১২
এ টাকা সেই টাকা। কথাটা শিবেশ্বর তাঁকে পত্রে লিখেছিল, কিন্তু তিনি সে-সব পত্র খোলেন নি। এখানে এসে প্রথম নাতির কাছে শুনেছেন। সেই কারণে যজ্ঞেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে যান নি দেবেশ্বর নদীর ঘাট পর্যন্ত এবং যজ্ঞেশ্বরও ঠাকুরদাকে অভ্যর্থনা জানাতে নাটমন্দিরে নামে নি, আগের রাত্রি থেকে শরীর খারাপের অজুহাতে উপবাস করে শুয়েছিলেন। ঠাকুরদা ঘরে এলে তিনি কেঁদেছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতে শুরু করেও বলতে পারেন নি, বলেছিলেন—বড়কাকা তো তোমাকে লিখেছিল। তুমি তো তার উত্তর পর্যন্ত দাও নি।
ঠাকুরদা বলেছিলেন—চিঠি এক ম্যানেজারের ছাড়া আর কারুর চিঠিই খুলে পড়ি নি আমি। শুধু তোমাদের কুশলেই খুশী ছিলাম ভাই। দেবেশ্বরের বিরুদ্ধে শিবেশ্বরের অভিযোগ, শিবেশ্বরের বিরুদ্ধে দেবেশ্বরের, কি দেবেশ্বরের বিরুদ্ধে তোমার, এ সব পড়ে তীর্থযাত্রার আনন্দ, পুণ্য এসব আমি তেতো করতে চাই নি ভাই। আচ্ছা আমি শুনব সব, শিবেশ্বরের কাছে।
শিবেশ্বর মুখে কিছু বলেন নি, তাঁর লেখা না-খোলা চিঠির ভেতর থেকে সেই চিঠিখানা বের করে হাতে দিয়ে বলেছিলেন, —পড়ে দেখুন।
পড়ে দেখে খাতার খরচটায় একটা চিহ্ন দিয়ে রাখছিলেন রত্নেশ্বর রায়, কিন্তু শিবেশ্বর বলেছিলেন—টাকাটা দাদা কলকাতা থেকে এসেই শোধ করে দিয়েছেন, জমা আছে পরে। তবে আরও টাকা তিনি নিয়েছেন এবং মামলা-সেরেস্তার ডিক্রী দরুন প্রাপ্য টাকা উনি ছেড়ে দিয়েছেন। তা সব দেখতে পাবেন খাতায়। এবং এ ছাড়া আট হাজার টাকা দিয়ে একখানা বাংলা খবরের কাগজ বের হচ্ছে, তার শেয়ার কিনেছেন। এটাও আপনাকে বিবেচনা করে দেখতে বলি। খবরের কাগজ থেকে লাভ কখনও হয় না। যারা ও থেকে লাভ করতে পারে, তাদের জাত আলাদা। আবার যেসব বড় বড় জমিদার কাগজ বের করে শখ করেন, লোকসান দেন, তাঁরা হলেন বড় বড় জমিদার, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর মত বড় তাঁরা।
রত্নেশ্বর বলেছিলেন—হুঁ!
* * *
মেমসাহেবের কথাটা তিনি জানেন, শুনেছেন, এই তথ্যটুকু জানিয়ে রত্নেশ্বর রায় বললেন—ও আমি জানি শুনেছি। ও কথা থাক। ও আলোচনা থাক। কিন্তু—তুমি আট হাজার টাকা দিয়ে খবরের কাগজের শেয়ার কিনেছ কেন?
—আপনার আপত্তি হবে এটা ঠিক বুঝতে পারি নি আমি। আমাদের দেশে ইংরেজ রাজা হয়ে বসে আছে, থাকল, কিন্তু চিরকালের জন্য নয়। হতেও পারে না। তাছাড়া প্রজারও বলবার কথা থাকতে পারে। থাকতে পারে নয়, থাকেও। আমার এক বন্ধুর কাগজ, কাগজ ভালই চলে; হঠাৎ একটা মামলায় পড়েছিল বলেই শেয়ার বিক্রী করলে। সেটা কিনেছি আমি।
—কিন্তু পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের সময় আমরা, জমিদারেরা বন্দোবস্তের শর্ত অনুযায়ী স্বীকার করেছি—
—আমি জানি সে সব। তারপর অনেক কাল চলে গেছে। জমিদারদের অধীনে রায়তদের সঙ্গে সাবেক টেনেন্সী অ্যাক্টের কত বদল হল। জমিদারদের ক্ষমতা কত খর্ব হয়ে গেল। পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের পর পত্তনী আইন হল। সুতরাং কোন শর্তই চিরস্থায়ী নয়। তাছাড়া আমার জন্যেই তার পুরনো সাপ্তাহিক কাগজখানা উঠে গেল।
—তার মানে?
—আমি কয়েকটা লেখা লিখেছিলাম। যার জন্যে তার কাগজ গবর্নমেন্টের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিল। আমি এখানকার রাজকর্মচারীদের বিশেষ করে ব্যবসাদার ইংরেজদের কঠিন সমালোচনা করেছিলাম। বলতে গেলে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের হুকুমেই দেশ চলে। ইংলিশম্যান স্টেটসম্যান মারফতে হুকুম তৈরী করে। বিলেত থেকে তাই পাস হয়ে আসে। আমাদের কাগজের মধ্যে বেঙ্গলী আর অমৃতবাজার। বেঙ্গলীর সুরেনবাবুর সঙ্গে আমার খুব বনে না। অমৃতবাজারের মতিলালবাবু, শিশিরবাবু আমাকে ভালবাসেন, আমিও শ্রদ্ধা করি ওঁদের, কিন্তু নিজের কাগজ না হলে অন্তত নিজের ইচ্ছামত লেখা যায় না। আমার কয়লার ব্যবসা আজ এক বছর ধরে এক রকম অচল হয়ে রয়েছে। তা থাকলে এস্টেট থেকে টাকা আমি নিতাম না। বেশ আপনার অমত যখন, তখন ও টাকাও আমি ফিরিয়ে দেব এস্টেটকে
রত্নেশ্বর রায় বলেছিলেন—সেইটেই ভাল মনে করি আমি। কারণ শিবেশ্বরের এতে আপত্তি আছে।
এ কথার উত্তর দেন নি দেবেশ্বর, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নতদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলেছিলেন—তাহলে আমি কালই কলকাতা চলে যাব।
চমকে উঠে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—কালই?
—হ্যাঁ। বিলম্বে তো অকারণ সময় নষ্ট। আমার বিজনেসটা শুধু নামে দাঁড়িয়ে আছে, চালু করা প্রয়োজন। হয়তো কোন ল্যান্ড বিক্রী করে দেব, দিয়ে কাগজ বের করব, প্রিন্টিং প্রেস করব।
—কয়লার জমি বিক্রী করবার আগে আমাকে জানিও।
—আপনি কিনবেন?
—কিনব।
—বেশ জানাব আমি। বলে উঠে চলে গিয়েছিলেন দেবেশ্বর।
সন্ধ্যায় রায়বাহাদুরের চাকর এসে তাঁকে জানিয়েছিল, কত্তা একবার হুজুরকে স্মরণ করেছেন। দেবেশ্বর হুইস্কির গ্লাস নিয়ে বসেছিলেন। চাকরটার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন—বল গে, যাচ্ছি। একটু পরে।
কিছুক্ষণ পর দেবেশ্বর এসে সামনে দাঁড়ালেন। রত্নেশ্বর বললেন—বস তো। একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। যজ্ঞেশ্বর আমার কাছে এসেছিল। সে আমায় বলে গেছে তোমায় জানাতে যে, সে তোমার সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক।
—অনিচ্ছুক! একটু চুপ করে থেকে বললেন—সে কথা আমাকে বললেই সে পারত।
—পারত। কিন্তু তা করে নি। আমার মনে হয় তাতে সে অন্যায় করে নি। আমি পর নই।
—না, আমি তা বলছি না। তবে তার কোন আশঙ্কার হেতু তো ছিল না, কারণ সে যখন বার্বারাকে চাবুক মেরেছিল, তখন আমি তাকে কিছু বলি নি।
—তা বল নি। তবু তার আশঙ্কা স্বাভাবিক। হয়তো তুমি এর পর তার উপর তুষ্ট থাকবে না।
—বেশ, সে এখানেই থাকতে পারে। আমি উমা আর যোগেশ্বরকে নিয়ে কলকাতায় যাব।
—ওরাও এখানে থাকলে ভাল হয় না?
—ওরাও কি কিছু বলেছে?
—হ্যাঁ, বউমারও ইচ্ছে নয় যে উনি এখান থেকে যান।
—ভাল, আমি একলাই যাব।
বলে মাথা হেঁট করে বাপের পায়ের ধুলো নিয়ে তিনি উঠে চলে এসেছিলেন এবং কীর্তিহাট থেকে স্টেশন পর্যন্ত কয়েক ক্রোশ পথ তিনি ভোরবেলা উঠে পায়ে হেঁটে চলে এসেছিলেন। চাকরকে বলে এসেছিলেন, তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে কলকাতা ফিরতে। সকালবেলা উঠে খবরটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী জুতিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রায়বাহাদুর। সে গাড়ীও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
রায়বাহাদুর বলেছিলেন—উত্তম।
নাতিদের ডেকে বলেছিলেন-এর জন্য আমার সম্পত্তির তোমাদের বাবার অংশ তোমাদের দিয়ে যাব। শুধু তাই নয়, তোমাদের তিন ভাগের এক ভাগ পাঁচ আনা ছ গণ্ডা দু কড়া দু ক্রান্তির বদলে ছ আনা দিয়ে যাব। বাৎসরিক ষাট হাজার টাকা আয় হলে এক আনায় প্রায় চার হাজার টাকা হবে; বিশ গুণ পণে তার দাম অন্তত আশী হাজার টাকা।
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, রায়বাড়ীর এক আনা সম্পত্তির আয় বছরে চার হাজার টাকা, ষোল আনায় চৌষট্টি হাজার টাকা। এর বাইরে আছে বারো বারো চব্বিশ হাজার টাকার দেবোত্তর। জমিদারী মুনাফার একসময় কুড়ি গুণ পণ ছিল স্ট্যান্ডার্ড দাম। একেবারে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের মতো ফিক্সড। গিনির দামের মত দাম তার বেড়েছে কিন্তু কমে নি কখনও। তবে স্বত্ব পত্তনী বা দরপত্তনী হলে তার দাম কম হত নিশ্চয়। রায়দের সম্পত্তির যে-অংশটা ব্যক্তিগত, তা সবটাই পত্তনী বা দরপত্তনী। জমিদারী বা পত্তনী যেটা মূল স্বত্ব—সেটা দেবতার নামে কেনা, সেটা দেবোত্তর। সেই হিসেবে রত্নেশ্বর রায় বড় নাতিকে যে বললেন—এক আনা অংশ আমি বেশী দেব, তার দাম পনের গুণো দরে হয় ষাট হাজার—দশ গুণো পণে হয় চল্লিশ হাজার; গড় করে নিলে দাঁড়াবে পঞ্চাশ হাজারে। ডি এল রায়ের সাজাহান নাটকে আগ্রা কেল্লায় বন্দী শাজাহান হিন্দুস্থানের মসনদ আর মুকুটের লোভ দেখিয়েও মহম্মদকে পিতৃদ্রোহী করতে পারেন নি। সেটা নেহাৎ কবিকল্পনা নাও হতে পারে। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর রায়ের ক্ষেত্রে সেটা কবি-কল্পনা বা অবাস্তব। বাবার সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ত্যাগ করে কীর্তিহাটেই থাকতে রাজী হয়েছিলেন। এবং লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিষয়কর্ম বুঝতে আরম্ভ করেছিলেন দাদুর কাছে।
পিতার কাছে পুত্রের মূল্য আর পুত্রের কাছে পিতার মূল্য ওই পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছে ছোট হয়ে গেল।
দেবেশ্বরের মত দুর্ভাগা আমি দেখি নি। অথবা এমন আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মপরায়ণ রায়বংশে কেউ জন্মায় নি।
মাটির উপর মানুষ জন্মেছে বলেই মাটির দাম আছে। মাটি নিয়ে কেনা-বেচা মানুষেই করে। অনেকটা মাটি কোনরকমে দখল করে তাকে হাসিল করে তার দাম বাড়ায়। মানুষেরা এসে বসবাস করে প্রজা হয়। যে-মাটির উপর মানুষ নেই, সে-মাটির দাম নেই, তার নামও কেউ করে না, শোনে না। সেই মাটির দাম যখন মানুষের চেয়ে বেশী হয়ে ওঠে, তখন মাটি ব্যঙ্গ করে হাসে না কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্গতির বাকি থাকে না।
কথাগুলো আমার নয়, দেবেশ্বর রায়ের। তিনি কথাগুলি বাপকে লিখেছিলেন, লিখেছিলেন—সংসারে লোকে দুঃখের মধ্যেও পরম সুখে থাকে, সংসারের আনন্দে। পিতা পুত্রের মুখ চাহিয়া থাকে, স্বামী স্ত্রীর মুখ চাহিয়া থাকে। আপনি অর্থমূল্যে আমার সব কাড়িয়া লইলেন। রায়বংশের চরম অপরাধ আপনি করিয়া গেলেন। বাল্যকালে আমার মনে পড়ে কালীপূজায় কলিকাতার যাত্রায় নরমেধ যজ্ঞ পালা দেখিয়াছিলাম। তাহাতে পুরাণের কোন রাজা নরকস্থ পিতার মুক্তির জন্য নরমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন। যজ্ঞে আহুতি দিবার জন্য একটি অতি-দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাছে প্রচুর স্বর্ণ দিয়া লোক প্রেরণ করিয়াছিলেন, ব্রাহ্মণের তিন পুত্র, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় পুত্র বিক্রয় করিতে ইচ্ছা করিয়াও মুখে বলিতে পারেন নাই। ব্রাহ্মণ বলিয়াছিলেন, জ্যেষ্ঠপুত্র আমার প্রিয়—দিতে পারিব না, ব্রাহ্মণী কনিষ্ঠপুত্রকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন, মধ্যম পুত্র পিতামাতার কথোপকথন শুনিয়া অত্যন্ত বেদনার্ত চিত্তে আমাকে তো কেহ চাহে না বলিয়া স্বেচ্ছায় রাজার লোকের নিকট নিজেকে সমর্পণ করিয়া বলিয়াছিলেন—আমি যাইব, আমার মূল্যের স্বর্ণ আমার পিতামাতাকে দান করুন। মনে আছে সে-পালা দেখিয়া দেবেশ্বর ক্রন্দন করিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন—আমাকে কেহ ভালবাসে না। আপনি আমাকে কোন মূল্য না দিয়াই আমার স্ত্রী-পুত্র-সংসার সব কাড়িয়া লইলেন। মরুভূমি, যেখানে মানুষ বাস করে না, সেখানকার জমির কোন দাম নাই। মাটির দাম মানুষের জন্য। মানুষই বেচে, মানুষই কেনে সেই মাটির দাম মানুষের চেয়ে বেশী হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে রায়বংশটাই দ্বিতীয়বার অভিশপ্ত হইল। আমি অভিশাপে বিশ্বাস করি না। আপনি করেন বলিয়াই লিখিতেছি। নারীর জন্য সর্বনাশের অভিশাপ যদি আমা হইতে হয় তবে সম্পত্তি এবং অর্থের জন্য রায়বংশ সকল হীন কর্মই করিবে—ইহাতে কোন সন্দেহ রহিল না। চরম অধঃপতনে নামাইয়া দিলেন। বুকের ভিতরটা নিরেট পাথরের মত জমিয়া শক্ত হইয়া গেল। ইচ্ছা করিলে আমি মকদ্দমা করিতে পারি বা পারিব। হাইকোর্ট প্রিভি-কাউন্সিল পর্যন্তও চলিতে পারে কিন্তু তাহা আমি করিব না।
রত্নেশ্বর রায় উত্তর দিয়েছিলেন—“আমি তোমার পুত্র অপহরণ করি নাই। তুমি তোমার পিতার বক্ষে শেলাঘাত করিয়া বিরোধ করিয়াছ। অদ্যাবধি শরাঘাত করিতেছ। দেখিয়া তোমার পুত্র শিক্ষা লইয়াছে; সে আসিয়া আমার পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছে মাত্র। আমি স্নেহবশতঃ তাহাকে তোমার আঘাত হইতে রক্ষা করিয়াছি, যতদিন বাঁচিব ততদিন করিব। ষোল বৎসর বয়সে তুমি আমাকে যে-দুঃখ দিয়াছ, তাহা অপেক্ষা সে অধিক দুঃখ দিয়াছে কি?”
উত্তরে এবার একছত্র মাত্র লিখেছিলেন দেবেশ্বর—“আমি আপনার অবাধ্য হইয়া যাহা করিয়াছিলাম, তাহার জন্য আত্মহত্যা করিতে চাহিয়াছিলাম—যজ্ঞেশ্বর বলিতে গেলে আমাকেই চাবুক মারিয়াছে। আপনি তাহাকে প্রশ্রয় দিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে খাড়া করিলেন। এ বিষয়ে আর আমি কোন পত্রালাপ করিব না। এইখানেই শেষ হইল।”
এরপর তিনি নতুন করে ব্যবসায়-বাণিজ্যে মন দিয়েছিলেন। সেই কয়লার খনির জন্য কেনা জায়গাগুলি পড়েই ছিল, অধিকাংশই যার অযোগ্য মনে হয়েছিল, তারই মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেল উৎকৃষ্ট কয়লার জমি। জায়গাটা বরাকরে। জমিদার কাশিমবাজারের রাজএস্টেট। তখনও রাণী স্বর্ণময়ীর আমল। দেবেশ্বর রায় আরও জায়গা সেখানে বন্দোবস্ত নিয়ে দস্তুরমত ক্লাইভ স্ট্রীটে আপিস খুলে বসলেন। কালের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার আপিস কোয়ার্টারে বড় বড় বাড়ী উঠেছে, গ্যাসের আলো হয়েছে। কলকাতায় সম্পত্তির দাম বেড়ে গেছে তিনগুণ চারগুণ। দেবেশ্বর কলিয়ারী ডেভেলপমেন্টের জন্য জানবাজারের বসতবাড়ী বন্ধক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অংশীদার যোগাড় করলেন। ওই বরাকর অঞ্চলের কয়লার খনির কাজে দুপুরুষ ধরে তাঁরা কাজ করে আসছেন। পরনে ন-হাতি ধুতি, গায়ে পিরান, কয়লার কুঠিতে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন গরুর গাড়ীর ঠিকাদার হিসাবে। খনির মুখ থেকে কয়লা রেল-সাইডিংয়ে ঢালাই করবার জন্য গাড়ির যোগান দিতেন। তা ক্রমে ক্রমে কয়লাকুঠীর—বিশেষ করে ও অঞ্চলের কয়লাকুঠীর সমস্ত কিছুর সঙ্গে তাঁদের নিবিড় পরিচয়। কয়লার কুঠীতে বসে থেকে তাঁরা খনি তৈরী করবেন, চালাবেন, কলকাতায় বসে দেবেশ্বর কলকাতার আপিস চালাবেন। এই বন্দোবস্ত করেছিলেন। দেখতে দেখতে বছর-তিনেকের মধ্যে রয় এ্যান্ড চক্রবর্তী কোম্পানী কলকাতায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ওই বরাকর সিমের কয়লার জন্যে।
কয়লার খনির ইতিহাস যদি খুঁজে দেখ সুলতা, তবে দেবেশ্বর রায় আর মহাদেব চক্রবর্তীর নাম খুঁজে তুমি পাবে তার সঙ্গে পাবে বরাকরের বেগনিয়া সিমের কয়লার উল্লেখ। তার সঙ্গে ঝরিয়ায় পাবে সুরাটার কলিয়ারীর একটা বিশেষ সিমের নাম। পশ্চিমে এডেন হয়ে বিলেত, এদিকে সিংগাপুর-হংকং পর্যন্ত জাহাজে কয়লা চালান করতে শুরু করেছিলেন। কলকাতার আপিসে সায়েব সুপারিন্টেন্ডেন্ট রেখেছিলেন-কয়লার কুঠী দেখবার জন্যে সায়েব জেনারেল ম্যানেজার রেখেছিলেন; কলকাতার বড় বড় ইংরেজ কোম্পানীর আপিসে বড়সাহেবদের সঙ্গে বন্ধুর মত অন্তরঙ্গতা ছিল—হ্যালো চার্লি, বলে হাত বাড়িয়ে দিতেন। তারাও হেসে সবিস্ময়ে বলত—রয়! হোয়াটস দি নিউজ?
—আই থিঙ্ক ভেরী এনকারেজিং সামথিং; সো আই থট আই শুড কাম টু ইউ মাইসেলফ্ টু একস্টেন্ড মাই ইনভিটেশন টু এ গার্ডেন পার্টি ইন দি ইভনিং। ইউ মাস্ট কাম।
—গার্ডেন পার্টি! নচ-গার্লস উইল বি দেয়ার?
—সার্টেনলি, গার্লস উইল বি দেয়ার, বাট নট নেটিভ নচ-গার্লস দিস টাইম। অ্যাংলো গার্লস টু কীপ কম্পানী।
এইভাবেই সেকালের সমুদ্রে বাণিজ্য-তরী চলতো সুলতা। শুধু সেকালেই আর এ দেশেই বা বলি কেন, সব কালেই সব দেশেই বোধ হয় বাণিজ্যতরী এইভাবেই চলে। সে শ্রীমন্ত সদাগরের বাপ ধনপতির আমল থেকে দেবেশ্বরের আমল পর্যন্ত।
দেবেশ্বর রায় বলতেন—শুধু বাণিজ্যতরী নয়, জীবনতরীই চলে এইভাবে। প্রকৃতির হাতছানিতে পুরুষ যেভাবে এসে জোটে, সেইভাবে জীবনের সব চলে। নারী-ভূমি-অর্থ চিরকাল টেনে আনছে। চিরকাল। তার মধ্যে নারীই প্রথম। রামায়ণে সীতা, মহাভারতে দ্রৌপদী, ট্রয়ে হেলেন, চিতোরে পদ্মিনী; দুনিয়ার যত আনটোল্ড, আনরিটন ইতিহাস এবং ইতিকথা খুঁজে দেখ, প্রতি মানুষের জীবনেই এই।
উয়োম্যান ইজ দেয়ার ইন দি ডেপ্থ। তারই জন্য ইউ ওয়ান্ট এ হোম। দ্যাট হোম ইজ সুইট, দি সুইটেস্ট প্লেস ইন দি ওয়ার্ল্ড, ওনলি ফর হার। ইউ ওয়ান্ট এ কিংডম ফর হার। ইউ ওয়ান্ট টু মেক হার এ কুইন। শী ইজ এ উইচ। সে তোমাকে মুগ্ধ করে, তোমাকে দিয়ে করিয়ে নেয়। আমাদের শাস্ত্রে বলে—প্রকৃতি পুরুষের বুকে চড়ে নাচে। ওয়ান্ডারফুল দ্যাটস হোয়াই ম্যান ফট উইথ উয়োম্যান। পুরুষ উইথ প্রকৃতি। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পুরুষ সাধনা করে পলিগেমাস নেচারকে ডেভেলপ করেছে। তার পলিগেমাস নেচার তাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছে। মাকড়সার জীবন দেখো। হ্যাভ ইউ সীন এ স্পাইডারস্ লাইফ চার্লি? ট্রাই টু সী ভেরী ইন্টারেস্টিং। দি ফিমেল স্পাইডার ইটস্ দি মেল স্পাইডার অ্যাজ সুন অ্যাজ দেয়ার এনজয়মেন্ট ইজ কমপ্লিট। বাট ম্যান হ্যাজ টেকন রিভেঞ্জ। হি ইজ দি মাস্টার নাও।—তার সঙ্গে সে প্রভুত্ব পেয়েছে মাটির উপর-মেটিরিয়েলসের উপর।
চার্লি সাহেব মস্তবড় সায়েব কোম্পানীর কলকাতা আপিসের জেনারেল ম্যানেজার। ব্যবসাবুদ্ধিতে কয়লাখনির ভালমন্দতে খুব বুদ্ধিমান লোক। কিন্তু এসব তার মাথায় ঢুকত না। অবাক হয়ে শুনত। হেসে উড়িয়ে দিতেও পারত না। কারণ গার্ডেন পার্টিতে মধ্যে মধ্যে মিস্টার রায় শেক্সপীয়র আবৃত্তি করতেন। গান করতেন প্রতি পার্টিতে! বাংলা, হিন্দী, এমন কি খাঁটি ইংরিজী সুরে ইংরিজী গানও গাইতেন তিনি, শোনাতেন মধ্যে মধ্যে। চার্লি মুগ্ধ হয়ে বলত —এ চার্মিং ম্যান। ওয়ান্ডারফুল!
সে-আমলের পলিটিক্স্ তা-ও করেছেন। ইংরিজী কাগজে চিঠি লিখতেন ছদ্মনামে। অমৃতবাজারের শিশিরকুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি।
* * *
কিছুদিন পর বাপ চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘোরাতে। কিন্তু ঘোরেন নি তিনি। রত্নেশ্বর রায় পুত্রবধূকে নিয়ে এসেছিলেন নিজে। আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেবেশ্বর আপিসে খবর পেয়েছিলেন—বাবা এসেছেন বড় পুত্রবধূকে নিয়ে। তিনি আপিস থেকেই উধাও হয়েছিলেন। দিন-চারেক পর পুত্রবধূ বলেছিলেন—বাবা, আপনি ফিরে যান।
—তুমি?
—আমি থাকব। একটু থেমে থেকে বলেছিলেন—যোগেশ্বরকেও নিয়ে যান। আপনার কাছে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব।
—না মা। তোমায় আমি ফিরিয়েই নিয়ে যাব। আমার হতভাগ্য ছেলে তোমার মর্যাদা বুঝলে না, কিন্তু একদিন এর জন্য ওকে অনুতাপ করতে হবে।
পুত্রবধূকে নিয়ে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন।
খবর পেয়ে দেবেশ্বর রায় বাগানবাড়ীর আসর ভেঙেছিলেন। দিন-তিনেক পর সকালবেলা এসেছিলেন শিবেশ্বর। সকালবেলা ভিন্ন দেবেশ্বরের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত। আপিসে দেখা হতে পারে কিন্তু সেখানে এসব বলা যায় না। তাছাড়া ওখানে দেবেশ্বর রায়ের তৃতীয় মেজাজ বের হয়। খাঁটি এক সায়েবী মেজাজ।
মোম দিয়ে মাজা ও পাকানো গোঁফে অকারণে বাঁ হাতের আঙুল অতি সন্তর্পণে বুলিয়ে কপাল কুঁচকে অন্যমনস্ক ভাবে কথা বলতেন। ছোট ছোট দু-চারটে শব্দে গড়া বাক্য। তার বেশী নয়। এবং হঠাৎ টেবিলে রাখা ব্লটিং-প্যাডের কাগজ রেখে কিছু লিখতে সুরু করে দিয়ে বলতেন—এক্সিকিউজ মি প্লিজ! কাম সাম আদার টাইম। কিংবা আই হ্যাভ নাথিং মোর সে।
তাই সকালেই গিছলেন শিবেশ্বর।
শিবেশ্বর অনুযোগ করে বলেছলেন—তুমি এত বড় হৃদয়হীন তা জানতাম না। তুমি বউদির সঙ্গে দেখা করলে না? বাবার সঙ্গে যা করলে, ছিঃ!
চুপ করে থেকেছিলেন দেবেশ্বর। অর্থাৎ অনুযোগ মেনে নিয়েছিলেন, সেটা দেবেশ্বরের পক্ষে অস্বাভাবিক। একটু পর বলেছিলেন—হ্যাঁ, আমি অপরাধী। কিন্তু কি করব? দ্যাট টাইর্যান্ট—আমাদের বাবার জীবনের যত চেপে রাখা ক্ষুব্ধ প্রকৃতিগুলো উনি আমাকে দিয়ে পৃথিবীতে এনেছেন। হি ইজ রেসপনসিবল। শিবেশ্বর, উনি বলেন—রায়বংশের উপর অভিশাপ আছে। সেটা আমি মানি নে। কিন্তু এটা মানি যে, ওঁর সাপ্রেসড হাঙ্গার, কৃচ্ছ্রসাধনে চাপা প্রবৃত্তি খোঁচা-খাওয়া সাপের মত আমার বুকে বিষ ঢেলেছে। আমার অপরাধ জানি, তোমার বউদির কাছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় অপরাধ বাবার। আমি ভালবেসেছিলাম ভায়লেটকে। ভায়লেট অঞ্জনাপিসীর মেয়ে। তুমি জান না, আমি জানি। আমাকে অঞ্জনাপিসী ডেকে বলে গিয়েছিল মরবার আগে, দেবু, এই মেয়েটাকে তুই তোর সেবাদাসী করে রাখিস। সাহস থাকে তো বিয়ে করিস রে। ওকে বাঁচাস। নইলে মেয়েটার হাড়ির ললাট ডোমের দুর্গতি হবে। তাই হয়েছে। ওঃ, তার একটা ছেলে হয়েছিল, সেটাকে পড়াতে চেয়েছি, পড়ে নি। চাকরি করে দিয়েছি, সেখানে ক্রিমিন্যালের কাজ করেছে। ভায়লা এখন মাতাল, কুৎসিত, ওঃ শিবেশ্বর! আমি তার জন্যে দায়ী। আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু আসল দায়ী দ্যাট টাইর্যান্ট। কি ক্ষতি হত, বলতে পার, যদি মেয়েটা—
শিবেশ্বর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, বলেছিলেন—এসব কথা কানে শোনাও পাপ দাদা। আমি শুনতে পারব না। একটা খবর দিয়ে যাই। বউদি তোমাকে খালাস দিয়েছেন। ভগবানকে আশ্রয় করেছেন। আমাকে আসবার সময় বললেন –ঠাকুরপো, তোমার দাদাকে বলো, আমি তাঁকে খালাস দিলাম। যাতে তিনি আনন্দ পান, তাই যেন করেন। তবে নিজের দেহের যত্ন যেন নেন। আমার দাদাশ্বশুরের রক্ষিতা সোফি বাঈয়ের কথা শুনেছি। উনি যদি কাউকে ভালবাসেন, তবে তাকেই যেন রাখেন। সে যত্ন-টত্ন করবে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দেবেশ্বর বলেছিলেন-নো। তাহলে সেটা হবে বাড়ীর ঝিয়ের সঙ্গে ইল্লিসিট কনেকশন। সে হয় না। ঠাকুরদা সোফি বাঈকে ভালবাসতেন আগে থেকে। তাছাড়া সে কালটা ছিল আলাদা। তখন রাজা বা বড় জায়গীরদারদের বাড়ীর পাশে পোষা রাণ্ডীমহল থাকত। সেকাল এটা নয়।
হেসে শিবেশ্বর বলেছিলেন—সে এখনও আছে। নেই কে বললে! তুমি তো কীর্তিহাটে বাস করলে না। আমি বাস করেছি বাবার সঙ্গে; বাবার হয়ে আমাকেই যেতে হয় এখানে-ওখানে নেমন্তন্ন রাখতে। এখনও জায়গীরদারের ছেলে ঘেরা বাগানের মধ্যে, পুকুরের ধারে কৃষ্ণলীলা করে।
দেবেশ্বর বলেছিলেন—তারা বর্বর, আই হেট দেম। বলতে পার, ষোল বছর বয়সে I was mad after Violet—সুতরাং তফাৎ কি! কিন্তু তফাৎ আছে, I loved her; অঞ্জনাপিসীর কাছে কথা দিয়েছিলাম। অঞ্জনাপিসী, বলছি তো ওকে আমাকে দিয়ে গিছল।
—বেশ তো তাকেই রাখ।
—না, তা হয় না।
—কেন? নার্স সাজিয়ে রেখে দাও।
—না-না-না। সে আর ভাবা যায় না শিবেশ্বর। আমি তো তাকে নিয়ে একসঙ্গে মরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে তা পারে নি। তারপর বাবা তাকে আমার দৃষ্টিপথ থেকে সরিয়ে পিদ্রুজদের এক বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন—একটা ছেলে হল। থাক, সে তুমি জান। কিন্তু এটা বোধ হয় জান না, সে ভায়লেট ইজ ওয়ার্স দ্যান এ স্ট্রীট গার্ল; ইভন্ ওয়ার্স দ্যান গোয়ান গার্লস। ছেলেটা বড় হয়েছে। তার লেখাপড়া হয় নি। তাকে চাকরি দিয়েছি, but he is a criminal—a drunkard—sometimes he is violent. সে যদি মায়ের সূত্র ধরে স্বীকৃতি পায় তবে সে আমার বুকে চেপে বসবে। আমার জন্যে আমি ভাবি নে। কিন্তু সে যদি কোন দিন কীর্তিহাটে গিয়ে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের অপমান করে, তাহলে তাকে গুলী করে মারতে হবে, ভায়লেটকে মারতে হবে, নিজে মরতে হবে।
—বেশ তাহলে আর একটা কাজ কর।
—কি?
—আবার তুমি পছন্দ করে বিয়ে কর। সে কথাও বউদি বলে দিয়েছেন। বললেন —বল না ঠাকুরপো, আমি না হয় ভাঁড়ারে খাটব, রান্নাবান্না দেখব, উনি নতুন বিয়ে করে মাথায় করে রাখুন। ভারতচন্দ্রের ছড়া আউড়ে বললে—গঙ্গা নামে সতী তার তরঙ্গ এমনি,
—না। তাও হয় না শিবেশ্বর। বিয়ের কাল এখনও যায় নি। চারটে পাঁচটা-সাতটা বিয়ে করা যায়। কুলীনেরা বিশ-পঁচিশটা আজও করছে। কিন্তু যারা করে তাদের মধ্যে আমি নেই। দেশে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে, কীর্তিহাটে থেকে সেটা ঠিক বুঝতে পার না। এক বিয়ের যুগ আসছে। ব্রাহ্মধর্মের হাওয়া বাঁচিয়ে চল, দেখ নি তার চেয়েও জোরালো হাওয়া এনে দিয়ে গেল কামারপুকুরের এক প্রায় নিরক্ষর বামুনের ছেলে। তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ইউরোপকে চমকে দিয়েছে। আমি ওই রাজার ছেলের মত কেষ্ট সেজে কীর্তিহাটে কাঁসাইয়ের পাড়ে বৃন্দাবন লীলাও করতে পারব না, স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শও আঁকড়ে ধরতে পারছি না। I am doomed, শিবেশ্বর। শ্যামাকান্তের উপর যে অভিশাপ তাই হোক, আর না হয় রায়বাহাদুর রত্নেশ্বরের কৃচ্ছ্রসাধনের জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরা প্রবৃত্তি হোক যার জন্যেই হোক, আই এ্যাম লাইক এ শুটিং স্টার। এই জ্বালা নিয়ে আমাকে কীর্তিনাশার জলে ডুবে নিভে যেতে দাও! পাপ-অভিশাপের বোঝা নিয়ে আমাকে ভেসে যেতে দাও, হারিয়ে যেতে দাও।
একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি।
—এগুলো তাহলে ফিরে নিয়ে যাব?
—কি?
—বউদিদির কোম্পানীর কাগজগুলো। তিনি তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—ওঁর কাজে লাগাতে বলো। এ নিয়ে আমি কি করব?
ফিরে দেন নি দেবেশ্বর, নিয়েছিলেন। বলেছিলেন—বলো, নিলাম। আর বলো, আমি যেদিন একলা থাকি, ‘সোবার’ থাকি শিবেশ্বর, সেদিন আমি বসে বসে ভাবি, আমি মরে যাচ্ছি কি মরে গেছি, বড়বউ বুকের উপর নীরবে মাথা রেখে পড়ে আছে, আর তার চোখের জলে আমার মরা দেহখানার বুক ভেসে যাচ্ছে। ভাবতে ভাল লাগে, আমার এত অপরাধ সত্ত্বেও সে আমার মরামুখ ধরে বলছে—এ জন্মে পেয়েও পেলাম না, কিন্তু জন্ম-জন্মান্তরেও যেন পাই তোমাকে। এবার যেন পেতে দিও। ধরা দিয়ো।
চোখ থেকে তাঁর জল গড়িয়ে পড়ছিল। শিবেশ্বর চোখে রুমাল দিয়ে উঠে চলে এসেছিলেন।
এসব কথা আমি ছোট মেজঠাকুমার কাছে শুনেছি সুলতা। মেজঠাকুর্দা মধ্যে মধ্যে এই গল্প বলে ছোট মেজঠাকুমাকে পতিভক্তি শেখাতেন।
ঘড়িতে ঢং-ঢং করে চারটে বাজল।
সুরেশ্বর বললে—কথা শেষ করি সুলতা। রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। তবে শীতের রাত তাই ভরসা।
এরপর হঠাৎ একটা মোড় ফিরল, এর বছর দেড়েক পর। ছোট ছেলে যোগেশ্বর একদিন পালিয়ে এলেন কীর্তিহাট থেকে। সকালবেলা দেবেশ্বর উঠে শুনলেন, যোগেশ্বর এসে বসে আছে বসবার ঘরে। ছোট ছেলে তাঁর প্রিয় ছিল, তার সঙ্গে রুচির মিল ছিল, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছেলে, ইংরিজী ভাল আয়ত্ত করেছিলেন, চমৎকার ইংরিজী বলতেন, সেই কারণে বেশী ভালবাসতেন।
দেবেশ্বর উঠে কথাটা শুনেই মুখে খানিকটা জল দিয়েই হন হন করে এসে ঢুকেছিলেন ছেলেকে দেখবার জন্য। ছেলে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। সারারাত্রি জেগে এসেছিল সে। ছেলে তখন অনেক বেড়েছে, ছোট নেই। ষোল বছরে পা দিয়েছে। কিন্তু দেবেশ্বর রায় শুধু সুকুমার লাবণ্যযুক্ত আর সুপুরুষ ছিলেন না, বলশালী পুরুষ ছিলেন, তিনি ছেলেকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন।
ছোট ছেলে যোগেশ্বর সেবার এন্ট্রান্স দেবে। তিনি পালিয়ে এসেছেন, দাদু তাঁদের দুই ভাইয়ের একসঙ্গে বিয়ের আয়োজন করছেন। কিন্তু তিনি এখন বিয়ে করবেন না। কীর্তিহাটও তাঁর পক্ষে অসহ্য হয়েছে। মা দিন-রাত ঠাকুর নিয়ে আছে আর ভাগবত নিয়ে আছে। আপন মনে কথা বলে। লোকে বলে মাথা খারাপ হয়েছে। দাদা ঠাকুরদার সঙ্গে কাছারী করে। কাকা মামলা-সেরেস্তা দেখে, থিয়েটার করে। কাকীমার বারো মাস অসুখ। সব ভার চাকর আর ঝিয়ের। তাঁর ভাল লাগে নি, তিনি পালিয়ে এসেছেন।
উৎসাহিত হয়েছিলেন দেবেশ্বর রায়। পরের দিনই সমারোহ করে ছেলের পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, স্কুলে নয়, বাড়ীতে; তার জন্য তিন-তিনজন মাস্টার রেখে দিয়েছিলেন। আলমারী ভর্তি বই এনে ঘর বোঝাই করে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা শান্ত এবং সংযত হয়েছিলেন দেবেশ্বর। রায়বাহাদুরের লোক এসেছিল যোগেশ্বরকে নিতে, কিন্তু দেবেশ্বর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এর পরই বাপের কাছ থেকে পেলেন শেষ আঘাত। সেদিন শিবেশ্বর এসে উপস্থিত হলেন। শিবেশ্বর মধ্যে মধ্যে কলকাতায় আসেন, কিন্তু তিনি ওঠেন গোয়াবাগানের বাড়ীতে। রামেশ্বর ল’ পড়ে, সেও থাকে ওই বাড়ীতে। কখনও-সখনও আসে সে। কিন্তু শিবেশ্বর আসেন না। এবার শিবেশ্বর এলেন দেখা করতে; তাতে দেবেশ্বর রায় বিস্মিত হন নি। শুধু ভুরু কুঁচকে উঠেছিল আপনা থেকেই, কিন্তু সেটা পরম বিস্ময়ে পরিণত হল, যখন গাড়ীর ভিতর থেকে শিবেশ্বরের পিছন পিছন নামলেন দেবেশ্বরের কয়লার ব্যবসার পার্টনার। রয় এ্যান্ড চক্রবর্তী কোম্পানী কলিয়ারী প্রোপাইটারস ও কোল মারচেন্টসের অংশীদার মহাদেব চক্রবর্তী নিজে। প্রায়ই আসেন চক্রবর্তী; প্রয়োজনে আসতে হয়। তাঁদেরও বাসা আছে এখানে। কিন্তু এবার শিবেশ্বরের পিছনে পিছনে কেন?
চক্রবর্তী হা-হা করে হেসে উঠে বললেন—কেমন মজাটি হল, দেখেন কেমন? মজা করবার লেগে কিছু বলি নাই আমি। হুঁ।
শিবেশ্বর এবার বললেন—বাবা যজ্ঞেশ্বরের বিয়ের ঠিক করেছেন চক্রবর্তী মশায়ের মেয়ের সঙ্গে।
চক্রবর্তী হা-হা-হা-হা শব্দে হেসে জানবাজারের বাড়ীখানা মুখরিত করে দিয়েছিলেন। রত্নেশ্বর রায় সমস্ত সম্বন্ধ পাকা করে মেয়ের বাপকে পাঠিয়েছেন, ছেলের বাপকে বলবার জন্যে।
বলেছেন—আমার উপর কথা সে বলবে না। তবু একবার বলা উচিত, বলে আসুন। শিবেশ্বরের সঙ্গে যান আপনি। খানিকটা কৌতুকও হবে।
দেবেশ্বর স্তম্ভিতও হন নি, বিস্মিতও হন নি; শুধু তাঁর অংশীদার এবং ভাবী বৈবাহিকের হাসির সঙ্গে গলা মিলিয়ে খানিকটা হেসেছিলেন। মত তাঁকে দিতে হয়েছিল। বেয়াইয়ের আরও দাবী ছিল, তাঁর ছোট মেয়ের সঙ্গে যোগেশ্বরের বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সে হয় নি। দেবেশ্বর বলেছিলেন—না-না, এমন কাজ করবেন না। এ ছেলে আমার বিয়ে দেবার মত নয়। বাজে একেবারে বাজে। তাছাড়া দুই ভাইকে দুই মেয়ে দেবেন, তারপর জামাইরা যদি একজন সামনে থেকে একজন পিছন থেকে আক্রমণ করে আপনার দফা-রফা করে, তখন যে আর বাঁচবার পথ থাকবে না। এটার না আছে জমিদারী বুদ্ধি, না আছে ব্যবসাবুদ্ধি, শুধু বই পড়ে। শুধুই বই। হয়তো বউমাকে আদরই করবে না।
শিবেশ্বর মাথা নিচু করে বসেছিলেন। মহাদেব চক্রবর্তী হা-হা করে হেসে ঘর ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেশ্বর চুপ করে গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। বেয়াইয়ের হাসি শেষ হলে তিনি বলেছিলেন—যজ্ঞেশ্বরের বিয়েতে বাবা মত দিয়েছেন, সেখানে আমার অমতের কোন কারণ নেই।
মহাদেব চক্রবর্তী চলে যাবার পর তিনি বাপকে চিঠি লিখেছিলেন—“আপনি আপনার বড় নাতির বিবাহ শেষ পর্যন্ত একটি বর্বরের গৃহে স্থির করিবেন ইহা আমি ভাবি নাই।”
পিতা উত্তরে লিখেছিলেন—“তোমার ব্যবসা আমি নিরাপদ করিয়া দিলাম। না হইলে এই চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ তোমার সর্বস্ব উদরসাৎ করিত। মহাদেবের দুইটি কন্যা, ছোটটির সঙ্গে যোগেশ্বরের বিবাহ দিলে ভাল করিতে।”
দেবেশ্বর লিখেছিলেন-”ভারতবর্ষের ইতিহাসে গোলকুণ্ডার কথায় পড়িয়াছি, শাহজাদা ঔরংজীব গোলকুণ্ডার সুলতানদের রাজ্য গ্রাস করিবার জন্য গোলকুণ্ডার সুলতানের এক কন্যার সহিত নিজ পুত্রের বিবাহ দিয়া পথ প্রশস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু ভাগ্যচক্র এমনি যে, কনিষ্ঠা কন্যার সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল আবুল হাসান নামক একজন মাতাল চরিত্রহীন মুসলমান যুবকের, গোলকুণ্ডার সিংহাসন সেই ব্যক্তিই পাইয়াছিল। অদৃষ্টে থাকিলে যজ্ঞেশ্বর একলাই চক্রবর্তীর সব কিছুর মালিক হইতে পারিবে। তবে আমি অবগত আছি যে, মহাদেব চক্রবর্তীর দাদা ভোলানাথের এক পুত্রকে সে পোষ্যপুত্র লইয়া সম্পত্তি তাহাকে দিবে। সুতরাং যোগেশ্বরকে অকারণে কয়লার কালি ঘাঁটিয়া লক্ষ্মী সন্ধান করিতে দিব না।”
ছেলের বিয়েতে তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু নিতান্তই নিমন্ত্রিতের মত যাওয়া। আগে থেকে লিখেছিলেন—তিনি বিবিমহলে থাকবেন। কারণ লিখেছিলেন যে, তাঁর খাদ্যাখাদ্যের বিচার আদৌ কড়াকড়ি নয়। রোজই মুরগী খান, অবশ্য মুরগী না হলেও যদি বা চলে, মুরগীর ডিম না হলে চলবে না। এবং একটু নিরালা হলেই ভাল হয়। বিবিমহল তাঁর পছন্দমত স্থান।
রত্নেশ্বর রায় সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন; এমনভাবে সে ব্যবস্থা করেছিলেন যে, দেবেশ্বর রায় অভিভূত এবং স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। বিবিমহলে তাঁকে যিনি অভ্যর্থনা করেছিলেন, তিনি রায়বাড়ীর বড় বউঠাকরুণ উমা দেবী। দেবেশ্বর রায়ের চিরউপেক্ষিতা স্ত্রী। বড় ছেলের বিবাহ, শাশুড়ীহীন সংসারে তিনি জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূ, তিনিই ন্যায়ত কর্ত্রী; তিনি সব ফেলে বিবিমহলে দীর্ঘকাল—পাঁচ বছর পর স্বামীকে অভ্যর্থনা করলেন।
দেবেশ্বর সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন—তুমি?
—হ্যাঁ, আমি।
—বাবার হুকুম বুঝি?
—না। আমার ঠাকুরের হুকুম।
—তোমার ঠাকুর?
—হ্যাঁ, গোবিন্দজী। গোবিন্দজী বললেন যে স্বামীকে দেখ গে আগে।
—তাই বললেন? কথা বলেন নাকি তোমার সঙ্গে?
—হ্যাঁ, বলেন। হাত নেড়ে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দেন। মনে মনে, কানে কানে বলেন। প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছেন এই ধরিত্রীর মত সহ্যশক্তিশালিনী মেয়েটি। চাকর এই সময় ট্রে-তে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকছিল। বড়বউ এগিয়ে গিয়ে ধমক দিয়ে বলেছিলেন—বললাম না, আমাকে ডাকবি, আমি এনে দেব! কেন তুই ডিম ছাড়ালি? আমি ছাড়াব বলি নি?
দেবেশ্বর অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তুমি মুরগীর ডিম নাড়বে, ছোঁবে?
—ছোঁব না? তুমি খাবে, না ছুঁলে কি করে চলবে? ঠাকুর পই পই করে বলে দিয়েছেন। নিজে হাতে ছাড়িয়ে খেতে দিবি। নিজে হাতে। ঘেন্না করবি নি। হ্যাঁ। বাপ রে! বলেন, স্বামীর কাজ না করলেই পাপ।
দেবেশ্বর স্তব্ধ হয়ে বসেই ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর রায়বাহাদুর এসেছিলেন—দেবেশ্বর!
—আজ্ঞে! চমকে উঠে দেবেশ্বর চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। পিতা-পুত্রে সামনা-সামনি দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। ছেলে প্রণাম করেছিল। বাপ নীরবে হাত তুলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন-তোমার উপবাসে কষ্ট হবে বলে শিবেশ্বরকে বলেছি নান্দীমুখ করবার জন্য। বুঝেছ?
—হ্যাঁ, ভালই করেছেন।
এর পর মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে রায়বাহাদুর চলে এসেছিলেন।
.