চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ১৫

১৫

বড় আঘাত পেয়েছিলাম সুলতা। নিষ্ঠুর আঘাত। অর্চনাকে সত্যিই নিজের সহোদরার মত ভালবেসেছিলাম। ভাবছিলাম, এ কি হল? ভাবছিলাম, এরপর ওর কি হবে? কীর্তিহাটে মেজদিকে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছি, সেখান থেকে হিলডা কুইনিকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল, তাদের উপর অত্যাচার করছে লোকে, বিশেষ করে ধনেশ্বরকাকার ছেলেরা, সুখেশ্বরকাকার ছেলেরা—তাদের উত্তেজিত করছেন স্বয়ং ধনেশ্বরকাকা, জগদীশ্বরকাকা; আমি কুইনিকে হিলডাকে বলেছি, আমি ফিরে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলব। যদি তারা আমার কথা শোনে তবে ভাল; যদি না শোনে তবে সেই কথাই তোমাদের জানিয়ে দিয়ে বলব—এবার তোমরা যা খুশী করতে পারো। কিন্তু সেসব মনে করেও কলকাতা থেকে সরতে আমি পারি নি। এই বাড়ীতে শুধু ঘুরেছি আর ভেবেছি।

এ কি করলাম একটা ভ্রান্ত আবেগবশে! অর্চনার চেহারার সঙ্গে ভবানী দেবীর চেহারার মিল আছে বলে অন্নপূর্ণা-মায়ের নাতির ছেলের হাতে তুলে দিলাম। নিজেও তো বিশ্বাস খানিকটা করেছিলাম ওই কথাটা। অন্যত্র বিয়ে দিলেই তো হতো। জগদীশ্বরকাকা তাঁর সম্বন্ধীর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। সে দ্বিতীয়পক্ষ এবং সাবইন্সপেকটর বলে অর্চনা কেঁদে বলেছিল, আমি মরব বিষ খেয়ে। কিংবা নিজে গিয়ে পুলিসের হাতে ধরা দেবো। বলব সকল কথা খুলে। সুতরাং ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কাকে দোষ দেবো?

এরই মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন জগদীশ্বরকাকা। এলেন সস্ত্রীক। উঠলেন আমার এই বাড়ীতেই। সদ্যবিধবা কন্যার বাড়ীতে উঠতেই ইচ্ছে ছিল তাঁর কিন্তু খুড়ীমা তা হতে দেন নি।

খুড়ীমা এসেছিলেন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু জগদীশ্বরকাকা এসেছিলেন রথীনের সম্পত্তির খোঁজখবর নিতে।

রথীনের ইন্সিওরেন্স ছিল কিন্তু সে পলিসি লন্ডনবাসিনী স্ত্রীকে দেওয়া ছিল।

জগদীশ্বরকাকা ফিরে এসে আমাকে বললেন—আমার কি সর্বনাশ করেছ তুমি জান?

আমি চুপ করে রইলাম। কি বলব? অস্বীকার করার উপায় ছিল না।

জগদীশ্বরকাকা বলেছিলেন—তুমি জান, রথীন অর্চনাকে বিয়ের আগে একটা ফিরিঙ্গী মেয়েকে—

বলেছিলাম—আপনার মতই সেদিন রথীনের বাবার কাছে শুনেছি। এবং তাঁরাও জেনেছেন রথীনের মৃত্যুর পর

জগদীশ্বরকাকা চীৎকার করে উঠেছিলেন—খুন করে হাম্ ফাঁসি যায়েগা। হাম্ জগদীশ্বর রায় হ্যায়। কোইকো খাতির হাম নেহি করতা হ্যায়।

আমি কোন কথাই বলতে পারি নি। সে প্রতিবাদ দূরের কথা, বরং ভাবছিলাম জগদীশ্বরকাকা যদি আমার ওপর আঘাত করেন তো নিজের কাছ থেকে গ্লানি হতে পরিত্রাণ পাই। কিন্তু জগদীশ্বরকাকার স্ত্রী প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন-ছি-ছি-ছি! তোমাকে ছি! রায়বংশ! রায়বংশের জয়ধ্বজা! বজ্রাঘাত হয় না তোমাদের জয়ধ্বজার ওপর! কেন ওকে গাল দিচ্ছ? কি করেছে ও? টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ওই ওর অপরাধ?

সুলতা, জগদীশ্বরকাকা চিরদিন খুড়ীমাকে নিষ্ঠুর নির্যাতন নির্যাতিত করেছেন। নিষ্ঠুর কদর্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। দুটো কথা তাঁর মুখে প্রায়ই লেগে থাকত। হারামীর বাচ্চা হারামী আর বাঁদীর বেটী বাঁদী। শেষটা অভ্যাস করেছিলেন খুড়ীমার ওপর কথাটা প্রয়োগ করে করে। সেদিন তার একটাও বের হয় নি জগদীশ্বরকাকার মুখ থেকে।

আমার দুই কানের চারিপাশে খুড়ীমার একটা কথা বেজেই চলেছিল-বজ্রাঘাত হয় না তোমাদের জয়ধ্বজার ওপর? বজ্রাঘাত হয় না তোমাদের জয়ধ্বজার ওপর? বজ্রাঘাত হয় না তোমাদের জয়ধ্বজার ওপর?

কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে একটু হাসলে সুরেশ্বর। তারপর বললে—জান সুলতা, সেদিন একটা হিসেব করেছিলাম। বিচিত্র হিসেব। হিসেবের শুরু হল- রায়বংশের শুরু থেকে আমি পর্যন্ত সাতপুরুষের মধ্যে জয়ধ্বজা উড়িয়ে সবার সামনে দাঁড়াবার মত কেউ ছিলেন?

হ্যাঁ, জমিদার হিসেবে ছিলেন, কয়েকজনই ছিলেন। খেয়ালী-বিলাসী হিসেবেও ছিলেন। দাতা হিসেবেও ছিলেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে? রত্নেশ্বর রায়কে প্রণাম করে বলেছিলাম—শুধু তুমিই ছিলে। তোমার অত্যাচার তোমার শোষণ-শাসন সত্ত্বেও এক তুমিই ছিলে রায়বংশের জয়ধ্বজার মানুষ আর কেউ না। তবে হয়তো একালে তাও নাকচ হয়ে যাবে, কারণ তুমি রায়বংশের আয়কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ষাট হাজার টাকা বৃদ্ধি করেছিলে। কুড়ারাম রায়ের দেবকীর্তির কালও গেছে।

হঠাৎ চিন্তাটা রায়বংশ ছেড়ে গোটা বাংলাদেশের সমস্ত জমিদারবংশ খুঁজতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন কিন্তু মুহূর্তে মাথাটা নত হয়ে গিয়েছিল।

সুলতা সেটা ১৯৩৮ সাল।

মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তখনও বেঁচে। অবনীন্দ্রনাথও বেঁচে। কেষ্টনগরের চৌধুরী বংশের প্রমথ চৌধুরী জীবিত। কিন্তু সব প্রাচীন। নূতন কালের উজ্জ্বল মানুষের মধ্যে একজনকেও পাই নি যার কপালে জমিদারবংশের ছাপ মারা আছে! অপরিসীম বিস্ময় বোধ করেছিলাম। জমিদারবংশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ জন্মালেন কি করে? রাশিয়াতে জন্মেছিলেন ‘টলস্টয়’। কাউন্ট টলস্টয়। ঋষি টলস্টয়।

* * *

সেদিন কোথাও কোন সান্ত্বনা পাই নি সুলতা, হতাশায় আক্ষেপে যেন ভেঙে পড়েছিলাম। দুঃখ যেটা অর্চনার জন্যে অনুভব করেছিলাম, সেইটে ওই জগদীশ্বরকাকার কুৎসিত কথা আর খুড়ীমার এই ক’টা কথা—“বজ্রাঘাত হয় না ওই জয়ধ্বজার উপর” আমাকে যেন পাগল করে তুলেছিল। মনে হয়েছিল—রায়বংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়াই ভাল।

আবার মনে হয়েছিল—বাঁচতে হবে। যা হয়েছে তা হয়েছে, আমি বাঁচব। আমি কীর্তিহাটের সব কিছু বিক্রী করে দিয়ে পালিয়ে এসে বাঁচব।

ঠিক এই মুহূর্তে রঘুয়া চাকর এসে বলেছিল—দিদিমণি আইলেন।

—দিদিমণি? চমকে উঠেছিলাম।

—অৰ্চনা-দিদিমণি!

অর্চনা এসেছে? বেরিয়ে গেলাম। দেখলাম অর্চনার শ্বশুর তাকে নিয়ে এসেছেন এ-বাড়ী। এসেছেন আমার কাছে। জগদীশ্বরকাকা সকালে দাবী জানিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে তিনি বাড়ী নিয়ে যাবেন। রথীনের দরুন যা তাঁর পাওনা তা অর্চনার অভিভাবক হিসেবে তাঁকেই বুঝিয়ে দেওয়া হোক। এবং অর্চনার ভরণপোষণের জন্য মাসিক একটা খোরপোষের ব্যবস্থা করা হোক।

তাই তিনি অর্চনাকে সঙ্গে করে আমার কাছে এসেছেন। কারণ এ বিয়ে দিয়েছিলাম আমিই। এবং আমাকে দেখেই তাঁরা আমার খুড়তুতো বোন বলে এবং অর্চনা অবিকল ভবানী দেবীর মতো দেখতে বলে বিবাহ দিয়েছিলেন।

রথীনের বাপ বললেন—আমরা বউমার অভিভাবক হিসেবে তোমাকে জানি। জগদীশ্বর রায়কে জানি না। ওঁকে দেখলে এ বিয়ে হত না। উনি যে দাবি জানিয়েছিলেন–বউমাকে সে সম্পর্কে মত জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি কোন উত্তর দেননি। আমি ওঁকে এনেছি তোমার সামনে ওঁর সঙ্গে কথা বলব। কথা নয় সুরেশ্বর-একটা দলিল করেছি, দেখ।

* * *

দলিলখানা পড়ে আমার মনে পড়েছিল আমার ঠাকুমার কথা। আমার ঠাকুমাকে কীর্তিহাটের ঠাকুরবাড়ীতে ঢুকতে দেননি এই জগদীশ্বরকাকা আর তাঁর দাদা ধনেশ্বর কাকা। কলকাতায় তাঁকে বন্দী করে রেখেছিলেন আমার জ্যাঠামশাই, আমার বাবা প্রতিবাদ করেন নি। করতে পারেন নি দেবোত্তর সম্পত্তির জন্যে। ঠাকুমা কোন রকমে বেরিয়ে পালিয়ে গেলেন বৃন্দাবনে। সেখানে স্বামীর ভিক্ষে-মা, না, তাই বা কেন বলব সুলতা, বলব এক বৃদ্ধা বাঈজীর স্নেহদৃষ্টিতে পড়ে তাঁর আশ্রমে স্থান পেয়েছিলেন। নইলে হয়তো ওই ঘরে বন্দী অবস্থায় মরতেন, না-হয় বৃন্দাবনে একলা পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে ভিক্ষে করতেন। তাঁর পৈতৃক দেড় লক্ষ টাকার কোম্পানীর কাগজ তাঁর বড়ছেলে যজ্ঞেশ্বর রায় নিজের নামে নিজেদের নামে এনডোর্স করিয়ে নিয়েছিলেন। আমার বাবা নীরব ছিলেন, কিন্তু টাকার ভাগ নিয়েছিলেন।

আর এই ১৯০০ সালের ৩৭ বছর পর কাল এমন পাল্টেছে যে রথীনের বাবা যে দলিল করে এনেছেন তাতে অর্চনার জন্য মাসিক একশো টাকা মাসোহারা তাছাড়া বছরে দুবার দেড়শো করে তিনশো টাকা মোট পনেরশো টাকার ব্যবস্থা করেছেন। তার জন্য ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছেন। কিন্তু সে মূল টাকায় অর্চনার অধিকার থাকবে না। অর্চনার মৃত্যুর পর সে টাকা তাঁর অন্য উত্তরাধিকারীরা পাবে। যদি বর্তমানকালের ধারা অনুযায়ী অর্চনা বিধবা বিবাহ আইন অনুযায়ী বা তিন আইন মতে বিবাহ করে, তবে অর্চনা এককালীন পাঁচ হাজার টাকা পাবে তার সংসার পাতবার জন্য; অবশ্য তারপর আর মাসোহারার অধিকারিণী সে হবে না।

ইচ্ছানুযায়ী সে পিত্রালয়ে বা হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ীতে থাকতে পারবে বা স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্রও থাকতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে মাসিক তিরিশ টাকা পর্যন্ত বাড়ীভাড়া পেতে পারবে।

আমি বিস্ময়ে প্রায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর উদারতা দেখে।

অর্চনার শ্বশুর বলেছিলেন-আমার ইচ্ছে বউমা আমার কাছেই থাকেন, পড়াশোনা করেন; এ অবস্থায় পড়াশোনাই সব থেকে শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। আগে হলে দীক্ষা দিয়ে পুজো-অর্চনার পথ ধরানো নিয়ম ছিল—এ যুগে শিক্ষা—। কিন্তু ওঁর কি মত তা উনি বলেন নি।

অর্চনা বরাবর এসে অবধি বসেছিল পাথরের মূর্তির মত। সে ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে জানিয়েছিল-না।

.

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর বলেছিল—সুলতা, অৰ্চনা এখানে বসে আছে তাই বলছি নইলে রায়বাড়ীর জবানবন্দীর মধ্যে বাংলার নূতন যুগের শিক্ষিত সমাজের একটি উজ্জ্বল ঘরের লুকানো অন্ধকারের কথা প্রকাশ করতাম না। রায়বংশের ছবির সারির মধ্যে মুখুজ্জেবাড়ীর অন্ধকারের ছবি এখানে টাঙিয়ে দিতাম না।

সেদিন কথাটা অনুমান করতেও পারি নি। অর্চনাকেই দোষ দিয়েছিলাম। এদের বাড়ীটাও পচে গিয়েছিল।

অর্চনা নিজেই এবার বললে-আমি অনুমানে বুঝেছিলাম, ঠিক প্রমাণ তখনও পাই নি। তবে ভুল আমি করি নি। আলোর তলায় অন্ধকার নয়—লণ্ঠনের উপরেও অন্ধকার জমে গোটা আলোটাকেই কালিপড়া লালচে আলোয় পরিণত করেছিল বাড়ীটা। ছ বছর পর ১৯৪৩ সালে যুদ্ধের সময় আমার দেওরদের যে চেহারা দেখেছি; সে চেহারার পত্তন ছ বছরের অনেক আগে হয়েছে। ওখানে থাকলে আমার নিষ্কৃতি ছিল না। সে যেন আমার অন্তর আমাকে বলে দিয়েছিল। ও বাড়ীতে থাকতে আমার সাহস হয় নি।

সুরেশ্বর বাধা দিয়ে বললে—থাক ওদের কথা। রায়বাড়ীর জবানবন্দীতে ওইখানেই মানে রথীনের আত্মহত্যা আর অন্নপূর্ণা-মায়ের মৃত্যুর সঙ্গেই ওদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গেছে। ওরা যা হয়েছে তা নিয়ে ওরা আছে। দুনিয়ায় অন্তরাত্মা বলে একটা সত্তা আছে। তাতে আমি বিশ্বাস করি। মাটির বুকের মধ্যে তার উৎস, কিন্তু মানুষের বুকের ভিতরেই সে গঙ্গাধারা হয়ে বয়ে গেছে। আজ সে ধারা কীর্তিনাশা হয়ে সব ভেঙেচুরেই দিক আর ভাগীরথীর মত সে মজেই যাক কাল আবার তার মোড় ফিরবে। নতুন চেহারা নেবে সে। সেই ভরসায় মানুষ বাঁচে। আমিও সেই ভরসায় বেঁচে রয়েছি, জবানবন্দী দিয়ে জমিদার-জীবনের পালা শেষ ক’রে নতুন জীবন শুরু করতে চাচ্ছি। এখন জবানবন্দীর কথায় আসি। সুলতা, যে কথা অৰ্চনা বলতে যাচ্ছিল সে বড় মর্মান্তিক। ওর শ্বশুরবাড়ীর কথা। ওর দেওরদের কথা, ওর খুড়শ্বশুরদের কথা। যুদ্ধের সময় ওরা ওয়ার কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল; সে সময় কন্ট্রাক্টররা যা করেছে তা বলবার প্রয়োজন নেই। সেটার আঁচ শ্বশুরবাড়ীতে মাস আষ্টেকের মধ্যেই অর্চনা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সে সময় ভয় ছিল না, কারণ তখন অন্নপূর্ণা-মা বেঁচেছিলেন আর রথীনও তখন বেঁচে। রথীনের জীবনে পাপপুণ্য ছিল না, ধর্ম-অধর্ম ছিল না। কিন্তু অর্চনার উপর অধিকারের দাবী তার ছিল। বাপকে সে বম্বেতে বলেছিল—ভুল করেছি রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করে, হিন্দুমতে দশটা বিয়েতে বাধা নেই—হিন্দুমতে বিয়ে করলে আমাকে মরতে হত না। মা-মণির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও হয়তো মাফ পেতাম।

যাক—। অৰ্চনা কীর্তিহাটে ফিরল ওর বাবার সঙ্গে; জগদীশ্বরকাকা এবং ওর মা ওকে নিয়ে কীর্তিহাট ফিরলেন। আমি তার আগেই কীর্তিহাটে ফিরেছি এবং কীর্তিহাটেই নয়, আশপাশ চারিদিকের মানুষের কাছে রায়বাড়ীর জমিদারীর প্রজার কাছে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছি; হয়েছি গোয়ানদের সমর্থক হিসাবে এবং সেই সূত্রে ইংরেজ সরকারের সমর্থক হিসেবে।

মেদিনীপুরে কুইনি এবং হিলডা এসে অভিযোগ করেছিল—গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে। তারা তাদের উপর কংগ্রেসবিরোধী হিসেবে অত্যাচার করছে। আমি যদি এর প্রতিকার করি তো ভাল, নাহলে তারা মেদিনীপুরের ডি-এম-এর কাছে গিয়ে নালিশ করবে। সেই কারণে কুইনি হিলডা খড়্গপুরের মিসেস হাডসনকে নিয়ে এসেছিল। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, অনুরোধ করেছিলাম মিটমাটের চেষ্টা আমি করব এবং বোধ হয় মিটমাটও হয়ে যাবে; তবে তোমাদের কাছে অনুরোধ—তোমরা অপেক্ষা কর।

অপেক্ষা তারা করেছিল। কুইনি হিলডা মেজদির সঙ্গেই কীর্তিহাট ফিরে গিয়েছিল। আমি চলে এলাম কলকাতায় অর্চনার দুর্ভাগ্যের সংবাদ পেয়ে।

সেই কারণেই আমি অর্চনা এবং জগদীশ্বরকাকাদের রেখেই কীর্তিহাট চলে এসেছিলাম। দেখলাম সারা অঞ্চলটার মানুষ ওই গোয়ানদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়ে তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গোয়ানরা ভীত হয়েছে। কিন্তু নত হয় নি। তারাও প্রতিজ্ঞা করেছে তারা নত হবে না। তারা দেশের মালিক ভারতবর্ষের এম্পায়ারের সঙ্গে স্বধর্মাবলম্বী। কেন তারা নত হবে?

দুটো-চারটে ছোটখাটো ঝগড়াও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি কলকাতায় তখন, কুইনি হিলডা আমার প্রতিশ্রুতি পেয়েও তার উপর নির্ভর করে থাকতে পারে নি। গোয়ানদের নেতৃত্ব করেছে কুইনি। ব্যাপারটা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত যায় নি। কিন্তু এস-ডি-ও পর্যন্ত গিয়েছে এবং এস-ডি-ও সার্কেল অফিসারকে তদন্তের ভার দিয়েছিলেন। জেলাটা মেদিনীপুর, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তাণ্ডব শেষ হয়েছে মাত্র দু বছর আগে। সার্কেল অফিসার পুলিস রক্ষী নিয়ে এসেছিলেন তদন্তে। অভিযোগ এখানকার কংগ্রেসীদের প্ররোচনায় তাদের বয়কট করা হয়েছে এবং নানাভাবে তাদের বিব্রত করা হচ্ছে। তারপর ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে কোন দিন কি অত্যাচার হয়েছে গোয়ানদের ওপর। সে ফিরিস্তি অনেক। শুরু হয়েছে সিদ্ধাসন জঙ্গলে গোয়ানদের প্রবেশাধিকার থেকে। শেষ হয়েছে গোয়ানপাড়ার মেয়েরা এবং ছেলেরা কীর্তিহাটের স্কুলে জায়গা পায় না। এ ছাড়া অভিযোগ হয়েছে রায়বাড়ীর ধনেশ্বরকাকার ছোটছেলে নব যুবক অরুণেশ্বর এবং সুখেশ্বরকাকার ছোটছেলে দীপকেশ্বরের বিরুদ্ধে। তারা এই বয়কটের সুযোগ গোয়ানপাড়ার মেয়েদের উপর ঘৃণ্য অত্যাচার শুরু করেছে।

সাধারণের পক্ষে এসেছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি সেই বৃদ্ধ রঙলাল ঘোষ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন কুইনিকে যে, কোন অন্যায় কীর্তিহাটের লোক স্বীকার করে না। কীর্তিহাটে থেকে যারা কীর্তিহাটের লোকেদের সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন করবে না তাদের সঙ্গে কীর্তিহাটের লোকের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ঘরে আগুন তারা লাগাবে না এটা নিশ্চিত, কিন্তু তাদের ঘরে আগুন লাগলে নেভাতে যাবে না। তারা কীর্তিহাটের লোকেদের সঙ্গে যদি একধর্মের লোক না হয় তবে তাদের কীর্তিহাটের লোকেরা ধর্মস্থানে ঢুকতে দেবে না। প্রয়োজন হলে লেনদেন কাজকারবার সব বন্ধ করে দেবে।

কুইনি বলেছিল—মুসলমানরা কংগ্রেস-বিরোধী—তাদের সঙ্গে এই রকম করতে পারেন? সারওয়ার্দী সাহেবের বাড়ী মেদিনীপুর শহর।

ঝগড়া বেশ দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। অরুণেশ্বর দীপকেশ্বরের অপরাধ ঠিক প্রমাণিত হয় নি। কীর্তিহাটের লোকেরা বলেছে-না-না-না। তাদের চরিত্র বড় ভাল।

সার্কেল অফিসার ফিরে গেছেন। প্রমাণ পান নি।

তারপর কুইনির নামের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে হাতেলেখা পোস্টার মেরে কীর্তিহাট গোয়ানপাড়ার দেওয়াল ছেয়ে দিয়েছে কারা।

কুইনির পড়ার খরচা দেয় কেন সুরেশ্বর রায়? কুইনি নেয় কেন? কুইনির কলকাতার বাড়ি খালাস করতে টাকা কে দিয়েছে? কেন দিয়েছে?

এই অবস্থায় আমি গিয়ে পৌঁছুলাম সুলতা।

আমার নায়েব আমাকে সমস্ত কথা বলে বললে—আপনি এ নিয়ে কিছু করবেন না, বলবেন না। ব্যাপারটা সাংঘাতিক হয়ে উঠবে।

ওদিকে ঠাকুরবাড়ীতে মেজদির প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছেন ধনেশ্বরকাকারা। ওখানে শিবেশ্বর রায়ের বংশের লোকেরা জোট বেঁধেছে।

মেজদি যেন বোবা হয়ে গেছেন। হবারই কথা। এগুলো আগে থেকেই তিনি কল্পনা করেছিলেন, আমাকে বলেছিলেন—স্বর্গ-বৈকুণ্ঠ-কৈলাস এ সবের কথা বইয়ে পড়েছি ভাই, গল্পে শুনেছি, যাত্রার দলে থিয়েটারে সাজিয়েগুছিয়ে দেখিয়েছে দেখেছি। যতক্ষণ পড়ি যতক্ষণ শুনি যতক্ষণ দেখি বেশ লাগে। কিন্তু ভাই পিথিবীতে যেখানে যত ঠাকুর আর ঠাকুরবাড়ী আছে, সেখানে মানুষে যা করে তাই হয়—দেবতার মহিমা কোথাও দেখি নি বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না। রায়বাড়ীর কালী-মা, গোবিন্দ, সৌভাগ্য-শিলা সত্যি হলে তারা কি ওই পচা মেজতরফের দত্যিগুলোর হুকুমে চলে? ওখানে আর আমি থাকতে পারব না। তার থেকে তুই আমাকে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দে ভাই। আমি বড়দির আশ্রমের উঠোন ঝাঁট দিয়ে ভিক্ষে করে খাব।

তিনি এসব বিষয়ে একটি কথা বলেন নি। ঠাকুরবাড়ী ঢুকতে যান নি। বাড়ীতে ওঠেন নি। উঠেছেন বিবি মহলে।

তিনিও আমাকে বললেন—ভাই, ধোঁয়ানো আগুনে খোঁচা দিস নে ভাই, বাতাস দিস নে, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।

আমি ভাবলাম-কি করব?

হঠাৎ বিকেলবেলা কুইনি এল ক’জন গোয়ানকে সঙ্গে ক’রে-আমার সামনে মাথা তুলে সদর্পেই জিজ্ঞাসা করলে—এই আপনার কথার দাম?

আমি কথা দিয়েছি, সে তার দাম যাচাই করতে ছাড়বে কেন!

নির্ভীক মেয়েটাকে দেখে খুশী হয়েছিলাম এবং তোমার কাছে গোপন করব না আমার দেহের মধ্যে দেবেশ্বর রায়ের রক্ত সাড়া দিয়ে উঠেছিল। আমি মুগ্ধদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম।

মুখচোখ লাল হয়ে উঠল কুইনির। সে হিলডাকে বললে—চল দিদিয়া, জবাব পেয়েছি। চল। বাবুজাত-রায়বাহাদুরের জাত আলাদা হয় না। চল।

আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। লজ্জিত হলাম। বললাম- মাফ কর কুইনি। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। আমি কথা দিয়েছি চেষ্টা করব। আবার বলছি সে চেষ্টা আমি করব। আমি কালই বলব সকলকে। ওঁরা না শুনলে যা ইচ্ছা হয় করো।

১৯৩৮ সালের মে মাস। আমি কীর্তিহাটের জমিদার অর্থসম্পদহীন মেজতরফ নয়; অর্থবল আমার ছিল; কিন্তু সেদিন আমিই গেলাম কীর্তিহাটের রঙলাল ঘোষের বাড়ী।

জমিদার মহাজন ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য সকলে সেদিন মানতে বাধ্য ছিল রঙলাল ঘোষকে। রঙলাল ঘোষ আমার সঙ্গে দেখাই করলেন না। ফিরিয়ে দিলেন, বললেন—শরীর খারাপ, তা ছাড়া সময় নেই। জবাবটা বহন ক’রে এনেছিলেন রঙলাল ঘোষের বড়ছেলে। লোকটি মিষ্টভাষী লোক। তিনি বললেন —“বাবা কি বলবেন? তিনি জানেন আপনি যার জন্যে এসেছেন। ও হবে না। গোয়ানদের সঙ্গে মিটমাট হবে না। আপনিও ও নিয়ে জড়িয়ে থাকবেন না। আর ওই কুইনি মেয়েটার পড়ার খরচা আপনি দেন তাও আর দেবেন না। আপনার বদনাম রটছে। ওদের সঙ্গে থাকলে লোকে ধর্মঘট করবে। খাজনা দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে সোসাল বয়কটও করবে।”

আমি মাথা নিচু ক’রে ফিরে এলাম সদগোপপাড়া থেকে রায়বাড়ী। পথে কতকগুলি ছেলে হাততালি দিলে। হঠাৎ একটা নির্জন জায়গায় কে কোথা থেকে বললে-জমিদার! ফলিয়ে দেব জমিদারী। হেসে সুরেশ্বর বললে—এতদিনের রায়বংশের যে ছেলেটি কীর্তিহাটে উজ্জ্বল মহিমায় বিরাজ করছিল, তার গায়ে তারাই অবহেলা অবজ্ঞা এবং উপেক্ষার কালি মাখিয়ে কালো করে দিল।

তা করুক। আমি অন্যায় করি নি এই জোরটা আমার ছিল। তাই ওখান থেকে চলে আসব সংকল্প করেছি আবার ভেঙেছি, ভেঙে সেখানে ওই কালি মেখেই কালো মুখ নিয়েই থেকেছি দিনের পর দিন। এরই মধ্যে গাঁয়ে ফিরে এলেন জগদীশ্বরকাকা অর্চনাকে নিয়ে। এবং কন্যার সম্পদ মাসিক একশো টাকা আয় আর অর্চনার গহনার মূলধন সে প্রায় পনের হাজার টাকার উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে ফিরলেন। অর্চনা তখনও মুহ্যমান।

ঠিক একদিন পর অর্থাৎ পরদিন সকালেই মেজদিদি ওবাড়ী থেকে ফিরে এলেন সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে। দুই চোখ থেকে চোখের জলের ধারার আর বিরাম ছিল না।

জগদীশ্বরকাকা তাঁর গলা ধরে বাড়ী থেকে বের করে পথের উপর ফেলে দিয়েছেন, চীৎকার ক’রে কুৎসিত ভাষায় তাঁর অপমান করেছেন। জেলে গিয়ে তাঁর জাত গিয়েছে। অজাতের হাতে খেয়েছেন।-তাছাড়া আরও অনেক কিছু। অর্চনা প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু মুহূর্তে জগদীশ্বরকাকা তাকে শাসিয়ে বলেছেন—এখনি গিয়ে পুলিসের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ ক’রে তোমাকে ঠেলে দিয়ে আসব শ্রীঘরে।

শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মেজদি হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন—আমায় বৃন্দাবন পাঠিয়ে দে ভাই। তোর পায়ে ধরছি আমি।

তাই ঠিক করে ফেললাম। মেজদিকে বৃন্দাবনেই দিয়ে আসব। সেই ভাল—শিবেশ্বর রায়ের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী জেল থেকে ফিরে এসে নির্বাসিতা দেবেশ্বর রায়ের স্ত্রীর পাশেই ব্রজধামের রজের উপর জীবনের শেষ আশ্রয় গড়ে তুলুন। আর কোথায় যাবেন?

গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে করা থেকে ভাল। শহরে বাজারে ব্যবসাদার কি ঢাকরে বড়লোকের বাড়ীতে দাসী বা রাঁধুনীবৃত্তি থেকে সে ভাল।

যাবার সময় খবর শুনে শুধু অর্চনা এসেছিল। দেখলাম ওর চোখ দুটো ঝক্‌ঝক্ করছে। শোকের মুহ্যমানতা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে—তাই যাও সুরোদা। সেই ভাল। বললাম-ভাল নয়? জমিদার শিবেশ্বর রায়ের স্ত্রীর অন্যের বাড়ী দাসী বা রাঁধুনী হওয়া থেকে তো ভাল!

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিল অর্চনা। তারপর সুরেশ্বর অর্চনার দিকে তাকিয়ে বললে—তোর মনে আছে অর্চি?

একটি রেখার মত ক্ষীণ হাসি নিঃশব্দে তার ঠোঁটের দুই প্রান্তে ফুটে উঠল—সেও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—মনে নেই? নিজের কথাও তো ছিল ওর মধ্যে সুরোদা। আমি তো তখন বুঝতে পেরেছি, বাবা আমার গয়নার টাকার উপর নজর ফেলেছেন। রাত্রে মাকে বলেছেন—গয়নাগুলো বেচে একবন্দ ভাল জমি কিনে ফেলব অর্চির নামে। আর কিছু টাকা নিয়ে তেজারতি করব। আর আমাদের দুঃখ থাকবে না। শুনে সারারাত ঘুমুই নি। ভোরে উঠে তোমার ওখানে বিবিমহলে এলাম। তুমি বললে মেজদিকে বৃন্দাবনে রাখতে যাচ্ছি। আমার মনে পড়েছিল দ্রৌপদীর অজ্ঞাতবাসে সৈরিন্ধ্রী হয়ে চাকরি করার কথা। সেকালে দাসী হয়েও এঁটো খেতে হয় নি, পায়ে হাত দিতে হয় নি; তা ছাড়াও কীচকের মত মহাপাষণ্ডের হাত থেকেও বাঁচা সম্ভবপর হয়েছিল। একালে দ্রৌপদীরা মানে রাজা-জমিদার বাড়ীর মেয়েরা চাকরি করতে গেলে ওর কোনটা থেকে রেহাই পাবে না। যাও তুমি দিয়ে এস। সেই ভাল। সেইদিনই রওনা হয়েছিলাম।

বৃন্দাবনে কৃষ্ণাবাঈয়ের আশ্রমে আমার জন্যে পরমতম বিস্ময় আর ধ্রুবতারার মত স্থির আর শেষ নির্দেশ অপেক্ষা করে ছিল তা আমি জানতাম না। কোন ভৃগুজাতকের গুণীনও গণনা করে বলতে পারতেন না; কোন মানুষ কল্পনা করতে পারতেন না।

আশ্রমে ঢুকতেই তাঁর সঙ্গে দেখা হল।

কত পরিচিতের মত বললেন-এসেছ?

আমি অবাক হয়ে গিছলাম তাঁকে দেখে। গায়ের রঙটা টটকে গৌরবর্ণ, ছোটখাটো মাথায়, বেশ মোটাসোটা মানুষটি; তিনি সুন্দর কি অসুন্দর সে বিচার বোধ হয় কেউ করবে না—দেখলেই মনে হবে আহা কি প্রসন্ন মানুষ!

তিনি আবার বললেন—এসেছ তো অনেক দিন, এতদিনে। বলতে বলতে থেমে গিয়ে বললেন—দেনাশোধের পালা এবার। নয়? আমি জানি, আমি জানি। দেনা যে শোধ করতে হবে তোমাকে।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, সেদিন আমি আমার পিতামহীর সামনে বসে তাঁর কথা শুনে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে কি বলব, তিনি যা বলেছিলেন, তাই মনে হয়েছিল ধ্রুবসত্য। মনে হয়েছিল, তিনি দিব্যদৃষ্টি পেয়েছেন, ভবিষ্যৎ যেন দেখতে পাচ্ছেন, প্রত্যক্ষ দর্শন করে বলছেন। মনে হয়েছিল, তিনি আর মানুষ নন। মানুষের দেহেই তিনি দেবতার চেয়েও পবিত্র হয়েছেন, জগতের সব ন্যায়, সব ধর্ম তাঁকে আশ্রয় করে যেন ধন্য হয়ে গেছে।

তিনি বলেছিলেন, নাতি, আমার সঙ্গে কথা হয় ঠাকুরের। সে ভাই অনেকদিন থেকে। কীর্তিহাটে মন্দিরে গেলে কথা হতো, এখানে ভাই চব্বিশ ঘণ্টা। আমার আশেপাশে অহরহ ফিরছে, কথা বলছে, বুঝেছ নাতি!

ঘাড় নেড়ে আমি বলেছিলুম, হ্যাঁ, বুঝেছি। মাথার গোলমাল তাঁর অনেকদিন হয়েছে। কিন্তু সে-কথাটা আমলই পায় নি মনের কাছে। আমি দেখলাম, পৃথিবীর সব কিছু আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে তাঁর কাছে। যা ঘটেছে, যা ঘটছে, তার কারণ তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করে ফেলেন। কিছুই অগোচর থাকে না। সব। সেই সর্বঘটে যাঁর অধিষ্ঠান, তাঁর ইচ্ছে। বলেন—ওই তো, মজা লাগাতে সে ওস্তাদ। মহা ওস্তাদ! বিপদে ফেলে মজা দেখে। বিপদেও ফেলে আবার ভরসা করলে পারও করে সে-ই।

বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশক তখন, ১৯৩৮ সাল, এর ন’বছর পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। তারও দু বছর আগে এ্যাটমিক যুগ আরম্ভের যুগ। ১৯৪৫ সালে। সেই ১৯৩৮ সালেও তিনি কেমন জান? মডার্ন ইন্ডিয়ার মধ্যে আজও যেমন গঙ্গাসাগর মেলায়, পূর্ণকুম্ভে, প্রয়াগে, হরিদ্বারে অতীত ভারতের বিচিত্র রূপ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে, ঠিক তেমনি। এবং গঙ্গাসাগরে দারুণ শীতে বাংলার মন্ত্রীদের স্নান করার এবং প্রয়াগে কুম্ভে সেন্টারের মন্ত্রীদের স্নানের মধ্যে মডার্ন ইন্ডিয়া যেমন পুরনো ভারতের কাছে সবিস্ময়ে মাথা নত করে আমিও সেদিন তেমনি করে অভিভূত হয়ে তাঁর কথা মেনে নিয়েছিলাম পরম সত্য এবং ধ্রুবসত্য বলে। একবিন্দু সংশয় যেমন তাঁর বলার মধ্যে ছিল না, তেমনি শোনার মধ্যেও আমার এতটুকু প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ ছিল না।

একটু চুপ করে থেকে আবার সুরেশ্বর একটা সিগারেট ধরিয়ে শুরু করলে, বললে—পরে এ নিয়ে আমি বিচার করেছি খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখেছি। কেবল একটা কথা বা তাঁর একটা ধারণা ছাড়া বাকীগুলির মধ্যে অবিশ্বাসের কিছু ছিলও না।

ঠাকুমা সেই গোড়াতেই আমাকে ডেকেছিলেন—’বড়বাবু’ বলে। অর্থাৎ দেবেশ্বর রায়ই জন্মান্তর নিয়ে আমি অর্থাৎ সুরেশ্বর হয়ে জন্মেছি—এই ধারণাটার কথা বলছি। ওটা তিনি ছাড়েন নি। সায়েন্স অব হেরিডিটির কথা মোটামুটি জানি, কিন্তু ভাল ভাবে জানি না, তাঁকে বোঝাতে গিয়েও বোঝাতে পারি নি, আর তিনি তা ঘাড় নেড়ে হেসে উড়িয়েই দিয়েছিলেন। একটি বুলিই ধরেছিলেন—জানি? ‘বড়বাবু’ জানি। এসব আমি অনেকদিন আগে থেকে জানি। তুমি আবার আসবে, তোমাকে আবার নতুন জন্ম নিয়ে রায়বাড়ীতেই আসতে হবে, তোমাকে দেনা শোধ করতে হবে।

সুলতা, তাঁর কথাগুলো আজও আমার কানে বাজছে। বলেছিলেন—বড়বাবু, যত বড় মানুষটা তুমি, তার শতগুণ ভারী দেনার বোঝা তোমার ঘাড়ে। জন্মে জন্মে বোঝা বাড়িয়েই চলেছ; বাড়িয়েই চলেছ; এবার বোঝা নামাও, শোধ করো, দেনার বোঝা শোধ করো।

আমার চিবুকে হাত দিয়ে আদর করে বলেছিলেন—আমার কাছে একটা কথা আদায় করেছিলে, তোমার মনে আছে? সেই তুমি মারা গেলে, তার কদিন আগে! বলেছিলে-বড়বউ, তোমার ঠাকুর ঠিক বলেছেন—দেনার জন্যেই জন্মে জন্মে তোমাকে পেয়েও আমি পাচ্ছিনে। এবার দেনা শোধ করবই। তোমাকে পেতে হবে বড়বউ, প্রাণটা আমার হাহাকার করছে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম পাগলের প্রলাপ; কিন্তু তবুও অশ্রদ্ধা করে তাঁকে অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। উঠে পালিয়ে আসতেও পারছিলাম না। শুধু একটা রুদ্ধ বেদনার আবেগ বুকের মধ্যে আমার উথলে উথলে উঠছিল। ভাবছিলাম—রায়বাড়ীর দেবেশ্বর রায়ের গৃহিণী রত্নেশ্বর রায়ের মহাসমাদরের জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূই এঁর পরিচয় নয়, এঁর পরিচয় সীতা-সাবিত্রীর মত, এঁকে ধনসম্পদ আর মিথ্যা মর্যাদা-স্ফীত রায়বংশ এইভাবে পরিত্যাগ করেছে। হতভাগ্য রায়বংশ! অথবা রায়বংশের মত সব বংশের ভাগ্যই এই। সে সেই রামায়ণের কাল থেকে। সীতাকে বনবাসেই যেতে হয়, শেষ হয় পাতাল প্রবেশে। সঙ্গে সঙ্গে বংশের লক্ষ্মীও উবে যান।

তুমি জান কিনা আমি জানি না, মহারাজ প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে একটা জনপ্রবাদ আছে। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বাড়ীতে মা ভবানী ছিলেন কন্যারূপা হয়ে। যখন মহারাজ প্রতাপাদিত্য জামাই রামচন্দ্রকে হত্যা করবেন বলে স্থির করলেন, রাজ্যের জন্য, মর্যাদার জন্য, তখন নাকি তাঁর মেয়ের রূপ ধরে মা ভবানী এসে বলেছিলেন—বাবা, আমার মুখের দিকে তাকাও—! শক্তি আর অহংকারমত্ত প্রতাপাদিত্য বলেছিল—চলে যা আমার সুমুখ থেকে, তোর মুখ আর দেখব না।—

মা সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের অহংকার আর অধর্ম-উত্তপ্ত বাড়ী ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁর ঝাঁপিটি নিয়ে। গিয়ে উঠেছিলেন ভবানন্দ মজুমদারের বাড়ী।

ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গলে গল্পটা একটু অন্যরকম করে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন-মা প্রথম ছিলেন হরি হোড়ের বাড়ীতে। তারপর ঠিক ওইভাবেই কন্যাবেশে হোড়মশায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলেন—বাবা, আমি আর থাকতে পারছিনে। তোমার জামাই আসছে। হোড় রেগেই ছিলেন মেয়ের ওপর, বলেছিলেন- যা-যা, এখুনি যা।

মা অন্নপূর্ণা গঙ্গা পার হয়ে যাবার সময় ঈশ্বরী পাটনীর কাঠের সেঁউতি সোনা করে দিয়ে আর তার ছেলেরা দুধে-ভাতে থাকবে এই বর দিয়ে মজুমদার বাড়ী প্রবেশ করেছিলেন।

প্রতাপাদিত্যের গল্পটা আমাকে বলেছিলেন আমার মেজদিদি, শিবেশ্বরের তৃতীয় পক্ষ পুরুত ভটচাজের কন্যেটি; তিনি কার কাছে এটা শুনেছিলেন তা বলতে পারিনে।

আমি সেদিন আমার ঠাকুমার সামনে বসে সেই গল্পটাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, রায়বাড়ীর লক্ষ্মী ছিলেন এই বড়-বউটি; তাঁকে উপেক্ষা করলেন সবাই। স্বামী দেবেশ্বর রায়, ছেলেরা-যজ্ঞেশ্বর রায়, যোগেশ্বর রায়, মেজতরফের দেওর শিবেশ্বর রায় থেকে তাঁর ছেলে ধনেশ্বর, জগদীশ্বর, সুখেশ্বর—সবাই।

ইনি বুঝি তিনিই। রায়বাড়ীর লক্ষ্মী। ইনি যা বলছেন, বাস্তব বিচারে তা প্রলাপ হলেও প্রলাপ নয়। এই হল সত্যকারের সত্য।

সুলতা, আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি কথা ঠাকুমা?

বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে বললেন—দেখ, ওই ভালবাসিনে! ওইসব কথা চাপা দেওয়া! তুমি বল নি আমাকে, বড়বউ তুমি বল, আমাকে তুমি জন্মজন্মান্তরে কামনা করবে! আমার জন্যে অপেক্ষা করবে? আমি চুপ করে ছিলাম। তোমার সে কি জেদ। কি বলব বল, আমি তো সবই জানি। ঠাকুরের সঙ্গে কথা হত, তিনি তো আমাকে সব বলতেন। আমি তাঁকে শুধিয়েছিলাম—এত কষ্ট কেন আমার কপালে লিখলে? ঠাকুর বললেন—এর আগের ক’জন্ম আমাকে ফেলে তুই ওর পেছনে ছুটেছিস। আমি ডেকেছি, আসিস নি। এবার ও তোকে ছুঁড়ে ফেলেছে, এবার তুই আমার কাছে এসেছিস, এবার তোর মুক্তি। তোর স্বামীকে সব দিয়েছিলাম। নিলে কই। নেবার মধ্যে নিলে রূপোর তাল, আর রূপের তাল। তাহলে কি বলব? তবু তুমি ছাড় না। তখন বললাম। তুমি বললে, বড়বউ, আজ থেকে জীবনের দেনা শোধ করব। তুমি শুধু এইটুকু বলো ঠাকুরকে—ঠাকুর, মুক্তি আমাকে দিয়ো না, আমাকে তোমার দাসী করে রাখ, যেদিন তার মুক্তি হবে সেইদিন মুক্তি দিয়ো আমাকে। সে ঋণশোধ করবে, কড়াক্রান্তি হিসেব করে শোধ করবে বলে কথা দিয়েছে আমাকে। দেবেশ্বর রায় আমার সাধের বর- আমার মোহন বড়বাবু, আর যা করবে করুক, মিথ্যে কথা বলে না।—

—সে-সব বলেক’য়ে আজ ভুলে যাচ্ছ বড়বাবু! ছি-ছি-ছি!

মেজদি অবাক হয়ে সব শুনছিলেন, তিনি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে বলেছিলেন-তা ও করছে দিদি, তা ও করছে।

—করছে? তবে যে বড়বাবু জিজ্ঞাসা করছ, ‘কি কথা ঠাকুমা?”

হেসে বলেছিলেন—আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ? তা তুমি তো জান আমি ঠাট্টা বুঝি না। বোকাসোকা মানুষ। বাবাঃ, যা ভয় লাগত, কথা তো নয় যেন জেরা। এখন নাতি হয়ে জন্মেছ, ভয় আর ঠিক করে না। ক’টা কথা জিজ্ঞেস করি। করব? আমি বললাম—করুন। জিজ্ঞাসা করলেন—মদ খাও? মাথা হেঁট করে বললাম—খাই ঠাকুমা। বললেন—হুঁ, আমি জানি। বড়বাবু মদ না খেয়ে থাকবে! বাবাঃ, বড়বাবুর বাবা, বাঘের মত বাপ, তিনি রাগ করে গর্জাচ্ছেন, বড়বাবু টেবিল ধরে টলছেন আর আমাকে বলছেন, বড়বউ, আমার সেই গুলী খাওয়া জায়গাটায় ব্যথা করছে, মালিশ দিয়ে দেবে চল। আর বাবাকে বল, কাল-কাল কথা বলব। আর বিয়ে করেছ? বিয়ে? এবার মেজদি বললেন-না দিদি, বিয়ে করে নি। বললেন—করে নি? তাহলে? বড়বাবু, আবার সেই পাপ বাড়াচ্ছ? না-না ভাই আমার, লক্ষ্মী সোনা আমার, ও-পাপ করো না ভাই। ও মহাপাপ। আমি হাত জোড় করে বললাম—না ঠাকুমা, বিয়ে আমি করি নি। কিন্তু যে পাপের কথা বলছেন, সে পাপও আমি করিনে। আমি রায়বংশের অভিশাপের কথা জানি, আজ ছ’পুরুষ পর্যন্ত জমানো পাপের কথা জানি।

—রাশি রাশি পাপ। ওরে নাতি, রায়বংশের পাপ জমা করলে পাহাড়-পর্বত হয় রে-পাহাড়-পর্বত হয়।

হঠাৎ যেন পাল্টে গেলেন ঠাকুমা। কি ভাবনায় যেন ডুবে রইলেন, তারপর যেন অনেকটা সহজ মানুষের মত বললেন–কি নাম তোমার নাতি? হ্যাঁ-হ্যাঁ, সুরেশ্বর। অবিকল তুমি বড়বাবুর মত দেখতে; বড়বাবু শেষকালে কিছুদিন আমাকে ভালবেসেছিলেন। আমি দেবতা দেবতা করতাম, আমাকে বলেছিলেন—দেখ আমি পুরুষমানুষ, তোমাকে আমি বিয়ে করেছি, কেউ যদি তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসে, তবে আমি তার সঙ্গে লড়ব, মরব, তার আগে তো ছেড়ে দেব না। সে যদি তোমার গোবিন্দ এসে কেড়ে নেন, তবে আমি তার সঙ্গেও লড়ব। না লড়ে, না মরে তোমাকে আমি ছিনিয়ে নিতে দেব না।

চোখ থেকে তাঁর জল গড়াল। বললেন—দেখ ভাই, তখন কি জানতাম কথাটা এমনি করে ফলবে! তিনি মারা গেলেন। আমাকে ঠাকুর কেমন কৌশল করে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন দেখ। ভাই আমার ভিক্ষে-শাশুড়ীকে দিয়ে পুরী তৈরী করে এখানে রাখলেন। তা ভাই আমার দশা হল, আমি এসে না পারলাম ঠাকুরকে আত্মসমর্পণ করতে, আর না পারলাম মরতে। দেখ! আঃ, তোমাকে দেখে কত কথা যে মনে পড়ছে। তুমি ভাই অবিকল আমার সেই বড়বাবু। বুঝেছ! বড় আবোলতাবোল যে মনে পড়ছে।

আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন—হাঁ যা বলছিলাম, শোন ভাই নাতি। রায়বংশের পাপের কথা। বড়বাবু আমাকে বলেছিলেন—বড়বউ, পাপ আমাদের জমা করলে পর্বত হয়, গঙ্গার বুকে ফেললে গঙ্গার বুক পুরে ওঠে, মজে যায়। আমি হিসেব করে দেখেছি বড়বউ, পাপ শুধু একরকম নয়, যত রকমের পাপ হতে পারে, সব-সব-সব রকম পাপ জমা হয়েছে রায়বাড়ীর পাপ-পুণ্যের সিন্দুকে। পাপের সিন্দুক বোঝাই। দেখ রায়েদের জমিদারীতে পত্তনীতে, দরপত্তনীতে একশো পঁয়ত্রিশখানা গ্রাম। এ গ্রামের খাজনা বাড়িয়ে তিন ডবল করেছি। একশো পঁয়ত্রিশখানা গ্রামে কমপক্ষে পনের হাজার লোকের বাস, আজ পাঁচপুরুষ ধরে পাঁচ-পনেরং পঁচাত্তর হাজার লোকের মাথায় পা দিয়ে হেঁটেছি। পুজো করে ওরা যে লক্ষ্মী ঘরে তুলেছে, সে লক্ষ্মীর ভাগ নিয়েছি। ঘরে আগুন দিয়েছি। চাবুক মেরেছি। বুকে গাছের গুঁড়ি চাপিয়েছি; থামের সঙ্গে বেঁধেছি। তাছাড়া বড়বউ, নিজেদের পাপ- মদ খেয়ে নিজের সর্বনাশ করেছি। তোমার মত লক্ষ্মীকে ফেলে কত কদাচার করেছি বড়বউ, ওই ভায়লেট, ওঃ! পাপের কি শেষ আছে বড়বউ? বাবা ভিক্ষে-মাকে তাড়ালেন। কেন, না, সে পাপদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছে। অঞ্জনা-পিসীকে, হ্যাঁ, একরকম তাকেও তিনি তাড়ালেন। তাছাড়া বাবার মাতামহের পাপ, সে পাপ তুমি জান না, ভীষণ পাপ, বাবার পিতামহের পাপ, সে-ও ভীষণ পাপ। পাপের বিন্ধ্যপর্বত, মাথা ঠেলে উঠছে—সূর্যের পথ বন্ধ করে দাঁড়াবে একদিন, সেদিন রায়বংশে আর সূর্য উঠবে না, রাত্রি পোয়াবে না। দিনের আলোর মুখ রায়বংশ দেখবে না। হয়তো জন্তু-জানোয়ার হয়ে রাত্রির অন্ধকারে হাঁক মেরে বেড়াবে। তখন এই মানুষেরাই গুলী করে মারবে, ফাঁদ পেতে ধরবে। বড়বাবু আমার হাত ধরে বলেছিল-নাতি, বলেছিল—তোমাকে দুঃখু দিয়ে তোমার চোখের জল দেখে আমার চোখের মোহ কেটে গেল বড়বউ, আমি দেখতে পাচ্ছি কত পাপ আজ ঝোলা পাহাড়ের মত মাথার ওপর ঝুলছে। যদি সময় পাই, তবে এই জন্মে এর প্রায়শ্চিত্ত করব, না পেলে কত জন্ম ঘুরতে হবে জানি না। আমি বলেছিলাম-না গো না। ভগবানের নাম কর, শরণ নাও, আগুনে খড় পুড়ে যাওয়ার মত পুড়ে যাবে। তা বড়বাবু হেসে বলেছিলেন—সে যদি তোমার মত পারতাম মানিকবউ, তবে তো বেঁচে যেতাম। তা যে পারি না। পাপ করব আর হরিনামের ঝোলা নিয়ে জপ করব—আর পাপ ছাই হবে, এত সোজা হলে পাপও মিথ্যে, পূণ্যও মিথ্যে। সত্যি দেনা আর পাওনার মামলা। এতে একদিন না একদিন দেনদারকে হারতেই হয়। কেন জান? মূলধনের অভাব ব’লে। এই যে রাজবাড়ী, জমিদারবাড়ী, নবাববাড়ী, বাদশা-বাড়ী এ সব গেছে ওই মূলধনের অভাবে। আমরা তো সামান্য। রামরাজ্য রামের অযোধ্যা, রামের বংশ তাও গেছে, কৃষ্ণের দ্বারকা যদুবংশও, তাও গেছে। শ্ৰীকৃষ্ণ ষোল হাজার বিয়ে করেছিলেন। তাদের ছেলে নাতিদের বউ তারাও ছিল—সব নিয়ে লাখ হবে, না দশ লাখ হবে তার হিসেব বেদব্যাস দেন নি-তবে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাধের শরে দেহত্যাগ করলেন। রুক্মিণী সত্যভামা সহমৃতা হলেন—বাদবাকী যারা রইল তাদের এসে শবরেরা ব্যাধেরা ধরে নিয়ে গেল। ওদিকে সমুদ্রের বানে দ্বারকা ভেসে ডুবে গেল। দিল্লীর বাদশাদের বংশ নাকি রেঙ্গুনে দোকান করে। দিল্লীতে টাঙা চালায়। এই নিয়ম বড়-বউ। দেনা শোধ করতে হয়, পাওনা আদায় করতে পাওনাদার আসে, লাঠি মেরে আদায় করে নিয়ে যায়। এই যে একশো পঁয়ত্রিশখানা গাঁয়ের লোক, যাদের কাছে আমরা বাড়তি আদায় করেছি, তারা ছাড়বে মনে করেছ? ছাড়বে না। আদায় করে নেবে। কি করে নেবে তা জানি না, তবে নেবে। দেনার পাহাড়-সেই পাহাড়ের চূড়া হল ওই ভায়লেট। ও তোমার আর আমার মধ্যে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে পেতে হাত বাড়িয়ে পাই নে। ও এসে দাঁড়ায়।

ঠাকুমা চুপ ক’রে গেলেন। তারপর সে কি কান্না। কাঁদতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর আবার যখন কথা বলতে শুরু করলেন তখন আবার কথার গোলমাল শুরু হ’ল।

সুরেশ্বর বললে—মাঝখানে বেশ সহজ মানুষের মতই কথা বলছিলেন, কোন গোলমাল তো ছিল না। তবে হ্যাঁ, পুরনোকালের মানুষ, বাহাত্তর বছর বয়স—তাঁর কথাগুলো তোমার আমার কাছে অন্ধ সংস্কারের কথা মনে হতে পারে। সে কথা আলাদা।

এবার বললেন-নাতি, তুমি সেই বড়বাবু। সেই রূপ সেই ধরনের কথাবার্তা—চলাফেরা ঢঙ-ঢাঙ সব সেই। মেজবউ বললে তুমি বিয়ে কর নি, তুমি প্রজাদিগে দয়া করেছ; বসত সব লাখরাজ করে দিয়েছ—গো-চর ছেড়ে দিয়েছ; গোয়ানদের গোয়ানপাড়া সব শরিকের কাছে কিনে তাদের নিষ্কর করে দিয়েছ; এই তো দেনা শোধ করছ। তা ছাড়া ভাই, এই যৌবনে তুমি বিয়ে না করে বিবাগী হয়েছ।

হেসে ফেললেন। বুকে হাত দিয়ে বললেন—আমার জন্যে, বুঝেছ আমার জন্যে। কিন্তু ভাই, এ জন্মে তো হবে না। এখন মরলে আমার বিয়ের বয়েস হতে তো আরও বিশ বছর গো। এখন তো ষোল-সতেরোর কমে মেয়েদের বিয়েই হয় না। লেখাপড়া শিখতে হবে। তার পরে মনে কর তোমার সঙ্গে প্রেম করতে হবে-না কি লা মেজবউ? এমনি এমনি কি কাপড়ে-চোপড়ে মুড়ে গয়না পরিয়ে কপালে সিঁদুর ঘষে বিয়ের দিন আছে? নেই। তুমি ভাই এ জন্মটা বিয়ে না করে দেনা শোধ কর; সেই ভায়লার বংশের কেউ থাকলে তাকে তুষ্ট ক’রো ভাই, এদিকে আমি মরি। তারপর তুমি এস। তোমারও খুশী আমারও খুশী। বৈকুণ্ঠে তুমি হবে দাস আমি হব দাসী। আর আমাদের জন্ম হবে না। কেমন?

আমি কোন উত্তর দিই নি–বা দিতে পারি নি সুলতা, বুকের ভেতর কান্নার উচ্ছ্বসিত বর্ষার কাঁসাইকে বাঁধন দিয়ে কোনমতে শুনে যাচ্ছিলাম।

দেবেশ্বর রায়—রায়বংশের মনোহর পুরুষ—যদুবংশের কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠপুত্র প্রদ্যুম্ন, তাঁর স্ত্রী, রায়বাড়ীর মাণিকবউ—তাঁর এই অবস্থা! তাঁর কথা বিশ্বাস করেছিলাম কি করি নি-একথা আমাকে জিজ্ঞাসা করো না সুলতা; সে আমি বলতে পারব না। আজ তা আমি ঠিক স্মরণ করতে পারব না। তবে হ্যাঁ-এটুকু বলতে পারি একালের ধারা মত, ‘রাবিশ’ বলে কথাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হা-হা করে হেসে উল্টে পড়তে পারি নি। বলতে পারি কথাগুলো মনের মধ্যে অবিস্মরণীয় হয়ে শিলালিপির মত খোদাই করা হয়ে গিয়েছিল বুকের মধ্যে

রায়বংশের দেনার পরিমাণ জমা করলে পাহাড় হয়ে ওঠে। ভগবানের নামে বিশ্বাস নেই যে তাঁর নাম করলে শিলা বিগলিত হবে -সগরবংশ উদ্ধারের জন্য গঙ্গার ধারা নেমে এসে উদ্ধার করবে শ্যামাকান্ত চাটুজ্জেকে, সোমেশ্বর রায়কে, রাণী কাত্যায়নীকে, বীরেশ্বর রায়কে, বিমলা দেবীকে; তারপর—হ্যাঁ, রত্নেশ্বর রায়ও আছেন তাঁদের মধ্যে, নিশ্চয় আছেন; সম্ভবতঃ তাঁর পাওনাদারের সংখ্যা বেশী, রায়বাড়ীর আয়কে তিনগুণ বাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কুড়ি হাজারকে ষাট হাজারে তুলেছিলেন। দেবেশ্বর রায়, শিবেশ্বর রায়, তারপর আমার বাবা যোগেশ্বর রায় থেকে দেনা শোধ শুরু হয়েছে। অসংখ্য পাওনাদার অসংখ্য হাজারে হাজারে পাওনাদার যেন মুঠি-বাঁধা হাত তুলে তাঁদের কাছে দাবী করছে—“পাওনা শোধ করো-আমাদের পাওনা ফেলো।”

একটা কথা বিশ্বাস করো সুলতা, এইসব কথা যখন ঠাকুমা বলছিলেন তখন এসব যেন তিনি চোখে দেখছিলেন। কয়েকবার বলেও ছিলেন—ভাই, আমি দেখতে পাচ্ছি রে, আমি দেখতে পাচ্ছি! পরলোকে রায়বংশের কর্তারা হাতজোড় করে আসামীর মত দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতা, মেজদি এতক্ষণ পর্যন্ত অবাক হয়ে শুনছিলেন, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন তাঁর বড়-জায়ের মুখের দিকে। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে ছবিগুলো দেখতে চেষ্টা করছেন। আমার ঠাকুমা থামতেই তিনি ব্যাকুল হয়ে তাঁর হাত ধরে নাড়া দিয়ে ডেকে বললেন-দিদি!

তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি তো মেজবউ, মেজঠাকুরপোর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী! এ্যাঁ?

—হ্যাঁ দিদি।

সমাদর করে তাঁর মুখে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঠাকুমা বললেন—আহারে! কচি বয়েস তোর—তোর এই দশা করে দিয়ে গেল মেজবাবু? না-না-না। মেজবাবু বড় নিষ্ঠুর ছিল রে। দয়া-মায়া তার ছিল না। অন্য দোষ না থাক, মানুষকে পীড়ন আর ওই বুড়োবয়সে তোকে গরীবের মেয়ে পেয়ে বিয়ে করে শেষে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে যাওয়া বড় নিষ্ঠুরের কাজ। দিদি! অনেক কষ্ট তিনি পেয়েছেন বেঁচে থেকে। অনেক অন্যায়ও করেছেন। আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার—

বাধা দিয়ে ঠাকুমা বললেন-আমার যা করেছিল ঠাকুরপো তা আমি ক্ষমা করেছি মেজবউ। সে আমি মাফ করেছি। কিন্তু ঠাকুরপো যে বড় বেশী মিথ্যে মামলা করেছে রে! লোকের হ’রেহর্মে নিয়ে যে মনে ভারী সুখ পেত সে।

—খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর দিদি?

—তা হচ্ছে ভাই।

মেজদির চোখ থেকে জলের ধারা নেমে এসেছিল। বড় ভাল লেগেছিল আমার। হয়তো আমার কথা শুনে তুমি মনে মনে হাসছ। ভাবছ সুরেশ্বরের পাগল ঠাকুমা পটুয়াদের কাছে দেখা এবং শোনা নরকের বর্ণনা আর ছবির কথা বলে যাচ্ছেন, গ্রাম্য পুরুতের মেয়ে মেজদি-টি সেই সব কথা ধ্রুবসত্য বলে বিশ্বাস করে কাঁদছে, ভাবপ্রবণ অর্ধশিক্ষিত ধনীর দুলাল সুরেশ্বরও তাই বিশ্বাস করছে ধ্রুবসত্য বলে। এ যুগে কথাটা হাসিরই বটে, শুনলে—তুমি তো তুমি, একটা ক্লাস টেনের ছেলেও ব্যঙ্গভরে হাসবে। কিন্তু না, ঠিক তা নয়। ঠাকুমার কথায় এটা ভাবি নি যে আমিই দেবেশ্বর রায়, জন্মান্তরে আবার আমি রায়বাড়ীতে এসেছি, সুরেশ্বর রায় নাম নিয়ে জন্মের ঋণ শোধ করতে। এও বিশ্বাস করি নি যে আমার পূর্বপুরুষেরা এক অদৃশ্যলোকে কায়াহীন অস্তিত্ব নিয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন আর পঁচাত্তর হাজার থেকে এক লাখ অভিযোগকারীরা চীৎকার করে অবাঙমনসগোচর ঈশ্বর-বিচারকের কাছে দাবী জানাচ্ছে—মাটিতে পুঁতে ডালকুত্তা দিয়ে ওদের কায়াহীন সত্তার মাংস ছিঁড়ে খাওয়ানো হোক, কি ফাঁসি দেওয়া হোক, কি ফের কৃমিকীট করে পৃথিবীর কোন আবর্জনাস্তূপে ওদের জন্মান্তর নেওয়ার দণ্ড দিয়ে পাঠানো হোক।

না—তা বিশ্বাস আমি করি নি।

তবে ঠাকুমার সে বিশ্বাসকে আমি মিথ্যাও মনে করতে পারি নি। যা আমার কাছে সত্য নয় তাই যে মিথ্যা- তা আমি মনে করি নে সুলতা। তাই তোমাকে ডেকে তোমার সামনে আমি জবানবন্দী দিচ্ছি। দেখ, ইতিহাসের ধারায় উত্থান-পতনের পিছনে আছে উলঙ্গ শক্তি, তার সঙ্গে ন্যায়নীতি জুড়তে হয়, ন্যায়নীতিকে মূল্য না দিয়েও বড় বড় অধিনায়কেরা লোককে প্রতারিত করতেই সেটা করে। তার চেয়ে এক কণা বেশী মূল্য তার নেই। কিন্তু লোকে ন্যায়নীতি মানে। লোকের সঙ্গে সঙ্গে জীবন মানে। কত যুগ কত কাল কত জন্মান্তর পার হয়ে মানুষের দেহের মধ্যে জীবন এসে শুধু অমর হতেই চায় নি—আরণ্য অন্ধকারের অন্যায় থেকে ন্যায়ে ও আসতে চেয়েছে। রায়বংশের অন্যায়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েই আমি সেটেলমেন্ট উপলক্ষে কীর্তিহাট গিয়ে আর ফিরি নি। প্রথম টের পেলাম ঠাকুরদাস পালের খুনের কথা। খুন করিয়েছেন রত্নেশ্বর রায়; আর ঠাকুরদাস পালের প্রপৌত্রের কন্যা তুমি। চমকে উঠেছিলাম। এবং খুঁজতে লেগেছিলাম রায়বংশের পাপ-পুণ্যের খতিয়ানের খাতা

সে খাতাও পেয়েছিলাম। ঋণ বেরিয়েছিল বা পাপ বেরিয়েছিল অজস্র, পুঞ্জ পুঞ্জ, পিটিয়ে পিটিয়ে তাকে জমিয়ে এত ভারী তাকে করে তোলা হয়েছে যে গোটা বংশটাই তার ভারে হাঁটু ভেঙে ধুলোয় মুখ গুঁজে পড়েছে। বৃন্দাবনে ঠাকুমার মুখ থেকে যেন গোটা বংশটা আর্তনাদ করে উঠল—ঋণ শোধ করে আমাদের বাঁচাও। আমাদের বাঁচাও। আমাদের বাঁচাও!

যে সব ছবিগুলো আমি আঁকছিলাম সুলতা—সেগুলো যেন ঠাকুমার কাছে ভাষা পেয়ে কথা ক’য়ে উঠল।

পরের দিন আমি বৃন্দাবন থেকে চলে আসব, প্রণাম করে বিদায় নিতে গেলাম ঠাকুমার কাছে, মেজদির কাছে।

মেজদি’কে কিছু টাকা দিলাম-বললাম রাখ মেজদি। দেখ আমি জানি না, ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসাও করি নি-করবার সাহসও নেই যে এখানে ওঁর অধিকার কি? কি আছে ওঁদের? টাকাটা রাখ যদি কখনও কাজে লাগে!

ঠাকুমাকে প্রণাম করতে গেলাম। দেখলাম তিনি যেন অন্য মানুষ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন—তুমি আমার নাতি, সুরেশ্বর, যোগেশ্বরের ছেলে। যোগেশ্বর তাই করেছিল? তোমার মাকে দুঃখ দিয়ে ফেলে রেখে কোন একটা বিবি মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল?

বুঝলাম মেজদির কাছে শুনেছেন। চুপ ক’রে রইলাম। উত্তর কি দেব বল? হঠাৎ কপালে হাত দিয়ে তিনি বললেন—কপাল। রায়বংশের কপাল!

একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ঝরে পড়ল তাঁর বুক থেকে। বললেন-যজ্ঞেশ্বর ভায়লার বাড়ীটা কেড়ে নিয়েছিল? তুমি তাকে টাকা দিয়ে বাড়ী উদ্ধার করে-তার কে-যেন ছেলের মেয়ের মেয়ে—হ্যাঁ, তাই তো বললে—তাকে তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ? তাকে পড়ার খরচ দিচ্ছ?

এবার বললাম, দিয়েছি। অন্নপূর্ণা-মা বললেন, আর আমারও মনে হল—না দিলে অত্যন্ত অন্যায় হবে।

—হ্যাঁ ভাই। খুব অন্যায় হবে। তোমার ঠাকুরদাদা অবিকল তোমার মত দেখতে ভাই। তাঁর সব থেকে বড়-দেনা ওই ভায়লার কাছে। আমার বড়বাবু তার উপর অবিচার করেছিলেন। চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়েকে ডাকলেন, আয় একসঙ্গে দু’জনে মরি আয়। কিন্তু সে ভয় খেলে। পারলে না। বড়বাবু তো আলাদা জাতের মানুষ—তিনি গুলী খেয়ে মরতে গেলেন। গুলী খেলেন—পড়েও গেলেন। ভায়লা পালালো গোপাল ঘোষের সঙ্গে। বড়বাবু বাঁচলেন, গুলী বুকে বেঁধে নি। বেঁচে উঠে আর তাকে চোখে দেখলেন না। মেয়েটা সারাজীবন কেঁদে ম’ল; রাস্তার ঝাড়ুদারের হাতের ঝাঁটার মত অবস্থা হল। তবু বড়বাবু তাকে ভালবাসতেন। তার জন্যেই আমি তাঁর ভালবাসা পাই নি। ভায়লাকে দূর করে দিয়ে তাকে খুঁজতেই তিনি ছুটে বেরিয়ে গিয়ে কাঁসাইয়ের গর্ভে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে মারা গেলেন। ভায়লা বিষ খেয়ে ম’ল সিদ্ধাসনের জঙ্গলে। পরলোকেও মিলতে পারেন নি বড়বাবু। ওরা কিরিশ্চান তো! আঃ বড় দুঃখ! ওদের দেখো। বুঝলে!

দেখব বলে কথা দিয়েই বৃন্দাবন থেকে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম না যে ইতিমধ্যে গোয়ানপাড়া আগুন লেগে পুড়ে গেছে। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। হিলডা মারা গেছে। তার ঘরেই প্রথম আগুন লেগেছিল।

খবরটা পেলাম কলকাতায় পৌঁছে। একখানা চিঠি এসেছিল। লিখেছিল অৰ্চনা। লিখেছিল—সুরোদা, বৃন্দাবন থেকে এতদিনে ফিরেছ বোধ হয়। খুব গুরুতর ব্যাপার এখানে। একসঙ্গে তোমাকে দুখানা চিঠি লিখছি—একখানা বৃন্দাবনে, একখানা কলকাতায়। যেখানে পাও। এখানে গোয়ানদের সঙ্গে ঝগড়া চরমে উঠেছিল। এবং তার ফলও ফলে গেল। যে ঝগড়াটার জন্যে তুমি মিনতি জানিয়ে কদিন চুপচাপ থাকতে বলে গেলে সেটা চরমে উঠে গেল দিন তিনেকের মধ্যেই। আমার দুঃখ, আমার লজ্জার কারণ এক রকম বলতে গেলে আমি। কলকাতা থেকে ফেরার পর বাবার নতুন চেহারাটা দেখে গেছ—তাপও সয়েছ খানিকটা, বাবার ভয়েই ঠাকুমা বৃন্দাবন পালালেন, সে তুমিও জান, আমিও জানি। বাবার এখন সদাসর্বদাই রুদ্রমূর্তি। তার কারণ আমার টাকা। ও টাকা এখন তার মুঠোয় তিনি সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন সকলকে। আমি তোমার সঙ্গে পালালে ভাল করতাম। ওদিকে জেলখানা থেকে অতুলকাকা গোয়ানদের খবর পেয়ে ওদের বয়কট করতে অর্ডার পাঠিয়েছিলেন। তুমি যাবার পরই অর্ডারটা গোপনে জেলখানা থেকে আসে। গ্রামে খুব কড়াকড়ি হয়। গোয়ানরা মিটিং ক’রে ঠিক করে যে তারা মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। মুসলীম লীগের প্রটেকশন নেবে। বাবা এই সুযোগে ওদের এখান থেকে উঠিয়ে দিয়ে আমার টাকায় ওদের জমি কিনবার মতলবে হঠাৎ খুব কংগ্রেসী হয়ে উঠে ওদের পাড়ায় গিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে এলেন। তার দিনতিনেক পরেই রাত্রে গোয়ানপাড়ায় আগুন লাগল। গোটা পাড়াটা পুড়ে গেল—মায় গির্জের দু-পাশে রাণীগঞ্জ টালির ছাওয়ানো চাল পর্যন্ত। হিলডা পুড়ে মারা গেছে। এখানে টেনশন খুব বেশী। তুমি চিঠি পাওয়া মাত্র চলে এস, অন্ততঃ আমাকে বাঁচাও। আমি বোধ হয় মরে যাব সুরোদা। গোটা গাঁয়ের লোক এটা চাপাচ্ছে বাবা এবং জ্যেঠামশায়ের ওপর। বলছে কংগ্রেস এ করতে পারে না। এ করেছেন রায়বাবুরা। ধনেশ্বরবাবু জগদীশ্বরবাবু আর সুখেশ্বরবাবুর ছেলেরা। করেছে কমলেশ্বরের সঙ্গীসাথীরা। আমার প্রণাম নাও। ইতি অৰ্চনা।

সুলতা, সেইদিনই রওনা হলাম কীর্তিহাট।

স্টেশনে নেমে শুনলাম জগদীশ্বরকাকা নিজের বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

সুরেশ্বর বললে—রায়বাড়ীর জবানবন্দীতে পুরনো কাল শেষ হয়ে গেল সুলতা। দেবেশ্বর রায়ের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ। যারা বাংলাদেশে প্রথম ইংরিজী শিক্ষা, ইংরিজী সভ্যতা, ইংরিজী আভিজাত্য আমদানী করেছিল তাদের নাম তুমি এক এক করে স্মরণ কর কিংবা আউড়ে যাও, রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব থেকে প্রত্যেকেই জমিদারীর উপর বংশের প্রতিষ্ঠা করে গিছলেন। আবার যাঁরা শুধু দেশকে শুষেছেন, চুষেছেন রক্তপায়ী বাদুড়ের মত তাঁরাও জমিদার ছিলেন। এঁদের আভিজাত্যের কাল, এঁদের গৌরবের কাল, দাপটের কাল মোটা হিসেবে বলতে গেলে ১৯০০ সাল পর্যন্ত। ১৯০১ থেকে নতুন কাল আরম্ভ। সেটার প্রকাশ হয়েছিল ১৯০৫ সালে।

ইংরেজ শাসনে লর্ড কার্জন শেষ অপ্রতিহত-প্রতাপ ভাইসরয়। সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের মানুষের কাছে বিনা প্রতিবাদের ভারতেশ্বরী। দেবেশ্বর রায় রায়বাড়ির শেষ রাজাবাবু। বাংলাদেশে জমিদারদের অপ্রতিহত প্রতাপের কাল—নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী। ১৯০১ সাল থেকে মানুষ জাগতে শুরু করেছে। ব্যবসাদারেরা তাদের থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে; ল্যান্ড-হোল্ডারস এ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন থেকে দেশী চেম্বার অব কমার্সগুলোর দাম বেড়েছে। উকীল, ডাক্তার, মোক্তার, ব্যারিস্টার, প্রফেসরের কাল শুরু হল। দেবেশ্বর রায়ের উত্তরাধিকারী আমার জেঠামশায় যজ্ঞেশ্বর রায় হয়েছিলেন কলিয়ারী প্রোপ্রাইটার—মস্তবড় খনিমালিক। বাবা হয়েছিলেন জার্নালিস্ট।

একটু চুপ ক’রে থেকে সুরেশ্বর বললে—মানুষ কাল তৈরী করে, না কাল মানুষ তৈরী করে? হয়তো বা দুটোই সত্যি। নাইনটিনথ্ সেঞ্চুরীতে বীরেশ্বর রত্নেশ্বর দেবেশ্বর রায়দের মত জমিদার অনেক ছিল। এঁদের থেকে উন্নত আর বেশী কেউ ছিল না। থাকবার মধ্যে একটা আধটা ঠাকুরবাড়ীর মত বাড়ি—মানুষের মধ্যে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মত মানুষ ছিলেন জমিদারদের মধ্যে।

বলতে গেলে রায়বাড়ীর জবানবন্দী এখানেই শেষ। কারণ তার পরের কথা—আমার বাবার কথা, যোগেশ্বর রায়ের কথা, এ শুধু তোমারই জানা কথা নয়, হয়তো এ কালের সকলের জানা কথা। আমার জ্যাঠামশায়ের কথা হয়তো তুমি জান না, কিন্তু বাংলাদেশের যারা বাঙালী ব্যবসাদারদের কথা জানে, তারা যজ্ঞেশ্বর রায়ের কথাও জানে। তার কথা জানলেই বাঙালী ব্যবসাদারের কথা জানা হয়ে যাবে। কিন্তু সেসব কথা থাক সুলতা, দেবেশ্বর রায় পর্বের শেষ কথাটা বলে নিই। সেটা আমিও জানতাম না।

শেষ কথা, দেবেশ্বর রায়ের পাগল স্ত্রীর বৃন্দাবনে নির্বাসন। নির্বাসন দিলেন কে জান? দিলেন শিবেশ্বর রায় এবং যজ্ঞেশ্বর রায়। এবং নীরবে মাথা নত করে দেখলেন আমার বাবা বাংলাদেশের বিখ্যাত জার্নালিস্ট যোগেশ্বর রায়।

আমি কথাটা আবছা-আবছা শুনেছিলাম। কিন্তু কখনো জিজ্ঞাসা করে ভালভাবে জেনে নিতে সাহস হয় নি। জিজ্ঞাসা করব কাকে? ছেলেবেলা থেকে শুনতাম ঠাকুমা থাকেন বৃন্দাবনে বাবার কোন ব্যগ্রতা দেখি নি কোন দিন মায়ের জন্যে। মায়ের কাছেও তাঁর কথা কিছু শুনি নি। বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে পত্র দিয়ে থাকলে জানবাজারের বাড়ীর ম্যানেজার দিয়ে থাকবেন। তিনি পেয়ে থাকলেও কোন উত্তর দেন নি।

তবে চাপা একটা কথা শুনতাম—ঠাকুমা একবস্ত্রে বাড়ী থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন বৃন্দাবন। তিনি নাকি স্বামীর মৃত্যুর পর উন্মাদ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। লোকে বলে গোয়ানদের পাড়ায় গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কেউ বলত, তাদের বাড়ীতে নাকি খেয়েছিলেন। কথাগুলো এলোমেলো কথা। যার জন্য এ বাড়ীর সঙ্গে, তাঁর নিজের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর সব সম্পর্ক চুকে গেছে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *