কুইন অ্যান

কুইন অ্যান 

জেলার ম্যাজিস্ট্রেট উডবার্ন সাহেব কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বিলাত যাইতেছেন, আসবাবপত্র সব বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। দুইটা কুকুর সঙ্গে যাইবে, গোটা চারেক বিলি হইয়া গিয়াছে। বাকি আছে একটি ঘুড়ী। সাহেব ওটাকে প্রথম হইতেই ওয়েলার জাতীয় বলিয়া পরিচয় দিয়া বড় ভুল করিয়া বসিয়া আছেন। প্রবল খিলাফৎ আন্দোলনের যুগ; যাহাদের কিনিবার ক্ষমতা আছে; বলিতেছে, আরেবিয়ান জাতের হইলে কেনা যাইত। দুই-একজন নন্-খিলাফতিস্ট রাজি হইয়াছে, কিন্তু দর উঠিতেছে না। তাহা ছাড়া সাহেবের কানে উঠিয়াছে, ইহারা নিজেরা ব্যবহার করিবে না, তিনি যাত্রা করিলেই জাত ভাঁড়াইয়া ঘুড়ীটাকে প্রাচ্য করিয়া লইবে, তাহার পর চড়া দামে ছাড়িয়া দিবে। 

এদিকে সময় আর মাত্র দিন পনেরো-ষোলো; মীমাংসা একটা হওয়া চাইই। অথচ সাহেবের ইচ্ছা নয় যে, ঘুড়ীটা যাহার তাহার হাতে পড়িয়া কষ্ট পায়, একাদিক্রমে দশটা বৎসর একসঙ্গে আদরযত্নে কাটাইল! কী যে করিবেন, ব্যাকুলভাবে চিন্তা করিতে করিতে একদিন হঠাৎ রায় সাহেবের কথা মনে পড়িয়া গেল। রায় সাহেব ননীগোপাল চক্রবর্তী জমিদার অ্যান্ড অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁহার হাতের দেওয়া খেতাব, লোকটা খাতির রাখিলেও রাখিতে পারে। সাহেব ভাবিলেন, দেখাই যাক না ভেজে কি না; ঘুড়ীটা তাহা হইলে সুখে থাকে। 

রায় সাহেবকে সেলাম পাঠানো হইল। উপস্থিত হইলে অবান্তর নানা রকম কথার পর আসল কথাটা পাড়িলেন। দেখা গেল, ভিজিয়া থাকাটাই রায় সাহেবদের স্বাভাবিক অবস্থা, বেশি সিঞ্চিত করিতে হইল না। সাহেব যে অন্যের হাতে প্রিয় ঘুড়ীটাকে বিশ্বাস করিয়া দিতে চান না, আর এতগুলা হোমরা-চোমরাদের মধ্যে তিনিই যে সাহেবের বিশ্বাসভাজন বলিয়া মনোনীত হইয়াছেন, ইহার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিলেন। সাহেবের যখন সেই রকমই অভিরুচি, তখন তিনি উপহার হিসাবেই সেটিকে লইতে রাজি আছেন, গৌরবের সহিত রাজি আছেন। তবে দাম হিসাবে নয়, শুধু বিলাতে গিয়া তিনি যাহাতে ওই রকমই একটি ঘুড়ী অবিলম্বে কিনিয়া লন, সেজন্য অল্পস্বল্প করিয়া অন্ততপক্ষে হাজারখানেক টাকাও অনুগ্রহণ করিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। রায়-সাহেবোচিত বিনয়ের সহিত একটু তর্কও করিতে ছাড়িলেন না, তা যদি না করেন সাহেব, তো হুজুরের দান দেখে অধীন না হয় সর্বদা হুজুরকে স্মরণ করিবে, কিন্তু অধীনকে মনে করার হুজুরের কাছে থাকবে কী? না, সে হবে না। 

উঠিবার সময় রায় সাহেবও আসল কথাটা পাড়িলেন, বার্থ-ডে অনার্সের সময়টা আছে, হুজুর যাচ্ছেন, আশেপাশেই ক-বছরের মধ্যে পাঁচ-ছটা রায় সাহেব হয়ে গেল, ছ্যাকড়া-গাড়ির মতো বেড়ে যাচ্ছে, ওতে আর মান থাকে না। লোকে গালাগাল দেওয়ার জন্যে আজকাল কথাটা ব্যবহার করছে। 

সাহেব কথা দিলেন, আগন্তুক ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ফর্দ দিবার সময় তাঁহার কথা বিশেষ করিয়া বলিয়া দিবেন। উঠিবার সময় করমর্দন করিয়া বলিলেন, আমার মস্ত বড় একটা সান্ত্বনা রইল যে, ঘুড়ীটা একজন সমঝদার আর হুঁশিয়ার ঘোড়সওয়ারের হাতে পড়ল। শুনলাম, এ তল্লাটে নাকি এ বিষয়ে আপনার সমকক্ষ আর নেই কেউ। 

রায় সাহেব নিজের প্রশংসায় লজ্জিত হইয়া বলিলেন, না, তেমন কিছু নয়, তবে ঘোড়া জিনিসটা ছেলেবেলা থেকে চড়ার অভ্যাস আছে, এই যা। 

.

কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, তবে পনেরো আনা বাড়াইয়া বলা। বয়স যখন চৌদ্দো কী পনেরো হইবে, রায় সাহেব ফোটো তুলিবার জন্য সখ করিয়া একবার একটা টাট্টুতে চড়িয়াছিলেন, একটা মহারাট্টী ব্যাবসাদার বিক্রয় করিতে আনিয়াছিল। চড়ার পরমুহূর্ত হইতে ঘোড়াটা বনবন করিয়া অল্প পরিসরের মধ্যে এ রকম ঘুরিতে আরম্ভ করিয়া দেয় যে, প্রায় আধ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘাড়ের চুল আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিতে হইয়াছিল; সবে নূতন পৈতা হইয়াছে, গায়ত্রীর উপর খুব বিশ্বাস, এক হাতে ভূর্ভুবঃ স্বঃ, আর এক হাতে ঘোড়ার ঘাড়ের রোমরাশি। 

পরে জানা গেল, সেটি সার্কাসের ঘোড়া। সেই যে কেমন একটা আতঙ্ক ঢুকিয়া গেল রায় সাহেবের মনে, সেই হইতে ও জানোয়ারটি সম্বন্ধে চাণক্যের উপদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়া আসিয়াছেন, সার্কাসের ঘোড়া বা বাহিরের ঘোড়া বাছেন না, ভাবেন, রেসের ঘোড়া হইলেই বিপদ কম হইত নাকি? সে বরং আরও বড় করিয়া চক্কর মারিত। 

কিন্তু রায়-সাহেবির মোহ, উপায় কী। 

তাহা ছাড়া আরও একটু কথা আছে। নিশ্চিত জীবনের সবচেয়ে যাহা বড় চিন্তা, কিছুদিন হইতে তিনি তদ্দ্বারা নির্মমভাবে আক্রান্ত। পরিবর্ধমান ভুঁড়ি তাঁহাকে হিমশিম খাওয়াইয়া ছাড়িতেছে। ডাক্তারেরা বলিয়াছিলেন, এর দাওয়াই—বেড়ানো; সেটা উত্তরোত্তর অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে। এদিকে ওরা রব তুলিয়াছিল, তাহা হইলে ঘোড়ায় চড়ুন। বিশ্রী রকম গরম পড়িয়া কষ্ট বাড়িয়াছে। দোমনা হইয়া কয়েকদিন হইতে ভাবিতেছিলেন, মন্দ কি! একটা তেমন শান্তশিষ্ট, প্রভুভক্ত, বিশ্বাসপরায়ণ, বাধ্য, ভব্যসভ্য, নিরীহ, গোবেচারি গোছের ঘোড়া যদি পাওয়া যাইত! 

এই সময়টা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তলব করিলেন। 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যে দিন চলিয়া গেলেন, সেই দিন বৈকালে সাহেবের সহিত আমির হোসেন ঘুড়ীটাকে আনিয়া হাজির করিল। একটা জিনিস বটে! দীর্ঘ নিটোল শরীর, উন্নত বর্তুল গ্রীবা, বিশাল চক্ষু দুইটি প্রাণের দীপ্তিতে ভরা, এক মুহূর্ত সুস্থির নয়—চনমন চনমন করিতেছে, ক্ষুরের আওয়াজে আর সাজের মসমসানিতে জায়গাটা যেন জাগিয়া উঠিল। আমির হোসেন জানাইল, ঘুড়ীর নাম—কুইন অ্যান। 

পারিষদেরা বলিল, হ্যাঁ, হুজুরের যুগ্যি ঘুড়ী বটে; গা নয় তো, কাচ—মাছি বসলে পিছলে পড়বে। 

অতি মসৃণ গা-টার দিকে চাহিয়া রায় সাহেব শুষ্ককণ্ঠে বলিলেন, হুঁ, তবে আমি তাড়াতাড়ি ওকে কিছু বলছি না। খাক-দাক জিরুক কদিন। ঘোড়ার নিয়ম হচ্ছে, মাঝে মাঝে বেশ দিনকতক বসিয়ে রাখা। 

যাঁহারা ঘোড়ার সম্বন্ধে কিছু বুঝেন, তাঁহাদের বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না, ঘোড়ার নিয়ম ঠিক বিপরীত। অভিজ্ঞ আমির হোসেন রায় সাহেবের ভুলটা শুধরাইয়া দিতে যাইতেছিল, পারিষদদিগের একজন চোখ-টিপুনিতে থামিয়া গেল। 

রায় সাহেব বিচক্ষণের মতো একটু চিন্তিতভাবে বলিলেন, আচ্ছা, ঘোড়া এত মোটা হওয়া কি ভালো—কোনওখানে একটু টোল নেই, তোমরা কি বলো হে? 

দুই-একজন ব্যাপারটা বুঝিল, মাছি পিছলানোর কথাটা রায় সাহেবকে ভড়কাইয়া দিয়াছে। বলিল, আজ্ঞে, ঘোড়া একটু যদি রোগাশোগা না হল তো কি হল? যদি নিজের মাংস বইতেই হয়রান হল তো সওয়ারি বইবে কখন? 

একজন বলিল, আর তা হল তো ঘোড়ায় না চড়ে লোকে গোল বালিশেই চড়তে পারত হুজুর। 

রায় সাহেব বলিলেন, দৌড়োয় কেমন আমির হোসেন? মানে, ইয়ে তো বেশ? আমির হোসেন গর্বের গাঢ় স্বরে বলিল, তীরের মতো হুজুর, একটু রাশ আলগা দিয়ে একটুখানি ইশারা, ব্যস্, আর দেখতে হবে না। 

রায় সাহেব বিবর্ণমুখে বলিলেন, আমিও তাই চাই। ভালো কথা, থামাবার ইশারাটা কী? ওর নাম কী, সব ঘোড়া আবার একই ইশারাতে থামে না কিনা; আমি ছেলেবেলায় যে ঘোড়াটায় চড়তাম — 

থামানো এক হ্যাঙ্গামা হুজুর, এক-এক বার দেখেছি, রাশ টেনে প্রায় শুয়ে পড়তে হয়েছে সাহেবকে, তবে থেমেছে! 

ঘুড়ীটা ছটফট করিতেছিল, পিঠে দুইটা সাবাসির চাপড় কষিয়া আমির হোসেন বলিল, তবে আর বলছি কী, হুজুরের যুগ্যি ঘুড়ী একেবারে। তবে একটা বড় দোষ আছে। 

রায় সাহেব তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, কী, কী দোষ? আগ্রহটা চাপিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু বেশ বুঝা গেল, অশ্বিনীর গুণের তালিকায় ভিতরে ভিতরে উদবিগ্ন হইয়া দোষের আশায় অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া উঠিয়াছেন। 

আমির হোসেন বলিল, এক-এক সময় কী দোষ হয়, কোনমতেই চাল ধরে না তখন। 

চাল ধরে না মানে কী? দৌড়ুতে চায় না। 

দৌড়ুনো দূরের কথা, বিলকুল নড়তে চায় না। এ ঝোঁক এক-একবার দু-তিন দিন পর্যন্ত থেকে যায়। সাহেব কত ডাক্তার দেখালেন, কত— 

নড়তে চায় না মানে কী? অনেক ঘোড়া চলবে না, কিন্তু একই জায়গায় ঘুরপাক খাবে, অন্তত সেটুকুও নিশ্চয় চলে তো? 

আজ্ঞে না, চারটি নাল পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে, হাজার মারুন, পিটুন, লোভ দেখান, কিছুতেই কিছু হয় না। 

রায় সাহেবের মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা দিল। অত্যন্ত কৌতুক বোধ করিতেছেন যেন, ভাবটা এই রকম করিয়া বলিলেন, আচ্ছা তো, পা পুঁতে দাঁড়িয়ে থাকবে, নড়বে না? বেশ, এমনই আপাতত তুমি ফেরি দাওগে রোজ, তবে এই রকম একগুঁয়েমি ধরলে আমায় খবর দিও, শায়েস্তা করে দোব। 

আমির হোসেন সেলাম করিয়া চলিয়া যাইতেছিল, ডাকিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, আর দেখো আমির হোসেন, ফেরি করবার সময় তুমি আর ওকে দৌড় করিও না; আপাতত দৌড়ের অভ্যাসটা যাক। আমি ওই পা পুঁতে দাঁড়ানো থেকে আস্তে আস্তে চলতে আরম্ভ করা, তারপরে একটু একটু কায়দামাফিক দৌড়ুনো, তারপর আরও জোরে, এই করে একেবারে গোড়া থেকে তোয়ের করব। একটি বছরের বেশি লাগবে না। আমির হোসেন বিস্ময়াভিভূত হইয়া কী বলিতে যাইতেছিল, একজন পারিষদের ইশারায় আর একটা সেলাম করিয়া ‘যে আজ্ঞে হুজুর’ বলিয়া চলিয়া গেল। 

.

ঘুড়ীটা নূতন আস্তাবলে প্রবেশ করিয়া তিন-চার দিন বেজায় মনমরা হইয়া রহিল। আমির হোসেন ঘুড়ীর সহিত এত্তালা করিল, সাহেবকে দেখতে না পেয়ে কিছু খাচ্ছে—টাচ্ছে না হুজুর, তিন দিনেই যেন গলে গেছে। 

রায় সাহেব বলিলেন, জোর করে খাওয়ানোর দরকার নেই, ওদের সয় না।

একটু থামিয়া বলিলেন, মেহনত করাচ্ছ তো? 

আজ্ঞে, এত কাহিলের ওপরে— 

পারিষদের একজনের চোখ-টিপুনিতে আমির হোসেন কথাটা আর শেষ করিল না; একটু থামিয়া বলিল, আজ বিকেলে একবার বের করেছিলাম, দেখলাম, নড়তে নারাজ। ভাবলাম, যাক, দুদিন আর ফেরি দোব না, হুজুরেরও মানা আছে। 

রায় সাহেব উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন; বলিলেন, ওই তো আমির হোসেন ঘোড়ার মেজাজ বুঝতে তোমার এখনও দেরি আছে। এই তো মেহনত নেবার সময়; ঘোড়ার জেদ বাড়তে দিয়েছ কী বিগড়েছে,—ঘোড়ার আর রেয়তের। ও কাজের কথা নয়, সকালে একবার নিয়ে এস, বাছাধন বুঝুন কার পাল্লায় পড়েছেন। হ্যাঁ, ভালো কথা, তা বলে যেন খাওয়াতে জেদ ভাঙতে যেও না, পিঠে সইবে বলে যে পেটেও সইবে, তা ভেবো না।—বলিয়া রসিকতায় আবার হাসিয়া উঠিলেন। সকলে যোগ দিল। ঘুড়ীটা মাথা নিচু করিয়া ডান ক্ষুর দিয়া রাস্তা চাঁছিতেছিল, ঘাড় ফিরাইয়া দেখিয়া নাক কাঁপাইয়া একটা আওয়াজ করিল। 

কী ভাবিল, অথবা কিছু ভাবিল কি না, সেই জানে। রাত্রে দেখা গেল, তাহার অগ্নিমান্দ্যটা হঠাৎ তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। চার দিনের না হোক, দিন দুইয়ের আহার সে দিব্য পুষাইয়া লইয়া এবং বেশ স্ফূর্তির সহিত অঙ্গচালনা করিতে লাগিল। মোটের উপর বেশ বুঝা গেল, ও স্থির করিয়া ফেলিয়াছে যে, যাওয়া-আসা, মিলন—বিরহ পৃথিবীতে চিরকালই চলিতেছে, উহার জন্য শোকে ঘাস-জল ছাড়িয়া দিলে শুধু আত্মনির্যাতনই সার হয়; এবং বোধ করি, এও ভাবিল যে, তাহাতে শুধু দুশমনের মুখেই হাসি ফুটে মাত্র। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যত রকম ঘোড়ায় চড়িবার সাজগোজ শরীরকে ভারাক্রান্ত এবং জবরজঙ্গ করিবার জন্য সৃষ্টি হইয়াছে, সে সমস্তই কয়েকদিন পূর্বে কেনা হইয়া গিয়াছে। সকালে উঠিয়া রায় সাহেব ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়া সযত্নে গোলমাল করিয়া সবগুলি পরিধান করিলেন। আজ অশ্বপৃষ্ঠে তাঁহার ফটো লওয়া হইবে, বহুদিনের সাধ। সব ঠিক হইয়া গিয়াছে, একখানা টাঙানো থাকিবে বারান্দায়, একখানা বৈঠকখানায়, একখানা শোবার ঘরে। প্রত্যেক পারিষদ এক-একখানা করিয়া দস্তখত করা ছবি পাইবে। খান পনেরো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইবে। 

শহর হইতে ফোটোগ্রাফার আসিয়াছে, সাড়ম্বরে ক্যামেরা ঠিকঠাক করিতেছে। রায় সাহেবের মনটি খুব প্রসন্ন; ঘোড়ায় চড়াও হইবে, ফোটো লওয়াও হইবে, আর এদিকে ঘোড়া এক পা নড়িবেও না, চক্কর দেওয়া তো দূরের কথা। 

পারিষদেরা সব হাজির; হাসি-ঠাট্টা, ঘোড়া দুরস্ত করার গল্প চলিতেছে। রায় সাহেব বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়া প্রকাণ্ড আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া মাথার পাগড়িটাতে সাধ্যমতো রাজপুতি ঢং ফুটাইবার চেষ্টা করিতেছেন, এমন সময় আরশিতে ঘুড়ীর ছায়া পড়িল। 

রায় সাহেব ঘুরিয়া বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কার ঘোড়া আমির হোসেন? 

আমির হোসেন ঝুঁকিয়া একটি সেলাম করিয়া সহাস্য বদনে কহিল, হুজুরেরই কুইন অ্যান, রাত থেকে খেয়ে-দেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে, চেনা যাবে, কমনে থেকে? শুধু একবারটি করেছিলাম, দেখিস, মালিক প্রথম সওয়ারি হবেন, ইউ নোটি গেরেল! 

শেষের ইংরেজিটুকু ঘুড়ীর উদ্দেশে; সে শরীর দুলাইয়া দুলাইয়া অতিরিক্ত নাচ লাগাইয়া দিয়াছিল এবং মাঝে মাঝে আমির হোসেনের হস্তধৃত লাগামে এক-একটা উৎকট ঝাঁকুনি দিয়া নিজের অসহিষ্ণুতা জ্ঞাপন করিতে ছিল। দাবড়ানি খাইয়া রায় সাহেবের পোশাকের উপর চক্ষু দুইটা ন্যস্ত করিয়া একটা আনন্দধ্বনি সহকারে মুখটা ঘুরাইয়া লইল। 

আমির হোসেন বাঁ হাতটা তাহার ঘাড়ের উপর বুলাইয়া বলিল, সবুর, মালিক আসছেন; লেকিন সাচ্চা চাল দেখানো চাই, হাঁ। 

রায় সাহেবের মুখটা শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে। কাষ্ঠ-হাসি হাসিয়া বলিলেন, বেশ, বেশ, ভালো কথা; অনন্ত কাল বলছিলে, একবার চড়বে, না হয় ঘুরে এস না; দোব ব্রিচেসটা খুলে? মানে, কথা হচ্ছে, আমার পাল্লায় পড়লে এমন ঢিট করে ছাড়ব যে, খানিকক্ষণ ওর আর পদার্থ থাকবে না, মিইয়ে যাবে; তখন আর চড়ে সুখ পাবে না। 

অনন্ত নামক পারিষদ তাড়াতাড়ি একটু হাতজোড় করিয়া বলিল, আজ্ঞে না হুজুর। ওরে বাবা! কালকে মিইয়ে ছিল বলেই বলেছিলাম চড়ব; নেহাত পা পুঁতে দাঁড়িয়ে থাকছে বললে কিনা! 

রায় সাহেব একবার অপর সকলের উপর চোখ দুইটা বুলাইয়া আনিলেন, কেহ চোখ নামাইয়া লইল, কেহ টুপ করিয়া দরজার আড়ালে সরিয়া গিয়া চোখে চোখ ফেলিতে দিল না। কে একজন একেবারে সামনা-সামনি ছিল, ভীতভাবে হাসিয়া বলিল, হুজুরকে বঞ্চিত করে কেউ কি আগে চড়তে রাজি হবে? হোক কলিযুগ, তবু— 

উপায়ান্তর না দেখিয়া রায় সাহেব আরশির সামনে সরিয়া আসিয়া পাগড়িটা খুলিয়া আবার সযত্নে এবং সবিলম্বে চাপিয়া চাপিয়া বাঁধিতে লাগিলেন। আশা, যদি ইতিমধ্যে কিছু একটা হইয়া গিরা তিনি এ যাত্রা রক্ষা পান;—ভূমিকম্প, কী অগ্নিকাণ্ড, কী অপঘাত, যা হয় একটা কিছু, মানটা কোনও রকমে যাহাতে বাঁচিয়া যায়। কিন্তু পাগড়ি বাঁধা পর্যন্ত যথেষ্ট সময় থাকিতেও সেসব কিছুই হইল না; যদিও ইহাতেও কোনও সন্দেহ রহিল না যে, সাধের বিপদটি খুবই আসন্ন, তাঁহার ঘোড়ায় চড়ার জন্য অপেক্ষা করিতেছে মাত্র। দায়ে-পড়া বীরত্বের সহিত অগ্রসর হইলেন। নরম আলগা শরীরের মাংস পাতলা করিয়া মাখা ময়দার মতো পোশাকের খাঁজে খাঁজে ভরিয়া যাইতে লাগিল। 

প্রথম তো চড়াই একটা সমস্যা। যে পারিষদটি কলিযুগ হইলেও রায় সাহেবকে প্রথম অশ্বারোহণের আনন্দ ও গৌরব হইতে বঞ্চিত করিতে চায় নাই, সে সামনে আসিয়া বলিল, আপনি তা বলে যেন লাফিয়ে চড়তে যাবেন না হুজুর, এই সেদিন অমন বাতে ভুগলেন। তার চেয়ে আমির হোসেন, তুমি এই বারান্দার পাশটায় এনে দাঁড় করাও, টুপ করে উঠে পড়ুন। 

রায় সাহেব সামান্য একটু ল্যাংচানোভাবে চলিতে চলিতে বলিলেন, তবে তাই আনো; হ্যাঁ, ব্যথাটা যেন একটু আউরেছে বটে। 

ঘুড়ীটাকে বারান্দার পাশে আনিয়া দাঁড় করানো হইল। সে পিঠটা একটু সংকুচিত করিয়া সংশয়ান্বিত দৃষ্টিতে ঘাড় বাঁকাইয়া চাহিয়া রহিল। 

.

চড়িতে যা দেরি; ঘুড়ীটা সঙ্গে সঙ্গে তরতর করিয়া প্রাণ লইয়া পালানো-গোছের করিয়া খানিকটা ছুটিয়া গেল; আমির হোসেনের হাতেই লাগামটা ছিল, অতি কষ্টে রুখিয়া ফেলিল। গালে পিঠে হাত বুলাইয়া আশ্বস্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল; বলিল, ঠান্ডা রহ বেটি, ভয় নেই! 

রায় সাহেব উঠিয়াই দুই হাতে কুইন অ্যানের ঘাড় জড়াইয়া শুইয়া পড়িয়াছিলেন, সেই অবস্থাতেই প্রশ্ন করিলেন, ফোটো তোলা হচ্ছে না তো?

ফোটোগ্রাফার বলিল, তুলিনি এখনও; আপনি যেই একটু স্টেডি হয়ে বসবেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে একসপোজার দোব; সেইজন্যে অপেক্ষা করে আছি। 

রায় সাহেব মাথাটা তুলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু কুইন অ্যান হঠাৎ সামনের পা দুইটা মুড়িয়া পিছনের পায়ে দাঁড়াইয়া উঠিতে আবার মাথাটা গুঁজড়াইয়া পড়িলেন এবং ওরই মধ্যে নির্ভুল হিসাব করিয়া বলিলেন, আপনি তা হলে কাল আসবেন, খবর দোব। আমির হোসেন কাছে আছে তো? 

এই যে রয়েছি হুজুর, লাগামটা দোব? 

না না, ধরে থাক, লাগাম চাইছি না, জিজ্ঞাসা করছিলাম—ওই আবার উঠল; টেনে নামাও, টেনে নামাও আমির হোসেন; বসে পড় ছুঁয়ে। শিবু বেয়ারাকে ডেকে নাও, ভারী আছে। 

আমির হোসেন টানিয়া ঝুঁকিয়া পড়িতেই কুইন অ্যান সামনের পায়ে ভর দিয়া পিছনে লাফাইয়া উঠিল। 

রায় সাহেব ঘাড়ের দিকে খানিকটা পিছলাইয়া গিয়া আর্তস্বরে বলিলেন, তোমরা কেউ ল্যাজ চেপে ধরো, কিছু বলবে না, খুব ঠান্ডা ঘো—

আমির হোসেন তাড়াতাড়ি সাবধান করিয়া দিল, না না, ল্যাজে হাত দিলে আজ ও বরদাস্ত করবে না, একে মন ভালো নেই, মোটে এই একটু ফূর্তি জমে আসছে—

রায় সাহেব শুষ্ককণ্ঠে বলিলেন, তা হলে? এ যে একবার সামনে উঠছে, একবার পেছনে উঠছে, এ কোন দেশি ফূর্তি আমির হোসেন? বাপ রে, যেন কাপড়-কাচা করছে! 

সাহেব পিঠে হাত ঠুকে বলতেন, ‘ডার্লিং, প্রিটি ডিয়ার!’ তাই বলুন না হুজুর!

পারিষদদের মধ্যে একজন বলিল, ডার্লিং তো মেমকে বলে সাহেবরা, সে কথা উনি ঘুড়ীকে কেমন করে— 

আওয়াজ পাইয়া রায় সাহেব ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, তোমরা বুঝি সব তামাশা দেখছ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! মেমসাহেবকে বলে—কেন, একে বললে কি অন্যায়টা হয়? ডার্লিং, ডার্লিং, ডার্লিং—তুমি সঙ্গে সঙ্গে এই দিকে হাতটা ঘুরিয়ে ঠুকতে থাক আমির হোসেন, যেন মনে করে, আমি ঠুকছি, মানে সায়েব ঠুকছে। আর কী বলতেন সায়েব? 

‘প্রিটি ডিয়ার’ বলুন হুজুর। 

প্রিটি ডিয়ার—ওই রে! লাগাম কষে ধরে থেকো। প্রিটি ডিয়ার! 

বলুন, নোটি গেরেল। 

দেখো দেখো, অন্যমনস্ক হয়ো না। না, ওটা আর বলে কাজ নেই, বড্ড যেন বোঝে। গুড গার্ল বলতেন কি সায়েব? বললে বুঝতে পারবে? যাদুমণি সোনামণি এই রকম কতকগুলা বাংলা শেখাও এবার আমির হোসেন, যেমন শুনতে মিষ্টি তেমনই–ধরো ধরো, ধরো আমির হোসেন; আমি ভাবছি, নেমে আবার ভালো করে উঠব; বেদখল করে ফেলেছে, বারান্দার কাছে আর একবার নিয়ে যেতে পার? 

যাচ্ছি হুজুর, তবে সায়েব বারান্দার ওপর পা তুলে রুটি খেতে শিখিয়েছিলেন, তাই ভাবছি—যদি হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আপনি এখন পিঠে রয়েছেন। 

না না, তবে কাজ নেই; আর একটু দূরে সরিয়ে নাও বরং। বারান্দা থেকে কতটা দূরে আছে আমির হোসেন? দূরে গিয়েই বরং ভালো করে দাঁড় করাও, নেমে পড়ি 

আমির হোসেন আর একটা সামনে উঠিবার ঝোঁক সামলাইতে সামলাইতে বলিল, নামতে গেলেই বাগড়া দেবে; মনটা ভালো আছে কিনা, একটু নাচতে কুঁদতে চায়; খালি জিন পছন্দ করবে না এখন ভালো ওয়েলার হুজুর, ওদের রেওয়াজই এই। রায় সাহেব নিরাশভাবে বলিলেন, সর্বনাশ! তা হলে? নামতেও বাগড়া দেবে, পিঠে রেখেই বা কি ভালো ব্যবহারটা করছে? একী ফ্যাসাদে পড়া গেল! 

কুইন অ্যান আরও দুই-একবার সামনে এবং পিছনে পা তুলিয়া নিজের শরীরটা নানাভাবে দুলাইয়া দুলাইয়া যেন আমির হোসেনের কথাটার সমর্থন করিল, তাহার পর চিঁ-হিঁ-হিঁ করিয়া একটা সুদীর্ঘ হ্রেষাধ্বনি করিয়া উঠিল। 

গলাটা বেশ ভালো করিয়া ধরিয়া রায় সাহেব প্রশ্ন করিলেন, ডাকলে কেন ওরকম করে আমির হোসেন? বারান্দায় টেবিলের ওপর আমার প্লেটে পাঁউরুটি পড়ে আছে, শিগগির সরিয়ে নিতে বলো তো। 

না হুজুর, ডাকার পরে কুইন ঠান্ডা হয়ে যায়, ও ওর একটা লুটিস হচ্ছে।

রায় সাহেব তদবস্থা হইয়াই একটু পড়িয়া রহিলেন। পরে অতি সাবধানে মাথাটা সামান্য একটু তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ঠিক বলছ তো? দেখো। 

হ্যাঁ হুজুর, প্রায়ই তো এই রকম— 

তাড়াতাড়ি আবার শুইয়া পড়িয়া রায় সাহেব প্রশ্ন করিলেন, প্রায় মানে?

না, আর ভয় নেই হুজুর, বসুন সিধে হয়ে 

ভয় কথাটা বোধ হয় পৌরুষে বড় বেশি ঘা দিল; তাহা ছাড়া ঘুড়ীটাও সত্যই আর নড়াচড়া করিতেছে না। রায় সাহেব সতর্কভাবে এবং আমির হোসেনকে খুব সতর্ক করিতে করিতে সিধা হইয়া বসিলেন। আমির হোসেন লাগামটা দিতে যাইতেছিল, তাড়াতাড়ি বলিলেন, না না, আগে তুমি এক হাতে ওর ঘাড়ের চুলটা ধরো কষে আর দেখো, ঘাড়ের চুল বেশি ছোট করে ছেঁটে কাজ নেই, বড় চুলেই ঘুড়ীকে মানায় ভালো। 

পারিষদরা আবার আগাইয়া আসিয়াছিল। অনন্ত বলিল, আজ্ঞে, তা তো মানাবেই, ঘুড়ী হল মেয়ে-ঘোড়া কিনা। 

রায় সাহেব ঘুড়ীর কানের মাঝখানে দৃষ্টি স্থির করিয়া বসিয়া ছিলেন। মুখ না ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কে, অনন্ত? 

অনন্ত আরও আগাইয়া আসিয়া উত্তর করিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। 

যেন ঠান্ডা হয়েছে, না? 

হতেই হবে হুজুর, কার পাল্লায়—

ফোটোগ্রাফার চলে গেছে? 

দূরে বারান্দার এক কোণ হইতে উত্তর আসিল, না, এই তো রয়েছি। 

অনন্ত বলিল, যান না, এই বেলা টুপ করে ফোটোটা তুলে নিন মশাই। হুজুর তো বেটিকে শায়েস্তা করে এনেইছেন। 

ফোটোগ্রাফার আস্তে আস্তে নামিয়া প্রায় বিশ হাত দূরে স্ট্যান্ডটা দাঁড় করাইয়া ক্যামেরাটা বসাইল। নিজে কালো পর্দার ভিতর ছয়-সাত বার মাথা গলাইয়া, বাহির করিয়া প্রায় মিনিট পাঁচ-ছয় পরে ফোকাস ঠিক করিল। কুইন অ্যান স্থির, ল্যাজটি পর্যন্ত নড়ে না। ফোটোগ্রাফার চারিদিক একবার দেখিয়া লইয়া ক্যামেরার সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, ঠিক হয়েছে, আর সেকেন্ড কয়েক; দেখবেন, যেন— 

লেন্সের মুখ হইতে ক্যাপটা খুলিয়া লইয়া কায়দা হাত ঘুরাইয়া বলিতে লাগিল, ওয়ান, টু—

কুইন অ্যান এতক্ষণ পরে একবার ঘাড় বাঁকাইয়া একটু আড়চোখে দেখিয়া লইল, এবং থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে চি-হি-হি করিয়া শব্দ করিয়া উঠিল, এবং চক্ষের পলকে ঘুরিয়া গিয়া ক্যামেরার একেবারে সামনা-সামনি হইয়া দাঁড়াইল। 

ফোটোগ্রাফার ক্যামেরা ছাড়িয়া ‘বাপ রে বাপ’ বলিয়া তিন লাফে গিয়া বারান্দায় উঠিয়া পড়িল। যাহারা বারান্দায় ছিল, তাহারা ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। রায় সাহেব লাগাম ছাড়িয়া গলা আঁকড়াইয়া শুইয়া একটা বিকট চিৎকার করিয়া উঠিলেন। আমির হোসেন তাড়াতাড়ি আসিয়া লাগামটা ধরিয়া ফেলিল। 

একটু রুক্ষভাবেই বলিল, ওয়ান টু—ওসব বলবার কী দরকার ছিল ওনার? ওই বলে সায়েব এদানি ওকে হার্ডল ডিঙতে শেখাচ্ছিল, ওনার ওই তিন-ঠ্যাঙে জিনিসটা দেখে ভাবলে বুঝি— 

রায় সাহেব শুইয়া শুইয়াই তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, সরিয়ে নাও ফোটোগ্রাফার, ওটা সরিয়ে নাও। হার্ডল রেস—সেই সাত বেড়া ডিঙিয়ে ছোটে তো? নিয়েছ সরিয়ে? 

কুইন অ্যানের হার্ডল ডিঙাইবার ইচ্ছা ছিল কি না, বলা যায় না; কিন্তু সম্ভাবনার পূর্বেই তিন-চারজন আসিয়া স্ট্যান্ড ও ঢাকনাসুদ্ধ ক্যামেরাটা বারান্দায় তুলিয়া ফেলিল। কুইন অ্যান সামনের ডান ক্ষুরটা দিয়া কাঁকরের রাস্তাটা চার পাঁচ বার জোরে জোরে আঁচড়াইল, তারপর খুব আস্তে আস্তে শরীর আন্দোলিত করিয়া সামনে চলিতে আরম্ভ করিল। রায় সাহেব ঘাড়ের রোমরাশির ভেতর হইতে রুদ্ধ গলায় প্রশ্ন করিলেন, কোথায় চলল বলো তো আমির হোসেন? ক্যামেরাটা বারান্দায়, না ঘরে? 

মন-মরা হয়ে যেন আস্তাবলে চলল বলে বোধ হচ্ছে। ওর ইচ্ছেটা ছিল একটু ঘুরে ফিরে আসা হুজুর, শেষ নাগাদ একটু ডিঙুবে বলে আশা করেছিল, তাও হল না, ওর দিল ভেঙে গেছে, দেখছেন না? 

রায় সাহেব মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, হুঁ। যেন পাঁজরা ভেদ করিয়া তিনি ঘুড়ীর ভাঙা দিল প্রত্যক্ষ করিতেছেন। 

একটু পরে প্রশ্ন করিলেন, যাচ্ছে তো ঠিক আস্তাবলের দিকে আমির হোসেন? কোনখানটায় এল? কতক্ষণ থাকে বলো তো মন-মরা ভাবটা? আর মিনিট পাঁচ-ছয় থাকবে না? 

.

পরদিন সকালে রায় সাহেব একটু খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি হইতে বাহির হইলেন। পারিষদেরা উপস্থিতই ছিল। অনন্তকে বলিলেন, তুমি ঠিক বলেছ অনন্ত, বাতটা একেবারে সেরে না গেলে ঘোড়ায় চড়াটা কাজের কথা নয়। দিব্যি পছন্দ হয়েছিল ঘুড়ীটা হে, যেমন দেখতে, তেমনই তেজী, কাল দেখলাম কিনা একটু নেড়ে-চেড়ে। ভেবেছিলাম, মনের মতনটি করে গড়ে নোব। কিন্তু না, তুমি দিয়ে দাও কাগজে একটা বিজ্ঞাপন। সামনের শীতটা যাক, তখন আবার একটা কিনে নিতেই বা কতক্ষণ? 

পারিষদদের মধ্যে একটি নিশ্চিন্ততার দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *