৭
অন্নপূর্ণা-মার সঙ্গে সেই শেষ দেখা আমার। উনি আমার হাতে রেশমী কাপড়ে বাঁধা পুরানো চিঠির বান্ডিল একটা দিলেন, বললেন—নিয়ে রাখ, এর মধ্যে সব কথা পাবি। আমার দেবুর কথা। শুনেছি যখন সে মারা যায়, তখন বিকারের ঘোরে কেবলি আমাকে ডেকেছিল রাঙাপিসী রাঙাপিসী, বাবা ভায়লেটকে নর্দমার জলে ডুবিয়ে মেরে দিলেন। ছি-ছি রাঙাপিসী। তুমি ভুলতে পার? রাঙাপিসী! এর অর্থ অনেক। সে অনেক কথা। তা ওই কাগজের বান্ডিলের মধ্যে ছিল। দেবেশ্বর রায়ের রাঙাপিসী অন্নপূর্ণা দেবী সযত্নে সব বান্ডিল বেঁধে রেখেছিলেন। হয়তো আমার জন্যই রেখেছিলেন। কারণ, সেই রাত্রে ওই বান্ডিল হাতে হরিশ মুখার্জি রোড থেকে জানবাজার ফিরে এসে পরের দিন সকালেই আমি মেদিনীপুর রওনা হয়ে গেলাম মেজদির জন্যে। ম্যাজিস্ট্রেট বি আর সেন এসে মেদিনীপুরে ঝড়ো হাওয়ার মোড় ফিরিয়েছেন। ওখানকার অবস্থা সহজ করে এনেছেন মেলামেশার মধ্য দিয়ে, কাজকর্মের মধ্য দিয়ে।
মেদিনীপুরে ‘বিদ্যাসাগর হল’ তৈরী হচ্ছে। জেলার বড় বড় জমিদার, রাজা উপাধিধারী জমিদার মেদিনীপুরে অনেক, নাড়াজোল ঝাড়গ্রাম, কীর্তিহাটের পাশে গর্গ বাহাদুরেরা, রামগড়ের রাজা—সে একটা লম্বা ফর্দ হয়। তাছাড়া রায়বাহাদুর, রায়সাহেব, জমিদারও আছে। পল্টনী মেজাজের শাসনতন্ত্রের মধ্যে টাকা আদায় সোজা ব্যাপার। টাকা অনেক উঠেছে।
ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজমের দুর্দিন এসেছে তার এম্পায়ারের শ্রেষ্ঠ ভূখণ্ডে; বিরাট মহীরুহের শিকড়ে টান ধরেছে, কট কট করে কাটছে, সঙ্গে সঙ্গে মহীরুহটির প্রশাখা এই জমিদারীগুলোই আগে শুকিয়ে আসছে; তবু যা আছে, দু-চার-দশটা কাঁচা পাতা, ডালের মধ্যে রস, তাই তখন আদায় করে বা সম্বল করে বাঁচতে চাচ্ছে। মানুষকে ভোলাতে হবে। মানুষ আর সহজে ভুলবে না। তাই বিদ্যাসাগরের স্মৃতির উপর সৌধ গড়ে শাস্তিস্থাপনের ব্যবস্থা। জমিদারেরা সঞ্চিত টাকা থেকে দিচ্ছেন। ধার করেও দিচ্ছেন। না দিয়ে উপায় কি? যারা দেশের মানুষ, যারা ইংরেজের সঙ্গে লড়ছে, তারাই জমিদারের প্রজা। জমিদারীর বিপক্ষে ফতোয়া বেরিয়ে গেছে। কীর্তিহাটের জমিদারীতে আমি যখ হয়ে আছি। টাকা আমিও দিয়েছি।
সমারোহ করে কাজকর্ম হচ্ছে। ওখানকার উকীলদের মধ্যে যাঁরা অগ্রণী, তাঁরা একটু একটু করে কাছে এগিয়ে এসেছেন। ওদিকে মার খেয়ে ক্লান্ত মেদিনীপুরের যৌবনশক্তি গাছতলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে ১৯৪২ সালের জন্য। রবীন্দ্রনাথ তখনও বেঁচে, তিনি আসবেন বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল হলের ওপনিংয়ের জন্যে। কলকাতায় সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন।
এরই মধ্যে মেদিনীপুর এসে সুধাকরবাবু উকিলের মারফৎ পিটিশন দিয়ে মিস্টার সেনের সঙ্গে ইন্টারভ্যু চাইলাম। পেলাম ইন্টারভ্যু, মিস্টার সেনের সঙ্গে দেখা হতেই বললেন-ও কেসটার জন্যে অলরেডি আমি রেকমেন্ড করে লিখেছি। আশা করছি দিন-দশকের মধ্যেই একটা উত্তর পাব। মনে হয়, ওঁকে ছেড়েই দেওয়া হবে।
মিস্টার সেনের কাছে আশ্বাস পেয়ে কীর্তিহাট ফিরলাম। আমার জীবনের সব গ্রন্থি সব জট যেন খুলে গেল বলে মনে হল। অর্চনার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে—। তবে ফেরবার দিন অর্থাৎ টেলিগ্রাম নিয়ে রথীন যখন অন্নপূর্ণা-মার ঘরে ঢুকল, তখন তার গায়ে ওষুধের তীব্র গন্ধে আমার মনটা কেমন খারাপ হয়েছিল সুলতা।
আমি যে মদ খাই। অনেকদিন খাচ্ছি। খেয়ালী মানুষ, কখনও ছেড়ে দি, খাব না বলে প্রতিজ্ঞা করি, আবার কখনও প্রতিজ্ঞা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ধরি। আমার বাধা বন্ধ নেই। গুরুজন নেই, লজ্জা-সংকোচও নেই। কিন্তু যাদের বাধাবন্ধ আছে, তাদের জানি। তাদের দেখেছি, তাদের চিনি।
১৯৩৭ সাল পার হয়ে ৩৮ সালের কাল চলছে, আমাদের জীবন পাল্টাচ্ছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি সব দিক থেকে। ১৯৩০ সালের ‘মাস’ মুভমেন্টের পর যে এবার কোন্ মুভমেন্ট আসছে তা কেউ জানে না, তবে সেটা যে ১৯৩০ সালের পুনরাবৃত্তি হবে না এটা নিশ্চিত। তবে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের ব্যাকগ্রাউন্ডে কুইট ইন্ডিয়া, আজাদ হিন্দ, তার সঙ্গে পিপলস ওয়ারের কল্পনা কেউ ভাবতে পারে না। বড়জোর ভাবে, আর একটা রিফর্ম। শুধু মুসলিম লীগকে রাজী করাতে পারলেই হয়। নতুন কালের মানুষেরা স্পষ্ট বলছে—পুরনো কিছু চলবে না। তার সঙ্গে রথীনের মদ খাওয়ার সামঞ্জস্য আছে। তবু মনে দুঃখ পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম অন্নপূর্ণা-মার জন্যে। তিনি বেঁচে থাকতেই এই হল। তা হোক, উনি আর ক’দিন।—এই বলে সান্ত্বনা নিতে গিয়েও নিতে পারিনি। দুঃখ হয়েছিল অর্চনার জন্যে। মেয়েটা বড় ভাল মেয়ে। অন্নপূর্ণা-মার মেজদির কথা রায়বাড়ীর প্রবাদে আমার বিশ্বাস নেই। ভবানী দেবী অৰ্চনা হয়ে ফিরে আসেননি। সায়েন্স অব হেরিডিটি আছে। চেহারায় এমন মিল বিচিত্রভাবে একবংশে দেখা যায়। চরিত্রেও মিল হয়। অর্চনার সঙ্গে ভবানী দেবীর চেহারা চরিত্রের ঠিক সেই মিল। মেয়েটা অন্যায় কিছু সহ্য করতে পারবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এদের প্রতিবাদ থাকে—অর্চনারও আছে। রথীনের মদ খাওয়া কি ও সহ্য করতে পারবে? ভেবেছিলাম—ওকে ডেকে বলে দেব, সহ্য করে নিস অর্চনা। ও ডাক্তার মানুষ। একালের ডাক্তার। ১৯৩৮ সালের। দেখ, এককালে বীরেশ্বর রায়ের আমলে প্রবাদ ছিল রায়বাড়ীর ইটগুলো মদে ভিজিয়ে তৈরী করে পোড়ানো হয়েছিল। কীর্তিহাটের মাটি মদ খায়। সে গোটা বাংলা দেশেই। তারপর আবার মোড় ফিরেছিল। তারপর ফের আবার মোড় ফিরেছে রে। তোরা মাথার ঘোমটা টেনে নামিয়ে শুধু স্বাধীন জেনানা হতেই চাচ্ছিসনে, স্বাধীনতা আনবার জন্যে বোমা পিস্তল নিয়েও কারবার শুরু করেছিস। আমি বড়লোকের বাড়ীর পার্টির খবর জানি, মেয়েরা এখন হেল্থড্রিংকও করছেন। সুতরাং ও নিয়ে মাথা ঘামাসনে ভাই। লোকটাকে যদি ভালবেসে ফেরাতে পারিস তো ফেরা। নইলে মেনে নে। মনে হয়েছিল মানাতে পারবে অর্চনা।
এরপর জট মেজদিদি। তার জটও খুলে দিচ্ছেন বিধাতা। অথবা ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে আপনি খুলছে। মেজদিকে কীর্তিহাটের দেবসেবার ভার দিয়ে আমি ছুটি নেব।
ছুটি মানে কীর্তিহাট থেকে ছুটি, রায়বংশের গ্রন্থি খুলে ছুটি। চলে যাব, ঘুরে বেড়াব পৃথিবীময়। টাকা আছে আমার। ঘুরে বেড়াব। দুনিয়াময়। এবং একদিন কোথাও কোনও বিদেশে বা স্বদেশে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকব, একদিন চোখ বুজব। এবং এইসব কাহিনী লিখে যে সব ছবিগুলো তখন পর্যন্ত এঁকেছিলাম, সেগুলো তোমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে অ্যাটর্নী সলিসিটারকে দিয়ে যাব। আমার ঠাকুরদা দেবেশ্বর রায়, তাঁর ছোট ছেলে অর্থাৎ আমার বাবাকে খুব ভালবাসতেন। তাঁকে তিনি নিজের মনের মত করে গড়তে চেয়েছিলেন। আমার বাবা অর্ধেকটা হয়েছিলেন তাঁর মনের মত, অর্ধেকটা হয়েছিলেন তাঁর মত। তাঁকেও আমার ঠাকুরদা বলে গিয়েছিলেন।
Don’t marry,—my boy—একটি স্ত্রীলোক ছাড়া দুনিয়ার সব স্ত্রীলোককে যদি মা ভাবতে পার, বলতে পার, তবেই বিয়ে করো; and try to love her try to find out that Eternal She-in her. She is in every woman, just awaken her.
যদি চেষ্টা কর তবে নিশ্চয় একদিন ভালবাসা আসবে। পাবে—দেবে। তা যদি না পারো, তবে বিয়ে করো না। একা হয়ে থাক। তোমার নিজের মা; fortunately আমার কন্যা নেই, তোমার বোন নেই, সুতরাং তোমার মা ছাড়া সব নারীর কাছেই তুমি সেই চিরন্তন পুরুষ—Eternal He হতে পারবে। কোন অনুতাপ হবে না। কোন পাপ হবে না। শুধু নারীকে জয় করার মত শক্তি তোমার চাই। আর অনুতাপকে মনের ঘরে ঢুকতে দিতে না পারার শক্তি অর্জন করতে হবে তোমাকে।
বাবা আমার সাতাশ বছর পর্যন্ত সে কথা মেনে এসে, সাতাশ বছর বয়সে আমার মাকে বিয়ে করলেন। তারপর ঠাকুরদা যা বললেন তাই হল; অন্য একজন উয়োম্যান মিশ্র রক্তের লাবণ্যবতী চন্দ্রিকা এল এবং বাবাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।
বাবাও চিঠি লিখেছেন মাকে। যখন বম্বে থেকে চন্দ্রিকাকে নিয়ে তিনি ইউরোপ চলে যান তখন। লিখেছিলেন, “সুরেশ্বর যেন বিবাহ না করে। আমাদের বংশে অভিশাপ আছে। আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন। কারণ ঠিক জানি না, বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি, রায়বংশের ছেলে, তাদের রক্তে মদ্য এবং নারী সম্পর্কে একটা উদ্দাম ধারা আছে। এ হয়তো সকল পুরুষের মধ্যেই থাকা সম্ভব, কিন্তু যাদের এই ধারাটা সম্পত্তি, অর্থ সম্মানের একটা উঁচু ঢিবি বা পাহাড় বা পর্বত থেকে ঝরে, তখন সেটা জলপ্রপাতের মত সশব্দে ঝরে। একটু হাঁক-ডাক ক’রে ব্রাভাডো ক’রে এগুলো করে এবং এই সব মায়াময়ী, মোহময়ী যারা তারা এটা পছন্দ করে। সুরোর বেলা এর সম্ভাবনা খুব বেশী। তুমি তার বিয়ে দিয়ো না। সে বিয়ে করতে চাইলে তাকে বলো বা আমার এই চিঠি দেখিও। তার প্রতি আমার উপদেশ —Don’t marry. End our line with you.
