কী?
লোকে বলত, আটাশ নম্বর হরি বোস স্ট্রিটে যারা বাস করে, তাদের সবাই মানুষ নয়।
আমি কিন্তু মানুষ এবং ওই মেসবাড়িতে আর যাদের সঙ্গে বাস করছি— তারাও আমারই মতন মানুষ।
এর ওর তার কাছে জিজ্ঞাসা করেও সন্দেহজনক বেশিকিছু জানতে পারিনি। রাত্রে মাঝে মাঝে নাকি কোনো ঘরের দরজা অকারণে খুলে যায়। সিঁড়ির ওপরে কাদের পায়ের শব্দ হয়। অন্ধকারে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কয়।
এসব যে ভূতের কীর্তি, মেসের অন্যান্য লোকরাও জোর করে তা বলতে পারলে না। বাজে ভ্রম হতেও পারে, কারণ কেউ চোখে কিছু দেখেনি।
সেদিনটা ছিল মেঘলা। পূর্ণিমাতেও চাঁদ পেয়েছিল ছুটি। বৃষ্টিজল বার বার আকাশের অন্ধকারকে ধুয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু মুছে দিতে পারছিল না।
খাওয়াদাওয়ার পর বসে বসে ভূতের গল্পই হচ্ছিল।
কাহিনিটা রোমাঞ্চকর হলেও নাকি সত্য। কিন্তু গল্প যিনি বলছিলেন, গল্পের ভূতটাকে তিনি স্বচক্ষে দেখেননি— সচরাচর যা হয়ে থাকে। সত্য ভূতের গল্পই শোনা যায়, কিন্তু সত্য ভূত চোখে কেউ দেখে না।
ভূত সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক, কিন্তু ভূতের গল্প শুনলে মনটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে। আমি ভূত মানি না। ভূত কখনো দেখিনি, দেখবার আশাও রাখি না। তবু সেদিন রাতে ঘরের আলো নিবিয়ে যখন বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিলুম, তখন বুকের কাছটা কেমন ছ্যাঁৎ-ছ্যাঁৎ করতে লাগল। মনে হল, ঘরের থমথমে অন্ধকার যেন কেমন একটা অস্বাভাবিক ভয়ে ছমছমে হয়ে আছে।
খাটের ওপরে অনেকক্ষণ ধরে এপাশ-ওপাশ করলুম, তবু চোখে ঘুম নেই। এমন সময়ে একটা ভয়ানক কাণ্ড হল। ঠিক যেন কড়িকাঠ থেকে আমার বুকের উপরে কী-একটা খসে পড়ল… একটা হাত-পা-ওয়ালা জীব! দু-হাতে সে আমার গলা চেপে ধরলে!… কুকুর নয়, বিড়াল নয়— কী এটা? মানুষ? কড়িকাঠ থেকে পড়ল মানুষ!
কাপুরুষ নই। কিন্তু তবু আমি আতঙ্কে আঁতকে উঠলুম। দু-খানা হাড়-কঠিন হাত আমার গলা টিপে ধরেছে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! আমিও প্রাণপণে তাকে চেপে ধরলুম। সে আমার গলা ছেড়ে দিলে বটে, কিন্তু ভীষণ বিক্রমে আমার সঙ্গে লড়তে লাগল। কখনো আঁচড়ায়, কখনো কামড়ায়, কখনো আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনুভবে বুঝলুম, জীবটা একেবারে উলঙ্গ!
সবাই জানে, আমি খুব বলবান ব্যক্তি। কিন্তু সেই অজানা জীবটাকে কায়দায় আনতে গিয়ে আমার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাবার মতো হল। অনেকক্ষণ জোঝাজুঝির পর আমি যখন প্রায় কাবু হয়ে পড়েছি, তখন টের পেলুম যে, সে-ও ফোঁস ফোঁস করে বেজায় হাঁপাচ্ছে। তখন উৎসাহিত হয়ে আমি দ্বিগুণ বিক্রমে তার বুকের ওপরে দুই হাঁটু দিয়ে চেপে বসলুম।
তারপর এক হাতে তার গলা টিপে ধরে আর এক হাতে ‘বেড সুইচ’টা টিপে দিলুম।
কিন্তু আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে যা দেখলুম, শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
এখনও সে-মুহূর্তের কথা ভাবলে প্রাণ আমার শিউরে ওঠে!
আলো জ্বেলে বিছানার ওপরে আমি কিছুই দেখতে পেলুম না!
কিছুই নেই— কিছুই নেই, তবে আমি কাকে চেপে ধরে আছি? কে আমার সর্বাঙ্গ আঁচড়ে-কামড়ে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে, আমার দু-হাতের ভিতরে এমন ছটফট করছে? এর দেহ তপ্ত, মাংসল, এর হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে, এর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে; অথচ আমার চোখের সামনে কিছুই নেই— কোনো অস্পষ্ট ছায়া বা ধোঁয়াটে রেখা পর্যন্ত নয়!
এতক্ষণ পরে মহা ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠলুম। একবার নয়, দু-বার নয়— বার বার! এ ব্যাপারের পর চিৎকার না-করে থাকা যায় না।
পাশের ঘরে থাকত আমার বন্ধু মহিম। সে তাড়াতাড়ি ছুটে এল।
আমার মুখ নিশ্চয়ই ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল, কারণ ঘরে ঢুকেই সে বলে উঠল, ‘নবীন, নবীন! ব্যাপার কী? তুমি ওরকম হয়ে গেছ কেন?’
‘মহিম! কে আমাকে আক্রমণ করেছে? আমি একে চেপে ধরে আছি, কিন্তু আমি একে দেখতে পাচ্ছি না!’
হো-হো করে কারা হেসে উঠল। ফিরে দেখি, আমার চিৎকারে মেসের সবাই ঘরের ভিতরে ছুটে এসেছে। আমার কথা শুনে তারাই হাসছে। তারা ঠাউরেছে, আমার মাথা হঠাৎ বিগড়ে গেছে।
মহিম বললে, ‘নবীন, আজ কি তুমি সিদ্ধি-টিদ্ধি কিছু খেয়েছ?’
আমি সকাতরে বললুম, ‘দোহাই তোমার, আমার কথায় বিশ্বাস করো! দেখছ না, আমার গা দিয়ে রক্ত ঝরছে? দেখছ না, এর ধাক্কায় আমার দেহ কেঁপে-কেঁপে উঠছে?… আচ্ছা, এতেও যদি তোমার বিশ্বাস না-হয়, তবে তুমি নিজেই এদিকে এসো। এর গায়ে হাত দিয়ে দেখ।’
মহিম এগিয়ে এল। তারপর আমার নির্দেশ অনুসারে এক জায়গায় হাত দিয়েই তীব্র চিৎকার করে উঠল। মহিম একে ছুঁয়েছে!
আমি যন্ত্রণাবিকৃত স্বরে বললুম, ‘মহিম, আমি আর একে ধরে রাখতে পারছি না। এর জোর যেন ক্রমেই বেড়ে উঠেছে! ঘরের ওই কোণে একগাছা দড়ি পড়ে আছে। শিগগির দড়িগাছা নিয়ে এসো— আমাকে সাহায্য করো!’
মহিম আর আমি দড়ি দিয়ে সেই অদৃশ্য জীবটাকে বাঁধতে লাগলুম। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য— শূন্যতার চারিদিকে দড়ি জড়ানো!
ঘরের ভিতরে যারা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা ভাবলে আমরা কোনো কৌতুক অভিনয় করছি।
বাড়িওয়ালা বললে, ‘এই পাগলামি দেখাবার জন্যে কি তোমরা রাত দুটোর সময়ে আমাদের ঘুম ভাঙালে?’
আমি রেগে বললুম, ‘পাগলামি? যার খুশি হয় এসে এর গায়ে হাত দিয়ে দেখুক না!’
কিন্তু সে পরীক্ষাতেও কেউ রাজি হল না। তবু তারা আমাদের কথায় বিশ্বাস করলে না। বাড়িওয়ালা বললে, ‘জ্যান্ত জীব, অথচ দেখা যায় না— এ কেমন গাঁজাখুরি কথা!’
আমি আর মহিম তখন একসঙ্গে দড়ি ধরে সেই অদৃশ্য জীবটাকে টেনে তুললুম। তারপর দু-একবার তাকে শূন্যে দুলিয়ে দড়িগাছা ছেড়ে দিলুম একটা ভারী জিনিস পড়লে যেমন হয়— ধপাস করে একটা শব্দ হল। বালিশ ও বিছানার মাঝখানটা নেমে গেল এবং খাটের কাঠ মচমচ করে আর্তনাদ করে উঠল!
পরমুহূর্তে ঘরের ভিতর আর জনপ্রাণী রইল না— বিষম ভয়ে সকলেই হুড়মুড় করে বেগে পলায়ন করল!
বিছানার উপরে পড়ে সে ছটফট করছে, আর তার ছটফটানির চোটে বিছানার চাদরখানা কুঁচকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে!
মহিম বললে, ‘নবীন, এ দৃশ্য চোখে দেখতেও আমার ভয় হচ্ছে!’
‘আমারও।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা যে একেবারেই ধারণাতীত, তাও বলতে পারি না।’
‘তুমি কী বলছ হে? এর চেয়ে ধারণাতীত ব্যাপার আর কী হতে পারে? পৃথিবীতে এমন ব্যাপার আর কখনো ঘটেছে?’
‘আচ্ছা, ভালো করে ভেবে দেখ। আমাদের সামনে একটা বস্তু রয়েছে, অথচ আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসকেও আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তাকে আমরা ছুঁতে পারি। বাতাসের অস্তিত্ব কি আমরা অস্বীকার করি?’
‘কিন্তু এ যে জীবন্ত! এর বুকে হাত দিলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনুভব করবে!’
‘নবীন, তুমি প্রেত-চক্রের কথা শুনেছ তো? সেখানে এমন সব প্রেতের আবির্ভাব হয়, যাদের দেখা যায় না, কিন্তু ছোঁয়া যায়!’
‘মহিম, মহিম! তুমি কি তবে বলতে চাও, আমরা একটা প্রেতকে গ্রেপ্তার করেছি?’
‘আমি এখন কিছুই বলতে চাই না। তবে ব্যাপারটার শেষ পর্যন্ত না দেখে আমি ছাড়ব না। দেখ, বিছানা আর তোলপাড় হচ্ছে না। নিশ্বাসের শব্দও হচ্ছে, আস্তে-আস্তে। বন্দি বোধ হয় ঘুমোচ্ছে।’
সে রাত্রে কিন্তু আর আমাদের ঘুম হল না— এর পরেও কি কারুর চোখে আর ঘুম আসে?
…পরদিন সকাল বেলায় আমাদের মেসবাড়ির সামনে শহর যেন ভেঙে পড়ল! সকলেরই মুখে এক জিজ্ঞাসা— যাকে আমরা পাকড়াও করেছি, সেটা কী? কিন্তু যা-কিছু প্রশ্ন হচ্ছে, সবই ঘরের বাইরে থেকে, ঘরের ভিতরে ভরসা করে কেউ পা বাড়াচ্ছে না।
তার আকার কীরকম সেটা জানবার জন্যে মন ব্যস্ত হয়ে উঠল। সাবধানে (পাছে কামড়ে দেয়) তার গায়ে হাত বুলিয়ে যা বুঝেছি— মানুষের মতো; নাক, চোখ, মুখ; মাথায় চুল নেই; হাত আর পাও মানুষের মতো; লম্বায় তেরো-চৌদ্দো বৎসর বয়সের বালকের মতো।
পরের দিন সন্ধ্যার আগেই মেসের সমস্ত ভাড়াটে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সরে পড়ল।
বাড়িওয়ালা এসে বললে, ‘ও-আপদকে আমার বাড়িতে আমি রাখব না। তোমরা যদি রাখতে চাও তো আমি তোমাদের নামে নালিশ করব!’
আমি বললুম, ‘ইচ্ছে করলেই তুমি একে বিদায় করতে পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
কিন্তু তাকে বিদায় করতে রাজি আছে টাকার লোভ দেখিয়েও এমন লোক খুঁজে পাওয়া গেল না।
সেইখানে বন্দি হয়ে সে দিনের-পর-দিন ধড়ফড় করতে লাগল!
হপ্তা খানেক পরে মহিম একদিন হঠাৎ বললে, ‘আমাদের বন্দির চেহারা কীরকম তা জানবার এক উপায় আমি আবিষ্কার করেছি।’
‘কী, কী উপায়?’
‘ওর দেহ যখন স্পর্শ করা যায়, তখন ”প্যারিস-প্লাস্টার” দিয়ে অনায়াসেই ওর ছাঁচ তোলা চলবে।’
‘ঠিক বলেছ? কিন্তু সে-সময়ে ও যদি ছটফট করে, তাহলে তো ছাঁচ উঠবে না।’
‘নবীন, তুমি তো ডাক্তারি শিখছ। ওকে ”ক্লোরোফর্ম” দিয়ে তুমি তো খুব সহজেই অজ্ঞান করে ফেলতে পারো। তাহলে ছাঁচ তুলতে আর কিছুই বাধা হবে না।’
মহিমের বুদ্ধি খুব সাফ। তারই কথামতো কাজ করা গেল। ছাঁচও উঠল।
উঃ, সে কী বিদঘুটে চেহারা! মানুষের মতন গড়ন বটে, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর মূর্তি! চোখ দুটো গোল ভাঁটার মতো, নাকটা ছুঁচোলো ও বাঁকা, ঠোঁট পুরু-পুরু ও উলটানো, দাঁতগুলো বড়ো বড়ো হিংস্র জানোয়ারের মতো— ঠিক যেন পিশাচের মুখ, যেন মানুষের রক্ত-মাংস খাওয়াই তার অভ্যাস!
এখন এই ভয়াবহ জীবকে নিয়ে কী করা যায়? একে বাড়ির ভিতরে রাখাও চলবে না, ছেড়ে দেওয়াও অসম্ভব। ছাড়া পেলে এ পৃথিবীর কত মানুষের ঘাড় মটকাবে, তা কে বলতে পারে? তবে কী করব আমরা? একে হত্যা করে সকল আপদ চুকিয়ে দেব? না, তাও সম্ভব নয়। এর গড়ন যে মানুষের মতো!
প্রতিদিনই এইসব কথা আমাদের মনে হয়।
সেই অদ্ভুত অদৃশ্য জীবের খাদ্য যে কী, তাও বোঝা গেল না। সকলরকম খাবারই তার সামনে রেখে দি, কিন্তু সে কিছুই ছোঁয় না। পনেরো দিন কেটে গেল, তবু অনাহারে সে মরল না। তখনও ছাড়ান পাবার জন্যে সে গড়াগড়ি দিয়ে ও ছটফট করে সারা বিছানা তোলপাড় করে তুলছে!
কিন্তু তারপরে ধীরে ধীরে তার ছটফটানি কমে এল।
বিশদিন পরে দেখা গেল, তার হৃৎপিণ্ডের গতি বন্ধ হয়ে গেছে। হাত দিয়ে বুঝলুম, তার দেহ কঠিন, আড়ষ্ট ও ঠান্ডা। সে মরেছে। কিন্তু কী সে? একী সেই অদৃশ্য জগতের কেউ, যে-জগতের বাসিন্দারা মানুষকে রাত্রে এসে ভয় দেখায় এবং আমরা যাদের প্রেত বলে মনে করি?