১০
সুরেশ্বর বললে—এর পর হার মেনেছিলেন রত্নেশ্বর। দেবেশ্বরকে কলকাতা ফিরে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাপ-বেটায় একটা আপোস হয়েছিল। রত্নেশ্বর দেবেশ্বরের ভিক্ষে-মা কৃষ্ণভামিনীর সম্পত্তির দুইয়ের তিন অংশের দাম হিসেবে পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা আর কলকাতার বাড়ী লিখে দিয়ে বলেছিলেন—আমি বিবেচনা করে দেখলাম, ওই সম্পত্তিটা ষোল আনা তোমারই প্রাপ্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে যখন আর হবার উপায় নেই এবং তিন ভাগের দু ভাগ তোমার ভাইরা পাবে…তখন তার দাম হিসেবে এটা তোমাকে দিচ্ছি। আমার ইচ্ছায় তুমি সাহেব কোম্পানীর চাকরি ছেড়েছ; এই টাকায় তুমি এখনই ব্যবসা আরম্ভ কর।
আরও কথা হয়েছিল, দেবেশ্বর কথা দিয়েছিলেন—মদ্যপান তিনি সংযতভাবেই করবেন। অসংযতভাবে মদ্যপান স্বাস্থ্যহানি, পাপ না হোক অপরাধ। এবং—
বেদনার্ত হাসি হেসে সুরেশ্বর বললে—এবং নারীর কথাও হয়েছিল। রত্নেশ্বর তাতেও সঙ্কোচবোধ করেন নি। ইঙ্গিতে অনুরোধ করেছিলেন অবশ্য। বলেছিলেন—হ্যাঁ, ভূমি এবং সম্পদের যারা অধিকারী তারা সংসারে নারীর ক্ষেত্রে ভোগী। কুলপতি, সমাজপতিরা বহুবিবাহ করে থাকেন। রাজারা বহুবিবাহের পরও রক্ষিতা রাখেন। আমাদের আশেপাশে তো দেখছি রাজ-রাজড়াদের। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন রত্নেশ্বর রায়।
তারপর বলেছিলেন—তবু নিজের ইজ্জত, বংশের মর্যাদা, এসব বজায় রেখেই সব করা উচিত। মদ্যপান করতে হয় ঘরে বসে কর। বাইরে পথে বেরিয়ে মত্ততা কেন প্রকাশ করবে? শুধু তো মর্যাদা ইজ্জত নয়, নিজের নিরাপত্তা আছে, আরও অনেক কিছু আছে।
দেবেশ্বর রায় কোন উত্তর দেন নি, স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন—আমি এর উত্তর লিখে পাঠিয়ে দেব।
রত্নেশ্বরই প্রথম প্রস্তাব লিখে পাঠিয়েছিলেন। বাড়ী ভাড়া করে রক্ষিতা রাখার কথা ছিল। বীরেশ্বর রায়ের শেষজীবনে যেমন সোফি বাঈ ছিল। রত্নেশ্বর লিখেছিলেন—“ভায়লেটের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখ বা থাকে, ইহা আমার ইচ্ছা নহে। তাহার সহিত সম্পর্ক রাখিলে কোনদিন-না-কোনদিন এই গোয়ানপাড়ার গোয়ানরা রায়বাড়ীর দুর্নামের ধ্বজা হইয়া থাকিবে এবং ইহাদিগকে ভয় করিয়া চলিতে হইবে।”
দেবেশ্বর উত্তর দিয়েছিলেন—ভায়লেটের প্রতি তাঁর আর কোন আকর্ষণ নেই। সে মোহ তাঁর কেটে গেছে। “এবং এ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা আপনার সহিত করিবার মতো মনের কাঠিন্য আমার আর নাই। আমি আপনার নিকট পরাজিত হইয়াছি। আপনি চিন্তিত হইবেন না। আমি এমন কোন কর্ম করিব না, যাহাতে আপনাকে লজ্জিত হইতে হইবে।”
এর পর চিঠি এসেছিল, আবার তোমাকে উত্ত্যক্ত করিতেছি। আমার বধুমাতার অবস্থা কি হইবে?
উত্তর গিয়েছিল, “আমি ইতর নহি, তাহার কোন অসম্মান হইবে না।”
এর উত্তরেও প্রশ্ন এসেছিল, “সম্মান তোমার নিকট হইতে তাহার কাম্য নয়। এবং সে যতক্ষণ নিজে অসম্মানের মত কর্ম না করে, ততক্ষণ কাহার সাধ্য তাহাকে অসম্মান করে। আমি অবহেলা, অবজ্ঞার কথা বলিয়াছি। স্বামীর নিকট হইতে স্ত্রীর যাহা প্রাপ্য তাহার সম্পর্কেই প্রশ্ন করিয়াছি।”
দেবেশ্বর উত্তর দিয়েছিলেন, “বহুজন সমক্ষে শাস্ত্রীয় মন্ত্রপাঠ করিয়া শপথ করিয়া যাহা রক্ষা করিতে পারি নাই, দিব বলিয়া দিতে পারি নাই, আবার আপনার নিকট শপথ করিয়া তাহা দিব বলিয়া কি লাভ হইবে? তবে চেষ্টা আমি করিব। এবং আমি চেষ্টা করিয়া দিতে তাঁহাকে পারিব না, যদি তিনি তাঁহার পাওনা, আমি যেমন আপনার নিকট আদায় করিয়া লইলাম, তেমনি করিয়া আদায় করিয়া লইতে না পারেন।”
এর পর আর প্রশ্ন রত্নেশ্বর করেন নি। শুধু নিজের ডায়রীতে লিখেছেন—“ভাগ্য বড়, না পৌরুষ বড়, এ প্রশ্নের সেই একই উত্তর রইল চিরকাল। “ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র ন চ বিদ্যা ন চ পৌরুষং।” রায়বংশের ভাগ্য! এই তার কর্মফলের দ্বারা নির্দিষ্ট প্রাপ্য। একটা তীরকে যেমন যে মুখে নিক্ষেপ কর, সে তার গতিতে সেই মুখেই ছোটে, তেমনি করিয়াই ছুটিয়াছে। আমার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়া গেল।
***
বিচিত্র চরিত্র দেবেশ্বর রায়; সুলতা, আজ তাঁকে বিচিত্র চরিত্র মনে হয় বটে, কিন্তু সেকালে তিনি ছিলেন ‘আলট্রা মডার্ন’। অবিশ্বাসী, নাস্তিক–ইতিবাদের একটি সংজ্ঞাকে তিনি মনুষ্যত্ব বলে মানতেন এই পর্যন্ত। তর্কে-যুক্তিতে ক্ষুরধার, কল্পনাতে তিনি অসম্ভব অবাস্তবকে জীবনে গড়ে তুলতে চান। কলকাতায় এসে খনির জায়গা কিনে খনির মালিক হয়ে বসলেন। জমিদারী তিনি পছন্দ করেন না। বলেন—মনুষ্যত্ববিরোধী। তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভারতবর্ষের অন্যতম নির্মাণকর্তা হয়ে ধনকুবের হবেন, এই তাঁর বাসনা। এসব মানুষের মন মাটিতে বিচরণ করে না, আকাশে পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়; না, তার চেয়ে বলব, মাটির বুকের জলীয় বাষ্পের মত আকাশে মেঘ হয়ে ভেসে বেড়ায়, নিচে মাটিতে নামতে হলে হয় জলধারায় নামে, নয় বিদ্যুতের মত পৃথিবীর বুক চিরে নামে। জলধারায় নামার মধ্যেও ঝড় সঙ্গে নিয়ে আসে। কখনও মানুষের সর্বনাশ করে দিয়ে যায় কখনও দেখা দিয়েও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, পৃথিবীর ফসল শুকিয়ে মরে; তবে অধিকাংশ সময়ই পৃথিবীতে ফসল বাঁচিয়ে সুফলা করে দিয়ে যায়। দেবেশ্বর ছিলেন, শুধু দেবেশ্বর কেন, সম্পদশালী সম্পত্তিশালী ঘরের মানুষের ছেলেরা এই মেঘের মত। হয় অতিবৃষ্টি, নয় অনাবৃষ্টিতে চিরকাল ধরে মানুষকে ক্লেশ দিচ্ছে। আবার ফসলের জলও দিচ্ছে। কিন্তু পুষ্কর মেঘের সঙ্গে তুলনা হয়, এমন বংশ বাংলাদেশে আমার চোখে একটি। সেটি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশ।
জাতবংশে ভুবনবিদিতে পুষ্করাবর্তকানাং ওই একটি বংশকেই বলা যায়। দেবেশ্বরকে কিংবা রায়বাড়ীকে আমি পুষ্কর বংশ বলি না, বলব না। তবে দেবেশ্বর অভিজাত ছিলেন। ‘সম্বর্ত’ মেঘ বলতে পার।
খনির ব্যবসায়ে অসামান্য সাফল্য এবং কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। রাণীগঞ্জ গিরিডি ফিল্ড তখন সায়েব কোম্পানীর হাতে, দেবেশ্বর রায় বরাকর থেকে পশ্চিম এলাকার কয়লার জমি সংগ্রহ করে ওদিককার একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছিলেন।
এই দেখ, সুলতা! সুরেশ্বর একখানা ছবির দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দেখিয়ে বললে—এই ছবিখানা দেখ!
শাল গায়ে কোঁচানো কাপড় পরা দেবেশ্বর রায়। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছেন তখন ওই পোশাকেই আপিস করেন। ইংরেজ ম্যানেজার রেখেছেন। কাপড় পরে ইংরেজ চাকরকে হুকুম করেন। বিলিতী মদ খান। মেমসাহেব অনুগৃহীতা রেখেছেন।
ওদিকে প্যানেলে দেখ—প্রথমেই দেখ রামকৃষ্ণদেবের তিরোধান, ওই দেখ তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দ। ওখানে লেখা আছে—উনি বলছেন “মনে রাখিও জন্ম হইতেই তুমি মহামায়ার কাছে উৎসর্গীকৃত।” ওই দেখ -বঙ্কিমচন্দ্র, হাতে আনন্দমঠ, ওখানে লেখা বন্দেমাতরম্ গান—সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং—শস্যশ্যামলাং মাতরম্। তারপর দেখ রবীন্দ্রনাথ। ওখানে লিখেছি-”ওরে তুই ওঠ আজি। আগুন লেগেছে কোথা। কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি জাগাতে জগৎ-জনে।” ওই দেখ, তারপর কংগ্রেসের অধিবেশন।
দেবেশ্বর রায়ের মুখ দেখ, একসঙ্গে সমস্ত কিছুর প্রতি বক্র এবং ব্যঙ্গ হাস্যভরা দৃষ্টি। সবকিছুকে অবজ্ঞা করেছেন। শুধু নিজেকে ভেবেছেন সত্য, বাকী সব মিথ্যা। বাপের সঙ্গে, ভাইদের সঙ্গে এমন কি নিজের বড় ছেলের সঙ্গেও মেলে নি তাঁর। এরই মধ্যে তিনি একলা চলেছেন—তিনি। বুকের ভিতর তাঁর রাক্ষসী ক্ষুধা।
এ ক্ষুধা রায়বংশের তিন ছেলের মধ্যেই ছিল কিন্তু দেবেশ্বর রায়ের ক্ষুধার সঙ্গে কারুর ক্ষুধার তুলনা হয় না। নিত্যনূতনের ক্ষুধা। এবং এ ক্ষুধার রুচি ছিল তাঁর ভায়লেটের স্বজাতীয়াদের মধ্যে। মিশ্র রক্ত। মিশ্র সৌন্দর্য।
তিনি স্বীকার করতেন—এ তাঁর ভায়লেটের ক্ষুধা। কিন্তু বিচিত্র কথা—জীবনে সেই গুলী করে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর আর কোনদিন ভায়লেটকে স্মরণ করেন নি। মুখ দেখেন নি। কতদিন ভায়লেট এসে উঁকিঝুকি মেরে ফিরে গেছে কিন্তু তিনি সেদিকে দৃষ্টি ফেরান নি। তাঁর কারণ বলতেন—ওকে তো জীবনটাই দিতে চেয়েছিলাম। ওকে সঙ্গে নিয়ে মরতেই চেয়েছিলাম। ও পারলে না। আমি বাঁচতে চাই নি, অ্যাকসিডেন্টালি বেঁচেছি, ওর মুখ আর দেখে? তবে হ্যাঁ, নিত্যনূতন ফিরিঙ্গী মেয়েদের মধ্যে ওর ক্ষুধাই মেটাতে চাই, তা মেটে না। আশ্চর্য লাগে। তবে এটা সেই অভিশাপ-টভিশাপও নয়, আমিও শ্যামাকান্ত নই। পুনর্জন্ম আমি মানি না। এ্যান্ড দিস ইজ দি ইটারন্যাল হাঙ্গার অফ ম্যান ফর উয়োম্যান। ম্যান ইজ পলিগেমাস বাই নেচার। বহু ভোগ বা সব ভোগ করব এই তার চিরন্তন বাসনা। আমার মধ্যে এটা খুব প্রবল। তার কারণ আমি জমিদারের ছেলে আমার শরীরে ফিউড্যাল রক্ত এবং হাতে প্রচুর অর্থ আছে এবং আমি একজন জেদী, শক্তিমান, বুদ্ধিমান ও দুঃসাহসী ব্যক্তি। এবং আমি মিথ্যাবাদী নই, সেইহেতু ইস্কাপনকে আমি ইস্কাপনই বলি। ধর্মের ধাঁধা নীতি এবং ন্যায়শাস্ত্রের আনরিয়াল রোমান্টিক বুলি-টুলি আমি পছন্দ করি না!
রত্নেশ্বর তাঁর ডায়রীতে কিন্তু লিখে গেছেন—“এ পাপ দেবেশ্বরের ইচ্ছাকৃত নহে। ইহা তাহার প্রাক্তন। হয়তো সে-ই পূর্বজন্মে ভ্ৰষ্টযোগী ছিলেন। তিনি যাহা চাহিয়াছিলেন, তাহা পাইতে আসিয়াছেন, ভোগ করিতে আসিয়াছেন, প্রায়শ্চিত্ত করিতে আসিয়াছেন। তাহা না হইলে ভায়লেটের প্রতি যত আকর্ষণ তত ঘৃণা কেন হইবে? ভায়লেট যে অঞ্জনার কন্যা, সে কথা অপরে না জানিলেও, আমি তো এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হইতে পারি না।”
এরই মধ্যে নিঃশব্দে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে কেঁদে যেতেন আমার পিতামহী উমারাণী দেবী। সহ্যশক্তির জীবন্ত মূর্তির মত।
রত্নেশ্বর রায় তাঁর এই পুত্রটিকে স্বেচ্ছামত বিচরণের অধিকার দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, দেবেশ্বর তা কেড়ে আদায় করে নিয়েছিলেন বাপের কাছ থেকে, রত্নেশ্বর তা তাঁকে দিয়েও ছিলেন। ভাবতেন হস্তক্ষেপ করবেন না তিনি। কিন্তু এই পুত্রবধূটির কথা স্মরণ করে হস্তক্ষেপ না করে পারেন নি। এবং এই নিয়ে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ছেলের সঙ্গে লড়াই করেছেন।
শুধু পুত্রবধূর জন্য বললে অন্যায় হবে। রত্নেশ্বর রায়ের প্রিয়তম পুত্র ছিলেন দেবেশ্বর রায়। তার পরিচয় আছে পিতাপুত্রের পত্রগুলির মধ্যে। আর কিছু আছে রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীর মধ্যে। এগুলি সবই পেয়েছি আমি। পত্রগুলির মধ্যে বৈষয়িক কর্ম নিয়ে বাদানুবাদ, ক্ষেত্রবিশেষে প্রশংসা এবং কুশল আদান-প্রদানই বেশী, কিন্তু যে একটি সরল আন্তরিকতা নিরাবরণ সত্য ফুটে উঠেছে, সেটি কি করে সম্ভবপর হল, তা ঠিক ধারণা করতে পারিনে আমি।
রত্নেশ্বর রায়ের শরীর ভাঙল তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই। বাপ ছেলেকে লিখলেন- “এইবার তুমি আসিয়া বিষয়ের ভার গ্রহণ কর। এই দেহে এই ভার বহন করিতে হইলে শ্বাসরুদ্ধ হইয়া মরিতে হইবে আমাকে। আমার কিছুই ভাল লাগিতেছে না।”
দেবেশ্বর লিখলেন—“আপনার হাতের হাল গ্রহণ করার মত যোগ্যতা আমার নাই। তদুপরি আমি জমিদারী কর্মটিকেই ঠিক পছন্দ করি না। গরীবের উপর পীড়নই তো জমিদারী চালানো নয়—এই সকল গ্রাম্য ব্যক্তিগণের সঙ্গে অহরহ সাহচর্য করিয়া অনেক নীচে নামিতে হয়।”
আর একখানা পত্রে লিখেছেন—“আমি স্বীকার করিতেছি যে, আপনার ব্যক্তি-জীবনের আদর্শ আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অনেক শ্রেষ্ঠ। স্বাস্থ্য আপনার যাহা দেখিলাম, তাহাতে আপনি আমা অপেক্ষা সমর্থ আছেন। আমার অমিতাচার আছে, আপনার তাহা নাই। আপনি এইসব গ্রাম্য ব্যক্তিদের মধ্যে থাকিয়া তাহাদের নিকট খাজনা লইয়া তাহাদের শাসন করিয়াই ক্ষান্ত থাকেন না, তাহার সঙ্গে এই সকল মনুষ্যদের জন্য একটি কল্যাণকর কর্ম-কল্পনা লইয়া কর্ম করিয়া থাকেন। ইহাদের মধ্যে বাস করিয়াও ইহাদের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তাহা আমি পারিব না।”
বাপ এর উত্তরে লিখলেন-“আমার মনে হইতেছে যে, তুমি তোমার আসল মত আমার নিকট গোপন করিতেছ। আমি শয্যাশায়ী না হইলেও, আমার এই ক্লান্ত অবস্থায় আমাকে সাহায্য করা কি তোমার কর্তব্য নয়?”
উত্তরে দেবেশ্বর লিখেছিলেন—“সংসারে কর্তব্যের আর শেষ নাই। সব মান্য করিয়া চলিতে পারে এমত মানুষ আর কয়জন আছে। আমার তো কর্তব্যচ্যুতির শেষ নাই। আমি মদ্যপানে আসক্ত, আরও নানাবিধ দোষ আছে। তাহা ব্যতীত পিতাকে মান্য করিয়া চলা যেখানে কর্তব্য, সেখানে আপনার ও আমার মধ্যে মতান্তর বৃদ্ধি পায়—তাহাকে কি কোনমতে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হইবে? আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভক্তি করি, ভয়ও করি। তাহা আন্তরিক। কিন্তু আপনার মতের সহিত আমার মতের পার্থক্যের কথা আপনি জানেন। আপনাকে সাহায্য করিতে গিয়া আপনাকে রুষ্ট করা বা আপনার সহিত বিরোধ করিতে আমি চাহি না। তাহা ছাড়াও কথা আছে। শিবেশ্বর আজ উপযুক্ত হইয়াছে, জমিদারী পরিচালনার ব্যাপারে তাহার নেশা আছে, আসক্তি আছে। সে আপনার অধীনে কার্য করিতেছে। তদুপরি সে আপনার পন্থাকেই অনুসরণ করিবার চেষ্টা করে। ধর্মবিশ্বাসী, দেবদ্বিজে ভক্তি আছে, আমার বিবেচনায় কীর্তিহাটের দেবোত্তর এবং দেবকীর্তি পরিচালনার সে-ই যোগ্য ব্যক্তি। তাহাকে ঠেলিয়া আমাকে ভার দিলে সে ক্ষুব্ধ হইবে, তাহার ফল ভাল হইবে না। রামেশ্বর বি-এ পাস করিয়া ল লেকচার কমপ্লিট করিয়া এমনি রহিয়াছে এখানে। তাহাকে আপনি মামলা সেরেস্তা এবং আপনার পারসোনাল এস্টেটের ভার দিতে পারেন। আমি এখানে নানান কর্মে জড়িত। সভা-সমিতি এবং কয়েকটা অ্যাসোসিয়েশন গঠন করিয়াছি। এবং বহু যত্নে ও পরিশ্রমে যে খনি-ব্যবসায় আমি গঠন করিয়াছি, বাহির দিক হইতে তাহার সমারোহ এবং প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট মনে হইলেও, সেটা ঠিক নহে। তাহার ভিতরে অনেক জট বাঁধিয়াছে। কয়েকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। এমত অবস্থায় এসব ছাড়িয়া আমার যাওয়ার অর্থ তাহার ধ্বংসসাধন করা।
“পরিশেষে একটা সংবাদ আপনাকে আমার জানানো উচিত। এখানে সেক্রেটারিয়েটে আমার পরিচিত বন্ধুজন আছে। কয়েকজন ইংরাজও আছেন। আমারও যাতায়াত আছে। আমি খবর পাইয়াছি যে, আপনাকে রাজা টাইটেল দিবার কথা মধ্যে মধ্যে উঠিয়া থাকে। এখন ঘন ঘন উঠিতেছে। আর একটা বড় দান হইলেই ওটা নিশ্চিত হইবে বলিয়া মনে করি।”
সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর রায় এবার হার মেনে চিঠি লিখেছিলেন সুলতা। এমন ভাবে বীরেশ্বর রায়ও হার মানেন নি তাঁর কাছে। তাঁর ডায়রীতে তিনি লিখে গেছেন—“আমার পিতা আমার কাছে হার মানেন নাই, আমার মাতৃদেবীর নিকট হার মানিয়াছিলেন। আমিই পুত্রের নিকট পরাজয় মানিলাম। আমার সকল দম্ভ চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া ধূলিসাৎ হইয়া গেল।”
দেবেশ্বর রায়ের চিঠির উত্তরে তিনি লিখলেন—“তোমার পত্র পাঠ করিয়া আমি অত্যন্ত ব্যথিত হইলাম। এরূপ পত্রোত্তর আমি প্রত্যাশা করি নাই। তবে ইহাই হয়তো আমার প্রাপ্য, কারণ আমি সমস্ত জীবন ধরিয়া সকলকেই বলপূর্বক নত করিয়াছি, কাহারও নিকট নত হই নাই। এমন কি নিজের পিতৃদেবের নিকটও না। তুমি রাজা খেতাবের খবর দিয়াছ, সে সংবাদ আমার নিকট অগোচরে নাই; কিন্তু রাজা খেতাবের সাধ আমার নাই। জীবনে যত দান করিয়াছি, স্মরণ করিয়া দেখিতেছি পুণ্যের জন্য কোন দান করি নাই, খ্যাতির জন্য সরকারী খেতাবের জন্য করিয়াছি। স্কুল ডাক্তারখানা প্রভৃতি কীর্তিও তাহারই জন্য। দেবতা প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, দেবতার নামে দেবোত্তর এস্টেট গড়িবার জন্য; নিজের সংসারের মঙ্গল সাধন করিবেন তিনি সেই জন্য। যে অর্থব্যয় করিয়াছি দানখাতে কীর্তিখাতে তাহা নিজের তহবিল হইতে দিই নাই, প্রজাদের পীড়ন করিয়া আদায় করিয়া দিয়াছি। নিজে কিছু দিই নাই। আজ আমি শঙ্কিত। কেমন একটা শঙ্কা আমাকে যেন মাঝে মাঝে বিহ্বল করিয়া তোলে। তুমি নিজে ব্যবসায় করিয়াছ, উপার্জন করিতেছ, কিন্তু তোমার মধ্যে দেখিতেছি রায়বংশের অভিশাপ যাহা তুমি বিশ্বাস কর না তাহা যেন ফণা তুলিয়া আমাকেই দংশন করিতে চাহিতেছে। তুমি ধর্ম মান না, ঈশ্বর মান না, বলিতে গেলে এদেশের কিছুই মান্য কর না, এমন কি রাজশক্তিকেও না। আমি শুনিয়াছি, হোমরুল প্রভৃতি আন্দোলনের সঙ্গে তুমি যুক্ত। ইহা গর্বের কথাও বটে আবার অনেকটা শঙ্কার কথাও বটে। এবং ইহা আমাদের ঠিক ভারতীয় ধর্ম নহে। আমাদের শাস্ত্রমতে কলিতে এখন ম্লেচ্ছরাই একচ্ছত্রাধিপতি হইবে। এই সম্রাট ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাহা ব্যতীত এমন শান্তি-শৃঙ্খলা তাহার স্থাপন করিয়াছে যাহা স্বপ্নাতীত। আজ আমরা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা লইয়া নিরাপদ নিঃশঙ্ক। অথচ তুমি পুরাপুরি ইংরাজীভাবাপন্ন। তবুও তুমি আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তুমি শক্তিমান তুমি সাহসী তুমি সত্যবাদী। তুমি ছাড়া অপর কাহারও ভরসা আমি করিতে পারিতেছি না। কিছুদিন শিবেশ্বরের উপর প্রত্যাশা করিয়াছিলাম। সে মদ্যপান করে না, সে ত্রিসন্ধ্যা করে, দেবদ্বিজে ভক্তি আছে। শাস্ত্রাদি পাঠ করে। সে স্ত্রীতে অনুরক্ত। কিন্তু যত দিন যাইতেছে তত আমার চক্ষু খুলিতেছে; সে মদ্যপান করে না, কিন্তু শুনিতেছি সে গঞ্জিকা সেবন করে অতি গোপনে। সে ত্রিসন্ধ্যা করে দেবদ্বিজে ভক্তি করে, শাস্ত্রপাঠ করে কিন্তু শৃগালের মত ভীরু এবং লোভী; ভোরবেলা সূর্যোদয়ের পূর্বে বিছানায় বসিয়া সেরখানেক সন্দেশ রসগোল্লা ভক্ষণ করে, কারণ সকাল হইতে কিছু না খাইয়া স্নানাদি সারিয়া প্রাতঃসন্ধ্যা করিয়া চা-পান করিবে। দেবতার ব্রাহ্মণের জমি বা বিষয় বেনামে মহাজনী করিয়া বন্ধক লয়। শাস্ত্রপাঠ করে কিন্তু স্ত্রীলোক অপেক্ষাও শুচিবাইগ্রস্ত। স্ত্রীতে অনুরক্ত কিন্তু তাহা অপেক্ষাও চরিত্রহীন হইলেও ভাল হইত। কারণ সে স্ত্রী ছাড়িয়া একটা দিনও থাকিতে পারে না। ইহারই মধ্যে তাহার দুই পুত্র এক কন্যা। এখানে একটা থিয়েটার পার্টি করিয়াছে। কতকগুলো অপোগণ্ড ইতর শ্রেণীর বালক লইয়া নাচ শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া তাহাতে প্রমত্ত রহিয়াছে। কখনও সত্য কথা বলে না, বাক্য দিয়া বাক্য রক্ষা করে না। মামলায় মকদ্দমায় প্রবল আসক্তি। কীর্তিহাট এস্টেটের মামলা সেরেস্তা আমিই বড় করিয়া পত্তন করিয়াছি, কিন্তু বাজীকর, স্বত্ব, করবৃদ্ধি প্রভৃতি জমিদারী-সংক্রান্ত মকদ্দমা ছাড়া মকদ্দমা ছিল না। শিবেশ্বর তাহার সঙ্গে মহাজনী যোগ করিয়াছে। লোকের নিকট হইতে সে হ্যান্ডনোট তমসুদ কিনিয়া লইয়া খাতকের নামে নালিশ করে।
তোমার পতনের মধ্যে একটা বড় কিছু পতনের মর্যাদা আছে গুরুত্ব আছে। তাহার অধঃপতন ক্ষুদ্রতায় ঘৃণ্য। সম্প্রতি একজন বাদ্যকরের কাছে দেবোত্তরের জমি ক্রয় করিয়াছে স্ত্রীর নামে। শশকের মত ভীরু। কীটপতঙ্গ ব্যাধি সমস্ত কিছুর ভয়ে অস্থির। ডাকাতের ভয়ে সমস্ত রাত্রি নিদ্রা যায় না। রাজকুমারী রাণী কাত্যায়নী দেবীর আমলের মত দারোয়ানগুলিকে সমস্ত রাত্রি হল্লা করিতে হয়।
রামেশ্বরকেও জান। সে তোমাকে অনুকরণ করিতে চায় কিন্তু তাহার ধীশক্তি নাই এবং সাহসও নাই। দুইবার বি-এ ফেল করিয়া বিলাত যাইতে চায়। ব্যারিস্টার হইয়া আসিবে। সেও মদ্যপান করে, সেও চরিত্রভ্রষ্ট। সর্বাপেক্ষা দুঃখ তাহার যত কৃদুষ্টি রায়বাড়ীতে যাহারা আশ্রিত তাহাদের যুবতী স্ত্রী-কন্যাদের উপর।
আমি অসহায়ের মত দেখিতেছি। দেবশক্তির রোষ অভিশাপ হইতে পরিত্রাণ কোন এক ব্যক্তি পাইলেও পাইতে পারে কিন্তু বংশের উপর অভিশাপ পতিত হইলে আর রক্ষা নাই। কোন এক পুরুষ পরিত্রাণ পাইবার চেষ্টা করিলেও বংশ পরিত্রাণ পায় না। অথবা ইহাই কালের অভিপ্রায়। কলির শেষে এমত হইবারই কথা। মানুষের সাত্ত্বিক ভাব বিলুপ্ত হইয়াছে রাজসিক ভাবও বিগত হইতেছে, এক্ষণে তামসিক ভাবই সমস্ত মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করিতেছে। মনে হইতেছে, অচিরকালের মধ্যেই এ দেশের অবশিষ্ট অর্ধপাদ পুণ্য তাহাও শেষ হইয়া সবই বিলুপ্ত হইবে! তবুও যে কয়টা দিন বাঁচি তুমি ভার লইলে আমি বড় সুখী হইতাম”—
ছেলে উত্তর দিলেন—সংক্ষিপ্ত উত্তর। “আপনার সহিত চিরকালের মত বিচ্ছেদ হয় ইহা কাহারও কাম্য নয়। এই শঙ্কা আছে বলিয়াই অক্ষমতা জ্ঞাপন করিতেছি। তবে আপনি যে আশঙ্কা করিয়াছেন বা দেবরোষ দেবীর অভিসম্পাত অপ্রাকৃত দৈব বলিয়া যাহা বিশ্বাস করেন, তাহা নিতান্তই সাধারণ প্রাকৃত জাগতিক ঘটনা। ইহা চিরকাল ঘটিতেছে ও ঘটিবে। শাস্ত্রীয় ধারণার ও মন্ত্র-তন্ত্রের ফেরের মধ্যে পড়িয়াই শ্যামাকান্তের ঐরূপ মানসিক বিকৃতি ঘটিয়াছিল নতুবা ইহা তো পৃথিবীতে জীবজগতে অতি সাধারণ ব্যাপার; মনুষ্যকুলের মধ্যেও এমন ঘটনা তো অহরহই ঘটিতেছে। বিশেষ করিয়া বিত্তশালী সম্পদশালী যাহারা তাহাদের মধ্যে এবং যাহারা দেহের শক্তিতে একেবারে দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ, যাহাদের গুণ্ডা বলি, তাহাদের মধ্যে আবার যাহারা খুবই বুদ্ধিমান, চতুর, বিদ্যাবুদ্ধির শক্তিতে বলীয়ান বলিয়া দেশ ও সমাজের চলিত ধ্যানধারণা হইতে সৃষ্ট নিয়মাদির অলীক গণ্ডী পার হইয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে এমন ঘটনা অনেক ঘটিতেছে। তাঁহারা শ্যামাকান্তের মত পাগল হইয়া যান না। আপনি পিতা আপনার সহিত এসব লইয়া তর্ক আমার সাজে না। অন্ততঃ আমাদের সমাজে সাজে না। তবে আপনি কথাটা লইয়া পত্রে বড়ই আক্ষেপ করিয়াছেন এবং আপনি এইরূপ ধারণার বদ্ধ সংস্কারে আজীবন ক্লেশ পাইতেছেন বলিয়াই কথাগুলি লিখিলাম। আমার জীবনে আপনার সহিত যে সংঘর্ষ এবং গরমিল তাহাও এই মতভেদ হইতে উদ্ভুত হইয়াছে বলিয়াই লিখিতে সাহস পাইলাম। পরিশেষে নিবেদন—সম্পত্তিরক্ষার জন্য আমাকে কীর্তিহাটে লইয়া গিয়া বিব্রত করিবেন না বা নিজেও বিব্রত হইবেন না। শ্রীচরণে নিবেদন ইতি।”
—মধ্যে মধ্যে সংসারে ঘটনা এমনভাবে ঘটে সুলতা; সুরেশ্বর বললে, —যে দেখেশুনে মনে হয় মানুষ যখন কোন সংকল্প করে তাকে ভাঙবার জন্যেই ঘটনাটা কেউ ঘটালে।
আমাদের কীর্তিহাটের দয়াল দাদু আজ বেঁচে নেই, ১৯৩৭ সালেও ছিলেন, ১৯৪২ সালের সাইক্লোনের পরই মারা গিছলেন। তিনি বলতেন—ভায়া, ভগবানের মত রসিকও কেউ নেই আবার দর্পহারীও কেউ নেই। জান, মধ্যে মধ্যে মানুষ যখন আস্ফালন করে তখন তিনি কান পেতে শোনেন আড়ালে দাঁড়িয়ে আর মুচকে মুচকে হাসেন। তারপরই তাঁর ঘটনাচক্রের যে বিরাট কলটি সেই কলের একটি ছোট্ট বোতাম-টোতাম টিপে দেন আর এমন ঘটনা ঘটে যে মানুষের আস্ফালন সংকল্প সব কাচের বাসনের মত আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
—এখানেও যেন দর্পহারী ভগবান কথাটা কান পেতে শুনে হেসেছিলেন। হঠাৎ একদিন টেলিগ্রাম এল জানবাজারে—“আগামীকাল স্টেশনে গাড়ী রাখ।” রায়বাহাদুর।
সেকালে রায়বাহাদুরেরা খেতাবটাকে বাড়িতেও ব্যবহার করতেন। গিন্নীরা সাধারণতঃ বলেন, বলতেন—উনি ওঁর; না হয় কর্তা-কর্তার, নয় তো বাবু-বাবুর; রায়বাহাদুর হলে তাঁরাও চাকরবাকর থেকে সবার কাছেই বলেন- রায়বাহাদুর, রায়বাহাদুরের। রায়বাহাদুরের টেলিগ্রামে রায়বাহাদুর লিখে ঠিকানার ঘরে নিজের নামটা লিখতেন।
চমকে উঠেছিলেন দেবেশ্বর রায়। এ কোন্ সময়ে আসছেন তিনি?—আসবার কারণ তাঁর অনেক ছিল—তখন কলকাতায় নতুন বিডন স্ট্রীটের উত্তরে গোয়াবাগানের কাছ বরাবর একবিঘে জমির উপর বাড়ী—হুগোলকুড়িয়া লেন; পাশে একটা তেল কল, এ হচ্ছে শিবেশ্বর এবং রামেশ্বরের জন্যে। তত্ত্বাবধান যা করবার শিবেশ্বর এসে গিয়েই করতেন। রামেশ্বর থাকতেনই জানবাজারে, দাদার ভক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর উপর খুব ভরসা শিবেশ্বর করতেন না। কিন্তু দেবেশ্বরের পক্ষে সময়টা খুব ভাল ছিল না, অন্তত বাপের সঙ্গে দেখা করবার মত শান্ত এবং স্থির ছিল না মন। তখন কিছুদিন ধরে ব্যবসা বাড়াবার জন্যে নতুন নতুন পিটখাদ কেটে চলেছিলেন, তার মধ্যে কয়েকটা ভুয়ো হয়ে গেল। তিনি হুন্ডী কেটে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সময় বুঝে হুন্ডীওয়ালারা চেপে ধরেছে। তিনি বিব্রত। টাকা চাই। সে অনেক টাকা, সে আমলে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। তারই জন্য তিনি ছুটোছুটি করছেন কিন্তু বাপকে জানান নি; এ ধরনের বিপদে বাপকে কখনও জানাবেন না এই প্রতিজ্ঞা করেই তিনি নেমেছিলেন স্বাধীন ব্যবসায়ে।
দেবেশ্বর রায় শুধু জেদী ছিলেন না, তাঁর অনুমান শক্তি ছিল বুদ্ধির সঙ্গে প্রখর, তার উপর ছিল একটা আভিজাত্যবোধ।
সেকালে তখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈতৃক ঋণশোধের একটি আশ্চর্য আভিজাত্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।
দেবেশ্বর রায় সেইদিনই সায়েব কোম্পানীকে চারটে কলিয়ারী বেচে হুণ্ডী শোধের ব্যবস্থা করে ফিরে এলেন; বলতে গেলে ব্যবসা একরকম উঠিয়েই দিলেন; কারণ চালু কলিয়ারী রইল না, থাকবার মধ্যে থাকল মানভূম জেলায় বিস্তীর্ণ পতিত প্রান্তর, তাও বরাকর থেকে এদিকে ঝরিয়া ওদিকে কাতরাস পর্যন্ত ছড়ানো। তাতে কাজ করতেও বহু অর্থ প্রয়োজন। তা হোক তিনি খুশী হলেন। বাপ যেন তাঁকে এই বিব্রত অবস্থায় না দেখেন।
টাকা তাঁর স্ত্রীর ছিল। উমা দেবী বাপ-মায়ের এক কন্যা। মানুষ হয়েছিলেন দিদিমার কাছে তাঁর সম্পত্তি টাকায় পরিণত ক’রে কোম্পানীর কাগজ করে দিয়েছিলেন দিদিমা, সে কাগজের পরিমাণ কম নয় দেড় লাখ। সে কাগজ ছিল রত্নেশ্বর রায়ের কাছে। বউ দিয়েছিলেন রাখতে—বাবা, এ আপনি রাখুন। আমি কোথায় রাখব।
রত্নেশ্বর রেখেছিলেন। যখন দেবেশ্বর কীর্তিহাট থেকে বাপের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে জিতে ফিরে আসেন তখন তিনি তাঁর ভিক্ষে-মা কৃষ্ণভামিনীর সম্পত্তির তিন ভাগের দু ভাগ বাবদ দাম হিসেব ক’রে নিয়েছিলেন, কিন্তু স্ত্রীর নামের কোম্পানীর কাগজ তিনি নেন নি। তিনি চান নি, রত্নেশ্বরও দেন নি; এমন কি উল্লেখও করেননি।
স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহার কোথাও বাইরে একটা বিভেদ ছিল না কিন্তু অন্তরে অন্তরে একটা বিরাট পার্থক্যের দুই তীরে তাঁরা বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন নাস্তিক, স্ত্রী ছিলেন ঘোরতর দেবতা-বিশ্বাসী। দেবেশ্বর বাস করতেন ভাবীকালে, স্ত্রী বাস করতেন ভূতকালে; বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী ভবানী দেবীর মত ছিল বিশ্বাস ও নিষ্ঠা। স্বামীকে ভয় করতেন তিনি। প্রমত্ত দেবেশ্বর বিছানায় শুতেন, স্ত্রী পায়ের তলায় বসে হাত বুলিয়ে দিতেন, এইটুকু না হলে দেবেশ্বরের ঘুম আসতে দেরী হত, এটুকু বড় ভাল লাগত তাঁর, পায়ে স্ত্রীর আলতো হাতের স্পর্শ পাবা মাত্র তাঁর চোখ বুজে যেত, তারপরই হয়তো মিনিটখানেকের মধ্যে নাক ডাকতো তাঁর। তখন উমা দেবী জানালার মধ্য দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে বসে কাঁদতেন। কোন কোন দিন টের পেয়ে দেবেশ্বর প্রমত্ততার মধ্যেই পুরুষের স্বাভাবিক কামনায় আত্মনিবেদনকারীটিকে টেনে নিতেন আদর করতেন, তারপর ঘুমিয়ে যেতেন। স্ত্রীও হয়তো ঘুমিয়ে যেতেন, কিছুক্ষণ পর পাশের খাটে ছেলের সাড়া পেয়ে উঠে যেতেন। সকালবেলা থেকে জীবন আর এক রকম। কায়দা আর কানুনের চাকায় ঢাকায় দাঁতে দাঁতে লেগে ঘুরে চলতেন। নিঃশব্দে সে ঘোরা, বিনা সংঘর্ষে সে ঘোরা, দিনের পর রাত্রি আসার মত সে ঘোরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ, তখনও বাংলাদেশে মেয়েদের জীবনে চলছে চরম দুর্ভাগ্য। পুরুষের ক্রীতদাসী, সমাজে বহু সুন্দর বাক্য বহু সম্মানের অভিনয়ের মধ্যে তার আসল স্বরূপ হল কেনাবেচার সামগ্রী। বাপের বুকের বোঝা শ্বশুরের ঘরে নামে লক্ষ্মী হলেও কাজে স্বামীর অনুগ্রহনির্ভরা।
ছেলে বিয়ে করতে যেতো মা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেন- কোথায় যাচ্ছ বাবা?
ছেলেকে জবাব দিতে হত—তোমার দাসী আনতে মা।
দেবেশ্বর নিজে এদের দলের ছিলেন না, অন্য মত পোষণ করতেন, কিন্তু কালের প্রভাব এড়াতে পারেন নি। স্ত্রী সেকেলে মনোভাবের বলে তাঁকে ঘরের কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন, নিজের মনের অধিকার দেন নি। সেই কারণেই স্ত্রীর টাকা তিনি বাপের কাছ থেকে চেয়ে নেন নি। স্ত্রী যা হয় করবেন অথবা তাঁর অন্তে উত্তরাধিকারীরা যা হয় করবেন, তিনি ছোঁবেন না, নেবেন না, এই ছিল তাঁর সংকল্প। স্ত্রী নিজে চেয়ে নিয়ে দিলে তিনি হয়তো নিতেন কিন্তু স্ত্রী তো তা দেন নি।
রত্নেশ্বর রায় সেই কোম্পানীর কাগজ নিয়েই দিতে এসেছিলেন এবং নিজে থেকে বাকী টাকা দিয়ে সব মেটানোই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। সে অনুমান করে নিতে দেবেশ্বরের দেরী হয় নি। তাই তিনি একদিনেই কলিয়ারী বেচে দিয়ে প্রশান্তমুখে বাপকে আনতে গিয়েছিলেন হাওড়া স্টেশন।
হাওড়ায় ছেলেকে দেখে রত্নেশ্বর রায়ও ধাঁধাতে পড়েছিলেন। এমন প্রশান্ত মুখ তো তিনি কল্পনা করেন নি।
ছেলে প্রণাম করে জিনিসপত্র গাড়ীর ছাদে চাপিয়ে গাড়ীর সামনের সিটে বসে বাপকে প্রশ্ন করেছিলেন—হঠাৎ এমনভাবে এলেন, খবর সব ভাল তো? চিঠি না দিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন!
গাড়ীর ভিতর বসে অন্ধকারের মধ্যেই ছেলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছিলেন রত্নেশ্বর রায়। বললেন—হ্যাঁ ভাল।
ছেলে আর প্রশ্ন করলেন না। চুপ করে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে বললেন—হুগোলকুড়িয়ার বাড়ী সেদিন আমি দেখতে গিছলাম, প্ল্যান আমার ভাল লাগল না। ঘরগুলো—
—ও সব শিবেশ্বর রামেশ্বরের পছন্দ, ওদের বাড়ী ওরা যেমন চায় তেমনি হচ্ছে।
—বাড়ীটা ওখানে না করলেই হত। তেলকলটা কিনছেন, তেলকলের জন্যে ও জায়গাটা রেখে সরে বাড়ি করাই ভাল ছিল।
—থাক ওসব কথা। আমি ওজন্যে আসি নি। আমি হিসেব মেটাতে এসেছি। আমার শরীর ভাল যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দিন ফুরিয়ে আসছে। প্রপিতামহ কুড়ারাম রায় দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন, তারপর থেকে পিতামহ সোমেশ্বরের কাল থেকে সবাই আমাদের স্বপ্নায়ু। পঞ্চাশ কেউ পার হয় না। তোমাকে এত ক’রে লিখলাম তুমি গেলে না। আমি এলাম তোমার যা বিশেষ কিছু আমার কাছে পাওনা আছে তাই দেবার জন্য।
—পাওনা? আপনার কাছে আমার বিশেষ পাওনা? হাসলেন দেবেশ্বর।
—হ্যাঁ। তোমার ভিক্ষে-মায়ের টাকা তুমি নিয়েছ। আমি দিয়েছি। কিন্তু বউমার পিতৃধন কোম্পানীর কাগজ আমার কাছে গচ্ছিত ছিল, সেটা তুমি চাও নি। তা ছাড়া বউমার দিদিমা বলেছিলেন—ওর বয়স বিশ বছর না হওয়া পর্যন্ত ওর হাতে বা–।
একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—এমন কি তোমার হাতে দিতেও বারণ করেছিলেন। আবার একটু চুপ ক’রে থেকে বলেছিলেন—কথাটা তোমাকে বলা হয় নি। এ বিয়ের সম্বন্ধ আমি করি নি; কাশীতে পিসেমশাই আর অন্নপূর্ণা এ সম্বন্ধ করেছিল। তখন তুমি গুলীর ক্ষতের জন্যে বিছানায় শুয়ে। তোমার কথাটা তাঁর অগোচর ছিল না। সেই জন্যেই বউমার বিশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তাকে বা তোমাকে দিতে বারণ করেছিলেন।
দেবেশ্বর সামনের সিটে স্থির হয়ে বসে শুনছিলেন। কোন উত্তর করেন নি।
বাড়ীতে এসে মুখ হাত ধুয়ে খাবার আসনে বসে রত্নেশ্বর পুত্রবধূকে ডেকে কোম্পানীর কাগজগুলি তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন-তোমার পৈতৃক ধন মা। তোমার দিদিমা তোমার বাপের শরিকানী সম্পত্তি বেচে টাকা দিয়ে কোম্পানীর কাগজ করেছিলেন। বিয়ের সময় আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন—উমার বিশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এ কাগজ আপনার হাতে রাখবেন। আমি তার থেকেও বেশী দিন রেখেছি। সুদে আসলে জমে দেড় লক্ষের উপর দাম এর এখন নাও এখন। নাও তুমি। নিয়ে দেবেশ্বরকে দাও। আমি শুনেছি—দেবেশ্বর বিজনেসে লোকসান খেয়েছে। হুন্ডীর দেনায় বিব্রত হয়েছে। টাকা আমি দিতে পারতাম। কিন্তু সম্ভবতঃ দেবেশ্বর তা নেবে না। ভাইদের অজুহাত দেখাবে। সেটা নেহাৎ মিথ্যেও নয়। শিবেশ্বর এমনিতেই বলে আমি পক্ষপাত ক’রে থাকি। দেবেশ্বর, এই টাকা তুমি ব্যবসায়ে লাগাও। প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে এস্টেট থেকে টাকা ধার হিসেবেও দিতে পারি।
চমকে ঠিক ওঠেন নি দেবেশ্বর, তিনি গোড়াতেই অনুমান করেছিলেন, তবুও কথাটা এইভাবে পাড়বেন এ অনুমান করেননি। ভেবেছিলেন রত্নেশ্বর নিজের স্বভাব অনুযায়ী উপদেশের ছলে তাঁকে অনেক তিরস্কার ক’রে বলবেন-হুন্ডীর ডিটেলস দাও আমি সব মিটিয়ে দিয়ে তবে যাব।
বধূ কোম্পানীর কাগজগুলি হাতে তুলে না নিয়ে বললে—আপনার ছেলেকেই দিন।
—না মা, তুমি নিজে ওকে দাও, দিয়ে প্রণাম কর।
দেবেশ্বর এতক্ষণে বলেছিলেন—হুন্ডীর ঝঞ্ঝাট সব মিটে গেছে। আজই আমি মিটিয়ে ফেলেছি।
—মিটিয়ে ফেলেছ? কি ক’রে মেটালে? আমি খবর পেয়েছিলাম—তুমি বিব্রত হয়ে পড়েছ। পাগলের মত ঘুরছ টাকার জন্যে। আমার শরীর খারাপ তবু আমি শুনে স্থির থাকতে পারি নি।
দেবেশ্বর বলেছিলেন- মিথ্যে শোনেন নি। দুটো দুটো বড় প্রজেক্ট একেবারে ফেল করে গেল—ডাইক বেরিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অ্যাবানডন করতে হয়েছে। এদিকে পাওনাদারেরা সময় বুঝে চেপে ধরবার চেষ্টা করলে যা আমাদের স্বভাব। কিন্তু আমি তাতে দমি নি। ভার্জিন ল্যান্ড যা নিয়েছি তা রেখে চালু কলিয়ারি ক’টা বিক্রী করে দিচ্ছি বেঙ্গল কোলকে—চুক্তি হয়ে গেছে। দলিল হতে বাকী আছে। হুন্ডীর দায় এখন বেঙ্গল কোলের।
—চালু কলিয়ারীগুলো সব বিক্রি করে দিলে, আমাকে জানালে না?
চুপ ক’রে থাকলেন দেবেশ্বর।
—আমি কি তোমার শত্রু দেবেশ্বর?
দেবেশ্বর তবু নীরব হয়ে রইলেন।
—দেবেশ্বর!
এবার দেবেশ্বর বললেন—না। আপনি জন্মদাতা পিতা। কিন্তু এ ব্যবসা আমি আপনার অমতে করেছি। এতে ফেল পড়ে দেনার জন্যে আপনার কাছে গেলে আপনার ছেলের মত কাজ করা হ’ত না।
—বউমার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলে?
ঘাড় নাড়লেন দেবেশ্বর। না।
সঙ্গে সঙ্গে বধূ উমা চেতনা হারিয়ে পড়ে গেলেন মাটির উপর আছাড় খেয়ে।
এর পনের দিনের মধ্যে আবার টেলিগ্রাম এল কীর্তিহাট থেকে। রত্নেশ্বর রায় কীর্তিহাট ফিরে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জ্বর হয়েছে। রত্নেশ্বর রায় টেলিগ্রাম করেছেন–বউমা এবং ছেলেদের নিয়ে এখানে এস, আমি অসুস্থ। ঠিক তার পরের দিন আবার টেলিগ্রাম এল-ফাদার’স ইলনেস সিরিয়াস, ডিলিরিয়াস, কাম ইমিডিয়েটলি—শিবেশ্বর।
এবার ফিরতে হয়েছিল দেবেশ্বরকে। স্ত্রী দুই পুত্র নিয়ে দেবেশ্বর কীর্তিহাটে ফিরেছিলেন বহুকাল পর। অবশ্য দু’একদিনের বা চারদিনের জন্য কয়েকবার এসেছেন, এ আসা সে আসা নয়; এবার এসেছিলেন যেন থাকতে হবে বলে। সঙ্গে পনের বছরের বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বর এবং ছোট ছেলে যোগেশ্বর তখন তের বছরের। যোগেশ্বরের পর আর সন্তান হয় নি।
রুগ্ন বিকারগ্রস্ত বাপের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম নিজেকে হারালেন দেবেশ্বর। এবং হেরেও গেলেন। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বকছেন—বাবা, বাবা, বাবা! না-না-না! মা কই মা? –মা?
—স্বর্ণলতা! সরস্বতী বউ! ছি—ছি! কোথা যে যাও! কেন অঞ্জনাকে বার বার আমার কাছে আসতে দাও। ছি—ছি।—ছি-ছি। তুমি কিছু বোঝ না।—না-না-না।
দেবেশ্বর এল না? দেবেশ্বর? দেবেশ্বর!
টপ্টপ্ করে চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করেছিল। এই সময় শিবেশ্বর এসে গম্ভীর মুখে তাঁর হাতে একখানা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন—এখানা বাবা কাল লিখে ম্যানেজারের হাতে দিয়েছিলেন। উনি আমাকে দিয়েছেন। কাগজখানা তুমিই রাখ।
জ্বরে পড়ে অবধি রত্নেশ্বর রায় একটা কঠিন কিছুর আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির প্রৌঢ় ডাক্তার তাঁকে গোড়া থেকেই দেখছিলেন, তাঁকেও তিনি তাঁর আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি মাথা চুলকে বলেছিলেন—কই, তেমন কিছু তো ঠিক মনে হচ্ছে না।
অল্প অল্প জ্বর, শরীর খারাপ; এই পর্যন্তই—তার বেশী কিছু না। রোজ কাছারী করছিলেন। পাঁচ দিনের দিন জ্বরটা একজুরীতে দাঁড়াল, ষষ্ঠ দিনের দিন তিনি সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়ে ডাক্তারকে এবং ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একসঙ্গে। ডাক্তারকে বলেছিলেন—কি বুঝছ?
—আজ্ঞে না, তেমন কিছু নয়, বোধহয় পেট পরিষ্কার নেই—
—তুমি ঠিক ধরতে পারছ না। মেদিনীপুর থেকে সিভিল সার্জেনকে কল দাও। একটু পর বলেছিলেন—না, বেটাদের মুখখানাই লাল আর মুখেই খুব বড়াই। মেদিনীপুরের গোলক ডাক্তারকে কল দাও! বুঝেছ?
ম্যানেজারকে বলেছিলেন—তুমি এই টেলিগ্রামটা পাঠাও কলকাতায়।
প্রথম টেলিগ্রাম নিজে খসড়া করে দিয়েছিলেন—বউমা এবং ছেলেদের নিয়ে অবিলম্বে এস, আমি অসুস্থ–রত্নেশ্বর।
ম্যানেজার চলে যাচ্ছিলেন রত্নেশ্বর হঠাৎ তাঁকে ডেকে বলেছিলেন—দাঁড়াও হে। শুনে যাও।
ব’লে একখানা নাম ছাপানো কাগজ টেনে নিয়ে তাতে কিছু লিখে ম্যানেজারের হাতে দিতে গিয়েও দেন নি। কাগজখানাকে সামনে রেখে তার একটা নকল করে নিয়ে বলেছিলেন—“একখানা সদরের উকিলের কাছে পাঠিয়ে দাও। একখানা তোমার হাতে রইল। যদি আমার রোগ কঠিন হয় তা হ’লে এই নির্দেশমত কাজ করবে। বুঝেছ?”
কাগজখানায় লেখা ছিল—“অদ্য হইতে আমার জীবিতকালের শেষক্ষণ পর্যন্ত রায়বাড়ীর সমুদয় এস্টেট ইত্যাদি সমস্তই আমার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান দেবেশ্বর রায়ের হুকুমমত এবং তাঁহার সহিসাবুদে চলিতে থাকিবে। ব্যাঙ্কের কার্যাদি বন্ধ থাকিবে। আদায়ী খাজনা ইত্যাদি ও সিন্দুকে মজুত অর্থ হইতে ব্যয়াদি নির্বাহ হইবেক। সিন্দুকে যাহা মজুত আছে তাহা গতকালকার রোকড়ের হিসাবের মধ্যে দৃষ্ট হইবেক। তাহার পাশে আমি সহি দিয়াছি। ইহাতে অপর কোন ব্যক্তির অর্থাৎ আমার অপর দুই পুত্রের কোন প্রকার আপত্তি চলিবে না। দেবেশ্বরের সকল কৃতকার্য আমার কৃতকার্যের তুল্য বলিয়া গণ্য হইবেক। আমি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে বিছানায় বসিয়া এই পত্ৰ লিখিলাম এবং ইহার একখণ্ড নকল সদরে আমাদের উকীলের নিকট প্রেরণ করিলাম।
ইতি রত্নেশ্বর রায়।”
শিবেশ্বর সেই কাগজখানি বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন—এই উনি নিজে হাতে লিখে ম্যানেজারের হাতে দিয়েছিলেন। ম্যানেজার আমাকে দিলেন পরশু উনি হুঁশ হারাবার পর। পরশু সাত দিন গেছে। মেদিনীপুরের ডাক্তার বলে গেছে জ্বর বিকার।
থেমে থেমে কথা বলছিলেন শিবেশ্বর।
দেবেশ্বর বুঝতে পারছিলেন যে, শিবেশ্বর কান্না চেপে কথা বলছে। কথাটা ঠিক। ভুল তাঁর হয় নি। ক্ষোভে ক্রোধে তাঁর কান্না আসছিল। শিবেশ্বর জানতেন বিশ্বাস করতেন তিনিই পিতার অনুগত এবং প্রিয়তম পুত্র। দেবেশ্বরের চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল এবার। বত্রিশ দিন পর রত্নেশ্বর রায় সেই জ্বরের পর পথ্য করেছিলেন—জ্বর ছেড়েছিল আটাশ দিনের দিন। বিকার কেটেছিল চব্বিশ দিনে।
বিকারের মধ্যে বার বার বলেছেন—দরজা খোল দেবেশ্বর। দেবেশ্বর! বেশ ধমক দিয়ে বলেছেন। কখনও মিনতি করে বলেছেন। তারপর বলেছেন।—ভাঙো দরজা ভাঙো আবদুল—মহাবীর, তোড়ো দরজা।
বিকার যেদিন কাটল সেদিনও ডেকেছিলেন—দেবেশ্বর! দেবেশ্বর কই? পুত্রবধূকে মাথার শিয়রে দেখে চিনতে পেরেছিলেন—বলেছিলেন, বড়বউমা! এপাশে তাকিয়ে দেখে মেজবউমাকে দেখে বলেছিলেন—মেজবউমা! শিবেশ্বরের প্রথমা স্ত্রী ইনি।—
বড় পুত্রবধূ তাড়াতাড়ি মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে ডেকেছিলেন —বাবা!
—মা! তারপরই বলেছিলেন—জোরে বল, কানে ঠিক শুনতে পাচ্ছি না।—
বড়বউমা বলেছিলেন-ছোটবউও রয়েছে; এই যে আমার পাশেই রয়েছে। বলে ছোটবউ অর্থাৎ রামেশ্বরের স্ত্রীকে শ্বশুরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।
শ্বশুর একটু ক্ষীণ হেসে, ঘাড় নেড়ে সন্তোষ প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছিলেন—সঙ্গে সঙ্গে দু ফোঁটা জল দুই চোখের কোলে জমে উঠেছিল।
বড়বউমা আবার বলেছিলেন—পিসীমা এসেছিলেন কাশী থেকে। পরশু থেকে জ্বর কমতে শুরু করেছে দেখে কলকাতা ফিরে গেছেন। আবার আসবেন। কথা বুঝতে ভুল করেন নি রত্নেশ্বর রায়—সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন—অন্নপূর্ণা এসেছিল!
—কি কষ্ট হচ্ছে বাবা? বোধ হয় চোখের জল দেখেই বড়বউমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কথাটা—
—কষ্ট? বুঝতে পারছি না। একটু ভেবে নিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন—বড় দুর্বল মনে হচ্ছে!
—চুপ করে শুয়ে থাকুন। বড় দুর্বলই হয়েছেন যে!
—কদিন হল আজ?
—চব্বিশ দিন।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রত্নেশ্বর বলেছিলেন-তোমরা কবে এলে?
—আজ আঠার দিন হয়ে গেল বাবা।
—দেবেশ্বর? সে?
—এসেছেন? ওই যে ওই বারান্দায়, আসছেন বোধ হয়।
সত্যিই বারান্দায় পায়ের শব্দ উঠছিল, সে শব্দ রত্নেশ্বর রায় শুনতে পান নি। দেবেশ্বর শিবেশ্বর রামেশ্বর তিন ভাই—খবর পেয়ে বারান্দা ধরে ঘরে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
বড়বউ ইশারা করে ডেকেছিলেন স্বামীকে-এস।—
দেবেশ্বর দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। রত্নেশ্বর দেবেশ্বরকেই বলেছিলেন—এসেছ?—
দেবেশ্বর চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছিলেন। এর উত্তর দিতে তিনি পারেন নি। খুঁজে পান নি। তবে তিন ভাইয়ের চোখ জলে ভরে উঠেছিল। এরই মধ্যে ডাক্তার এসে পড়ে সবিনয়ে মৃদুস্বরে বলেছিলেন—ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার বড়বাবু!
বড়বাবু দেবেশ্বর। দেবেশ্বর বলেছিলেন—হ্যাঁ। নিশ্চয়। তবে ওঁকে বলে যেতে হবে। না হলে-
বড়বউ উমা বলেছিলেন—জোরে বলো একটু—কানে ঠিক শুনতে পাচ্ছেন না।
দেবেশ্বর ঝুঁকে পড়ে বলেছিলেন—ডাক্তার বলছেন আপনার এখন বিশ্রাম দরকার।
রত্নেশ্বর রায় ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলেন—হ্যাঁ।
তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন-আর কিছু হবে না। হতে দেরী আছে। বলে গেছে আমাকে।
সবিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন দেবেশ্বর, তাঁর সঙ্গে অন্য ভাই এবং বউয়েরাও।
রত্নেশ্বর রায় বলেছিলেন—তোমার মা! তোমার মা সারা অসুখটা ওই ঘরে আমার সামনে বসে থেকেছে। এই তো সে গেল। বলে গেল—আমি এবার চল্লাম। এখন আসতে তোমার দেরী আছে কিছুদিন। ভাল হয়ে গেলে এবার।
* * *