কী ১০-১৩

১০.

বারোই জুন 1943। লস অ্যালামস থেকে দুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে ওপেনহাইমার এসেছে সানফ্রানসিস্কোয়। উঠেছে একটা হোটেলে। ওর স্ত্রী রয়েছে লস-অ্যালামস-এ। হঠাৎ কেন ওকে সানফ্রানসিস্কো আসতে হল? তা কেউ জানে না। এমনকি মিসেস ওপেনহাইমারও নয়। হোটেল থেকে রাত আটটা নাগাদ বের হল ওপেনহাইমার। একটা ট্যাক্সি নিল। ড্রাইভারকে বলল, চল-টেলিগ্রাফ হিল।

রবার্ট জে ওপেনহাইমার স্বপ্নেও ভাবেনি, ও ট্যাক্সি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠল রাস্তার ওপাশে একটা গাড়ির চালক। লোকটা তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলেছে আজ চার মাস। লস অ্যালামস থেকে একই ট্রেনে সে এসেছে সানফ্রানসিস্কোয়। লোকটার নাম ডি-সি। একজন এফ. বি. আই. এজেন্ট। কর্নেল প্যাশ নিযুক্ত।

এফ. বি. আই.-য়ের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে বিশেষ ক্ষমতাবলে জেনারেল গ্রোভসস্ ওপেনহাইমারকে চাকরি দিয়েছেন। এ কাজের অধিকার তার ছিল। কিন্তু তাই বলে এফ বি. আই.-চিফ, তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। যাকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া যায়নি, জাতির স্বার্থে তার ওপর নজর রাখবার আদেশ দিয়েছেন কর্নেল প্যাশকে। ওপেনহাইমারের প্রতিটি পদক্ষেপের রেকর্ড তৈরি হয়ে যাচ্ছে তার অজান্তে।

ট্যাক্সিটা টেলিগ্রাফ হিল-এর একটা বাংলো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে ওপেনহাইমার ঢুকে গেল ভেতরে। ডি-সি সে বাড়ি থেকে একশ মিটার দূরে তার গাড়িটা পার্ক করে চুপচাপ বসে রইল টেলিফটো ক্যামেরা হাতে। রাত বারোটা নাগাদ বাড়ির আলো নিবে গেল। সারা রাত কেউ বার হল না বাড়িটা থেকে। পরদিন ভোরবেলা দরজা খুলে বার হয়ে এল ওপনেহাইমার এবং একটি বছর-বত্রিশের মহিলা। মেয়েটি গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করল –ওপেনহাইমারকে নিয়ে চলে গেল এয়ারপোর্ট-এর দিকে। প্লেন ধরে ওপেনহাইমার চলে গেল পূর্বমুখে।

পরদিন বিস্তারিত রিপোর্ট পৌঁছে গেল কর্নেল প্যাশ-এর টেবিলে, খানপাঁচেক ফটো সমেত। মেয়েটিকে সহজেই শনাক্ত করা গেল। ডক্টর মিস্ জীন ট্যাটল। নামকরা কম্যুনিস্ট।

29 শে জুন জি-টু ডিভিসনের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ কর্নেল প্যাশ একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন নিউ ইয়র্কে তার বড়কর্তা কর্নেল ল্যান্সডেলের কাছে।

***

ঠিক দু-মাস পরে একদিন রবার্ট ওপেনহাইমারকে দেখা গেল সানফ্রানসিস্কোতে জি-টু ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার্সে লায়াল জনসনের কামরায়। জনসন ডি- সিলভার ওপরওয়ালা এবং কর্নেল প্যাশ-এর অধীনে নিযুক্ত। বারোই জুন রাত্রের রিপোর্টখানা ডি-সি এর মাধ্যমে ওপরে পাঠিয়েছিলেন, ফলে মিস ট্যাটল-সংক্রান্ত সংবাদ জানতে বাকি ছিল না লায়াল জনসনের। আপ্যায়ন করে বসালো সে লস অ্যালামসের ডিরেক্টারকে।

শোনা গেল, ওপেনহাইমারের আগমনের হেতু হচ্ছে রোজি লোমানিটজ। ছোকরার পিছনে লেগেছে এফ.বি.আই.। লোমানিটজ ছিল বার্কলেতে ওপির ছাত্র, বর্তমানে লস অ্যালামসে। তাকে নাকি এফ. বি. আই. থেকে ধরে এনেছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তাই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টার স্বয়ং এসেছেন পুলিস হেডকোয়াটার্সে তত্ত্ব-তালাশ নিতে।

জনসন কম্যুনিস্ট-প্রভাবের কথা আলোচনা করল, বললে লোমানিজকে আপাতত নাকি ছাড়া যাচ্ছে না। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে তাকে। জনসনের ধারণা রীতিমত একটা গুপ্তচরবাহিনী ম্যানহাটান ডিস্ট্রিক্ট-এ গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ডলারে মাইনে পায় না, পায়, রুবলস-এ।

ওপেনহাইমার গম্ভীর হয়ে বললে, আমি তোমার সঙ্গে একমত ক্যাপ্টেন। এমন ইঙ্গিত আমিও পেয়েছি।

–আপনি? কী ব্যাপার?

 –জর্জ এলটেন্টনের নাম শুনেছ?

-বলেন কী! তার ফাইলটা আমি সপ্তাহে তিনবার ওল্টাই। নামকরা রাশান-এজেন্ট।

–সেই এলটেন্টন একজন দালালকে পাঠিয়েছিল লস অ্যালামসে। কার্যোদ্ধার হয়নি, কিন্তু সে তিন-তিনটে দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল।

-বলেন কী! একটু বিস্তারিত করে বলবেন?

–বলতেই তো এসেছি–

আদ্যোপান্ত ঘটনাটা শুনে জনসন বললে, প্রফেসর এটা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, আমার বস কর্নেল প্যাশ আপনার মুখ থেকে সরাসরি শুনতে চাইবেন।

–আমার আপত্তি নেই আবার বলতে। কর্নেল প্যাশ তার চেম্বার আছেন?

-না, ডক্টর। উনি একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছেন। আপনি কাল সকালে একবার আসতে পারবেন?

–পারব। আটটার সময়। বিকালের প্লেনে আমি ফিরে যাব।

 কর্নেল প্যাশ তার ঘরেই ছিলেন। কিন্তু ইচ্ছে করে কিছুটা সময় নিল তীক্ষ্ণধী জনসন। সে মনে মনে ছক কষে ফেলেছে। ওপেনহাইমার ফিরে যেতেই সে কর্নেল প্যাশ-এর ঘরে ঢুকল। বিস্তারিত বলল সব কথা খুলে। কর্নেল প্যাশ বললে, এখনই ওকে ডেকে নিয়ে এলে না কেন?

–কিছু ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেট লাগাতে হবে স্যার। ডক্টর ওপেনহাইমারের স্টেটমেন্টটা টেপ-রেকর্ড করে রাখতে চাই।

প্যাশ খুশি হল তার অধীনস্থ কর্মচারীর দূরদর্শিতায়।

পরদিন ওপেনহাইমার যখন কর্নেল প্যাশ-এর ঘরে ঢুকল তখন সে জানত না, রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে যা বলছে তা গোপনে টেপ-রেকর্ড হয়ে রইল এফ. বি. আইয়ের দপ্তরে। কর্নেল প্যাশ আন্দাজ করেছিল, কোনো কাউন্টার-এসপায়োনেজের সূত্রে ওপেনহাইমার জানতে পেরেছিল, তাকে সন্দেহ করছে এফ. বি. আই.। তাই সে নিজে থেকেই ভালমানুষি দেখাতে এসেছিল জি-টু সদর দপ্তরে। আসলে লোমানিটজ-এর বিষয়ে তত্ত্বতালাস নিতে সে আদৌ আসেনি এবার সানফ্রানসিস্কোতে। এসেছিল পুলিসের সঙ্গে দহরম-মহরম করতে।

ওপেনহাইমারের গল্পটা ছিল এইরকম–এটেন্টনের দালাল লস অ্যালামসে। তিন-তিনজন বৈজ্ঞানিককে পর্যায়ক্রমে যাচাই করে। তিনজনই তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। ঐ তিনজন বৈজ্ঞানিকের নাম, অন্তত দালালটির নাম, জানবার জন্য প্যাশ খুব পীড়াপীড়ি করে; কিন্তু কিছুতেই সেকথা বলতে রাজি হলেন না ওপেনহাইমার। তার যুক্তি-দালালটি আসলে নিতান্ত ভালামানুষ–ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝেই সে এমন কাজ করেছে। তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না–আর বৈজ্ঞানিক তিনজন তো প্রত্যাখ্যানই করেছেন। ফলে তাঁদের আর মিছে কেন জড়ানো?

পরদিনই কথোকথনের টেপ-এর একটা কপি সমেত দীর্ঘ রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল প্যাশ তার উপরওয়ালা কর্নেল ল্যান্সডেল-এর কাছে–নিউইয়র্কে। তার রিপোর্টের উপসংহারে প্যাশ লিখেছিল

“ This office is still of the opinion that Oppenheimer is not to be fully trusted and that his loyalty to the nation is divided. It is believed that the only undivided loyalty that he can give is to Sci ence and it is strongly felt that if in his position the Soviet Gov ernment could offer more for the advancement of his scientific cause, he would select that Government as the one to which he could express his loyalty.”

অর্থাৎ: ওপেনহাইমারকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় না। জাতির প্রতি তার অকুণ্ঠ আনুগত্য নেই। তার একমাত্র লক্ষ্য : বিজ্ঞান। আজ যদি সোভিয়েট গভর্নমেন্ট তাকে বিজ্ঞানচর্চায় বেশি সুযোগ দেবার লোভ দেখায়, তবে সে অনায়াসে ও-পক্ষে যোগ দেবে!

অনতিবিলম্বে ল্যান্সডেল ডেকে পাঠালেন ওপেনহাইমারকে। পুনরায় জেরা। নানাভাবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ওপেনহাইমার দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করল, ঐ তিনজন বৈজ্ঞানিক অথবা ঐ দালালটির নাম প্রকাশ করে দিতে। বলল, আপনাদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করতে আমি প্রস্তুত–এজন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কথা বলতে এসেছিঃ কিন্তু তাই বলে যাঁরা অপরাধী নন তাদের নাম আমি কিছুতেই বলব না।

ল্যান্সডেল বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। না বলতে চাইলে আর কী করব আমরা? এটা তো নাৎসি জার্মানি অথবা স্তালিনের রাশিয়া নয়। আপনাকে কোনোভাবেই বিব্রত করব না আমরা। খুশি হয়ে ওপেনহাইমার ফিরে গেল লস অ্যালামসে। মিস্ ট্যাটলকের প্রসঙ্গ আদৌ উঠল না।

***

ওখানেই কিন্তু মিটল না ব্যাপারটা। সমস্ত কাগজপত্র এফ. বি. আই. পাঠিয়ে দিল জেনারেল গ্রোভসকেটেপ রেকর্ড, মিস্ ট্যাটলকের ফটো সমেত। লিখল, আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও আপনি ব্যক্তিগত দায়িত্বে ওপেনহাইমারকে নিযুক্ত করেছিলেন। আমরা আবার সুপারিশ করছি–তাকে অবিলম্বে বরখাস্ত করুন। এছাড়া আমাদের আরও তিনটি দাবি; প্রথমত-মিস্ ট্যাটলকের সঙ্গে কেন ওপনেহাইমার রাত কাটালেন? দ্বিতীয়ত-ঐ তিনজন বৈজ্ঞানিক কে? তৃতীয়ত–ঐ দালালটি কে? এ তিনটি প্রশ্নের জবাব আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর কাছ থেকে জেনে আমাদের জানান। ব্যাপারটার গুরুত্ব যথেষ্ট। আপনার রিপোর্ট পেলে আমরা যুদ্ধসচিবের কাছে আমাদের রিপোর্ট পাঠাব।

জেনারেল গ্রোভসস-এর মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ম্যানহাটান ততদিন প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিকাগোতে ফের্মি ‘চেন-রিয়্যাকশন’ সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। ইউ-238 থেকে ইউ-235 পরমাণু পৃথকরণও করা গেছে। প্লুটোনিয়াম পরমাণু বিদীর্ণ করার ফর্মুলাও আবিষ্কৃত। এইসব তাত্ত্বিক সূত্রের সাহায্যে লস অ্যালামসে হাতে-কলমে বোমা প্রস্তুত হচ্ছে। সে কাজ যে তত্ত্বাবধান করছে, সে লোকটা রবার্ট জে. ওপেনহাইমার। ক্লাউস ফুকস্ ইতিমধ্যে হিসাব কষে বার করেছেন বোমার আকার, ওজন ও আকৃতি অর্থাৎ ‘ক্রিটিক্যাল সাইজ। ওপেনহাইমার বিভিন্ন বিভাগে তার অংশ তৈরি করেছেন। এ অবস্থায় ওপেনহাইমার সম্পূর্ণ অনিবার্য। অথচ

গ্রোভস্ ডেকে পাঠালেন ওপিকে। খোলাখুলি বললেন, তোমার বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ আছে। আমাকে সব কথা খুলে বলতেই হবে। বল, কে ঐ দালাল, কোন্ তিনজন বৈজ্ঞানিককে যাচাই করেছিল সে।

জবাবে ওপেনহাইমার যা বলেছিল, সেটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড় মিথ্যাভাষণ।

তিনজন বৈজ্ঞানিকের মধ্যে দুজনের নাম সে বলেনি, বলেছিল মাত্র একজনের নাম। সে নামটা: রবার্ট জে, ওপেনহাইমার। দালালের নামটাও প্রকাশ করে দিয়েছিল সে এবার। তার নাম হাকন শেভেলিয়ার।

সজ্ঞান মিথ্যাভাষণ! বাস্তবে যা হয়েছিল তা এই : অন্য দুজন বৈজ্ঞানিক অলীক!

হাকন শেভেলিয়ার ওর দীর্ঘদিনের বন্ধু। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপনা করছেন 1938 থেকে। ওপনেহাইমারের ঝোঁক ছিল সাহিত্যের প্রতি। কাব্যপাঠে তার সখ ছিল। শুধু ইংরাজি নয়, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান সাহিত্যও পড়তেন তিনি। এমন কি সংস্কৃতও। যত্ন নিয়ে সংস্কৃত শিখেছিলেন। সেই সূত্রেই এই দার্শনিক মনোভাবাপন্ন নির্বিরোধী সাহিত্যের অধ্যাপকটির সঙ্গে আলাপ। কৈশোরে এবং যৌবনে ওপেনহাইমার সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন একথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। সেই আমলেই এটেন্টনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল শেভেলিয়ার এবং ওপির। কিছুদিন আগে লস অ্যালামস থেকে ওপেনহাইমার সস্ত্রীক ক্যালিফোর্নিয়াতে এসেছিলেন। পুরাতন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শেভেলিয়ার সস্ত্রীক। সন্ধ্যাবেলা। দুটি মহিলা বসে ড্রইংরুমে গল্প করছেন–ওপেনহাইমার উঠে গেলেন প্যানট্রিতে, ককটেইল বানিয়ে আনতে। গল্প করতে করতে শেভেলিয়ারও উঠে এলেন। ওপি ডিক্যানটারে ড্রাই মার্টিনী ঢালছেন, হঠাৎ শেভেলিয়ার বললেন, এলটেন্টনকে মনে আছে তোমার?

মুখ না ঘুরিয়েই ওপেনহাইমার বললেন, বিলক্ষণ। কেন?

কদিন আগে সে এসেছিল আমার কাছে। তোমার খোঁজ করছিল।

–কেন? কোনো প্রয়োজনে?

–না, ঠিক প্রয়োজনে নয়। বলছিল, রাশিয়া এবং আমেরিকা যদিও এ যুদ্ধে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে লড়াই করছে, তবু দু-দেশের বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে না।

অন্যমনস্কের মতো ওপেনহাইমার বলেন, তাই নাকি?

–নয়? তুমি কি মনে কর না–তোমরা যেসব আবিষ্কার করছ রাশিয়ান বৈজ্ঞানিকদের তা জানা উচিত এবং তারা যা বার করছে তা তোমাদের জানা উচিত?

এইবার ওপি তাকিয়ে দেখল বন্ধুর দিকে। হেসে বললে, তুমি কি চাও আমি পরমাণু বোমার ফর্মুলা ওদের দিয়ে দিই?

–আমি চাই, একথা বলছি না। তবে এলটেন্টন নিশ্চয় তাই চায়। রাশিয়াতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি কতটা হয়েছে তাও সে জানাতে চায়।

এর জবাবে ওপেনহাইমার বাস্তবে কী বলেছিলেন তা নির্ধারিত হয়নি। শেভেলিয়ারের মতে–”আমার যতদূর মনে পড়ে, ওপি বলেছিল–ওভাবে খবর আদানপ্রদান করা ঠিক নয়।“ ওপেনহাইমারের মতে, আমি দৃঢ়স্বরে বলেছিলাম—“সেটা তো বিশ্বাসঘাতকতা!”

মোটকথা এখানেই কথোপকথনের সমাপ্তি। ওঁরা ড্রইংরুমে ফিরে আসেন এবং পরস্পরের স্বাস্থ্যপান করেন।

মজা হচ্ছে এই যে, ওপেনহাইমার সন্দেহাতীতরূপে জানতেন যে, দার্শনিক প্রকৃতির হাকন শেভেলিয়ার আদৌ গুপ্তচরের বৃত্তি নিয়ে ও প্রসঙ্গ তোলেননি’ নিছক কথার কথা হিসাবে ‘অ্যাকাডেমিক আলোচনা করেছিলেন বন্ধুর সঙ্গে। ওপেনহাইমার যদি উৎসাহিত হতেন তবে হয়তো তিনি বলতেন–তাহলে তোমরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ কর। রাশিয়ার তথ্য সংগ্রহ কর, তোমাদের তথ্য ওদের জানাও!

ওপেনহাইমারের এই স্বীকারোক্তির ফলাফল শেভেলিয়ারের জীবনে মারাত্মকভাবে প্রতিফলিত হয়। তৎক্ষণাৎ তাকে বরখাস্ত করা হল অজ্ঞাত কারণে–এবং প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি কোথাও চাকরি জোগাড় করতে পারেননি বাকি জীবনে! প্রাইভেট টুইশানি করে জীবন কাটিয়েছেন। দীর্ঘ দশ বছর ধরে শেভেলিয়ার জানতে পারেননি তার কারণ। এ দশ বছরে বন্ধু ওপেনহাইমারের সঙ্গে দেখাও হয়েছে বেকার দুর্দশাগ্রস্ত শেভেলিয়ারের। ওপেনহাইমার শুধু মৌখিক সহানুভূতি জানিয়েছেন।

দীর্ঘ দশ বছর পরে আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন (ভেলিয়ার দম্পতি। যুদ্ধ শেষে যখন ওপেনহাইমারকে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল আসামির কাঠগড়ায়, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ফ্রান্স বসে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় বেকার মানুষটা পড়েছিলেন আমেরিকায় ও গনহ, ইমারের বিচার কাহিনি। জবানবন্দিতে নিজ নামটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। স্ত্রীকে কে বলে উঠেছিলেন, ওগো শুনছ! এই দেখ, কেন আমার করি। গিয়েছিল।

বন্ধুর সঙ্গে শেভেলিয়ারের আর কোনোদিন সাক্ষাৎ বা পত্রালাপ হয়নি।

জেনারেল গ্রোভসস্ মিস্ ট্যাটলকের প্রসঙ্গ আদৌ তোলেননি। কে ওপেনহাইমার ঐ মহিলাটির সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলেন সৌজন্যবোধে তিনি তা জানতে চাননি। তবে দশ বছর পরে কর্নেল প্যাশ যখন বিচারকের সামনে তার যাবতীয় নথিপত্র দাখিল করেন তখন ওপেনহাইমারকে সব কথা স্বীকার করতে হয়।

.

১১.

বারোই এপ্রিল 1945। সকাল সাতটা বেজে নয় মিনিট।

ঘটনাটা বর্ণনা করবার আগে তার পটভূমিটা একবার ঐতিহাসিক মূল্যায়নে ঝালিয়ে নেওয়া ভাল। জার্মানির অবস্থা সঙ্গীন। বার্লিনের পতন হতে বাকি আছে মাত্র আঠারোটি দিন। ওদিক থেকে রাশিয়ান রেড আর্মি, আর এদিক থেকে জেনারেল প্যাটনের থার্ড আর্মি বার্লিনের টুটি টিপে ধরেছে। যে কোনোদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারে-’ভি-ডে’ পালনের আদেশ এসে যেতে পারে। জাপানেরও নাভিশ্বাস উঠেছে পৃথিবীর অপর প্রান্তে। তিল তিল করে জাপানের মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে চলেছে মার্কিন বাহিনী।

যে কথা বলছিলাম। ঠিক সাতটা বেজে নয় মিনিটে ডায়াসের উপর উঠে দাঁড়ালেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। সেই ইতিহাসের ক্যাবিনেট রুম। উপরে ঝুলছে উড্রো উইলসনের তৈলচিত্র। ঘরে রুজভেল্ট-ক্যাবিনেটের সব কয়জন সভ্য। গত রাত্রে মারা গেছেন রুজভেল্ট। তার মরদেহ তখনও মাটির বুকে ফিরে যায়নি। চিফ জাস্টিস হারলান স্টোনের হাত থেকে বাইবেলটা নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট–আই, হ্যারি এস. ট্রুম্যান, ডু সলেলি সোয়্যার…

সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান। দশ মিনিটের ভেতরেই শেষ। পূর্ববর্তী ক্যাবিনেটের সদস্যরা একে একে ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেলেন। হারল্ড আইকস, হেনরি ওয়ালেস, হেনরি মর্থে্নথাও…ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে ডায়াস থেকে নেমে এলেন সদ্যনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট এবং তখনই তার নজরে পড়ল কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন একজন। একমাথা সাদা ধপধপে চুল, বলিরেখাঙ্কিত বৃদ্ধ–হেনরি স্টিমসন, যুদ্ধসচিব।

–আপনি যাননি?

 –যাবার উপায় নেই। অত্যন্ত জরুরি একটা কথা আপনাকে এখনই জানাতে

চাই।

-যুদ্ধের সব কথাই তো জরুরি।

-না, যুদ্ধক্ষেত্রের কথা নয়। এখানকার কথাই। আপনার মনে আছে প্রেসিডেন্ট-এনকোয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান ক্যাবিনেট-সদস্য হ্যারি ট্রুম্যানের বাড়িতে গিয়ে তাকে আমি একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলাম।

–আছে মিস্টার সেক্রেটারি। ম্যানহাটান-প্রজেক্ট! যেখানে কোটি কোটি ডলার খরচ হয়েছে অথচ এক আউন্সও ফিনিশড প্রডাক্ট বার হয়নি।

-ইয়েস! ম্যানহাটান-প্রজেক্ট।

ঘড়ির দিকে এনজর দেখে নিয়ে ট্রুম্যান বললেন, দু-মিনিটের মধ্যে মূল তথ্যটা বলুন।

–ম্যানহাটান-প্রজেক্টে পরমাণু বোমা তৈরি হচ্ছে, সত্যিই কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে। আমাদের আশা চারমাসের মধ্যে সেটা তৈরি হয়ে যাবে। একটি বোমায় হয়তো লক্ষ লোককে হত্যা করা যাবে। অসীম শক্তিশালী এই বোমা!

ম্লান হাসলেন হ্যারি ট্রুম্যান। বললেন, মিস্টার সেক্রেটারি। আমার অভিনন্দন! আশ্চর্য! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত এখবরটা জানাননি। কে কে জানেন?

তার চেয়ে শুনুন- কে কে জানেন না। ডগলাস ম্যাকআর্থার জানেন না, জেনারেল প্যাটন জানেন না, আইসেনহাওয়ার জানেন না,

-চার্চিল জানেন?

–জানেন।

–স্তালিন?

 –না।

***

চিঠি লেখা হল। সেই চিঠিখানা নিউইয়র্কের হোয়াইট-হাউসে পৌঁছাল এপ্রিলের বারো তারিখ।

কর্মভার বুঝে নিতে দিন সাতেক সময় লাগল ট্রুম্যানের। যুদ্ধসচিব কিন্তু নাছোড়বান্দা। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এত বড় একটা ব্যাপার তিনি কিছুতেই আর গোপন রাখবেন না। অগত্যা সময় করে নিয়ে পঁচিশে এপ্রিল 1945 সকালে ট্রুম্যান বসলেন যুদ্ধসচিবের সঙ্গে ম্যানহাটান-প্রকল্পের কথা আলোচনা করতে। সে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন আর একজন মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি–জেনারেল গ্রোভস।

প্রেসিডেন্ট প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, এ প্রকল্পে হাত দেওয়া হল কার পরামর্শে?

গ্রোভস্ ফাইল থেকে একটি চিঠি মেলে ধরলেন। দীর্ঘ পত্র। লিখেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে। তারিখটা দোসরা অগাস্ট 1939। তার লাল পেন্সিলে দাগ দেওয়া কয়েকটা ছত্রের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট :

“…it has been made probable–through the work of Joliot in France as well as Fermi and Szilard in America… that it may be come possible to set up a nuclear chain reactions in a large mass of uranium… This new phenomenon would also lead to the con struction of bombs… extremely powerful bombs….” ‘জুলিও-ৎজিলাৰ্ড-ফের্মি সব অচেনা নাম, ‘চেন রিয়্যাকসান-অফ ইউরেনিয়াম’ ব্যাপারটা বোঝা গেল না–কিন্তু শেষ পংক্তিটা বুঝতে পারলেন ট্রুম্যান–অসীম শক্তিধর বোমার জন্ম হতে পারে।

–কিন্তু কী হবে এ বোমা দিয়ে? জার্মানির পতন হতে তো আর এক সপ্তাহ। প্যাসিফিক-ফ্রন্ট থেকেও যে খবর পাচ্ছি–

বাধা দিয়ে অভিজ্ঞ স্টিমসন বলেন, প্রেসিডেন্ট! এই পরমাণু বোমার ব্যবহার করবো কি করবো না, করলে কেমন করে, কোথায় করবো তা স্থির করতে পারে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি। তাদের সুপারিশ আপনি মানতেও পারেন, নাও মানতে পারেন

–ঠিক কথা। এমন একটি কমিটি তৈরি করুন তাহলে।

–আপনার এইরকম অভিরুচি হতে পারে মনে করে আমি পূর্বেই একটি খসড়া তৈরি করে এনেছি। এতে পাঁচজন সদস্য আছেন।

প্রেসিডেন্ট কমিটি সভ্যদের নাম অনুমোদন করলেন। পাঁচজনই সমর-বিশারদ। বৈজ্ঞানিকদলের একজনও ছিলেন না কমিটিতে–অর্থাৎ যে বৈজ্ঞানিকদল প্রত্যক্ষভাবে পরমাণু-বোমা তৈরি করছিলেন।

ঐ পঁচিশে এপ্রিলই গঠিত হয়ে গেল ‘ইন্টেরিম কমিটি।

*

পঁচিশে এপ্রিল তারিখটা বুঝে নিতে আবার একবার পৃথিবীর উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ঐ দিন:

ইতালির গণ-অভ্যুথান হল। গুপ্তআবাস থেকে ফ্যাসিস্ট বেনিতো মুসোলিনি আর তার শয্যাসঙ্গিনী ক্লারাকে বের করে আনলো উন্মত্ত বিদ্রোহীরা। হত্যা করে ‘পাবলিক স্কোয়ার’-এ ঠ্যাঙ ধরে ঝুলিয়ে দিল, মাথা নিচের দিক করে।

জার্মানিতে ঐ একই দিনে রাশিয়ান লালফৌজ বার্লিন উপকণ্ঠে প্রথম প্রাচীর ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ঈভা ব্রাউন এলেন বার্লিন-বাঙ্কারে হিটলারের পরিণাম ভাগ করে নিতে।

