চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ৮

সুরেশ্বর বললে, সে এক করুণ ইতিহাস—তারই সঙ্গে খানিকটা সামাজিক রুচিতে কুৎসিতও বটে। একালে যদিবা এ সত্যকে সহ্য করা যায়, সেকালে কোনমতেই তা সহ্য করা যেতো না। এর মধ্যে মানুষের মনের চিরন্তন কামনার যে লজ্জাহীন, ভয়হীন, সঙ্কোচহীন প্রকাশ, তার তুলনা রাবণের চিতার সঙ্গে। সে নাকি কোনকালে নেভে না, চিরকাল জ্বলছে—চিরকাল জ্বলবে।

ওই মেয়েটির মাতৃত্বের আকাঙক্ষা। তার সঙ্গে ওই হতভাগ্যের বিচিত্র হতাশা —তার রক্ত-জল-করে-অর্জন-করা সম্পদ-সম্পত্তি সে কাকে দিয়ে যাবে। কে তার উপাধি বহন করবে। সেকালে তার সঙ্গে আরও কামনা ছিল—কে তাকে জলপিণ্ড দেবে!

এরপর যে ব্যাপার ঘটল, তা যেমন শ্রুতিকটু, সমাজবিরুদ্ধ, তেমনি এই মায়া-মমতার সংসারে সম্পদ-সম্পত্তির দুনিয়ায় চিরন্তন। মহাভারতের কাল থেকে ঘটে আসছে। ব্যাসদেব যে সাহসের সঙ্গে সেই সত্তাকে প্রকাশ করেছেন, তারই নজির তুলে দেবেশ্বর রায় তাঁর রাঙাপিসীকে অনায়াসে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। লিখেছিলেন—

“রাঙাপিসী, বিষয়ের সংসারে মমতার পৃথিবীতে এ বোধ হয় চিরকাল ঘটিতেছে। ব্যাসদেবের মহাভারতে আছে পঞ্চপাণ্ডবের জন্মকাহিনী। এই হতভাগ্য দম্পতির সেই মতি হইল। এই যুবতীটি স্বামীকে সত্যই ভালবাসিত। স্বামীর সঙ্গে নাকি রাত্রে বসিয়া ক্রন্দন করিত—এসব তাহাদের কে খাইবে? অবশেষে উভয়ে পরামর্শ করিয়া ওই পথই ধরিল। পুরুষটির এক নীচজাতীয়া পালিকা মা ছিল, তাহার মায়ের মৃত্যুর পর সে-ই তাহাকে মানুষ করিয়াছিল; সেই মায়ের গর্ভের এক ছোট ভাই, সে ছিল তাহাদের বাড়ীর কেনা গোলামের মত। ছেলেবেলায় ছিল রাখাল, তাহার পর হইয়াছিল মাহিন্দার, তাহার পর সে তাহাদের জমি চাষ করিত এবং চাকর বলিতে চাকর, ভারবহনকারী পশু বলিতে তাহাই, আবার বন্ধু বলিতে একান্ত আপন বন্ধু ভাই, তা-ও ছিল সে। সব কথাই তাহার সহিত হইত। স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করিয়া একদা তাহাকেই সমস্ত দুঃখ ব্যক্ত করিল। এই অস্পৃশ্য নীচজাতীয় পুরুষটি বয়সে এই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা প্রায় দশ বৎসরের কনিষ্ঠ ছিল এবং আকারে অবয়বে কালো কষ্টিপাথরে গড়া ভীমাকৃতির তুল্য সুন্দর ছিল। এই মেয়েটির ও তাহার স্বামীর বংশরক্ষা করিবার নিমিত্ত এমনি কৃষ্ণবর্ণ এক পুত্র যথাসময়ে তাহারা পাইয়াছিল। তাহারই বিচার হইয়াছিল। নালিশ আনিয়াছিল—মেয়েটির ভাইয়েরা, পুরুষটির জ্ঞাতিরা। কারণ তাহারা দুইপক্ষই প্রত্যাশা করিয়াছিল—ওই নিঃসন্তান দম্পতির সম্পত্তি তাহারাই পাইবে। জ্ঞাতিদের প্রাপ্য আইনানুসারে। শ্যালকেরা আশা করিয়াছিল, দানপত্র লিখাইয়া লইবে বা তাহাদের সন্তান পোষ্যপুত্র লওয়াইবে।

প্রমাণ ছিল অকাট্য। ওই শিশুটির কৃষ্ণবর্ণ। তাহার উপর ওই কৃষ্ণবর্ণ পুরুষটির স্বীকারোক্তি। কাছারীতে তাহাকে থামে বাঁধিয়া তাহার পিঠ বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিয়া স্বীকার করানো হইয়াছিল। এবং বিচারে হুকুম হইয়াছিল—এই দম্পতিকে ওই সন্তান লইয়া সামান্য অস্থাবর লইয়া গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইবে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হইবে, ওই সম্পত্তি ওই গ্রামের গ্রাম্য দেবতাদের দেবোত্তররূপে গণ্য হইবে।

রাঙাপিসী, সেদিন বাল্যকালে বাবামহাশয়কে যেমন বিচারক বিধাতার অবতার মনে হইয়াছিল, এই রায়কেও ঠিক তদ্রূপ বিধাতার রায় বলিয়া মনে হইয়াছিল।

ইহার পর নয় বৎসর বয়সে আমার উপনয়ন হইল। আমার মুখ দেখিলেন হুগলী জেলার কায়স্থ জমিদার মিত্র-গোবিন্দপুরের জমিদার শিবদাস মিত্রের তৃতীয় পক্ষের বন্ধ্যা স্ত্রী। কৃষ্ণভামিনী দাসী। এখানেও একটা সমস্যা ছিল। সমস্যা—কৃষ্ণভামিনী দাসীকে অপবাদ দিয়া সম্পত্তি হইতে বিতাড়িত করিতে চেষ্টা করিতেছিল শিবদাস মিত্রের ভাগিনেয়। কারণ ভাবী উত্তরাধিকারী সে-ই। অথচ শিবদাস মিত্র তাঁহার স্বোপার্জিত সম্পত্তি তাহার তৃতীয় পক্ষের যুবতী নিঃসন্তান স্ত্রীকে নির্বঢ়স্বত্বে উইল করিয়া দিয়াছেন। বারো মাসে বারো হাজার টাকা আয়ের জমিদারী। এবং নগদ অর্থ। কৃষ্ণভামিনী দাসী বাছিয়া বাছিয়া শরণ লইলেন ধার্মিক সাধুপ্রকৃতির খ্যাতিমান ও প্রতাপবান জমিদার রত্নেশ্বর রায়ের। রাঙাপিসী, তোমার জমিদারী শ্যামনগরের পত্তনীদার কীর্তিহাটের রায়বংশ। শ্যামনগর-রাধানগর লইয়া যে বিরাট পর্ব তাহা তোমার অগোচর নয়। শ্যামনগর হুগলী জেলার অন্তর্গত। চুঁচুড়ায় রায়েদের বাড়ী ছিল একখানা, সেখানে সেরেস্তা ছিল এবং সেখানে রত্নেশ্বর রায় মধ্যে মধ্যে যাইয়া বিশ্রাম করিতেন। গঙ্গার ধারে বাড়ী, তাঁহার প্রিয়স্থান ছিল। এখানেই একদা এই কৃষ্ণভামিনী দাসীর সঙ্গে আমার মাতাঠাকুরাণীর পরিচয় হয়; কৃষ্ণভামিনী দাসী একদিন পাল্কী করিয়া আসিয়া আমার মাতাঠাকুরাণীর সঙ্গে আলাপ করিয়া গেলেন, আট বছরের আমাকে সমাদর করিয়া কোলে লইয়া একটি মোহর দিয়া গেলেন। বলিয়া গেলেন, আমার কিশোর গোপাল। এবং নিজ বাটীতে রাধাসুন্দরজীউ ঠাকুরের আরতি দেখিতে নিমন্ত্রণ করিলেন। তাহার পর ক্রমে সে আলাপ গাঢ় হইল। এবং সুদীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানিয়া মাতাঠাকুরাণীর সঙ্গে আমার পিতার কাছে আসিয়া প্রণতা হইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন—আমাকে রক্ষা করিতে হইবে। আমি অনাথা। আপনার নাম-খ্যাতি এ-অঞ্চলে কে না জানে! এ অবলা-অনাথাকে আপনি রক্ষা করুন।

রাঙাপিসী, কথাগুলি আমার কানে এখনও যেন বাজিতেছে। মাতাঠাকুরাণী তাঁহার পাশে, আমি ভিক্ষা-মায়ের কোলের কাছে, তিনি আমাকে কোলের কাছে লইয়াই দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছিলেন।

বাবামহাশয় সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন—আমি সমস্তই অবগত আছি। দেবেশ্বরের গর্ভধারিণীর নিকটও আপনার কথা শুনিয়াছি। অসহায়কে রক্ষা করা শ্রেষ্ঠ মনুষ্যধর্ম। ইহা যে না করে সে ধর্মে পতিত হয়। আমা হইতে যতদূর হইবে অবশ্যই তাহা করিব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন।

কৃষ্ণভামিনী দাসী আবার তাঁহাকে প্রণাম করিয়াছিলেন। তাহার পর এক বৎসরের মধ্যে অনেক অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পাইল। তিনি আমাকে বড় ভালবাসিলেন। এবং আমাকে সন্তানরূপে পাইবার বাসনায় আমার উপনয়নের সময় মুখ দেখিলেন। মুখ দেখিবার কালে তিনি আমাকে মূল্যবান হীরার আংটি এবং হীরা-বসানো বোতাম, রূপার বাসন এবং একশত একটি মোহর দিয়াছিলেন।

ভিক্ষা-মা এখানেই ক্ষান্ত হইলেন না, রাধাসুন্দর ঠাকুরের সম্পত্তি দেবোত্তর ছিল, তাহার সেবায়েৎ-স্বত্ব বলিলেন আমাকে দিবেন। তখন রত্নেশ্বর রায়ের প্রতাপে বাঘে-বলদে একঘাটে জল খায়—তাঁহার নাগপাশের মত কৌশল-জালে এবং অর্ধচন্দ্রবাণের মত ক্ষুরধার বুদ্ধিতে অঘটন ঘটে। সুতরাং কৃষ্ণভামিনী দাসীর স্বামীর জ্ঞাতিবর্গ পিছু হটিল। রত্নেশ্বর রায়ের প্রভাবে এবং কৌশলে সামান্য কিছু সম্পত্তি লইয়া তাহারা সম্পত্তির উপর কৃষ্ণভামিনী দাসীর নির্বঢ় স্বত্ব স্বীকার করিয়া দলিল করিয়া দিল। এদিকে আমার ভিক্ষা-মা বাবামহাশয়ের সম্পর্কে বেয়ান হইলেন। তাঁহার সামনে ঘোমটা কমাইয়া কপালে চুলের রেখার প্রান্ত পর্যন্ত তুলিলেন। হাস্য-পরিহাস হইতে লাগিল।

বৎসর-তিনেক পর, তখন আমার বয়স বারো বৎসর, সবে জানবাজারের বাড়ীতে থাকিয়া হিন্দু স্কুলে পড়াশুনা করিতেছি। দেশে তখন বর্ধমান ফিবারের প্রকোপ হইয়াছে। কয়েকটা অজন্মায় দুর্ভিক্ষ গিয়াছে, লোক মরিয়াছে। বর্ধমান ফিবার দেশময় ছড়াইয়াছে। রত্নেশ্বর রায় কীর্তিহাটে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। পুরাতন যেটা ছিল, সেটা একটা সামান্য ব্যাপার। এ চিকিৎসালয় সত্যই বড় চিকিৎসালয়। তাঁহার নাম তখন দেশে কীর্তিমান লোকেদের প্রথম সারিতে স্থান পাইয়াছে, হঠাৎ কলিকাতায় বসিয়া শুনিলাম আমার ভিক্ষামাতা কৃষ্ণভামিনী দাসী বৃন্দাবনবাসিনী হইয়াছেন। দেশে আর ফিরিবেন না। এবং তিনি তাঁহার স্বামীর উইলসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি রাধাসুন্দরের নামে দেবোত্তর করিয়া, গুজব শুনিলাম, ভিক্ষাপুত্র আমাকেই তাঁহার সেবায়েত করিয়া গিয়াছেন।

কৃষ্ণভামিনী-মা আমাকে বড় ভালবাসিতেন। তাঁহার কথা তুমি জান, তুমি তাঁহাকে দেখিয়াছ, তোমাকেও তিনি তোমার বিবাহের সময় মূল্যবান অলঙ্কার দিয়াছিলেন। কিন্তু বৎসরখানেকের মধ্যে আমি যাহা শুনিলাম, তাহাতে আমার এতদিনের পৃথিবী সব যেন পাল্টাইয়া গেল। আমি যাঁহাকে এতদিন দেবতা ভাবিয়াছিলাম, তাঁহার ছদ্মবেশটা খসিয়া গেল। আমি দেখিলাম, তিনি যাহাই হউন, দেবতা বা দানব, মানব বা অসুর—তিনি হউন পবিত্র চরিত্রবান, তিনি ত্রিসন্ধ্যা করুন, তিনি জপ করুন, তিনি প্রকাশ্যে দান করুন, তিনি হউন কীর্তিমান, তিনি দয়াহীন, মায়াহীন, ক্ষমাহীন, তিনি দেবস্থলের খঙ্গের মত পবিত্র, কিন্তু তাঁহার কর্ম-দেবতার হাড়িকাষ্ঠে আবদ্ধ হতভাগ্য মেষ-মহিষ এবং ছাগগুলিকে ছেদন করা। হয়তো এককালে খঙ্গ লইয়া শত্রুর সঙ্গে, বিধর্মী বা অধর্মাচারীর সঙ্গে যুদ্ধ করা হইত, কিন্তু এখন তাহা কেহ করে না; সে তাহার রক্তপিপাসার নিবৃত্তি করে, অসহায় পশুগুলিকে ছেদন করিয়া। রাঙাপিসী, আমার ভিক্ষা-মা কৃষ্ণভামিনী স্বেচ্ছায় বৃন্দাবন বাস করেন নাই। রত্নেশ্বর রায় তাঁহাকে সম্পত্তি দেবোত্তর করাইয়া, সে দেবোত্তরের ট্রাস্টি নিজে হইয়া তাঁহাকে বৃন্দাবনে নির্বাসিত করিয়াছিলেন। কেন জান? কৃষ্ণভামিনী দাসী ছিলেন বন্ধ্যা এবং বয়সে পঁচিশ-ত্রিশ, তিনি বেয়াই সম্পর্ক ধরিয়া রত্নেশ্বর রায়ের সঙ্গে হাস্য-পরিহাস করিতে গিয়া তাঁহার প্রেমে পড়িয়াছিলেন। সে-প্রেম এমনি গাঢ় এবং তাহার ফলে তাঁহার পক্ষে দেহ-কামনা এমনই অসম্বরণীয় হইয়াছিল যে, একদিন সমস্তই সকাতরে নিবেদন করিয়া রত্নেশ্বর রায়ের নিকট পত্র লিখিয়াছিলেন। সেই পত্রখানিকেই তিনি কৃষ্ণভামিনী দাসীর মৃত্যুবাণ হিসাবে ব্যবহার করিয়া তাঁহাকে এইভাবে সর্বস্ব দেবোত্তর করাইয়া নিজে সেবায়েত ট্রাস্টি হইয়া তাঁহাকে বধ করিলেন।

রাঙাপিসী, কৃষ্ণভামিনী দাসী কিন্তু নির্বাসিতা হইয়াও নির্বাসিতা হয়েন নাই। তিনি বৃন্দাবন হইতে চলিয়া আসিয়া কলিকাতাতেই কৃষ্ণাবাঈ নামে বাইজীর পেশা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত আমার দেখা হইয়াছে। আমি তাঁহাকে ঘৃণা করি নাই, মা বলিয়াই সম্বোধন করিয়াছিলাম। তিনি কাঁদিয়াছিলেন। সমস্ত শুনিয়া আমার সেদিন প্রথম আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা হইয়াছিল।

আর একজন এসব কথা আমাকে বলিয়াছিল। সে ব্যক্তি শ্যামনগরের ঠাকুরদাস জ্যাঠামশাই।”

***

সুরেশ্বর থামলে। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে টান দিয়ে পত্রখানা পত্রের বান্ডিলে রেখে দিয়ে বললে-থাক, পত্র থাক। কি হবে তোমার কাছে এত প্রমাণপ্ৰয়োগ দিয়ে?—প্রয়োজন নেই। মুখেই বলি। রায়বংশের প্রাচীনকালের কথার আর অল্পই বাকী। সামান্য।

তবে একটা কথা বলব। রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে এর একটি ঘটনাও গোপন করা নেই। এবং আশ্চর্যের কথা সুলতা, তিনি এইসব ঘটনা লিখতে গিয়ে অসত্য, অসততা এবং মিথ্যা ও পাপকে, আগুনের অন্ধকারকে দহন করার মত দহন করেছেন। দৃঢ়বিশ্বাস এবং সূক্ষ্মতম বিচারবোধের পরিচয় সেখানে ছত্রে ছত্রে। এবং নিজের উপরেও শাস্তিবিধান করেছেন।

কৃষ্ণভামিনীর পত্র পেয়ে তিনি তিন দিন উপবাস করেছিলেন। এবং নিজের রূপ ও কান্তির জন্য বার বার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, “হাঁ, আমার এই কান্তি ও রূপও ইহার জন্য দায়ী। কি করিয়া অস্বীকার করিব? কিন্তু এই বাক্য শ্রবণে পাপ, চিন্তনে পাপ! পত্রযোগে সেই পাপ আমাকে অর্শিল। সুতরাং প্রায়শ্চিত্ত উপবাসাদি করাই স্থির করিলাম।” তাছাড়া এই রাধাসুন্দরকে কীর্তিহাটে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করে, তার বাৎসরিক এক হাজার টাকা আয় এমন পাকা করে কীর্তি ও কর্ম দিয়ে গিয়েছিলেন যে, তা থেকে বছরে দশ টাকাও রায়বংশের কোন স্বার্থে লাগেনি। না সুলতা, লাগে, কিছু লাগে : লাগে রাধাসুন্দরের অন্নপ্রসাদ। সে-প্রসাদ আগে রায়বংশে গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। আজ আর সে-নিষেধ কেউ মানে না। আর ওই পঙ্গু ব্রাহ্মণটি এবং এই ব্রাত্য ঔরসজাত সন্তানটিকে বুকে করে বৈশাখের রৌদ্রে যেদিন ওই যুবতীটি আগুনের মতো তেতে-ওঠা মেদিনীপুরের লালমাটির পথের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল, সেদিন ডায়রীতে লিখেছেন—“আজ পঙ্ক এবং চন্দন, এই দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, ইহা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু তাহা পারিতেছি না। নাসারন্ধ্র বলিতেছে পঙ্ক-গন্ধ সহ্য করিতে পারি না, পারি না, পারি না। শ্বাসরোধ করিতেছে। অন্তর বলিতেছে—শ্বাসরোধে মৃত্যু অনিবার্য বিধান যাহা বিধান, তাহাই বিধাতার নির্দেশ। অঙ্গে পঙ্ক মাখিলে চর্মরোগ হইবে। চর্মরোগও ব্যাধি। কি করিব, কুষ্ঠরোগীকে মমতা করিয়া কোন্ বিধানে আশ্রয় দিব? বুঝিতেছি এই মমতাগুলি মোহ, এই দুঃখগুলি অলীক, মিথ্যা। কি করিব? তাহাকে নির্বাসন দিতে আমি বাধ্য।

তবে এই বারো হাজার টাকা আয় সেকালে তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন দেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আর চিকিৎসার জন্য। সে-দান কলকাতার মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজও তা বজায় আছে। আজও তা থেকে কিছু উপকার হয়।

তবে একথাও ঠিক নয় যে, এ থেকে নিজের বংশের জন্য তিনি কিছু করেন নি। ধর্ম এবং আইন বিচারমত পাপ বাঁচিয়ে এ সম্পত্তি নিজের নামে পত্তনী এবং দরপত্তনী নিয়ে দশ হাজার টাকার জমিদারীকে বাইশ হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। পথ সেই চিরাচরিত পথ।

খাজনা বৃদ্ধি আর পতিত আবাদ।

শেষ বৃদ্ধি হয়েছে রত্নেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর—শিবেশ্বর রায়ের হাতে তখন জমিদারী গেছে। দেবেশ্বর রায়ও সদ্য মারা গেছেন তখন। তারপর পতিত আবাদ থেকে বৃদ্ধির দিকটা অব্যাহত থাকলেও ফসলের মূল্যবৃদ্ধিহেতু বৃদ্ধি—যা ইংরেজের আইন অনুসারে পনের বছর পর জমিদারেরা পেতে পারে, তা আর পায় নি রায়েরা।

* * *

সুরেশ্বর পোড়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে টিপে নিভিয়ে দিয়ে বললে, সেসব তথ্য ফ্যাক্টস ফিগারস তুমি ভাল করেই জান আমার চেয়ে। স্বীকার করবে নিশ্চয়। গোটা বাংলাদেশ জুড়েই ওখানে এক হাল। ওকথা থাক, এখন রায়বাড়ীর কথা বলি। পৃথিবীর মানুষের কাছে তোমার মারফৎ আমার জবানবন্দী শেষ করি।

বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ দেবেশ্বরের যেদিন ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছিল, সেদিন চিঠি লিখতে বসেছিলেন বাপকে। তখন দেবেশ্বর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছেন, ষোল বছর বয়স পার হয়েছেন, তখন তাঁর মন একটা চেহারা নিয়েছে—যে চেহারাটা বলতে গেলে রত্নেশ্বর রায় তাঁর অজ্ঞাতসারে নিজেই গড়ে দিয়েছেন। তবে তাকে শেষ গড়ন দিয়ে গেছে কৃষ্ণাবাঈ—অর্থাৎ বৃন্দাবন থেকে নিরুদ্দিষ্টা কৃষ্ণভামিনী দাসী আর শ্যামনগরের ঠাকুরদাস পাল, দেবেশ্বরের গোপাল দাদার বাবা, রত্নেশ্বরের বাল্যকালের দোসর, পার্শ্বচর, শ্রেষ্ঠ হিতাকাঙক্ষী, যা তোমার পছন্দ সুলতা সেই বিশেষণই তুমি গ্রহণ কর। তখন তিনি রত্নেশ্বরকে বলেন- “নিম নিম। ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত–নিম না ছাড়ে আপন জাত।” জ্যেঠামণি, হয়তো তুমিও তোমার বাবার মতো হবে। কিন্তু শোন শোন—এই সদগোপ জ্যেঠা তোমার-তোমাদের জন্যে প্রাণ দিতে পারে গো! তা পারে। কিন্তু দুঃখু কি জান, তোমরা বড় হলেই ফণা তুলে ফোঁস ক’রে ওঠো, উঠে বল—তোরা ঢোঁড়া—তোরা দাঁড়াশ—তোরা সরে যা। তখন সে ফোঁসানি সামলায় কে?

কৃষ্ণাবাঈয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল দেবেশ্বরের কলকাতার এক বিখ্যাত জমিদার বাড়ীর বিয়ের আসরে। রত্নেশ্বরের চিঠির নির্দেশমত সামাজিকতা রক্ষা করবার জন্য তাঁকে যেতে হত রায়বাড়ীর তরফ থেকে লৌকিকতা বা উপহার নিয়ে। তখন লৌকিকতারই যুগ ছিল। বড় বড় বাড়ীর রেওয়াজ ছিল তাঁদের থেকে বড় বাড়ীর নিমন্ত্রণে মোহর বা গহনা দেওয়া। হীন অবস্থার বাড়ীর নিমন্ত্রণে নগদ টাকা, দশ বিশ পঞ্চাশ কদাচিৎ একশো টাকা। সেটা নগদ টাকা। বধূর সামনে রাখা পরাতে রেখে দিয়ে, আশীর্বাদ বা প্রণাম করে চলে আসতেন। পাশে যৌতুক বা লৌকিকতা গুনে নিয়ে খাতায় লিখে রাখবার কর্মচারী বসে থাকত। ওদিকে একদিকে খাওয়া-দাওয়ার আসর, অন্যদিকে একটা আসরে চলত সঙ্গীত-নৃত্যের আসর। সঙ্গীতজ্ঞ গুণীরা সামনে বসতেন, ফরমায়েশ করতেন; পিছনের লোকেরা আসত যেত; আসত যেত; ক্রমান্বয়েই বদল হত আসনের লোক। এই আসরে তরুণ কন্দর্পের মত দেবেশ্বরের হাত ধরে গৃহকর্তা নিজে সামনের আসনে বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—বস গান শোন; খেয়ে তবে যেতে পাবে।

আশপাশের সামনের সারির শ্রোতাদের বলেছিলেন—কীর্তিহাটের রত্নেশ্বর রায়ের বড় ছেলে। গান ওদের রক্তে।

কথাটা সে-কালে কলকাতার ধনী ও গুণীসমাজে সকলেই জানত। জানত এ বংশের সকলেই জন্ম থেকে গানে বোধ নিয়ে জন্মায়, কণ্ঠস্বরও সকলের সুস্বর। এদের বংশে কেউ একজন নাকি গান গেয়ে শক্তি-সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

১৮৭৮।৭৯ সাল। বাংলাদেশে রামপ্রসাদী গান তখন কীর্তনের সঙ্গে প্রায় সমান মর্যাদা পেয়েছে। তান্ত্রিক সাধুদের যুগ সেটা। বীরাচারী বামাচারীদের উপর যত ঘৃণা ইংরাজী শিক্ষিতদের, সাধারণের কাছে তত সমাদর ভক্তিমার্গী শক্তিসাধকদের। রামকৃষ্ণদেব তখন পূর্ণ প্রকাশ করেছেন নিজেকে দক্ষিণেশ্বরে। ইংরিজী শিক্ষিত নরেন দত্ত, থিয়েটারের প্রবর্তক, শেক্সপীয়রভক্ত জি সি তাঁর পায়ে গড়াবেন, তার আয়োজন চলছে।

গৃহস্বামীর কথায় সকলেই ফিরে তাকিয়েছিল এই সুন্দর তরুণটির দিকে। দেবেশ্বর তখন লম্বা ছিপছিপে অসাধারণ সুন্দর কিশোর। লজ্জিত হয়ে তিনি সকলকে নমস্কার ক’রে চেয়ারে বসে, আসরের নায়িকার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।

—এ কে? এ কে? এ কে?

হঠাৎ গায়িকা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সেই আসরের উপরই আছাড় খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

দুদিন পর একজন লোক এসে একখানা চিঠি দিয়ে গিয়েছিল দেবেশ্বর রায়কে। লিখেছিলেন—তাঁর ভিক্ষামাতার প্রেতিনী। তার প্রথম পত্রেই ছিল—“বাবামণি, আত্মহত্যা করিলে মানুষ প্রেতযোনি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আমিও প্রেতযোনি প্রাপ্ত হইয়াছি।

নিঃসন্তান কায়স্থ কন্যা, তোমার মুখ কেবলমাত্র মা হইবার সাধ মিটাইবার জন্য দেখি নাই, মৃত্যুর পর তোমার হাতের একটু জল পাইব এবং ‘রৌরব’ নরক হইতে মুক্তি পাইব বলিয়াও আশা করিয়াছিলাম।”

তারপর ওই বিবরণ। বিস্তৃতভাবে তিনি লিখেছিলেন, কোন কথা গোপন করেন নি। লিখেছিলেন—“দোষ আমার, আমি তাঁহার রূপেগুণে মুগ্ধ হইয়াছিলাম। তাঁহার চরণে আপনাকে বিকাইয়া দিতে চাহিয়াছিলাম। তিনি ফিরাইয়া দিলেই পলাইয়া আসিতাম এবং দূর হইতে তাঁহাকে ভালবাসিয়া জীবনটা কাটাইয়া দিতাম। কিন্তু তিনি আমাকে পদাঘাতে দূর করিলেন। দেশের ও দশের সম্মুখে অপমানিত করিলেন। তাহা আমার সহ্য হয় নাই। আমি বৃন্দাবন হইতে পলাইয়া আসিয়াছিলাম আগ্রা। আমার রূপ ছিল এবং গানের গলা ছিল, তাহার সহিত সঞ্চিত কিছু গোপন অর্থ ছিল, আগ্রায় আসিয়া গান শিক্ষা করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলাম, তোমার পিতার সহিত এইভাবে একদিন সাক্ষাৎ করিব আশা করিয়া। কিন্তু আমার মাথায় বজ্রাঘাত হইল। তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার গোপাল, তুমি আমার মুক্তিদাতা ব্রহ্মচারী, এই পাপিনীর বেশে দেখা হইল তোমার সঙ্গে।”

রাঙাপিসী, এই পত্র পাইয়া আমি তিন দিন ক্রন্দন করিয়াছিলাম। গোপালদাদাকে পাঠাইয়া তাঁহার সন্ধান লইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতে চাহিয়াছিলাম; দেখা করিয়াছিলাম হাওড়া স্টেশনে, তিনি এই বঙ্গদেশ হইতেই পলাইয়া যাইতেছেন। মা বলিয়া ডাকিয়াছিলাম। তিনি জোর করিয়া আমার পায়ের ধূলা লইয়াছিলেন। সেদিন তিনি আমাকে টাকাও দিতে চাহিয়াছিলেন। একটা ভারী হাতবাক্স লইয়া বলিয়াছিলেন—এইটি তুমি লও।

কিন্তু রায়বংশের দেবেশ্বর তাহা লয় নাই। পিসী, সেদিন যদি বাক্সটা লইতাম, তবে ভায়লেটকে লইয়া সংসার পাতিয়া ব্যবসা করিবার জন্য টাকা ঋণ চাহিয়া তোমাকে পত্র লিখিতে হইত না। এবং ঠিক এইরূপ পরিণতিটা সম্ভবতঃ হইত না রাঙাপিসী, এই অল্পকালের জীবনে, এই পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে দেখিলাম অনেক, বুঝিলাম অনেক। স্বর্গ-নরকের হদিস পাই নাই, ভগবানকে ঠিক বিশ্বাস করিতে পারি নাই। অবিশ্বাস, তাই বা করিতে পারিলাম কই? ধর্ম—যে ধর্ম তোমরা মানিয়া চল তাহাকে মানিতে পারি নাই। তাহাকে মানিতে পারি নাই বাবামহাশয়ের কার্যকলাপের জন্য। মানুষটা পাথর, মানুষটা পাথর! রাঙাপিসী, এই পাথরে আমি মাথা ঠুকিয়া লড়াই করিয়াছি, রক্তাক্ত করিয়াছি মাথাটা। শুধু শেষকালটায়-রাঙাপিসী-যুঝিতে পারিলাম না। দশদিন শ্রাদ্ধের সময় আসিতে পার নাই। অথবা ইচ্ছা করিয়াই আইস নাই। ছয় মাসে রায়বাহাদুরের উপযুক্ত শ্রাদ্ধ করিব। তুমি আইস। কলিকাতায় থাকিয়াও তোমার সহিত দেখা করি না, তোমার বাড়ী যাই না, তাহার কারণ, অন্যে না চিনুক আমি তোমাকে চিনি। আমি তোমাকে জানি। তুমি রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের যোগ্যা ভগ্নী। তুমি আমাকে মদ্যপ বলিয়া ঘৃণা করিবে। আমি দেবতা মানি না, ধর্ম মানি না বলিয়া ঘৃণা করিবে। আরো অনেক কারণে ঘৃণা করিবে।

চিঠিখানার তারিখ ১৮৯৭ সাল। ১৮৯৬ সালে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় মারা গিয়েছিলেন। এগিয়ে এসে পড়েছি। ১৮৭৮ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল আঠারো বছর। এই আঠারো বছর রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় এবং দেবেশ্বর রায়ে নিষ্ঠুর সংগ্রাম চলেছে। এ সংগ্রাম একদিনের জন্য থামে নি। রত্নেশ্বর রায় পুত্রকে চালাতে চেয়েছিলেন নিজের মতে, নিজের পথে।

সেদিন, মানে, যেদিন রত্নেশ্বর রায় বড় ছেলের অভিযোগের কথা শুনে, লক্ষ্মীর ঘর থেকে চোখের জলের সঙ্গে তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেলেন, বলে গেলেন, অঞ্জনার মেয়েকে আমি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম সংসারজীবনে, সমাজজীবনে। চেয়েছিলেন রেভারেন্ড কালীমোহন ব্যানার্জি, নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তার মধ্যে তাকে ফিরিয়ে আনবেন। এদের মধ্যে ক্রীশ্চিয়ানিটি ভারতবর্ষের স্পর্শ পেয়েছিল, ক্রীশ্চিয়ানিটির সঙ্গে ভারতবর্ষের সাধনার ধারাটি যুক্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশের রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত চোখের সামনে রয়েছে। আর যারা মেমসাহেব বিয়ে করে বা যে মেয়েরা সাহেব বিয়ে করে ওই এলিয়ট রোড, কি খিদিরপুরে পাড়া ফেঁদেছে, যারা নাম পাল্টেছে, বুলি পাল্টেছে, তারাও রয়েছে সুলতা। তাদের দৃষ্টান্ত সে-কালে আরও কটুভাবে প্রকট ছিল, তারা নিষ্ঠুর অবজ্ঞায় আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করত। তাই যে সম্পর্ক অঞ্জনা ছিঁড়ে চলে গিয়েছিল, সেই সম্পর্ক আবার নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন ভায়লেটকে দেশী ক্রীশ্চানসমাজে বিয়ে দিয়ে।

গোপালকেও টাকা দিয়েছিলেন। পাঁচ হাজার টাকাই দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন দেবেশ্বরের হাত দিয়েই। তারপর করেছিলেন দেবেশ্বরের বিবাহের আয়োজন।

রাঙাপিসীর পছন্দ-করা ওই দশ পার হয়ে এগারোয় পা-দেওয়া পিতৃমাতৃহীনা মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মেয়েটির নাম উমা। মাথায় ছোটখাটো, তবে রূপসী বটে। তার সঙ্গে একটু—

থেমে গেল সুরেশ্বর। তারপর বললে—কি বলব সুলতা? মানে ঠিক বিশেষণটি যেন খুঁজে পাচ্ছি না। প্রগল্‌ভা কথাটা ঠিক হবে না।

অর্চনা হেসে বললে—বড়ঠাকুমা ছেলেবেলায় দিদিমার আদরে অকালে একটু বেশী পেকেছিলেন।

—না, অকালপক্ব কথাটাও খাটবে না। বরং প্রিকোসাস বলতে পারা যায়।

—না সুরোদা, প্রিকোসাস শব্দটাও ভাল না, ঠিকও নয়। তার থেকে বরং অকাল-ভারিক্কি বা অকাল-গিন্নীবান্নী ভাল। নিজের দিদিমার কাছ থেকে ওটাই শিখে এসেছিলেন। স্বামীর প্রেয়সী হওয়ার চেয়ে বাড়ীর গৃহিণী ছিলেন তিনি বেশী। বেলফুলের মালা গেঁথে রাধাসুন্দরের এবং রাধারাণীর জন্য নিত্য পাঠাতেন। কিন্তু কোনদিন সন্ধ্যায় বেলকুঁড়ি মালী তুলে দিয়ে যেত, তা নিয়ে মালা গেঁথে নিজের খোঁপায় পরেন নি বা স্বামীকে পরাবার জন্যে আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে যাননি।

—ঠিক বলেছিস অর্চি। এ কথাটা এমন ভাবে বলতে আমি কখনও পারতাম না রে! রাঙাপিসীকে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন ওই পিতৃশ্রাদ্ধের সময়, তাতে স্ত্রী উমার সম্বন্ধে লিখেছেন-”রাঙাপিসী, বয়স তখন ষোল পার হইয়া সতেরোতে পড়িয়াছি, একটি এগারো বছরে পা দেওয়া কনেই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তখন প্রেম করিয়াছি ভায়লেটের সঙ্গে। সাদা চামড়ার ক্রীশ্চান মেয়ে, গোয়া হইতে কলিকাতার ফিরিঙ্গীপাড়া হইয়া কীর্তিহাটের গোয়ানপাড়া ফেরত ভায়লেটের সঙ্গে প্রেম করিয়াছি যে উল্লাসের মধ্যে, যে নেশার মধ্যে, তাহা বিবাহিত এই পত্নীর মধ্যে ছিল না। থাকিবার কথা নয়। তাহার উপর উমার ছিল প্রাচীনকালের মন। সে মনের কাছে আনন্দের চেয়ে পুণ্য ও ধর্মের মূল্য বেশী। ওই বয়সেই সে ব্রতের জন্য স্বচ্ছন্দে উপবাস করিতে পারিত। সারাটা দিনই প্রায় সে কীর্তিহাটের ঠাকুরদের অর্চনার আয়োজনে ব্যস্ত থাকিত কিন্তু আমার সঙ্গে দুদণ্ড বসিয়া গল্প করিবার অথবা একটি বসন্তকালে পূর্ণিমারাত্রে মুখের দিকে চাহিয়া বসিবার অবকাশ বা আগ্রহ তাহার হয় নাই।

বলিলে বলিত, কেমন কথা তোমার? এ সবই তো তোমার জন্যই করি, না “হরের মায়ের” জন্য করি। “হরের-মা” কথাটা সে আজও ব্যবহার করে।

তাহার উপর রাঙাপিসী, বিবাহের পর কীর্তিহাটে ছিলাম এবং এন্ট্রান্স পাস করিয়া কলিকাতায় আসিলাম। সর্বত্রই, একলা আমার উপর নহে, আমাদের উভয়ের উপর দৃষ্টি রাখিবার জন্য কীর্তিহাটের সংসারটাই কলিকাতায় আসিল।

শিবেশ্বর রামেশ্বরকে লইয়া মাতাঠাকুরাণী আসিলেন। বাবামহাশয় পনের দিন থাকিতেন কীর্তিহাটে, পনের দিন থাকিতেন কলিকাতায়।

একদা একখানা দলিল তৈয়ারী করিয়া আমাকে বলিলেন—সহি কর।

দেখিলাম, এলিয়ট রোডের যে বাড়ীখানা আমি লিজ লইয়াছিলাম, সেখানকার মালিকানি স্বত্ব কিনিয়া তিনি ওই বাটী ভায়লেটকে দান করিতেছেন। এবং জানিলাম—ভায়লেটের একটি পুত্রসন্তান হইয়াছে।

.

জবানবন্দী আমার শেষ হয়ে আসছে-সুরেশ্বর বললে।

ভায়লেটকে অনেক খেসারত দিয়ে রত্নেশ্বর রায় দেবেশ্বরের সম্মুখ থেকে সরিয়েছিলেন বটে কিন্তু ভায়লেট তাঁর মনে দেবেশ্বরের অন্তিম মুহূর্তে বিকারগ্রস্ত চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দেবেশ্বর রায় বিকারের ঝোঁকে বলেছিলেন, গোপালদা বের করে দে, কেন আনলি ভায়লাকে-বের ক’রে দে! জোর করে বের করে দে, আ, হাসছে দেখ! ‘ইউ গেট আউট আই সে! শাট্ দ্য ডোর। ইউ শাট্ দ্য ডোর!

আমার ব্যাখ্যা কি জান? শ্যামাকান্তের প্রতি সেই মহাশক্তির রোষ। সেই রোষ ভায়লা হয়ে এসেছিল তাঁর সামনে।

হঠাৎ চুপ করে গেল সুরেশ্বর। সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে।

সুলতা বললে—হঠাৎ এমন করে, এই যুগে, উনিশশো সালের পঞ্চাশ বছরের পর যখন অ্যাটমিক এজে মানুষ পা দিচ্ছে, তখন এইভাবে ব্যাখ্যা করছ কেন? তুমি তো রিএ্যাকশানারি ছিলে না, হঠাৎ এসব কি? না—এসব তোমার আর্টের তুলির ছোপ?

অর্চনা মৃদু স্বরে বললে—মধ্যে মধ্যে এই রকম বলে ও-বংশের ঋণ শোধ করতে তুমি বাধ্য।

সুরেশ্বর বললে—নিশ্চয়ই তা বলতে পার তুমি। কিন্তু না। হয়তো বলার ঢঙটা আমার ঠিক হল না। হেরিডিটির থিয়োরি দিয়ে বললে বাহবা দিতে। তা ছাড়া আর একটা কারণ আছে, সেটা হল এই যে, দেবেশ্বর রায় নিজে এই কথাগুলো একরকম লিখে গেছেন মৃত্যুর দিনেই। সে লেখা তোমাকে দেখাব আমি।

নইলে জীবনের শেষ বছরটা তিনি অত্যন্ত শান্তভাবে যাপন করেছিলে, জীবনে শান্তি খুঁজেছিলেন। প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন কেন, ভালবেসেছিলেন তাঁর উপেক্ষিতা স্ত্রীকে।

স্ত্রী তাঁর সে ভালবাসা নিতে চান নি। বিশ্বাস করেন নি। হয়তো নেবারও শক্তি তাঁর ছিল না, তখন তিনি নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করেছেন দেবতার পায়ে।

দেবেশ্বর তাতে দমেন নি। বলেছিলেন—আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, আমাদের ডাইভোর্স নেই; আমার তোমার উপর অখণ্ড অধিকার। দেবতা হোক, দৈত্য হোক, যে হয় সে হোক, তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে, তার সঙ্গে যুদ্ধ করে হয় মরব, নয় তোমায় ছিনিয়ে আনব।

এবং তা তিনি এনেছিলেন; পেরেছিলেন তিনি স্ত্রীকে তাঁর অভিমুখিনী করতে। ছেচল্লিশ বছর বয়সে মারা গিছলেন; তাঁর বয়স তখন ছেচল্লিশ, তাঁর স্ত্রীর বয়স চল্লিশ; বড়ছেলে—আমার জ্যাঠামশাইয়ের বয়স তখন সাতাশ, আমার বাবার বয়স পঁচিশ। তখন দেবেশ্বর রায় অহরহ চাইতেন স্ত্রীকে, বলতেন—জীবনে এত শাস্তি আছে তা জানতাম না।

আমার ঠাকুমা উমা দেবী বসে হাসতেন।

হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গিয়ে দেবেশ্বর চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, স্ত্রী শঙ্কিত হয়ে উঠে প্রশ্ন করতেন—কি হল? অ্যাঁ!

দেবেশ্বর বলতেন—এই জীবনেই সব শেষ? তোমাকে আর পাব না? এত ভালবাসা এত প্রেম সব শেষ এই কটা দিনেই?

স্ত্রী বলতেন—শেষ কেন হবে? শেষের মধ্যে অশেষ যিনি, ওই মা—ওঁকে ডাক, ওঁর দয়া হলে, শেষের পরেও আছে।

দেবেশ্বর বলতেন—না। ম্লান বিষণ্ণ হেসে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলতেন—meaningless, life is meaningless উমা!

চোখ দিয়ে তাঁর জল গড়াতো। তাঁর স্ত্রী হাঁপিয়ে উঠতেন, তিনি নিজে এর উত্তর জানতেন নিজের বিশ্বাসবোধে, কিন্তু তা বিশ্বাস করাবার ক্ষমতা তো তাঁর ছিল না। তাও দেবেশ্বর রায়কে।

তিনি নাস্তিক ছিলেন চিরজীবন। তিনি মৃত্যুর দিন এই কথাগুলো লিখে গিছলেন—“শ্যামাকান্ত মহাশক্তির যে রোষবহ্নিতে দগ্ধ হইয়াছিলেন, সেই বহ্নির ক্ষুধার তৃপ্তি আজও হয় নাই। বাবামহাশয় ইহার দহন হইতে বাঁচিয়াছিলেন নিজের পুণ্যে। তবু তাঁহার বুকে নাগিনীর ছোবলের মত ছোবল সে দিয়াছিল কিন্তু দংশন করিতে পারে নাই। আমাকে সে ছাড়িল না, আমি মরিলাম।”

আরও অনেক কথা। যথাসময়ে বলব। এখন হারানো ক্রমটা খুঁজে নিয়ে বলি।

বিয়ের পর সরস্বতী বউরাণী তিন ছেলে এবং বউকে নিয়ে এসে পাকা হয়ে বসেছিলেন জানবাজারের বাড়ীতে।

দেবেশ্বর ফার্স্ট ডিভিশনে এন্ট্রান্স পাস ক’রে প্রেসিডেন্সিতে এফ. এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন; শিবেশ্বর রামেশ্বর এঁরা তখন একজন চৌদ্দ বছরের, একজন এগার বছরের। কালের বয়স বাড়ে কিনা জানিনে। তবে আমাদের বাড়ে বলে হিসেব একটা রাখি। ১৮৮০ সাল পার হয়েছে। বাংলাদেশের জীবনসমুদ্রে পূর্ণিমার জোয়ার জেগেছে। ইংলিশ চ্যানেলের, মেডিটেরিয়ানের উত্তর কূল ঘেঁষা জোয়ারের সাদা ফেনা মাথায় করে যে ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ে আমাদের ঘরদোরের সব কিছু ভাসিয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছিল, আমাদের জীবন-সমুদ্রের ঢেউ সে ঢেউগুলোকে রুখে দিয়েছে। নতুন ব্রাহ্মধর্মের যুক্তিবাদী ধর্ম আর জীবনের প্রসার তখন তাতে আশ্চর্য জোর দিয়েছে। দু’চারজন মুসলমানও নাকি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন তখন। ওদিকে দক্ষিণেশ্বরে কলরোল উঠেছে। এরই মধ্যে নতুন বিয়ে করে দেবেশ্বর রায় প্রথম দুটো বছর শুধু পড়া আর নতুন বউকে নিয়ে মশগুল হতে চেয়েছিলেন। বউকে জীবন ভরে পাওয়া সহজ হয় নি, পান নি; কলকাতার জানবাজারে বাড়ী হলেও এখানেও কীর্তিহাটের রায়বাড়ীর চালচলনের এতটুকু এদিক ওদিক হয় নি। বউ সেই নিয়মানুসারে উঠত ভোরবেলা, অন্ধকার থাকতে। এবং নিজের ঝিকে ডেকে নিয়ে (ডাকতে অবশ্য হত না–ঝি উঠে বসেই থাকত) প্রাতঃকৃত্য থেকে স্নান পর্যন্ত সেরে নিয়ে শাশুড়ীর কাছে এসে দাঁড়াতেন, শাশুড়ী বধূকে ভাবীকালের রায়গৃহিণীর ছাঁচে ঢেলে তৈরী করতেন। রান্নাবান্না কি হবে—থেকে শুরু করে, ঝি-চাকরের খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত সব কিছুর উপর দৃষ্টি রাখাই গৃহিণীত্ব। সেই দৃষ্টিই তিনি দিতেন। শ্বশুর এলে তাঁর সেবা এবং তাঁর উপদেশ শোনা ছিল অন্যতম কর্তব্য। এবং তার সঙ্গে আর একটা কর্তব্য ছিল, সেটি গভীর রাত্রিতে শেষবার ঘরে যাবার পূর্ব পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে দেখা না করা।

প্রথম স্ত্রী যতদিন নিতান্ত বালিকা ছিলেন, ততদিন দেবেশ্বর এটা মেনেছিলেন, তিনি বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। বই, বই, বই; পড়া পড়া পড়া! তাঁকেও তখন ছাঁচে ঢালাই চলছে। অথবা নিজেই তিনি নিজেকে গড়ছেন। রায়বংশের আভিজাত্যের ইতিহাসে দেবেশ্বর শ্রেষ্ঠ অভিজাত। চলন ছিল ধীর, কিন্তু দীর্ঘদেহ দেবেশ্বরের পদক্ষেপ ছিল দীর্ঘ। বেশে-ভূষায় শুভ্রতার মহিমা ছিল অক্ষুণ্ণ, অমলিন। কণ্ঠ ছিল গম্ভীর কিন্তু স্বর ছিল মৃদু। পাতলা গোঁফ তখন বেরুচ্ছে, তা তিনি মোম দিয়ে মেজে সূচালো করতে চাচ্ছেন। গায়ে আতরের গন্ধ থাকত অহরহ। দৃষ্টি ছিল তির্যক, কথা বলতেন বেঁকিয়ে, ঠোঁট দুটিও একটু বেঁকত। নমস্কার করতেন সর্বাগ্রে। ঘৃণা করে তাকালে, যার দিকে তাকাতেন সে যেন মনে মনে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। এই দেবেশ্বর রায়—তখন তিনি ১৮।১৯ বছরের নবযুবক, তিনি এই বালিকা স্ত্রীর জন্য জেগে বসে থাকতেন। বই হাতে। বালিকাবধূ আসত পায়ের তোড়া বাজিয়ে, ঝুম ঝুম শব্দ তুলে। হাতে থাকত পান, নিজের হাতে সাজা। এও তাঁকে শিখিয়েছিলেন তাঁর দিদিমা এবং তাঁর শাশুড়ী। দেবেশ্বর পান দু-খিলি খেয়ে বলতেন—“মালা গাঁথতে পার না? বেলফুলের এত কুঁড়ি!”

বালিকাবধূ শিউরে উঠে বলতেন—বাবা গো, ফুলে পূজো হয়, মা পুজো করেন—

—মা তো এত ফুল নিয়ে পূজো করেন না। ফুল তো গাছেই বাসী হয়।

—তা হোক। কি মনে করবেন বল তো!

এই বলতে বলতেই বালিকাবধূ ঢুলতে আরম্ভ করতেন। এবং আর কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বামীর বুকে বা কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতেন।

এইভাবে দু বছর কাটল। বালিকাবধূ কিশোরী হল। “ত্রয়োদশ বসন্তের মালা।” দেবেশ্বর এফ-এ পরীক্ষায় বৃত্তি নিয়ে পাস করলেন। দেবেশ্বর প্রেসিডেন্সী কলেজে বি-এ ক্লাসে ভর্তি হলেন। এবং বধুর কোলে এল প্রথম সন্তান।

এরই মধ্যে হঠাৎ এল সংঘাত। হঠাৎ সরস্বতী বউরাণী মারা গেলেন। সেই শ্রাদ্ধে শ্যামনগর থেকে কীর্তিহাট এল ঠাকুরদাস পাল। ঠাকুরদাসের সঙ্গে আর একবার ছিন্ন প্রীতির বন্ধন জোড়া লেগেছিল, দেবেশ্বর রায়ের বিয়ের সময়। সুখী হয়েছিলেন রত্নেশ্বর। সব ভার দিয়েছিলেন ঠাকুরদাসকে। গোপালও এসেছিল বিয়েতে। কিন্তু সে কীর্তিহাট যায় নি। যায় নি গোয়ানদের জন্য। এবার এল এই শ্রাদ্ধে। তখন সে সেই পাঁচ হাজার টাকা মূলধনে ব্যবসা শুরু করে বিশ-ত্রিশ হাজারের মালিক হয়েছে। হঠাৎ শ্রাদ্ধের পরেই ঠাকুরদাস খুন হয়ে গেল। বচসা করতে করতে পিদ্রু গোয়ান তার পেটটা ফেঁড়ে দিলে।

সুরেশ্বর বললে—তার গূঢ় কারণটা রায়বাহাদুরের ডায়রীতে পাই নি সুলতা। পেয়েছি দেবেশ্বর রায় যে চিঠি লিখেছিলেন রাঙাপিসীকে, তার মধ্যে।

“ঠাকুরদাস জ্যাঠামশাই খুন হইলেন; সে খুনের হেতু কে, আমি অথবা গোপালদা তাহা আজও বুঝিতে পারি নাই। তবে খুন পিদ্রু করিলেও তাহা করাইল কে, তাহা বুঝিতে বাকি থাকে নাই।”

গোপাল একটা অন্যায় করেছিলেন। দেবেশ্বরও তার ভাগী ছিলেন। গোপাল তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার মালিকই হন নি, তিনি তখন ব্রাহ্ম হয়েছেন। একটি মেয়েকে ভালবেসে তাকে বিয়ে করবার জন্য ব্রাহ্ম হয়েছেন। সে কথাটা তিনি বলেন নি। এবং দেবেশ্বর সেটা জানতেন, তিনিও সেটা বলেন নি। কথাটা হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়ল।

রত্নেশ্বর রায় প্রাচীনপন্থী, তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। সে ক্ষোভ তাঁর প্রচণ্ড ক্ষোভ। তিনি প্রথম দেবেশ্বরকেই বলেছিলেন—তুমি জান যখন, তখন আমাকে বল নি কেন?

দেবেশ্বর বলেছিলেন- কেন বাবা, গোপালদা এখানে তো ব্রাহ্ম হয়েছে বলে মাথাও উঁচু করে নি। ব্রাহ্মণদের সঙ্গেও খায় নি, খেতেও চায় নি; যেখানে থাকতে দিয়েছেন থেকেছে। কারুর অসম্মানও করে নি।

রায়বাহাদুর বলেছিলেন—সে সদগোপ হয়ে বৈদ্যকন্যা বিবাহ করেছে। এ অধর্ম। এর সাজা দেব আমি।

দেবেশ্বর বলেছিলেন—তার আগে আমাকে সাজা দিতে হবে। কারণ এতে আমি মত দিয়েছিলাম। কাউকে জানাতে বারণ করেছিলাম। এবং এ শ্রাদ্ধেও তাকে আমি আসতে বলেছি বলেই সাহস করে সে এসেছে।

বলেই তিনি চলে গিয়েছিলেন, অন্দরে নিজের ঘরে।

দেবেশ্বর লিখেছেন—“বাবা মহাশয়ের আসল ক্ষোভটা গোপালদাদার উপর, সে ব্রাহ্ম হইবে কেন? ব্রাহ্মধর্মের তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। সে তুমি অবগত আছ। আমার উত্তর শুনিয়া তিনি বলিলেন-তোমার স্পর্ধা, তুমি এমন কথা বলিতেছ। শাস্ত্রের তুমি কি জান? আমি বলিলাম-কিছুই জানিতে চাহি না। তবে গোপালদাদা কোন অন্যায় করিয়াছে, যে শাস্ত্রে বলিবে, আমি মানিতে পারিব না। তিনি ক্ষিপ্ত হইয়া গেলেন। ইহার পরই পিদ্রু আসিয়া তাঁহার কাছে গোপালদাদার বিরুদ্ধে নালিশ করিল। ভায়লেটকে সে গোয়ানপাড়া হইতে তিন বৎসর পূর্বে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছে।”

ঠাকুরদাস ছুটে এসেছিল। তার আগে রটে গেছে যে, পিদ্রু নালিশ করেছে গোপালের নামে। রত্নেশ্বর বলেছিলেন—তুই বসে দেখ ঠাকুরদাস। আমার বিচারে বাধা দিস নে। আমি অন্যায় বিচার করব না।

ঠাকুরদাস চিনতেন তার দাদাঠাকুরটিকে, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তার মানে? গোপাল আমাকে বলেছে, তুমি দেববাবুর উপর ক্ষেপেছ। দেখ, তুমি গোপালকে সাজা দাও দাও, আমি তাকে সাজা দেব, ত্যাজ্যপুত্তুর করব।

—আমিও দেবেশ্বরকে তাই করব। সম্পত্তি সব দেব বউমাকে। তারও জাত গিয়েছে।

—দাদাঠাকুর! এ সব তুমি কর না।

—না করে আমি পারি না। ধর্মের অপমান হয়েছে, পিদ্রু নালিশ করেছে।

—ধৰ্ম্ম-অধৰ্ম্ম বুঝি না। দেবুবাবা গুলী খেয়ে মরতে চেয়েছিল। প্রাশ্চিত্তির তার হয়ে গিয়েছে। গোপালকে তুমি তখন পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছ। কেন দিয়েছিলে! আর পিদ্রু? ওকে তুমি শুধোও দিকি, ওর বোনের বিচার কে করবে? সে তো তোমার দেওয়া বাড়ীতে তোমার টাকায় ধেই ধেই করে নাচছে! বেশ্যে—

পিদ্রু চিৎকার করে উঠেছিল–ঝুটা বাত। মু সামাল করনা—

—যাঃ বেটা গোয়ান। চেঁচাসনে মেলা।

ধমক দিয়েছিলেন এবার রত্নেশ্বর-ঠা-কু-র-দাস!

–দাদাঠাকুর কার বিচার করবে? বল তো? তোমার বাবা, তার বাবা, তোমার মায়ের বাবার?

—দারোয়ান! দরওয়াজা সব বন্ধ কর, দারোয়ান। ঠাকুরদাস, কি বলছিস! আস্তে বল। আস্তে।

গলা নামিয়েই বলেছিল ঠাকুরদাস —কিন্তু নিচু গলা হলেও খুব শক্ত গলায় বলেছিল—দেবুবাবুকে নিয়ে যদি কিছু কর—আমি জানি, তুমি পার, সব পার, যে শ্যামনগরকে বাঁচাতে তুমি মরতে গিয়েছিলে, সেই শ্যামনগরের মানুষের টুটিতে পা দিয়ে তুমি টাকা বার ক’রে সেই টাকায় ইস্কুল করে দিলে। তুমি সব পারো। কিন্তু এ কাজ করলে আমি গাঁয়ে গাঁয়ে বলে বেড়াব ঢাক বাজিয়ে,—শুধাও তোমাদের জমিদার রত্নেশ্বর রায়কে, তার মায়ের বাবার নাম কি? জমিদারের আসল মা কে? আসল বাবা কে? তুমি শাক দিয়ে মাছ ঢেকেছ? উল্টে দেব শাকের ঢাকা। বলব, শুধাও ভায়লা কার বিটি? ওর বাবা যে হোক, মা-টা কে?

মনে মনে চমকে উঠেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। কিন্তু তার প্রকাশ বাইরে কিছু হয় নি। শুধু বলেছিলেন—চেঁচাস নে ঠাকুরদাস, চেঁচাস নে। যা বলবি আস্তে বল।

ঠাকুরদাস ভেবেছিল, সে জিতেছে। সে আরও স্ফীত হয়ে বলেছিল-আমি সব জানি, তোমাদের ভাই-বুনের ঝগড়ার সময়, যেদিন অন্নপূর্ণাদিদিকে সব কথা বলে চিঠিপত্তর পড়ে শোনাও, সেদিন আমি সব শুনেছি। ওসব কথা তুমি ছাড়ান দাও। দেবুবাবা বড়লোকের ছেলে, তার ওপর এই তোমাদের বংশাবলীর ধারা। একটা শাপ-শাপান্ত আছে। এক পুরুষে তা ক্ষয় না দাদাঠাকুর। অনেক পুরুষ লাগে। আর এ তো একটা ওই জাতের ছুঁড়ি। নিজেদের ভেতরেই দশজনার সঙ্গে রসের খেল খেলে, শেষে একজনাকে বিয়ে করে। আজ বিয়ে করে, কালকে ছাড়ে, আবার আর একজনাকে ধরে।

পিজ লাফ দিয়ে উঠেছিল আবার–হুজুর!

হুজুর তখন পিদ্রুর দিকেই তাকিয়েছিলেন।

হুজুর বলেছিলেন—আমার ছেলের বিচার আমি করতে পারি পিদ্রু, কিন্তু ঠাকুরদাসের ছেলের বিচার আমি করতে পারব না।

—ঠাকুরদাস কি বলছে, তার বিচার কর।

—তাও পারব না।

—তবে আমি নিজ জোরসে শোধ নিয়ে লেবে।

—সে কথা ওকে বল। বোঝাপড়া কর।

বাস। সঙ্গে সঙ্গে পিভ্রূ ঠাকুরদাসের টুটি চেপে ধরেছিল। ঠাকুরদাস চমকে উঠে গলা ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে বলেছিল—আয় শালা–আয়, বাইরে আয়। তুই গোয়ান, আমি গোপ। আয়!

তারপর, ওই কংসাবতীর ঘাটে–।

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *