চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ৩

অন্নপূর্ণা-মাকে আমি যত দেখছিলাম, ততই যেন অভিভূত হচ্ছিলাম। বিশেষ করে জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন থেকে। তাই বা কেন সুলতা, সেই যেদিন উনি রথীনকে সঙ্গে করে এনে বিয়েতে রথীনের সম্মতি দেওয়ালেন এবং নিজে দেখলেন কুইনিকে আর হিলডাকে, সেইদিন থেকেই। আমি দেখেই যাচ্ছিলাম আর এইটুকু বুঝছিলাম যে, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে যা আছে, রায় কোম্পানীর সঙ্গে ভায়লেট পিড়ুজের পত্রালাপের মধ্যে যা আছে, দেবেশ্বর রায়ের একখানা চিঠির মধ্যে যা আছে, তার চেয়েও আরও কিছু বেশী জানেন অন্নপূর্ণা-মা।

অনুমান আমার মিথ্যে নয় সুলতা। তিনি তা জানতেন।

যেদিনের কথা বলছিলাম, যেদিন কুইনিকে ওইসব কথা বলছিলেন, সেদিন ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে, অর্চনার বিয়ে হবে ঠিক হয়েছে ফাল্গুনের শেষে, মার্চের ৮ তারিখে; ওই দলিল ফেরত দেবার জন্যেই অন্নপূর্ণা-মা ওদের আটকে রেখেছিলেন কলকাতায়। পড়ে গিয়ে হিলডার হাঁটুটা শুধু পাকেই নি একটা স্থায়ী স্পেন হয়ে প্রায় খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। তারও চিকিৎসা হচ্ছিল। সেদিন কুইনি কোন কথা বলতে পারলে না, চলে গেল—অন্নপূর্ণা-মা মুখ ফেরালেন, দেখলাম তাঁর চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়েছে। আঁচল দিয়ে মুছে তিনি বললেন—সুরেশ্বর, এ ভারটাও তুলে নিস রে। মেয়েটাকে পড়িয়ে-শুনিয়ে মানুষ করে দে। এতে তোর সত্যিকারের ধর্ম করা হবে রে। সে-সব কথা তোকে মুখে বলতে পারব না। কথা তো অল্প নয় রে, কথা অনেক। দেখ, কথা এত রে, কথা যদি ইট-কাঠ বা পাথর হত, কিম্বা সব কথা যদি কাগজে লিখে থাকে-থাকে সাজানো হত, তবে গোটা এই হলঘরখানাই ভরে যেত। বুঝলি! বলতে গেলে জীবনে আর কুলোবে না। আমি তোকে একখানা চিঠি দেব-চিঠিখানা দেবুর লেখা। দেবু তোর ঠাকুরদা, দেবেশ্বর রায় সম্পর্কে আমার ভাইপো, আমার সহোদরের ছেলে সে তুই জানিস। তোর জ্যাঠাও জানে না। বয়সে প্রায় একবয়সী ছিলাম, আমি থাকতাম কাশীতে, সে থাকত কীর্তিহাটে, দুজনে দুজনকে চিঠি লিখতাম। সেকালের ছোট পোস্টকার্ড, তিন-চারটে লাইন লিখতে ফুরিয়ে যেত। তাও আমার কাছে দু-একখানা আছে। সে আমার ছোট ভাইয়ের অধিক ছিল রে। ভাইপো থেকে ভাই, ছোট ভাই, বেশী আপন। আমরা বন্ধু ছিলাম। খুব ছোটবেলা কালীপূজোর পরদিন ভাইফোঁটা, আমি পিসেমশাই আর পিসিমার সঙ্গে কাশী থেকে পুজোর সময় শ্যামনগর এসে কীর্তিহাট আসতাম। সে আমার হাতের ফোঁটা নেবার জন্যে কাঁদত। একসঙ্গে খেলা করতাম। দশ বছর বয়স তখন। আমার বিয়ের জন্যে পাত্রের খোঁজ হচ্ছে, দেবু আমাকে বলেছিল—পিসি, তোমার বিয়ের পরই তো আমার বিয়ে হবে। তা তুমি বলে দিয়ো, আমি মেম বিয়ে করব। তার মনের কথা প্রথম বিশ বছর সে আমাকে বরাবর জানিয়েছে; তারপর সে বদলেছিল। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে ঘা খেয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছিল পাথরের মত। তার একখানা চিঠি আমি তোকে দেব—তুই পড়ে দেখিস। আমার মৃত্যুর আগে ওগুলো ছিঁড়ে ফেলব ঠিক করেছিলাম, তাই করতামও। কিন্তু তোকে পেয়ে মনে হচ্ছে, তুই আমার যেন সেই দেবু। তোকে এই চিঠিখানা দেব, তুই পড়ে দেখিস। তার মধ্যে তার একটা ইচ্ছের কথা আছে। ওরে, সে আমাকে লিখেছিল টাকার জন্যেই। কীর্তিহাটের রায়বাড়ির রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের বড় ছেলে দেবেশ্বর রায় আমার কাছে হাজার টাকা ধার চেয়েছিল। এই কুইনির মায়ের বাপের মা অঞ্জনাদির পেটের মেয়ে ভায়লেটের জন্যে চেয়েছিল। আমি দিই নি।

ইচ্ছে করেই দিই নি। নইলে আমার টাকা ছিল। একটু চুপ করলেন অন্নপূর্ণা-মা। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—টাকা দিলে আর দেবেশ্বরকে কীর্তিহাটের বংশের মধ্যে পেতাম না রে। ও ভায়লেটকে নিয়ে ক্রীশ্চান হয়ে যেতো। টাকাটা চেয়েছিল—। থাক, যে-চিঠিখানা দেব তোকে, তারই মধ্যেই তুই সব দেখতে পাবি।

আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন—অথচ এর ভিটা গেড়ে দিয়েছিল আমার দাদা। রায়বাহাদুর গোঁড়া ধার্মিক রত্নেশ্বর রায়।

* * *

সুরেশ্বর বলতে বলতে থামলে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে—বারোটা বাজতে চলেছে। জিরো আওয়ার। কীর্তিহাটের কড়চাও শেষ হয়ে আসছে। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় আর তাঁর বড়ছেলে দেবেশ্বর রায়ের কথা বললেই শেষ। তারপর আমি আর তার শেষপুরুষ, ছবিতে যে-কড়চা এঁকেছি, তার মধ্যে আমি ছবি নই। আমি জীবন্ত। বিংশ শতাব্দীর মানুষ।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় আর দেবেশ্বর রায়ের কাহিনী ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যেই শেষ। পৃথিবীতে ইংরেজ জাতের দীপ্ত মধ্যাহ্ন। বৈশাখের মধ্যাহ্ন। ইংরেজ তখন বৈশাখের সূর্যের মত প্রখর প্রদীপ্ত। তার সেই প্রচণ্ড তেজের উত্তাপে বাংলাদেশে জমিদারেরা সুবর্ণরেখার বালুচরের মতো সূর্যের চেয়েও অসহনীয় কিন্তু তবু লোকে তাদের সহ্য করে, দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করে, তাদেরই বলে ‘মা-বাপ’। বালির মধ্যে সোনার দানা বা কণা সত্যই পাওয়া যেত, খুব বেশী না হলেও নেহাৎ কম নয়। অনেক। অনেক।

ইস্কুল, হাসপাতাল, চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারী যা বাংলাদেশে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল, তার বারো আনা দিয়েছে এই জমিদারেরা।

সুলতা এতক্ষণে কথা বললে, বললে—আমি তোমাকে সমর্থন করছি সুরেশ্বর। তার সংখ্যাও মোটামুটি আমার জানা আছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ইংরেজ সরকার মোটামুটি জেলাওয়ারি একটা জেলাস্কুল, আর একটা সদর হাসপাতাল দিয়েছে। হয়তো বা দুটো-একটা জেলায় দুটো থাকতে পারে কিন্তু দুটোর বেশী নয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হবার পূর্বে এই হিসেবে আটাশটা জেলায় গোটা-তিরিশেক ইস্কুল গভর্নমেন্ট দিয়েছে, হাসপাতালও তাই। কিন্তু পার্টিশনের সময় প্রায় চোদ্দশত ইস্কুল আমাদের দেশে ছিল। এর কিছু ছিল মিশনারীদের। কিছু গ্রামের লোকের চাঁদায়। শতকরা আশীটাই জমিদারদের দেওয়া। তার সঙ্গে অনেক কথা আসে, সেসব থাক, আমি ওসব শুনতে আসি নি, আমি তোমার রায়বাড়ির বা কীর্তিহাটের কড়চা দেখতে এসেছি, শুনতে এসেছি। বলে রাখি, এর মধ্যে আমার সঙ্গে তোমার পুরনো হৃদ্যতার জের অবশ্যই আছে, কিন্তু তার মধ্যে কোন হৃদয়ের আকর্ষণের জের নেই। তুমি কড়চার কথা বল।

ঢং-ঢং-ঢং শব্দে ঘড়িটা বাজতে শুরু করল।

সুলতা বললে—তোমার অন্নপূর্ণা-মা যে চিঠিখানা তোমাকে দিয়েছিলেন, সেই চিঠিটা থেকে শুরু কর। চিঠিখানা তোমার কাছে আছে?

—আছে। যা তোমাকে বলেছি, যা আমি ছবিতে এঁকেছি, তা যে সব কাগজ থেকে পেয়েছি, সে সব কাগজ আমার কাছে বড় মূল্যবান দলিল সুলতা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এইসব দলিলের দেনা আমাকে শোধ করতে হবে। লোকে আমাকে পাগল বলে। এই তো কালও রায়বাড়ীর অন্য জ্ঞাতিরা আমাকে গালাগাল দিয়ে গেলেন এর জন্যে। তা দিন। আমার সংকল্প আমি পালন করব।

সামনের টেবিলে জমা করা কাগজপত্রের মধ্য থেকে একটা ছোট চন্দনকাঠের বাক্স থেকে সুরেশ্বর একখানা খাম বের করলে। সেই ছোট পোস্টকার্ড ছোট খামের আমলের—মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি আঁকা খাম। তার মধ্যে থেকে লাইন-টানা চিঠির কাগজে লেখা চিঠি। চিঠির কাগজখানা গিরিমাটির রঙ ধরেছে এবং কোণগুলো ভেঙে গেছে। ভাঁজে ভাঁজে ফাট ধরেছে।

* * *

চিঠিখানার তারিখ ১৮৭৮ সাল, বাংলা ১৮২৫ সাল। কলকাতার জানবাজারের বাড়ী থেকেই চিঠি লিখেছিলেন দেবেশ্বর রায়।

শ্রীচরণকমলেষু,

প্রণাম শতকোটি নিবেদনমিদং, পিসী, মদীয় এই পত্র পাইয়া তুমি খুবই আশ্চর্যান্বিত হইবে। সম্ভবত মদীয় নাম দেখিয়া আমার উপর তোমার ঘৃণারও উদ্রেক হইতে পারে। কিন্তু নিবেদন করিব এই যে, পত্রখানি তুমি পাঠ করিয়া দেখিয়ো। এ সংসারে তুমি আমাকে আপন দিদির মত যে-প্রকার স্নেহ কর, তাহা অত্যন্ত দুর্লভ। এমতপ্রকার স্নেহ আমাকে আমার পিতা করেন না, মাতাও করেন না। আমি আজ তাঁহাদের বিষদৃষ্টিতে পতিত হইয়াছি। আমাকে একরূপ ঘরে বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছে।

মদীয় বিবরণ তুমি জান। তুমি শুনিয়াছ। অবশ্য পূর্বে তোমার সহিত পরামর্শ করিয়া করিলে হয়তো এমতপ্রকার অবস্থা-বিপর্যয়ে পতিত হইতে হইত না। তবে তুমি ভায়লা বলিয়া যে অনাথা মেয়েটি পিড়ুজের বাড়ীতে থাকিত, তাহাকে দেখিয়াছ। তাহাকে তুমি চেন। মেয়েটা আমার অপেক্ষা বৎসর-দুয়ের ছোট। মেমসাহেবদের মত গায়ের রঙ। সে যে অঞ্জনাপিসির কন্যা, তাহা আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম।

ইহা কি প্রকারে আমি অবগত হইলাম, তাহা বলিয়াছিলাম কিনা জানি না। তাহাই তোমাকে বলিব। না হইলে তুমি সমস্ত বুঝিতে পারিবে না।

আমার বয়স তখন বৎসর-সাতেক, তোমার তখন বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে। জানবাজারের বাড়ীতে তৎকালে ছিলাম। মা তখন প্রসবের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছেন। আমি দেখিতাম এই ভায়লাকে কোলে করিয়া কলিকাতাবাসী একজন গোয়ান সেরেস্তায় আসিয়া দাঁড়ায় এবং সপ্তাহে কয়েকটি করিয়া টাকা লইয়া যায়।

বাবামশাই আসিলে তিনি লোকটাকে লইয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া কথা বলেন। আমার খুব কৌতূহল হইত। কারণ ছেলেবেলা হইতেই মেমসাহেব আমার খুব ভাল লাগে। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করিবার ইচ্ছা হইল—তাহাও করিলাম। সে ভাঙা-ভাঙা বাংলায় দুই-চারিটা কথা বলিত। ইংরাজী সে জানিত না। আমি তখন ইংরাজী শিখিয়াছি, মাস্টার আমাকে তখন মুখে-মুখে ওয়ার্ড-বুক মুখস্থ করাইয়াছে। আমি মধ্যে মধ্যে ইংরাজী বলিলে সে দুই হাত নাড়িয়া দিত, বুঝাইয়া দিত জানি না। বলিত, পর্তুগীজ পর্তুগীজ!

একদিবস আমার পিতৃদেব এবং আমার মাতৃদেবী নিজেদের মধ্যে কলহ করিয়া আমাকে জানাইয়া দিলেন যে ওই মেয়েটি অঞ্জনাপিসীর কন্যা। গভীর রাত্রিকাল তখন। আমি মায়ের নিকট ছোট একখানি খাটে শুইয়াছিলাম, মায়ের খাটে মা শয়ন করিয়াছিলেন, আমি নিদ্রিত ছিলাম, হঠাৎ মায়ের উচ্চকণ্ঠে আমি জাগিয়া উঠিলাম।

প্রথমেই শুনিলাম—ওই যে ফিরিঙ্গী মেয়েটা কোলে লইয়া গোয়ান ছোঁড়াটা আসে, বল, বল, বল সে মেয়েটা কে? কার মেয়ে? তুমি উহাকে প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা করিয়া দাও কিনা? বল?

বাবামশায় যেন একটা চাপা গর্জন করিয়া উঠিলেন, চীৎকার করিও না। যাহা বলিবে আস্তে আস্তে বল। একটা কেলেঙ্কারি করিয়া লাভ হইবে না। দেবেশ্বর জাগিয়া উঠিবে।

বলিয়া তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন—দেবেশ্বর। দেবু। বাপি। আমি আগেই ভয় পাইয়া গিয়াছিলাম। আমি কোন সাড়া দিলাম না, অন্তরে নিদারুণ ভয় সঞ্চারিত হইল। আমি চুপচাপ পড়িয়া রহিলাম। যেন গাঢ় ঘুমে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি।

তারপর পিসী যাহা সেদিন শুনিয়াছিলাম, তাহার অর্থ সম্যক অনুধাবন করিতে পারি নাই। কিন্তু কথাগুলি ভুলি নাই। জ্ঞান হইবার পর বোধশক্তি জন্মিবার পর তাহার অর্থ বুঝিলাম। বুঝিলাম -মা সেদিন ওই ভায়লাকে অঞ্জনার কন্যা বলিয়া জানিলেন। অঞ্জনার প্রতি পিতৃদেবের একটা গোপন লালসা বা অনুরাগ ছিল। কিন্তু তিনি তাহা তাঁহার অন্তরে অন্তরে চাপিয়া রাখিয়াছিলেন। এবং অঞ্জনাকে তাহার দরিদ্র বাউণ্ডুলে স্বামীর নিকট হইতে একরূপ ছিনাইয়া লইয়া নিজেদের কাছে কাছে রাখিয়াছিলেন। এতটা সহ্য করিতে পারে নাই অঞ্জনা। সে আলফানসো পিড়ুজের সঙ্গে পলাইয়া গিয়াছিল। এখন আলফানসো খুন হইয়াছে। গোয়াতে অঞ্জনাদিদি থাকিতে পারে নাই। এবং শরীরেও রোগ ধরিয়াছিল; সেই কারণে বহু কষ্টেই ওই ভায়লা মেয়েটাকে লইয়া কোনমতে কলিকাতায় আসিয়া ফিরিঙ্গীপাড়ায় যেখানে গোয়ানীজরা থাকে, সেইখানে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে। এবং এখানে আসিয়া বাবামহাশয়কে পত্র লিখিয়া বাঁচিয়া থাকিবার মত সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছে। বাবামহাশয় সপ্তাহে দশ টাকা হিসাবে বরাদ্দ করিয়াছেন, একসঙ্গে সমস্ত টাকা দেন না, তাহার কারণ একসঙ্গে সমস্ত টাকাটা হাতে পাইলে সবটাই খরচ করিয়া ফেলিবে।

বাবামহাশয় নিষ্ঠুরভাবে বলিলেন—হাঁ বাসিতাম। অঞ্জনাকে ভালবাসিতাম বলিয়াই তাহাকে তাহার স্বামীর নিকট হইতে ছিনাইয়া লইয়াছিলাম। তোমার নাম করিয়া তোমার নিকটেই রাখিয়াছিলাম। কিন্তু তাহার সহিত কোনপ্রকার গাঢ় সম্পর্ক হইতে দিই নাই, তাহা আমার নিষ্ঠুর চরিত্রবল। আমি অতি নিষ্ঠুর ব্যক্তি। অত্যন্ত নিষ্ঠুর আমি। আমি আত্মহত্যা করিতে পারি। আমার আঙ্গুল একটি একটি করিয়া ছেদন করিতে পারি। তাহার জন্যই করি নাই। নতুবা অঞ্জনাকে একখানা বাড়ীতে রক্ষিতা হিসাবে রাখিলে কে আমাকে বাধা দিতে পারিত! তোমার এস-ডি-ও সাহেব-পিতারও ক্ষমতা ছিল না।

মা কিছু বলিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু বাবামহাশয় বাধা দিয়া বলিয়াছিলেন, চুপ কর চুপ কর। বৃথা আস্ফালন করিয়া কোন লাভ হইবে না। রত্নেশ্বর আইনকে লঙ্ঘন করিয়া চলে না। তোমার বাবা আইনের বাহিরে যাইতে পারেন না। তাহা ব্যতীত বাবার উপরে বাবার মত এস-ডি-ও’র উপর ম্যাজিস্ট্রেট, তাহার উপর কমিশনার, তাহার উপর লোন্ট-গভর্নর আছেন; এদিকে জর্জকোর্ট আছে, হাইকোর্ট আছে। ইহাদের দিয়াই আমি সহস্ৰ সহস্ৰ দুর্ধর্ষ প্রজাকে পদানত করিয়াছি। বৃদ্ধি লইয়াছি। তাহাদের পায়ের গোলাম করিয়া রাখিয়াছি। তোমার বাবার কাছে শুনিয়াছি যে, সরকারী মহলে আমার যত সুনাম, তত দুর্নাম। তবুও তাঁহারা আমার প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে কিছুই করিতে পারেন না। তেমনি ভাবেই অঞ্জনাকে—। থাক, কথাগুলো উচ্চারণ করিতেও ঘৃণা বোধ হইতেছে। নারীজাতি অতি ঈর্ষাপরায়ণ, অঞ্জনা মরণাপন্ন, তাহার ওই শিশু-কন্যাটি লইয়া নিরাশ্রয়, আমি তাহাকে সামান্য সাহায্য করি তাহাও তোমার সহ্য হইতেছে না।

পিসী, কথাগুলো আমি কোনদিন ভুলিতে পারি নাই। ইহার পর একদিন সেই গোয়ানটার সঙ্গে চুপি চুপি অঞ্জনাপিসীকে দেখিতে গিয়াছিলাম। অঞ্জনাপিসীকে চিনিতে খুব কষ্ট হয় নাই, কিন্তু তাহার অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখ পাইয়াছিলাম। অঞ্জনাপিসী খুব আদর করিয়াছিল এবং বলিয়াছিল-আঃ! কি কপাল, আর কি বিধান। দেবুর সঙ্গে ভায়লার বিবাহ হইবার উপায় নাই। হইলে কি ভালই না হইত।

পিসী, কথাগুলো সে-সময় বোধহয় তোমাকে বলিয়াছিলাম। যেবার অঞ্জনাপিসীর মৃত্যুর পর বাবামহাশয়ের ব্যবস্থায় ভায়লেট গোয়ানপাড়ায় পিড্রুজদের বাড়ীতে আশ্রয় পাইল, পিড়ুজের সভগ্নী পরিচয়ে এবং তুমি তাহাকে প্রথম দেখিলে, সেবার বোধহয় তোমাকে কথাগুলি বলিয়াছিলাম। তোমার হয়তো মনে নাই।

কিন্তু আমার ইহাই সর্বনাশ ঘটাইয়াছে। আমি ভায়লেটকে ভালবাসিয়াছি। সে-ও আমার প্রতি আশ্চর্যরূপে অনুরক্ত। তাহাকে ছাড়িয়া আমি বাঁচিব না, সে-ও আমাকে ছাড়িয়া বাঁচিবে না। ধর্মমতে বিবাহ না হইলেও, আমরা স্বামী-স্ত্রীই হইয়া গিয়াছি। এবং আশঙ্কা করিতেছি, কিছুদিনের মধ্যে এ-ঘটনা আর লোকচক্ষে অপ্রকাশ থাকিবে না।

তুমি তো বাবামহাশয়কে জান। এ কথা তিনি জানিতে পারিলে হয় ভায়লেট মরিবে, নয় আমাকে চরম অপমানে অপমানিত করিয়া দূর করিয়া দিবেন। তাহা আমি চাহি না। আমি ভায়লেটকে লইয়া চলিয়া গিয়া ক্রীশ্চান হইয়া বিবাহ করিব। এবং দরিদ্র ভাবেই জীবন-যাপন আরম্ভ করিব। তবে আমার ভরসা আছে এই যে, যদি আমি কিছু টাকা একসঙ্গে সংগ্রহ করিতে পারি, তবে আমি তাহা হইতে ব্যবসা-বাণিজ্য করিয়া উন্নতি করিতে পারিব। মাইকেল মধুসূদন মহাকবি হইয়াছিলেন। আমি হইব না কে বলিতে পারে?

তোমার হাতে টাকা আছে। তুমি তো টাকা পাইয়াছ। আমাকে কয়েক হাজার টাকা ধার দিতে পার পিসী! আমি শোধ দিব, নিশ্চয় শোধ দিব। আমাকে বিশ্বাস কর-আমাকে বিশ্বাস কর। আমাকে বাঁচাইতে পার তুমি, বাঁচাইবে? মায়ের গয়না আমি চুরি করিতে পারি—টাকাও চুরি করিতে পারি। কিন্তু তাহা আমি করিব না। তোমার ভাইপো চোর নয়।

সুরেশ্বর কয়েক মুহূর্তের জন্যে ভাবলে। পুরানো চিঠিখানার শেষের পাতাটার নীচের দিকটা উপরে ছিল বলে ময়লা একটু বেশী হয়েছিল। চিঠিখানার ওই অংশ থেকে চোখ তুলে বললে—এই অংশটা আমার খুব ভাল লাগে। দেবেশ্বর রায়কে এই অংশ থেকে স্পষ্ট চেনা যায় জানা যায়। কথাগুলো খুব দামী—সেই বয়সে দেবেশ্বর রায় কি করে যে লিখেছিলেন, তা বলতে পারব না। কথাগুলো শোন, শুনলেই বুঝতে পারবে।

“পিসী, আমার ভয় হইতেছে যে, তুমি আমাকে বুঝিবে না, বুঝিতে চাহিবে না। তুমি বাবামহাশয়ের সহোদরা হইলেই ভাল হইত। আশ্চর্য বোধ হয় এই যে, বিমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় দাদামহাশয়ের সন্তান পোষ্যপুত্র সূত্রে বীরেশ্বর রায়ের পুত্র হইয়া অবিকল তাঁহার স্বভাব কিরূপে পাইলেন? তুমি বাবামহাশয়ের অপেক্ষাও জেদী। এই বয়সে একটি সন্তান লইয়া জেদের বশে স্বেচ্ছায় স্বামীগৃহ হইতে নির্বাসন লইয়া কাশীতে বিমলাকান্ত দাদামহাশয়ের কাছে পালক-পিতার কাছে গিয়া সংসার পাতিয়াছ। পিতৃবংশের সহিত মামলা করিবে না —ইহা তোমার জেদ। জেদ করিয়া তুমি স্বামীকে ছাড়িয়াছ। তাহা ছাড়া সারা দেশের মেয়েরাই এমন যে, জাতের জন্য স্বামী তাহারা অনায়াসে ছাড়িতে পারে। স্বামী ক্রীশ্চান কি মুসলমান হইলে—স্ত্রী জাতের জন্য স্বামীকে ছাড়িল। পুরুষেও পারে। তাহাই করে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলায় নবকুমারের প্রথম পক্ষের স্ত্রী পদ্মাবতীর কি অপরাধ বল? জোরপূর্বক তাহাদের বাপ-মায়ের সহিত তাহাকেও মুসলমান হইতে হইল। তাহার জন্য নবকুমার পরিত্যাগ কেন করিবে। কিন্তু ইহাই এ-দেশে হয়। পিসী, ইহাই আমি পারি না। পারিব না। আমার কাছে জাতিধর্ম অপেক্ষাও প্রেম বড়। যাহাকে ভালবাসিয়াছি, তাহাকে ছাড়িতে পারিব না। তাহারই জন্য তোমার নিকট আমি সকাতরে আবেদন করিতেছি। পিসী, এই সাহায্যটুকু তুমি আমাকে কর। তোমার ভাইপো দেবু তোমাদের শিবঠাকুরের মত। সে প্রেমের জন্য প্রিয়তমার জন্য অঙ্গে ছাই মাখিয়া শ্মশানের পোড়াবাঁশ ও চ্যাটাইয়ে ঘর বাঁধিয়া, ভিক্ষা করিয়া থাকিতেও রাজী আছে। কিন্তু এত কষ্ট সহিবে না। অভ্যাস নাই। অভ্যাস করিতে গেলে অকালমৃত্যু ঘটিবে। পিসী, তাহা কি সহ্য করিতে পারিবে? তুমি আমাকে টাকা ধার দাও। আমি তাহা মূলধন করিয়া ব্যবসা করিব, ঘর বাঁধিব। “

শেষের দিকটায় কাব্য একটু বেশী হয়েছে এবং রোমান্টিক হয়ে পড়েছেন। তা হোন, সেটা আমি ধরি নি, কারণ তখন দেবেশ্বরের বয়স সবে ষোল পার হয়ে সতেরোতে পড়েছে। গ্রামেই হাই ইংলিশ স্কুল ছিল, কিন্তু রায়বাহাদুর ছেলেকে জানবাজারের বাড়ীতে রেখে পড়াতেন। পড়াতেন হিন্দু স্কুলে। তাঁর কাছে থাকত গোপাল পাল, ঠাকুরদাস পালের এ-পক্ষের বড় ছেলে। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বরের বিয়ের ঠিক আগেই বা ঠিক পরেই তাঁরও বিয়ে হয়েছিল রঙলাল ঘোষের পিসীর সঙ্গে। সে-কথা আগেই বলেছি।

১৯৩৭ সাল থেকে আবার পিছিয়ে চল সুলতা। সময়টা ১৮৭৬ সাল। রত্নেশ্বর রায় শ্যামনগরে হাই-ইংলিশ স্কুল স্থাপন করিলেন বিমলাকান্ত তখনও বেঁচে; তিনি বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন—না রত্নেশ্বর, আমি আজও বর্তমান রয়েছি। আমার নামে নয়। রত্নেশ্বর বলেছিলেন—কেন? তাতে কি হল? এই তো কীর্তিহাটের স্কুলের এম-ই স্কুল বাবা থাকতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল বীরেশ্বর রায় এম-ই স্কুল। তারপর স্কুল এন্ট্রান্স স্ট্যান্ডার্ড হল, তখন তার সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে বীরেশ্বর রায় এম-ই এ্যাণ্ড রত্নেশ্বর রায়

এইচ-ই স্কুল নাম দেওয়া হয়েছে। তাতে অন্যায় হয়েছে বলতে চান? তাছাড়া কর্মের জন্য নিন্দাই বলুন আর প্রশংসাই বলুন, এ-প্রাপ্য হল তার যে সেই কর্ম করে। সে সমাজে বলুন, রাজদ্বারে বলুন, অথবা বিধাতার বিচারালয়েই বলুন। সালটা ওই ১৮৭৮।৭৯ সাল।

এসব কথাই চিঠি মারফৎ চলছিল সুলতা।

বিমলাকান্ত লিখেছিলেন—“তাহা হইলে এ স্কুল তোমার নামেই স্থাপিত হওয়া উচিত, আমার নামে নয়। অথবা শুধু গ্রামের নামেই নামকরণ হওয়া উচিত। শ্যামনগর হাই-ইংলিশ ইস্কুল। কারণ শ্যামনগরের জমিদারী স্বত্ব আমাদের বংশের বা আমার হইলেও ইহার আসল মালিক কীর্তিহাটের রায়বংশ। তাঁহাদের অর্থেই এ লাট আমার নামে ক্রয় করা হইয়াছিল। তৎপর তাহা পত্তনী লইয়াছেন কীর্তিহাটের রায় অর্থাৎ তুমি। এই লাটের বৃদ্ধি লইয়াই একদা দে সরকারদের সহিত তোমার বিরোধ বাধিয়াছিল। তাহা হইতেই বহু ঘটনা ঘটিয়াছে। রবিনসন সাহেব আসিয়া কুঠী করিতে গিয়া মরিয়াছে। দে-সরকারেরা গিয়াছে। এখন জমিদারী আমার কিন্তু পত্তনীদার হিসাবে খাস দখল তোমার। তুমি এই লাটের মোট আদায় ৫৬০০ টাকার মধ্যে সরকারকে দেয় রাজস্ব ৪০০০ টাকা বাদে ১৬০০ টাকা আমাকে ঠাকুরের সেবায়েত হিসাবে লভ্য প্রদান করিয়া থাক। লাভ তোমাদের এস্টেটের কিছুই নাই, আছে লোকসান। আদায় খরচা লোকসান লাগে। লাভ বলিতে শ্যামনগর রাধানগর এবং ঠাকুরপাড়া এবং পাইকপাড়া কয়েকটির খাস দখল বা অধিপতিত্ব। তুমি এই গ্রামের বৃদ্ধির জন্য একদা জমিদারের সঙ্গে বিবাদ করিয়াছিলে—এবার শ্যামনগরে বিদ্যালয় স্থাপন করিবার সংকল্প করিয়া সমুদয় মৌজায় ডৌল জমার উপর সিকি বৃদ্ধি দাবী করিয়াছ। অর্থাৎ ৫৬০০ টাকার সিকি ১৪০০ টাকা বৃদ্ধি হইবে। ইহার সহিত কিছু খাসদখলী জমি ইত্যাদিও দেওয়া হইবে। ইহা সবই রায় এস্টেটের দান। সুতরাং ইহাতে কোনপ্রকার কীর্তি স্থাপনের গৌরব বা পুণ্যের দাবী শ্যামনগরের ভট্টাচার্য বংশের নাই। সুতরাং ইহা তোমার নামেই স্থাপন কর। আরও একটা শাস্ত্রবাক্য স্মরণ করাইয়া দিই। “সর্বত্র জয়মিচ্ছেৎ পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ম্।” তোমার গৌরবেই আমার গৌরব। পিতৃপুরুষের গৌরব।

প্রসঙ্গক্রমে লিখি যে ঠাকুরদাস আমাকে এ সম্পর্কে পত্র লিখিয়াছিল। শ্যামনগরে বৃদ্ধির প্রস্তাবে সে খুবই ক্ষিপ্ত হইয়াছিল। এবং তৎসঙ্গে আর ভদ্রজনেরাও আমাকে লিখিয়াছিলেন যে, আমি যেন ইহাতে হস্তক্ষেপ করিয়া এই বৃদ্ধি নিবারণ করি। কিন্তু আমি তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া পত্রাদি লিখিয়াছি। এবং এই উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত হইলে গ্রামের যে কি প্রকার উপকার হইবেক তাহাও বুঝাইয়াছি। তাঁহারা আমার পত্রের আর উত্তর দেন নাই কিন্তু জানিলাম কথাটা ঠিক তাহারা মানিতে চাহেন নাই। তোমাকে এই বৃদ্ধির জন্য অনেক অর্থাদি ব্যয় করিতে হইয়াছে। প্রায় দুইশত জোতের উপর বৃদ্ধির নালিশ চলিয়াছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। তাহাতে কৃতকার্য হইয়া তুমি মায়-খরচা ডিক্রী পাইয়াছ। তাহাতে অবশ্যই আজি খুশী হইয়াছি। এ সম্পর্কে ঠাকুরদাস কিছু অসন্তুষ্ট হইয়াছে। সে আমাকে এই লইয়া একখানা পত্র লিখিয়াছে। পত্রখানায় যে ক্ষোভ আছে তাহা নিশ্চয়ই আমি সমর্থন করিতেছি না। তুমি যেমন তাহার জোতের উপর বৃদ্ধি লইয়াছ তেমনি তাহাকে নিষ্কর দিয়াছ এবং যথেষ্ট করিয়াছ। কিন্তু তাহার একটা কথায় আমার খটকা লাগিয়াছে। আমি সন্দেহ করিতেছি যে, সে কোনরূপে আমার সহিত তোমার এবং ভবানী ভগ্নীর সহিত আমার সম্পর্কের কথা জানে বা জানিতে পারিয়াছে।”

রত্নেশ্বর রায় এ পত্রের কোন উত্তর দিয়েছিলেন কিনা জানি না। তবে ইস্কুলের নাম রেখেছিলেন রত্নেশ্বর রায় হাই-ইংলিশ স্কুল। এবং ঠাকুরদাস পালের নাম আর কোন কিছুতে উল্লেখ পাই নি।

রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে চিঠিটার কথা উল্লেখ আছে। “আজ কাশী হইতে পত্র পাইলাম। পিসামহাশয় পত্র লিখিয়াছেন। তাঁহার পত্র পড়িয়া ঠাকুরদাসকে বাজাইয়া দেখিব বলিয়া তাহাকে আনিতে লোক পাঠাইলাম। পিসামহাশয় যাহা লিখিয়াছেন তাহা সত্য হইলে তো ঠাকুরদাসকে।”

আর কিছু লেখেন নি তিনি। তারপর লিখেছেন—“কথাটা সত্য মনে হইতেছে। ইদানীং ঠাকুরদাস আমাকে নির্জনে পাইলে শ্যামনগরের বৃদ্ধি লইয়া পূর্বের সম্পর্ক ধরিয়া নির্বোধ আমাকে দাদাঠাকুর সম্বোধন করে এবং আমার সহিত বাকযুদ্ধ করিতে সাহসী হয়। আমি সহ্য করি কিন্তু মাত্রা ছাড়াইবার উপক্রম করিলেই কিছু কঠোর কণ্ঠে ‘ঠাকুরদাস’ বলিয়া ডাকিলেই বা সজোরে গলাঝাড়া শব্দ করিলেই চুপ করিয়া যায়। আমি আঙ্গুল দেখাইয়া বলি—যা বাহিরে যা। সাধারণ লোকের মগজে গোবর থাকে, তোর মগজে মহিষের বিষ্ঠা পোরা আছে। তর্ক করিস না, বাহিরে যা!

সে বাহিরে যায় কিন্তু বারান্দায় বা এমন কোন স্থানে বসিয়া যেন আপন মনেই বলে—“ঘি দিয়া ভাজ নিমের পাত—নিম না ছাড়েন আপন জাত!” অথচ তাহার উদ্দেশ্য কথাটা আমাকে শোনানো।

যে সব মূর্খেরা ইস্কুলের উপকারিতা বুঝে না, শুধু খাজনা বৃদ্ধিটাকে অপমান বোধ করে, তাহাদের উন্নতিবিধান করিতে ভগবানেরও সাধ্য নাই। ইহারা ইংরাজকে দেখিয়া মাটিতে উপুড় হইয়া পড়িবে। এ দেশী ইংরাজী জানা ব্যক্তিকে ইংরাজের সমকক্ষ ভাবিবে—অথচ নিজেরা কিছুতেই ইংরাজী শিখিবে না। বলিবে-কি বলিতেছেন মহাশয়, আমরা যদি ইংরাজীই শিখিব তবে চাষবাস করিবে কাহারা? আপনাদের ভৃত্যগিরি করিবে কাহারা? কিন্তু আশ্চর্য, প্রজা হিসাবে ইহাদের আর একটা চেহারা আছে। ঠাকুরদাস পালের ঘরে যখন জমিদারের দেওয়া আগুনে স্ত্রীপুত্র পুড়িয়া মরিয়াছিল, সে ছবি আমি আজও ভুলিতে পারি নাই।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *