কী ৫-৯

০৬.

পা! দিস রিকোয়্যার্স অ্যাকশন!

ব্যাস। আর কিছু নয়। ইমিডিয়েট নয়, এমার্জেন্সি নয়, টপ-প্রায়োরিটি নয়, এমনকি টপ-সিক্রেটও নয়। কোনো বিশেষণের ভার নেই আদেশটায়। সাদামাটা হুকুম : পা! এটার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।

তা হল। ব্যবস্থা হল। বিশেষণ-বিমুক্ত সেই আদেশের ‘অ্যাকশন’টার জাত নির্ণয় করব আমরা। তার অর্থনৈতিক মূল্য, গোপনীয়তা এবং ব্যাপকতা। প্রথমটায় কাজ শুরু হল ছোটো করেই। সারা মার্কিন মুলুকে দশটি রিসার্চ গ্রুপ এ নিয়ে গোপন গবেষণা শুরু করলেন। প্রথম বছরে অর্থ বরাদ্দ করা হল মাত্র তিন লক্ষ ডলার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ব্যাপক আকার ধারণ করল। এক সময়ে বৈজ্ঞানিকের দল জানালেন, তামার চেয়ে রুপোর তারের বিদ্যুৎবাহী ক্ষমতা বেশি। তাদের কিছু রুপো চাই। টাকশালের আন্ডার-সেক্রেটারি ড্যানিয়েল বেল বললেন, বেশ, দেব। বলুন কতটা রুপো চাই?

মানহাটান প্রডাকশানের চিফ বললেন, ধরুন আপাতত পনেরো হাজার টন।

ড্যানিয়েল বেল আঁৎকে উঠে বলেন, টন! কী বলছেন মশাই। রুপোর ওজন কখনও টনে হয়? হয় আউন্সে!

মানহাটান চিফ লেসলি গ্রোভস্ জবাবে কিছু বলবার আগেই তার সহকারী বৈজ্ঞানিকটি বলেন, ঠিক আছে। তাই বলছি–ফাইভ পয়েন্ট ফোর ইন্টু টেন দু দ্য পাওয়ার এইট!’

ড্যানিয়েল বেল-এর মুখের নিম্নাংশ ঝুলে পড়ে। বলেন, তার মানে?

-পনেরো হাজার টন ইজুকালটু 5.4 x 10^8 আউন্স। আপনি আউন্সে জানতে চাইছিলেন তো? তাই বলছিলাম আর কি!

বেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, থাক স্যার, আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না, ওই পনেরো হাজার টন রুপোই পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আর গোপনীয়তা? রুজভেল্ট মারা যাবার পর হ্যারি ট্রুম্যান যখন এসে বসলেন তার শূন্য সিংহাসনে-চোদ্দই এপ্রিল 1945-এ-তখন তিনিও জানতেন না এতবড় মানহাটান প্রজেক্টের কথা। চেয়ারে বসার পরে তিনি সেটা শুনেছিলেন। তার চেয়েও মজার কথা হচ্ছে সেনেটের হ্যারি ট্রুম্যান 1940 সালে একটি কমিটির চেয়ারম্যানরূপে নির্বাচিত হন– ”কমিটি টু ইনভেস্টিগেট দ্য ন্যাশনাল ডিফেন্স প্রোগ্রাম”। যুদ্ধপ্রচেষ্টায় যে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার যাথার্থ্য নির্ণয় করে সেনেটকে জানানোর দায়িত্ব এই অনুসন্ধান কমিটির। তার চেয়ারম্যানরূপে কাজ করতে গিয়ে ট্রুম্যান জানতে পারলেন–কী একটা মানহাটান প্রজেক্টে কোটি কোটি ডলার ব্যয়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পে দৈনিক নাকি এক লক্ষ লোক খাটছে-ট্রেনে আর লরিতে লক্ষ লক্ষ টন কাঁচামাল ওই কারখানায় ঢুকছে, অথচ এ পর্যন্ত একটা ছোট্ট প্যাকেটও ‘ফিনিশড গুড় হিসাবে বার হয়ে আসেনি। ট্রুম্যান একটা প্রকাণ্ড কেলেঙ্কারী হাতেনাতে ধরবেন বলে ওই প্রকল্প সরেজমিনে দেখবার জন্য প্রস্তুত হলেন। খবর পেয়ে যুদ্ধসচিব বৃদ্ধ স্টিমসন সেনেটর হ্যারি ট্রুম্যানকে ফোন করলেন, বললেন, সেনেটর, আপনাকে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ জানাতে এসেছি। আপনি মানহাটান প্রজেক্ট সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করতে যাবেন না।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন সেনেটর হ্যারি ট্রুম্যান। বলেছিলেন, কেন মিস্টার সেক্রেটারি?

-কেন, তাও আমি বলতে পারব না। শুধু জানতে পারি, পৃথিবীর ইতিহাসে মানহাটান-প্রজেক্ট সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গোপন প্রকল্প। এর পাই-পয়সা খরচের জন্য আমি যুদ্ধশেষে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকব। আপনার অনুসন্ধান কার্য আমাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দেবে।

প্রবীণ রাজনীতিক ওই সেক্রেটারি অফ ওয়ার-এর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল সেনেটর ট্রুম্যানের। তিনি তৎক্ষণাৎ অনুসন্ধানের আদেশ প্রত্যাহার করেছিলেন। তার পাঁচ বছর পরে ট্রুম্যান আমেরিকার প্রেসিডেন্টরূপে নির্বাচিত হন এবং তৎক্ষণাৎ তাকে আদ্যন্ত ব্যাপারটা খুলে বলেছিলেন যুগ্মসচিব হেনরি স্টিমসন! তার আগে নয়!

***

আর ব্যাপকতা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে আট-দশটি বিভিন্ন কেন্দ্রে একযোগে চলছিল গবেষণা কার্য। কয়েক হাজার বৈজ্ঞানিক তাতে নিযুক্ত। 1942 সাল-ত বিজ্ঞানীরা পাঁচ-পাঁচটি বিকল্প পথে সমাধানের পথ খুঁজতে শুরু করেছেন। পাঁচটি পথের কোন্ পথ শেষ লক্ষ্যে পৌঁছাবে তা কেউ বলতে পারে না। তার ভিতর তিনটি পথ হচ্ছে ইউরেনিয়াম-বোমা তৈরি করবার প্রচেষ্টা, দুটি প্লুটোনিয়াম-বোমার।

বৈজ্ঞানিকেরা বলেছেন, ইউরেনিয়াম-বোমা তৈরির তিনটি বিকল্প পথ আছে। প্রথমত ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক উপায়ে। তার জন্য ভোলা হল দেশের দুই প্রান্তে দুই কেন্দ্র- বার্কলেতে এবং ওক-রিজে। দ্বিতীয় পথ–গ্যাসীয় ডিফুশন-মেথড। সে পরীক্ষাকার্য চালানো হল নিউইয়র্ক এবং ডেট্রয়েট-এ। তৃতীয় পথ হল–সেন্ট্রিফুজ-পদ্ধতি।

অনুরূপভাবে, প্লুটোনিয়াম-বোমা তৈরি হতে পারে দুটি পদ্ধতিতে-গ্রাফাইট রিয়্যাকটারে অথবা ভারী জল দিয়ে।

বস্তুত পাঁচটি অন্ধ গলিতেই তখন পথ হাড়াচ্ছেন বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিকরা। পাঁচটি বিকল্প-পদ্ধতিতেই কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছিল! কোনো পথই ওঁরা ত্যাগ করতে পারছিলেন না। কোটি অন্ধ গলি এবং কোন্ পথে লক্ষ্যে পৌঁছানেনা যাবে কেউ তা জানে না!

এই ফাঁকে বলে রাখি–আমাদের কাহিনির বিশ্বাসঘাতক ডেক্সটারের কল্যাণে রাশিয়া ওই পাঁচমাথার মোড়ে বিব্রত হয়নি–সোজা এক পথে এগিয়ে গিয়েছিল। তাতে কোটি কোটি রুল বেঁচে গিয়েছিল রাশিয়ার।

***

ম্যানহাটান-প্রকল্পের এক-এক প্রান্তে যারা কাজ করেন, তারা অপর প্রান্তের খবর জানেন না। গোপনীয়তার প্রয়োজনে নিজ ল্যাবরেটারির বাইরের খবর কেউ পান না। শুধু তাই নয়–প্রত্যেকে শুধু নিজ নিজ পরীক্ষার ফলাফলটুকুই জানতে পারেন, তার বেশি নয়। এ ব্যবস্থায় গোপনীয়তা রক্ষা হয় বটে কিন্তু কাজ দ্রুত এগোয় না। যে পরীক্ষার ফল চূড়ান্তভাবে জেনে ফেলেছেন ওক-রিজের বিজ্ঞানীরা সেগুলিই হয়তো কষে বার করছেন বার্কলের অধ্যাপকেরা। কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন–এভাবে চলবে না। সমগ্র ম্যানহাটান-প্রকল্পের একজন সর্বময় কর্তা চাই। নিঃসন্দেহে তিনি হবেন একজন সামরিক অফিসার। শুধু তাই নয়–চাই একজন প্রথম শ্রেণির অল্পবয়সী পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি প্রতিটি কেন্দ্রের সংবাদ সংগ্রহ করে ওই সর্বময় কর্তাকে জানাবেন। এক কেন্দ্রের খবর অপর কেন্দ্রের প্রয়োজনবোধে জানাবেন।

যুদ্ধসচিবের নিজের কাজ অফুরন্তযুদ্ধের কাজ। সারা পৃথিবীতে মার্কিন সৈন্য তখন যুদ্ধ করছে। তাই এই মানহাটান প্রকল্পের জন্য তিনি একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেট-আপ তৈরি করে দিলেন। তৈরি হল একটি উপদেষ্টা পরিষদ। তার চারজন সভ্য। যুদ্ধসচিবের পক্ষে রইলেন চিফ-অফ স্টাফ জেনারেল জর্জ মার্শাল। এঁদের পরামর্শ অনুসারে কাজ করবেন ওই সর্বময় কর্তা জেনারেল লেসলি গ্রোভ। তার মিলিটারি সহকারী রইলেন কর্নেল মার্শাল ও কর্নেল নিক। ছক তৈরি হল।

এই দশটি কেন্দ্রে যেসব বিজ্ঞানী কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয়ই সব কয়টি কেন্দ্রের খবর রাখতেন। কিন্তু মূল ভূমিকা ছিল দুজনের সামরিক কর্তা জেনারেল গ্রোভসস্ এবং বেসামরিক ডক্টর ওপেনহাইমারের। এঁদের দুজনকে আর একটু কাছ থেকে দেখতে হবে আমাদের।

***

1942 সালের সতেরোই সেপ্টেম্বর লেসলি গ্রোভসের জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। সেদিনই সে বদলির অর্ডার পেলো। সাগরপারে যেতে হবে তাকে, আমেরিকার বাইরে। এই স্বপ্ন সে দেখে এসেছে আকৈশোর। গ্রোভস মিলিটারি স্কুল থেকে পাশ করে বের হয় 1918-তে। ঠিক সে বছরই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেবার সৌভাগ্য হয়নি বেচারার। তারপর এই দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে একটাও যুদ্ধ করার সুযোগ সে পায়নি। অথচ ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে উঠেছে ওপরে–এখন সে কর্নেল। এবারকার বিশ্বযুদ্ধে তার দায়িত্ব ছিল ‘মিলিটারি এঞ্জিনিয়ার যোদ্ধা!’ এতদিন পরে কর্নেল গ্রোভস বদলির অর্ডার পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বন্ধুদের দেখালো অর্ডারটা–এবার সে সাগরপারে সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে।

ম্যানহাটান প্রকল্প

[চিত্র]

ধড়াচূড়া সেঁটে গ্রোভস এসে হাজির হল তার বড়কর্তার ঘরে। মেজর-জেনারেল সমারডেল ওকে সমাদর করে বসালেন। বললেন, অর্ডার পেয়েছ?

পেয়েছি জেনারেল, ধন্যবাদ। কখন আমি আমার বর্তমান কাজের দায়িত্ব। বুঝিয়ে দেব?

–এখনই। তোমার সাবস্টিট্যুট তৈরি আছে।

একটু ইতস্তত করে গ্রোভস বলে, কোন্ রণাঙ্গনে যেতে হবে আমাকে?

রণাঙ্গন? না না যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে না তোমাকে আদৌ! তোমার কাজ এই ওয়াশিংটনেই!

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে গ্রোভস। নীরবে তার বদলির অর্ডারখানা বাড়িয়ে ধরে। সেটা ‘ওভারসিজ অ্যাসাইনমেন্ট’–সাগরপারে যাবার নির্দেশবহ।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি। আমরা চেয়েছিলাম, তোমার সহকর্মীরা ভুল খবরই পাক। মানে, তুমি যেন বিদেশ যাচ্ছ। আসলে তোমাকে আমরা নিয়োগ করছি মানহাটান প্রকল্পের সর্বময় কর্তারূপে। কাজটা তোমার মতো এঞ্জিনিয়ার-যোদ্ধার উপযুক্ত।

ধরা গলায় গ্রোভস বলে, জেনারেল। আমি কোনো এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করিনি। এই ‘এঞ্জিনিয়ার যোদ্ধার’ খেতাব থেকে এবার আমি মুক্তি পেতে চাই। আপনি দয়া করে

জেনারেল ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, কর্নেল, যে কাজটা তোমাকে দেওয়া হচ্ছে সেটা এ বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আইসেনহাওয়ার, প্যাটন অথবা মন্টির ওপর যতটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে একচুলও কম নয়। দ্বিতীয়ত, এজন্য তোমাকে নির্বাচন করেছেন যুদ্ধসচিব হেনরি স্টিমসন নিজে–অন্তত দশজন সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেটের ভিতর থেকে বেছে নিয়ে। শেষ কথা, প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তোমার নিয়োগপত্রে সই দিয়েছেন। কিছু বলবে?

বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল লেসলি গ্রোভস।

***

মানহাটান প্রকল্পের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো সব কয়টি কেন্দ্র একবার করে ঘুরে এল গ্রোভস। সব কয়টি কেন্দ্র সরেজমিনে দেখল। প্রতিটি কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে আলাপ হল, পরিচয় হল। অবাক হয়ে গেল সে।

সর্বপ্রথমেই সে এল নিউইয়র্কে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাঁটাতারে ঘেরা অংশ। এখানে নাকি গ্যাসীয়-ডিফিউশন পদ্ধতিতে ইউরেনিয়ামকে পৃথককরণ করার প্রচেষ্টা হচ্ছে। ইউরেনিয়াম-ওর’ থেকে ইউ-235 নিষ্কাশনের প্রচেষ্টা। বাইরে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে, ‘এস. এ. এম.’ অর্থাৎ Substitute Alloy Materials। লোকচক্ষুকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ অদ্ভুত নাম। ল্যাবরেটারির কর্ণধার ডক্টর হারল্ড ইউরে(1893-1981)–নোবেল লরিয়েট রসায়নবিজ্ঞানী। কিন্তু দৈনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করেন ড. ড্যানিং, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের উৎসাহী বৈজ্ঞানিক। ওঁরা দুজনে গ্রোকে নিয়ে গ্যাসীয় ডিফিউশন পদ্ধতি দেখাবার জন্য বার হলেন। কিন্তু গ্রোভস বাধা দিয়ে বললে, ডক্টর ইউরে, ল্যাবরেটারি পরিদর্শনের আগে দয়া করে আমাকে বুঝিয়ে দিন গ্যাসীয় ডিফিউশন পদ্ধতিটাই বা কী, আর কেন ওটা করতে চাইছেন।

ডক্টর ইউরে বলেন, তার আগে আপনি বলুন–পারমাণবিক-বোমা জিনিসটা কীভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে সেটা কি আপনি বুঝেছেন? জানেন?

-ভালোভাবে নয়। মূল তত্ত্বটা আমাকে দয়া করে বলুন।

 ডক্টর ইউরে যা বললেন তার সংক্ষিপ্তসার এইরকম—

 ইটালিতে ফের্মি এবং জার্মানিতে অটো হান ইতিপূর্বেই ইউরেনিয়াম পরমাণুর অন্তর বিদীর্ণ করেছেন। তাতে ইউরেনিয়াম পরমাণু দু-টুকরো হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে ক্রিপটন আর বেরিয়ামে। পারমাণবিক শক্তিও জন্ম নিয়েছে–কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। তা হোক, ওই সঙ্গে আমরা দেখেছি নূতন দু-তিনটি নিউট্রন বিমুক্ত হয়েছে। সেই দু-তিনটি নিউট্রন তীব্রবেগে ছুটে গেছে এবং অন্যান্য পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেছে। এখন যদি এমন ব্যবস্থা করা যায় যে, ওই দু-তিনটি নবলব্ধ নিউট্রন আর দু-একটি পরমাণুর অন্তর বিদীর্ণ করবে তবে আমরা আবার কিছু শক্তি পাব এবং পাব দুই-দুগুণে চারটে নতুন নিউট্রন। সে দুটি আবার চার-দুগুণে আটটা, তা থেকে আট-দুগুণে ষোলোটা নিউট্রন মুক্ত হতে পারে। এইভাবে বিশ-ধাপ চললেই লক্ষ লক্ষ নিউট্রন মুক্ত হবে, পঁচিশ ধাপে কোটি কোটি পরমাণু বিদীর্ণ হয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাবে! ব্যাপারটার চিত্রকল্প হবে এই রকম (চিত্র 7)। লক্ষণীয়, চিত্র 6-তে আমরা দেখিয়েছি, ইউরেনিয়াম পরমাণু বিদীর্ণ হওয়ায় তিনটি নিউট্রন ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। চিত্র 7-এ তার যে-কোনো দুটির চেন-রিয়্যাকশন দেখানো হয়েছে। তিনটিই যদি কার্যকরী হয় তাহলে অঙ্কশাস্ত্র মতে 3-9-27-81….এভাবেও চেন রিয়্যাকশন হতে পারে।]

চিত্র 7. অ্যাটম-বোমা তৈরির পঞ্চম ধাপ—চেন-রিয়্যাকশন

[চিত্র 7. অ্যাটম-বোমা তৈরির পঞ্চম ধাপ—চেন-রিয়্যাকশন]

মজা হচ্ছে এই যে, এটা তখনই সম্ভব যখন মুক্ত নিউট্রনের আশেপাশে যথেষ্ট পরিমাণ ইউ-235 পরমাণু থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আকরিক ইউরেনিয়ামে প্রতিটি ইউ-235-এর জায়গায় দেড়শটি ইউ-238 থাকে। ফলে অধিকাংশ নিউট্রনই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। চিত্র 8-এ ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। কালো কালো বলগুলি ইউ-235 সাদাগুলি ইউ-238। বাঁ-দিক থেকে আমরা তিনটি নিউট্রন বুলেট ছেড়েছি। ধরা যাক দু-নম্বর বুলেট ঘটনাস্থলে গিয়ে একটি ইউ-235 চিত্র 8. নিউট্রন-বুলেট পরমাণুকে বিদ্ধও করল, তা থেকে দুটি নূতন নিউট্রনও বিমুক্ত হল। কিন্তু চেন-রিয়্যাকশান হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? চতুর্দিকেই যে ইউ-238।

চিত্র 8. নিউট্রন-বুলেট

[চিত্র 8. নিউট্রন-বুলেট]

ইউরে বললেন, সেজন্য আমরা এখানে আকরিক ইউরেনিয়াম থেকে ইউ-235–কে পৃথককরণ করছি। এমন অবস্থা করতে চাই যাতে নিউট্রন-বুলেটকে যে ভীড়ের দিকে ছোঁড়া হবে সেখানে শুধুমাত্র ইউ-235ই থাকবে। তাহলে চিত্র 7-এর মতো চেন-রিয়্যাকশান, অর্থাৎ চক্রবর্তন-পদ্ধতি, চালু হয়ে যাবে–দুই, চার, আট, ষোললা, বত্রিশ, চৌষট্টি ইত্যাদি-ইত্যাদি। অর্থাৎ পঁচিশ-তিরিশ ধাপ পরে কোটি কোটি পরমাণুর বিস্ফোরণ।

কীভাবে সেটা করতে চান?

