চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ২১. পরিশিষ্ট

২১. পরিশিষ্ট

চার বছর পর ১৯৫৭ সাল, জুলাই মাস। সন্ধ্যার সময় সুলতা ঘোষ বাসায় ফিরে প্রথমেই টেবিলের উপর রাখা ডাকের কাগজগুলি নেড়েচেড়ে দেখলে। বেশীর ভাগই কাগজপত্র, সাপ্তাহিক পাক্ষিক পত্র, কিছু ফরেন-এম্বাসী থেকে পাঠানো কাগজ, তাদের প্রচারপত্র। বাকী সব এদেশের। কিছু বিজ্ঞাপন। কিছু বুক পোস্ট। মিটিংয়ের নিমন্ত্রণপত্র কিংবা নোটিশ। কয়েকখানা বড় চৌকো দামী খাম। সরকারী ফাংশনে নিমন্ত্রণের কার্ড এসেছে। ওগুলিকে ঠেলে রাখতে গিয়ে একখানা এমনি দামী বড় চৌকো খাম তার চোখে পড়ল। সে একটু বিস্মিত হয়ে গেল। খামটার মাথায় লেখা ৺গঙ্গা। অর্থাৎ কারও শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্র।

সুলতার জীবন একক জীবন, অধ্যাপনা তার জীবিকা এবং রাজনৈতিক কাজ তার জীবনাদর্শ কিংবা জীবনের নেশা; এমন জীবনে সমাজ ও সংসারের পারিবারিক সুখদুঃখের সঙ্গে বন্ধন তার দুর্বল। মা-বাপ মারা গেছেন বছর তিনেক আগে; ১৯৫৪ সালে। তারপর সে ভাইদের সঙ্গে আলাদা হয়ে বাসা করেছে। তার এই একক জীবনে বান্ধব-বান্ধবীদের ছেলেমেয়ের অন্নপ্রাশন বা কোন তরুণ শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী বা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বিয়ের নিমন্ত্রণ আসে, কিন্তু ‘ওঁ গঙ্গা’ লেখা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ আসে না। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ এক-আধখানা আসে পোস্টকার্ড বা খামের ভিতর কার্ড—তাতে শুধু কালো বর্ডার থাকে—ওঁ গঙ্গা-টঙ্গা থাকে না। ওঁ গঙ্গা লেখা খাম এবং খামখানা বুকপোস্ট নয়; রীতিমত খামের টিকিট মারা মুখবন্ধ পত্র। ভিতরে বোধ হয় ব্যক্তিগত পত্রও আছে ছাপা নিমন্ত্রণ-পত্র ছাড়া।

পত্রখানা হাতে নিয়ে সে ভাবলে কোথা থেকে এল? কার পত্র? কে মারা গেল? টিকিটের উপর পোস্টাল স্ট্যাম্প দেখে বুঝতে চেষ্টা করলে কিন্তু নাম পড়া গেল না। কলকাতার কোন পোস্টাপিস থেকে আসছে না। কলকাতার পোস্টাপিসগুলোর সীলের একটা বিশেষত্ব থাকে। এতে তা নেই।

খুলতে যেন খানিকটা সংকোচ হচ্ছে, পিছিয়ে আসতে চাচ্ছে মন। একটু চুপ ক’রে বসে থেকে সে খুলে ফেললে। কার্ড নয় চিঠি এবং একখানা নয় দুখানা। অনুমানমত একখানা হাতে লেখা, অন্যখানা ছাপা। ভাঁজের উল্টো পিঠ থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। সে আগে ছাপা চিঠিখানাই খুলে নিচের দিকে তাকিয়ে নিমন্ত্রণকর্তার নামটা পড়ল।

সাবিত্রী রায়। কীর্তিহাট মেদিনীপুর। কীর্তিহাটের রায় মানে রায়বাড়ী। কিন্তু সাবিত্রী রায় কে? চোখের দৃষ্টি উপরে তুলতেই তার চোখ নিবন্ধ হল একটা নামের উপর-সুরেশ্বর রায়। আমার স্বামী সুরেশ্বর রায় পরলোকগমন করিয়াছেন। তদুপলক্ষে আগামী ২২শে শ্রাবণ ঝুলন পূর্ণিমার দিন তাঁহার ষান্মাষিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষে পারলৌকিক বৃষোৎসর্গ ক্রিয়াদি —আর পড়তে পারলে না সুলতা, হঠাৎ বুকের মধ্যে বর্ষার ফুলে ওঠা মেঘের মত পুঞ্জিত মেঘ ফুলে ফেঁপে উঠে তার অন্তরলোকটা আচ্ছন্ন ক’রে ফেললে।

সুরেশ্বর নেই?

কিন্তু সাবিত্রী দেবী কে? সুরেশ্বর বিয়ে করেছিল কুইনি মুখার্জী বলে একটি ক্রীশ্চান মেয়েকে। গোয়ানপাড়ার ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এবং সে তো সাবিত্রী নয়। তবে নতুন বিয়ে করেছে সুরেশ্বর?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে সুলতা। মনে পড়ল চার বছর আগে দুদিন ধরে সেই রায়বাড়ীর জবানবন্দি শোনার কথা। ১৯৪২-এর সাইক্লোনের রাত্রে সুরেশ্বর এবং কুইনি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করেছিল এবং কালী-মায়ের প্রসাদী সিঁদুর রায়বংশের মেয়েদের সামনে কুইনির সিঁথিতে পরিয়ে দিয়েছিল। এবং কলকাতা চলে এসেছিল ক’দিন পরই। কীর্তিহাটে থাকতে পারে নি, থাকা সম্ভবপর হয় নি। রায়বংশের পুরুষেরা আপত্তি করেছিল। যে বাড়ীতে পাষাণময়ী কালী প্রতিষ্ঠিতা, রাধাসুন্দর বিগ্রহ এবং রাজরাজেশ্বর সৌভাগ্যশিলা শালগ্রাম অধিষ্ঠিত সে বাড়ীতে এই ধরনের বিবাহ সিদ্ধ নয় এবং কোন ক্রীশ্চান বা ভিন্নজাতীয়া স্ত্রীকে নিয়ে কেউ এই রায়বাড়িতে বসবাসেরও অধিকারী নন অথবা সম্পত্তিরও অংশীদার হতে পারেন না কারণ সম্পত্তি সমস্তই দেবোত্তর।

তাই কুইনিকে নিয়ে কলকাতা পালিয়ে এসেছিল সুরেশ্বর। তারপর লেগেছিল এই বিয়েকে উপলক্ষ করে মামলা। প্রকাণ্ড মামলা। সুরেশ্বর বলেছিল—প্রকৃতির একটা নিয়ম আছে, সেই নিয়মে রায়বাড়িকে একদিন হারিয়ে যেতে হবে নগণ্য হয়ে, সব মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে হবে। মুঘল বাদশাহের বংশের ছেলেদের নাকি কুরশীনাম-ধ’রে খুঁজে পাওয়া যায় না অথচ যে টাঙায় চড়ে লোকে তাদের খোঁজে সেই টাঙার টাঙাওয়ালাই হয়তো বাদশা বংশের। রায়বাড়িও সেই পালা শুরু হয়েছে। আমি এরই মধ্যে নিজে থেকে এগিয়ে এসে কিছু দেনা শোধ করতে সংকল্প করেছিলাম বাবার মৃত্যুর পর; মৃত্যুশয্যায় মাও আমাকে বলতেন। সেদিনও বলেছেন। সর্বশেষ বলেছিলেন—ঠাকুমা উমা দেবী। তাঁর আশীর্বাদেই হোক আর যাই হোক, গোয়ানপাড়ার ক্রীশ্চান মেয়ে কুইনির রূপের মোহ যখন আমায় টানলে, যখন আমি জমিদারীর অর্থবল নিয়েও তাকে জমিদারের ছেলের মত জয় করে দেনার ভার বৃদ্ধি করি নি, তাকে প্রেম দিয়ে জয় ক’রে তার সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বেঁধে কিছু দেনা শোধই করেছিলাম। কিন্তু তা রায়বাড়ীর শরিকেরা মঞ্জুর করলে না। দেবতার দোহাই দিয়ে আদালতে নালিশ করলে আমার জাত গেছে এ বিয়ে ক’রে সুতরাং দেবসেবায় আমার অধিকার নেই। দেবসেবায় অধিকার না থাকলে দেবত্র সম্পত্তি পাব না এবং হিন্দু ব্রাহ্মণবংশোদ্ভব কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের অর্জিত সম্পত্তির একটি কণারও আমি অধিকারী হতে পারি না। এ দেশের ধর্মাধিকরণের মামলার ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। ইতিহাসেও আছে।

সুলতাই তাকে বাধা দিয়েছিল। চোখে দেখা ভারতবর্ষের ইতিহাসের সব থেকে বড় কথাটা মনে পড়িয়ে দিয়ে বলেছিল —ক’বছর আগে যে দেশটা স্বাধীন হতে গিয়ে ধর্মের পর কবন্ধ হয়ে তবে রেহাই পেলে সে দেশে ওর নজীরের আর দরকার নেই সুরেশ্বর। তুমি বল কি হল তারপর?

হেসে সুরেশ্বর বলেছিল —কি আর? মামলা, মামলা দায়ের হল, মেদিনীপুরের জজ কোর্টে। আর কীর্তিহাটের পঞ্চগ্রাম সপ্তগ্রামের ব্রাহ্মণ ও হিন্দুসমাজের মাতব্বরদের ডেকে রায়বংশের তালিকা থেকে আমার নাম কেটে দেবার ব্যবস্থা করলেন।

১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল দু’ বছরের মধ্যে মামলা মেদিনীপুর কোর্ট থেকে হাইকোর্ট এসে দাখিল হয়েছিল। এবং এ মামলায় এবার দীর্ঘকাল পর ঘরের কোটরের অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন আমার জ্যাঠামশায় যজ্ঞেশ্বর রায়।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের প্রিয়তম জ্যেষ্ঠপৌত্র। যজ্ঞেশ্বর রায় দেবেশ্বরের সামনে তাঁর প্রিয়পাত্রী গবর্নেস মেমসাহেবের পিঠে চাবুক মেরে তাড়িয়েছিলেন। যজ্ঞেশ্বর রায় বাপের কদাচারের বিরোধী ছিলেন। যজ্ঞেশ্বর রায় নিজের মাকে ক্রীশ্চানপাড়ায় ক্রীশ্চানের ঘরে জল খাওয়ার জন্য পাগল বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁকে বৃন্দাবনে বনবাসিনী করেছিলেন। ভায়লেটের পুত্রের দৌহিত্রী কুইনিকে ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করার যে অন্যায় এবং যে অনাচার আমি করলাম বলে তাঁর মনে হল তা তিনি সহ্য করতে পারেন নি। তাছাড়া তখন তিনি অবস্থার দিক দিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধের কাল, ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে যুদ্ধ এসে পড়েছে; বার্মা ফ্রন্টে ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি উঠেছে; কলকাতার আকাশে জাপানী বম্বার এসে বম্বিং করে গেছে। ইংরেজ আমেরিকান কাফ্রি নিগ্রো পল্টনে দেশ ছেয়ে গেছে। তার সঙ্গে এসেছে লাখ লাখ টাকার নোট, দেশের হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই সুযোগে জ্যাঠামশাই আবার নেমেছিলেন ব্যবসাতে। তাঁর দুই ছেলে এক আমেরিকান কর্নেলের সুনজরে পড়ে মিলিটারি কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন যা থেকে রাতারাতি অবস্থা ফিরে গেছে। আবার গাড়ী কিনেছে বাড়ী কিনেছে; সন্ধ্যার অবকাশ বিনোদনের জন্য ময়দানে ময়দানে নিত্যনতুন বিনোদিনীর সন্ধান ক’রে বেড়ায়। তারাও এসে দাঁড়াল বাপের পিছনে। যজ্ঞেশ্বর রায় কতকগুলো পত্র বের করেছিলেন। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেশ্বর রায় লিখেছিলেন পরস্পরকে। তাতে তাঁর স্বপক্ষে যাবার মত অনেক কিছু ছিল।

সে মামলা ১৯৫৩ সালে সেদিনও মেটে নি। তখনও মামলা চলছিল।

সব মনে পড়ছে সুলতার। ওঃ, সুরেশ্বর নেই! সুরেশ্বর! সুরেশ্বর তার জীবনের প্রথম যৌবনস্বপ্নের রাজপুত্র। পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়েই সে এসেছিল। সোনার কাঠি রুপার কাঠি নাড়ানাড়ি করতে করতে সে তার ঘুম ভাঙিয়েছিল।

ফুল তুলে এনে ঢেলে দিয়ে বলেছিল—মালা গাঁথো। সে মালা গাঁথলে, সুরেশ্বরও মালা গেঁথেছিল কিন্তু বিনিময় করা হয়ে উঠল না। কোথা থেকে তাদের মাঝখান এসে দাঁড়াল তারই পূর্বপুরুষের রক্তের স্রোত। সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রের পিছন থেকে ডাক দিয়েছিল তার নরক-যন্ত্রণাকাতর পূর্বপুরুষেরা। ‘উদ্ধার কর—আমাদের উদ্ধার কর। আমরা বহু ঋণে ঋণী। সে ঋণ শোধ করে আমাদের মুক্ত কর।’

থাক—সে সব কথা থাক। সে সব কথা চাপাই পড়ে থাক; না-চাপা পড়ে নয়, কালস্রোতে অতীতকালের বিস্মৃতির দিগন্তে অন্ধকারে হারিয়ে যাক।

সুরেশ্বর সেই দেনা শোধ করতে চেয়েছিল।

সেদিনও তাই সে বলেছিল সুলতাকে। বলেছিল—এই মামলা আমার জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করে দিলে সুলতা।

বড় বড় আইনজ্ঞেরা বললেন—ব্যাপারটা কতটা জটিল বুঝতে পারছি না। দলিলে অনেক রকম হয়েছে। অনেক ব্যাখ্যা হয়। আচরণেও তাঁরা অনেক রকম ক’রে গেছেন। তবু একটা কাজ করা ভাল। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে স্বতন্ত্র ভাবে বাস করুন। দেবোত্তর বা পৈতৃক সম্পত্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। তিন আইনে বিয়ে করেছেন, ওতে আপনার ধর্ম আপনার, স্ত্রীর ধর্ম তাঁর, তা আইন মানবে। কিন্তু কীর্তিহাটের দেবোত্তর এলাকার মধ্যে তাঁকে আনবেন না। তাতে ওঁরা সুবিধে পাবেন।

শুনে কুইনি আমাকে বললে, তুমি আমাকে বিদায় দাও। আমি চলে যাই। বিদায় না দাও আমি জোর ক’রে চলে যাব।

সুরেশ্বর বলেছিল—বলতে গেলে সে সংঘর্ষ এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ। কুইনি উপবাস শুরু করেছিল। তার স্বামীর জীবনে ঘরে-সংসারে যদি সে সর্বময়ী কর্তৃত্ব না পায় তবে বিবাহ তার কিসের বিবাহ? আর এ যদি দেবেশ্বর রায়ের ঋণশোধ হয় তা হলেই বা সে এ বিবাহ স্বীকার করবে কেন? না, তাও সে চায় না। দেবেশ্বর ভায়লেটের জীবনের দেনাপাওনার শোধবোধ হিসেবনিকেশ একান্তভাবে তাদের ব্যাপার। সুরেশ্বরও দেবেশ্বর রায় নয়, সেও ভায়লেট নয়।

সুরেশ্বর হেসে সেদিন সুলতাকে বলেছিল, আজও সুলতার মনে পড়ছে তার সে হাসিমুখ; সুরেশ্বর বলেছিল—নারীচরিত্র, নারীর মন, নারীর হৃদয় সবই বিচিত্র-সম্ভবতঃ বিধাতার পরম রহস্যময় সৃষ্টি সুলতা। সম্ভবতঃ সে কথা তোমরা নিজেরাও জান না। কুইনি আমার কাছে দুয়ে হয়ে উঠেছিল। আমি যখন বললাম—বেশ চাইনে আমি দেবোত্তরের সেবায়েতের অধিকার। কি হবে ওতে? কি আছে? আছে শুধু দেবতার প্রসাদী অন্ন আর ইস্কুল, ডাক্তারখানার ফাউন্ডার হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার হওয়ার অধিকার। ও আমি চাইনে।

কুইনি সারাদিন ভেবেচিন্তে বলেছিল—না, তাও ছেড়ে দিতে পারবে না।

—কি করব তা হ’লে আমাকে বল?

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল—সে আমাকে বলে দিতে হবে? তুমি জমিদারের বংশের ছেলে—তুমি জান না? তুমি মামলা লড়ে যাও।

—সেই মামলার জন্যই তো উকীলরা বলেছে—আমরা যেন এখন রায়বাড়ী দেবোত্তরের সীমানার মধ্যে বাস না করি। আমরা তিন আইনমতে বিয়ে করেছি; ওতে আমার জাত যায় নি, যাবে না। আজকে বিলেত থেকে এসে কেউ প্রায়শ্চিত্তও করে না। আপত্তি গ্রাহ্য হতে পারে যদি তুমি মনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে দেবতার পূজার্চনার উদ্যোগ-আয়োজনে হাত দাও। মন্দিরে ঢুকতে যাও—

—মন্দিরে না হয় নাই ঢুকলাম কিন্তু তোমার স্ত্রী হয়ে আমি সে অধিকারই বা পাব না কেন?

চোখ ফেটে তার জল এসেছিল।

বলেছিল—তোমার ভগবানের কাছে যদি আমি অস্পৃশ্য হই তবে আমি তোমার ঘরের অধিকার নিয়ে কি করব?

এবার কেঁদে ফেলেছিল ঝর ঝর ক’রে—তাহলে আমার ঠাঁই কোথা রইল বল? গোয়ানপাড়ায় ওদের কাছেও আমার স্থান নেই তোমাদের বাড়ী কীর্তিহাটের বাড়ীতেও না। তোমার স্বর্গেও না। অথচ সম্পত্তির অধিকাংশই আজ তোমার। তুমি জমিদার। আমার জন্যে তুমি চোর সাজবে সেখানে? আমি তোমার স্ত্রী হয়েও আমার প্রাপ্য সম্মান পাব না? তার চেয়ে মুক্তি দাও আমাকে।

সুরেশ্বর বলেছিল—আমি সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম দেবোত্তরের অধিকার ছেড়ে দেব আমি। আমি ধর্ম বলতে গেলে মানিনে। তবু তোমার ধর্মান্তর গ্রহণ করতেও রাজী আছি। আমি রাজ্যের জন্য রামের মত সীতাকে বনবাস দিতে চাইনে। তার থেকে আমিও বনবাসী হব তোমার সঙ্গে।

কিন্তু তাতেও সে রাজী হয় নি।

—না। না। বলে সে শুধু কেঁদেছিল। শুধু কাঁদাই নয়, সাইক্লোনের রাত্রে সে যেমন ভয়ার্ত হয়েছিল তেমনি ভয়ার্ত হয়ে পড়েছিল। বাড়ী থেকে চলে যাবার জন্যে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত গিয়েও সে ফিরে এসেছিল। যেতে তার সাহস হয় নি। ডাইভোর্সের কথাও সে তুলতে পারে নি। কারণ সে তখন একা নয়। তার গর্ভে তখন আমাদের সন্তান এসেছে।

আমি তাকে বলেছিলাম—তা হলে এক কাজ কর। তুমিই হিন্দুধর্ম গ্রহণ কর। তোমার পূর্বপুরুষেরা তো হিন্দু ছিলেন।

তীক্ষ্ণস্বরে প্রতিবাদ করে উঠেছিল সে—না

মনে পড়ছে সুলতার—সুরেশ্বর বলেছিল—দেখ সুলতা, যদি বলতে পারতাম বা সত্যিই এমন হত যে বিষয়সম্পদকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাঁচা যায় বা তার আকর্ষণ ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে একটি পুরুষ এবং একটি নারী পথে বেরিয়ে গাছতলায় বাসা বাঁধতে পারত তা হ’লে সে কথাটা আজ তোমার কাছে উঁচুগলায় বলতে বড় ভাল হ’ত। অন্তত উল্লাস বোধ করতাম। কিন্তু তা হয় নি। এবং সচরাচর তা হয় না। আমাদের দেশে কত অসবর্ণ এবং এ জাতে ও জাতে প্রেম ব্যর্থ হয়েছে তার সংখ্যা নেই। তাতে সমাজ দায়ী বলে এসেছি কিন্তু সমাজের সেখানে শুধু একঘরে করার ক্ষমতাটাই চরম ক্ষমতা নয়, চরম ক্ষমতা সেখানে ঘর থেকে বের করে দেওয়া—সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়া। আমার সম্পত্তি কম সম্পত্তি নয়। মূল দেবোত্তরের আয়ও আমার অংশে খরচখরচা বাদে চার হাজার টাকা। তার সঙ্গে ছিল এক বিচিত্র জেদ—। “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী”।

যে জেদে কুরুক্ষেত্রে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী শেষ হয়ে গিয়েছিল। যে জেদের মামলায় শোভাবাজারের দেবেদের বাড়ীর মামলায় ছ-সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছিল।

আবার কুইনির এবং আমার আকর্ষণ, আমাদের প্রেম এমন ক্ষীণজীবী ছিল না—যা এই স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রথম আঘাতেই মরে যাবে।

আমরা মিথ্যাবাদীও ছিলাম না—আজও নই।

আমরা শেষ পর্যন্ত মামলার জন্যেই আইনজ্ঞদের পরামর্শে আলাদা বাস করতে লাগলাম। কুইনী চলে গেল এলিয়ট রোডের বাড়িতে। সেখান থেকে নার্সিংহোমে। সেখানেই আমাদের একমাত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হ’ল।

সুলতা বিস্মিত হয়েছিল—তোমার ছেলে?

—হ্যাঁ। আমাদের ছেলে। কুইনির এবং আমার। মানবেশ্বর। কুইনি তাকে নিয়ে দেরাদুনে থাকে। ছেলে থাকে রেসিডেনসিয়াল ইস্কুলে, কুইনি থাকে বাড়ীতে সেখানে একখানা বাড়ি কিনেছে সে। ওখানে সে চাকরিও একটা করে। মানবেশ্বরের জন্মের পর সে ভর্তি হয়েছিল কলেজে; তোমাকে আগে বলেছি সে অর্চনার সঙ্গে এম-এ পাস করেছিল। সে আমার কাছ থেকে তার নিজের জন্যে কিছুই নেয় না, মানবের খরচ নেয়। সম্ভবতঃ আমরা দুজনে পরস্পর থেকে দূরে গিয়ে পড়েছি। অনেকটা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

পরস্পর থেকে দূরে দূরে থাকলে যা হয়। যেমন তোমার সঙ্গে হয়েছে। তাই। তা ছাড়াও কারণ আছে সুলতা। সে যা চায় আমি তা ঠিক সমর্থন করি না। আমি যা চাই তার সে প্রতিবাদ করে।

দেখ, আমার মনে একটা কল্পনা আছে। রায়বংশের পূর্বপুরুষেরা মানুষের কল্যাণ যা ক’রে গেছেন তার পুণ্য তাঁদের—কিন্তু যে সব অকল্যাণ অত্যাচার করে গেছেন সে তাঁদের পাপ তাঁদের দুর্নাম, যা আজকে রায়বংশের ছেলেদের কপালে উল্কিতে কলঙ্কচিহ্নের মত আঁকা হয়ে গেছে, তার জন্যে কিছু করে যাব।

১৯৪৮-৪৯ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষের ক্রমশ গ’ড়ে ওঠা তোমরাও দেখেছ, হয়তো, রাজনীতি ভাল বোঝ, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছ, তোমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পার কিন্তু আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম, শিল্পী হিসেবে কাজ পেয়েছিলাম, সে আমি নিয়েও ছিলাম। অবস্থা সচ্ছল বলে প্রত্যাখ্যান করি নি। কয়েকজন বড় নেতা বা ভারতভাগ্যবিধাতার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তাঁরা স্নেহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্দার প্যাটেল একজন। তিনি প্রথম দিন আমাকে দেখে বলেছিলেন—তুমি আর্টিস্ট রয়?

বলেছিলাম —Yes sir.

—আমার মনে হচ্ছে তোমার পিছনে একটা পুরনো ফ্যামিলির ট্রাডিশন রয়েছে। তোমার চেহারা তোমার সহবৎ বলছে।

বলেছিলাম—সামান্য আয়ের জমিদারবংশের ছেলে।

—হ্যাঁ। সেই কথাই বলছি। খুশী হয়েছি তোমাকে দেখে। আরও খুশী হয়েছি তুমি শিল্পী হিসেবে কাজ করছ বলে। গুড।

তাঁর স্নেহ পেয়েছিলাম সুলতা। সেই সূত্রে আমি ভারতবর্ষের ইন্ট্রিগ্রেশন চোখে দেখেছি। ভারতবর্ষের মহারাজা মহারাণাদের সে এক আশ্চর্য মহিমা।

দু’একজন জুনাগড়ের নবাব, হায়দ্রাবাদের নিজাম বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু সেটা ক্ষুদ্র বৈষয়িক স্বার্থের জন্য নয়। সেটা ধর্মের গোঁড়ামি বলতে পার আবার সেটাকে উল্টে পাকিস্তানীদের ধর্মের জন্য ত্যাগের মহিমাও বলতে পার।

হেসে বলেছিল সুরেশ্বর যে বিচারবুদ্ধি সেকুলার স্টেট ভারতবর্ষে সামাজিক বিধানে আমার এবং কুইনির মধ্যে নল আর দময়ন্তীর মাঝখানে ছুরি হাতে কলির মত আকর্ষণের বন্ধন কেটে দিচ্ছিল।

যাক। মোটমাট দিল্লী থেকে ১৯৫০ সালে আমি একটা মন নিয়ে ফিরেছিলাম। বলতে পার, ইমোশনাল মন। যে মন আমাকে বলেছিল—জমিদারী তুমিও সরকারকে দিয়ে দাও। বল স্বাধীন ভারতবর্ষে গভর্নমেন্টের অধীনে কীর্তিহাটের প্রজাদের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে থাকব আমি। তোমরা নাও জমিদারী। জমিদারীর আয় এখানকার মানুষের কল্যাণের জন্য খরচ করা হোক!

এতে কিন্তু কুইনি রাজী হয় নি। মুখে আপত্তি করে নি কিন্তু খুশি সে হয় নি।

আমি বলেছিলাম—এতেই রায়বংশের পূর্বপুরুষদের সকল অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে।

সে বলেছিল-মানবেশ্বরের মা হিসেবে আমি এতে আপত্তি করছি। সে জমিদারবংশে জন্মে কেন সাধারণ প্রজার সঙ্গে এক হয়ে বাস করবে কীর্তিহাটে?

সেদিন সুরেশ্বরের জবানবন্দীতে কীর্তিহাটের কড়চায় এইখানেই ছেদ পড়েছিল। কারণ ঠিক এই সময়টিতেই একখানা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই ট্যাক্সি থেকেই নেমেছিল একটি আধুনিকা মেয়ে এবং তার হাত ধরে একটি ছেলে।

সুলতার বুঝতে বাকী থাকে নি তারা কে। ছেলেটির মুখে সুরেশ্বরের ছাপ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। মেয়েটির মধ্যে ছিল একটি মিশ্র সৌন্দর্যের আভাস। রুখু চুলে পিঙ্গল আভাস, চোখের তারাতেও ছিল তাই। তার মধ্যে আছে মোহ।

এই কুইনি। মা ছেলের মুখে পাহাড় থেকে নেমে আসার ছাপ রয়েছে।

সুরেশ্বর প্রপিতামহ-পিতামহের ঋণশোধ করতে—অঞ্জনার মেয়ে ভায়লেটের ছেলের দৌহিত্রী এই মেয়েটিকে সেই আকর্ষণে জীবনে গ্রহণ করতে চেয়েছিল অথবা ওর রূপের মোহে মোহাবিষ্ট শিল্পীর মত আপনাকে হারিয়ে ওকে গ্রহণ করেছিল, তাতে তার প্রশ্ন জেগেছিল।

কিন্তু আর সে ওখানে অপেক্ষা করতে চায় নি। চলে আসতে চেয়েছিল।

আলাপ করিয়ে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ আটকে রেখেছিল তাকে সুরেশ্বর। কিন্তু জবানবন্দী বা কড়চার কথার ওখানেই শেষ। তবে আরও খানিকটা আন্দাজ করে নিয়ে ছিল সুলতা কথাবার্তা থেকে।

প্রাথমিক আলাপের কুইনি হঠাৎ বলেছিল সুলতাকে—আপনি বয়সে বড়–দিদি বলব আপনাকে। কেমন?

সুলতা বিব্রত বোধ করেছিল, তবু বলতে হয়েছিল—বেশ তো!

কুইনী বলেছিল—সম্ভবত জানেন যে উনি জমিদারী বিনা কমপেনসেশনে নেবার জন্যে গভর্নমেন্টকে মানে চীফ মিনিস্টার ডাঃ রায়কে পত্র লিখেছেন?

সুলতা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, বলেছিল—কই জানিনে তো! এ কথা তো বলনি সুরেশ্বর!

হেসে সুরেশ্বর বলেছিল না, বলি নি। ডাঃ রায়ের জবাব এখনও পাই নি। ২৩শে অ্যাসেম্বলীতে বিলটা পাস হয়েছে। ২৪শে মানে গত পরশু হঠাৎ চিঠিটা লিখে ফেললাম। টেলিফোনে কথাটা কুইনিকে জানিয়েছিলাম। ও রাগ করলে। কথাটা তোমাকে বলা হয় নি। বলবার সময়ও পাই নি। পুরনো কথা—

কুইনী কথাটা কেড়ে নিয়ে বলেছিল—দেখ, জীবনে বোধ হয় আমাদের মেলবার অধিকারই ছিল না। আকর্ষণ অনেক সময় দুর্নিবার হয়, আত্মসম্বরণ করা যায় না। তবু সম্বরণ করতে হয় নইলে চরম মূল্য দিতে হয়। আমাদের তাই হয়েছে। তোমারও ভুল আমারও ভুল। তার মাশুল আমি দিচ্ছি দেব, তুমিও দিচ্ছ সম্ভবত দিয়ে যাবে। একদিন হঠাৎ দিতে অস্বীকার ক’রে আবার নতুন জীবন আরম্ভ করবে তা বলছিনে। আমরা পৃথক হয়ে রয়েছি, পৃথক হয়েই গেছি। আমার কোন দাবীই তোমার কাছে নেই। সে জানাচ্ছি নে। কিন্তু মানবেশ্বর? ওর অধিকার ও ছাড়বে কেন? আপনি বিচার করে বলুন সুলতাদি?

সুলতাকে বলতে হয়েছিল—কথাটা উনি অন্যায় বলেন নি সুরেশ্বর। এতে কি হচ্ছে? যেখানে বছরে বছরে ডেভেলপমেন্টের নাম করে দেশবিদেশ থেকে হাজার কোটী দরুনে টাকা ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে তোমার কমপেনসেশনের অল্প হয়তো লক্ষই হল- তা গভর্নমেন্টকে ছেড়ে দিয়ে কি লাভ হবে?

সুরেশ্বর বলেছিল—রায়বংশের পূর্বপুরুষেরা মুক্তি পাবেন হয়তো। আর আমার মন বলছে, তাঁরা মুক্তি পান আর না পান, আমি মুক্তি পাব। বাংলা দেশের ইতিহাসের নথিপত্রের মধ্যে থাকবে, মহাকালের খাতাতেও থাকবে, অন্ততঃ একজনও জমিদারীর কমপেনসেশনের টাকা নেয় নি।

এবার কেউ কিছু বলবার আগেই পরশু রায়বাড়ির যে শরিকরা এসেছেন কলকাতায়, তাঁরা এসে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকলেন।

কুইনি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে বললে—এই যে এঁরাও হাজির হয়েছেন। ওঁদের দাবী মিটিয়ে মিটমাট করবে নাকি? কিন্তু কেন করবে? আমাদের জীবনের ধারা যুক্তবেণী থেকে মুক্তবেণীতে খুলে দু দিকে বেয়ে গেল; চলছে সমুদ্রমুখে, আর তো মিলবে না। এখন আর কার স্রোত বন্ধ করে মুখে বাঁধ দেবে?

—ধর, আমার।

—না, আমারও না, তোমারও না। এই ভাল।

—সুরেশ্বর! কার গম্ভীর আওয়াজ এসেছিল নিচে থেকে।

—যাচ্ছি অতুলকা। বস

অতুলেশ্বরকে নিয়ে এসেছিল রায়বাড়ীর শরিকেরা। সুরেশ্বরের আগেই সুলতা উঠে বলেছিল—আমি উঠলাম সুরেশ্বর!

ওইখানেই সুরেশ্বর ও কীর্তিহাটের কাহিনীর কড়চার জবানবন্দী শেষ হয়েছিল চার বছর আগে। ১৯৫৩ সালের ২৬শে নভেম্বর সকালবেলা নটার সময়। সুলতা চলে এসেছিল। আর খবর রাখে নি। ভুলেই গিয়েছিল এক রকম। ওরাও খোঁজ করে নি। সে নিজেও করে নি।

***

এতকাল পর আজ হঠাৎ এই চিঠিখানা!

ও! সুরেশ্বর নেই! কয়েক ফোঁটা চোখের জল টপটপ করে ঝরে পড়ল তার। টেবিলে ভর দিয়ে হাতের তালুতে থুতনি রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি। ঝিরঝির করে একপশলা বৃষ্টি এসেছে। মৃদু মৃদু জলে ভেজা হাওয়া আসছে। তার সঙ্গে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির ছাট।

কিছুক্ষণ পরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে হাতে লেখা চিঠিখানা খুললে। নীচে নামটা দেখলে সাবিত্রী দেবী। তার পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে লিখেছে ‘কুইনি’।

কুইনিই সাবিত্রী! সাবিত্রী? কে? কেউ দিয়েছিল নামটা? কেউ মানে সুরেশ্বর, না অর্চনা, না নিজেই ও নিয়েছিল?

হঠাৎ কুইনি থেকে সাবিত্রী কেন?

থাক। থাক সে কথা। সে চিঠিখানা পড়লে। লিখেছে

“ভাই সুলতাদি,

এ ছাড়া আর কি বলে সম্বোধন জানাব আপনাকে? দেখতেই পাচ্ছেন উনি নেই। ছ’ মাস আগে দোলপূর্ণিমার দিন আমাকে মানবকে ফেলে চলে গেছেন। আগামী শ্রাবণ মাসে ঝুলন পূর্ণিমার দিন তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া করবে মানব। আপনি আসবেন দয়া করে? এলে খুব খুশী হব। কীর্তিহাটে আপনাকে একবার নিয়ে আসবার একান্ত অভিপ্রায় ওঁর ছিল। আমি একান্তভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, আসবেন।

ইতি সাবিত্রী রায় (কুইনি)”

সুলতা মনে মনে বললে, যাব বইকি। যাব। নিশ্চয় যাব। দেখে আসব।

গেল সুলতা। খবর দেওয়া ছিল, রাস্তাঘাট এখন সুগম হয়েছে, পিচঢালা রাস্তা, কোন কষ্ট হল না তার। স্টেশনে গাড়ী ছিল, আর ছিল রঘুয়া। পথ, মোটরেও ঘণ্টা দেড়েক লাগল। বাস চলছে, তার সঙ্গে গরুর গাড়ী চলছে। আগে বাস ছিল না, মোটর ছিল না, বড় বড় জমিদারদের পাল্কী চলত, হাতী চলত। জুড়িগাড়ীও মধ্যে মধ্যে চলত।

কীর্তিহাটে এসে যখন ঢুকল, তখন বেশ বেলা হয়েছে কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; রোদ্দুর ওঠে নি এখনও। সব যেন ভিজে নরম হয়ে গেছে। মনটা সুলতার উদাসীন হয়েই ছিল। আরও যেন সজল এবং নরম হয়ে উঠল।

সর্বাগ্রে চোখে পড়ল বিরাট বড় ভাঙা তে-মহলা বাড়ীটা। প্রায় মুখ থুবড়ে পড়বার মত হয়ে আছে। যে কোন দিন যে কোন মুহূর্তে পড়তে পারে।

সুলতা জিজ্ঞাসা করলে রঘুকে—রঘু, ওইটে বুঝি বাবুদের বাড়ী?

—হাঁ দিদিমণি। অন্দরমহল। কাছারী, ঠাকুরবাড়ী ওদিকে আছে।

—ভেঙে ফেটে তো চৌচির হয়েছে!

—হাঁ। বাবুই তো মেরামত করাতেন। থাকত সব শরিকরা। তা মামলা বাধলো তো বন্ধ করে দিলেন মেরামত। শরিকরা সব জানলা-দরজা খুলে নিয়ে গেল। ছাদ ভাঙিয়েছে, কড়ি-ভি নিয়ে গেছে।

—বিবিমহল কোনটা?

—সেটা থোড়া দূর। একদম নদীর কিনারে। উ ঠিক আছে। মেরামত করাইসেন বাবু। ওই দেখেন।

বিবিমহল অটুট আছে। তবে নাম পাল্টে গেছে। বাড়ি ঢুকবার ফটকটার থামের গায়ে ট্যাবলেট মারা ‘ভবানী নিবাস’। হাসলে সুলতা। শতাব্দীর কালিপড়া দেওয়াল কি একটা পাতলা সাদা কলি চুনের আস্তরণে ঢাকা পড়ে! তবে সুরেশ্বরের মনটা সে বুঝতে পারলে।

অর্চনা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে বললে-এস ভাই সুলতাদি। চা খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নাও। চল, শ্রাদ্ধ দেখবে চল। বার বার করে বলেছে কুইনি, যেন সুলতাদিকে নিয়ে যেও।

—সে কি সেখানে? শ্রাদ্ধের আসরে?

—হ্যাঁ।

সবিস্ময়ে সুলতা প্রশ্ন করলে-শ্রাদ্ধ কি রকম হচ্ছে, মানে কি মতে? চিঠিতে বৃষোৎসর্গ লেখা!

অর্চনা বিষণ্ণ হেসে বললে—হ্যাঁ, হিন্দুমতেই হচ্ছে। হিন্দুশ্রাদ্ধের যে পদ্ধতিতে বৃষোৎসর্গ হয়। তুমি যা বলছ বুঝেছি। কিন্তু সুরোদার মৃত্যুর পর এমন ভেঙে পড়ল কুইনি যে শরিকদের ডেকে তাদের জমি-জেরাত ছেড়ে দিলে, তারপর পণ্ডিতদের মত নিয়ে ক্রিয়া করে হিন্দুধর্মে দীক্ষা নিয়ে সাবিত্রী নাম নিয়েছে। নামটা অবশ্য সুরোদাই দিয়ে গিছল। মানব শ্রাদ্ধ করবে, সে শ্রাদ্ধের চরু রাঁধবে। সেখানেই রয়েছে সে।

সুলতা বললে—ট্রেনেই ভোরবেলা হাতমুখ ধুয়েছি। স্টেশনে এক কাপ চাও খেয়েছি। চল আগে শ্রাদ্ধের ওখানেই চল।

—এস। বলে চলতে সুরু করলে অর্চনা। বিবিমহল থেকে বেরিয়ে বড় বাগানের ভিতর দিয়ে অন্দরমহল হয়ে ঠাকুরবাড়ী। সুলতার মনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেক প্রশ্ন। হঠাৎ সুলতা থমকে দাঁড়াল। বললে—একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

অর্চনা বিষণ্ণ হেসে বললে—কুইনির কথা?

—হ্যাঁ। সেবার তো দেখে গেলাম ওঁরা পৃথক বাস করছেন, ডাইভোর্স হবে বলেই মনে হল।

অৰ্চনা বললে—হ্যাঁ। তাই আমরাও ভেবেছিলাম। চলছিলও ওইভাবে। কুইনি চাকরি নিয়েছিল। দেরাদুনেই থাকত। মানব বড় হতে একটু গোলমালও বেধেছিল। সুরোদা ওকে দেরাদুন থেকে সরিয়ে শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলেন। কুইনি নভেম্বর শীতের ছুটিতে আসত, শান্তিনিকেতনে বাড়ী কিনেছিলেন সুরোদা, সেখানে এসে ছেলেকে নিয়ে থাকত। আবার গরমের সময় মানবকে সুরোদা পাঠিয়ে দিতেন দেরাদুন। নিজে আজ কলকাতা, কাল কীর্তিহাট, পরশু শান্তিনিকেতন করে ফিরতেন। সুরোদা জমিদারী বিনা কম্পেনসেশনে গভর্নমেন্টকে দিতে চেয়েছিলেন, জানেন কিনা জানি না।

সুলতা বললে—জানি। কি হল তার?

—ডাঃ রায় লিখেছিলেন, আপনি টাকাটা নিয়ে কিছুতে দান করে দিন। আমরা বিনা কম্পেনসেশনে জমিদারী নিতে পারি না। আইনে বাধবে। সুরোদার ইচ্ছে টাকাটা তিনি স‍ই করে হাত পেতে নেবেন না। তাই একটা কিছু করবার চেষ্টায় ঘুরছিলেন। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তাতে জমিদারী স্বত্বটাই দান করে দেবেন। তারাই টাকাটা নেবে। এই খাটাখাটনি আর ওই দোষ, মদ খাওয়া। ওতেই হঠাৎ হল করোনারি অ্যাটাক। শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে কুইনি এল। এসে তাঁর বিছানার পাশে বসল। বাড়াবাড়িটা কমলে একদিন সুরোদাকে বললে, আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দাও। সুরোদা বললে—দেব? কুইনি কেঁদে ফেলেছিল ঝরঝর করে। ছ’টা মাস সুরোদার বিছানার পাশ থেকে ওঠে নি। শেষকালটায় ওর কোলেই মাথা রেখে শুয়ে থাকতে ভালবাসতেন। নামটা পাল্টে সুরোদাই সাবিত্রী বলে ডাকতেন। ওর কোলেই মাথা রেখে সুরোদা চলে গেল। গত ফাল্গুন মাসে। তখনই কুইনি ওই দীক্ষা নিয়ে বিধবা সাজলে। ওটার দরকারও ছিল। না করলে এখানকার লোকে আপত্তি করত। নারায়ণ মন্দিরের চত্বরে শ্রাদ্ধ হচ্ছে, সামনে রাজরাজেশ্বরশিলা, মন্দিরে রাধাসুন্দর বিগ্রহ, ওখানে কুইনিকে চরু রাঁধতে দিতো না। অবশ্য অন্য কেউ রাঁধলেও চলত। কিন্তু কুইনি ওটা নিজে হাতে করবে বলেই প্রতিজ্ঞা করেছিল যেন। মনে ওর দ্বিধা হয়েছে, কষ্ট হয়েছে দীক্ষা নিতে। আমি বলেছি, কেন, তোমার দীক্ষা নিয়ে কাজটা কি? এখন তো হিন্দু কোডবিল পাস হয়েছে, এখন তো সম্পত্তি নিয়ে গোল বাধবে না।

ও বলেছিল—না, অর্চনা ভাই, তাঁর শ্রাদ্ধে চরু আমি রাঁধব না, অন্যে রাঁধবে, তা সইতে আমি পারব না। বেঁচে থাকতে এই সম্পত্তির জন্যে আর ধর্মের জন্যে আমি তাঁকে পেয়ে হারালাম। তিনি আমাকে পাবার জন্যে তপস্যা করে পেলেন, পেয়েও ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। তিনি মারা গেছেন। আজ যদি আমি এইটুকু না করি, তবে মানুষেরা বলবে, এ তার কেউ নয়, কেউ ছিল না। হয়তো মানবও বলবে। হয়তো অর্চনা আমার মনও বলবে। বলবে- সে আমার কেউ ছিল না। আমিও তার কেউ ছিলাম না। ধর্ম আর সম্পদ এ দুটো আমাদের জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিল। আজ আর আমি আমার কিছু রাখব না। তাঁর ধর্ম, তাঁর কর্ম, তাঁর সম্পদই আজ আমার সব হোক। দীক্ষা নিতে হবে, অন্ততঃ যেন চরু রাঁধতে কেউ বাধা না দেয়। শেষকালটায় সুরোদা কুইনি-কুইনি করে পাগল হয়েছিলেন। সরে গেলেই ডাকতেন, সাবিত্রী! সাবিত্রী! আর বলতেন, “আমাকে ভুলে যাবে না তো?”

কুইনি বলত–আঃ, কি বলছ!

—ভুলে গেলে যদি আত্মা থাকে তবে বড় কষ্ট পাবে, আমার আত্মা! জান এখন আত্মা আছে ভাবতে ভাল লাগছে।

কেঁদে ফেলত কুইনি। ঝরঝর করে কাঁদত। শেষকালটাতেও সেই কথা।

আঁচল দিয়ে চোখ মুছলে অর্চনা। সম্ভবতঃ সুরেশ্বরের মৃত্যুকালটা মনে পড়ে গেল।

সুলতা বললে—শেষকালটায় আর কি হয়েছিল?

—কি আর হবে! যা হয়েছিল—হাইপ্রেসার। ঘুম হত না। মধ্যে মধ্যে কাশতো। ঠেস দিয়ে বসা, আধশোয়া হয়ে থাকত। হাতখানা থাকত কুইনির কাঁধে। কুইনি বুকে হাত বুলোেত। একটু সামলে নিয়েই বলত, “আমাকে যেন ভুলো না।” আর আক্ষেপ, রায়বাড়ীর দেনা শোধ হল না। রায়বাড়ীর অনেক দেনা। ভেবেছিলাম কমপেনসেশনের টাকা দিয়ে প্রতি গ্রামে একটা করে কিছু করে দেব। তা হল না। এই আপসোস।

কথা বলতে বলতেই তারা পথ চলছিল। বিবিমহল থেকে অন্দরমহলে ঢুকে, মহলের পর মহল পার হয়ে চলছিল ঠাকুরবাড়ীর দিকে

অৰ্চনা বললে—কখনও বলত, দেখ সাবিত্রী, আমি বোধ হয় মিথ্যে ঋণ-ঋণ করছি। কিসের ঋণ বল তো? রায়েরা তো কীর্তিহাটের জন্য কম করে নি! অনেক করেছে। অনেক। ইস্কুল, ডাক্তারখানা।

একেবারে তিন-চার দিন আগে সিদ্ধান্ত করেছিল জমিদারী কমপেনসেশনের টাকা ওই দক্ষিণী ব্রাহ্মণের ভূদান যজ্ঞে দিয়ে দিও সাবিত্রী। “সব ভূমি গোপাল কি হ্যায়! যে বলে তার যজ্ঞে দিও। তাতেই ঋণশোধ হবে আমাদের।”

সোসালিজম কম্যুনিজম বুঝি না কুইনি। ‘সব ভূমি গোপাল কি’ বললে বুঝতে পারি। মন প্রসন্ন হয়। ওখানে দিও।

বিস্মিত হয়ে সুলতা প্রশ্ন করলে—বিনোবাজীর ভুদান দেবার কথাই বুঝি শেষ সিদ্ধান্ত!

—হ্যাঁ। সুরোদা তাই বলে গেছে। তার থেকে ভাল পথ বা দেবার মত আধার সে আর পায় নি। কুইনি এর মধ্যে গিয়ে দেখা করে এসেছে বিনোবাজীর সঙ্গে—বলতে বলতে তারা এসে ঢুকল রাধাসুন্দরের চত্বরে।

সেখানেই হয়েছে শ্রাদ্ধের আয়োজন। সামনে বেদীর উপর বসানো সিংহাসনে রাজ-রাজেশ্বর ঠাকুর, তার নীচে সুরেশ্বরের নিজে হাতে আঁকা পোর্ট্রেট। চারটি ষোড়শ। তাছাড়া আরও একটি রূপোর ষোড়শ। ঝকমক করছে পালিশ করা চাঁদির ঘড়া থালা বাটি গেলাস পিলসুজ প্রভৃতি। একখানা নতুন দামী খাট, দামী বিছানা, তাতে নেটের মশারি টাঙানো। এ ছাড়াও চারখানি খাট, তাও খাটিয়া নয়; তাও বার্নিশ করা ঝকমকে খাট।

ভাঙা বাড়ীর সমস্ত বিষণ্ণতা এবং সঙ্কোচ যেন ধুয়ে-মুছে গেছে এখানে, এই শ্রাদ্ধের সমারোহে এবং মূল্যবান জিনিসগুলির সমাবেশে। চত্বরে অন্যদিকে শতরঞ্চির উপর ধবধবে চাদর বিছিয়ে আসর পাতা হয়েছে। সেখানে একদিকে শাস্ত্রজ্ঞেরা বসেছেন, অন্যদিকে বসেছে গ্রামের ভদ্রজনেরা। তার সঙ্গে কয়েকজন নিমন্ত্রিত অতিথি। শাস্ত্রের আলোচনা হচ্ছে।

ওপাশে ভোগবাড়ী। সেখানে রান্নাবান্না হচ্ছে। ধোঁয়া উঠছে। ব্যঞ্জন-রান্নার গন্ধ আসছে। ঘি পোড়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আজ নিয়মমত লুচি সহযোগে ফলাহার।

একদিকে বসেছে রায়বাড়ীর মেয়েরা। রূপ দেখলেই বোঝা যায়।

মন্ত্রপাঠ করাচ্ছেন পুরোহিত, সামনে মুণ্ডিতমস্তক মানবেশ্বর বসে আছে, তার পিঠ ধরে বসে আছে কুইনি। চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থার মত বসে আছে। তারও ঠোঁট নড়ছে। বোধ হয় মনে মনে সেও মন্ত্রপাঠ করে যাচ্ছে, পুরোহিত বলছেন—ওঁ মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবা

সব কিছু মিলে ভারী ভাল লাগল সুলতার। ধীরে ধীরে যেন অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল সে।

তার মনে হল যেন জমিদারদের শেষ অ্যারিস্ট্রোক্রাট মানুষটি জীবনরঙ্গমঞ্চে তাঁর ভূমিকা শেষ করে প্রস্থান করছেন। প্রস্থান করছেন এই সমারোহের মধ্যে দিয়ে। যাবার সময় তাঁর সঞ্চয় সম্বল সব উজাড় করে দিয়ে-থুয়ে শূন্যহাতে হাসিমুখে চলে যাচ্ছেন। বংশের দেনা যদি বাকী থেকে থাকে তো থেকে গেছে, থাক। তার জন্য পরলোক থাকলে নরকে খেটে শোধ দেব। না থাকে হল না শোধ। হল না, হল না। আর পাওনাই যদি থাকে তো থাক, তাও তিনি চান না। ও সবই দান করে গেলেন। চলে যাচ্ছেন কোন ঊর্ধ্বলোকে। কাঁধের চাদর উড়ছে বাতাসে। কোঁচানো ধুতির কোঁচার ভাঁজ খুলে খুলে উড়ছে। সুরেশ্বর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

নীচে ধ্যানস্থার মত বসে আছে কুইনি।

সুলতার বার বার দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে কুইনির উপর। চোখে জল এল তার। সে চোখ বন্ধ করলে। আঁচল দিয়ে মুছলে।

অন্ধকার হয়ে গেল সব।

যবনিকা নামছে বোধ হয়।

নতুন কালের যবনিকা উঠুক। মানুষের কালের।

কীর্তিহাটের কড়চা সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *