কুঁদপুরের বাঘ – লীলা মজুমদার
কলকাতা থেকে রওনা হয়ে যদি কেউ নৌকা করে, আস্তে আস্তে, থামতে থামতে, এই ধর শীতের সময়, কিংবা শীতের ঠিক আগেই, বা ঠিক পরেই, একেবারে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যায়, তাহলে তার এমন সব অভিজ্ঞতা হবার সম্ভাবনা আছে, যার ফলে সে আর আগের মানুষ থাকবে না। বড়ো বড়ো তীর্থস্থানের কথা বলছি না; সেখানে গেলে কেউ বদলায় না। ছোটো ছোটো জায়গায় যেতে হবে, ডায়মণ্ডহারবার আর ফ্রেজারগঞ্জ ছাড়িয়ে যাবার পর। ফ্রেজারগঞ্জ পর্যন্ত কলকাতার দৌড়; তারপর থেকেই জায়গাটা বদলাতে শুরু করে।
৩০০ বছর আগেও অবিশ্যি কলকাতা পর্যন্ত তার বিস্তার ছিল। চেরাঙ্গীবাবার বনের মধ্যে দিয়ে কালীঘাট যাবার পথে বাঘ এসে প্রায়ই দু-চারটে তীর্থযাত্রী ধরে নিয়ে যেত। গঙ্গাসাগর পৌঁছোবার আগেই যদি অন্ধকার হত, তো মাঝগাঙে নৌকা নোঙর করে রাত কাটাতে হত। নৌকাতে একটা বড়ো মশাল সারারাত জ্বলত। বনের জানোয়ার আগুনকে যেমন ভয় করে, তেমন আর কিছুকে নয়। তবু নাকি এক একটা দুঃসাহসিক বাঘ সাঁতার কেটে, নৌকা থেকে মানুষ টেনে নিয়ে যেত।
আমার পঞ্চুকাকা পোর্ট কমিশনারে লঞ্চে কাজ করতেন, তাঁর কাছে নানান রোমাঞ্চকর গল্প শুনতাম। একবার আমাদের পাশের বাড়ির ঠানদিদি এইসব গল্প বলার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি হঠাৎ বলে বসলেন, ‘তা হতে পারে, কিন্তু ওগুলো সত্যি বাঘ নয়। সত্যি বাঘ বেড়ালের মতো। ওরা জল পছন্দ করে না।’
পঞ্চুকাকা বিরক্ত হলেন। ‘আপনি এত কথা কী করে জানলেন? তা ছাড়া সত্যি বাঘ নয়তো কি কেউ বাঘ সেজে আসে নাকি?’
ঠানদিদি বললেন, ‘কুঁদপুরে আমার বাপের বাড়ি, আমি জানব না তো কে জানবে বলো? কেউ বাঘ সাজে না; বাঘ সাজতে পয়সা লাগে, ওরা কেউ চারটে পয়সারও মালিক নয়। বাঘ সাজে না কেউ! বাঘ হয়ে যায়।’
তাই শুনে সকলে খুব হেসেছিল। ঠানদিদি চারদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি, বিশ্বাস হল না বুঝি? কতটুকুই বা জানো তোমরা। কুঁদপুরের ছোটো ছেলেরাও তার চেয়ে বেশি জানে। আমাদের গাঁয়ে সুন্দর রায়ের মন্দির আছে। হাজার বছরের পুরোনো। সুন্দর রায়ের মন্দিরে মূর্তি থাকে না, কিন্তু রোজ পুজো দিতে হয়। তাঁর বেজায় দাপট। তিনি যেমন বাঘদের দেশের মানুষদের দেবতা, তেমনি বাঘদেরও দেবতা। কাজেই সেখানকার মানুষ যে বাঘ হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?’
‘কিন্তু মানুষের বাঘ হওয়ার চেয়েও ঢের বেশি ভয়াবহ ব্যাপার বাঘের মানুষ হওয়া। কারণ তাকে চেনা যায় না। মানুষ বাঘ বেজায় বেঘো হয়। কিন্তু বাঘ-মানুষ পরম সাত্ত্বিক হয়।’
বলা বাহুল্য, ঠানদিদির কথা শুনে আমরা একেবারে থ! ঠানদিদি বলে চললেন, ‘আজকাল তোমাদের বৈজ্ঞানিকরা কলের মানুষ বানিয়ে তাদের দিয়ে হিসাব কষিয়ে তোমাদের তাক লাগিয়ে দেয়! আমার কিন্তু হাসি পায়। ছোটোবেলায় আমাদের গাঁয়ে হামেশাই যা হতে দেখেছি সেসব কথা বললে তোমাদের পিলে চমকে যাবে।’
অমনি সবাই চ্যাঁচাতে লাগল, ‘বলুন, বলুন।’
ঠানদিদি আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন।
‘মনে থাকে যেন, এসব আমার খুব ছোটোবেলার কথা, কাজেই কিছু কিছু ভুলও হতে পারে। আমাদের পাশের বাড়িতে সুন্দর রায়ের পুরুত ঠাকুর থাকতেন। ওই মাছ-মকরের দেশ, যেখানে রুই-কাতলাকে লোকে নিরামিষ বলে, নালা-নর্দমাতে হাত গলালেই এই বড়ো বড়ো বাগদা উঠে আসে; সেইখানে ওই বুড়ো স্বপাকে হবিষ্যি রেঁধে খেতেন। তাঁর একটা ছোটো শাকের খেত ছিল। তিনি নিজে সেটার দেখাশুনো করতেন।’
একদিন সন্ধ্যেবেলায় পুজো সেরে বাড়ি ফিরছেন, দেখেন একটা বাঘ তাঁর শাকের খেতে ঢুকেছে। পুরুত ঠাকুরের কিন্তু ব্যাপার বুঝতে বাকি রইল না। অমনি তিনি মশাল হাতে বাঘের দিকে তেড়ে গেলেন। বাঘ একবার তাঁর দিকে তাকিয়েই এক দৌড়ে তাঁর গোয়ালঘরে গিয়ে ঢুকল। গোয়ালঘরে পুরুত ঠাকুরের বদমেজাজি বুড়ো বলদ থাকত। পুরুত ঠাকুর অমনি মুচকি হেসে গোয়ালঘরের লোহার আগল তুলে দিয়ে এলেন। তাঁর ঘর নিকোতো পাদুর বউ; সে তো কান্ড দেখে অবাক। উঠিপড়ি করে গাঁয়ে গিয়ে খবরটা রটাতে তার বেশি সময় লাগেনি। পরদিন সকালে গোয়ালঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে সবাই দেখে বুড়ো বলদ যেমন ছিল তেমনি আছে; বাঘ-ফাগ কিছু নেই। পাদুর বউ গোয়ালঘরের দোর খুলে গোবর বের করে, ঘর-উঠোন নিকিয়ে, পুরুত ঠাকুরের রান্নার কাঠ জড়ো করে রেখে বাড়ি চলে গেল।
গাঁয়ে গিয়ে শুনল হরু গয়লার ছেলে নাকি পুরুত ঠাকুরের বাড়ি থেকে দুটো শাক তুলেছিল বলে, পুরুত তাকে গোয়ালঘরে বন্ধ করে ‘নেই’ করে দিয়েছে। হরু গঞ্জে গিয়ে নালিশ করেছে। মামলার দিন গাঁসুদ্ধু সব মজা দেখতে গেল। পাদুর বউ যেচে গিয়ে সাক্ষী দিল যে হরুর ওই ড্যাকরা ছেলেকে পুরুত মোটেই কিছু করেনি, গোয়ালে একটা বাঘকে বন্ধ করেছিল।
হাকিম বললেন, ‘কোথায় সে বাঘ? তাকে দেখাও।’
পাদুর বউ বলল, ‘সে তো দেখলাম নেই।’
হরু কেঁদে পড়ল, ‘ওই তো হল, ধর্মাবতার, আমার ছেলে আর বাঘ কি আলাদা হল নাকি?’
হাকিম ছিলেন সায়েব। তিনি মুখ্যু গ্রামের লোকদের কথা শুনে মহা রেগেমেগে কেস বাতিল করে দিলেন। তারপর গাঁয়ের মাতব্বরদের খুব বকাবকি করলেন। হাকিমের সময়ের কি দাম নেই নাকি? আর এই বেচারা ভদ্রলোক, পুজো করে দিন কাটান, এঁকে এমন হেনস্থা করবার মানেটা কি? ওই হরুকেই সাজা দেওয়া উচিত ছিল। মানুষ কখনো বাঘ হয়? নাকি বাঘ মানুষ হয়? যত সব মুখ্যু কোথাকার—কি হল?
পুরুত ঠাকুর হঠাৎ রুখে উঠে, হাকিমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘ও-ও মানুষ বাঘ হয় না আর বাঘ মানুষ হয় না, এই তোমার বিদ্যে! গাঁউক!’ এই বলে ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে, ল্যাজ দুলিয়ে, এক লাফে বনের দিকে দৌড় দিলেন। আদালত-সুদ্ধু সকলে সুন্দর রায়ের জয়ধ্বনি দিল। সেই ইস্তক পুরুত-ঠাকুরকে আর কেউ চোখে দেখেনি। আজ পর্যন্ত কুঁদপুরের সুন্দর রায়ের মন্দিরে কোনো পুরুত-টুরুত নেই। গাঁয়ের লোকে মন্দিরে রোজ দু-বেলা প্রদীপ জ্বেলে ফল-ফুল দিয়ে আসে। সুন্দর রায়ের দেশ ওটা, কে বাঘ কে মানুষ কে বলতে পারে? আজকাল নাকি আবার বাঘের চাষ হচ্ছে। শুনলেও হাসি পায়।
এই বলে ঠানদিদি উঠে যাচ্ছিলেন, এমন সময় পঞ্চুকাকা বললেন, ‘তাহলে হরু গয়লার ছেলের কী হল?’
‘কী আবার হবে? তারপরেই একটা চুরির কেস। আসামিকে হাজির করতেই, সক্কলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘ওই যে হরুর ছেলে তুটে! ব্যাটা অ্যাদ্দিন হাজতে ছিল তাহলে।’
পঞ্চুকাকা ছাড়েন না, ‘তাহলে গোয়ালের বাঘটার কি হল?’
‘আরে সেটা কি সত্যি বাঘ ছিল নাকি? পাদুর বউ-এর বরটা নারকেল চুরির হাঙ্গামায় পড়ে গেলে, তার-ও তো একটা গা-ঢাকা দেবার উপায় থাকা চাই।’ এই বলে ঠানদিদি সত্যি সত্যি বাড়ি চলে গেলেন।
পঞ্চুকাকাও উঠে পড়ে বললেন,—‘যত সব গাঁজাখুরি গল্প। তবে ওসব জায়গায় যে অসম্ভব ঘটনা ঘটাও সম্ভব, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’