১৩
গভর্নমেন্টের দরবারে রায়বাহাদুর হলে কি হয়, কীর্তিহাটের রত্নেশ্বর রায় রাজা। তাঁর বড় নাতির বিবাহ। উৎসব হয়েছিল বিরাট। বিপুল সমারোহ। আলোতে, বাজীতে, বাজনায়, দানে ধ্যানে রাজসূয় ব্যাপার, খাওয়ানো- দাওয়ানোতে চর্ব্যচূষ্য-লেহ্যপেয় ব্যবস্থা। ক্রমাগত দানে-ধ্যানে খাওয়ানো-দাওয়ানোতে অষ্টাহব্যাপী নাচ, গান, যাত্রা, থিয়েটার নিয়ে এলাহি কাণ্ড। অবশ্য পোষ্যপুত্র হিসেবে রত্নেশ্বরের গদিতে চড়ার সময়ের মত নয়। কিন্তু দেবেশ্বর চতুর্থ দিনে বউভাতের পরই চলে এসেছিলেন।
আসবার সময় স্ত্রীকে বলেছিলেন—আমার সঙ্গে চল।
স্ত্রী বলেছিলেন—ওরে বাপ রে, সে কি করে হবে গো! শ্বশুর কি মনে করবেন? তাছাড়া আমার ঠাকুর? ওঁকে ছেড়ে তো থাকতে পারব না আমি।
—আমাকে পেয়েও থাকতে পারবে না?
—তা কি করে পারব? অভ্যেস তো নেই।
—আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাব।
—তা নিয়ে যেও না, আমি ভয়ে মরে যাব।
—না, ভয় লাগবে না। আমাকে দেখে তোমার ভয় করে?
—না। কিন্তু তবু পারব না। ওগো, দয়া করে আমাকে নিয়ে যেও না। আমি যেমন এখানে গোবিন্দজীকে নিয়ে আছি, তেমনি থাকতে দাও। আমি মরে যাব।
তবুও হয়তো জোর করে তাকে নিয়ে আসতেন দেবেশ্বর; তাঁর সংসার হতে অবজ্ঞাতা স্ত্রীকে ফিরে পেতে তাঁর আকাঙ্ক্ষা হয়েছিল, কিন্তু রায়বাহাদুর পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বললেন—তা তো পারব না দেবেশ্বর। এই কুটুম্ব-স্বজন থাকতে থাকতে বড়বউমা যাবেন, এ তো হয় না। লোকে কি বলবে? তোমার না হয় কাজের ছুতো আছে। তোমার উপরে আমি আছি। ছেলের বিয়ের সব ভার আমার উপর দিয়ে যাচ্ছ—হল, মানালো। কিন্তু তোমার মা নেই, বড়বউমা যাবেন কি বলে?
চুপ করে রইলেন দেবেশ্বর। একটু পর বললেন—আমি ফিরে আসব নিতে? চুকে গেলে পর? এমন কি আমি থেকেও যেতে পারি।
একটু চুপ করে থেকে রত্নেশ্বর রায় বলেছিলেন-তুমি থাকলে আমি খুব খুশী হব এবং তোমার কল্যাণ হবে। হয়তো তোমার সঙ্গে তোমার বাপের এবং ছেলের সঙ্গে একটা আপোস হতে পারে। কিন্তু বউমাকে পাঠাবই এ বলতে পারব না। বউমাকে নিয়ে আমি ফিরে এসেছি। বউমার মাথার গোলমাল হয়েছে বলে লোকে কিন্তু আমি জানি উনি গোবিন্দকে সেবা করে সিদ্ধি পেতে চলেছেন। দেরী নেই। তাঁকে তো পাঠাতে পারব না।
দেবেশ্বর বলেছিলেন—তাহলে আমি চলে যাই।
—থাকতে যখন পার, তখন থাকাটাই ভাল নয় কি? তোমার তো অসুবিধা কিছু ঘটছে না। একরকম গুরুর আদরেই তো রাখা হয়েছে। অসুবিধা কিছু ঘটছে তো বল।
মুখ লাল হয়ে উঠেছিল দেবেশ্বরের। এবার তিনি বলেছিলেন—কিছু অসুবিধা আছে। সেটা ইচ্ছে করলেও দূর করতে পারবেন না। সমাগত প্রজাসজ্জনদের প্রহার দেখছি, দেখে যে কষ্ট পাচ্ছি, তা ঠিক সহ্য করা সম্ভবপর নয়।
—মানে?
—মানে, শুনেছি সমস্ত মহালে নাতির বিয়েতে চাঁদা মাথট নিয়েছেন টাকায় চার আনা। তার উপর তাদের নিমন্ত্রণ করে এনে বউমাকে এবং যজ্ঞেশ্বরকে নাটমন্দিরে বসিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে নজরানা আদায় করলেন। আপনার অর্থের অভাব ছিল না, তবু করলেন। এটা ঠিক আমি—!
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় নি সুলতা, কীর্তিহাট থেকে ফিরে শুধু যোগেশ্বরকে নিয়েই কলকাতা এসে ছদ্মনাম দিয়ে একখানা চিঠি তিনি লিখেছিলেন, সেটা বেরিয়েছিল ইংলিশম্যানে। হেডিং ছিল—“দি ড্রেন্স্ অব দি সোসাইটি”। ছদ্মনামটা জানতেন রত্নেশ্বর রায়।
***
এরপর আর পিতাপুত্রে দেখা হয় নি। দেবেশ্বর রায় তাঁর মৃতদেহ দেখেছিলেন।
১৯০০ সাল। নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি শেষ করে টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরিতে পৌঁছেই মারা গেলেন রত্নেশ্বর রায়। খামখেয়ালী দেবেশ্বর রায় এই চার বছরে একটা নতুন পথ ধরেছিলেন। বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বরকে ডেকে কয়লার ব্যবসাতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এবং নিজে ধীরে ধীরে সরে এসে খানিকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন; সেতার, এসরাজ নিয়ে গান গেয়ে কাটাতেন, কিছুটা পলিটিক্স করেছেন; আর একখানা ভাল কাগজ করবার কল্পনা করেছেন। জীবনে যেন একটা অস্থিরতার মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। অস্থির মানুষ চিরকাল। নিত্য প্রতিমুহূর্তে যেখানে মানুষ বদলায়, সেখানে স্থির কি বা কে বল—সুলতা। তবে কিছু কিছু মানুষের অস্থিরতা বড় প্রকট, বড় স্পষ্ট ধরা পড়ে। দেবেশ্বর রায়ের এই সময়ের অস্থিরতা যেন সেই রকম। নইলে ভাবতে পার সুলতা, দেবেশ্বর রায় দক্ষিণেশ্বর যান, বেলুড় মঠে যান! নতুন করে সংস্কৃত পড়েন! কিছুদিন মদ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছোট ছেলেকে আমার বাবা যোগেশ্বর রায়কে অহরহ সঙ্গে রাখতেন। আমার বাবা তখন এন্ট্রান্স, এফ-এ পাস করে বি-এ পড়ছেন প্রেসিডেন্সী কলেজে। সবই কিছুদিনের জন্যে। কিছুদিন পর আবার পুরনো দেবেশ্বর রায়। মদের নেশায় গালে, কপালে লালচে আভা ফুটে ওঠে—চোখ লালচে এবং অর্ধ-নিমীলিত হয়, মৃদু মৃদু হাসেন অথবা ঠোঁট দুটো মিলে ধনুকের মত ব্যঙ্গে বেঁকে যায়। বাড়ী ছেড়ে বাগানে গিয়ে বাসা গাড়তেন।
কারণ একটা ঘটেছিল, ভায়লেট পিদ্রুসের ছেলে, যাকে এলিয়ট রোডের বাড়ী দান করেছিলেন, যে রয় এ্যান্ড চক্রবর্তী কোম্পানীতে চাকরি করত, সে মারা গেছে। ভায়লা মদ খেয়ে খেয়ে দুর্দান্ত মাতাল হয়ে পড়েছিল, ছেলের মৃত্যুর পর সে মধ্যে মধ্যে এসে এই বাড়ীর ফটকে এসে চেঁচাতো।
—‘রয়বাবু! রয়বাবু!’
তার কণ্ঠস্বর কানে এলেই দেবেশ্বর চীৎকার করতেন—দারোয়ান, নিকাল দো, নিকাল দো You get out—I say. Shut the gate. দারোয়ান। তারপরই চলে যেতেন বাগানবাড়ি।
এরই মধ্যে ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে কীর্তিহাটের লোক এল চিঠি নিয়ে।
লিখেছেন শিবেশ্বর- “ বাবামহাশয়ের কঠিন অসুখ, পত্রপাঠ আপনি চলিয়া আসিবেন। আপনার নাম করিয়া জ্ঞান হারাইয়াছেন। কলিকাতা লইয়া যাইবার অবস্থা নাই। একজন বড় ডাক্তার লইয়া আসিবেন। গোয়াবাগানে রামেশ্বরকে পত্র দিলাম। বিডন স্ট্রীটে যজ্ঞেশ্বরের নূতন বাটীতেও পত্র গেল। সকলকে লইয়া পত্রপাঠ চলিয়া আসিতে অন্যমত করিবেন না। এবং ইহা যেভাবে ঘটিল, তাহা অতীব দুঃখের কথা, আক্ষেপের কথা। বাবামহাশয় লাট ভবানন্দবাটীর কাছারীতে সেখানকার পুলবন্দী সম্পর্কে চাঁদা ধার্য করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে প্রজাদের সহিত মতান্তর ঘটে, প্রজারা সম্মুখে কিছু বলিতে পারে না কিন্তু শীতকালের রাত্রিকালে কাছারীঘরের চালে অগ্নিসংযোগ করে। ভাগ্যক্রমে বাবামহাশয় নিরাপদে বাহিরে আসেন বটে কিন্তু শীতরাত্রে ঠাণ্ডায় জ্বরভাব হয়। সেই জ্বরভাব লইয়াই তিনি রাগ করিয়া কীর্তিহাট আসিয়াছিলেন; প্রথমে সকলেই অনুমান করিয়াছিলেন যে শীঘ্রই সারিয়া যাইবে। কিন্তু হঠাৎ জ্বর প্রবলাকার ধারণ করিয়াছে।
পুঃ—হরিশ মুখার্জি রোডে অন্নপূর্ণাপিসীমাকে চিঠি দিলাম।”
বিচিত্র সংঘটন, তখন দেবেশ্বর মধুপুরে গেছেন। কলকাতায় নেই। যোগেশ্বর নিজে মধুপুর গিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে এনে হাওড়ায় গাড়ী বদল করে কীর্তিহাটে গিয়ে যখন পৌঁছুলেন তখন রত্নেশ্বর রায় রায়বাহাদুর, কীর্তিহাটের রাজা—দুষ্টের দমনকর্তা, শিষ্টের শাসক, বহুকীর্তিতে কীর্তিমান আর বেঁচে নেই, সকালবেলা মারা গেছেন, শবদেহ নাটমন্দিরে মা-কালীর সম্মুখে রাখা হয়েছে। সকলে অপেক্ষা করে রয়েছেন বড়বাবুর, দেবেশ্বর রায়ের। টেলিগ্রাম এসেছে দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছুবেন, স্টেশনে ষোল বেহারার দুখানা পাল্কী রাখা হয়েছে।
দেবেশ্বর রায় বেহারাদের বলেছিলেন—মুখ বন্ধ করে যাবি।
—হুজুর, আগের লোকে পথের হাল বলে না দিলে পিছেকার বেহারারা। চুপ করে গিয়েছিল তারা বড়বাবুর মুখ দেখে।
দেবেশ্বর তাদের বক্তব্য বুঝেছিলেন, আগের বেহারারা পথের অবস্থা না বলে দিলে পিছনের বেহারারা ঠিক চলতে পারবে না। তাদের সামনেটা তো বন্ধ। তিনি বলেছিলেন, তাহলে ‘প্লো হি—হি প্লো’ হাঁকটা হাঁকবিনে।
শবদেহের পায়ের তলায় বসে দেবেশ্বর রায় গভীর স্বরে বারকয়েক ডাকলেন বাবা! বাবা! বাবা!—
ডাকতে ডাকতে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ছেলেমানুষের মত কেঁদেছিলেন বাবার পায়ের উপর মাথা রেখে।
কেউ সান্ত্বনা দিতে পারে নি। দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী উমা দেবী। তিনি সেদিন দশখানা গ্রামের লোকের সামনে স্বামীর দুই কাঁধ ধরে ডেকে বলেছিলেন—ওঠো। বড়বাবু—বড়বাবু ওঠো! ওগো, বাবা তোমাকে ক্ষমা করে গেছেন। শোন শোন, আমাকে নিজে মুখে বলে গেছেন। নিজে চিঠি লিখে দিয়ে গেছেন তোমাকে দিতে। ওঠো। আমার দিকে চেয়ে দেখ; তোমার তো অনেক আছে গো, আমার কেবল তুমি, তুমি তাও আমাকে দাও নি। বাবা আমাকে বলতেন, ভয় কি! আমার দিকে চাও। ওঠো। বাবার শেষ কাজ করে এস। এই চিঠিখানা নাও।
চিঠিখানায় ছেলেকে শুধু ক্ষমা করেই যান নি রত্নেশ্বর রায়, ছেলের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। আরও লিখেছিলেন-হয়তো তোমার কথাই ঠিক। মাতামহ শ্যামাকান্তের অভিশাপ লইয়া যে বিশ্বাসটা আমাদের বংশে একটা ভীতির সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা হয়তো একটা সংস্কার। তাহা ক্রিয়া করিয়াছে। সম্পদের শক্তির অফুরন্ত তৈলে প্ৰজ্বলিত অগ্নি দাউ-দাউ করিয়া জ্বলিয়াছে, তাহাকে আমরা অন্যরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছি। যাই হোক, ব্যাপারটা মানুষের পক্ষে অপমানকর বটে। পাপ তো বটে। এই পাপচক্র চক্রান্ত সৃষ্টি করিয়া বংশকে পঙ্গু করিতেছে। তুমি ইহা পরিত্যাগ কর। বধূমাতাকে সমাদর কর। জীবনের স্বাদ পাইবে। শান্তি পাইবে। কল্যাণ হইবে। পিতৃবাক্য অবহেলা করিয়ো না। ভায়লেটের মাসিক বৃত্তি এবং তাহার পুত্রের যে কন্যাটি আছে, তাহার খরচ যেন বন্ধ না হয়।
পরিশেষে লিখেছিলেন—তুমি মদ্যপানে অভ্যস্ত। অশৌচ অবস্থায় মদ্যপান না করিলে হয়তো স্বাস্থ্যভঙ্গ হইতে পারে। আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম।
বিচিত্র বিষণ্ণ একটি হাসি তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল।
সুরেশ্বর বললে-এটা অবশ্য আমার কল্পনা, সুলতা। ওই দেখ সেই ছবিখানা। এই দেখ—দেবেশ্বরের মুখে সেই বিষণ্ণ বিচিত্র হাসি। প্যানেলে দেখ, বাঁদিকটা কালো অন্ধকারে ঢাকা হতে হতে ফিকে হয়ে লাল হয়েছে, রাত্রির পর প্রভাত হবে, সূর্যোদয় হয় নি, লালচে আভার সবটাই এসে পড়েছে দেবেশ্বরের মুখে। কালো অন্ধকারের মধ্যে নির্বাপিত রত্নেশ্বর রায়ের চিতা। নাইনটিনথ সেঞ্চুরি শেষ হয়ে গেল। দেবেশ্বর নাইনটিয়েথ সেঞ্চুরির শেষকৃত্য করে দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছেন। সামনেটা টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরির একশো বছর। দেবেশ্বরের হাতে তুলি—তিনি রায়বংশে তাঁর জীবনশিল্পের পত্তন করতে চাচ্ছেন। হাতের তুলি কাঁপছে।
অজ্ঞান হয়ে পড়বার আগে পর্যন্ত রায়বাহাদুর ডায়রী লিখে গেছেন। শেষ কদিনের ডায়রি অদ্ভুত সুলতা। আশ্চর্য লাগে আমার।
যেদিন রাত্রে কাছারীতে আগুন লাগল, তার আগের দিন হতে প্রজারা কাছারী আসা বন্ধ করেছিল। ব্যাপারটা পুলবন্দীর চাঁদা। নদীর ধারে ধারে বন্যা নিবারণের বাঁধ হবে- সরকার সিকি দেবেন, প্রজা সিকি দেবে, জমিদার দেবেন অর্ধেক এই নিয়ম। রায়বাহাদুর বলেছেন প্রজা অর্ধেক দেবে। টাকাটা চাঁদা হিসেবে তিনি আদায় নেবেন। প্রজারা বলেছে-এই সেদিন হুজুরের পৌত্রের বিয়েতে আমরা টাকায় সিকি চাঁদা দিয়েছি আর আমরা দিতে পারব না। কয়েকদিন পর বললে—দেব না। সেটা অবশ্য তাঁর সামনে নয়। গ্রামে বাইরে বাইরে। রায়বাহাদুর ডেকে প্রশ্ন করলেন—এইরকম কথা শুনছি। এ সত্যি?
কেউ উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। কিন্তু এর উত্তর না দিলে ছুটি নেই। রায়বাহাদুর উঠতে দিলেন না কাউকে।
শেষে তারা বললে—আজকের দিনটা সময় দিতে আজ্ঞে হয় হুজুর, কাল দিব উত্তর। খানিক শলাপরামর্শ করি।
ছুটি দিলেন রায়বাহাদুর। ডায়রীতে শেষ লাইন লিখেছেন—“দিনে দিনে দেশকালে কি হইতেছে? প্রজারা এই ধরনের বেয়াদপি করিতে সাহস করে!”
পরদিন সকাল থেকে গ্রামের সমস্ত পুরুষেরা অনুপস্থিত। কেউ বাড়ী নেই। সকালবেলা জল খেয়ে তাদের আসবার কথা ছিল, কিন্তু কেউ এল না। ডিসেম্বর মাস, ভরাভর্তি ধান কাটার সময়, লাট ভবানন্দবাটীর চারখানা মৌজা নদীর ধারে তার কোন গ্রামের মাঠে একটি লোক নেই। সোনার বর্ণ পাকা ধানে ভরা মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখী উড়ছে, শীতের উত্তুরে বাতাসে রৌদ্রের সঙ্গে রাত্রের শিশিরভেজা নরম ধান, শুকিয়ে উঠছে সঙ্গে সঙ্গে, গোটা মাঠ জুড়ে একটা মুড়মুড় মুড়মুড় শব্দ উঠছে।
সেইদিনই রায়বাহাদুরের হুকুমে সমস্ত গ্রামের গরু-বাছুর, ছাগল-ভেড়া ঘরে বন্ধ রইল। ঘর থেকে বের হতে পেলো না। রাখালেরা ফিরে গেল। গ্রামের রাস্তা সরকারী খাসপতিত, জমিদারের জমি, সেখানে বের হতে দেবেন না রায়বাহাদুর। বন্ধ করলেন না পানীয় জল সরকারী পুকুর থেকে। স্নান বন্ধ হল সরকারী পুকুরে। সন্ধ্যেবেলা ঢেঁড়া পড়ল—“কাল সকালবেলা এক প্রহরের মধ্যে প্রত্যেক প্রজাকে কাছারীতে হাজির হবার জন্য হুকুমজারী করা হচ্ছে। যে প্রজা হাজির না হবে, তার সরকারী জমি, পুষ্করিণী এবং গাছপালা যা সরকারী পতিতের উপর থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারের সুবিধা ইত্যাদি বাতিল করা হবে।”
এর পরিণাম অতি ভয়ানক সুলতা। এ যে না দেখেছে সে বুঝবে না। গরু-বাছুর পথে বের হলে খোঁয়াড়ে যায়, ইচ্ছে করলে বউ-বেটী মেয়েছেলে পথে বের হলে ট্রেসপাসার হত সেকালে। পাকা ফসল মাঠে থাকত, মিলিয়ে যেত। আরও অনেক কিছু হত। তার মধ্যে ঘরে আগুন, লাঠিবাজী, ফৌজদারী কি নেই সুলতা। এসব হল আইনসম্মত শাসনবিধি। কিন্তু ততদূর অগ্রসর হতে পারেন নি রত্নেশ্বর রায়। তিনি জানতেন না যে, কাল তাঁর অজ্ঞাতসারে আরও অনেক এগিয়ে গেছে। প্রজাদের সেই কালই সেই রাত্রেই বোধ হয় খুঁচিয়ে জাগিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল—“যা, তার চেয়ে আজ রাত্রি পোয়াবার আগেই কাছারীতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দে। জমিদার বুঝুক তোরাও লড়তে পারিস।”
রত্নেশ্বর রায় তাঁর সেদিনের ডায়রীতে লিখেছেন—রাত্রিতে কাছারীতে আগুন লাগিল। শীতের রাত্রি, প্রথমটা বুঝিতে পারি নাই। পরে যখন লোক-লস্করের হাঁকাহাঁকিতে ঘুম ভাঙিল, তখন তাড়াতাড়ি ঘর খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলাম ঘরখানা জ্বলিতেছে। আমি স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। তৎপর ক্রুদ্ধ হইলাম। দেখিতে দেখিতে মনে পড়িল আর একবার জমিদার দে-সরকার আমাকে ঘরে শিকল দিয়া প্রজা হিসাবে পুড়াইয়া মারিতে চাহিয়াছিল। রক্ষা করিয়াছিল ঠাকুরদাস। ঠাকুরদাসের কথা মনে করিয়া অনুশোচনা হইল। কাঁদিলাম। তাহার পর মনোমধ্যে চিন্তান্তরে উপনীত হইলাম। এবং চমৎকৃত হইয়া গেলাম। এবার প্রজারা জমিদারকে ঘরে আগুন লাগাইয়া পুড়াইয়া মারিতে চাহিতেছে। আমার মত জমিদারকেও গ্রাহ্য করিল না। কাল কি এতই বদল হইয়া গেল? ইহার পর? ভবিষ্যতে কি হইবে? জমিদারবর্গের সাবধান হইবার সময় আসিয়াছে! আমি চিন্তিত হইতেছি রায়বংশের জন্য। আমার অন্তে মদীয় পুত্রদের কি দশা হইবেক? দেবেশ্বর একসঙ্গে আমীর মেজাজের এবং সাহেবী মেজাজের লোক। প্রজাদের সে ঘৃণাও করে, তাহাদের দয়াও করে। শিবেশ্বর মামলাবাজ এবং শক্তি না থাকা সত্ত্বেও জবরদস্ত জমিদার হইতে চায়। রামেশ্বর কলিকাতাবিলাসী ব্রাহ্মঘেঁষা একটা অপদার্থ বিলাসী। যজ্ঞেশ্বরের সম্বন্ধে আশা করিয়াছিলাম, সে বিবাহ করিয়া শ্বশুরদের সংস্রবে কয়লা ব্যবসায়ী হইয়া গেল। কি করিব অদ্য হইতে তাহাই চিন্তা হইল।
সে-চিন্তার মীমাংসার পূর্বেই তিনি অজ্ঞান হয়ে মারা গিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
লোকে বলেছিল—ইন্দ্রপাত হয়ে গেল।
***
দেবেশ্বর মুখাগ্নি করে বাড়ী ফিরে কম্বলের শয্যায় বসে ভাইদের বলেছিলেন—আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। শিবেশ্বর ভেবেছিলেন, বড় ভাই মদ খাবেন। বাপ অনুমতি দিয়ে গেছেন তাঁর শেষ চিঠিতে। চাকরদের তিনি ডেকে বলেই গিয়েছিলেন—বড়বাবুকে মাল দিবি কিন্তু যেন বেশী দিসনে। আর দোহাই বাবা, অখাদ্য-কুখাদ্য যা খায়টায় এর সঙ্গে, ধর না মুর্গীর ডিম-ফিম সেগুলো যেন চাইলেও দিসনে। অন্ততঃ হুকুম করলে বড়মাকে ডেকে দিস। না—বড়মা কি করবে—আমাকে ডেকে দিস অন্তত। খবরটা দিস, বুঝলি!
চাকর তাঁর খাসচাকর নিমাই দাস; কলকাতার মতোই ট্রে-তে করে বোতল-গ্লাস-সোডা এনে নামিয়ে দিলে।
তাকিয়ে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল তাঁর। নিমাই চাকর তাঁর নিজের তালিম দেওয়া চাকর। সে তাঁর চাউনির অর্থ বোঝে, কথা বলবার জন্যে মুখ খুললে জানতে পারে এবার কিসের হুকুম হবে। সে তাঁর কোঁচকানো ভুরুর দিকে তাকিয়ে সভয়ে বললে-আজ্ঞে মেজবাবু বললেন; কথাটা অসমাপ্ত রেখে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দেবেশ্বর বলেছিলেন—নিয়ে যা। ও আর খাব না। আর কোনদিন আনবিনে সামনে। শোন। যদিই ভুলে গিয়ে আনতে বলি, তবে তুই মনে করিয়ে দিস। যা মানিকবউকে বল—এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে আসবে। অশৌচের সময় তোর হাতে জল পর্যন্ত খেতে পারব না, বুঝলি!
মানিকবউ অর্থাৎ উমা দেবী জলের গ্লাস নিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন–বাবা তো বলে গিছলেন খেতে তোমাকে। ফিরিয়ে দিলে কেন?
দেবেশ্বর বলেছিলেন—আর কখনও খাব না বলে।
—খাবে না? অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন উমা দেবী স্বামীর মুখের দিকে।—আর কখনও খাবে না?
—না।
—তোমাকে আমি বুঝতে পারি না। ভারী ভয় করে।
—বসো।
—বসবার কি উপায় আছে? যাই দেখি, গোবিন্দমন্দিরের কাজকর্ম আমি করি তো, এবার কাউকে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে করাতে হবে।
—কেন? সেবার যজ্ঞেশ্বরের বিয়ের সময় চব্বিশ ঘণ্টা তো আমার কাছেই থাকতে। মুর্গীর ডিম পর্যন্ত নেড়েছ—
—সেবার গোবিন্দ বলেছিলেন।
—এবার?
—না। এবার তো বলেন নি। বরং মুখ শুকিয়ে গেছে গোবিন্দর, বলছেন—বাবা চলে গেলেন আর কি আমার সেই যত্ন করবে এরা মানিকবউ? তুমি একটু দেখো। বাবাও বলে গেছেন। কি করব বল?
অকস্মাৎ ফেটে পড়েছিলেন দেবেশ্বর। তা হ’লে আমি কাকে নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলে থাকব বলতে পার?
বিব্রত হয়ে মানিকবউ বলেছিলেন—এ কি বিপদে পড়লাম মা! আমাকে নিয়ে কি করবে তুমি? না-না-না। তোমার অনেক আছে। বই আছে, গান আছে, তারপরে লোক আছে জন আছে, বিষয় আছে, ব্যাপার আছে, আমার যে গোবিন্দ ছাড়া আর কেউ নেই
—না—আমি আছি। আর আমি ওসব চাইনে, আমি তোমাকে চাই। তুমি বসো। যেতে পাবে না তুমি।
—না–না-না। তোমাকে আমার ভয় করে। আর আমি যে আমাকে গোবিন্দকে সঁপে দিয়েছি। তোমাকেই দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তো নিলে না। পায়ের তলায় পড়ে কাঁদতাম—কই একদিনও তো দেখ নি। বাবা টেনে এনে এখানে গোবিন্দের হাতে দিয়ে বলেছিলেন—মা, ওই ওঁর পায়ে নিজেকে ঢেলে দাও। কি করব মা! অপরাধ আমার। বিয়ে তো ও করে নি, আমি জোর করে দিয়েছি। আমি তাই আছি। সেবার গোবিন্দ বলেছিলেন—আমি বিবিমহলে তোমার সেবা করেছিলাম। এবার তো বলেন নি। আমি পারব না।
ঠিক এই মুহূর্তেই দুই ভাই এবং ম্যানেজার এত্তেলা পাঠিয়েছিলেন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলতে তাঁরা আসছেন।
শ্রাদ্ধের কথা প্রায় বাঁধা কথা ছিল সেকালে। দশ দিনে তিলকাঞ্চন সেরে রেখে ছ-মাসে সপিণ্ডীকরণের সময়ে দানসাগর। কিন্তু কথা তা ছাড়াও ছিল। সম্পত্তির কথা। তা ছাড়া আরও একটা বড় কথা তুলেছিলেন শিবেশ্বর। হয়তো সেইটেই রায়বংশের ভবিতব্যের কথা
শ্রাদ্ধ দানসাগর ছ’মাসে নয়-দশ দিনেই করার কথা হয়েছিল। রামেশ্বর ব্যারিস্টারী পড়তে বিলেত যাবেন। অনুমতি রত্নেশ্বর দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে, প্রয়োজন অনুভব করছিলেন রায়বংশের কারুর বিলেত অন্তত যাওয়া প্রয়োজন, নইলে যেন রায়বংশের সম্মান খর্ব হচ্ছে।
বিষয় তিন ভাগ করে দিয়েই গিয়েছিলেন রত্নেশ্বর রায়। বড় ছেলেকে ছ আনা দিয়ে গিয়েছিলেন পৌত্রদের কাছে প্রতিশ্রুতি মত। এবং নতুন প্রভিশন করে গিয়েছিলেন, তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তি যা পুত্রেরা পাবে তা থেকে তাঁরা তাঁদের পুত্রদের এক ধর্মান্তর গ্রহণ ছাড়া অন্য কোন কারণেই বঞ্চিত করতে পারবেন না। সেই মতই ব্যবস্থা হয়েছিল। আদায়পত্র একত্রে হবে। শিবেশ্বর দেখাশুনা করবেন, তার জন্য একটা মাসোহারা পাবেন। মাসে আড়াইশো টাকা, বছরে তিন হাজার।
এর পরই শিবেশ্বর সেই কথা তুলেছিলেন, বাবাকে লাট ভবানন্দবাটীর প্রজারা একরকম পুড়িয়েই মেরেছে। ঘরে আগুন দিয়েছিল। শিকল- তালাও দিয়েছিল। জানালা ভেঙে তিনি বেরিয়েছিলেন। সেই অবস্থায় ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে মরার সঙ্গে পুড়ে মরার তফাৎ কতটুকু। আমি বলি এ পুড়ে-পুড়ে মরাই হয়েছে তাঁর। এর প্রতিকার কি হবে?
সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। উত্তর চট্ ক’রে কেউ দিতে পারেন নি।
কিছুক্ষণ পর দেবেশ্বর বলেছিলেন—বাবা কি করতে চেয়েছিলেন?
—তিনি ঠিক কিছু করেন নি। তবে—
—তবে কি?
—ভাবছিলেন দেওয়ানীর পথে যাবেন, না ফৌজদারীর পথে যাবেন।
ম্যানেজার বললেন-ফৌজদারীর পথে একালে হাঙ্গামা অনেক, সে থানা থেকে ওপর পর্যন্ত মুখ চাপা দিতে দিতে অনেক বেগ পেতে হয়। তার ওপর কাল এমন পড়েছে যে, প্রজার দোষ এ দেখবেই না লোকে, কিছু হলে আগেভাগেই জমিদারকে দায়ী ক’রে ব’সে থাকবে। শিবেশ্বর বলেছিলেন—তা ব’লে ভয় ক’রে ব’সে থাকলে দুদিন পর তারা মাথার উপর দিয়ে চলতে শুরু করবে। জমিদারী হয়তো ছেড়ে দিতে হবে।
দেবেশ্বর এবার বলেছিলেন—বাবা ভাবছিলেন কোন্ পথে যাবেন। আমাদের পথের ভাবনা নেই, পথ আমাদের একটি; বাবার মৃত্যুর শোধ। বাবা দেওয়ানীর পথে অবাধ্য দুর্দান্ত প্রজাকে শাসন করবার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু আমরা সে ভাবব কি করে? শোধ তুলতে হলে এ চক্র যারা ক’রেছিল তার লীডার যে তার মাথাটা নিতে হবে। না হলে পিছন থেকে সাপের মত কামড়ে বিষ ঢেলে লুকিয়ে পড়ার মধ্যে আমি নেই। তবে হ্যাঁ, বাবা যদি ক্ষমা করে যেতেন তাহলে আমরা চুপ ক’রে থাকতে পারতাম। অথবা এখনও যদি সে এসে গড়িয়ে পড়ে মাথাটা লুটিয়ে দেয় তবে গলায় খাঁড়া ঠেকিয়ে আমরা ক্ষমা করতে পারি। এই আমার মত। সেইটে হলে আমি খুশী হই। খুন হলে লোকে বলবে—রায়বাহাদুরকে এমন অপমান বা দুর্দশা কিছু করেছিল যার জন্যে খুন না করে ছেলেদের ঝাল মেটে নি।
* * *
রায়বাড়ীতে ওই সর্বনেশে মামলা ঢুকল সুলতা। এবার মামলা একতরফা নয়। এবার মামলায় প্রতিপক্ষ দাঁড়াল। প্রজারা লড়াই দিলে। ফৌজদারীতে মাঠে লড়াই হল, পথে হল, মোড়ল লোকটা খুন হ’ল, মামলা চলল একটার পর একটা। এক বছর ব’সে রইলেন দেবেশ্বর কীর্তিহাটে। শুধু এই জন্যেই বসে রইলেন। কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। মদ সেই ছেড়েছিলেন আর খান নি। জমিদারী নতুন ধাঁচে ঢালতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে শিবেশ্বরের সঙ্গে বিরোধ বাধল, তার সঙ্গে যোগ দিলেন বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বর। তিনি তখন কলকাতায় ব্যবসা দেখেন শ্বশুরের সঙ্গে। অপবাদ রটল পিতৃহন্তাকে সুকৌশলে ক্ষমা করছেন দেবেশ্বর রায়। মরা বাপের উপর শোধ তুলছেন। তার কারণ তিনি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছিলেন, এবং মধ্যে মধ্যে বলতেন—যথেষ্ট হয়েছে, লোকটাকে এবার মাফ কর। অপবাদ শুনে চমকে উঠে চলে এলেন দেবেশ্বর রায়। জমিদারীর ব্যবস্থা করলেন দুভাগে ভাগ করে। প্রথম অবিভাজ্য দেবোত্তর এস্টেট, তার কমন ম্যানেজার করে দিলেন শিবেশ্বর রায়কে। আর দেবোত্তরের অধীনে পত্তনীদার হিসেবে যে ব্যাপারটা বড়, এবং খাস, রায়বংশধরদের ব্যক্তিগত, তা ভাগ ক’রে নিয়ে নিজের অংশের মধ্যে পুরনো কালের আচার্য দেওয়ান ম্যানেজারের পৌত্রকে ম্যানেজার রেখে কলকাতা চলে এলেন। তখন সম্পত্তিতে তাঁর অংশ সাড়ে আট আনা, রামেশ্বর বিলেত যাবার সময় তাঁর অংশের সম্পত্তি নামমাত্র মুনাফা রেখে দরপত্তনী দিয়ে গেছেন। সেটা দু ভাই-ই নিয়েছেন।
কলকাতায় ফিরে এসে নতুন মানুষ দেবেশ্বর প্রথম দিনই আপিস গিয়ে চমকে গেলেন। কলকাতার আপিসে তাঁর ঘরে তাঁর চেয়ারে বসছেন বড়ছেলে যজ্ঞেশ্বর। রত্নেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর এই কয়েক মাসের মধ্যে পরিবর্তনটা ঘটে গেছে। ব্যবসায় পার্টনার মহাদেব চক্রবর্তী যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুর, তিনিই নাকি এ ব্যবস্থা করেছেন। আপিসের স্টাফও বদল হয়ে গেছে। সে বেয়ারা পর্যন্ত।
যজ্ঞেশ্বর বাপকে দেখে চমকে উঠেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—পাখা এখানটায় একটু বেশী পাওয়া যায় সেই জন্যে—।
দেবেশ্বর বলেছিলেন—বসো তুমি। আমি বসব না। আমি চলে যাব ঘণ্টাখানেক পর।
পরদিন এসে চেপে বসে গোটা ব্যবসাটির অবস্থা দেখে তাঁর অংশের প্রাপ্য টাকা বের করে নিয়ে স্বতন্ত্র করে ব্যাঙ্কে মজুত ক’রে বড়ছেলেকে ডেকে বললেন—শোন, কোন বিজনেসের সঙ্গে আর আমি সম্পর্ক রাখব না। ইচ্ছে বিক্রী ক’রে দি কিন্তু ভেবে দেখলাম—তুমি যখন কাজকর্ম শিখেছ এবং অর্ধেকের অংশীদার চক্রবর্তী যখন তোমার শ্বশুর, তখন ছেড়ে না দিয়ে তোমাকে দেওয়াই ভাল। কি বল?
চুপ করে রইলেন যজ্ঞেশ্বর।
দেবেশ্বর বললেন—একটি শর্তে।
এবার বেশ ধীরভাবেই যজ্ঞেশ্বর বললেন —বলুন।
দেবেশ্বর বললেন—জানবাজারের বাড়ী, ব্যাঙ্কে মজুত এবং কোম্পানীর কাগজে লগ্নী করা যা টাকাকড়ি আছে, এসব এখন আমার রইল, আমার অন্তে এ সমস্ত পাবে যোগেশ্বর।
—কীর্তিহাটের সম্পত্তি—
—ওতে তো বাপের ছেলেকে বঞ্চিত করবার অধিকার নেই। সে আমি বলব না। ওতে তোমাদের দুই ভাইয়ের সমান অংশ পাওয়া উচিত, তাই পাবে।
একটু চুপ ক’রে থেকে যজ্ঞেশ্বর বলেছিলেন—বেশ, আমি তাতে সম্মত, শুধু মায়ের কোম্পানীর কাগজের অর্ধেক, যেটা আমি পাব সেটা আমাকে দিন। আপনি যেভাবে ব্যবসার রিজার্ভ ফাণ্ড তুলে নিয়েছেন, তাতে ব্যবসা আমি চালাবো কিসে!
—তোমার মা থাকতেই তাঁর টাকাটা নেবে? সে টাকায় আমি কখনও হাত দিই নি।
—মায়ের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে। অর্ধোন্মাদ। সে অবশ্য আপনার জন্যেই।
—থাক। তাই পাবে তুমি। দিয়ে দেব।
—আপনি কি রিটায়ার করবেন? না কীর্তিহাটে গিয়ে বসবেন?
—না। আমি এখানেই থাকব। রিটায়ার করা বলতে পার। তবে একটা কিছু অবলম্বন রাখতে হবে তো। ভাবছি বাই-উইকলি ইংরিজী খবরের কাগজ করব। কাগজের প্রয়োজন আছে। আমার পরে ওটা যোগেশ্বর চালাবে। সে এবার বি-এতে ইংরিজীতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এম-এতেও তেমনি ফল করবে। আমার বড় শখ ছিল, সেটা যোগেশ্বরকে দিয়ে করে যাব।
* * *
সুরেশ্বর বললে–টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরীতে ঢুকে দেবেশ্বর রায় আর বেঁচে থাকেন নি। তারপরের কথা তুমি সবই জান সুলতা। জান না শুধু দেবেশ্বর রায়ের মৃত্যুর কথাটা। তিনি মারা গেলেন কি ভাবে। লোকে জানে জমিদারের ছেলে যে ভাবে মারা যায় সেই ভাবেই মারা গেছেন তিনি। মদ খেয়ে খেয়ে তিনি হঠাৎ একসময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আর জ্ঞান হয় নি। সেকালে বলেছিল—ব্রেন ফিভার; একালে হলে বলত সেরিব্রেল থ্রমবসিস্। সেইটুকু বললেই আমার অতীতকাল শেষ।
* * *