২
অন্নপূর্ণা দেবী বড় জেদী মানুষ ছিলেন। বেটাছেলে হলে সম্ভবতঃ সম্পত্তির জন্য মামলা করুন বা না করুন দাদা রত্নেশ্বর রায়ের সঙ্গে খুনোখুনির মত একটা কিছু ক’রে বসতেন। মেয়ে বলেই তা করেননি। তার বদলে ত্যাগ করে সব ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন কাশী, পিসেমশাই এবং পালকপিতা বিমলাকান্তের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাইয়ের কাছে আসেন নি। রত্নেশ্বর রায়ও আশ্চর্য মানুষ, বীরেশ্বর রায়ের নামে যে সব কলকাতার সম্পত্তি ছিল তাও বোনকে দিতে চাননি। জানবাজারের এই বাড়ীখানা, এখানাও সেই সম্পত্তির মধ্যে খানিকটা সুলতা। এগুলো অন্তত অন্নপূর্ণা দেবী ওই শ্যামাকান্তের কলঙ্ক এবং বিমলাদেবীর সন্তান চুরির কেলেঙ্কারিকে সামনে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মামলা চালাতে পারতেন, কিন্তু তাও তিনি করেননি।
জমিদারী ব্যবস্থায় ইংরেজ যখন সামন্ততন্ত্রকে পল্টন সিপাহী হাতিয়ার ইত্যাদির হাঙ্গামা থেকে মুক্ত ক’রে হাল্কা-পক্ষা এবং পরগণাগুলোকে প্লটে তৌজিতে ভাগ করে ছোট ক’রে দিলে, তখন এর প্রভাবে দুটো ফল ফলেছিল; অনেক মধ্যবিত্ত উপরে উঠে জমিদার বনে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় রক্তারক্তিতে যুদ্ধের নেশা মিটিয়েছে, জাল-জালিয়াতি করে পাপের শেষ রাখেনি, আবার অনেক ক্ষেত্রে মনকে উঁচুও করেছিল।
রত্নেশ্বর তাঁর জীবনে ছোটতে বড়তে, দেওয়ানীতে ফৌজদারীতে, মানি সুটে, রেন্ট সুটে, টাইটেল সুটে, সাধারণ ক্রিমিন্যাল কেস এবং সেসনস কেসে মুন্সেফী আদালত এবং ডেপুটি এস-ডি-ও থেকে জজকোর্ট পর্যন্ত আপীল নিয়ে যে মামলা-মকদ্দমা করেছেন তার সংখ্যা কত হবে জান? আমি এক লক্ষ পঁচিশ হাজার পর্যন্ত গুনে আর চেষ্টা করিনি। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী জীবনে কি বাপের সম্পত্তি কি স্বামীর সম্পত্তির ভাগের জন্য একটিও মামলা করেননি। অন্নপূর্ণাদেবী যদি বীরেশ্বরের পুত্রসন্তান হতেন তবে তিনি যে কি হতেন তা বলতে পারব না। তবে কন্যা হয়েও যে বংশধারাটি তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তা সত্যই অসাধারণ। এবং তাঁর নিজের কথা যা বলেছি তোমাকে, তা একবিন্দু বাড়িয়ে বলিনি।
এই অন্নপূর্ণা দেবী এসে দাঁড়ালেন বরানগরের রত্নেশ্বর রায়ের জ্যেষ্ঠ পৌত্র যজ্ঞেশ্বর রায়ের স্ত্রীর পিতৃদত্ত বাড়ীর দরজায়। যজ্ঞেশ্বর রায় তখন সর্বস্বান্ত, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, ইনসলভেন্সী নিয়েছেন, কিন্তু তবু পাওনাদারের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। কারুর সঙ্গে দেখা করেন না। সব ঐশ্বর্যবিলাসই গেছে, কিন্তু একজন গুর্খা দারোয়ান তখনও পর্যন্ত আছে। সে দরজা আটকালো।
আটকালো বটে, কিন্তু খুব সম্ভ্রমভরেই বললে-বাবুজীর বেমার আছে মাইজী, যানে কো মানা হ্যায়।
অন্নপূর্ণা দেবীর চেহারার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যাকে কেউই বোধহয় লঙ্ঘন করতে পারতো না। আমার রূপের প্রশংসা তোমার কাছে করে লাভ নেই। তবে আমাকে দেখে খেলো লোক কেউ ভাববে না নিশ্চয়। দারোয়ান আমার পথ আটকাতে পারতো অন্য ভঙ্গিতে। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবীর মহিমাকে লঙ্ঘন করা যেতো না।
অন্নপূর্ণা দেবী তাকে ধমকালেন না। তার উপর অসন্তুষ্ট হলেন না। বললেন —তোর তো কথাবার্তার তরিবৎ খুব ভাল রে বাবা!
লোকটা খানিকটা অবাক হয়ে গেল; হয়তো বা অন্নপূর্ণা-মা কি বললেন তা ঠিক ধরতে পারলে না, তবে তার আভাসেই সে ধন্য হয়ে গেল। এমন এক মাঈজী তার কথাবার্তার তারিফ করছেন।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন-দেখ, আমি তোর বাবুর পিতাজীর ফুফু আছি। বাবুজীর দিদিয়া। উনকে দেখনে কো লিয়ে আয়ি হ্যায়, আওর দু-চার বাত ভি হ্যায়। লেকিন উসমে ঝামেলা কুছ নেহি হ্যায়; সমঝা? ডিক্রীকে বাত ভি নেহি, কুছ মাঙনে কি বাত ভি নেহি। সমঝা? ছোড় দরওয়াজা, মুঝে যানে দো। নেহি তো উপর যাকে বাবুজী সাব কি কহনা কি অন্নপূর্ণা মাঈজী আয়ি হ্যায় ভওয়ানীপুর সে। হাঁ?
বলতে বলতেই সিঁড়ির মাথায় দেখা দিলেন জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা খুব বড় ব্যবসাদার বাড়ীর মেয়ে।
এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন—ঠাকুমা! আপনি!
—হ্যাঁ আমি। যজ্ঞেশ্বরের কাছে এসেছি।
আমিও সুট ক’রে গিয়ে প্রণাম করলাম। জ্যাঠাইমাকে। জ্যাঠাইমা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—সুরেশ্বর!
—হ্যাঁ জ্যাঠাইমা, আমি
—দাড়িটাড়ি রেখে এ কি চেহারা করেছিস রে!
অন্নপূর্ণা-মা বললেন—ওসব আমি সব ব্যবস্থা করব। ওকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছি, ও দাড়ি কামাবে।
জীবনে সবেতেই একটা গৌরচন্দ্রিকা অর্থাৎ ভূমিকা থাকে সুলতা, সেদিনের গৌরচন্দ্রিকার সব কথাই বাদ দেব, কেননা তাতে অনেক সময় নেবে।
সেদিন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খাঁটি অ্যারিস্টোক্র্যাট রায়বংশের মহিলা, বয়স পঁচাত্তর বছর, তিনি দাঁড়ালেন রায়বংশের আর একজন খাঁটি জমিদার ব্যবসাদার তনয়ের সম্মুখে।
ভূমিকা যা তা জ্যাঠাইমার সঙ্গেই শেষ হয়েছিল। জ্যাঠাইমা জ্যাঠামশায়কে খবর দিয়ে তাঁকে একরকম প্রস্তুত ক’রে দিয়ে তবে অন্নপুর্ণা-মাকে জ্যাঠামশায়ের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত যজ্ঞেশ্বর রায়ের ডান দিকটা পঙ্গু হয়ে গেছে, হাতখানা থেকে পা পর্যন্ত স্নায়ুগুলো সব অবশ হয়েছে, কিন্তু ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত ঠিকই আছে, কথাবার্তাও বলতে পারেন, তবে একটু যেন জড়ানো জড়ানো; বসেছিলেন সে-আমলের প্রকাণ্ড বড় একখানা খাটে। খাটের গদিটা পাশে পাশে ছিঁড়ে ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে। উপরের তোশকখানা ছেঁড়া নয় তবে পিটানো, এমন শক্ত যে জমানো তুলোর একখানা তোশক বলা যায়। তার উপর চাদরখানা পুরো তোশকটা ঢাকেনি বলেই দেখা যাচ্ছিল। খাটো চাদরখানা ময়লা চিট, বিবর্ণ। ঠাকুমাকে দেখে হেসেই জ্যাঠামশাই বললেন—এস ঠাকুমা!
থমকে দাঁড়ালেন অন্নপূর্ণা—তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন পক্ষাঘাতটা কি রকমের, ডান পা-খানা ঢাকা ছিল, ডান হাতখানাও ছিল, সুতরাং ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থা দেখে অন্নপূর্ণা-মা বোধহয় পক্ষাঘাতের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বললেন—প্যারালিসিস্ তোর কোনখানে রে হরি?
হরি হল যজ্ঞেশ্বরের ডাকনাম। রত্নেশ্বর রায় যজ্ঞেশ্বর নাম রেখে বলেছিলেন-যজ্ঞেশ্বর—হরি!
যজ্ঞেশ্বর হেসে বললেন—হরি চিরকাল ছলনাময় নয় ঠাকুমা? তা ভাবতে পার, পাওনাদার ফাঁকি দিতে প্যারালিটিক্ সেজে বসে আছি। শুনেছি তোমার দাদা, আমার ঠাকুরদা সাহেবের ভোজের আসর থেকে পেট কামড়াচ্ছে ব’লে ঘরের ভিতরে শুতে গিয়েছিল। কিন্তু আসলে গিয়েছিল রাধানগরের দে সরকারদের বাড়ীতে ডাকাত ফেলে লোকটাকে ঠ্যাঙাতে আর তার ঘর পোড়াতে। আমি তো তোমাদেরই নাতি। আমি যজ্ঞেশ্বর হরি, ছলনা অবশ্যই করতে পারি। কিন্তু তা নয়। এই দেখ!
ব’লে গায়ে ঢাকা দেওয়া চাদরখানার ভেতর থেকে ডান হাতখানা বহু কষ্টে বের করলেন। হাতখানা কনুয়ের কাছ থেকে বেঁকে রয়েছে এবং গাছের মরা ডালের মত শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে আসছে। আঙুলগুলোই আগে শুকিয়ে গেছে; যখন বের করছিলেন তখন থরথর করে কাঁপছিল।
বললেন—এই এইটুকু এখন বের করতে পারছি, আগে একেবারেই পারতাম না। কোমর থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত ডান পা-খানা অসাড়। নড়ে না। তোমার নাতবউ ঢেকেঢুকে দিয়ে তুলে
বসিয়ে দিয়ে যায়, আবার শোবার সময় শুইয়ে দেয়। তোমাদের যজ্ঞেশ্বর হরি ছলনাময় বটে কিন্তু এ অসুখে নয়। তা তুমি হঠাৎ এলে ঠাকুমা-ব্যাপার কি বল তো! সত্যিই তুমি এলিয়ট রোডের বাড়ীখানার জন্যে এসেছ?
অন্নপূর্ণা-মা কথা বলতে পারলেন না, চুপ ক’রে বসে রইলেন মাটির দিকে তাকিয়ে।
জ্যাঠামশাই একটু অপেক্ষা ক’রে বললেন—সুরেশ্বর বাড়ীখানা কিনতে চেয়েছে শুনে খুব আশ্চর্য হইনি। রায়বংশের ছেলে, তার উপর অবস্থা ওর সচ্ছল। গোটা রায়বংশটা দেউলে হয়ে গেল, আশ্চর্য ঢেঁকে রইল যোগেশ্বরের ছেলে। শুনেছি বাপের মত খেয়ালী। বাপ খেয়ালী হলেও অন্যরকমের মানুষ ছিল, জমিদারের ছেলে, বড় ব্যবসাও ছিল আমাদের, কিন্তু যোগেশ্বর লেখাপড়া শিখে খবরের কাগজে চাকরি নিলে। বাবা তাই পছন্দ করলেন। তখন ঠাকুমা, ঠিক বুঝতে পারি নি। বাবা তো আমাকে খুব ভাল চোখে দেখতেন না। তাই ভাগের সময় গোটা ব্যবসাটা আমাকে দিয়ে বাড়ী আর নগদ টাকা যোগেশ্বরকে যখন দিলেন তখন আশ্চর্য হলাম। তবে কি জান ঠাকুমা, সবই ভাগ্য। আমি ভাগ্যকে মানতাম—আজও মানি। তার জন্যে কবচ মাদুলি গ্রহরত্ন অনেক ধারণ করেছি বোঝা দরুণে। আমার ভাগ্যে কোষ্ঠীতে এই ছিল। তাই হল। কি করব? তা তুমি এ নিয়ে এলে কেন বল তো? সুরেশ্বর কিনতে চায় বুঝি, প্রণবেশ্বরের কাছে শুনেছি আমি, কুইনি বলে যে মেয়েটা এখন বাড়ীর মালিক ছিল—। একটু হেসে চুপ ক’রে গেলেন জ্যাঠামশায়, কিন্তু ইঙ্গিতটা বুঝতে কারুর বাকি রইল না।
এতক্ষণে অন্নপূর্ণা-মা মুখ খুললেন, বললেন —দাদা তোকে খুব ভালবাসতেন। বলতেন—ওরে আমি মরে গেলে লোকে ভাবত আমি আবার ফিরে এসেছি। তুই একেবারে আমার মত। তাই ঠিক। তেমনি কুটিল তেমনি জটিল—সবই তেমনি
—হ্যাঁ, তা বলতেন। তাঁকে আমার ভালও লাগত। খুব ভাল লাগত। তা খানিকটা বটেও। তাঁর পথেই চলত চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিচিত্র ভাগ্যের কথা, তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জিতে গেলেন, রায়বাড়ীকে ছোট থেকে বড় করে গেলেন, আর আমি হেরে গেলাম। আমার কোষ্ঠীতে শনির ফল, শনি আমাকে রাজা করেছিল, সে আবার সব কেড়ে নিলে।
—আজেবাজে কথা না বলে আমার কথার জবাব দে তো!
—কি বল?
—এলিয়ট রোডের বাড়ীটার উপর তুই ছোঁ দিলি কেন?
—বাড়ীটা দেখলাম আমাদের—সেইজন্যে। বাড়ীখানা কেনার দলিল পর্যন্ত রয়েছে। দেখ না। বলে নতুন বের করা একখানা কবলার কপি বের করে দিলেন। মাথার বালিশের তলাতেই সেটা ছিল। তার সঙ্গে কতকগুলো কর্পোরেশনের ট্যাক্সের রসিদ। আজও ট্যাক্স দিচ্ছি।
—যজ্ঞেশ্বর!
—ঠাক্মা!
—তোর ওই সব কথাবার্তা তুই ছাড়। সোজা কথা বল। কুইনি বলে মেয়েটির পরিচয় তুই জানিস নে? ন্যাকা সাজিস নে, তোর ঠাকুরদা আমার দাদা, রায়বংশের পুণ্যবান পুরুষকে ঠিক আমি এই কথাই বলেছিলাম। দাদা, তুমি ন্যাকা সেজো না। ভায়লেট অঞ্জনাদির মেয়ে এ তুমি জানতে না? দাদা ঠিক তোর মতই ন্যাকা সেজেছিল। আমি তিনবার ছি-ছি-ছি বলেছিলাম, তাতে দাদা মাথা হেঁট করেছিল, তুই করছিস নে, তুই আরও পাষণ্ড রে যজ্ঞেশ্বর।
কথাগুলি আমি বুঝতে পারছিলাম সুলতা, আমি অবাক হইনি। লজ্জায় প্রথমটা পিছন ফিরেছিলাম, তারপর ঠিক এই কথার পরই অন্নপূর্ণা-মাকে বলেছিলাম—আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াই মা-মণি! আপনাদের কথা শেষ হোক
অন্নপুর্ণা-মা বলেছিলেন—না, তুই বস সুরেশ্বর। তুইও শোন। অর্চনার বিয়েতে তোর কাছে কুইনির বাড়ী ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তটা পণের মধ্যে কেন ধরেছি তুইও শোন। কুইনিকে একখানা বাড়ী আমি আমার টাকায় কিনে দিতে পারি। তাতে আমার দেবুর আত্মা শান্তি পাবে; কিন্তু তাতে দাদার দানপত্র নাকচ হবে, দাদা রত্নেশ্বর রায় রায়বাহাদুর স্বর্গ থেকে সিংহাসন সমেত উল্টে পড়বে রে-পড়বে নরকে। তুই চুপ করে আছিস কেন যজ্ঞেশ্বর? রায়বাহাদুর এ বাড়ী দেবুর পাপের জন্য দেয়নি, দিয়েছিল ভায়লেট মেয়েটা অঞ্জনাদির মেয়ে ব’লে। ওকে কিছু দেবার অজুহাত খুঁজছিল দাদা; দেবার জন্যে মনটা অধীর হয়েই ছিল। দেবুর এই ভুলটা হ’তেই সে বাড়ীটা লেখাপড়া করে দিল ভায়লেটকে। এই জানবাজারের বাড়ীতে যেদিন দেবু গুলী খেয়ে মরতে চেয়েছিল বাপের ভয়ে, সেদিন দাদা কলকাতা এসেছিল শুধু আমার সঙ্গে মিটমাট করতে। তখনি আমি কোলে এক বছরের ছেলেকে নিয়ে আমার স্বামীকে অনেক কষ্টে রাজী করে জোড়াসাঁকোর জ্যাঠাইমার বাড়ী গিয়ে উঠেছিলাম। তারপর স্বামীকে বললাম—তুমি ফিরে যাও, আমি আর ফিরে যাব না তোমাদের বাড়ী। আমি কাশীতে পিসেমশাইকে চিঠি লিখেছি, তিনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি সেখানেই থাকব, তোমাদের অন্নে আর আমার প্রয়োজন নেই। আমার ছেলে বড় হয়ে তার সম্পত্তির জন্য যা করবার করবে। তার অভিভাবক হিসেবে তোমাদের কিছু করতে হবে না। কাশী থেকে মামা মানে পিসেমশাই এলেন, কীর্তিহাট থেকে দাদা এল। এসে জানবাজারের বাড়ীর ফটকে দেখলেন ভায়লাকে। বন্ধ ফটকের সামনে রাস্তার উপর মাথা ঠুকে কাঁদছে—রায়বাবু মেরি রায়বাবু! মেরি রায়বাবু! দাদার গাড়ী এসে দাঁড়াল। দাদা এখানকার দপ্তরে খবর দিয়েছিল, কিন্তু খবরটা এসে পৌঁছয়নি। ডাকের গোলমাল হয়েছিল। দাদা ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করে একেবারে ঠিক সেই সময়টাতেই এসে হাজির হল। দাদা ভায়লাকে চিনত। ভাল করে চিনত। অঞ্জনার মুখের মত মুখ ছিল বলে চিনত!
রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় সাধু চরিত্রের লোক। লোকে বলে সাক্ষাৎ শিব। শিবের গায়ের বর্ণ দিনের আলোর থেকেও সাদা। তেমনি স্বচ্ছ এবং শুভ্র নাকি শিবের চরিত্র। কালীর ছোঁয়াচ লাগলেও জানা যায়, বোঝা যায়। যতই গোপন করুক দাদা, অঞ্জনাকে ভালবাসার কথাটা গোপন থাকেনি। আশ্চর্য মানুষ আশ্চর্য ভালবাসা। আশ্চর্য ধর্মপরায়ণতা!
অঞ্জনাকে ভালবেসে, শুধু তার স্বামীর কাছ থেকেই ছিনিয়ে নিলে। কাছে কাছে চোখে চোখে রাখলে, কিন্তু সরস্বতী বউয়ের সামনে। তাকে পাহারা রেখে হেসে কথা বলে, রাগ করে, সে রাগ করলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে একরকম মান ভাঙিয়ে নিজের সাধ মেটালে, কিন্তু অঞ্জনার সাধ তাতে মিটল না। সে একদিন হলদীর বাপ পিড়ুজের দাদা, যে রবিনসনকে খুন করেছিল, তার সঙ্গে পালাল। পালাল—কীট সাহেবকে চিঠি লিখে জানিয়ে ক্রীশ্চান হয়ে গোয়া পালালো। বছর কয়েক পর অনেক কষ্টে গোয়া থেকে ফিরে এল কলকাতায়; কোলে তার ভায়লেট। দেহে সাতখানা রোগ ধরেছে, যা কিছু গহনাগাঁটি ছিল সব গিয়েছে; রত্নেশ্বর রায় অঞ্জনাকে ভোগ করে স্পর্শ করেননি, কিন্তু তার সর্বাঙ্গ সাজিয়ে গহনা দিয়েছিলেন, পালাবার সময় অঞ্জনা সে সব ফেলে যায়নি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। পিড্রুজ তার সে সব বেচে খেয়েছে, তারপর কার সঙ্গে ঝগড়ায় ছুরি মারামারি করে ছুরি খেয়ে মরেছে। অঞ্জনা সেকালের বামুনের ঘরের মেয়ে, এগিয়েছিল অনেকদুর, হুগলী জেলার একখানা অজ পাড়াগাঁ থেকে কীর্তিহাট হয়ে কলকাতা, সেখান থেকে পশ্চিম মুখে একেবারে গোয়া পর্যন্ত। তার ওদিকে সমুদ্রে ভাসতে আর সাহস হয়নি, অন্য কাউকে বিয়ে করবার মত দেহেও কিছু ছিল না, আর মনেও ঠিক হয়নি বা মনের মত মানুষ পায়নি। ফিরে এসেছিল কলকাতা। রিপন স্ট্রীট থেকে পার্ক স্ট্রীট এলাকায় গোয়ানীজদের একটা আড্ডা ছিল, সেই আড্ডায় এসে উঠে সাহায্যের জন্যে চিঠি লিখেছিল—একখানা দাদাকে, একখানা আমাকে। বলতে গেলে আমার মারফৎ পিসেমশাইকে।
বুঝতে পেরেছ সুলতা, অন্নপূর্ণা-মায়ের পিসেমশাই কে? বিমলাকান্ত। অন্নপূর্ণা দেবী বললেন—আমার বয়স তখন বছর-ন’য়েক হবে। অঞ্জনাদি যখন চলে যায়, তখন আমার বয়স ছিল ছ’ বছর। এর তিন বছর পর অঞ্জনা ফিরে চিঠি লিখেছিল আমাকে কাশীতে। চিঠি সাহায্যের জন্য। চিঠিখানা আমার হারায়নি। চিঠিখানা আছে। পিসেমশাইয়ের স্বভাব ছিল বড় গোছালো—বড় পরিচ্ছন্ন মানুষ, চিঠিখানি তিনি রেখে দিয়েছিলেন।
তখন আমার ন’ বছর বয়স। চিঠিখানা এল, খামের চিঠি; পিসেমশাই চিঠিখানা খুলে পড়ে আমাকে দিলেন। চিঠিখানা আমার মনে আছে—“মহামহিম মহিমান্বিতা শ্রীমতী অন্নপূর্ণা দেবীর নিকট অধীনের নিবেদন এই যে, এককালে আমি সম্পর্কে আপনার দূরসম্পর্কের দিদি হইতাম, তৎকালে আমার নাম ছিল অঞ্জনা এবং কীর্তিহাটের রায়বাটীতে রায়হুজুর ও রায়গিন্নীর নিকট পরম সমাদরের মধ্যেই বাস করিতাম। এবং কাজকর্ম করিতাম। কিন্তু যাহার ভাগ্য মন্দ হয়, তাহার মতিও সু হইতে কু হয়; কুমতি-দুর্মতি মন্দভাগ্য-মন্দভাগিনীদের ঘাড়ে ভর করিয়া থাকে। আমারও তদ্রূপ ঘটিয়াছিল। সেই দুর্মতিবশত আমি একদা গৃহ হইতে পলায়ন করিয়া ক্রীশ্চানধর্ম অবলম্বন করিয়াছিলাম। ফলে আজ আমার দুঃখ-দুর্দশার অবধি নাই। আমি ক্রীশ্চান হইয়া রায়-হুজুরের কলিকাতাস্থ মোকামের বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্র এবং ঘোড়া ও গাড়ী প্রভৃতি দেখিবার জন্য যে পর্তুগীজ, যাহাকে সকলে গোয়ান বলিয়া জানিত ও ভাবিত, তাহাকে বিবাহ করিয়া গোয়া পালাইয়াছিলাম। কিন্তু মদীয় মন্দভাগ্যবশত সে ব্যক্তি মারা গিয়াছে এবং আমি নিরতিশয় দুর্ভাগ্যের মধ্যে নিপতিত হইয়াছি। দেহেও অনেক রোগ ঢুকিয়াছে। খুব বেশীদিন সম্ভবত বাঁচিব না। কিন্তু আপাতত চতুর্দিক অন্ধকার নিরীক্ষণ করিতেছি। আমার কোলে একটি বৎসরখানেকের কন্যা। তাহাকে বাঁচাইবার মত সামর্থ্য নাই। সেইজন্য আপনার নিকট কিছু অর্থসাহায্য প্রার্থনা করিয়া অত্র পত্রযোগে দরখাস্ত জানাইতেছি। আমার সহস্র অপরাধ, ক্রীশ্চান হইয়াছি, পরপুরুষের সঙ্গে চলিয়া আসিয়াছি—ইহা কখনওই মার্জনার যোগ্য নয়। তবুও উদরের জ্বালায় এবং আমার কন্যাকে বাঁচাইবার জন্য লজ্জার মাথা খাইয়া পত্ৰ লিখিলাম। আপনাদের অনেক আছে। আপনার জ্যেষ্ঠ রায়হুজুরকেও পত্রযোগে দরখাস্ত জানাইয়াছি। তিনি দিবেন না জানি, তিনি কঠোর ধার্মিক লোক, তবুও করুণা করিবার সময় তো পাপ বিচার কেহ করে না, পাপীকেই তো করুণা করিতে হয়। ভগবানও পাপীকে দয়া করিয়া থাকেন। সেই হিসাবে তিনি দয়া করিলে করিতে পারেন। আপনি করিবেন বলিয়া ভরসা করিতেছি। এবং দয়া করিয়া রায়হুজুরকেও যদি কিছু লেখেন—আমাকে ক্ষমা করিতে, দয়া করিতে, তবে অধিনীর প্রতি অনেক কৃপা করা হইবেক।”
চিঠিখানা আজও আমার কাছে আছে।
অন্নপূর্ণা-মা একটু থামলেন; বয়স হয়েছিল—এতক্ষণ কথা বলে একটু হাঁপাচ্ছিলেন। থামলেও জ্যাঠামশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর রায়ের মুখ যেন পাথরের মুখ। একটি রেখাও তাতে বদল হয়নি।
এই ফাঁকে তিনি বললেন—এসব কথা তুমি যখন বলছ, তখন সত্যি বলেই মানছি ঠাকমা, কিন্তু আমাকে তুমি বলছ কি?—যা বলছ তাই বল! বাড়ীটা ছেড়ে দিতে বলছ তো!
—হ্যাঁ। শুধু তাই নয়, তোকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি, তুই এত ছোট কাজ করলি কেন?
—ছোট কাজ কি করে হল ঠাকমা? আইনসঙ্গত না হয়, মামলা করলেই তো বাড়ীটা পাবে।
—দাদা বাড়ীটা দান করে দলিল একখানা করে দিয়েছিল, কিন্তু বাড়ীটার করপোরেশন ট্যাক্স দিয়েছে বরাবর তোদের কলকাতার এস্টেট। পাছে ট্যাক্সের জন্য গোলমালে পড়ে, দিতে না পারে, বিব্রত হয়, তারই জন্য এইরকম করেছিল। তাছাড়া পাছে ওরা কেউ বিক্রী করে দেয়, দেনার দায়ে বাড়ীটাকে জড়িয়ে ফেলে, তাই এই জট পাকিয়েছিল। তুই তার সুযোগ নিয়েছিস।
—বল না, অন্যায় করেছি? কিছু বে-আইনী করেছি? বল?
—তা করিসনি। কিন্তু তুই তোর বাপকে, তোর ঠাকুরদাদাকে নরকে ডোবাচ্ছিস।
—না, ঠাকুরদার যে-দায়টা বলছ, সেটা তুমি চাপাচ্ছ দাদার উপর। মায়ের পেটের ভাই নয়, তোমার বাপ পুষ্যিপুত্তুর নিয়েছিল ঠাকুরদাদাকে, তার জন্যে আমার ঠাকুরদার উপর তোমার রাগ এ তো সবাই জানে গো। তবে হ্যাঁ, আমার বাপের কথা যা বললে, তা অবিশ্যি পাপপুণ্যি স্বর্গ-নরক এসব থাকলে মানতে হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও মানতে হয়, পাপ করলেই তার সাজা আছে। সে সাজার মাফ নেই ঠাকুমা। ভায়লা বলে গোয়ান ফিরিঙ্গী মেয়েটার সঙ্গ —সে বাড়ী দান করেও হয় না।
—চুপ কর, চুপ কর। ওরে যজ্ঞেশ্বর, তুই চুপ কর।—
আর্তনাদ করে উঠলেন অন্নপূর্ণা-মা।
কিন্তু জ্যাঠামশাই যজ্ঞেশ্বর রায় চুপ করলেন না, তোমার ভাইপো তোমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। তার নিন্দে তোমার সহ্য হচ্ছে না-না? কিন্তু কি করব বল? ও যে তাঁর প্রাপ্য গো। মিথ্যে তুমি অঞ্জনা-ফঞ্জনার ফ্যাচাং তুলে ঠাকুরদার মত দেবচরিত্র ব্যক্তির অপমান করছ।
অন্নপূর্ণা-মা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন—অবিকল সেই রত্নেশ্বর রায়। অবিকল। ঠিক এমনি করেই নিজের বাপের উপর রাগ করে কথা বলত, তারই ওপর সব দোষ চাপাত। অবিকল! লাখখানেক কি তারও বেশী মামলা দাদা করেছে। তার সব কাগজপত্র যদি থাকে, তবে অন্তত বিশ-পঞ্চাশটা মামলায় হয় মামলা দায়েরের আর্জিতে, নয় মামলার জবাবে বলা আছে-বীরেশ্বর রায় মদ্যপান করিয়া বেহুঁশ থাকিতেন, এবং মদ্যপানের ফলে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটিয়াছিল বলিয়া এমন স্বীকৃতি তিনি দিয়াছিলেন। জীবনের শেষভাগে তাঁহার পক্ষাঘাত ঘটিয়াছিল। এরূপ ক্ষেত্রে তাঁহার কোন স্বীকৃতি বা সহির মূল্য গ্রাহ্য হইতে পারে না।
যজ্ঞেশ্বর রায় হেসে বললেন—ওসব কথা ছাড়ান দাও না ঠাকুমা। তুমি কুইনির বাড়ীখানা কুইনিকে ফিরিয়ে দিতে চাও। তা বেশ তো, পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটে বাড়ীখানার দামের অর্ধেক টাকা আমাকে দিয়ে একটা না-দাবী লিখিয়ে নাও। চুকে যাক। টাকাটা তুমিও দিচ্ছ না, দেবে সুরেশ্বর। জগদীশ্বরের মেয়েটা ওর গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধেছে। ওর যখন ওগরাতেই হবে তাকে, তখন টাকাটা ওই দেবে।
একটা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে সুলতা। আমার নিজের গলায় এতখানি ভয়ঙ্কর চড়া সুর বা গর্জন বের হতে পারে, এর আগে তা আমি জানতাম না। গান গাইবার সুকণ্ঠ রায়বংশে আছে। শ্যামাকান্তের দান এই সুকণ্ঠ আর সংগীতব্যাকরণে জ্ঞান-এ নিয়েই অনেকে আমরা জন্মেছি, কিন্তু এমন গর্জন এক মেজঠাকুরদা শিবেশ্বর রায়ের সেই দৈত্যাকৃতি পশুচরিত্র ছেলেটা ছাড়া কারও গলায় বের হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল না। আমার মনে পড়ে গিয়েছিল—কিছুদিন আগে অন্নপূর্ণামায়ের নামে লেখা একখানা বেনামী চিঠির কথা। যে চিঠিতে অজ্ঞাত পত্ৰলেখক অর্চনার প্রতি আমার স্নেহ-মমতার কুৎসিত ব্যাখ্যা করে অপবাদ দিয়ে সংবাদ দিয়েছিল তাঁকে। বিয়েটা যাতে না হয়; তারই চেষ্টা ছিল তাতে। চকিতে কথাটা মনে হতেই আমার ধারণা জন্মেছিল, সে-চিঠি হয় লিখেছিল বা লিখিয়েছিল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠেছিলাম পশুর মত—চু-প করুন আপনি!
সে চীৎকারে চমকে উঠেছিলেন যজ্ঞেশ্বর রায়। চমকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন, নির্বাক হয়ে। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপরই আত্মসম্বরণ করে নিয়ে বলেছিলেন—কেন? এমন করে চীৎকার করে উঠলে কেন? একটা জন্তুর মত? অ্যাঁ!
আমি বলেছিলাম-সে চিঠি তাহলে আপনি লিখিয়েছিলেন?
একটু চুপ করে থেকে যজ্ঞেশ্বর রায় বলেছিলেন—হ্যাঁ। আমিই লিখিয়েছিলাম একরকম। হ্যাঁ, একরকম আমিই বইকি! প্রণবেশ্বর কীর্তিহাট থেকে এসে বললে সমস্ত কথা, অতুল-মেজখুড়ীমার বোমা-পিস্তল নিয়ে জেলের কথা। অর্চনার সঙ্গে তোমার মাখামাখির কথা। সব শুনলাম। শুনলাম এবং সন্দেহ হল। এ তো হামেশাই হয়। বড় বড় বাড়ীতে, যে-সব বাড়ীতে বড় সংসার, পোষ্য অনেক হয়, সে সব বাড়ীর মালিকেরা ভোগ করে থাকেন পোষ্যদের বধূ-কন্যাদের। তা করেন। যারা দুবেলা দুমুঠো ভাত পায়, মাথা গুঁজবার একখানা ঘর পায়, বড়বাড়ীর লোক বলে পরিচয় দিতে পায়, তাদের পুরুষ অভিভাবক থাকে না বা থাকলেও বোবা হয়ে থাকে। বাইরে এখানে-ওখানে গালাগাল দেয়। যেখানে কোন লোক থাকে না। এর মধ্যে মালিকপক্ষের ছেলে বা কর্তার নজরে মেয়েরা কেউ পড়লে আর কি রক্ষে থাকে? এই তো আমার শ্বশুরবাড়ীতেই, আগে রেওয়াজ ছিল, মেয়েদের কুলীনের ঘরে বিয়ে দিয়ে মেয়ে-জামাই ঘরে রাখা, কিছু সম্পত্তি দেওয়া। তারপর হত এই তারা যখন একপাল করে ছেলে-মেয়ে বিইয়ে বসত, তখন—।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন-থাক। আর বেদ-বেদান্ত আওড়াতে হবে না তোকে যজ্ঞেশ্বর। তুই স্বীকার করলি এই যথেষ্ট।
—কেন, কথাটা মিথ্যে বললাম নাকি? তোমার দাদা রায়বাহাদুরের যে অপবাদ তুমি দিচ্ছ, সেটাই বা কি গো? কলকাতায় ওটা আকছার বড়লোক বাড়ীর কীর্তি। বড় বড় বাড়ীর কেচ্ছা আছে, বড় বাড়ীতে গরীব আত্মীয়ের বউ-বেটী নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরত, এক-একখানা গয়না নিয়ে। কর্তা একলা ঘরে বসে বউ দেখতেন আর গয়না দিতেন। তোমার ভাইপো ভায়লাকে নিয়ে এতবড় যে কীর্তি করলে সেটা? সেটাই বা কি? তোমার ভাইপোর মেমসাহেবের ওপর একটা ঝোঁক ছিল। যোগেশ্বরকে লেখাপড়া শেখাবার নামে একজন মেমসাহেব গবর্নেস রেখেছিল, আমার মায়ের চোখ থেকে জলের ধারা-বওয়া আমি ভুলিনি, আমি তাকে চাবুক মেরে তাড়িয়েছিলাম।
বাধা দিয়ে অন্নপূর্ণা-মা বললেন—তুই দিব্যদৃষ্টি মহাপুরুষ রে। তোর সঙ্গে কথা কইতে আসা আমার ভুল হয়েছিল। তোর ঠাকুরদার থেকে তুই সরেস। নির্বাণ তোর এই জন্মেই হবে। শুধু টাকা আর সম্পত্তির মায়াটা থাকবে, আর ওইটেই হবে তোর সিদ্ধির বাণী। ওসব কথা থাক। এখন ওই বাড়ীর জন্যে কি নিবি তাই বল। কেস তো আমি কোর্টে ওঠাতে পারব না, নইলে দেখতাম তুই কতবড় পাষণ্ড! কত তোর টাকার জোর, আর কত তোর জেদ! আমার কপাল! বুঝলি, আমার কপাল! কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে।
একটু চুপ করে থেকে যজ্ঞেশ্বর রায় বলেছিলেন—তা দিয়ো হাজার পাঁচেক।
এবার আমি আর অন্নপূর্ণা-মাকে কথা বলতে দিই নি। বলেছিলাম—টাকাটার বদলে চেক যদি আজই দিয়ে যাই?
—তা দিতে পার। আমি না-দাবী লিখে দেব বলে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, টাকাটার জন্যে রসিদ দিচ্ছি। তবে বেয়ারার চেক দিতে হবে।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন—চেক দিয়ে দে সুরেশ্বর। কিন্তু তোর বউয়ের হাতে দেব, তোকে দেব না। আর একটা প্রতিশ্রুতি করিয়ে নেব।
—প্রতিশ্রুতি! হাসলেন যজ্ঞেশ্বর রায়।
—হ্যাঁ। মিথ্যে বেনামী পত্র লিখে তুই অর্চনার বিয়েতে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিস। এমন কাজ এর পর আর করবি নে।
চুপ করে রইলেন যজ্ঞেশ্বর রায়, তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। ফিরে যখন তাকালেন তখন আমি পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে গেলাম সুলতা। দেখলাম, যজ্ঞেশ্বর রায়ের চোখ ছলছল করছে।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন-এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন—কি বলে এমন কথাটা লিখলি তুই? তোর মনে এতটুকু লাগল না? একবার মনে হল না যে, মেয়েটা তোর বাপের…
—বাবার কথা তুলো না ঠাকুমা। না।
—বেশ তোর কাকা, তিনি তো তোর সঙ্গে কোন অসদ্ভাব করেননি। শিবেশ্বর? তাছাড়া ঠাকুরদা তোর কাছে দেবতা, এ মেয়ে তো তাঁরই এক নাতি জগদীশ্বরের মেয়ে।
যজ্ঞেশ্বর রায় বললেন –ঠাকুমা, ওটা আমার কেমন একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে। সে আজ থেকে নয়, সেই ছেলেবেলা থেকে। বাল্যবয়স থেকে। তোমাকে বলি। ঠাকুরদা একটা ঝিকে হঠাৎ দেখলেন, তার আগে দেখেননি। যুবতী ঝি, বছর সতেরো-আঠারো বয়স, তাকে রেখেছেন ঠাকুমা। ওই ঝিটার মা, ঠাকুমার খাস-ঝি ছিল। নাম ছিল কামিনী। কামিনীর মেয়ে যামিনী এ বাড়ীতেই মানুষ হয়েছিল, বারো বছর হতে না হতে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুরদা। মেয়েটার কপাল; বিধবা হয়ে ফিরে এল ভরাযৌবন নিয়ে। কামিনী খুব করে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরলে, মা, বাড়ীর এককোণে ওকে একটু ঠাঁই দাও। ঠাকুমা ঠাকুরদার মত জানতেন, তিনি তাকে বাড়ীতে রাখলেন খুব গোপনে। ঠাকুরদার চোখের সামনে যেতে বারণ ছিল। তা সে যেতো না। কিন্তু হঠাৎ একদিন বিপদ ঘটল; মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হল। মেয়েটার মা জানতে পেরে কেঁদে এসে পড়ল ঠাকুমার কাছে। উপায় কর মা। ছোটবাবু—মানে ছোটকাকা রামেশ্বর…। কথাটা শেষ পর্যন্ত রায়বাহাদুরের কানে উঠল। ঠাকুরদার খেয়াল ছিল না যে, আমি পাশের ঘরেই আছি, আমার বয়স তখন বারো পার হয়ে তেরোয় পড়েছে। ঠাকুরদা তিরস্কার করেছিলেন ঠাকুমাকে। বলেছিলেন—সরস্বতী-বউ, যে ঘরে লক্ষ্মী থাকে তার ঘরে অলক্ষ্মী চারিদিক থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে আশ্রয় চায়। আশ্রয় দিতে নেই। অন্ততঃ ভোগী যারা, জমিদার যারা, তাদের তো নেই-ই। দিলে কি হয় জান? ওই অলক্ষ্মী রূপসী রূপ ধরে যৌবনের ডালা তুলে ধরে এই বংশের মালিক, তার বংশধরদের সামনে। ভোগ করলেই অলক্ষ্মীর মনস্কামনা পূর্ণ। ধর্ম পালায় ধর্মের সঙ্গে ভাগ্য যায়, ভাগ্যের সঙ্গে যশ যায়, যশের সঙ্গে সম্মান যায়। সম্মানের সঙ্গে অধিকার যায়, ক্রমে সব যায়, লক্ষ্মী ছেড়ে পালাল, অলক্ষ্মী তখন দারিদ্র্য দুর্ভাগ্য নিয়ে বংশকে ছারখার করে দেয়। তার উপর তুমি জান না সরস্বতী-বউ, এ বংশের উপর পূর্বপুরুষের অর্জিত একটা অভিসম্পাত আছে। নিদারুণ অভিসম্পাত। নারীঘটিত পাপ বংশে ঘটবেই, এবং তাতেই সব নষ্ট হবে। আমি এমন কঠোর সংযম করি, পূজা করি, অর্চনা করি, শুধু এই পাপ থেকে রায়বংশকে উদ্ধার করতে। কিন্তু তোমরাই তা হতে দিলে না। দেবে না। হলো তো। রামেশ্বরকে ডোবালে তো পাপে। ডোবালে তুমি। দয়া করতে গিয়ে পাপের উপকরণ তুমি রামেশ্বরের মুখের সামনে ধরে দিলে। সে নতুন জোয়ান, তার দোষ কি? সে সামনে হরিণী পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বাঘের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে! দেখেও জ্ঞান হল না তোমার? এর আগে দেবেশ্বরকে নিয়ে এত বড় কাণ্ডটা হয়ে গেল, ভায়লা মেয়েটাকে নিয়ে কি করলে সে, তার জন্যে কি করলাম আমি—তা তো জান! ঠাকুরদাস খুন হয়ে গেল। আমি নিজে বিশ্বাস করি নে সরস্বতী-বউ। মেয়েদের সতীত্বে আর পুরুষের সৎ শুদ্ধ থাকায় বিশ্বাস করি নে। থাকতে গেলে আমার মত যারা চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থাকে, তারাই পারে। ঘি আর আগুন এক জায়গায় থাকলেই জ্বলবে। দাউ-দাউ করে জ্বলবে, ঘি শেষ হলে আগুন ছাই চাপা পড়বে।
তারপর ঠাকুমা, কি বলব, আমার অদৃষ্ট, ঠাকুরদা তীর্থে গেলেন, বাবা কীর্তিহাটে এসে থাকলেন, আমরা এলাম, কলকাতায় যোগেশ্বরের জন্যে যে গবর্নেস রাখা হয়েছিল সে এল, বিবিমহলে থাকল, বাবার সঙ্গে একসঙ্গে বেড়াতো, একসঙ্গে চা খেতো। গল্প করত। মা কাঁদত। আমি বুঝতে শিখেছি। আমি শুনেছিলাম মায়ের কাছে, ভায়লেটকে নিয়ে প্রথম বয়সে বাবার কীর্তির কথা। ঠাকুরদার ভয়ে ওকথা কীর্তিহাটে মুখে আনতো না কেউ। গোয়ানরা গান করত—
বড়া বড়া মোকাম কি বড়া কারখানা
উধর মত যানা মৎ যানা
শুননা মানা, দেখনা মানা, বাত কহনা মানা
বড়া কারখানা—
পিন্দ্রর ফাঁসি হয়েছিল, তারই গান বেঁধেছিল ওরা। তবে মা জানতেন, মায়ের কাছে শুনে জেনেছিলেম, নইলে ভায়লেটকে নিয়ে যখন বাবা এসব কাণ্ড করেন, তখন বাবার বিয়েই হয় নি! তাছাড়া মেজকাকার কাছে শুনেছি, ছোটকাকার কাছে শুনেছি। ঠাকুরদা বার বার বলতেন আমাকে, তোমার বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না দাদু। সর্বনাশ হয়ে যাবে। রায়বংশের ওপর দেবরোষ আছে। নারী হতে সর্বনাশ। মনে একটা ভয় হয়েছিল। তত সন্দেহ বেড়েছিল। তারপর যে বাড়ীতে আমার বিয়ে হল, সে বাড়ীতে তখনও আমার বুড়ো দাদাশ্বশুর বেঁচে।
বয়স তখন সত্তরের কাছে, স্ত্রী মারা গিয়ে খালাস পেয়েছেন; দীর্ঘকাল তিনি পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। পঙ্গু স্ত্রী থাকতেই তাঁর সেবা করত তাঁর পোষ্যা আপন ভাগ্নীর বিধবা মেয়ে। সে সেবা সত্যি-সত্যিই রক্ষিতার সেবা ঠাকুমা। আজ তুমি কথাটা বড় ঘা দিয়ে বললে বলে তোমার কাছে বলছি। এই বুড়োকে কারুর কিছু বলার উপায় ছিল না, তার কারণ এই বুড়োই কয়লাকুঠীতে সামান্য চাকরি করতে গিয়ে সেকালে পাঁচ-ছ লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তি করেছিল। সমস্ত সম্পত্তির দাম কষতে গেলে কোটির কাছে যাবে। শুধু ঐ মেয়েটিই নয়, ও বাড়ীতে যত পোষ্য দেখেছি, তাদের যাদের রূপ-যৌবন ছিল, সকলকেই ওই দণ্ড দিতে হয়েছে। দণ্ড দিতে হয়েছে বলছি কেন, তারা গয়নাগাঁটি, টাকা-কড়ি বাপ-ভাইয়ের চাকরির জন্যে ওই মাশুল দিয়েছে।
একটু থামলেন যজ্ঞেশ্বর রায়।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন—কথাটা তুই বেশী বাড়িয়ে বলছিস যজ্ঞেশ্বর, নইলে কথাটা সত্যি। আমার শ্বশুরবাড়ীতেও ওই হাল ছিল। তারপর পরমহংসদেব প্রকট হলেন, লোকে তাঁকে জানল, চিনল, তাঁর পিছনে স্বামীজী এলেন, তখন দেশের হাল ফিরল।
জ্যাঠামশাই বললেন—না ঠাকুমা, কথাটা ঠিক হল না। পরমহংসদেব এলেন তাঁর কৃপায় গিরিশ ঘোষ মশায়ের থিয়েটারের মধ্যে থেকেও মতি পাল্টেছিল, কিন্তু জমিদার বড়লোকের বাড়ীর কারও কোন গতি হয়নি। যা ছিল তাই থেকেছে, তাই রয়েছে। আমাদের বংশে দেবরোষের কথা শুনি, কিন্তু সেটা কি তা জানি নে। জানতে কোন রকমেই পারি নি। শুনি ধর্মসাধনে পাপ, আর সম্পদে পাপ। ঠাকুমা, বহু কর্ম আমি করেছি, দীক্ষা আমি নিয়েছিলাম, সে সব গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দিয়েছি, কিছুই আমি মানি নে। তবে এটা জানি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্বামী বিবেকানন্দ হাজার বছরে একজন। বাকী সন্ন্যাসী সাধুগুলো চোর, ভণ্ড, লম্পট। আর ধনীর ছেলেগুলো সব শয়তান, চরিত্রহীন। তারা আবার যখন গরীব হয়, লক্ষ্মী ছাড়ে, তখন শুধু পুরুষের নয়, বাড়ীর বউ-বেটীরও পতন ঘটে। ও পাপ কেউ ঘোচাতে পারে না ঠাকমা। এ দেশে ধর্ম নিয়ে যত মাতামাতি হয়েছে, তত কোথাও হয়নি। মেয়েরা, সে স্বামীকে ভালোবাসুক না-বাসুক, সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর চিতায় পুড়ে মরেছে। ঈশ্বরকে নিয়ে এত খেলা কেউ কোথাও খেলেনি। বিধবা বিবাহ আইন করেও এদেশে চালানো যায়নি। এত পাপ, এত ভয়ঙ্কর পাপ কোন দেশে—ধর্মের উল্টোপিঠে তার আড়ালের আশ্রয়ে ঘটেনি। আবার একথাও সত্য যে, এত ভালবাসাও কোন দেশে, কোন নারী কোন পুরুষকে বাসে নি। কোন পুরুষ কোন নারীকে বাসে নি। সম্পদেও আমরা পাপ করেছি। এ আমার কথা নয় ঠাকুমা, এ আমার ঠাকুরদাদা তোমার দাদার কথা। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের কথা, আমাকে নিজে মুখে বলতেন এসব কথা। শুনেছি তাঁর নিজের পিতামহ—মানে বিমলাকান্তের বাপ কি এক ভীষণ সাধনা করেছিলেন। তারই পাপ নাকি আমরা ভোগ করছি। রায়বংশে ধর্মের পাপ ধন-সম্পদের পাপ একসঙ্গে জমা হয়েছে। আমার মনে অহরহ সন্দেহ হয় ঠাকুমা, এ বংশে ছেলে-মেয়ে কেউ সৎ থাকতে পারে না, সতী থাকতে পারে না। চিরজীবন এই সন্দেহ আমার মনে। তাই আমি প্রণবেশ্বরের কাছে যখন শুনলাম সুরেশ্বরের সঙ্গে জগদীশ্বরের মেয়ের এত মাখামাখি, তখন একটা সন্দেহের সুতো টেনে বের করেছিলাম। তারপর যখন শুনলাম, সুরেশ্বর তার বিয়ের জন্যে এত টাকা খরচ করছে, তখন আমার আর সেটা সন্দেহের সুতো রইল না। মোটা দড়ি হয়ে উঠল। আগেকার আমি, মানে অর্থবান যজ্ঞেশ্বর রায় হলে আমি এ সন্দেহ চিঠি লিখে তোমাকে জানাতাম না। কিন্তু গরীব হয়ে ছোট হয়ে গেছি। মনটা ছোট হয়ে গেছে। কিছু মনে করো না ঠাকুমা। অভিসম্পাত দাও, তা দাও। হাজার বার দাও। কিন্তু আমার উপর রাগ করে মন খারাপ করে যেয়ো না।
সুলতা! সুরেশ্বর বললে —এই যজ্ঞেশ্বর রায় আমার জ্যাঠামশাই যে সন্দেহের দড়ি পাকিয়ে তুলেছিলেন সেদিন, সেই সুতোই কাল হয়েছিল। প্রণবেশ্বর এই সন্দেহের কথা জানিয়েছিল রথীনকে। অর্চনার সঙ্গে রথীনের বিয়ের পর প্রণবেশ্বরের সঙ্গে মাখামাখি একটু বেশী হয়েছিল রথীনের। কেন জান?
অন্নপূর্ণা-মা যে-বাড়ী, যে-বংশ দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন, কোন পাপ প্রবেশ করতে দেবেন না বলে বদ্ধপরিকর ছিলেন, সেই বংশে পাপই বল আর যাই বল, সুলতা, ব্যভিচারকে কি বলবে, মদ্যপানকে কি বলবে বল? বল? If it is not a sin—তাই মেনে নেব আমি। Sin বলে কিছু নেই! মদ্যপানকেও মেনে নেব। খেলে কোন দোষই নেই। কিসের দোষ? Neither a sin nor a crime. ওটা ঊনবিংশ শতাব্দীর পিউরিটান মুভমেন্টের একটা idea, তাই হল। কিন্তু ব্যভিচার? প্রথমে রথীন ডাক্তার অর্চনাকে বিয়ে করতে অরাজী হয়েছিল বলেছি। কেন শোন, একটি Anglo nurseকে নিয়ে সে তখনই জড়িয়ে পড়েছিল। সেই মেয়েটির সঙ্গে প্রণবেশ্বরেরও আলাপ ছিল। আলাপটা ঠিক নার্সটির সঙ্গে নয়, তার দিদির সঙ্গে। সেই সূত্রে তারা চিনত পরস্পরকে, কিন্তু আত্মীয় হিসেবে পরিচয় ছিল না। প্রণবেশ্বরদাদা রথীনকে জানত মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে প্রথম, তারপর ডাক্তার হিসেবে। আর রথীন প্রণবেশ্বরকে চিনেছিল প্রথম পেশেন্ট হিসেবে। নার্স তাকে এবং নিজের দিদিকে স্যালভারসন ইঞ্জেকশন দেওয়াবার জন্য নিয়ে এসেছিল রথীনের কাছে। রথীন তখন সিক্সথ ইয়ারের ছাত্র। তারপর নার্সটির বাড়ীতে দুই ভায়রাভাইয়ের মত তাদের দেখা হয়েছে। এবং মধ্যে মধ্যে ডাক্তারের কাছে পেশেন্ট হিসেবে এসেছে।
পরিচয় হল বিয়ের পর।
তারপর সুলতা—যজ্ঞেশ্বর রায় যে কাজ করেছিলেন, বিবাহের আগে বিয়ে বন্ধ করবার জন্যে, সেই কাজ প্রণবেশ্বর করলে বিবাহের পরে। জ্যাঠামশাই অপবাদ দিয়েছিলেন অর্চনার নামে। প্রণবেশ্বর এবার অর্চনাকে চিঠি দিয়েছিল রথীনের নামে। তার আর সেই নার্সের একসঙ্গে বসে তোলানো ছবিসমেত প্রমাণসমেত পত্র।
উদ্দেশ্য কি জান সুলতা? উদ্দেশ্য অর্চনার সুখের ঘরে আগুন লাগানো। আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তার ফল এমন হল যে—চুপ করলে সুরেশ্বর
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সুরেশ্বর। সুলতাও কোন কথা খুঁজে পেলে না।
অনেকক্ষণ পর সুরেশ্বর বললে—অথচ বিয়ের পর রথীন মোটামুটি নিজেকে শুধরে নিয়েছিল। তা না হলে হয়ত ভাবতাম যে, প্রণবেশ্বরদাদার নারীদেহলোভী মন নার্সটির বড় বোনের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে বা তার প্রতি অরুচি ধরিয়ে নার্সটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
থাক ও কথা এখন, সুলতা। মোটামুটি বলে রাখলাম, এর পর যথাসময়ে যথাক্রমে অর্চনার এ দুর্ভাগ্যের কথা বলব। এখন ও কথা থাক।
এখন যা বলছিলাম তাই বলি।
সেদিন জ্যাঠাইমাকে সাক্ষী রেখে জ্যাঠামশায়ের হাতে পাঁচ হাজার টাকার চেক লিখে দিয়ে কুইনির ওই বাড়ীটা খালাস করে এনেছিলাম। এবং ক’দিন পর তার কাছে না-দাবী দলিল করিয়ে নিয়ে আমিও না-দাবী রেজেস্ট্রী করে দলিল দুখানা দিয়ে এসেছিলাম অন্নপূর্ণা-মা’র হাতে। ওই কুইনিকে আমি দিই নি। দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা-মা।
তিনি কীর্তিহাটে যাননি। কুইনিকে আনিয়েছিলেন কলকাতা। ঘটনাটা ঘটেছিল বিয়ের আগেই। কুইনিকে দলিল দুখানা হাতে দিয়ে বাড়ীতে দখল দিয়েই তাকে বলেছিলেন, এই নে তোর বাড়ীর দলিল।
কুইনি বড় শান্ত, না ঠিক বলা হল না, সুলতা, বড় নীরব মেয়ে। কথা বেশী বলে না। নীরবেই সে হাত পেতে দলিল দুখানা নিয়ে বলেছিল, আপনাকে নমস্কার করতে লজ্জা করছে, প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে, করব?
অন্নপূর্ণা-মা বলেছিলেন—করবি বইকি, আমি খুশী হব রে। ক্রীশ্চান হলেও বাঙালী। প্রণাম করা তো শুধু হিদুর নিয়ম নয়। এ নিয়ম এই দেশের নিয়ম। যেমন এই শাড়ী পরেছিস। শাড়ী তো সাহেবদের দেশে পরে না।
—পা ছোঁব?
একটু ভেবে নিয়ে অন্নপূর্ণা-মা পা দুখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—ছোঁ!
তাঁর পা-দুখানা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই অন্নপূর্ণা-মা তাঁর হাতখানা কুইনির মাথার ওপর রেখে আশীর্বাদ করলেন। কি আশীর্বাদ করলেন তিনিই জানেন, তবে দু ফোঁটা জল তাঁর চোখ থেকে টপটপ করে পড়ল।
আমি খুব বিস্মিত হই নি সুলতা। আমি এর কারণ জানতাম। ভেবেছিলাম, কুইনি কিছু বিস্মিত হবে, কিন্তু তাও সে হয় নি।
অন্নপূর্ণা-মা বলেছিলেন—দেখ, আর একটা কথা তোকে বলব।
—বলুন।
—আমি সুরেশ্বরকে বলেছি, তোর পড়াশোনার খরচ সব ও দেবে। তুই পড়। ওই গোয়ানপাড়ার হলদীদের সঙ্গে থেকে ওদের মত হয়ে যাস্ নে।
কুইনি মৃদুস্বরে বললে—সে-কথা বাবু দিদিয়াকে বলেছেন মা।
অন্নপূর্ণা-মা বললেন—জানি। কিন্তু তুই তো তোর উত্তর দিস নি। তুই তো গোয়ান নোস কুইনী। তোর বাবা মুখুজ্জে ছিল। বামুন থেকে ক্রীশ্চান হয়েছিল। তোর মাসে পিড়ুজের মেয়ে নয় কুইনি। পিড়ুজের মা ভায়লা পিড়ুজের মেয়ে, বাপ ছিল পিড্রুজ কিন্তু তার মা ছিল বামুনের মেয়ে। ভায়লার ছেলে তোর মায়ের বাপকে লোকে পিভুজ বলেই জানে বটে কিন্তু তা নয় কুইনি, সে-ও হল বামুনের ছেলে। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন–মা-বাপ একসঙ্গে মরে গিয়ে হিলডার কাছে গিয়ে পড়েছিস্, কিন্তু ওদের মধ্যে থেকে ওরকম হলে তো চলবে না। তোর মায়ের বাপের বংশ খুব বড় বংশ—। চুপ করে গেলেন অন্নপূর্ণা-মা। মুখ ফিরিয়ে নিলেন কুইনীর দিক থেকে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কুইনি—কোন উত্তর দিলে না বা দিতে পারলে না। শুধু ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
কুইনি চলে গেলে অন্নপূর্ণা-মা মুখ ফেরালেন আমার দিকে, দেখলাম তাঁর চোখ থেকে দুটি জলের ধারা গড়াচ্ছে।
.