জাপানে ব্যাপক বোমাবর্ষণে ঐ দিন ধূলিসাৎ হয়ে গেল টোকিওর অনেকটা এলাকা।

মারিয়ানায়–অর্থাৎ হাওয়াই এবং ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের মাঝামাঝি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি নির্জন দ্বীপে–ঐ দিন 509 নং কম্পোসিট গ্রুপ পারমাণবিক বোমার সাময়িক পান্থশালাটি নির্মাণ শেষ করল।

যাই হোক, ইন্টেরিম কমিটির দ্বিতীয় মিটিং বসল পেন্টাগনে, ত্রিশে মে। কমিটির সদস্যেরা বললেন-বৈজ্ঞানিক দলের ভিতর থেকে কিছু বিশেষজ্ঞকে কমিটিতে কোঅপ্ট করা দরকার। না হলে এই বোমা নিয়ে কী করা উচিত তা ওঁরা নির্ধারণ করতে পারছেন না! তৎক্ষণাৎ সদস্য সংখ্যায় যুক্ত হল আরও চারটি নাম। কম্পটন, ফের্মি, লরেন্স এবং ওপেনহাইমার। শেষোক্ত ব্যক্তি বাদে তিনজনই বিজ্ঞানে নোবেল-লরিয়েট।

ওই চারজন ছাড়া বাদবাকি কেউই সেদিন জানতেন না অ্যাটম বোমা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে কিনা। প্রস্তুত হওয়ার আগেই একটি কমিটি নির্ধারণ করতে বসেছেন–কোথায় ওটা ফেলা হবে। খবরটা ওঁরা পেতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে।

ওয়াইৎসেকার একজন অতি উচ্চপদস্থ মার্কিন সামরিক অফিসারকে এই সময় গাউডসমিটের রিপোর্টখানা দেখিয়ে বলেছিলেন, এতদিনে নিশ্চিত হওয়া গেল কী বলেন? জার্মান জুজুর আর ভয় নেই। আমাদেরও তাহলে এই নারকীয় কাণ্ডটা করতে হবে না।

অভিজ্ঞ সামরিক অফিসারটি জবাবে বলেছিলেন, তাই কি হয় স্যার? এত খরচ পড়ল যার পেছনে সেটা ব্যবহারই হবে না? দেখবেন, বোমা ঠিকই পড়বে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ওয়াইৎসেকার।

***

বস্তুতপক্ষে এই বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের পরিণাম সম্বন্ধে অনেক প্রথম শ্রেণির বৈজ্ঞানিকই ততদিনে ভাবতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে গাউডসমিট-এর রিপোর্ট পাওয়ার পরে। এঁদের মধ্যে প্রফেসর নীলস বোহর, ৎজিলাৰ্ড, ফ্রাঙ্ক, রোবিনোভিচ ইত্যাদি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাদের প্রচেষ্টার কথা একে একে বলি।

সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অগ্রণী হয়েছিলেন দার্শনিক প্রকৃতির প্রফেসর বোহর। পরমাণু-বোমা তৈরি হবার ঠিক এক বছর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে দেখা করেন ছাব্বিশে অগাস্ট 1944-এ। একটি সুলিথিত স্মারকলিপি ধরিয়ে দেন প্রেসিডেন্টের হাতে। এই রিপোর্টে বোহর প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন অনাগত পরমাণু-বোমা প্রয়োগের বিষয়ে চিন্তা করতে। প্রফেসর বোহর রাজনীতিক ছিলেন না–কিন্তু এই রিপোর্টে তিনি অদ্ভুত দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। একস্থানে তিনি বলেছেন, বিশ্বাস সৃষ্টিকারী আক্রমণকারীদের স্বপ্ন ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। তাদের পতন অনিবার্য এবং আসন্ন। কিন্তু আমার আশঙ্কা হয়, যে সব জাতি এ আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে যুদ্ধান্তে তাদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেবে–কারণ। তাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে মৌল পার্থক্য আছে।

এজন্য বিশ্বশান্তির মুখ চেয়ে তিনি মিত্রপক্ষের তিন শীর্য-শক্তির ভিতর এই অসীম শক্তিধর অস্ত্রের বিষয়ে একটা সমঝোতায় আসতে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এইভাবে গোপন সাক্ষাৎকারের কোনো রেকর্ড রেখে যাওয়া পছন্দ করতেন না। নীল বোহরের সঙ্গে আলোচনার সময় তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না কেউ। প্রেসিডেন্ট কাউকে বলে যাননি তাদের কী কথাবার্তা হয়েছিল। যুদ্ধান্তে প্রফেসর বোহর-কে এ বিষয় প্রশ্ন করা হলে নৈতিক কারণে তিনি কোনো জবাব দিতে অস্বীকার করেন। বলেন, প্রেসিডেন্ট যখন তা বলে যাননি–তখন আমার কিছু বলা শোভন হবে না।

মোটকথা, প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে অগ্রসর হয়ে কিছু করলেন না। নীলস বোহর অতঃপর চার্চিলের সঙ্গে দেখা করেন। সে সাক্ষাৎকারের সময় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা লর্ড চেরওয়েলও উপস্থিত ছিলেন। প্রফেসর বোহর পরমাণু-বোমার ফলশ্রুতি সম্বন্ধে দীর্ঘ আধঘন্টা ধরে বলেন। ধৈর্য ধরে এতক্ষণ শুনছিলেন চার্চিল। হঠাৎ তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। লর্ড চেরওয়েলকে বলেন : লোকটা কী বলতে চায়? রাজনীতি না পদার্থবিদ্যা?

What is he really talking about? Politics or Physics?

নীলস বোহর এ ব্যাপারে কী বলবেন ভেবে পাননি।

***

মর্মাহত হয়েছিলেন আলেকজান্ডার সাও। পারমাণবিক-বোমা প্রায় তৈরি হয়ে এল অথচ জার্মানি বা জাপান তা তৈরি করেনি জেনে ধনকুবের সাও রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েন। তার মনে হয় বর্তমান যুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহৃত হলে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর জন্য তিনিই পরোক্ষভাবে দায়ী হয়ে থাকবেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে একটা খসরা দাখিল করেন 1944-এর ডিসেম্বরে।

তার প্রস্তাবটা ছিল–মিত্রশক্তি এবং নিরপেক্ষ দেশগুলির বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক, ধর্মজগতের প্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে এই অস্ত্রের কার্যকারিতা পরখ করে দেখানো হবে। এভাবে এ অস্ত্রের প্রয়োগক্ষমতা প্রমাণ করে জার্মানি ও জাপানকে চরমপত্র দেওয়া উচিত নির্দিষ্ট তারিখের ভেতর আত্মসমর্পণের নির্দেশ জানিয়ে।

এ পত্রটিও রুজভেল্ট বিবেচনার জন্য রেখেছিলেন তার দপ্তরে। যুদ্ধসচিবকে এর কথাও কিছু বলে যাননি।

পরমাণু-বোমার প্রয়োগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উদ্যোগী হন হাঙ্গেরিয়ান বৈজ্ঞানিক ৎজিলাৰ্ড। 1939 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনিই ছুটে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন-এর কাছে। এবার 1945-এ তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র মানসচক্ষে দেখে শিউরে উঠলেন। তার মনে হল, এ বোমার জন্য তিনিই একান্তভাবে দায়ী। বোমা যাতে বর্ষিত না হয় সেজন্য প্রাণপাত করেছিলেন। ৎজিলাৰ্ড। ক্রমাগত চেষ্টা করেও হ্যাঁরী ট্রম্যানের সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে পারলেন না তিনি। অতিব্যস্ত প্রেসিডেন্ট তার সাক্ষাৎপ্রার্থীকে পাঠিয়ে দিলেন জেমস বার্নের্স-এর কাছে। বার্নের্স একজন ক্ষমতাশালী ডেমোক্র্যাট সেনেটর। বস্তুত ওৎজিলার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের এক-সপ্তাহের ভিতরেই তিনি সেক্রেটারি অফ স্টেট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

ৎজিলাৰ্ড মানবিকতার দোহাই পেড়ে ধুরন্ধর বার্নের্সকে কাবু করতে পারলেন না। অবশেষে অন্য যুক্তির অবতারণা করলেন তিনি, আমার মনে হয় এখনই রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তিবদ্ধ হওয়া উচিত। আমি স্যার, বর্তমান বিশ্বযুদ্ধের কথা ভাবছি না। ভাবছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা।

বার্নের্স হেসে বলেছিলেন, তাহলে বলব, বড় তাড়াতাড়ি ভাবছেন আপনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই এখনও শেষ হয়নি। আর ফর যোর ইনফরমেশন, প্রফেসর, রাশিয়ায় ইউরেনিয়াম আদৌ নেই।

হতাশ হয়ে ফিরে এলেন ৎজিলাৰ্ড লস অ্যালামসে। দেখলেন, সেখানে তাঁর সহকর্মী বৈজ্ঞানিকরা অনেকেই তার সঙ্গে একমত। তাঁরা বলছেন, জার্মানি যখন পরাজিত, জাপান নতজানু, তখন এ বোমা বর্ষণের কোনো অর্থই হয় না।

কে একজন (নামটা জানা যায়নি) বলেছিলেন, কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের যুক্তি না শোনেন তবে আমরা এ কারখানায় ধর্মঘট করব। মার্কিন সরকার আমাদের সঙ্গে অলিখিত ভদ্রলোকের চুক্তি করেছিলেন যে, এ অস্ত্র শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে ব্যবহৃত হবে- আগ্রাসী রণনীতির জন্য নয়। সরকার যদি চুক্তি না মানেন তবে সেটা হবে সরকারের চরম বিশ্বাসঘাতকতা!

ফুকস্ নাকি জবাবে বলেছিলেন, এখন এ প্রকল্প যে অবস্থায় আছে তাতে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েটদের দিয়েই বাকি কাজটা সম্পন্ন করা সম্ভব। নাট-বোল্টুগুলো তো শুধু কষতে বাকি, বন্ধু!

লস অ্যালামসে সেদিন রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনেকক্ষণ এ নিয়ে আলোচনা হল। শিবিরে ইতিমধ্যে দুটি দল হয়ে গেছে। একদলের নেতা ওপেনহাইমার,–সে দলে আছেন ইন্টেরিম কমিটির বাকি তিনজন সদস্য–ফের্মি, কম্পটন আর লরেন্স। অপর দল বোমাবিরোধী। সে দলের দলপতি অভিজাত জার্মান বৈজ্ঞানিক নোবেল-লরিয়েট জেমস্ ফ্রাঙ্ক এবং তার সক্রিয় কর্তা ৎজিলাৰ্ড। ঐরাত্রেই সাতজন বৈজ্ঞানিক তৈরি করলেন একটি রিপোর্ট। তার নাম ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট। তাতে সই দিলেন–ফ্রাঙ্ক, ৎজিলাৰ্ড, রোবিনোভিচ এবং আরও চারজন। রিপোর্টখানি নিয়ে ৎজিলাৰ্ড উপস্থিত হলেন ক্লাউস ফুকস-এর চেম্বারে। কিন্তু সই দিতে অস্বীকার করলেন ফুকস।

-কেন? আপনি তো বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে বলেই চিরকাল জানতাম আমি।

–আজ্ঞে না! ভুল জানতেন! এই বোমা তৈরি করতে দুই বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বুঝেছেন? দুই বিলিয়ন ডলার।

-তাহলে আপনি কি কিছুই করবেন না?

–কেন করব না? জাপান যখন জ্বলবে তখন বেহালা বাজাব। নীরোও তো তাই করেছিলেন। এই তো ইতিহাসের শিক্ষা।

ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ৎজিলাৰ্ড। শেষদিকে ফের্মি মত বদলেছিলেন। তিনি এবং আই রাবি একটা যৌথ পত্র লিখেছিলেন প্রেসিডেন্টকে, “এই অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা মনে করে আমরা পরামর্শ দিই নৈতিক কারণে এর প্রয়োগ আপনি বন্ধ করুন।”

নীলস বোহর-এর পত্র, ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট, ফের্মির চিঠি–কিছুতেই কিছু হল না। আরও একটা চেষ্টা করেছিলেন ওৎজিলাৰ্ড। একক প্রচেষ্টা। গাড়ি নিয়ে একাই চলে গিয়েছিলেন লং-আইল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্তে। এবার বাড়িটা চিনতে অসুবিধা হয়নি। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক এবার সহজেই চিনতে পারলেন ৎজিলাৰ্ডকে। ছয় বছর আগে তাকে দেখেছিলেন, সে ওঁর ছাত্র। আদ্যোপান্ত সব কথা খুলে বললেন ৎজিলাৰ্ড। আইনস্টাইন তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন পুনরায় রুজভেল্টকে একটি পত্র লিখতে।

25 মার্চ 1945 চিঠি লেখা হল। সেই চিঠিখানি নিউ ইয়র্কের হোয়াইট-হাউসে পৌঁছাল এপ্রিলের বারো তারিখ। কিন্তু প্রাপকের হাতে সেটা পৌঁছল না। পূর্বরাত্রে চিঠির প্রাপক ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট অন্তিম নিশ্বাস ফেলেছেন। চিঠিখানা রাখা ছিল, না-খোলা অবস্থায়, তার স্থলাভিষিক্ত হ্যারি ট্রুম্যানের টেবিলে। অপাত্রের হাতে। নিতান্তই নিয়তির পরিহাস!

.

১২.

পাঁচই জুলাই 1945। তিনখানি টেলিগ্রাম করলেন ওপেনহাইমার। একই বয়ান। প্রাপক তিনজন হচ্ছেন শিকাগোর আর্থার কম্পটন, বার্কলের আর্নেস্ট লরেন্স এবং নিউইয়র্কের লেসলি গ্রোভ। তিনজনেই আমেরিকান। টেলিগ্রামের বক্তব্য ‘পনের তারিখের পরে মাছ ধরতে যাব। বৃষ্টি না পড়লে পরদিনই মাছ ধরা যায়।

তিনজনেই প্রস্তুত ছিলেন। সাঙ্কেতিক ভাষার বক্তব্য বুঝলেন। রওনা হলেন দেখতে।

তিনটি বোমা তৈরি হয়েছে এতদিনে। দুটি প্লুটোনিয়াম পরমাণুর, একটি ইউরেনিয়ামের। সর্বমোট খরচ হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অঙ্কশাস্ত্রের হিসাবে তিনটিই ব্রহ্মাস্ত্র। তবে সব কিছু খাতায়-কলমে।

প্রশ্ন মাত্র একটাই : ফাটবে তো?

স্থির হল, একটিকে ফাটিয়ে পরখ করা হবে। লস অ্যালামস থেকে 339 কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে জনমানবহীন এক বিজন প্রান্তরে। জায়গাটার নাম অ্যালমগডো। মাস-ছয়েক আগেই স্থানটি নির্বাচিত হয়েছিল। ছয়মাস ধরে যাবতীয় ব্যবস্থা করা হচ্ছে ঐ মরুপ্রান্তরের গভীরে। সে ব্যবস্থার একটু পরিচয় দিই।

যেখানে বোমাটা ফাটবে তাকে বলা হল ‘গ্রাউন্ড জিরো’। প্রশ্ন হল : কতদূরে রাখা হবে যন্ত্রপাতি? মানুষের পক্ষেই বা নিরাপদ দূরত্ব কতটা? পরমাণু-বোমার বিস্ফোরণের পূর্বঅভিজ্ঞতা তো কারও নেই! আন্দাজে ভুল হলে যে শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকেরাই উড়ে যাবেন!! কী করা যায়? সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ছিল ক্রিস্টিয়াকোস্কির নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষ কমিটির উপর। কিস্টি ছিলেন বিস্ফোরক-বিশারদ। কিস্টি বললেন, প্রথমে একটি নমুনা বোমা ফাটাও। সাতই মে সেই বোমা ফাটানো হল–পরমাণু বোমা নয়, একশ-টন ওজনের ডিনামাইট স্তূপ। তার বিস্ফোরণের নিখুঁত হিসাব করা হল। এবার ‘স্কেল ফেলে’ কতদূরে কে থাকবেন স্থির করা হল। পরমাণু-বোমার বিস্ফোরণ ক্ষমতা হিসাবমতো হবে 5,000 টন টি.এন.টি.র সমান। অর্থাৎ 50 গুণ সব কিছু বাড়ানো হল। নমুনা-বোমার যে যন্ত্রটা এক কিমি দূরত্বে নিরাপদ মনে হয়েছে তাকে পরমাণু বোমার ক্ষেত্রে 50 কিমি দূরে বসাতে হবে!

***

নির্ধারিত দিনে প্রায় আড়াই শতজন বৈজ্ঞানিক সমবেত হলেন ‘ট্রিনিটি-টেস্ট’ দেখতে। দুর্ভাগ্যক্রমে বৃষ্টি শুরু হল। আবহাওয়াবিদরা বললেন, রাত দুটোর পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। গ্রাউন্ড-জিরো থেকে দশহাজার গজ দূরে (প্রায় নয় কিলোমিটার) তিনটি অবজারবেশন পোস্ট তৈরি হয়েছে। বিশেষভাবে নির্মিত ভূগর্ভস্থ গুহায়। এখানে কয়েকটি যন্ত্রের মাধ্যমে রেকর্ড করা হবে বিস্ফোরণের ফলাফল। বেস-ক্যাম্পের দূরত্ব ষোলো কিলোমিটার। সেখানে ফাঁকায় দাঁড়ানো-না দাঁড়ানো নয়, শোওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঐ দশ হাজার গজ দূরে থেকে বোতাম টিপে রেডিও-র মাধ্যমে বোমাটাকে ফাটানো হবে। তাই বলে অত দামি জিনিসটাকে তো বিনা রক্ষকে ফেলে রাখা যায় না। তাই স্থির হয়েছে। দু-জন মেশিনগানধারীসহ দুঃসাহসী ক্রিস্টিয়াকৌস্কি ঐ বোমার কাছে পাহারা দেবেন পাঁচটা পর্যন্ত। এঞ্জিন-চালু অবস্থায় একটা জিপ খাড়া থাকবে। ঠিক পাঁচটায় ওঁরা রুদ্ধশ্বাসে জিপে করে পালাবেন। কিস্টি পাকা ড্রাইভার। আধঘন্টায় অনায়াসেই পৌঁছে যাবেন ষোলো কিলোমিটার দূরের নিরাপদ বেস ক্যাম্পে।

কে যেন বলল, কিন্তু ধরুন জিপটা যদি যান্ত্রিক গণ্ডগোলে অচল হয়ে পড়ে?

গ্রোভস্ বলেন, সে কথাও ভেবেছি আমি। তাই তো কিস্টিকে পছন্দ করলাম। ও ভাল দৌড়ায়। কলেজ স্পোর্টস-এ প্রাইজ পেয়েছে। এবার প্রাইজটা তো বড় সামান্য নয়–ওর প্রাণ-কিস্টি আধঘন্টায় নিরাপদ দূরত্বে যাবেই।

ওপেহাইমারকে দশ হাজার গজ দূরত্বে ভূগর্ভস্থ কক্ষে রেখে গ্রোভূস্ চলে গেলেন বেস ক্যাম্পে। অনেকেই আছেন সেখানে। প্রত্যেককে নির্দেশ দেওয়া। হয়েছিল–গণনা শুরু হতেই মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। ঠ্যাঙ বোমার দিকে, মাথা উল্টোদিকে। কানে তুলো। চোখ বন্ধ। তার উপর হাত চাপা দিতে হবে। আলোর ঝলকানি চুকে যাওয়ার পর ওদিকে তাকাতে পার–তবে খালি চোখে নয়, বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো গগলস পরে। প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে। সেই চশমা।

ঘোষক গুনতি শুরু করল 5-10 মিনিট থেকে। প্রথমে পাঁচ মিনিটের তফাতে, পরে প্রতি মিনিটে। পাঁচটা উনত্রিশে মিনিটের প্রতি সেকেন্ডে।

পাঁচটা উনত্রিশেও কিন্তু জিপটা এসে পৌঁছাল না। উত্তেজনায় ছটফট করছে সবাই। স্যাশ অ্যালিসন নির্বিকারভাবে সেকেন্ড ঘোষণা করে চলছে: উনষাট… আটান্ন…সাতান্ন….

মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড বাকি থাকতে জিপটা এসে থামল। পড়ি-তো-মরি করে তিনজনে ঢুকে পড়লেন ভূগর্ভস্থ নিরাপদ কক্ষে।

নয়… আট….সাত….

সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন চোখ-কান বন্ধ করে।

একটিমাত্র ব্যতিক্রম। একজন এ আদেশ মানেননি। সজ্ঞানে। সাত সেকেন্ড বাকি থাকতে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন তিনি। বলে ওঠেন : দুত্তোর! দশ মাইল দূরত্বে এখানে ঘোড়ার ডিম হবে।

নোবেল লরিয়েট লরেন্স শুয়ে ঠিক পাশেই। কানে তুলো গোঁজা, তবু শুনতে পেলেন তিনি কথাটা। কে এমনভাবে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বুঝতে পারলেন না। মুখ তুলতেও সাহস হল না-: চার ….তিন….দুই….

চীৎকার করে ওঠেন আর্নেস্ট লরেন্স, শুয়ে পড়ো! মরবে তুমি!

লোকটাও চীৎকার করে ওঠে: কী বকছেন স্যার পাগলের মত।

তৎক্ষণাৎ চিনতে পারেন লরেন্স। কিন্তু জবাব দেবার সময় ছিল না। ঘোষক বললে, নাউ।

***

ট্রিনিটি-টেস্ট-এ যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক ছাড়া একজন মাত্র সাংবাদিককে এ পরীক্ষায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এর উইলিয়াম লরেন্স। সকল বর্ণনাই এক সুরে বাঁধা। সুপারলেটিভের ছড়াছড়ি। সেটাই স্বাভাবিক। অভিধান হাতড়ে কেউ উপযুক্ত বিশেষণ খুঁজে পাননি।

ফাইনম্যানের কথা বলি। একমাত্র তিনিই সোজা দাঁড়িয়ে ওদিকে চোখ বুজে তাকিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতাটা উনি এমনভাবে বর্ণনা করেছেন: মুহূর্তে সব সাদা হয়ে গেল। যেন অজস্র সূর্য একসঙ্গে আকাশে উঠেছে! চোখ ঝলসে গেল। চোখে ও মাথায় যন্ত্রণা বোধ হল। আমার চোখ বন্ধ ছিল, গগলস-এর নিচে। তাতেই ঐ অনুভূতি হল আমার। পরমুহূর্তেই যন্ত্রণা সত্ত্বেও আমি চোখ খুললাম। সাদা আলোটা ততক্ষণে হলুদ হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড একটা ধোঁওয়ার বলয় পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ধোঁয়ার ঐ কুণ্ডলিগুলি ওপরে কমলা রঙের আর একটা আগুনের বলয়–তার কিনারগুলো সিঁদুরে লাল। ওপরে ওপরে আরো ওপরে উঠে গেল। অনাবিষ্কৃত একটা নগ্ন সত্য প্রকাশিত হল যেন–পারমাণবিক বন্ধনমুক্ত মহামৃত্যু। অপূর্ব দৃশ্য! তারপর অস্বাভাবিক একটা নিস্তব্ধতা। আমাদের বেস ক্যাম্পের কেউ কোনো কথা বলেনি। পুরো দেড় মিনিট। তারপর এল বিস্ফোরণের শব্দটা!

দেড় মিনিট পরে। লরেন্স এতটা আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন যে, হঠাৎ বলে ওঠেন, ওটা কিসের শব্দ?

যেন এত বড় একটা বিস্ফোরণের পরে কোনো শব্দই হবে না!

ওপেনহাইমার দশ হাজার গজ দূরের ‘এম’-পয়েন্টে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি নাকি বলে ওঠেন :

 “নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্।
দৃষ্টা হি ত্বাং প্ৰব্যথিতান্তরাত্মা ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো।”

–ইস দ্যাট গ্রিক প্রফেসর?– প্রশ্ন করেন জেমস ফ্রাঙ্ক।

 –নো স্যার। ইটস স্যানস্কৃট! জবাব দিলেন ওপেনহাইমার!

–কী অর্থ কবিতাটার?

–হে পরমপিতা! আপনার আকাশস্পর্শী তেজোময় নানাবর্ণযুক্ত ঐ বিস্ফারিত মুখমণ্ডল এবং উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার হৃদয় আজ ব্যথিত। আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি, আমি ‘শম’ অর্থাৎ শান্তি হারিয়ে ফেলেছি।

অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আশ্চর্য কবিতা। ঐ কথাটাই ঠিক মনে হচ্ছিল আমার। জার্মান ভাষায় অবশ্য। এ বিস্ফোরণে একটা জিনিস হারিয়ে গেল শুধু–সেটা শান্তি! আমার হৃদয়ও আজ ব্যথিত।

গ্রোভস অনতিবিলম্বে একটি টেলিগ্রাফ করেন পটসড্যামে, যুদ্ধসচিব স্টিমসনকে–

“সন্তান নির্বিঘ্নে জন্মলাভ করেছে। স্বাস্থ্যবান শিশু। সে হাইহোল্ডে* [*হাইহোল্ড স্টিমসনের বাড়ি। গ্রোভসের অফিস থেকে তার দূরত্ব কত তা টেলিগ্রাফক্লার্ক না বুঝলেও স্টিমসন বুঝবেন।] থাকলেও এখানে বসে তাকে দেখতে পেতাম। তার চিল্লানি এখান থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাবে।”

টেলিগ্রাফটা পাঠানো হল পটসড্যামে। জার্মানিতে। যুদ্ধসচিব তখন সেখানে। শুধু তিনি একা নন। হ্যারি ট্রুম্যানও। ঐ পটসড্যামে।

পটসড্যাম।

সাধারণজ্ঞানের প্রশ্নপত্রে প্রশ্নটা করে দেখবেন : পটসড্যাম কোথায়? কীজন্য বিখ্যাত?

শতকরা নিরানব্বই জন ছাত্র লিখবে নির্ভুল উত্তর-’বার্লিন শহরের দক্ষিণপশ্চিম শহরতলি। বার্লিনের পতনের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে এখানে বিজয়ী মিত্রপক্ষের শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল। এখান থেকেই জাপানকে নতজানু হবার আদেশ প্রচারিত হয়।

শতকরা একজন হয়তো ভুল উত্তর লিখে বসবে। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, বেচারি ফিজিক্স কিংবা ম্যাথুসের। ভুল উত্তর লেখায় নিশ্চয় তাকে আপনি নম্বর দেবেন না। বোকাটা লিখেছে: পটসডামে আলবার্ট আইনস্টাইনের বাড়ি। বিতাড়িত হবার পূর্ব জীবনের কুড়িটি বছর তিনি ওখানে কাটিয়েছেন।

স্থান-কাল-পাত্র। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। স্থানটাকে আপাতত ধ্রুবক বলে ধরে নিন–দেখবেন, পাত্র কাল এর সঙ্গে তাল রেখে চলছে। ধরুন কালটা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দশক। দেখবেন, পটসড্যামের রাস্তায় সারি সারি পপলার গাছের তলা দিয়ে প্রত্যষে প্রাতভ্রমণে বার হয়েছেন একজন প্রোঢ়। সারা শহরতলি তখন ঘুমোচ্ছে, কুয়াশার ঘোর ভেদ করে পুবআকাশ থেকে সোনালি হাতছানি এসে পড়েছে ভ্রমণরত প্রৌঢ় মানুষটির কালো ওভারকোটে। ওঁর এক হাতে ছড়ি, অপরহাতে ধরা আছে কুকুরের চেন। মুখে মোটা চুরুট। সারা শহরতলি ঘুমোচ্ছে, শুধু কৌতূহলী একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছুটছে তাঁর পিছন পিছন–ওঁরই চুরুটের ধোঁয়া। অনুগামী ধূমকুণ্ডলী আর অগ্রগামী কুকুর, মাঝখান চলছেন আইনস্টাইন। শুধু ঐ কুকুরটাই নয়, প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিককে পিছনে ফেলে আগে আগে ছুটছে আরও একটা জিনিস। সেটা ঐ বৈজ্ঞানিকের চিন্তাধারা। শুধু বৈজ্ঞানিককেই নয়, বিশ্বকেই যেন কয়েক দশক পিছনে ফেলে যেতে চায় সেটা।

বদলে দিন ‘কাল’টাকে। এগিয়ে আসুন দশক দুয়েক। আমাদের এ কাহিনির বর্তমান পটভূমিতে। 1945 সালের ষোলোই জুলাই। ট্রিনিটি টেস্টের ঐ চিহ্নিত দিনে। দেখবেন পাত্রও বদলে গেছে। পরিবেশটাও। সেই নীলআকাশ-সন্ধানী পপলারগুলি উলীত। শহরতলি ঘুমোচ্ছে না–সেটা শ্মশান। পথের ধারে ধারে আর কারনেশান-ডায়ান্থাস্- হলিহক নেই, আছে কংক্রিটের চাংক–ইটের স্তূপ আর মিলিটারি ডিসপোসালের শূন্যগর্ভ ক্যান। এবার পাত্রত্রয় হচ্ছেন বিজয়দপী তিন যুদ্ধবাজ–চার্চিল, ট্রুম্যান আর স্তালিন।

যুদ্ধের সময় তিন প্রধান একাধিকবার মিলিত হয়েছিলেন। কুইবেক-এ, তেহেরান-এ এবং ইয়ালটায়। ট্রুম্যান অবশ্য এই প্রথম যোগ দিচ্ছেন শীর্য সম্মেলনে; ইতিপূর্বে এসেছিলেন রুজভেল্ট। শেষ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য চিহ্নিত হয়েছিল পরাজিত বার্লিন শহর। দুর্ভাগ্যবশত বার্লিনে এমন একখানা বড় বাড়ি নজর পড়ল না, যেখানে এত বড় সম্মেলন হতে পারে। সমস্ত শহর তখন ধ্বংসস্তূপ। তাই শহরপ্রান্তে ক্রাউন-প্রিন্স উইলহেলম-এর আবাসে আহত হল এই মহাসম্মেলন। ষোলোহ জুলাই প্রথম অধিবেশন বসার কথা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, স্তালিন সময়মতো এসে পৌঁছাতে পারলেন না। কী করা যায়? সময় কাটাতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান গেলেন বার্লিন শহর দেখতে। অর্থাৎ বার্লিনের ধ্বংসস্তূপ দেখতে। সঙ্গে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ। যুদ্ধসচিব স্টিমসন, সেক্রেটারি অফ স্টেট, নৌবিভাগের অ্যাডমিরাল লেহি প্রভৃতি। এ কাহিনির পক্ষে আপাতদৃষ্টিতে সেই ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শনের বর্ণনা বাহুল্য মনে হতে পারে, কিন্তু বোধকরি এরও প্রয়োজন আছে। পরমাণু-বোমা ফেলবার চূড়ান্ত আদেশ যিনি দিয়েছিলেন, সেই মানুষটিকে ঠিকমত চিনে নিতে হলে এটাও উপেক্ষার নয়।

প্রেসিডেন্ট তার স্মৃতিচারণে বলেছেন, “একটা বাড়িও নজর পড়ল না যেটা অনাহত। সবকটিই ক্ষতিগ্রস্ত। হয় ধ্বংসস্তূপ, না হলে হাড়-পাঁজরা বার করে দাঁড়িয়ে আছে প্রেতের মতো। আমাদের গাড়ির ক্যারাভ্যান গিয়ে থামল রাইষ চ্যান্সলারির সামনে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। সেই ঝোলা বারান্দাটার চিহ্নমাত্র নেই–যেটির ওপর দাঁড়িয়ে হিটলার তার অনুগামী নাৎসি যুদ্ধবাজদের সামনে বক্তৃতা দিত।”

ট্রুম্যান তো আর সেই ফিজিক্স অথবা ম্যাথসের ছাত্রটি নন–তাহ খোঁজ করে দেখতে চাননি–আইনস্টাইনের বাড়িটা মুখ থুবড়ে পড়েছে অথবা ‘হাড়-পাঁজরা বার করে দাঁড়িয়ে আছে।

ভ্রমণকাহিনীর উপসংহারে ট্রুম্যান লিখেছেন

“It is a demonstration of what can happen when a man over reaches himself…. I never saw such destruction. I don’t know whether they learned anything from it or not.”

অর্থাৎ মানুষ তার ক্ষমতার বাইরে হাত বাড়ালে কী পায় তারই প্রদর্শনী যেন!… আমি এমন ধ্বংসস্তূপ কখনো দেখিনি। জানি না, ওরা এ থেকে আদৌ কোনো শিক্ষা পেল কিনা।

ইতিহাস এর জবাব দিয়েছে। ওরা কোনো শিক্ষা পাক আর না পাক, প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান যে কোনো শিক্ষাই পাননি তার প্রমাণ হিরোশিমা এবং নাগাসাকি!

When a man over-reaches himself….

পরদিন সতেরোই জুলাই সকালে মার্কিন যুদ্ধসচিব এসে দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে। বাড়িয়ে দিলেন একটি টেলিগ্রাফ। তাতে লেখা–সন্তান নির্বিঘ্নে জন্মলাভ করেছে।

চার্চিল আনন্দে আত্মহারা। তখনই দেখা করলেন ট্রম্যানের সঙ্গে। পরামর্শ দিলেন–এ কথা স্তালিনকে ঘুণাক্ষরেও জানাবার প্রয়োজন নেই। তুরুপের টেক্কা লুকিয়ে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু দেখতে হবে, রাশিয়া যেন এই শেষ মওকায় জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে বসে। তাহলেই তাকে লুটের ভাগ দিতে হবে। জাপানের সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমানে আনাক্রমণাত্মক চুক্তি বজায় আছে। তাই থাক। স্তালিন যেন অ্যাটম বোমার কথা জানতে না পারে। ট্রম্যানের এটা ঠিক পছন্দ হল না। চার্চিল তাঁর সঙ্গে একমত হলেন না। ঐদিনই পটসড্যামে এসে উপস্থিত হলেন ইউরোপ-খণ্ডে মিলিত মিত্র বাহিনীর সেনাপতি জেনারেল আইসেনহাওয়ার। অ্যাটম-বোমার বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও তিনি জানতেন না। সব কথা শুনে তিনি নাকি বলেছিলেন আশা করি এমন অস্ত্র আমাদের ব্যবহার করতে হবে না।

অথচ ঐদিনই ট্রুম্যান তাঁর দিনপঞ্জিকায় লেখেন—

“I then agreed to the use of the A-bomb if Japan did not yield.’

–অর্থাৎ সেই দিনই ঠিক করলাম জাপান আত্মসমর্পণ না করলে আমি। পরমাণু-বোমা ব্যবহার করব।

অবশেষে স্তালিন এসে পৌঁছালেন পটসড্যাম-এ। শুরু হল ঐতিহাসিক অধিবেশন। তিন রাষ্ট্রের প্রধান, তাঁদের ধুরন্ধর রাজনৈতিক সহকর্মী আর দোভাষীদের দল। যুবরাজ উইলহেমের ঐতিহাসিক প্রাসাদ গমগম করছে। যুদ্ধকালে এটা হাসপাতালরূপে ব্যবহৃত হয়েছিল। যুদ্ধান্তে হাসপাতাল সাফা করে এই সম্মলনের ব্যবস্থা হয়েছে। হাসপাতাল ছিল নাৎসি জার্মানির। জার্মানরা রাজপ্রাসাদের ভিতর একটি ফুলের বাগান বানিয়েছিল। এত বোমা-বর্ষণেও ফুলগাছগুলি নিঃশেষিত হয়নি। হল এই অনুষ্ঠানে। ফুলগুলো তুলে এনে ওরা বিজয়-উৎসবের তোড়া বাঁধল। হল-এর কেন্দ্রস্থলে রাখা ছিল এক হাজার জেরেনিয়াম ফুলের প্রকাণ্ড একটা ‘রেড স্টার’–স্তালিনকে সম্বর্ধনা জানাতে।

এক সপ্তাহে ধরে চলল অধিবেশন। পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হল। ফিলিপাইন, ভারতবর্ষ, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মানির ভবিষ্যৎ লিপিবদ্ধ হল। স্তালিন বললেন, ইতিপূর্বে তিনি বলেছেন–জার্মানির পতনের তিন মাসের মধ্যেই তিনি জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। তিনমাস প্রায় পূর্ণ হয়ে এসেছে। এখন সময় হয়েছে নিকট, অনুমতি পেলেই তিনি জাপানের সঙ্গে বাঁধন ছিঁড়তে প্রস্তুত। চার্চিল ভাব দেখাচ্ছেন, তুমি আর কেন মিছে কষ্ট করবে ভাই? আমরা দুজনেই ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেব।

সম্মেলন শেষ হয়ে এল প্রায়। ট্রুম্যান প্রতিদিনই স্তালিনকে মারাত্মক সংবাদটি জানাবেন মনে করেন, অথচ হয়ে ওঠে না। চার্চিল এর ঘোরতর বিরোধী। হয়তো তাই ইতস্তত করছিলেন।

উনিশে জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সকলকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করলেন। বিরাট আয়োজন। খানা আর পিনার অঢেল ব্যবস্থা। ডিনারের সময় পিয়ানো বাজাল মার্কিন বাহিনীর সার্জেন্ট ইউজিন লিস্ট। ভাল পিয়ানোর হাত ছিল ছোকরার। বাজালো ‘এ মাইনর’, ওপাস 42-এ শর্পা-র একখানা বিখ্যাত ওয়ালটজ। চমৎকার বাজালো। সঙ্গীত শেষ হতেই মহান নেতা স্তালিন প্রস্তাব করলেন, সঙ্গীতজ্ঞের সম্মানে ওঁরা তিন নেতা একটি ‘টোস্ট’ দেবেন। তৎক্ষণাৎ তিন নেতা মদের পাত্র হাতে এগিয়ে এলেন মার্চ করে। সার্জেন্ট লিস্ট-এর নাকের ডগায় এসে পানপাত্র তুলে ধরে তার স্বাস্থ্য পান করলেন। অ্যাডমিরাল লেহি তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন–উৎসব শেষে সার্জেন্ট লিস্ট ওঁকে বলে, স্যার যুদ্ধের সময় অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এমন আতঙ্কগ্রস্ত আমি জীবনে হইনি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি স্তালিন, চার্চিল আর আমাদের প্রেসিডেন্ট মার্চ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।

তার দুদিন পরে একুশে জুলাই ডিনার ‘থ্রো করলেন কমরেড স্তালিন। ট্রুম্যান সাহেবের ওপর টেক্কা ঝাড়লেন তিনি। আগেকার ভোজের থেকে পাঁচ কোর্স বেশি খাবার এল। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে তাঁর নির্দেশে একটি জঙ্গী বিমানে মস্কো থেকে এসে উপস্থিত হল শ্রেষ্ঠ পিয়ানোবাদকের দল। আগের দিন খানাপিনা মিটেছিল রাত একটায়–এবার রাত দেড়টা পর্যন্ত চলল সঙ্গীতের আসর। আধ ঘন্টা বেশি। চার্চিল মশাই নাকি গান ভালবাসেন নানা শেক্সপীয়র পড়ে কোনো অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে এটা আমি অনুমান করছি না। তিনি নিজেই তা লিখেছেন:

I was bored to tears. I don’t like music. I wanted to go home.

চার্চিল-সাহেব নাকি গানের মাঝপথেই উঠে চলে যেতে চেয়েছিলেন। ট্রুম্যান তাকে আটকে রাখেন, বলেন এটা খারাপ দেখাবে।

তার দুদিন পরে চরম প্রতিশোধ নিলেন সিংহশিশু চার্চিল। এবার তিনি হলেন নিমন্ত্রণকর্তা। লন্ডন থেকে এল রয়্যাল এয়ারফোর্সের পিয়ানো-বাদকের দল। অ্যাডমিরাল লেহি লিখেছেন, ‘গান যেমনই হক, চার্চিল সাহেবের কড়া হুকুম ছিল; রাত দুটোর আগে যেন গান-বাজনার আসর না ভাঙা হয়। সিগারেটসেবী ট্রুম্যান-সাহেবের উপর পাইপমুখো স্তালিন মেরেছিলেন টেক্কা। কিন্তু পিঠ তুলতে পারলেন না তিনি–চুরুটমুখো চার্চিল এবার ঝাড়লেন ছোট্ট একখানি দুরি। তুরুপের।

এদিকে ট্রুম্যানের অবস্থা সেই ‘ভবম-হাজামের মত। পেট ফুলছে ক্রমাগত। ফুলবেই। চার্চিলকে বলেছেন, চার্চিল বারণ করেছেন স্তালিনকে জানাতে–কিন্তু সামরিক শক্তি হিসাবে ব্রিটেনের চেয়ে রাশিয়ার স্থান অনেক উঁচুতে। তাই এতবড় খবরটা স্তালিনকে না বলা পর্যন্ত ঘুম হচ্ছিল না ট্রুম্যানের। তাতে চার্চিল চটে যায় তো যাক। কে জানে–এই নিয়ে যদি যুদ্ধোত্তর-দুনিয়ায় স্তালিনের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের সূত্রপাত হয়ে যায়? তখন তো চার্চিল পাঁচিলের ওপর বসে মিটিমিটি হাসবে।–এতবড় দায়িত্ব নিতে সাহস হল না ট্রুম্যানের। স্থির করলেন, খবরটা জানাবেন–তবে কায়দা করে। অর্থাৎ সময়, পরিবেশ আর ভাষার ভেতর থাকবে ওস্তাদি প্যাঁচ।’ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভঙ্গিতে!

পরদিন চব্বিশে জুলাই–অর্থাৎ হিরোশিমায় বোমাবর্ষণের মাত্র তেরোদিন আগে–সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষিত হবার পর সবাই যখন একে একে চলে যাচ্ছেন তখন ট্রুম্যান গুটিগুটি এগিয়ে এলেন স্তালিনের কাছে। যেন মামুলি খোশ-খবর বলছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘ভাল কথা মনে পড়ল… ইয়ে হয়েছে….শুনেছি আমার বিজ্ঞানীরা নাকি একটা মারণাস্ত্র বার করেছেন যার অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ শক্তি।

একনিশ্বাসে কথাটা বলে ট্রুম্যান হাসিহাসি মুখ করলেন। চার্চিল দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই। ঊর্ধ্বমুখে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়ছিলেন নির্বিকারভাবে। যেন খবরটা নেহাৎই মামুলি। স্তালিন বিন্দুমাত্র ঔৎসুক্য দেখালেন না। বললেন তাই নাকি? খুব আনন্দের কথা। ওটা ঐ বাঁটকুল জাপানিদের মাথার ঝাড়ুন তাহলে।

ভাষাটা আমি বানিয়েছি। হয়তো ঠিক এ ভাষায় কথোপকথা হয়নি। এই ঐতিহাসিক আলাপচারিতার কোনো ‘ডাইরেক্ট স্পীচ অফ ন্যারেশান’ অনেক খুঁজেও পাইনি। যা পেয়েছি তা এই:

ট্রুম্যান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন

“On July 24 I casually mentioned to Stalin that we had a new weapon of unusual destructive force. The Russian Premier showed no special interest. All he said was that, he was glad 16 hear it and hoped we make good use of it against the Japanese,”

স্তালিন গাড়িতে উঠে রওনা দেওয়া মাত্র চার্চিল বললেন, মহান নেতা-সাহেব কী বললেন?

–কিছুই তো বললেন না। জানতেও চাইলেন না কী জাতের বিস্ফোরক!

চার্চিল তাঁর স্মৃতিচারণ গ্রন্থে বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন :

“Nothing would have been easier than for him to say : Thank you so much for telling me about your new bomb. I, of course, have no technical knowledge. May I send my experts in these nu clear sciences to see your experts tomorrow morning?”

“স্তালিন সহজেই বলতে পারতেন, ঐ বোমার কথা জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি অবশ্য বিজ্ঞানের ব্যাপার ভাল বুঝি না। কাল বরং আমার পরমাণু-বিশারদ পদার্থ বিজ্ঞানীদের আপনার বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দিই, কী বলেন?”

চার্চিল তিনটি ভুল করেছেন। প্রথমত ট্রুম্যান ‘বোমা’ শব্দটা আদৌ ব্যবহার করেননি, বলেছিলেন ‘মারণাস্ত্র। দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক’ শব্দটাও উচ্চারণ করেননি ট্রুম্যান-ফলে নিউক্লিয়ার পদার্থ বিজ্ঞানীদের’ প্রসঙ্গই ওঠে না। তৃতীয়ত, চার্চিল জানতেন না স্তালিনের এ ঔদাসিন্যের মূল কারণ কী! স্তালিন ন্যাকা সেজেছিলেন মাত্র। তিনি জানতেন সবই, এবং এও জানতেন যে, ঐ পারমাণবিক অস্ত্রের যাবতীয় সংবাদ তার গুপ্তচরবাহিনী সংগ্রহ করে যাচ্ছে। যথাসময়ে তার সবকটি খুঁটিনাটি জানতে পারবেন উনি।

সেয়ান সেয়ানে কোলাকুলির সময় এমনই হয়ে থাকে। কোন্ সেয়ান কোন্ সেয়ানকে লেঙ্গি মারছে কোনো সেয়ানই তা বুঝতে পারে না। সবাই ভাবে আমি বুঝি জিতলাম। লেঙ্গি যে আসলে মারছেন মহানেতা স্তালিন তা ট্রুম্যান টের পেলেন বেশ কিছুদিন পরে-ম্যাকেঞ্জি কিং-এর পত্র পেয়ে।

***

ওইদিনই ট্রুম্যান এবং স্টিমসনের কাছে এসে উপস্থিত হলেন মার্কিন স্থলবাহিনীর প্রধান জেনারেল মার্শাল এবং বিমানবাহিনীর চিফ জেনারেল আর্নল্ড। তারা জানতে চাইলেন–পারমাণবিক বোমা আদৌ ফেলা হবে কি না, হলে কবে হবে এবং কোথায় ফেলা হবে।

প্রথম দুটি প্রশ্নের জবাব পেলেন সহজেই : বোমা ফেলা হবে এবং যতশ্রীঘ্র সম্ভব। তৃতীয় প্রশ্নটির বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা হল। প্রথমে স্থির হয়েছিল এই পাঁচটি শহরের মধ্যে যে কোনো একটিতে ফেলা হবে সেই বিধ্বংসী বোমা-হিরোসিমা, ককুরা, নীগাতা, নাগাসাকি অথবা কিয়াতো। স্টিমসনের অনুরোধে শেষ নামটা বাতিল করা হল। ওখানে নাকি আছে প্রাচীনতম বৌদ্ধমন্দির–বহু শতাব্দীর স্মৃতিবিজড়িত স্বর্ণমন্দির।

একটিমাত্র পারমাণবিক বোমায় কতটা ক্ষতি হতে পারে সেটা নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে অনেক আগে থেকেই নির্দেশ জারি করা হয়েছিল–ঐ পাঁচটি শহরে আদৌ কোনো সাধারণ বোমা বর্ষণ করা হবে না। ঐ পাঁচটি শহরবাসী তাদের দুর্লভ সৌভাগ্যে এতদিন উৎফুল্ল ছিল। তাদের ধারণা–এটা নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। তারা জানত না যে, তারা একদল সাইকোপ্যাথের জিয়ানো কই মাছ।

.

১৩.

ছাব্বিশে জুলাই পটন্ড্যাম থেকে ঘোষিত হল তিন বিশ্ববিজয়ীর শেষ চরমপত্র : অবিলম্বে জাপান যদি আত্মসমর্পণ না করে তবে চরম সর্বনাশ অনিবার্য।

তারপর যা ঘটেছে তা সর্বজনবিদিত ইতিহাস। বাস্তবপক্ষে স্তালিন জার্মানিতে এসে পট্‌ল্ড্যামে মিলিত হবার আগেই জাপান রাশিয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল–সে নাকি আত্মসমর্পণ করতে চায়। রাশিয়া যেন মধ্যস্থতা করে। স্তালিন জাপানকে সে সুযোগ দেননি। সে ইতিহাস আমি বিস্তারিত বলেছি আমার ‘জাপান থেকে ফেরা’ গ্রন্থে। পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মোটকথা জাপানের জবাব কী হবে তা ধরে নিয়েই যাবতীয় ব্যবস্থা ঘড়ির কাঁটা ধরে করা হচ্ছিল। গ্রোভস-এর। ভাষায়, ‘কোটি কোটি ডলার খরচ করে আমরা কী বানালাম তা পাঁচজনকে না দেখালে কৈফিয়ৎ দেব কী?’ অন্যত্র–

‘No need to get so excited! It’s better for a few thousand Japs to perish than a single of our boys.’

: ‘অতটা উত্তেজিত হবার কী আছে? আমাদের একটা ছোকরার প্রাণ রক্ষা করতে কয়েক হাজার জাপানিকে প্রয়োজন হলে প্রাণ দিতে হবে বৈকি।

এসব যুক্তি আপনারা শুনেছেন। খবরের কাগজে পড়েছেন। বোধকরি শোনেননি তার জবাবটা। খ্রিস্টান পাদরি শীল ওর প্রত্যুত্তরে যে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–

 ‘ঠিক ঐ যুক্তিই একদিন দেখিয়েছিলেন হিটলার-হল্যান্ডে বোমাবর্ষণের আগে, অথবা ইহুদি নিধনযজ্ঞকালে!

সে যাই হোক, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে। জাপান জানে না, পৃথিবী জানে না সে কথা। প্রশান্ত মহাসাগরের এক অখ্যাত দ্বীপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র। প্রহর গুনে চলছে। টাইম-বম্ব! কোনো দুর্ঘটনা না হলে সে বোমা ফাটবেই!

দুর্ঘটনা ঘটেছিল। একটা নয়–দু-দুটো। তবু হিরোশিমা মুক্তি পেল না।

প্রথম দুর্ঘটনা–’ইন্ডিয়ানাপোলিস্’ যুদ্ধ জাহাজ জাপানি সাবমেরিনে সলিলসমাধি লাভ করল। ঐ জাহাজেই পাঠানো হয়েছিল পরমাণু বোমাটিকে, আমেরিকার কোনো বন্দর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের নির্দিষ্ট দ্বীপপুঞ্জে। জাহাজের ক্যাপ্টেনও জানতো না, কি মহামূল্য সম্পদ সে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নৌবাহিনীর চিরাচরিত রীতি লঙ্ঘন করে তাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে! ডেক-এর উপর ঐ যে বিচিত্র বস্তুটি রাখা আছে ঐটাকে বাঁচাতে হবে–প্রয়োজনবোধে আকাপ্টেন জাহাজের সমুদয় নাবিকের জীবনের বিনিময়েও। জাহাজ ডুবে গেলেও ওটা সমুদ্রে ভাসবে এমন বন্দোবস্ত করা আছে। ইন্ডিয়ানাপোলিস এই অভিযান থেকে ফিরে আসেনি নিরাপদ বন্দরে–জাপানি সাবমেরিনে সেটা ডুবে যায়–কিন্তু নিরাপদে ওই অজানা বস্তুটি প্রশান্ত মহাসাগরের নির্দিষ্ট বন্দরে নামিয়ে ফিরে আসার পথে।

দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটা রাজনৈতিক। চৌঠা জুলাই গ্রেট ব্রিটেনে গণভোট হয়। পটসড্যামে যখন মহাসম্মেলন চলছে তখন ব্রিটেনে ভোটের গুনতি হচ্ছে। চার্চিল নিশ্চিন্ত ছিলেন সাফল্যের বিষয়ে–এত বড় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বিজয়ী। তবু ফলাফল ঘোষিত হবার পূর্বমুহূর্তে তিনি ফিরে এলেন স্বদেশে। ছাব্বিশে জুলাই মধ্যরাত্রে ঘোষিত হল পল্ড্যামের শেষ হুঙ্কার আর ঐ দিনই শেষ রাত্রে হল নির্বাচনের ফলাফল। চার্চিল হেরে গেছেন! বিকাল চারটার সময় চার্চিল এলেন বাকিংহাম প্যালেসে। পদত্যাগপত্র দাখিল করতে। এতবড় আঘাত আর অপমান তিনি কল্পনাই করেননি। বেরিয়ে যাওয়ার মুখে সাংবাদিকদের শুধু বলেছিলেন–”আমি দুঃখিত, যুদ্ধটা চূড়ান্তভাবে শেষ করার সুযোগ আমাকে দেশবাসী দিল না। তবে জাপানের পতন আসন্ন। আজ্ঞে হ্যাঁ আপনারা যত তাড়াতাড়ি ভাবছেন, তার আগেই। তার ব্যবস্থাও আমি করে এসেছি।

ছয়ই অগাস্ট, রাত্রি দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তিনটি বিমান রওনা হল জাপানের দিকে। একটি বোমারু বিমান-নাম ‘এনোলা গে’। তার গর্ভে একটি মাত্র বোমা। প্রকাণ্ড বোমা, অথচ তার নাম লিটল বয়’!! তার পাইলট কর্নেল টিবেট এবং বোমারু ক্যাপ্টেন পার্সন জানে কী বস্তুটি। আর কেউ তা জানে না। সকাল আটটা পনেরো মিনিটে রেডিওতে নির্দেশ এল-নির্বাচিত তিনটি শহরের সবগুলিতেই যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তবে বোমাবর্ষণ না করেই ফিরে এস।

পরপর তিনটি শহরের নাম মনে আছে পাইলটের: হিরোসিমা, ককুরা আর নীগাতা।

নটা বেজে পনেরো। বিমান তখন 9,632 মিটার উঁচুতে, গতিবেগ ঘন্টায় 525 কিমি। পিছনে পিছনে আসছে দুটি ফাইটার প্লেন।

দূরে দেখা গেল হিরোশিমা। ইতিপূর্বে বোমাবর্ষণ হয়নি সেখানে। শহরবাসী নিশ্চিন্ত।

পার্সন বোতামটা টিপল। বোমাটা বেরিয়ে যেতেই খানিকটা লাফিয়ে উঠল প্লেনটা। পরক্ষণেই প্লেনের মুখটা ঘুরিয়ে দিল টিবেট। ফুলস্পীড! পালাও পালাও।

হঠাৎ আলোয় আলো হয়ে উঠল সমস্ত জগৎ। পরমুহূর্তেই একটা ধাক্কা খেল প্লেনটা। কয়েক সেকেন্ড পরে আবার একটা ধাক্কা। প্রথমটা প্রাথমিক বিস্ফোরণের। বিস্ফোরণ হয়েছে মাটি থেকে দু-হাজার ফুট (600 মিটার) ওপরে। দ্বিতীয়টা সেই বিস্ফোরণের প্রতিঘাত। পৃথিবীর বুকে আঘাত খেয়ে শব্দতরঙ্গের প্রতিধ্বনি। প্লেনটা তখন পনের মাইল (24 কিমি) দূরে।

পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে একটা জনপদ। তার নাম হচ্ছে, হচ্ছে নয়, ছিল–হিরোশিমা!

***

পরদিন সাতই অগাস্ট সকাল নয়টার সময় টোকিও শহরপ্রান্তে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটি মিলিটারি জিপ। একজন মিলিটারি অফিসার এসে কড়া নাড়লেন দরজায়। কিমোবনা-পরা এক বৃদ্ধ বার হয়ে এলেন : কী চাই?

প্রফেসর নিশিনা, এখনই আমার সঙ্গে আসতে হবে। গতকাল থেকে আমরা হিরোশিমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। না টেলিফোনে, না রেডিওতে। এইমাত্র খবর পেলাম সেখানে নাকি একটা-আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা মাত্ৰ-বোমা পড়েছে। তাতে শহরটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আপনি এসে দেখুন।

প্রফেসর য়োমিও নিশিনা হচ্ছেন জাপানের সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। নীলস বোহর-এর সঙ্গে কাজ করতেন। অটো হানের বন্ধু!

মুহূর্তমধ্যে তৈরি হয়ে নিলেন নিশিনা।

জিপে উঠতে যাবেন এক সাংবাদিক দৌড়ে এল। বললে, প্রফেসর, ওরা বলছে এটা পরমাণু বোমা। এইমাত্র মার্কিন ব্রডকাস্ট শুনে এলাম। নির্জলা মিথ্যা প্রচার। কী বলেন?

-আমি তো এখনও কিছুই দেখিনি। যা শুনছি তাতে মনে হয়…মিথ্যা নয়।

 যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন প্রফেসর নিশিনা। তবু মনোবল হারাননি। সমস্ত দিন অম্লত অভুক্ত বৃদ্ধ প্রফেসর ধ্বংসস্তু’ পরিদর্শন করলেন, মাপ-জোখ নিলেন–যেস্থানের ওপর বোমাটা ফেটে পড়েছিল সেখানে মাটি খুঁড়ে রেডিও-অ্যাকটিভিটির পরিমাণ নিরূপণ করলেন নিজের বিপদ তুচ্ছ করে (চার মাস পরে তাঁর দেহে রেডিও-অ্যাকটিভিটির লক্ষণ দেখা যায় এবং দীর্ঘদিন তিনি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন)। দুদিন পরে (9 অগাস্ট) ক্লান্তদেহে ফিরে এলেন যখন টোকিওতে, তখন উনি জানেন… তাপমাত্রা কতটা উঠেছিল, কত উঁচুতে বোমাটা ফেটেছিল, বায়ুর গতি কতটা হয়েছে, কতটা টি.এন.টি. বোমার বিস্ফোরণের সমতুল্য এই দুর্ভাগ্য। পরে হিসাব কষে দেখা গেছে প্রফেসর নিশিনার এই প্রাথমিক হিসাব নিখুঁত হিসাবের 97 শতাংশ নির্ভুল।

টোকিওতে ফিরে এসেও রেহাই নেই। মিলিটারির লোকেরা বাড়ি যেতে দিল না ওঁকে। সোজা নিয়ে গেল সমরদপ্তর।

একজন সামরিক বড়কর্তা বললেন, প্রফেসর। কতদিন লাগবে অমন বোমা তৈরি করতে? মাসছয়েক পর্যন্ত আমরা ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারি।

প্রফেসর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিততে ছয় মাস কেন, ছয় বছর লাগা উচিত। আর আপনারা একটা কথা খেয়াল করছেন না–জাপানে। ইউরেনিয়াম ধাতু আদৌ নেই।

প্রফেসর। এই নতুন বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো পথই কি আপনি দেখাতে পারেন না? ক্লান্ত প্রফেসর বললেন, পারি। জাপান ভূখণ্ডের ওপর কোনো মার্কিন বিমান এসে পৌঁছাবার আগেই তাকে গুলি করে নামাতে হবে। সমুদ্রে।

এতক্ষণে নিশিনা ছুটি পেলেন। প্রায় মাতালের মতো টলতে টলতে ফিরে এলেন সমরদপ্তর থেকে নিজ আবাসে। বাড়িতে ঢুকেই দেখেন সেখানে অপেক্ষা করছেন দুজন সামরিক অফিসার। ওঁকে দেখেই একজন লাফিয়ে ওঠেন: প্রফেসর। এখনি আমার সঙ্গে একবার আসতে হবে। নাগাসাকির সঙ্গে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওরা কোনো সাড়া দিচ্ছে না। না টেলিফোন, না রেডিওতে! কী হতে পারে বলুন তো?

***

পরমাণু-বোমার সাফল্যে ম্যানহাটান-প্রজেক্টে যে অবিমিশ্র আনন্দের হিল্লোল বয়ে গিয়েছিল এমন কথা বলতে পারি না। ৎজিলাৰ্ড বলেছিলেন, ছয়ই অগাস্ট তারিখটা আমার জীবনে একটা কালো দিন। আইনস্টাইন, ফ্রাঙ্ক, রোবিনোভিচ প্রভৃতি মর্মাহত হয়েছিলেন এ সংবাদে। উইনি হিগিবথাম নামে একজন বৈজ্ঞানিক রেডিওতে খবর শুনে মাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যে কাজ এতদিন ধরে করলাম তার জন্য বিন্দুমাত্র গর্ববোধ করছি না। I am afraid that Gandhi is the only real disciple of Christ at present!’

আর একজন বাস্তুচ্যুত জার্মান কবি হেরম্যান হেজভর্ন লিখলেন একটা এপিক কবিতা

The Bomb that Fell on America

তার একস্থানের অনুবাদ :

“বোমাটি পড়ল মার্কিন মুলুকে–মাটিতে নয়, মাথায়।

কই? মানুষগুলো ছাই হয়ে গেল না তো?

যেমন গেছিল হিরোশিমায়?

না! মানুষের দেহ রইল অবিকৃত।

বিকৃত শুধু মন!

গলে পচে খসে পড়ছে মানুষের অন্তঃকরণ!

সর্বজনশ্রদ্ধেয় আর নরাধম এক সারিতে এসে দাঁড়াল।

 হারিয়ে গেল একটা সেতু….অতীতের সঙ্গে বর্তমানের।

 এতদিনের শক্ত পৃথিবীটা প্রকাণ্ড জেলির মত থকথকে।

ক্লেদাক্ত পূতিগন্ধময় কৃমিকুণ্ড একটা।

না! পৃথিবীটা নেই। হারিয়ে গেছে!

 এ আমরা কী করলাম!

হে আমার স্বদেশবাসী। এ তোমরা কী করলে!”

 এজাতীয় চিন্তা করার মানুষ কিন্তু মুষ্টিমেয়। লস অ্যালামসে অধিকাংশই সেদিন আনন্দে আত্মহারা। জ্বলন্ত মশাল হাতে শোভাযাত্রায় পথে নেমেছে সবাই। নাচে গানে হৈ-হল্লায় ফেটে পরছে। সবাই সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

ক্লাউস ফুকস্ বললে, আজ উৎসব হবে। সারারাত সবাই নাচব। ভোজের আয়োজন কর। খানা, পিনা ঔর নাচনা! দাঁড়াও গাড়িটা বার করি। মদের বন্যা বইয়ে দেব।

ফুকস্ বেরিয়ে গেল তার গাড়িটা নিয়ে সান্তা-ফের দিকে। সান্তা-ফে লস অ্যালামস থেকে মাইল চব্বিশ ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই প্রচুর মদ কিনে ফিরে এল আবার। মধ্যরাত পর্যন্ত চলল মদ্যপানের আসর। একমাত্র প্রফেসর ফ্রাঙ্ক সস্ত্রীক উঠে চলে গিয়েছিলেন। এক লক্ষ জাপানির মৃত্যুকে মদ্যপানের মাধ্যমে অভিনন্দিত করতে তিনি গররাজি। ফুকস্ মদ নিয়ে ফিরে আসার পর উঠে গেলেন ৎজিলাৰ্ড আর ফাইনম্যান। তাঁরাও উৎসবে যোগদান করতে অস্বীকার করলেন। ফুকস্ বলে, প্রফেসর ৎজিলাৰ্ড!

ৎজিলাৰ্ড জবাব দিলেন না। নীরবে বেরিয়ে এলেন ব্যাঙ্কোয়েট হল ছেড়ে। উৎসব গৃহের বাইরে এসে দেখেন ফাইনম্যান অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিও এ উৎসবে যোগদান করতে অস্বীকার করেছেন।

ৎজিলাৰ্ড ফাইনম্যানকে বললেন, আশ্চর্য। আমি ভাবতেই পারিনি ফুকস্ লোকটা এমন। লক্ষাধিক জাপানির মৃত্যুতে নোকটা পৈশাচিক উল্লাসে একেবারে নাচছে!

ফাইনম্যান বলেন, কেন প্রফেসর? আমি তো সেদিনই বলেছিলাম–

Fuchs/Looks/An ascetic/Theoretic!

***

পৃথিবীর অপর প্রান্তে ঐ ছয়ই অগস্টের রেডিও নিউজের প্রতিক্রিয়ার কথা বলি এবার :

ইংল্যান্ডে ‘ফার্ম হল’ কারাগারে সন্ধ্যা ছয়টার নিউজ বুলেটিন শুনে লাফিয়ে ওঠে কারারক্ষক মেজর রিটনার। রেডিও নিউজে বলছে, লর্ডস মাঠে অস্ট্রেলিয়া পাঁচ উইকেটে 265 করেছে। তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত সংবাদ। আজ সকালে একটি মার্কিন বি-29 বিমান হিরোশিমায় একটা পারমাণবিক বোমা ফেলেছে। মুহূর্তমধ্যে এক লক্ষ জাপানি হতাহত। বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা নাকি বিশ হাজার টি.এন.টি. বোমার সমতুল। জাপানে হিরোশিমা নামে কোনো শহর আজ আর নেই।

মেজর রিটনার লোভ সামলাতে পারে না। তার বন্দিশালায় তখন আটক আছেন পরাজিত জার্মানির সর্বশ্রেষ্ঠ নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টবৃন্দ। যাঁদের তৈরি অ্যাটম বোমার ভয়েই এতদিন কাটা হয়ে ছিল মিত্রপক্ষ। মেজর রিটনার তৎক্ষণাৎ তলব করে বন্দিদলের বয়োজ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকটিকে।

অনতিবিলম্বে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে এসে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক অটো হান। ইউরেনিয়াম-পরমাণুর হৃদয় যিনি সর্বপ্রথম সজ্ঞানে বিদীর্ণ করেছিলেন, সেই বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক। রিটনার তাঁকে সমাদর করে বসালেন। খবরটা রসিয়ে রসিয়ে শোনালেন তাকে। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বৃদ্ধ অধ্যাপক। চুপ করে বসে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত–যেন মৌনতা অবলম্বন করছেন কোনো শোকের বার্তা শুনে। তারপর মুখ তুলে হঠাৎ বলেন, নিউজ-এ কি বলেছে, এটা পারমাণবিক বিস্ফোরণ?

-ইয়েস প্রফেসর।

বৃদ্ধ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন আবার। তারপর হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে যায়। চমকে উঠে আবার বলেন, এক্সকিউজ মি! কী বললেন তখন? হান্ড্রেড থাউজেন্ড জাপানি মারা গেছে একটি বিস্ফোরণে?

-ইয়েস প্রফেসর। তাই তো বলল রেডিওতে।

হানড্রেড থাউজেন্ড! একলক্ষ!-বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে গেলেন। পারলেন না। টলে পড়লেন সোফায়। মেজর রিটনার ছুটে আসে। ওঁর নাড়ির গতি পরীক্ষা করে তৎক্ষণাৎ কিছুটা ব্রান্ডি খাইয়ে দেয়। বলে, আপনি এখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন বরং…..

“থ্যাঙ্কু মেজর। হ্যাঁ তাই করতে হবে। আমি….ঠিক…মানে দাঁড়াতে পারছি না।

সন্ধ্যা সাতটায় বন্দিদের নৈশ আহার পরিবেশন করা হল। বন্দি-বিজ্ঞানীরা। যে-যার চিহ্নিত চেয়ারে গিয়ে বসলেন। ফন লে, ওয়াইৎসেকার, গেলার্চ, উইটজ, হেইসেনবের্গ প্রভৃতি। দলে ওঁরা দশজন। হঠাৎ সকলের নজর পড়ল টেবিলের মাঝখানের সিটটা খালি। প্রফেসর অটো হান আসেননি। তিনিই বয়োজ্যেষ্ঠ, সর্বজনশ্রদ্ধেয়। মাঝখানের চেয়ারখানা তাঁর।

ডক্টর কার্ল উইটজ বললেন, প্রফেসর হানকে মেজর রিটনার ডেকে পাঠিয়েছিল ঘন্টাখানেক আগে। এখনও ফিরলেন না কেন তিনি? তোমরা অপেক্ষা। কর, আমি ওকে নিয়ে আসি।

মিনিট-দশেক পবে ডক্টর উইটজ-এর কাঁধে ভর দিয়ে বৃদ্ধ অধ্যাপক এলেন।

–কী হয়েছে স্যার? আপনি কি অসুস্থ?

-না না, আমার কিছু হয়নি। একটা খবর আছে। এইমাত্র বি. বি. সি. রেডিও ব্রডকাস্ট করেছে….

খবরটা বিস্ফোরকের মতোই ফাটল-কিন্তু কেউ কোনো শব্দ করল না। পুরো দেড় মিনিট।

স্তব্ধতা ভেঙে প্রফেসর হানই প্রথম কথা বললেন। ইতিমধ্যে তিনি সামলেছেন অনেকটা। হেসে বললেন, হেইসেনবের্গ, মাই বয়। তুমি হেরে গেছ। আমেরিকান বৈজ্ঞানিকদের কাছে। তোমার স্থান এখন দ্বিতীয় সারিতে।

দ্বিতীয় সারি! প্রফেসর হেইসেনবের্গ জীবনে কোনো পরীক্ষায় কখনও দ্বিতীয় হননি। ম্লান হাসলেন তিনি। বললেন, ইয়েস প্রফেসর। সে কথা আর বলতে!

সহ্য হল না ওয়াইৎসেকার-এর। বললেন, না! আমেরিকান-বৈজ্ঞানিকদের কাছে নয়।

-নয়?

-না, প্রফেসর হান। আমরা হেরে গেছি হিটলারের ইহুদি-বিদ্বেষ নীতির কাছে। আমেরিকান কে? আইনস্টাইন, ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্রাঙ্ক, নীলস বোহর? নাকি ৎজিলাৰ্ড, টেলার, ফের্মি, ফুস্, ওয়াইসকফ, কিস্টি, রবিননাভিচ? কে? কে আমেরিকান?

মাথা নেড়ে প্রফেসর হান বলেন, আমি জানি না–এ বোমা কে বানিয়েছে। আমি শুধু জানি, আমার অপরাজিত শিষ্য হেইসেনবের্গ আজ দ্বিতীয় সারিতে।

–আমি স্বীকার করছি, স্যার। মাথাটা নিচু করলেন হেইসেনবের্গ।

 কিন্তু অত সহজে ওয়াইৎসেকার মেনে নিলেন না এ অভিযোগ। দৃঢ়স্বরে বললেন, আমি মানি না একথা। হিটলারের হাতে তুলে দেব না বলেই আমরা ওটা বানাইনি–না হলে ওদের আগে, অনেক-অনেক আগে ওটা তৈরি করতে পারতাম আমরা।

আহারান্তে রাত নয়টায় বিস্তারিত রেডিও বুলেটিন শুনলেন ওঁরা। তারপর একে একে যে যার বিছানায় চলে গেলেন। শুভ রাত্রি’ ঘোষণা করার কথা আজ আর কারও মনেও পড়ল না। হলের মধ্যে আটখানা খাট পাতা আর বয়োজ্যষ্ঠ দুজনের জন্য আছে একটি পৃথক ঘর। ফন লে আর অটো হানের ঘর। সকলেই শুয়ে পড়েছেন, কিন্তু ঘুম আসছে না কারও। হঠাৎ রাত দুটোর সময় প্রফেসর ফন লে এ ঘরে এসে বললেন–তোমরা একবার ও ঘরে চল। প্রফেসর হান যেন কেমন করছেন!

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন হেইসেনবের্গ। কেমন করছেন মানে? কী করছেন?

–আমার আশঙ্কা হচ্ছে, উনি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন।

ওঁরা ধীরপদে একে একে আসেন এ ঘরে। মোমবাতি জ্বলছে বন্দিশালায়। স্তিমিত আলোকে দেখা যায় খাটের ওপর চুপ করে বসে আছেন বৃদ্ধ। চোখে উদ্ভান্ত পাগলের দৃষ্টি। হেইসেনবের্গ সন্তর্পণে এগিয়ে আসেন। হাতটা তুলে নেন তাঁর। সম্বিত ফিরে পান বৃদ্ধ। বিহুলের মতো তাকিয়ে দেখেন পুত্রপ্রতিম শিষ্যের দিকে। হেইসেনবের্গ বললেন, স্থির হোন প্রফেসর! হেরে গেছি তাতে হয়েছেটা। কী? হারতেই কি চাননি এতদিন? আপনি নিজেই তো একদিন বলেছিলেন–হিটলারের হাতে অ্যাটম বোমা তুলে দেওয়ার আগে আত্মহত্যা করব আমি।

বৃদ্ধের ঠোঁট দুটি নড়ে ওঠে। অস্ফুটে বলেন, সেজন্য নয়, ওয়ার্নার, সে জন্য নয়।

–তবে কী জন্য?

–ঐ ম্যাথমেটিক্যাল ফিগারটা। হান্ড্রেড থাউজেন্ড। টেন টু দি পাওয়ার ফাইভ।

-কিন্তু আপনি তার কী করবেন, স্যার? আপনি কেন এতটা ভেঙে পড়ছেন?

দু-হাতে মুখ ঢেকে বৃদ্ধ হাহাকারে ভেঙে পড়েন: আমি..আমিই যে ওদের প্রথম পথ দেখিয়েছিলাম মাই বয়!…আমার হাতটা আজ রক্তে লাল হয়ে গেছে…. দেখছ না! হান্ড্রেড থাউজেন্ড সোস্।

বলিরেখাঙ্কিত হাতটা বাড়িয়ে ধরেন মোমবাতির স্তিমিত আলোয়।

হেইসেনবের্গ ওঁর মাথাটা নিজের বুকের ওপর টেনে নেন। পাকা চুলে ভরা মাথার ওপর হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। যেন বাচ্চা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছেন।

***

6.8.1945। বিজয়ী পৃথিবী আনন্দ-উৎসবে নাচছে। গোটা আমেরিকা আজ আলো-ঝকমল। কম-বেশি সবাই মাতাল। শুধু একটি লোক দৃঢ় পদবিক্ষেপে এগিয়ে আসছিল সান্তা-ফের কাছে, কাস্টিলো ব্রিজ স্টেশনের দক্ষিণতম প্রান্তে। জায়গাটা জনবিরল। লোকটার পরনে গ্রে রঙের স্যুট। মাথার টুপিটা নামানো, মুখে আলো পড়েনি। হাতে কিছু নেই। ঠোঁটে ঝুলছে সিগারেট। স্টেশনের শেষ প্রান্তে এখানটা আলো-আঁধারি। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। দেশলাইয়ের শেষ কাঠিটা জ্বেলে নিবে যাওয়া সিগারেটটা ধরালো। সেই আলোয় মুখের একটা আভাস দেখা গেল।

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে এল আর একজন। বললে, পূর্বদিকে যাবার ট্রেন কখন পাওয়া যাবে বলতে পারেন?

লোকটা আগন্তুককে আপাদমস্তক দেখে নিল একবার। হা পোশাকের বর্ণনা নিখুঁত। যেমনটি হবার কথা। নীল স্যুট, সাদা-কালো ডোরাকাটা টাই, মাথায় বাউলার হ্যাট। তবু সন্দেহ ঘোচে না লোকটার। বলে, জানি না। কোথা থেকে আসছেন আপনি?

অতি নিম্নস্বরে লোকটা বলল; I come from Julius!

এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল। শেকহ্যান্ড করল আগন্তুকের সঙ্গে। বললে, আমার নাম ডেক্সটার। আপনার?

–চার্লস রেমন্ড। হাউ ডু য়ু ডু?

ডেক্সটার বললে, কোথাও গিয়ে কিছু খেলে হত।

–আসুন। স্টেশনের কাছেই আমার জানা একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে।

 দুজনে এগিয়ে গেল জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। আর কোনো কথা হল না পথে। প্ল্যাটফর্ম টিকিট ছিল দুজনেরই। দাখিল করে বেরিয়ে এল রাস্তায়। অনতিদূরের এক পানাগারে ঢুকল দুজন। দূরের একটা আলো-আঁধারি কোণে গিয়ে বসল। তখনও দুজন নির্বাক। এতক্ষণে নজর হল ডেক্সটারের, চালর্স-এর হাতে রয়েছে। একটা অ্যাটাচি-কেস। কিন্তু ওর তো খালি হাতে আসার কথা।

ওয়েটার এসে দাঁড়ায়। দু-পেগ কনিয়াকের অর্ডার নিয়ে চলে গেল। ডেক্সটার সন্তর্পণে তার পকেট থেকে বার করে আনল একটা কাগজের টুকরো। নিঃশব্দে রাখল সেটা টেবিলের ওপর। কোনো একটা রেস্তোরাঁ-রসিদের একটা ছেঁড়া টুকরো। চালর্স নজর করলে দেখতে পেত রসিদটা ‘গোল্ডেন ড্রাগন’ পাব-এর মদের বিল। সানফ্রান্সিস্কোর একটি পানাগারের। তারিখটা চার মাস আগেকার। সে কিন্তু নজরই করল না এসব। সন্তর্পণে তার বাঁ-পকেট থেকে বার করল অনুরূপ একখণ্ড ছেঁড়া কাগজ। ডেক্সটার দুটো টুকরো পাশাপাশি জোড়া দিচ্ছিল যখন, তখন চার্লস নজর রাখছিল চারদিকে। না, কেউ লক্ষ্য করছে না ওদের। দুটি ছেঁড়া কাগজ খাঁজে খাঁজে মিলে গেল। কুচিকুচি করে কাগজটা ডেক্সটার ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে।

ওয়েটার এসে দাঁড়াল। নামিয়ে রাখল দুটি পানপাত্র। হলুদ রংএর পানীয়। পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করল ওরা নীরবে।

এরপর ডেক্সটার তার পকেট থেকে বার করল একটা পলমল সিগারেটের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করল না কিন্তু। গোটা প্যাকেটটাই চার্লস-এর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, গট ম্যাচেস্?

-ইয়াহ!

 চার্লস গ্রহণ করল সিগারেটের গোটা প্যাকেটটা। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ঢুকিয়ে দিল পকেটে। পরমুহূর্তেই হাতটা বার করে আনল। তাতে পলমলের প্যাকেটটা তো আছেই, আছে একটা লাইটারও। দুজনে দুটো সিগারেট বার করে ধরালো। ডেক্সটার এবার সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে নিজের পকেটে রাখল। যার সিগারেট তার পকেটেই ফিরে গেল।

ইতিমধ্যে ঠিক ওদের পাশের টেবিলে এসে বসেছে একটি ছেলে আর মেয়ে। তাদের চোখের সামনেই ঘটল ব্যাপারটা। মেয়েটা কেমন যেন ওদের দিকে তাকাচ্ছে বারে বারে। চার্লস অস্বস্তি বোধ করছে। ইঙ্গিত করল সে বন্ধুকে। দুজনে উঠে পড়ল। অতি দ্রুতচ্ছন্দে গ্লাস দুটো শেষ করে।

ওয়েটার এসে দাঁড়াল। দাম মিটিয়ে দিল চার্লস।

ম্লান হাসল ডেক্সটার। কী আশ্চর্য! চার্লস লোকটাকে টিপস্ দিল বিলের মাত্র শতকরা দশের হিসাবে। কী কৃপণ লোকটা! ভাবছিল ডেক্সটার। আর কেউ না জানলেও ওরা দুজন এবং রেমন্ডের ডান-পকেটের ইনসাইড লাইনিংটা তো জানে, সিগারেট প্যাকেটের বদল হয়ে গেছে। লোকটার পকেটে এখন যে প্যাকেটটা আছে তার দাম মিলিয়ান নয়– বিলিয়ন ডলারের হিসাবে।

কিন্তু উপায় ছিল না চার্লস-এর। সে কত টিপস্ দেবে তারও নির্দেশ সে পেয়েছিল। টিপসের অঙ্কটা যেন এতবেশি না হয় যাতে ওয়েটারটা কৃতজ্ঞ হয়ে দ্বিতীয়বার ওর মুখের দিকে তাকায়। আবার এত কমও যেন না হয়, যাতে অন্য কারণে সে চোখ তুলে তাকায়।

পথে নেমে এসে ডেক্সটার বলল, গুড নাইট!

–জাস্ট এ মিনিট। তোমার অ্যাটাচি-কেসটা ফেলে যাচ্ছ।

 হাত বাড়িয়ে অ্যাটাচি-কেসটা চার্লস দিতে চায় ডেক্সটারকে। ভ্রূদুটি কুঞ্চিত হয়ে ওঠে ডেক্সটারের। বলে, কী আছে ওতে?

চারদিকে চোখ বুলিয়ে একবার দেখল চার্লস। রাস্তার এদিকটা এখন জনশূন্য। নিম্নকণ্ঠে বললে, ওজনটা তুমিই দেখ। অল ইন টোয়েন্টি অ্যান্ড ফিফটি ডলার বিলস্।

অর্থাৎ বিশ এবং পঞ্চাশ ডলারের খুচরো নোট। যা অপরাধ-বিজ্ঞানের ভাষায় ‘নম্বরী নোট’ নয়। যা সহজে খরচ করা যাবে। ডেক্সটার একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। সুটকেসের ওজনটা বাদ দিয়ে “নেট ওজনে’ ডলারের অঙ্কটা টেন-টু-দ্য-পাওয়ার কততে দাঁড়াবে আন্দাজ করতে তার কোনো স্লাইড-রুলের প্রয়োজন হল না। বললে, এ শর্ত ছিল না তো

–জুলিয়াস বিনা পারিশ্রমিকে কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করায় না।

হঠাৎ ধক করে জ্বলে উঠল ডেক্সটারের চোখ দুটো। বললে, দেন গিভ মি ব্যাক মাই সিগারেট-প্যাকেট!

আঁতকে ওঠে রেমন্ড: কী ব্যাপার?

-জুলিয়াসকে বোলো-ডেক্সটার অর্থের লোভে একাজ করছে না।

–ঠিক হ্যায়।

 কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই চার্লস অ্যাটাচিটা হাতে হাঁটতে শুরু করে। একটা ট্যাক্সি আসছিল এদিকে। সেটাকে দাঁড় করায়। পালাতে পারলে সে বাঁচে।

ডেক্সটার অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে থাকে ফুটপাথ ধরে।

সেই রাত্রে লস অ্যালামসে ফিরে ডেক্সটার শোওয়ার আগে দিনপঞ্জিকায় লিখেছিল:

Others talk, hope, wait and are repeatedly disappointed, be cause they don’t understand the true nature of political power. Well, I’m going to act. I’ve acted. May be I have prevented another World War.

: ওরা বাকবিস্তার করে, আশা করে, অপেক্ষা করে আর বারে বারে বোকা হয়, কারণ ওরা জানে না রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃত স্বরূপ। আমি ও ফাঁদে পা দেব না। যা করবার নিজেই করব। করেছি। হয়তো আজ আমিই পথ রুদ্ধ করে দিয়ে। গেলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

তারপর বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল।

তবু শেষ হল না দিনটা। মিনিটদশেক বিছানায় পরে থেকে আবার উঠল। আলোটা জ্বালল। দিনপঞ্জিকার পাতাখানা পড়ল আবার। হাসল। ছিঁড়ে নিল পাতাটা। তারপর দেশলাই জ্বেলে লেখাটা পুড়িয়ে ছাই করে দিল।

পাঠকের হয়তো স্মরণ আছে-আমি অনেক আগেই বলেছি–এ বিশ্বাসঘাতকতার মূল্যায়ন করতে বসে একটা সমীকরণ কষে দুটি ফল পেয়েছি। একটা বিলিয়ন ডলারের অঙ্ক এবং দ্বিতীয়টা শূন্য।

আশা করি হিসাবের কড়ি বাঘে খায়নি।

 x(x –10^9) = 0

ইকোয়েশানের দুটি ‘রূপ’ই নির্ভুল। এ বিশ্বাসঘাতকতার মূল্যমান বিলিয়ান ডলারেও প্রকাশ করা যায়; আবার বলা যায়, সেটা স্রেফ শূন্য! কিউ. ই. ডি.।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *