১১
বত্রিশ দিনের দিন পথ্য পেয়েছিলেন। সেদিন অন্নপূর্ণা দেবী কলকাতা থেকে এসেছিলেন কীর্তিহাট। যাবার সময় তাঁর দেবু ভাইপোকে বলে গিয়েছিলেন—তুই যেন এখনই দাদাকে ফেলে কলকাতা চলে যাস নি দেবু।
দেবেশ্বর হেসেছিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন—চলে যাব এটা তোমরা ভাই-বোনে ধরেই নিয়েছ পিসী?
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্নপূর্ণা বলেছিলেন—হ্যাঁ, দাদা বলছিলেন।
—সে তুমি বলতেই আমি বুঝেছি।
—না, শুধু উনি বলেন নি-আমিও বলছি। আমি তোকে জানি। তোর মত নেমকহারাম আর দুটি নেই। অত্যন্ত স্বার্থপর।
দেবেশ্বর হেসে বলেছিলেন—হ্যাঁ, ওটা আমি মানি। তবে আমার স্বার্থবোধ একটু ভিন্ন রকমের পিসী। স্বার্থ আমার কাছে selfishness যাকে বলে তাও বটে, আবার ওইটের মধ্যেই আমার আসল মানে আসল চেহারা যাকে বলে তাও বটে। তবে এখন যাব না, অন্তত উনি একটু সেরে না ওঠা পর্যন্ত না। এ তোমাকে কথা দিলাম।
কথাটা শুনে খুশী হয়েছিলেন রত্নেশ্বর রায়। ছেলেকে বলেছিলেন—অন্নপূর্ণা আমাকে সব বলেছে। আমি শুনে সুখী হয়েছি। একটা পাওয়ার অব এ্যাটর্নী রেজেস্ত্রী করে দিতে চাই তোমার নামে। আমাকে তোমরা খালাস দাও। আর—
একটু চুপ করে থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—আমি বাপ তুমি ছেলে। আমি যা চাই তা তুমি জান। কিন্তু তা বলে তাই নিয়ে তোমাকে কষ্ট আমি দেব না, দিতে চাইনে! শুধু আমার অনুরোধ—ভোগকে ব্যভিচার করো না, মদ যদি খাও বা না খেয়ে থাকতে নাই পার—খাওয়ায় যদি দোষ আছে মনে নাই হয় তোমার তবে খেয়ো। আমার বাবা খেতেন, পিতামহ খেতেন—তাঁরাও। মানে সোফিয়া বাঈকে আমি মায়ের মতই দেখেছি—শেষ কালটায়। আমার মা-তাঁর হাতেই বাবার সেবার ভার দিয়ে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই মদে যেন তোমাকে না খায়, আর ভোগকে ব্যভিচার করে তুলো না।—
দেবেশ্বর রাঙা হয়ে উঠেছিলেন, মুখে কিছু বলেন নি।
রত্নেশ্বর বলেছিলেন—জমিদারী চালাবার ব্যবস্থা তুমি যেমন ভাল বুঝবে করবে—তাতে আমি কোন আপত্তি করব না। একটু সারলেই আমার ইচ্ছে পুরী গিয়ে আশ্বিন মাসটা থেকে শরীর সেরে, একবার তীর্থও দর্শন করব। ইংরেজদের দৌলতে তীর্থভ্রমণে আর কষ্ট নেই—যার যেমন বিত্তের সাধ্য সে তেমনি আরামে যেতে পারে। শিবেশ্বর তোমার কাছে থাকবে, রামেশ্বর এবং ছোট বউমাকে নিয়ে আমি বরং যাব, কি বল?—
সুরেশ্বর বললে-রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রী থেকে চমৎকার একখানা ‘ভারত দর্শন’ নামে ভ্রমণবৃত্তান্ত রচিত হতে পারত। সুন্দর বর্ণনা তাঁর। হয়তো ঐরকম ইচ্ছে তাঁর ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজে পরিণত হয় নি। পুরীতে মাস দুয়েক থেকে, পুরী থেকে দক্ষিণে মাদ্রাজ হয়ে রামেশ্বরম্ এবং ফেরবার সময় ভারতের পশ্চিম উপকূল হয়ে দ্বারকা, সেখান থেকে রাজস্থান, পাঞ্জাব, চিতোরগড়, জ্বালামুখী হয়ে কুরুক্ষেত্র, সাবিত্রী, দিল্লী, আগ্রা, বৃন্দাবন এসে সেখানে কিছুদিন থেকে বাড়ী ফিরেছিলেন এক বৎসর পর। এর মধ্যে প্রতিটি স্থানে তাঁর কাছে পত্র গেছে—এক কর্মচারীদের লেখা পত্র ছাড়া অন্য কোন পত্র তিনি খোলেন নি পড়েন নি। এক বৎসর পর যখন তিনি ফিরলেন—তখন তাঁর কাছে শিবেশ্বরের লেখা খামের চিঠি বারো-চৌদ্দখানা, না-খোলা অবস্থায় তাঁর ব্যাগে বন্ধ ছিল। কর্মচারীদের চিঠিতে সংসারের পরিজনদের কুশলেই তিনি তুষ্ট ছিলেন—তার বেশী কিছু চান নি।
যেদিন ফিরেছিলেন সেদিন কীর্তিহাটে উৎসব হয়েছিল।
হাসলে সুরেশ্বর।—
দেবেশ্বর রায় এ উৎসবের পরিকল্পনা করেছিলেন।
সে উৎসব খাঁটি সাহেবী কায়দায়। কাঁসাইয়ের ঘাট পর্যন্ত এসেছিলেন পাল্কীতে। তারপর কাঁসাইয়ের ঘাট থেকে ল্যান্ডো-গাড়ীতে। বাপের অনুপস্থিতিতে এ গাড়ী এবং একজোড়া বাদামী রঙয়ের ঘোড়া কিনেছিলেন দেবেশ্বর রায়।
ঘাট থেকে সেই গাড়ীতে চড়িয়ে বাপের সামনের সিটে ছোট দুই ভাইকে বসিয়ে নিজে কোচবক্সে বসে ঘোড়ার রাশ ধরে চালিয়ে গ্রামে ঢুকেছিলেন।
রায়বাহাদুর গাড়ীতে উঠতে গিয়ে পাদানীতে পা রেখে থমকে গিছলেন; বলেছিলেন—কই যজ্ঞেশ্বর কোথায়? সে আসে নি? অসুখ-বিসুখ করে নি তো?
বড় নাতিকে তিনি প্রাণের তুল্য ভালবাসতেন। বয়স তখন ষোল হয়েছে। তাকে তিনি ওই ঘাটেই প্রত্যাশা করেছিলেন এবং তাকে তাঁর পাশে বসিয়ে নিয়ে যাবেন ভাবছিলেন। দেবেশ্বর বলেছিলেন-না, তাকে আনি নি। কারণ যোগেশ্বর ধনেশ্বর জগদীশ্বর এদের তিনজনকেও তা হলে আনতে হত। ওটা ঠিক আমি পছন্দ করি না। যজ্ঞেশ্বর আসবে আর ওরা বাড়ীতে পড়ে থাকবে—কাঁদবে, সেটা অন্যায় হত।
বলেই তিনি বাপকে অনেকটা হাতে ধরে উঠিয়ে দিয়ে নিজে কোচবক্সে উঠে বসেছিলেন। তাঁর রাশের টান পেয়েই ঘোড়া দুটো লাল কাঁকর বিছানো রাস্তার উপর চলতে শুরু করেছিল—ঘাড় বেঁকিয়ে—। দেবেশ্বরের শক্তহাতের টানে ঘাড় বেঁকিয়ে মন্থর গতিতে চলছিল তারা বাধ্য হয়ে। দ্রুত গেলে রাস্তার দুধারের লোক রায়হুজুরকে দেখতে পাবে না।
এই গাড়ীর জন্যে গ্রামের রাস্তাকে পাকা করতে হয়েছিল। তার উপর ফটক তৈরী করে, দুদিকে কলাগাছ এবং আমের শাখা দেওয়া জলভর্তি কলসী বসিয়ে দিয়েছিলেন—রাস্তার দুধারে খুঁটি পুঁতে আমের শাখা ঝুলিয়ে দিয়েই শেষ হয়নি, দুধারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন চাপরাসীদের। তারা বন্দুকের নল উপরদিকে তুলে পর পর ষোলটা ফায়ার করে মালিককে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। শুধু গ্রামের লোক নয়—আশেপাশের পাঁচ-সাতখানা গ্রামের লোক রায়বাহাদুরের প্রত্যাবর্তন দেখতে নিজে থেকেই ভিড় করে জমায়েত হয়েছিল কীর্তিহাটে। সেদিনের ভাণ্ডারের খাতায় চালের খরচ দেখেছি কুড়ি মন। তার অর্থ দু হাজার লোকের খাবার বরাদ্দ। সন্ধ্যার সময় পুড়েছিল বারুদের কারখানা।
রত্নেশ্বর রায় নিজে ডায়রীতে লিখেছেন—“ল্যান্ডো গাড়ীতে আরোহণ করিয়া পুষ্পমাল্য শোভিত হইয়া বাঁশ ও ফুলপাতায় নির্মিত তোরণগুলির মধ্য দিয়া গ্রামে প্রবেশ করিলাম—বন্দুকের ধ্বনি হইতে লাগিল—পথের দুই পার্শ্বে লোকজনেরা ভিড় জমাইয়া দাঁড়াইয়া আছে—এসব দেখিয়া ভালই লাগিল। বুঝিতে পারিলাম—শ্রীমান দেবেশ্বর এক বৎসরের মধ্যে এস্টেটের ভোল পাল্টাইয়া ফেলিয়াছে। সমস্ত দারোয়ানদের পোশাক এবং চাপরাস দেওয়া হইয়াছে। মনে হইতেছে ইহা যেন একটি ছোটখাটো রাজ্য এবং আমিই তাহার অধীশ্বর। সমস্ত কিছুর মধ্যে আশ্চর্য একটি শৃঙ্খলা দেখিয়া বড় ভাল লাগিল। দূর হইতে রায়বাড়ীর চিলের ছাদ ও ছাদের আলসেগুলি নীল আকাশের গায়ে গ্রামের গাছপালার শ্যামশোভার ঊর্ধ্বে চিত্রবৎ শুভ্র শোভায় ঝলমল করিতেছে। বুঝিলাম—মদীয় প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে বাড়ীঘর সবই চুনকাম করানো হইয়াছে। জানালা দরজায় রঙ হইয়াছে। গাড়ী আসিয়া রায়জননী মা শ্যামাসুন্দরীর ফটকে দাঁড়াইল। আমি গাড়ী হইতে নামিতে নামিতে মাটিতে পা দিয়াই বিস্মিত হইয়া গেলাম—। দেখিলাম পুরাতন ফটক নাই—তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া নূতন ফটক তৈয়ারী হইয়াছে। প্রথম প্রবেশপথেই দেখিলাম গোটা জগৎটাই পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে।”
ফটকটা তৈরী করিয়েছিলেন কুড়ারাম রায় নিজে। ফটকের দুই পাশে দুটো বিরাটকায় প্রহরীর মুর্তি ছিল। পঙ্কচুনের কাজকরা মূর্তিদুটো মজবুত ছিল খুব—কিন্তু রুচিসম্পন্ন ছিল না। সেকালের নতুন তেলেঙ্গী সিপাইয়ের আদর্শে, খাটো কুর্তা হাঁটু পর্যন্ত বকলস আঁটা, টাইট পেন্টুলান পরা মূর্তি ছিল। গোল গোল বড় বড় চোখ—তেমনি পাকানো গোঁফ; সে সব আবার রঙ লাগিয়ে মূর্তি দুটোকে আরও ভয়াল করে তোলা হয়েছিল। ছোট ছোট ছেলেপুলেরা মূর্তি দুটো দেখলে ভয় খেতো; হয়তো বা যেসব গ্রাম্য দরিদ্র প্রজারা মনের দিক থেকে শৈশব বা বাল্যকাল অতিক্রম করেনি—তারাও জমিদার বাড়ী ঢুকবার সময় আতঙ্কিত হয়ে এখানে প্রবেশ করত।
সে দুটোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে, তার চিহ্নমাত্র নেই। তার স্থলে দুপাশে দুটো পাথরের সিংহ বসানো হয়েছে। সামনের দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে থাকা ভঙ্গিতে তৈরী সিংহের মূর্তি দুটো অদ্ভুত। রত্নেশ্বর এ ধরনের বা এ গড়নের পাথরের ছোট ছোট সিংহ উড়িষ্যায় দেখেছেন। এ দুটো দেখতে অবিকল সেই রকম হলেও আকারে বেশ বড়; অন্তত নিচের দিকে হাত তিনেক উঁচু পাথরের থামের উপর বসিয়ে অনেক বেশী উঁচু করে তোলা হয়েছে।
রত্নেশ্বর থমকে দাঁড়ানোর জন্যই সমস্ত কিছু যেন একটা হুঁচোট খেয়ে গেল। স্তব্ধ রায়বাহাদুর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সিংহ দুটোর দিকে। একবার এটাকে দেখছেন—একবার ওটাকে।
ওদিকে তখন ভিতরে নাটমন্দিরে শাঁখ বাজছে, দুটি সধবা মেয়ে পূর্ণকুম্ভ কাঁখে নিয়ে ফটকের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে—ম্যানেজার থেকে কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে একদিকে—মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ীর মেয়েরা—মানে বড়বউ এবং মেজবউ-তাঁদের পিছনে রায়বাড়ীর অনেক পোষ্য। মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন পুরোহিত; মায়ের পূজক এবং পরিচারকেরা। মিনিট দুয়েক রায়বাহাদুর দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন মূর্তি দুটো। এই দু মিনিট কাল সময়ই যেন অনেক বেশী সময় বলে মনে হয়েছিল সকলের। রায়বাহাদুরের কপালে সারি সারি রেখা জেগে উঠেছে। রত্নেশ্বর রায়ের কপালখানি ছিল প্রশস্ত এবং চিত্তের সামান্য ক্ষোভে বা বিরক্তিতে পাঁচটা সমান্তরাল রেখা জেগে উঠত। চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠত তীক্ষ্ণ। তাঁর অসন্তোষ বুঝতে কারুর বাকী রইল না।—
বড়ছেলে দেবেশ্বর এসে কাছে দাঁড়ালেন, বললেন—ভিতরে চলুন। সকলে অপেক্ষা করছেন।
—এ সিংহ দুটো?
উড়িষ্যার তৈরী। আপনি তীর্থে বেরিয়ে গেলেন পুরী থেকে—আমি ফিরবার সময় কোনারক ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম। সেখান থেকে স্যান্ডস্টোনের সিংহমূর্তি নিয়ে এসে, কলকাতায় সায়েব কোম্পানীকে বরাত দিয়ে, মার্বেলের বড় সাইজের করিয়ে আনিয়েছি। সে মূর্তি দুটো অত্যন্ত খারাপ ছিল, দেখতে ভালগার। এ দুটো ভাল হয় নি?
ছেলের মুখের দিকে তাকালেন রায়বাহাদুর। দেখলেন টকটকে ফরসা রঙ বড় বেশী লাল হয়ে উঠেছে, সম্ভবতঃ এতক্ষণ এই শক্তিমান ঘোড়া দুটোর রাশ ক’ষে টেনে ধরে এসে পরিশ্রম বেশী হয়ে গেছে। তিনি বললেন-ভাল নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু ও মূর্তি দুটো আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা কালীবাড়ী তৈরী করাবার সময় নিজের পছন্দমত করে তৈরী করিয়েছিলেন তো!
—আছে সে দুটো। গোটাগুটি তুলবার চেষ্টা করিয়েছিলাম, কিন্তু ঠিক পারা যায় নি। কিছু কিছু ভেঙে গেছে; ফেটেও গেছে। হয়তো বা আর কিছুদিনের মধ্যেই আপনা-আপনিই ফাটত—বয়স তো কম হল না—১৭৯৫ সাল আর এটা ১৮৯৬ সাল একশো এক বছর হয়ে গেল।
—হুঁ। বলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন রত্নেশ্বর রায়; তারপর অকস্মাৎ যেন সচেতন হয়ে বলেছিলেন—চল ভিতরে চল। ব’লে পা বাড়িয়েছিলেন। মন্দিরের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে চারিদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে খুঁজতে ডেকে উঠেছিলেন—দাদু, দাদুরা কই? অর্থাৎ নাতিরা!
দেবেশ্বর বলেছিলেন -মাকে প্রণাম করুন, তারপর সকলে এসে আপনাকে প্রণাম করবে।
রত্নেশ্বর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—দীর্ঘজীবী হও।
অপর সকল নাতিরা এসে প্রণাম করলে তাঁকে।—এল না কেবল বড়নাতি। সে শরীর খারাপ বলে ঘরে শুয়েছিল। তার সঙ্গে দেখা করতে ঢুকলেন রত্নেশ্বর রায় দেবেশ্বর বারান্দায় থমকে দাঁড়ালেন—বললেন —আমি এখন আসছি। দরকার হলে ডেকে পাঠাবেন।
বলেই, চলে গেলেন।
রত্নেশ্বর রায় নাতির ঘরে ঢুকলেন।—কি হয়েছে দাদু?
* * *
নাতির ঘর থেকে বের হলেন একটু গম্ভীর মুখে—তারপর রায়বাড়ীটার প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখে এসে নিজের ঘরে ঢুকলেন। এতক্ষণে প্রথম কথা বললেন —বললেন, আমার ঘরটা তেল-রঙ না করলেই ভাল করতে। সাদার চেয়ে কোন রঙ আমার ভাল লাগে না, আর তেলরঙের একটা গন্ধ আছে। আঃ। ওটা আবার কি? ও, কেরোসিন তেলে চলা পাখা! না-না-না। ওটা বড়বাবুর ঘরে দাও। না, বড়বাবুর আর মেজবাবুর ঘরে পাখা তো আছে। তা হলে যেখানে হোক দাও। কেরোসিন তেলে চলা পাখার বাতাস গরম হবে—একটা গন্ধ হবে গ্যাসের। আমার টানা পাখা ভাল।
পরের দিন নতুন কাছারী ঘরে এসে বসেই আবার উঠে পেলেন। এসে বসলেন দেবোত্তরের সাবেক কাছারী ঘরে, যেখানে সোমেশ্বর রায় বসতেন; সেখান থেকে উঠে নিজের শোবার ঘরে ইজিচেয়ারে বসে বললেন—এখানেই আমার বসবার জায়গা করতে বল। আর তোমাদের বড়বাবুকে গিয়ে বল, গত বছরের কাগজপত্র একটু দেখতে চাই। জমাখরচ—রোকড়খানা আর মোটামুটি আয়ব্যয়ের হিসেবটা।
তিনদিন পর দেবেশ্বর এসে পাশে দাঁড়ালেন।
খাতা দেখছিলেন রত্নেশ্বর রায়। মুখ তুলে বললেন—ভাবছিলাম তোমাকে ডাকতে পাঠাব। কয়েকটা খরচের ব্যাপার—
—খাতা সব দেখলেন?
—হ্যাঁ। সবই ঠিক আছে প্রায়। হ্যাঁ, তবে মামলা সেরেস্তায় কয়েকটা ডিক্রি আদায়ের ব্যাপারে—
—আপনার যদি আপত্তি থাকে তবে ও টাকা আমি পূরণ করে দেব। বোধ হয় হাজার পনের হবে।
—হ্যাঁ। চোদ্দ হাজার পাঁচশো কয়েক টাকা কয়েক আনা কত পাই যেন। না-না। ও তুমি ঠিক করেছ বেশ করেছ।
—হ্যাঁ, মহেশ্বর দাসের উপর তিরিশটা নালিশে আমাদের সুদ আর খরচা নিয়ে বিশ হাজার টাকার ডিক্রী হয়েছিল। সে শুনেছি উদ্ধত লোক। তা উদ্ধত একটু তো হবেই। বছরে সাড়ে তিন হাজার টাকা খাজনা দেয়, জমি অন্তত দু হাজার বিঘের কাছাকাছি। আমাদের গোমস্তাদের মাইনে দিয়ে সে রাখতে পারে। সে লোক এল কাছারীতে, আমি ডিভিশনাল কমিশনার এবং কালেক্টরের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় পায়ের কাছে টাকার তোড়া নামিয়ে দিয়ে প্রণাম করে হাত জোড় করে বললে —হুজুর, আমাকে বাঁচান তো বাঁচি নইলে আমাকে মরতে হবে। স্ত্রীপুত্র নিয়ে ভিক্ষে করতে হবে। আমি কি করব; বহুলোকের সামনে ব্যাপার; আমি ভেবে দেখবারও অবকাশ পেলাম না—টাকার তোড়াটা তুলে নিলাম। ব্যাপারটা খানিকটা জানা ছিল—বললাম, আর আমাদের কর্মচারীদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করবে না তো? খাজনা দেব না, নালিশ করে নাও গে—বলবে না তো? বললে—তা কখনও বলি নি হুজুর; কিন্তু আপনার গোমস্তা–ও তো হুজুর আমারই জ্ঞাতি, ওকেও আমিই হুজুরদের দরবারে জামিন হয়ে গোমস্তার আমলার কাছে ঢুকিয়েছিলাম। তার পরেতে উন্নতি হল —হুজুরদের বিশ্বাসের লোক হল—হয়ে হুজুর আমার মাথাতেও পা দিয়ে হাঁটতে চাইলে। চোখ রাঙাতে লাগল। কি করব হুজুর, আমি রাগের বশে একদিন, চামড়ার মুখ তো—বলে ফেললাম, নালিশ করে লে গা! বিনা নালিশে দোব না। বলেছিলাম—বলা বটে! আমি টাকার তোড়াটা নিয়ে সেখানেই তাকে খালাস দিয়ে এলাম। তারপর ঠিক এই ধরনের ডিক্রীর খাতক প্রজা অনেক কজন এল। তাদের সব বিভিন্ন রকম ব্যাপার। সব ক্ষেত্রেই—
চুপ করে গেলেন দেবেশ্বর। কারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের সম্পত্তির সারাংশের মত কোন কোন বিশেষ ভূমি বা বাগান বা দীঘির জন্য প্রলুব্ধ হয়েছিলেন নিজে শিবেশ্বর। তা দিতে রাজী না হওয়ার জন্য শিবেশ্বরই সুকৌশলে গোমস্তাদের দিয়ে প্রজার সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে নালিশ চাপিয়েছেন তাদের উপর। কথাটা কিন্তু বাপকে মুখে বলতে পারলেন না দেবেশ্বর
রত্নেশ্বর বললেন—তোমার নোট আছে আমি দেখেছি। এবং বুঝেছি কার কথা বলতে গিয়েও তুমি পারো নি। শিবেশ্বরের এই স্বভাব আমার মাথা হেঁট করে। তাই তোমার উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু—
একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—শিবেশ্বর কটা খরচের কথা বলেছিল,—দেখলাম তোমার নামে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে একবার পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছ—
—খাতা সব দেখেছেন তা হলে?
—হ্যাঁ, দেখেছি। আরও একবার আট হাজার টাকা—
–সেটা আমাদের এস্টেটের তরফ থেকে খবরের কাগজের শেয়ার কিনেছি। আর আমার নামে নেওয়া টাকাটা—ছোট খোকা যোগেশ্বরের গবর্নেসের অপমান করেছিল যজ্ঞেশ্বর; তার দরুন তাকে ক্ষতিপূরণ বলুন, হ্যাঁ, তাই ছাড়া আর কি বলব—তাই দিয়েছি। কিন্তু সে টাকা তো আমি—
গলা পরিষ্কার করার ছলে রত্নেশ্বর একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাতে দেবেশ্বর থামেন নি—তিনি বলেছিলেন—সে টাকা পরে কলকাতা থেকে চেক ভাঙিয়ে এনে তো এস্টেটে জমা দিয়েছি।
রত্নেশ্বর এবার বললেন—কথাটার আলোচনা থাক। আমি সব শুনেছি।
রত্নেশ্বর রায় তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এক বছর। এই এক বছরের মধ্যে দেবেশ্বর এস্টেটের ভার নিয়েছিলেন—কিন্তু কলকাতার বসবাস ছাড়েন নি, ছেলেরা কলকাতার স্কুলে পড়ে; তিনি আসা যাওয়া করতেন। থাকতেন বিবিমহলে। মেজভাই শিবেশ্বরের স্ত্রী সংসারের গৃহিণী ছিলেন। পূজোর সময় স্কুল আপিস বন্ধ; এই সময় দেবেশ্বর স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে কীর্তিহাট এসেছিলেন। সঙ্গে এসেছিল এক মেমসাহেব।
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, আমার বাবাকে তিনি ইংরিজী পড়াতেন, আর দেবেশ্বর রায়ের চিঠিপত্র লিখতেন। অন্ততঃ সেই পরিচয়েই মেমসাহেব এসেছিল। কিন্তু ওই পরিচয়টা ছিল নিতান্তই একটা নামাবলীর মত। কীর্তিহাটের সমাজ, বাড়ীর দেবদেবীর পূজার্চনায় বাধার চেয়েও শিবেশ্বরের আপত্তি খণ্ডনের জন্যই নামাবলী তিনি পরিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটির আসল পরিচয় গোপন করবার মত সতর্ক মানুষ দেবেশ্বর ছিলেন না। মেয়েটি ছিল তাঁর অনুগৃহীতা। জীবনে দেবেশ্বর রায় অনেক ভুল করে গেছেন; কিন্তু অনুশোচনা কোন কিছুর জন্যে করেন নি। অনুশোচনা এবার এই ভুলের জন্য করতে হয়েছিল। তিনি তাঁর জমিদারীর ঐশ্বর্য দেখাতে এনেছিলেন শ্বেতাঙ্গিনীটিকে। লর্ড বা আর্ল বা ডিউক অব্ কীর্তিহাটের কাল্ এবং এস্টেটের ঐশ্বর্য দেখাবার জন্য এনেছিলেন। পুজোর পরই কালীপূজো, সে সময় কীর্তিহাটে উৎসব হয়; সেবার দেবেশ্বর সে উৎসব বাড়িয়েছিলেন। তাছাড়া রেল লাইন হয়ে অবধি রায়বাড়ীর বজরাগুলো প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো মেরামত করিয়ে কাঁসাইয়ের মোহনায় পড়ে, ভাগীরথী ধরে, সুন্দরবনের শোভা দেখাবার কল্পনাও ছিল তাঁর। কিন্তু একটা কথা ভাবেন নি। ভাবেন নি বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বরের বয়স পনের বছর হয়েছে এবং ঠিক এই পনের বছর বয়েসে তিনি নিজে ভায়লেটের প্রেমে পড়ে রত্নেশ্বর রায়ের মত বাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।
সুলতা, আমার পিতামহী উমা দেবী ছিলেন মূর্তিমতী সহিষ্ণুতা, তিনি নীরবে সব সহ্য করে যেতেন। স্বামীর যোগ্যা স্ত্রী নন বলে আক্ষেপ ছিল, অভিমান ছিল, অনুচ্ছ্বসিত সমুদ্রের মত তার সমস্ত স্রোত, গতিবেগ অন্তরে অন্তরে সঞ্চারিত হত; গভীর রাত্রে কাঁদতেন তিনি। তখন স্বামী বিলিতী মদের নেশায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকতেন। বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বর এ সব লক্ষ্য করেছিলেন। এবং তখন তাঁর কানে এসে পৌঁছেছে বাংলা দেশের নতুন আহ্বান।
স্বামী বিবেকানন্দের তখন শিকাগোতে ধর্মসম্মেলনে বিশ্বজয় হয়ে গেছে। ধনীর পুত্র যজ্ঞেশ্বর মুচি-মেথরকে, নির্ধন-দরিদ্রকে ভাই বলতে পারেন নি, কিন্তু সায়েবীয়ানার উপর, মদ্যপানের উপর একটা বিদ্বেষ জন্মেছে। ধর্মের প্রতি একটা অনুরাগ এসেছে। কিন্তু সে অনুরাগ—খানিকটা বাপের আচরণের উপর যে ক্রোধ, সেই ক্রোধ। ক্রোধ এবং ক্ষোভ কিংবা বলতে পার যজ্ঞেশ্বর রায়ের জীবনের ভিতের পত্তন হয়েছে ওই মাল-মশলায়। নইলে চরিত্রে তিনি বিচিত্র, তার পরিচয় কিছু পেয়েছ; বলেছি অর্চনার বিয়ে প্রসঙ্গে। কুইনির বাড়ী প্রসঙ্গে। এক নরনারীর সম্পর্ক সম্বন্ধে কুটিল সন্দেহ আর ওই দিকে নিজের চরিত্রের সততার কৃচ্ছ্রসাধন ছাড়া অন্য কোন সততা বল, সততার সাধনা বল কিছু ছিল না। প্রথম যৌবনে অনেক দিন পর্যন্ত মদ খান নি, তারপর তান্ত্রিক দীক্ষা নিয়ে দীক্ষার দোহাই দিয়ে মদ্যপান করেছেন। কয়লার ব্যবসায়ে একসময় উথলে উঠেছিলেন, বিশেষ করে গত প্রথম মহাযুদ্ধের সময়, সে-সময় তিনি জাপানে কয়লা সরবরাহ করতেন। অর্ডার পাবার জন্য জাপানী ফার্মের সাহেবদের নিমন্ত্রণ করতেন বাগানবাড়ীতে। সেখানে নাচগান হত। তিনিই উদ্যোগ করতেন। নারীর রূপ আর তার দেহ, এই দুটোর বিনিময়ে সব কিছুই পেতে পারে মানুষ। কিন্তু সে যজ্ঞেশ্বর রায় ১৯১৪-১৫ সালের যজ্ঞেশ্বর রায়। ১৮৯৪-৯৫ সালে যজ্ঞেশ্বর রায় আদর্শবাদী ছিলেন। দাম্ভিক আদর্শবাদী। জমিদারের ছেলে, দেবেশ্বর রায়ের বড় ছেলে, রত্নেশ্বর রায়ের প্রথম পৌত্র, তাঁর যদি দম্ভ না হবে তো হবে কার? দাম্ভিক যজ্ঞেশ্বর রায় সেদিন বাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি এই শ্বেতাঙ্গিনী মহিলাটিকে সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু কলকাতায় কিছু বলবার অবকাশ পেতেন না। মহিলাটি সকালে একবার আসতেন- যোগেশ্বরকে ইংরেজী শেখাতেন, দেবেশ্বরের কাছে দু-চারখানা চিঠি ডিটেশন নিতেন, নিয়ে ফিরে যেতেন। দেবেশ্বর রায় তাঁর একটা ভাড়া-করা বাড়ীতে সন্ধ্যার পর গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। মদ্যপান করে গাড়ীতে বেড়ানো ছিল একটা শখ। কোন কোন দিন ডিনার খেয়ে বাড়ী ফিরতেন।
বাড়ীতে স্ত্রী উমা জেগে বসে থাকতেন, একখানি ধর্মগ্রন্থ নিয়ে। পড়েই যেতেন, পড়েই যেতেন। জীবনের কুড়িটা বৎসর ওই একখানি বই-ই তিনি পড়ে গেছেন; কতবার পড়েছেন, তার হিসেব নিজেও রাখেন নি। বইখানি শ্রীমদ্ভাগবতের বাংলা অনুবাদ। যজ্ঞেশ্বর রাত্রি এগারোটায় বারোটায় উঠে এসে উঁকি মেরে দেখে যেতেন; মাকে জেগে বই খুলে বসে থাকতে দেখে শুধু বলতেন—এখনও শোও নি মা?
মা বিচিত্র হেসে বলতেন-না রে। ভাগবতের উপাখ্যানটা শেষ করে নিই, তারপর শোব।
যজ্ঞেশ্বর জানতেন। কোন্ উপাখ্যান পড়ছ জিজ্ঞাসা করলে মাকে বই দেখে তবে বলতে হবে, তাই আর কোন কথা না বলেই চলে যেতেন। ক্রুদ্ধ হতেন বাপের উপর এবং এই বিদেশিনীর উপর। কিন্তু বলতে কিছু পারতেন না। সুযোগ পেলেন এখানে।
সেদিন সকালে বিবিমহলে বসে দেবেশ্বর আর বিদেশিনী চা খাচ্ছিলেন। কীর্তিহাটে এসে অবধি এটা হয়েছিল তাঁর নিত্যকর্ম। মেমসাহেব নিজের চায়ের কাপে চা ঢালছিলেন, দেবেশ্বরের সামনে টেবিলের উপর তাঁর চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল, তিনি অপেক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রিয়পাত্রীর চায়ের জন্য। হঠাৎ ছোট ছেলে যোগেশ্বর ছুটে এসে ঘরে ঢুকে তাঁর ‘আন্টির হাত ধরে টেনে বলেছিলেন—আন্টি কাম এ্যান্ড সি, আন্ডি! এ ভেরী বিগ বীয়ার।
একটা লোক ভালুক নাচাতে এসেছিল, ভালুকটা ছিল খুব বড়, সেইটে তিনি আন্টিকে দেখাবার আগ্রহে ছুটে এসে তাঁর হাত ধরে টেনেছিলেন। আন্টিকে যোগেশ্বর ভালবাসতেন। যজ্ঞেশ্বরের মত তাঁর প্রতি তাঁর বিরাগ ছিল না।
এর পিছনে আরও একটা কারণও ছিল, সেটা দেবেশ্বর রায় বলে গেছেন। এই মহিলাটিকে দেবেশ্বর কেবল যোগেশ্বরের জন্যেই রাখেন নি, দুই ছেলেকেই ইংরিজীতে কথা বলতে শেখাবে বলে রেখেছিলেন। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর গোড়া থেকেই ইংরিজীতে কাঁচা ছিলেন, ইংরিজী তিনি ভালবাসতেন না; মেমসাহেবও এই অবাধ্য ছাত্রটির ওপর প্রসন্ন ছিলেন না। কিন্তু যোগেশ্বর ইংরিজী ভালবাসতেন, বলতে পারতেন চমৎকার! শুধু ইংরিজীতেই নয়, অন্য সব বিষয়েও ভাল ছাত্র ছিলেন। ‘আণ্টি’কে তিনি এইজন্যেই ভালবাসতেন এবং এই জন্যই এত বড় ভালুকটা তাঁকে দেখাবার জন্যে ছুটে এসে তাঁর হাত ধরে টেনেছিলেন। সে টানে আন্টির হাতের চায়ের কেটলীটা চায়ের কাপ থেকে সরে এসে তাঁর পোশাকের উপর গড়িয়ে পড়েছিল, খানিকটা পায়ের উপরেও গড়িয়ে পড়েছিল।
আন্টি এটা সহ্য করতে পারেন নি। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কেটলীটা টেবিলের উপর রেখে যোগেশ্বরের গালে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছিলেন। চড়ের জোরটা সজোর বলেও তার মাত্রা ঠিক বোঝানো যাবে না; গৌরবর্ণ রঙ রায়বংশে কুড়ারাম রায়েরও আগে থেকে বাসা বেঁধেছে; যোগেশ্বরের গালের সুন্দর রঙের উপর মেমসাহেবের পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ ফুটে উঠেছিল।
যোগেশ্বর আঘাত যত পেয়েছিলেন, তার থেকে মনে আহত হয়েছিলেন বেশী। তিনি গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিবিমহল থেকে চলে আসছিলেন অন্দরের দিকে; পথের উপর ওদিক থেকে ঘোড়ায় চড়ে প্রাতভ্রমণ সেরে ফিরছিলেন বড় ভাই যজ্ঞেশ্বর। পরস্পরকে দেখে পরস্পরেই থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। যজ্ঞেশ্বর ঘোড়ার রাশ টেনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি হল? কাঁদছিস কেন রে?
গালের হাতটা সরিয়ে আঙ্গুলের দাগগুলো দেখিয়ে যোগেশ্বর বলেছিলেন—মারলে।
—কে?
—আন্টি!
ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে যজ্ঞেশ্বর তার গালের দাগগুলো দেখে ঘোড়াটার লাগাম পথের ধারে একটা গাছের ডালে আটকে দিয়ে চাবুকটা হাতে করে হন হন করে জুতোর শব্দ তুলে বিবিমহলের ছত্রিঘরের দিকে উঠে গিয়েছিলেন। এবং রক্তচক্ষে মেমসাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন—যোগেশ্বরকে এমন করে মেরেছ কেন? হোয়াই?
চমকে গিছলেন মেমসাহেব। দেবেশ্বরও চমকে ছিলেন। কিন্তু করতে কেউ কিছু পারে নি। যজ্ঞেশ্বর নিজের হাতের চাবুক দিয়ে মেমসাহেবের পিঠে আঘাত করে বলেছিলেন—এইটে বুড়ো আঙুলের দাগের জন্যে, এইটে তর্জনীর দাগের জন্যে, এইটে মধ্যমার দাগের জন্যে, এইটে
ততক্ষণ দেবেশ্বর উঠে এসে যজ্ঞেশ্বরের সামনে দাঁড়িয়েছেন।
যজ্ঞেশ্বর চারবারের বার চাবুকটা তুলে আর নামান নি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাবুকটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরে যেমন হন হন করে গিয়েছিলেন, তেমনিভাবেই চলে এসেছিলেন।
দেবেশ্বর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই ছিলেন, যেন পাথর হয়ে গেছেন।
এর পরের ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত। মেমসাহেব বলেছিলেন–তোমাকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি।
দেবেশ্বর বলেছিলেন—দাঁড়াও। দয়া করে আধ ঘণ্টা সবুর কর।
বলেই হুকুম দিয়েছিলেন, কোচম্যানকে বল গাড়ী আনতে। যত তাড়াতাড়ি হয়।
আর একখানা কাগজে স্লিপ লিখে ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, পাঁচ হাজার টাকা এখুনিই পাঠিয়ে দিন। আমার নিজের নামে খরচ পড়বে। হাওলাত লিখবেন। টাকাটা পরে দেব।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ীতে করে মেমসাহেবকে নিয়ে তিনি কলকাতা রওনা হয়ে গিয়েছেন।
* * *