–ইউরেনিয়াম থেকে উৎপন্ন ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড গ্যাসকে উত্তপ্ত করে একটা ফিলটার টিউব-এর ভেতর দিয়ে পাঠাতে হবে। ওই ফিলটার টিউবে থাকবে অসংখ্য অতিক্ষুদ্র ছিদ্র। তাহলে হালকা ইউ-235 পরমাণুগুলো ভারী ইউ-238 পরমাণু থেকে পৃথক হয়ে যাবে।

-বুঝলাম।

-আজ্ঞে না, বোঝেননি। প্রথমত ইউরেনিয়াম হচ্ছে সবচেয়ে ভারী ধাতু। তাকে তরল এবং শেষমেশ গ্যাসে রূপান্তরিত করাই এক ঝকমারি ব্যাপার। প্রচণ্ড উত্তাপ লাগে। দ্বিতীয়ত, গ্যাসীয় ইউরেনিয়াম অত্যন্ত করোসিভ; পাইপগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, ওই যে আমি বললাম, ‘অসংখ্য ছোটো ছোটো ছিদ্র’ ওটা তো অবৈজ্ঞানিক উক্তি। অসংখ্য’ শব্দটার অর্থ হচ্ছে কয়েক শত কোটি! এবং ছোটো ছোটো’ শব্দটার ব্যাখ্যা হচ্ছে প্রতিটি ছিদ্রের ব্যাস এক মিলিমিটারের দশ হাজার ভাগের একভাগ!

গ্রোভস, রুমাল দিয়ে মুখটা মুছলেন।

–আমার বক্তব্যটা শেষ হয়নি জেনারেল। ইউরেনিয়াম 238 অত্যন্ত দুর্লভ ও দুর্মূল্য পদার্থ। আর তা থেকে আমরা পরমাণু বোমা বানানোর উপযুক্ত ইউরেনিয়াম 235 পাচ্ছি 0.7 শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় দেড়শ গ্রামে এক গ্রাম।

গ্রোভস ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় হলেন।

***

পরবর্তী পরিদর্শন শিকাগোতে। এখানে ইউরেনিয়াম নয়, প্লুটোনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। সর্বময় কর্তা আর্থার কম্পটন (1892-1962)। তিনি ছাড়া আরও দুজন নোবেল-লরিয়েট করমর্দন করলেন গ্রোদ্রে সঙ্গে। তারা হচ্ছেন ইটালিয়ন ফের্মি এবং জার্মান ফ্রাঙ্ক। দুজনেই ফ্যাসিস্ট আর নাৎসি রাজ্যের প্রাক্তন বাসিন্দা। ফের্মি এসেছেন পালিয়ে, ফ্রাঙ্ক বিতাড়িত হয়ে। গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়াও ওঁর সঙ্গে মিলিত হলেন উইগনার আর ৎজিলাৰ্ড–যাঁরা গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের পত্র আহরণে।

এর ভিতর ইউজিন উইগনার (1902-1995) একটি অদ্ভুত চরিত্র। এঁর কথা আগে বিস্তারিত বলা হয়নি। এই প্রতিভাশালী হাঙ্গেরীয় পদার্থবিজ্ঞানীর সৌজন্য আর ভদ্রতা-জ্ঞান ছিল প্রবাদের মতো। মেজাজ খারাপ করা জিনিসটা যে কী, তা তিনি জানতেনই না। ৎজিলাৰ্ড তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, উইগনারের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে দীর্ঘদিন মিশেছি। এমন অমায়িক ভদ্র মানুষ আর হয় না। কখনও তাকে রাগতে দেখিনি, কখনও কাউকে গালাগাল করতে শুনিনি। না! ভুল বললাম। জীবনে একবার তাকে রাগতে দেখেছিলাম। সেবারে উনি আমাকে গাড়ি করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিলেন। উনি বসেছেন স্টিয়ারিঙে, আমি ওঁর পাশে। কোথাও কিছু নেই ‘ট্রাফিক-রুলস’ শিকেয় তুলে ওপাশ থেকে একটা গাড়ি হুড়মুড় করে এসে পড়ল আমাদের সামনে। উইগনার কোনক্রমে ব্রেক কষে দুর্ঘটনা এড়িয়ে ফেলেন। দুটো গাড়িই দাঁড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্য করে দেখি, ওপাশের গাড়িটার চালক মদে চুর হয়ে আছে। সেই একদিন উইগনারকে ক্ষেপে যেতে দেখেছিলাম। হঠাৎ চীৎকার করে উইগনার বললেন : “গো টু হেল–” পরমুহূর্তেই স্বভাববিনয়ী স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছোট্ট করে যোগ করলেন “প্লিজ!”

শিকাগো গ্রুপের কর্তা ছিলেন কম্পটন; কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র হচ্ছেন এনরিকো ফের্মি। উনি কম কথার মানুষ। সব আলোচনাতেই দেখা যেত তিনি তার অভিমত জানাতেন সবার শেষে। আর অনিবার্যভাবে প্রমাণ হত–ফের্মির বক্তব্যই নির্ভুল। অথচ অত্যন্ত নিরভিমানী ব্যক্তি। আত্মপ্রশংসা যে তিনি করতেন না তা নয় কিন্তু তার ক্ষেত্র বিজ্ঞান নয়। নিজে যে একজন মস্ত সাঁতারু, মস্ত পর্বতারোহী অথবা গোয়েন্দা গল্পের আসল অপরাধীকে সবার আগে ধরে ফেলার পারদর্শিতা তার আছে একথা সাড়ম্বরে বলতেন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ উঠলেই উনি সঙ্কুচিত হয়ে পড়তেন। বলতেন–এত সব জ্ঞানীগুণীরা আছেন, ওঁদের জিজ্ঞাসা করুন। ফের্মির একটি বিলাস ছিল কম্পুটারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। ওঁর ছোট্ট স্লাইড-রুল হাতে উনি কম্পুটারের সঙ্গে লড়াই করতেন। কখনও উনি জিততেন, কখনও কম্পুটার। মানসাঙ্কে এমনই অদ্ভুত প্রতিভা ছিল তার।

ফ্রাঙ্কের কথা আগেই বলেছি। সহকর্মীদের অপমানে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে দেশত্যাগী হয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক। আভিজাত্য ছিল তার রক্তে।

বাকি রইল শিকাগো-গ্রুপের কর্তা আর্থার কম্পটনের পরিচয়। ওঁর সহকর্মীরা ঠাট্টা করে বলত, কম্পটন শিকাগো-গ্রুপের প্রকৃত লিডার নন,-ডেপুটি লিডার। মূল নিয়ামক হচ্ছেন তার গিন্নিবেটি কম্পটন। নোবেল-লরিয়েট প্রৌঢ় কম্পটন হাসতেন সেকথা শুনে। কারণ ছিল! তাকে যখন শিকাগো-গ্রুপের কর্তৃত্ব দেবার প্রস্তাব হল কম্পটন সরাসরি বড়কর্তাদের বলেছিলেন, আমি এক শর্তে এ পদ গ্রহণ করতে রাজি আছি।

-কী শর্ত বলুন?

–আমার স্ত্রীকেও ক্লিয়ারেন্স দিতে হবে। পদাধিকারবলে আমি যেসব গুপ্ত কথা জানব তা আমার স্ত্রীকেও জানাতে পারি আমি। পদাধিকারবলে আমি যেসব গোপন স্থানে যাব, আমার স্ত্রীরও সেখানে যাবার অধিকার থাকবে।

এ অদ্ভূত অনুরোধে অবাক হয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। তবু মেনে নিয়েছিলেন তারা। বেটি কম্পটন শিকাগো ল্যাবরেটারির নানান কাজ করতেন। সবাই তার আদেশ মেনে চলত। সর্বজনশ্রদ্ধেয়া কর্ত্রীই ছিলেন তিনি শিকাগো বীক্ষণাগারে।

***

গ্রোভস পরিদর্শনে আসায় ওঁরা তাঁকে নিয়ে বসালেন লেকচার হলে। গ্রোভস প্রশ্ন করলেন, একটা পরমাণু বোমার জন্য কতটা প্লুটোনিয়াম দরকার?

ফ্রাঙ্ক বললেন, সেটা নির্ভর করছে আপনি কত বড় বোমা চান তার ওপর।

–ধরুন দশ হাজার টন TNT-বোমার বিস্ফোরণের উপযুক্ত পারমাণবিক বোমা।

তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেল যোগ-বিয়োগ-ইনটিগ্র্যাল ক্যালকুলাসের অঙ্ক। ব্ল্যাকবোর্ডে পড়তে শুরু করল হিজিবিজি লেখা। হাতির শুড়ের মতো চিহ্ন সব। আলফা-বিটা-থিটা-এপসাইলনের বন্যায় ভেসে গেলো কালো বোর্ড। সবাই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে। একমাত্র ব্যতিক্রম এনরিকো ফের্মি। তিনি আপন মনে স্লাইড রুল ঘষছেন। হঠাৎ গ্রোভস-এর নজর হল পঞ্চম ধাপ থেকে ষষ্ঠ ধাপে আসবার সময় একটা ভুল হয়েছে। বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা। তিন-তিনজন নোবেল-লরিয়েট বিজ্ঞানী উপস্থিত রয়েছেন! আছেন ৎজিলাৰ্ড, উইগনারের মতো বিচক্ষণ বিজ্ঞানী। ওঁর মনে হল এটা কি ওঁরা ইচ্ছা করে কাঁদ। পেতেছেন? মানহাটান প্রকল্পের সর্বময় কর্তা কতটা অঙ্ক বোঝেন তাই কি বুঝে নিতে চান তারা। তা সে যাই হোক, হঠাৎ উঠে দাঁড়ান তিনি। বলেন, মাপ করবেন, ওই ষষ্ঠ ধাপটা আমি বুঝতে পারছি না। ওর আগের ধাপের 10^5 পরের ধাপে হঠাৎ 10^6 হল কেমন করে?

গণিতজ্ঞ তৎক্ষণাৎ বলেন, ধন্যবাদ। ওটা নিছক ভুলই।

ভুলটা সংশোধন করেন তিনি। গ্রোভস আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।

শেষ ফলাফলটা যখন বলা হয় তখন গ্রোভস জানতে চাইলেন–আপনাদের এই সংখ্যা কত পার্সেন্ট শুদ্ধ? অর্থাৎ কতটা এদিক-ওদিক হতে পারে?

কম্পটন তৎক্ষণাৎ বলেন, ধরুন দশ পার্সেন্ট শুদ্ধ!

এমন আজব কথা জীবনে শোনেনি গ্রোভ! বললেন মাত্র দশ পার্সেন্ট! বলেন কি?

-হ্যাঁ। বর্তমানে এর চেয়ে নির্ভুল উত্তর অঙ্কশাস্ত্র মতে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

গ্রোভস তখন ভাবছিলেন একটা নিমন্ত্রণ বাড়ির কথা। ক্যাটারারকে উনি বলছেন, আজ আমার বাড়ি কিছু লোক খাবে। খাবারের যোগাড় দিতে হবে আপনাকে। দেখবেন, খাবারে কম না পড়ে যেন। আর অপচয়ও না হয়।

ক্যাটারার জানতে চাইল, কতজন লোক খাবে স্যার?

–এই ধরুন জনা দশেক অথবা হাজারখানেক!

শতকরা দশভাগ নির্ভুল উত্তর। কারণ ‘দশ’ হচ্ছে একশর দশ-শতাংশ। নির্ভুল উত্তর, আবার ‘হাজার’-এর দশ-শতাংশ। নির্ভুল উত্তর হচ্ছে ‘একশ’! করো এবার আহারের আয়োজন!

***

শিকাগো ল্যাবরেটারি পরিদর্শন সেরে ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল গ্রোভসস আসছিলেন ফ্রাঙ্কের অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানেই তার নৈশ-আহারের ব্যবস্থা। ফ্রাঙ্ক নৈশাহারে নিমন্ত্রণ করেছেন পরিদর্শককে। শহরের অপর প্রান্তে একটা নয়তলা বাড়ির একটি অ্যাপার্টমেন্টে তখন বাস করতেন সস্ত্রীক জে ফ্রাঙ্ক। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ফ্রাঙ্ক নিজে, পাশে বসে আছেন গ্রোভস। কথাপ্রসঙ্গে ফ্রাঙ্ক বললেন, আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থাটা! টেন পার্সেন্ট কারেক্ট উত্তর দিয়ে আপনি কী করবেন? কতটা প্লুটোনিয়াম লাগবে, কতটা ফিশনের মেটিরিয়াল লাগবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। কিন্তু কী করা যাবে বলুন? আর কিছুদিন গবেষণা না করলে আমরা ওর চেয়ে কিছু কম-ভুল ফিগার দিতে পারছি না।

গ্রোভস সহানুভূতি দেখিয়ে বলেন, বুঝেছি। তবু হতাশ হবার কিছু নেই। আপনাদের সামনে কী পরিমাণ বাধা তা বুঝতে পারছি আমি।

ফ্রাঙ্ক হেসে বলেন, না! পারছেন না। আমার সাফল্যের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী জানেন?

–কী?

–ফ্রাউ ফ্রাঙ্ক।

অবাক হয়ে যান গ্রোভস। কী বলবেন ভেবে পান না। দাম্পত্য জীবনে ফ্রাঙ্ক কি অসুখী? তবু সে কথা এমন সদ্যপরিচিত লোকের কাছেই বা উনি বলবেন কেন? ফ্রাঙ্ক অভিজাত পরিবারের মানুষ, আত্মমর্যাদাজ্ঞান তার প্রখর। এমন বেমক্কা একটা পারিবারিক রহস্য কেন উঘাটিত করে বসলেন তিনি?

ডিনার টেবিলে সৌজন্য বজায় রেখে মামুলি প্রশ্ন করেন গ্রোভস। শ্রীযুক্তা ফ্রাঙ্ক অতি অমায়িক মহিলা। দেখলে বোঝা যায়, এককালে খুবই সুন্দরী ছিলেন। মার্জিত, অভিজাত এবং সদাহাস্যময়ী আদর্শ হোস্টেস। অতিথির আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি থাকল না। আলাপ হল নানা বিষয়ে পানাহারের ফাঁকে ফাঁকে। ফ্রাই ফ্রাঙ্ক তার ছেলেবেলায় গল্প শোনালেন। ব্যাভেরিয়ায় তার বাড়ি। ব্যাভেরিয়ার রাজপ্রাসাদে, সেখানকার চিত্রশালা, বিয়ার-পার্ক, চার্চ–কত স্মৃতিকথা। মার্কিন জীবনযাত্রার সঙ্গে জার্মান জীবনের তুলনা করলেন। ওঁদের জার্মানি থেকে চলে আসার প্রসঙ্গ উঠল। হিটলারের ইহুদি নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রফেসর ফ্রাঙ্ক পদত্যাগ করে। দেশত্যাগী হলেন। কোনো সভাসমিতির আয়োজন নিষিদ্ধ ছিল। ওঁর এক জার্মান সহকারী এবং শিষ্য ক্যারিও খবর পেয়ে গোপনে দেখা করতে এল। অধ্যাপকের হাতে তুলে দিল একটা প্রকাণ্ড অ্যালবাম। ফটোগ্রাফির সখ ছিল ক্যারিওর। গোটিনজেন-এর অসংখ্য ছবি তুলেছে সে। সাজিয়েছিল ওই অ্যালবামে। প্রফেসর ফ্রাঙ্ক ইতস্তত করে বলেছিলেন, তোমার এত সাধের সংকলনটা আমাকে দিয়ে দেবে? অরুদ্ধ কণ্ঠে ক্যারিও বলেছিল, প্রফেসর, আমি যে খাঁটি আর্য! গোটা গোটিনজেনটাই তো রইল আমার ভাগ। তার ছায়াটুকুই তো শুধু আপনাকে দিচ্ছি।

গ্রোভস্ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেন, অ্যালবামটা নিয়ে এসেছেন তো এখানে?

ফ্রাই ফ্রাঙ্ক উঁকি মেরে দেখলেন, প্রফেসর ফ্রাঙ্ক প্যান্ট্রিতে কয়েকপাত্র মার্টিনি বানাতে ব্যস্ত। চুপি চুপি বলেন, প্রফেসর অবসর পেলেই সেটার পাতা ওল্টান। ওই অ্যালবামটাই ওঁর প্রাণ। উনি গোটিনজেনকে যতটা ভালোবেসেছিলেন ততটা আমাকেও বাসেননি। গোটিনজেন ছিল আমার সতীন।

দুজনেই হেসে ওঠেন।

শ্ৰীমতী ফ্রাঙ্ক বলেন, অথচ মজা কী জানেন জেনারেল? প্রফেসর এই অ্যালবামটা নিয়ে এলেন তার পোর্টম্যান্টোতে–রেখে এলেন নোবেল প্রাইজের সোনার মেডেলটা!

-সে কী! ওটার আর কতটুকু ওজন?

-না, ওজনের জন্য নয়। ওঁর যুক্তি অন্য রকম। বললেন, মেডেলটা তো একা জেমস ফ্রাঙ্ক পায়নি–পেয়েছে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়! ওটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটারিতেই থাকবে। ল্যাবরেটারিতেই রেখে এসেছেন সেটাকে!

গ্রোভস্ চমকে ওঠেন। বলেন, সর্বনাশ! গেস্টাপো সেটা খুঁজে পেলে গলিয়ে ফেলবে! সোনাটা ওয়্যার-ফান্ডে জমা দেবে!

ততক্ষণে ফিরে এসেছেন প্রফেসর ফ্রাঙ্ক কয়েকপাত্র পানীয় ট্রেতে করে নিয়ে। বলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না জেনারেল। ওরা সেটা খুঁজে পাবে না।

-মাটির নীচে পুঁতে রেখে এসেছেন?

–না। কারণ তাহলে ওরা খুঁজে পেত। আমি সেটা ফেলে রেখে এসেছি একটা নাইট্রিক অ্যাসিডের বোতলে! যুদ্ধের পরে ঠিক সেটা খুঁজে পাওয়া যাবে, দেখবেন আপনি।* [* প্রফেসর ফ্রাঙ্কের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। ফ্রাঙ্কই একমাত্র নোবেল-লরিয়েট যিনি এক নোবেল প্রাইজ দুবার পেয়েছেন। যুদ্ধান্তে নাইট্রিক-অ্যাসিডের বোতলের তলদেশ থেকে যখন সোনার মেডেলটি উদ্ধার করা গেলো তখন দেখা গেল তার লেখা কিছু কিছু ক্ষয়ে গেছে। খবরটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তাতে সুইডেনের আকাঁদেমি ফ্রাঙ্কের কাছ থেকে মেডেলটি ফেরত নেয়-নূতন করে ছাপ দিয়ে পরের বছর উৎসবের সময় সেই মেডেলটি ফ্রাঙ্ককে দ্বিতীয়বার উপহার দেওয়া হয়।]

গ্রোভস বলেন, সে যাই হোক, আপনি জার্মানি থেকে বিদায়পর্বের গল্প বলেছিলেন–

শ্ৰীমতী ফ্রাঙ্ক তার গল্পের সূত্র তুলে নেন–

ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল কয়েকজন। অনাড়ম্বর বিদায়পর্ব। গোটিনজেন-এর মধ্যমণি চিরদিনের মতো বিদায় নিচ্ছেন। তাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন মাত্র জনা-পাঁচেক সহকর্মী ও ছাত্র। প্রফেসর হিলবার্ট, হেইসেনবের্গ, ক্যারিও প্রভৃতি। ফ্রাঙ্ক সস্ত্রীক গাড়িতে উঠে বসলেন। গার্ড হুইসিল দিল। সবুজ পতাকা নাড়াল। কিন্তু কী-এক যান্ত্রিক গণ্ডগোলে ইঞ্জিনটা চালু হল না। ঠিক সেই মুহূর্তেই স্টেশনের একজন কুলি এমন একটা কথা বলে বসল যা ফ্রাই ফ্রাঙ্ক জীবনে ভুলবেন না। লোকটি এগিয়ে এসে অধ্যাপক ফ্রাঙ্ককে বললে, হের প্রফেসর! একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? হিটলারের ওই মাথামোটা অফিসারগুলো যে সহজ হিসাবটা বুঝল না, সেটা ওই জড় ইঞ্জিনটাও বুঝে ফেলেছে! সে প্রতিবাদ জানাচ্ছে! আপনাকে নিয়ে যেতে সে রাজি নয়!

গল্পগুজবে কথাবার্তায় প্রায় মধ্যরাত্রি হয়ে গেল। গ্রোভস মনে মনে ভাবছিলেন অন্য একটি কথা। অধ্যাপক কেন তখন বললেন–তাঁর সাফল্যের পথে প্রধান বাধা হচ্ছেন ফ্রাই ফ্রাঙ্ক। এমন অমায়িক সুন্দরী সপ্রতিভ স্ত্রীর বিরুদ্ধে কী তার অভিযোগ? বুঝে উঠতে পারলেন না সেটা। যাই হোক, মধ্যরাত্রে গ্রোভস্ বিদায় নিয়ে উঠে পড়েন। ওঁরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন অতিথিকে গাড়িতে তুলে দিতে। বিদায় বেলায় গ্রোভস্ গৃহস্বামীকে বললেন, আপনাদের আতিথেয়তার কথা জীবনে ভুলব না আমি!

কোথাও কিছু নেই ধক্ করে জ্বলে উঠল শ্রীযুক্তা ফ্রাঙ্কের নীল চোখ দুটো। যেন অপমানকর কোনো উক্তি করেছেন গ্রোভস। মুহূর্তে বদলে গেলেন তিনি। বললেন, কী বললেন? কোনোদিন ভুলবেন না? কোনো দিন নয়?

গ্রোভস স্তম্ভিত! কী হল হঠাৎ! এমন বদলে গেলেন কেন উনি?

অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, প্লিজ ডার্লিং! জেনারেল আমাদের অতিথি!

ঘুরে দাঁড়ালেন মহিলা। স্বামীর মুখোমুখি। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, সো হোয়াট? অতিথি-সৎকার তো আমি চুটিয়ে করেছি জেম। ত্রুটি রাখিনি কিছু। এবার আমাকে ব্যাপারটা সমঝিয়ে নিতে দাও।

হতাশ হয়ে শ্রাগ করলেন অধ্যাপক।

গৃহস্বামিনী আবার ঘুরে দাঁড়ালেন গ্রোভস-এর দিকে। মুখোমুখি। অসমাপ্ত বাক্যটার জের টেনে পুনরায় বলেন, কী বলছিলেন? কোনো দিন ভুলবেন না? আমার শ্বশুরবাড়ি হ্যান্সবুর্গ অথবা আমার বাপের বাড়ি ব্যাভেরিয়ায় যেদিন ওই অ্যাটম-বোমটি নিক্ষেপ করার আদেশ জারি করবেন সেদিনও নয়? আমার স্বামী সাফল্যমণ্ডিত হওয়া মাত্রই তো সে আদেশ জারি করবেন আপনি, হের জেনারেল। তাই নয়?

গ্রোভস-এর মাথা নীচু হয়ে গেল। মাটিতে একেবারে মিশে যেতে ইচ্ছে হল তার। ভুল। মারাত্মক ভ্রান্তি। এতক্ষণ ওঁর খেয়াল হয়নি–ওঁরা দুজন জার্মান। জার্মানিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার ব্রত নিয়েই তিনি আজ মানহাটান প্রকল্পের সর্বময় কর্তা। নোবেল-লরিয়েট জেমস্ ফ্রাঙ্ক মাতৃভূমিকে শ্মশানে রূপান্তরিত করবার সংকল্প নিয়েই প্রাণপাত করছেন। তাই তার সাফল্যের পথে আজ সবচেয়ে বড় বাধা–ফ্রাই ফ্রাঙ্ক!

হে ঈশ্বর! প্রথম পরমাণু-বোমার বিস্ফোরণ যেন অন্তত ওই ব্যাভেরিয়াতে না হয়!

.

০৭.

তৃতীয় পরিদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার সর্বময় কর্তা ই. ও. লরেন্স (1901-1958)। তিনিও নোবেল-লরিয়েট (1939)। দীর্ঘদেহী, প্ল্যাটিনাম-ব্লন্ড চুল, অথচ মুখখানা ছেলেমানুষের মতো অপাপবিদ্ধ। প্রফেসর লরেন্স গাড়ি নিয়ে নিজেই এসেছিলেন সানফ্রান্সিস্কো এয়ারোড্রামে। গ্রোভস আত্মপরিচয় দিতে সহৃদয় করমর্দন করে বললেন, জেনারেল, আমি শুনেছি ইতিমধ্যে আপনি কলোম্বিয়া আর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এসেছেন। এখানে আমরা অনেকটা এগিয়ে আছি। চলুন, আমরা সরাসরি রেডিয়েশান হিল-এ যাব–মানে আমাদের ল্যাবরেটারিতে।

দীর্ঘ পথশ্রমে গ্রোভস্ ছিলেন ক্লান্ত। কিন্তু তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন তিনি। শিকাগো এবং নিউ ইয়র্কের অবস্থা দেখে হতাশ হয়েছেন–এখানে লরেন্স বলছেন, কাজ অনেকটা এগিয়ে আছে। বেশ, দেখাই যাক।

লরেন্স নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন ওঁকে। গ্রোভস তার যুদ্ধ পরবর্তী স্মৃতিচারণে বলেছেন, “যুদ্ধ চলাকালে আমার জীবনে সবচেয়ে লোমহর্ষক কটি মুহূর্ত ছিল সানফ্রান্সিস্কো থেকে রেডিয়েশান হিল-এ আসা। মনে হল, আমি বুঝি মোটর রেসিং-এর প্রতিযোগী। নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি চালালেন লরেন্স, কোনো ট্রাফিক-রু না মেনে। স্থানীয় লোকেরা বোধহয় গাড়িটাকে চেনে, পুলিস-পুঙ্গবেরাও এই পাগলা নোবেল-লরিয়েট ড্রাইভারের গাড়ির নম্বর-প্লেটের সঙ্গে পরিচিত। না হলে এই দশ মিনিট ড্রাইভিং-এ দশটা নোটবুকে ওঁর গাড়ির নম্বর উঠে যাবার কথা।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ–আমরা আধঘণ্টার পথ দশমিনিটে পাড়ি দিয়ে অক্ষত শরীরে এসে উপস্থিত হলাম গন্তব্যস্থলে। প্রফেসর লরেন্স সুইচ-অফ করে বলেন, আসুন।

“আমি বলি, একটু অপেক্ষা করুন প্রফেসর। নোটবইতে একটা কথা লিখে রাখি।

“গাড়ি থেকে নামবার আগেই নোটবইতে লিখে রাখলাম–আর্নেস্ট লরেন্স-এর গাড়ির জন্য একটি সরকারি ড্রাইভার নিযুক্ত করতে হবে। লরেন্সকে স্টিয়ারিঙে বসতে দেওয়া হবে না। হেড-কোয়াটার্সে পোঁছে এটাই হবে আমার প্রথম ডিটেশান। সামরিক আদেশ।”

লরেন্স ওঁকে বিচিত্রদর্শন একটি যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এটা তার নিজস্ব আবিষ্কার। সদ্য আবিষ্কৃত। নাম হচ্ছে ক্যালুট্রন। ক্যালু” হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্মৃতিবাহী, আর “ট্রন” সাইক্লোট্রন যন্ত্রের শেষাংশ। গ্রোভস সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, এতে কী হয়?

এক গাল হাসলেন লরেন্স। সে হাসিতেই যেন জবাব-অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন! ইহলোকে সুখি, অন্তে গোলোকে গমন!

-বলছি শুনুন। আপনি জানেন–আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউ-238 থেকে ইউ-235কে বিচ্ছিন্ন করা। কলোম্বিয়াতে ওঁরা সেটা করতে চাইছেন ছ্যাঁদাওয়ালা টিউবের মধ্য দিয়ে গ্যাসীয় অবস্থায় ইউরেনিয়ামকে পাঠিয়ে। আমার এটা হচ্ছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পদ্ধতি। এই ক্যালুট্রন যন্ত্রে আছে একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড। গ্যাসীয় অবস্থায় ইউরেনিয়াম যখন এই যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাবে তখন চৌম্বক-আকর্ষণে হালকা ইউ-235 অপেক্ষাকৃত ভারী ইউ-238 থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ব্যাপারটা কেমন জানেন? মনে করুন একই ফোর্সে দুটি পাথরকে ছোঁড়া হল–একটা ভারী একটা হালকা। তাহলে কী হবে? হালকা পাথরটা এগিয়ে যাবে, নয় কি?

সহজ ব্যাখ্যা। গ্রোভস্ প্রশ্ন করেন, কতক্ষণ চালানো হবে যন্ত্রটা?

–অন্তত চব্বিশ ঘন্টা।

 –চালিয়ে দেখেছেন? কত পার্সেন্ট সেপারেশন হচ্ছে?

–না জেনারেল। যন্ত্রটা মিনিট পনেরোর বেশি চালানো যাচ্ছে না বর্তমানে। যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিচ্ছে তার মধ্যে। গরম হয়ে যাচ্ছে।

-বলেন কী? তাহলে এতদিনে কতটুকু ইউ-235 পেয়েছেন?

-না, না, এখনও আমরা একটুও ইউ-235 পাইনি। তবে পাব, শীঘ্রই পাব। কী বলেন?

***

সব কয়টি কেন্দ্র ঘুরে গ্রোভস্ এসে দেখা করলেন যুদ্ধসচিবের সঙ্গে।

বললেন, স্যার, একজন বৈজ্ঞানিক সহকারী আমার চাই। পদার্থবিজ্ঞানী। বে-সামরিক সহকারী।

বৃদ্ধ স্টিমসন বলেন, নিশ্চয়। আপনি তাকে নির্বাচন করুন। তেমন কোনো লোক জানা আছে আপনার?

–আছে স্যার। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট জে. ওপেনহাইমার।

–তাকে বাজিয়ে দেখুন। যাচাই করুন। ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করুন।

ধন্যবাদ স্যার।

***

যুদ্ধ-সচিব যেমন এককথায় মেনে নিয়েছিলেন, তার অধীনস্থ চিফ অফ স্টাফ জেনারেল মার্শাল কিন্তু তেমনিভাবে এ নির্বাচন মেনে নিলেন না। কে এই রবার্ট জে. ওপেনহাইমার, যাকে জেনারেল গ্রোভসস্ এতবড় সম্মানজনক পদে বসাতে চাইছেন? সে কি নোবেল-লরিয়েট? সে কি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো অসামান্য দানের অধিকারী? বয়সে, পদমর্যাদায় সে কি ওই এক ডজন নোবেল-প্রাইজ-পাওয়া ধুরন্ধর বৈজ্ঞানিককে নিয়ে কারবার করতে পারবে? ওই অজ্ঞাতনামা ওপেনহাইমারের বায়োডাটার’ ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছিলেন জেনারেল মার্শাল। দুর্ভাগ্যবশত প্রতিটি প্রশ্নের জবাবই হচ্ছিল নেতিবাচক! বায়োডাটা অনুযায়ী।

উনিশ শ চার সালে নিউ ইয়র্কে জন্ম। পিতা জার্মানি থেকে এসেছিলেন সতেরো বছর বয়সে। একজন সাফল্যমণ্ডিত বিজনেসম্যান। মায়ের জন্ম বালটিমোরে। বিবাহের আগে ছিলেন আর্টিস্ট এবং আর্ট-শিক্ষিকা। ওপেনহাইমার 1922-এ হাভার্ড কলেজে ভর্তি হয়, তিন বছর পরে ডিগ্রি পায়। চলে যায় কেমব্রিজে। পরে জার্মানির গোটিনজেন-এ। 1927-এ ডকটরেট পায় সেখান থেকে। তারপর হাভার্ড-এ বছরখানেক ফেলোশিপ পায়, পরে লিডেন ও জুরিখে চাকরি করে। এর পরে ফিরে আসে আমেরিকায়। গত বারো-তেরো বছর সে বার্কলেতে অধ্যাপনায় নিযুক্ত আছে।

অর্থাৎ নেহাত মামুলি কেরিয়ার। বড়জোর বলতে পারা যায়, গড়পড়তা ছাত্রদের চেয়ে কিছু ওপরে। মন্দ নয়-এর ওপর–চলনসই। ওর সমবয়সী এবং সহাধ্যায়ী ছাত্ররা ইতিমধ্যে অনেক-অনেক বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক কাজ করেছে, নোবেল পুরস্কার পেয়েছে–যেমন হেইসেনবের্গ, ফের্মি, ডিরাক, জোলিও-কুরি ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ ওপেনহাইমার

জেনারেল মার্শাল শেষ পর্যন্ত ডেকে পাঠালেন গ্রোভসকে। বললেন, আমি দুঃখিত জেনারেল, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এই ওপেনহাইমার ছোকরাকে দিয়ে আমাদের কাজ চলবে না।

-কেন জেনারেল?

–কী দেখে নির্বাচন করলেন ওকে? এতগুলো নোবেল-লরিয়েটকে

বাধা দিয়ে গ্রোভস্ বলেন, নোবেল-লরিয়েটদের চালাতে হলে নোবেলতর-লরিয়েট চাই এ ধারণা হল কেন আপনার? আমি তো সাধারণ পি. এইচ. ডি.-ও নই, তবু তো বেশ চলছে আমার।

–আপনার কথা আলাদা। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো–কী দেখেছেন আপনি ওই ছোকরার ভিতর?

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জেনারেল গ্রোভসস বলেন, আমি ওর চোখে আগুন জ্বলতে দেখেছি জেনারেল!

মার্শাল সামরিক অফিসার, প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। প্রাগম্যাটিক! এমন ভাবালুতা কখনও লক্ষ্য করেননি ইতিপূর্বে। আর কোনো প্রশ্ন করেন না উনি। বলেন, ইফ য়ু মাস্ট-ওয়েল, হ্যাভ হিম। প্রোভাইডেড…….

হ্যাঁ, ‘প্রোভাইডেড’! যদি এফ. বি. আই. ওকে ক্লিয়ারেন্স দেয়। এতবড় দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করার আগে রাষ্ট্রের গুপ্তচর বাহিনিকে সুযোগ দিতে হবে। তারা চিরে-চিরে ফালাফালা করে দেখবে ওপেনহাইমারের অতীত ইতিহাস। লোকটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় কিনা। তাতে অবশ্য গ্রোভস্ রাজি। রাজি হতেই হবে। এই হচ্ছে আইন। স্থির হল, ওপেনহাইমারকে সাময়িকভাবে কাজে বহাল করা হবে। প্রভিশানালি। এফ. বি. আই-য়ের ক্লিয়ারেন্স পেলে তাকে দেওয়া হবে পাকা নিয়োগপত্র।

***

ওপেনহাইমার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দীর্ঘ দিনের ছুটি নিয়ে এসে যোগ দিল জেনারেল গ্রোভসস-এর দপ্তরে। ছায়ার মতো ঘুরতে লাগল সে বড়সাহেবের সঙ্গে। অচিরে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গ্রোভ। ওপির কর্মক্ষমতায়, দৈহিক ও মানসিক সহ্য ক্ষমতায়, উৎসাহে, অধ্যবসায়ে। স্থির করলেন যেমন করেই হোক ওকে কাজে আটকাতে হবে।

গ্রোভস-এর সঙ্গে সব কয়টি কেন্দ্র ঘুরে এসে ওপি বললে, স্যার, দুটো কথা আমার বলার আছে।

-বল?

প্রথমত, আপনি নৌ-বিভাগ এবং বিমানদপ্তরকে এবার ব্যাপারটা জানান। তাদের প্রস্তুত হতে সময় লাগবে। যে পাইলট প্লেনটা উড়িয়ে নিয়ে যাবে, যে বোমাটা ফেলবে তারা ইতিমধ্যে ডামি নিয়ে অভ্যাস শুরু করুক। কোটি-কোটি ডলার খরচ করে যে বোমা তৈরি হবে, ছোঁড়ার দোষে সেটা যেন ব্যর্থ না হয়।

–দ্বিতীয়ত?

–দ্বিতীয়ত, বোমা তৈরির কারখানাটা এবার বানাতে শুরু করা উচিত। পাঁচটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে–হচ্ছে দশটি কেন্দ্রে। কিন্তু ওঁরা পদ্ধতিটা থিওরেটিক্যালি’ বলবেন। সেটা বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে একটা প্রকাণ্ড তৈরি-কারখানা চাই–

–কিন্তু সে তো দেশের যে কোনো কারখানাতেই হতে পারে ডক্টর?

পারে না স্যার। সেটা হতে হবে জনমানবের বসতি থেকে বহু দূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে। বোমার ফর্মুলা যদি আমরা আজ থেকে এক বছর পরে পাই, তবে এই এক বছরের ভিতর আমাদের ফ্যাক্টরি, স্টাফ-কোয়াটার্স, জল-বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি সব কিছু শেষ করে তৈরি হয়ে থাকতে হবে। নয় কি?

গ্রোভস খুশি হলেন। অত্যন্ত খুশি হলেন। বলেন, সত্যি কথা বলতে কি এটা আমিও ভেবেছি। ইতিমধ্যে তিন চারটে সম্ভাব্য ‘সাইট’ ঠিক করেও রেখেছি। চল, আমরা দুজনে সেগুলি দেখে আসি।

সম্ভাব্য স্থানগুলির তালিকা দেখে ওপেনহাইমার বললে, আমি নিশ্চিত–আপনি শেষ পর্যন্ত এই লস অ্যালামসকেই নির্বাচন করবেন।

-কেমন করে জানলে? তুমি গিয়েছ ওখানে?

-ওখানে আমার বাড়ি। ছেলেবেলায় ওখানকার স্কুলে পড়েছি–নিউ মেক্সিকোর রাঞ্চে আমার কৈশোর কেটেছে। জায়গাটা হবে এ কাজের জন্য আইডিয়াল সাইট।

নিউ-মেক্সিকোর এক জনমানবহীন প্রান্তরে অস্তেবাসী জনপদ সান্তা-ফে। সেখানে থেকে একটা উদাসী সড়ক চলে গেছে পাহাড়ের ওপর। ওই পাকদণ্ডী পথের প্রান্তে আছে একটা ছোট্ট স্কুল। 1918 সালে ওই লস অ্যালামস রাঞ্চ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার–আলফ্রেড জে কর্নেল। এখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ। সংসারে কেউ নেই। ওই স্কুলটা তার প্রাণ। ওপেনহাইমার ঠিক তার ছাত্র নয়, তবু দুজনেই দুজনকে চেনেন। সমুদ্র সমতল থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে ভারি সুন্দর পরিবেশে এই স্কুলটি অবস্থিত। মাঝে মাঝে শিকারীরা আসে বন্দুক নিয়ে–ওখানকার পার্বত্য অরণ্যে এখনও প্রচুর হরিণ পাওয়া যায়; আর পাওয়া যায় গেম বার্ডস। শান্ত পরিবেশ বন্দুকের মুহুর্মুহু গর্জনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেদিন বৃদ্ধ কর্নেল বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়েন। তারপর শিকারীরা আবার চলে যায়, স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে খেলায়, পড়ায় মেতে ওঠেন বৃদ্ধ।

একদিন ওই স্কুলের সামনে এসে থামল একটা জিপ। নেমে এলেন তিনজন ভদ্রলোক। বেসামরিক লোক। তার মধ্যে ‘ওপি’কে চিনতে পারলেন বৃদ্ধ কর্নেল। বলেন, আরে এস এস। তুমি কী মনে করে? কই বন্দুক আনোনি তো?

–বন্দুক! বন্দুক কী হবে স্যার?

–ও! শিকার করতে আসনি তাহলে? বাল্যভূমি দেখতে এসেছ? তা ভালো। কিন্তু এঁরা?

মিস্টার গ্রোভস, মিস্টার নিকলস্-আমার বন্ধু।

 বৃদ্ধ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার স্কুলটা দেখালেন। ছেলেদের দেখালেন। খুশিয়াল হয়ে উঠলেন তিনি। ওপেনহাইমারের মনের ভিতর তখন কী হচ্ছিল তা কেউ খেয়াল করেনি।

সমস্ত এলাকাটা পরিদর্শন শেষ করে সিভিলিয়ানবেশী তিনজন আবার ফিরে এলেন নিউইয়র্কে। হ্যাঁ, জায়গাটা পছন্দ হয়েছে গ্রোভূ-এর।

সাতদিন পরে আলফ্রেড কর্নেল একটি মর্মান্তিক আদেশ পেলেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে তার স্কুল এবং তৎসংলগ্ন সমস্ত জমি, মায় গোটা পাহাড়টা সরকার জবরদখল করছেন। না, ঠিক জবরদখল নয়, খেসারত বাবদ একটা চেকও যুক্ত ছিল পত্রের সঙ্গে। মাথায় হাত দিয়ে বসলেন বৃদ্ধ। এ কী হল? কেমন করে হল? কাকে ধরবেন? কার কাছে দরবার করবেন? আচ্ছা ‘ওপি’কে চিঠি লিখলে কেমন হয়? সে তো এখন মস্ত অধ্যাপক। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রফেসর!

কিছুতেই কিছু হল না। সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হল। ছাত্ররা ফিরে গেল যে যার বাড়ি। লাইব্রেরির বইগুলো বিলিয়ে দিলেন। চেকটা ক্যাশ করতে পাঠালেন ব্যাঙ্কে।

চেক-এর অঙ্কটা বড় জাতেরই ছিল। বৃদ্ধের বাকি জীবনের খোরপোশ চলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি। চেক ক্যাশ হয়ে আসার আগেই ভগ্নহৃদয়ে আলফ্রেড কর্নেল মারা গেলেন। ঈশ্বরকে ওপেনহাইমার ধন্যবাদ দিয়েছিল কি সেজন্য? বৃদ্ধের মুখোমুখি তাকে দ্বিতীয়বার দাঁড়াতে হল না বলে?

গ্রোভস-এর প্রথমে ধারণা ছিল এখানে শতখানেক বৈজ্ঞানিক এসে হয়তো কাজ করবেন। প্রাথমিক ব্যবস্থা সেই মতোই হয়েছিল। কিন্তু বছর শেষ না হতে ওখানে এলেন সাড়ে তিনহাজার কর্মী, পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াল ছয় হাজারে।

বিজন প্রান্তরে এমন একটা কারখানা কেন গড়ে উঠছে–কী তৈরি হবে ওখানে, একথা সততই জিজ্ঞাসা করে সকলে। জবাব পায় না। বুঝতে পারে না তারা। ওখানে যারা আসে, থাকে, তারা মিলিটারি পোশাকের নোক নয়, সবই সিভিলিয়ান।

***

চূড়ান্ত গোপনীয়তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল লস-অ্যালামস-এ। প্রতিটি বৈজ্ঞানিকের একটা করে নামকরণ করা হল। সেই নতুন নামে তাদের চিঠিপত্র আসত। আসত একই ঠিকানায়—’ইউনাইটেড স্টেট আর্মি, পোস্ট অফিস বক্স নং 1663’-এই ঠিকানায়। লস অ্যালামস তো দূরের কথা, খামের ওপর নিউ-মেক্সিকো পর্যন্ত লেখা হত না। প্রতিটি বৈজ্ঞানিকের ব্যক্তিগত চিঠি আসা এবং যাওয়ার পথে সেনসর করা হত। কোনো গোপন খবর যেন কোনোভাবে বাইরে পাচার হয়ে যায়। অধিকাংশ বিজ্ঞানী স্ত্রী-পুত্র পরিজনদের ছেড়ে এসেছেন। তারা শুধু জানতেন স্বামী যুদ্ধের গোপন-কাজে নিযুক্ত। কী কাজ, কোথায় কাজ তা জানতেন না। বিজ্ঞানীদের কড়া হুকুম দেওয়া হয়েছিল পরস্পরকে যেন ‘ডক্টর’ বা ‘প্রফেসর’ জাতীয় সম্বোধন না করেন। এতে সন্দেহের উদ্রেক করবে। তাহলে রাম-শ্যাম-যদু ভাবতে বসবে–এতগুলি পি. এইচ. ডি. অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই বিজন প্রান্তরে কেন জমায়েত হয়েছেন? হয়তো গোটা পরিকল্পনাটাই তাতে বানচাল হয়ে যাবে! সম্বোধন করতে হবে শুধু ‘মিস্টার’ বলে। অনেকের সেটা ভুল হয়ে যেত। অধ্যাপকসুলভ অন্যমনস্কতায় ভুল সম্বোধন করেই মনে মনে জিব কাটতেন! একবার এডওয়ার্ড টেলর সান্তা-ফেতে একটি মর্মর মূর্তি দেখিয়ে তার বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন–ওটা কার মূর্তি?

বন্ধু অ্যালিসনও পদার্থবিজ্ঞানী। রসিক ব্যক্তি। তিনি টেলরের কানে কানে বললেন, মূর্তিটা আর্চবিশপ লামির। কিন্তু খবরদার–তোমাকে যদি কেউ এ প্রশ্ন করে তবে বলবে ‘মিস্টার’ লামির। ভুলেও আর্চবিশপ’ বোলো না যেন!

সরল প্রকৃতির টেলর অবাক হয়ে বলেন, কেন? পাথরের মূর্তিতে আবার গোপনীয়তা কিসের?

অ্যালিসন বিজ্ঞের হাসি হেসে বলেন, আছে, ব্রাদার, আছে! বুঝলে না? নাহলে রাম-শ্যাম-যদু ভাবতে বসবে, এতগুলি কাক কেন প্রত্যহ ওঁর মাথায় ‘ইয়ে’ ত্যাগ করে। খ্রিস্টধর্মটাই হয়তো বানচাল হয়ে যাবে!

বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিক নীলস বোহর-এর নতুন নাম দেওয়া হল ‘নিকোলাস বেকার। বাঘা বাঘা ফমূলা ওঁর কণ্ঠস্থ অথচ এই নামটা তার মনে থাকত না। মিটিং-এর ভিতর কেউ হয়তো প্রশ্ন করে ওঠে–মিস্টার বেকার এ বিষয়ে কী বলেন?

বোহর নির্বিকারভাবে ব্যোম মেরে বসে থাকেন। ওঁর কোনো ছাত্র তখন হয়তো ওঁর কানে কানে বলে, স্যার, আপনাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে–

প্রফেসর আঁৎকে উঠতেন, হু? মি? গুড হেভেন্স! আমার মনেই থাকে না যে আমার নাম বোহর নয়, বেকার!

অতঃপর মিটিং-এ উপস্থিত আর কারও জানতে বাকি থাকে না ‘নিকোলাস বেকার’ কার ছদ্মনাম!

***

আর একবার। সেটা নিউ ইয়র্কে। প্রফেসর বোহর একটা অত্যন্ত জরুরি ও গোপনীয় মিটিং-এ যোগদান করতে যাচ্ছেন। অন্যমনস্ক অধ্যাপকটির জন্য সদা-সর্বদা একজন দেহরক্ষীর ব্যবস্থা ছিল। সিকিউরিটি-ম্যান। গন্তব্যস্থলে ও পৌঁছে দিয়ে লোকটা বিদায় নিল। মিটিং-এ বেচারি যেতে পারবে না। লিফ-এ মুখে ওঁকে রেখে শেষবারের মতো ফিসফিস করে মনে করিয়ে দেয়; প্লি প্রফেসর, মনে রাখবেন আপনার নাম নীলস বোহর নয়, নিকোলাস বেকার। কেমন?

-ঠিক আছে। ঠিক আছে! আমি অত অন্যমনস্ক নই! আমি ভুলিনি!

লিফট এসে দাঁড়াল। ওঁর সঙ্গে একই লিফট-এ উঠেছেন একটি মহিলা : স্বয়ংক্রিয় লিস্ট। চালক নেই। তৃতীয় যাত্রীও নেই। রুদ্ধদ্বারকক্ষে একটি মহিলা সহযাত্রী দেখে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে কোণ নিলেন অধ্যাপকমশাই। মহিলাটি এঁকে আদৌ নজর করেননি। একমনে একটা খবরের কাগজ দেখছেন তিনি। হঠাৎ প্রফেসর বোহর-এর মনে হল মহিলাটি তার অত্যন্ত পরিচিত। আরে! এ যে হালবানের স্ত্রী। হালবান ছিলেন ডেনমার্কে ওঁর সহকর্মী। প্রফেসর সবিনয়ে প্রশ্ন করেন :

–মাপ করবেন, আপনি কি ফ্রাই ফন হালবান নন?

নীলস বোহর জানতেন না, তার বন্ধু হালবানের সঙ্গে স্ত্রীর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে এবং মহিলাটি মিস্টার প্লাজেককে ইতিমধ্যে বিবাহ করেছেন। ভদ্রমহিলা কাগজ থেকে মুখ না তুলে বললেন, আজ্ঞে না! আপনার ভুল হচ্ছে স্যার আমার নাম মিসেস প্লাজেক।

–আয়াম সরি!

লিফট ওপরে উঠছে। হঠাৎ কাগজ থেকে মুখ তুলে মহিলাটি তার সহযাত্রীর দিকে চোখ তুলে চাইলেন। একেবারে লাফিয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, কী আশ্চর্য! আপনি! প্রফেসর বোহর!

প্রফেসর বোহর গম্ভীরভাবে বললেন, আপনার ভুল হয়েছে মাদাম–আমার নাম নিকোলাস বেকার!

লিফট পৌঁছে গেল! গটগট করে এগিয়ে গেলেন নিকোলাস বেকার। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন মিসেস প্লাজেক! ঋষিপ্রতিম প্রফেসর বোহর এমন বেমক্কা মিথ্যা কথা বললেন কেন?

.

০৮.

অশান্তভাবে নিজের ঘরে পদচারণা করছিলেন জেনারেল গ্রোভসস। ওপিকে ডেকে পাঠিয়েছেন অনেকক্ষণ। এখনও আসছে না কেন সে? কিন্তু এলে তিনি কী বলবেন? কেমন করে জেনে নেবেন প্রকৃত সত্যটা? ওপি, ওপেনহাইমারকে তার চাই,–নিতান্তই অপরিহার্য সে। এই কয়েকমাসে সে মন্ত্রের মতো সমস্ত প্রকল্পটাতে যেন প্রাণ সঞ্চার করেছে। তার অধ্যবসায়ে, কর্মপদ্ধতিতে, তার উৎসাহে অভিভূত হয়ে পড়েছেন গ্রোভস, এখন তাকে কোনক্রমেই ছাড়া যায় না। অথচ

হ্যাঁ। এফ. বি. আই. থেকে রিপোর্ট এসেছে ইতিমধ্যে। গুপ্তচর দপ্তর স্পষ্ট করে জানিয়েছে, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট জে ওপেনহাইমারকে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দেওয়া যাবে না। তিন-তিনটি ছিদ্র তারা বার করেছে ওপির পূর্ব-ইতিহাস হাড়ে। এক নম্বর, সে দীর্ঘদিন ধরে কম্যুনিস্ট চিন্তাধারা প্রচার করত। দু নম্বর, ওর ভ্রাতৃবধূ ‘জ্যাকি’ একজন কম্যুনিস্ট ছিল। আর তিন নম্বর, ওর স্ত্রীর প্রথমপক্ষের স্বামী ছিল একজন উৎসাহী কম্যুনিস্ট কর্মকর্তা।

গ্রোভস্ টেবিলের ওপর থেকে একখানি পত্রিকা তুলে পাতা উল্টাতে থাকেন। ‘পিপলস ওয়ার্ল্ডের’ বর্তমান সংখ্যা। পত্রিকাটির নামই শোনা ছিল না। রিপোর্টখানা পড়ে কৌতূহলের বশে আজ একখানা কিনে ফেলেছেন। পাতা উল্টে দেখছিলেন, কই তেমন কোনো মারাত্মক রচনা তো নজরে পড়ল না?

–গুড মর্নিং স্যার!–ওপি এসেছে।

 –এস, বস বস।

 ভিজিটার্স চেয়ারে বসতে বসতে ওপেনহাইমার বলে, এ কি স্যার? আপনার হাতে পিপল্স ওয়ার্ল্ড!

-কেন? এটা কি নিষিদ্ধ কোনো পত্রিকা?

–না। নিষিদ্ধ ঠিক নয়, তবে ওরা তো ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করে না—

–তাই নাকি? আমি পড়ে দেখিনি। তুমি পড়েছ?

–এ সংখ্যাটা পড়িনি। বস্তুতপক্ষে গত তিন-চার বছর পড়িনি। তবে এককালে আমি ওই পত্রিকার সভ্য ছিলাম।

-তাই নাকি?

–শুধু তাই নয় স্যার, ছদ্মনামে এককালে আমি ওতে প্রবন্ধও ছাপিয়েছি! স্তম্ভিত হয়ে গেলেন গ্রোভস্। এ খবরটা তো এফ. বি. আই.ও পায়নি। অথচ ও কেমন সরল বিশ্বাসে বলে গেল! পুনরায় প্রশ্ন করেন, সে সময় তোমার বুঝি ক্যমুনিজম-এ বিশ্বাস ছিল?

–তা ছিল। কিছুটা আমার ভাইয়ের প্রভাব—

ভাই! ভাই কে?

–আমার ভাই ফ্রাঙ্ক ছিল ঘোর কম্যুনিস্ট। তার স্ত্রী জ্যাকলিনও তাই। এখন অবশ্য তাদের মত বদলে গেছে। যাই হোক, আমাকে ডেকেছিলেন কেন?

মনের মেঘ অনেকখানি সরে গেছে ইতিমধ্যে। গ্রোভস্ শেষ প্রশ্নটা এড়িয়ে বলেন, কিছু মনে কর না ওপি, তোমাকে একটি পারিবারিক প্রশ্ন করছি। তোমার স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামীও কি একজন কম্যুনিস্ট ছিলেন?

–ছিলেন। তাঁর নাম জো ড্যালবর। তিনি ছিলেন স্পেনের একজন নেতৃস্থানীয় কম্যুনিস্ট পার্টি অফিশিয়াল। স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি মারা যান।

–তার মানে তোমার স্ত্রীও কিছুটা

–কিছুটা কেন? এককালে তিনিও ঘোর কম্যুনিস্ট ছিলেন।

একটু ঘুরিয়ে গ্রোভস বললেন, আমি ভাবছি–এসব কথা আবার এফ. বি. আই. খুঁচিয়ে বের করবে না তো? তুমি তো জানই, এফ. বি. আই.-এর ক্লিয়ারেন্স ছাড়া

–হ্যাঁ, জানি বই কী! কিন্তু খুঁচিয়ে বার করার কী আছে? আমাকে প্রশ্ন করলেই আমি অকপটে সব বলব। এককালে কম্যুনিস্ট ডকট্রিন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল একথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। কিন্তু বর্তমানে আমি ডেমোেক্রাসির পূজারী। শুধু আমি নই–আমরা সবাই। আমি, আমার স্ত্রী, আমার ভাই, তার স্ত্রী!

সে যাই হোক আমাকে ডেকেছিলেন কেন?

‘কেন ডেকেছিলেন’ তার কৈফিয়ৎ গ্রোভস কী দিয়েছিলেন, আদৌ দিয়েছিলেন কিনা তার কোনো প্রমাণ নেই। যা আছে তা হচ্ছে সমর বিভাগের একটি গোপন নথি। ওই জুলাই-এর বিশ তারিখে লেখা। চিঠিখানা হুবহু অনুবাদ করে দিলাম–

গোপনতম পত্র

যুদ্ধবিভাগ
চিফ ইঞ্জিনিয়ার দপ্তর
ওয়াশিংটন, জুলাই 20, 1943

বিষয় : জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার
 প্রাপক : দ্য ডিস্ট্রিক্ট এঞ্জিনিয়ার, মানহাটান ডিস্ট্রিক্ট
স্টেশন ‘এফ’, নিউ ইয়র্ক।

পনেরই জুলাই তারিখে প্রদত্ত আমার মৌখিক নির্দেশের পরিপূরক হিসাবে এতদ্বারা অনুরোধ জানানো যাইতেছে যে, উপরুল্লিখিত ব্যক্তিকে অবিলম্বে প্রস্তাবিত পদে নিযুক্ত করা হউক। ইহাও উল্লেখ থাকে যে, তাহার বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ ইতিপূর্বে আপনি আমাকে জানাইয়াছেন তাহা পাঠান্তে সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে বিশেষ ক্ষমতাবলে আমি এই আদেশ জারি করিতেছি। উল্লিখিত ব্যক্তি এই প্রকল্পের পক্ষে অনিবার্য।

— এল, আর. গ্রোভস
ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল, সি, ই,

তরোয়ালের এক কোপে সব রকম বাধাবিঘু সরিয়ে দিলেন সামরিক অফিসারটি।

ওপি হলেন লস-অ্যালামসের অফিশিয়াল কর্ণধার!

***

লস অ্যালামসে একে একে এসে জুটলেন বিজ্ঞানীরা। মূল-নিয়ামক ওপি। পৃথিবীর ইতিহাসে এতগুলি প্রথমশ্রেণির বৈজ্ঞানিক কখনও একত্র হয়ে একযোগে কাজ করেননি। এলেন–ৎজিলাৰ্ড, গ্যামো, টেলার, উইগনার, ফের্মি, হান্স বেথে,–ফন নয়মান, ক্রিস্টিয়াকৌস্কি, রোবিনোভিচ, ওয়াইস্কফ, পার্লস, অটো ফ্রিশ, উইলিয়াম পেনি, ক্লাউস ফুকস, কেনেডি, স্মিথ, পার্সন ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। সাতটি বিভাগ, তার সাতজন কর্ণধার–প্রত্যেকের অধীনে পাঁচ-সাতটি শাখা। থিওরিটিক্যাল বিভাগের এনরিকো ফের্মি–প্রভৃতি প্রভৃতি এবং প্রভৃতি। সকলের পরিচয় দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। দু-চার জনের কথা বলি–

হান্স বেথে নোবেল-লরিয়েট জার্মান। নাৎসি শাসনে উত্যক্ত হয়ে 1935-এ পালিয়ে আসেন আমেরিকায়। তাঁর জীবনের এক কৌতুককর অভিজ্ঞতার কথা বলি–যা থেকে বোঝা যাবে, বিজ্ঞানীরা রাজনীতিকদের পাল্লায় পড়ে কী জাতীয় নাকাল হতেন। পারির পতনের সময়ে (1940) আমেরিকায় উদ্বাস্তু হ্যান্স বেথে একটি সমর-সম্বন্ধীয় আবিষ্কার করে বসলেন। কামানের গোলায় সাঁজোয়া গাড়ির প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার বিষয়ে একটি আবিষ্কার। কাগজপত্র নিয়ে তিনি দেখা করলেন মার্কিন সামরিক বড়কর্তার সঙ্গে। সামরিক বড়কর্তা সেটা পড়ে অভিভূত হয়ে বললেন, প্রফেসর, আপনার এ আবিষ্কার প্রভূতভাবে আমাদের কাজে লাগবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

হান্স বেথে গদগদ হয়ে বলেন, কিছু না, কিছু না–আমার পরীক্ষা কার্যটা শেষ হয়নি। আরও উন্নত ধরনের সাঁজোয়া গাড়ির চাদর তৈরি করব আমি। রিসার্চের কাগজগুলো দিন–অসমাপ্ত কাজটা শেষ করি–

বড়কর্তা বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত প্রফেসর, রিপোর্টটা আর আপনাকে ফেরত দেওয়া যাবে না। আমাদের চোখে আপনি হচ্ছেন শত্রুপক্ষের লোক, জার্মান ন্যাশনাল!

–সে কি! আবিষ্কারটা যে আমারই! আর ওটা যে অসম্পূর্ণ!

–আয়াম সরি, প্রফেসর!

—দুত্তোর ‘সরি’! ওর কপিও যে নেই আমার কাছে –

আয়াম সরি এগেন, হের প্রফেসর!

পাঠকের হয়তো মনে হচ্ছে আমি বানিয়ে বলছি! বিশ্বাস করুন-এতে একবিন্দু অতিরঞ্জন নেই। সেই হান্স বেথে বর্তমানে লস অ্যালামসের থিওরিটিক্যাল ডিভিশনের ডিরেক্টর।

***

এক্সপ্লোসিভ বিভাগের ডিরেক্টার জর্জ ক্রিস্টিয়াকৌস্কি-সংক্ষেপে ‘কিস্টি। খাস রাশিয়ান। বয়স তেতাল্লিশ। জন্ম কিয়েভ-এ। বলশেভিকদের বিরুদ্ধে শ্বেত রাশিয়ান বাহিনির হয়ে কৈশোরে লড়াই করেছিলেন। তুরস্কের ভিতর দিয়ে পালিয়ে শেষ পর্যন্ত কপর্দকহীন উদ্বাস্তু হিসাবে এসে পৌঁছান বার্লিনে। সেখানে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেন; 1925-এ চলে আসেন মার্কিন-মুলুকে। প্রিন্সটনে অধ্যাপনা করছিলেন-ওপি তাকে ধরে এনেছে লস অ্যালামসে। দুর্ধর্ষ বেপরোয়া এই কিস্টি। একবার তিনি তার সহকর্মীদের বলেছিলেন, তোমরা বোমার এই বিস্ফোরকগুলোকে খামকা ভয় পাও। ডিনামাইট নয় এই প্যাকেটগুলো–নাড়াচাড়ায় ফেটে যাবে না। অত পুতুপুতু কর কেন?

ওঁর সহকর্মীরা সৌজন্যবোধে মাথা নাড়ে। বেশ বোঝা যায়, তারা মেনে নেয় না ওঁর কথা।

প্র্যাকটিক্যাল কিস্টি বুঝতে পারেন–ওরা বিশ্বাস করছে না। তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন বিস্ফোরক-ভর্তি প্যাকিং কেসগুলো ওঁর গাড়িতে তুলে দিতে। আট-দশটা প্যাকিং-কেস গাড়ির সিটে চড়িয়ে কিস্টি বিস্মিত সহকর্মীদের চোখের সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন উনি?–ভাবছে সবাই। কোথাও যাননি কিস্টি। সামনের উবড়ো-বড়ো মাঠের মাঝখানে খানিকটা বেপরোয়া ড্রাইভ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন এক্সপ্লোসিভ বিভাগের ডিরেক্টার। চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছে সহকর্মীরা। কিস্টি গাড়ি থেকে নেমে এসে বললেন, দেখলে? ফাটলো? নাও, এবার গাড়ি থেকে ওগুলো নামাও!

আর এক রাশিয়ান বৈজ্ঞানিক হচ্ছেন গ্যামো–জর্জ গ্যামো। যাঁর “One? Two? Three… Infinity” বইটি বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেরই অবশ্যপাঠ্য। চুটকি রসিকতায়, গল্প বলায়, ধাঁধা বানানোতে অদ্ভুত পারদর্শিতা ছিল তাঁর। জন্ম রাশিয়ায় শিক্ষা গোটিনজেন-এ। হেইসেনবের্গ, ওপি, টেলার ইত্যাদির সহপাঠী। গ্যামো কীভাবে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসেন তার গল্প শুনিয়েছেন উনি। স্কুলের গণ্ডী তখন সবে পার হয়েছেন গ্যামো। ছুটিতে উনি জার্মানি বেড়াতে যাবার সংকল্প করলেন-বাসনা, স্বচক্ষে দেখে আসবেন সেই অদ্ভুত মানুষটিকে–আলবার্ট আইনস্টাইন যাঁর নাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গ্যামো অঙ্কে রেকর্ড মার্ক পেয়েছেন–ওইটাই তার প্রাইজ হিসাবে দাবি করলেন। বাবা রাজি হলেন খরচ দিতে–রাজি হলেন না রাশিয়ান গভর্নমেন্ট। সেইদিন থেকেই গ্যামোর স্বপ্ন ছিল রাশিয়া থেকে পালানো। আফগান-সীমান্ত দিয়ে প্রথমবার পালাবার চেষ্টা ব্যর্থ হল। সীমান্তরক্ষীরা ধরে ফেলল কিশোরবয়স্ক পলাতককে; কিন্তু গ্যামো তাদের বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন। ওই পাহাড়ের মাথায় চড়বার বাসনা নিয়ে বাড়ি থেকে বার হয়ে পথ হারিয়েছেন। যাই হোক, তাকে ফিরে আসতে হল। এরপর অল্পবয়সেই গ্যামো বিবাহ করেন। সদ্যবিবাহিতা বধূকে খুলে বললেন মনের কথা। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে কিশোরী মেয়েটি রাজি হয়ে যায়। একটা নৌকা নিয়ে দুজনে বার হয়ে পড়েন একদিন কৃষ্ণসাগরের বুকে। ওপারে রাশিয়ান এলাকা নয়। এই দুঃসাহসিক অভিযানটিও ব্যর্থ হল। ঝড়ের মধ্যে পড়ে এই দুলর্ভ প্রতিভার সলিল-সমাধি হতে বসেছিল। উদ্ধার করল আবার সেই সীমান্তরক্ষীর দল। রাশিয়ান বর্ডার-পুলিস। এবারও তার আসল উদ্দেশ্য তারা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ‘ওয়ান, টু, থ্রি.ইনফিনিটি’ গ্রন্থ যিনি ভবিষ্যতে লিখবেন তিনি কি প্রথম আর দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হয়েই থামতে পারেন? ইনফিনিটি পর্যন্ত যেতে হয়নি, তৃতীয় প্রচেষ্টাতেই সাফল্যমণ্ডিত হন। এসে পৌঁছালেন বার্লিনে। দেখলেন সেই মানুষটিকে, বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়–আলবার্ট আইনস্টাইনকে!

***

লস-অ্যালামসের আর একটি অদ্ভুত চরিত্র ডক্টর ক্লাউস ফুকস্ (1912-1988)। জার্মান, কিন্তু ইহুদি নন। তবু বিতাড়িত হয়েছিলেন নাৎসি জার্মানি থেকে। কপর্দকহীন অবস্থায় এসে পৌঁছান ইংল্যান্ডে (1933)। বাবা ছিলেন শান্তিকামী প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক–সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। স্পষ্টবক্তা এবং নির্ভীক। তিনি ছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী, ক্রিশ্চিয়ান কোয়েকার্স-সম্প্রদায়ের একজন কর্মকর্তা! একটি কোয়েকার্স-পরিবারেই আশ্রয় পান ক্লাউস, ইংল্যান্ডে। সাতে-পাঁচে থাকতেন না, রাজনীতি থেকে শত হস্ত দূরে থেকে পড়াশুনা শেষ করলেন ইংল্যান্ডে এসে। দুর্দান্ত ভালো রেজাল্ট হল শেষ পরীক্ষায়। ম্যাক্স বর্ন ওই সময়ে ইংল্যান্ডে–তিনি ক্লাউসকে দেখে আকৃষ্ট হলেন। জুটিয়ে দিলেন এক রিসার্চ স্কলারশিপ। সেখানেও সুনাম হল। পরে জেমস্ চ্যাডউইকের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড থেকে যে বৈজ্ঞানিক দল অ্যাটম-বোমা প্রকল্পে আমেরিকায় আসে তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে অটো ফ্রিশ (শ্রীমতী মাইটনারের সেই বোনপো, যিনি নীলস বোহর-এর ঘুষি খেয়েছিলেন), উইলিয়াম পেনি, পার্লস প্রভৃতির সঙ্গে এখানে আসেন। প্রথমে ছিলেন ওক-রিজ-এর গ্যাসীয় ডিফুশন প্রকল্পে। পরে চলে আসেন লস-অ্যালামসে। প্রচণ্ড স্মোকার, মদ্যপানও করেন প্রচুর, তবে মাতাল হন না। ব্যাচিলার, সুদর্শন–মেয়েমহলে খুবই জনপ্রিয়।

মেয়ে-মহলের কথাই যখন উঠল তখন বলি–ডক্টর ফুকস সম্বন্ধে লস-অ্যালামসে একটা গুজব বেশ চালু ছিল। তার সঙ্গে নাকি মিসেস্ অটো কার্ল-এর একটু বিশেষ জাতের সদ্ভাব ছিল। এমন গুজব তো রটতেই পারে। প্রথম কথা, ডক্টর ফুকস্ সুদর্শন, ব্যাচিলার এবং প্রফেসর অটো কার্ল বৃদ্ধ অথচ তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী রোনাটা কার্ল ডাকসাইটে সুন্দরী এবং যুবতী। কর্তা-গিন্নিতে না-হোক বিশ-বাইশ বছরের ফারাক! ডক্টর ফুকস্ এবং রোনাটা কার্ল দুজনেই স্বীকার করতেন ওঁরা দুজনে বাল্যবন্ধু। কিশোরী বয়স থেকেই রোনাটা চিনতো ফুকসকে। বস্তুত জার্মানি থেকে পালিয়ে এসে ফুস্ ওই রোনাটাদের পরিবারেই আশ্রয় পায়। আলাপটা সেই আমলের, কিন্তু দুষ্টু লোকের মন তাতে মানে না। তারা ভাবে–এর পিছনে বুঝি গভীরতর এক গোপন ইতিহাস আছে–যার রেশ আজও মেটেনি।

লস-অ্যালামসে–বস্তুত গোটা মানহাটান প্রকল্পে–ডক্টর ফু-এর একটা প্রকাণ্ড দান আছে–উনিই পরমাণু বোমার ক্রিটিক্যাল-সাইজটা অঙ্ক কষে বার করেন। সেই ‘ক্রিটিক্যাল সাইজ’-এর হিসাব এখনও ছাপা হয়নি। সেটা আজও চরমতম গোপন নথি।

***

কিন্তু ক্রিটিক্যাল সাইজটা কী?

ধরা যাক একটা ছোট্ট ইউ-235-এর টুকরোয় কোনো নিউট্রন আঘাত করে একটি পরমাণু বিদীর্ণ করল। তা থেকে নূতন দু-তিনটি নিউট্রন জন্মলাভ করবে এবং দু-তিন দিকে যাবে। ইউ-235-এর টুকরোটা আকারে ছোটো হলে নব-বিমুক্ত নিউট্রন দুটি হয়তো কিছুদূর গিয়েই থেমে যাবে, অর্থাৎ নূতন পরমাণু-অন্তর বিদীর্ণ করার আগেই তার যাত্রা শেষ করবে। এখন যদি আর একটু বড় মাপের টুকরো নিই তাহলে হয়তো একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে নিউট্রন পাব। হয়তো শেষে ওই চারটে নিউট্রনও মাঝপথে বিলুপ্ত হবে। এমনিভাবে বাড়তে বাড়তে আমরা এমন একটা নির্দিষ্ট আকারে পৌঁছাব যখন ওই চেন-রিয়্যাকশান বা ‘চক্রাবর্তন-পদ্ধতি’ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। সেই নির্দিষ্ট মাপকাঠিকেই বলে ‘ক্রিটিক্যাল-সাইজ। লস-অ্যালামসের বিজ্ঞানীরা চাইছিলেন ক্রিটিক্যাল-সাইজের চেয়ে একটু ছোট মাপের দুটি ইউরেনিয়াম টুকরোকে একটা বাধাদানকারী পদার্থের দু-পাশে রাখতে। যদি এমন হয় যে, আকাশ থেকে বোমা পড়তে পড়তে পর্দাটা গলে যাবে, তাহলে ভূপৃষ্ঠে পোঁছবার আগেই দুটি ‘সাব-ক্রিটিক্যাল’ টুকরো পরস্পরের সংস্পর্শে এসে ‘সুপার-ক্রিটিক্যাল’ হয়ে যাবে। যার অর্থ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। এই ব্যাপারটা চিত্র 9-এ বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে।

চিত্র 9. অ্যাটম-বোমা তৈরির অন্তিম ধাপ- ‘ক্রিটিকাল সাইজ’

[চিত্র 9. অ্যাটম-বোমা তৈরির অন্তিম ধাপ- ‘ক্রিটিকাল সাইজ’]

***

কিন্তু লস-অ্যালামসে সবচেয়ে অদ্ভুত চরিত্র হচ্ছেন রিচার্ড ফাইনম্যান (1918 – 1988)। ডাক নাম ‘ডিক’। সব রিচার্ড-এরই ডাকনাম হয় ডিক, যেমন সব কানাইলালের ডাক নাম কানু। ফাইনম্যানের আর এক ডাক নাম চালু হয়েছিল লস-অ্যালামসে–মসকুইটো বোট। ডিরেক্টার নোবেল-লরিয়েট হান্স বেথে সেই সুবাদে হচ্ছেন ‘ব্যাটলশিপ’! মানসাঙ্কে ফাইনম্যান ছিলেন ফের্মির মতো ধুরন্ধর। কাউকে কেয়ার করতেন না। নোবেল-প্রাইজপ্রাপ্ত বেথে, ফ্রাঙ্ক, লরেন্স ইত্যাদিকে মুখের ওপর বলতেন-‘কী বকছেন স্যার পাগলের মতো!’–’পাগলের মতো’ কথাটা ছিল তার প্রতিবাদের বাঁধা লবজ, মুদ্রাদোষ!

অদ্ভুত ফুর্তিবাজ। দুষ্টমিতে ভরা। একেবারে ছেলেমানুষ। এদিকে ধাঁধায় পাকা মাথা। ফাইনম্যানের স্ত্রী থাকতেন নিউইয়র্ক। যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী। ভদ্রমহিলারও মাথা খেলত ধাঁধার সমাধানে। স্বামী-স্ত্রী নানান ধরনের ধাঁধা নিয়ে সময় কাটাতেন। এখন দুজনে আছেন দেশের দুই প্রান্তে–তাই দুজনে চিঠিপত্র লিখতেন সাঙ্কেতিক ভাষায়। অথবা চিঠি লিখে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে পাঠাতেন। ‘জিগস’ ধাঁধার মতো টুকরা কাগজগুলি সাজিয়ে প্রাপককে পাঠোদ্ধার করতে হত। শোনা যায়, এ কাজের উদ্দেশ্য হল সেনসারকে নাকাল করা। ব্যাটারা কেন খুলে পড়বে ওঁদের প্রেমপত্র?

সেনসরের কথাই যখন উঠল তখন বলি শুনুন। সেনসরের বড় কর্তা ম্যাককিলভির সঙ্গে একবার খুব বেধে গিয়েছিল ফাইনম্যানের। ম্যাককিলভি বলে, সাঙ্কেতিক ভাষা ডি-কোড করা অপরাধ-বিজ্ঞানের একটা বিশেষ শাখা। ও-বিষয়ে যে গবেষণা করেনি তার পক্ষে এ ধাঁধার সমাধান সম্ভবপর নয়। ফাইনম্যান বলেছিলেন, লুক হিয়ার ম্যাক্, অপরাধ-বিজ্ঞানী কোনোদিনই অঙ্কশাস্ত্রের মামুলি কোনো ছোট্ট ফর্মুলাও বুঝতে পারবে না, যেমন ধরুন অতি ছোট্ট একটি ফর্মুলা : E = mc^2! কিছু বুঝলেন? অথচ দুরূহতম ক্রিমিনোলজির সমস্যা নিয়ে আসুন আমার কাছে, এক সেকেন্ডে তা ‘ফুস’–

হাতের তুড়ি বাজিয়ে ‘ফুসটা’ যে কতটা অকিঞ্চিৎকর তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

ম্যাককিলভি সে অপমান ভোলেনি। দুদিন পরেই সে এসে হাজির হল একখানা চিঠি হাতে। বললে, এক্সকিউজ মি স্যার। এ চিঠি পাস হবে না!

ফাইনম্যান দেখলেন তার স্ত্রীকে লেখা প্রেমপত্রখানা খামখোলা অবস্থায় নিয়ে এসেছে ম্যাককিলভি।

কী ব্যাপার? দেখা গেল–ফাইনম্যান স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘সাত হাজার ফুট উঁচুতে থাকায় নিউ মেক্সিকোর গরমটা আমরা টের পাচ্ছি না।

ম্যাককিলভি এক গাল হেসে বলে, E = mc ফর্মূলা না বুঝলেও এটুকু বুঝি, এইভাবে আপনি মিসেসকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আপনি বর্তমানে অছেন নিউ মেক্সিকোতে। একটা রিলিফ-ম্যাপ খুলে মিসেস্ সহজেই বুঝবেন সাত হাজার ফুট উঁচুতে কোথায় আছেন আপনি! ওই লাইনটা কেটে দিতে হবে।

দুরন্ত ক্রোধে ওর হাত থেকে চিঠিখানা ছিনিয়ে নিয়ে ফাইনম্যান কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। হাসতে হাসতে ফিরে গেল ম্যাককিলভি।

কিন্তু আবার তাকে আসতে হল। এবারও তার হাতে ফাইনম্যানের স্ত্রীকে লেখা চিঠি। এবার ফাইনম্যান স্ত্রীকে লিখেছেন “RETEP” কেমন আছে? SBM OBMOTA এ বছর এসে পৌঁছতে পারবেন বলে মনে হয় না।” পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি ম্যাককিলভি। Retep অথবা Sbm. Obmota কারও নাম হয় নাকি? চিঠিখানা নিয়ে তাই সে আবার এসেছে ওঁর দপ্তরে। বললে, মাপ করবেন প্রফেসর ফাইনম্যান, এমন অদ্ভুত নাম আমি জীবনে শুনিনি…

প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠেন ফাইনম্যান, একজ্যাক্টলি। আমিও তো তাই বলতে চাই! এমন অদ্ভুত নাম আমি জীবনে শুনিনি! প্রফেসর ফাইনম্যান। কে তিনি? আমার নাম মিস্টার হেইলি!

থতমত খেয়ে ম্যাককিলভি বলে, না…ইয়ে…এখানে তো বাইরের লোক কেউ নেই…

–বাইরের লোক নেই এই অজুহাতে আপনি আমাকে ‘প্রফেসর ফাইনম্যান’ বলে ডাকবেন? If you call me such ‘names’ I’ll report against you!

একেবারে মিইয়ে যায় বেচারি। বলে, আমি দুঃখিত। আচ্ছা আচ্ছা মিস্টার হেইলি! কিন্তু আপনার চিঠির অর্থ যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ফাইনম্যান গম্ভীরভাবে বলেন, প্রেমপত্রটি আপনার উদ্দেশ্যে আমি লিখিনি মশাই। আপনি না বুঝলেও চলবে।

  ম্যাককিলভি তবু অনুনয়ের সুরে বলে, তবু স্যার না বুঝে কেমন করে চিঠি। পাস করি বলুন? এই দুটো কথা–Retep এবং Sbm. Obmota-এর অর্থ কি?

এতক্ষণে রাগ পড়ে গেছে ফাইনম্যানের। বললেন, অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা করে সাজানো আছে। আমার স্ত্রী অনায়াসেই বুঝবেন। Retep হচ্ছে পিটার, আমার ছেলে। আর Sbm. Obmota হচ্ছেন Mrs. Mobota আমার পুত্রের গর্ভনেস; কিউবান মহিলা একজন। ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন; এ বছর আর ফিরবেন বলে মনে হয় না।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ম্যাককিলভির। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় হল সে।

ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়। সিকিউরিটি অফিসার ম্যাককিলভির নাকে ফাইনম্যান ঝামা ঘষে দিয়েছেন–এ খবরে সবাই খুশি। এরপর থেকে অনেকেই ওঁর পরামর্শ নিতে আসে–কেমন করে সেনসরকে এড়িয়ে বাড়িতে কোনো বিশেষ খবর জানানো যায়।

ম্যাককিলভির নাকে ফাইনম্যান কী পরিমাণ ঝামা ঘষেছিলেন তা অবশ্য সঠিক জানতে পারেনি কেউ। ঘটনাটা নিম্নেক্তরূপ–

দিনতিনেক পরে ম্যাককিলভি ডাকে একখানা টাইপ করা চিঠি পায়। ছোট্ট চিঠি। তাতে লেখা ছিল; “প্রিয় ইডিয়ট,

তোমাকে চারটে খবর জানাচ্ছি। এই চিঠিখানা পড়েই ছিঁড়ে ফেল। আর খবর চারটে বেমালুম গিলে ফেল। হজম করে ফেল। জানাজানি হলেই তোমার চাকরি নট। বুঝলে হাঁদারাম?

এক নম্বর খবর :প্রফেসর ফাইনম্যানের পিটার নামে কোনো পুত্রসন্তান নেই।

দুই নম্বর : পিটার একজন রাশান-এজেন্টের ছদ্মনাম।

তিন নম্বর : মিসেস মোবোটো নামে কোনো চাকরানী ওঁর নিউ ইয়র্কের ডেরায় কোনোদিন ছিল না।

চার নম্বর : চিঠিতে অক্ষরগুলো আদৌ উল্টোপাল্টা করে সাজানো ছিল না। ছিল, স্রেফ উল্টো করে সাজানো। Retep উল্টো করলে হয় Peter; কেমন তো? এবার SBMOB MOTA কথাটি উল্টে নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করত মূর্খ-সম্রাট-কথাটা জানাজানি হলে তোমার চাকরি থাকবে কিনা!

Guess Who!”

“বলতো কে?”-র নির্দেশ আধাআধি পালন করেছিল ম্যাককিলভি। চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে; কাউকে জানায়নি, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ওই অজ্ঞাত পত্রলেখকের প্রথম ও তৃতীয় সংবাদ নিছক সত্য!

এ কাহিনি-বর্ণিত বিশ্বাসঘাতক যতদিন না গ্রেপ্তার হয় ততদিন–দীর্ঘ তিনটি বছর ম্যাককিলভি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি। তার হিতৈষী ওই পত্ৰলেখককে খুঁজে বার করবার চেষ্টাই করেনি সে। অনুশোচনায় আর অন্তর্দ্বন্দ্বে কাটা হয়ে ছিল। পাক্কা তিনটি বছর।

***

লস অ্যালামসে নীলস বোহর-এর প্রথম আবির্ভাব প্রসঙ্গেও ফাইনম্যানের নামটা লিপিবদ্ধ রয়েছে দেখছি। প্রফেসর বোহর কী একটা নূতন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। লস অ্যালামসের বিজ্ঞানীদের তিনি সেটা জানাবার জন্য এসে হাজির হলেন, লেকচারের নির্ধারিত দিনের আগের দিন। পরদিন প্রফেসর বোহর একটা নূতন কিছু বলবেন, তাই একটা চাঞ্চল্য স্বতই দেখা গিয়েছিল লস অ্যালামসে। সেইদিনই সন্ধ্যাবেলা ফাইনম্যানের ঘরে টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। ফাইনম্যান কোনো ধাঁধা কষছিলেন কিনা জানি না, টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলেন, হ্যালো!

–আমি জিম বেকার বলছি। আমরা এইমাত্র এসে পৌঁছেছি। বাবা আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। আপনি একবার গেস্ট-হাউসে আসবেন?

ফাইনম্যান অবাক হয়ে বলেন, জিম বেকার। আমি ঠিক আপনাকে তো–

–আবার বাবার নাম নিকোলাস বেকার!

চমকে উঠেন ফাইনম্যান! মনে পড়ে যায় সব কথা। নীলস্ বোহরের পুত্র অ্যাগী বোহরও যে এসেছে আমেরিকায়, একথা স্মরণ হয়। নিশ্চয়ই তার ছদ্মনাম–জিম।

অবাক হয়ে ফাইনম্যান বলেন, আপনি ভুল করছেন না তো? আমাকে আপনার বাবা কেন খুঁজবেন? আমার নামই জানেন না তিনি।

–জানেন। আপনি মিস্টার হেইলি তো?

 –হ্যাঁ, তাই বটে। আচ্ছা আমি এখনই আসছি।

ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে হাজির হলেন গেস্ট-হাউসে। প্রফেসর বোহর ওঁকে দেখেই বললেন, তোমার নামই তো ফাইনম্যান?

-ইয়েস, প্রফেসর।

–ঠিক আছে। বস। এই দেখ আমার রিপোর্ট।

রিপোর্ট দেখবেন কি? ফাইনম্যান তখনও ভাবছেন, লস অ্যালামসে এত এত পণ্ডিত থাকতে হঠাৎ তাকে পাকড়াও করলেন কেন প্রফেসর বোহর। পরদিন যে রিপোর্ট সকলকে পড়ে শোনাবেন, হঠাৎ তা এই ভ্রমণ-ক্লান্ত দিবাশেষে ওঁকে শোনাতে বসলেন কেন বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিক? কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল তার। আকণ্ঠ ডুবে গেলেন অঙ্ক-সমুদ্রে। তারপরেই হঠাৎ চীৎকার করে ওঠেন, কী লিখেছেন মশাই পাগলের মতো! এ কী হয়? আটটা ‘আন্-নোন’ আর সাতটা ইকোয়েশন’-এ তো কোনোদিনই সমাধান করা যাবে না।

পাশে দাঁড়িয়েছিল জিম বেকার। কর্ণমূল লাল হয়ে ওঠে তার। কোনো মরমানুষ তার পিতৃদেবকে ‘পাগল’ বলছে এমনটা সে শোনেনি জীবনে। প্রফেসর বোহর কিন্তু নির্বিকার। বলেন, কারেক্ট। কিন্তু এই অষ্টম ইকোয়েশনটাও তো আমাদের হাতে আছে!

শীতালী পাখির মতো ‘ফাই-থিটা-এপসাইলনের একটা ঝাক নেমে এল ব্ল্যাকবোর্ডে।

ফাইনম্যান বলেন, আই সি। আসুন তাহলে কষে ফেলা যাক।

রাত তিনটে নাগাদ শেষ হল অঙ্কটা!

ভোররাত নাগাদ প্রফেসর বোরকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলেন উনি ঘর ছেড়ে। জিম বেকার এগিয়ে এল ওঁকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে। গাড়িতে উঠে হঠ। ফাইনম্যান প্রশ্ন করেন, একটা কথা, জিম। তোমার বাবা এত লোক থাকতে আমাকেই বা ডেকে পাঠালেন কেন?

–আপনার কথা বাবা শুনেছিলেন শিকাগো থাকতেই!

–কিন্তু এখানে তো ধুরন্ধর বৈজ্ঞানিক আরও অনেক আছেন–ফের্মি, হান্স বেথে, ৎজিলাৰ্ড, ফন নয়ম্যান…

-জানি। তাদের কেউ আমার বাবাকে ‘পাগল’ বলবার সাহস রাখেন না—

–পাগল! পাগল কে বললে?

–আপনি বলছেন।

–হুঁ! মি? ইম্পসিবল। আমি, ডিক ফাইনম্যান প্রফেসর নীলস বোহরকে..এ সব কী বকছ পাগলের মতো?

–বাবা বলেছিলেন–আর সকলেই তার থিয়োরিটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবেন। তার প্রতি শ্রদ্ধায়, সৌজন্যে, প্রতিবাদ করবেন না-ভুলগুলো তাদের নজরে পড়বে না। পারলে আপনিই–

–তাই বলে আমি প্রফেসর বোহরকে ‘পাগল’ বলব?

–বলব নয় স্যার, বলেছেন। আমি নিজের কানে শুনেছি।

গাড়ি থেকে নেমে আসেন ফাইনম্যান। বলেন, তাহলে চল ক্ষমা চেয়ে আসি।

–প্লিজ প্রফেসর! বাবা শুয়ে পড়েছেন। রাত সাড়ে তিনটে বাজে!

মন ভার করে ফাইনম্যান ফিরে এলেন নিজের ঘরে। না না, এ অসম্ভব। তিনি কখনও বিংশ শতাব্দীর বিস্ময় প্রফেসর নীলস বোহরকে ‘পাগল’ বলতে পারে? তিনি? ডিক ফাইনম্যান! জিম বেকার বৃথাই বকছে পাগলের মতো!

***

ফাইনম্যানের আর এক বাতিক ছিল মুখে মুখে চুটকি কবিতা রচনার। স্রেফ পা-টানা। প্রফেসর নীলস বোহরকে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মধ্যরাত্রে যে তিনি ‘পাগল’ বলেছেন এটা জিম বেকার কাউকে বলেনি। পরদিন বোহর বক্তৃতা দিলেন। তার প্রস্থানের পর অন্যান্য সহ-বিজ্ঞানীরা ফাইনম্যানকে বললেন, কেমন লাগল প্রফেসর বোহরকে?

ফাইনম্যান তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে জবাব দিলেন :

Professor Bohr   প্রফেসর বোহর

 Knows no whore!    মোর মনচোর!

Drinks no liquor   কামিনীকাঞ্চনত্যাগী

Is no bore.   সন্ন্যাসী ঘোর!

 স্থিতপ্রজ্ঞ ড্যানিশ অধ্যাপকের অনেক জীবনীকার দীর্ঘ রচনায় তার দেবতুল্য চরিত্র সম্বন্ধে লিখে গেছেন, কিন্তু মাত্র চারটি ছত্রে ফাইনম্যান যে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন, তা বোধহয় অনবদ্য। কবিতাটি শুনেই ক্লাউস ফুকস্ বলে ওঠেন : আরে আরে! আপনি করছেন কি, প্রফেসর! বোহর আবার কে? শুনলেন না, ওঁর নাম নিকোলাস বেকার?

ফাইনম্যান বলেন, আই বেগ য়োর পাৰ্ডন। সে ক্ষেত্রে আমি বলব :

Nicholas Baker,   নিকোলাস বেকার-যুগান্তকারী।

 Epoch-maker.   অ্যাটমের শিরে যিনি–হানেন বাড়ি।

Atom-breaker!   এহ বাহ্য! তিনি–খাননা তাড়ি!!

Yet he is not A liquor-taker!!

চরমতম অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স! যেন যুগান্তকারী আবিষ্কার করা অথবা পরমাণুর অন্তর বিদীর্ণ করাও কিছু নয়! তার চেয়েও বড় বিস্ময় : লোকটা মদ খায় না।

হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। ৎজিলাৰ্ড বলেন : এবার ক্লাউস ফুকস-এর নামে একটা হোক। ওই তোমার ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছে।

ফাইনম্যানের জাপানি-তাংকা মুখে মুখে প্রস্তুত :

 Fuchs    ফুকসহেব তো ধর্মের এক ষণ্ড।

Looks   একাই পারেন করতে গাজন পণ্ড।

 An ascetic.   সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী এক ভণ্ড।

 Theoretic!

অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে সবাই। অর্থাৎ প্রফেসর বোহর হচ্ছেন সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক আর ক্লাউস ফুকস্ হচ্ছে ভেকধারী। দেখলে মনে হয় সন্ন্যাসী, আসলে পাজির পা-ঝাড়া।

***

ফাইনম্যানের কীর্তিকাহিনি সবিস্তারে বলতে গেলে আলাদা একখানা বই লিখতে হয়। তবু আরও দু-চারটে কথা বলি। কারণ এই চরিত্রটিকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি কর্নেল প্যাশ–এ কাহিনির গোয়েন্দা। তার বারে বারে মনে হয়েছিল সমস্ত প্রক্রিয়াটা মাইক্রোফিলমে রূপান্তরিত করে রাশিয়ান গুপ্তচরকে হস্তান্তরিত করার হিম্মৎ ছিল ওই ছেলেমানুষিতে-ভরা ফাইনম্যানের!

লস অ্যালামসের ইতিহাসের রচয়িতা ‘মানহাটান প্রজেক্ট’ গ্রন্থে লিখেছেন

“It also afforded Feynman great amusement to work-out the combination numbers of the steel safes in which the most secert and important data of research were kept. In one case he actually succeeded, after weeks of study, in opening the main file-cupboard at the records centre in Los Alamos, while the officer-in-charge of it was absent for a few minutes. Feynmann contented himself, in the brief period during which he had all the atomic secrets at his disposal, with placing in the safe a scrap of paper on which he had written : Guess Who?”

বুঝুন কাণ্ড! কী বলবেন এমন লোককে? খেয়ালী? পাগল? ছেলেমানুষ? না কি ধূর্তস্য ধূর্ত ক্রিমিনাল? যে সিন্দুকে গোপনতম তথ্য রাখা থাকে তা ওই লোকটা কোন্ কায়দায় খুলে ফেলল মাত্র কয়েক মিনিট সুযোগে? আর কেন খুলল? কী উদ্দেশ্য তার? শুধুই সবাইকে চমকে দিতে? ‘বলতো কে?’–লেখা একটা কাগজ ওই আলমারির খোপে রেখে আসবার ছেলেমানুষিতে?

অদ্ভুত প্রতিভা ছিল এই ফাইনম্যানের। প্রফেসর বোহর শিকাগোতে বসে কেমন করে তার নাম জানলেন সেটাও আন্দাজ করতে পারি Grauff-এর লেখা ‘মানহাটান প্রজেক্ট’ গ্রন্থ থেকে। উনি লিখেছেন

“ফাইনম্যানকে শিকাগোতে প্রতিটি গ্রুপের কাজ দেখতে যেতে হত। সেখানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা-কম্পটন, উইগনার, টেলার অথবা ফের্মি তাকে নানা উপদেশ দিতেন। একবার হঠাৎ ওঁর কানে গেল–কী একটা অঙ্ক শিকাগো-গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে কষতে পারছেন না। কৌতূহলী ফাইনম্যান জানতে চাইলেন, অঙ্কটা কী? শুনে, মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে সেটা কষে দিলেন তিনি। ফিরে এসে উনি ওর বন্ধুকে বলেছিলেন–বড়কর্তারা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছেন তো, তাই একটু গুরুদক্ষিণা দিয়ে এলাম।”

খবরটা জানতে পেরেছিলেন নীলস বোহর।

আর একবার। গভর্নিং বোর্ডের মিটিংয়ে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন, IBM কোম্পানি একরকম নতুন কম্পুটার-বার করেছে যাতে অত্যন্ত দ্রুত যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অঙ্ক কষা যায়। কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি এগুলি বসানো হয়েছে। অনেক আলোচনার পর ওই যন্ত্র কেনা ঠিক হল। তখনও ইলেকট্রনিক কম্পুটার চালু হয়নি কোথাও। অর্ডার গেল আই. বি. এম. কোম্পানির কাছে। যন্ত্রটা নতুন, তার ব্যবহার কেউ জানে না–তাই কোম্পানিকে লেখা হল যারা যন্ত্রটা বসাতে আসবে তাদের সঙ্গে যেন মেশিনম্যানও পাঠানো হয়। মানহাটান প্রকল্পে তারা থেকে যাবে। যন্ত্রগুলো চালাবে।

যা হয়। কোম্পানি পত্রপাঠ যন্ত্রগুলো পাঠিয়ে দিল। তারপর শুরু করল চিঠি-চাপাটি। যারা মেশিন চালাবে তাদের কী হারে মাইনে দেওয়া হবে, তাদের চাকরির নিরাপত্তা কতদূর, থাকবার কী ব্যবস্থা হবে ইত্যাদি। বড় বড় প্যাকিং কেস পড়ে রইল গুদামে আর কোম্পানি শুরু করল দরকষাকষি! যাই হোক, দিন পনেরো পর এল কোম্পানির লোক–কিন্তু কোথায় গেল সেই প্যাকিং কেসগুলো? সেগুলো তো গুদামে নেই। ফাইনম্যান হচ্ছেন বিভাগীয় কর্তা। বড়কর্তা তাকে প্রশ্ন করেন, সেই প্রকাণ্ড প্যাকিং কেসগুলো কোন্ গুদামে আছে? লোক এসে গেছে যে! ফাইনম্যান বলেন, কোগুলো স্যার? সেই আই. বি. এম. কম্পুটারগুলো? লোক আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে আমি নিজেই যন্ত্রটা বসিয়ে নিয়েছি। হ্যাঁ, খুব ভালো যন্ত্র। ব্যবহার করছি তো আজ দিন সাতেক। চমৎকার জিনিস!

কোম্পানির লোক এবং ডিরেক্টার স্তম্ভিত। স্বচক্ষে দেখতে এলেন তারা। হ্যাঁ, কাজ হচ্ছে। পুরোদমে কাজ হচ্ছে মেশিনে!

বিস্মিত হয়ে ডিরেক্টার বলেন, কী আশ্চর্য! এ যন্ত্রটা তো সদ্য-আবিষ্কৃত। কেমন করে বসালে হে! এমন কমপ্লিকেটেড ইলেকট্রনিক কম্পুটার।

–ছেলেবেলায় আমি যে মেকানো বানাতাম স্যার-ফাইনম্যানের সাফ জবাব।

-তাই বলে এত লক্ষ ডলার দামের যন্ত্র কাউকে কিছু না বলে তুমি খুলে ফেললে?

–কী যে বলেন স্যার ‘পাগলের মতো’! সাতদিন এগিয়ে গেল না আমাদের কাজ?

কোম্পানি-প্রেরিত লোকগুলো অবশ্য চাকরি পেল। দিন দশেক পরে মসকুইটো বোট আবার এসে হানা দিলেন ব্যাটলশিপের ঘরে। বললেন, ওই লোকগুলো কাজে উৎসাহ পাচ্ছে না। দৈনিক আটঘণ্টা ডিউটি দিচ্ছে–কিন্তু কাজে প্রাণ নেই যেন।

-কেন প্রাণ নেই?

-কেমন করে থাকবে? কিসের অঙ্ক কষছে তাই যে ওরা জানে না! ওদের বলে দেওয়া উচিত ওরা কিজন্য এই মেশিন চালাচ্ছে। তাহলেই ও বা উৎসাহ পাবে।

ফাইনম্যানের বাঁধা-লবজটাই বলে বসলেন ডিরেক্টার-পাগলের মতো কথা বলো না! ওদের ওসব কথা জানানোর আইন নেই!

—আমি ডক্টর ওপেনহাইমারকে বলে দেখব?

–দেখতে পায়। সে রাজি হবে না।

কিন্তু ফাইনম্যান নাছোড়বান্দা; পাগলটাকে রোখা যাবে না জেনে শেষ পর্ষ ওপেনহাইমার রাজি হলেন। ফাইনম্যান ওই মেশিনম্যান ছোকরাদের ব্যাপারট। একদিন ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, তোমরা আসলে তৈরি করছ অ্যাটম-বোমা। তোমরা তার এক-একটা নাট বল্ট! বুঝলে?

আশ্চর্য! সাতদিনের মাথায় ফাইনম্যান এসে দাখিল করলেন তার পরিসংখ্যান। মেশিনের আউটপুট হান্ড্রেড-পার্সেন্ট বেড়ে গেছে। বলেন, দেখলেন স্যার? আপনারা শুধু আপত্তিই করছিলেন পাগলের মতো।

.

০৯.

‘কাগুজে-বাঘ’ কথাটা আজকাল প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। আমার তো মনে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কাগুজে-বাঘ হচ্ছে জার্মান অ্যাটম-বোমা! এই বাঘের ভয়েই একদিন রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘পা। এটার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এই বাঘের ভয়ে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে মার্কিন-সরকার মানহাটান-প্রকল্পে হাত দিয়েছেন। জার্মান-বৈজ্ঞানিকদের আগেই আমেরিকায় অ্যাটম-বোমা তৈরি করে ফেলতে হবে।

যুদ্ধের শেষাশেষি এক গবেষকদল জার্মানিতে গিয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছিলেন, জার্মানিতে পরমাণু-বোমা সম্বন্ধে কতদূর কী করা হয়েছিল। সে অনুসন্ধানের ফলশ্রুতি–জার্মান-বৈজ্ঞানিকরা অ্যাটম-বোমা থেকে অনেক অনেক দূরে ছিলেন। এটা প্রথমটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। অটো হান, হেইসেনবের্গ, ওয়াইৎসেকার বা ফন লে-র মতো অসীম প্রতিভাধরদের এ অসাফল্যের কারণ কী? সে কথাই বলব এবার।

জার্মান যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে একটি মার্কিন মিশন এল যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানিতে–এল গবেষণা করে দেখতে, জার্মানি অ্যাটম-বোমা বানানোর চেষ্টায় কতদূর কী করতে পেরেছিল। তার একটা বিশেষ কারণও ছিল। 1942-এর ডিসেম্বরে মার্কিন গুপ্তচর-বাহিনী খবর পেল বড়দিনের দিন হিটলারের বিমানবহর অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে নাকি মার্কিন ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ করতে আসছে। সাধারণ বোমা নয়, পরমাণু বোমা। ওদের লক্ষ্যস্থল নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন অথবা শিকাগো। খবরটা এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল যে, বড়কর্তারা নানান অজুহাতে স্ত্রী-পুত্র পরিবারকে বড়দিনের আনন্দ উৎসব থেকে বঞ্চিত করে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বড়দিন পার হয়ে গেলো। বোমা পড়ল না। পরের বছর জানুয়ারিতে তৈরি করা হয় এই মিশন অ্যালসস্। তার কর্ণধার কর্নেল প্যাশ। যাঁকে এ কাহিনির প্রথম অধ্যায়ে আমরা চিনেছি।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলেন প্যাশ-এর মতো ‘অ-পদার্থ-বিদ’কে দিয়ে কাজ হবে না। তাই ওঁরা খোঁজ করতে শুরু করেন এমন একজনকে যিনি পদার্থবিদ্যাতে পারদর্শী এবং অপরাধ-বিজ্ঞানেও। পাওয়া গেল তেমন সব্যসাচী। স্যামুয়েল গাউডসমিট। ওলন্দাজ বৈজ্ঞানিক। গোটিনজেন-এর প্রাক্তন-ছাত্র– হেইসেনবের্গের সহাধ্যায়ী অথচ ক্রিমিনোলজি হচ্ছে তার প্যাশন। বৃদ্ধ বাবা-মা হল্যান্ডেই আছেন। যুদ্ধের আগেই উনি ডেনমার্কে পালিয়ে যান, প্রফেসর বোহর-এর অধীনে ডক্টরেট লাভ করে পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। বর্তমানে ম্যাসাচুটেস-এ রেডার-প্রকল্পে নিযুক্ত।

মনের মতো কাজ পেলেন গাউডসমিট। প্রথমত, গোয়েন্দা কাহিনির নায়ক হলেন; দু-নম্বর, বৃদ্ধ পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাতের একটা সম্ভাবনা দেখা দিল। গত তিন বছর তাদের কোনো চিঠিপত্র পাননি। হল্যান্ড এতদিন ছিল নাৎসিবাহিনীর দখলে!

গাউডসমিট-এর এই অনুসন্ধানকার্য আর একটা পৃথক গোয়েন্দা বিষয়বস্তু হতে পারে। স্থানাভাবে আমাকে দু-একটা ইঙ্গিত দিয়েই শেষ করতে হল। কৌতূহলী পাঠক গাউডসমিট-এর স্মৃতিচারণ Alsos’ পড়ে দেখতে পারেন।

তার গ্রন্থ পড়ে জানতে পারছি, নোবেল-লরিয়েট বৈজ্ঞানিক জোলিও-কুরি অধিকৃত-পারিতে বন্দুক হাতে রাস্তার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন! বর্ণনা দিয়েছেন–কীভাবে ফরাসি পদার্থবিদ জর্জেস ব্রুহাট মৃত্যুবরণ করেন। প্রফেসর ব্রুহাট-এর ছাত্র রাউসেল পারির মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। গেস্টাপো অপরিসীম যন্ত্রণা দিয়েও প্রফেসার ব্রুহাট-এর কাছ থেকে তার ছাত্রের ঠিকানা জানতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা বৃদ্ধ প্রফেসরকে পাঠিয়ে দেয় একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। অধ্যাপক নির্বিচারে মেনে নিলেন এই বন্দীজীবন। সেখানে তিনি বন্দীদের নিয়ে গণিত-জ্যোতিষ চর্চা করতেন–আকাশের তারা চেনাতেন। অনাহারে শেষ পর্যন্ত প্রফেসর ব্রুহাট মারা যান।

বলেছেন, হলওয়েক-এর কথাও। হলওয়েক একটা নতুন ধরনের মেশিনগান আবিষ্কার করে উপহার দিয়েছিলেন পারির মুক্তি ফৌজকে। এ কথা জানতে পেরেছিল গেস্টাপো। হলওয়েক ধরা পরার পর জার্মান গুপ্তচরেরা বৈজ্ঞানিককে ওই আবিষ্কারের সূত্রটা তাদের জানিয়ে দেবার জন্য নিপীড়ন শুরু করে। তিল তিল করে মৃত্যু বরণ করেছিলেন হলওয়েক–তার অতিপ্রিয় মুক্তি ফৌজের বিরুদ্ধে তার আবিষ্কারকে ব্যবহৃত হতে দেননি।

***

গাউডসমিট-এর তালিকায় ছিল চারটি নাম। চারজনের পক্ষেই পরমাণু-বোমার হৃদয় বিদীর্ণ করা সম্ভব। তারা হচ্ছেন–অটো হান, ফন লে, ওয়াইৎসেকার আর হেইসেনবের্গ। বিধ্বস্ত জার্মানির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে তিনি খুঁজে ফিরেছেন ওই চারজনকে। খবর পেয়েছিলেন, স্ট্রাসবের্গ-এ ছিল ওঁদের মূল কেন্দ্র। স্ট্রাসবের্গ তখনও নাৎসি ফৌজের দখলে। অবশেষে 1944-এ পনেরই নভেম্বর জেনারেল প্যাটন-এর বিজয়ী বাহিনী প্রবেশ করল স্ট্রাসবের্গ-এ। কর্নেল প্যাশ একটি সাঁজোয়া গাড়িতে গাউডসমিটকে নিয়ে মেশিনগানের গুলিবর্ষণের ভিতরেই প্রবেশ করলেন স্ট্রাসবের্গে। গবেষণাগারের অবস্থান দেখানো ম্যাপ সঙ্গে ছিল। খুঁজে পেতে দেরি হল না। সৈন্যদের নিয়ে ওঁরা ঢুকে পড়লেন ল্যাবরেটারির ধ্বংসস্তূপে। না, চারজনের একজনেরও সন্ধান পেলেন না। তবে যারা বন্দী হলেন তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল–কিছুদিন আগেও ওঁরা এখানে ছিলেন। শহরের পতন আসন্ন বুঝতে পেরে জার্মান-বিজ্ঞানের চার মধ্যমণি পালিয়েছেন কাইজার উইলহেম ইন্সটিটুটে। বিজ্ঞানীদের ধরা গেল না, উদ্ধার করা গেল কিছু গোপন নথি। সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা।

ক্রিমিনোলজি ছিল গাউডসমিটের বিলাস। সারারাত মোমবাতির আলোয় গবেষণা করে তিনি ওই সাঙ্কেতিক-ভাষা ডি-কোড করলেন। পাঠোদ্ধারের পর বোঝা গেল রিপোর্টটা তৈরি করছেন স্বয়ং ওয়াইৎসেকার, স্বহস্তে। মাত্র দু-মাস পূর্বের রচনা। তা থেকে নিঃসন্দেহে বোঝা গেল, জার্মান-বৈজ্ঞানিকেরা ইউরেনিয়াম অথবা প্লুটোনিয়ামের পরমাণুকে ক্রমাগত বিদীর্ণ করতে তখনও কোনো ‘চেইন-রিয়্যাকশন’ বার করতে পারেননি। ইউ-238 থেকে ইউ 235-এর বিচ্ছিন্নকরণও সম্ভব হয়নি। তৎক্ষণাৎ বিস্তারিত রিপোর্ট লিখে ডক্টর গাউডসমিট পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল তার।

মার্কিন কর্তৃপক্ষ কিন্তু এ তথ্য আদৌ বিশ্বাস করতে পারলেন না। জবাবে তারা জানালেন, “আমাদের সন্দেহ, সহজে ভাঙা যায় এমন সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখে ওয়াইৎসেকার ইচ্ছা করেই ওই রিপোর্ট ল্যাবরেটারিতে রেখে গেছেন, আমাদের চোখে ধুলো দিতে। দ্বিতীয় কথা, আপনার ধারণা ভ্রান্তও হতে পারে। অটো হান, ফন লে, ওয়াইৎসেকার অথবা হাইসেনবের্গ ছাড়াও অখ্যাত অজ্ঞাত কোনো বৈজ্ঞানিক হয়তো নির্জন সাধনায় ওই আবিষ্কার করে বসেছেন, যার কথা আপনি কল্পনাও করতে পারছেন না।”

এ-কথার জবাবে ওই মিলিটারি বড়কর্তাকে অভিমানী নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট যে-কথা লিখেছিলেন তার আর অনুবাদ হয় না! যুদ্ধকালে সামরিক কর্তা এবং ডিপ্লোম্যাটেরা বরাবরই বৈজ্ঞানিকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। প্রফেসর বোহর, ম্যাক্স বর্ন অথবা জেমস ফ্রাঙ্কের মতো বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিকদের নির্বিচারে আদেশ পালন করতে বাধ্য করেছেন ওই সব সামরিক কর্তা আর রাজনীতির পণ্ডিতম্মন্যের দল। গাউডসমিট-এর এই চাবুকের মতো জবাবটি যেন সেই অপমানের প্রতিশোধ! গাউডসমিট মার্কিন সমরনায়ককে লিখেছিলেন :

“A paper-hanger may perhaps imagine that he has turned into a military genius overnight, and a trader in champagne may be able to disguise himself as a diplomat. But laymen of that sort could never have acquired sufficient scientific knowledge, in so short a time, to be able to construct an atom bomb.

[কোনো রংমিস্ত্রি হয়তো মনে করতে পারে রাতারাতি সে একজন সামরিক ধুরন্ধর হয়ে উঠেছে অথবা কোনো ভাঁটিখানার শুঁড়ি রাত-পোহালে বিখ্যাত রাজনীতিকের ছদ্মবেশ হয়তো ধারণ করতে পারে–কিন্তু একজন রাস্তার লোক এত অল্পসময়ে এতটা বৈজ্ঞানিক-জ্ঞান লাভ কিছুতেই করতে পারে না যাতে সে পরমাণু-বোমার নির্মাতা হয়ে পড়বে।]

দুঃখের বিষয় পত্রের প্রাপকটি সামরিক জীবনের পূর্বাশ্রমে রঙের-মিস্ত্রি অথবা মদের কারবারী ছিলেন কিনা এ তথ্যটার সন্ধান পাইনি।

***

আরও পরে মিত্রপক্ষের বিজয়ী বাহিনী অধিকার করল কাইজার উইলহেম ইন্সটিটুট। এবারও সৈন্যদলের সঙ্গে ছিলেন কর্নেল প্যাশ এবং গাউডসমিট! একজন সংবাদবহ এসে খবর দিল, ইন্সটিটুটের ল্যাবরেটারিতে কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে তারা গ্রেপ্তার করেছে–চিনতে পারছে না। গাউডসমিট তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েন। বলেন, চল এখনই গিয়ে দেখব।

গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেন কর্নেল প্যাশ নিজে। প্রশ্ন করেন তিনি, ডক্টর, এবার যদি জালে আপনার প্রাইজ গেম ধরা পড়ে থাকে তবে আপনি তাদের চিনতে পারবেন তো?

ম্লান হাসলেন ডক্টর গাউডসমিট। বলেন, কর্নেল, ওঁদের মধ্যে কেউ আমার অধ্যাপক, কেউ আমার সহপাঠী! আমি চিনব না?

চিনতে কোনো অসুবিধা হল না সত্যই। বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যাঁরা, তাঁরা জার্মানির শ্রেষ্ঠ মনীষা–নোবেল লরিয়েট অটো হান, ফন লে এবং ওয়াইৎসেকার সমেত আরও পাঁচজন প্রধান নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট।

-হাউ ডু য়ু ডু প্রফেসর?–প্রশ্ন করেন গাউডসমিট লজ্জায় লাল হয়ে।

-য়ু নিডন্ট ব্লাশ, মাই বয়!-জবাব দিলেন বৃদ্ধ অটো হান। ইউরেনিয়াম পরমাণুর হৃদয় যিনি সর্বপ্রথম বিদীর্ণ করেছিলেন।

ধরা পড়লেন না শুধু হেইসেনবের্গ। রাত তিনটের সময় একটা সাইকেলে চেপে কাইজার ইন্সটিটুট ছেড়ে তিনি নাকি উত্তর ব্যাভেরিয়ার দিকে রওনা হয়ে গেছেন। সেখানে ছিলেন হেইসেনবের্গের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার। শেষ মুহূর্ত কয়টি তিনি তাদের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলেন। পঁচিশ বছর বয়েসে যিনি নোবেল-প্রাইজ পাওয়ার মতো আবিষ্কার করতে পারেন, কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পদ প্রত্যাখ্যান করে পরাজয়ের হলাহল আকণ্ঠ পান করে নীলকণ্ঠ হতে যাঁরা কুণ্ঠা নেই, সেই হেইসেনবের্গ রাতারাতি প্রায় একশ কিলোমিটার সাইকেলে পাড়ি দিয়ে চলে গেছেন উত্তর ব্যাভেরিয়ায়।

হেইসেনবের্গ সেইখানেই গ্রেপ্তার হন–আরও পরে।

সেদিন কিন্তু ওঁরা হেইসেনবের্গের সাক্ষাৎ পাননি। তার ল্যাবরেটারির চিহ্নিত ঘরটি তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। এখানে একটি জিনিস উদ্ধার করেছিলেন কর্নেল প্যাশ–একটি ফটো! ঘরের টেবিলে ফটো-স্ট্যান্ডে রাখা ছিল। দুটি যুবক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে–কনভোকেশন গাউন পরে। সদ্য ডক্টরেট হয়েছেন তারা। একজন ওয়ার্নার হেইসেনবের্গ আর একজন স্যামুয়েল গাউডসমিট। পলাতক ও পশ্চাদ্ধাবনকারী।

গাউডসমিটের অনুসন্ধানকার্যের মর্মান্তিক উপসংহারের প্রসঙ্গে এবার আসি। খুঁজতে খুঁজতে এবং ঘুরতে ঘুরতে গাউডসমিট এসে পৌঁছলেন হল্যান্ডে-দ্য হেগে। হেগ-এর ন্যাশনাল ইন্সটিটুটে অনুসন্ধান শেষ করে গাউডসমিট তার সহকারীকে বললেন, কর্নেল, একবেলার জন্য ছুটি চাইছি। ওবেলা আমি আসব না।

-কেন? কী করবেন ওবেলায়?

–দ্য হেগ হচ্ছে আমার পিতৃভূমি। শহরের ওপ্রান্তে ছিল আমাদের বাড়িটা। তিন বছর আগেও সেখান থেকে বাবা-মায়ের চিঠি পেয়েছি। বাবার সত্তরতম জন্মদিনে একটা কেও করেছিলাম। জানি না, সেটা পেয়েছিলেন কিনা।

–আয়াম সরি। যান, গিয়ে খোঁজ করে দেখুন।

পনেরো বছর পরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে। রীতিমতো কৃতী সন্তান–বংশের গৌরব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল উনিশ বছর বয়সে-জার্মানি, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড ঘুরে পোঁচেছে আমেরিকায়। সদ্য স্কুল থেকে পাশ ছেলে আজ ডক্টরেট পাওয়া প্রৌঢ়। যুদ্ধ বাধার আগে গাউডসমিট আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বুড়ো-বুড়ির ইমিগ্রেশান পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে মার্কিন মুলুকে নিয়ে যাওয়ার। নানান বাধা বিপত্তিতে সেটা শেষ পর্যন্ত ঘটে উঠেনি। গত তিন বছর কোনো খবরই পাননি।

গাউডসমিটের এই প্রত্যাবর্তনের কাহিনিটা আমি নিজের ভাষায় বলব না; তার রচনার অনুবাদ করে যাব। ভাবানুবাদ নয়, তাতে আমার ভাবালুতা হয়তো অজান্তে মিশে যাবে–আক্ষরিক অনুবাদ :

“জিপটাকে আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে রেখে হেঁটেই এগিয়ে গেলাম। বাড়িটা তখনও খাড়া আছে, কিন্তু কাছে এসে দেখলাম, সব কটা জানলাই অদৃশ্য। দরজা বন্ধ ছিল। জানলা দিয়ে লাফ মেরে ভিতরে ঢুকলাম। জনমানব নেই।…এ ঘরটা ছেলেবেলায় ছিল আমার নার্সারি; পরে পড়ার ঘর। চারিদিকে কাগজপত্র ছড়ানো–তার মধ্যে আমার স্কুল-ছাড়ার সার্টিফিকেটখানি। চকিতে মনে পড়ল, এটা বরাবর বাবার ড্রয়ারে সযত্নে রাখা থাকত। দু-চোখ বুজে আমি বিশ-ত্রিশ বছর পিছিয়ে গেলাম। ওইখানে ছিল আমার অন্ধ মায়ের টেবিলটা; এইখানে আমার বুককেসটা। আমার সেই অত অত বই সব কোথায় গেল?…পিছনে মায়ের সখের বাগানটা আগাছায় ভরে গেছে। শুধু লাইলাক গাছটা নীরবে সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভগ্নস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে হল আমি চরম অপরাধ করেছি।…হয়তো ওঁদের আমি বাঁচাতে পারতাম। আমেরিকান ভিসা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছিল–বাবার এবং মায়ের; যদি আর একটু বেশি ছুটোছুটি করতাম, যদি ইমিগ্রেশন অফিসে আরও বেশি করে ধর্না দিতাম, নিশ্চয়ই ওই নৃশংস নাৎসিদের হাত থেকে ওঁদের আমি রক্ষা করতে পারতাম। কী হয়েছিল তাদের? এখানেই মারা গেছেন? পাড়ার লোক কিছু বলতে পারবে? কিন্তু গোটা পাড়াটাই যে ফাঁকা। চেনা মুখ একটাও দেখছি না…”।

এর মাসখানেক পরে একটি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে অনুসন্ধান করবার সময় ওই প্রশ্নটির সমাধান হঠাৎ উনি খুঁজে পেয়েছিলেন। গ্যাস-চেম্বারে যাদের পাঠানো হচ্ছে তাদের নাম-ধাম লেখা থাকত একটা রেজিস্টারে। তাতেই উদ্ধার করলেন দুটি নাম। বাবার এবং অন্ধ মায়ের।

গাউডসমিট লিখছেন–

“And that is why, I know the precise date my father and blind mother were put to death in the gas chamber. It was my father’s seventieth birthday”.

“তাই আমি জানি, ঠিক কোনদিন আমার বাবা এবং অন্ধ মা গ্যাস চেম্বারে শেষ দূষিত নিশ্বাস নেন। তারিখটা ছিল আমার বাবার সত্তরতম জন্মদিন।”

***

জার্মানিতে অ্যাটম-বোমা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত না হওয়ার চারটি প্রধান হেতু। তার প্রথম তিনটির ওপরেই বেশি জোর দিয়েছেন মার্কিন আর ইংরেজ সাংবাদিক এবং ঐতিহাসিকের দল। কিন্তু D. Irving-এর লেখা “The German Atomic Bomb–the History of Nuclear Research in Nazi Germany” szlo পড়ে আমার মনে হয়েছে প্রথম এবং চতুর্থ কারণটাই সর্বপ্রধান।

চারটি হেতু নিম্নোক্তরূপ–

প্রথমত-অনার্য এবং ইহুদি, এই অজুহাতে হিটলার নেতৃস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের বিতাড়ন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত–যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন তাঁদের নাৎসি যুদ্ধবাজদের অধীনে এমন দৈহিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছিল যা গবেষণার পরিপন্থী। তৃতীয়ত-যন্ত্রপাতি বা গবেষণার জন্য উপযুক্ত অর্থের ব্যবস্থা করা হয়নি এবং চতুর্থত-বৈজ্ঞানিকদের সাফল্যের বিষয়ে অনীহা, এমনকি অনিচ্ছা!

শেষ যুক্তিটারই বিস্তার করব বিশেষভাবে।

1939-এর ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর-অর্থাৎ আলেকজান্ডার সাস্ যেদিন আইনস্টাইনের চিঠি নিয়ে রুজভেল্টের সঙ্গে দেখা করেন তার পনেরো দিন আগে– বার্লিনে জন্ম নেয় ইউরেনিয়াম প্রজেক্ট। নয়জন পদার্থবিজ্ঞানী এতে অংশ নেন–তার ভিতর উপস্থিত ছিলেন না অটো হান, ফন লে, ওয়াইৎসেকার বা হেইসেনবের্গ। এঁরা কেউ আমন্ত্রিত হননি। ওই নয়জনও উঁচুদরের পদার্থ বিজ্ঞানী–কিন্তু তাদের নির্বাচনের আসল হেতু নাৎসিবাদের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন। মাসখানেকের ভিতরেই বোধহয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল–ডাক পড়ল ওয়াইৎসেকার এবং হেইসেনবের্গের। প্রকল্পের কর্ণধার হলেন দুবাই, তার অধীনে রইলেন হেইসেনবের্গ, যদিও পাণ্ডিত্যে হেইসেনবের্গ-এর স্থান অনেক উচ্চে। অটো হানকেও ডাকা হয়েছিল পরে–কিন্তু হান সর্বসমক্ষে বলে ওঠেন, ‘হিটলারের হাতে অ্যাটম-বোমা তুলে দেওয়ার আগে আমি আত্মহত্যা করব।’

ওঁর এক ছাত্র সৌজন্যের বালাই না মেনে ছুটে এসে মুখ চেপে ধরেছিল শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের।

মোট কথা, দ্বিতীয় শ্রেণির বৈজ্ঞানিকদলের অধীনে শেষ পর্যন্ত ওই চারজনকেই গবেষণার কাজে নিযুক্ত হতে হল। প্রথমে ওঁরা স্থির করেছিলেন প্রতিবাদ করে শহীদ হবেন; কিন্তু মূলত হেইসেনবের্গের বুদ্ধিতেই ওঁরা অন্য পথ ধরেন। ওঁরা ভাব দেখান যেন আপ্রাণ প্রচেষ্টাতেও কিছু করতে পারছেন না। এই প্রসঙ্গে স্বয়ং হেইসেনবের্গ যুদ্ধান্তে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন–

 “ডিক্টেটারশিপে তারাই সক্রিয়ভাবে বাধার সৃষ্টি করতে পারে, যারা ভান করে যায় শাসনযন্ত্রের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করতে তারা প্রস্তুত। প্রতিবাদের অর্থ বন্দীশিবিরে আবদ্ধ হওয়া। সেখানে শহীদ হয়েও লাভ নেই–কেউ তার নাম বা মতাদর্শের কথা জানতে পারবে না। তার নামোচ্চারণই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। বিশে জুলাই যারা নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে প্রাণ দিল–তাদের মধ্যে আমার কিছু বন্ধুও আছে–তাদের কথা মনে করে আমার আত্মানুশোচনা হয়। আবার ভাবি–ওরাই কি প্রমাণ করে দিয়ে গেল না, ওই শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার–তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার, একমাত্র পথ হচ্ছে সহযোগিতার ভান করে যাওয়া?”

এর পর জার্মান বৈজ্ঞানিকের দল পরমাণু বোমা বানানোর প্রতিযোগিতায় কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন সেকথা বিস্তারিত আলোচনার অপেক্ষা রাখে না।

***

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করে এ পরিচ্ছেদের যবনিকা টানব। যুদ্ধ চলাকালে হাইসেনবের্গের সঙ্গে প্রফেসর নীলস বোহর-এর সাক্ষাৎ। তখনও প্রফেসর বোহর ডেনমার্ক ছেড়ে পালিয়ে আসেননি। ডেনমার্ক তখন নাৎসি অধিকারে। বোহর তার ইহুদি এবং অনার্য সহকারী বন্ধুদের সকলেই ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় পাচার করেছেন–শূন্য ল্যাবরেটরি আঁকড়ে তিনি একা পড়ে আছেন শুধু এই বিশ্বাসটুকু নিয়ে যে, হিটলার অন্তত তাকে কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে পাঠাবে না। ভয়ে সবাই কাটা হয়ে আছে।

এই সময় অটো হান, হেইসেনবের্গ প্রভৃতি স্থির করলেন প্রফেসর বোহর-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা নিতান্ত প্রয়োজন। আমেরিকা যেমন জার্মান পরমাণু-বোমার ভয়ে ভীত–এইসব বৈজ্ঞানিকও অনুরূপভাবে ভাবছিলেন, মার্কিন পরমাণু-বোমায় তাদের সাধের জার্মানি ধ্বংসপুরীতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। তাদের দুঃখটা আরও বেশি–কারণ অতলান্তিকের ওপারে যারা বোমা বানাচ্ছেন, তাঁরা অনেকেই জার্মান-ফ্রাঙ্ক, ম্যাক্স বর্ন, ৎজিলাৰ্ড, ফুস্, হান্স বেথে–সবাই ওঁদের ঘরের লোক। ওইসব মার্কিন-প্রবাসী মধ্যযুরোপিয়দের একটা খবর দেওয়া দরকার যে, জার্মান পরমাণু-বোমা একটি কাগুজে-বাঘ। তার ভয়ে আগেভাগেই তোমরা এ-দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করো না। এ খবর পশ্চিমখণ্ডে পৌঁছে দেওয়ার মতো উপযুক্ত লোক একমাত্র ডেনিশ বৈজ্ঞানিক নীলস বোহর। তার কথা এমন কেউ অবিশ্বাস করবে না যে ফিজিক্স বইয়ের প্রথম পাতাটা উল্টেছে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা কে বাঁধে? ওঁরা এই দৌত্যকার্যে পাঠালেন স্বয়ং হেইসেনবের্গকে। হেইসেনবের্গ ‘ইউরেনিয়াম-প্রকল্পের ডেপুটি ডাইরেকটার, তার একটা পদমর্যাদা আছে। তার চেয়েও বড় কথা, হেইসেনবের্গ হচ্ছেন নী বোহরের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র।

গুরুশিষ্যের সাক্ষাৎকারটা নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক!

তার একটা কাকতালীয় হেতু আছে। হেইসেনবের্গ তার থিয়োরি অনুসারে দু-নৌকায় পা দিয়ে চলছিলেন। বাহ্যত জার্মান-সরকারকে মদত দিতে হচ্ছিল তাঁকে, যাতে তার সহকর্মী বৈজ্ঞানিকদের ওপর নাৎসি অত্যাচার না হয়। এজন্য জার্মানি যখন পোলান্ড অভিযান করে তখন এক সম্বর্ধনা সভায় হেইসেনবের্গ। হিটলারকে প্রশংসা করে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে সেটা নজরে পড়েছিল তার অধ্যাপক নীলস বোহর-এর। তাই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের ধারণা হয়েছিল তার প্রিয় ছাত্র হেইসেনবের্গ নাৎসি শাসকদের অন্ধ ভক্ত। ওই ‘বাইরে-এক ভিতরে-আর’ নীতি কল্পনাই করতে পারেন না সহজ সরল সোজাপথের পথিক নীলস বোহর। তাই হেইসেনবের্গ যখন কোপেনহেগেন-এ এসে তার অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করলেন তখন অত্যন্ত গম্ভীর এবং উদাসীনভাবে তাকে গ্রহণ করলেন প্রফেসর বোহর। অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন দু-জনে, জনান্তিকেই কিন্তু কেউই মন খুলে প্রাণের কথা বলতে পারেননি। দুজনেই দুজনকে ভয় পাচ্ছিলেন। হেইসেনবের্গ শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করে বসলেন, আপনি কি মনে করেন অনতিবিলম্বে পরমাণু-বোমা তৈরি হতে পারে?

নীলস বোহর জবাবে বলেছিলেন, আমি তা মনে করি না।

–কিন্তু আমি করি স্যার। আমার দৃঢ় ধারণা, চেষ্টা করলে আমরা অনতিবিলম্বে ওই রকম বোমা তৈরি করতে পারি।

উদাসীনভাবে বোহর বলেন, হতে পারে। নাৎসি জার্মানির ভিতরে তোমরা কতদূর কী করেছ তা জানব কেমন করে?

হিতে বিপরীত হচ্ছে বুঝতে পেরে হেইসেনবের্গ বলেন, সে-কথা বলছি না। স্যার। আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওরা অনেকটা এগিয়েছে?

আবার উদাসীনভাবে বোহর বললেন, আমার মনে করায় কী এসে যায়?

মোটকথা হতাশ হয়ে হেইসেনবের্গ ফিরে গেলেন। আসল কথা খুলে বলার মতো পরিবেশই খুঁজে পেলেন না তিনি। বস্তুত এই সাক্ষাৎকারে ভালোর চেয়ে মন্দই হল বেশি। নীলস্ বোহরের ধারণা হল নাৎসি বৈজ্ঞানিকরা অনতিবিলম্বে পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে। না হলে ওকথা বলল কেন হেইসেনবের্গ?

এই সাক্ষাৎকারের পরেই বোহর-এর এক বন্ধু গোপনে এসে খবর দিলেন তাকে গ্রেপ্তার করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বোহর সুইডেনে পালিয়ে গেলেন। সেখান থেকে প্লেনে করে ইংল্যান্ডে। পরে আমেরিকায়। নীলস বোহর বহু সম্মান পেয়েছেন জীবনে–তার ভিতর একটি তার প্লেনে করে ইংল্যান্ডে আসার সময়। ব্রিটিশ এয়ারচিফ এই মূল্যবান কমডিটিটিকে নিরাপদে সুইডেন থেকে ইংল্যান্ডে আনবার ব্যবস্থায় এতই সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন যে, তাকে একটি বোমারু বিমানে করে নিয়ে আসা হয়। বৃদ্ধকে বসতে বলা হল প্যারাসুট এবং লাইফ-বেল্ট সেঁটে, বোমার গর্তটায়। বিস্মিত বোহর প্রশ্ন করলেন–এ কি! ওইখানে বসব কেন? গর্তের ভিতর?

পাইলট সবিনয়ে বললে, সেই রকমই নির্দেশ আছে স্যার! আমার প্লেন আক্রান্ত হলে আমি আপনাকে জীবন্ত বোমার মতো সমুদ্রে ফেলে দেব। আদেশ আছে, প্লেনটা ভেঙে গেলেও আপনাকে বাঁচাতে হবে। পিছন-পিছন আসছে একটা সি-প্লেন, সে আপনাকে উদ্ধার করবে!

ইংল্যান্ডে পৌঁছে জার্মান ইউরেনিয়াম-প্রোজেক্ট সম্বন্ধে প্রফেসর বোহর যা বললেন, তাতে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা নূতন করে শুনল হুঙ্কার–কাগুজে বাঘ-এর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *