১৭
ঘোষের ছেলে বলেই গেল—শুধু জাত? এঁরা সম্পর্কসুদ্ধ মানেন না। অন্তত এঁর সম্পর্কে যা শুনছি এবং বাইরে থেকে দেখেশুনে যে সত্য অনুমান করা যায়, বোঝা যায়, তাতে অনুমান মিথ্যে বলে ঠিক মনে হয় না। এই তো রায়বংশের বাবুরা কল্যাণবাবু, প্রণববাবু, এমন কি প্রবীণ ধনেশ্বরবাবু বসে রয়েছেন, এই তো আমার পিছনেই মাথা হেঁট করে বসে রয়েছেন—বলুন না, ওঁরা বলুন না?
ধনেশ্বরকাকা বলে উঠলেন—ছেড়ে দাও না মশাই। ও-কথাটা ছেড়ে দাও না। এখন যার বিচার হচ্ছে, তাই হোক না। গ্রামের লোকের অমতে তাদের উপেক্ষা করে গোয়ানদের এই সাহায্য দিচ্ছেন উনি—
হঠাৎ একটি ছেলে লাফ দিয়ে উঠে আমার সামনে এসে হাতের আস্তিন গুটিয়ে ঘুঁসি পাকিয়ে বললে —বলুন, স্বীকার করুন অন্যায় হয়েছে! আর বলুন দেবেন না টাকা ওদের?
হঠাৎ যেন আমি আমাকে ফিরে পেলাম। দৃঢ়কণ্ঠে আমি বললাম —না।
—না? ক্ষুব্ধকণ্ঠে সবিস্ময়ে না শব্দটা জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সে হঠাৎ একটা ঘঁষি আমার মুখের উপর মেরে বসল। লাগল এই ঠোঁটের ডান কোণে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটটা কেটে গেল, বেশ গভীর ভাবেই কেটেছিল, মুখের মধ্যে রক্তের স্বাদ অনুভব করলাম। তখন আবার সে ঘঁষি তুলেছে। সুরেশ্বর রায়ের রায়বংশের কাছে পাওয়া দীর্ঘ সবল দেহখানা শক্ত এবং কঠোর হয়ে উঠল। আমার হাতখানা তার থেকে অনেক লম্বা। শক্ত মুঠিতে তার হাতখানা চেপে ধরে রুখে দিলাম। রঙলাল ঘোষ প্রবীণ মানুষ, সম্ভবত নতুন যুগের মোকাবিলা করা নগ্ন সত্যটাকে স্বীকার করতে পারলেন না। তিনি চীৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলেন-এ কি? এ কি কাণ্ড? না-না—
কিন্তু তাঁর কথা কে শুনবে? কেউ গ্রাহ্য করলে না সভাপতির নির্দেশ,—একদল অল্পবয়সী লাফ দিয়ে উঠে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কে যে কি দিয়ে আঘাত করেছিল তা বলতে পারব না। আমি কিছুক্ষণ—সে বোধ হয় মিনিট দুয়েক রুখেছিলাম, তার পরই কপালের উপর এসে পড়ল একটা অত্যন্ত কঠিন কিছুর নিষ্ঠুর আঘাত। আমি বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারাচ্ছি, বুঝতে পারলাম পড়ে যাচ্ছি, কিন্তু তবু আর্তনাদ করলাম না, কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইলাম না, রায়বাড়ীর নাটমন্দিরের ওপর পড়ে মরতেই চাইলাম—এইটুকু তোমাকে বলতে পারি। কথাটা আমার বিশ্বাস করো। তারপর আর কিছু মনে থাকবার কথা নয়, মনেও নেই।
জ্ঞান যখন হল, তখন আমি বিবিমহলে বিছানায় শুয়ে। আমার মাথার শিয়রে কেউ বসে ছিল দেখতে পাই নি। পাশে দাঁড়িয়েছিল চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ডাক্তার। কাঁসাইয়ের ধারের জানালাটার পাশে চেয়ারে বসেছিলেন একজন পুলিস অফিসার। এদিকে দাঁড়িয়েছিল রঘু। সময়টা ভোরবেলা। তার মানে প্রায় সারাটা রাত্রিই এইভাবে কেটেছে। রাত্রে তমলুক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয় নি। মাথায় আঘাত, চেতনাহীন অবস্থা, এ অবস্থায় এক পাল্কি ছাড়া অন্য কোন যানে এমন রোগী পাঠানো যায় না। তাই বিবিমহলে এনে ডাক্তারকে ডেকে পুলিসের পাহারায় রাখা হয়েছে।
শুনলাম, কেউ শক্ত একটা কিছু সম্ভবত লোহার শিক দিয়ে মেরেছিল আমার মাথায়, পিছন দিক থেকে মেরেছিল। কানের খুব কাছাকাছি। একটু এ-পাশে হলেই জীবন-সংশয় হত। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই রক্তের ধারা গড়িয়ে এসেছিল। তারপরই সশব্দে পড়ে গিয়েছিলাম।
এতক্ষণে সকলের উত্তেজনার ছুটন্ত ধারার মুখে একটা ধ্বস ছেড়ে খসে পড়ে তার গতি রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
এক মুহূর্তে গোটা আসরটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
শুধু রঙলাল ঘোষ চীৎকার করে উঠেছিলেন—কি হল? ওরে কি হল? ওরে মারামারি করিসনে। ওরে!
কেউ প্রশ্ন করে উঠেছিল—মরে গেল নাকি? বাধালি ফ্যাসাদ!
ঘোষের উকীল ছেলে শুধু মাথা ঠিক রেখে ডেকে বলেছিল—জল, জল! ওরে জল আন, জল!
কতক লোক পিছু হটে সরে গিয়েছিল। কেউ কেউ চলেও গিয়েছিল। কেউ গিয়েছিল জলের সন্ধানে।
ঠিক এই সময়ে বাড়ির অন্দরের দরজার মুখ থেকে একটি তীব্র নারী-কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল—ছি-ছি-ছি! এমন করে পচে গেছে! গোটা বংশটা এমনি করে পচে গেছে! ছি-ছি-ছি!
এ কণ্ঠস্বর, সুলতা, গোবরডাঙ্গার খুড়ীমার। সারাজীবন যিনি মুখ বুজে স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছেন আর ঘৃণা করেছেন স্বামীকে, শ্বশুরকে, দেওরদের, সৎ-শাশুড়ীদের, কাকে নয়, রায়বাড়ীর মেজতরফের ইট-কাঠকেও ঘেন্না করেছেন। ধনেশ্বরকাকার স্ত্রী—ব্রজদার মা।
ব্রজদা সেই যে বউ নিয়ে এসেছিল, অতুল ধরা পড়বার সময়—সেই সময় সে যে আমার কি পরিচয় তার মায়ের কাছে দিয়ে গিছল বলতে পারব না, তবে এই আশ্চর্য গোবরডাঙার অহঙ্কৃতা মেয়েটি আমায় ভালবেসে ফেলেছিলেন—ব্রজদার চেয়েও বেশী ভালবেসেছিলেন।
তিনি তাঁর অভ্যাসমত আপন ঘরে বসেছিলেন, অর্চনা খবরটা পেয়ে ছুটে দেখতে এসেছিল কি হচ্ছে! দোতলার টানা বারান্দায় যেখানে বসে রায়বাড়ীর মেয়েরা চিকের আড়াল থেকে নাটমন্দিরের যাত্রা শুনত, বাঈনাচ দেখত, সেইখানে দাঁড়িয়ে কিছুটা দেখেই ছুটে গিয়ে নিজের মায়ের পায়ে মাথা কুটতে লেগেছিল।—এইজন্যে—এইজন্যে নিয়ে এসেছিলে আমাকে? মা হয়ে, বাপ হয়ে তোমরা আমাকে এই কলঙ্ক মুখে মাখিয়ে দিতে এনেছিলে? বাপ আত্মহত্যা করে জুড়িয়েছে। তুমি? তুমি কি করবে? একবার বললে না যে আমার কন্যার কলঙ্ক যে দেয়, তার মাথায় বজ্রাঘাত হোক! পারলে না বলতে?
চীৎকার শুনে বেরিয়ে এসেছিলেন গোবরডাঙার বউ। জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি হয়েছে রে অর্চনা, অমন করে চেঁচাচ্ছিস?
অর্চনা চীৎকার করে উঠেছিল—কি হয়েছে গিয়ে দেখে আসুন কালীবাড়ির নাট-মন্দিরে। সুরোদাকে বলি দিচ্ছে। তার বিচার হচ্ছে।
—বিচার? কিসের বিচার? কে বিচার করছে?
—বিচার করছে রঙলাল ঘোষ। নালিশ করেছে গাঁয়ের লোক, তাদের সঙ্গে কল্যাণদা, প্রণবদা, জ্যাঠাইমা কি বলব—সবাই আছে,—তাদের নালিশ হচ্ছে, সুরোদা অনেক টাকা খরচ করে আমার বিয়ে দিয়েছেন; ছি-ছি জ্যাঠাইমা, ছি-ছি-ছি!
কিসে থেকে কি হয় এবং কেমন করে হয়, এ বলা খুব সহজ নয় সুলতা, কখনও কখনও মনে হয় বলাই যায় না। গোবরডাঙার খুড়ীমা মুহূর্তে যেন সর্বাঙ্গে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বালিয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। অর্চনার হাত ধরে ওই ছি-ছি-ছি বলতে-বলতেই—সারা সিঁড়ি নেমে কাছারীর দরজা পেরিয়ে ঠাকুরবাড়ী ঢুকে সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছি। আসর ভেঙেছে। ধনেশ্বরকাকা তাঁকে বাধা দিতে গিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মুখের কাছে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি যত বলেছিলেন—গোবরডাঙার বউ, গোবরডাঙার বউ! আঃ, করছ কি? গোবরডাঙ্গার বউ তত বলেছিলেন—তুমি এমন পিশাচ, এমন অমানুষ, ছি-ছি-ছি! দাঁড়িয়ে দেখছ? মিথ্যে নালিশ করছ? ছি-ছি-ছি! এই জন্যে আমার ছেলেগুলো এমন অমানুষ, এমন পশু! ছি-ছি-ছি!—মেজঠাকুরপো গাঁজা খেতো, মদ খেতো জন্তুর মত রাগ ছিল, তারও লজ্জা ছিল, সেও লজ্জায় আত্মহত্যা করে বেঁচেছে। আর তুমি? ছি-ছি-ছি! কল্যাণেশ্বর অর্চনাকে জড়িয়ে মিথ্যে কলঙ্ক দিয়ে অপবাদ দিচ্ছে, তাই তুমি কানে শুনছ, সায় দিচ্ছ? ছি-ছি-ছি! ওকে তাড়াতে চাও? এই প্রবৃত্তি তোমার? ছি-ছি-ছি! কথাটা অর্চনার কাছে শোন; তুই বল অৰ্চনা—আমি দেখি নি সে গোবরডাঙার খুড়ীমাকে, তুই দেখেছিস। বল—জীবনে বোধ হয় একবার তিনি ওই মহিমময়ী মূর্তিতে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন।
***
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অর্চনা বললে—সেদিন তিনি যেন নিজেকে ফাটিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। আমার কথা শুনে আমার হাত ধরে টেনে নিচে প্রায় হেঁচড়ে নিয়ে এসেছিলেন; মুখে ওই এক বুলি—ছি-ছি-ছি!
তারপর তাঁর সে মূর্তির দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। নাটমন্দিরে-নাটমন্দির ভরা লোক, হ্যাজাকের আলো জ্বলছিল, তুমি পড়ে রয়েছ, রক্তের দাগগুলো কালো দাগড়া-দাগড়া ছোপের মতো দেখাচ্ছিল, তারই মধ্যে জ্যাঠাইমা দাঁড়ালেন—সাদা শাঁখের মত গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, মোটাসোটা মানুষ, মাথার কাপড় পড়ে গেছে গ্রাহ্য নেই, হ্যাজাকের আলোর সামনে দাঁড়িয়ে তিরস্কার করলেন জ্যাঠামশাইকে। সম্ভবত স্বামীর প্রতি জীবনের জমা-করা ঘেন্না, জীবনে সন্তানদের কাছে পাওয়া লজ্জার দুঃখ- সব যেন ফেটে চৌচির হয়ে আছড়ে পড়ল সেদিন সেই নাটমন্দিরে। কি বলেছিলেন সব কথা মনে নেই, বলতে পারব না। তবে একটা কথা মনে আছে। কানের পাশে আমার যেন বেজে উঠছে এই মুহূর্তে, শুধু এই মুহূর্তেই কেন সুরোদা, যখনই কোনক্রমে জ্যাঠাইমা কি সেই দিনের ঘটনা, কি আমার নিজের ভাগ্যের কথা মনে করি, তখনই কানের পাশে এইভাবেই বেজে ওঠে তাঁর কথাগুলো, আর চোখ বুজলেই দেখতে পাই সেই রাত্তিরের সেই ছবি—হ্যাজাকের উজ্জ্বল আলোয় তেমনি উজ্জ্বল জ্যাঠাইমার মূর্তি, মুখ-চোখ।
ওঃ, বলেছিলেন কথাগুলো বজ্রাঘাতের ধ্বনির মত, চমকে দিয়েছিল সকলকে। আঘাতটা তাঁর নিজের বুকেই বেজেছিল। বলেছিলেন, এইজন্যেই,–এইজন্যেই আমার গর্ভের এতগুলো সন্তান—সবগুলো তার জানোয়ার, জন্তু, প্রেত আর পিশাচ, একটা মানুষ হয় নি। কিন্তু রায়বাড়ীর সব বিষ কি তুমিই খেয়েছিলে? ওঃ, ভাগ্যিস আমার গর্ভে মেয়ে হয় নি! তাহলে তো —। ছি-ছি-ছি!
শেষ পর্যন্ত যে কি হত, কি বলতেন বা করতেন তিনি, তা বলতে পারব না সুলতাদি; ঘটনা বলুন বা যা ঘটেছিল বলুন, তাতে একটা ছেদ পড়ে গেল আর একটা ঘটনা ঘটে। বাইরে পুলিস এসে পড়ল।
ময়না থানায় খবর পাঠিয়েছিল মিসেস হাডসন আর কুইনি। গোমেশ আর ডিক্রুজ সুরোদার কাছেই চাকরি করত, সে জান তুমি; কিন্তু ভোটের ব্যাপার নিয়ে কীর্তিহাটের সঙ্গে গোয়ানপাড়ার ঝগড়া লাগতেই ওদিকে গোয়ানদের পিছনে এসে দাঁড়াল মুসলিম লীগের পাণ্ডা আর খড়্গপুরের মিসেস হাডসন। এদিকে কীর্তিহাটের লোকেদের সঙ্গে সারা দেশ—তার সঙ্গে মহারাজ নলকে বাড়িয়ে দেওয়া কলির শানানো ছুরির মত রায়বাড়ীর কল্যাণদা, প্রণবদা, আমার বাবা, জ্যাঠামশাই, বলতে গেলে এক সুরোদাকে বাদ দিয়ে সবাই।
নল-দময়ন্তীর ব্যাপারটা কলিযুগে ঘটেনি। ঘটলে অন্য রকম ঘটত। কলির শানানো ছুরিখানা দিয়ে কাপড়খানাকে মাঝখানে চিড়ে বাঁধন কেটে পালানোর মত পালাতেন না নল, কলিযুগ হলে দময়ন্তীর বুকে ছুরিখানা বসিয়ে দিয়ে গোটা কাপড়খানা নিজে নিয়ে পালাতেন।
এখানেও ঝগড়াটা চরমে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম কীর্তিহাটে উঠল গোয়ানদের বয়কট কর ধুয়ো। তারপরই আরম্ভ হল—গাঁয়ে পেলেই ধরে মারো। ডিক্রুজ, গোমেশ পালালো। ওদিকে গোয়ানপাড়ায় দোকান হয়ে গেল তিন-চারটে। তারপরই লাগল আগুন। পুড়ে গেল গোয়ানপাড়া।
গোয়ানপাড়া কংগ্রেস পোড়ায় নি। রঙলাল ঘোষ কিছু জানতেন না। তবে তাঁর উকীল ছেলে জানতেন, তার সঙ্গে জানতেন রায়বাড়ীর কর্তারা। কল্যাণের খাতক ছিল অনেকগুলি, গোয়ান খাতক। অল্প অল্প টাকা সুদে-আসলে বেড়ে বেড়ে তিন-চার গুণ হয়ে বন্ধকী তমসুদে পরিণত হয়েছিল। কল্যাণদা জানতো যে গোয়ানপাড়া সুরোদা লাখরাজ করে দিলে সেটেলমেন্টে সে গোয়ানপাড়ার বারো আনা তার। তাই সেদিন যা পেয়েছিল সুরোদার কাছে, তাই নিয়ে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ নতুন আইন হবার কথা শোনা গেল।
ডেট-সেটেলমেন্ট বোর্ড হবে। খাতক যত টাকা মূল নিয়েছে, তার বেশী পাবে না আর তা সহজ কিস্তিবন্দীতে শোধ দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কল্যাণদার দশ হাজার টাকা পাওনা, সে-হিসেবে পাঁচ হাজারের কমে দাঁড়াবে। কল্যাণদার চক্রান্তেই ধুয়ো উঠল—গোয়ান তাড়াও, হঠাও।
তার জন্যে লাগল আগুন। পুড়ে ছারখার হয়ে গেল গোয়ানপাড়া। সরকার থেকে সাহায্য এল, রক্ষা করবার জন্যে পুলিস এল, তার উপর এদের হাত ছিল না। কিন্তু সুরেশ্বরদা সাহায্য করায় এরা বসাল বিচারসভা, ওদিকে সেই খবর গোয়ানপাড়ায় পৌঁছুতেই গোয়ানরা পাঠালে পুলিসে খবর। সুরেশ্বরদাকে এরা অনেকেই বড়লোক বলে খাতির করত। পাড়াটা লাখরাজ করে দেওয়ায় সত্যিকার শ্রদ্ধাও অনেকে করত। কিন্তু সেদিনের সে-ব্যাপারটা খাতির কিংবা শ্রদ্ধার জন্যে তারা করে নি-তারা জেদের বশে করেছিল।
“সুরেশ্বর রায়বাবু তাদের সাহায্য করতে চেয়েছে বলে তাকে ধরে-বেঁধে গ্রামসভা বিচার করছে। এখুনি পুলিস এলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন। ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলবে। ইয়োরস ফেথফুলি, মিস্ কুইনি মুকুর্জি এবং মিসেস্ হাডসন। সেক্রেটারী এবং প্রেসিডেন্ট গোয়ান এ্যাসোসিয়েশন, কীর্তিহাট, গোয়ানপাড়া।”
অর্চনা বললে—চোখের সামনে দেখছিলাম লোকগুলো চলে যাচ্ছে। নাটমন্দিরের ভিড় পাতলা হচ্ছে। খুব খেয়াল সেদিকে ছিল না। আমি অভিভূতের মত তাকিয়েছিলাম জ্যাঠাইমার দিকে।
জ্যাঠাইমার সে কি মূর্তি!
হঠাৎ কে কাকে বললে—উঠে এস! শুনছ—উঠে এস! পুলিস, পুলিস এসেছে। পুলিস!
রঙলাল ঘোষকে বলছিল তার উকীল ছেলে।
জ্যাঠামশাই, ধনেশ্বর রায়, সুলতাদি, এবার এসে বললেন—থাম, এবার থাম গোবরডাঙার বউ—। পুলিস এসেছে। যাও বাড়ীর ভেতর যাও।
জ্যাঠাইমা যেন বুঝতে পারলেন না। শুধু তাকিয়ে রইলেন জ্যাঠামশাইয়ের দিকে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
—শুনছ? পুলিস, পুলিস আসছে।
হঠাৎ জ্যাঠাইমা একটা আর্তনাদ করে দুই হাতে কপাল টিপে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। তারপর যেন ঢলে পড়ে গেলেন কালীমায়ের পাট-অঙ্গনে।
ওদিকে অনেকগুলো ভারী জুতোর শব্দ তুলে পুলিস ঘরে ঢুকল।
সুরোদা তখন রক্তাক্ত মাথা নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে নাটমন্দিরে, নাট-অঙ্গনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন জ্যাঠাইমা। নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন দুই বৃদ্ধ-ধনেশ্বর রায় আর রঙলাল ঘোষ। আর আমি।
একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল; বারকয়েক দপ্ দপ্ করে লাফিয়ে জ্বলে হ্যাজাকবাতিটা নিভে গেল। জমিদারীর বিলুপ্তি ঘটল আজ, কিন্তু জমিদার রায়বাড়ীর শেষ আলো সেইদিন নিভেছিল সুলতাদি। এ-সত্য দুই চোখ মেলে আমি ছাড়া আর কেউ দেখে নি। সুরোদাও না।
সুরেশ্বর বললে—তাই ঠিক সুলতা, অৰ্চনা যা বললে, তাই ঠিক। ওই দিনই রায়বাড়ীর শেষ অন্তত বংশধারার নাটকে জমিদারী অঙ্কের শেষ। মানুষের বংশধারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বংশ হয় না, সে কালের সঙ্গে চলে। শুধু এক-একটা পর্বে ছেদ পড়ে! পাঠান মুঘল সুলতান বাদশা—তার আগে হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা ইতিহাস বিখ্যাত রাজা মহারাজা—তাঁদের বংশ নির্বংশ হয়েছে এমন ভাববার কারণ নেই। খুঁজলে পাওয়া হয়তো যাবে—কোন দোকানদার বা মুটেমজুরের মধ্যে। মানে রাজা মহারাজা বাদশা সুলতান বংশ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকে তারা। সুলতানশাহী বাদশাহী চরিত্র বা মেজাজ তাদের থাকে না। তাদের কে মনে রাখে বলো? তাদের কথা কে গল্প করে বলো?—করে না। ভাল লাগে না শুনতে। তাই বলি আমার-বংশে ছেদ পড়ল, শেষ হল। রায়বংশেও তাই হ’ল। সেদিন যখন প্রজাদের ডেকে আমাকে অপরাধী সাজিয়ে তাদের দিয়েই বিচার করালে আমারই জ্ঞাতিরা, তখনই সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে রায়বংশের নাটকে যবনিকা পড়ল। এর পর যে বংশধারা রইল-সে নদী নয়—সেগুলোকে নালা বলতে পার।
একটু হেসে সুরেশ্বর বললে সে সময়ে মানে ১৯৩৮।৪০ সালে সম্ভবতঃ বাংলাদেশে সব জমিদারী বংশেরই অল্পবিস্তর এই দশা হয়েছে। প্রজারা সকলেই বিচার করতে বসুক না বসুক অভিযোগের ফিরিস্তি তৈরী করছিল। কিন্তু জমিদারদের তখনও কাঠগড়ায় হাজির করতে পারে নি। জমিদারী আমলের শেষ দৃশ্যের শুরুতেই রায়বংশের পালা সারা হয়ে গেল। যারা টিকে রইল তাদের অধিকাংশই সরকারকে আঁকড়ে ধরে টিকে রইল। রায়বংশ তা পারলে না। না পারলেন ধনেশ্বর কাকারা, না পারলেন প্রণবেশ্বর দাদারা এবং সব থেকে সচ্ছল অবস্থা ছিল আমার—আমিও পারলাম না তা। এবং সেই দিন রাত্রেই যা করলাম, তাতে আমি সরকারকে স্বীকার করলাম না, স্বীকার করলাম প্রজাদের। হ’ল কি জান?
আমার জ্ঞান হতেই আমার বিছানার সামনে উপবিষ্ট এস. আইটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—এই যে জ্ঞান হয়েছে আপনার! কেমন মনে হচ্ছে বলুন তো সুরেশ্বরবাবু?
নিজের কপালে হাত দিয়ে ব্যান্ডেজটায় হাত বুলিয়ে দেখতে দেখতেই সব মনে পড়ে গিয়েছিল। শুধু বুঝতে পারি নি-পুলিস কোথা থেকে এল এবং কেমন করে এল! প্রশ্নটার উত্তর মিলুক বা না মিলুক, প্রশ্নটা থেকে আরও কতকগুলো ফ্যাকড়া প্রশ্ন বেরিয়ে প্রশ্নটার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছিল। কেন—পুলিস এল কেন? পুলিস এমন ক’রে বসে কেন? আমাকে ঘিরে রয়েছে কেন? আমাকে অ্যারেস্ট করেছে কিনা—ইত্যাদি—ইত্যাদি। আমি ভাবছিলাম। দারোগাটি আবার প্রশ্ন করলেন —সুরেশ্বরবাবু, কি কষ্ট হচ্ছে আপনার?
বোধ করি দারোগার গলার আওয়াজ পেয়েই ওঘর থেকে এ-ঘরে এসে ঢুকলেন আর একজন পুলিস অফিসার—যাকে দেখে খট্ করে গোড়ালি ঠুকে দারোগাবাবু সেলাম দিলেন।
নতুন আগন্তুক জিজ্ঞাসা করলেন—জ্ঞান হয়েছে নাকি?
—হ্যাঁ স্যার, চোখ মেলেছেন। কিন্তু সাড়া দেন নি।
নতুন আগন্তুকটি অল্পবয়সী এবং উচ্চপদস্থ অফিসার। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনার আর কোন ভয় নেই—আমরা খুব সময়ে এসে পড়েছিলাম। এখন আপনি সেফ। কেমন মনে হচ্ছে বলুন তো?
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতেই বললাম—ভাল। বিশেষ কষ্ট কিছু নেই—তবে মাথায় একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।
—ওটা খুব সিরিয়াস নয়। কিন্তু একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে যে আপনাকে। এখন সেটা পারবেন? এখন হলেই ভাল হয়।
পুলিসের কাছে স্টেটমেন্ট! সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে সহস্র প্রশ্ন জেগে উঠল। সহস্র প্রশ্নের সবগুলোই রায়বংশ নিয়ে। মনে তো সবই পড়ছিল। ধনেশ্বর কাকা —প্রণবেশ্বরদা—কল্যাণেশ্বর, অর্চনা, সবার কথা মনে পড়ছিল। স্টেটমেন্ট দিতে গেলে কোন্ কথা বাদ দেব? কার কথা বাদ দেব? কেমন করে দেব?
জীবনে যে সাহস বা সত্যবোধ থাকলে ব্যাসদেবের মত মহাভারতের প্রথমেই নিজের জন্মকথা—তাঁর পিতা পরাশরের সঙ্গে মা মৎস্যগন্ধার দেহসংসর্গের কথা—অত্যন্ত সহজে বলা যায় বা বলতে পারে মানুষ, তা আমার সেদিন ছিল না। রায়বংশের কারুরই ছিল না। সে সত্যবোধকে আড়াল করে বা ভ্রূণহত্যার মত হত্যা ক’রে দাঁড়িয়েছিল জমিদারীর মর্যাদা। ওই জমিদারীর মর্যাদাই রায়দের বংশমর্যাদা, তাছাড়া আর কিছু নয়।
ডি-এস-পি, ভদ্রলোকটি ডি-এস-পি, তিনি আবার ডাকলেন-সুরেশ্বরবাবু!
চোখ বুজেই উত্তর দিলাম—বলুন!
–স্টেটমেন্ট দিতে হবে যে আপনাকে!
–স্টেটমেন্ট!
—হ্যাঁ। কি হয়েছিল? কি করে আঘাত লাগল আপনার কপালে? কে মেরেছিল আপনাকে? আপনাদের বাড়ীর নাটমন্দিরে এত লোকেরা মিলে কি করছিল?
আমার থেকেও বছর ছয়-সাতের ছোট ছিলেন ভদ্রলোক। ১৯৩৮ সালে আমার বয়স আটাশ—তাঁর বয়স তখন সদ্য বিশ পেরিয়েছে। পুলিস লাইনে তখনও পাকেন নি, পাকলে ওইভাবে সমস্ত পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিতেন না।
তিনি বললেন-ময়না থানায় গোয়ানপাড়া থেকে দুজন লোক এবং আপনার কর্মচারী আচার্যের চিঠি নিয়ে একজন লোক গিয়ে খবর দেয় যে গ্রামের লোকেরা এবং রায়বাড়ীর অন্য অন্য দেউলে-পড়া শরিকেরা মিলে আপনার বিচার সভা বসিয়েছে। গোয়ানপাড়া থেকে মিসেস হাসন আর মিস কুইনি মুখার্জী চিঠিতে লিখেছিলেন, গোমেশ এবং ডিক্রুজ এরা চোখে দেখেছে—সুরেশ্বর রায়কে কীর্তিহাটের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের বিচার সভায়। বাবু সুরেশ্বর রায় একজন কাইন্ড-হার্টেড ইয়ং মডার্ন জমিন্ডার—উইথ নো প্রেজুডিস অব এনি কাইন্ড। গোয়ানরা ক্রীশ্চান বলে তিনি তাদের ঘৃণা করেন না। গোয়ানদের ঘরবাড়ী পুড়ে যাওয়ার জন্যে তিনি সকল গোয়ানকে সাহায্য করতে চেয়েছেন বলে কীর্তিহাট পিপল তাঁকে বিচার করে সাজা দিতে সঙ্কল্প করেছে এবং সুরেশ্বরবাবুর জ্ঞাতিরা—যারা সুরেশ্বরবাবুর মৃত্যুতে লাভবান হতে পারে তারা। দে হ্যাভ জয়েনড হ্যাণ্ডস উইথ দি ভিলেজারস। তাঁকে মেরে ফেলাও অসম্ভব নয়। আপনারা তাড়াতাড়ি এলে তাঁর জীবন রক্ষা পেতে পারে এবং গোয়ানপাড়া কারা পুড়িয়েছে তার অব্যর্থ প্রমাণও পেতে পারেন পুলিস বিভাগ।
আমরা বলতে গেলে দৌড়ে এসেছি। অফিসাররা সাইকেলে এসেছেন—আর্মড কনেস্টবস্ ডবল মার্চ করে এসেছে সারাটা পথ। এসে আপনাকে জীবন্ত অবস্থায় পেয়েছি এইটেই লাক্ বলতে হবে। মাথাটা কেটে গেছে—অনেকখানি রক্ত পড়েছে। লোকজন কেউ নেই। থাকবার মধ্যে ধনেশ্বরবাবু বসে আছেন তাঁর স্ত্রীর মাথা কোলে ক’রে। ভদ্রমহিলা বোধ হয় মারা গেছেন—তাঁর মাথার শিরা ছিঁড়ে গেছে। সেরিব্রেল থ্রম্বসিস। আর বুড়ো রঙলাল ঘোষ। এবং আপনার খুড়তুতো বোন অৰ্চনা দেবী।
সুরেশ্বর একটু হাসলে। হেসে বললে—সেদিন সর্বপ্রথম বাঁচাতে চেয়েছিলাম অৰ্চনাকে। তার কথাটা উল্লেখই করি নি। আর রায়বাড়ির শরিকদের কথা এবং রঙলাল ঘোষের কথা মনে রেখে ওদের বাঁচাবার জন্য গোয়ানদের কথাটাকেই একমাত্র কথা ক’রে তুলে বলেছিলাম- হ্যাঁ, বিচার একটা হচ্ছিল, রায়বাড়ীর শরিকরাই গ্রামের লোকদের ডেকেছিলেন—বিচার করবার জন্যে। আমারই বিচার হচ্ছিল।
—কিসের বিচার? কি অপরাধ করেছিলেন আপনি?
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ভেবে নিয়ে বলে ফেললাম,—আমার একটু বেশি মেলামেশা ঘনিষ্ঠতা হয়ে যাচ্ছিল গোয়ানদের সঙ্গে—মানে।
কি বলব ভেবে পাই নি। তবু একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলাম, আন্দাজে আন্দাজে সেই পথেই চলেছিলাম। কথাটা আংশিকভাবে সত্যও বটে। আমার শরিকদের দাবীও ছিল তাই। গোয়ানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্যেই হোক আর অন্য অমার্জনীয় কলঙ্কের জন্যেই হোক—আমায় ধর্মভ্রষ্ট জাতিচ্যুত করে পতিত করতে পারলেই অন্ততঃ দেবোত্তরের সেবাইতের অধিকার থেকে আমি বঞ্চিত হব। আমি গোয়ানদের কথাটাকে সেই কারণেই আঁকড়ে ধরেছিলাম। তবুও বলতে গিয়ে থামতে হল। সত্যকে খালি মাথায় ধরে নিয়ে অনায়াসে চলা যায়, কিন্তু রাজাগিরি বা জমিদারগিরির পাগড়ী বা তাজের উপর চাপানো যায় না—তাতে ওই তাজ বা পাগড়ী ভেঙে যায় চেপ্টে যায়, অন্ততঃ পাগড়ি তাজ লজ্জিত হয়, লাঞ্ছিত হয়। আমি থেমে গেলাম।
কিন্তু পুলিস অফিসার ছাড়বেন কেন—তিনি যুগিয়ে দিলেন—
—মানে? বলুন—সুরেশ্বরবাবু।
—মানে তাদের সম্পর্কে কি বলব? বলব আমার কিছু দুর্বলতা আছে।
—দুর্বলতা? I See, কি দুর্বলতা? বলুন!
ভদ্রলোক আমাকে ঠেলে ঠেলে যেন কোণে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যে শক্তিতে আমি নখদাঁত বের করে দাঁড়াতে পারতাম তা আমার ছিল না। আমি বলতে পারতাম সুলতা, বলতে আমি গিয়েওছিলাম আমার পিতামহ দেবেশ্বর রায়ের ঋণের কথা; বলতে পারতাম আমার ঠাকুমার কথা; অনায়াসে বলতে পারতাম আমার ঠাকুমা আমাকে বলেছেন—ভাই নাতি, তোমার ঠাকুরদার সব থেকে বড় ঋণ ওই গোয়ানদের কাছে। ভাই, তোমার ঠাকুরদার শ্রাদ্ধের সময় সেই ঋণ শোধ হ’ল না, শোধ করবার কথা কেউ ভাবলে না দেখে আমি গোয়ানপাড়ায় গির্জের পাদরীর কাছে—পাড়ার লোকেদের কাছে গিয়েছিলাম—ঋণ শোধ করতে। কিন্তু তাও হয় নি। উপরন্তু আমার জাত গেছে ব’লে আমাকে ঠাকুরবাড়ী ঢুকতে দেয় নি। আমাকে এনে কলকাতায় বন্ধ রেখেছিল। সেখান থেকে আমি বেরিয়ে ভাগ্যক্রমে বৃন্দাবনে এসে গোবিন্দের আশ্রয় পেয়েছি।
বলতে বলতে সুরেশ্বরের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল। সে চুপ করলে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে-সুলতা, সেদিনের সে অবস্থা আমি কখনও ভুলব না। ওঃ, কে যেন আমার গলা টিপে ধরলে। সেদিন জানতে পারি নি, বুঝতে পারি নি, তবে আজ বুঝতে পারি, বলতে পারি—গলা টিপে ধরেছিল আমার জমিদারির ইজ্জৎ; কুড়ারাম ভটচাজ—জমিদার হয়ে রায় খেতাব নিয়েছিলেন। রায়বংশ জমিদারবংশ, রায়বাড়ীর মর্যাদা জমিদারীর মর্যাদা। ব্রাহ্মণের মর্যাদা নয়। বেদব্যাসের মর্যাদা আর পাণ্ডব কৌরবদের মর্যাদা আলাদা সুলতা। বেদব্যাসের পিতৃমাতৃ-পরিচয়ের মধ্যে কোন আবরণ নেই—কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর এবং পাণ্ডবদের সত্যকার পিতৃপরিচয়ের কানাঘুষোর মধ্যে লোকে বলাবলি করেছে, উচ্চারণ করতে বা এ নিয়ে গবেষণা করতে কারুর সাহস হয় নি।
আজ সত্যকেই তোমার সামনে উদ্ঘাটিত করছি। সেদিনের মত জমিদারী ইজ্জৎকে বড় করছি না, সেই সঙ্গে এই সত্যটুকুও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি সুলতা যে এই ইজ্জত মিথ্যা হলেও মূল্যের দিক থেকে কম নয়। খাটো কাপড় কি বঙ্কল পোশাকের সঙ্গে রাজ-জমিদারের পোশাক-পরিচ্ছদের মূল্য বিচার করে দেখ, প্রমাণ তার প্রত্যক্ষ।
পিতামহ দেবেশ্বর রায়ের ঋণের কথা বলতে গিয়ে বলতে পারি নি আমি। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার ভিতর থেকে কেউ যেন বলেছিল—না, তুমি বলো না। ছি!
ডি-এস-পি আবার প্রশ্ন করেছিলেন-সুরেশ্বরবাবু!
আমার মনে পড়ছে কপালের ব্যান্ডেজে আমার চাড় পড়েছিল, টনটন করে উঠেছিল কপাল। আমি কপাল কুঁচকে বলেছিলাম—এই দুর্বলতার মানেও আমাকে বলতে হবে?
—তা হবে সুরেশ্বরবাবু। না হলে এর মানে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তা যে কিছু কিছু করি নি তা নয়। করেছি। ধনেশ্বরবাবুর একটা স্টেটমেন্ট আমরা নিয়েছি। এবং সেটাকে আমরা সত্য বলেই মনে করি। তাঁর স্ত্রী শুনলাম ব্রেনে হেমারেজ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মৃত বলেই ধরা যায়। এই মুহূর্তে তিনি মিথ্যা বলবেন না। কথাটা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম; কারণ তখনও আমি গোবরডাঙার খুড়ীমার খবর জানতাম না। আমি অজ্ঞান হয়ে যাবার পর তিনি নাটমন্দিরে ঢুকেছিলেন। ডি-এস-পির কথায় বাধা দিয়ে আমি বললাম—একসকিউজ মি সার, কি বলছেন আপনি তা তো বুঝতে পারছি না। কে–কার কথা বলছেন মৃত বলে ধরা যায়?
ডি-এস-পি বললেন—ধনেশ্বরবাবুর স্ত্রী। তিনি এই বিচারের আসরে প্রতিবাদ করবার জন্য বেরিয়ে এসেছিলেন। এবং সেইখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ডাক্তার দেখেছেন, বলেছেন—ব্রেনে কোন শিরা ছিঁড়ে হেমারেজ হচ্ছে। বোধ হয় বাঁচবেন না। বাঁচলেও প্যারালিটিক হয়ে সেবার ধন হয়ে বেঁচে থাকবেন।
আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসেছিল। আমি তাঁর কথাই ভাবছিলাম। কি বিচিত্র পরিচয়ই না রেখে গেলেন ব্রজদার মা! ওঃ!
ডি-এস-পি আমাকে ডাকলেন। বললেন—আমার কাজটা আমি শেষ করে নেব সুরেশ্বরবাবু। যা বলছিলাম আমি—যাঁর স্ত্রী এই মুহূর্তে মৃত্যুশয্যায় তিনি মিথ্যা কথা বলবেন না এইটেই ধরা যায়। ধনেশ্বরবাবু এই মুহূর্তে যা বলেছেন তাকে আমি সত্য বলেই ধরে নিয়েছি।
—কি বলেছেন তিনি না জানলে কি ক’রে এর উত্তর দিতে পারি বলুন!
তিনি বলেছেন—রায়বংশের আপনার লাইনটায় একটা দোষ আছে। সেটা আপনার পিতামহের ছিল, আপনার বাবার ছিল এবং আপনার মধ্যেও সেটা ফুটে উঠছে। অন্যেরা নানারকম অপবাদ যা দিচ্ছে তা সবই মিথ্যে। সেগুলো বিষয় নিয়ে আক্রোশবশে দিচ্ছে। কিন্তু গোয়ানপাড়ার হিলডা পিদ্রুজের সম্পর্কে নাতনী কুইনি মুখার্জি বলে একটি মেয়েকে আপনি বিশেষ অনুগ্রহ করেন, তাকে ইস্কুলে পড়াচ্ছেন। তার কলকাতায় একখানা বাড়ী আছে, তা নিয়ে কি গোলমাল হয়েছিল, আপনি অনেক টাকা খরচ করে বাড়ী ঝঞ্ঝাটমুক্ত ক’রে দিয়েছেন—
খানিকটা থেমে ডি-এস-পি বললেন-ধনেশ্বরবাবু বললেন—গোয়ানদের মধ্যে কয়েকটা খারাপ মেয়ে আছে, তারা প্রায় ব্রাত্য শ্রেণীর। তাদের সঙ্গে আপনার কোন অপবাদ বা গোপন সম্পর্কের কথা আজও পর্যন্ত তিনি শোনেন নি। এবং বিশ্বাসও করেন না। তবে কুইনি সম্পর্কে কিছু কথা তাঁর কানে এসেছে। সে কুইনির ছবি এঁকেছে। কুইনি মধ্যে মধ্যে তাঁর বাড়ী বিবিমহলে আসা-যাওয়া করেছে। কল্যাণেশ্বরবাবু বললেন—তিনি হিলডাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ঐসব কি হচ্ছে হিলডা? সুরোবাবুর মতলবটা কি? তাতে সে বলেছিল—সুরোবাবু যে মতলব করবে তাই হাসিল হবে। তুমরা টাকা খরচ করো, এমনি জিমিদার হও, তুমার মতলব ভি হাসিল কর দেগা। কুইনি তো সুরোবাবুর ঠাকুরদাদার—
সুলতা, আমার বুকের ভিতর থেকে মুহূর্তে কে যেন কথা বলে উঠেছিল। আমি ডি-এস-পি’কে বাধা দিয়ে বলে উঠেছিলাম-ইয়েস সার, আমি স্বীকার করছি কুইনি সম্পর্কে আমার উইকনেস আছে। পারসোনাল উইকনেস। আমি তাকে স্নেহ করি।
ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডি-এস-পি বললেন—দোহাই আপনার, প্লিজ কল স্পেড এ স্পেড ভাইয়ের মত, বোনের মত, প্ল্যাটোনিক ইত্যাদি কথাগুলো বলবেন না। আমাদের পুলিসী শাস্ত্রে এগুলো নেহাতই ফাঁকা কলসীর আওয়াজ।
সঙ্গে সঙ্গে আমার দেহের মধ্যে রক্ত যেন বিদ্রোহ করে টগবগ করে ফুটে উঠেছিল। আমি উঠে বসে বলেছিলাম- লেট মি ফিনিশ প্লিজ! আমার কথা ঠিক শেষ হয় নি। তার আগেই আপনি কথা বললেন।
—ও, আই অ্যাম সরি! বলুন কি বলছেন? শেষ করুন। আপনি তাকে স্নেহ করেন—। বলুন!
—হ্যাঁ, আমি তাকে স্নেহ করি। স্নেহ এবং ভালবাসায় তফাৎ খুব বেশী নয়। একটু মাত্র। বয়সে ছোট যাকে ভালবাসি তাকে স্নেহও করি। এবার কুইনি সম্পর্কে আমার ভালবাসার স্বরূপ বা মানে আপনার অভিধান মত করে নিতে পারেন।
—তার সঙ্গে আপনার দেহসম্পর্ক হয়েছে কখনও?
চমকে উঠেছিলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করে বলেছিলাম না।
—তা হলে? ইউ স্পেন্ট সো মাচ মানি অন হার!
আমি হেসে বলেছিলাম—আমার টাকার অভাব নেই স্যার। একলা মানুষ টাকা ঠিক খরচ করতে পথ পাইনে। জমিদারের ছেলেদের মেজাজ এবং চরিত্র তো জানেন; বিয়ে করি নি, চরিত্রদোষ চলিত অর্থে এখনও নেই। কুইনিকে ভাল লেগেছে, তাকে গড়ে তুলছি; পিছনে খরচ করতে ভাল লাগছে। তারপর যা হয় হবে। এই পর্যন্ত বলতে পারি। বেশী আজ আর বলতে পারব না। শরিকরা বিচারসভা ডেকেছিল ওই জন্যে। আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন—আমার মতলবটা কি? অনেকের মনে—মানে আমাদের শরিকদের ধারণা আমি ওকে বিবাহ পর্যন্ত করতে পারি। দু’একজনের ধারণা—মধ্যে কুইনি আর হিলডা বাড়ীর গোলমালের জন্যে কলকাতা গিয়েছিল, তখন রেজেস্ট্রি-ফেজেস্ট্রি করে বিয়ে একটা হয়ে গেছে। এই নিয়ে কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। আমি ঠিক চিনিনে, একজন আমার সঙ্গে তর্ক করছিল, আমি রাগের বশে তারপর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলাম, ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পড়ে গেলাম আছড়ে খেয়ে, পড়বার সময় শক্ত একটা কিছুতে আঘাত লেগে আমার মাথাটা কেটে গিয়ে থাকবে। আমি মাথায় একটা যন্ত্রণা অনুভব করেছি মাত্র, তার বেশী কিছু বলতে পারব না। জ্ঞান হয়ে দেখছি আমি এখানে শুয়ে আছি।
ডি-এস-পি এতক্ষণে বুঝলেন –কেসটা ফেঁসে গেল। তিনি দৃষ্টি বিস্ফারিত করে আমার মুখের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর বললেন-সুরেশ্বরবাবু!
—বলুন!
—আপনার মাথায় লোহার ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করে নি?
—না। ওটা পড়ে ছিল। আমারই হাতের কাছে ছিল ওটা। আঘাত আমাকে কেউ করে নি।
ডি-এস-পি আর কিছু না বলে চলে গিছলেন রাত্রির মত।
পরের দিন সকালে ডি-এস-পি আবার এসেছিলেন আমার কাছে। তখন গোবরডাঙার খুড়ীমা মারা গেছেন—এ বাড়ীতে কান্নার রোল উঠেছে। আমি বসে আছি মাথা হেঁট ক’রে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ডাক্তার ব্যান্ডেজটা আবার ভাল ক’রে বাঁধছে। কপালের ক্ষত থেকে আবার রক্ত পড়তে শুরু হয়েছিল।
ডি-এস-পি উপরে উঠে এসেছিলেন—সঙ্গে তাঁর কুইনি। কুইনির মুখ-চোখ যেন থমথম্ করছিল।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম আমি। বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ড যেন চঞ্চল অধীর হয়ে উঠেছিল। মনে পড়ল মেদিনীপুরের বাড়ীতে মাসখানেক আগে কুইনিকে দেখে ঠিক এমনি চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। সহস্র নারীর মধ্যে যে নারী এক অজ্ঞাত বিচিত্র কারণে এক বিশেষ পুরুষের কাছে সবচেয়ে বেশী কামনীয়া হয়, রূপের ব্যাকরণের শত ত্রুটি সত্ত্বেও সব থেকে বেশী রমণীয়া হয়, সেই বিচিত্র কারণেই কুইনিকে দেখে আমার চিত্ত আমার দেহের অণুপরমাণু চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।
কুইনি কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠেছিল—আপনাকে আমি ঘৃণা করি, অত্যন্ত ঘৃণা করি। আপনাদের বংশকে আমি জানি। আপনারা অত্যাচারী, শোষক, আপনারা ব্যভিচারী, লম্পট। আপনারা মিথ্যাবাদী প্রতারক। আপনি এই কুমতলবে আমাকে পড়ার খরচ দেন এবং আমার বাড়ীর টাকা দিয়েছেন তা আমি জানতাম না। আমি আপনার টাকা আর নেব না। গোয়ানপাড়ার কোন লোক আপনার সাহায্য নেবে না।
আমি তার মুখের দিকেই তাকিয়েছিলাম। মুগ্ধের মত তাকিয়ে ছিলাম। কুইনির রূপের স্বরূপ কেমন, সে বিচার অন্যে করতে পারে, আমি পারি না। তাকে দেখলেই সে আমার একান্ত আপনার, কিংবা সে আমার এমনি একটা—এমনি একটা ইমোশনাল ধারণা আমাকে যেন অভিভূত করে দিত। তা এখনও দেয় সুলতা।
ডি-এস-পি আমাকে সেই পত্র এবং কাগজগুলো দেখিয়েছিলেন, যেগুলো কুইনি একদিন বিবিমহলে অর্চনার সঙ্গে এসে আমাকে দেখিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার মুখে অস্তগামী সূর্যের আলো পড়া তার মুখ আমার মনে পড়েছিল সেদিন। সেদিন কাঁসাই পার হবার সময় কুইনির ছবিটা দেখাচ্ছিল শিল্যুটের মত, তাও মনে পড়েছিল।
ডি-এস-পি বলেছিলেন—এগুলো দেখেছেন তো আপনি?
বললাম—দেখেছি।
—তা হলে?
—কি তা হলে?
—কোটা সত্য?
—যদি বলি দুটোই সত্য!
—বলব মিথ্যে বলছেন একটা।
—না। তা মনে করিনে। তবে যা খুশী ধরে নিতে পারেন।
একটু হেসে বলেছিলাম—আপন বলেই ওকে ভালবাসি। এই সত্যটা কেন সত্য হবে না বলুন তো?
সুলতা, এর পরেই দিনই জীবন আমার দুদিক থেকে বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। দুদিক থেকে কেন, তিন দিক থেকে।
কীর্তিহাটের শরিকদের তরফ থেকে।
কীর্তিহাটের লোকদের তরফ থেকেও।
গোয়ানপাড়ার লোকদের তরফ থেকেও
কেউ চাইল না আমাকে।
বারো দিন পর, গোবরডাঙার খুড়ীমার শ্রাদ্ধের পর অর্চনাকে নিয়ে আমি কলকাতা চলে এলাম। ব্ৰজদা টেলিগ্রাম পেয়ে বিহার থেকে এসেছিল মা’র শ্রাদ্ধ করতে। সাহায্য করেছিল ব্রজদা। কীর্তিহাটের জমিদারী জীবনে যবনিকা টেনে দিলাম বলে ঘোষণা করেই কলকাতা এলাম। কয়েকদিন পর বৃন্দাবন গিয়ে নিয়ে এলাম রায়বাড়ীর মেজ-হুজুর শিবেশ্বর রায়ের কেনা তৃতীয়পক্ষ সেই পুরোহিতকন্যাকে। গিয়ে বললাম—তোমার স্বামীর মেজছেলের কন্যা অর্চনা। তুমি তাকে বাঁচাতে জেলে গেছ। এবার ফিরে চল—তার ভার তোমাকে নিতে হবে। আমি রেহাই নেব। আমার বাবা অনেক টাকা রেখে গেছেন। আমি তা উড়িয়ে দেব। চলে যাব কলিযুগের স্বর্গে; স্বর্গ বল স্বর্গ, বৈকুণ্ঠ বল বৈকুণ্ঠ—জীবনের মোক্ষধাম ইয়োরোপ। ইয়োরোপে যাব। তা ছাড়া কি করব? সংসারে সেকালে পয়সা যার থাকত সে কাশী বৃন্দাবন যেত। একালে ইয়োরোপ যায়। আমি ভেবেছিলাম গিয়ে আর ফিরবই না। ওখানেই থেকে যাব।
যাবার সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। যাবার আগে তোমাকে কুইনির ছবিটা প্রেজেন্ট করেছিলাম মামাতো বোনের মারফত। তুমি রিফিউজ করেছিলে। সেটা সেদিন আমার বগলেই ছিল।
ওঃ, ভাগ্যে তুমি ছবিখানা নাও নি সুলতা! কেন জান? ওই ছবিখানা নতুন করে আঁকতে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে যেতাম। পারতাম না। মনে হ’ত পারব না। কিছুতেই পারব না।
সুরেশ্বর বললে—ভেবেছিলাম, ইয়োরোপ থেকে ফিরব না। ওখানেই থেকে যাব। আমার বাবা জার্মানীর হাসপাতালে জীবনে ছেদ টেনেছিলেন—আমিও তেমনি ভাবে ছেদ টেনে দেব। তারপর যজ্ঞেশ্বর রায়, তাঁর ছেলেরা এবং শিবেশ্বর রায়ের পতিত বংশের প্রেতেরা কে কি করলে বা করবে তা নিয়ে কোন চিন্তাই করব না। ইয়োরোপে গিয়ে জীবনের অবদমিত সমস্ত বাসনাকে মুক্তি দিয়ে দেব; আমার যা অর্থ আছে—তাই দিয়েই সিংহদ্বার না হোক- একটা বেশ প্রশস্ত ফটক খুলে দেওয়া হবে।
বাসনা আমার ছিল। কারই বা থাকে না! তোমাকে নিয়েই তো বাসনা আমার কম উল্লসিত কম উচ্ছ্বসিত হয় নি। কল্পনা তো অনেক করেছিলাম। কিন্তু এক ঠাকুরদাস পালের রক্তের নদীই তোমাকে আমার নাগাল থেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। এবং আশ্চর্যভাবে রায়বংশের গোপন পরিচয় আমার সামনে তার গোপন অপরাধের ফিরিস্তি খুলে দেখিয়ে দিলে দুনিয়ার কাছে আমাদের দেনা কত। এবং সেই দেনার সুদ কি বিচিত্রভাবে প্রকৃতির নিয়মে আমরা আদায় দিচ্ছি, দিতে বাধ্য হচ্ছি!
বাবার শেষ চিঠিখানা যা তিনি মাকে লিখেছিলেন-সেখানা আমার স্যুটকেসেই রাখতাম; যে কথাটা তিনি তার মধ্যে আমাকে বলে গিয়েছিলেন তা আমার মনে অক্ষয় হয়ে ছিল। লিখেছিলেন “মেয়েদের থেকে যদি দূরে থাকতে না পারে তবে যেন বিয়ে না করে সুরেশ্বর।”
আমি ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের থেকে দূরেই থেকেছি-ভয় ক’রে কিন্তু স্থিরনিশ্চয় হতে পারি নি, বুঝতে পারি নি, মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে পারব কিনা!
ভূ-সম্পত্তির অধিকার—যারা নিজেদের ভূমির বা পৃথিবীর স্বামী মনে করে—তারা জানে না কি অপরাধ করে! কথাটা জানিয়ে গিছলেন রত্নেশ্বর রায়। বলতেন—ভূমি হল পৃথিবী। পৃথিবী মানুষের মা। পৃথিবীর স্বামী যারা হতে যায় বা হয় বলে মনে করে—তাদের অসাধ্য পাপ বোধ হয় পৃথিবীতে হয় না। জীবনে তারা সম্পর্ক বাছে না। এ কথার নজীর পৃথিবীর সব দেশের রাজা-জমিদারের ঘরে আছে। অপরের স্ত্রী হরণ, দরিদ্র আত্মীয়ের স্ত্রী-কন্যা নিয়ে অপবাদ জড় করলে পাহাড় হয়। জমিদারবাড়ী বা রাজার বাড়ীতে দরিদ্র আত্মীয় সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে এসে অনেক ক্ষেত্রে বহু উপঢৌকন উপহার নিয়ে ফিরে গেছে—অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী বা স্বামী কারুর আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অঞ্জনার মত স্নেহের আবরণে অনুগ্রহ পেয়ে থেকে গেছে; অঞ্জনার ভাগ্য- বেচারা দৃষ্টি-ভোগের অতিরিক্ত ভোগে লাগে নি বলে নিজেকে গোয়ানিজের ভোগ্যা করে আপনি গড়িয়ে গিয়ে তার পাতায় পড়েছিল।
একটু চুপ করে থেকে সে আবার বললে—নিজেকে আমি বার বার বহুবার বিশ্লেষণ করেছি, বিচার করেছি। দেখেছি মেজঠাকুমা, অৰ্চনা সম্পর্কে আমার অপরাধ কতটা! অকুণ্ঠ কণ্ঠে বলছি—অকপট চিত্তে তোমাকে বলছি, শুধু তোমাকে নয়, দুনিয়াকেই বলছি, না, ওখানে অপরাধ আমার ছিল না। মুসলমান বা ক্রীশ্চান হলে অর্চনা সম্পর্কে কোন মনোভাবেই দোষ থাকত না কিন্তু হিন্দুধর্ম না মেনেও হিন্দু বলেই ও-কামনা কখনও জাগে নি। তবে একটু বেশী রকম সজাগ সতর্ক থেকেছি বরাবর। বুকের দরজায় কামনার করাঘাত হলেই জেগে উঠেছি। রুষ্ট সাড়ায় সাড়া দিয়েছি—ও-দিক থেকে আঘাত স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ওইখানেই আমি অনুভব করেছি সুলতা—সম্পদের ঐশ্বর্যের এবং ভূমির অধিকারের কি প্রবল শক্তি! সমুদ্রে পড়েও মানুষ বাঁচে, হয়তো সমুদ্রই তাকে তীরে এনে দেয় কিন্তু সম্পদ ঐশ্বর্যশালীর বাঁধনে ধরা পড়লে তাকে বাঁধনের পীড়নে এলিয়ে পড়তেই হবে। সেখানে কাউকে বাঁচাতে হলে সম্পদশালীকে রাবণের মত অভিশপ্ত করে রাখতে হবে। বাল্মীকি সীতাকে রাবণের কুড়ি হাতের আকর্ষণ থেকে রক্ষা করবার জন্য আগে থেকে নল-কুবেরকে দিয়ে অভিশাপ দিয়েই রেখেছিলেন-নারীর অমতে জোর করে নারীধর্ষণ করলে, দশটা মাথা একশো ফাটে ফেটে এক-একটা মাথা দশচিড় হয়ে যাবে। শুধু সম্পদশালীকেই দোষ দেব না—দরিদ্রকেও দোষ দেব সুলতা। তারা রিক্ত বঞ্চিত বলে তাদের ন্যায় বিচারে মাফ করবার অধিকার কারও নেই। সে যারা করবেন তাঁরা পলিটিকাল লীডার, খেয়ালি বিধাতা বা ডিক্টেটার। আমি দেখেছি—দরিদ্র পিতামাতা কন্যাকে সম্পদশালীর সামনে এনে ধরে ইচ্ছে করে। দরিদ্র নারী—সেও এসে সম্পদশালীর নজরে পড়তে চায়। কিন্তু সে সব কথা থাক। আমার জবানবন্দীতে আমার কথা বলি। রায়বংশে যে বাসনার স্রোত… সোমেশ্বর থেকে শ্যামাকান্ত থেকে রায়বংশের জমিদারী আর রূপের দুই কূলের মাঝখান দিয়ে বেয়ে এসেছে-তার বেগ তার স্রোত আমার মধ্যেও ছিল, কিন্তু আমি তার মুখে বাঁধ দিয়েছিলাম।
ইংল্যান্ড যাবার আগে ওই দিন রাত্রে ডি-এস-পি’র কাছে রায়বংশের ইজ্জত মর্যাদা বাঁচাতে কলঙ্ক নিলাম নিজের মাথায়। কলঙ্ক একতরফা হয় না; কলঙ্ক রটাতে হলে আর একটা তরফের প্রয়োজন হয়। তরফ খুঁজতে গিয়ে আর কাউকে পেলাম না, পেলাম ওই গোয়ানদের; গোয়ানদের মধ্যে ওই কুইনি মেয়েটির সঙ্গে একটা টাকা দেওয়ার সূত্র জড়ানো ছিল। সেই সূত্র ধরে ডি-এস-পি জিজ্ঞাসা করলেন—কুইনির প্রতি দুর্বলতার স্বরূপটা কি? তার মানেটা কি? আমি কোণঠেসা আসামীর মতই বললাম—প্রেমও এক ধরনের স্নেহ। স্নেহও এক ধরনের প্রেম।
সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্তর যেন শতমুখ হয়ে সায় দিয়ে উঠল—আমার দেহেও তার ছোঁয়াচ লাগল, কথাটা বলেও ভাল লাগল সুলতা; মনে হল আশ্চর্য একটা সত্যের সাক্ষাৎ পেলাম, সন্ধান পেলাম। জানলাম আমার মধ্যে প্রবল দেহবাসনা এবং নারীহৃদয় কামনা রয়েছে এবং এই মেয়েটিকেই আমি দেহ দিয়ে চাই, মন দিয়ে চাই। একান্তভাবে আপনার করে চাই। আমার জমিদারসত্তা এবং আমার ব্যক্তিসত্তা দুই সত্তা সমান আগ্রহে অধীর হয়ে উঠেছিল তাকে পাবার জন্য।
আমি অনেক ভেবেছি, জাহাজে সারা বে অব বেঙ্গল, এ্যারেবিয়ান সী, মেডিটেরিয়ান অতিক্রম করবার সময় শুধু এই কথাই ভেবেছি; নিজেকে বিচার করেছি; বলতে পার নিজেকে চিরে চিরে সমস্ত কিছু ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখেছি এবং বুঝেছি।
জমিদারের বা ধনীর ছেলেদের একটা পাপ অভিপ্ৰায় থাকে—তারা তাদের উপর নির্ভরশীল বা তাদের দ্বারা যারা উপকৃত, অনুগৃহীত তাদের নিজেদের সম্পত্তি মনে করে; বিশেষ করে তাদের মেয়েদের উপর ভোগের অধিকার দাবী করে। আগের কালে দাসীদের দেহমনের অধিকার দাবী করত প্রভুরা।
আর একদিক দিয়ে মানুষের, সেটা সব মানুষেরই সুলতা, একটা ছেলেমানুষী রোমান্টিসিজম আছে—যে রোমান্টিসিজমের জন্ম হয় ছেলেবেলায় রাজপুত্র রাজকন্যা বা রাজপুত্র আর চাষীর মেয়ের প্রেমের গল্প শুনে। অনেক বাধা অনেক বিঘ্ন অতিক্রম করে মিলন হলেই মন ভরে ওঠে। এইটেকেই বাড়িয়ে নিয়ে গল্প বানাও দেখবে একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসত, কিন্তু তাদের বিয়ে হল না; সেই দুঃখ মেটাবার জন্য তারা কল্পনা করে এর ছেলের সঙ্গে ওর মেয়ের বিয়ে দেবে।
সুলতা, দেবেশ্বর রায়ের পৌত্র—দেবেশ্বর রায়ের প্রথম প্রিয়া—গোয়ান মেয়ে ভায়লেটের ছেলের দৌহিত্রী—কুইনিকে ভালবাসে তাকে সে চায় এই কথা সর্বসমক্ষে ব’লে আশ্চর্য তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এবং পেতেও তাকে চেয়েছিলাম।
আরও একটা সত্য ছিল। সে সত্য সর্বজনীন কিনা জানি না—তবে রায়বংশে এ সত্যটা স্বীকৃত। এবং এটা রাজবংশের একটা ধারা। আমার বাবা চন্দ্রিকাকে ভালবেসেছিলেন-মিশ্র সৌন্দর্যের জন্য। দেবেশ্বর রায় পিদ্রুজ আর অঞ্জনার সন্তান ভায়লেটকে ভালবেসেছিলেন। কুইনির মধ্যেও বোধ হয় আমি তারই আকর্ষণই অনুভব করেছিলাম। এটা বোধ হয় চিরন্তন কামনা মানুষের।
বিলেতে গিয়ে এ আকর্ষণ আমার বাড়ল সুলতা। এবং এই কুইনির আকর্ষণই আমাকে ওখানে শ্বেতাঙ্গিনী সমাজে নিজেকে হারিয়ে যেতে দিলে না। একটা ঘটনা ঘটল।
আমার ছবি কিছু নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ছবিগুলো নিয়ে একটা এগজিবিশন হয়েছিল। এই এগজিবিশনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কুইনির ছবিখানা। বিচিত্র ঘটনা সুলতা, যে দেখতে এল, সেই এসে থমকে দাঁড়াল কুইনির ছবির সামনে। অবাক হয়ে দেখলে। বললে—কী সুন্দর!
শুধু ছবি সুন্দর নয়, যার ছবি সেও কত সুন্দর কী সুন্দর! দুখানা ছবি ছিল কুইনির। একখানাতে কুইনির কোলে একটি শিশু দিয়ে এঁকেছিলাম Indian Madona’—ওদের চার্চের ছবি পুড়ে গিয়েছিল, ছবিখানা ওদের চার্চের জন্যই এঁকেছিলাম—কলকাতায় এসে এবং যে টাকাটা আমি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেই টাকার সঙ্গে ছবিখানাও দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু টাকা বা ছবি কিছুই নেয় নি কুইনি। আমি চিঠি লিখেছিলাম, তার উত্তরে সে লিখেছিল—উই আর আনএবেল টু এ্যাকসেপ্ট এনি হেল্প ফ্রম ইউ। থ্যাংকস্।
কুইনির আরও একখানা ছবি আমি এঁকেছিলাম—এ ছবিখানা সেই রক্তসন্ধ্যার আলো মুখে পড়া কুইনির ছবি। নাম দিয়েছিলাম ‘গোধূলি লগ্ন’।
পাশাপাশি টাঙানো ছিল ছবি দু’খানা। দর্শক খুব বেশী আসে নি, কিন্তু যারাই এসেছিল তারাই ওই ছবি দু’খানার সামনে দাঁড়াত, মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখত এবং প্রশ্ন করত—কত দাম?
প্রথম দিন চমকে উঠেছিলাম। দাম?
—হ্যাঁ, কত দাম? আমি কিনতে চাই। দাম তো লেখা নেই।
—ও ছবি দু’খানা বিক্রীর জন্য নয়।
—নয়! তাহলে তোমার বাকি ওই রাবিশগুলো কে কিনবে?
উত্তর কি দেব, চুপ করেই ছিলাম। উত্তর দিতে পারতাম—বলতে পারতাম, ছবি তুমি বোঝ না তাই বাকীগুলোকে রাবিশ বলছ। ওইগুলোই modern ছবি। কিন্তু তা পারি নি, তার কারণ লোকটির পরিচয় জানতাম, একজন বড় আর্ট ক্রিটিক। অন্য ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ছবি দু’খানার দিকে তাকিয়েছিলেন ভদ্রলোক, তারপর বলেছিলেন-দেয়ার ইজ লাইফ ইন দোজ টু; সো লিভিং!
আমি এরপর ছবিদুটোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম। সত্যিই এক এক সময় মনে হত—সত্যিকারের কুইনি। এখনি হয়তো কথা বলবে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। এগজিবিশন শেষ হল। সব ছবির মধ্যে ওই কুইনির ছবিরই প্রশংসা হল বেশী। তার মধ্যে “ Indian Madona” ছবিটাই বেশী পছন্দ করেছিল। আমি তাকিয়ে থাকতাম আর মধ্যে মধ্যে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতাম—আমার শিরায় শিরায় রক্ত ছুটত দূরত্ত আবেগে। আমি অনুভব করতাম ওই মেয়েটিকে আমি জীবনে চাই।
নারীকে জীবনে পুরুষ চায়, পুরুষ নারীকে চায়। এ চাওয়া দু’রকম। Man wants woman in life—যে woman-এর বিশেষ পরিচয় নেই; পরিচয় সে woman- তার নারীত্বই তার পরিচয়। এইটেই সাধারণ নিয়ম সুলতা। কিন্তু মানুষ এক আশ্চর্যভাবে বদলে নিয়েছে —সে চায়—একজন বিশেষ নারীকে। সেটা প্রথমে থাকে নেশা-পরে সেটা হয় ভালবাসা।
কুইনিকে মেদিনীপুরের বাড়ীতে মিসেস হাডসন আর হিলডার সঙ্গে দেখে প্রথম আমার নেশা জেগেছিল। শাড়ী পরে সে আশ্চর্য যৌবন-মোহময়ী হয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। বোধ হয় বলেছি কথাপ্রসঙ্গে; বলেছি, নারীকে নিয়ে মোহ সেই আমার প্রথম জাগল। তোমার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে যা জাগিয়ে তুলেছিলাম, ছোট একটি গাছকে বড় করে তুলে ফুল ফোটানোর মত ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম—তা সেদিন কুইনিকে দেখবামাত্র জেগে উঠেছিল; ফুল ফোটার কথায় বলব—পাতাহীন ভুঁইচাপার গেঁড়ে থেকে হঠাৎ যেন ডাঁটি বেরিয়েছিল কুঁড়ি নিয়ে। সেই কুঁড়িটি ফুটল বিলেতে ওই ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে।
হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নানা অসম্ভব কল্পনা করতাম। ওই কুইনিকে নিয়ে কল্পনা। ভাল লাগত। সারারাতই প্রায় জেগে থাকতাম।
কিছুদিনের মধ্যেই মদের মাত্রা বেড়ে গেল। এবং—। চুপ ক’রে গেল সুরেশ্বর। স্থির দৃষ্টিতে খোলা জানালার ওপারের দিকে তাকিয়ে বললে—সকল সত্যই বলতে বসেছি সুলতা, রায়বংশের কুড়ারাম রায় ভটচাজ থেকে শুরু করে আমার পিতামহ পর্যন্ত পিতৃ-পুরুষেরা ন্যায় অন্যায় যা করেছেন তা মুক্তকণ্ঠে বলেছি। অন্যায়গুলোই বড় করে তুলে ধরে বলেছি। বলবার কারণ আছে—কারণ পাপগুলো সব মানুষেই করে, এ পাপ মানুষের—কিন্তু তাঁরা পাপগুলো জমিদারীরই বলে ঘোষণা করে করেছেন। আমার বাবার কথা জান। তাই আর বললাম না। এবার আমার কথা বলি। আমার মধ্যে ওই কামনা-বাসনা ওই প্রকৃতি অথবা পাপ বল পাপ, ক্রিমিন্যাল ইনস্টিংক্ট বল তাই, অন্যায় বল অন্যায়, অমার্জনীয় সামাজিক অপরাধ বল তাই—আমার রক্তের মধ্যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। আমার পূর্বপুরুষেরা জমিদারীর দৌলতে সামুদ্রিক সরীসৃপের মত যে প্রবৃত্তিকে তাঁদের রক্তের মধ্যে লালন করেছিলেন, পুষ্ট করেছিলেন—যার বীজ মাছের ডিমের মত আমার রক্তে ছিল—তা ফাট্ল এবং হাঙরের মত হিংস্র স্বভাব নিয়ে সে বেড়ে উঠল।
সারজীবনই একরকম-একটা সাবধান বাণী আমার কানের কাছে বেজেছিল। আমার বাবার দৃষ্টান্ত আমাকে ভীত করে রেখেছিল—তাঁর কণ্ঠস্বর আমার কানের কাছে বাজত, —সুরোর যেন বিয়ে দিয়ো না। আমার দৃষ্টান্ত দেখলে। আমাদের বংশের বড় ভয় মেয়েদের থেকে। বংশগত ব্যাধি এটা।
মায়ের মুখ মনে পড়ত। যেন বিষে নীল হয়ে যাওয়া মুখ। যার জন্য ব্রজদার শেফালির বাড়ী গিয়ে ওই দেহব্যবসায়িনীদের দেখে আকৃষ্ট হয়েও দাতা সেজে আত্মরক্ষা করেছি। কীর্তিহাটে গিয়ে অত্যন্ত সতর্ক থেকেছি। তোমার সঙ্গে সম্বন্ধ ছিন্ন করেছি। সেই ভয় কাটতে লাগল সন্ধ্যার কনে-দেখা আলো-মাখা তরুণী কুইনির ছবিখানা দেখতে দেখতে। এগজিবিশনের সময় সেই যে ছবিটার মধ্যে নেশার সন্ধান দিয়ে গেল আমাকে সেই আর্ট- ক্রিটিক—সেই নেশা আমাকে পাগল করে দিলে। মদ খেতাম, আর ছবিখানার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এবং কল্পনা করতাম। যে কল্পনা করতাম তার মধ্যে প্রচণ্ড উন্মাদনা আছে, সে উন্মাদনা মহাভারতে নাগকন্যা উলূপীর জন্য অর্জুনের সাজে, ইতিহাসে পদ্মিনীর জন্য আলাউদ্দিন খিলজীর সাজে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে কোন দেশে কারুর পক্ষেই সহজে ঘটে না, এবং আমার মত যে মানুষ আধা-জমিদার বা জমিদার থেকে খারিজ তার পক্ষে তো সাজেই না। কিন্তু তবু মন মানল না। এবং তা থেকেই একদিন আমি যেন লালসায় কামনায় উন্মাদ হয়ে উঠলাম।
সুলতা—আমি নারী-দেহের জন্য লালায়িত হলাম। জীবনের অবরুদ্ধ ভোগের প্রবৃত্তি কুইনির ছবির ইশারাতেই যেন বোতল-খোলা দৈত্যের মত বেরিয়ে এল।
I wanted women in my life. তার পথে কোন বাধা ছিল না, সেই সুদূর শ্বেত দ্বীপে। টাকাও আমার হাতে ছিল প্রচুর। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। টাকাটা যুদ্ধের আগে খুব কম ছিল না। মূল্য তখন তার অনেক ছিল। সেই টাকাটা দুই হাতে মুঠো ভরে নিয়ে নেমে পড়লাম লন্ডনের নৈশজীবনে।
বন্ধু মিলতে দেরি হয় নি। ভারতীয় বন্ধুই মিলেছিল। তারা ওদেশেই কাজ করে, পড়ে; জীবনের স্লেটে তাদের হাজার হিজিবিজি, কিন্তু সে তারা গ্রাহ্য করে না। তারাও আমার টাকা-পয়সার সাচ্ছল্য দেখে প্রসন্ন উল্লাসেই এগিয়ে এসেছিল। মাস কয়েক প্রায় পাগলের মত ছুটেছি, ছুটতে চেষ্টা করেছি। তারপর হঠাৎ একদিন আমার বংশগত অভিশাপ আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
সকালবেলা ঘরে বসে আছি; ওই কুইনির ছবির দিকে তাকিয়েই বসে সিগারেটের রিঙ ছাড়ছি আর ভাবছি; ভাবছি, কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছি না, তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছে না। বাড়ছে। তার থেকেও কিছু বেশী। কুইনির জন্যই জীবন-তৃষ্ণা বাড়ছে। সকালবেলা যখন রাত্রির অন্ধকারের ঘোর থাকে না, তখন তাকে মনে পড়ে, ঠাকুমা উমাদেবীকে মনে পড়ে, মেজঠাকুমা মেজদিকে মনে পড়ে, অর্চনাকে মনে পড়ে। বুকের মধ্যে জ্বালা ধরে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আপনার অজ্ঞাতসারে–আঃ—বলে চিৎকার করে উঠি।
আয়নায় নিজের ছবি দেখে ভয় পাই। চোখের কোলে কালি পড়েছে, গোল একটা কালো বেষ্টনীর মধ্যে আমার এই বড় চোখ দুটো যেন ঘোলাটে রঙ ধরেছে; মনে হয়, সোনার গিল্টী-করা প্রদীপটার গিল্টী উঠে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে লোহা; ঘি নেই, সরষের তেলও নেই, জ্বলছে লালচে কেরোসিনে; লালচে আলোর শিখার মাথায় ধোঁয়া উঠছে রাশি রাশি।
নারীকে তো ভয় নয়, রায়বংশে ভয় বরাবরই নিজেকে। ধর্ম সাধনা আর ভূমির আধিপত্য করতে গিয়ে, নরনারী দেহ-মিলনের মধ্য দিয়ে প্রেমচেতনাটুকুকে বিসর্জন দিয়েছেন, নয়তো প্রকৃতি-শক্তিকে আজ্ঞাবাহিনী ক্রীতদাসীর মত আয়ত্ত করবার জন্য শ্মশানে যে যজ্ঞ করেছিলেন, তাতেই আহুতি দিয়েছেন। শ্যামাকান্ত মহাপ্রকৃতিকে ভোগ্যা নারীর মত আয়ত্ত করতে চেয়েছিলেন, বীরাচারের সাধনায়। বীরাচারে সিদ্ধ হয়ে তিনি খেলবেন আর শক্তি তাকে খেলার উপকরণ যোগাবে অথবা নিজেই তার উপকরণ হবে। তিনি তাকে আদিম পুরুষের নারীকে বেঁধে রাখার মত বেঁধে রেখে দেবেন। নারীকে বেঁধে প্রহার করবেন, তবু তাকে পেলাম না বলে আক্ষেপ করবেন। তারপর সোমেশ্বর থেকে দেবেশ্বর পর্যন্ত, তাই বা কেন, যোগেশ্বর রায় পর্যন্ত এক দশা। তাঁরা ভূমিকে ভোগ করলেন নারীর মত, আর নারীকে ভোগ করলেন ভূমির মত। ভূমিকে কখনও সেবা করলেন না, পূজা করলেন না, আদায় করলেন শুধু কর; আর নারীকে কখনও প্রেম দিলেন না, তার কাছে চাইলেন শুধু সন্তান। ভূমির গণ্ডীর পরিমাপ যত বৃহৎই হোক, কখনও হলেন না তৃপ্ত, কখনও মিটল না ক্ষুধা, নারীর দেহ ভোগ ক’রে কখনও সুখের শেষ পেলেন না, বেছে বেছে রূপসী নারী এনে অন্তঃপুর সাজিয়ে কখনও মিটল না তৃষ্ণা। একখানা এক একর দেড় একর জমির ধানে যে সব মানুষের সারা বছরের অন্ন জোটে, একটি নারীর প্রেমে যে সব মানুষের তৃষ্ণা মেটে, সে মানুষের দল থেকে পৃথক আমি, স্বতন্ত্র আমি। তারাই সভ্য মানুষ, তারাই দেবত্বের অধিকারী। রায়বংশ ধর্মকে আশ্রয় করে বর্বরতায় ফিরে গেছে, আদিম অন্ধকারে ফিরে গেছে, সম্পদকে আশ্রয় করেও তাই, সেই আদিম অরণ্যযুগে ফিরে গেছে। প্রিয়ার প্রতি যার প্রেম নেই, পৃথিবীর জন্যেই বা তার প্রেম কোথায়?
সে সময় আমি ডায়রী রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। রত্নেশ্বর রায়ের মত নয়; বীরেশ্বর রায়ের মত। জীবনের স্মরণীয় দিন ও ঘটনা। মেমোরেবল ডে অ্যান্ড ইনসিডেন্টস।
প্রথম দিন যেদিন জীবনে প্রথম একটি কন্যা শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে সারারাত তার দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে রইলাম, কিছুতেই তাকে স্পর্শ করতে পারলাম না; কেন পারলাম না, সে সম্পর্কে লেখা আছে-”মদের নেশার মধ্যে নৈশ আবরণী পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কেমন হয়ে গেলাম। বিচিত্রভাবে তার মধ্যে অনেককে দেখলাম। দেখলাম না শুধু তাকেই। মেয়েটি আমাকে গালাগাল দিলে, আমার রাগ হয়ে গেল, আমি চিৎকার করে উঠলাম—
Shut up—I say you shut up.
আমার চীৎকারে সে চমকে গিছল। ভয় পেয়েছিল। সারারাত্রির পর সে ঘুম ভেঙে উঠে আমায় তার ঘরের দরজা খুলে দিলে।”
আবার যেদিন সকল ভয়কে অতিক্রম করেছি, সেদিনও আমি চীৎকার করেছি। এবং সেই রাত্রেই চলে আসতে চেয়েছি। সম্ভব হয় নি। সারারাত্রি বসে কাটিয়েছি, প্রথম দিনের মতই।
সব লিখে রেখেছি। সেদিনও সকালে উঠে ডায়রী লেখা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে কুইনির ছবি দেখছি, আর ওই সব কথাই ভাবছি, তার সঙ্গে মধ্যে মধ্যে কুইনি যেন ছবির মধ্যে সজীব হয়ে উঠছে, আমাকে ডাকছে। অথচ তার শেষ কথা মনে পড়ছে, আমি ঘৃণা করি আপনাদের। আপনাদের গোটা রায়বাড়ীকে ঘৃণা করি।
এমন সময় হোটেলের পরিচারক একখানা কার্ড নিয়ে আমাকে দিতে এল, একজন কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
দেখলাম—প্রিন্স হারা রে, প্রিন্স অব কীটিহাটা। প্রিন্স অ্যান্ড এ স্পিরিচুয়াল ম্যান।
মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে উঠল, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল, একটা অসহনীয় উদ্বেগ বুকের ভিতরে জমে উঠল পুঞ্জীভূত হয়ে।
প্রিন্স অব কীর্তিহাট! প্রিন্স অব কীর্তিহাট! কে? কে?
প্রিন্স অব কীর্তিহাট নিজেই পরিচয় দিলেন, তাঁর ফাদার ছিলেন রাজা আর রে, রামেশ্বর রে। আমাদের রাজা উপাধি বংশগত। নো ওয়ান ক্যান ডিনাই আওয়ার রাজা টাইটেল। ইউ সি. কীর্তিহাট ইজ ইন দি প্রভিন্স অব বেঙ্গল। উই আর কিংস এ্যান্ড ব্রাহমিনস বোথ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর মুখের দিকে। মিল খুঁজছিলাম চেহারায়, রঙ-এ, কাঠামোয়, নাকে-মুখে-চোখে। পাচ্ছিলাম সে মিল। তিনি বলেই যাচ্ছিলেন, আমরা বাংলাদেশের প্রাচীনতম অভিজাত বংশ।
You see since the time of Raja Bailal Sen, আমার পূর্বপুরুষ রাজার Chief Minister । You see, he was and we also are the worshipper of Goddess Shakti. We are তান্ত্রিকস। বল্লাল সেনের পর লক্ষ্মণ সেন রাজা হলেন। He was a staunch Baishnav; আমার পূর্বপুরুষ বার বার রাজাকে বারণ করেছিলেন, এইভাবে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। প্রশ্রয় দিয়ো না।
But he turned a deaf ear to him, never cared to follow his advice; and you—you certainly know what happened; only seventeen —সতেরোজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে বাংলা দেশ জয় করেছিলেন বক্তিয়ার খিলজী!
অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন প্রিন্স হারা রে; রত্নেশ্বর রায়ের তৃতীয় পুত্র রামেশ্বর রায়ের এক পুত্র। কোন্ পুত্র তা জানি না। রামেশ্বর রায় সুকৌশলে বিষয় বিক্রী করে বিলেতে এসেছিলেন, ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে গিয়ে ব্রাহ্ম হয়ে বিয়ে করেছিলেন এক ব্রাহ্ম মেয়েকে! তাঁরই এক ছেলে বিলেতে এসে বাস করছেন। এসেছিলেন আই-সি-এস পড়তে।
হারা রে বললেন—
I was a very brilliant student. My subject of interest was Sanskrit-great poet Kalidasa was my first attraction, then the greatest of all poems-Veda- then Upanisada.-I learnt two things from this Upanisada, the greatest of all poetries of the world—
শোভাবা মর্ত্যস্য যদন্তকৈত
সর্বেন্দ্রিয়াণাং জরয়স্তি তেজঃ।
অপি সর্বং জীবিতমল্লমেব,
তব্বৈ বাহাস্তব নৃত্যগীতে।।
ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যো
লক্ষ্যামহে বিত্তমদ্রাক্ষ্ম চেৎ ত্বা।
জীবিষ্যামো যাবদীশিষ্যসি ত্বং,
বরস্তু বরণীয়ঃ স এব।
আপনি একজন বড় আর্টিস্ট and আমি শুনলাম—A great learned man also also a very rich mana Brahmin also, আপনি নিশ্চয় জানেন—I am sure. নচিকেতা এই কথাগুলি বলেছিল যমকে। And you certainly remember-what মৈত্রেয়ী told to her husband গৌতম, যেনাহং নামৃতস্যাং তেনাহং কিম্ কুর্যাম।”
I went mad, Mr. Ray-I went mad.-and gave up the idea of appearing at the I. C. S. examination, and মিস্টার রে- আমি আমার আত্মাকে দেখতে পেলাম—Yes, I could see-I could feel এবং সব সংশয় ছিন্ন হয়ে গেল আমার—
ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে
সর্ব সংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কৰ্মানি
তস্মিন্ দৃষ্টি পরাবরে।
হিরণ্ময়ে পরে কোশে বিরজিৎ
ব্ৰহ্ম নিষ্কলম্।
তচ্ছুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ
যদাত্মবিদো বিদুঃ।।
ন তত্র সুর্যোভাতি ন চন্দ্র তারকং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।
ব্রহ্মৈ বেদমমৃতং পুরস্তাদ্ব্রহ্ম
পশ্চাদব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ।
অধশ্চোর্ধ্বঞ্চ প্রসৃতং ব্রহ্মৈবেদং
বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্।।
অনর্গল বলে গেলেন হারা রে। সুন্দর কণ্ঠ, প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ, সাদা দাড়ি-গোঁফে হাত বুলোচ্ছিলেন, দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল একটি আনন্দময় স্বপ্ন। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক এই সময়েই এসেছিল আমার একজন রাত্রির সহচর। বিনা কার্ডেই—May I come in!—বলে দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকে হারা রে-কে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে তীব্রদৃষ্টিতে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন—So you have come—অ্যাঁ!
প্রিন্স হারা রে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোরের মত সঙ্কুচিত এবং ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছিলেন। সুরেশ্বর বললে —হরি, হরেশ্বর রায়, রামেশ্বর রায় আমার কনিষ্ঠ পিতামহ, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র; তাঁর সম্পর্কে বিশেষ পরিচয় আমি পাই নি কীর্তিহাটের দপ্তরের কাগজের মধ্যে। এম-এ. বি-এল পাস করে এস্টেটের আইন বিভাগের দেখাশুনো করতেন। রায়বাহাদুর কিন্তু তাঁর মতের চেয়ে তাঁর পাটোয়ারী মামলায় মুহুরীর মতের বেশী দাম দিতেন। তবে ভালবাসতেন। ভদ্রলোক ছিলেন রামেশ্বর রায়। অনুকরণ করতেন বড়দাদার কিন্তু সে ‘মেটাল’ ছিল না তাঁর মধ্যে, সুতরাং সে ধার বা সে ঝকমকানি পাবেন কোত্থেকে? বড়দাদার অনুকরণে তিনি ছিলেন বিলাসী—ভদ্রলোক ইংরিজী এবং ইংরেজের প্রেমমুগ্ধ। তিনিই প্রথম বিলেত এসেছিলেন এবং ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে গিয়ে এলাহাবাদে বসেছিলেন। প্রথমা স্ত্রী যখন মারা গেছেন, একটি কন্যা ছিল সে স্ত্রীর গর্ভজাত, তার বিয়ে দেওয়ার অজুহাতে দেবোত্তরের অধীনে ব্যক্তিগত পত্তনী-দরপত্তনী এবং জোতজমাগুলোর একের-তিন অংশ তিনি বিক্রী করে দিয়ে মোটা টাকা নিয়ে গিয়ে বসেছিলেন এলাহাবাদে। এলাহাবাদে তাঁর প্র্যাকটিস জমে নি কিন্তু জীবনে স্বাধীন প্রেমের ক্ষেত্র এবং সুযোগ পেয়েছিলেন। একটি ব্রাহ্ম মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তাকে বিয়ে করলে সম্পত্তি নিয়ে গোল বাধবে এবং সে বাধাবেন মেজদা অর্থাৎ শিবেশ্বর রায়, তা তিনি জানতেন। তাই বিক্রী করে দিয়েছিলেন বড়ভাইকে, সব বলেই বিক্রী করেছিলেন। মিস্টার আর রে’র এই পুত্রটি সেই দ্বিতীয়া পত্নীর গর্ভজাত দ্বিতীয় পুত্র হারা রে। ছাত্র তিনি ভাল ছিলেন, সংস্কৃতে, ইংরিজীতে ডবল অনার্স নিয়ে বি-এ পাস করেছিলেন। বাপ বিলেত পাঠিয়েছিলেন আই-সি-এস পরীক্ষা দেবার জন্য। কিন্তু সে পরীক্ষা তাঁর আর কখনও দেওয়া হয় নি। এখানকার কাগজে ভারতবর্ষের গৌরব প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। ইংরিজী ভাল লিখতেন, তাঁর লেখার তখন দাম হয়েছিল এবং লেখার জন্য হারা রে-র নামও হয়েছিল, দু-চারটে ছোটখাটো আসরে বক্তৃতাও দিতেন তখন। হাইড পার্কেও টুল কাঁধে করে ঘুরেছেন।
তাঁর কেরিয়ারে ভবিষ্যৎ ছিল। ও-দেশে থাকলেও ছিল, এ-দেশে এলে তো কথাই ছিল না; এ-দেশে নেতৃত্বের সব থেকে বড় কোয়ালিফিকেশন হল E. R. মানে ইংল্যান্ড রিটার্নড। এদের জন্যে চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষা করতে হয় না—নতুন চেয়ার তোলা থাকে—এলেই নামিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রায়বংশের ছেলে হারা রে। হঠাৎ ধরা পড়ে গেলেন adultery-র দায়ে।
রায়বংশের ছেলে হারা রে, প্রথম বিয়ে করেছিলেন এক মহৎকুলের কন্যাকে। কোন এক স্যার টাইটেলধারীর আত্মীয়াকে, খাস বিলিতী স্যার এবং ভারতবর্ষের কোন এক প্রভিন্সের এক্স-গভর্নর। তাঁর এই আত্মীয়াটি তাঁর গভর্নরগিরির সময় ভারতবর্ষে এসে দেখে গেছেন এ-দেশ। দেখে গেছেন এ-দেশের যোগী-সন্ন্যাসী, ফকির, ফরচুনটেলার, পুরনো মন্দির, তীর্থস্থল, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, গোয়ালিয়র ফোর্ট, আগ্রা ফোর্ট থেকে কাশীতে সারনাথ। এবং তার সঙ্গে দেখে গেছেন ইন্ডিয়ান প্রিন্সদের বাড়ীঘর, বিরাট মহল, যার মধ্যে তাঁরা বাস করেন। আর মনে মনে প্রেমে পড়ে গেছেন তরুণ গৌতম বুদ্ধার সঙ্গে, যিনি সদ্যপ্রসূত পুত্র রাহুল এবং সুন্দরী গোপাকে ফেলে নির্বাণ খুঁজতে গিয়েছিলেন।
রায়বাড়ীর রূপবান এবং বিদ্বান বংশধরটির কাছে ‘ন বিত্তেন তর্পণীয় মনুষ্যা’ এবং ‘যেনাহং নামৃতস্যাম তেনাহং কিম্কুর্য্যাম্’ এই পরমতত্ত্ব শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আগুনের শিখায় আকৃষ্ট পতঙ্গের মত। বিলেতে তখনও লোকে স্বামী বিবেকানন্দকে ভোলে নি। মেয়েটি সব থেকে বেশী মুগ্ধ হয়ে গেল, যখন সে এই প্রিন্স হারা-রে-র কাছে শুনলে যে, তিনি তাঁর রাজা উত্তরাধিকার ত্যাগ করে শুধু ইন্ডিয়ার এনসেন্ট কালচারের স্বরূপ এবং মহিমা প্রচারের জন্যই এ-দেশে এসেছেন এবং সারাজীবন তাই করে যাবেন, তাঁর জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন, তরুণী কুমারীটি এই রাজপুত্রটির মধ্যে গৌতম বুদ্ধার নবজন্মকে প্রত্যক্ষ করেছিল। মেয়েটির কিছু পৈতৃক ধন ছিল, সবকিছু নিয়েই তিনিই প্রথম শিষ্যা, সচিব এবং সখিরূপে তাঁকে বরণ করে ধন্য হয়েছিলেন।
সালটা প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পর। যুদ্ধের সময় তিনি ইংল্যান্ডেই ছিলেন। এবং কাগজে ব্রিটেনদের জন্য কালীতত্ত্ব বিতরণ করে লিখতেন—এই সর্বশক্তিময়ী মাতৃশক্তি—Mother the all powerful —ব্যাখ্যা করে লিখতেন—তিনিই ক্রুদ্ধ হয়ে মানুষের অন্তরলোকে ক্রোধকে সঞ্চারিত করেন এবং তখনই ওয়ার বাধে এই পৃথিবীতে।
She is peace, She is anger, She is fire, She is water, She is heat, She is cold, She is the cause of everything-এর ফলে তাঁর খ্যাতি বেড়েছিল যথেষ্ট, শিষ্য-শিষ্যার সংখ্যাও বাড়ছিল সঙ্গে সঙ্গে। হঠাৎ একদা অঘটন ঘটে গেল। ১৯১৯ সালে আমিস্টিসের পর। হঠাৎ তাঁর স্ত্রীর পৈতৃক বাড়ীতে এসে উঠল অভিনেত্রী। সামান্য কদরের অভিনেত্রী কিন্তু অসামান্য প্রখর তার রসনা, কণ্ঠস্বরও তেমনি উচ্চ এবং কর্কশ।
সে দাবী করলে–রে তার স্বামী এবং তার সন্তানকে সে গর্ভে বহন করে বেড়াচ্ছে আর রে তাকে পরিত্যাগ করে এই ব্যভিচারিণী মহিলার গৃহে প্রমোদ বাসর যাপন করছেন।
বৃত্তান্ত তার অনেক সুলতা। মামলা হল, তাতে তিনি স্টেটমেন্ট করলেন। বিচিত্র স্টেটমেন্ট। বললেন—আমি ইন্ডিয়ান তান্ত্রিক যোগী। আমি মাদার দি অল পাওয়ারফুলের উপাসক, আমার পক্ষে সংসার কোন কিছুতে বাধা নেই। There is no bar. I deny all bars, তান্ত্রিক-যোগী আমি, আমি ওই অ্যাকট্রেসটির মধ্যে এমন এক উয়োম্যানকে দেখতে পেয়েছিলাম, সে সাধনার সময় আমার পাশে বসে থাকলে Mother the all powerful নিশ্চয় দেখা দেবেন। So I accepted her as my wife-আমি তাকে ইন্ডিয়ান তান্ত্রিক-রীতি অনুসারে বিবাহ করেছি।
জেল হয়ে গেল হারা রে-র। প্রথম স্ত্রী ডিভোর্সের মকর্দমা করে ডিভোর্স পেলেন। কাগজে কেলেঙ্কারি হতে তিনিই দেন নি। না হলে বোধ হয় খবরটা আগেই জানা হয়ে থাকত।
তারপর হারা রে জেল থেকে বেরিয়ে আবার একবার সেন্ট সাজবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতে খুব সুবিধে হয় নি। কিন্তু সুবিধে-অসুবিধেতে হারা রে’র কিছু যায় আসে নি। শিক্ষিত লোক, পণ্ডিত লোকও বলা যায়, তিনি বিচিত্র জীবন যাপন শুরু করলেন। দাড়ি-গোঁফ-চুল রেখে সে এক ভারতীয় তান্ত্রিক সাজলেন। এবং চিটিং-এর জন্য চুরির দায়ে আরও দু’বার জেল খেটেছেন। তা খাটুন, তবুও এখনও তাঁর লেখা কাগজে বের হয়। ভারতবর্ষের ধর্মের উপর তাঁর রচনার আদর করে ওখানকার কাগজওলারা, বিশেষ করে ১৯২১ সালের পর গান্ধীজীর ‘অহিংসা’র বিরুদ্ধে তাঁর কতকগুলো রচনার খুবই সমাদর হয়েছিল। লিখেছিলেন নাকি
This non-violence is Sudra cult in India. This is for those who are weak- who cannot understand গীতা অর চণ্ডী অর ‘ন জায়তে ন প্রিয়তে বা কদাচিৎ’—যাঁর বাণী, যিনি কুরুক্ষেত্রে এত রক্তপাত ঘটিয়েছেন, তাঁর নামে নন-ভায়লেন্স অহিংসা এর থেকে হাস্যকর কিছু হয় না। এ নেহাতই কাওয়ার্ডিস অথবা ডীপ পলিটিক্স বা কেউ বলতে পারে ‘ভেরী ক্লেভার কামোফ্লেজ’।
এসব পরিচয় আমার ওই রাত্রি সহচর বন্ধুটি মিস্টার হারা রায়ের সামনেই দিয়ে গেল। হারা রায় স্থির হয়ে শুনলেন। প্রথম যে একটা অপ্রতিভ শঙ্কিত ভাব তাঁর মুখের মধ্যে ফুটে উঠেছিল, ক্রমশঃ সেটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। প্রসন্নমুখে দাড়িতে হাত বুলিয়ে হারা রায় বললেন—জেন্টেলম্যান, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আপনাকে বলছি—আপনি একটি ‘বদ্ধজীব’ আপনার সঙ্গে আর কোন বর্বর জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ যাদের সঙ্গে জন্তু জানোয়ারের মিল বেশী, তাদের কোন প্রভেদ নেই। আপনি তান্ত্রিক স্পিরিচুয়ালিজিম কিছুই বোঝেন না। হ্যাঁ মহাশয়, আপনি যা ঘটনার বিবরণ দিলেন তা সত্য অর্থাৎ তা ঘটেছে। কিন্তু ঘটেছে বলেই তা সত্য এমন কথা আমি স্বীকার করি না। বিচারক আমার আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বুঝতে পারে নি, সেই জন্য সে জেল দিয়েছে। ইংরেজ বিচারক আজ ভারতবর্ষে সমস্ত পলিটিক্যাল লীডারসকে জেলে দিচ্ছে না? কিন্তু তাই বলে কি তারা গিল্টী? আর দে ক্রিমিন্যাল? বিচার সহজ নয় মহাশয়। দিগ্বিজয়ী আলেকজেন্দারকে যে প্রশ্ন করেছিল থ্রেসিয়ান রবার তার উত্তর আজও কেউ দিতে পারে নি। গো এ্যান্ড আস্ক কাইজার উইলহেল্ম দি সেকেন্ড-নাউ লিভিং ইন হলান্ড, আস্ক হিম-আর ইউ গিল্টী স্যার? অ্যান্ড ইউ উইল গেট দি আনসার। তিনি নিশ্চয় বলবেন—যুদ্ধে আমি পরাজিত হয়েছি বলেই হয়তো আমাকে দোষী বলতে পার কিন্তু যুদ্ধে আমি জয়ী হলে এ কথার উত্তর কি হত চিন্তা করে দেখ! হ্যাঁ, আমি যখন দিস মিস্টার রে কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি, তখন নিশ্চয় আপনি তাঁর সহচর বা পার্শ্বচর হিসেবে যা বলছেন বলতে পেরেছেন। অন্যথায় নিশ্চয়ই এ কথা বলতে পারতেন না! পারতেন? অল রাইট, আই, ফরগিভ ইউ জেন্টলম্যান, স্মল ফ্রাইজ ইউ আর দোষ তোমাদের দেব না। ইট ইজ নট ইজি টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি অর দি গ্রেটনেস অব মাই মিশন। ইয়োর গান্ধী কুড নট আন্ডারস্ট্যান্ড মি। সে আমাকে লিখেছিল—ভারতবর্ষে ফিরে এস। বাট—এখানে ইন্ডিয়ার ফিলসফি, রিলিজিয়নের গ্রেটনেস না বুঝলে দেশে হাজার মুভমেন্টেও কিছু হবে না। অলরাইট গুড বাঈ!
দীর্ঘ একটি বক্তৃতা দিয়ে তিনি টুপিটি তুলে নিয়ে লম্বা রুক্ষ কাঁচা-পাকা চুলের উপর বসিয়ে পিছন ফিরলেন। মনে মনে সহস্র লজ্জা, লক্ষ বেদনা আমাকে যে কী করে দিয়েছিল, তা বলতে পারব না। কখনও মনে হচ্ছিল—এই মুহূর্তে আমি আত্মহত্যা করি। নইলে হয়তো কখন কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে প্রকাশ করে ফেলব যে, ওই লোকটি আমার পিতৃব্য—কীর্তিহাটের রায়বংশের রামেশ্বর রায়ের পুত্র। তবুও আত্মসম্বরণ করতে পারলাম না। বললাম-ওয়েট প্লিজ এ মিনিট অর
—মি? ইউ আস্ক মি টু ওয়েট?
—ইয়েস স্যার।
—হোয়াট ফর? ইউ হ্যাভ গট সাম মোর স্ট্রং ওয়ার্ডস ফর মি–
—না। কোন কঠিন কথায় বোধ হয় আপনাকে আঘাত বা লজ্জা দেওয়া যায় না।
হেসে হারা রায় বললেন—দ্যাটস্ এ কম্প্লিমেন্ট। থ্যাঙ্ক য়ু।
—এই সামান্য কিছু সাহায্য আপনি নিয়ে যান। দশ পাউন্ডের নোট বের করে আমি তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে নোট ক’খানা কেড়ে নিয়ে বললেন—অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। অনেক ধন্যবাদ। টাকার আমার প্রয়োজন ছিল। চলে যেতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে বললেন—কয়েক মিনিট তোমার সঙ্গে নিরালায় কথা বলতে পাইনে রয়!
ভাবলাম, হয়তো এবার কোন দুর্বল মুহূর্ত এসেছে এবং সেই দুর্লভ দুর্বল মুহূর্তে সে অনুতাপ প্রকাশ করবে বা আমার কাছে সজল চোখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, হয়তো বা আরও কিছু টাকাও চাইতে পারে। আমার কাছে এমন একটি মুহূর্ত যত ভয়ের তত প্রলোভনের। ভয়, -হয়তো প্রকাশ করে ফেলব তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। প্রলোভন-সে-ও ওইটেই, হ্যাঁ, ওইটেই, কেবলমাত্র তার উল্টো পিঠটা।—আমি আমার নৈশ সহচরের দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল—ওকে প্রশ্রয় দেবেন না মিস্টার রয়। ডোন্ট। ও ভয়ানক লোক, নির্লজ্জ; ধর্মাধর্ম ন্যায়-নীতিজ্ঞানবর্জিত একটি ধুরন্ধর শয়তান।—
আমি বাধা দিয়ে বললাম—প্লিজ, প্লিজ। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য। একটু বিরক্তিভরেই বলেছিলাম। কারণ, ওই বন্ধুটিও তো হারা রে থেকে উঁচুদরের মানুষ ছিল না। রাত্রির সহচর। রাত্রির লন্ডনের মোহে তারা লন্ডনে থেকে গেছে; উপার্জন করে, সামান্যই করে। রাত্রির লন্ডনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে দিতেই চেয়েছিলাম। কীর্তিহাটের জমিদারীর মোহ কেটে গিয়েছে। রায়বংশের মোহও কেটে গেছে। এখানে এসেছিলাম টাকা নিয়ে এই জন্যেই। রক্তের মধ্যে থেকে যেন নির্দেশ পাচ্ছিলাম। তাই এই লোকটির সন্ধান পেয়ে তাকে ডেকে নিয়েছিলাম। টাকা পেতো সে আমার কাছে। সুতরাং তার উপর বিরক্ত হবার আমার অধিকার ছিল।
লোকটিও সরে গিয়েছিল। আমার কাছে প্রত্যাশা তার ফুরোয় নি তখনও। লোকটি চলে গেলে আমি হারা রে-কে প্রশ্ন করেছিলাম –বলুন কি বলবেন?
—ইয়ং ম্যান, ইয়ং ব্লাড তোমার—হট ব্লাড। আমি শুনেছি, তুমি নারী ক্ষুধাতুর!
আমার মাথার ভিতরটা ঝিম ঝিম করে উঠল। আমার খুড়ো, আমার বাবার নিজের খুড়তুতো-ভাই জিজ্ঞাসা করছেন। উনি অবশ্য জানেন না, কিন্তু আমি তো জানি। কিন্তু কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না।
—লজ্জা করছ? নো-নো-নো! লজ্জার কিছু নেই। নাথিং। তুমি জান না, তুমি বোঝ না; এটা অবশ্য দুর্ভাগ্য তোমার—ইন্ডিয়ান এবং বেঙ্গলী হয়ে তুমি এটা বোঝ না। ফেমাস তন্ত্র কাল্ট অব বেঙ্গল।
হঠাৎ থেমে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি জাতে কি বল তো? বাই কাস্ট—? ব্রাহমিন অর বৈদ্যা অর কায়স্থ অর এ শূদ্রা? হোয়াট?
বললাম—ব্রাহমিন।
—ব্রাহমিন? শাক্তা অর এ বৈষ্ণবা?
—কেন জিজ্ঞাসা করছ?
—বুঝেছি ওসব মানো না। দ্যাটস্ অলরাইট। ঠিক আছে। মানলে যে-কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তা বুঝতে সুবিধা হত। ভাল, সে-কথা বলব না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করব, সত্যিই তুমি হাংরী? দেখ, আমি তোমার ক্ষুধা মেটাতে কিছু সাহায্য করতে পারি। আমার অনেক শিষ্যা আছে। তারা আমার কাছে এই কারণেই আসে। আমি তাদের কবচ-মাদুলী-গোছের কিছু দিয়ে থাকি। তুমি আমার কাছে নিতে পার। রয়, মেনি উইমেন আমার লাইফে এসেছে। আমার কোন লজ্জা নেই। তুমি জানলে বুঝতে পৃথিবীতে ম্যান এ্যান্ড উয়োম্যান রিলেশনশিপ ছাড়া কিছু নেই। পুরুষ এ্যান্ড প্রকৃতি। নাথিং এলস্। ইফ ইউ লাইক, আই ক্যান হেল্প ইউ। থ্রো দ্যাট ননসেন্স ইয়ং ম্যান আউট।
আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আমার বিস্মিত দৃষ্টি দেখেই বোধ হয় তিনি বললেন—খুব আশ্চর্য মনে হচ্ছে রয়? কিন্তু আশ্চর্য আদৌ নয়। তোমাদের মনকে ইংরেজরা ক্রীশ্চানিটির একটা মরালিটি শিখিয়েছে, যে-মরালিটি তোমরা আজকের এডুকেশনে পাও, যেটা ব্রাহ্ম সোসাইটি প্রচার করেছে এককালে, তার জন্যেই এমন মনে হচ্ছে। নাহলে এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই।
This is the only truth of life.
এবার আমি বললাম—এসব ফিলসফি-স্পিরিচুয়ালিজম-এর দক্ষিণা তো আমাদের দেশ অনুযায়ী যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য, তার বেশী নয়। কিন্তু যে সাহায্য করতে চাচ্ছেন আমাকে, তার দক্ষিণা ওই যৎকিঞ্চিৎ হলে চলবে, না বেশী দিতে হবে?
—অবশ্যই বেশী দিতে হবে। আপনি জানেন, আমি বলেছি আপনাকে—আমি ভিক্ষে চাইতে এলেও আমি রাজার ছেলে। ব্লু ব্লাড আছে আমার মধ্যে। আমি সন্ন্যাসী হলেও আমি তাই। এ প্রিন্স। অল্পে আমার হাত ভরে না। আমি তোমাকে সার্ভিস দেব —আমার রেমুনারেশন ওই লোফার রাত্রি-সহচরটার সমান নিশ্চয় হবে না। তাছাড়া মিস্টার রয়, তোমাকে ফ্রাঙ্কলি বলি-আমার অনেক দেনা। অনেক। আমার নাক পর্যন্ত ডুবে গেছে। অহঙ্কারটাকেই বড় করছি না-তোমার করুণার কাছেও আবেদন জানাচ্ছি।
আমি নির্বাক হয়ে রইলাম সুলতা। কোন উত্তর পেলাম না। দেনাতে ডুবে গেছেন হারা রে। শুধু হারা রে নয়, কীর্তিহাটের রায়বংশের সবাই দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে দিন-রাত্রি পরিত্রাহি ডাক ছাড়ছে বলে মনে হল। এ দেনা শোধ করবার কি কারুর সাধ্যি আছে?
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হারা রে বললেন—আচ্ছা, তুমি ভেবে দেখ রয়। আমি আবার আসব তোমার কাছে।
বলে চলে গেলেন।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমার মনে পড়ছে সুলতা, স্পষ্ট মনে পড়ছে সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে কোথাও বুঝি আমার বা রায়বংশের কোন সন্তানের সুস্থ হয়ে থাকবার অধিকার নেই।
এই মুহূর্তে এসে ঢুকেছিল আমার সেই নৈশ অনুচরটি। তার নাম মিস্টার ঘোষ-চৌধুরী। স্মার্ট ইয়ং ম্যান, ডেয়ার-ডেভিল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললে-রয়—কি হল? মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়ে গেছে তো!
আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, উত্তর দিতে পারলাম না। সে হেসে বললে—সম্ভবতঃ তুমি এবার আমাকে চলে যেতে বলবে। যাব আমি—আই অ্যাম এ স্পোর্ট; আমি তোমাকে ব্ল্যাক-মেল করব না। আমার পাওনাটা শুধু পেলেই হল। তবে অ্যাজ এ ফ্রেন্ড অর কমরেড অর গাইড যাই বল, সেই হিসেবেই বলি–ডোন্ট ট্রাস্ট দ্যাট ম্যান—ও একটা পাইথন, লেজে জড়িয়ে পাক দিয়ে তোমার হাড়গোড় ভেঙে মাংসের দলা পাকিয়ে ধীরে ধীরে তোমাকে গিলবে।
আমি তাকে বলেছিলাম—ঘোষ-চৌধুরী, তুমি হুইস্কির জন্যে অর্ডার কর, আর দেখ ট্র্যাঙ্কুইলাইজার ট্যাবলেট আছে ওই দেরাজে, আমাকে দাও। আমি সুস্থবোধ করছি না। ওই লোকটা আমাকে অসুস্থ করে দিয়ে গেল।
—তোমাকে কিছু খাইয়েছে? কই এরকম তো কিছু করে বলে তো কখনও শুনি নি। তবে হি নোজ হিপনটিজিম। হিপনটাইজ করে টানে নিজের দিকে। স্পেশালি গার্লস—উইমেন।
—না চৌধুরী, খাওয়ায় নি কিছু। তবে হিপনটিজম বলছ তা হতে পারে। কিন্তু কি আশ্চর্য শক্তি ওর হিপনটিজমের তোমার কাছে আমি ঠিক ভাবে এক্সপ্লেন করতে পারব না। কিন্তু আমার দেহ-মন সবকিছুকে টানছে, প্রবলভাবে টানছে। আমি ওঁকে ভুলতে পারছি না। অন্য কথা ভাবতে পারছি না। শুধু ওঁর কথাই মনে ঘুরছে। দাও, আমাকে ট্রাঙ্কুইলাইজার দাও—ডবল ডোজে দাও। আর হুইস্কি দাও।
চৌধুরী ভিতরের অর্থ বুঝতে পারে নি। সে ভাবছিল হিপনটিজমের কথা। সে তাড়াতাড়ি আমাকে মদের গ্লাস এবং ট্রাঙ্কুইলাইজার ট্যাবলেট দিয়েছিল—আমি ডবল ডোজে খেয়ে শুয়ে ঘুমুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘুম সহজে আসে নি।
***