কুইনদের বিনিময়

কুইনদের বিনিময়

কুইনরা কখনও দরকষাকষি করে না।
–থ্রু দি লুকিং-গ্লাস
লুইস ক্যারোল

.

সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া
শরৎকাল ১৭৯১

তুষার ঢাকা প্রান্তর দিয়ে তিনঘোড়ার গাড়িটা ছুটে চলেছে। রিগার পর থেকে তুষারের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের গাড়িটা পাল্টে এই তিনঘোড়াবিশিষ্ট চওড়া আর উঁচু গাড়িটা নিয়েছে তারা। ঘোড়াগুলোর লাগামে বেশ কয়েকটি সিলভার রঙের বেল লাগানো।

 পিটার্সবার্গ থেকে মাত্র পনেরো-ষোলো মাইল দূরে এই জায়গায় এখনও গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে হলুদ রঙের পাতা। আংশিক তুষারাবৃত ক্ষেতে কৃষকের দল এখনও কাজ করে যাচ্ছে দিন-রাত, যদিও বাড়ি-ঘরের ছাদে তুষার জমতে জমতে ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ।

ফারের বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে অ্যাবিস বাইরের গ্রাম্য এলাকা দেখে যাচ্ছেন। ইউরোপিয়ান জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ইতিমধ্যে নভেম্বরের ৪ তারিখ এসে গেছে, ঠিক এক বছর সাত মাস আগে মন্তগ্লেইন সার্ভিস উত্তোলন করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখার কাজটা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু এখানে এই রাশিয়াতে প্রচলিত আছে গ্রেগরিয়াঁন ক্যালেন্ডার, সেটার হিসেবমতে আজ অক্টোবরের তেইশ তারিখ। বিভিন্ন দিক থেকে রাশিয়া পিছিয়ে আছে, ভাবলেন অ্যাবিস। এই দেশটি এমন এক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে যা ইউরোপের অন্য কোনো দেশ করে না। এটা তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে যেসব কৃষককে ক্ষেতে কাজ করতে দেখছেন তাদের জামাকাপড় বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে একইরকম আছে। তাদের রীতিনীতিরও কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে তার মনে হলো না। কালো চোখের এইসব দোমড়ানো মোচড়ানো মুখগুলো তাদের গাড়িটার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত তারা। যে হাতিয়ার দিয়ে কাজ করছে সেটা হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরি করে গেছিলো। প্রথম পিটারের শাসনকাল থেকে তারা মনে হয় দাড়ি-গোঁফ আর চুল কাটে নি।

তুষার ঢাকা প্রাঙ্গনের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট পিটার্সবার্গের বিশাল গেটটা। গাড়ির চালক রাজকীয় রক্ষীদের সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে আছে, আসন থেকে নেমে ঘোড়াগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে গেটটা খুলে দিলো সে। শহরের ভেতর দিয়ে আসার সময় অ্যাবিস দেখেছেন নেভা নদীর তীরে গম্বুজ আর চুরি মাথায় সাদ তুষার চকচক করছে। বাচ্চারা বরফের মাঠের উপর স্কেটিং করছে মনের আনন্দে। কুকুরে টানা জে চলে যাচ্ছে তাদের পাশ দিয়ে। হলুদ রঙের চুল আর নোংরা জামাকাপড় পরা শিশুরদল ডাকপিয়নের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে এক সা ভিক্ষা পাবার আশায়। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো।

বরফাচ্ছাদিত নদীটা পার হতেই অ্যাবিস তার সঙ্গে থাকা ট্রাভেলিং কেস আর নক্সা করা কাপড়টার উপর হাত বুলালেন। হাতের জপমালাটি স্পর্শ করে সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা সেরে নিলেন তিনি। সামনে যে তিক্ত আর গুরুদায়িত্ব আছে সেটা উপলব্ধি করলেন। শুধুমাত্র তিনিই এই মহাক্ষমতাধর জিনিসটা অর্পণ করেছেন সঠিক হাতে। এইসব হাত লোভ আর উচ্চাকাঙ্খি লোকজনের কবল থেকে একে সুরক্ষিত করবে। অ্যাবিস ভালো করেই জানেন এটা তার মিশন। জন্মের পর থেকেই তাকে এ কাজের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। এটা হস্তান্তর করার জন্য সারাজীবন ধরে তিনি অপেক্ষা করে গেছেন।

পঞ্চাশ বছর পর আজ শৈশবের সেই বন্ধুর সাথে দেখা করবেন তিনি। ফিরে গেলেন সেই অতীতে, যখন ভ্যালেন্টাইনের মতোই উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলো তার বন্ধু সোফিয়া অ্যানহল্ট-জারবেস্ট। এই বন্ধুকে তিনি সুদীর্ঘ অনেক বছর ধরে স্মরণ করে আসছেন। যৌবনের সময়গুলোতে গভীর অনুরক্ত হয়ে প্রায় প্রতি মাসেই তাকে চিঠি লিখতেন নিজের সিক্রেটগুলো জানিয়ে। যদিও তাদের দু’জনের চলারপথ ভিন্ন হওয়ায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারপরও সোফিয়াকে এখনও পোমারানিয়ায় প্রজাপতির পেছনে ছুটতে থাকা সোনালি চুলের কোনো চপল বালিকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। হ্যাঁ, পোমারানিয়ায় ছিলো তার মা-বাবার বাড়ি।

ঘোড়াগাড়িটা নদী পেরিয়ে শীতকালীন প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেলো অ্যাবিসের মধ্যে। সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে একগুচ্ছ মেঘ চলে গেলো। তিনি ভাবতে লাগলেন তার বন্ধু কি ধরণের মানুষ হবে, কারণ এখন তো সে আর পোমারানিয়ার সেই ছোট্ট সোফিয়াটি নেই। এখন তাকে সমগ ইউরোপে চেনে ক্যাথারিন দ্য জার নামে। সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি।

.

সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দ্য গ্রেট বসে আছেন তার ড্রেসিং টেবিল, আয়নার সামনে। তার বয়স বাষট্টি, উচ্চতা গড়পরতার চেয়ে একটু কম কেন ভারি শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর ভারি চোয়াল। তার শীতল-নীল চোখ জোড়া সচরাচর বেশ প্রণোচ্ছল থাকে, আজ সকালে একেবারেই ফাঁকা আর মলিন দেখাচ্ছে, কান্নার করণে লালচে হয়ে আছে কিছুটা। দুই সপ্তাহ ধরে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছেন তিনি। এমনকি পরিবারের লোকজনের সাথেও দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার ঘরের চারদেয়ালের বাইরে পুরো প্রাসাদের পবিবেশ থমথমে। শোকে মুহ্যমান সবাই। দুই সপ্তাহ আগে, অক্টোবরের ১২ তারিখে জাসি থেকে আগত কালো পোশাকের এক দূত জানিয়ে গেছে কাউন্ট পোটেমকিন মৃত্যুবরণ করেছেন।

 তাকে রাশিয়ার সিংহাসনে বসিয়েছে এই পটেমকিন, নিজের তলোয়াড় দান করেছে তাকে, ঘোড়া চালানোও শিখিয়েছে, এরফলে তিনি বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। এই বিদ্রোহীরা তার স্বামী জারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো। পটেমকিন তার প্রেমিক ছিলো, ছিলো রাজ্যের মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর জেনারেল আর সবথেকে বিশ্বস্ত একজন লোক, যাকে তিনি আমার একমাত্র স্বামী’ বলে ডাকতেন। পটেমকিনের কারণেই তার রাজত্বের সীমানা এক তৃতীয়াংশ বেড়ে কাসপিয়ান সাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নিকোলাইয়ে যাবার পথে কুকুরের মতোই মৃত্যুবরণ করেছে সে। ফিসান্ট আর প্যাটরিজ পাখির মাংস, শূকরের গোস্ত, লবন দেয়া গরুর মাংস ভক্ষণ আর সেইসাথে প্রচুর পরিমাণের মদ তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। অভিজাত রমণী তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখতে সারাক্ষণ তার টেবিলের উচ্ছিষ্ট ভোগ করার জন্য। চমৎকার প্রাসাদ, দামি দামি গহনা আর ফরাশি শ্যাম্পেইনের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন রুবল উড়িয়ে দিয়েছিলো সে। তবে, এই লোকই ক্যাথারিনকে এই বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর নারীতে পরিণত করেছিলো।

চারপাশে তার পরিচারিকারা নিঃশব্দ প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তার চুলে পাউডার লাগিয়ে দিচ্ছে, কেউ পরিয়ে দিচ্ছে জুতো। তিনি উঠে দাঁড়ালে তারা ধূসর রঙের ভেলভেটের আলখেল্লাটা তার গায়ে চাপিয়ে দিলো। এই নক্সা করা আলখেল্লাটি পরেই তিনি সব সময় রাজসভায় হাজির হন। সেন্ট ক্যাথারিন, সেন্ট ভ্লাদিমির, সেন্ট আলেক্সান্ডার নেভস্কি, সেন্ট এডু এবং সেন্ট জর্জের নামে ক্রুশ আঁকলেন। অভিজাত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

 দশ দিন পর আজই রাজসভায় হাজির হচ্ছেন। শীতকালীন প্রাসাদের দীর্ঘ করিডোরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীদলের মাঝখান দিয়ে দেহরক্ষিদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আজ থেকে কয়েক বছর আগে, এই করিডোরের জানালা দিয়েই তিনি দেখেছিলেন কিভাবে তার সেনাবাহিনী সেন্ট পিটার্সবার্গ আক্রমণ করতে আসা সুইডিশ রণতরীগুলো নেভা নদীতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যেতে যেতে একটা ভাবনায় ডুবে জানালাগুলোর দিকে তাকালেন।

রাজসভায় অপেক্ষা করছে একদল বিষাক্ত সাপ, যারা নিজেদেরকে কূটনৈতিক আর সভাসদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ধান্দায় মশগুল। তার নিজের ছেলে পলও তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। তবে পিটার্সবার্গে আরেকজন এসে পৌঁছেছে, যে তাকে রক্ষা করতে পারবে এই বিপদ থেকে। পোটেমকিন মারা যাবার পর তার যে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে সেটা পূরণ করার মতো একটি শক্তি আছে এই মহিলার কাছে। আজ সকালেই তার শৈশবের পুরনো বন্ধু, মন্তগ্লেইনের অ্যাবিস, হেলেনে দ্য রকুয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে পৌঁছেছে।

.

রাজসভায় কিছুক্ষণ থেকেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন ক্যাথারিন, তারপর তার বর্তমান প্রেমিক প্রাতো জুভোভের হাত ধরে চলে গেলেন প্রাইভেট অডিয়েন্স কক্ষে। অ্যাবিস সেখানে অপেক্ষা করছে তোর ভাই ভ্যালেরিয়ানের সাহচার্যে। সম্রাজ্ঞিকে দেখেই অ্যাবিস উঠে দাঁড়ালেন, ছুটে এলেন তার কাছে।

এতোদিন পরও, হালকাঁপাতলা ক্যাথারিনের বিরাট শারিরীক পরিবর্তন সত্ত্বেও অ্যাবিস তাকে দেখামাত্রই চিনে ফেললেন। তারা একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করার সময় ক্যাথারিন পাতো জুতভাভের দিকে তাকালেন। আকাশি নীল কোট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে সে। তার পোশাকে এতো অসংখ্য মেডেল যে মনে হবে সেগুলোর ভারে বুঝি পরেই যাবে লোকটা। হালকা-পাতলা শরীরের প্রাতো বয়সে বেশ তরুণ। তার আর ক্যাথারিনের সম্পর্কের কথা রাজসভার সবাই জানে। অ্যাবিসের সাথে কথা বলার সময় আলতো করে পাতোর হাত বোলাতে লাগলেন ক্যাথারিন।

“হেলেনে,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি। “তোমাকে দেখার জন্যে কতোদিন ধরে যে মুখিয়ে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না অবশেষে তুমি আমার কাছে এসেছো। আমি জানি, ঈশ্বর আমার হৃদয়ের কথা শুনেছেন, আমার শৈশবের বন্ধুকে তিনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন।”

পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে অ্যাবিসকে তিনি বসার জন্য ইশারা করে নিজেও বসে পড়লেন। প্লাতো আর ভ্যালেরিয়ান তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।

“তোমাকে দেখে খুব খুশি আমি, যদিও জানো আমি শোকে মুহ্যমান হয়ে আছি, তবে তোমার আগমণে সব শোক মুছে গেছে নিমেষে। আমার ব্যক্তিগত কক্ষে আজরাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করবো। হাসি-ঠাট্টা আর অনেক গল্পগুজব করবো, ভান করবো আমরা এখনও সেই তরুণীটিই আছি। ভ্যালেরিয়ান, তুমি কি আমার কথামতো ঐ মদের বোতলটা খুলে রেখেছিলে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভ্যালেরিয়ান চলে গেলো সাইডবোর্ডের দিকে।

“তোমার অবশ্যই এটা চেখে দেখা উচিত, মাই ডিয়ার। আমার রাজদরবারে যতো সম্পদ আছে এটা তারমধ্যে অন্যতম। অনেক বছর আগে দেনিস দিদেরো বর্দু থেকে এটা আমাকে এনে দিয়েছিলো। আমি তো এটাকে দামি হীরাজহরতের মতো মূল্য দিয়ে থাকি।”

ছোট্ট দুটো ক্রিস্টাল গ্লাসে লাল টকটকে মদ ঢেলে দিলো ভ্যালেরিয়ান। সেই মদে চুমুক দিলো ক্যাথারিন আর তার শৈশবের বান্ধবি।

“চমৎকার,” ক্যাথারিনের দিকে হেসে বললেন অ্যাবিস। “কিন্তু তোমাকে দেখার পর এই বুড়ো হাড়ে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর কোনো অসাধারন মদই তা করতে পারবে না, ফিগছেন।”

প্রাতো আর ভ্যালেরিয়ান একে অন্যের দিকে তাকালো। সম্রাজ্ঞি জন্মেছিলেন সোফিয়া অ্যানহল্ট-জার্বেস্ট নামে, তবে শৈশবে তার ডাক নাম ছিলো ‘ফিগচেন’। পাতো অবশ্য বিছানায় আদর করে তাকে ডাকে হৃদয়ের মক্ষিরাণী? বলে, তবে প্রকাশ্যে সব সময় হার ম্যাজেস্টি’ ছাড়া ডাকে না। এই নামে অবশ্য

সম্রাজ্ঞির সন্তানেরাও তাকে ডেকে থাকে। অবাক করা ব্যাপার হলো, সম্রাজ্ঞি কিন্তু অ্যাবিসের এমন আচরণে রুষ্ট হলেন না।

 “এবার আমাকে বলো তুমি কেন এতোদিন ফ্রান্সে থেকে গেলে,” বললেন। ক্যাথারিন। “তুমি যখন অ্যাবিটা বন্ধ করে দিলে তখন আমি ভেবেছিলাম সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়ায় চলে আসবে। আমার রাজসভায় তোমাদের দেশের অসংখ্য স্বেচ্ছায় নির্বাসিত লোকজনে পূর্ণ। ফ্রান্স হলো বারো শ’ মাথার একটি হাইড্রা, অরাজকতার একটি দেশ। এই মুচির দেশটা প্রকৃতির নিয়মই পাল্টে দিয়েছে!”

 একজন সম্রাজ্ঞির মুখ থেকে এরকম কথা শুনে অ্যাবিস অবাক হলেন। ফ্রান্স যে বিপজ্জনক জায়গা এটা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। তারপরও বলতে হয়, এই জারপত্মীই কি উদারমনা ভলতেয়ার আর দেনিস দিদেরোর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে নি? শ্রেণীসাম্য এবং নির্দিষ্ট সীমানার বিরোধী তত্ত্ব তো এরাই বলে বেড়াতো।

 “আমি সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারি নি,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। “কিছু বিষয় নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলাম-” পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাতো আর জুবোভের দিকে চট করে তাকালেন তিনি। প্রাতো চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে ক্যাথারিনের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। “তুমি ছাড়া আর কারো সামনে ব্যাপরটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।”

অ্যাবিসের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্যাথারিন খুব সহজভাবেই বললেন, “ভ্যালেরিয়ান, তুমি আর পাতো আলেক্সান্দ্রোভিচ চলে যাও।”

“কিন্তু ইওর হাইনেস…” অনেকটা শিশুসুলভ চপলতায় বলে উঠলো পাতো জুবোভ।

“আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ো না, ডার্লিং, আলতো করে পাতোর হাতে চাপড় মারলেন ক্যাথারিন। “হেলেনের সাথে আমার সখ্যতা প্রায় ষাট বছরের। আমরা কিছুক্ষণ একা থাকলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।”

“সে দেখতে খুব সুন্দর না?” দু’জন পুরুষ মানুষ ঘর থেকে চলে গেলে ক্যাথারিন জানতে চাইলেন অ্যাবিসের কাছে। “আমি জানি, তুমি আর আমি একই পথ বেছে নেই নি। তবে আশা করি আমি যখন তোমাকে বলবো ঠাণ্ডা শীতের পর সূর্যের নীচে দাঁড়ালে নিজেকে তুচ্ছ পোকামাকড়ের মতো হয় তখন আমাকে তুমি বুঝতে পারবে। বৃদ্ধগাছের পরিচর্যার জন্যে চাই তরুণ আর বলিষ্ঠ একজন মালি।”

অ্যাবিস চুপচাপ বসে থাকলেন। ভাবতে লাগলেন তার শুরুর দিকে পরিবল্পনাটি সঠিক ছিলো কিনা। তাদের মধ্যে প্রায়শই আন্তরিকমাখা চিঠি। চালাচালি হলেও শৈশবের এই বান্ধবীকে অনেক বছর দেখেন নি। তাহলে কি তার সম্পর্কে যেসব গুজব শোনা যায় তা সত্য? এই বয়স্ক নারী, যে এখনও কামার্ত আর ক্ষমতালোভী, তাকে কি আসন্ন গুরুদায়িত্বের জন্য বিশ্বাস করা যায়?

“আমি কি তোমাকে হতবাক করে দিয়েছি?” হেসে বললো ক্যাথারিন।

“মাই ডিয়ার সোফিয়া,” বললেন অ্যাবিস, “আমি বিশ্বাস করি তুমি মানুষকে ভড়কে দিতে খুব পছন্দ করো। তোমার মনে আছে, যখন চার বছর বয়স ছিলো, প্রুশিয়ার রাজার সামনে গিয়ে তুমি তার কোটের কাণায় চুমু খেতে অস্বীকার করেছিলে।”

“আমি তাকে বলেছিলাম দর্জি তার কোটটা একটু বেশি খাটো করে বানিয়েছে!” চোখে জল আসার আগপর্যন্ত হাসতে লাগলেন ক্যাথারিন। “আমার মা তো রেগেমেগে একাকার। রাজা তাকে বলেছিলেন, আমি নাকি একটু বেশিই সাহসী।”

অ্যাবিসও হেসে ফেললেন বান্ধবীর সাথে সাথে।

“তোমার কি মনে আছে ব্রুনউইকের গণক আমাদের হাত দেখে কি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন?” আস্তে করে জানতে চাইলেন তিনি। “তোমার হাতে নাকি তিনটি রাজমুকুট আছে।”

“বেশ ভালোই মনে আছে আমার,” বললেন সম্রাজ্ঞি। “সেদিনের পর থেকে আমি কখনও সন্দেহ করি নি যে আমি বিশাল একটি সাম্রাজ্য শাসন করবো। আমার আকাঙ্খা পূর্ণ হলে আমি সব সময়ই ভবিষ্যত্বাণীতে বিশ্বাস করি।” এবার আর অ্যাবিস হাসলেন না।

 “তোমার কি মনে আছে গণক আমার হাত দেখে কি বলেছিলেন?” জানতে চাইলেন অ্যাবিস।

কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলেন ক্যাথারিন। মনে আছে, যেনো কথাটা গতকালই বলা হয়েছে, অবশেষে বললেন তিনি। এজন্যেই আমি আকুল হয়ে তোমার আগমণের অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি যখন আসতে দেরি করছিলে তখন। আমার কী মনে হচ্ছিলো সেটা কল্পনাও করতে পারবে না…” একটু দ্বিধার সাথেই থেমে গেলেন। “তোমার কাছে কি সেগুলো আছে?” শেষে বললেন ক্যাথারিন দি গ্রেট।

 অ্যাবিস তার গাউনটা তুলে নিলেন, কোমরের সাথে চামড়ার একটা ছোট্ট ব্যাগ আটকে রাখা হয়েছে। একটা স্বর্ণখচিত জিনিস বের করলেন তিনি। জিনিসটা এমন একটা অবয়বের যেটা লম্বা গাউন পরে আছে, বসে আছে ছোট্ট একটা প্যাভিলিওনে। ক্যাথারিনের কাছে সেটা তুলে দিলেন অ্যাবিস। অবিশ্বাসের সাথে সম্রাজ্ঞি সেটা হাতে তুলে নিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা অবলোকন করলেন তিনি।

“ব্ল্যাক কুইন,” ক্যাথারিনের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে বললেন অ্যাবিস। সম্রাজ্ঞির হাতে হীরাজহরত খচিত নক্সা করা দাবার একটি খুঁটি। জিনিসটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।

“আর বাকিগুলো?” বললেন তিনি। তবে তার কণ্ঠে এমন কিছু আছে যেটা অ্যাবিসকে উদ্বিগ্ন করে তুললো।

“ওগুলো এমন জায়গায় নিরাপদে লুকিয়ে রাখা হয়েছে যে তারা কোনোভাবেই এর ক্ষতি করতে পারবে না।”

 “প্রিয় হেলেনে, সবগুলো অংশ আমাদেরকে একত্রিত করতে হবে এক্ষুণি! তুমি ভালো করেই জানো এই সার্ভিসটার ক্ষমতা সম্পর্কে। আমার মতো যোগ্য একজনের হাতে পড়লে এটা-”

“তুমি তো জানোই,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন অ্যাবিস, “অ্যাবির চারদেয়ালের মধ্য থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস সরিয়ে ফেলার যে অনুরোধ বিগত চল্লিশ বছর ধরে তুমি আমাকে করে গেছে সেটা এড়িয়ে গেছি। এখন তার কারণটা তোমাকে বলবো। সার্ভিসটা কোথায় লুকিয়ে রাখা ছিলো আমি কিন্তু সেটা ভালো করেই জানতাম-” ক্যাথারিন বিস্মিত হয়ে কিছু একটা বলতে গেলে অ্যাবিস তার কাঁধে হাত রেখে তাকে বিরত রাখলেন। “ওটা লুকানো স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার বিপদ সম্পর্কেও আমি ভালোভাবেই অবগত ছিলাম। এরকম একটা জিনিসের ব্যাপারে কেবলমাত্র একজন সেন্টকেই বিশ্বাস করা যায়। মাই ডিয়ার ফিগচেন, তুমি তো কোনো সেন্ট নও।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?” সম্রাজ্ঞি আর্তনাদ করে উঠলেন। “একটা খণ্ডবিখণ্ড জাতিকে একত্রিত করেছি আমি, অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত লোকজনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছি। প্লেগের মতো রোগ সমূলে উৎপাটন করেছি, নির্মাণ করেছি হাসপাতাল, স্কুল, রাশিয়ার অভ্যন্তরে নানান ধরণের সমস্যা দূর করে যুদ্ধের সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছি। কোণঠাসা করে ফেলেছি এ দেশের শত্রুদের। তুমি কি আমাকে অত্যাচারি শাসক মনে করো নাকি?”

“আমি শুধুমাত্র তোমার নিজের কল্যাণের কথা ভেবেছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস। “এই জিনিসটার এমন ক্ষমতা আছে যে সবচাইতে ঠাণ্ডা মাথাকেও বিগড়ে দিতে পারে অনায়াসে। মনে রেখে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আরেকটুর জন্যে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছিলো। শার্লেমেইনের মৃত্যুর পর তার ছেলে এটার জন্যে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিলো।”

“একটা আভ্যন্তরীণ বিবাদ, নাক সিটকিয়ে বললেন ক্যাথারিন। “আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে এ দুটো জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে।”

“মধ্য-ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চই কেবল এটার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন ধরে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যখন শুনতে পেলাম ফ্রান্স বিল অব সিজার নামের একটি আইন পাস করেছে, যার ফলে ফ্রান্সে অবস্থিত চার্চগুলোর সমস্ত সম্পত্তি সরকারের অধীনে চলে যাবে, তখনই বুঝতে পারলাম আমার বাজে আশংকাটাই সত্যি হতে চলেছে। ফরাসি সরকার মন্তগ্লেইনের অভিমুখে রওনা দিয়েছে, এ খবরটা শোনা মাত্রই আমি আর দেরি করি নি। মন্তগ্লেইনে কেন আসবে ওরা? আমরা তো প্যারিস থেকে অনেক দূরে পাবর্ত্য অঞ্চলের একটি অ্যাবি। প্যারিসের কাছাকাছি আরো অনেক সম্পদশালী অ্যাবি আছে, সেগুলো লুট করাই তো বেশি সহজ ছিলো। না। তারা লুট করতে চায় সার্ভিসটা। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলি অ্যাবি থেকে, ছড়িয়ে দেই সমগ্র ইউরোপে যাতে করে দীর্ঘদিনেও এটা একত্রিত করা সম্ভব না হয়—”

 “ছড়িয়ে দিয়েছো!” চিৎকার করে উঠলেন সম্রাজ্ঞি। আসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এখনও বুকের কাছে কালো রঙের রাণীর খুঁটিটা ধরা আছে। খাঁচায় বন্দী প্রাণীর মতো অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। “তুমি এরকম একটা কাজ কিভাবে করতে পারলে? তোমার উচিত ছিলো আমার কাছে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া!”

“সেটা আমি করতে পারতাম না!” বললেন অ্যাবিস। তার কণ্ঠে ভ্রমণের ক্লান্তি। “আমি জানতে পেরেছি অন্য কেউও এই সার্ভিসটার অবস্থান জানে। সম্ভবত বিদেশী কোনো শক্তি, ফরাসি অ্যাসেম্বলির সদস্যদেরকে বিল অব সিজার পাস করানোর জন্য ঘুষ দিয়েছে, মন্তগ্লেইনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করেছে তারাই। এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হয় না যে, এই অপশক্তি বিখ্যাত বক্তা মিরাবু আর আঁতুয়ার বিশপকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলো? একজন বিলটার লেখক, আর অন্যজন এটার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে অ্যাসেম্বলিতে। এই এপ্রিলে মিরাবু যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন তখন বিশপ তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিছানার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে নি। কোনো সন্দেহ নেই, বিশপ কোনো প্রকার চিঠিপত্র হস্তগত করতে মরিয়া ছিলো যা তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে যেতো।”

“তুমি এসব কথা কিভাবে জানতে পারলে?” বিড়বিড় করে বললেন ক্যাথারিন। ঘুরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।

“আমার কাছে তাদের চিঠি রয়েছে,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। তাদের দু’জনের কেউই কোনো কথা বললো না বেশ কিছুটা সময় ধরে। অবশেষে নরম ডিমলাইটের আলোয় কথা বললেন অ্যাবিস। “তুমি জানতে চেয়েছিলে না, আমি কেন ফ্রান্স থেকে এতো দেরি করে এলাম, আশা করি তুমি এর উত্তর পেয়ে গেছো। কে আমাকে দিয়ে বাধ্য করেছে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রাখা গোপনস্থান থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলতে, সেটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। কে সেই শত্রু যে আমাকে শিকারের মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, যতোক্ষণ না আমি চার্চের সাহায্যে মহাদেশের অন্যপ্রান্তে পালিয়ে গেছি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে?”

“তুমি কি জানতে পেরেছে কে সে?” স্থিরচোখে অ্যাবিসের দিকে চেয়ে বললেন ক্যাথারিন।

“হ্যাঁ, পেরেছি, শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস। “মাই ডিয়ার ফিগচেন, তুমি।”

.

“তুমি যদি সব জেনেই থাকো,” পরদিন সকালে বরফ আচ্ছাদিত পথ দিয়ে হার্মিটেজের দিকে যেতে যেতে অ্যাবিসকে বললেন জারিনা, “তাহলে পিটার্সবার্গে কেন এলে সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”

তাদের দু’জনের থেকে বিশ কদম দূরে একজন রাজকীয় রক্ষী তাদেরকে অনুসরণ করছে। অবশ্য তাদের কথাবার্তা সে শুনতে পাচ্ছে না।

“তার কারণ এতোকিছু জানার পরও আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, অ্যাবিস চোখেমুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বললেন। “আমি জানতাম ফরাসি সরকারের পতন নিয়ে তুমি শংকিত, দেশটা অরাজকতায় নিপতিত হবে বলে আশংকা করছিলে। তুমি চাইছিলে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা যেনো ভুল কোনো হাতে না পড়ে, আর তুমি এও সন্দেহ করেছিলে আমি হয়তো তোমার কথামতো কাজ করছি না। কিন্তু আমাকে বললো তো ফিগচেন, ফরাসি সৈন্যেরা যাতে মন্তগ্লেইন থেকে সার্ভিসটা তুলে নিয়ে না যেতে পারে তারজন্যে তুমি কি পরিকল্পনা করেছিলে? রাশিয়ান সৈন্য দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করতে?”

“মন্তগ্লেইনের পার্বত্য অঞ্চলে একদল সৈন্য লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি, ফরাসি সৈন্যরা যাতে ঐ জায়গায় যেতে না পারে তার জন্যে, হেসে বললেন। ক্যাথারিন। “তারা ইউনিফর্মে ছিলো না।”

“বুঝতে পেরেছি,” বললেন অ্যাবিস। “এরকম কঠিন পদক্ষেপ নেবার কথা কেন ভাবলে?”

“আমি যা জানি তা তোমাকে বলব,” সম্রাজ্ঞি বললেন। “তুমি তো জানোই আমি ভলতেয়ারের মৃত্যুর পর তার লাইব্রেরিটা কিনে নিয়েছি। তার ঐ লাইব্রেরিতে কার্ডিনাল রিশেলুর লেখা একটি জার্নাল ছিলো। সাংকেতিক ভাষায় মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা ছিলো তাতে। ভলতেয়ার সেই সাংকেতিক ভাষার মমোদ্ধার করেছিলেন। এভাবে আমি জানতে পারি তিনি কি আবিষ্কার করেছিলেন। এই পাণ্ডুলিপিটা হার্মিটেজের একটা সিন্দুকে তালা মেরে রাখা হয়েছে। তোমাকে এখন সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি ওটা দেখাবো বলে।”

“এই দলিলটার বিশেষত্ব কি?” জানতে চাইলেন অ্যাবিস, মনে মনে ভাবলেন তার বান্ধবী তাকে কেন এ কথাটা আগে বলে নি।

 “রিশেলু সার্ভিসটার খোঁজ পান এক মুর ক্রীতদাসের কাছ থেকে, তাকে শার্লেমেইনের জন্যে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিলো। তুমি তো জানোই স্পেন আর আফ্রিকায় মুরদের বিরুদ্ধে অনেক ক্রুসেড লড়েছিলেন শার্লেমেইন। তবে একবার সে দোভা আর বার্সেলোনা রক্ষা করেছিলেন খৃস্টান বাস্কদের বিরুদ্ধে। লড়াই করে, যারা মুরিশদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলো। বাস্করা খৃস্টান হলেও শত শত বছর ধরে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে পশ্চিম ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ নিতে উদগ্রীব ছিলো। বিশেষ করে আটলান্টিক উপকূল অঞ্চলটি।”

“মানে পিরেনিজের কথা বলছো?” বললেন অ্যাবিস।

“নিশ্চয়,” জারিনা জবাব দিলেন। তারা এটাকে বলে জাদুর পাহাড়। তুমি তো জানোই, এই পার্বত্য অঞ্চলটি জিওর জন্মের সময় থেকে মিস্টিক্যাল কাল্ট হিসেবে পরিচিত একটি গোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিলো। সেলটিক জাতি ওখান থেকেই ব্রিটানিতে এবং অবশেষে বৃটিশ আইলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এই অঞ্চল থেকেই মার্লিন দ্য ম্যাজিশিয়ান এসেছিলো, বর্তমানে দ্রুইদ নামে আমরা যে সিক্রেট কাল্টকে চিনি তারাও এসেছিলো ওখান থেকেই।”

“আমি অবশ্য এতোটা জানতাম না,” বললেন অ্যাবিস। নীচের ঠোঁট জোড়া। কামড়ে ধরে আছেন তিনি, চোখেমুখে একধরণের কাঠিন্যতা।

“তুমি এটা জার্নালে পাবে,” বললেন সম্রাজ্ঞি। “রিশেলু দাবি করেছেন মুররা নাকি এই অঞ্চলটা দখল করে নেবার পর শতশত বছর ধরে সেল্ট আর বাস্কদের। সুরক্ষিত করে রাখা ভয়ানক একটি সিক্রেট সম্পর্কে জেনে যায়। এইসব মুরিশ বিজয়ীরা এক ধরণের কোড আবিষ্কার করে সেটাকে লিপিবদ্ধ করে রাখে। এই সিক্রেটা তারা মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন খুঁটির স্বর্ণ আর রূপার নক্সার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। মুররা যখন বুঝতে পারে ইবারিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তাদের ক্ষমতা হাতছাড়া হতে যাচ্ছে তখন তারা দাবাবোর্ডটি শার্লেমেইনের কাছে পাঠিয়ে দেয়, তাকে তারা খুব শ্রদ্ধা করতো। তারা মনে করেছিলো সভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে ক্ষমতাবান শাসক হিসেবে শার্লেমেইনই পারবেন এটার সুরক্ষা দিতে।”

“তুমি এই গল্পটা বিশ্বাস করো?” হার্মিটেজের বিশাল প্রাঙ্গনে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন অ্যাবিস।

“তুমি নিজেই সেটা বিচার করে দেখো,” বললেন ক্যাথারিন। “আমি জানি সিক্রেটটা মুর কিংবা বাস্কদের চেয়েও প্রাচীন। দ্রুইদদের চেয়েও সেটার বয়স অনেক বেশি। বন্ধু, তোমাকে কি আমি জিজ্ঞেস করতে পারি ম্যাসন নামের পুরুষদের একটি সিক্রেট সোসাইটির নাম শুনেছো কিনা?”

অ্যাবিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় তিনি থমকে দাঁড়ালেন। “তুমি কি বললে?” ক্ষীণকণ্ঠে বললেন তিনি, খপ করে ধরে ফেললেন বান্ধবীর হাতটা।

“আহ,” বললেন ক্যাথারিন। “তাহলে তুমি জানবে এটা সত্যি। পাণ্ডুলিপিটা পড়ার পর আমি তোমাকে আমার গল্পটা বলবো।”

সম্রাজ্ঞির গল্প

আমার বয়স যখন চৌদ্দ তখন আমি আমার জন্মস্থান পোমারানিয়া ছেড়ে চলে আসি, যেখানে তুমি আর আমি একসাথে বেড়ে উঠেছি। তোমার বাবা সেসময় আমাদের পাশে যে এস্টেটটা ছিলো সেটা বিক্রি করে দিয়ে তার মাতৃভূমি ফ্রান্সে ফিরে গেছেন। আমি যে খুব শীঘ্রই রাণী হতে চলেছি সেই সুখবরটা তোমার সাথে ভাগাভাগি করে নেবার আনন্দ লাভ করতে পারি নি। এটা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না।

ঐ সময় জারিনা এলিজাবেথ পেত্রোভানার সাথে দেখা করার জন্য মস্কোতে চলে যাই আমি। এলিজাবেথ ছিলেন পিটার দ্য গ্রেটের কন্যা, তিনি রাজনৈতিক কু করে ক্ষমতা দখলে নিয়ে সমস্ত বিরোধীদেরকে বন্দী করে রেখেছিলেন জেলখানায়। যেহেতু তিনি বিয়েথা করেন নি, আর বাচ্চা নেবার মতো বয়সও। পেরিয়ে গিয়েছিলো তাই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার রহস্যময় ভাতিজা গ্র্যান্ড ডিউক পিটারকে। আমি তারই স্ত্রী হতে যাচ্ছিলাম।

রাশিয়ায় যাবার পথে আমি আর আমার মা বার্লিনে দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের রাজদরবারে বিরতি নেই। প্রুশিয়ার তরুণ সম্রাট ফ্রেডারিক, ভলতেয়ার যাকে ‘মহান’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনি চাইছিলেন বিয়ের মাধ্যমে রাশিয়া আর প্রুশিয়ার একত্রিকরণ করতে, আর সেই কাজ করার জন্যেই পেতে চাইছিলেন আমাকে। ফ্রেডারিকের নিজের বোনের চেয়ে আমি ছিলাম অধিকতর পছন্দের, কারণ তিনি তার বোনকে এরকম ভাগ্যের কাছে বলি দিতে পারছিলেন না।

ঐ সময়টাতে প্রশিয়ান রাজদরবারে অসংখ্য মেধাবী লোকজন ছিলো। আমি ওখানে যাওয়ামাত্র ম্রাট আমাকে মুগ্ধ করার জন্য সাধ্যমতো অনেক কিছুই করেছিলেন। তিনি তার বোনদের গাউন আমাকে পরতে দিলেন, প্রত্যেক রাতে ডিনারের সময় নিজের পাশে বসাতেন আমাকে, অপেরা আর ব্যালের গল্প বলে আমাকে আমোদিত করতেন। আমার বয়স অনেক কম হলেও আমি এসবে বিমোহিত হই নি। ভালো করেই জানতাম বিরাট একটা খেলায় তিনি আমাকে দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। এটা এমন একটা খেলা যা খেলা হবে ইউরোপ নামক একটি দাবাবোর্ডে।

কিছুদিনের মধ্যেই আমি জানতে পারলাম প্রুশিয়ান রাজদরবারে এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন যিনি দশ বছর রাশিয়ায় থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি ছিলেন সম্রাট ফ্রেডারিকের সভা-গণিতজ্ঞ, তার নাম লিওনহার্ড ইউলার। আমি বেশ সাহসের সাথেই অনুরোধ করলাম তার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাই, জানতে চাই সেই দেশটা সম্পর্কে যেখানে খুব শীঘ্রই আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি।

আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় বার্লিনের রাজদরবারের ছোট্ট একটি কক্ষে। এই সাদাসিধে আর অসাধারণ পণ্ডিত লোকটি এমন এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে পরিচিত হলেন যে খুব শীঘ্রই রাণী হতে যাচ্ছে। উনি ছিলেন বেশ লম্বা আর হালকাঁপাতলা গড়নের, একজোড়া কালো গভীর চোখ আর তীক্ষ্ণ নাক। আমার দিকে কেমন এক পাশ ফিরে তাকালেন। বললেন, সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার একচোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ইউলার নিজে গণিতজ্ঞের পাশাপাশি একজন জ্যোতির্বিদও ছিলেন।

“কথা বলার ব্যাপারে আমি খুব একটা অভ্যস্ত নই,” তিনি বলতে শুরু করলেন। “আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি যেখানে কথা বললে আপনাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।” এ হলো রাশিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জ্ঞানলাভ। তোমাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, পরবর্তী সময়ে এটা আমাকে বেশ ভালো কাজে দিয়েছিলো। তিনি আমাকে বলেছিলেন, জারিনা এলিজাবেথ পেট্রোভানার পনেরো হাজার পোশাক আর পঁচিশ হাজার জোড়া জুতো রয়েছে। তিনি যদি কখনও তার মিনিস্টারদের সাথে কোনো রকম দ্বিমত পোষণ করেন কিংবা কারো কথা অপছন্দ করেন তখন তার মাথা লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারেন, সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন ফাঁসিকাষ্ঠে। তার প্রেমিকেরা প্রায় সবাই সেনাবাহিনীর লোক। সম্রাজ্ঞির যৌনতার চেয়ে মদ্যপান চলে আরো অধিকহারে। নিজের মতের বিরুদ্ধে কোনো মতামত তিনি সহ্য করতে পারেন না।

 প্রাথমিক জড়তা কেটে যাবার পর ডক্টর ইউলার আর আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমরা একে অন্যকে বেশ পছন্দও করতে শুরু করি। তিনি স্বীকার করেন, আমাকে বার্লিন রাজসভায় গণিতের একজন ছাত্রি হিসেবে রেখে দিতে উদগ্রীব। তার মতে গণিতে নাকি আমি অনেক ভালো করবো। অবশ্য এটা করা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো।

ইউলার এও স্বীকার করেন, তিনি তার পৃষ্ঠপোষক সম্রাট ফ্রেডারিককে খুব একটা পাত্তা দেন না। ফ্রেডারিকের দূর্বল গণিতজ্ঞান ছাড়াও অনেক সঙ্গত কারণ। ছিলো। বার্লিনে আমার শেষদিনে ইউলার তার কারণটা আমাকে জানিয়েছিলেন।

“আমার ছোট্ট বন্ধু, তাকে বিদায় জানাতে তার ল্যাবরেটরিতে ঢুকতেই তিনি আমায় বললেন। আমার মনে আছে তিনি সিল্কের কাপড় দিয়ে একটা লেন্স পলিশ করছিলেন। “চলে যাবার আগে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। বিগত কয়েক দিনে আমি আপনাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি বিশ্বাস করি এখন যা বলবো সে ব্যাপারে আপনার উপর আস্থা রাখা যায়। আপনি যদি এই কথাগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে প্রকাশ করে দেন তাহলে আপনার আমার দু’জনের জীবনই মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে।”

আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই ডক্টর ইউলার, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনার কথাটা হেফাজত করবো। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন সেটার হয়তো দরকার হতে পারে।

“আপনার বয়স অনেক কম, আপনি ক্ষমতাহীন, তার উপর আপনি একজন নারী,” বললেন ইউলার। এসব কারণেই ফ্রেডারিক অপসাম্রাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে আপনাকে নির্বাচন করেছে তার একটি হাতিয়াড় হিসেবে। সম্ভবত আপনি জানেন না এই দেশটি বিগত বিশ বছর ধরে অসাধারণভাবেই নারী কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছে : প্রথমে পিটার দ্য গ্রেটের বিধবা স্ত্রী প্রথম ক্যাথারিন; তারপর আইভানের মেয়ে অ্যানা আইভানোভনা; অ্যানা মেকলেনবার্গ, যিনি তার নিজের সন্তান ষষ্ঠ আইভানের কাছ থেকে ভারপ্রাপ্ত সম্রাজ্ঞি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আর এখন ক্ষমতায় আছেন পিটারের কন্যা এলিজাবেথ পেত্রোভনা। আপনি যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তাহলে নিজেকে মারাত্মক বিপদের মধ্যে নিপতিত করবেন।”

দ্রলোকের কথা চুপচাপ শুনে গেলাম আমি। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আসলে তার দু’চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।

“পুরুষদের একটা সিক্রেট সোসাইটি আছে, তারা মনে করে সভ্যতার পরিক্রমা বদলে দেয়াই তাদের কাজ,” ইউলার আমাকে বললেন। আমরা বসেছিলাম তার ল্যাবরেটরির মাঝখানে, আমাদের চারপাশে ছিলো অসংখ্য টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, মোটা মোটা বই-পুস্তক আর স্তূপ করে রাখা কাগজপত্র। এইসব লোকেরা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তারা হলো আধ্যাত্মবাদী। তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা জানি সেটা আপনাকে বলছি, এটা হয়তো আপনার জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

“১২৭১ সালে ইংল্যান্ডের যুবরাজ, তৃতীয় হেনরির ছেলে এডওয়ার্ড ক্রুসেড লড়ার জন্য উত্তর-আফ্রিকার উপকূলে যান। জেরুজালেম শহরের কাছে একর নামের একটি জায়গায় অবতরণ করেন তিনি। সেখানে তিনি কী করেছেন না। করেছেন সে ব্যাপারে আমরা খুব একটা জানি না। শুধু জানি বেশ কয়েকটি লড়াই করেছিলেন, ওখানকার সম্প্রদায়ের শাসক মুসলিম মুরদের সাথেও দেখা হয়েছিলো তার। পরের বছরই তার বাবার মৃত্যুর কারণে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। ফিরে এসেই তিনি হয়ে যান ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড। বাকিটা ইতিহাসের বইতেই পাবেন। কিন্তু যেটা পাবেন না সেটা হলো আফ্রিকা থেকে তিনি কি নিয়ে এসেছিলেন।”

“সেটা কি?” আমি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম।

“এক মহান সিক্রেট জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এমন একটা সিক্রেট যা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই ছিলো,” ইউলার জবাবে বললেন। “তবে আমার গল্পটা তার পরের ঘটনা।

“ফিরে আসার পর কিং এডওয়ার্ড ইংল্যান্ডে একটি সোসাইটি গঠন করে সেখানে তিনি তার সিক্রেটটা শেয়ার করেন। তাদের ব্যাপারে আমরা খুব কমই জানি, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের গতিবিধি অনুসরণ করতে পারি আমরা। স্কটল্যান্ড অধিগ্রহণ করার পর আমরা জানতে পারি এই সোসাইটি সেখানেও বিস্তার লাভ করেছিলো। বেশ দীর্ঘদিন সেখানে চুপচাপ ছিলো তারা। এই শতকে জ্যাকোবাইটরা যখন স্কটল্যান্ড থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে আসে তখন তারা সোসাইটিটিও সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। ফ্রান্সে এসে তারা এর শিক্ষা দিতে। শুরু করে। ইংল্যান্ডে সোজানের সময়কালে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি মতেস্কু এই মতবাদে দীক্ষিত হন। তার সহায়তায়ই ১৭৩৪ সালে প্যারিসে স্থাপিত হয় লগি দে সায়েন্সে। তার চার বছর পর, আমাদের প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক সিংহাসনে। অধিষ্ঠিত হবার আগে, ব্রুন্সউইকে অবস্থিত এই সোসাইটিতে দীক্ষিত হন। একই বছর, পোপ দ্বাদশ ক্লেমেন্ট এই সোসাইটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটা বিল ইসু করেন। এটা এখন ইতালি, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের মতো নীচুভূমিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। তখন ঐ সোসাইটি এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে ক্যাথলিক ফ্রান্সের পালামেন্ট পোপের এই আদেশ রেজিস্টার করতে অস্বীকৃতি জানায়।”

“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন?” ডক্টর ইউলারকে জিজ্ঞেস করলাম। এইসব লোকের লক্ষ্য সম্পর্কে যদি আমি অবগতও হই তাতে আমার কি এসে যায়? এ ব্যাপারে আমি কীইবা করতে পারবো? যদিও আমার অনেক কিছু করার আকাঙ্খা আছে, কিন্তু আমি তো এখন নিতান্তই একজন বালিকা।”

“তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে আমি যতোটুকু জানি,” আস্তে করে বললেন ইউলার, “তাতে নিশ্চিত বুঝতে পারছি, এই লোকগুলোকে যদি পরাস্ত না করা যায় তাহলে তারাই সমগ্র দুনিয়াকে পরাস্ত করে ফেলবে। আজ হয়তো আপনি অল্পবয়সী এক বালিকা মাত্র, কিন্তু খুব শীঘ্রই রাশিয়ার জারপত্নি হবেন, বিগত দু’দশকের মধ্যে ঐ সাম্রাজ্যের প্রথম পুরুষ শাসকের স্ত্রী। আমি যা বলবো সেটা আপনার শোনা উচিত, তারপর ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন নাকি ভাববেন না সেটা আপনার অভিরুচি।” আমার হাতটা ধরলেন তিনি।

“কখনও কখনও এইসব লোক নিজেদেরকে ম্যাসন ভ্রাতৃসংঘ কিংবা রসিকুশিয়ান বলে অভিহিত করে। তারা নিজেদের জন্য যে নামই বেছে নিক না কেন, তাদের মধ্যে একটা জিনিস কমন। তাদের উৎপত্তি উত্তর-আফ্রিকায়। যুবরাজ এডওয়ার্ড যখন পশ্চিমের মাটিতে এই সোসাইটি স্থাপন করেন তখন এটার নাম দেন দ্য অর্ডার অব দি আর্কিটেক্টস অব আফ্রিকা। তারা মনে করে তাদের পূর্ব-পুরুষেরা ছিলো প্রাচীন মিশরের পিরামিড আর পাথর খোদাই করে নির্মাণ কাজের স্থপতি। তারাই ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান, বাবেল গেট আর টাওয়ার বানিয়েছে। তারা প্রাচীনকালের রহস্যগুলো জানে। তবে আমি বিশ্বাস করি তারা অন্য একটা জিনিসের স্থপতি, এটা অনেক বেশি সাম্প্রতিক আর আগের যেকোনো কিছুর তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাশালী…”

ইউলার একটু থেমে আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলেন সেটা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না। আজো সেই চাহনি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেনো পঞ্চাশ বছর আগে নয়, এটা ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। এচণ্ড ভীতির সাথে আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, আমার কানে ফিসফিস করে বলা কথাগুলো, তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এখনও টের পাই, মনে হয় তিনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছেন :

“আমার বিশ্বাস তারা মন্তগ্লেইন সার্ভিসেরও স্থপতি। নিজেদেরকে তারা এর যথার্থ উত্তরাধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে।”

.

গল্পটা বলা শেষ হলে ক্যাথারিন আর অ্যাবিস নির্বাক হয়ে বসে রইলেন হার্মিটেজের বিশাল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরিতেই আছে ভলতেয়ারের জানালগুলো। ত্রিশ ফুট উঁচু দেয়ালজুড়ে এই লাইব্রেরিতে রয়েছে অসংখ্য বই পুস্তক আর দলিল-দস্তাবেজ। বেড়াল যেমন ইঁদুরের দিকে তাকায় ঠিক সেভাবে অ্যাবিসের দিকে তাকালেন ক্যাথারিন। লাইব্রেরির বিশাল জানালা দিয়ে অ্যাবিস চেয়ে আছে বাইরে। রাজকীয় বৃক্ষীটি সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে। আছে।

“আমার প্রয়াত স্বামী, নরম কণ্ঠে বললেন ক্যাথারিন, “প্রুশিয়ার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। পিটার্সবার্গের রাজদরবারে প্রশিয়ার তৈরি একটি ইউনিফর্ম পরতেন পিটার। আমাদের বাসররাতে তিনি প্রুশিয়ার সৈন্যের খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন বিছানায়, আমাকে দিয়ে সেগুলো ড্রিলও করিয়েছিলেন। ফ্রেডারিক যখন অনেকটা জোর করেই ফ্রম্যাসন অর্ডারকে প্রুশিয়ায় নিয়ে আসেন তখন পিটার সেই দলে যোগ দেন, প্রতিজ্ঞা করেন আজীবন তিনি তাদের সমর্থন দিয়ে যাবেন।”

“আর এ কারণেই তুমি তোমার স্বামীকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে ভরে রাখলে, তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে,” বললেন অ্যাবিস।

উনি খুবই বিপজ্জনক রকমের ম্যানিয়াক হয়ে উঠেছিলেন,” বললেন। ক্যাথারিন। “তবে তার মৃত্যুর সাথে আমি সরাসরি জড়িত নই। ছয় বছর পর ১৭৬৮ সালে সিলেসিয়াতে আফ্রিকান আর্কিটেক্টদের জন্যে একটি লজ নির্মাণ করেন ফ্রেডারিক। সুইডেনের রাজা গুস্তাভাস এই দলে যোগ দেন, মারিয়া টেরেসা অস্ট্রিয়া থেকে এইসব জঘন্য লোকদেরকে বের করে দেবার অনেক প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও দেখা গেলো তার নিজেরই ছেলে দ্বিতীয় জোসেফ ওই সোসাইটিতে যোগ দিয়ে বসে আছে। এসব কথা জানার পর পরই আমি দেরি না করে আমার পুরনো বন্ধু ডক্টর ইউলারকে রাশিয়ায় নিয়ে আসি।

 “তিনি ততোদিনে বেশ বয়স্ক হয়ে গেছেন, তার দু’চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার দিব্যজ্ঞান একটুও কমে নি। ভলতেয়ার মারা গেলে ইউলারই আমাকে তার লাইব্রেরটিটা কিনে নেয়ার জন্য তাগিদ দেন। ওই লাইব্রেরিতে এমন কিছু দলিল-দস্তাবেজ ছিলো যা ফ্রেডারিক দি গ্রেট মরিয়া হয়ে পেতে চাইছিলেন। লাইব্রেরিটা কিনে পিটার্সবার্গে নিয়ে আসার পর আমি এসব জানতে পারি। এগুলো তোমাকে দেখানোর জন্য রেখে দিয়েছি।”

 ভলতেয়ারের পাণ্ডুলিপি থেকে একটা পার্চমেন্টের ডকুমেন্ট বের করে অ্যাবিসের কাছে দিলেন সম্রাজ্ঞি, সাবধানে সেটার ভাঁজ খুললেন তিনি। ভলতেয়ারকে লেখা প্রশিয়ার অস্থায়ী সম্রাট যুবরাজ ফ্রেডারিকের একটি চিঠি। যে বছর ফ্রেডারিক ম্যাসনে ঢুকেছিলেন ঠিক সেই বছরের তারিখে লেখা :

মঁসিয়ে, আপনার সমস্ত লেখা আমার কাছে থাকবে এরচেয়ে বড় কোনো আকাঙ্খা আমার নেই…এরমধ্যে যদি কোনো

পাণ্ডুলিপি আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চান, আমিও সেগুলোকে গোপন রাখতে বদ্ধপরিকর হবো…

কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন অ্যাবিস। তার দুচোখ উদাসী, উঠলো। আস্তে করে চিঠিটা ভাঁজ করে ক্যাথারিনের হাতে তুলে দিলে তিনি সেই আগের জায়গায় রেখে দিলেন।

“এটা কি পরিস্কার নয়, তিনি আসলে ভলতেয়ারের করা রিশেলুর ডায়রিটার সাংকেতিক ভাষা উদ্ধারের কথা বলছেন?” সম্রাজ্ঞি জানতে চাইলেন। ৯ সিক্রেট সোসাইটিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি এই তথ্যটা পাবার চেষ্টা করে গেছেন। এখন হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে…”

চামড়ায় বাধানো আরেকটা ভলিউম তুলে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে নির্দিষ্ট একটি পৃষ্ঠায় এসে থামলেন ক্যাথারিন। বহুদিন আগে যে কথা কোডের আকারে লিখে গেছেন কার্ডিনাল রিশেলু সেটা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন অ্যাবিসকে :

অবশেষে প্রাচীন ব্যাবিলনিয়াতে যে সিক্রেটটা আবিষ্কৃত হয়েছিলো সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। এই সিক্রেটটা পারস্য আর ভারতীয় সাম্রাজ্যেও পরিবাহিত হয়েছিলো। কেবলমাত্র মনোনীত করা হাতেগোণা কিছু লোকই সেটা জানতো, সেই সিক্রেটটা হলো মন্তগ্লেইন সার্ভিস। ঈশ্বরের পবিত্র নামের মতো এই সিক্রেটটা কখনও কোনো ভাষায় লেখা হয় নি। এই সিক্রেটটা এমনই শক্তিশালী যে সভ্যতার পতন কিংবা রাজ-রাজাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। গুপ্তসংঘে দীক্ষিত হওয়া ছাড়া কেউ এটা জানতে পারে না। যারা দীক্ষিত হয়েছে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়, তারপর নিতে হয় শপথ। এই জ্ঞান এতোটাই মারাত্মক যে সিক্রেট সোসাইটির শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য কাউকে এর হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হয় না। আমার বিশ্বাস, এই সিক্রেটটি ফর্মুলার আকারে রাখা হয়েছে, আর এই ফর্মুলাই সর্বকালের সব সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। আমাদের বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে রূপকথা। সিক্রেট জ্ঞানে দীক্ষিত হওয়া এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও মুররা এই ফর্মুলাটিকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসে লিপিবদ্ধ করে গেছে। তারা পবিত্র সিম্বলগুলো দাবাবোর্ডের বর্গ আর খুঁটির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, এই ফর্মুলার চাবি পাবে কেবলমাত্র এই খেলাটার একজন মাস্টার, সে-ই পারবে তালাটা খুলতে। অনেকগুলো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি এই ধারণায় উপনীত হয়েছি। এই পাণ্ডুলিপিগুলো জোগার করা হয়েছে শালোয়া, সয়সোয় আর তুর থেকে, তারপর আমি নিজে সেগুলো অনুবাদ করেছি।

ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন
ইসি সিগনাম,
আরমান্দ আঁ দুপ্লেসিস,
দুক দ্য রিশেলু, লুকোন, পইতু এবং প্যারিসের যাজক,
রোমের কার্ডিনাল
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী
১৬৪২ খৃস্টাব্দ

“এই মেমোয়া থেকে,” পড়া শেষ করে নিশ্চুপ হয়ে থাকা অ্যাবিসকে বললেন ক্যাথারিন, “আমরা জানতে পারি ‘আয়রন কার্ডিনাল’ মন্তগ্লেইন দেখার জন্যে খুব শীঘ্রই ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ঐ বছরের ডিসেম্বরেই তিনি মারা যান রুজিয়ে’তে বিদ্রোহ দমন পরিত্যাগ করার পর। আমরা কি এক মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করতে পারি, তিনি এইসব সিক্রেট সোসাইটিগুলোর অস্তিত্ত্বের ব্যাপারে অবগত ছিলেন, কিংবা অন্য কারোর হাতে পড়ার আগেই মন্তগ্লেইন সার্ভিসটি হস্তগত করতে চেয়েছিলেন? তিনি যা কিছুই করেছেন ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যেই করেছেন। তাহলে তিনি কেন পরিপক্ক হবার পর বদলে যাবেন?”

“মাই ডিয়ার ফিগচেন,” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। তবে এইসব কথা শুনে তার মনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটা এই হাসিতে প্রকাশ পেলো না। “তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু এইসব লোকজন এখন মৃত। তারা তাদের জীবকালে হয়তো এটা খুঁজেছে, কিন্তু পায় নি। তুমি নিশ্চয় বলতে চাচ্ছো না মৃতলোকগুলোর ভুত নিয়ে তুমি ভয়ে আছো?”

 “ভুত কিন্তু পুণরায় জেগে উঠতে পারে!” দৃঢ়ভাবে বললো ক্যাথারিন। “পনেরো বছর আগে আমেরিকার বৃটিশ কলোনিটি উচ্ছেদ করেছে এক অপশক্তি। এতে যারা জড়িত ছিলো তারা কারা? জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামের কিছু লোক-তারা সবাই ম্যাসন! আর এখন ফ্রান্সের রাজা জেলে বন্দী হয়ে আছেন, তার মুকুটের সাথে সাথে মুণ্ডুটাও কাটা যাবে খুব শীঘ্রই। এসবের পেছনে কারা আছে? লাফায়েত, কোদোর্সে, দাঁতোয়াঁ, দেমোলাঁ ব্রিসোয়ে, সিয়ে, আর রাজার নিজের ভায়েরা, যার মধ্যে দুইদোর্লিও আছে-তারাও সবাই ফ্রম্যাসন!”

“একটা কাকতালীয়-” অ্যাবিস পুরো কথাটা বলতে পারলেন না, মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিলেন ক্যাথারিন।

“এটাও কি কাকতালীয় ঘটনা, বিল অব সিজার পাস করার জন্য আমি যাদেরকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজনই আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলো আর সেই লোকটা ছিলো মিরাবু-সেও একজন ফ্রম্যাসন? সে যখন ঘুষটা নিয়েছিলো তখন অবশ্য জানতো না আমি তাকে সম্পদটা করায়ত্ত করতে বাধা দেবার পরিকল্পনা করেছিলাম।”

 “আঁতুয়ার বিশপ ঘুষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন?” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। “তিনি কি কারণ দেখিয়েছিলেন?”

 “রাজি হবার জন্য সে যে পরিমাণ টাকা চেয়েছিলো তা ছিলো অনেক বেশি,” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন সম্রাজ্ঞি, আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “ঐ লোকটা যা জানে তারচেয়ে অনেক বেশি জানাতে চেয়েছিলো আমাকে। তুমি কি জানো, অ্যাসেম্বলিতে তাকে কি নামে ডাকা হয়?-আঙ্কারার বেড়াল। মেনি বেড়ালের মতো সে মিউমিউ করে ঠিকই কিন্তু তার রয়েছে। শক্তিশালী থাবা। তাকে আমি বিশ্বাস করি না।”

“তুমি যে লোককে ঘুষ দিতে সক্ষম হয়েছে তাকে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু যাকে দিতে পারো নি তাকে অবিশ্বাস করছো?” বললেন অ্যাবিস। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে বান্ধবীর দিকে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, যেনো চলে যাবেন এক্ষুণি।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” জারিনা আর্তনাদ করে উঠলেন। “তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি কেন এসব করেছি? আমি তোমার কাছে আমার সুরক্ষা চাইছি। এই পৃথিবীর সবচাইতে বিশাল সাম্রাজ্যের একমাত্র শাসক আমি। আমি আমার ক্ষমতা তোমার হাতে অর্পণ করেছি…”

 “সোফিয়া, শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস, “তোমার প্রস্তাবের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, তবে তুমি এইসব লোকদের যতোটা ভয় পাচ্ছো আমি ততোটা পাচ্ছি না। তুমি যেমনটি দাবি করেছে, আমিও তাই বিশ্বাস করি, এই লোকগুলো আধ্যাত্মবাদী, হয়তো বিপ্লবীও হতে পারে। এই যে সিক্রেট সোসাইটিগুলো তুমি এতো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কিন্তু তোমার দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ে নি।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?” বললেন সম্রাজ্ঞি। “তাদের কাজকারবারে এটা তো একদম পরিস্কার, তারা রাজতন্ত্রকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চায়। এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন করা ছাড়া আর কি চাইতে পারে তারা?”

“সম্ভবত তাদের লক্ষ্য হলো এ বিশ্বকে মুক্ত করা।” হেসে বললেন অ্যাবিস। “এ মুহূর্তে আমার কাছে খুব বেশি প্রমাণ নেই যে অন্য কিছু বলবো, তবে এ কথা বলার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে : তোমার হাতের রেখায় যে নিয়তি লেখা রয়েছে সেটার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছো তুমি-তোমার হাতে রয়েছে তিনটি রাজমুকুট। তবে আমাকেও আমার নিজের নিয়তি অনুযায়ী কাজ করতে হবে।”

 অ্যাবিস তার হাতটা বান্ধবীর দিকে তুলে ধরলেন। তার হাতের তালুতে, কব্জির কাছে আয়ুরেখা এবং ভাগ্যরেখা ইংরেজি ৪ সংখ্যার মতো পেচিয়ে আছে। শীতল আর নির্বাক হয়ে তাকালেন ক্যাথারিন, তারপর সেই রেখা দুটোর উপর। আলতো করে আঙুল বুলালেন।

“তুমি আমার সুরক্ষা দিতে চাইছে,” আস্তে করে বললেন তিনি। কিন্তু তোমার চেয়ে বড় কোনো শক্তি আমার সুরক্ষা দিচ্ছে।”

“আমি জানতাম এটা!” কর্কশস্বরে বলে উঠলেন ক্যাথারিন। “তোমার এতোসব কথা বলা কারণ একটাই : আমাকে না জানিয়ে তুমি অন্য আরেকজনের সাথে আঁতাত করেছে! কে সে, যার প্রতি তুমি বিভ্রান্ত হয়ে আস্থা রেখেছো? তার নামটা আমাকে বলো! আমাকে সেটা বলতেই হবে!”

“খুশিমনেই বলবো।” হেসে বললেন অ্যাবিস। “যিনি আমার হাতের এই রেখাটা এঁকে দিয়েছেন। আর এই সাইন বলছে আমিই নিরঙ্কুশ রাজত্ব করবো। তুমি হতে পারো রাশিয়ানদের শাসক, মাই ডিয়ার ফিগচেন, তবে দয়া করে ভুলে যেও না আমি কে। আর কে আমাকে মনোনীত করেছেন। মনে রেখো, ঈশ্বর হলেন সবচাইতে বড় দাবা খেলোয়াড়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *