অধ্যায় ৩০
গাড়ির ভেতর গরমে টেকা যায় না। এলাকা তাঁতিয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের সুতীব্র গরমে। জোড়া ভ্রুর ওপর ঘামের পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এলো নির্ঝর। তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা আবহাওয়া বাইরে। বাতাস আছে। ঘামের ওপর বাতাসের পরশ ভালোই লাগছে। গাড়ির দরজায় তালা মেরে কাছের একটা চায়ের দোকানে বসলো সে। ভালোই পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকটা। কাছাকাছি একটা মেস থাকলে ব্যবসা ভালো চলারই কথা। হলে ওঠার আগে এই মেসে নির্ঝরও থাকতো। তখন এই ব্যাটা এখানে চা বিক্রি করতো বলে মনে হয় না।
“নির্ঝর ভাই!” কানের কাছে গগণবিদারী আওয়াজ তুললো কেউ
ভ্রু কুঁচকে তাকে দেখলো নির্ঝর। পরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না। জুনিয়র হবে, মুখে তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো দাঁড়ি। লাল টিশার্ট পরে আছে, বুকে বড় করে লেখা “ফাক মি হার্ড”।
নির্ঝর তাকে চিনতে না পারলেও জুনিয়র ছেলেটার উৎসাহে ভাটা পড়লো না। সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো সে, “আমি সঞ্জয়, ওয়ান টু! থার্টি ফার্স্টের দিন দেখা হয়েছিলো ভাই। আমাকে যে পোকা খাইয়ে দিয়েছিলেন।”
এবার নির্ঝরের মনে পড়লো। এই ছেলে থার্টিফার্স্টে এসে নগ্ন হওয়ার উপক্রম করেছিলো। পুরো মাতাল ছিল সেদিন। জুনিয়র, সিনিয়র মিলে অনেক মানুষ উঠেছিলো ইলেকট্রিক্যাল বিল্ডিংয়ে, বারবিকিউ করতে। মদ তো ছিলই, সেই সাথে ছিল অফুরান গাঁজা। দুই ঘণ্টা পরই সঞ্জয় একটা ছোটো দড়ি নিয়ে ছাদের কোণে চলে যেতে থাকে। ওকে নির্ঝর থামিয়েছিলো।
“ছাদের কিনারায় গিয়ে কি করবি?”
“দড়ি বেয়ে নিচে নামবো।”
“এইটুকু দড়ি দিয়ে পাঁচতলা নামতে পারবি?”
“একতলা নামতে পারবো। তখন আর চারতলা থাকবে।”
“সেই চারতলা নামবি কি করে? পড়ে মরে যাবি না?”
সঞ্জয় তখন বুঝিয়েছিলো, “ভাই, দড়ি তো আমার ওপরে লাগতেছে না। লাগতেছে নিচে। ঐ ওপরের একতলার দড়ি নিচে ফালায়া নাইমা যামু।”
মাতাল মানুষকে তো আর বোঝানো যায় না যুক্তির সমস্যা। কাজেই নির্ঝর যা করার ছিল তাই করেছে। ছাদের এক কোণে ছোট্ট লাইট জ্বালানো হয়েছিলো। সেখানে পোকা জমেছিলো কিছু। একটা পোকা ধরে জোর করে সঞ্জয়কে খাইয়ে দিতেই নেশা ছুটে গেছিলো তার।
গরম চোখে নির্ঝর বলেছিলো, “এটাকে ছাদ থেকে নামা। আর কোনো দিন এর হাতে গাঁজা দিবি না।”
সেই সঞ্জয় তাকে চিনেছে ঠিকই। ক্যাম্পাসে সিনিয়র ব্যাচগুলোর একটা হয়ে যাওয়ার সমস্যা এই। অর্ধেক দুনিয়া চিনবে। এখানে গেলে ঐ কোণা থেকে ডাকবে “নির্ঝর ভাই!”, সেখানে গেলে সেই কোণা থেকে ডাকবে। এতো ঝামেলার মধ্যে কাজ করা যায় না।
মেসের দরজার দিকে একটা চোখ রেখে সামান্য হাই হ্যালো করে সঞ্জয়কে বিদায় করার চেষ্টা করলো নির্ঝর। কিন্তু এতো সহজে করা গেলো না কাজটা। একসাথে মদ-গাঁজা খাওয়া মানুষ একে অন্যকে খুব ঘনিষ্ঠ মনে করতে শুরু করে। সঞ্জয়ও তেমনটাই ভাবছে। হয়তো অনেক জায়গায় গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলেছে, “আমি নির্ঝর ভাইয়ের ক্লোজ ছোটোভাই! একসাথে বসে গাঁজা খাই ব্যাটা।” এধরণের গায়ে পড়া ‘ক্লোজ’ ছোটোভাইদের নিয়েই যতো সমস্যা।
সঞ্জয়কে পরিস্কারভাবে চলে যেতে বলার পরও ছেলেটা আরও দশ মিনিট থাকলো। হাবিজাবি নিয়ে বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিলো একেবারে। যাওয়ার সময় মনে করিয়ে দিতেও ভুললো না, “ভাই, আমার দুইটা সিগারেট, একটা কলা, একটা চিপস আর একটা চা ছিল।”
পারলে ঈদের বাজারটাও করে নে! বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল নির্ঝর বিল দেওয়ার জন্য বড় ভাইকে সালাম-কালাম করেছিস যখন তখন এতো কমেই বা ছাড়বি কেন?
সঞ্জয় ছেলেটা যখন চলে যাচ্ছিলো, তখনই মাথায় আইডিয়াটা এলো। দুটো বেনসন, একটা কলা, একটা চিপস আর একটা চায়ের দাম উসুল করার উপায় হয়তো পাওয়া গেছে। পেছন থেকে ওকে ডাক দিয়ে কাছে আনলো নির্ঝর। ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতেই বুঝলো ছেলেটা। মাথা দুলিয়ে কালো মতো বাক্সটা হাতে নিয়ে সুড়সুড় করে মেসে ফিরে গেলো সে।
ওই মেসেই মুহিব নামের ছেলেটা থাকে। কয়েক ঘণ্টা ধরে শামীমটাও ওখানে গিয়ে ঢুকেছে। খুব বেশি কিছু জানা যায়নি এদের ব্যাপারে, জানানো হয়নি আসলে। এরা দু’জন জাকির পেছনে লেগেছে, এটুকু জানাই নির্ঝরের জন্য যথেষ্ট।
*
রেদোয়ান বিষয়টা পছন্দ করেনি, তোফায়েলের সাথে সরাসরি আলোচনা না হলেও সে এটা বুঝতে পেরেছে। পছন্দ হওয়ার মতো বিষয় এটা নয় অবশ্য। তোফায়েল স্বীকৃতি দিয়েছে, এতো সহজে তা সে দিয়ে ফেলবে এটা রেদোয়ান বিশ্বাস করতে পারছিলো না। যখন তাকে সবকিছু খুলে বলেছিলো তখন তার চোখে ছিল অবিশ্বাস।
“কি কাজটা করেছিস তোর মাথায় ঢুকেছে?” দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিলো রেদোয়ান।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তোফায়েল।
“তুই তাদের সাথে নেগোশিয়েট করার চেষ্টা করেছিস। এর অর্থটা বুঝতে পারছিস?”
“অবশ্যই!” সবজান্তার মতো তার মাথা দোলানো দেখে রাগটা আরও বেড়ে গেলো রেদোয়ানের।
“এর অর্থ হলো, তুই স্বীকার করে ফেলেছিস শামসকে খুন করার সময় ওখানেই ছিলি। তোর পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি পেয়ে গেছে ওরা।”
“এতে কিছু যায় আসে না। ওদের কাছে ছবি আছে।”
“নাও তো থাকতে পারে। হয়তো তোর মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করার চেষ্টা করেছে কেউ।”
“ছবি থাক আর না থাক, উইটনেস ওখানে ছিল। ঠিক ঠিক ঐ কথাগুলোই বলেছে মেয়েটা। উইটনেস ছাড়া আর কারও জানার কথা না এসব।”
গরম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করেছিলো রেদোয়ান।
“আমরা একটা কিছু মিস করছি। একটা ঘাপলা আছে এখানে। সমস্যাটা ঠিক ধরতে পারছি না।”
“ঘাপলা আছে তো অবশ্যই। সাক্ষী পয়দা হবে তা কে ভেবেছিলো!”
“সাক্ষী পয়দা হওয়াটা সমস্যা না। এক দুইজন থাকতে পারে ওদিকে, দূর থেকে দেখে ফেলতে পারে আমাদের এমনটা আমরা জানতাম। সম্ভাবনা কম ছিল ঠিক, তবে ছিল। সাক্ষী সামলে ফেলা সমস্যা হতো না আমাদের জন্য। আদালতের দিক থেকে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে এরা তো আদালতে যাচ্ছে না।”
“হুঁ। নিজেরাই আমাদের দিকে আসছে। অথচ আমাদের পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের জানা আছে। খানকিটা ভয় খাচ্ছে না কেন?”
“হতে পারে তাদের পেছনেও বড় কোনো শক্তি আছে। ব্যাক সাপোর্ট না পেলে তো এরকম একটা কাজে নামার কথা না। জাকি গ্রুপের কেউ নাকি? জাকিরে বানানোটা ঠিক হয় নাই, অন্য সিস্টেম করা উচিত ছিল। শামসের ঘটনার সাথে আমাদের রিলেশনটা সে জানে।”
“তা জানুক। সে আমাদের জন্য কোনো থ্রেট না। সাংগঠনিকভাবে তাকে দমিয়ে রাখা যাবে। পাতিনেতাদের পোছার টাইম আমাদের আগে ছিল, এখন নাই। এর মধ্যে সে যদি এই কেসে মাথা ঢোকায় পাতিনেতাও হইতে পারবে না আর কেন্দ্রে। ওর ক্যারিয়ারের খবর হয়ে যাবে। আমি নিজে খবর করার ব্যবস্থা করবো। মেসেজটার কথা সে কি ভুইলা গেছে?”
পায়চারী থামিয়ে একটা বিয়ারের বোতল বের করে খাটের কোণে বসে পড়লো রেদোয়ান। ছিপিটা খুলতে মিষ্টি শব্দে গড়িয়ে গেলো ধাতব মুখ। লম্বা এক চুমুক দিয়ে বন্ধুর হাতে তুলে দিলো বোতলটা।
“শালাকে জাকি গ্রুপ সাপোর্ট দিলে এতো সাহস হইতো না। এক সেকেন্ড দোস্ত।” রেদোয়ানকে এখন আতঙ্কিত মনে হচ্ছে, “এটা পলিটিকাল কোনো স্কিম না তো? আমাদের সঙ্গে কেউ খেলতেছে। সাধারণ কেউ এধরণের ঝামেলায় জড়াবে না। ক্যাম্পাসে আমাদের চেনে না কে?”
“শিট। হতে পারে।” তোফায়েলের কপালের ভাঁজ কয়েকটা বেড়ে গেলো, “এরকম পাওয়ার ছাড়া কেউ আমাদের ঘাঁটাতে আসবে না। এটাই হয়তো আমরা মিস করছিলাম। ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এধরণের ব্যাকআপ দেয় না। এরকম ঝামেলাতেও আসতে চাইবে না ইন্টারনাল ব্যাপার নিয়ে। পেছনে কে আছে? কোনো এমপি?”
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দুই যুবক অনেকটা সময় চুপ করে গেলো। অনেক লম্বা একটা সময় ধরে নিজেদের ক্ষমতাবান ভেবে এসেছে তারা। অনেক দীর্ঘ একটা সময়। এতোদিন পর আচমকাই টের পাচ্ছে, তাদের চেয়ে ক্ষমতাবান মানুষও এই পৃথিবীতে আছে। এধরণের মানুষগুলোকে তোয়াজ করে রাখাই রাজনীতির জগতের নিয়ম। তেমনটা তোফায়েল–রেদোয়ান নিয়মিতই করে এসেছে। কেন্দ্রে তাদের আলাদা মর্যাদা আছে। এরপরও কিভাবে অধিক ক্ষমতাবান কেউ তাদের বিরুদ্ধে অন্য এক পক্ষকে ইন্ধন যোগাতে পারে? সাধারণ ছাত্রদের দিয়ে এরকম সাহসিকতাপূর্ণ একটা কাজ করে ফেলা সম্ভব নয়, এমনটাই তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। ওরা কল্পনাও করতে পারলো না এই ঘটনার পেছনে একজন সাধারণ ছাত্র ছাড়া আর কারও ইন্ধন নেই!
এসময় কেউ ওদের ঘরে ঢুকে পড়লে দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারতো না। রেদোয়ান আর তোফায়েলের মুখে এখন বিশেষ এক অনুভূতির ছাপ, যেমনটা এই ক্যাম্পাসের কেউ তাদের মুখে কোনোদিন দেখেনি।
পরাক্রমশালী দুই ছাত্রনেতা ভয় পেয়েছে।
একটুখানি ভয় আর অনেকখানি বিভ্রান্তি।
*
সঞ্জয়কে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে এলো তারা দুইজন। কান থেকে হেডফোন খুলে মেসের প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্ঝর। পার্ক করা গাড়ির ভেতরে বসে থাকার একটা সুবিধে আছে। মানুষ ভেতরটা লক্ষ্য করে না। মুহিব-শামীম ওর ঠিক জানালা ঘেঁষে হেঁটে গেলো, তবে ড্রাইভারের দিকে তাকানোর চেষ্টাও কেউ করলো না। ওদের গতিপথ গাড়ির বিপরীতে। বেশ খানিকটা দূরে চলে যাওয়ার পরও ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো না নির্ঝর। মানুষের পিছু নেওয়ায় তার নামডাক আছে। জাকি গ্রুপের দুই বছর আগের সফলতার পেছনে বড় একটা ভূমিকা রেখেছিলো নির্ঝরের ফলোইং স্কিল। তবে বিরোধীদলের রাঘব বোয়াল ফলো করার সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারের চুনোপুঁটি ফলো করার পার্থক্য আছে। ভিআইপিকে গাড়ি ধরে ফলো করা সহজ। দ্রুতগামী যানবাহনে বসে থাকলে মানুষের পরিপার্শ্ব দেখার ক্ষমতা কমে যায়। অনেক বেশি তথ্য প্রসেস করতে হয় মস্তিষ্ককে। হেঁটে চললে এতো তথ্য নিয়ে মস্তিষ্ক কাজ করে না। চারপাশে কি চলছে সে বিষয়ে সতর্ক থাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়। অনুসরণকারীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট দু’জন এখন হেঁটে চলছে।
অনেকটা পেছনে পড়ে গেলো ওরা, মৃদু শব্দ করে স্টার্ট নিলো নির্ঝরের ইঞ্জিন। এখন সরাসরি ইউ-টার্ন নেওয়া যাবে না। ঘটনাটা মুহিবদের মনে থাকবে। অবচেতন মনে গাড়িটার একটা পরিচিতি আঁকা হয়ে যাবে। পরের কোনো রিমার্কেবল ইভেন্ট তার পরিচয় ফাঁস করে দেবে। কাজেই অনেকটা সামনে চলে গেলো নির্ঝর, তারপর ডিভাইডারে ফাঁক পেতে ঘুরিয়ে নিলো গাড়ি। ছুটলো মুহিব-শামীমের গতিপথে।
অনেকটা সামনে গিয়ে ওদের পাওয়া গেলো। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। এই চায়ের দোকানেই একটু আগে বসেছিলো নির্ঝর। ওর টার্গেট দু’জন এখন বেঞ্চে বসেছে। সম্ভবত চায়ের অর্ডার করেছে। ওদের ছাড়িয়ে আরও সামনে চলে গেলো নির্ঝর। নিরিবিলি দেখে পার্ক করলো। পেছনের সিটে উঠে বসলো তারপর, বাইনোকুলার বের করে তাকাতেই অনেকটা কাছ থেকে দেখা যায় শামীমের চেহারাটা।
এখান থেকে নির্ঝরের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনোদিকে যেতে পারবে না তারা।
খানিক আগে এদের দু’জনের কথা রেকর্ড হয়েছে তার স্পাইওয়ারে। রিসিভার প্ল্যান্ট করার কাজটা নির্ঝর নিজেই করতে এসেছিলো, তবে সঞ্জয়ের সঙ্গে ওভাবে আলাপ হয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছে এমনটা করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। জাকির ডান হাত হিসেবে নির্ঝরকে অনেকেই চেনে। মুহিবের ঘরটা চারতলায়। যদি একবার চারতলায় উঠে এমন কোনো জুনিয়রের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তখন সমস্যা হতে পারতো। তাছাড়া নির্ঝরের মতো একজন হলে থাকা হাই ক্লাস সিনিয়রকে মেসের চারতলার বাথরুমের ছাদের ফোকড়ে ঝুলে থাকতে দেখলে অনেকেরই চোখ কপালে উঠে যেতো।
মেসটা আদ্যোপান্ত চেনে নির্ঝর। মুহিবের রুম নম্বর বের করার জন্য একটা ফোন কলই যথেষ্ট ছিল। লোকেশন পেয়ে যাওয়ার পর বাগ কোথায় প্ল্যান্ট করবে তা ভেবে বের করতে সমস্যা হয়নি। সঞ্জয়কে পেয়ে যাওয়ার কারণে নিজেকে ঢোকা লাগেনি, এটা তার পরিকল্পনার পক্ষেই গেছে।
জাকি তাকে এমন একটা কাজে কেন পাঠিয়েছে সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত ধারণা তার নেই। জাকি টিম লিডার হিসেবে যথেষ্ট ভালো, তবে কোনো কিছু নিশ্চিত হওয়ার আগে মুখ খোলার অভ্যাস তার নেই। গত বার যখন এভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়েছিলো, নির্ঝর সেবারও জাকির কথামতো কাজ করেছে। চব্বিশ দিন একজনের পেছনে লেগে থাকার পর পঁচিশদিনের মাথায় জাকি তাকে জানিয়েছিলো এরা একটা বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছে আর সেজন্যই তাকে ফলো করতে বলা হয়েছিলো। আগে জানালে সমস্যাটা কোথায় ছিল? তবে এসব কথা জাকিকে বলে লাভ নেই। সে তার ইনফর্মারদের অন্ধকারে রেখে আনন্দ পায়। ইনফর্মার বেস্ট ফ্রেন্ড হলেও।
এবারও তাই ঘটবে মনে হচ্ছে। বিশ-বাইশ দিন এদের ফলো করবে নির্ঝর। রেকর্ড করবে এদের আলাপচারিতা। প্রাপ্ত সব তথ্য প্রতিরাতে জাকির কাছে ডেলিভারি দেবে। সারা রাত ধরে মনযোগ দিয়ে জাকি সেই রেকর্ডিং শুনবে। রিপোর্ট পড়বে। নোটবুকে নীল কালি দিয়ে হিজিবিজি লিখবে তারপর দেখা যাবে এই দুই ছোকরাও বোমা-টোমা বানাচ্ছে। বাইনোকুলারে তাদের চেহারা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করলো নির্ঝর।
ছুঁচকো দাঁড়ি আছে একটার মুখে। শিবির নাকি? কাঁধ ঝাঁকালো পাতিনেতা। এসব নিয়ে ইনফর্মারের ভাবার দরকার কি? তার কাজ তথ্য সংগ্রহ করা।
তথ্য যা সংগ্রহ করেছে তাতে করে বিশেষ লাভ হয়তো জাকির হবে না। ছেলে দুটো বেশিরভাগ আলোচনাই করেছে তাদের অসুস্থ বন্ধু লিটুকে নিয়ে। এর বাইরে আর কিছু নিয়েও তারা কথা বলেছে। জনৈক ভাইপার এবং বারবিকে ঘিরে তাদের আলাপ কোনদিকে গেছে ঠিক বোঝা যায়নি। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে তা
নির্ঝরের ধারণা তারা কাউকে কিডন্যাপ করতে যাচ্ছে। তাদের আলোচনায় “ড্রপ পয়েন্ট” আর “র্যানজম” শব্দ দুটো একাধিকবার ব্যবহার হয়েছে। জাকি বলেছিলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া গেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিতে। দুর্বোধ্য সাঙ্কেতিক ভাষা থেকে কিডন্যাপিংয়ের উপসংহারে পৌঁছে যাওয়ার পর ফোন করা যায় না। নির্ঝরের অনুমানশক্তি যে খুব একটা প্রখর নয় তার প্রমাণ অতীতে বহুবার করা হয়েছে, অনুসিদ্ধান্তসহ।
ফোন নয়, জুম লেন্সসহ ক্যামেরাটা বের করে কয়েকটা ছবি তুললো সে, দুইজনকে যেন স্পষ্ট দেখা যায়। চায়ের বিল দিচ্ছে তার শিকারদ্বয়। পেছনের সিটে ক্যামেরাটা ফেলে তাদের দিকে তাকালো নির্ঝর।
ছেলেদুটো রাস্তার অন্যপাশে একটা অটো দাঁড় করাচ্ছে। নির্ঝরের গাড়ির বিপরীত দিকেই ছুটতে শুরু করলো অটোটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে বাড়লো নির্ঝর। আরেকটা ডিভাইডার খুঁজছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনশ’ ষাট ডিগ্রি পাক খাওয়ালো তাকে ছেলেদুটো।
ডিভাইডার ঘুরে আসায় একটা লাভ হলো। অটোটা অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। রাস্তা এদিকটায় ভাঙা, গতি অস্বাভাবিক কমিয়ে রাখার ছুতো পেয়ে গেলো নির্ঝর। বড়দার মোড়ে এসে অবশ্য রাস্তা ভালো হয়ে গেছে। এখানে গতি কমিয়ে একটা প্রাইভেট কার চালানোই হবে সন্দেহজনক। তবে নির্ঝর গতি কমিয়ে রাখলো যতোক্ষণ না অটোটা চৌরাস্তার ঠিক কোন দিকে ঢুকছে তা নিশ্চিত হওয়া গেলো।
অটো ঢুকেছে বাম দিকের রাস্তায়। এটা সরাসরি রেলস্টেশনে চলে গেছে। ভণিতার সুযোগ কম, গতি বাড়ালো নির্ঝর। অটোটাকে নিমেষেই ওভারটেক করে সামনে চলে যেতে হলো তাকে। স্টেশনের সামান্য আগে এক পেট্রল পাম্পের পেছনে গাড়ি থামালো। অটোটা তাকে ছাড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় ভেতরে মুহিব-শামীমকে দেখা না গেলে ইউ-টার্ন নিয়ে ফিরতি পথে ছুটতে হবে। নতুবা সামনে এগিয়ে যাবে নির্ঝর। গাড়ি নিয়ে মানুষ ফলো করার ঝামেলাগুলোর মধ্যে এই ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরর মেথড অন্যতম।
পেছন পেছন অনুসরণ না করে, সামনে থেকে করো!
অটোটা কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্ঝরের গাড়িকে ছাড়িয়ে গেলো। ভেতরে মুহিব আর শামীম এখনও মুখোমুখী বসে আছে। তাদের একজনের হাতে সিগারেট দেখা গেলো। অটোতে তারা ছাড়া আর কোনো যাত্রী না থাকার সুযোগে ছেলেগুলো সিগারেট ধরিয়েছে। নিঃশব্দে গাড়ি নিয়ে আড়াল ছেড়ে বের হয়ে এলো নির্ঝর। আঠার মতো লেগে থাকলো স্টেশন পর্যন্ত। অটোর গতি কমে যেতে থাকলেও নিজের গাড়ির গতি কমালো না; ওদের ছাড়িয়ে সামনে চলে গেলো। বাম দিকে বাসের কাউন্টারগুলো আছে। তাদেরও ছাড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গা বেছে গাড়ি পার্ক করে বের হয়ে এলো সে। চাবির গুচ্ছটা পকেটে ভরে একরকম দৌড়ে এলো রেল স্টেশনের দিকে। আজকের দিনের দ্বিতীয় ট্রায়াল অ্যান্ড এরর।
অনেকটা দূর থেকে মুহিবের লম্বা দেহটাকে স্টেশনে ঢুকে যেতে দেখলো নির্ঝর। প্রায় ছুটতে ছুটতে স্টেশন বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়লো ও। হৃৎপিণ্ডটা খুব জোরে জোরে শব্দ করছে। বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাবে কি না কে জানে! মনে হচ্ছে এই ধুকপুকানির শব্দ তার শিকার দু’জনের কানেও চলে যাবে।
স্টেশনের ভেতর লোকে লোকারণ্য। আঁতিপাতি করে ওদের খুঁজলো নির্ঝর। এখানে তাদের হারিয়ে ফেলা যাবে না। মুহিব বা শামীমের হাতে লাগেজ ছিল না। এমনকি একটা মামুলি কাঁধের ব্যাগও না। তারা নিশ্চয় স্টেশনে ট্রেন ধরতে আসেনি। অর্থাৎ, এখানে হয় তারা কারও সাথে মিট করতে এসেছে, নয়তো…
নির্ঝরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে মধ্যম উচ্চতার শ্যামলা একটা মেয়েকে হেঁটে আসতে দেখছে সে। পায়ে শক্ত মেয়েলি বুটজোড়া, গায়ে হলুদ ফতুয়া আর নীল জিন্সে দারুণ আকর্ষণীয়া মনে হচ্ছে এখান থেকে।
এগিয়ে এসে মুহিবকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটা। শামীমের বুকে হাল্কা খোঁচা দিয়ে কি যেন জানতে চাইলো।
কাঁপা হাতে ফোন বের করে জাকির নাম্বারে ডায়াল করতে শুরু করলো নির্ঝর। কাকে কিডন্যাপ করা হবে তা মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে।