চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ১

অন্নপূর্ণা-মা সেদিন অর্চনার বিয়ে পাকা করবার সময় সুরেশ্বরকে শর্ত করিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন—শোন কালকে যা কথা হয়েছে, তাই ঠিক রইল, কন্যাভরণ আমি নেব না। শুধু শাঁখা শাড়ী দিবি। পাত্রকে পাত্রাভরণ দিতে হবে ও যা চাইবে। ছোঁড়ার মোটরগাড়ীতে ঝোঁক, ডাক্তার হয়েছে। একটা মোটরগাড়ী দিস্। আর ঘড়িফড়ি যা দিতে হয় আসর সাজিয়ে দিবি। যোগেশ্বরই একমাত্র টাকা রেখেছিল, জমিয়েছিল, সুদে বাড়িয়েছিল; তার অর্ধেক সে উড়িয়ে দিয়ে গেছে। ধনীদের টাকা রাজা জমিদারের টাকা যাতে যায় তাতেই উড়িয়েছে। তবু ভাল সে অর্ধেক রেখে গেছে। নগেন বলছিল—নাতবউ তোর মায়ের বুদ্ধিতে তা বিষয়-সম্পত্তিতে লগ্নী ক’রে বেড়েছে অনেক। তোর বোন নেই। তুই দিবি। তার সঙ্গে আর একটি শর্ত চাপাব।

সুরেশ্বর বলেছিল—বলুন।

—ওই বাড়ী, যা দাদা দানপত্র করে দিয়ে গিয়েছে অঞ্জনাদি’র মেয়ে ভায়লাকে, যাকে দেবেশ্বর ক্রীশ্চান হয়ে বিয়ে করবার জন্য ক্ষেপেছিল, তার বাড়ী যদি কেড়ে নেয় রায়বংশের কেউ, তাতে চোদ্দপুরুষ নরকস্থ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই সুরেশ্বর।

সুরেশ্বর বলেছিল-ব্যাপারটা যতদূর বুঝছি, তাতে হ্যারিস বলে একটা লোক, সে হল কুইনির মায়ের সৎমামা—

—তুই বলছিস ভায়লার বেটা পিড্রুজ যে ফিরিঙ্গী মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল, সেই মেয়েটার দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীর সন্তান?

—হ্যাঁ। সে কিছুদিন আগে কীর্তিহাটে গিয়েছিল। তার দাবী তার মা, মানে কুইনির মায়ের মা মরবার সময় কুইনির মাকে বলেছিল, হ্যারিসকে থাকবার জন্যে একখানা ঘর দিস। লোকটা জঙ্গলে বাস করত, বড়লোকদের শিকারের শখ হলে তাদের বনে নিয়ে গিয়ে শিকারের ব্যবস্থা করে দিত। তারপর একটা খুনখারাপী করে লোকটার জেল হয় বারো বছর। জেল থেকে ফিরে লোকটা কলকাতায় এসে দেখে কুইনির মা মরে গেছে, কুইনিকে হিলডা নিয়ে এসেছে কীর্তিহাটে। সে কীর্তিহাটে এসেছিল কুইনিকে নিয়ে কলকাতার বাড়ীতে বাস করবে, কুইনিকে মানুষ করে তুলবে লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু হিলডা লোকটাকে হাঁকিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল—ওর মতলবটাই অত্যন্ত বদ মতলব। মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে—

হ্যারিসকে নিয়ে যা ঘটেছিল তা সে সবই বললে অন্নপূর্ণা-মাকে। এবং দুই আর দুই চারের মত হ্যারিস ও প্রণবেশ্বরের যোগাযোগ ফলটাই অনুমান ক’রে বললে-হ্যারিসই খুঁজে বের করেছে প্রণবেশ্বরদাকে। হয়তো বা কীর্তিহাট থেকেই সে ঠিকানা-ফিকানা যোগাড় করে এনেছিল। এসে এই কাণ্ড বাধিয়েছে। তা আপনি বলছেন—আমি বাড়ীটা যদি দরকার হয় তবে না-হয় দাম দিয়েই আবার কুইনির নামে দলিল করিয়ে দেব। নিশ্চয় করব আমি।

রথীন চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে শুনেই গেল। একটি কথাও বললে না। সে চারিদিক ঘুরে আমার আঁকা ছবিগুলো দেখছিল।

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—বিয়ে তা হলে ফাল্গুনেই হবে। তুই আয়োজন কর। কি রে রথীন? বল আর একবার বল!

—আবারও বলতে হবে?

—হবে।

—তা হলে বলছি, আগে একবার তিন সত্যি করেছি, আবারও করছি। করব, করব, করব। অন্নপূর্ণা-মা বললেন—ভাল, তুই একবার ওই মেয়েটিকে ডাক।

—কাকে? কুইনিকে?

—হ্যাঁ।

—এখানে ডাকব?

—বারান্দাতে দাঁড়াতে বল।

কুইনি এসে বারান্দাতে দাঁড়াল, অন্নপূর্ণা-মা তাকে বললেন-তোমার বাপ তো মুখুজ্জে বামুন ছিল?

কুইনি হাসলে, বললে—হ্যাঁ মুখার্জি ছিলেন কিন্তু আমরা ক্রীশ্চান। আমার বাবার বাবা তাঁর বাবা প্রপিতামহ ক্রীশ্চান হয়েছিলেন।

একটু চুপ ক’রে থেকে অন্নপূর্ণা-মা বললেন—তা হলেও তুমি ভায়লেটের বংশ। আমি এই বাবুকে বলে গেলাম, কোন ভয় নেই তোমার, ও বাড়ী তোমরা নিশ্চয় ফিরে পাবে। ভায়লেটকে আমি চিনতাম।

কুইনী চুপ ক’রে রইল।

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—আমি কে জান?

কুইনি বললে—জানি, হিলডাদিদিয়া বললে-আপনি কীর্তিহাটের সব থেকে বড় জমিদার রায়বাহাদুরের বোন।

—হ্যাঁ। তোমার মায়ের বাবার মা ভায়লা-ভায়লাটাকে আমি তোমার মত দেখেছি। বুঝেছ? তাকে খুব ভালবাসতাম আমি।

কুইনী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এই চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা বিনীত আভিজাত্য আছে সুলতা। সে আঘাত সহ্য করে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু হারে না। কারণ যুদ্ধ তো হয় না তার সঙ্গে। সে নিরস্ত্র। তবে হ্যাঁ, অনেক কুম্ভকর্ণ আছে যারা সশস্ত্র নিরস্ত্র বাছে না, চর্বণ করে হাড়গোড় পর্যন্ত শেষ করে দেয়।

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—আমি সুরেশ্বরকে বলে দিলাম। তুমি পড়াশোনা কর। রায়বাড়ীর বড় তরফ তোমার পড়ার সমস্ত খরচ যোগাবে। ভায়লেটের ছেলে মিশনারী ইস্কুলে পড়ত। তার খরচ বড় রায় তরফ দিয়েছে। পিড্রুজ মারা গেলে তোমার মায়ের পড়ার খরচ তাও দিয়েছে। কনভেন্টে পড়ত বোধ হয়।

কুইনি সবিস্ময়ে তার দিকে তাকালে এবার। সম্ভবতঃ এত কথা তিনি জানলেন কি করে সেই প্রশ্নটাই তাকে বিস্মিত করে তুলেছিল।

অন্নপূর্ণা-মা রথীনকে সঙ্গে নিয়েই চলে গেলেন।

বিকেলবেলা খবর পেলাম বিশে ফাল্গুন বিয়ের দিন স্থির করছেন অন্নপূর্ণা-মা।

বিশে ফাল্গুনই বিয়ে হয়ে গেল সুলতা। শর্ত আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম সুলতা। শুধু অর্চনার বিবাহের বরপণ বা খরচ সম্পর্কেই নয়, অন্নপূর্ণা-মা কুইনি সম্পর্কে যে শর্ত আমার উপর চাপিয়েছিলেন তাও আমি পালন করেছিলাম।

তার মধ্যে কিছু কথা আছে, কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, সে কথা না বললে রায়বাড়ীর জবানবন্দী অসম্পূর্ণ থাকবে। এবং অর্চনাকে নিয়ে যা প্রশ্ন করলে তাও ঠিক পরিষ্কার হবে না।

***

বিয়ে ঠিক হয়েছে বিশে ফাল্গুন। আমি জানবাজারের বাড়ীতে। জগদীশ্বরকাকার গোটা সংসারকে এখানে নিয়ে এসেছি। হিলডা কুইনি ফিরে গেছে কীর্তিহাটে। আমি মেদিনীপুরের মিশনারীদের ইস্কুলে এবং হোস্টেলে কুইনিকে দেবার জন্যে চিঠি লিখেছি। আর বাড়ীখানার জন্য প্রণবেশ্বরদাদার সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। অনুমান আমার সত্য, হ্যারিস এসে প্রণবেশ্বরদাদাকে দিয়ে বন্ধ ঘরখানা খুলিয়ে ঢুকে বসেছে। প্রণবেশ্বরদা হাজার হলেও রায়বাড়ীর ছেলে। বিষয় ব্যাপার বোঝে, হ্যারিসের কথায় কাগজপত্র খুঁজে পেতে পেয়েছে কর্পোরেশনের ট্যাক্সের রসিদ। অবশ্য বেশ ক’বছর আগের রসিদ। তখন তাদের অবস্থা ভালই ছিল। বোধ করি বিশ বছর আগের। তারপর খুঁজে খুঁজে পেয়েছে যে বাড়ীর দানপত্র হওয়া যে কালে হয়েছে সেই কাল থেকেই কর্পোরেশনের ট্যাক্স বরাবরই দিয়ে আসছে রায়বাড়ীর বড় তরফ।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর এ দায়টা চাপিয়ে রেখে গিয়েছিলেন বড় ছেলে দেবেশ্বরের ঘাড়ে। তাই বরাবর দেওয়া হয়ে আসছে। বিশ বছর আগে যখন বড়তরফের বড়তরফ প্রণবেশ্বরদাদারা কর্পোরেশনের সব ট্যাক্সই বাকী ফেলতে শুরু করলেন, তখন থেকে আমাদের বা আমার তরফ থেকেই জয়েন্ট প্রপার্টির ট্যাক্স দিয়ে আসা হচ্ছিল। এ বিশ বছরের ট্যাক্স আমরাই দিয়ে এসেছি। হ্যারিসের কাছে হদিসটা পেয়ে প্রণবেশ্বরদা নিজে থেকে গিয়ে ব্যবস্থা ক’রে কর্পোরেশন ট্যাক্স দিয়ে এসেছে এবং একলা তার বাপের অর্থাৎ জ্যাঠামশাই যজ্ঞেশ্বর রায়ের নামে রসিদ কাটিয়ে এনেছে। তার ফল এই। এলিয়ট রোডের বাড়ীখানি লাভ! লাভ না হোক ফ্রেম বটে। ষোল আনা না হোক আট আনা বটে—তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরও একটা জিনিসে তার ভরসা ছিল, সেটা আমার মূর্খতা। সেটেলমেন্টে নগদ হাজার কয়েক টাকা দিয়ে গোয়ানপাড়া চাকরান থেকে পুরো লাখরাজ করে দিয়েছি; কীর্তিহাটে গোচরভূমি আর বসতবাড়ী কুড়ারাম ভট্টচাজের পাঁচালী দেখিয়ে বিনা খাজনায় ভোগ করতে দিয়েছি, এবং টাকা এখনও আমার লাখ কয়েক ছিল সুতরাং হিলডা এবং কুইনি কেঁদে পড়লে হয়তো আরও কিছু খরচ করতে আমি রাজী না হয়ে পারব না।

প্রণবেশ্বরের হিসাবে ভুল ছিল না। কিন্তু ওদের অদৃষ্ট খারাপ, তার প্যাঁচেই সত্যি অঙ্কও ভুল হয়ে যায়। পাওনার অঙ্কের বাঁদিকে কখন যে একটা ফুটকি বসিয়ে দিয়ে পূর্ণকে ভগ্নাংশ করে দেয় তা গণৎকার বলতে পারে, আমি পারি না। অন্তত তখন তেমনি কপালের পালাই চলছিল।

প্রণবেশ্বরদাদাকে ধরতে চেষ্টা করেও পারছিনে। জগদীশ্বরকাকাকে আনতে চেষ্টা করছি, তাও পারছি না। জগদীশ্বরকাকা স্ত্রীর সঙ্গে অর্চনা এবং অন্য ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছেন, নিজে আসেননি।

কারণ তখন ইলেকশন ক্যাম্পেন চলছে পুরোদমে, এবং ইলেকশন ঠিক সামনে।

মেদিনীপুর। বাংলার পীঠস্থান মেদিনীপুর। সকলেই জানে মেদিনীপুর থেকে কংগ্রেস ক্যান্ডিডেট এবং এক্সট্রিমিস্ট ক্যান্ডিডেট ছাড়া কেউ আসবে না। কংগ্রেসের ভিতরে তখন দুটো ভাগ তা তুমি আমার থেকে ভাল জান সুলতা। কিন্তু প্রণবেশ্বরদাদা সেখানে গেছেন, জগদীশ্বরকাকা সেখানে থেকে গেছেন এই ভোটপর্ব থেকে কিছু উপার্জনের প্রত্যাশায়।

আমি সকালবেলায় উঠে বারান্দায় রেলিংয়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি খবরের কাগজের জন্যে। কোথায় কোন্ বক্তৃতা হল, কে কি বললে, তা জানবার জন্যে মন উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে। বিয়ের উদ্যোগের আয়োজন চলছে। খুড়ীমা ম্লান-মুখে এসে যখন বলেন—হ্যাঁ বাবা, এটার কি করবে? তখন আর লজ্জার আমার বাকী থাকে না।

আমি বলি—যা বলবেন তাই হবে।

কিন্তু তিনি মাটির দিকে মুখ নামিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন—তাতে যে অনেক খরচ হবে বাবা।

—আমি আপনাদেরই ছেলে। বললে এমন আশ্চর্য হাসেন, যাতে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যেতে হয়।

সেদিন সেই সকালেই মনোহরপুরের খুড়ীমা বলতে এসেছিলেন—প্রণামীর কাপড়ের কথা। দুদিন আগে ওবাড়ী থেকে অন্নপূর্ণা-মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে এর জন্যে। সকলকে ঘর থেকে সরিয়ে দিয়ে খিল বন্ধ করে অন্নপূর্ণা-মা আমাকে বলেছিলেন—শোন সুরো, আজ আমি যা বলছি তা রায়বাড়ীর মেয়ে হয়ে বলছি রে! ভবানীপুরের মুখুজ্জেবাড়ীর বউ না আজ আমি। এরা বড় ছোট রে! সেইজন্যে আমার পেটের ছেলে থেকে-আমার রক্ত দিয়ে এদের তৈরী করে ভেবেছিলাম যে এরা পাল্টাবে। তা পাল্টায় না রে। দেখ–ক’দিন থেকেই নগেন সুরেন বীরেন এদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে, বউরাও গিয়ে যোগ দিচ্ছে। সে সব কথা কানে আসছে আমার। ছোটলোকের মত কথা রে। কাল নাকি কথা হয়েছে, শুধু কথা কেন, ফর্দও হয়ে গেছে একটা প্রণামীর কাপড়ের ফর্দ! বুঝলি! চাকরবাকর ঝি ঠাকুর সহিস কোচম্যান এ তো সব আছেই, এগুলো বকশিশ। কিন্তু প্রণামীর দাবী নাকি রথীনের মা বলেছে—আমাদের মানে আমার, মেজ বউয়ের, ছোট বউয়ের বাপ-মায়ের না দিলে মাথা হেঁট হবে। ওটা তোমরা নিজেরা কিনেই দাও।

সুরেশ্বর, কথাটা আমার বড় গায়ে লেগেছে রে। দেখ, ছেলেদের বলতে পারিনি কিন্তু তোকে বলতে আমার লজ্জা নেই। কেন জানিস? ওরা হল পরগোত্র, ওদের গোত্রে আমি এসে পড়েছিলাম, লাঞ্ছনার অন্ত হয়নি। আমার বাপের টাকায় আর পিসেমশায়ের টাকায় এই বংশ আমি আমার বংশ মনে করেছিলাম। কিন্তু তারাই আজ আমার বাপের বংশের খেউড় করছে, তা আমার বুকে শেলের মত বিঁধছে। শোন, ফর্দ আমি কাল করে পাঠিয়ে দেব। কাকে কি কাপড় দিতে হবে—গরদ, শান্তিপুরে, কাঁচি, মিলের পেটাই, খদ্দর সব লিখে দেব। বাজারের সর্বোৎকৃষ্ট জিনিস তুই দিবি। সর্বোৎকৃষ্ট। শোন, টাকা আমি দেব, কিন্তু কাকপক্ষীতে জানবে না। তুই আর আমি।

আমি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে একটু হয়তো উঁচু গলাতেই বলেছিলাম—না বড়মা, খরচ যা লাগে।

তিনি মুখটা আমার চেপে ধরেছিলেন। জানিসনে সুরো, দেওয়ালের কান আছে। যা বাড়ী যা।

বাড়ি ফিরে সেই মত ফর্দই আমি করিয়েছিলাম। কথাটা কেমন করে যে জগদীশকাকার স্ত্রীর কানে উঠেছিল তা বলতে পারব না, তিনি সকালবেলাতেই অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—একটা কথা বলতে এলাম বাবা।

—কি বলুন খুড়ীমা!

—ওঁরা নাকি যা প্রণামীর কাপড়ের ফর্দ দিয়েছেন তার দাম নাকি আড়াই হাজারের কম হবে না?

সুরেশ্বর বললে—তখনও ১৯৩৭ সাল সুলতা। চালের দর চার টাকার মত, কাপড় কাঁচি ধুতির জোড়া বোধ হয় বারো-চৌদ্দ টাকার বেশী নয়। মানে একখানা ছ’সাত টাকা। তাতে আড়াই হাজারে কত কাপড় তা বুঝতে পারছ। অবশ্য গরদ কম ছিল না। সব মুরশিদাবাদী গরদের শাড়ী। তিনি লজ্জিত এবং সঙ্কুচিত হয়েছেন তাতেই।

সুলতা, আমি হেসে বলতে যাচ্ছিলাম—খুড়ীমা, আমার সহোদরা থাকলে তো তার বিয়ের খরচ করতে হত, ভাবুন তাই করছি। জানেন তো, টাকা আমার অনেক জমিয়ে দিয়ে গেছেন আমার মা। এই কালই দেখছিলাম—। কথাটা আর শেষ হল না সুলতা, বড়মা অন্নপূর্ণা দেবীর গাড়ী এসে এ-বাড়ী ঢুকল।

আমি ছুটেই নেমে গেলাম। এত সকালে অন্নপূর্ণা-মা কেন এলেন আবার! কি হল? একজন পঁচাত্তর বছর বয়স্কা মহিলা দেহে না-হয় শক্ত আছেন মনে তো আছেনই, তবুও বয়সের বছরের পরিমাণ তো কম নয়। অনেকের ওটা বেড়েই যায় কিন্তু কমে না বোধহয় কারুরই। গাড়ীটা থামতেই আমি দরজার নিচের অংশটা খুলে দিয়ে পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম—বড়মা!

দেখলাম, বড়মার সামনে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বসে আছেন দয়াল-ঠাকুরদা।

বড়মা বললেন—তোর কাছেই এসেছি, কাজ আছে!

অন্নপূর্ণা-মা স্থূলকায় ছিলেন না, আবার গুটিয়ে খাটো হয়েও যান নি, মুখখানা তাঁর বার্ধক্যের রেখার জালে জালে দুর্বোধ্য নয়, দেখলাম রাঙা মুখখানা থমথম করছে। কণ্ঠস্বর ভারী, তার মধ্যে এতটুকু স্নেহ-আশ্বাসের আভাস নেই।

আমি তাড়াতাড়ি দরজার নিচের কাটা দরজাটা খুলে দিলাম। বড়মা হাতখানা বাড়িয়ে বললেন—ধর আমাকে।

আমার হাত ধরে নেমে বললেন—চল, উপরে তোর মায়ের ঘরে চল। পিছন পিছন দয়াল-ঠাকুরদা নামলেন, অন্নপূর্ণা-মা বললেন—এস দয়াল, তুমি সঙ্গেই এস।

উপরের ঘরে গিয়ে মেঝের উপর কার্পেট আমিই পেতে দিলাম। বড়মা বললেন—দরজা বন্ধ করে দে। জানালাও। যা বলব তা যেন কেউ শুনতে না পায়। বাইরে বলে দে যেন কেউ না আসে। জগদীশ্বরের বউ, অর্চনা এরাও কেউ না।

বলব কি সুলতা, বুকখানা আমার কেঁপে উঠল। ভয় হল এই অলঙ্ঘনীয়া মহিলাটিকে। আবার কি বলবেন?

দয়াল-ঠাকুরদা কেবল বললেন—কেন পিসীমা, এসব বাজে—

—তুই থাম দয়াল! অন্নপূর্ণা-ঠাকুমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—তুই মদ খাস সুরেশ্বর?

মনে মনে চমকে গেলাম। কিন্তু বাইরে চমকালাম না। বললাম—খাই বড়মা।

—খাস! আচ্ছা আর একটা কথা বল তো—সেখানে তুই কুইনিকে নিয়ে। চুপ ক’রে গিয়ে বললেন—তার জন্যেই কি তুই কুইনির দিদি হিলডাকে গোয়ানপাড়ার একরকম মালিক করে দিয়েছিস! লাখরাজ করে দিয়েছিস গোয়ানপাড়া?

—না। এর একটাও সত্য নয়। সত্য কেবল ওরা যখন লাখরাজ দাবি করলে—

—সে আমি দয়ালের কাছে শুনেছি। যদুরাম রায়ের লাখরাজের ছাড়পত্র দেখিয়েছিল দয়াল সেই দিন। তুই তাই দেখে গোয়ানপাড়া লাখরাজ করে দিয়েছিলি।

—হ্যাঁ বড়মা। কথাটা ঠিক তাই বটে।

—টাকাও তার জন্যে অনেকগুলো খরচ করেছিস। তারপর তিক্ত হেসে বললেন—ছোট মেজবউমা, মানে শিবেশ্বরের তৃতীয় পক্ষের বউকে ল্যাভেন্ডার সাবান মাখিয়ে কলঙ্কভাগিনী করেছিস!

—তোমাকে কে বললে বড়মা?

দয়াল-ঠাকুরদা কাতর কণ্ঠে বললেন—ওঁকে কীর্তিহাট থেকে চিঠি লিখেছে ভাই। সে একখানা মস্ত বেনামী চিঠি।

বড়মা তাঁর গঙ্গাস্নানের ঝোলা থেকে একখানা চিঠি বের করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন—পড়ে দেখ। চিঠিখানা পেয়েছি পরশু, পেয়েই আমি লোক পাঠিয়ে দয়ালকে আনলাম। দয়াল কখনও মিথ্যে বলবে না আমার কাছে। রায়বাড়ীর সবটাই ফাট ধরছে, বংশে পচ ধরছে তা আমি জানি। বেশী পুরনো হলেই তা হয়। রামের অযোধ্যা নেই, বংশ থাকলে তাদের কি দশা হত ভগবান জানেন। পুরাণে আছে যদুবংশ শেষ হয়েছিল মদ খেয়ে নিজেরা মারামারি করে। বাদশাদের বংশ শুনেছি টাঙা চালায়। তাদের মধ্যেও কত পাপ কত পচন কে জানে? আশ্চর্য কিছু নয়। তোর বাপই তো তার চরম ক’রে গেছে। তোকে দেখে ভরসা হয়েছিল। তারপর এই মেয়েটার ছবি দেখে মনে হয়েছিল সত্যি সত্যিই আমার মা বুঝি ফিরে এসেছেন, সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যি ফিরেছে রায়বংশে। এ চিঠিতে সব জঘন্য কথা আছে সুরেশ্বর। জঘন্য কথা। তাই দয়ালকে আনতে পাঠিয়েছিলাম। তার কাছে জানব শুনব। তা সব শুনলাম জানলাম। তুই পড়ে দেখিস। দেখিস নয়, দেখ। আর বল তো—চিঠিখানার হাতের লেখা তুই চিনিস কিনা? চিঠিখানা যে রায়বাড়ীর কোন কুলাঙ্গারের লেখা তাতে সন্দেহ নেই। অর্চনার বিয়েটা ভেঙে দিতে চায়। আর রাগ আছে তোর ওপর, খুব রাগ, সেটাও এই সব কলঙ্ক রটনা করে মেটাতে চায়। তুই যে নিজে থেকে তোর টাকা খরচ করে অর্চনার বিয়ে দিতে চাস তার উপরেও একটা কুৎসিত মতলব চাপিয়েছে।

সুলতা, চিঠিখানা হাতে করে আমি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। সমস্ত শরীরের মধ্যে যেন একটা কাঁপুনি বেয়ে চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে একটা নিষ্ঠুর আক্রোশ, ক্রোধ, প্রতিহিংসাস্পৃহা যা বল তাই। চিঠিখানা খুলতে আমার সাহস হচ্ছিল না। হোক মিথ্যা, হোক অসত্য, কিন্তু কুৎসিত ভয়ঙ্কর কদর্য কিছু কে দেখতে চায় বল!

দয়াল-ঠাকুরদা বললেন—না—না পিসীমা, কেন ওই মিথ্যেকথা-ভরা মতলববাজি চিঠিখানা পড়তে ওকে বলছ তুমি? না—না। চিঠিখানা তুমি নিয়ে নাও। বুঝলে? পুড়িয়ে দাও। ছাই ক’রে দাও পিসীমা।

অন্নপূর্ণা-মা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন-সেই ভাল। দে, চিঠিখানা আমাকে ফিরে দে। শুধু লেখাটা দেখে বল দেখি এ লেখা তুই চিনিস কিনা?

আমি বললাম—না বড়মা, চিঠিখানা আমি পড়ব। পড়তে চাই।

* * *

সেটেলমেন্টের নোটিশ পেয়ে কীর্তিহাটে এসে আমি মহিষের মত পঙ্কপঙ্খলে সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে শুধু নাকের ফুটো দুটি চাগিয়ে প্রমত্ত হয়ে পড়ে আছি, পত্রের বক্তব্য তাই হলেও আসল লক্ষ্য অর্চনার বিয়ে।

“আপনাদের মত বংশ—যাঁহারা বাংলাদেশে এবং কলকাতায় দেশপ্রেমিক গান্ধীবাদী, মরালিস্ট হিসাবে বিখ্যাত, তাঁহারা যদি এই কন্যার মত কন্যাকে গৃহে বধূ করিয়া লইয়া যান তবে সম্ভবতঃ দশ মাস যাইতে না যাইতেই সন্তান কোলে করিয়া বসিবেন জানিবেন।

এই যে বড়তরফের সুরেশ্বর, যে প্রকৃতপক্ষে রায়বাড়ীর অবশিষ্ট সম্পত্তির মালিক এই সুরেশ্বর কি স্বার্থে দশ-বারো-পনেরো হাজার টাকা খরচ করিয়া বিবাহ দিতে উদ্যত হইয়াছে? এতই উদার সে? এতই মহৎ?

এই ধনীপুত্রটির পিতৃপরিচয় বঙ্গদেশে বিখ্যাত, সুবিদিত। তাঁহার পুত্র এখানে আসিয়া অর্থের উত্তাপে সর্বগ্রাসী অগ্নির মত জ্বলিতেছে এবং যাহা পাইতেছে তাহাই গ্রাস করিতেছে। তাহার সম্পর্কে বিচার নাই। সে সর্বভুকের মত মেজতরফের যুবতী ছোটগিন্নীকে ল্যাভেন্ডার সাবান মাখাইয়া কেলেঙ্কারি ছড়াইয়াছে। তাহাকে মাসে মাসে সে নিয়মিত টাকা দিত। এই জেলের সময়েও বহু টাকা সে তাহার জন্য খরচ করিয়াছে। এবং তাহার দ্বারাই সে রায়বংশের কুমারী কন্যাগুলিকে লইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিয়াছে। অর্চনার উপরেই তাহার বেশী টান ছিল।

তাহার উপর এখানে আসিলেই বুঝিতে পারিবেন, জানিতে পারিবেন, গোয়ানপাড়ায় গোয়ানদের লইয়াও সেই কাণ্ড করিয়া চলিয়াছে সে। দিবারাত্রি মদ্যপান করে এবং ছবি আঁকার ছল করিয়া এখানে সেখানে বসিয়া থাকে। গোয়ানপাড়ার হিলডা বুড়ীর এক সম্পর্কীয় নাতনী আছে, তাহার নাম কুইনি। সেই কুইনির উপরেও তাহার খুব নজর। খবর লইলে জানিতে পারিবেন, সে তাহাকে মেদিনীপুর মিশনারী ইস্কুলে এবং বোর্ডিংয়ে রাখিয়া শিক্ষিতা মেমসাহেব তৈরী করিয়া লইতেছে।

অর্চনার দায় এখন কাঁধ হইতে না নামাইলে উপায় নাই। কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবে। তাহারই জন্য তাহাকে আপনাদের পবিত্র বংশের স্কন্ধে চাপাইয়া কুইনিকে লইয়া ভবিষ্যতে স্ফূর্তির তালে আছে।

কুইনির জন্যও খরচ সে অনেক করিতেছে। খবর লইলেই জানিতে পারিবেন। এলিয়ট রোডের একখানা বাড়ী লইয়া সে প্রায় হাজার সাত-আষ্টেক টাকা তাহার জ্যাঠতুতো ভাই প্রণবেশ্বরকে দিতে রাজী হইয়াছে।

এ সম্পর্কে আরও একটি সংবাদ জানাই, সেদিন ইলেকশনে ভোটের জন্য কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ..রাজাবাহাদুরের তরফের লোক আসিয়াছিল, তাহাদের তরফের বক্তারা প্রকাশ্যে বলিয়া গেল যে সুরেশ্বরবাবু নিজে আধা ক্রীশ্চান—ধর্মহীন ব্যক্তি, তাঁহার কথায় তোমরা ভুলিয়ো না। তিনি গোয়ানপাড়ার কুইনি নামক ক্রীশ্চান মেয়েকে মিশনারী ইস্কুলে রাখিয়া পালিতেছেন।”

ইলেকশনের সময় আমি যেতে পারিনি কিন্তু আমার তরফের লোকেরা, কর্মচারীরা কংগ্রেসের হয়েই কাজ করছিল। কীর্তিহাটের লোকেদের বলবার কিছু প্রয়োজন ছিল না। সে গোটা দেশেরই প্রায় এক অবস্থা। তবু আমি বলেছিলাম। খান দুই চিঠিও লিখেছিলাম। একটা ছোট নিবেদনপত্র ছাপিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে ছিল “বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে যারা অন্ধকারে আলো জ্বেলে পথ চলছে, তাদের পিছনে চল। অন্য পথ নেই”।

কালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটা শক্ত হাতে ধরা একটা মশালের আলো তার তলায় ওই দুটো লাইন লিখে এখান থেকে ছাপিয়ে আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তার উত্তরে নাকি এই কথা রাজারা বলেছেন।

তা বলুন। জানি কংগ্রেস—মানে মানুষেরা জিতবে। মানুষ মানে জীবন্ত মানুষ, নতুন মানুষ, পুরনো নয়, পচা নয়। জানি আমি নিজে পচা-বাড়ীর ছেলে। আমি—যোগেশ্বর রায়, সেকালের ইংলিশম্যান স্টেটস্ম্যান—ইংরেজ সরকারের মুখপত্রের লেখকের ছেলে আমি! আমি ‘বিদায় সত্যাগ্রহ’ লিখে বাপের ধারা বজায় রেখেছি। এবং ইংরেজ আছে বলে আজও আছি। আমাকেও যেতে হবে বৃটিশ ইম্পিরিয়ালিজমের সঙ্গে। বৃটিশ ইম্পিরিয়ালিজম যাবে। ইউরোপে সে জার্মানির হিটলারের দুই হাতে দুই গালে চড় খেয়ে হাত বুলিয়ে মিষ্টি কথায় বন্দীশালার ক্ষেপে যাওয়া জন্তুকে ‘মান যাও, মান যাও’ বলে মানাতে চাচ্ছে। কিন্তু যেতে তাকে হবেই। তার সঙ্গেই আমি যাব। তবু আমি ওই ছোট পোস্টার এঁকে ছেপে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ভবিষ্যৎ আমিই এঁকেছিলাম।

কিন্তু তাতে নাম আমায় ছিল না। তবে পুলিশ ঠিক বের করেছিল।

আর জানত শুধু প্রণবেশ্বরদা। যেদিন জানবাজারের বাড়ীতে বসে এই ছবিটা আঁকি, সেইদিনই প্রণবেশ্বরদা এসেছিল এই এলিয়ট রোডের বাড়ী সম্পর্কে কথা বলতে। পাশে বসেছিল। আমাকে বলে গিয়েছিল—কুইনিকে ওলাইজ করতে চাও তো টাকা কিছু ছাড়। পেটে ক্ষিদে মুখে লজ্জা করা কাজের কথা নয়।

আমি চিঠিখানা থেকে চোখ তুলে তাকালাম। যেন চোখের উপর ভাসছিল প্রণবেশ্বর দাদার ছবি। দেখছিলাম তাকে।

বললাম-বড়মা, এ-চিঠি লিখেছে প্রণবেশ্বরদা।

—হ্যাঁ।

দয়াল-ঠাকুরদা বললেন—না ভাই, এ হাতের লেখা আমি চিনি। এ-হাতের লেখা সুখেশ্বরের ছেলে কল্যাণেশ্বরের।

—তা হোক ঠাকুরদা, আমার এই পোস্টারের কথা অন্য কেউ জানে না—জানে শুধু প্রণবেশ্বরদা। সে দেখেছিল ছবিখানা আঁকতে।

বড়মা চুপ করে বসেছিলেন—ভাবছিলেন। হঠাৎ বললেন—তুই যজ্ঞেশ্বরের ঠিকানা জানিস? কাশীতে কোথায় থাকে সে?

আমি বললাম—কাশীতে তো থাকেন না জ্যাঠামশায়। ঠিকানা কাশীর আছে বটে। তবে থাকেন এখানে।

—এখানে মানে? কলকাতায়?

—না, কলকাতায় ঠিক নয়, থাকেন বরানগরে।

—বরানগরে?

—হ্যাঁ। সেদিন প্রণবেশ্বরদাদা বলে গেলেন। অনেকগুলো বড়ি-ওয়ারেন্ট ঝুলছে, তাই কাশীর ঠিকানাটা রেখে এখানে বরানগরে আছেন। তবে মাথার গোলমাল হয়ে গেছে।

—আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারিস?

—ঠিকানা আমাকে বলে গেছেন প্রণবেশ্বরদা। কারণ, টাকা জ্যেঠামশাই নিজে হাতে নেন। এলিয়ট রোডের বাড়ীর ওই মিউনিসিপ্যাল বিলের ভুলের দরুন যা পাবেন, তা নিজে হাতেই নেবেন। ছেলেদের দেবেন না।

সুরেশ্বর বললে—জ্যাঠামশাই যজ্ঞেশ্বর রায়কে বাল্যকালে দেখেছিলাম। তারপর দীর্ঘকাল বোধহয় বিশ-বাইশ বছর পর দেখলাম অন্নপূর্ণা-মায়ের তাগিদে। বিচিত্র যজ্ঞেশ্বর রায়। মহিমান্বিত রায়বংশের কফিনে পোরা মমি। বরানগরে গঙ্গার ধারে একখানা বড় ফাটলধরা বাড়ীতে থাকতেন তখন। বাড়ীখানা সত্যিই কফিনের মত, আর জ্যেঠামশাই রায়বংশের সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মমি। ইনসলভেন্ট, প্যারালিটিক, দিলদরিয়া লোক, জেদী, উদার, বদমেজাজী, অতিভদ্র, পরস্বাপহারী, দাতা—একসঙ্গে সব। ছ-ফুটের কাছাকাছি লম্বা মানুষটা খাট জুড়ে পড়েছিলেন।

ভাঙা ফাটল ধরা বাড়ী; সামনের প্রথম এবং প্রধান দরজা দু পাল্লার কব্জায় মরচে ধরেছে, ইস্কুপ খুলে গেছে, বন্ধ আছে ভিতর থেকে—কিন্তু দুটো প্লেট আঁটা আছে দু পাল্লায়; একটাতে লেখা আছে জেঠাইমার নাম, অন্যটায় লেখা আছে—’বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’।

বাড়ীখানা জেঠাইমার সম্পত্তি। তাঁর বাপের বাড়ীর দিক থেকে পেয়েছিলেন। বন্ধ থাকে জ্যেঠামশায়ের পাওনাদারদের ভয়ে। যেমন তেমন পাওনাদার নয়—দু-দশ বা দুশো পাঁচশো পাওনা নয়, ও হলো দু হাজার পাঁচ হাজার থেকে লাখ দু লাখ পর্যন্ত সুবিস্তৃত এবং পাওনাদারেরাও তেমনি—এ-ব্যাঙ্ক ও-ব্যাঙ্ক; এ-কোম্পানী ও-কোম্পানী; যাদের আসল পরিচয় হ’ল খ্যাতিমান মাড়বার রাজস্থানের শেঠেরা; আর এই ১৯৫৩ সালে যাঁরা বড় বড় ইংরেজ কোম্পানীর মালিকানি কিনেছেন—তাঁরা। জ্যাঠামশায় তাঁর জীবনে রায়বাড়ীর সমস্ত ইতিহাসটাকেই পুনরাবৃত্তি করেছেন। গড়েছেন ভেঙেছেন, আবার গড়েছেন আবার ভেঙেছেন। শেষ পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন।

রত্নেশ্বর রায়ের জীবন মাত্র রাহান্ন বছরের জীবন। বাহান্ন বছরে রায়বাড়ীকে নতুন ছাঁচে ঢেলে গড়ে গিয়েছিলেন; বীরেশ্বর রায়ের আমলে যে সম্পত্তির আয় ছিল কুড়ি হাজার টাকা, তাকে বাড়িয়ে তিনি তুলেছিলেন চল্লিশ হাজার এবং পনের বছর পরে তাকে পঁয়তাল্লিশ হাজারে তুলবার পাকা রাস্তার প্ল্যান তৈরী ক’রে জমি পর্যন্ত প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন।

তুমি রাজনৈতিক কর্মী সুলতা; তুমি নিশ্চয় জান ভারতেশ্বরী এবং ইংলন্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার আমল থেকে এ আইন প্রচলিত ছিল। পনের বছর অন্তর বৃদ্ধি পাবার হকদার ছিল জমিদারেরা। তার কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ফসলের দাম বাড়লেই জমিদার তার অংশ বাবদ খাজনা বাড়াতেন। সারাটা জীবনভোর তিনি এ কর্তব্য কর্ম ভোলেননি। এবং কোন সময়েই আপসে করেননি, আদালতে গিয়ে নালিশ করে লড়ে পাওনা আদায় করেছেন অথবা প্রজার সঙ্গে আদালত সাক্ষী রেখে সোলেনামা করেছেন। এ ছাড়া পতিত পুকুর কাটিয়েছেন। নদীর ধারের গ্রামে বন্যা নিবারণের জন্য বাঁধ তৈরী করিয়েছেন। সুতরাং জমির উন্নতি করেছেন বলেও খাজনা বৃদ্ধিতে তাঁর একটা দাবী ছিল। তিনটে এন্ট্রান্স স্কুল, দুটো চ্যারিটেবল ডিসপেনসারী করেছিলেন, মেয়েদের প্রাইমারি স্কুল তাও করে গেছেন দুটো। মাইনর ইস্কুল করেছেন আরও কয়েকটা। নিঃসন্দেহে কীর্তিমান পুরুষ। কীর্তিহাট থেকে তমলুক পর্যন্ত কাঁচা পথটা পাকা করেছিলেন; বহু দরিদ্রকে দান করেছেন; বহু বুদ্ধিমান ছেলেকে লেখাপড়া শিখতে বৃত্তি দিতেন। এই জানবাজারের বাড়ীতে ওই ওপাশের একতলা ঘরগুলোতে তারা থাকত; তাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা ছিল, তারা খেয়ে কলেজ যেত।

পত্নীব্রত পুরুষ। শ্রীমতী স্বর্ণলতা —যার নাম সরস্বতী বউ—তার মুখের দিক ছাড়া নাকি তিনি অন্য স্ত্রীলোকের মুখের দিকে তাকাতেন না।

একটু হেসে সুরেশ্বর বললে—সুলতা, অপবাদ রটনা সম্পর্কে মানুষের একটা দুর্নাম আছে। কিন্তু রায়বাহাদুরের ডায়রী পড়ে আমি বলতে পারি, শুধু অপবাদই নয়; প্রশংসাবাদ সম্পর্কেও মানুষ ঠিক তাই।

মানুষের মনই হ’ল ডিফেকটিভ থারমোমিটারের মত। অপবাদ প্রশংসাবাদের উত্তাপ আসলে যাই হোক ও একশো হলে একশো দুইয়ে গিয়ে পৌঁছবে। তবে এটা মানতে রাজী আছি যে, অপবাদ আসলে একশো হলে সেটা হয় একশো পাঁচ, আর প্রশংসাবাদ সেখানে আসলে একশো হলে একশো দুই-তিন-এর বেশী ঠেলে না। মানুষ প্রশংসাও করে নিন্দাও করে, তবে নিন্দা একটু বেশী করে।

রায়বাহাদুরের ডায়রীতে অঞ্জনার কথা যা আছে তা তোমাকে পড়ে শুনিয়েছি। এ ছাড়াও কখনও কখনও রায়বাহাদুরের ডায়রীতে গল্পের মত বিচিত্র ঘটনার কথা আছে। অনেকগুলোই মনে আছে—তার দু-একটা বললেই বুঝতে পারবে। হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের কামরায় দুটি সুন্দরী পার্শী মেয়েকে দেখে লিখেছেন—

“অদ্য কীর্তিহাট ফিরিতেছি। গত কয়েকদিন হইতেই রূপ চাক্ষুষ করিবার প্রবল আকাঙক্ষা হইতেছিল। সেদিন দত্তবাড়ীর ছেলের বিবাহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়া দুইজন অপরূপ সুন্দরী বাঈজীকে দেখিয়া অবধি ভাবিতেছিলাম, ইহাদিগকে কীর্তিহাটে রাজ-রাজেশ্বরের কোন পর্ব উপলক্ষ্যে বায়না করিয়া লইয়া যাইব। তাহা হইলে চক্ষুর তৃষ্ণা মিটাইয়া তাহাদের দেখিবার সুযোগ পাইব। দত্তবাড়ীর বিবাহের নাচ-গানের আসরে রত্নেশ্বর রায় বসিয়া বসিয়া অবশ্যই এই বাঈজীদের রূপ দেখিতে পারেন না। তাহাতে শত্রুজনে অপযশ ঘোষণার প্রশ্রয় পাইবে। এবং মনের মধ্যে যে প্রবৃত্তির বিষবৃক্ষ আছে, তাহার তলদেশে জল সিঞ্চন করা হইবে। কিন্তু কীর্তিহাটে সম্মুখে রাজরাজেশ্বর জিউ প্রভুকে রাখিয়া তাহাদের দেখিলে রূপের তৃষ্ণা মিটিবে কিন্তু তাহাতে পাপ স্পর্শিতে পারিবে না। এবং কেহ কোন নিন্দার কথাও বলিতে পারিবে না। আমার জীবনের প্রতিজ্ঞাও ভঙ্গ হইবে না। কিন্তু অদ্য হাওড়া স্টেশনে এই পার্শী মহিলা দুটিকে দেখিয়া আমার ভ্রম ভঙ্গ হইল। কি অপরূপ রূপসী এই মেয়ে দুইটি। ইহাদিগকে যুগল তিলোত্তমা বলা চলে। ইহাদের কাছে সেই বাঈজী দুইটি অনেক মলিন। আকাশের চন্দ্রমা এবং পঙ্কপম্বলে তাহার প্রতিবিম্ব এই দুইয়ে যত তফাৎ তত তফাৎ। চক্ষু জুড়াইয়া গেল। হৃদয় ভরিয়া গেল। ঈশ্বরের রূপসৃষ্টির আর শেষ নাই তাহা অনায়াসে এক মুহূর্তে বুঝিতে পারিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিতে পারিলাম তিনিই বুঝাইয়া দিতেছেন যে, রূপ খুঁজিয়ো না, তাহা হইলে আর সারা জীবনে বিশ্রাম পাইবে না, রূপের পর রূপ আসিয়া তোমাকে হাতছানি দিয়া মরীচিকা যেমন করিয়া তৃষ্ণার্ত হরিণ ছুটাইয়া লইয়া চলে মরুভূমির উত্তাপের মধ্যে, তেমনি করিয়া ছুটাইয়া চলিবে এবং একদা মৃত্যু-মূর্তিতে আবির্ভূত হইয়া তোমাকে সংহার করিবে। সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অপার করুণাও উপলব্ধি করিলাম, তিনি আমার প্রার্থনা যেন স্বকর্ণে শুনিয়া আজ এইভাবে ট্রেনের কামরায় এই রূপসী মেয়ে দুইটিকে দেখাইয়া দিলেন।”

এমন ঘটনা রায়বাহাদুরের জীবনে অজস্র ঘটেছে। তিনি অকপটে ঘটনাগুলি লিখে গেছেন। কীর্তিহাটের বাড়ীতে যুবতী শ্রীমতী মেয়ে-ঝি রাখা তিনি বন্ধ করে একটা নিয়ম করেছিলেন।

করেছিলেন অঞ্জনার ঘটনার পর থেকে। রায়বাহাদুরের স্ত্রী সরস্বতী বউ স্বামীগরবিনী এবং আদরিণী ছিলেন, সে গরব সে আদর পরিমাণে এত বেশী যে, তিনি এগুলো গ্রাহ্যই করতেন না। তাঁর কাছে যে ঝি থাকবে সে কুদর্শনা হবে এ তিনি পছন্দ করতে পারতেন না। ঝগড়া করতেন স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তিনি পেরে ওঠেননি। রত্নেশ্বর রায় তাঁকে তাড়িয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। সরস্বতী বউ আবার আনতেন রূপসী যুবতী ঝি এবং তাকে স্বামীর চোখের সামনে যেতে দিতেন না। এবং হেসে স্বামীকে বলতেন—কি বাতিক মা? শেষে আমায় না তাড়াও! ভিতরের তত্ত্বটা তিনি বুঝতেন না।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের বড় নাতি আমার জ্যাঠামশায় যজ্ঞেশ্বর রায় ঠিক তেমনি মানুষ! পিতামহের মতই পত্নীব্রত ছিলেন। তফাৎ রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় কীর্তিতে কীর্তিমান, আর নাতি যজ্ঞেশ্বর রায় ভ্রষ্টকীর্তি। রায়বাহাদুর সম্পত্তিকে বাড়িয়ে গেছেন, বাপের আমলের আয়কে চারগুণ করেছেন—আর নাতি যজ্ঞেশ্বর রায় দশের বাঁদিকের একটাকেই মুছে দিয়েছেন। অবশেষে স্ত্রীর পিতৃদত্ত বরানগরের এই পুরনো বাড়ীটায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *