক আছে, কে এদের সন্দেহ করবে?”
“তুই ওদের দিয়ে কাজটা করাতে চাইছিস?”
এই প্রশ্নের উত্তর জাকি দেয়নি, তবে মঞ্জুর জানে এর উত্তর কোনোভাবেই নেতিবাচক আসবে না।