কথাটা আমার মনে গেঁথে ছিল। বিয়ে করব নাই স্থির করেছিলাম। হঠাৎ মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে তুমি এলে। তোমার সঙ্গে পরিচয় বিচিত্রভাবে, ব্রজেশ্বরদার সেই শেফালিকে নিয়ে কেমন-চট করে একটা কথার জট পাকিয়ে গেল। তুমি বললে—ওর সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার না করলেই পারতেন! যাই হোক, ওরা-ওরাও তো মানুষ। মেয়েছেলে কথাটা সারাদিন মনে ঘুরল, সন্ধ্যেবেলা ট্যাক্সি করে গিয়ে শেফালির বাড়ী গেলাম, তার দুঃখ মোচন করে ফিরে এলাম সগৌরবে। তারপর একদিন গিয়ে দোরে দোরে যারা দেহের পসরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পেটের অন্নের জন্যে, তাদের টাকা দিয়ে ফিরে এসে তারই গৌরবে তোমার কাছে বিকিয়ে গেলাম। তারপর কীর্তিহাটে এসে পড়লাম, রায়বংশের বিষয় আর কৃতকর্মের ইতিহাসের ঘূর্ণিতে। ডুবেই গেলাম। তোমার হাত ছেড়ে দিলাম। নিজে ডুবতেই লাগলাম। টেনে তোমাকে ধরলে হয়তো তুমিই আমার গলা টিপে ধরবে বলে ভয় হল।
সেদিন ১৯৩৮ সালে, সেদিন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিট্রেট বি আর সেনের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে মনে হল, যেন ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠলাম। এবার ছুটি পাব। ভাবলাম কি জান, ভাবলাম অর্চনার বিয়ে হয়ে গেছে, মেজদি আমার খালাস পাচ্ছেন, এবার আমি খালাস। জমিদারীর দেবোত্তর যেমন আছে তেমনি থাকবে, সে ওই মেজতরফই আপন গরজে রক্ষা করবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে পত্তনী-স্বত্ব কিনে কিনে যে সম্পত্তির মালিক হয়েছি, তা সব বেচে দিয়ে চলে যাব; আর ফিরব না। অন্ততঃ কীর্তিহাটে আর না। কলকাতার জানবাজারের বাড়ী কলকাতার অন্য সম্পত্তি, তাও সব বিক্রীটিক্রি করে চলে যাব ইউরোপ, অথবা আমেরিকা, অথবা প্যাসিফিকের কোন দ্বীপে। সেখানে চাষবাস করব, ছবি আঁকব। আর enjoy করব life।
আজও আমার মনের মধ্যে সেদিনের সেই স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে যেন হয়তো বা এইমাত্র ঘটে গেছে। মনে পড়লে সেদিনের সেই ইমোশনের স্পর্শও যেন পাই। বলতে পারি, তোমাকে সেদিন আমার এই কল্পনা ‘টু এনজয় লাইফ’ ‘এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া’–এর মূলে ছিলে হয়তো তুমি। হয়তো বলছি এই কারণে যে, আমি হলপ করে বলতে পারব না যে সে তুমি। সে একজন নারী! যে নারীর বন্ধনে চাষী বাঁধা আছে, মজুর বাঁধা আছে, গৃহস্থ বাঁধা আছে, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, প্রজা, জমিদার, মহাজন, রাজা-মহারাজা, সম্রাট সবাই বাঁধা আছে; তেমনি একজন নারী। যে বিপ্লবীরা তখন আগুন নিয়ে খেলা করে, ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেয়, তাদের কথা ঠিক জানিনে, বলতে পারব না; মনের গভীরের গভীরে কেউ আছেন কিনা যাকে তারা দেশের পর্যায়ে পূজোর ফুলের মত ঢেলে দিয়ে নির্মাল্য করে দেয়। যাদের বাঁধন কেটে বেরিয়ে গেলে তবে গৌতম পরমবুদ্ধ হন, নিমাই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হন, তেমনি একজন কেউ ছিল। তার মুখ শিল্যুটের ছবির মত দেখছিলাম। পিছনে ঝলমল করছে আলো, আর সে আমার ঘরে দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকছে। আমি তাকে ঠিক শিল্যুটের ছবির মত দেখছি। আমি বসে গভীর চিন্তায় যেন ডুব ছিলাম। ভাবছিলাম এই সব কথাই। ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল একটি নয়, দুটি মেয়ে। শিল্যুটের মত।
শিল্যুটের মত হতে একজনকে চিনতাম, একজন কুইনি; তাকে একদিন বিবিমহলের ছাদের উপর থেকে এমনি শিল্যুটের মত দেখেছিলাম। কিন্তু অনেকটা দূরে ছিল বলে ছোট দেখিয়েছিল এর থেকে। আর একজনকে চিনলাম না; অপরিচিতা গাউন পরা একটি মেয়ে। তাদের সঙ্গে হিলডা।
অন্নপূর্ণা-মার কথা নিশ্চয় মনে আছে, তিনি তাঁর সোনাভাইপোর প্রথম প্রণয়ের ফলের বংশোদ্ভূতা এই মেয়েটিকে শুধু আমাকে দিয়ে বাড়ীই ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেননি, তাকে পড়িয়ে কোন দেশী ক্রীশ্চানের সঙ্গে বিয়ে দেবার অঙ্গীকার আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। আমি তাকে মেদিনীপুর ক্রীশ্চান মিশনে ভর্তি করতে গিয়ে ভর্তি করিনি। কারণ সেখানে অধিকাংশই ছিল সাঁওতাল আর চুয়াড়দের মেয়ে। তাদের লেখাপড়া কতদূর কি হয় তা বলতে পারব না, তবে আবহাওয়াটা আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। শুধু আমারই বা কেন, বুড়ী হিলডা এসেছিল সঙ্গে, তারও হয়নি। সে বুড়ী হয়েছে, মুখে তার মাকড়শার জালের মত বার্ধক্যের হিজিবিজি রেখা পড়েছে, কিন্তু তার চোখ এবং রঙের মধ্যে একটা পিঙ্গলাভা আছে, ঘষা তামার মত রঙ, যার গৌরব ওরা এখনও করে। সেটা বরং কুইনির মধ্যেই নেই, থাকলেও ঈষৎ যৎসামান্য, চোখের তারায় শ্বেত রক্তের একটা ছাপ আছে। হিলডা বলেছিল—না বাবুসাহেব, ই জাগায় নেহি। ইতো সব কালা-আদমীর মিশন আছে। না-না-না। আমাদের হারমাদী খুন, হারমাদী ইজ্জৎ, না-না। ইখানে কুইনিকে দিব না।
তার জন্যই তাকে শেষ পর্যন্ত দিয়েছিলাম খড়্গপুরে। ওখানে ক্রীশ্চান আছে অনেক; অ্যাংলো আছে; রেলওয়ে ইস্কুল আছে, মেয়েদের বোর্ডিং আছে। সেখানেই কুইনির পড়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। হিলডা খুশী হয়েছিল, কুইনিও খুশী হয়েছিল।
সেদিন কুইনি ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বলেছিল- নমস্কার স্যার!
মনটা যেন আমার চমকে উঠল। শুধু মন কেন, মন দেহ সব। আচমকা কেউ কিছু বললে যেমন চমকে ওঠে মানুষ ঠিক তেমনি। ঠিক তেমনিই, তবু যেন তার সঙ্গে আরও কিছু ছিল। হ্যাঁ, আরও কিছু। পরে নিজেকে বিশ্লেষণ করেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি তার সত্যস্বরূপ। সে পরে বলছি। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মেয়েটিকে যেন বড় আপনার মনে হল, আমার একান্ত করে নিজস্ব সম্পত্তির মত, হ্যাঁ সুলতা, তাই ঠিক, তাই মনে হল। বুকের ভিতরে রক্ত যেন চলকে উঠল। সে চলকানো কখনো তোমার সঙ্গে ইডেন গার্ডেনস-এ বেড়াতে গিয়েও হয়নি।
কণ্ঠস্বরে তার আভাস ফুটে উঠল, মুখের ভাবে, চোখের দৃষ্টিতেও তার প্রতিভাস ফুটেছিল। বলে উঠলাম—কুইনি!
মেয়েটা থমকে গেল। অত্যন্ত সংযত কণ্ঠে দৃষ্টি নামিয়ে আমাকে বললে—একটা কাজে এসেছি আপনার কাছে। কোর্টে গিয়েছিলাম, সেখানে শুনলাম আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন, এখুনি ডি-এম-এর সঙ্গে দেখা করে বাসায় এসেছেন। দিদি বললে—
হিলডা সেলাম করে বললে—হ্যাঁ হুজুর, আমি বললাম। উরা শুনতে চায় না। ওদের খুন তেজী আছে, গরম আছে। দরখাস দিতে যাচ্ছিল হুজুর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে। হামাদের উখানে হামরা হুজুর কংগিরিসকে ভোট দিলাম না। কংগিরিস ইংরাজ ক্রীশ্চান লোকের দুশমনি করে। হামি লোক কিরিশ্চান, হামি লোক কংগিরিসকে ভোট দিলাম না।
কুইনি তাকে বাধা দিয়ে বললে—তুমি থাম দিদিয়া। আমি বলছি। মিসেস হাডসন আসুন, আমরা সব বুঝিয়ে বলব। তুমি খুব বেশী বক। থাম একটু।
আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম সুলতা। এই কয়েক মাসের মধ্যেই কুইনি কত পাল্টে গেছে! তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
কংগ্রেসকে ভোট না দেওয়ার জন্য গোটা কীর্তিহাট গোয়ানদের উপর বিরূপ হয়েছে। তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন জগদীশ্বরকাকা, অর্চনার বাবা আর বিমলেশ্বর -অতুলেশ্বরের ঠিক উপরের বড়ভাই। পরশু যাকে আমি হাত মুচড়ে ধরেছিলাম ইতরামির জন্য সে-ই। তার সঙ্গে রঙলাল ঘোষ আছেন। বৃদ্ধ রঙলাল ঘোষ নাকি বলেছেন—ইংরেজ সরকারের সঙ্গে লড়াই হবে, সে বড় লড়াই। সে লড়াই করবেন গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল, বল্লভভাই প্যাটেল, বীরেন শাসমল। এখানে গোয়ানদের সঙ্গে লড়ব আমরা।
হিলডা নিজে এসেছিল রঙলালের কাছে। আপনে ঘোষ, এমুন বাত কাহে বললেন?
বুক চাপড়ে রঙ্গলাল বলেছেন- হামারা খুশী। তারপর বলেছেন—এইবার শোধ হবে আমার পিসের খুনের! পিড়ুজের ফাঁসিতে শোধ হয় নাই!
সেই সব খবর খড়্গপুরের ক্রীশ্চানেরা আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানেরা পেয়েছে, খড়্গপুর ক্রীশ্চান গার্লস হোস্টেলবাসিনী কুইনির কাছে এবং গোয়ানপাড়া গিয়ে হিলডাকে এবং কুইনিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে মেদিনীপুর ডি-এম-এর কাছে দরখাস্ত করতে। একদিকে ১৯৩০-এর সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স সল্ট মুভমেন্ট, আর পেডি বার্জ ডগলাস মার্ডার করা মেদিনীপুরের প্রচণ্ড ভয়, অন্যদিকে মিলিটারী বুটের থেঁতলানি আর পিউনিটিভ ট্যাক্সের ভারে জর্জরিত মেদিনীপুরে গোয়ানপাড়া থেকে খড়্গপুর অবধি অ্যাংলোদের এবং বিদেশী উপাধিধারী কালো ক্রীশ্চানদের অবস্থা ক্ষুরের ধারের উপর দিয়ে হেঁটে চলার মত মর্মান্তিক। ভয়ে রাত্রে ঘুম হয় না, দিনে আস্ফালন করে তাড়ির নেশায় প্রমত্তের মত।
১৯৩০ সাল থেকে বাংলা দেশের সে যুদ্ধের কথা ঐতিহাসিক। সে তো বলার প্রয়োজন নেই, তবু আমার জবানবন্দীর সেদিনের এই ঘটনাটির জন্য উল্লেখের প্রয়োজন আছে, মেদিনীপুরের কথা আগে বলেছি, তার সঙ্গে একটা কথা বলা হয় নি, ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসেছেন নেতৃত্বের আসনে। সদ্য তিনি তখন বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন, আয়ারল্যাণ্ডের বিপ্লবী নেতা ডি ভ্যালেরার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এদিকে নতুন ইলেকশনে গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজের শক্তি, অহঙ্কার রাষ্ট্রনৈতিক বুদ্ধিকে চমকে দিয়ে তার সমস্ত প্রতিক্রিয়ার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে কংগ্রেস সব Province- এ ministry form করেছে। পারেনি সিন্ধু আর বাংলায়। মুসলীম লীগের নায়ক জিন্নাসাহেব স্থির করেছিলেন চিরকালের জন্যে চলে যাবেন ইংলন্ডে। কিন্তু দুটি প্রদেশে দুটি পা রাখবার জায়গা পেয়ে তিনি জিনিসপত্র লগেজের বাঁধনের গিঁট খুলে ফেলেছেন।
মনে একটা ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে ছিলাম কুইনির মুখের দিকে। তাকিয়ে ভাবছিলাম, নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, কুইনি আমার আপনজন নয়?
কুইনি অস্বস্তিবোধ করছিল বোধ হয়। আমার দৃষ্টিতে নিশ্চয় অস্বস্তিকর কিছু ছিল। নিজের দৃষ্টি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, সামনে আমার আয়না ছিল মা, আমি আমার দৃষ্টির প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম কুইনির চোখে। কুইনি বললে—দেখুন, নেহাত দিদিয়া বললে, সুরেশ্বরবাবু যখন এখানে রয়েছে, তখন আগে তাঁর কাছে যাব। তাঁকে না বলে কিছু করব না, কাউকে কিছু করতে দেব না। নিমকহারামী হবে। তাই ডি-এম-এর কাছে যাবার আগে আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি এর প্রতিবিধান করতে পারবেন?
আমি কিছু বলবার আগেই মিসেস হাডসন বললে—Won’t you ask us to sit down Babu?
অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, বসতে বললাম; রঘুয়াকে বললাম—ভাল মিষ্টি আনতে। চা করতে।
অতিথিদের আপ্যায়ন করে বিদায় করলাম। বললাম—আমি তোমাদের ডি-এম-এর কাছে যেতেও বলব না, বারণও করব না। জমিদার হিসেবে আজ আর আমার খাজনা আদায় করে সরকারের প্রাপ্য সরকারী মালখানায় জমা দিয়ে বাকীটা নিজের জন্যে জমানো বা নিজে ভোগ করা ছাড়া করণীয় কিছুই নেই। বড়জোর দু-দশ টাকা চাঁদা দিতে পারি। দেওয়া উচিত বলে মনে করি। তার বেশী কিছু নয়। তবু কীর্তিহাটে গিয়ে একথা বলব আমি। বলব এই পর্যন্ত। যেমন ঠিক তোমাদের বলছি। তার বেশী কিছু নয়।
—বাস্। বাস্। ওই সে হোয়ে যাবে কুইনি। বাস্ করো। ছোটবাবু রাজাবাবু যখন বলিয়েছেন, তখন জরুর সব মিটমাট হো যায়ে গা। দরখাস-অরখাস দেনে কা কুছ জরুরৎ নেহি। চল বাবা, ঘর চল।
মিসেস হাডসন’ কুইনিকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেল। পরামর্শ করলে। তারপর ফিরে এসে বললে—বেশ তাই হল। আপনি চেষ্টা করে দেখুন। আমরা অপেক্ষা করব তার জন্য। ওরা চলে গেল। শুধু হিলডা যাবার সময় বলে গেল—বাবুসাহেব!
—বল হিলডা!
—হামার পর, কুইনির পর আপনে গোস্যা করো না। আপনের পর হামিলোগের কোই নালিশ নেহি, কুছ না!
—না-না হিলডা। তা আমি ভাবিনি।
কাতরভাবে হিলডা বললে—বহুৎ জুলুম করছে বাবু, বহুৎ জুলুম!
—আমি বারণ করব। ওদের অনুরোধ করব। তোমরা ভেবো না।
* * *
সন্ধ্যাবেলা থেকে সেদিন আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমার সমস্ত জীবনের মধ্যে এই রাত্রিটি আমার একটি স্মরণীয় রাত্রি। অবিস্মরণীয়। ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না।
বুঝতে পারলাম ওই কুইনি মেয়েটা আমার সমস্ত দেহ-মনকে এক আশ্চর্য মোহে মোহাচ্ছন্ন করে তুলেছে।
প্রথমে মনে হল, এ আমার রক্তের ধারা। রায়বংশের জীবনের অভ্যাস রক্তস্রোতের মধ্যে একটা রোগের বীজাণুর মত মিশে রয়েছে। সংসারে আজও এমন কোন ছাঁকনি তৈরী হয় নি, যা দিয়ে একে ছেঁকে শোধন করা যায়।
রঘুয়াকে ডেকে বললাম -বাজারে যা, এক বোতল হুইস্কি কিনে আন।
রঘুয়া বললে-আছে।
—আছে? অন্নপূর্ণা-মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে শপথ করেছিলাম, মদও আর খাব না। সে আজ ছ-সাত মাস হয়ে গেল। তবু রঘুয়া বলছে, আছে!
রঘুয়া আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বললে—আগেও তো তিন-চার দফে ছোড়া, আওর ফের এক রোজ হুকুম হল কি রঘুয়া লে আয় হুইস্কি! তো দো-তিন বোতল তখন বাক্সমে ছিলো, রেখে দিলাম। আনব?
—আন।
—ইখানে? এই রাস্তার সামনা ঘরমে? উপর চলো। হামি থোড়া কুছ খানাকে সঙ্গে সব তৈয়ার করে দি!
বললাম- দে।
রঘু চলে গেল। আমিও উপরের ঘরে পায়চারি করছিলাম, আর ভাবছিলাম, ভাবছিলাম ওই কুইনির কথা। ওই কিশোরীটির মুখে-চোখে, সকল তনু ঘিরে থাকা একটা আশ্চর্য মোহ আমাকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে। রায়বংশের স্রোতের মুখে ওই তনুখানিকে যেন একখানি কুমারী তরণীর মত নিজের ভাগ্যের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
মনে মনে প্রশ্ন করেছিলাম, কই, সুলতাকে নিয়ে তো এমন কল্পনা করনি? কুইনিকে নিয়ে কেন?
চট করে মন উত্তর দিয়েছিল, সুলতা তোমার দ্বারা উপকৃতা নয়; তোমার অধিকারের মধ্যে সে বাস করে না। তোমার দানের অর্থে সে অন্নে শিক্ষায় দেহ-মনকে পুষ্ট করছে না।
বোধ করি ওর একটা দাবী আছে। আগের কালে এ দাবী ছিল সোচ্চার ঘোষিত। জীবনে এবং জগতে সব ভ্যালুর মধ্যে সম্পদের ভ্যালু হল প্রত্যক্ষ স্পষ্ট; ওর স্ট্যান্ডার্ড–গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে মাপ করা। তার সঙ্গে শক্তি, রাষ্ট্রশক্তি, মালিকানিশক্তি এক হলে তো রক্ষে থাকে না। আহমেদ শাহ আবদালীর ইতিহাসটা পড়া ছিল আমার ভাল করে। অন্তত মনে ছিল। শাহ আবদালীর নাকটা বসে গিয়েছিল, সেখানে চিরস্থায়ী একটা ক্ষত ছিল; ক্ষতটা কুষ্ঠরোগের। সেই আবদালী ষাট বছর বয়সে যখন দিল্লীর রঙমহলে ঢুকল, তখন দিল্লীর বাদশাহ বংশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ষোল-সতেরো কি আঠারো বছরের হজরত বেগমের দেহ-মন দাবী করে বললে—চাই, হজরৎ বেগমের দেহের মনের আমি হকদার।
আমার মনের কামনাও তারই হয়তো অবশেষ। নদীটা শুকিয়ে এসেছে, ১৭৫৭ সাল আর ১৯৩৮ সাল, ১৮১ বছরের মধ্যে। নদীটার উপরে স্রোত নেই, কিন্তু বালির তলে তলে স্রোত আজও বইছে, আজও বইছে। রত্নেশ্বর রায় অঞ্জনাকে করতলগত করে পাথরের দেবতার মত দৃষ্টিভোগে সন্তুষ্ট ছিলেন। তার ছেলে দেবেশ্বর রায় ভায়লেটকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন, কৈশোর-চাপল্যে। আমি তাঁর পৌত্র, সুরেশ্বর। কুইনিও ওই অঞ্জনার বংশের। আমি তাকে চোরাবালির মত গ্রাস করতে চাচ্ছি।
ঘুরতে ঘুরতে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। কিছু চাই। কিছু চাই। মনে পড়ল, অন্নপূর্ণা-মার দেওয়া কাগজের বান্ডিলটার কথা। স্যুটকেস খুলে তাই নিয়ে বসলাম। রঘু বোতল এনে নামিয়ে রাখলে টেবিলের উপর।
সুরেশ্বর বললে—১৯৩৮ সালের সেদিন মার্চের ৩০শে। তারিখটা আমার মনে আছে সুলতা। কীর্তিহাটের রায়বংশের রত্নেশ্বর রায় আর দেবেশ্বর রায়ের পিতাপুত্রের বিস্ময়কর দ্বন্দ্বের কাহিনীর সবটুকু জেনে শেষ করেছিলাম। কড়চা বল জবানবন্দী বল তার উপাদান সংগ্রহ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সারারাত্রি জেগে অন্নপূর্ণা-মা’র দেওয়া কাগজপত্রগুলি পড়ে শেষ করেছিলাম ভোরবেলা পর্যন্ত।
বাপের সঙ্গে দেবেশ্বর রায়ের এই সংগ্রাম শুরু হয়েছিল শৈশবে। পরস্পরের অজ্ঞাতসারেই শুরু হয়েছিল। শুরু ক’রে দিয়ে গিয়েছিল অঞ্জনা। অল্প কিছুটা বয়স হতেই দেবেশ্বরের আশ্রয় মায়ের কোল থেকে গিয়ে নির্দিষ্ট হয়েছিল অঞ্জনার কোলে। চার বছর বয়স থেকে; তখন সরস্বতী বউয়ের গর্ভে এসেছে আর একজন।
সেই সময় অঞ্জনার কাছে শুয়ে সে কাঁদত। অঞ্জনাও মধ্যে মধ্যে কাঁদত। দেবেশ্বর কাঁদতেন মায়ের কোলের জন্য। অঞ্জনা কাঁদত ব্যর্থ জীবনের জন্য। দুজনেই দায়ী করেছিল রত্নেশ্বরকে। রত্নেশ্বরের চরিত্রগৌরবের মধ্যে যাই থাক, সে হীরে মতি পান্না নীলা যাই হোক, তার স্পর্শ, তার দীপ্তি, সবই ছিল বড় রূঢ় উত্তপ্ত। তাঁর কণ্ঠস্বরে সঙ্গীত ছিল। কিন্তু সঙ্গীত সভয়ে বিদায় নিয়েছিল।
এগুলো অস্পষ্ট। প্রথম স্পষ্ট হয়েছে যেদিন অঞ্জনা প্রথম বদ্ধ ঘরের মধ্যে রত্নেশ্বর রায়ের সঙ্গে সমানে জবাব করেছে। তখন সরস্বতী বউ আঁতুড়ঘরে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে মারা গেছে, প্রসূতি অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে। তারই অবসরের মধ্যে রত্নেশ্বর রায় সন্ধান পেয়েছেন অঞ্জনা এবং আলফাসোর সঙ্গে একটা কিছুর পালা চলেছে। এবং সে পালাটা আছে রত্নেশ্বরের ডায়রীর মধ্যে সে তুমি শুনেছ। ঘণ্টা দুয়েক আগে ডায়রী থেকে পড়ে শুনিয়েছি। দেবেশ্বর সেটা শুনেছিলেন।
জীবনের প্রায় শেষকালে, তখনও তিনি যুবক, বাংলাদেশের বিদগ্ধ মানুষের সমাজের একজন উজ্জ্বল মানুষ, বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হয়নি—তখন তিনি রাঙাপিসীকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠিতে আছে এ-সংবাদটা। রত্নেশ্বর রায়ের পাশেই ঘরটাই ছিল দেবেশ্বরের ঘর, এই ঘরেই অঞ্জনা দেবেশ্বরকে নিয়ে থাকতেন। সরস্বতী বউ আঁতুড়ঘরে। বাড়ীর এক প্রান্তে।
অঞ্জনার সঙ্গে কথা বলবার সময় সাবধান হতে ভোলেন নি রত্নেশ্বর। সেদিকে দৃষ্টিহীন বা ভ্রূক্ষেপহীন তিনি ছিলেন না। বাড়ীটার বারান্দার দু মাথায় পাহারা রেখেই কথা বলছিলেন অঞ্জনার সঙ্গে। হুকুম ছিল কেউ যেন না আসে। কিন্তু তারা চার বছরের দেবেশ্বরকে কেউ এর মধ্যে ফেলে নি। ফেলতে পারে নি। হয়তো মনেই হয় নি। দেবেশ্বর ছিলেন মায়ের আঁতুড়ঘরের বাইরে বারান্দায় বসে, সেখান থেকে এসেছিলেন অঞ্জনার খোঁজে। তাঁকে কেউ আটকায় নি। কিন্তু কিছুটা এসে নিজেই যেন আটকে গিছলেন, বাবার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অঞ্জনা পিসীর কণ্ঠস্বরের পাল্লায় ভয় পেয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন অঞ্জনা পিসীকে বকছে। অঞ্জনা পিসী সমানে উত্তর করছে। এমন কখনও ভাবতে পারেন না তখন দেবেশ্বর।
ঘরের দরজার কোণে দাঁড়িয়ে তিনি যত কেঁদেছিলেন তার সবটাই অঞ্জনা পিসীর জন্যে। আর রাগ হয়েছিল বাবার উপরে।
“এই রাগ তিলে তিলে বৃদ্ধি পাইয়া এক পর্বত সৃষ্টি হইতেছিল রাঙাপিসী। বাল্যকালে তিনি কদাচ আমাকে সমাদর করিয়াছেন। শুধু শিক্ষাই দিয়াছেন। কীর্তিহাটের প্রতিটি ব্যক্তিকে দেখিয়াছি, তাহাদের সে কি ভয়!
রাঙাপিসী, নিত্য প্রভাত হইতে নানা স্থানের প্রজারা আসিত; তাহারা অগ্রে আসিয়া কাছারীতে সেলামী জমা দিয়া সেরেস্তায় আগমনের কারণ জানাইত, তাহার পর মা কালীর নাটমন্দিরে গিয়া মা কালীকে প্রণাম করিত। রাজরাজেশ্বরকে প্রণাম করিত। তখনও রাধাসুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয় নাই। তুমি জান রাঙাপিসী, এই যুগল বিগ্রহ আমার ভিক্ষা-মা ও ভিক্ষা-বাবার। সে কথা পরে বলিব। আগের কথা আগে লিখি।
রাঙাপিসী, কীর্তিহাটের চাউল এবং ধান্যেরও জমাখরচের খাতা আছে; নিত্য প্রায় এক মণ চাউল খরচ হইত দেবোত্তরে। প্রায় একশত জনের খাদ্য। প্রজা কোনদিন পঞ্চাশ, কোনদিন ষাট, কোনদিন সত্তর-আশী আসিয়াছে। সকলেই সেলামী দিয়াছে। তাহারা অন্নের মূল্য দিয়া অন্ন গ্রহণ করিয়াছে। তাদের সকলেরই প্রার্থনা এক—হুজুর মা-বাপ; হুজুর রক্ষা করুন। ডিক্রীর টাকা দিতে হইলে আমাকে সর্বস্বান্ত হইতে হইবে।
আমার পিতার মুখ যেন প্রস্তরে গঠিত মুখ। তাঁহার এক কথা। “আইন অনুসারে যাহা প্রাপ্য তাহার অতিরিক্ত এক কপর্দক আমার দাবী নহে। ডিক্রীর টাকা ছাড়িতে হইলে একদিন আমাকেও সর্বস্বান্ত হইতে হইবে। সম্পত্তি প্রথমতঃ দেবোত্তর, মালিক দেবতা, দ্বিতীয়তঃ এ সম্পত্তি রায়বংশের আগামী পুরুষদের, ইহাকে আমি কোনক্রমেই ক্ষয় করিতে পারি না। ন্যায্য প্রাপ্য ছাড়িয়া দিবার অধিকার আমার নাই। কথা কয়টি শেষ হইতে-না-হইতে দারোয়ান তাহাকে বলিত—’উঠো বাহার চলো। উঠো উঠো!’
দ্বিতীয় জনের ডাক হইত। সেই একই কথা।
পিসী, প্রথম প্রথম মনে একটা ভয় হইত, একটা গভীর শ্রদ্ধা এবং বিস্ময় জাগ্রত হইয়া আমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিত। তাহার উপর তাঁহার কঠিন চরিত্র। রাঙাপিসী, অঞ্জনা পিসীর সঙ্গে তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়াছিলাম কিন্তু তাহার অর্থ বুঝি নাই। বুঝিয়াছিলাম অঞ্জনা পিসী বাবাকে কঠিন কথা বলিল। বাবার শাসন সে গ্রাহ্য করিল না। ইহার পর হঠাৎ সে চলিয়া গেল, লোকে তাহার নিন্দা করিল; “কুলের বাহির হইয়া গিয়াছে” কথাটা শুনিলাম কিন্তু ঠিক বুঝিলাম না, তবে কাজটা অত্যন্ত ঘৃণ্য তাহা বুঝিলাম। বাবার ক্রোধ দেখিলাম। একটা গোয়ান ছোকরা, সে ইহাতে লিপ্ত ছিল। আলফানসোর সহকারী হিসাবে, ঘোড়া দেখাশোনা করিত, সে কোথায় হারাইয়া গেল। শুনিলাম তাহাকে কাটিয়া গঙ্গায় ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে, বাবামহাশয়ের হুকুমে। কারণ সে আলফানসোকে সাহায্য করিয়াছিল। আমার ভয় আরও বাড়িল। মনে হইল, বাবা এত নিষ্ঠুর কেন? তাহার পরই নিজের ভয় হইল। বাবার মত পুণ্যাত্মা ধার্মিক লোক, তাঁহার যে নিষ্ঠুর না হইয়া উপায় নাই। কি করিবেন? পাপীকে দণ্ড তিনি না দিলে কে দিবে! শিহরিয়া উঠিলাম।
কিন্তু একদিন আর মানিতে পারিলাম না। একদিন দেখিলাম, নাটমন্দিরে কালীমায়ের সম্মুখে একজন অর্ধ-উন্মাদিনী যুবতী বুক চাপড়াইয়া চীৎকার করিতেছে। মস্তকে অবগুণ্ঠন নাই, কেশরাশি এলাইয়া পড়িয়াছে, বক্ষের বস্ত্রও খসিয়া গিয়াছে, ভ্রূক্ষেপ নাই, সে বুক চাপড়াইয়া চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিতেছে। বলিতেছে—এই বিচার? এই বিচার? মানি না, এ বিচার মানি না, মানব না।
কীর্তিহাটের কাছারীবাড়ী ও ওদিকে নাটমন্দিরের চারিদিকে গোমস্তা, নায়েব, আমলা, পাইক, চাপরাশি, পূজক-পুরোহিত, পরিচারক প্রভৃতি দাঁড়াইয়া গিয়াছে স্তম্ভিতের মত। এই উন্মাদিনীর ভয় নাই, সঙ্কোচ নাই, জিহ্বার আগলবাঁধ নাই সে কীর্তিহাটের রত্নেশ্বর রায়কে তিরস্কার—তাই বা কেন, গালিগালাজ করিয়া চলিয়াছে। আমিও অবাক হইয়া বাড়ীর ভিতরের দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলাম।
এমন সময় বাবামহাশয়ের গলার সাড়া পাওয়া গেল। তিনি তাঁহার খাস কাছারী হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিলেন—সকলে আপন আপন কাজে চলিয়া যাও। কোন ব্যক্তি দাঁড়াইয়া থাকিয়ো না।
সে-কণ্ঠস্বর, সে হুকুমজারীর ভঙ্গি উপেক্ষা করিতে কাহারও সাধ্য ছিল না। সকলেই চলিয়া গেল। বাহিরে ফটকের সামনে কতকগুলো লোক, তাহারা বাহিরের লোক, দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল, তাহারাও সভয়ে প্রস্থান করল। আমিও ভয় পাইয়া পলাইয়া গেলাম। কিন্তু আমার বুকের ভিতরটা কেমন করিতেছিল, কান্না পাইতেছিল—আশঙ্কা হইতেছিল যে, এইবার বোধ হয় বাবা ওই হতভাগিনীকে তলোয়ার দিয়া কাটিয়া ফেলিবেন। ওই স্ত্রীলোকটি দরিদ্র বটে কিন্তু নীচজাতীয়া নয়, তাহার আকৃতি ও রূপের মধ্যেই তা পরিস্ফুট ছিল। এবং তাহার আকৃতি ও রূপের মধ্যে এমন কিছু ছিল, যাহা আমার মত সাত-আট বৎসরের বালকের মনকেও দয়ার্দ্র করিয়া তুলিয়াছিল। তাই পলাইয়া গিয়াও পলাইতে পারিলাম না। ফিরিয়া গেলাম ছাদের উপর, সেখানে আলসের আড়ালে লুকাইয়া ফাঁক দিয়া দেখিতে লাগিলাম ও শুনিতে লাগিলাম। এতক্ষণে দৃষ্টিতে পড়িল যে মেয়েটির সামনে নাটমন্দিরে এক প্রৌঢ় মাথায় হাত দিয়া চুপ করিয়া নতদৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া আছে। লোকটার মাথা ফাটিয়া গিয়াছে। কপালে রক্ত গড়াইয়া পড়িতেছে। স্ত্রীলোকটি বাবামহাশয়কে দেখিয়া পায়ে আছাড় খাইয়া পড়িল —বাবুমহাশয় দয়া করুন, বাবুমহাশয় কৃপা করুন। বিবেচনা করিয়া বিচার করুন বাবুমহাশয়।
রাঙাপিসী, আজও আমি স্পষ্ট দেখিতে পাই যে, ওই উন্মাদিনী মেয়েটির উচ্চ ব্যাকুল কণ্ঠস্বর, তাহার বক্ষের আকুতি-মিনতি আমার বাবামহাশয়ের দিকে তাকাইয়া ধীরে ধীরে স্তিমিত হইয়া আসিতে লাগিল। বাবামহাশয়ও তাহার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাইয়া ছিলেন। ক্রমে ক্রমে মেয়েটির কণ্ঠস্বর যেন কেহ বন্ধ করিয়া দিল—হাত দুইটা দিয়া যে বুক চাপড়াইতেছিল, সে হাত দুইটা যেন অবশ হইয়া শুধু যুক্তকর হইয়া রহিল।
বাবামহাশয় বলিলেন—তোদের স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে যে নালিশ, তাহা কি মিথ্যা? এই কালীমাতার সম্মুখে তাঁহার নির্মাল্য হাতে লইয়া বলিতে পারিস?
মেয়েটি নীরব হইয়া গেল।
পুরুষটির মাথা আরও নত হইল। বাবামশায় বলিলেন- বল্, সত্য কিনা বল!
পুরুষটি এবার বাবার পায়ে পড়িয়া বলিল—সত্য। কিন্তু হুজুর, আপনি সব শুনিয়া বিচার করিয়া—
বাবামহাশয় সিংহগর্জনে বলিলেন—বাহির হইয়া যা। তুই পাপিষ্ঠ, আর ওটা পাপিষ্ঠা; যা যা, এখুনি বাহির হইয়া যা। আমার মন্দির অপবিত্র হইয়াছে। যাহা বিচার হইয়াছে, তাহা সত্য বিচার হইয়াছে। যা–বাহির হইয়া যা। যা এবং তিন দিনের মধ্যে গ্রাম ছাড়িয়া তোদের চলিয়া যাইতে হইবে।
তাহারা চলিয়া গেল। সে-সময়টা বৈশাখ মাস, বেলা তখন দ্বিপ্রহর, মেয়েটি ও পুরুষটি নতমস্তকে নীরবে বাহির হইয়া গেল, যাইবার সময় মেয়েটি একটি থামের ছায়ায় শায়িত ঘুমন্ত একটি শিশুকে কোলে করিয়া চলিয়া গেল।
এ বিচারের কারণ শুনিয়া বাবা সম্পর্কে আমার ভয় আরও বাড়িয়াছিল। মনে হইয়াছিল—বাবামহাশয় বিচারক—বিধাতার মূর্তিমস্ত অবতার।
কারণ কি জান?
এই প্রৌঢ় ব্যক্তিটি একজন বিশেষ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, যাহারা কন্যা বিক্রয় করে। বিবাহের সময় কন্যার পিতাকে পণ দিয়া বিবাহ করিতে হয়। এই প্রৌঢ়টি জল-অচল হিন্দুদের মধ্যে পূজা-অর্চনা ও পৌরোহিত্য করিত। পৈতৃক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তিল তিল করিয়া পয়সা জমাইয়া অবস্থা বেশ সচ্ছল করিয়া তুলিয়া একদা বিবাহ করিয়া সংসারী হইবার সাধ হইয়াছিল। এবং একটি আট বৎসরের পিতৃহীনা কন্যাকে প্রায় চারিশত টাকা পণ দিয়া বিবাহ করিয়া ঘরদুয়ার সাজাইয়া পাতিয়াছিল। সময়টা তখন দুর্ভিক্ষের সময়—মেদিনীপুরে ১৮৬৪ সালে সাইক্লোন ঝড়ের পর দারুণ দুর্ভিক্ষ হয়। সেই সময় এই লোকটি সমস্ত শ্বশুরবাড়ীর লোকদের বাঁচাইয়াছিল। কন্যাটির মাতা ও ভ্রাতাদের পর্যন্ত স্বগৃহে আনিয়া রাখিয়াছিল। এই ব্রাহ্মণ প্রৌঢ় এইভাবেই প্রায় খেলাঘরের বরকনে খেলা শুরু করিয়া, যখন কন্যাটি যৌবনে উপনীত হইল, তখন একদা হতভাগ্য পথের মধ্যে পড়িয়া গিয়া কোমরে আঘাত পাইয়া একেবারে কোমরভাঙা কুব্জ হইয়া গেল, সেই সঙ্গে তাহার পুরুষ-জীবনের সকল শক্তি তিরোহিত হইল।
.