৯
পুজোর ঘরে ঢুকবার আগে চাকর মহিন্দরকে ডেকে বলেছিলেন–বাবু উঠলেই আমাকে ইশারায় জানিয়ো। দেওয়ানজী কাছারীতে এলেই তাঁকে খবর দিয়ো কোন কাজ যেন আমার সঙ্গে দেখা না করে না করেন। রত্ন হয়তো উঠে থাকবে, তাকে বলো আমার আশীর্বাদ না নিয়ে যেন বাইরে না বের হয়। কোন হুকুম না দেয়। সে যেন কলকাতার জ্যেঠামশাই আর তাঁর ভায়রাভাইয়ের দেখাশোনা করে। অঞ্জনা, তোমার উপর ভার রইল জগদ্ধাত্রী দিদির আর ওঁর বোনের।
গতরাত্রে এরই মধ্যে বীরেশ্বরবাবুর খুড়তুতো দাদা দেবপ্রসাদ এসেছেন, জগদ্ধাত্রী বউ এসেছেন, সঙ্গে এসেছেন সস্ত্রীক স-পুত্রকন্যা তাঁর ভায়রাভাই, মেদিনীপুর সদরের এস-ডি-ও রাধারমণবাবু।
তাঁরা ওদিকের মহলের দোতলায় আছেন। লোকজন চাকর দাসী সবই সেখানে মোতায়েন আছে, তবুও নিজেরা দেখাশোনা না করলে আতিথ্যে ত্রুটি হবে।
বীরেশ্বর, রত্নেশ্বর, দেওয়ান আচার্য-কারুর সাহায্যেরই কিন্তু ভবানীর প্রযোজন হয় নি। কার্যোদ্ধার তিনি নিজেই করেছিলেন। স্বামী পুত্র কাউকে একটি কথাও বলতে দেন নি।
তিনি পুজোর আসনে বসে অন্তরের সঙ্গে ডেকে দেবতাকে বলেছিলেন—গোপালকে তুমি রক্ষা কর মা। ওই মেয়েটির কাছে আমার মুখ রক্ষা কর।
তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। স্তবের সঙ্গে প্রার্থনা শেষ করে তিনি প্রণাম সেরে চোখ খুলেই দেখেছিলেন জগদ্ধাত্রী দেবীকে। জগদ্ধাত্রী তাঁর সম্পর্কে বড় হলেও তাঁর সখী, বয়সে তিনিই বছর দুয়ের বড়।
জগদ্ধাত্রী দেবী কখন এসে তাঁর পুজোর আসনের খানিকটা দূরে বসেছিলেন। চোখাচোখি হতেই জগদ্ধাত্রী বলেছিলেন—তোর পুজো করা সার্থক! কতক্ষণ বসে আছি। খেয়াল নেই। চোখ থেকে জলের ধারা আর থামে না!
ভবানী হেসে চোখ মুছে বললেন না ভাই, সাড়া ঠিক পাই নি।
—এমনি করে রোজ কাঁদিস?
—কাঁদি। কোন কোন দিন মনের দুঃখ জানাই আর কাঁদি!
—মনের আবার দুঃখ কি তোর এখন?
—সংসারটাই দুঃখে ভরা ভাই। আর নিজের দুঃখই কি সব?
—তা বটে।
—সুরবালা উঠেছে? রাত্রে কোন অসুবিধে হয়নি?
—অসুবিধে? বাপরে! মুখের কথা না খসাতে পাঁচটা লোক ছুটে আসছে। তা ছাড়া ওই অঞ্জনা মেয়েটি। একেবারে হাজির হয়ে আছে। সুরো উঠেছে, সে মেয়েকে নিয়ে এসেছিল, তোর ধ্যান দেখে চলে গেল। আমাকে রেখে গেল।
ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভবানী দেবী। বললেন—আমি যাচ্ছি। পুজোর কাপড় ছেড়ে, পুজোর হাত রত্নেশ্বরের মাথায় দিয়ে, ওঁর গায়ে বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছি আমি।
—না। তোর সঙ্গে কথা এখানেই বলবে সুরবালা। তুই পুজোর আসনে বসে থাকবি, ও বলবে!
—কেন? কি ব্যাপার? দোহাই তোর, আমি ভাই সিদ্ধ-টিদ্ধ নই। কি ফ্যাসাদ মা।
তারপরই একটা কথা মনে ক’রে এক নিঃশ্বাসেই বললেন—তা ছাড়া ওঁর কর্তা তো শুনেছি সাহেবী মেজাজের মানুষ, বাড়ীতে সাহেবী কেতা; সুরবালাও তো মেমসাহেব হয়ে উঠেছিল শুনেছি, ওঁদের এসব বাতিক কেন?
হেসে জগদ্ধাত্রী বললেন-সে-সব উল্টে গেছে। এখন মাদুলী-কবচ পরে। মাঝখানে রাধারমণের ঝগড়া লেগেছিল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে, দারুণ ঝগড়া। চাকরি যায় যায়। হঠাৎ কার পরামর্শে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীকে দিয়ে যাগযজ্ঞি করিয়ে খুব ফল হয়েছে। সাহেবটা ঘোড়া থেকে পড়ে খোঁড়া হয়ে বিলেত চলে গেল; রাধারমণের চাকরি যাওয়া দূরের কথা, উন্নতি হল, বাঁকড়ো ছোট জেলা, সেখান থেকে মেদিনীপুরে এস-ডি-ও হয়ে এল। লালমুখের পোস্ট এটা, বাঙালীকে দেয় না; তা ওকেই দিলে। এখন ভক্তি-টক্তি খুব। তার ওপর মেয়ে বড় হয়েছে; তেরো পার হতে চলেছে। সাহেবী মেজাজ নামের জন্যে ভাল বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে না। মুখ টিপে হাসলেন জগদ্ধাত্রী দেবী। বললেন-তা না হলে নিজে যেচে চিঠি লিখে আমাদের সঙ্গে ক’রে তোর বাড়ী এসেছে!
ভবানী স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আভাস তিনি পেয়েছেন।—মেয়ের বিয়ে?
প্রশ্নটা করবার আগেই জগদ্ধাত্রী দেবী মৃদুস্বরে বললেন—ওই এসেছে ওরা! অঞ্জনার সঙ্গে বাড়ী ঘুরে, ছাদে উঠে গ্রামটা দেখে এল। জানবাজারের বাড়ী দেখেছে একদিন।
তারপরই উচ্চকণ্ঠে বললেন—আয় সুরো আয়। আমি বসিয়ে রেখেছি।
ভবানী দেবী ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। এবং দেখলেন বারান্দায় দরজায় ঠিক মুখেই অঞ্জনা এবং তার পিছনে সুরবালা ও তাঁর বড় মেয়ে স্বর্ণলতা ঘরে ঢুকছে। হেসে ভবানী বললেন—আসুন!
অঞ্জনা তাড়াতাড়ি একখানা গালিচা এনে বললে—মামিমা, আপনি মেঝেতে বসেছেন! উঠুন উঠুন। গালিচাখানা পেতে দি!
সুরবালা সরাসরি বললেন—আমার স্বর্ণকে এনেছি আপনার কাছে। ওকে এই আপনার পুজোর আসনের সামনে আপনার হাতে দিতে এসেছি। ওকে আপনাকে নিতে হবে। বলুন, পুজোর আসনে বসে বলুন নিলেন!
মেয়েটি সুন্দরী, কিন্তু রূপ যেন একটু উগ্র। রঙ উগ্র, চোখের দৃষ্টি একটু খটখটে, হয়তো মেজাজ একটু উগ্র হবে। মেয়েটি একটু ডাগরই হয়েছে। তাঁর মনে পড়ল রত্নেশ্বরকে
রত্নেশ্বরও সেদিক থেকে বিয়ের বয়স পার হয়-হয় বয়সে পৌঁচেছে। কুড়ি বছরে পা দেবে। রত্নেশ্বরের বিয়ের কথা এতদিন বিমলাকান্ত বলেন নি, বীরেশ্বর বলেন নি, বলেন নি ঠিক এই দিনটির জন্যে। এ দিনটি না পার হলে বিবাহের আসরে হয় অধর্ম ক’রে মিথ্যা বলতে হত, না হয় রায়বাড়ির গুপ্তকথা প্রকাশ পেত।
বিবাহের সম্প্রদানের আসরে বলতে হবে-ভরদ্বাজ অঙ্গিরস—বার্হস্পত্য প্রবরস্য-কুড়ারাম দেবশর্মণঃ প্রপৌত্রং—সোমেশ্বর দেবশর্মণঃ পৌত্রং—বীরেশ্বর দেবশর্মণঃ পুত্রম্। কিন্তু তা বলবার উপায় ছিল না। রত্নেশ্বর এতদিন বিমলাকান্তের পুত্র বলে পরিচিত ছিল! সত্য বললে রায়বংশের যে কথা—যে মর্মান্তিক সত্য-নবদ্বীপে শ্যামাকান্তের কবরের নিচে চাপা পড়েছে-তা প্রকাশ হয়ে পড়ত!
রত্নেশ্বরের সঙ্গে ভালই মানাবে।
সুরবালা বলেছিলেন—মেয়ে আমার অসুন্দর নয় ভাই। তাছাড়া আপনার রত্নেশ্বর শুনেছি ভাল লেখাপড়া করেছে। কাল রাত্রে উনি তো কথাবার্তা বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লেখাপড়া খুব ভালবাসে। আমার মেয়েকেও লেখাপড়া শিখিয়েছি। বাংলা তো ভালই জানে। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা মুখস্থ। ইংরিজীও বেশ ভাল জানে—উনি শিখিয়েছেন। ফার্স্ট বুক সেকেন্ড বুক একেবারে মুখস্থ। ইস্কুলে দেবার জন্যে উঠন্দি, তা আমি দিতে দিই নি। তা হ’লে আর ব্রাহ্ম না হয়ে উপায় থাকত না।
ভবানী ভাবছিলেন। মনের মধ্যে রত্নেশ্বর, তারপর বীরেশ্বর, তারপর মনে হল রাধারমণবাবু এস-ডি-ও; তার পরেই চকিতে মনে পড়ে গেল অবগুণ্ঠনাবৃতা একটি মেয়ে, তারপর মনে পড়ল গোপাল সিংয়ের নাম। আবার মনে পড়ল রাধারমণবাবু এস-ডি-ও!
সুরবালা বলেছিলেন-আমরা অবিশ্যি চাকরে। আপনারা মস্ত জমিদার। রাজা লোক। তবু এ বিয়েতে অগৌরব হবে না আপনাদের!
ভবানী বলেছিলেন—আমি ভাই পণ নেব!
—দেব। আমাদের সাধ্যমত দেব। বলুন কি নেবেন?
—মেয়ে-জামাইকে কি দেবেন সে আপনারা জানেন। যা দেবেন তাই অনেক। তবে আমি মা, আমাকে পণ দিতে হবে!
—বেশ তো! বলুন। হুকুম করুন!
—সে ভাই, মেয়ের বাপকে বলব। পণ নেব আমি তাঁর কাছে।
***
সুরেশ্বর বললে-ভবানী দেবী তাঁর ভাবী বৈবাহিকের কাছে পণ নিয়েছিলেন—গোপাল সিংয়ের মামলা থেকে মুক্তি! তিনি বলেছিলেন—ওর স্ত্রীকে আমি কথা দিয়েছি। গোপালকে বাঁচাতে যা করবার করব।
রাধারমণবাবু অভিভূত হয়েছিলেন ভবানী দেবীর করুণা দেখে। তিনি বলেছিলেন—লোকটা পাষণ্ড, অতি দুর্দান্ত, সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর লোক। এবার নিজের ফাঁদে নিজে পড়ে গেছে। এসব লোকের সাজা হওয়াই উচিত। তবু আপনি যখন বলছেন তখন আমার থেকে যতটুকু হয় করব আমি। আসল হাত আপনাদের। আপনারা যদি, মানে বীরেশ্বরবাবু যদি, বীরপুরের লোকেদের সামলান, তারা যদি সাক্ষী না দেয়, তা হলে খালাস পেয়ে যাবে! আমি বলব যাকে যা বলবার, মানে তদন্তের সময় তারা যাতে চোখ বুজে তদন্ত ক’রে যায়, তা বলব।
ভবানী বলেছিলেন—ওঁকে আমি বলেছি।
.
সে এর আগেই হয়ে গেছে। বীরেশ্বর রায়ও ভবানীর কথায় গোপালকে ক্ষমা করেছিলেন। রাধারমণবাবুর সঙ্গে একথা হবার আগেই তিনি স্বামীর কাছে একথা বলে মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন—সতীবউ, তোমাকে অদেয় আমার কিছু নেই! তাই হবে। দিলাম!
ভবানী তাঁর পায়ের উপর মাথা রেখে প্রণাম করতে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন তাঁর পায়ের উপর।
বীরেশ্বর সমাদর করে তাঁর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওঠ, কেঁদো না। তুমি করুণাময়ী। তবে একটা কথা আছে।
মাথা তুলে বসেছিলেন ভবানী দেবী।
বীরেশ্বর বলেছিলেন-তার স্ত্রীকে বল, শর্ত হল গোপাল সিংকে আসতে হবে। হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইতে হবে! অন্যায় বলছি?
ভবানী বলেছিলেন—না। অন্যায় বলনি। তা করতে হবে বইকি! মামলা-মকদ্দমা এ সবই তাকে মেটাতে হবে। নিশ্চয় হবে। কিন্তু তুমি রত্নেশ্বরকে বল! সে হয়তো কথা শুনতে চাইবে না!
—তোমার কথা শুনতে চাইবে না?
—তুমি বুঝতে পারো না?
একটু চুপ করে থেকে বীরেশ্বর বলেছিলেন—তা পারি! রত্নেশ্বর আমার থেকেও জেদী। আমার চেয়ে সে শক্তিতেও বড়। আচ্ছা, তাকে বলব আমি।
ভবানী বলেছিলেন—আমি যাই, তোমার কাছে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।
—একটু বস। তুমি বড় দূরে দূরে থাকো। এতকাল পর ফিরে এসেও কাছে এলে না। ব্রত করেছিলে, তা শেষ হয়েও শেষ হল না। ব্রতধর্ম নিয়েই থেকে গেলে।
ভবানী তাঁর কাছে একটু সরে বসে বলেছিলেন—রত্নেশ্বরের বিয়ে হোক, তাকে সব ভার দিয়ে চল আমরা তীর্থ বেড়িয়ে আসি।
—খুব ভাল বলেছ। খুব ভাল বলেছ। এখন সুবিধাও হল, রেলগাড়ী হয়ে গেল। পথের কষ্ট নেই। তাই যাব! শুধু তীর্থ নয়, আগ্রা লক্ষ্ণৌ দিল্লী এসবও দেখে আসব। আগ্রায় তাজমহল দেখব। তুমি তাজমহল দেখো, আমি তোমাকে দেখব!
হঠাৎ একটা শব্দে তাঁদের বাক্যালাপে ছেদ পড়েছিল। দরজার ওপাশে রাস্তাঘরের মেঝের উপর একটা কিছু যেন পড়ে গিয়ে শব্দ হয়েছিল।
বীরেশ্বর রায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কে?
ভয়ার্ত ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর এসেছিল—আমি! অঞ্জনা!
ভবানী দেবী বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। অঞ্জনার শ্যামবর্ণ মুখও ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, সে একখানি পরাতের উপর বীরেশ্বর রায়ের প্রাতরাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। পরাত থেকে জলের গ্লাসটা কি করে মেঝের উপর পড়ে গেছে। সে পরাতখানা নামাতেও পারছে না, জলের গ্লাসটা নিয়ে কি করবে তাও বুঝতে পারছে না।
ভবানী দেবী বলেছিলেন- পড়ে গেল গ্লাসটা? কি ছিল ওতে?
—জল! কোনরকমে উত্তর দিয়েছিল অঞ্জনা।
—তা যাক। ওটা তুমি আমাকে দাও, দিয়ে—যাও নতুন গ্লাসে জল নিয়ে এস। না, মহেন্দ্ৰকে দিয়ে জল পাঠিয়ে দিয়ো। তুমি বরং রত্নেশ্বরকে গিয়ে বল, সে যেন এখুনি এ-ঘরে আসে। একটু পর। ওঁর খাওয়াটা হয়ে যাক। বুঝেছ!
ঘাড় নেড়ে—হ্যাঁ—জানিয়ে চলে আসতে পেরে বেঁচে গিয়েছিল। সে খাবারের পরাত নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল, কর্তা-গিন্নীর কথার সাড়া পেয়ে। ভাবছিল সাড়া দিয়ে ঢুকবে কিনা; এই মুহূর্তেই কানে এসেছিল বীরেশ্বরের গাঢ়স্বর এবং সেই গাঢ়স্বরের ওই গাঢ় কথা কটি—একটু বসো। তুমি বড় দুরে দূরে থাক। কতকাল পর ফিরে এসেও কাছে এলে না।
রত্নেশ্বরের সমবয়সী অঞ্জনা, রত্নেশ্বর থেকে কয়েকদিনের বড়। সেদিন বলেছিল—সাতদিনের বড়। কিন্তু না, ঠিক হিসেবে আটদিনের বড়। সে হিসেবটা হয়েছিল রত্নেশ্বরের জন্মদিন ধ’রে নয়, বিমলার মৃত সন্তানের জন্মদিন ধরে। বয়স তার উনিশ পার হচ্ছে। তার উপর সন্তান হয়নি। এবং বিচিত্র চরিত্র, দারিদ্র্য এবং বাউন্ডুলে স্বামীর উপেক্ষার মধ্যেও কৌতুক আর পরের ঘরের আনন্দ উল্লাসের ভাগ নিয়ে সে শুধু বেঁচেই নেই, সংসারে বিচরণ করে বেড়ায় চঞ্চল পদক্ষেপে। দশের সম্মুখে কোনরকমে পদক্ষেপের সে চাঞ্চল্য সংযত হয়, কিন্তু একা হলে আর রক্ষে থাকে না। সেদিন সেই মুহূর্তে ওই ভেজানো দরজার এপাশে একলা ওই রাস্তাঘরটিতে দাঁড়িয়ে কর্তা ও গৃহিণীর এই গাঢ় কথাবার্তা শুনে তার অন্তরের কৌতুক-সরসতা উছলে উঠেছিল। সে নীরবে দাঁড়িয়ে আড়িপাতার মত শুনতে আরম্ভ করেছিল তাঁদের কথাগুলি। তন্ময় হয়ে শুনছিল। যখন বীরেশ্বর বলেছিলেন—তাজমহল দেখতে যাব, সেখানে তুমি দেখবে তাজমহল আর আমি তাকিয়ে থাকব তোমার মুখের দিকে। তখন তার কৌতুক- সরসতা প্রমত্ত হয়ে উঠেছিল দমকা বাতাসের মত। হাসি চাপতে গিয়ে মুখে কাপড় চাপা দেবার জন্য হাত খোলা পায় নি; ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের কাপড়ে মুখ গুঁজতে গিয়ে নড়ে উঠেছিল হাতে ধরা পরাতখানা এবং গ্লাসটা গিয়েছিল সশব্দে মেঝের উপর পড়ে। লজ্জার এবং ভয়ের আর অন্ত ছিল না।
বড়লোকের বাড়িতে আগন্তুক দরিদ্র আত্মীয়দের অবস্থা বড় নিদারুণ। চাকরদের চেয়েও মর্মান্তিক। তার উপর সদ্য একদিন আগে তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ভবানী দেবী তাকে নিজের কাছে রেখেছেন, তার সব ভার নিয়েছেন, বাউন্ডুলে স্বামীকেও চাকরি দেবেন বলেছেন। চোখের উপর এ বাড়ীর ঐশ্বর্যের পরিপূর্ণ খেলা দেখেছে। গোপাল সিং-এর খবরের মধ্যে এদের বিক্রম দেখেছে, বীরেশ্বর রায়ের গাম্ভীর্য দেখেছে, ফলে একটা নিদারুণ ভয়ও তার অজ্ঞাতসারে মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত ছায়ার মত জমে উঠেছে। সেটা তাকে হাঁ করে গিলতে এসেছিল সেই মুহূর্তে। কেঁপে উঠে সে কোনরকমে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল; ঠেসটা না পেলে হয়তো পড়ে যেত।
ভবানী দেবী এসে তাকে তিরস্কার করলেন না, তাকে অব্যাহতি দিয়ে বললেন—মহেন্দ্ৰকে দিয়ে জল পাঠিয়ে দাও। আর তুমি রত্নেশ্বরকে বল, সে যেন কর্তার সঙ্গে এখুনি দেখা করে।
সে বাঁচল। বেঁচে গেল। রাস্তা-ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দাটা হাল্কা পায়ে পার হয়ে ডানদিকে আর একটা রাস্তা-ঘরে বেঁকে সে খানিকটা ছুটে নিল আনন্দে এবং কৌতুকে। কিন্তু আবার থমকে গিয়েছিল রত্নেশ্বরের সামনে এসে। রত্নেশ্বরকেও তার ভয় হয়ে গেছে ওই বীরেশ্বর রায়ের মতই। তারই বয়সী, তার থেকে সাতদিনের ছোট এই আত্মীয়টি শুধু লম্বায় চওড়াতেই নয়, চোখের চাউনিতে, কথায়-বার্তায়, তার থেকে ওজনে অনেক ভারী। নিজেকে সংযত করেই সে ঘরে ঢুকেছিল।
কিন্তু রত্নেশ্বর তাকে আশ্চর্য হাল্কা এবং প্রসন্ন মেজাজে স্নেহসরস কণ্ঠে বলেছিলেন—কি সংবাদ?
রত্নেশ্বরও বিবাহের কথার সংবাদটা শুনেছেন। তাঁর মেজাজে তখন দোলা লেগেছে। তিনি প্রসন্ন মনেই ছিলেন এবং অঞ্জনার মতোই কাউকে খুঁজছিলেন যার কাছে তিনি অসংকোচে সংবাদটা সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি বাইরে বের হবার জন্যে পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। এবং এই কথাই ভাবছিলেন।
চাকরদের কাছে এ সংবাদ অসঙ্কোচে সংগ্রহ করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে বোন বউদি অথবা ঠাকুমা-দিদিমারাই গুপ্তচরের কাজ করবার যোগ্য পাত্রী। কিন্তু তেমন কেউ ছিল না। তাই অঞ্জনাকে দেখে তিনি তার মধ্যেই সেই প্রত্যাশিত জনটিকে পেয়ে উল্লসিত কণ্ঠে—
সুরেশ্বর বললে—তাই বা কেন সুলতা, উচ্ছ্বসিত উল্লাসের সঙ্গেই আহ্বান এবং প্রশ্ন করেছিলেন—কী সংবাদ?
পৃথিবীতে এমন কতগুলো জায়গা আছে, যে জায়গাগুলোতে ধ্বনির প্রতিধ্বনি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে সাড়া দেয়। অনেক খিলেনওয়ালা বাড়ীতে একটা ‘কে’ শব্দ বললে প্রতিধ্বনিটা সাতটা-আটটা ‘কে’ পরপর স্পষ্ট হয়ে বেজে বেজে যায়। অঞ্জনার প্রকৃতি, চরিত্র ঠিক এমনি ধরনের। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া বাজে। রত্নেশ্বর রায়ের এই হাল্কা মেজাজের সুপ্রসন্ন ওই ‘কী সংবাদ’ প্রশ্নটির প্রতিধ্বনি মুহূর্তে উত্তর হয়ে বেরিয়ে এসেছিল তার মুখ থেকে। তার নেভানো কৌতুকসরস চিত্তদীপটি দপ করে জ্বলে উঠেছিল। সে বলেছিল-সংবাদ, সুসংবাদ! মিষ্টি খাওয়ান।
—মিষ্টি? তা খাওয়াব। কিন্তু সংবাদটা আগে বল!
—আপনার বিয়ে।
—বিয়ে!
—হ্যাঁ। কনে তো দেখা দিতে এসেছে!
—শুনেছি।
—দেখেছেনও!
—দূর থেকে।
কৌতুকময়ী মেয়েটি মুহূর্তে রঙ্গময়ী হয়ে উঠে চুপিচুপি বলেছিল—কাছ থেকে দেখতে চান নাকি?
—উঁ? কাছ থেকে দেখা? না—। এতটা থাক। কিন্তু তোমাকে খুঁজছিলাম।
—কেন?
—মেয়েটি মানুষ কেমন যাচাই করে বলতে পারো?
—পারি! কি যাচাই করতে হবে বলুন!
—এখন হবে না। বলব তোমাকে। বুঝেছ। আমি এখন একটু বেরুব। সরকারী হাকিমরা আসবেন। বিবি-মহলে যাব। পরে দুপুরবেলা একটু অবসর ক’রে এস।
—আসব। কিন্তু এখন বাইরে যাবেন না। কর্তাগিন্নী ডাকছেন আপনাকে। বসে আছেন।
—বাবা-মা দুজনে ডাকছেন? কেন?
—তা জানিনে। আসুন এখন। এমনিতেই কথায় দেরী হয়ে গিয়েছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার বিয়ের আনন্দে!
—আমার বিয়ের কথায় তোমার এত আনন্দ?
—হবে না! কত ধুমধাম হবে! কিন্তু আসুন।
পথে যেতে যেতে অঞ্জনা বলেছিল—বাবাঃ, যে বিপদ হয়েছিল–।
—কী বিপদ?
—সে সেই দুপুরবেলা বলব!
.
বাপ-মায়ের ঘরের সামনে এসে সাড়া দিয়ে ঘরে ঢুকলেন রত্নেশ্বর।—মা।
উত্তর দিলেন বীরেশ্বর।—এস।
তাঁর পোশাকপরিচ্ছদ দেখে বললেন—বেরুচ্ছ কোথাও?
—হ্যাঁ, বিবিমহলে যাব।
—হ্যাঁ, দেখে এস। সমস্ত বন্দোবস্ত নিজে দেখা উচিত। রাজকর্মচারীরা আসবেন। এঁরা হলেন সাপ, গোখরো সাপ, বাঁশী বাজিয়ে যতক্ষণ মনোরঞ্জন করে রাখতে পারবে ততক্ষণ বেশ তালে তালে দুলে দুলে নেচে যাবেন। যেমনি তাল কাটবে কি তার প্রতি একটু অন্যমনস্ক হবে, অমনি ছোবল দেবে। চাণক্যের শ্লোকেই আছে—রাজকুলকে বিশ্বাস করো না। অবশ্য এবার রাধারমণবাবু রয়েছেন বাড়ীতে, তিনি আত্মীয় হয়ে এসেছেন, আত্মীয় হতেও চাচ্ছেন। তাঁর জন্য অনেকটা ঘরোয়া ব্যাপার হবে। তবু দেখে এস। নিন্দারই বা কিছু থাকবে কেন। যাবার সময় বিবিমহল হয়ে যাও, ওঁদের সঙ্গে দেখা করে কুশল-বার্তা জিজ্ঞাসা করে যাবে। দেবপ্রসাদ দাদা আছেন, জ্যেঠাইমা আছেন, ওঁদের প্রণাম যেমন করবে, তেমনি রাধারমণবাবু এবং তাঁর স্ত্রীকেও প্রণাম করবে।
—যে আজ্ঞে। ওঁদের কাছ হয়েই যাচ্ছি।
—বসো, আর একটা কথা আছে। তোমার জননী একটি কঠিন ভিক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একজনকে। ভোরবেলা মঙ্গল আরতির সময় একজন স্ত্রীলোক প্রার্থী তাঁর পায়ে ধরে ভিক্ষা চেয়েছেন—উনি মায়ের সামনে দেবো বলেছেন।
রত্নেশ্বর ভুল বুঝলেন। তিনি ভাবলেন, ভোরবেলা সম্ভবত রাধারমণবাবুর স্ত্রী বিয়ের কথা তুলে ভবানী দেবীর কথা আদায় করেছেন। সেই কথা বলছেন বাবা। তিনি হেসে বললেন—কথা দিয়েছেন মা, তখন কথা কি আছে। দিতে হবে!
ভবানী দেবী এবার কথা বললেন—গোপাল সিংয়ের স্ত্রী এসে হাত জোড় করে আমাকে বললে—আমার স্বামীকে বাঁচাও মা! এ এক তুমি পারো। আমি তাকে কথা দিয়েছি রত্ন। মেয়েটি বলছে-গোপালের ফাঁসি হয়ে যাবে। তার বড় ছেলে মারা গেছে, বাঁচেনি। বড়-স্ত্রী মর-মর। গাঁয়ের লোক ক্ষেপে গিয়েছে গোপালের উপর। পুলিশ এসেছে, তাকে খুঁজছে। সে ফেরার।
বীরেশ্বর রায় বললেন—আমাকে উনি বলতেই আমিও তুমি যা বললে তাই-ই বলেছি, তবে শর্ত রেখেছি, গোপালকে এসে ক্ষমা চাইতে হবে প্রকাশ্য কাছারীতে। মণ্ডলান দাবী নিজে থেকে নাকচ করতে হবে। তা ছাড়া যেখানে যা জবরদখল করে রেখেছে সব ছাড়তে হবে। মুখ নিচু করে রত্নেশ্বর শুনে যাচ্ছিলেন কথাগুলি। ক্ষণে-ক্ষণে তাঁর কপাল কুঁচকে উঠছিল। গোপাল সিংকে ক্ষমা করার কথা তিনি ভাবতে পারেন না। রাগ হচ্ছিল তাঁর মায়ের উপর! ক্ষমা করবেন তিনি গোপালকে? গোপাল তাঁর সম্পর্কে যা বলেছিল, তা তো তিনি না-জানা নন। গোপাল তাঁকে ঘর বন্ধ করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। তাকে বাঁচাতে হবে? এ কি সত্য যুগ না ত্রেতা যুগ না দ্বাপর যুগ? শিবি রাজা আশ্রিত পায়রাকে বাঁচাবার জন্যে নিজের গায়ের মাংস কেটে দিয়েছিলেন বাজপাখীকে। জীমূতবাহন নাগকে রক্ষা করতে গরুড়ের আহার হতে গিয়েছিলেন। বশিষ্ঠ ক্ষমা করেছিলেন পুত্রঘাতী বিশ্বামিত্রকে। এটা কলি যুগ!
ভবানী ছেলেকে নীরব দেখে বলেছিলেন—কি, তুই চুপ করে রইলি যে?
—কী বলব? তুমি কথা দিয়েছ, বাবা তাই মেনে নিয়েছেন, এর ওপর আমি আর কী বলব? তবে—
—কি?
—তবে এতে আমাদের করবার কি আছে? আমরা বাঁচাবো বললেই তো বাঁচানো যাবে না। এ তো এখন কোর্টের হাতে। এ তো খুনের মামলা দাঁড়াবে! বাদী তো আমরা নই।
বীরেশ্বর বলেছিলেন—তা নই। কিন্তু কেসের সাক্ষীর মালিক আমরা। বীরপুরের সাক্ষী বীরপুরের প্রজারা। আমরা যা বলাব, তাই তারা বলবে। তাছাড়া সরকারী মহলকেও আমরা একটু-আধটু বলে কয়েও দিতে পারব বই কি! ব্যাপারটা তোমাকে নিয়েই জটিল হয়েছে বেশী। তোমাকে সে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল—
—যদি তাই হ’ত, তা হ’লে কি গোপালকে বাঁচাবার কথা বলতে পারতেন! মা একথা দিতে পারতেন?
—না। তা পারতাম না। কিন্তু তা যখন হয় নি রত্ন, তখন ক্রোধ তোমার সম্বরণ করাই উচিত।
ভবানী বলে উঠলেন-ওরে তোর—তোর বাপের এতে কল্যাণই হবে। বুঝলি, দুহাত তুলে আশীর্বাদ করবে। বল তো কি কাণ্ড হল? লোকটা নিজের ছেলেকে খুন করে বসল-তোদের ওপর রাগে। তা ছাড়া রত্ন, তুই ফিরে এলি আপনার অধিকারে। তোর বিয়ে দেব। তুই সংসারী হয়ে জীবন আরম্ভ করবি। আজ দয়াধর্ম করে আশীর্বাদ কুড়িয়ে নে বাবা। লোকে ধন্য ধন্য করুক। বীরেশ্বর বললেন—আরো একটা কথা আছে রত্ন, আজ গোপালকে রক্ষা করলে লোকে বলবে—এরা শুধু মারতেই পারে না, ইচ্ছে করলে এরা বাঁচাতেও পারে।
সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর ডায়রীতে লিখেছেন—“শেষ কথা দুইটাতে আমার ক্ষোভ অপসারিত হইল! নুতন সংসার জীবনে প্রবেশ করিব, এই সময় গোপাল সিং-এর ওই অল্পবয়সী স্ত্রীটির এবং তাহার বালকপুত্র দুইটির অশ্রুজলে অবশ্যই আমার কল্যাণ হইবে না। ইহা অপেক্ষাও মূল্যবান কথা বলিয়াছেন পিতৃদেব। তাঁহার বিবেচনা, বুদ্ধি এবং বিচারবোধ যতই দেখিতেছি ততই বিস্মিত হইতেছি। সত্যই তো, লোকে বলিবে—রায়বাবুরা ইচ্ছে করিলে শুধু মারিতেই পারেন না; ইচ্ছে করিলে বাঁচাইতেও পারেন। বুঝিতে পারিয়া বলিলাম—ঠিক বলিয়াছেন। আমার আর কোন ক্ষোভ রহিল না। গোপালকে রক্ষা করাই এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য।”
***
রত্নেশ্বর এবার উঠবার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। ভবানী বলেছিলেন—আর একটু বস। গোপালের স্ত্রীকে ডাকি, তাকে তোরা বাপ-বেটায় একটু আশ্বাস দে। আর কথাগুলোও বল! গোপালের স্ত্রী এসে প্রায় হাউ-মাউ করে কেঁদেছিল। সে কান্নায় রত্নেশ্বর স্থির থাকতে পারেন নি, কিন্তু বীরেশ্বর রায় অবিচলিত ছিলেন। রত্নেশ্বরের চোখে জল এসেছিল। তিনি তা গোপন করতেই জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বীরেশ্বর রায় স্থির হয়ে বসে গড়গড়ার নল টেনেই গিয়েছিলেন। গোপালের স্ত্রীকে তার কান্নার বেগ কমে এলে বলেছিলেন—শোন বাছা, কতকগুলো কথা আমি বলে নি। স্থির হয়ে শোনো।
একে একে শর্তগুলি বলে গিয়েছিল বীরেশ্বর রায়।
মণ্ডলান তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
বীরপুরের সমস্ত জবর-দখল সম্পত্তি ছাড়তে হবে।
কীর্তিহাটের কাছারীতে এসে কসুর স্বীকার করে মাফ চাইতে হবে।
এবার বল, তুমি গোপাল সিংকে রাজী করাতে পারবে?
দীর্ঘ ঘোমটা টানা ছত্রীর মেয়ে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল—হ্যাঁ।
তারপর উঠে দাঁড়িয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তাঘরে পেয়েছিল অঞ্জনাকে। তাকে বলেছিল—রাণী মাঈজীকে একবার ডেকে দাও।
ভবানী দেবী উঠে এসেছিলেন, সে ভবানী দেবীকে বলেছিল-সে রাজী না হলে আমি আর আসব না। রাজী হলে আমি নিজে তাকে নিয়ে আসব!
এতে মত শুধু দেননি দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্য!
তিনি সব শুনে বলেছিলেন—এ কি করছেন বাবা বীরেশ্বর?
বীরেশ্বর রায় চুপ করে ছিলেন—উত্তর দিতে পারেন নি।
ভবানী দেবী বলেছিলেন—মায়ের সামনে আমি কথা দিয়েছি দেওয়ান কাকা।
আলোচনাটা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলত কিন্তু মহিন্দর চাকর খবর নিয়ে এসেছিল—দেবপ্রসাদবাবু, রাধারমণবাবু হাকিমসাহেবকে নিয়ে বাবুর কাছে আসছেন!
দেওয়ান আচার্য একটি কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন—তা’হলে আমি যাই। ওঁরা আসছেন। ওদিকে অনেক কাজ! আপনারা হুকুম করছেন, আপনারা মালিক; আপনারা যা বলছেন তাই হবে। তবে—। একটু চুপ করে থেকেছিলেন। তারপর বলেছিলেন—সাপের মাজা ভেঙে ছেড়ে দিলে কিছুদিন পর আবার ভাঙা মাজা জোড় খায়। তখন সে সাপ হয় কালসাপ!
বলতে বলতেই—কই ভায়া কই? বলে দেবপ্রসাদবাবু সাড়া দিয়েছিলেন।
—এস দাদা এস!
—হ্যাঁ মহিন্দর বললে—তুমি একটু পরে আসছ। তা রাধারমণ বললেন—সেটা ওঁকে কষ্ট দেওয়া হবে, ওঁর হাঁটতে কষ্ট হয়, বাঁ পা এখনো টেনে চলতে হয়; চলুন আমরাই যাই। রাধারমণও এসেছেন। তোমার বউদি সুরবালা, সুরবালার মেয়ে স্বর্ণ, ছেলে মণীন্দ্র সকলে এসেছি আমরা।
বীরেশ্বর বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ালেন তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য। ভবানী তাঁর লাঠিটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
—আসুন-আসুন-আসুন!
দেওয়ান আচার্য বেরিয়ে চলে গেলেন।
***
রাধারমণবাবু বসেই বললেন—এ তো আপনারা রাজত্ব গড়ে তুলেছেন বীরেশ্বরবাবু।
বীরেশ্বর রায় হেসে বললেন—পূর্বপুরুষ করে গেছেন। আমাদের ভাগ্যে আমরা ভোগ করছি।
—তা করুন। রাজারা—রাজাদের ছেলেরা তাই করে। কিন্তু অনেক কীর্তি করেছেন। ভারী ভাল লাগল! আপনার রত্নেশ্বরও খুব উপযুক্ত, খুব যোগ্যতা। He is a brilliant boy- আপনার দেওয়ান আমাকে বলছিলেন।
রত্নেশ্বর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। প্রণামাদি আসবামাত্র হয়ে গেছে।
রাধারমণবাবু বললেন—কে একটা দুর্দান্ত দুষ্ট লোক নাকি ভারী উপদ্রব শুরু করেছে। বলছিলেন আপনার দেওয়ান। শুনলাম আপনাদের ওপর রাগে সে নাকি নিজের ঘরে আগুন লাগিয়েছে, বাধা দেওয়ায় তার নিজের ছেলেকে মাথায় মেরেছে এমন করে যে খুন হয়ে গেছে! আমি সব বলব আপনাদের এস-ডি-ওকে। পুলিশকে একটু কড়কে দেবেন। ওরা সব পারে! এসব লোকের চরম সাজা হওয়া উচিত। আমি শুনে খুশি হলাম কেন জানেন? আপনারা বেআইনী জবরদস্তি কিছু করেন নি। আপনারা আইনের পথেই চলেছেন। গভর্নমেন্টও এইটে চাইছেন।
বীরেশ্বর বললেন—কিন্তু বড় মর্মান্তিক হয়ে গেল ব্যাপারটা! বিশেষত আমার গৃহিণীর মনে বড় লেগেছে। তিনি বলছেন—মণ্ডলানটা এইভাবে—
বাধা দিয়ে রাধারমণবাবু বললেন—নো —নো—নো স্যার, নো। আপনারা ঠিক করেছেন। খুব ভাল কাজ করেছেন। জানেন না বোধহয়, গভর্নমেন্ট ভূমিস্বত্ব আইন সংশোধন করেছেন। তাতে প্রজাদের অনেক সুবিধে হবে। বড়লাটের কাউন্সিলে আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনা চলছে।
রত্নেশ্বর বললেন—Mr. Currie মুভ করছেন! To amend the law relating to the recovery of rent in the Presidency of Fort William in Bengal?
—তুমি খবর রাখ! বা! হ্যাঁ, ওটা অনেকদুর এগিয়েছে। মোটামুটি it is meant for improving the position of the raiyats of Bengal. দুটো জিনিস নির্ঘাৎ-একটা হল—the abolition of the Zaminders. Power to compel the attendance of their raiyats—আর হাজির করতে বাধ্য করতে পারবেন না জমিদাররা। Second হল, বারো বছর একনাগাড়ে প্রজা জোত ভোগ করলেই অকুপেন্সি রাইট হয়ে যাবে। বারো বছরের উপর মণ্ডলান স্বত্বের মণ্ডলকে তালুকদারি যদি দেয় এই বারো বছরের দাবীতে তাহ’লে আপনাদের মুশকিল হবে। বীরপুরের case-এ ঠিক করেছেন আপনারা। এরপর মণ্ডলান আয়মাদারী এসব আর থাকবে না। আপনাদের দেওয়ানের ফোরসাইট আছে। খুব ভাল ব্যবস্থা করেছেন।
ওদিকে জগদ্ধাত্রী সুরবালা স্বর্ণলতা ভবানী দেবীকে ঘিরে পাশের ঘরে বসেছিলেন, কিন্তু ওঁদের কান ছিল এ-ঘরে। সুরবালাই বললেন—ধান ভানতে শিবের গীত। এখানে এসেও নেই গভর্নমেন্ট আর গভর্নমেন্ট আইন আর আইন। দেখ তো কাণ্ড! বল না—জগদি!
জগদ্ধাত্রী দেবী উঠে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন—ও মশাই সাহেবমানুষ, মেমসাহেব যে মেজাজ খারাপ করছেন! বলছেন কুটুম্ববাড়ীতে এসে সাহেবী মেজাজটা ভুলতে পারো না। ধান ভানতে শিবের গীত গাও যে! এলে মেয়ের বিয়ের কথা নিয়ে, এসে এসব হচ্ছে কি? রাধারমণবাবু অপ্রতিভ হলেন। বললেন-সে ধর না হয়েই গেছে দিদি। যখন এসেছি, তখন বীরেশ্বরবাবুর মত রাজা লোক প্রার্থীকে ফেরাবেন কি বলে?
রত্নেশ্বর আর দাঁড়ালেন না। বললেন—আমি তাহলে এখন আসি। ওঁরা সব আসবেন, আমি দেখে আসি ব্যবস্থা সব ঠিকমত হল কিনা!
যাবার সময় ফিরে ওঘরে স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করেও পারলেন না।
* * *
খুশী কথাটা ঠিক যেন লাগসই হচ্ছে না সুলতা। সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর রায় তাঁর ডায়রীতে যে কথাটা ব্যবহার করেছেন সে কথাটা একালে পড়তে গিয়ে আমারও মনে হয়েছে বড্ড যেন বাড়াবাড়ি করেছেন, তরুণ রত্নেশ্বর। তবে ঊনবিংশ শতকের ঊনষাট সালে ভাষার ঢঙটাই ওইরকমই ছিল। যুগটাই ঈশ্বর গুপ্তের যুগ। এদিকে কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নক্সায় যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা রত্নেশ্বর রায়ের মত চরিত্রের মানুষের পছন্দ না হবারই কথা। তিনি লিখেছেন—“অহো! এই জগৎ-সংসারে প্রেম কি দুর্লভ আনন্দদায়িনী সামগ্রী। ইহা অনন্ত অপার আনন্দসুধা রসের অফুরন্ত নির্ঝর ধারা। অকস্মাৎ যেন শরবিদ্ধ হৃদয়—ভূতল বিদীর্ণ হওত প্রবল উৎসধারায় উৎক্ষিপ্ত হইয়া আমার তাপিত নবযৌবনকে নিষিক্ত করিয়া দিতেছে। আমার জীবন যৌবন যেন প্রখর গ্রীষ্মসত্তাপিত পত্রহীন বৃক্ষের মত এই রস অভিসিঞ্চনে পত্রপল্লব সমৃদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। পল্লবাগ্রভাগে পুষ্প উদ্দামের জন্য ব্যাকুল হইয়াছে।”
ইত্যাদি ইত্যাদি সে অনেক কথা তিনি লিখেছেন। তাই বলছি কানের সাদামাটা ‘খুশী’ শব্দটা বোধহয় রত্নেশ্বর রায়ের মনের অবস্থা বোঝাবার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। সেটা আর খুঁজে হয়রান হব না সুলতা, তুমি বুঝে নিয়ো। তিনি লিখেছেন—তাঁর গান মনে পড়েছিল।
গানে রত্নেশ্বরের অধিকার দুদিক থেকে। সংসারে হেরিডিটির সত্য অত্যন্ত প্রত্যক্ষ। পিতৃকুলে বীরেশ্বর রায় গান-বাজনার চর্চা করেছিলেন। মাতৃকুলে শ্যামাকান্ত ছিলেন সিদ্ধগায়ক। ভবানী দেবীও গানে জন্মগত অধিকার নিয়ে জন্মেছিলেন। রত্নেশ্বরের স্নায়ুশিরায় অস্থিমজ্জায় মস্তিষ্কে বুদ্ধিতে বোধে সঙ্গীতবোধ ও তার ব্যাকরণের ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার বংশসঞ্চিত গুপ্তধনের মতই রাখা ছিল। ওই মধ্যে মধ্যে কখনো এমনি উল্লাসী আনন্দে কদাচিৎ গুঞ্জন করেছেন। সেদিনটি তার মধ্যে একটি দিন। রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীর বংশ বিবরণের মধ্যে যা পেয়েছি তাতে কখনো গান গেয়েছেন এমন কথা লেখেন নি। তাঁর দিনলিপি আরম্ভ হয়েছে মাত্র দুদিন আগে থেকে। ওই দোলের দিন, পোষ্যপুত্র হিসেবে মা-বাপের কোলে ফিরে আসার দিন থেকে। তার তৃতীয় দিনে রত্নেশ্বর বিবাহ-সম্ভাবনাতেই শুধু নয়, ভাবী বধুটিকে বাড়ীতে চকিত চাহনিতে দেখে বিবিমহলে যাবার পথে গুনগুন করে বসন্তরাগ ভেঁজেছিলেন। পিছনের বরকন্দাজ তাতে হাসে নি, সে বাবুজী সাহেবের গান শুনে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। বিবিমহলে রত্নেশ্বর রায় যখন দেখাশোনা করছিলেন, তখন বরকন্দাজটি আর একজন বরকন্দাজকে বলেছিল-আরে ভাই, বাবুজী সাহেব এমন গানা জানেন কি বলব তোমাকে!
রত্নেশ্বর কথাটা শুনেছিলেন। এবং নিজেকে সতর্ক করেছিলেন—“অন্যায় করিয়াছি, নিজের অজ্ঞাতসারে গান গাহিয়া ফেলিয়াছি। গানের পথে বিপদ আছে রায়বংশের।”
বিবিমহলে তখন ঝাড়াই মোছাই হয়ে গেছে। ভবানী দেবীর প্রত্যাবর্তনের পর বীরেশ্বর রায় বিবিমহলে বাস করেন নি। বংশের অন্দরে বাস করছিলেন। বিবিমহলের ফার্নিচার তখন এখানে এবাড়িতে এসেছে। তার জায়গায় রত্নেশ্বর আসবেন বলে সে সব নতুন ফার্নিচার এসেছিল কলকাতা থেকে, গদীআঁটা চেয়ার সোফা, মার্বেলটপ টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, বড় বড় আয়না, নতুন গালিচা সেইসব দিয়ে বিবিমহল সাজানো হয়েছে। হয়েছে ক’ মাস আগেই, সেই ইস্কুলের ফাউন্ডেশন স্টোন স্থাপনের সময়। সেগুলো ঝাড়ামোছা এবং একটু এদিক ওদিক করে সাজানো এইসব কাজ হচ্ছিল সেদিন। কুইন ভিক্টোরিয়ার, প্রিন্স অ্যালবার্টের ছবি টাঙানো হয়েছে; তার সঙ্গে বিলাতী ল্যান্ডস্কেপ ক’খানা টাঙিয়ে সাজিয়েছে। এ-সব কাজের জন্য কলকাতা থেকে সাহেববাড়ীতে কাজকরা একজন বেয়ারাকে আনা হয়েছে। সে-ই সব বরাতমত করাচ্ছে। রত্নেশ্বর নিজে প্রত্যেক ঘরের ব্যবস্থা দেখে খুশী হয়েই ওখান থেকে ফিরছিলেন; নিচে এসে দেখলেন দেওয়ান আচার্য তাঁর জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। বললেন—বাবুজী সাহেব, আমি তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি ভাই!
রত্নেশ্বর বললেন —–বলুন।
—বলব কি? তুমি তো সব জান। এ তুমি বলে ক’য়ে বন্ধ করো।
—কি?
—গোপাল সিংয়ের সম্বন্ধে যে হুকুম হল সে হুকুম তুমি ওল্টাতে পার। ওল্টাও ভাই। নইলে জমিদারী চলবে না। অন্তত আমি তো চালাতে পারব না।
রত্নেশ্বর তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তা কি করে হয়! মন তাঁর অন্যরকম হয়ে ছিল, তিনি সায় দিতে পারলেন না। বললেন-তা কি ক’রে হয় বলুন? মা কথা দিয়েছেন, খোদ কর্তা পর্যন্ত গোপাল সিংয়ের স্ত্রীকে ডেকে কথা দিলেন। সে কথা এখন না বলবেন কি করে?
আচার্য বললেন—আমি তা হ’লে বাবুজী সাহেব, এই কাজকর্মগুলি চুকে গেলেই কাজ থেকে ছুটি নেব।
—ছুটি নেবেন!
—হ্যাঁ। এরপর আমি আর কাজ করতে পারব না। আমার মুখ থাকবে না। কথায় বলেও আচার্য তৃপ্তি পান নি, কথা শেষ করে ঘাড় নেড়েছিলেন—না।
রত্নেশ্বর তাঁর ডায়রীতে লিখেছেন—“মুহূর্তে আমার মন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। আচার্য দেওয়ান আমাদের কথাও শুনিতে চাহিতেছেন না। এবং ভাবিতেছেন, রায়বাড়ীর তিনিই হর্তাকর্তা বিধাতা। তিনি না হইলে রায় এস্টেট চলিবে না, অচল হইয়া পড়িবে। আমি বলিলাম-বেশ আপনি যাহা বলিতেছেন তাহা পিতৃদেবকে বলিব।” কথাটা আর সেই মুহূর্তে বেশীদুর অগ্রসর হতে পারে নি; পালকীর বেহারার হাঁক শোনা গিয়েছিল। ব্যস্ত হয়ে একজন নায়েব ছুটে এসে খবর দিয়েছিল-হাকিমরা এসে পড়েছেন!
রায়বাড়ীতে হাকিমদের সংবর্ধনা সেদিন রায়বাড়ীর সৌভাগ্যে কুটুম্বিতার আসরে পরিণত হয়েছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সদর এস-ডি-ও রাধারমণবাবুর কন্যার বিবাহের সম্বন্ধের আসরে পরিণত হয়েছিল। ধুতিচাদর পরা রাধারমণবাবু তমলুকের এস-ডি-ও গুপ্ত সাহেবকে বলেছিলেন—আজ কিন্তু আমরা রায়বাড়ীতে গভর্নমেন্ট অফিসিয়েল নই মিস্টার গুপ্তা। আমরা আজ কন্যাপক্ষ। আপনারা শুনে নিশ্চয় খুশি হবেন যে আমার মেয়ে স্বর্ণলতার সঙ্গে বীরেশ্বরবাবুর পুত্র রত্নেশ্বরের বিয়ের সম্বন্ধ আজ পাকা হয়ে গেল!
অল্পবয়সী ইংরেজ ডি-এস-পি জোন্স এসেছিল শিকারের লোভে। কথাটা শুনে সে উল্লসিত হয়ে বলেছিল—তা হলে তো এ শুভকর্মে আমাদের বরকনের কল্যাণ কামনা করে কিছু পান করা উচিত।
এ কথায় রাধারমণবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন—সম্ভবত তিনি আমার সম্মুখে মদ্যপান করিতে সঙ্কোচ বোধ করেছিলেন।
বীরেশ্বর রায় রত্নেশ্বরকে বলেছিলেন—তুমি তাহলে ওদিকে গিয়ে কাজকর্মগুলি দেখ রত্নেশ্বর!
অবশ্য তার আগেই পরিচয়পর্ব শেষ হয়েছে। কীর্তিহাটের রায়বংশের উত্তরাধিকারীকে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন বীরেশ্বর রায় এবং তাঁর সঙ্গে রাধারমণবাবু তাঁর গুণপনার পরিচয় দিয়েছেন। সরকারী হাকিম তিনি—তিনি রত্নেশ্বরের গুণের কথা তাঁদের সামনে তুলে ধরেছিলেন সুন্দর কৌশলের সঙ্গে।
প্রথমেই বলেছিলেন—রত্নেশ্বর রায় কাশীতে ছিলেন মিউটিনির সময়। নিজের চোখে সব দেখেছেন। আমাকে বলছিলেন কাল; এমন সুন্দরভাবে বললেন এবং এমন বিচার করেছেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এবং আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তাঁর সুক্ষ্ম বিচারশক্তি দেখে। সমস্ত ব্যাপারটা অ্যানালিসিস করে অল্প কথায় সমস্ত কথাটা বলে দিলেন। বললেন—এটা হল ইন্ডিয়ার ধর্মান্ধতার সঙ্গে ইউরোপীয়ান সিভিলিজেশনের লাস্ট ফাইট। এটাকে আলোর সঙ্গে অন্ধকারের লড়াই বলা যেতে পারে। ইন্ডিয়ার ভাগ্য ভালো যে আলোর জয় হয়েছে। অ্যান্ড—: এইটেই আমার সব থেকে ভাল লেগেছে; উনি বললেন—আলোই জেতে চিরকাল, অন্ধকার হারে।
রত্নেশ্বর নিজের ডায়রীতে লিখেছেন—“এরূপ কথা আমি বলিয়াছিলাম ইহা সত্য কিন্তু এমন চমৎকার করিয়া বলি নাই। এবং ইহার সঙ্গে নির্বিচারে বালকবৃদ্ধকে হত্যা করার নিন্দা ও করিয়াছিলাম, কিন্তু আমার ভাবী শ্বশুরমহাশয় এই কথাগুলি বলিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন যে কোম্পানীর তরফের অত্যাচার বৃত্তান্ত বলা উচিত হইবে না।”
ওখান থেকে ফেরার পথে রত্নেশ্বর দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর ভাবী বধুকে। রায়বাড়ীর আলসের উপর বুক রেখে দুটি মেয়ে বোধহয় কীর্তিহাট গ্রাম দেখছিল। তার একজন অঞ্জনা, অন্যজন স্বর্ণলতা; স্বর্ণলতাকে তিনি খুব ভাল করে না দেখলেও তিনি তাঁকে চিনতে ভুল করেন নি। কারণ এমন মেয়ে রায়বাড়ীর জ্ঞাতি-কুটুম্বের মধ্যে কেউ ছিল না।
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন—“বিবিমহল ও রায়বাড়ীর খাসমহলের মধ্যবর্তী যে কলমের বাগান, সেই বাগানের প্রবেশমুখে উক্ত নারীমূর্তিদ্বয়কে দেখিয়া চিনিলাম এবং পুলকিত হইলাম। অঞ্জনার পার্শ্ববর্তিনী ওই স্বর্ণাভ-বর্ণা কিশোরীটি যে স্বর্ণলতা ব্যতিরেকে অন্য কেহ হইতে পারে না ইহাতে আমার সংশয় ছিল না। আমি একটি বৃক্ষান্তরালে দণ্ডায়মান হইয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলাম। হৃদয় অভূতপূর্ব ভাবাবেশে আবিষ্ট হইল। সম্ভবত তাহারা আমাকেও দেখিয়াছিল। কারণ তাহারা সরিয়া গেল। আমিও সরিয়া আসিলাম এবং লজ্জিত হইলাম। ছি—ছি—ছি, যদ্যপি কেহ দেখিয়া ফেলে! লোকে হাস্য করিবে। আমি তাড়াতাড়ি তত্রস্থান হইতে দ্রুতপদে কাছারীর মুখে চলিলাম। আমার সঙ্গে বরকন্দাজ আমাকে দেখিতে না পাইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। আর একটু বিলম্ব হইলে সম্ভবত গোলমাল হইত। যাহা হোক, কাছারীতে আসিয়া বসিয়া মহাবীর সিংহকে আজ্ঞা করিলাম যে, কেহ যেন এখন না আইসে। আমি বসিয়া স্বর্ণলতার সঙ্গে আমার ভাবী মিলিত জীবনের একটি সুখ-কল্পনার চিত্র মনে মনে অঙ্কিত করিতে বসিলাম।
“অকস্মাৎ মনে হইল অঞ্জনাকে বলিয়াছি দ্বিপ্রহরে আমার নিকট আসিবার জন্য। স্বর্ণলতার অন্তরের পরিচয় সম্যক জ্ঞাত হওনের জন্য কিছু প্রশ্ন করিব। কিন্তু কি প্রশ্ন করিব? প্রশ্ন একটি। আমাকে তাহার পছন্দ হইয়াছে তো? কিন্তু তাহা কি অঞ্জনাকে সরাসরি বলিতে পারিব? অঞ্জনা একটু প্রগল্ভা। লজ্জাবোধ হইতেছে।”
সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর একটি ছোট কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাটি তাঁর ডায়রীর মধ্যে আছে।
কন্যার হইবে বিয়া ঘটকেরে আনাইয়া
পিতা কয় বাখানিয়া
পাত্র চাই ইন্দ্রের মতন
মাতা কহে বুদ্ধি নাই ইন্দ্র সাথে চন্দ্র চাই
খানিক কুবেরও চাই
রাজরূপ তার সাথে ধন।
টক নাড়িয়া মাথা কন্যারে শুধায় কথা
এবে তুমি বল মাতা
এর সাথে আর কারে চাই?
কন্যা ভাবে মনে মনে হায় বলিব কেমনে
ইন্দ্র চন্দ্র কুবেরের সঙ্গে যেন—পাই।
অঞ্জনার হাতে এই ধাঁধাটি দেবেন। স্বর্ণলতাকে সে বলবে—এই শেষ ছত্রে ইন্দ্র চন্দ্র কুবেরের সঙ্গে কাকে চাই এই ফাঁকটি তুমি পূরণ করে দাও না ভাই! উত্তরটা আমি ভাই বুঝতে পারছি না!
অঞ্জনা লেখাপড়া জানে না, কিন্তু তা বলে মূর্খ বলতে যা বোঝায় তা নয়। সেকালে লেখাপড়া না জেনেও পুরাণে কাব্যে রঙ্গরসিকতায় সে পারঙ্গমা ছিল। ছড়া, পাঁচালী, কৃত্তিবাসী-কাশীদাসী রামায়ণ মহাভারতের অনেক অংশ মুখস্থ ছিল। আওড়াতে পারত। রীত তরিবৎ তাও সে ভালই জানত। লেখাপড়া না জানলেও অশিক্ষিতা ছিল না। সে একবার শুনে বলেছিল—কি-কি-কি, আর একবার পড়ুন তো!
রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন—সুলতা- “অঞ্জনার প্রশ্নে আমি কৌতুকবোধ করিলাম। বুঝিলাম সে বুঝিতে পারে নাই। আমি তাহাকে আবার একবার পড়িয়া শোনাইলাম। সে এবার খুক খুক শব্দে হাসিয়া ফেলিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখে কাপড় চাপা দিয়া হাসি রোধ করিতে চাহিল।”
রত্নেশ্বর প্রশ্ন করেছিলেন—হাসলে যে?
অঞ্জনা বলেছিল—এ তো খুব সোজা।
—সোজা? কই বল তো শুনি—।
—আর একবার পড়ুন।
রত্নেশ্বর পড়েছিলেন—
“ঘটক নাড়িয়া মাথা
কন্যারে শুধায় কথা
এবে তুমি বল মাতা এর সাথে
আর কারে চাই?
কন্যা ভাবে মনে মনে
হায় বলিব কেমনে—
ইন্দ্র চন্দ্র কুবেরের সঙ্গে যেন—
অঞ্জনা বলে উঠেছিল—“রত্নেশ্বরে পাই।”
বলে খিলখিল শব্দে হেসে উঠেছিল।
রত্নেশ্বর শঙ্কিত হয়ে উঠে বলেছিলেন—চুপ-চুপ। বাইরে কে কোথায় শুনতে পাবে!
সাক্ষাৎকারটি পূর্বের বন্দোবস্ত মত দুপুরবেলা নির্জনে রত্নেশ্বরের ঘরে হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর গ্রামাঞ্চলে একটা বিশ্রামের সময় আসে। তখন সকলেই একটু আধটু গড়ায়।
সুরেশ্বর বললে—কি শীত কি গ্রীষ্ম-দুপুরের পর একটু গড়ানো এদেশের পক্ষে প্রয়োজন কি না সে কথা বৈজ্ঞানিকেরা বলতে পারেন। শুনেছি গান্ধীজীও নাকি গড়িয়ে থাকেন। ওঁর কোমরে যে পকেট ঘড়িটা আছে তাতে অ্যালার্ম বাজে; ওই আধঘণ্টা তিন কোয়ার্টার পর সেটা বাজুক না বাজুক ঠিক উঠে পড়েন। তবে গ্রামের লোক—নিতান্ত গরীবের ঘর ছাড়া সবাই ঘুমোয়। ১৯৩৭ সালেও ঘুমোতে দেখেছি আমি। ওর মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া বোধ হয় আভিজাত্যও আছে। আমারও ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে।
সুলতা হেসে বললে—জানি আমি, আজ দুপুরেই টেলিফোন করেছিলাম। রঘু আমাকে বললে—লালবাবু নিদ যাচ্ছে দিদিমণি। কাল রাতভর আপনা সাথ গল্প করিয়েছেন, আজ তো বহুক্ষণ নিদ যাবেন। দুপহর বেলা নিদ না গেলে তবিয়ং খারাপ হয় উনকা। আমি বললাম থাক তাহলে, ডেকো না।
সুরেশ্বর হাসলে। বললে-রঘুও ঘুমোয়। তবে টেলিফোনের রিঙ শুনে বোধ হয় জেগে উঠেছিল। ওরও এ রোগ ধরেছে কীর্তিহাটে। দুপুরবেলা সারা গ্রামে অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্যে ঘুমপাড়ানি মাসি এসে আঁচল বিছিয়ে বসেন।
—সেদিন, মানে, ১৮৫৮ সালের ফাল্গুন মাসের দুপুর বেলাটায় সবাই গাঢ়-ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আগের দুদিন সারারাত্রিব্যাপী উৎসব গেছে। সারা রায়বাড়ীটা নিস্তব্ধ নিঝুম। রায়বাড়ীর কার্নিশে কার্নিশে অনেক পায়রা থাকত; আজও আছে; সেগুলো পর্যন্ত বাসায় বুক পেতে বসে থাকে; মধ্যে মধ্যে এক-একটা শব্দ ক’রে, তাও ক্ষীণ।
রত্নেশ্বর তাও লিখেছেন ডায়রীতে। তাঁর সেদিন ঘুম আসে নি। মধ্যে মধ্যে তন্দ্রা আসছিল কিন্তু পায়রাদের ওই ডাকেই চট্ চট্ করে সে তন্দ্রা ভেঙে যাচ্ছিল। মধ্যে মধ্যে ভাবনা হচ্ছিল—অঞ্জনা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি। দুচারবার খাট থেকে নেমে পায়চারি করেছেন; বার দুই বাড়ীর ভিতরের দিকের বারান্দায় দরজা ফাঁক করে তাকিয়ে দেখেছেন অঞ্জনা আসছে কি না। আবার দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় উঠে হেলান দিয়ে বসেছিলেন।
লিখেছেন—“প্রেমজনিত উদ্বেগ সম্বরণ করা অতীব কঠিন। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া দেখিতেছি এখনো তিনটা বাজে নাই। খাওয়া-দাওয়া আড়াইটা পর্যন্ত শেষ হয়। সুতরাং মাত্র অর্ধঘণ্টা পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে মাত্র, অথচ আমার মনে হইতেছে অন্তত দুই-তিন ঘণ্টাকাল আমি অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছি।”
তারপর একসময় অঞ্জনা ঠিক এল। সন্তর্পণে দরজাটি খুলে গেল—এক ঝলক আলো ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকল অঞ্জনা এবং দরজাটি বন্ধ ক’রে এগিয়ে কাছে এসে বললে —বাবা! সবার চোখে ঘুম আছে, ঠাকমার চোখে ঘুম নেই। দিব্যি দেখি নাক ডাকছে, দেখে যেই উঠি অমনি দেখি বুড়ি ওঁ-আঁ শুরু করে দেয়। চোখ খুলে তাকিয়ে বলে—কিলা, উঠলি যে? বিকেল হয়ে গেল নাকি? একবার বললাম—ঘাটে যাব। তা বলেনা। আর একটু পরে যাস। এখন সব ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এই রাজসূয় যজ্ঞি। তিভুবনের নোক চারিদিকে। সোম মেয়ে—কোথা কে থাকে! যাসনে-শো! কি করব? এই এতক্ষণে ঘুমুলো। আস্তে আস্তে উঠে এসেছি। নেন—কি হুকুম বলুন!
রত্নেশ্বর বলেছিলেন—খুব সাবধানে করতে হবে। বুঝেছ!
—বুঝেছি, বলুন।
—একটি ধাঁধা দেব। যেন তোমাকে ধাঁধাটি দিয়েছি আমি। বুঝেছ?
—হ্যাঁ।
—তুমি মনে কর ধাঁধাটি বুঝতে পার নি এই ভান দেখিয়ে স্বর্ণলতাকে ডেকে বলবে—ভাই, তুমি তো লেখাপড়া জানা শহুরে মেয়ে, এই ধাঁধাটি পুরণ করে দেবে?
—ধাঁধা? কি ধাঁধা? বলুন।
–কাগজে লিখে দিয়েছি। না হলে তোমার ভুল হয়ে যাবে।
—আমাকে শোনাবেন না? আমি তো পড়তে জানি না।
পড়ে শুনিয়েছিলেন রত্নেশ্বর। অঞ্জনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল—কি—কি—কি? আর একবার পড়ুন তো! বলে মুখে কাপড় চাপা দিয়েছিল। সে ধাঁধাই হোক আর ছড়াই হোক তার মর্মটা অনায়াসে বুঝেছিল। হাসিও পেয়েছিল কৌতুকে।
ধাঁধাটা শুনে অঞ্জনা বলেছিল-ও তো সোজা। উত্তর—“রত্নেশ্বরে পাই”। বলে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।
রত্নেশ্বর বলেছিলেন—চুপ-চুপ–কে শুনতে পাবে।
অঞ্জনাও সতর্ক হয়ে চুপ করে গিয়েছিল। ফিস্ ফিস্ ক’রে বলেছিল—ওই আমার দোষ। হেসে ফেলি। মা বলত-দুশমনের হাড়ে তৈরি দাঁত না হলে এমন করে সবটাতেই কেউ হাসতে পারে না! ওতেই মরবি—তুই ওতেই মরবি!
রত্নেশ্বর ডায়রীতে লিখেছেন—“অঞ্জনার বাক্যগুলি শ্রবণ করিয়া আমার অন্তর মুহূর্তে গভীর বিষাদে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। এই দরিদ্র অথচ উল্লাস এবং সদাহাস্যময়ী মেয়েটির হাস্য কেহ সহ্য করে না। স্থির করিলাম ইহাকে পরবর্তীকালে স্বর্ণলতার সঙ্গিনী করিয়া দিব। এবং আমি ইহাকে সত্যকারের আপন জনের মতোই সমাদর সম্ভ্রম করিব।”
অঞ্জনা চিঠিখানা হাতে ক’রে বলেছিল—তা হলে আমি যাই। আপনার কনেকে দেখিয়ে জবাব এনে দেব। তার যা বুদ্ধি সে ঠিক জবাব লিখে দেবে!
—কিন্তু বলে দি একটা কথা। উত্তরে কোন মানুষের নাম হবে না।
—মানুষের নাম হবে না?
—না। তোমার জবাব ঠিক হয় নি। রত্নেশ্বরে পাই লিখলে হবে না। লিখতে হবে দেবতার নাম।
—দেবতার নাম?
—হ্যাঁ। ইন্দ্র চন্দ্র কুবের এঁদের সঙ্গে মানুষের নাম কি চলে? ওখানে দেবতার নাম দিতে হবে। যেমন রামচন্দ্রে পাই নয়তো মহেশ্বরে পাই নয়তো নারায়ণে পাই।
আবার, মুখে কাপড় চাপা দিলে অঞ্জনা। আবার তার হাসি পেয়েছে।
রত্নেশ্বরও হেসে বললেন—আবার হাসি পেল কিসে?
—যদি স্বর্ণলতা লেখে-মহেশ্বরে পাই!
—বেশ তো, আমি শিবের মতই হব তাহলে!
—পারবেন?
—কেন, পারব না কেন?
—শিব শ্মশানে-মশানে ফেরে। গাঁজা ভাঙ খায়। ভূত নিয়ে ফেরে। আপনি এই রাজ-অট্টালিকা ছেড়ে এমন হতে পারবেন? আরো অনেক চাই—বুড়ো হতে হবে, মাথায় জটা মুখে দাড়ি, মাগো! সে হতে পারবেন না আপনি।
রত্নেশ্বর হেসে ফেললেন। মেয়েটা এমন যে, সব কিছুকেই হাস্যকর করে তুলতে পারে। শিবের শিবত্ব বোঝে না, বুঝলেও সে-সব বাদ দিয়ে তার সকৌতুক দৃষ্টিতে শিবের পাকা চুল দাড়ি জটা এবং ভাঙ খাওয়াটাই সব হয়ে ওঠে! তিনি বললেন—তা হোক। তুমি ওকে দিয়ো তো! দেখি না কোন্ দেবতা ওর পছন্দ!
অঞ্জনা চলে গিয়েছিল এবং ফিরে এসেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন রত্নেশ্বর উঠে মুখ হাত ধুচ্ছেন, সন্ধের উৎসব আজ বিশিষ্ট উৎসব। আজ হবে বাঈজীর নাচ। এখুনি নিচে নেমে কাছারীতে গিয়ে বসবেন। খবরাখবর নেবেন।
চাকর রুপোর গ্লাসে ডাবের জল এনে ত্রিপয়ের উপর রেখেছে। রেকাবিতে মশলাপান। মুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়ে কাপড়চোপড় ছাড়বেন।
অঞ্জনা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
রত্নেশ্বর লিখেছেন—“তাহার মুখ সহাস্য; এবং কৌতুকে চোখ দুটি উজ্জ্বল। দেখিয়াই বুঝিলাম সে এই অল্প সময়ের মধ্যেই ধাঁধার উত্তর লইয়া আসিয়াছে। আমার অন্তর মন উদ্গ্রীব হইয়া উঠিল উত্তরের জন্য। কিন্তু ভৃত্যের সম্মুখে এসব কথা বলিতে নাই। কি করিয়া জিজ্ঞাসা করিব বুঝিতে পারিলাম না। শুধু কহিলাম—আইস। কোনো সংবাদ আছে কি?”
অঞ্জনা চতুরা, সে বলিল—“এই যাঃ, আমার যে ভুল হইয়া গেল।”
অঞ্জনা চাকর গোবিন্দকে বলেছিল—গোবিন্দ, যাও তো নিচে ঠাকুমার কাছে যাও। বলো ছোটবাবুর জন্যে পান সাজা আছে, বড়বাবুর রেকাবিতে পান আছে, তার পাশেই ছোট রেকাবি আছে, তাতে যে পান সে পান ছোটবাবুর। সে রেকাবিটা নিয়ে এস তো।
গোবিন্দ চলে গেলে অঞ্জনা বলেছিল—পান সেজেছে স্বর্ণলতা। আমি আলাদা করে আপনার জন্যে রেখে দিয়েছি।
মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসি গোপন করে অঞ্জনা বলেছিল—খুব চালাক, খুব চালাক মেয়ে। আমি পান সাজছিলাম। আপনার হুকুম তামিল করতে গিয়ে আজ এবেলার পান সাজা হয়নি। পান সাজছি আর ভাবছি, কি করে যাই, কি ক’রে বলি। হঠাৎ আমার ভাগ্যি; ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল চুপ করে। আমি পান সাজছি দেখে কাছে এসে বললে-পান সাজছ? বললাম—হ্যাঁ। এ পান কর্তাবাবুর, সতী বউরাণীর আর ছোটবাবুর। এ পান আমি সাজি। তারপর বললাম—এসেছ ভালই হয়েছে। একটা ধাঁধার উত্তর করে দিতে পার? বললে—ধাঁধা? কি ধাঁধা? পাড়াগাঁয়ের ধাঁধা ভাই আমি জানি না। বললাম-না; এ ভাই ছোটবাবুর তৈরী করা ধাঁধা। বললে—ছোটবাবু কে? বললাম—রত্নেশ্বরবাবু! মুখটা লাল হয়ে উঠল, বললে—উনি বুঝি তোমাকে ধাঁধা দেন উত্তর করতে? বুঝেছেন? মনে মনে—।
মুখে আবার একবার কাপড় চাপা দিয়ে সামলে নিয়ে বললে অঞ্জনা—আমি বললাম—না, আমি ভাই, সম্পর্কে ওঁর সাতদিনের বড় দিদি। কিন্তু ওঁরা ভাই বড়লোক, রাজা লোক, আর ভালমানুষ, তাই আমি পোয্য হলেও চাকর মনে করেন না, সম্বন্ধটার মান রাখেন। আজ ওঁকে ডেকেছিলেন সতী বউরাণী জ্যেঠাইমা, আমি ডাকতে গেলাম। দেখলাম একমনে কাগজে লিখছেন। আমাকে দেখে হেসে বললেন—কই অঞ্জনাদি, একটা ধাঁধার উত্তর দাও তো! আমি ভাই পারলাম না। লেখাপড়া জানা পণ্ডিত লোক। বললাম- লিখে দিন ভেবে বলব। এই দেখ! বলে কাগজখানা দেখালাম। তা পড়ে হেসে বললে-বল না, তোমার যে দেবতা পছন্দ তাঁর নাম। আমার তো হয়ে গিয়েছে। এ জন্মের ঢাক বেজে গিয়েছে। কোন দেবতা ধারে কাছে ঘেঁষে না। তুমি বল। তো বললে কাকে ছেড়ে ভাই কাকে চাইব বল! তেত্রিশ কোটি দেবতা। একে ছেড়ে ওকে চাইলে অন্যজনে রাগ করে। তার থেকে ভাই একজনের মধ্যে সব দেবতাকেই চাই। বুঝেছ! ওখানে উত্তর হবে ‘সব দেবে’ চাই! হেসে বললে—আমাকে বল, কি বললেন তোমার ছোটবাবু। তারপর বললে—তোমায় তো দেখছি অনেক পান সাজতে হবে। আমি কয়েকটা সেজে দেব? বলে পান সাজতে বসল। খিলি আষ্টেক পান সেজে দিয়ে উঠে গেল।
রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন ডায়েরীতে—’উত্তর পাইয়া সত্য সত্যই আমি পরাজিত হইলাম। সুকৌশলে ‘সব দেবে’ লিখিয়া আমাকে ঠকাইয়া দিয়াছে। নারী চরিত্র সত্যই দুয়ে; বুঝিতে পারিলাম না তাহার পছন্দ কি! কিন্তু পান যখন সাজিয়া দিয়াছে, তখন বিবাহে তাহার আগ্রহ আছে ইহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না।”
অঞ্জনা রত্নেশ্বর রায়ের সম্মুখে হাত পেতে বলেছিলেন—আমার বকশিশ।
—বকশিশ! বকশিশ কি আপনার জনকে দেয়? তুমি কি দাস-দাসী? তুমি সম্পর্কে আমার সাত দিনের বড় দিদি।
—দিদি না ছাই! সাত দিনের বড় আবার বড়। আর রাজাবাবুর দিদি কি গরীব হয়? আমি আপনাদের দাসী না হই পোষ্য। চাকরে মাইনে পায়। আত্মীয় পোষ্যরা পেটভাতার পোষ্য।
রত্নেশ্বর রায় আবেগে বিচলিত হইয়াছিলেন-সেই বিচলিত মনে দুই হাতে অঞ্জনার পাতা অঞ্জলিবদ্ধ হাত দুখানি চেপে ধরে বলেছিলেন-না-না-না! তোমার সম্মান এ সংসারে আমার মত, আমার যে বউ আসবে তার মতই হবে।
অঞ্জনা বলেছিল—হাত ছাড়ুন। আমার পাতা হাত ভরে গিয়েছে।
রত্নেশ্বরের ডায়রীতে আছে—“অঞ্জনাও আনন্দে পুলকে থর-থর করিয়া কাঁপিতে ছিল, আমি তাহার হস্ত দুইখানি ছাড়িয়া দিতেই সে সেই হাত মাথায় বুলাইয়া বুকে ধরিয়া চঞ্চল পদে প্রস্থান করিল।”
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, বিবাহস্বপ্নে বিভোর তরুণ রত্নেশ্বর রায় সেদিন ঠিক বুঝতে পারেন নি যে কি ঘটল। বুঝতে পেরেছিলেন অনেক পরে। সে কথা পরে বলবার সময় হলে বলব। তবে তার ছবি আমি এঁকেছি। এই দেখ সে ছবি।
তরুণ রত্নেশ্বর রায় একটি দীর্ঘ শ্যামাঙ্গী মেয়ের হাত ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে যেন জলবিন্দুর আভাস! দুজনেরই প্রফিইলের ছবি। মেয়েটির চোখটি বড় সুন্দর; আর মাথায় একরাশি কোঁকড়ানো চুল, ফুলে ফেঁপে পিঠের দিকে উঠে পড়েছে, তাতে একটা ঢঙ এসেছে, যেটা ঠিক এদেশী নয়, অনেকটা সেকালের ইজিপশিয়ান মেয়েদের চুলের মতো।
সুলতা ছবিখানা দেখে বিস্মিত হল। মনে হল এই মেয়েটির ছবি যেন আর কোথাও আছে, এই সব ছবিগুলোর মধ্যে। সে উঠে এসে ছবিখানার কাছে দাঁড়াল। তারপর চোখ ফিরিয়ে বাকী ছবিগুলো দেখতে গিয়ে আটকে গেল, পাশের ছবিখানার দিকে।
কোন একজন ভয়ঙ্কর-দর্শন লোকের ছবি। দাঁতে দাঁত টিপে লোকটা একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপকে ধরে আছে। লোকটা যেন রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, পাথর কেটে গড়া একটা মূর্তি। সুলতা সবিস্ময়ে বললে—এ ছবিটা?
সুরেশ্বর বললে—ও ছবিটা গোপাল সিংয়ের। ওই গোপাল সিং।
—এই গোপাল সিং! কিন্তু এমন করে একটা সাপকে ধরে রয়েছে কেন?
—বলছি সুলতা। এই খবরটা সেদিন ঠিক এমনিভাবেই অর্থাৎ এই মুহূর্তটিতেই এসেছিল রায়বাড়ীতে। রত্নেশ্বর ডায়রীতে লিখেছেন—“আমি অঞ্জনার গমনপথের দিকেই দৃষ্টিপাত করতঃ তাহার কথাই চিন্তা করিতেছিলাম। এমত সময়ে বাহিরের বারান্দার দিক হইতে বন্ধ দরজার ওদিক হইতে কে ডাকিল—হুজুর!
—কে?
—হামি, মহাবীর সিং।
এদিকে দরজা দিয়ে তখনই পানের রেকাবি হাতে ঘরে ঢুকেছিল তাঁর খাস চাকর গোবিন্দ। গোবিন্দ রেকাবিখানা তাঁর সামনে নামিয়ে দিতেই সাগ্রহে দুটি পান তুলে মুখে পুরে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—দরজা খুলে দে!
দরজা খুলতেই মহাবীর সেলাম করে জানিয়েছিলেন বড়া হুজুর, আপনে কহলেন কি উনকে সাথ ভেট করনে কো লিয়ে!
—আচ্ছা। যাচ্ছি। বল গিয়ে আসছি আমি।
কথার মধ্যেই এসে ঘরে ঢুকলেন ভবানী দেবী। রত্নেশ্বর?
—মা!
আমার কথার কোন দাম রইল না রে? আমি মা আনন্দময়ীর সামনে যে কথা বললাম সে-কথা থাকবে নাঃ ঠোঁট দুটি তাঁর কাঁপতে লাগল।
সবিস্ময়ে রত্নেশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন—কেন মা?
—কুতুবপুরের কাছারীর লোকেরা গোপাল সিংকে ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছে।
—কে বললে?
—কুতুবপুরের কাছারীর লোক খবর এনেছে।
—সে কি? আমি তো সকালেই লোক পাঠিয়েছি কুতুবপুরে!
ব্যাপারটা লোক পৌঁছুবার আগেই ঘটে গেছে। আগে থেকেই কুতুবপুর কাছারীতে যে হুকুম ছিল সেই অনুযায়ী ঘটেছে।
সুরেশ্বর বললে—আগে তোমাকে বলেছি সুলতা, কীর্তিহাটের বিচক্ষণ দেওয়ান ঠিকই অনুমান করেছিলেন যে, বীরপুর মৌজার মণ্ডলান স্বত্ব ভগবান মণ্ডল ডাক নিয়েছে, এ সংবাদ যে মুহূর্তে গোপাল পাবে, সেই মুহূর্তে গোপাল খোঁচা-খাওয়া বাঘের মত দুর্দান্ত ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ঝাঁপ দেবে। তাঁর হুকুম ছিল যে, বেলা এক প্রহরের পরই কুতুবপুর কাছারীর বরকন্দাজ ঢেঁড়াদার নিয়ে বীরপুরের পথে পথে এই ঘোষণা জারী করবে। এবং গোপাল সিংয়ের কানে কোনরকমে পৌঁছে দিয়ে পালাবে। যদি পালাতে না পারে, যদি গোপালের হাতে জখম হতে হয় তবে রায় এস্টেট থেকে খেসারত পাবে, মোটা টাকা। সে আমলে একশো টাকার দাম অনেক, এ আমলের হাজার টাকা থেকেও বেশী। আরো আন্দাজ ছিল এই যে, গোপাল তালাবন্ধ ভগবানের বাড়িতে আগুন দেবে। কিংবা দল জুটিয়ে এসে লুট করবে। হুকুম ছিল, সঙ্গে সঙ্গে থানায় এত্তেলা দেবে। থানায় বন্দোবস্ত করা ছিল। থানার দারোগা, জমাদার, মুন্সীবাবুদের সঙ্গে গোপালের দহরম-মহরমের কথা অজানা ছিল না কারুর; দেওয়ান তারও ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। একদিকে এস-ডি-ও, ডি-এস-পিকে নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন কীর্তিহাটে, তার সঙ্গে ইন্সপেক্টারবাবুও বাদ যান নি। ওদিকে দারোগা, জমাদার, মুহুরীবাবুদের খুশী করবার ভার দিয়েছিলেন কুতুবপুরের নায়েবকে। সে তা করেছিল। ঘটল সবই, কিন্তু গোপাল সিং যা করলে, তা সকলের অনুমানকে অতিক্রম করে গেল। দেওয়ান আচার্য যে-মুহূর্তে খবর পেলেন যে, গোপাল বড় ছেলে এবং বড় স্ত্রীকে জখম করে নিজের ঘরে আগুন দিয়ে ছুটে পালিয়েছে, ফেরার হয়েছে, সেই মুহূর্তেই সওয়ার পাঠিয়েছিলেন কুতুবপুরের নায়েবের কাছে যে, কাছারীর সমস্ত লোকজন নিয়ে খোঁজ করে গোপাল সিংকে ধর, পুলিশের হাতে দাও। যারা ধরবে তারা একশো টাকা বকশিশ পাবে। অবশ্য সকলে মিলে।
খবরটা কুতুবপুর গিয়ে পৌঁছেছিল সন্ধ্যার পর। ওদিকে কুতুবপুরে, বীরপুরে এবং আশপাশের চার-পাঁচখানা গ্রামে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনার শেষ ছিল না। আজকের এই ঘটনাটিতে সকল লোকের মনই বিরূপ হয়ে উঠেছিল এই দুর্দান্ত লোকটির উপর। তার সঙ্গে প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মজলিসে খবর আসছিল, গোপাল সিংকে দেখা গেছে কোনো জঙ্গলে অথবা কেউ যেতে দেখেছে জনহীন মাঠের মধ্য দিয়ে। অথবা গোপাল সিংয়ের কোন অনুচরের বাড়ীতে। কেউ বলে ওই গ্রামে, কেউ বলে সে গ্রামে। থানার দারোগা তখন গোপালের বাড়ীতে পৌঁছে এজাহার নিচ্ছেন। তার ছোট বউ গরুর গাড়ী চড়ে রওনা হয়েছে কীর্তিহাট সতীরাণী মায়ের উদ্দেশে। ওদিকে কুতুবপুরের কাছারী থেকে বরকন্দাজ পাইকের দল একশো টাকা বকশিশের উত্তেজনায় সেই রাত্রেই বেরিয়ে পড়েছিল গোপাল সিংয়ের সন্ধানে। হাতে মশাল, লাঠি, সড়কি। তবে হুকুম ছিল, জীবিত গোপাল সিংকে ধরতে হবে। গোপাল ফাঁসিকাঠে ঝুলে তার জীবনের মাশুল দিয়ে যাবে এই ছিল সর্ববাদীসম্মত রায়।
শুধু জমিদারের রায় নয়, মানুষের রায়ও ছিল তাই। সরকারের রায়ও তাই।
হিটলার নিজে আত্মহত্যা করেছে, তাতে বিজয়ী পক্ষ তৃপ্ত হয়নি। বিচার করে তাকে তারা মৃত্যুদণ্ডই দিত। কিন্তু বিচার হয় নি বলে ক্ষোভ থেকে গেছে। তোজো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয় নি। তাকে বাঁচাবার জন্য বোধহয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সার্জনরা ছুটে এসেছিল এবং তাঁকে বাঁচিয়েছিল। বাঁচিয়েছিল তাকে বিচার করে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে।
***